অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম 20%

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 22 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 20106 / ডাউনলোড: 3820
সাইজ সাইজ সাইজ
অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

আল্লাহ্ তা‘আলার সৃষ্টিনিচয়ের মধ্যে মানুষের রয়েছে এক অনন্য অবস্থান। আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকল মানুষের নিকট এটা সুস্পষ্ট ও স্বীকৃত যে, প্রাণী প্রজাতিসমূহের মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্ব যতোটা তার সৃজনশীলতার কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশী তার বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্) ও ইচ্ছাশক্তির কারণে। এ দু’টি বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ তার সহজাত প্রকৃতিকে পরাভূত করতে সক্ষম। যে সব বিষয় গোটা মানব জাতির কর্ম ও আচরণকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতা থাকা-নাথাকা সংক্রান্ত ধারণা। এ ক্ষেত্রে বেশীর ভাগ মানুষই তাত্ত্বিকভাবে বিশ্বাস করে যে, মানুষের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতা বলতে কিছুই নেই, বরং তার জন্ম-মৃত্যু এবং সারা জীবনের কার্যাবলী ও সুখ-দুঃখ পূর্ব থেকেই নির্ধারিত হয়ে আছে বা তার প্রতিটি কাজই আল্লাহ্ তা‘আলা তার দ্বারা করিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু তাদের বেশীর ভাগ কাজকর্ম ও কথাবার্তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, তারা নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতায় বিশ্বাসী। বস্তুতঃ তাদের তাত্ত্বিক বিশ্বাস তাদের কর্ম ও আচরণের ওপর খুব কমই ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে, বরং তা কেবল ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাবই বিস্তার করে থাকে। মানব জাতিকে, বিশেষ করে মুসলমানদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্যে এ প্রশ্নটির সঠিক সমাধান উদ্ভাবন অপরিহার্য। এ লক্ষ্যেই অত্র গ্রন্থ রচনার প্রয়াস।

 


1

2

3

4

5

6

সৃষ্টির ত্রুটি ও অপূর্ণতার কারণ

আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টিনিচয়কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে ব্যষ্টিক বা ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ এবং একটি হচ্ছে সামষ্টিক দৃষ্টিকোণ। সামষ্টিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যাবে , এ সৃষ্টিলোকে রয়েছে শত শত কোটি ধরনের ও প্রজাতির সৃষ্টি-যে সম্বন্ধে সামান্য চিন্তা করলেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয় । এই বিভিন্ন ধরন ও প্রজাতির সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে পরমাণুর ন্যায় ক্ষুদ্রতম সৃষ্টি থেকে শুরু করে মানুষের ন্যায় জটিলতম বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণী। একটি অতি ক্ষুদ্র পিপিলিকার গঠনশৈলী , বুদ্ধিমত্তা ও কার্যক্রম নিয়ে চিন্তা করলে বিস্ময়ের শেষ থাকে না। আর মানুষ নিয়ে গবেষণা করে এখনো তার চূড়ান্ত কূলকিনারা করা যায় নি।

বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যায় , একটি মানুষের মস্তিষ্কের শুধু স্মৃতিকোষগুলোর ক্ষমতাই চার হাজার সুপার কম্পিউটারের সমান। আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন:

( وَفِي الْأَرْضِ آيَاتٌ لِلْمُوقِنِينَ وَفِي أَنْفُسِكُمْ أَفَلَا تُبْصِرُونَ)

আর এ পৃথিবীর মধ্যে এবং তোমাদের নিজেদের সত্তার মধ্যেও , দৃঢ় প্রত্যয় (ইয়াক্বীন্)-এর অধিকারী লোকদের জন্য নিদর্শনাদি রয়েছে ; তোমরা কি দেখতে পাচ্ছো না ? (সূরাহ্ আয্-যারি আত্: ২০-২১)

( فَتَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ)

অতএব , পরম বরকতময় আল্লাহ্ যিনি সর্বোত্তম স্রষ্টা। (সূরাহ্ আল্-মু মিনূন্: ১৪)

কিন্তু ব্যষ্টিক পর্যায়ে আমরা কিছু কিছু সৃষ্টিতে ত্রুটি দেখতে পাই। যেমন: একটি শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মগ্রহণ করে , একটি ফলের এক পাশ শক্ত হয়ে যেতে পারে , ফলে তা আর ভক্ষণোপযোগী থাকে না , ইত্যাদি। প্রশ্ন হচ্ছে , এসব ত্রুটির উৎস কী ? মহান প্রজ্ঞাময় পরম প্রমুক্ত আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টিতে তো ত্রুটি থাকার কথা নয় ; তাহলে কেন এ সব ত্রুটি ?

এখানে আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টিপরিকল্পনা ও সৃষ্টিপ্রক্রিয়া সম্বন্ধে প্রণিধানের বিষয় রয়েছে। তা হচ্ছে , আদি সৃষ্টিসমূহ , বিশেষ করে সৃষ্টিলোকে প্রতিষ্ঠিত প্রাকৃতিক বিধান সমূহ আল্লাহ্ তা আলার প্রত্যক্ষ সৃষ্টি। তেমনি প্রাথমিক সৃষ্টিসমূহ , বিশেষতঃ ফেরেশতাকুল , বস্তুজগতের মৌলতম উপাদান (যার সাহায্যে পরমাণু গঠন করা হয়েছে) এবং এ ধরনের আরো অনেক সৃষ্টি-যে সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান নেই-আল্লাহ্ তা আলার প্রত্যক্ষ সৃষ্টি। এ সব সৃষ্টির পূর্ণ কারণ স্বয়ং এবং একমাত্র আল্লাহ্ তা আলা। এ সব সৃষ্টিতে কোনো রকমের ত্রুটি বা অপূর্ণতার প্রশ্নই ওঠে না।

আল্লাহ্ তা আলা চাইলে পরবর্তী পর্যায়ের তথা যৌগিক সৃষ্টি সমূহকেও স্বীয় প্রত্যক্ষ ইচ্ছার মাধ্যমে সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু তাতে তাঁর সৃষ্ট বিভিন্ন উপায়-উপাদানের কোনো কার্যকরিতা বা গুণ প্রকাশ পেতো না , তেমনি তিনি যে বিস্ময়কর জটিল প্রাকৃতিক বিধান সৃষ্টি করেছেন তা সৃষ্টি করতেন না। কিন্তু তিনি চাইলেন যে , যৌগিক সৃষ্টিসমূহে তাঁরই সৃষ্ট প্রাথমিক সৃষ্টিসমূহ (প্রাকৃতিক বিধান , উপায়-উপাদান ও ফেরেশতাকুল) ভূমিকা পালন করুক যাতে তাঁর বিস্ময়কর সৃষ্টিক্ষমতার মহিমা প্রকাশ পায়। উদাহরণ স্বরূপ , একজন লোক স্বীয় গৃহকর্ম , বাগান রচনা ও কৃষিকাজ অত্যন্ত সুন্দর ও নিখুঁতভাবে আঞ্জাম দেয়। কিন্তু আরেক জন লোক একটি কম্পিউটার ও কম্পিউটার-চালিত রোবট তৈরী করেছে এবং তার পক্ষ থেকে ঐ রোবটটি তার সকল কাজ সম্পাদন করে। কম্পিউটার যতই উন্নত হোক না কেন , এমন কতক কাজ আছে যা মানুষ করতে পারে কিন্তু কম্পিউটার বা কম্পিউটার-চালিত রোবট করতে পারে না এবং যে সব কাজ সম্পাদন করে তাতেও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিকসমূহে তার তুলনায় মানুষের দক্ষতা অনেক বেশী থাকে। (এতদসংক্রান্ত অনেক উদাহরণ দেয়া যায় যে সম্পর্কে এ সব যন্ত্র ব্যবহারকারী ব্যক্তিমাত্রই কমবেশী অবগত , তবে তা আমাদের অত্র আলোচনার জন্য যরূরী নয়।) এ কারণে যে ব্যক্তি নিজের কাজসমূহ নিজেই সূক্ষ্মভাবে সম্পাদন করে তার কাজের তুলনায় কম্পিউটার-চালিত রোবটের কোনো কোনো কাজে অপূর্ণতা বা ত্রুটি প্রকাশ পেতে পারে। কিন্তু এ সত্ত্বেও কম্পিউটার-চালিত রোবটের কাজ তার স্রষ্টা-মালিকের মহিমাই প্রকাশ করে। নিঃসন্দেহে জ্ঞানী , বিজ্ঞানী ও স্রষ্টা হিসেবে কম্পিউটার-চালিত রোবটের স্রষ্টা-মালিকের গুণাবলী ও যোগ্যতা একই কাজ সমূহ প্রত্যক্ষভাবে সম্পাদনকারীর (তা তার কাজ যতই নিখুঁত হোক না কেন) তুলনায় অনেক বেশী বলে স্বীকৃত হবে।

এ আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেলো যে , সৃষ্টিলোকে যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সৃষ্টিতে ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা দেখা যায় তার কারণ সৃষ্টিকর্মে অন্য সৃষ্টির ভূমিকা ; সৃষ্টির গুণাবলী ও যোগ্যতার সীমাবদ্ধতার কারণেই কখনো কখনো এরূপ হওয়া স্বাভাবিক। মোদ্দা কথা , সাধারণতঃ যৌগিক সৃষ্টিকর্ম সমূহে আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টি-ইচ্ছাই একমাত্র কারণ নয় , বরং সৃষ্টিকার্যে ভূমিকা পালনকারী অন্যান্য কারণও পূর্ণ কারণের অন্তর্ভুক্ত। তাই স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলাও তাঁর কতক সৃষ্টিকে স্রষ্টা হিসেবে উল্লেখ করেছেন ; বলেছেন:

( فَتَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ)

অতএব , পরম বরকতময় আল্লাহ্ যিনি স্রষ্টাগণের মধ্যে সর্বোত্তম। (সূরাহ্ আল্-মু মিনূন্: ১৪)

অবশ্য সৃষ্টিসমূহ সৃষ্টিকর্মে অংশগ্রহণ করলেও যেহেতু তারা নিজেরাও আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টি তথা সকল সৃষ্টির আদি কারণ আল্লাহ্ তা আলা , সেহেতু গোটা সৃষ্টিকর্মকে আল্লাহ্ তা আলার প্রতি আরোপ করা হলেও ভুল হবে না। অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহ্ তা আলাই প্রকৃত স্রষ্টা বা অমুখাপেক্ষী স্বাধীন ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতাবান স্রষ্টা। তাই তিনি এরশাদ করেন:قل الله خالق کل شيءٍ - (হে রাসূল!) বলে দিন: আল্লাহ্ প্রতিটি জিনিসেরই স্রষ্টা। (সূরাহ্ আর্-রা দ্: ১৬) তবে এর মানে সৃষ্টিকর্মে সৃষ্টির ভূমিকার অস্বীকৃতি নয়। অতএব , এ আয়াত থেকে এ-ও প্রমাণিত হয় না যে , সৃষ্টির মধ্যকার ত্রুটির জন্য আল্লাহ্ তা আলাই দায়ী। এ প্রসঙ্গেও রোবটের কাজের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। রোবট যে পণ্য উৎপাদন করে তাকে কিন্তু রোবটের উৎপাদিত পণ্য বলা হয় না , বলা হয় অমুকের (রোবটের মালিকের) বা অমুক কোম্পানীর উৎপাদিত পণ্য , কারণ তা উৎপাদনের মূলে রয়েছেন ঐ মালিক। কিন্তু রোবটের কর্মক্ষমতার সীমাবদ্ধতা জনিত কারণে পণ্যে যে ত্রুটি দেখা দেয় তা যে , রোবট ব্যবহারের কারণেই সে প্রশ্নেও বিতর্কের অবকাশ থাকে না।

তবে প্রশ্ন উঠতে পারে যে , সৃষ্টিকর্মের পূর্ণ কারণে অংশগ্রহণের কারণেই কাউকে স্রষ্টা বলে অভিহিত করা যেতে পারে কিনা ? কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে , আল্লাহ্ তা আলা সুস্পষ্টভাবেই তাঁর কতক সৃষ্টিকে স্রষ্টা বলে উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে স্রষ্টা বলতে সৃষ্টিকর্মে অংশগ্রহণকারী বা আল্লাহর সৃষ্ট উপাদান দ্বারা কিছু সৃষ্টিকারী ও যে বুঝানো হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলা চলে। উদাহরণস্বরূপ , আল্লাহ্ তা আলা হযরত ঈসা (আঃ)-এর প্রতি সৃষ্টিকর্ম আরোপ করেছেন ; এরশাদ করেছেন:

( وَإِذْ تَخْلُقُ مِنَ الطِّينِ كَهَيْئَةِ الطَّيْرِ بِإِذْنِي فَتَنْفُخُ فِيهَا فَتَكُونُ طَيْرًا بِإِذْنِي)

আর (হে ঈসা!) স্মরণ করো , যখন তুমি আমার অনুমতিক্রমে মাটি দ্বারা পাখীর প্রতিকৃতি তৈরী করতে , অতঃপর তাতে ফুঁক দিতে , ফলে আমার ইচ্ছায় তা পাখী হয়ে যেতো। (সূরাহ্ আল্-মায়েদাহ্: ১১০)

এ আয়াতে সুস্পষ্টতঃই হযরত ঈসা (আঃ) কর্তৃক পাখীর প্রতিকৃতি সৃষ্টি করার কথা বলা হয়েছে যদিও তিনি তা আল্লাহর সৃষ্ট মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেন অর্থাৎ তিনি পাখীর প্রতিকৃতি সৃষ্টির পূর্ণ কারণ ছিলেন না , পূর্ণ কারণে অংশগ্রহণকারী ও বস্তুর রূপান্তরকারী ছিলেন মাত্র।

অবশ্য আল্লাহ্ তা আলা যেখানে মানুষকে স্রষ্টাগণ (খালেক্বীন্) বলে উল্লেখ করেছেন সেখানে তাদেরকে শুধু খোদায়ী সৃষ্টিকর্মের পূর্ণ কারণে অংশগ্রহণকারী হিসেবেই নয় , বরং তাদের মনোজাগতিক সৃষ্টিসমূহের পূর্ণ কারণ রূপ স্রষ্টা হিসেবেও বুঝানো হয়ে থাকতে পারে। কারণ , মানুষ তার মনোজগতে অনেক কিছু সৃষ্টি করে যদিও তা আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টির তুলনায় খুবই দুর্বল ও স্বল্পস্থায়ী। তাছাড়া মানুষ বস্তুজগতে যে সব পরিবর্তন সাধন করে (বাড়ী , গাড়ী ও আসবাবপত্র থেকে শুরু করে সুপার কম্পিউটার তৈরী পর্যন্ত) তার ভিত্তি হচ্ছে মনোজগতে সৃষ্ট ঐ সব জিনিসের অবস্তুগত রূপ যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরই সৃষ্টি এবং ঐ সব মনোজাগতিক সৃষ্টি পার্থিব উপাদানের ওপর নির্ভরশীল নয়।

বস্তুতঃ কল্পনা ও পরিকল্পনা (এবং চিন্তা-চেতনা) এক ধরনের অস্তিত্ব ; অনস্তিত্ব নয় বা সাথে সাথে অনস্তিত্বে চলে যাওয়ার মতো বিষয় নয়। বরং এর সবই আলমে মালাকুতে বা আলমে বারযাখে সংরক্ষিত থাকে। আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন:

( قُلْ إِنْ تُخْفُوا مَا فِي صُدُورِكُمْ أَوْ تُبْدُوهُ يَعْلَمْهُ اللَّهُ)

(হে রাসূল!) বলে দিন: তোমাদের অন্তঃকরণে যা কিছু আছে তোমরা যদি তা গোপন করো বা প্রকাশ করো (উভয় অবস্থায়ই) আল্লাহ্ তা জানেন। (সূরাহ্ আালে ইমরান্: ২৯)

এছাড়া আল্লাহ্ তা আলা অনেকগুলো আয়াতে নিজেকেعليم بذات الصدور (অন্তরস্থ বিষয়সমূহ সম্বন্ধে সদা অবগত) বলে উল্লেখ করেছেন। এ থেকে , বিশেষ করে এ ব্যাপারেذات (সত্তা) শব্দ ব্যবহার থেকে প্রমাণিত হয় যে , অন্তরস্থ বিষয়সমূহ বা মানোজাগতিক সৃষ্টিসমূহ প্রকৃত অস্তিত্ব।

আল্লাহ্ তা আলা আরো এরশাদ করেন:

( وَإِنْ تُبْدُوا مَا فِي أَنْفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوهُ يُحَاسِبْكُمْ بِهِ اللَّهُ)

তোমরা তোমাদের সত্তায় যা নিহিত আছে তা প্রকাশ করো বা গোপনই করো , আল্লাহ্ তার হিসাব গ্রহণ করবেন। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ২৮৪)

বলা বাহুল্য যে , হিসাবের সময় মানুষের ভালো-মন্দ সকল কর্মকে (যার সবই সংরক্ষিত আছে) দেখানো হবে (সূরাহ্ আল্-যিলযাল্: ৭) যাতে ব্যক্তি তার খারাপ আমল সমূহ অস্বীকার করতে না পারে। অতএব , তার মনোজাগতিক ভালো-মন্দ কাজ (চিন্তা-চেতনা , কল্পনা ও পরিকল্পনা)-ও দেখানো হবে যা এ সবের প্রকৃত অস্তিত্ব হওয়া ও সংরক্ষিত থাকাই প্রমাণ করে। এ ধরনের সৃষ্টির পূর্ণ কারণ স্বয়ং মানুষ ; সে এ সব সৃষ্টির প্রকৃত স্রষ্টা।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলে নয়। তা হচ্ছে , আল্লাহ্ তা আলা তো তাঁর সৃষ্টিকার্যের জন্য কারো সাহায্যের মুখাপেক্ষী নন ; তিনি চাইলেই সৃষ্টি হয়ে যায়। এরশাদ হয়েছে:

( إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ)

নিঃসন্দেহে তাঁর কাজ (বা আদেশ) এমন যে , তিনি যখন কোনো কিছু ইচ্ছা করেন তখন শুধু বলেন: হও , অতএব , তা হয়ে যায়। (সূরাহ্ ইয়া-সীন্: ৮২) এমতাবস্থায় তাঁর সৃষ্টিকার্যে সচেতন সৃষ্টিসমূহের অংশগ্রহণের সুযোগ কোথায় ?

এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে এই যে , এ আয়াতে শুধু আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টিকার্যের কথা বলা হয় নি , বরং সৃষ্টিকুলের এখতিয়ারাধীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও মৌলিক নব নব সৃষ্টি সহ তাঁর সকল কার্যের কথাই বলা হয়েছে , যদিও প্রশ্নের বিষয়বস্তু অর্থাৎ সৃষ্টিকার্যও তার অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ্ তা আলা যখন সৃষ্টিকার্যের ইচ্ছা করেন তখন তার মানে এ নয় যে , তিনি যখন কোনো সৃষ্টিকার্যের ইচ্ছা করেন তখন সেই মুহূর্তেই তা সংঘটিত হওয়া অপরিহার্য। কারণ , তিনি যখন কোনো কিছু সৃষ্টির ইচ্ছা করেন তখন তাঁর ইচ্ছার মধ্যে শুধু সংশ্লিষ্ট সৃষ্টিটির বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ গঠনপ্রকৃতি ও তার উপাদান-উপকরণই শামিল থাকে না , বরং স্থানগত , কালগত ও প্রক্রিয়াগত উপাদানও শামিল থাকে এবং তদনুযায়ী যথাযথ প্রক্রিয়ায় যথাসময়ে ও যথাস্থানে সংশ্লিষ্ট সৃষ্টির আবির্ভাব অনিবার্য হয়ে যায়। অবশ্য আল্লাহ্ তা আলা চাইলে কোনো সৃষ্টিকে তাৎক্ষণিকভাবে অস্তিত্ব প্রদান করতে পারেন , কিন্তু তাঁর জন্য এটা অপরিহার্য নয় যে , তিনি কেবল তাৎক্ষণিক ও মাধ্যম বিহীন সৃষ্টির ইচ্ছা করবেন এবং বিলম্বে কার্যকরোপযোগী ও মাধ্যম বিশিষ্ট সৃষ্টির ইচ্ছা করবেন না। বরং তিনি উভয় ধরনের সৃষ্টিরই ইচ্ছা করতে পারেন এবং যা-ই ইচ্ছা করেন ও যেভাবে ইচ্ছা করেন সেভাবেই তার আবির্ভাব অনিবার্য। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তিনি চাইলে দুই বা ততোধিক সম্ভাবনাকেও তাঁর ইচ্ছায় শামিল রাখতে পারেন।

আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টি-ইচ্ছা যে তাৎক্ষণিকভাবে ও বিনা মাধ্যমে বাস্তবায়িত হওয়া অপরিহার্য নয় তার অন্যতম প্রমাণ হযরত আদম (আঃ)-এর সৃষ্টি। আল্লাহ্ তা আলা ফেরেশতাদেরকে বলেন:( انی جاعل فی الارض خليفة ) - অবশ্যই আমি ধরণীর বুকে প্রতিনিধি নিয়োগকারী। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ৩০) এর মানে হচ্ছে , আল্লাহ্ তা আলা যে হযরত আদম (আঃ)কে সৃষ্টির ইচ্ছা করেন (সৃষ্টি করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন) তা করেন ফেরেশতাদেরকে জানানোর আগেই। কিন্তু তিনি তাঁর এ ইচ্ছা বা সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন ইচ্ছা করা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের মুহূর্তেই করেন নি , বরং আরো পরে তা বাস্তবায়ন করেন। শুধু তা-ই নয় , আসমানী কিতাবধারী সকল ধর্মের অভিন্ন মত অনুযায়ী , আল্লাহ্ তা আলার নির্দেশে ফেরেশতারাই হযরত আদম (আঃ)-এর বস্তুগত দেহ তৈরী করেছিলো , যদিও আল্লাহ্ তা আলা চাইলে হযরত আদম (আঃ) মাটির উপাদান ও ফেরেশতাদের মাধ্যম ছাড়াই অস্তিত্বলাভ করতেন। তবে সে ক্ষেত্রে মাটির গুণ ও ফেরেশতাদের কর্মক্ষমতা প্রকাশ পেতো না-যা প্রকাশ পাওয়ায় যিনি মাটি ও ফেরেশতাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর মাহাত্ম্য অধিকতর মাত্রায় প্রকাশ পেয়েছে।

আল্লাহ্ তা আলার বিশেষ সৃষ্টি-ইচ্ছার (قضاء تکوينی الاهی ) বাস্তবায়ন যে তাৎক্ষণিক বা বিনা মাধ্যমে হওয়া অপরিহার্য নয় , বরং তাঁর ইচ্ছায় পুরোপুরি বা আংশিক প্রাকৃতিক কারণ ও অপ্রাকৃতিক মাধ্যম শামিল থাকতে পারে এবং ইচ্ছাকরণ ও বাস্তবায়নের মধ্যে কালগত ব্যবধানও তাঁর ইচ্ছায় শামিল থাকতে পারে-হযরত ঈসা (আঃ)-এর জন্মের ঘটনা তার আরেকটি প্রমাণ।

আল্লাহ্ তা আলা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)কে উদ্দেশ করে এরশাদ করেন: (হে রাসূল!) স্মরণ করুন , ফেরেশতারা বললো: হে মারইয়াম! অবশ্যই আল্লাহ্ আপনাকে তাঁর নিজের পক্ষ থেকে এক বাণীর (তাঁর বাণীর মূর্ত প্রতীক-এর) সুসংবাদ দিচ্ছেন ; তাঁর নাম মাসীহ্ ঈসা ইবনে মারইয়াম। (সূরাহ্ আালে ইমরান্: ৫) এ থেকে সুস্পষ্ট যে , এ সুসংবাদ হযরত মারইয়াম (আঃ)কে প্রদানের পূর্বেই আল্লাহ্ তা আলা তাঁকে সৃষ্টির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সাথে সাথেই হযরত ঈসা (আঃ) সৃষ্টি হন নি। অতঃপর এ সুসংবাদ পেয়ে হযরত মারইয়াম (আঃ) বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন: হে আমার রব! কী করে আমার সন্তান হবে যখন কোনো মানুষ (পুরুষ) আমাকে স্পর্শ করে নি ? (সূরাহ্ আালে ইমরান্: ৪৭) তখন আল্লাহ্ তা আলা তাঁকে ওয়াহী করে বলেন:

( كَذَلِكِ اللَّهُ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ إِذَا قَضَى أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ)

এভাবেই (হবে ; কারণ ,) আল্লাহ্ যাকে চান সৃষ্টি করেন। তিনি যখন কোনো বিষয়ে ফয়সালা করেন তখন নিঃসন্দেহে তাকে বলেন: হও , অতএব , তা হয়ে যায়। (সূরাহ্ আালে ইমরান্: ৪৭)

কিন্তু আল্লাহ্ তা আলা হযরত ঈসা (আঃ)কে সৃষ্টি করার ইচ্ছা করা সত্ত্বেও সাথে সাথে বিনা মাধ্যমে তাঁকে সৃষ্টি করেন নি ; বরং আংশিক প্রাকৃতিক কারণ (মাতা)-এর মাধ্যমে কিছুটা সময় নিয়ে তাঁকে সৃষ্টি করেন। অর্থাৎ এ আংশিক প্রাকৃতিক কারণ ও সময় সহই আল্লাহ্ তা আলা তাঁকে সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেছিলেন ; তাৎক্ষণিক ও বিনা মাধ্যমে সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেন নি ।

বস্তুতঃ আল্লাহ্ তা আলার প্রত্যক্ষ সৃষ্টি সংক্রান্ত বিশেষ ইচ্ছার বিষয়টি নতুন সৃষ্টি-উপাদান বা নতুন প্রজাতি সৃষ্টিকরণ এবং সৃষ্টিলোকের চলমান প্রক্রিয়ায় ক্ষেত্রবিশেষে হস্তক্ষেপকরণ-এই তিনটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ; আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্ট কারণবিধির আওতায় স্বাভাবিকভাবে চলমান প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এ প্রক্রিয়ার সূচনা ও তার নিয়মবিধি আল্লাহ্ তা আলার বিশেষ সৃষ্টি-ইচ্ছারই প্রতিফলন , অতঃপর এর ধারাবাহিকতা তাঁর সর্বজনীন ইচ্ছারই আওতায় অব্যাহত রয়েছে যার মধ্যে দুই সম্ভাবনা (محو و اثبات )ও অন্তর্ভুক্ত এবং সৃষ্টিকর্মের পূর্ণ কারণের মধ্যে সৃষ্টির অংশগ্রহণ এই দুই সম্ভাবনারই আওতাভুক্ত বিষয়।

সংক্ষেপে , আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টি-ইচ্ছা বা সৃষ্টিকার্য সম্পাদন প্রক্রিয়া দুই ধরনের বলে আমরা দেখতে পাই:

(১) আল্লাহ্ তা আলার প্রত্যক্ষ সৃষ্টি-ইচ্ছা। এতে সংশ্লিষ্ট সৃষ্টির বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ গঠন ও অব্যাহত থাকার প্রক্রিয়া , আবির্ভাবের স্থান ও কাল এবং অস্তিত্বলাভের উপায়-উপকরণ ও প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত থাকে। তার উপায়-উপকরণ প্রকৃতি থেকে নেয়া হবে , নাকি তা সরাসরি সৃষ্টি করা হবে তা-ও তাঁর ইচ্ছায় অন্তর্ভুক্ত থাকে।

(২) আল্লাহ্ তা আলার পরোক্ষ বা সর্বজনীন সৃষ্টি-ইচ্ছা। আল্লাহ্ তা আলার এ সৃষ্টি-ইচ্ছার মধ্যে একাধিক সম্ভাবনাযুক্ত ভবিষ্যতও অন্তর্ভুক্ত। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শর্তাবলী বা পূর্ণ কারণ বিদ্যমান হলে সৃষ্টিকার্য সম্পাদিত হবে , নচেৎ তা হবে না। এ ক্ষেত্রে সৃষ্টিকার্যে ভূমিকা পালনকারী উপাদান সমূহ যেহেতু আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টি , সে হিসেবে এ সব উপাদানের ভূমিকা আল্লাহ্ তা আলার পরোক্ষ সৃষ্টি-ইচ্ছার আওতাভুক্ত। এ উপাদানগুলো হচ্ছে:

১। আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিধিবিধান ,

২। আল্লাহ্ তা আলার পূর্ণ অনুগত সৃষ্টি ফেরশতাগণ ,

৩। প্রাণশীল সৃষ্টিনিচয়ের সহজাত প্রবণতা ,

৪। ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন প্রাণশীল সৃষ্টিনিচয়ের সহজাত প্রবণতা এবং

৫। স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতার অধিকারী সৃষ্টি (মানুষ ও জিন্)।

কিন্তু সৃষ্টিতে ত্রুটির কারণ কেবল সৃষ্টিকর্মে সৃষ্টির অংশগ্রহণই নয় , বরং সৃষ্টির স্বেচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত নেতিবাচক ভূমিকাও দায়ী। সৃষ্টিকর্মে অংশগ্রহণ একটি ইতিবাচক ভূমিকা , যদিও ভূমিকা পালনকারীদের অনেকের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার কারণে সৃষ্টিতে ত্রুটি প্রকাশ পেতে পারে। অন্যদিকে গোটা সৃষ্টিব্যবস্থার বৃহত্তর লক্ষ্যে তথা পূর্ণতা বিধানের লক্ষ্যে আল্লাহ্ তা আলা বিভিন্ন সৃষ্টির বিকাশ ও স্বার্থের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা ও সাংঘর্ষিকতা নিহিত রেখেছেন। এই সাংঘর্ষিকতা ও স্বার্থদ্বন্দ্ব একদিকে যেমন দৃশ্যতঃ কতক সৃষ্টির জন্য অবাঞ্ছিত অবস্থা সৃষ্টি করে , তেমনি তার প্রভাব নেতিবাচক হিসেবে দেখা যায় তথা কোনো কোনো সৃষ্টিতে ত্রুটি আকারে প্রকাশ পায়। অন্য কথায় , আল্লাহ্ তা আলা তাঁর সৃষ্টিব্যবস্থাপনায় এমন ব্যবস্থা রেখেছেন যার ফলে এক সৃষ্টি অন্য সৃষ্টির জন্ম , বিকাশ , বিস্তার ও পূর্ণতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ , একটি বড় গাছের নীচে গজানো একটি চারাগাছ পুরোপুরি ভারসাম্যপূর্ণভাবে বিকাশ লাভে সক্ষম হয় না। একটি পোকার জীবনধারণ , বিকাশ ও পূর্ণতার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন , কিন্তু এই পোকাটির প্রয়োজন মিটাতে গিয়ে একটি ফল বা একটি উদ্ভিদ , এমনকি বিশালায়তন একটি বৃক্ষ ত্রুটিযুক্ত হয়ে পড়ে। কোনো কোনো প্রাণী অপর কোনো কোনো প্রাণীকে ভক্ষণ করে যা শেষোক্তদের জন্য অবাঞ্ছিত। আবার রোগজীবাণু বা অন্য কোনো কিছুর নেতিবাচক প্রভাবে মানুষ ও অন্য প্রাণীর মধ্যে ত্রুটি (যেমন: বিকলাঙ্গতা , অন্ধত্ব ইত্যাদি) প্রকাশ পেতে পারে। কিন্তু এই সাংঘর্ষিকতার মধ্যে সামগ্রিকভাবে সৃষ্টিকুলের কল্যাণ বা স্বার্থ নিহিত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ , বিভিন্ন প্রাণী একে অপরকে খায় বলেই বিশ্বে প্রাণী প্রজাতি সমূহের মধ্যে সংখ্যাগত ভারসাম্য বজায় থাকে ও স্থানসঙ্কুলানের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ , বিভিন্ন ধরনের মাছ ও পাখী বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ ভক্ষণ করে। এ না হলে মানুষ ও পশুপাখীর জন্য কোনো পানযোগ্য পানি ও শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণোপযোগী বায়ু এবং বিচরণ করার মতো কোনো ভূখণ্ড অবশিষ্ট থাকতো না। তাছাড়া উদ্ভিদ , পোকামাকড় , কীটপতঙ্গ ও অন্যান্য প্রাণী প্রজাতিকে অন্যদের ভক্ষণ হতে নিরাপদ রাখা হলে তথা কোনো প্রাণীর মধ্যেই অন্য প্রাণীকে ভক্ষণের স্পৃহা সৃষ্টি করা না হলে প্রাণীকুলের জন্য খাদ্য হিসেবে শুধু জড় পদার্থ তথা মাটি ও পানি গ্রহণের স্পৃহা সৃষ্টি করতে হতো। তাহলে প্রাণীকুলের মধ্যে কোনো ধরনের আন্তঃক্রিয়াই সংঘটিত হতো না এবং আন্তঃক্রিয়া থেকে তাদের মধ্যকার যে সব গুণ-বৈশিষ্ট্য তথা প্রবণতা ও সম্ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তা ঘটতো না। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে সকল প্রজাতি হতো পরস্পর বিচ্ছিন্ন তথা কখনোই পরস্পর মিলিত হবে না এমন সরল রেখার মতো। সে ক্ষেত্রে জড়দেহে চেতনার অধিকারী সৃষ্টিনিচয়ের পরিবর্তে কেবল ফেরেশতা সৃষ্টি করাই বিধেয় হতো। কিন্তু তার ফলে আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টিক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ সীমিত হয়ে পড়তো।

অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই যে , রোগজীবাণুর অস্তিত্ব মানুষের জন্য কষ্টের ও তাদের মধ্যে ত্রুটি সৃষ্টির কারণ হলেও তা চিকিৎসা-গবেষণার প্রেরণাদাতাস্বরূপ ভূমিকা পালন করেছে এবং এর ফলে মানুষের নিকট বিভিন্ন বস্তুর গুণাগুণ ও মানবদেহের অভ্যন্তরস্থ বিস্ময়কর জটিল ব্যবস্থাপনার জ্ঞান প্রকাশ পেয়েছে। রোগজীবাণু , রোগব্যাধি এবং মানুষ , প্রাণী ও উদ্ভিদের শরীরে ত্রুটি না থাকলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উদ্ভব ঘটতো না এবং মানুষ আল্লাহ্ তা আলার বহু সৃষ্টি সম্বন্ধে জানা ও তাঁর বিস্ময়কর সৃষ্টিকুশলতা অনুভব করা থেকে বঞ্চিত থাকতো।

মোদ্দা কথা , সৃষ্টিতে ত্রুটি ও দুর্বলতার অন্যতম কারণ হচ্ছে বিভিন্ন সৃষ্টির মধ্যে সাংঘর্ষিকতা ও স্বার্থদ্বন্দ্ব যা সমগ্র সৃষ্টিব্যবস্থাকে পূর্ণতায় উপনীত করার জন্য অপরিহার্য।

আমরা এবং ইসলাম

ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী আমরা ইরানীরা কয়েক সহস্রাব্দ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে কখনও বন্ধুত্বপূর্ণ আবার কখনও শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করেছি। এ সম্পর্কের কারণে তাদের অনেক চিন্তা ও বিশ্বাস যেমন আমাদের মধ্যে এসেছে তেমনি আমাদের অনেক চিন্তা ও বিশ্বাসও তাদের ওপর প্রভাব ফেলেছে। যখনই অন্য জাতি ও গোষ্ঠীর জাতিসত্তা ও প্রভুত্বের কথা এসেছে আমরা তাদের মাঝে বিলুপ্ত হইনি ;বরং অন্য জাতিসত্তাকে প্রতিরোধ করেছি। তবে আমরা নিজ জাতিসত্তাকে ভালবাসার কারণে এটি করলেও এর মধ্যে কোন গোঁড়ামি বা অন্ধ বিশ্বাস ছিল না। কারণ মনের কোন অন্ধত্বই আমাদের সত্য হতে দূরে রাখতে এবং সত্যের বিরোধী ও শত্রু করতে পারেনি।

হাখামানেশী রাজত্বের সময় যখন ইরান বর্তমান সীমার বাইরেও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশসহ একই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল তখন হতে বর্তমানে দু হাজার পাঁচশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। পঁচিশ শতাব্দীর মধ্যে চৌদ্দ শতাব্দী ধরে আমরা ইসলামের ছায়ায় বাস করছি এবং এ ধর্ম আমাদের জীবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। এ দীনের রীতি ও শিক্ষাতেই আমরা আমাদের শিশুদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছি ,আমাদের জীবন পরিচালিত করেছি ,এক আল্লাহর ইবাদাত করেছি ,এ দীনের রীতিতেই আমাদের মৃতদের কবরস্থ করেছি। আমাদের ইতিহাস ,রাজনীতি ,বিচার ব্যবস্থা ,আইন ,সংস্কৃতি ,সভ্যতা ,সামাজিক আচার-এক কথায় সকল কিছু ইসলামের সঙ্গে মিশে গেছে। সকল জ্ঞানী ব্যক্তিই স্বীকার করেছেন ,ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে শতাব্দীকাল ধরে আমরা অসাধারণ ও মহা মূল্যবান অবদান রেখেছি যা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না ,এমনকি অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে দীনের প্রচার-প্রসার এবং উন্নয়নে আরবদের চেয়েও অধিক অবদান রেখেছি। কোন জাতিই আমাদের মত এ দীনের প্রচার-প্রসার ও বিস্তৃতিতে ভূমিকা রাখতে পারেনি।

এ জন্যই ইসলাম ও ইরানের সম্পর্ককে বিভিন্ন আঙ্গিকে পর্যালোচনার অধিকার আমরা রাখি। ইসলামী জ্ঞানের প্রসারে আমাদের ভূমিকা এবং আমাদের আত্মিক ও বস্তুগত উন্নয়নে ইসলামের অবদান পূর্ণাঙ্গ ও যথার্থরূপে ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্য প্রমাণসহ স্পষ্ট করে তুলে ধরতেই আমাদের এ আলোচনা।

বর্তমান সময়ে জাতি আরাধনা

বর্তমান শতাব্দীর বহুল আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হলো জাতীয়তা। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক জাতিগোষ্ঠীই ,এমনকি মুসলমানদের মধ্যে ইরানী ও অ-ইরানী সকলেই এ বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তাদের অনেকে এ আলোচনায় এতটা ডুবে গিয়েছেন ,যার কোন সীমা-পরিসীমা নেই।

বাস্তবতা হলো বর্তমান সময়ে জাতীয়তাবাদ মুসলিম বিশ্বের জন্য এক বিরাট সমস্যা। জাতীয়তাবাদের ধারণা ইসলামী মৌল প্রশিক্ষণের নীতির বিরোধী ও এ চিন্তাধারা মুসলিম ঐক্যের পথে বড় প্রতিবন্ধক।

আমরা জানি ইসলামী সমাজ বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে গঠিত এবং অতীতে ইসলাম বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে ইসলামী সমাজের ছায়ায় একত্রিত করেছে। এ একতা এখনও বাস্তবে বিদ্যমান। এটি বাস্তব সত্য ,এখনও সত্তর কোটি1 মানুষের বৃহত্তর একটি জনগোষ্ঠী এক চিন্তা ,মূল্যবোধ ,অনুভূতি এবং সহাবস্থানের ধারণায় বিশ্বাসী। তাদের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে তা তাদের নিজস্ব নয় ;বরং তা সরকারসমূহ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে এবং সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোতে যার কারণ আমেরিকা ও ইউরোপের শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ। তদুপরি এ সকল কারণ মানুষের অন্তরের এ ভিত্তিকে ধ্বংস করতে পারেনি। ইকবাল লাহোরীর ভাষায় :

সত্যের প্রমাণ মোদের নিকট রয়েছে একটিই ,

তাঁবুগুলো বিচ্ছিন্ন মোদের ,হৃদয় তো একটিই।

অধিবাসী মোরা কেউ হিজায ,চীন ,ইরান ও ভারতের ,

সকলে মোরা যেন শিশির একই প্রভাতের।

এই একক জনগোষ্ঠী হতেই প্রতি বছর হজ্বের মৌসুমে পনেরো লক্ষ মানুষের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় ।

জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদ এমন এক চিন্তা যা বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীকে একে অপরের বিপরীতে দাঁড় করায়। গত শতাব্দী2 হতে ইউরোপে এ চিন্তার ঢেউ উচ্চকিত হয়েছে । হয়তো বা সেখানে এটি স্বাভাবিক। কারণ ইউরোপে এমন কোন মতবাদ ছিল না যা সেখানকার বিভিন্ন জাতিকে উচ্চতর পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। পরবর্তীতে সাম্রাজ্যবাদীদের মাধ্যমে এ ঢেউয়ের ধাক্কা প্রাচ্যের জাতিগুলোর মধ্যেও লাগে। সাম্রাজ্যবাদ বিভেদের জন্ম দাও ও শাসন কর নীতি প্রয়োগ শুরু করে। এ নীতি বাস্তবায়নের জন্য সর্বোত্তম পথ হিসেবে ইসলামী জাতি-গোষ্ঠীসমূহকে নিজ নিজ বর্ণ ও জাতিসত্তার প্রতি মনোনিবেশের দিকে পরিচালিত করার প্রচেষ্টা নেয় এবং এক কাল্পনিক আত্মগর্বে নিমজ্জিত হতে উদ্বুদ্ধ করে ,যেমন ভারতীয়কে বলে ,তোমার অতীত এরূপ গৌরবময় ,তুর্কীকে বলে ,প্যানতুর্কী ইজম ধারণায় নব্য তুর্কী আন্দোলন শুরু কর ,আরবকে বলে ,তাদের মধ্যে পূর্ব হতেই গোত্রবাদের ধারণাসহ আরব জাতিত্বের ধারণা প্রকট ছিল-আরবী ভাষার ওপর ভিত্তি করে প্যান আরব ইজম আন্দোলনের সূচনা কর। ইরানীকে বলে ,তুমি আর্য জাতিভুক্ত এবং সেমিটিক জাতিভুক্ত আরব হতে ভিন্ন ,তোমার চিন্তা-ধারণা সবই ভিন্ন।

জাতীয়তাবাদী ধারণা জাতীয় চিন্তা ও অনুভূতির জাগরণের মাধ্যমে হয়তো অনেক জাতিরই স্বাধীন অস্তিত্বের বিষয়ে ইতিবাচক ও কল্যাণকর কিছু প্রভাব রাখতে পারে ,কিন্তু ইসলামী জাতিগুলোর মধ্যে এর কল্যাণকর কোন প্রভাব তো পড়েইনি ;বরং অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতার কারণ হয়ে দেখা দেয়। ইসলামী জাতিসমূহ শতাব্দীকাল পূর্বে ঐক্যের আরো উচ্চতর পর্যায় অতিক্রম করেছিল। কারণ ইসলাম শতাব্দীকাল পূর্বে একক চিন্তা ,বিশ্বাস ও আদর্শের ভিত্তিতে অনন্য ঐক্য সৃষ্টি করেছিল ,এমনকি বিংশ শতাব্দীতেও ইসলাম প্রমাণ করেছে এ ঐক্যের ভিত্তি উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর!

বিংশ শতাব্দীতে মুসলমানরা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যে সব আন্দোলনের মাধ্যমে উপনিবেশবাদীদের প্রভাব হতে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে তার পেছনে জাতিগত কারণ অপেক্ষা ইসলামী কারণই মুখ্য ও অধিকতর ফলপ্রসূ ছিল। উদাহরণস্বরূপ আলজিরিয়া ,ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের কথা বলতে পারি।

হ্যাঁ ,এ জাতিসমূহ শতাব্দীকাল হতে প্রমাণ দিয়েছে এক চিন্তা ,বিশ্বাস ও মতাদর্শের ভিত্তি এমন এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সৃষ্টি করতে পারে যা তাদেরকে সাম্রাজ্যবাদের থাবা হতে মুক্ত করতে সক্ষম। তাই এরূপ জাতি-গোষ্ঠীকে জাতীয়তাবাদের মত চিন্তার দিকে পরিচালিত করা প্রতিক্রিয়াশীলতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

সুতরাং বর্ণ ও জাতীয়তাবাদের উদ্গাতা হলো ইউরোপ এবং এ চিন্তাধারা ইসলামী বিশ্বের জন্য অনেক বড় সমস্যার সৃষ্টি করেছে। সাইয়্যেদ জামালউদ্দীন আসাদাবাদীর (আফগানী) নিজ জাতিসত্তা গোপন করার কারণ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে ,তিনি চান নি তাঁকে বিশেষ কোন জাতিভুক্ত বলে পরিচিত করানো হোক যা উপনিবেশবাদীদের হাতে একটি হাতিয়ার হতে পারে এবং অন্য জাতিভুক্তদের তাঁর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে পারে।

আমরা যেহেতু এক ধর্ম ,একই মতাদর্শ ও পথের ওপর রয়েছি যার নাম ইসলাম এবং যার মধ্যে জাতিগত ধারণার উপাদান নেই সেহেতু এ মতাদর্শের বিপরীতে বর্ণ ও জাতিগত যে কোন ধারণার বিরুদ্ধে আমরা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারি না। আমরা অবহিত ,সম্প্রতি অনেক ব্যক্তিই ইরানী জাতিসত্তা সংরক্ষণের নামে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেছে এবং আরব ও আরবী ভাষার বিরুদ্ধে সংগ্রামের নামে ইসলামের পবিত্র অনুভূতির প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করছে।3

ইরানে ইসলামের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধের নমুনা আমরা বই-পুস্তক ,দৈনিক ,সাপ্তাহিক ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে লক্ষ্য করছি। এটি আকস্মিক কোন বিষয় নয় ;বরং একটি পরিকল্পিত নকশা ও লক্ষ্যের ফলশ্রুতি।

বর্তমানে যারথুষ্ট্র ( Zoroastrian)ধর্মের প্রচারণা বেড়ে গিয়েছে এবং এটি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক কার্যক্রমে পরিণত হয়েছে। সকলেই জানেন আজকের ইরানীরা কখনই যারথুষ্ট্র ধর্মে ফিরে যাবে না এবং যারথুস্ট্র ধর্মের শিক্ষাও ইসলামের স্থান দখল করতে পারবে না। যে সকল ব্যক্তি মাযদাকী , মনী এবং যারথুষ্ট্র ধর্মের ব্যক্তিত্ব বলে পরিচিত তাদের সকলেই আজ জাতীয় মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিহিত এবং ইসলামী শিক্ষা হতে বিচ্যুত চরিত্র বৈ তাদের ভিন্ন কোন চরিত্র ছিল না। এখানে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই হোক বা আরব জাতির বাহানা এনেই হোক কার্যক্রম চালিয়ে ইরানীদের মন হতে ইসলামের প্রসিদ্ধ বীরদের স্মৃতি মুছে দিতে পারবে না। কখনই আল মুকান্না , মিনবাদ , ববাকে খুররামদীন এবং মজিয়ররা ইরানীদের অন্তরে আলী ইবনে আবি তালিব , হুসাইন ইবনে আলী , এমনকি সালমান ফারসীর স্থান অধিকারে সক্ষম নয়। সকলেই তা জানে।

যদিও এর মাধ্যমে হয়তো অপরিপক্ব ও বুদ্ধিহীন যুবকদের মধ্যে দেশ ,জাতি ও রাষ্ট্রীয় চেতনা ও অনুভূতি জাগরিত করা এবং তাদের সঙ্গে ইসলামের ব্যবধান ও সম্পর্কচ্ছেদ সৃষ্টি সম্ভব। অর্থাৎ যদিও ইসলামী অনুভূতির স্থলাভিষিক্ত হিসেবে অন্য ধর্মানুভূতি প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয় ,কিন্তু ইসলামী অনুভূতির পরিবর্তন ঘটিয়ে তার বিপরীত অনুভূতি সৃষ্টি করে সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতা করা সম্ভব। এজন্যই লক্ষ্য করি ধর্ম ও আল্লাহ্বিরোধী ব্যক্তিরা বুদ্ধিহীন মগজ হতে উৎসারিত অর্থহীন লেখাগুলোতে যারথুষ্ট্র এবং ইসলাম পূর্ববর্তী ইরানের অবস্থাকে সমর্থন করে চলেছে। তাদের লক্ষ্য আমাদের নিকট স্পষ্ট।

আমরা আমাদের এ আলোচনায় ঐ যুক্তি এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আলোচনা করব যে যুক্তি ও দৃষ্টিকোণ থেকে এই ব্যক্তিরা বিষয়টিকে দেখে। আর তা হলো জাতীয়তা ,জাতীয় চেতনা এবং জাতীয়তাবাদ। হ্যাঁ ,এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আমরা আলোচনা রাখব। যদিও আমরা ইকবাল লাহোরীর এ কথা ভুলে যাই নি- জাতিভক্তি ও আরাধনা এক প্রকার অসভ্যতা । এ বিষয়টির প্রতি আমাদের দৃষ্টি রয়েছে যে ,জাতীয় চেতনা ও অনুভূতির ইতিবাচকতা ততক্ষণ পর্যন্ত রয়েছে যতক্ষণ এর মাধ্যমে স্বদেশের মানুষের সেবা করা যায। কিন্তু কখনও কখনও অনুভূতি ও চেতনা নেতিবাচকতার জন্ম দেয় ,বৈষম্যের সৃষ্টি করে ,ভাল-মন্দ বিচারে অন্ধত্ব ও পক্ষপাতিত্ব এবং নৈতিকতা ও মানবিকতাবিরোধী চেতনার উৎপত্তি ঘটায়।

আমরা জানি জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় চেতনার যুক্তি অপেক্ষা উচ্চতর যুক্তি আমাদের নিকট রয়েছে যেখানে জ্ঞান ,দর্শন ও ধর্ম আবেগ-অনুভূতির ঊর্ধে অবস্থান করছে। জাতীয় অনুভূতির চেতনা সকল স্থানে গ্রহণীয় হলেও জ্ঞান ,দর্শন ও ধর্মের অনুসন্ধানে গ্রহণযোগ্য নয়। জ্ঞান ,দর্শন ও ধর্মীয় কোন বিষয়ে তা রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় হলেই গ্রহণযোগ্য হবে এমনটি নয়। তেমনিভাবে চিন্তাগত কোন বিষয় বিদেশী ও বিজাতীয় হলেই তা বর্জনীয় এমনও নয়। এ কথা সত্য যে ,জ্ঞান ,ধর্ম ও দর্শনের কোন রাষ্ট্র নেই । কারণ এগুলো সর্বজনীন। তাই ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ,বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদেরও কোন নির্দিষ্ট রাষ্ট্র নেই ,তাঁরাও বিশ্বজনীন। তাঁরা সমগ্র বিশ্বের ,সকল রাষ্ট্রই তাঁদের রাষ্ট্র এবং সকল মানুষই তাঁদের স্বদেশী।

যদিও বিষয়গুলো আমরা জানি তদুপরি এখানে মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতর এ যুক্তিকে আমরা আপাতত দূরে রাখছি এবং অপূর্ণাঙ্গ মানুষদের উপযোগী অনুভূতি ও আবেগকেন্দ্রিক যুক্তির ওপর নির্ভর করেই এ আলোচনা শুরু করছি।

আমরা দেখতে চাই জাতীয় চেতনা ও অনুভূতির দৃষ্টিতে যদি ইসলামকে যাচাই করি তা কি বিজাতীয় বলে পরিগণিত হবে ? আমরা দেখতে চাই জাতীয়তার মানদণ্ডে ইসলাম ইরানী জাতীয়তা ও ইরানী জাতীয়তাবাদী চেতনার অন্তর্ভুক্ত নাকি এর বহির্ভূত।

এ লক্ষ্যে আমাদের আলোচনাকে দু টি অংশে ভাগ করব। প্রথমত আমরা জাতীয়তার মানদণ্ড অর্থাৎ কোন বস্তুকে জাতীয়তার অন্তর্ভুক্ত ও বহির্ভূত বলার মানদণ্ড কি তা দেখব। দ্বিতীয়ত দেখব এ মানদণ্ডের আলোকে ইসলাম ইরানী জাতীয়তার অভ্যন্তরের বিষয় নাকি বিজাতীয় ? বাস্তবে আমাদের আলোচনায় দু টি প্রতিজ্ঞা রয়েছে। প্রথম অংশ বৃহত্তর প্রতিজ্ঞা ( major premise) এবং দ্বিতীয় অংশ ক্ষুদ্রতর প্রতিজ্ঞা ( minor premise) ।

প্রসঙ্গত ইসলাম ও যারথুষ্ট্র প্রবণতার (যারথুষ্ট্র ধর্ম প্রবণতা) মধ্যে একটি তুলনামূলক আলোচনা রাখব এবং তাতে প্রমাণিত হবে জাতীয়তার মানদণ্ডে ইসলাম ইরানী জাতিসত্তার অধিকতর নিকটবর্তী নাকি যারথুষ্ট্র প্রবণতা ?

আমরা এবং ইসলাম

ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী আমরা ইরানীরা কয়েক সহস্রাব্দ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে কখনও বন্ধুত্বপূর্ণ আবার কখনও শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করেছি। এ সম্পর্কের কারণে তাদের অনেক চিন্তা ও বিশ্বাস যেমন আমাদের মধ্যে এসেছে তেমনি আমাদের অনেক চিন্তা ও বিশ্বাসও তাদের ওপর প্রভাব ফেলেছে। যখনই অন্য জাতি ও গোষ্ঠীর জাতিসত্তা ও প্রভুত্বের কথা এসেছে আমরা তাদের মাঝে বিলুপ্ত হইনি ;বরং অন্য জাতিসত্তাকে প্রতিরোধ করেছি। তবে আমরা নিজ জাতিসত্তাকে ভালবাসার কারণে এটি করলেও এর মধ্যে কোন গোঁড়ামি বা অন্ধ বিশ্বাস ছিল না। কারণ মনের কোন অন্ধত্বই আমাদের সত্য হতে দূরে রাখতে এবং সত্যের বিরোধী ও শত্রু করতে পারেনি।

হাখামানেশী রাজত্বের সময় যখন ইরান বর্তমান সীমার বাইরেও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশসহ একই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল তখন হতে বর্তমানে দু হাজার পাঁচশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। পঁচিশ শতাব্দীর মধ্যে চৌদ্দ শতাব্দী ধরে আমরা ইসলামের ছায়ায় বাস করছি এবং এ ধর্ম আমাদের জীবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। এ দীনের রীতি ও শিক্ষাতেই আমরা আমাদের শিশুদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছি ,আমাদের জীবন পরিচালিত করেছি ,এক আল্লাহর ইবাদাত করেছি ,এ দীনের রীতিতেই আমাদের মৃতদের কবরস্থ করেছি। আমাদের ইতিহাস ,রাজনীতি ,বিচার ব্যবস্থা ,আইন ,সংস্কৃতি ,সভ্যতা ,সামাজিক আচার-এক কথায় সকল কিছু ইসলামের সঙ্গে মিশে গেছে। সকল জ্ঞানী ব্যক্তিই স্বীকার করেছেন ,ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে শতাব্দীকাল ধরে আমরা অসাধারণ ও মহা মূল্যবান অবদান রেখেছি যা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না ,এমনকি অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে দীনের প্রচার-প্রসার এবং উন্নয়নে আরবদের চেয়েও অধিক অবদান রেখেছি। কোন জাতিই আমাদের মত এ দীনের প্রচার-প্রসার ও বিস্তৃতিতে ভূমিকা রাখতে পারেনি।

এ জন্যই ইসলাম ও ইরানের সম্পর্ককে বিভিন্ন আঙ্গিকে পর্যালোচনার অধিকার আমরা রাখি। ইসলামী জ্ঞানের প্রসারে আমাদের ভূমিকা এবং আমাদের আত্মিক ও বস্তুগত উন্নয়নে ইসলামের অবদান পূর্ণাঙ্গ ও যথার্থরূপে ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্য প্রমাণসহ স্পষ্ট করে তুলে ধরতেই আমাদের এ আলোচনা।

বর্তমান সময়ে জাতি আরাধনা

বর্তমান শতাব্দীর বহুল আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হলো জাতীয়তা। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক জাতিগোষ্ঠীই ,এমনকি মুসলমানদের মধ্যে ইরানী ও অ-ইরানী সকলেই এ বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তাদের অনেকে এ আলোচনায় এতটা ডুবে গিয়েছেন ,যার কোন সীমা-পরিসীমা নেই।

বাস্তবতা হলো বর্তমান সময়ে জাতীয়তাবাদ মুসলিম বিশ্বের জন্য এক বিরাট সমস্যা। জাতীয়তাবাদের ধারণা ইসলামী মৌল প্রশিক্ষণের নীতির বিরোধী ও এ চিন্তাধারা মুসলিম ঐক্যের পথে বড় প্রতিবন্ধক।

আমরা জানি ইসলামী সমাজ বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে গঠিত এবং অতীতে ইসলাম বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে ইসলামী সমাজের ছায়ায় একত্রিত করেছে। এ একতা এখনও বাস্তবে বিদ্যমান। এটি বাস্তব সত্য ,এখনও সত্তর কোটি1 মানুষের বৃহত্তর একটি জনগোষ্ঠী এক চিন্তা ,মূল্যবোধ ,অনুভূতি এবং সহাবস্থানের ধারণায় বিশ্বাসী। তাদের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে তা তাদের নিজস্ব নয় ;বরং তা সরকারসমূহ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে এবং সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোতে যার কারণ আমেরিকা ও ইউরোপের শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ। তদুপরি এ সকল কারণ মানুষের অন্তরের এ ভিত্তিকে ধ্বংস করতে পারেনি। ইকবাল লাহোরীর ভাষায় :

সত্যের প্রমাণ মোদের নিকট রয়েছে একটিই ,

তাঁবুগুলো বিচ্ছিন্ন মোদের ,হৃদয় তো একটিই।

অধিবাসী মোরা কেউ হিজায ,চীন ,ইরান ও ভারতের ,

সকলে মোরা যেন শিশির একই প্রভাতের।

এই একক জনগোষ্ঠী হতেই প্রতি বছর হজ্বের মৌসুমে পনেরো লক্ষ মানুষের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় ।

জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদ এমন এক চিন্তা যা বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীকে একে অপরের বিপরীতে দাঁড় করায়। গত শতাব্দী2 হতে ইউরোপে এ চিন্তার ঢেউ উচ্চকিত হয়েছে । হয়তো বা সেখানে এটি স্বাভাবিক। কারণ ইউরোপে এমন কোন মতবাদ ছিল না যা সেখানকার বিভিন্ন জাতিকে উচ্চতর পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। পরবর্তীতে সাম্রাজ্যবাদীদের মাধ্যমে এ ঢেউয়ের ধাক্কা প্রাচ্যের জাতিগুলোর মধ্যেও লাগে। সাম্রাজ্যবাদ বিভেদের জন্ম দাও ও শাসন কর নীতি প্রয়োগ শুরু করে। এ নীতি বাস্তবায়নের জন্য সর্বোত্তম পথ হিসেবে ইসলামী জাতি-গোষ্ঠীসমূহকে নিজ নিজ বর্ণ ও জাতিসত্তার প্রতি মনোনিবেশের দিকে পরিচালিত করার প্রচেষ্টা নেয় এবং এক কাল্পনিক আত্মগর্বে নিমজ্জিত হতে উদ্বুদ্ধ করে ,যেমন ভারতীয়কে বলে ,তোমার অতীত এরূপ গৌরবময় ,তুর্কীকে বলে ,প্যানতুর্কী ইজম ধারণায় নব্য তুর্কী আন্দোলন শুরু কর ,আরবকে বলে ,তাদের মধ্যে পূর্ব হতেই গোত্রবাদের ধারণাসহ আরব জাতিত্বের ধারণা প্রকট ছিল-আরবী ভাষার ওপর ভিত্তি করে প্যান আরব ইজম আন্দোলনের সূচনা কর। ইরানীকে বলে ,তুমি আর্য জাতিভুক্ত এবং সেমিটিক জাতিভুক্ত আরব হতে ভিন্ন ,তোমার চিন্তা-ধারণা সবই ভিন্ন।

জাতীয়তাবাদী ধারণা জাতীয় চিন্তা ও অনুভূতির জাগরণের মাধ্যমে হয়তো অনেক জাতিরই স্বাধীন অস্তিত্বের বিষয়ে ইতিবাচক ও কল্যাণকর কিছু প্রভাব রাখতে পারে ,কিন্তু ইসলামী জাতিগুলোর মধ্যে এর কল্যাণকর কোন প্রভাব তো পড়েইনি ;বরং অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতার কারণ হয়ে দেখা দেয়। ইসলামী জাতিসমূহ শতাব্দীকাল পূর্বে ঐক্যের আরো উচ্চতর পর্যায় অতিক্রম করেছিল। কারণ ইসলাম শতাব্দীকাল পূর্বে একক চিন্তা ,বিশ্বাস ও আদর্শের ভিত্তিতে অনন্য ঐক্য সৃষ্টি করেছিল ,এমনকি বিংশ শতাব্দীতেও ইসলাম প্রমাণ করেছে এ ঐক্যের ভিত্তি উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর!

বিংশ শতাব্দীতে মুসলমানরা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যে সব আন্দোলনের মাধ্যমে উপনিবেশবাদীদের প্রভাব হতে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে তার পেছনে জাতিগত কারণ অপেক্ষা ইসলামী কারণই মুখ্য ও অধিকতর ফলপ্রসূ ছিল। উদাহরণস্বরূপ আলজিরিয়া ,ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের কথা বলতে পারি।

হ্যাঁ ,এ জাতিসমূহ শতাব্দীকাল হতে প্রমাণ দিয়েছে এক চিন্তা ,বিশ্বাস ও মতাদর্শের ভিত্তি এমন এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সৃষ্টি করতে পারে যা তাদেরকে সাম্রাজ্যবাদের থাবা হতে মুক্ত করতে সক্ষম। তাই এরূপ জাতি-গোষ্ঠীকে জাতীয়তাবাদের মত চিন্তার দিকে পরিচালিত করা প্রতিক্রিয়াশীলতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

সুতরাং বর্ণ ও জাতীয়তাবাদের উদ্গাতা হলো ইউরোপ এবং এ চিন্তাধারা ইসলামী বিশ্বের জন্য অনেক বড় সমস্যার সৃষ্টি করেছে। সাইয়্যেদ জামালউদ্দীন আসাদাবাদীর (আফগানী) নিজ জাতিসত্তা গোপন করার কারণ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে ,তিনি চান নি তাঁকে বিশেষ কোন জাতিভুক্ত বলে পরিচিত করানো হোক যা উপনিবেশবাদীদের হাতে একটি হাতিয়ার হতে পারে এবং অন্য জাতিভুক্তদের তাঁর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে পারে।

আমরা যেহেতু এক ধর্ম ,একই মতাদর্শ ও পথের ওপর রয়েছি যার নাম ইসলাম এবং যার মধ্যে জাতিগত ধারণার উপাদান নেই সেহেতু এ মতাদর্শের বিপরীতে বর্ণ ও জাতিগত যে কোন ধারণার বিরুদ্ধে আমরা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারি না। আমরা অবহিত ,সম্প্রতি অনেক ব্যক্তিই ইরানী জাতিসত্তা সংরক্ষণের নামে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেছে এবং আরব ও আরবী ভাষার বিরুদ্ধে সংগ্রামের নামে ইসলামের পবিত্র অনুভূতির প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করছে।3

ইরানে ইসলামের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধের নমুনা আমরা বই-পুস্তক ,দৈনিক ,সাপ্তাহিক ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে লক্ষ্য করছি। এটি আকস্মিক কোন বিষয় নয় ;বরং একটি পরিকল্পিত নকশা ও লক্ষ্যের ফলশ্রুতি।

বর্তমানে যারথুষ্ট্র ( Zoroastrian)ধর্মের প্রচারণা বেড়ে গিয়েছে এবং এটি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক কার্যক্রমে পরিণত হয়েছে। সকলেই জানেন আজকের ইরানীরা কখনই যারথুষ্ট্র ধর্মে ফিরে যাবে না এবং যারথুস্ট্র ধর্মের শিক্ষাও ইসলামের স্থান দখল করতে পারবে না। যে সকল ব্যক্তি মাযদাকী , মনী এবং যারথুষ্ট্র ধর্মের ব্যক্তিত্ব বলে পরিচিত তাদের সকলেই আজ জাতীয় মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিহিত এবং ইসলামী শিক্ষা হতে বিচ্যুত চরিত্র বৈ তাদের ভিন্ন কোন চরিত্র ছিল না। এখানে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই হোক বা আরব জাতির বাহানা এনেই হোক কার্যক্রম চালিয়ে ইরানীদের মন হতে ইসলামের প্রসিদ্ধ বীরদের স্মৃতি মুছে দিতে পারবে না। কখনই আল মুকান্না , মিনবাদ , ববাকে খুররামদীন এবং মজিয়ররা ইরানীদের অন্তরে আলী ইবনে আবি তালিব , হুসাইন ইবনে আলী , এমনকি সালমান ফারসীর স্থান অধিকারে সক্ষম নয়। সকলেই তা জানে।

যদিও এর মাধ্যমে হয়তো অপরিপক্ব ও বুদ্ধিহীন যুবকদের মধ্যে দেশ ,জাতি ও রাষ্ট্রীয় চেতনা ও অনুভূতি জাগরিত করা এবং তাদের সঙ্গে ইসলামের ব্যবধান ও সম্পর্কচ্ছেদ সৃষ্টি সম্ভব। অর্থাৎ যদিও ইসলামী অনুভূতির স্থলাভিষিক্ত হিসেবে অন্য ধর্মানুভূতি প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয় ,কিন্তু ইসলামী অনুভূতির পরিবর্তন ঘটিয়ে তার বিপরীত অনুভূতি সৃষ্টি করে সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতা করা সম্ভব। এজন্যই লক্ষ্য করি ধর্ম ও আল্লাহ্বিরোধী ব্যক্তিরা বুদ্ধিহীন মগজ হতে উৎসারিত অর্থহীন লেখাগুলোতে যারথুষ্ট্র এবং ইসলাম পূর্ববর্তী ইরানের অবস্থাকে সমর্থন করে চলেছে। তাদের লক্ষ্য আমাদের নিকট স্পষ্ট।

আমরা আমাদের এ আলোচনায় ঐ যুক্তি এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আলোচনা করব যে যুক্তি ও দৃষ্টিকোণ থেকে এই ব্যক্তিরা বিষয়টিকে দেখে। আর তা হলো জাতীয়তা ,জাতীয় চেতনা এবং জাতীয়তাবাদ। হ্যাঁ ,এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আমরা আলোচনা রাখব। যদিও আমরা ইকবাল লাহোরীর এ কথা ভুলে যাই নি- জাতিভক্তি ও আরাধনা এক প্রকার অসভ্যতা । এ বিষয়টির প্রতি আমাদের দৃষ্টি রয়েছে যে ,জাতীয় চেতনা ও অনুভূতির ইতিবাচকতা ততক্ষণ পর্যন্ত রয়েছে যতক্ষণ এর মাধ্যমে স্বদেশের মানুষের সেবা করা যায। কিন্তু কখনও কখনও অনুভূতি ও চেতনা নেতিবাচকতার জন্ম দেয় ,বৈষম্যের সৃষ্টি করে ,ভাল-মন্দ বিচারে অন্ধত্ব ও পক্ষপাতিত্ব এবং নৈতিকতা ও মানবিকতাবিরোধী চেতনার উৎপত্তি ঘটায়।

আমরা জানি জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় চেতনার যুক্তি অপেক্ষা উচ্চতর যুক্তি আমাদের নিকট রয়েছে যেখানে জ্ঞান ,দর্শন ও ধর্ম আবেগ-অনুভূতির ঊর্ধে অবস্থান করছে। জাতীয় অনুভূতির চেতনা সকল স্থানে গ্রহণীয় হলেও জ্ঞান ,দর্শন ও ধর্মের অনুসন্ধানে গ্রহণযোগ্য নয়। জ্ঞান ,দর্শন ও ধর্মীয় কোন বিষয়ে তা রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় হলেই গ্রহণযোগ্য হবে এমনটি নয়। তেমনিভাবে চিন্তাগত কোন বিষয় বিদেশী ও বিজাতীয় হলেই তা বর্জনীয় এমনও নয়। এ কথা সত্য যে ,জ্ঞান ,ধর্ম ও দর্শনের কোন রাষ্ট্র নেই । কারণ এগুলো সর্বজনীন। তাই ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ,বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদেরও কোন নির্দিষ্ট রাষ্ট্র নেই ,তাঁরাও বিশ্বজনীন। তাঁরা সমগ্র বিশ্বের ,সকল রাষ্ট্রই তাঁদের রাষ্ট্র এবং সকল মানুষই তাঁদের স্বদেশী।

যদিও বিষয়গুলো আমরা জানি তদুপরি এখানে মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতর এ যুক্তিকে আমরা আপাতত দূরে রাখছি এবং অপূর্ণাঙ্গ মানুষদের উপযোগী অনুভূতি ও আবেগকেন্দ্রিক যুক্তির ওপর নির্ভর করেই এ আলোচনা শুরু করছি।

আমরা দেখতে চাই জাতীয় চেতনা ও অনুভূতির দৃষ্টিতে যদি ইসলামকে যাচাই করি তা কি বিজাতীয় বলে পরিগণিত হবে ? আমরা দেখতে চাই জাতীয়তার মানদণ্ডে ইসলাম ইরানী জাতীয়তা ও ইরানী জাতীয়তাবাদী চেতনার অন্তর্ভুক্ত নাকি এর বহির্ভূত।

এ লক্ষ্যে আমাদের আলোচনাকে দু টি অংশে ভাগ করব। প্রথমত আমরা জাতীয়তার মানদণ্ড অর্থাৎ কোন বস্তুকে জাতীয়তার অন্তর্ভুক্ত ও বহির্ভূত বলার মানদণ্ড কি তা দেখব। দ্বিতীয়ত দেখব এ মানদণ্ডের আলোকে ইসলাম ইরানী জাতীয়তার অভ্যন্তরের বিষয় নাকি বিজাতীয় ? বাস্তবে আমাদের আলোচনায় দু টি প্রতিজ্ঞা রয়েছে। প্রথম অংশ বৃহত্তর প্রতিজ্ঞা ( major premise) এবং দ্বিতীয় অংশ ক্ষুদ্রতর প্রতিজ্ঞা ( minor premise) ।

প্রসঙ্গত ইসলাম ও যারথুষ্ট্র প্রবণতার (যারথুষ্ট্র ধর্ম প্রবণতা) মধ্যে একটি তুলনামূলক আলোচনা রাখব এবং তাতে প্রমাণিত হবে জাতীয়তার মানদণ্ডে ইসলাম ইরানী জাতিসত্তার অধিকতর নিকটবর্তী নাকি যারথুষ্ট্র প্রবণতা ?


10

11

12

13

14

15