অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম 20%

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 22 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 20094 / ডাউনলোড: 3820
সাইজ সাইজ সাইজ
অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

আল্লাহ্ তা‘আলার সৃষ্টিনিচয়ের মধ্যে মানুষের রয়েছে এক অনন্য অবস্থান। আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকল মানুষের নিকট এটা সুস্পষ্ট ও স্বীকৃত যে, প্রাণী প্রজাতিসমূহের মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্ব যতোটা তার সৃজনশীলতার কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশী তার বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্) ও ইচ্ছাশক্তির কারণে। এ দু’টি বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ তার সহজাত প্রকৃতিকে পরাভূত করতে সক্ষম। যে সব বিষয় গোটা মানব জাতির কর্ম ও আচরণকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতা থাকা-নাথাকা সংক্রান্ত ধারণা। এ ক্ষেত্রে বেশীর ভাগ মানুষই তাত্ত্বিকভাবে বিশ্বাস করে যে, মানুষের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতা বলতে কিছুই নেই, বরং তার জন্ম-মৃত্যু এবং সারা জীবনের কার্যাবলী ও সুখ-দুঃখ পূর্ব থেকেই নির্ধারিত হয়ে আছে বা তার প্রতিটি কাজই আল্লাহ্ তা‘আলা তার দ্বারা করিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু তাদের বেশীর ভাগ কাজকর্ম ও কথাবার্তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, তারা নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতায় বিশ্বাসী। বস্তুতঃ তাদের তাত্ত্বিক বিশ্বাস তাদের কর্ম ও আচরণের ওপর খুব কমই ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে, বরং তা কেবল ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাবই বিস্তার করে থাকে। মানব জাতিকে, বিশেষ করে মুসলমানদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্যে এ প্রশ্নটির সঠিক সমাধান উদ্ভাবন অপরিহার্য। এ লক্ষ্যেই অত্র গ্রন্থ রচনার প্রয়াস।

 

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

নূর হোসেন মজিদী

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

ভূমিকা

আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টিনিচয়ের মধ্যে মানুষের রয়েছে এক অনন্য অবস্থান। আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকল মানুষের নিকট এটা সুস্পষ্ট ও স্বীকৃত যে , প্রাণী প্রজাতিসমূহের মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্ব যতোটা তার সৃজনশীলতার কারণে , তার চেয়ে অনেক বেশী তার বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্) ও ইচ্ছাশক্তির কারণে। এ দু টি বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ তার সহজাত প্রকৃতিকে পরাভূত করতে সক্ষম। যেমন: কোনো ক্ষুধার্ত প্রাণীর সামনে তার ভক্ষণোপযোগী কোনো খাদ্য থাকলে এবং তা খাবার পথে কোনো বাধা বা বিপদাশঙ্কা না থাকলে সে অবশ্যই তা খাবে ; সে তা খাবে না এটা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু মানুষ এর ব্যতিক্রম। সে চরম ক্ষুধার্ত অবস্থায়ও তার সামনে নির্ঝঞ্ঝাট খাদ্যোপকরণ পেয়েও না খেয়ে প্রাণপাত করতে প্রস্তুত হতে পারে।

বস্তুতঃ মানুষের কাজকর্ম তার ধ্যানধারণা ও চিন্তা-বিশ্বাসের অনুবর্তী। সে যদি নির্ঝঞ্ঝাট অবস্থায়ও সুস্বাদু খাদ্যোপকরণ উপেক্ষা করে মৃত্যুকে স্বাগত জানায় , তো তার ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-বিশ্বাসের কারণেই তা করে থাকে। অতএব , তার ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-বিশ্বাস যদি সঠিক হয় তাহলে তা তাকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনুপ্রাণিত করবে এবং তা যদি ভ্রান্ত হয় তাহলে তা তাকে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে ঠেলে দেবে।

যে সব বিষয় গোটা মানব জাতির কর্ম ও আচরণকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতা থাকা-নাথাকা সংক্রান্ত ধারণা। এ ক্ষেত্রে বেশীর ভাগ মানুষই তাত্ত্বিকভাবে বিশ্বাস করে যে , মানুষের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতা বলতে কিছুই নেই , বরং তার জন্ম-মৃত্যু এবং সারা জীবনের কার্যাবলী ও সুখ-দুঃখ পূর্ব থেকেই নির্ধারিত হয়ে আছে বা তার প্রতিটি কাজই আল্লাহ্ তা আলা তার দ্বারা করিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু তাদের বেশীর ভাগ কাজকর্ম ও কথাবার্তা থেকে প্রমাণিত হয় যে , তারা নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতায় বিশ্বাসী। বস্তুতঃ তাদের তাত্ত্বিক বিশ্বাস তাদের কর্ম ও আচরণের ওপর খুব কমই ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে , বরং তা কেবল ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাবই বিস্তার করে থাকে।

মানব জাতিকে , বিশেষ করে মুসলমানদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্যে এ প্রশ্নটির সঠিক সমাধান উদ্ভাবন অপরিহার্য। এ লক্ষ্যেই অত্র গ্রন্থ রচনার প্রয়াস।

আরবী ও ফার্সী ভাষায় অনেক বড় বড় মনীষী এ বিষয়ে বহু মূল্যবান বই-পুস্তক রচনা করেছেন। চাইলে এ সব বই-পুস্তক থেকে কোনোটি অনুবাদ করা যেতো। কিন্তু কয়েকটি কারণে কোনো গ্রন্থের অনুবাদ না করে এ বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র মৌলিক গ্রন্থ রচনাকে অগ্রাধিকার দিয়েছি।

প্রথমতঃ বাংলা ভাষার তুলনায় আরবী ও ফার্সী ভাষায় দ্বীনী জ্ঞানচর্চা ব্যাপকতা ও মান উভয় বিচারেই উন্নততর। ফলে উক্ত দুই ভাষার পাঠক-পাঠিকাদের ইসলামী বিষয়াদি সংক্রান্ত আলোচনার গ্রহণক্ষমতাও উন্নততর। এ কারণে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরবী ও ফার্সী ভাষায় রচিত বই-পুস্তকাদির বিষয়বস্তু বিন্যাস ও আলোচনার পদ্ধতি এমন যে , তার অনুবাদ বাংলাভাষী অধিকাংশ পাঠক-পাঠিকার জন্যই সহজবোধ্য হবে না।

দ্বিতীয়তঃ মানুষের কোনো লেখাই লেখকের একান্ত নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ও পরিবেশের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব নয়। এ কারণে বহু মনীষী লেখকের একই বিষয়ক লেখার মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতপার্থক্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে মতবিরোধ লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে হাদীছ গ্রহণের ক্ষেত্রে মনীষীদের মধ্যে মতপার্থক্য অনেক বেশী। তাই যার বক্তব্য বা প্রতিপাদ্যের সাথে শতকরা একশ ভাগ একমত হওয়া যাবে এমন কোনো গ্রন্থ নির্বাচন করা খুবই দুরূহ ব্যাপার , বরং প্রায় অসম্ভব।

তৃতীয়তঃ কালের প্রবাহে সব সময়ই নব নব যুগজিজ্ঞাসার উদ্ভব ঘটা স্বাভাবিক ব্যাপার। এ কারণেই পরবর্তী কালে জাগ্রত জিজ্ঞাসা সমূহের জবাব পূর্ববর্তী মনীষীদের লেখায় পাবার সম্ভাবনা থাকে খুবই কম।

এসব কারণে বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের প্রয়োজনকে সামনে রেখে এ বিষয়ে একটি মৌলিক গ্রন্থ রচনাকে অগ্রাধিকার দিয়েছি।

আলোচ্য বিষয়ে উপসংহারে উপনীত হওয়ার জন্যে চারটি সূত্র থেকে সাহায্য নেয়া যেতে পারে , তা হচ্ছে: বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্) , কোরআন , হাদীছ ও মনীষীদের মতামত। এর মধ্যে আক্বল্ হচ্ছে সর্বজনীন মানদণ্ড যা আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকল মানুষের মাঝেই নিহিত রয়েছে এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র মানদণ্ড। অন্যদিকে আক্বল্ কোরআন মজীদের ঐশিতায় ও বিকৃতিহীনতায় উপনীত হয়। তাই মুসলমানদের জন্য এ দু টি হচ্ছে বিতর্কাতীত মানদণ্ড। অন্যদিকে স্বয়ং কোরআন মজীদ আক্বলের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে।

কোরআন মজীদ জীবন ও জগতের মৌলিকতম সত্য অর্থাৎ স্রষ্টার অস্তিত্ব ও একত্ব , পরকালীন জীবনের সত্যতা এবং নবুওয়াত ও নবুওয়াতে মুহাম্মাদী (ছ্বাঃ) প্রশ্নে আক্বলের নিকট আবেদন করেছে। কোরআন মজীদ এসব বিষয়কে স্বতঃসিদ্ধ সত্য হিসেবে অন্ধভাবে মেনে নিতে বলে নি ; বললে তাতে কেউ সাড়া দিতো না ; প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্মের অন্ধ বিশ্বাসের ওপর স্থির থাকতো। এ কারণে আমরা দেখতে পাই যে , কোরআন মজীদ স্বীয় দাবীর সপক্ষে বিচারবুদ্ধির দলীল (যুক্তি) উপস্থাপন করেছে এবং এরপরও যারা তা গ্রহণ করে নি তাদেরকে বার বার বলেছে:افلا تعقلون (অতঃপর তোমরা কি বিচারবুদ্ধি কাজে লাগাবে না ?) এমনকি যারা বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্) প্রয়োগ করে না , কোরআন মজীদ তাদেরকে নিকৃষ্টতম পশু (شر الدوابّ ) বলে অভিহিত করেছে (সূরাহ্ আল-আনফাল্: ২১-২২)।

যারা সঠিকভাবে আক্বলের প্রয়োগ করে ও তার রায়কে মেনে নেয় তারা জীবন ও জগতের মহাসত্যগুলোকে মেনে নিতে বাধ্য। ফলে তারা শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াত এবং সর্বশেষ , পূর্ণাঙ্গ ও একমাত্র সংরক্ষিত ঐশী গ্রন্থ হিসেবে কোরআন মজীদকে মেনে নেয়। অন্যদিকে আক্বল্ জীবন ও জগতের যে মহাসত্যগুলোতে উপনীত হয় কোরআন মজীদ সে সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত বিস্তারিত ধারণা প্রদান করে। আর যেহেতু এ গ্রন্থ বিশ্বজগতের স্রষ্টা আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে সেহেতু এতে প্রদত্ত ধারণা পুরোপুরি অকাট্য-যে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সংশয়ের অবকাশ নেই। (অবশ্য কতক আয়াতের তাৎপর্য গ্রহণ প্রশ্নে মতপার্থক্য হতে পারে , তবে বিস্তারিত পর্যালোচনায় সে সব মতপার্থক্যের নিরসন অবশ্যম্ভাবী।)

জীবন ও জগতের মহাসত্যসমূহ (উছূলে দ্বীন বা দ্বীনের মূল ভিত্তিসমূহ ও তার শাখা-প্রশাখা সমূহ) সম্বন্ধে হাদীছে ও মনীষীদের লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। মনীষীদের বক্তব্য বিচারবুদ্ধি ও কোরআন মজীদের পাশাপাশি হাদীছ ও তাঁদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণার ওপরও ভিত্তিশীল। মূলতঃ শেষোক্ত দু টি সূত্রের ওপর নির্ভর করার কারণেই দ্বীনের মূল ভিত্তিসমূহের শাখা-প্রশাখা সংক্রান্ত আলোচনায় তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য ঘটেছে। বিশেষ করে আল্লাহ্ তা আলার গুণাবলী ও কর্ম সংক্রান্ত ধারণার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা মানুষের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতা থাকা-নাথাকা বিষয়ে তাঁদের মধ্যে শুধু মতপার্থক্যই ঘটে নি , বরং তাঁদের অনেকে পরস্পর একশ আশি ডিগ্রী বিপরীত মত প্রকাশ করেছেন। এ সব মতামত পর্যালোচনা করে সঠিক উপসংহারে উপনীত হওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার। কারণ , সে আলোচনা হবে যেমন জটিল , তেমনি অত্যন্ত দীর্ঘ ও সময়সাপেক্ষ এবং তাকে লিখিত আকারে উপস্থাপন করতে হলে বিশালায়তন গ্রন্থ রচনা করতে হবে-যা থেকে সাধারণ পাঠক-পাঠিকাদের উপকৃত হতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম।

তাছাড়া মনীষীদের সাথে সাধারণ মানুষের ভক্তিশ্রদ্ধা ও ভাবাবেগের সম্পর্ক জড়িত আছে বিধায় তাঁদের মতামতের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা-সমালোচনা গ্রহণ করার মতো মানসিক প্রস্তুতি খুব কম লোকেরই আছে। অন্যদিকে মনীষীদের মতামত যেহেতু মৌলিক দলীল নয় , বরং মৌলিক দলীল অবলম্বনে কৃত আলোচনা , সেহেতু তাঁদের মতামত টেনে না এনে মৌলিক দলীলের সাহায্যে প্রশ্নের জবাব সন্ধানই সঠিক পন্থা।

বিচারবুদ্ধি ও কোরআন মজীদ হচ্ছে মৌলিকতম ও নির্ভুলতম অকাট্য দলীল। দলীল হিসেবে হাদীছের মর্যাদা এতদুভয়ের পরে। তাছাড়া বিচারবুদ্ধি ও কোরআন মজীদ থেকে দিকনির্দেশ পাওয়া যতো সহজ , হাদীছ থেকে দিকনির্দেশ পাওয়া ততো সহজ নয়। বিচারবুদ্ধি ও কোরআন মজীদ যেরূপ অকাট্য , সীমিত সংখ্যক মুতাওয়াতির্ হাদীছ (যা প্রতি স্তরে এমন বিরাট সংখ্যক বর্ণনাকারী কর্তৃক বর্ণিত যাদের পক্ষে মিথ্যা রচনার জন ঐক্যবদ্ধ ও একমত হওয়া বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে অসম্ভব) বাদে হাদীছ শাস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার তদ্রূপ অকাট্য নয়। খবরে ওয়াহেদ নামে অভিহিত এসব হাদীছের বিশাল ভাণ্ডারে সঠিক (ছ্বহীহ্) হাদীছের মাঝে কিছু জাল ও বিকৃত হাদীছের প্রবেশ ঘটার বিষয়টি অনস্বীকার্য। তাই হাদীছ গ্রহণের জন্য অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বাছাই করা সত্ত্বেও মনীষীদের মধ্যে কতক হাদীছের যথার্থতা প্রশ্নে মতপার্থক্য হয়েছে। একজন যে হাদীছকে ছ্বহীহ্ বলেছেন আরেক জন তাকে জাল বলেছেন। এ থেকেই দু জনের রায় দু রকম হয়েছে।

এখানে হাদীছ সম্পর্কে দু টি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতির উল্লেখ অপরিহার্য। প্রথমতঃ কোরআন মজীদের সুস্পষ্ট বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক বক্তব্য সম্বলিত হাদীছ গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বিতীয়তঃ শরী আতের খুটিনাটি বিস্তারিত বিধানের ক্ষেত্রে খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছের শর্তসাপেক্ষ গ্রহণযোগ্যতা অনস্বীকার্য। কিন্তু ঈমানের মৌলিক বিষয়াদির (উছূলে দ্বীন) শাখা-প্রশাখার ব্যাপারে খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ গ্রহণযোগ্য নয়। যেহেতু খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছের অকাট্যতা প্রশ্নাতীত নয় , সেহেতু এরূপ ক্ষেত্রে (ঈমানের মৌলিক বিষয়াদির শাখা-প্রশাখার ব্যাপারে) খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ গ্রহণ করা ঈমানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে এরূপ বিষয়ে যখন পরস্পর বিরোধী হাদীছ পাওয়া যায় তখন দুই মতের মধ্যকার অন্ততঃ একটি মতের সমর্থনকারী হাদীছের জাল হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

মানুষের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতা থাকা-নাথাকা সম্পর্কিত পরস্পর বিরোধী মতের উৎস বা পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে এ ধরনের পরস্পরবিরোধী হাদীছ সমূহ। কেউ যখন এক মতের সমর্থনকারী একটি হাদীছ গ্রহণ করেছেন ও তার বিপরীত মতের হাদীছকে জাল বলে গণ্য করে প্রত্যাখ্যান করেছেন , তখন অন্য একজন ঠিক এর বিপরীত আচরণ করেছেন। এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ের হাদীছগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করলে একদিকে যেমন তা বিশাল আয়তন ধারণ করবে , অন্যদিকে তাতে ফয়সালায় উপনীত হওয়া যাবে না। কারণ , অতীতের মনীষীগণ যেভাবে ঐসব হাদীছ সম্পর্কে মতপার্থক্য করেছেন তার সাথে একটি নতুন মতপার্থক্য যুক্ত হবে মাত্র।

সর্বোপরি কথা হচ্ছে , অকাট্য দলীল আক্বল্ ও কোরআন মজীদের সাহায্যে যেখানে কোনো প্রশ্নের সঠিক জবাব মেলে সেখানে পরস্পর বিরোধী হাদীছ নিয়ে সুদীর্ঘ পর্যালোচনার প্রয়োজন কী ?

এ কারণেই অত্র গ্রন্থে আক্বায়েদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশাখা মানুষের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন ক্ষমতা থাকা-নাথাকা বিষয়ক আলোচনায় শুধু আক্বল্ ও কোরআন মজীদের দলীলের ওপরই নির্ভর করেছি।

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন অত্র গ্রন্থকে এর লেখক , প্রকাশ-প্রচারের সাথে জড়িত ব্যক্তিগণ এবং পাঠক-পাঠিকাদের হেদায়াত ও পরকালীন নাজাতের জন্য সহায়ক করে দিন। আমীন।

ঢাকা বিনীত

১৫ই জমাদিউল আউয়াল ১৪৩০ নূর হোসেন মজিদী

২৮শে বৈশাখ ১৪১৬

১১ই মে ২০০৯।

কৃতজ্ঞতা

অত্র গ্রন্থের মূল তথ্যসূত্র হচ্ছে কেবল বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্) ও কোরআন মজীদ। অন্য কোনো কোনো সূত্র থেকে যা কিছু গ্রহণ করা হয়েছে তা পর্যালোচনার সুবিধার্থে মাত্র , প্রামাণ্য দলীল হিসেবে নয়। তবে কতক মনীষীর লেখা এতদ্বিষয়ক গ্রন্থাবলী আমাকে এ বিষয়ে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে। আমি তাঁদেরকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি এবং তাঁদেরকে শুভ প্রতিদান দেয়ার জন্য আল্লাহ্ তা আলার দরবারে বিশেষভাবে দো আ করছি। তবে গ্রন্থটিকে যাতে কেবল আক্বল্ ও কোরআন মজীদের ভিত্তিতে বিবেচনা করা হয় সে উদ্দেশ্যে এখানে তাঁদের নামোল্লেখ থেকে বিরত থাকলাম।

অত্র গ্রন্থে কোরআন মজীদের যে সব আয়াত উদ্ধৃত করেছি সে সবের অনুবাদ কোনো বিশেষ অনুবাদগ্রন্থ থেকে গ্রহণ না করে সরাসরি অনুবাদ করাকেই উত্তম মনে করেছি এবং অনুবাদের ক্ষেত্রে আরবী ব্যাকরণ ও অভিধানকে প্রাধান্য দিয়েছি। তবে কিছু কিছু আয়াতের ক্ষেত্রে কোরআন মজীদের বিভিন্ন আরবী , ফার্সী , ইংরেজী ও বাংলা তাফসীর ও তরজমা এবং কোরআনিক পরিভাষার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে সহায়তা নিয়েছি। সর্বোপরি , আলোচ্য বিষয় সংশ্লিষ্ট কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াত খুঁজে বের করার জন্য মুহাম্মাদ ফুআদ আবদুল বাক্বী প্রণীত আল্-মু জামুল্ মুফাহরিস্ লি-আলফাযিল্ কোরআানিল্ কারীম্ থেকে সহায়তা নিয়েছি। প্রসঙ্গক্রমে আশায়েরী মতের উদ্ভবের ঘটনা ও অন্য যে ক টি ঐতিহাসিক তথ্য উল্লিখিত হয়েছে তা-ও কয়েকটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে।

আল্লাহ্ তা আলা সংশ্লিষ্ট মুফাসসির , গ্রন্থকার ও অনুবাদকগণকে তাঁদের মহান খেদমতের শুভ প্রতিদান প্রদান করুন। আমীন।

ঢাকা বিনীত

১৫ই জমাদিউল আউয়াল ১৪৩০ নূর হোসেন মজিদী

২৮শে বৈশাখ ১৪১৬ । ১১ই মে ২০০৯।

অদৃষ্টবাদ: বিশ্বাস বনাম আচরণ

আমাদের সমাজে ইসলামী পরিভাষা তাক্বদীর্ (تقدیر )-এর অর্থ গ্রহণ করা হয় ভাগ্য বা ভাগ্যলিপি । সাধারণভাবে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে এই যে , আমাদের ভালো-মন্দ সব কিছুই আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে পূর্ব হতেই নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে। এর ভিত্তি হচ্ছে ঈমানে মুফাছ্বছ্বাল্ (বিস্তারিত ঈমান) নামে শৈশবে মুসলমানদেরকে যে বাক্যটি মুখস্ত করানো হয় তার অংশবিশেষ-যাতে বলা হয়:والقدر خيره و شره من الله تعالی (আর ভাগ্য ; এর ভালো ও মন্দ আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত) , যদিও কোরআন মজীদের কোথাওই এ বাক্যাংশটি নেই।

এ ব্যাপারে দ্বিমতের অবকাশ নেই যে , ঈমানের মৌলিক বিষয়াদির ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ও তার শাখা-প্রশাখার ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির (عقل ) রায় বা কোরআন মজীদের দলীল থাকা অপরিহার্য। বিশেষ করে কোরআন মজীদ বা বিচারবুদ্ধির রায় নয় এমন ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-বিশ্বাসে যদি মুসলমানদের মধ্যে মতৈক্য (ইজমা -اجماع ) না থাকে , বরং বিতর্ক থাকে , তাহলে তা কিছুতেই ঈমানের মৌলিক বিষয়সমূহ ও তার শাখা-প্রশাখার অন্যতম বলে গণ্য হতে পারে না।

অবশ্য কোনো কোনো হাদীছে এ ধরনের বর্ণনা রয়েছে যে , মানবশিশু জন্মগ্রহণের পূর্বেই অর্থাৎ ভ্রূণ আকারে মাতৃগর্ভে থাকাকালেই আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে ফেরেশতা এসে তার ভাগ্যলিপিতে তার পুরো ভবিষ্যত জীবনের সব কিছুই লিখে দিয়ে যায় ; এমনকি সে নেককার হবে , নাকি গুনাহ্গার হবে তথা বেহেশতে যাবে , নাকি দোযখে যাবে তা-ও লিখে দিয়ে যায়।

এ ধরনের হাদীছ মুসলিম উম্মাহর সকল ধারার দ্বীনী চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের নিকট সর্বসম্মতভাবে গৃহীত নয় এবং তা মুতাওয়াতির্ (প্রতিটি স্তরে বিপুল সংখ্যক সূত্রে বর্ণিত) নয় , বরং এগুলো খবরে ওয়াহেদ্ (অন্ততঃ প্রথম স্তরে অর্থাৎ ছ্বাহাবীদের স্তরে কম সংখ্যক সূত্রে বর্ণিত) হাদীছ। আর খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উতরে যাওয়া সাপেক্ষে আহ্কামের খুটিনাটি নির্ধারণে এবং অন্য অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞানগত বিষয়ে গ্রহণযোগ্য হলেও ঈমানের মৌলিক বিষয়াদিতে ও এর শাখা-প্রশাখায় তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের সময় তাঁর ছ্বাহাবীর সংখ্যা ছিলো লক্ষাধিক। এমতাবস্থায় ঈমানের অন্যতম মৌলিক গুরুত্ব সম্পন্ন কোনো বিষয়ে তাঁর দেয়া বক্তব্য বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মাত্র দু চার জন ছ্বাহাবীর জানা থাকবে , অন্যদের জানা থাকবে না অর্থাৎ তা মুতাওয়াতির্ পর্যায়ে উত্তীর্ণ হবে না এটা অসম্ভব।

এটা সর্বজন স্বীকৃত ঐতিহাসিক সত্য যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকাল এবং ছ্বিহাহ্ সিত্তাহ্ (ছয়টি নির্ভুল হাদীছ্ গ্রন্থ) হিসেবে অভিহিত হাদীছগ্রন্থ সমূহ ও অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থ সংকলনের মধ্যবর্তী দুই শতাধিক বছর সময়ের মধ্যে বহু মিথ্যা হাদীছ রচিত হয়েছিলো। হাদীছ সংকলনকারী ইমামগণ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নির্বাচিত হাদীছের সংকলন করা সত্ত্বেও এ সব সংকলনে কতক জাল হাদীছ অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়া অসম্ভব নয়। বিশেষ করে যে সব হাদীছের বক্তব্য আক্বল্-এর অকাট্য রায় ও কোরআন মজীদের বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক তা জাল হবার ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।

অতএব , এটা সন্দেহাতীত যে , ঈমানের মৌলিক বিষয় সমূহের মধ্যকার কোনো বিষয়ে বা তার শাখা-প্রশাখায় খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের সমাজে এ ধরনের হাদীছের ভিত্তিতে অদৃষ্টবাদকে ঈমানের অন্যতম মৌলিক বিষয় বলে গণ্য করে নেয়া হয়েছে। অবশ্য আধুনিক শিক্ষার প্রভাবে অনেকের মন-মগয থেকেই শৈশবে শেখানো অদৃষ্টবাদিতার এ অন্ধ বিশ্বাস উবে যায় এবং মানুষের কর্মক্ষমতায় বিশ্বাস তার স্থান দখল করে নেয়। তবে বর্তমান প্রজন্মের মনে মানুষের কর্মক্ষমতায় বিশ্বাসের পিছনে প্রধানতঃ পাশ্চাত্যের বস্তুবাদের প্রভাব সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলার অস্তিত্ব ও গুণাবলী এবং তাঁর নিকট জবাবদিহিতা সম্পর্কে উদাসীনতা সংমিশ্রিত থাকে।

অন্যদিকে যারা অদৃষ্টবাদের প্রবক্তা তাদের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কথাবার্তা ও আচরণে কিন্তু অদৃষ্টবাদের প্রতিফলন ঘটে না। বরং তারা কার্যতঃ কর্মক্ষমতায় বিশ্বাসী । কেবল আক্বা এদী বিতর্কের বেলায়ই তারা অদৃষ্টবাদের পক্ষে যুক্তি দেখায়। এভাবে আমাদের সমাজে চিন্তা ও আচরণের মধ্যে বিরাট বৈপরীত্য ও অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়েছে যা আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছে। ফলে মুসলমানদের কাছ থেকে যেখানে আল্লাহ্ তা আলার ওপর নির্ভরতা সহকারে কর্মমুখরতাই বাঞ্ছনীয় সেখানে তার পরিবর্তে দেখা যায় যে , সমাজের একটি অংশ স্থবিরতা ও হতাশায় নিমজ্জিত এবং অপর অংশটি পুরোপুরি বস্তুবাদী ধ্যানধারণা ও পার্থিবতায় নিমজ্জিত। এ উভয় ধরনের প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত হয়ে সঠিক চিন্তা ও আচরণে উত্তরণের জন্য মানুষের জীবনের গতিধারা নিয়ন্ত্রণের কারক সমূহ ও সে সবের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয় করা অপরিহার্য।


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15