অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম 13%

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 22 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 20109 / ডাউনলোড: 3821
সাইজ সাইজ সাইজ
অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

আল্লাহ্ তা‘আলার সৃষ্টিনিচয়ের মধ্যে মানুষের রয়েছে এক অনন্য অবস্থান। আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকল মানুষের নিকট এটা সুস্পষ্ট ও স্বীকৃত যে, প্রাণী প্রজাতিসমূহের মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্ব যতোটা তার সৃজনশীলতার কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশী তার বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্) ও ইচ্ছাশক্তির কারণে। এ দু’টি বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ তার সহজাত প্রকৃতিকে পরাভূত করতে সক্ষম। যে সব বিষয় গোটা মানব জাতির কর্ম ও আচরণকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতা থাকা-নাথাকা সংক্রান্ত ধারণা। এ ক্ষেত্রে বেশীর ভাগ মানুষই তাত্ত্বিকভাবে বিশ্বাস করে যে, মানুষের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতা বলতে কিছুই নেই, বরং তার জন্ম-মৃত্যু এবং সারা জীবনের কার্যাবলী ও সুখ-দুঃখ পূর্ব থেকেই নির্ধারিত হয়ে আছে বা তার প্রতিটি কাজই আল্লাহ্ তা‘আলা তার দ্বারা করিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু তাদের বেশীর ভাগ কাজকর্ম ও কথাবার্তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, তারা নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতায় বিশ্বাসী। বস্তুতঃ তাদের তাত্ত্বিক বিশ্বাস তাদের কর্ম ও আচরণের ওপর খুব কমই ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে, বরং তা কেবল ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাবই বিস্তার করে থাকে। মানব জাতিকে, বিশেষ করে মুসলমানদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্যে এ প্রশ্নটির সঠিক সমাধান উদ্ভাবন অপরিহার্য। এ লক্ষ্যেই অত্র গ্রন্থ রচনার প্রয়াস।

 


1

2

3

4

5

6

7

পরিশিষ্ট :

আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞানে সৃষ্টিকুলের ভবিষ্যত

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

জাবর্ ও এখতিয়ার্ কালাম্ শাস্ত্রের ও ইসলামী আক্বাএদের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত সুপ্রাচীন বিতর্কের বিষয়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে সঠিক মত হচ্ছে এই যে , না নিরঙ্কুশ জাবর্ , না নিরঙ্কুশ এখতিয়ার্ , বরং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী অবস্থা। কিন্তু জাবর্ ও এখতিয়ার্ সংক্রান্ত আলোচনায় জটিলতম গিঁট হচ্ছে সৃষ্টিকুলের ভবিষ্যত সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞানের সংজ্ঞা। কারণ , নিরঙ্কুশ জাবর্-এর প্রবক্তাদের মত হচ্ছে এই যে , আল্লাহ্ তা আলা স্বীয় অনাদিকালীন জ্ঞানের দ্বারা সৃষ্টিকুলের ভবিষ্যত সম্বন্ধে অবহিত , আর তাঁর ইলমের অন্যথা হতে পারে না , সুতরাং বান্দাহ্ মোটেই এখতিয়ারের অধিকারী নয়। (এটা মানলে বলতে হবে যে , বান্দাহদের কোনোই দায়-দায়িত্ব নেই।) এ মতের জবাবে বলা হয় , এটা অসম্ভব যে , আল্লাহ্ তা আলা কোনো মন্দ কাজের ইচ্ছা করবেন , অথচ আমরা দেখতে পাই যে , বান্দাহরা মন্দ কাজ করে থাকে।

অবশ্য এ বিষয়ে অতীতে অনেক দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে এবং এখনো এ বিষয়ে আলোচনার অবকাশ রয়েছে। আমি আমার অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে মোটামুটি আলোচনা করেছি , সুতরাং এখানে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করছি না। এখানে আমরা শুধু সৃষ্টিকুলের ভবিষ্যত সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা আলার ইলম্-এর প্রকৃতি বা ধরন সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করতে চাই।

যে বিষয়টি আমাকে এ ব্যাপারে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করতে বাধ্য করেছে তা হচ্ছে এ সম্পর্কে না জাবর্ , না এখ্তিয়ার্ , বরং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী অবস্থা র প্রবক্তাদের মধ্যকার কারো কারো মত-যা এ বিষয়ে জাবারীদের মতেরই অনুরূপ।

মনীষী অধ্যাপক ও স্বনামখ্যাত ইসলাম-গবেষক হযরত আয়াতুল্লাহ্ নাছ্বের্ মাকারেম শীরাযীর তত্ত্বাবধানে একদল মনীষী লেখকের দ্বারা ফার্সী ভাষায় প্রণীত তাফ্সীরে নামুনে নিঃসন্দেহে একটি মূল্যবান তাফসীরগ্রন্থ। সম্প্রতি (২০১২ সালে) এ তাফসীরগ্রন্থটি বাংলা ভাষায় অনুবাদের জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয় এবং এটির প্রথম খণ্ডের অনুবাদের দায়িত্ব অত্র লেখকের ওপর অর্পিত হয়। অনুবাদের শর্ত ছিলো এই যে , মূল ফার্সীতে যা আছে তা হুবহু ও নির্ভুলভাবে অনুবাদ করা হবে এবং অনুবাদকের দৃষ্টিতে মূল গ্রন্থে কোনো দুর্বলতা বা ত্রুটি ধরা পড়লে সে সম্বন্ধে নোট আকারে স্বতন্ত্রভাবে লিখে অনুবাদ-প্রকাশকের গোচরে আনতে হবে যাতে তা মূল গ্রন্থের লেখকদের জানানো হয়। এ শর্ত অনুযায়ী কাজ আঞ্জাম দেয়া হয়। কিন্তু যেহেতু দু একটি বিষয় এমন ছিলো যে , তা কেবল রচনাশৈলীর দুর্বলতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না , বরং প্রকাশিত মতামত সঠিক বা ভুল হওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলো , আর তা কেবল উক্ত তাফসীরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না , সেহেতু সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমার মতামত মনীষী ও চিন্তাশীল পাঠক-পাঠিকাদের গোচরে আনার প্রয়োজন অনুভব করছি। এ সব বিষয়ের অন্যতম হচ্ছে সৃষ্টিকুল সম্বন্ধে , বিশেষ করে সৃষ্টিকুলের ভবিষ্যত সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞান।

১৩৭২ ইরানী সালের বসন্তকালে প্রকাশিত উক্ত তাফসীরের প্রথম খণ্ডের ৪৮৯ নং পৃষ্ঠায় সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহর ১৪৩ নং আয়াত( وَمَا جَعَلْنَا الْقِبْلَةَ الَّتِي كُنْتَ عَلَيْهَا إِلا لِنَعْلَمَ مَنْ يَتَّبِعُ الرَّسُولَ مِمَّنْ يَنْقَلِبُ ) عَلَى عَقِبَيْهِ -এর ব্যাখ্যায়تفسیر جمله لنعلم উপশিরোনামে বলা হয়েছে:

আলোচ্য আয়াতেلنعلم (যাতে আমি জানতে পারি) কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। কোরআন মজীদে এ ধরনের আরো কিছু কথা বার বার ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এর মানে এ নয় যে , আল্লাহ্ তা আলা ঐ সময় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানতেন না এবং পরে অবগত হয়েছেন। বরং এরূপ ক্ষেত্রে জানা মানে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বাস্তবতাটি কার্যতঃ সংঘটিত হওয়া।

ব্যাখ্যা: আল্লাহ্ তা আলা অনাদি কাল থেকেই সমস্ত সৃষ্টির সমস্ত ভবিষ্যত ঘটনাবলী সম্বন্ধে অবগত যদিও তা ক্রমান্বয়ে অস্তিত্বলাভ করে বা সংঘটিত হয়। অতএব , ঘটনাবলীর সংঘটিত হওয়া ও সৃষ্টিসমূহের অস্তিত্বলাভ আল্লাহ্ তা আলার ইলমে কিছু যোগ করে না , বরং তিনি পূর্ব থেকেই যা জানতেন তা-ই এভাবে বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করে। এর তুলনা হচ্ছে এই যে , একজন স্থপতি একটি ভবনের নকশা তৈরী করলেন এবং এর ছোট-বড় ও খুঁটিনাটি সব কিছুই তিনি এটি নির্মিত হওয়ার আগেই জানেন। এরপর তিনি ক্রমান্বয়ে এ নকশাটির বাস্তবায়ন করেন। উক্ত স্থপতি যখন নকশাটির অংশবিশেষ বাস্তব রূপ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তখন তিনি বলেন , এ কাজটি এ উদ্দেশ্যে করছি যে , যা আমি করতে চাচ্ছিলাম তা বাস্তবে দেখতে পারি। অর্থাৎ আমার জ্ঞানে যে নকশা রয়েছে তাকে বাস্তবে রূপায়িত করবো। (আমরা আল্লাহ্ তা আলার গুণাবলী সংক্রান্ত আলোচনায় যেমন বলেছি , নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞান ও মানুষের জ্ঞানের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে ; এখানে উপমা দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিষয়টিকে সুস্পষ্টতর করা।) [উদ্ধৃতি সমাপ্ত]

এ বিষয়ে প্রায় সকল তাফসীরেই মোটামুটি একই ধরনের মতামত চোখে পড়ে। কিন্তু কেবল ব্যবহৃত শব্দাবলীর পার্থক্য ছাড়া উপরোক্ত মতের ও জাবারী মতের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কারণ , যদি এমনটাই হয়ে থাকে যে , সৃষ্টিকুলের , বিশেষতঃ মানবকুলের সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী খুটিনাটি সহ আল্লাহ্ তা আলার অনাদি ইলমে মওজূদ থেকে থাকে তাহলে তা সংঘটিত হওয়া অনিবার্য। (তাহলে সৃষ্টিকুলকে স্বীয় কাজের জন্য দায়ী গণ্য করা চলে না।) আর এ মত আমর্ বাইনাল্ আমরাইন্ মতের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।

দৃশ্যতঃ মনে হচ্ছে সৃষ্টিকুলের ভবিষ্যত সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা আলার প্রতি অজ্ঞতা আরোপের ভয় থেকেই উপরোক্ত অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে। আর এ ভয়ের উৎস হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার ইলমের , বিশেষ করে সৃষ্টিকুলের ভবিষ্যত সম্পর্কে তাঁর ইলমের বৈশিষ্ট্যাবলীর প্রতি নির্ভুলভাবে মনোযোগ (توجه ) প্রদানে ব্যর্থতা।

উক্ত তাফসীরে ব্যক্ত উপরোক্ত অভিমতটি যে ভুল তার অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে এই যে , একজন ফাছ্বীহ্ ও বালীগ্ব্ বক্তা বা লেখক স্বীয় বক্তব্যে ঠিক সেই সব শব্দ ব্যবহার করেন যা তাঁর উদ্দেশ্যকে নির্ভুলভাবে বুঝানোর জন্য উপযোগী। সুতরাং এখানে আল্লাহ্ তা আলার উদ্দেশ্য যদি বাস্তবতা কার্যতঃ সংঘটিত হওয়া হতো তাহলে তিনি জেনে নেয়া কথাটি ব্যবহার করতেন না।

দ্বিতীয়তঃ আমরা যদি ধরে নেই যে , উপরোক্ত মতটি সঠিক তাহলে প্রশ্ন জাগে যে , আল্লাহ্ তা আলা কি এটাই চাচ্ছিলেন যে , তিনি স্বয়ং যা তাঁর অনাদি ইলমে স্বীয় বান্দাদের জন্য নির্ধারণ করে রেখেছিলেন-যাতে তাঁর আদেশ-নিষেধের ব্যাপারে কারো কারো ফরমানবরদারী ও কারো কারো নাফরমানী শামিল রয়েছে- বাস্তবতা কার্যতঃ সংঘটিত করবেন ? সে ক্ষেত্রে বান্দাহদের দায়িত্বশীলতা কী ?

তৃতীয়তঃ ভবিষ্যতের সমস্ত কিছুই যদি আল্লাহ্ তা আলার অনাদি ইলমে শামিল থেকে থাকে তাহলে কেবল যে স্বীয় কর্মের জন্য বান্দাহদের কোনোই দায়-দায়িত্ব থাকা উচিত নয় শুধু তা-ই নয় , বরং স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার জন্যও আর করণীয় কিছুই থাকার কথা নয়। কারণ , সৃষ্টিকুলের ভবিষ্যত সম্বন্ধে যা কিছুই তাঁর অনাদি ইলমে ছিলো তা-ই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যথাসময়ে বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করবে। সুতরাং সে ক্ষেত্রে তাঁর জন্য নতুন কোনো কাজের বা নতুন কোনো ইচ্ছারই অবকাশ থাকে না। আর ইয়াহূদীরা যে বলতোيد الله مغلولة (আল্লাহর হাত সংবদ্ধ) মূলে হয়তো তা এ অর্থেই ছিলো , অথচ প্রকৃত ব্যাপার হলো এই যে , আল্লাহ্ তা আলার ইচ্ছাকরণ ও সৃষ্টিকর্ম সম্পাদন (خلاقِيت ) চিরন্তন এবং তা কখনোই সমাপ্ত হবে না।

এখানে যা সঠিক বলে মনে হয় তা হচ্ছে , আমরা আমাদের নিজেদের অনুভূতির ভিত্তিতে যে বলি , অতীতে সৃষ্টিকর্মের সূচনার আগে আল্লাহ্ তা আলা যখন সৃষ্টি করার ইচ্ছা করলেন তিনি যখন তাতে ইচ্ছা করেন যে , তিনি ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতার অধিকারী কতক সৃষ্টিকে , বিশেষ করে মানুষকে সৃষ্টি করবেন-যারা আল্লাহ্ তা আলার গুণাবলীর অধিকারী (যদিও সীমিত মাত্রায়) হবে এবং এ কারণে তারা নিজেদের ও বিশ্বজগতের ওপর প্রভাবের (ক্রিয়ার) অধিকারী হবে সেহেতু যদিও ফেরেশতাকুল , প্রাকৃতিক বিধিবিধান ও সৃষ্টিকর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্যর প্রশ্নে তাঁর তাওয়াজ্জুহ্ অকাট্যভাবে সংশ্লিষ্ট হয় , কিন্তু ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতার অধিকারী সৃষ্টিনিচয়ের ভবিষ্যত ইচ্ছা ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রটির আওতাভুক্ত কতক বিষয়ে তিনি তাঁর তাওয়াজ্জুহকে বিকল্প সহকারে বা শর্তাধীনতা সহকারে সংশ্লিষ্ট করেন। অর্থাৎ তাঁর ইচ্ছার সংশ্লিষ্টতা এরূপ যে , ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতার অধিকারী সৃষ্টিসমূহ (যে সৃষ্টি যে পরিমাণেই তার অধিকারী হোক না কেন) যদি অমুক কাজ সম্পাদন করে তাহলে অমুক ফল সংঘটিত হবে এবং যদি অমুক (অন্য একটি) কাজ সম্পাদন করে তাহলে অমুক (অন্য একটি) ফল সংঘটিত হবে। আর আল্লাহ্ তা আলা কর্তৃক ইচ্ছাকরণের পর থেকে এটাই বিলুপ্তি ও স্থিতির লাওহে (لوح محو و اثبات ) মওজূদ্ ছিলো । ফলে বান্দাহ্ যখন ঐ বিকল্প সম্ভাবনার মধ্য থেকে কোনো একটি কাজ আঞ্জাম দেয় তখন থেকে পরবর্তী সময়ের জন্য তা ও তার প্রভাব (ক্রিয়া) সমূহ স্থিতি লাভ করে। আর এ শর্তাধীনতা কেবল দু টি সম্ভাবনার মধ্যে সীমিত থাকে না , বরং অনেক বিষয়েই দুই-এর অধিক সম্ভাবনা , বরং বিপুল সংখ্যক সম্ভাবনা নিহিত থাকে। দৃশ্যতঃ মনে হয় যে , আমরা নিঃশর্তভাবে ভবিষ্যত বলে যা বুঝিয়ে থাকি আল্লাহ্ তা আলা তার বিরাট অংশকেই স্বীয় অকাট্য ও অপরিবর্তনীয় তাওয়াজ্জুহর বাইরে শর্তাধীন ও পরিবর্তনীয়রূপে রেখে দিয়েছেন। আর ভবিষ্যত -এর এ অংশে অনবরত আল্লাহ্ তা আলার ইচ্ছা নতুন সৃষ্টি (خلق جديد )-এর প্রতি সংশ্লিষ্ট হতে থাকে , তেমনি ভবিষ্যত -এর ঐ অংশের অংশবিশেষ ইচ্ছা ও স্বাধীনতার অধিকারী সৃষ্টিসমূহের ইচ্ছা ও স্বাধীনতা জাত ক্রিয়াকাণ্ডের প্রভাবের দ্বারা নির্ণীত হয়ে থাকে।

আল্লাহ্ তা আলা যখন এরশাদ করেন:إِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ وَيَأْتِ بِخَلْقٍ جَدِيد - তিনি যদি চান তো তোমাদেরকে অপসারিত করে দেবেন এবং একটি নতুন সৃষ্টি নিয়ে আসবেন। (সূরাহ্ ইবরাহীম্: ১৯ ও সূরাহ্ আল্-ফাত্বের: ১৬) তখন এর মানে হচ্ছে এই যে , মানব প্রজাতিকে অপসারিত করা বা না করার প্রতি এবং তার স্থলে কোনো (অনির্দিষ্ট) নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করা বা না করার প্রতি আল্লাহ্ তা আলার ইচ্ছা ও তাওয়াজ্জুহ্ এখনো সংশ্লিষ্ট হয় নি।

এখানে উল্লেখ্য যে , কালের প্রবাহে ইচ্ছা ও স্বাধীনতার অধিকারী সৃষ্টিসমূহের এখতিয়ারাধীন বিষয়াদিতে আল্লাহ্ তা আলার হস্তক্ষেপের বিষয়টিও এ পর্যায়ের বলে মনে হয়। এর মানে হচ্ছে , ইচ্ছা ও স্বাধীনতার অধিকারী সৃষ্টিসমূহের এখতিয়ারাধীন বিষয়াদিতে আল্লাহ্ তা আলার হস্তক্ষেপের বিষয়টি আল্লাহ্ তা আলার অনাদি জ্ঞানে নীতিগতভাবে কিন্তু অনির্দিষ্টভাবে নিহিত রয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা আলা যদি চান তাহলে তিনি ব্যক্তি বা সমষ্টির কল্যাণে বা সৃষ্টিলক্ষ্যের স্বার্থে সৃষ্টিকুলের এখতিয়ারাধীন বিষয়াদিতে ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করেন ও করবেন , কিন্তু সেই শুরুতেই অর্থাৎ অনাদিকালে এর বিস্তারিত বিষয়াদিতে ও সুনির্দিষ্টভাবে তাঁর অনাদি ইচ্ছা ও তাওয়াজ্জুহ্ সংশ্লিষ্ট হয় নি। তেমনি তাঁর অনাদি ইলমে নীতিগতভাবে ও সাধারণভাবে কিন্তু অনির্দিষ্টরূপে নিহিত ছিলো যে , ইচ্ছা ও স্বাধীনতা সহ আল্লাহ্ তা আলার গুণাবলীর অধিকারী এমন সৃষ্টিনিচয়ের মধ্য থেকে কতক দুর্বল (নৈতিক-চারিত্রিক দিক থেকে) সৃষ্টি অবশ্যই এ সব গুণের অপব্যবহার করবে , কিন্তু তাঁর ইলম্ ও তাওয়াজ্জুহ্ এর বিস্তারিত রূপের প্রতি অর্থাৎ ঠিক কোন্ কোন্ ব্যক্তি এ অপব্যবহার করবে তার প্রতি সংশ্লিষ্টতা লাভ করে নি। উদাহরণস্বরূপ , হযরত ইমাম হুসাইন্ ( আঃ)-এর ঘাতক কে হবে আল্লাহর অনাদি ইলমে তা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত ছিলো না , কিন্তু কালের প্রবাহে বান্দাহদের দ্বারা স্বেচ্ছায় ও স্বাধীনভাবে পথ বেছে নেয়ার পরিণামে তা অসংখ্য সম্ভাবনার মধ্য থেকে কয়েকটি পরস্পর বিকল্প সম্ভাবনায় সীমিত হয়ে যায় এবং পরে সম্ভবতঃ দুই সম্ভাবনার মধ্য থেকে নিশ্চিত হয়ে যায় যে , ঐ ব্যক্তি হবে শীমার। তেমনি এ ঘটনা সংঘটিত হবার স্থান ও সময় এবং অন্যান্য খুটিনাটি বিস্তারিত বিষয় অসংখ্য পরস্পর বিকল্প সম্ভাবনার মধ্য থেকে কালের প্রবাহে ক্রমান্বয়ে সীমিত হতে হতে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হয়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করতে হয় যে , এ বিষয়ে তাফ্সীরে নামুনের উপস্থাপিত ধারণার (অর্থাৎ জানা বলতে বাস্তব রূপ প্রদান বুঝানো হয়েছে-এ দাবীর) সমর্থনে অন্যত্র কোরআন মজীদ থেকে প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে।

যেহেতু আল্লাহ্ তা আলা সব কিছু জানেন তাহলে পরীক্ষা কী জন্য ? -এ প্রশ্নের জবাবে উক্ত তাফসীরের উক্ত খণ্ডের ৫২৭ নং পৃষ্ঠায় সূরাহ্ আালে ইমরানের ১৫৪ নং আয়াতের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে , পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্তরসমূহের মধ্যে যা কিছু আছে এবং আল্লাহ্ তা আলা অবগত আছেন-তাকে সুস্পষ্ট করে দেয়া।

এখানে দৃশ্যতঃ অভিন্ন এমন বিভিন্ন শব্দ (اشتراک لفظی ) থেকে ভুলের উদ্ভব হয়েছে। কারণ , সমস্ত রকমের পরীক্ষার প্রকৃতি ও তাৎপর্য অভিন্ন নয়। সৃষ্টির অন্তঃকরণে যা লুক্কায়িত আছে তাকে সুস্পষ্ট করার লক্ষ্যে পরীক্ষা এবং সৃষ্টির অন্তঃকরণে এখনো যা ইচ্ছা হিসেবে সুনির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে নি তাকে সুনির্দিষ্ট হবার পথে এগিয়ে দেয়ার জন্য পরীক্ষা অভিন্ন নয়। প্রথম ক্ষেত্রে জানার জন্য পরীক্ষা বলতে জানা মানে যা বান্দাহর অন্তঃকরণে আছে এবং আল্লাহ্ জানেন তা সুস্পষ্ট করা বা অন্য কথায় , বাস্তবে রূপায়িতকরণ -এ তাৎপর্য সঠিক তাৎপর্য। কিন্তু দ্বিতীয় বিষয়টির ক্ষেত্রে জানা থেকে এরূপ তাৎপর্য গ্রহণ করার উপায় নেই।

আলোচ্য বিষয়ে তাফ্সীরে নামুনে-র প্রণেতাদের কাছে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে , সৃষ্টিকুলের অন্তঃকরণ সমূহে যা কিছু আছে এবং যা আল্লাহ্ তা আলা জানতেন ও এখন প্রকাশিত করে দিতে চাচ্ছেন তা কি তাঁর অনাদি ইলমে হুবহু এ রকমই ছিলো , নাকি তা শর্তাধীন ছিলো বা , অন্য কথায় , তা বিলোপ ও স্থিতি লাওহে (لوح محو و اثبات ) নিহিত ছিলো ? তা যদি তাঁর অনাদি ইলমে হুবহু এ রকমই থেকে থাকে তাহলে অনিবার্যভাবেই তা জাবারী বিষয় , সুতরাং এরূপ বিষয়ের জন্য বান্দাহদেরকে দায়ী গণ্য করা যেতে পারে না। প্রকৃত ব্যাপার হলো এই যে , বান্দাহ্ যতক্ষণ একটি বিষয়ে তার অন্তরে ইচ্ছা না করে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ্ তা আলার ইলমে তা বিলোপ ও স্থিতি (محو و اثبات ) রূপে ছিলো। কারো হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়াও এ পর্যায়ভুক্ত। অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনো ব্যক্তির দুশমনদের স্বেচ্ছাকৃত সিদ্ধান্ত সমূহ সহ বিভিন্ন কারণের প্রভাবে ভবিষ্যতে ঐ ব্যক্তির নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এ বিষয়টি আল্লাহ্ তা আলার ইলমে-ও বিলোপ ও স্থিতি (محو و اثبات ) রূপে ছিলো।

এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি যে , এমনকি আল্লাহ্ তা আলার অনাদি ইলমে বেহেশতীদের ও দোযখীদের অনন্তকালীন বেহেশতী ও দোযখী জীবনের বিষয়টিও নিরঙ্কুশ বা নিঃশর্ত নয় , বরং তা শর্তাধীন সম্ভাবনা হিসেবে নিহিত রয়েছে। এ কারণে আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন:

( فَأَمَّا الَّذِينَ شَقُوا فَفِي النَّارِ لَهُمْ فِيهَا زَفِيرٌ وَشَهِيقٌ. خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالأرْضُ إِلا مَا شَاءَ رَبُّكَ إِنَّ رَبَّكَ فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ. وَأَمَّا الَّذِينَ سُعِدُوا فَفِي الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالأرْضُ إِلا مَا شَاءَ رَبُّكَ عَطَاءً غَيْرَ مَجْذُوذٍ)

অতএব , যারা হতভাগ্য হবে তারা দোযখে যাবে এবং তারা অর্তনাদ করতে ও দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকবে ; তারা চিরদিন তথা যতদিন আসমান সমূহ ও পৃথিবী টিকে থাকবে ততদিন সেখানে থাকবে যদি না (হে রাসূল!) আপনার রব অন্যথা ইচ্ছা করেন। নিঃসন্দেহে আপনার রব সদা সর্বদাই যা কিছু ইচ্ছা করেন তা-ই সম্পাদনকারী। আর যারা সৌভাগ্যের অধিকারী হবে তারা জান্নাতে যাবে: তারা চিরদিন তথা যতদিন আসমান সমূহ ও পৃথিবী টিকে থাকবে ততদিন সেখানে থাকবে যদি না (হে রাসূল!) আপনার রব অন্যথা ইচ্ছা করেন। (নচেৎ) এ দান সমাপ্ত হবার নয়। (সূরাহ্ হূদ্: ১০৬-১০৮)

অত্র আলোচনার সমাপ্তি পর্যায়ে আল্লাহর ইলম্-এ কিছু বৃদ্ধি না হওয়া বিষয়ক অভিমত প্রসঙ্গে বলতে হয় যে , আল্লাহ্ তা আলার সত্তাগত ছ্বিফাত্ রূপ ইলম্ ও ইচ্ছা এবং তাঁর সত্তা অভিন্ন , সুতরাং আল্লাহ্ তা আলার এ ইলম্ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ , এ ক্ষেত্রে তিনি স্বীয় সত্তা সম্বন্ধে সদা অবগত। কিন্তু সৃষ্টিনিচয় সম্বন্ধে তাঁর ইচ্ছা ও ইলম্ হচ্ছে কর্তাবাচক (فاعلی ), আর তাঁর এই কর্তাবাচকতা তথা ইচ্ছা ও ইলম্-এর সক্রিয়তা (فاعليت ) হচ্ছে একটি অব্যাহত সম্পর্ক ; এটা কোন বার বিশিষ্ট (دفعی ) ক্রিয়া নয় যে , তাঁর এ ধরনের ইচ্ছা একবার সক্রিয় হয়ে এরপর নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে বা আর অস্তিত্বশীল থাকবে না। অন্যদিকে সৃষ্টিকরণ রূপ ক্রিয়া সম্পর্কে তাঁর কর্তাবাচক ইলম্ (علم فاعلی ) সংশ্লিষ্ট সৃষ্টিকে সৃষ্টিকরণের ইচ্ছার অভিন্ন সময়ের , তাঁর কর্তাবাচক ইচ্ছার (اراده فاعلی ) অগ্রগামী নয়। সুতরাং তিনি যখন বলেন: যদি আল্লাহ্ চান তখন তার মানে হচ্ছে এই যে , তিনি যা চাওয়া বা না চাওয়া (যেহেতু বলেছেন যদি ) সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন তা যদি চান সে ক্ষেত্রে সে সম্পর্কে তা চাওয়ার তথা ইচ্ছা করার অভিন্ন সময়ে জানবেন , তা চাওয়ার তথা ইচ্ছা করার আগে নয়। তেমনি ইচ্ছাশক্তির অধিকারী সৃষ্টিনিচয় কর্তৃক ইচ্ছাকরণ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা আলার কর্তাবাচক ইলম্ (علم فاعلی )-ও এ পর্যায়েরই অর্থাৎ ইচ্ছাশক্তির অধিকারী কোনো সৃষ্টি যখন কোনো কিছু ইচ্ছা করে তখন অভিন্ন সময়েই আল্লাহ্ তা আলা সে সম্বন্ধে অবগত হন , না তার আগে , না তার পরে। কারণ , ইচ্ছাকারীর তুলনায় তাঁর অবগতি বিলম্বিত হওয়ার (সেকেণ্ডের কোটি ভাগের এক ভাগ হলেও) তথা পরে অবগত হবার প্রশ্নই উঠতে পারে না , অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট সৃষ্টি কর্তৃক ইচ্ছা করার আগে তা অবগত না হওয়ার কারণ এই যে , তিনি স্বেচ্ছায় সৃষ্টিনিচয়ের ভবিষ্যত ইচ্ছার প্রতি তাওয়াজ্জুহ্ করা থেকে বিরত থাকেন। কারণ , তিনি তাওয়াজ্জুহ্ করলে তা আর সৃষ্টির ইচ্ছাধীন থাকবে না , বরং অনিবার্য-তে পরিণত হয়ে যাবে।

অবশ্য বিভিন্ন কারণের প্রভাবে যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ভবিষ্যতে কোনো একটি বিষয় ইচ্ছাকরণ নিশ্চিত হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলা তা নিশ্চিত হওয়ার সমসময়ে জানবেন যদিও ঐ ব্যক্তি তখনো তা ইচ্ছা করে নি। কিন্তু এরূপ ক্ষেত্রে আমরা প্রচলিত কথায় ঐ ব্যক্তির প্রতি ইচ্ছাকরণ আরোপ করলেও এ ক্ষেত্রে বিষয়টি তার ইচ্ছাধীন বিষয় নয় , বরং অন্যান্য কারণ দ্বারা তার জন্য ইচ্ছাকরণ নিশ্চিত করার কারণে তা আর স্বাধীন ইচ্ছা থাকে নি এবং প্রকৃত অর্থে ইচ্ছা মানে হচ্ছে স্বাধীন ইচ্ছা ; যে ইচ্ছাকরণে বাধ্য করা হয়েছে (তা যে বা যারাই বাধ্য করে থাকুক না কেন) তা প্রকৃত ইচ্ছা নয়। আর এ বিষয়টি আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। তবে লক্ষ্যণীয় যে , এ ক্ষেত্রেও ঐ ব্যক্তির ইচ্ছাকরণের বিষয়টি আল্লাহ্ তা আলার অনাদি ইলমে নিহিত ছিলো না , বরং বিভিন্ন কারণ তার ইচ্ছাকরণকে নিশ্চিত করে তোলার সমসময়েই তা আল্লাহ্ তা আলার কর্তাবাচক ইলমে (علم فاعلی ) সংশ্লিষ্ট হয় , যদিও এ বিষয়ে আল্লাহ্ তা আলার ইলম্ ব্যক্তিটির তথাকথিত ইচ্ছাকরণ-এর (এ জন্য তথাকথিত যে , সে বাধ্য হয়ে ইচ্ছা করেছে) তুলনায় অগ্রগামী।

সংক্ষেপে: আল্লাহ্ তা আলার ইচ্ছা ও সৃষ্টিকরণ সর্বকালীন এবং এ ক্ষেত্রেও তিনি যে কোনো রকমের শর্তাধীনতা ও সীমাবদ্ধতা থেকে পরম প্রমুক্ত। ভবিষ্যতের যে বিষয়টি বর্তমানে অস্তিত্বহীন ও ভবিষ্যতে যার অস্তিত্বলাভও অনিশ্চিত আল্লাহ্ তা আলা যখন তার প্রতি তাওয়াজ্জুহ্ করেন নি তখন কী করে তাঁর প্রতি সে সম্বন্ধে অজ্ঞতা আরোপ করা যেতে পারে ? কারো প্রতি ভবিষ্যতের কোনো কিছু সম্বন্ধে কেবল তখনই অজ্ঞতা আরোপ করা যেতে পারে যখন তার সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি অনিবার্য হয় , অথচ ঐ ব্যক্তির বিষয়টি জানা না থাকে। তেমনি একাধিক সম্ভাবনা বিশিষ্ট ভবিষ্যত সম্বন্ধে-যার কোনো সম্ভাবনাটিরই বাস্তব রূপ লাভ নিশ্চিত নয়-তিনি যখন তার সবগুলো সম্ভাবনা সম্বন্ধেই অবগত থাকেন এবং কোনো সম্ভাবনার ভবিষ্যত বাস্তব রূপায়ন নিশ্চিত না থাকা সম্বন্ধেও অবগত থাকেন সে ক্ষেত্রেই বা কী করে বলা চলে যে , তিনি জানেন না ? তিনি যে , বলেছেন যে , তিনি এখনো জানেন না। -এর মানে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিষয়টির ভবিষ্যত দুই বা বহু সম্ভাবনার মধ্য থেকে কোনোটিরই বাস্তব রূপায়ন এখনো নিশ্চিত হয় নি এবং তিনি নিজেও উক্ত দুই বা বহু সম্ভাবনার মধ্য থেকে কোনো একটির প্রতি তাওয়াজ্জুহ্ করতে চান না।

স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির কর্ম আরোপ

কোরআন মজীদের বিরাট সংখ্যক আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে , আল্লাহ্ তা আলা মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা প্রদান করেছেন। কিন্তু কিছু কিছু আয়াতে একই কাজ একই সাথে সৃষ্টির প্রতি এবং আল্লাহ্ তা আলার প্রতি আরোপ করা হয়েছে। অন্যদিকে কতক আয়াতে সৃষ্টির কাজকে আল্লাহ্ তা আলার প্রতি আরোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে যারা প্রথম ও দ্বিতীয় ধরনের আয়াতের প্রতি মনোযোগ দেন না তাঁরা শেষোক্ত ধরনের আয়াত থেকে এরূপ উপসংহারে উপনীত হন যে , সমগ্র অস্তিত্বলোকে একমাত্র আল্লাহ্ তা আলা ছাড়া আর কোনো কর্মসম্পাদনকারী নেই। অন্যদিকে অনেকে দ্বিতীয়োক্ত ধরনের আয়াত থেকে দোদুল্যমান অবস্থার শিকার হন এবং ভেবে পান না যে , সৃষ্টিকুল যে সব কাজ সম্পাদন করে থাকে কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে তা কি তাদেরই কাজ , নাকি আল্লাহ্ তা আলার কাজ ?

এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে , কোরআন মজীদ একদিকে যেমন সকল জ্ঞানের আধার এবং সে হিসেবে এতে ব্যাপকতম , সূক্ষ্মতম ও গভীরতম সকল জ্ঞানের সমাহার ঘটেছে , অন্যদিকে তা সাহিত্যিক মানের দিক থেকেও ব্যাপকতম , সূক্ষ্মতম ও গভীরতম ভাব প্রকাশক। কোরআন মজীদ যে সব বৈশিষ্ট্যের কারণে মু জিযাহ্ তার মধ্যে এ দু টি বৈশিষ্ট্য অন্যতম।

বস্তুতঃ কোরআন মজীদ কোনো সাহিত্য বা কাব্যগ্রন্থ নয় , বরং এটি হচ্ছে তত্ত্ব , তথ্য , আইন , উপদেশ ও নৈতিক শিক্ষার সমাহার। তা সত্ত্বেও এটি কোনো বিশালায়তন গ্রন্থের রূপ পরিগ্রহ করে নি। অন্যদিকে এসব বিচিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ , বিশেষ করে গুরুভার বিষয়বস্তু সম্বলিত মানব রচিত একটি গ্রন্থ সুখপাঠ্য হওয়া একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু কোরআন মজীদ এসব বিষয়বস্তু সত্ত্বেও একটি সুখপাঠ্য গ্রন্থ যার ভাষা যেমন প্রাঞ্জল ও গতিশীল , তেমনি তার সাহিত্যিক ভাবধারা ও বৈশিষ্ট্য মানবিক প্রতিভার উর্ধে। এ কারণেই এতে এমন অনেক আয়াত রয়েছে যা ভাবার্থবাচক। সৃষ্টির কাজকে স্রষ্টার ওপর আরোপ করাও এ ধরনের ভাবার্থবাচক আয়াতের অন্তর্ভুক্ত যার মধ্যে গভীর চিন্তার খোরাক ও তত্ত্বজ্ঞান নিহিত রয়েছে। এখানে উদাহরণ স্বরূপ এ ধরনের কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হলো।

এরশাদ হয়েছে:

( وَإِذَا أَرَدْنَا أَنْ نُهْلِكَ قَرْيَةً أَمَرْنَا مُتْرَفِيهَا فَفَسَقُوا فِيهَا فَحَقَّ عَلَيْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنَاهَا تَدْمِيرًا)

আর আমি যখন কোনো জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি তখন তার সম্পদশালী লোকদেরকে আদেশ দেই , অতঃপর তারা সেখানে পাপাচার করে , ফলে তার (ঐ জনপদের) জন্য (ধ্বংসের) উক্তি অবধারিত হয়ে যায় , অতঃপর আমি তাকে (ঐ জনপদকে) ধ্বংস করে দিই ঠিক যেভাবে ধ্বংস করা উচিত। (সূরাহ্ আল্-ইসরা / বানী ইসরাঈল: ১৬)

বলা বাহুল্য যে , এখানে আদেশ দান বলতে পাপাচারের সুযোগ রুদ্ধ না করা এবং এজন্য প্রাকৃতিক বিধিবিধানকে সহায়ক রাখা। নয়তো আল্লাহ্ তা আলা কখনোই পাপের আদেশ দেন না। বরং কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভালো গুণ ও সংশোধনের সম্ভাবনা নিহিত থাকা সত্ত্বেও মানবিক দুর্বলতা বশে তারা পাপের দিকে অগ্রসর হলে আল্লাহ্ তা আলা বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক ও মানবিক বাধাবিঘ্ন ও বিপদাপদ সৃষ্টি করে তাদের পাপপ্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করেন। কিন্তু কোনো জনগোষ্ঠী যখন পাপাচার ও আল্লাহ্ তা আলার নাফরমানীর ব্যাপারে বেপরোয়া হয়ে ওঠে তখন আল্লাহ্ তা আলা তাদের পাপাচারের পথে বাধা সৃষ্টি করেন না। ফলে তারা পাপাচারে অধিকতর বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং ধ্বংসের উপযুক্ত হয়ে যায়। একেই আল্লাহ্ তা আলা ভাবার্থে তাঁর আদেশ বলে অভিহিত করেছেন।

অনুরূপভাবে বানী ইসরাঈলের নাফরমানী ও সে কারণে তাদেরকে শাস্তিদান প্রসঙ্গে তাদের উদ্দেশে সতর্কীকরণমূলক ভবিষ্যদ্বাণী উদ্ধৃত করে এরশাদ হয়েছে:

( وَقَضَيْنَا إِلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ فِي الْكِتَابِ لَتُفْسِدُنَّ فِي الْأَرْضِ مَرَّتَيْنِ وَلَتَعْلُنَّ عُلُوًّا كَبِيرًا فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ أُولَاهُمَا بَعَثْنَا عَلَيْكُمْ عِبَادًا لَنَا أُولِي بَأْسٍ شَدِيدٍ فَجَاسُوا خِلَالَ الدِّيَارِ و.... فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ الْآخِرَةِ لِيَسُوءُوا وُجُوهَكُمْ وَلِيَدْخُلُوا الْمَسْجِدَ كَمَا دَخَلُوهُ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَلِيُتَبِّرُوا مَا عَلَوْا تَتْبِيرًا)

আর আমি বানী ইসরাঈলের উদ্দেশে কিতাবে ফয়সালা করে দিয়েছিলাম যে , অবশ্যই তোমরা ধরণীর বুকে দুই বার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং অবশ্যই তোমরা গুরুতর ধরণের ঔদ্ধত্যের পরিচয় দেবে। অতঃপর যখন সেই দু টি প্রতিশ্রুতির প্রথমটি এলো তখন আমি তাদের বিরুদ্ধে আমার কঠোর যোদ্ধা বান্দাহদের পাঠালাম যারা সে জনপদের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়লো (এবং তাদেরকে হত্যা করলো।) অতঃপর যখন অপর প্রতিশ্রুতিটি(-এর সময়) সমুপস্থিত হলো তখন তারা (আমার প্রেরিত বান্দাহরা) তোমাদের চেহারা বিকৃত করে দিলো এবং প্রথম বার যেভাবে প্রবেশ করেছিলো সেভাবেই মসজিদে প্রবেশ করলো এবং যেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলো সেখানেই সর্বাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ চালালো। (সূরাহ্ আল্-ইসরা /বানী ইসরাঈল: ৪ , ৫ ও ৭)

এখানে কিতাবে ফয়সালা করে দেয়া মানে বানী ইসরাঈলের মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা ও অন্যান্য কার্যকারণের আলোকে অবধারিত হয়ে যাওয়া ভবিষ্যত সম্পর্কে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাবে (তাওরাতে) ভবিষ্যদ্বাণী ; বিনা কারণে স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারণ করে দেয়া নয়-এটা আমাদের ইতিপূর্বেকার আলোচনা সমূহ থেকে সুস্পষ্ট। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে , উপরোক্ত হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ মুশরিক বাহিনী দ্বারা সংঘটিত হয়েছিলো। কিন্তু আল্লাহ্ তা আলা তাদেরকে স্বীয় কঠোর যোদ্ধা বান্দাহ্ বলে এবং তাদেরকে তিনিই পাঠিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন , যদিও তারা তাদের পররাজ্যগ্রাস ও সম্পদলিপ্সার লক্ষ্যেই এ অভিযান চালিয়েছিলো এবং মসজিদুল আক্বছা -কেও ধ্বংস করেছিলো। যেহেতু বানী ইসরাঈল পাপাচারে লিপ্ত হওয়ায় ও আল্লাহ্ তা আলার নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করায় একদিকে আল্লাহর শাস্তির উপযুক্ত হয়ে গিয়েছিলো অন্যদিকে নৈতিক অধঃপতনের কারণে তাদের বীর্যবত্তা ও প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছিলো , সেহেতু মুশরিক দুশমনরা তাদের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে সাহসী হয়ে উঠেছিলো। আর এভাবে বানী ইসরাঈল তাদের পাপাচার ও সীমালঙ্ঘনের পার্থিব শাস্তি লাভ করেছিলো। তাই আল্লাহ্ তা আলা আক্রমণকারীদেরকে তাঁর নিজস্ব বাহিনী বলে অভিহিত করেন। বিশেষ করে সমগ্র সৃষ্টিলোকের সব কিছুই আল্লাহ্ তা আলার নির্ধারিত প্রাকৃতিক বিধানের আওতায় এবং মানুষকে তাঁরই দেয়া স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতার ব্যবহারের ফলে এ ধরনের ঘটনাবলী সংঘটিত হয়ে থাকে তাই ব্যাপকতর অর্থে এ কাজ তিনিই করেছেন বলে বলা যেতে পারে। কারণ , তিনি যদি চাইতেন যে , এ কাজ না হোক তাহলে তা হতো না।

আল্লাহ্ তা আলা অন্যত্র এরশাদ করেন:

( وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا)

আর , একদল লোক দ্বারা অপর এক দলকে আল্লাহর পক্ষ থেকে দমন করা না হলে খৃস্টানদের গীর্জা ও মঠ , ইয়াহূদীদের ইবাদতখানা এবং মসজিদ সমূহ-যাতে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়-ধ্বংস হয়ে যেতো। (সূরাহ্ আল্-হাজ্ব: ৪০)

বলা বাহুল্য যে , এ হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টিব্যবস্থাপনার অন্যতম প্রাকৃতিক বিধি যার আওতায় জাতি সমূহের উত্থান-পতন সংঘটিত হয়। এজন্য এটা অপরিহার্য নয় যে , সংঘাতে লিপ্ত পক্ষদ্বয়ের একটি অথবা আক্রমণকারী পক্ষ অবশ্যই সত্যপন্থী হবে। বরং উভয় পক্ষই বাতিলপন্থী হতে পারে এবং সত্যপন্থীরা এতই দুর্বল হতে পারে যে , তারা কোনো পক্ষ হিসেবে গণ্য হবার পর্যায়ে না-ও থাকতে পারে। এমতাবস্থায় দুই বাতিল পক্ষের সংঘাত ও একের দ্বারা অপরের ধ্বংসসাধনের ফলে সামগ্রিকভাবে বাতিলই দুর্বল হয়ে যায় এবং সেই অবকাশে দুর্বল অবস্থানের অধিকারী সত্যপন্থীদের জন্য অস্তিত্ব বজায় রাখা ও ধীরে হলেও বিকাশ-বিস্তারের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়। যেহেতু এসব সংঘাতের নায়করা আল্লাহ্ তা আলার উদ্দেশ্যকেই বাস্তবায়িত করছে সেহেতু আল্লাহ্ তা আলাই যেন তাদেরকে দিয়ে এ কাজ করাচ্ছেন।

অনুরূপভাবে আল্লাহ্ তা আলা একই কাজকে যেমন ফেরেশতাদের প্রতি আরোপ করেছেন , তেমনি তা তাঁর নিজের প্রতিও আরোপ করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ , আল্লাহ্ তা আলা মানুষের মৃত্যু ঘটানোর কাজ ফেরেশতাদের ( মালায়েকাহ্ বহুবচন বাচক শব্দ) প্রতি আরোপ করেছেন। এরশাদ হয়েছে:

( فَكَيْفَ إِذَا تَوَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ يَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَارَهُمْ)

তখন তাদের (কাফেরদের) অবস্থা কেমন হয় যখন ফেরেশতারা তাদের প্রাণ গ্রহণকালে তাদের চেহারায় ও তাদের পৃষ্ঠদেশে আঘাত করে। (সূরাহ্ মুহাম্মাদ: ২৭)

অপর এক আয়াতে প্রাণ গ্রহণের বিষয়টি মৃত্যুর ফেরেশতার (মালাকুল মাওত্=এক বচন/ আযরাঈল) প্রতি আরোপ করা হয়েছে:

( قُلْ يَتَوَفَّاكُمْ مَلَكُ الْمَوْتِ الَّذِي وُكِّلَ بِكُمْ ثُمَّ إِلَى رَبِّكُمْ تُرْجَعُونَ)

(নবী!) বলে দিন: মৃত্যুর ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ গ্রহণ করবে যাকে তোমাদের (প্রাণ হরণের) দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়েছে। অতঃপর তোমরা তোমাদের রবের দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে। (সূরাহ্ আস্-সাজদাহ্: ১১)

কিন্তু আল্লাহ্ তা আলা একই কাজ অন্যত্র তাঁর নিজের প্রতি আরোপ করেছেন। এরশাদ হয়েছে:

( اللَّهُ يَتَوَفَّى الْأَنْفُسَ حِينَ مَوْتِهَا وَالَّتِي لَمْ تَمُتْ فِي مَنَامِهَا فَيُمْسِكُ الَّتِي قَضَى عَلَيْهَا الْمَوْتَ وَيُرْسِلُ الْأُخْرَى إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى)

আল্লাহ্ নাফ্স্ সমূহকে পরিগ্রহণ করেন তার মৃত্যুর (প্রতিটি নাফসের) মৃত্যুর সময় এবং যে মারা যায় নি তার ঘুমের সময়। অতঃপর , যার ওপর মৃত্যুর ফয়সালা কার্যকর হয়েছে তাকে রেখে দেন এবং অন্যটিকে তার শেষ সময় পর্যন্ত (জীবন ধারণের জন্য পুনরায় ফেরত) পাঠিয়ে দেন। (সূরাহ্ আয্-যুমার: ৪২)

এ থেকে সুস্পষ্ট যে , মানুষের মৃত্যুর সময় প্রাণ গ্রহণের বিষয়টি একটি সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাধীনে সংঘটিত হয়ে থাকে ; কোনো ফেরেশতা বিশেষ বা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন ফেরেশতার দ্বারা নয়। এ ব্যবস্থার শীর্ষপরিচালক ও দায়িত্ব বণ্টনকারী হচ্ছেন একজন ফেরেশতা ; অন্য ফেরেশতারা তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীনে দায়িত্ব পালন করে। তাই এ কাজকে যেমন সরাসরি প্রাণ গ্রহণকারী ফেরেশতার প্রতি আরোপ করা চলে , তেমনি এ ব্যবস্থাপনার পরিচালক মালাকুল মাওতের প্রতিও আরোপ করা চলে। তেমনি এ ব্যবস্থাপনা আল্লাহ্ তা আলা কর্তৃক নির্ধারিত এবং এর মাধ্যমে তাঁরই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয় বিধায় তা আল্লাহ্ তা আলার প্রতিও আরোপ করা চলে। কিন্তু আল্লাহ্ তা আলার প্রতি আরোপ করার মানে এ নয় যে , স্বয়ং আল্লাহ্ই প্রতিটি প্রাণ গ্রহণ করেন এবং ফেরেশতারা প্রাণ গ্রহণের দায়িত্বে নিয়োজিত নয়।

অনুরূপ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বলা হয় যে , সৃষ্টিজগতের সব কিছুই আল্লাহ্ তা আলা করছেন তাহলে ভুল হবে না। কারণ , ফেরেশতা , মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকুল যা কিছু করছে তা আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টি হিসেবে , তাঁরই দেয়া শক্তি ও ক্ষমতা দ্বারা এবং তাঁরই প্রতিষ্ঠিত যান্ত্রিক নিয়মে বা তাঁরই দেয়া স্বাধীন ইচ্ছার সাহায্যে করছে। আল্লাহ্ তা আলা স্বাধীন ইচ্ছা না দিলে মানুষ স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী হতে পারতো না এবং তার সঠিক বা ভুল প্রয়োগের প্রশ্নও উঠতো না। অতএব , এ দৃষ্টিকোণ থেকে সকল কাজই আল্লাহ্ তা আলার কাজ। কিন্তু এ হচ্ছে উঁচু স্তরের ভাববাচক কথা। এর মানে এ নয় যে , মানুষ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতার অধিকারী নয় এবং তাকে দিয়ে যান্ত্রিকভাবে সব কিছু করিয়ে নেয়া হয়। অর্থাৎ এ ধরনের আয়াত থেকে কোনোভাবেই জাবারীয়াহ্ তত্ত্ব প্রমাণিত হয় না। কারণ , ঐ সব আয়াতের ভিত্তিতে জাবারীয়াহ্ তত্ত্বকে সঠিক মনে করা হলে যে সব আয়াত থেকে সৃষ্টির স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা প্রমাণিত হয় সে সব আয়াতকে উপেক্ষা করা হয়।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে , অধীনস্থদের কাজকে উপরস্থ কর্তা বা মালিকের কাজ বলে উল্লেখ করার রীতি মানবিক সমাজেও প্রচলিত রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ , কোনো সরকারের আমলে কোনো বড় ধরনের কাজ সম্পাদিত হলে , যেমন: বড় কোনো সেতু বা মহাসড়ক বা ভবন নির্মিত হলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে বলা হয় যে , অমুক এটি নির্মাণ করেছেন। আবার সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো সংসদ সদস্যের ভূমিকা থাকলে বলা হয় যে , অমুক এমপি এটি বানিয়েছেন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে যখন বলা হয় যে , অমুক এটি নির্মাণ করেছেন , তখন তা থেকে এমপি কর্তৃক তা নির্মাণের দাবীকে অস্বীকার করা হয় না এবং এমপি কর্তৃক নির্মাণের কথা বলার সময় প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তা নির্মাণের দাবীকে অস্বীকার করা হয় না। অন্যদিকে সেটির নির্মাণ প্রক্রিয়ায় একজন মন্ত্রী (ধরুন , যোগাযোগ মন্ত্রী) জড়িত থাকেন এবং এ কারণে তিনি তা নির্মাণ করেছেন বলেও উল্লেখ করা হয়। আবার এ কাজে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর অধীনস্থ বিভিন্ন কর্মকর্তা , ইঞ্জিনীয়ার ও কর্মচারীগণ এতে জড়িত থাকেন বিধায় তাঁরাও বলেন যে , আমরা এটি নির্মাণ করেছি। অথচ আক্ষরিক অর্থে যাকে নির্মাণকাজ বলা হয় তাতে এদের কেউই জড়িত থাকেন না। বরং বিভিন্ন স্তরের শ্রমিক , যেমন: রাজমিস্ত্রী , রাজ-যোগালী ও সাধারণ শ্রমিক , রংকারক , বিদ্যুত মিস্ত্রী , কাঠমিস্ত্রী , ঝালাইকারক ইত্যাদি বহু লোক জড়িত থাকে এবং তারাও বলে যে , আমরা এটি নির্মাণ করেছি। অনুরূপভাবে এর ত্রুটিগুলোও স্বতন্ত্রভাবে তাদের সকলের প্রতিই আরোপ করা হয়। যেমন: বলা হয় যে , অমুক প্রেসিডেন্ট (বা প্রধান মন্ত্রী বা এমপি বা মন্ত্রী) এ স্থাপনাটি নির্মাণ করেছেন , কিন্তু এর ডিজাইনটা ভালো হয় নি , বা (বলা হয়:) নিম্ন মানের সিমেন্ট ব্যবহার করায় এখনই আস্তরণ উঠে যাচ্ছে , যদিও এসব ত্রুটির সাথে তাঁদের কারোই সরাসরি সম্পর্ক নেই। বরং ডিজাইনের ত্রুটির জন্য ইঞ্জিনীয়ার বা স্থপতি এবং নিম্ন মানের সিমেন্টের জন্য ঠিকাদার দায়ী। অথবা ফেটে যাওয়ার জন্য শ্রমিকদের বা রাজমিস্ত্রীদের দায়িত্বহীনতাও দায়ী হতে পারে।

অনুরূপভাবে একটি সংবাদপত্রের উদাহরণ থেকেও বিষয়টি সহজে বোঝা যেতে পারে। একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক-প্রকাশকের প্রতি পুরো পত্রিকার সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজ আরোপ করা হয় , যদিও এ সব কাজ তাঁর অধীনস্থ লোকেরাই করে থাকেন ; এমনকি সম্পাদকীয় নিবন্ধ পর্যন্ত সহকারী সম্পাদকগণ লিখে থাকেন ; সম্পাদক স্বয়ং কদাচিৎ তা লিখে থাকেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুরো কাজটিই সম্পাদক কর্তৃক নির্ধারিত সম্পাদকীয় নীতিমালার আলোকে সম্পাদিত হয়ে থাকে বিধায় তা সম্পাদকের কাজ বলে বিবেচিত হয় , যদিও প্রতিটি কাজই তাঁর মনমতো বা তাঁর দৃষ্টিতে কাঙ্ক্ষিত মানের হয় না। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবেই সম্পাদকীয় নীতির বরখেলাফ কোনো কাজ করতে পারেন , কিন্তু এ কারণে কাজের প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে না , যদিও এজন্য পরে জবাবদিহি করতে হয় ; এমনকি চাকরিও চলে যেতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে অধীনস্থ লোকের ত্রুটিকেও সম্পাদকের প্রতি আরোপ করা হয় এবং তিনি সে কাজের দায়দায়িত্ব অস্বীকার করেন না। কিন্তু তার মানে এ নয় যে , তিনিই এ ত্রুটি করেছেন বা সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে দিয়ে তিনি তা করিয়েছেন এবং এ কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক দায়ী নন।


10

11

12

13

14

15