অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম 26%

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 22 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 20099 / ডাউনলোড: 3820
সাইজ সাইজ সাইজ
অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

আল্লাহ্ তা‘আলার সৃষ্টিনিচয়ের মধ্যে মানুষের রয়েছে এক অনন্য অবস্থান। আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকল মানুষের নিকট এটা সুস্পষ্ট ও স্বীকৃত যে, প্রাণী প্রজাতিসমূহের মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্ব যতোটা তার সৃজনশীলতার কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশী তার বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্) ও ইচ্ছাশক্তির কারণে। এ দু’টি বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ তার সহজাত প্রকৃতিকে পরাভূত করতে সক্ষম। যে সব বিষয় গোটা মানব জাতির কর্ম ও আচরণকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতা থাকা-নাথাকা সংক্রান্ত ধারণা। এ ক্ষেত্রে বেশীর ভাগ মানুষই তাত্ত্বিকভাবে বিশ্বাস করে যে, মানুষের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতা বলতে কিছুই নেই, বরং তার জন্ম-মৃত্যু এবং সারা জীবনের কার্যাবলী ও সুখ-দুঃখ পূর্ব থেকেই নির্ধারিত হয়ে আছে বা তার প্রতিটি কাজই আল্লাহ্ তা‘আলা তার দ্বারা করিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু তাদের বেশীর ভাগ কাজকর্ম ও কথাবার্তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, তারা নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতায় বিশ্বাসী। বস্তুতঃ তাদের তাত্ত্বিক বিশ্বাস তাদের কর্ম ও আচরণের ওপর খুব কমই ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে, বরং তা কেবল ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাবই বিস্তার করে থাকে। মানব জাতিকে, বিশেষ করে মুসলমানদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্যে এ প্রশ্নটির সঠিক সমাধান উদ্ভাবন অপরিহার্য। এ লক্ষ্যেই অত্র গ্রন্থ রচনার প্রয়াস।

 


1

বিচারবুদ্ধির আলোকে জাবর্ ও এখতিয়ার

জাবারীয়াহ্ চিন্তাধারায় নীতিগতভাব মনে করা হয় যে , বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্) বা যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সত্যে উপনীত হওয়া যায় না , বিশেষ করে আল্লাহ্ তা আলার গুণাবলী ও কার্যাবলী সম্বন্ধে সঠিক ধারণা লাভ করা সম্ভব নয়। আর মজার ব্যাপার হলো , তাঁরা তাঁদের এ মত প্রমাণের জন্যই যুক্তিতর্কের আশ্রয় গ্রহণ করে থাকেন।

জাবারীয়াহ্ মতের একটি যুক্তি হচ্ছে এই যে , মানুষকে স্বাধীন এখতিয়ারের (স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতার) অধিকারী মনে করা মানে আল্লাহ্ তা আলাকে অক্ষম গণ্য করা এবং মানুষকে ছোট ছোট খোদা রূপে গণ্য করা।

তাঁদের এ যুক্তি একেবারেই ভিত্তিহীন। কারণ , আল্লাহ্ তা আলার ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতা যেখানে তাঁর নিজস্ব , বরং তাঁর সত্তার বহিঃপ্রকাশ অর্থাৎ তাঁর সত্তা , ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা স্বতন্ত্র নয় , সেখানে মানুষের সত্তা , ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা পরস্পর স্বতন্ত্র এবং তিনটিই আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টি ; তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ও তাকে এ দু টি বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। তার স্বাধীনতা ও এখতিয়ার আল্লাহ্ তা আলারই দান। আল্লাহ্ তা আলা চাইলেই তার এখতিয়ার কেড়ে নিতে পারেন বা তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারেন (যদিও সৃষ্টির কল্যাণার্থে অপরিহার্য না হলে তিনি হস্তক্ষেপ করেন না)। অতএব , মানুষকে এখতিয়ারের অধিকারী গণ্য করা মানে তাদেরকে ছোট ছোট খোদা গণ্য করা-এরূপ যুক্তি অপযুক্তি বৈ নয়। অন্যদিকে আল্লাহ্ তা আলা সব সময় ও মানুষের সব কাজে হস্তক্ষেপ করেন না মনে করা মানে আল্লাহ্ তা আলাকে অক্ষম গণ্য করা-এ-ও একটি অপযুক্তি। কারণ , তিনি সর্বাবস্থায় ও সব সময় হস্তক্ষেপ করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় এ থেকে বিরত থাকেন।

মানুষের সকল কাজই আল্লাহ্ করান (সৃষ্টিকর্মের আদি সূচনাকালীন পূর্বনির্ধারণের মাধ্যমেই হোক , বা প্রতিটি প্রাণশীল সৃষ্টির জন্মের সূচনাকালীন ভাগ্য নির্ধারণের মাধ্যমেই হোক , বা প্রতিনিয়ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমেই হোক , অথবা বার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমেই হোক)-এ দাবীর মানে হচ্ছে , মানুষ যতো খারাপ কাজ করে (চুরি , ডাকাতি , মিথ্যাচার , হত্যা ও যেনা-ব্যভিচার সহ) তার সবই আল্লাহ্ তা আলা তাকে দিয়ে করিয়ে নেন। এভাবে আল্লাহ্ তা আলাকে সকল প্রকার পাপাচারের কর্তা গণ্য করা হয় যা অত্যন্ত মারাত্মক ও জঘন্য ধারণা। কিন্তু যে কোনো পাপ কাজ , এমনকি যে কোনো নিরর্থক কাজের কারণ হচ্ছে কর্তার কোনো না কোনো দুর্বলতা। আর পরম পূর্ণতার (کمال مطلق ) অধিকারী আল্লাহ্ তা আলা সকল প্রকার দুর্বলতা থেকে প্রমুক্ত (سبحان ) ।

সৃষ্টিজগতে আমরা সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার পূর্ণতা লক্ষ্য করি। কিন্তু খুটিনাটি ক্ষেত্রে পূর্ণতার পাশাপাশি অপূর্ণতাও দেখেতে পাই। আল্লাহ্ তা আলা পরম পূর্ণতার অধিকারী , তাই তাঁর কাজের ফলে অপূর্ণতা বা ত্রুটি অকল্পনীয়। এমতাবস্থায় অপূর্ণতার একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে। তা হচ্ছে , আল্লাহ্ তা আলা তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টিকর্ম ও ব্যবস্থাপনার আওতায় তাঁরই সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিধান এবং বস্তুগত ও প্রাণশীল সৃষ্টিনিচয়ের ক্রিয়াশীলতার সুযোগ রেখেছেন। ফলে এসব কারণের প্রভাবে বিভিন্ন মাত্রার পূর্ণতা ও অপূর্ণতার সংমিশ্রিত প্রতিক্রিয়া থেকে অপূর্ণতা ও ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

জাবারীয়াহ্ চিন্তাধারার পক্ষ থেকে উপস্থাপিত এক বড় ধরনের বিভ্রান্তিকর যুক্তি হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞানের যুক্তি। তাদের যুক্তি হচ্ছে এই যে , যেহেতু আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞান অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যতকে আয়ত্ত করে আছে সেহেতু তিনি জানেন ভবিষ্যতে কী হবে। আর আল্লাহ্ যা জানেন তার অন্যথা হতে পারে না। অর্থাৎ সৃষ্টির সিদ্ধান্তের মুহূর্তেই তিনি নির্ধারণ করে রেখেছেন যে , ক্বিয়ামত পর্যন্ত কী কী ঘটবে এবং এমনকি তার পরেও কী কী ঘটবে অর্থাৎ কে বেহেশতে যাবে আর কে দোযখে যাবে।

তাঁরা আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞানের যুক্তিটি যেভাবে উপস্থাপন করছেন তার মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে। তা হচ্ছে , এ ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞানকে শুধু ইতিবাচক বা নেতিবাচক তথ্য হিসেবে দেখা হয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও জ্ঞানের বিরাট বিরাট ক্ষেত্র রয়েছে। তা হচ্ছে শর্তাধীন ঘটনাবলীর জ্ঞান।

আল্লাহ্ তা আলা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও এখতিয়ারে অধিকারী সৃষ্টির ভবিষ্যতের অনেক বিষয়কে এভাবে নির্ধারণ করে রেখেছেন যে , সৃষ্টি স্বেচ্ছায় অমুক কাজ করলে অমুক ফল হবে এবং না করলে বা তার বিপরীত কাজ করলে সে ফল হবে না বা তার বিপরীত ফল হবে। ভবিষ্যতের এ অংশটি এভাবেই আল্লাহর জ্ঞানে নিহিত রয়েছে। তবে সৃষ্টির পক্ষ থেকে যখন এরূপ কোনো শর্তযুক্ত কাজের ক্ষেত্রে এমন পূর্বপ্রস্তুতিমূলক কাজ (مقدمات ) সম্পাদন করা হয় যখন কাজটির দুই সম্ভাবনার মধ্য থেকে একটি সম্ভাবনা বিলুপ্ত হয়ে যায় ও অপরটি নিশ্চিত হয়ে যায় , তখন আর তা শর্তাধীন থাকে না এবং তা এভাবেই আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞানের আওতায় ইতিবাচক বা নেতিবাচক নিশ্চিত ভবিষ্যত রূপে স্থানলাভ করে।

বলা হয় , আল্লাহ্ কি আগেই জানতেন না যে , তাঁর সৃষ্টি দুই সম্ভাবনাযুক্ত ভবিষ্যত কর্মের ব্যাপারে কোন্ সম্ভাবনার পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করবে ? এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে এই যে , আল্লাহ্ তা আলা সৃষ্টির এ ভবিষ্যত পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণের বিষয়টিকেও দুই বা বহু সম্ভাবনা বিশিষ্ট রূপে নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং এ রূপেই জানেন।

জাবারীয়াহ্ চিন্তাধারার দাবী অনুযায়ী আল্লাহ্ তা আলা সব কিছুই সৃষ্টির সূচনার পূর্বেই নির্ধারণ করে রেখেছেন , অতঃপর তা পর্যায়ক্রমে সংঘটিত হচ্ছে এবং তার কোনোই অন্যথা হচ্ছে না। যদি তা-ই হয় , তাহলে বলতে হবে যে , একবার সব কিছু নির্ধারণ করে দেয়ার পর আল্লাহ্ তা আলার আর কোনো করণীয় নেই। এমনকি তাঁকে ঘটনাবলীর নীরব পর্যবেক্ষকও বলা যাবে না। কারণ , সব কিছু পূর্বনির্ধারিত হলে তিনি তো জানেনই যে , কী হতে যাচ্ছে ; নতুন কিছু হচ্ছে না। অতএব , এ ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণের কোনোই গুরুত্ব নেই ; বরং এ ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ কথাটি আদৌ প্রযোজ্য নয়। বস্তুতঃ অসীম সৃষ্টিক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ্ তা আলা সম্পর্কে এ কথা ভাবাই যায় না যে , তিনি একবার সৃষ্টি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের (সব কিছু পূর্বনির্ধারণ করে দেয়ার) পর আর কিছুই করছেন না।

এ ক্ষেত্রে জাবারীয়াহ্ ও মু তাযিলী চিন্তাধারার মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে। কারণ , উভয় চিন্তাধারাই আল্লাহ্ তা আলাকে সৃষ্টি সম্পর্কে মাত্র একবার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে গণ্য করে , অনবরত নব সৃষ্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মনে করে না। তবে পার্থক্য এই যে , জাবারীয়াহ্ চিন্তাধারায় প্রাণীকুলের কর্মকেও পূর্বনির্ধারিত গণ্য করা হয় , কিন্তু মু তাযিলী চিন্তাধারায় তা গণ্য করা হয় না । [ইয়াহূদীরা যে দাবী করতোيد الله مغلولة আল্লাহর হাত সংবদ্ধ (অকর্মণ্য)। (সূরাহ্ আল্-মায়েদাহ্: ৬৪) , তখন সম্ভবতঃ তারা এটাই বুঝাতে চাইতো যে , আল্লাহ্ তা আলা একবার সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেয়ার পর সব কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলছে এবং সেই সাথে মানুষ ও প্রাণীকুল স্বাধীনভাবে যার যার কাজ করছে , অতঃপর আর তাঁর কিছুই (দান করণও যার অন্যতম) করণীয় নেই।]

অন্যদিকে জাবারীয়াহ্ চিন্তাধারার যে সব প্রবক্তা দাবী করেন যে , কারণবিধি [অর্থাৎ যে কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়া বা যে কোনো কিছু সৃষ্টি বা উদ্ভূত হওয়ার পিছনেই কারণ নিহিত রয়েছে-এই প্রাকৃতিক বিধি । ইংরেজীতে একে বলা হয় cause and effect, বাংলা ভাষায় সাধারণতঃ এর অনুবাদ করা হয় কার্যকারণ বিধি । কিন্তু একে কারণবিধি বা কারণ ও ফলাফল বিধি বলাই শ্রেয়।] বলতে কিছুই নেই অর্থাৎ , তাঁদের মতে , আল্লাহ্ তা আলা কারণবিধি সৃষ্টি করেন নি , বরং যে কোনো কাজের প্রতিটি পর্যায়ই আল্লাহ্ তা আলা কর্তৃক সরাসরি সম্পাদিত হয় , তখন তা প্রকৃত পক্ষে জাবারীয়াহ্ চিন্তাধারার মূল দাবী অর্থাৎ আল্লাহ্ তা আলার পূর্বনির্ধারণ -এর সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ , আল্লাহ্ তা আলা যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সম্পাদিত হতে বাধ্য। এমতাবস্থায় , প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি কাজ আল্লাহ্ করেন বা করান-এ দাবী গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু জাবারীয়াহ্ চিন্তাধারার প্রবক্তারা তা-ই দাবী করে থাকেন। যেমন: তাঁরা বলেন , আমরা যখন দেখি যে , এক ব্যক্তি একটি কাগজ পোড়াচ্ছে তখন প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ্ তা আলাই তার মনে কাগজ পোড়ানোর ইচ্ছা জাগ্রত করে দেন , নয়তো তার মনে কাগজ পোড়াবার ইচ্ছা সৃষ্টি হতো না। অতঃপর আল্লাহ্ তা আলা তার হাতকে আগুন লাগাবার জন্য সক্রিয় করে দেন , নয়তো তার ইচ্ছার কারণে তার হাত সক্রিয় হতো না। অতঃপর আল্লাহ্ তার হাতের মাধ্যমে কাগজে আগুন লাগিয়ে দেন , নয়তো (ধরুন) ম্যাচের কাঠির খোঁচায় আগুন জ্বলতো না। অতঃপর তিনি আগুনে দহনক্ষমতা সৃষ্টি করে দেন , নয়তো আগুনের দহনক্ষমতা নেই।

তাদের এ দাবী একজন প্রাথমিক স্তরের ও স্বল্প পরিমাণ দ্রব্যের উৎপাদকের জন্য প্রযোজ্য , মহাজ্ঞানী স্রষ্টার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। একজন প্রাথমিক স্তরের উৎপাদক একটি ধাতব পাত্র তৈরীর জন্য আকরিক বা খনিজ ধাতবকে হাপরে গলিয়ে ঢালাই করে , এরপর তা হাতুড়ী দিয়ে পিটিয়ে বিশেষ আকৃতি প্রদান করে , অতঃপর করাত বা বাটালী দ্বারা অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলে , রেত দিয়ে ঘষে মসৃণ করে এবং অন্য যন্ত্রপাতি দ্বারা তাতে তার নাম ও নকশা খোদাই করে। কিন্তু বহুমুখী ও ব্যাপক ভিত্তিক উৎপাদনকার্যে মশগুল একজন বিজ্ঞানী মালিক-উৎপাদক প্রথমে একটি স্বয়ংক্রিয় ও জটিল কারখানা নির্মাণ করেন , অতঃপর তার উৎপাদন কার্যের জন্য বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক ও পরিচালক এবং বিভিন্ন অংশের পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের জন্য বিভিন্ন টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ করেন। এরপর সেখানে যন্ত্রের নির্ধারিত দিকসমূহ দিয়ে তাতে বিভিন্ন ধরনের আকরিক ধাতব প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয় এবং নির্ধারিত দিকসমূহ দিয়ে বিভিন্ন কাঙ্ক্ষিত ধরনের , ডিজাইনের , মানের ও মাপের ধাতবপাত্র সমূহ বেরিয়ে আসে।

সর্বোপরি জাবারীয়াহ্ চিন্তাধারাকে সঠিক গণ্য করা হলে বলতে হবে যে , নাউযুবিল্লাহ্ , তিনি একজন খামখেয়ালী স্রষ্টা যে কারণে তিনি অযথাই সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি একজন যালেম স্রষ্টা যে কারণে তিনি প্রাণশীল সৃষ্টির ভাগ্যে দুঃখ-কষ্ট লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন। এরূপ চিন্তা সঠিক হলে পাপ-পুণ্য বলতে কিছুই নেই ; যার ভাগ্যে যা লেখা আছে তার জন্য তা-ই ঘটবে ; পাপ লেখা থাকলে সে পাপ কাজ করবে , পুণ্য লেখা থাকলে সে পুণ্য কাজ করবে। অথচ কী পরিহাস (!) , তিনিই যে পাপ করালেন সে পাপের জন্য তিনি বান্দাহকে শাস্তি দেবেন এবং তিনিই যে পুণ্য কাজ করালেন সে পুণ্য কাজের জন্য বান্দাহকে পুরস্কার দেবেন!! পরম প্রমুক্ত আল্লাহ্ তা আলা সম্বন্ধে এরূপ জঘন্য ধারণা পোষণ অত্যন্ত মারাত্মক ব্যাপার।

এ প্রসঙ্গে জাবারীয়াহ্ চিন্তাধারায় একটি উদ্ভট অভিমত ব্যক্ত করা হয়। তা হচ্ছে এই যে , মানুষের দায়িত্ব আমল করা (কাজ করা) ; যার ভাগ্যে জান্নাত লেখা আছে সে জান্নাতে যাবার উপযোগী কাজের সুযোগ পাবে এবং যার ভাগ্যে জাহান্নাম লেখা আছে সে জাহান্নামে যাবার উপযোগী কাজের সুযোগ পাবে। কিন্তু কথা হচ্ছে , সব কিছুই যদি পূর্বনির্ধারিত হবে এবং সব কিছু যদি আল্লাহ্ই করেন বা করান , তাহলে দায়িত্ব , কর্তব্য , উচিত , অনুচিত , ধর্ম , আমল , সুযোগ পাওয়া ইত্যাদি কথার কোনোই অর্থ হয় না।

আবার পাপ-পুণ্যের শাস্তি ও পুরষ্কার সম্বন্ধে স্ববিরোধী ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয় , যদিও আল্লাহ্ তার ভাগ্যে নির্ধারণ করে রেখেছেন তথাপি যেহেতু সে স্বেচ্ছায় এ কাজ করে তাই তাকে শাস্তি ও পুরস্কার দেয়া হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে , ভাগ্যে নির্ধারিত থাকলে অতঃপর স্বেচ্ছায় বলতে কিছু থাকে কি ? সে ক্ষেত্রে এ ইচ্ছাও তো পূর্বনির্ধারিত। ব্যক্তির ওপর যদি ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়া হয়ে থাকে তাহলে সে ইচ্ছার জন্য তাকে শাস্তি বা পুরষ্কার দেয়া চলে কি ?

আবার গোঁজামিল দিয়ে বলা হয় , আল্লাহ্ জানেন , অমুক ব্যক্তি স্বেচ্ছায় এ কাজ করবে। কিন্তু ব্যক্তির সৃষ্টির পূর্বেই যখন আল্লাহ্ তা জানতেন তখন তা (সরাসরিই হোক বা কারণবিধির মাধ্যমেই হোক) অবশ্যই আল্লাহ্ কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত , সুতরাং এখানে স্বেচ্ছায় কথাটি প্রযোজ্য নয়।

মোদ্দা কথা , বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে জাবারীয়াহ্ মতবাদ একটি ভ্রান্ত মতবাদ যা আল্লাহ্ তা আলা সম্বন্ধে অত্যন্ত ঘৃণ্য ধরনের ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে এ চিন্তাধারায় বিশ্বাসী হবার দাবীদার লোকদের বাস্তব কর্মে এ চিন্তাধরার প্রতিফলন ঘটে না , বরং সে ক্ষেত্রে এখতিয়ারিয়্যাহ্ চিন্তাধরারই প্রতিফলন ঘটে। তারা যখন লোকদের সাথে কথা বলে , বিতর্ক করে , ঝগড়া করে , বিরোধ-বিসম্বাদে লিপ্ত হয় এবং আরো অনেক কাজ সম্পাদন করে তখন এটা সুস্পষ্ট ধরা পড়ে যে , তারা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তিতে বিশ্বাসী। এরূপ ব্যক্তিকে কেউ আঘাত করলে সে প্রত্যাঘাত করে বা অন্ততঃ প্রতিবাদ করে , নিদেন পক্ষে আঘাতকারীকে অন্তরে ঘৃণা করে ; বলে না যে , আল্লাহ্ তা আলাই নির্ধারণ করে রেখেছিলেন যে , ঐ ব্যক্তি তাকে আঘাত করবে বা আল্লাহ্ই ঐ ব্যক্তির হাত দিয়ে তাকে আঘাত করেছেন।

এর বিপরীতে বিভিন্ন এখতিয়ারিয়্যাহ্ চিন্তাধারার মধ্যে যারা মানুষের ইচ্ছা ও কর্মশক্তির পরিপূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী তাদের চিন্তাধারাও ভারসাম্যহীন ও প্রান্তিক। যদিও মানুষের বিচারবুদ্ধি স্বীয় ইচ্ছা ও কর্মশক্তির স্বাধীনতা অনুভব করে ও প্রত্যক্ষ করে , অতএব , তার যে ইচ্ছা ও কর্মশক্তির স্বাধীনতা রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই , কিন্তু এ স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ ও নিয়ন্ত্রণহীন হওয়া সম্ভব নয়।

এটা অনস্বীকার্য যে , মানুষের ইচ্ছা ও চিন্তাচেতনার ওপর পারিপার্শ্বিকতা সহ কতক প্রাকৃতিক কারণের নেতিবাচক প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। আর বলা বাহুল্য যে , এসব কারণের পিছনে নিহিত সর্বজনীন কারণবিধি সমূহ আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকেই নির্ধারিত। অতএব , এ ব্যাপারে মানুষের প্রতি আল্লাহ্ তা আলার দায়িত্ব রয়েছে। এ কারণেই মানুষের বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্)কে জাগ্রতকরণ এবং তার ওপর থেকে নেতিবাচক প্রভাবের আবরণ সরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে আল্লাহ্ তা আলা যুগে যুগে নবী-রাসূল (আঃ) প্রেরণ করেন। এ ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না থাকলে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নবী-রাসূল প্রেরণের প্রয়োজনই হতো না।

দ্বিতীয়তঃ মানুষ শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি হলেও তার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। তাই তাকে ইচ্ছা ও কর্মের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা প্রদানকে বিচারবুদ্ধি সমর্থন করে না। বরং তাকে স্বাধীনতা প্রদানের পাশাপাশি প্রয়োজন বোধে নিয়ন্ত্রণ করাও অপরিহার্য। একটি ছোট শিশুকে যেভাবে তার পিতা বা মাতা উন্মুক্ত স্থানে স্বাধীনভাবে খেলাধুলা করতে দিলেও তার প্রতি দৃষ্টি রাখে যাতে সে নিজের বা কোনো কিছুর বড় ধরনের ক্ষতি করে না বসে ; এজন্য সে কখনো তাকে সতর্ক করে দেয় , কখনোবা জোর করে ধরে কোনো ঝুঁকি থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে , অনুরূপভাবে আল্লাহ্ তা আলাও মানুষকে স্বাধীনতা প্রদানের পাশাপাশি প্রয়োজন বোধে তাকে নিয়ন্ত্রণ করবেন এবং তার কাজে হস্তক্ষেপ করবেন এটাই দুর্বলতা বিশিষ্ট মানব প্রকৃতির দাবী। অতএব , মানুষের ইচ্ছা ও কর্মশক্তির নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা একটি অসম্ভব ব্যাপার।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয়ের উল্লেখ করা জরুরী মনে করছি। তা হচ্ছে , যেহেতু মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকুল সহ সমগ্র সৃষ্টিলোক আল্লাহ্ তা আলা কর্তৃক সৃষ্ট এবং সৃষ্ট হওয়ার পরে স্বীয় অস্তিত্ব অব্যাহত রাখার ব্যাপারেও আল্লাহ্ তা আলার ওপর নির্ভরশীল , আল্লাহ্ তা আলা কর্তৃক সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিধি-বিধান ও পরিবেশ এবং তাঁরই ইচ্ছা ক্রমে অব্যাহত থাকা মানবিক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত , আর তার ইচ্ছা ও কর্মশক্তিও তাঁরই সৃষ্টি এবং তিনি তাকে স্বাধীনতা দিয়েছেন বলেই তা স্বাধীনভাবে তৎপরতা চালায়-যা প্রয়োজন বোধে তিনি কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণ করেন , সেহেতু এক হিসেবে বলা চলে যে , সমগ্র সৃষ্টিলোকের সকল কাজই আল্লাহ্ তা আলার। কিন্তু এতদসত্ত্বেও যেহেতু মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা আংশিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হলেও আংশিকভাবে স্বাধীন , সেহেতু যে সব কাজ সে বাধ্য হয়ে নয় , বরং স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে সম্পাদন করে তার ভালোমন্দ ও দায়-দায়িত্ব তার নিজের ওপরে বর্তাবে-এটাই স্বাভাবিক।

এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয় উল্লেখ না করলে নয়। তা হচ্ছে , যদিও মানুষের কর্মক্ষমতা বিভিন্ন কারণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও সীমাবদ্ধ , কিন্তু তার বিচারবুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তি এতখানি শক্তিশালী যে , যে সব কাজ তার পক্ষে করা সম্ভব তা করা বা না-করার ব্যাপারে সে পুরোপুরি স্বাধীন।

কথাটা আরেকটু পরিস্কার করে বললে বলতে হয় , কতগুলো কাজ সে ইচ্ছা করলেও তার পক্ষে করা সম্ভব নয়। কারণ , বিভিন্ন কারণ তার জন্য ঐসব কাজ সম্পাদন অসম্ভব করে রেখেছে। উদাহরণ স্বরূপ , সে ইচ্ছা করতে পারে যে , একটি বিশালায়তন ভবন নির্মাণ করবে বা তার গ্রামের সকল দরিদ্র পরিবারকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে তুলে দেবে , কিন্তু প্রয়োজনীয় আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় সে তা করতে পারছে না। অথবা সে ইচ্ছা করছে যে , প্রতিবেশীর প্রাসাদোপম বাড়ীটা দখল করে নেবে , কিন্তু এ জন্য প্রয়োজনীয় জবরদস্তী ক্ষমতা ও শক্তি তার নেই। এসব ক্ষেত্রে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে ঐসব কর্ম সম্পাদনে অক্ষম অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে সে স্বাধীনতার অধিকারী নয়। কিন্তু ব্যক্তি অন্যের মালিকানাধীন অরক্ষিত কোনো বস্তু ইচ্ছা করলে নিতে পারে , আবার না-ও নিতে পারে। এমনকি চরম ক্ষুধার্ত অবস্থায়ও অন্যের মালিকানাধীন অরক্ষিত খাদ্যবস্তু (যেমন: কোনো বাগানের ফল) খেতে পারে , আবার তা খাওয়া থেকে বিরত থাকতেও পারে। তেমনি সে তার স্বোপার্জিত ধন-সম্পদ থেকে দরিদ্রদেরকে দান করতে পারে , আবার না-ও করতে পারে। শুধু তা-ই নয় , চরম ক্ষুধার্ত অবস্থায় সে তার নিজের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় খাবার (যার অতিরিক্ত নেই) নিজে যেমন খেতে পারে , তেমনি চাইলে অন্যকেও দিয়ে দিতে পারে। এমনকি মানুষ চাইলে বৈধ বা নিজস্ব খাদ্য-পানীয় সামনে থাকা সত্ত্বেও অনশন করে নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে।

এ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে , মানুষের ইচ্ছা ও কর্মশক্তির ক্ষেত্র সীমিত হলেও সে ঐ সীমিত ক্ষেত্রে কোনো কাজ করা বা না-করার ব্যাপারে পুরোপুরি স্বাধীন।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোরআনের অলৌকিকতা

অবতরণিকা

চৌদ্দশত বছর পূর্বে আল্লাহ তা আলা মানবজাতির পথচালিকা স্বরূপ কোরআন প্রেরণ করেছিলেন। এ স্বর্গীয় গ্রন্থখানা দৃঢ়ভাবে সমর্থন আর অনুসরণ করে মানবজাতি যেন সঠিক পথে পরিচালিত হয় এ আহ্বান করেছিলেন তিনি। নাযিল হওয়ার দিন থেকে শুরু করে শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত এ স্বর্গীয় আর সর্বশেষ বই খানা মানবজাতির জন্য একমাত্র পথচালিকা হিসেবে থেকে যাবে।

পবিত্র কোরআনের অসমকক্ষ আর অতুলনীয় রচনাশৈলী এবং এর মাঝে বিদ্যমান প্রকৃষ্ট , গভীর ও বিস্তৃত জ্ঞানই সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে এটি মহান আল্লাহ্ তাআলার বাণী। এ ছাড়াও কোরআনের এমন বহু অলৌকিক বৈশিষ্ট্যাবলী রয়েছে যেগুলো প্রমাণ করে যে এটি পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলারই নাযিলকৃত গ্রন্থ । এ সমস্ত গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যাদির একটি হলো-অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক যথার্থতা বা সত্যতা আজ থেকে ১৪০০ বছর আগেই কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছিল -যেগুলো কিনা আমরা সেদিন বিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিমালা দিয়ে আবিষ্কার বা সন্ধান করতে সক্ষম হয়েছি।

অবশ্যই কোরআন কোন বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ নয়। কিন্তু এরপরও বিজ্ঞান সংক্রান্ত বহু বিষয়াদি এ গ্রন্থটিতে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত রূপে ও সারগর্ভ হিসেবে বর্ণিত রয়েছে-যেগুলো বিংশ শতাব্দীর টেকনোলজী বা প্রযুক্তির মাধ্যমে কেবল সেদিন মানব জাতির সমক্ষে উন্মোচিত হয়েছে। কোরআন যখন নাযিল হয় , সে সময় এ বিষয়গুলো ছিল অজানা , এটি আরো প্রমাণ করে যে কোরআন আল্লাহর বাণী।

কোরআনে বর্ণিত বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয়াদি বুঝতে হলে আমাদের নজর দিতে হবে সে বিষয়টিতে যে কোরআন যখন নাযিল হয় বিজ্ঞান তখন কোন স্তরে ছিল।

সপ্তম শতাব্দীতে যখন কোরআন নাযিল হয় , সে সময়কার আরব সমাজে বৈজ্ঞানিক বিষয়াদিতে বহুবিধ কুসংস্কার আর ভিত্তিহীন বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। মহাবিশ্ব আর প্রকৃতি পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ করার মত কলাকৌশল বিদ্যমান না থাকায় সে সময়কার আদি আরব সমাজের মানুষ তাদের পূর্বপুরুষ থেকে প্রাপ্ত উপাখ্যান সমূহে বিশ্বাস করত। এরই একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায় যে , পৃথিবীর উপরিস্থিত আকাশই ধারণ করে আছে পর্বতসমূহকে। তাদের বিশ্বাস ছিল যে , পৃথিবী সমতল (গোলাকার নয়) ; আর পৃথিবীর-দু প্রান্তে রয়েছে উঁচু , উঁচু পর্বতমালা , ধারণা করা হত যে পর্বতমালাসমূহ স্তম্ভের ন্যায় পৃথিবীর উপরিস্থিত খিলান আকৃতির আকাশকে ধারণ করে আছে।

তবে যাই হোক কোরআন নাযিল হওয়ায় আরব সমাজের এসব কুসংস্কার দূরীভূত হয়ে যায়। সূরা রাদের দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে : তিনিই আল্লাহ যিনি কোন প্রকার অবলম্বন বা স্তম্ভের সাহায্য ছাড়াই আকাশসমূহকে সমুন্নত রেখেছেন । পর্বতমালা বিদ্যমান থাকার ফলেই গগনমন্ডল উপরে স্থির থাকতে পারছে - এরূপ বিশ্বাস উক্ত আয়াত দ্বারাই মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যায়। কোরআনে সেই সময়ে অন্যান্য বহু বিষয়াদি সংক্রান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী প্রকাশিত হয়েছিল যখন তা কারো পক্ষেই জানতে পারার কথা নয়। সে সময় মানুষ জ্যোতির্বিদ্যা , পদার্থবিদ্যা , কিংবা জীববিদ্যা বিষয়ে খুবই অল্প জ্ঞান রাখত। ঠিক তেমনি এক সময়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি , মানব সৃষ্টি , বায়ু মন্ডলের গঠন আর যে সুক্ষ্ম ভারসাম্য পৃথিবীর বুকে জীবের বা প্রাণের টিকে থাকা সম্ভব করে আছে - এ ধরণের বহু বিষয়াদির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী কোরআনে প্রকাশিত হয়েছে।

এখন চলুন আমরা কোরআনে প্রকাশিত বিজ্ঞান সংক্রান্ত কিছু অলৌকিক বিষয়াদির দিকে দৃষ্টিপাত করি।

মহাবিশ্ব সৃষ্টি

নিম্নের আয়াতটিতে বিশ্বব্রহ্মান্ডের উৎপত্তির কথা বর্ণিত রয়েছে :

তিনিই আদি স্রষ্টা আসমান ও জমিনের। ( কোরআন , ৬ : ১০১ )

পবিত্র কোরআনে প্রদত্ত এ তথ্যটি সমসাময়িক বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্যাবলীর সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সংগতিপূর্ণ । আজ জ্যোতির্বিদ্যা যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছেছে তা হলো-বস্তু আর সময়ের-পরিধিসহ গোটা মহাবিশ্ব অস্তিত্ত্বে এসেছে বিরাট এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে-যা কিনা খুব তড়িৎ গতিতে ঘটেছিল। মহাবিস্ফোরণ (Big Bang ) নামের এই ঘটনাটি একটিমাত্র ক্ষুদ্র বিন্দুর বিস্ফোরণের ফলে মহাবিশ্ব অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্ত্বে এসেছে। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি আর কিভাবে তা অস্তিত্ত্বে এসেছে-এ ব্যাপারে আধুনিক বিজ্ঞান পরিষদ একই মত পোষণ করে যে-মহাবিস্ফোরণই মহাবিশ্বের উৎপত্তি আর অস্তিত্ত্বের একমাত্র যৌক্তিক আর গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদান করে।

মহাবিস্ফোরণের পূর্বে পদার্থ বা বস্তু বলে কিছূ ছিলনা। এমনি এক অস্তিত্বহীন বা শূণ্যাবস্থা , যেথায় বিদ্যমান ছিল না কোন পদার্থ , না কোন শক্তি , এমনকি সময়ের অস্তিত্ত্ব ছিলনা-যা কেবল অধিবিদ্যামূলক (Metaphysically ) কিংবা বিমূর্ত আলোচনায় বর্ণনা করা যায় তেমনি একটি অবস্থা থেকে পদার্থ , শক্তি আর সময়ের সৃষ্টি হয়েছে। এই যে বিষয়টি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের মাধ্যমে কেবলি সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে-তাই ১৪০০ বছর আগে কোরআন মানবজাতির উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেছিল।

১৯৯২ সালে নাসা( NASA) Cobe Space স্যাটেলাইট পাঠায় যার সংবেদনশীল সেন্সরগুলো মহাবিস্ফোরণের ঘটনামূলক অবশিষ্টাংশ বা ছিটেফোটা ধরে রাখতে সক্ষম হয়। এই আবিষ্কার মহাবিস্ফোরণের প্রমাণ বহন করে , যা কিনা মহাবিশ্ব যে শূণ্যাবস্থা থেকে সৃষ্ট হয়েছে তারই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।

মহাবিশ্বের প্রসারণ

১৪০০ বছর পূর্বে যখন জ্যোতির্বিদ্যা ছিল তখনও আদিম অবস্থায় , তখনই আল্লাহ্ তাআলা কর্তৃক নাযিলকৃত কোরআনে বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রসারণের বিষয়টি এমনভাবে বর্ণিত হয় :

আর আমি স্বীয় ক্ষমতাবলে আসমানকে সৃষ্টি করেছি আর আমি অবশ্যই নিয়মিতভাবে তা প্রসারিত করছি। ( কোরআন , ৫১ : ৪৭ )

এই আয়াতটিতে উক্ত“Heavens” শব্দটি দিয়ে কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় মহাশূণ্য আর বিশ্বব্রহ্মান্ডকে নির্দেশ করা হয়েছে। এখানে শব্দটি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্য কথায় মহাবিশ্বের প্রসারণের ব্যাপারটি কোরআনে প্রকাশ হয়েছে। আর এটাই সেই পরম সিদ্ধান্ত বা কথা যেখানে বিজ্ঞান আজ পৌছেছে।

বিংশ শতাব্দীর উষালগ্ন পর্যন্ত বিজ্ঞান জগতে এই একটিমাত্র ধারণা প্রচলিত ছিল যে , মহাবিশ্বের রয়েছে একটি স্থির বা অপরিবর্তনীয় প্রকৃতি বা অবস্থা এবং অননন্তকাল -ধরেই এর অস্তিত্ব রয়েছে। অর্থাৎ এর কোন শুরু নেই , পরিবর্তনও নেই। যাই হোক প্রকৃতপক্ষেই মহাবিশ্বেরও যে একটি সূচনা বা আরম্ভ ছিল আর এটি ক্রমাগতই প্রসারিত হচ্ছে-আধুনিক প্রযুক্তিসমূহ দ্বারা গবেষণা , পর্যবেক্ষণ আর গণনা চালিয়ে এ তথ্যটি পাওয়া গেছে।

বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে রাশিয়ান পদার্থবিদAlexander Friedmann এবং বেলজিয়ামের মহাবিশ্ববিষয়ক বিজ্ঞানীGeorges Lemaitre থিওরী দিয়ে বা তত্ত্বগতভাবে গণনা করে দেখেন যে বিশ্বব্রহ্মান্ড বিরামহীনভাবে নিয়তই গতিশীল রয়েছে আর এটি প্রসারিতও হচ্ছে।

১৯২৯ সালে পর্যবেক্ষণমূলক ডাটার মাধ্যমেও এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়। আমেরিকান জ্যোতির্বিদEdwin Hubble একটি টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন যে নক্ষত্রপুঞ্জ আর গ্যালক্সিগুলো পরস্পর থেকে ক্রমাগতই দূরে সরে যাচ্ছে । বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে সবকিছু পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে , এতেই প্রমাণিত হয় যে এই মহাবিশ্ব নিয়ত প্রসারিত মহাবিশ্ব ।

মহাবিস্ফোরণের মুহূর্ত থেকেই বিশ্বব্রহ্মান্ড এক বিশাল বেগে ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীগণ মহাবিশ্বের এই প্রসারণকে বাতাসে ফোলানো একটি বেলুনের পৃষ্ঠের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

মহাবিশ্ব যে প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে - এটির সত্যতা পরবর্তী বছরসমূহের পর্যবেক্ষণ দ্বারা প্রমাণিত হয়। অথচ এই বিষয়টি পবিত্র কোরআনে যে সময়টিতে ব্যাখ্যা করা হয় তখন তা কেউ জানতো না। কেননা কোরআন আল্লাহর বাণী , যিনি সমগ্র বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা ও শাসনকর্তা।

আকাশ ও পৃথিবীর বিভক্তি ও পৃথকীকরন

গগনমন্ডলীর সৃষ্টি প্রসঙ্গে আরেকটি আয়াতে নিম্নের উক্তিটি করা হয়েছে :

অবিশ্বাসীরা কি ইহা লক্ষ্য করে নাই যে আকাশ ও পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল ( সংযুক্ত অবস্থায় ছিল ) , তারপর আমি উভয়কে আলাদা করে দিলাম এবং প্রাণবান সমস্ত কিছু আমি সৃষ্টি করলাম পানি থেকে। তবুও কি তারা ঈমান আনবে না ? (কোরআন , ২১ : ৩০)

আরবী অভিধানে রাত্ক্ব (RATQ ) শব্দটি অনূদিত হয়েছে সেলাইকৃত , বুননকৃত শব্দে যার অর্থ একটি অপরটির সঙ্গে সংযুক্ত বা সংমিশ্রিত হয়ে একাকার অবস্থায় ছিল । ভিন্ন ভিন্ন দুটি বস্তু মিলে একটি অখণ্ড বস্তু তৈরী করে - এটি উল্লেখ করতেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আমি সেলাই খুলে বিযুক্ত করেছি -এই শব্দ সমষ্টি আরবীতে একটি ক্রিয়াপদ ফাতাক্ব্ (fataqa ) দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এই শব্দটি এটাই সূচিত করে যে , কোন কিছু রাতক্ব অবস্থায় পূর্বে ছিল , এখন সেটি ছিঁড়ে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন আলাদা জিনিষ অস্তিত্ত্বে এসেছে। মাটি ভেদ করে একটি বীজ থেকে অংকুর বের হওয়ার কাজেও এই ক্রিয়াপদটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

চলুন আমরা হৃদয়ে এ ধারণাটি পোষণ করে আয়াতটির উপর আরেকবার দৃষ্টিপাত করি। এ আয়াতটি অনুসারে প্রথমে পৃথিবী আর গগনমন্ডল সংযুক্ত অবস্থায় রাতক্ব হিসেবে ছিল। এদের একটি অপরটি থেকে বের হয়ে আলাদা হয়েছে (ফাতাক্বা হয়েছে)। আগ্রহের সঙ্গে আমরা যখন মহাবিস্ফোরণের (Big Bang ) প্রথম মুহূর্তগুলো স্মরণ করে দেখি , তবে আমরা দেখতে পাই যে , মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তু বা পদার্থ একটি মাত্র বিন্দুতে বিদ্যমান ছিল। অন্যকথায় গগনমন্ডলী ও পৃথিবী - যখন তখনো সৃষ্টি - হয়নি তখন রাতক্ব অবস্থায় ছিল । প্রচন্ড বা ভয়ংকরভাবে বিন্দুটি বিস্ফোরিত হয় - যারই ফলে বিদ্যমান সমস্ত বস্তুগুলো - ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় ( ফাতাক্বাতে ) ; আর এ প্রক্রিয়াতেই সৃষ্ট হয়েছে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মান্ড।

বৈজ্ঞানিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যাবলীর সঙ্গে আয়াতটির অভিব্যক্তিগুলো তুলনা করে আমরা দেখতে পাই যে , এরা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে নিখুঁতভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যথেষ্ট কৌতুহলের ব্যাপার এটি যে বিংশ শতাব্দীর আগে এই তথ্যগুলো পাওয়া যায়নি।

কক্ষপথরাজি

পবিত্র কোরআনে যখনই চন্দ্র আর সূর্যের কথা বলা হয়েছে তখনই অত্যন্ত গুরুত্বের সহিত উল্লেখ করা হয়েছে যে , চন্দ্র আর সূর্য দুটিই নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় রয়েছে।

আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিন এবং চন্দ্র ও সূর্য। সবাই নিজ নিজ কক্ষপথে বিচরণ করে। (কোরআন , ২১ : ৩৩)-

সূর্য যে স্থির অবস্থায় নেই বরং একটি সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে বিচরণ করছে এ বিষয়টি আরেকটি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে : আর সূর্য স্বীয় গন্তব্য স্থানের দিকে চলতে থাকে। এটা পরাক্রমশালী , সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ। (কোরআন , ৩৬ : ৩৮)

এই যে বিষয়সমূহ কোরআনের মাধ্যমে আমরা অবগত হয়েছি সেগুলো আমাদের যুগে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ দ্বারা উদঘাটিত হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানে অভিজ্ঞজনদের গণনানুসারে সূর্যSolar Apex নামক একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘন্টায় ৭২০ ,০০০ কিলোমিটার বেগেVega নামক একটি নক্ষত্রের দিকে গতিশীল বা ভ্রমণরত রয়েছে। এর অর্থ এই দাড়ায় যে , সূর্য প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৭ ,২৮০ ,০০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে থাকে। সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের মাধ্যাকর্ষণজনিত সিস্টেমের আওতায় অন্তর্ভূক্ত অন্যান্য গ্রহ , নক্ষত্রগুলোও একই দূরত্ব অতিক্রম করে। অধিকন্তু বিশ্বব্রহ্মান্ডের সমস্ত নক্ষত্রপুঞ্জ ঠিক অনুরূপভাবে পরিকল্পিত গতিতে চলনশীল রয়েছে।

ঠিক এর মতোই গোটা বিশ্বব্রহ্মান্ড যে একই ধরণের পথ আর কক্ষপথে পরিপূর্ণ তা নিম্নরূপে কোরআনে বর্ণিত রয়েছে :

কসম বহু পথ আর কক্ষপথ বিশিষ্ট আসমানের। (কোরআন , ৫১ : ৭)

মহাবিশ্বে প্রায় ২০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে , যাদের প্রতিটি ২০০ বিলিয়ন নক্ষত্রপুঞ্জ নিয়ে গঠিত। বেশীর ভাগ নক্ষত্রের রয়েছে গ্রহ আর গ্রহের রয়েছে উপগ্রহ। গগনমন্ডলের সমস্ত বস্তুগুলোই সঠিকভাবে গণনাকৃত কক্ষপথসমূহে ঘুর্ণায়মানরত রয়েছে। মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে এদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে পরস্পরের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য ও সঠিক বিন্যাস রেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ ছাড়াও বহু ধুমকেতু রয়েছে যারা তাদের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষপথে বিচরণ করে।

মহাবিশ্বের কক্ষপথরাজি কেবলি এই গগনমন্ডলীর গ্রহ -নক্ষত্রের জন্য নয়। গ্যালাক্সিগুলোও সঠিকভাবে গণনাকৃত পরিকল্পিত কক্ষপথসমূহে বিশাল বেগে বিচরণ করে। এই বিচরণের সময় মহাকাশের কোন বস্তু একটি আরেকটির পথে চলে যায়না কিংবা সংঘর্ষে লিপ্ত হয় না।

এটা সুনিশ্চিত যে , কোরআন নাযিল হওয়ার কালে এখনকার মতো টেলিস্কোপ আবিষ্কৃত হয়নি , ছিলনা পর্যবেক্ষণের জন্য উন্নত প্রযুক্তি যার সাহায্যে এখন মহাশূণ্যের মিলিয়ন মিলিয়ন জায়গা পর্যবেক্ষণ করা যায় , ছিলনা পদার্থবিদ্যা বা জ্যোতির্বিদ্যার আধুনিক জ্ঞান ভান্ডার। কোরআনে যেমন বলা হয়েছে যে মহাশূণ্য পথ আর কক্ষপথসমূহে পরিপূর্ণ - যদিও তখনকার সময় তা নির্ণয় করা সম্ভব ছিল না। অথচ কোরআনে বেশ স্পষ্টভাবে বিষয়টি বর্ণিত রয়েছে - কেননা এই কোরআন মহাপরাক্রমশালী , মহাজ্ঞানী আল্লাহ তাআলার বাণী।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোরআনের অলৌকিকতা

অবতরণিকা

চৌদ্দশত বছর পূর্বে আল্লাহ তা আলা মানবজাতির পথচালিকা স্বরূপ কোরআন প্রেরণ করেছিলেন। এ স্বর্গীয় গ্রন্থখানা দৃঢ়ভাবে সমর্থন আর অনুসরণ করে মানবজাতি যেন সঠিক পথে পরিচালিত হয় এ আহ্বান করেছিলেন তিনি। নাযিল হওয়ার দিন থেকে শুরু করে শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত এ স্বর্গীয় আর সর্বশেষ বই খানা মানবজাতির জন্য একমাত্র পথচালিকা হিসেবে থেকে যাবে।

পবিত্র কোরআনের অসমকক্ষ আর অতুলনীয় রচনাশৈলী এবং এর মাঝে বিদ্যমান প্রকৃষ্ট , গভীর ও বিস্তৃত জ্ঞানই সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে এটি মহান আল্লাহ্ তাআলার বাণী। এ ছাড়াও কোরআনের এমন বহু অলৌকিক বৈশিষ্ট্যাবলী রয়েছে যেগুলো প্রমাণ করে যে এটি পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলারই নাযিলকৃত গ্রন্থ । এ সমস্ত গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যাদির একটি হলো-অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক যথার্থতা বা সত্যতা আজ থেকে ১৪০০ বছর আগেই কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছিল -যেগুলো কিনা আমরা সেদিন বিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিমালা দিয়ে আবিষ্কার বা সন্ধান করতে সক্ষম হয়েছি।

অবশ্যই কোরআন কোন বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ নয়। কিন্তু এরপরও বিজ্ঞান সংক্রান্ত বহু বিষয়াদি এ গ্রন্থটিতে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত রূপে ও সারগর্ভ হিসেবে বর্ণিত রয়েছে-যেগুলো বিংশ শতাব্দীর টেকনোলজী বা প্রযুক্তির মাধ্যমে কেবল সেদিন মানব জাতির সমক্ষে উন্মোচিত হয়েছে। কোরআন যখন নাযিল হয় , সে সময় এ বিষয়গুলো ছিল অজানা , এটি আরো প্রমাণ করে যে কোরআন আল্লাহর বাণী।

কোরআনে বর্ণিত বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয়াদি বুঝতে হলে আমাদের নজর দিতে হবে সে বিষয়টিতে যে কোরআন যখন নাযিল হয় বিজ্ঞান তখন কোন স্তরে ছিল।

সপ্তম শতাব্দীতে যখন কোরআন নাযিল হয় , সে সময়কার আরব সমাজে বৈজ্ঞানিক বিষয়াদিতে বহুবিধ কুসংস্কার আর ভিত্তিহীন বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। মহাবিশ্ব আর প্রকৃতি পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ করার মত কলাকৌশল বিদ্যমান না থাকায় সে সময়কার আদি আরব সমাজের মানুষ তাদের পূর্বপুরুষ থেকে প্রাপ্ত উপাখ্যান সমূহে বিশ্বাস করত। এরই একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায় যে , পৃথিবীর উপরিস্থিত আকাশই ধারণ করে আছে পর্বতসমূহকে। তাদের বিশ্বাস ছিল যে , পৃথিবী সমতল (গোলাকার নয়) ; আর পৃথিবীর-দু প্রান্তে রয়েছে উঁচু , উঁচু পর্বতমালা , ধারণা করা হত যে পর্বতমালাসমূহ স্তম্ভের ন্যায় পৃথিবীর উপরিস্থিত খিলান আকৃতির আকাশকে ধারণ করে আছে।

তবে যাই হোক কোরআন নাযিল হওয়ায় আরব সমাজের এসব কুসংস্কার দূরীভূত হয়ে যায়। সূরা রাদের দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে : তিনিই আল্লাহ যিনি কোন প্রকার অবলম্বন বা স্তম্ভের সাহায্য ছাড়াই আকাশসমূহকে সমুন্নত রেখেছেন । পর্বতমালা বিদ্যমান থাকার ফলেই গগনমন্ডল উপরে স্থির থাকতে পারছে - এরূপ বিশ্বাস উক্ত আয়াত দ্বারাই মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যায়। কোরআনে সেই সময়ে অন্যান্য বহু বিষয়াদি সংক্রান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী প্রকাশিত হয়েছিল যখন তা কারো পক্ষেই জানতে পারার কথা নয়। সে সময় মানুষ জ্যোতির্বিদ্যা , পদার্থবিদ্যা , কিংবা জীববিদ্যা বিষয়ে খুবই অল্প জ্ঞান রাখত। ঠিক তেমনি এক সময়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি , মানব সৃষ্টি , বায়ু মন্ডলের গঠন আর যে সুক্ষ্ম ভারসাম্য পৃথিবীর বুকে জীবের বা প্রাণের টিকে থাকা সম্ভব করে আছে - এ ধরণের বহু বিষয়াদির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী কোরআনে প্রকাশিত হয়েছে।

এখন চলুন আমরা কোরআনে প্রকাশিত বিজ্ঞান সংক্রান্ত কিছু অলৌকিক বিষয়াদির দিকে দৃষ্টিপাত করি।

মহাবিশ্ব সৃষ্টি

নিম্নের আয়াতটিতে বিশ্বব্রহ্মান্ডের উৎপত্তির কথা বর্ণিত রয়েছে :

তিনিই আদি স্রষ্টা আসমান ও জমিনের। ( কোরআন , ৬ : ১০১ )

পবিত্র কোরআনে প্রদত্ত এ তথ্যটি সমসাময়িক বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্যাবলীর সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সংগতিপূর্ণ । আজ জ্যোতির্বিদ্যা যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছেছে তা হলো-বস্তু আর সময়ের-পরিধিসহ গোটা মহাবিশ্ব অস্তিত্ত্বে এসেছে বিরাট এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে-যা কিনা খুব তড়িৎ গতিতে ঘটেছিল। মহাবিস্ফোরণ (Big Bang ) নামের এই ঘটনাটি একটিমাত্র ক্ষুদ্র বিন্দুর বিস্ফোরণের ফলে মহাবিশ্ব অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্ত্বে এসেছে। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি আর কিভাবে তা অস্তিত্ত্বে এসেছে-এ ব্যাপারে আধুনিক বিজ্ঞান পরিষদ একই মত পোষণ করে যে-মহাবিস্ফোরণই মহাবিশ্বের উৎপত্তি আর অস্তিত্ত্বের একমাত্র যৌক্তিক আর গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদান করে।

মহাবিস্ফোরণের পূর্বে পদার্থ বা বস্তু বলে কিছূ ছিলনা। এমনি এক অস্তিত্বহীন বা শূণ্যাবস্থা , যেথায় বিদ্যমান ছিল না কোন পদার্থ , না কোন শক্তি , এমনকি সময়ের অস্তিত্ত্ব ছিলনা-যা কেবল অধিবিদ্যামূলক (Metaphysically ) কিংবা বিমূর্ত আলোচনায় বর্ণনা করা যায় তেমনি একটি অবস্থা থেকে পদার্থ , শক্তি আর সময়ের সৃষ্টি হয়েছে। এই যে বিষয়টি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের মাধ্যমে কেবলি সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে-তাই ১৪০০ বছর আগে কোরআন মানবজাতির উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেছিল।

১৯৯২ সালে নাসা( NASA) Cobe Space স্যাটেলাইট পাঠায় যার সংবেদনশীল সেন্সরগুলো মহাবিস্ফোরণের ঘটনামূলক অবশিষ্টাংশ বা ছিটেফোটা ধরে রাখতে সক্ষম হয়। এই আবিষ্কার মহাবিস্ফোরণের প্রমাণ বহন করে , যা কিনা মহাবিশ্ব যে শূণ্যাবস্থা থেকে সৃষ্ট হয়েছে তারই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।

মহাবিশ্বের প্রসারণ

১৪০০ বছর পূর্বে যখন জ্যোতির্বিদ্যা ছিল তখনও আদিম অবস্থায় , তখনই আল্লাহ্ তাআলা কর্তৃক নাযিলকৃত কোরআনে বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রসারণের বিষয়টি এমনভাবে বর্ণিত হয় :

আর আমি স্বীয় ক্ষমতাবলে আসমানকে সৃষ্টি করেছি আর আমি অবশ্যই নিয়মিতভাবে তা প্রসারিত করছি। ( কোরআন , ৫১ : ৪৭ )

এই আয়াতটিতে উক্ত“Heavens” শব্দটি দিয়ে কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় মহাশূণ্য আর বিশ্বব্রহ্মান্ডকে নির্দেশ করা হয়েছে। এখানে শব্দটি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্য কথায় মহাবিশ্বের প্রসারণের ব্যাপারটি কোরআনে প্রকাশ হয়েছে। আর এটাই সেই পরম সিদ্ধান্ত বা কথা যেখানে বিজ্ঞান আজ পৌছেছে।

বিংশ শতাব্দীর উষালগ্ন পর্যন্ত বিজ্ঞান জগতে এই একটিমাত্র ধারণা প্রচলিত ছিল যে , মহাবিশ্বের রয়েছে একটি স্থির বা অপরিবর্তনীয় প্রকৃতি বা অবস্থা এবং অননন্তকাল -ধরেই এর অস্তিত্ব রয়েছে। অর্থাৎ এর কোন শুরু নেই , পরিবর্তনও নেই। যাই হোক প্রকৃতপক্ষেই মহাবিশ্বেরও যে একটি সূচনা বা আরম্ভ ছিল আর এটি ক্রমাগতই প্রসারিত হচ্ছে-আধুনিক প্রযুক্তিসমূহ দ্বারা গবেষণা , পর্যবেক্ষণ আর গণনা চালিয়ে এ তথ্যটি পাওয়া গেছে।

বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে রাশিয়ান পদার্থবিদAlexander Friedmann এবং বেলজিয়ামের মহাবিশ্ববিষয়ক বিজ্ঞানীGeorges Lemaitre থিওরী দিয়ে বা তত্ত্বগতভাবে গণনা করে দেখেন যে বিশ্বব্রহ্মান্ড বিরামহীনভাবে নিয়তই গতিশীল রয়েছে আর এটি প্রসারিতও হচ্ছে।

১৯২৯ সালে পর্যবেক্ষণমূলক ডাটার মাধ্যমেও এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়। আমেরিকান জ্যোতির্বিদEdwin Hubble একটি টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন যে নক্ষত্রপুঞ্জ আর গ্যালক্সিগুলো পরস্পর থেকে ক্রমাগতই দূরে সরে যাচ্ছে । বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে সবকিছু পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে , এতেই প্রমাণিত হয় যে এই মহাবিশ্ব নিয়ত প্রসারিত মহাবিশ্ব ।

মহাবিস্ফোরণের মুহূর্ত থেকেই বিশ্বব্রহ্মান্ড এক বিশাল বেগে ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীগণ মহাবিশ্বের এই প্রসারণকে বাতাসে ফোলানো একটি বেলুনের পৃষ্ঠের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

মহাবিশ্ব যে প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে - এটির সত্যতা পরবর্তী বছরসমূহের পর্যবেক্ষণ দ্বারা প্রমাণিত হয়। অথচ এই বিষয়টি পবিত্র কোরআনে যে সময়টিতে ব্যাখ্যা করা হয় তখন তা কেউ জানতো না। কেননা কোরআন আল্লাহর বাণী , যিনি সমগ্র বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা ও শাসনকর্তা।

আকাশ ও পৃথিবীর বিভক্তি ও পৃথকীকরন

গগনমন্ডলীর সৃষ্টি প্রসঙ্গে আরেকটি আয়াতে নিম্নের উক্তিটি করা হয়েছে :

অবিশ্বাসীরা কি ইহা লক্ষ্য করে নাই যে আকাশ ও পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল ( সংযুক্ত অবস্থায় ছিল ) , তারপর আমি উভয়কে আলাদা করে দিলাম এবং প্রাণবান সমস্ত কিছু আমি সৃষ্টি করলাম পানি থেকে। তবুও কি তারা ঈমান আনবে না ? (কোরআন , ২১ : ৩০)

আরবী অভিধানে রাত্ক্ব (RATQ ) শব্দটি অনূদিত হয়েছে সেলাইকৃত , বুননকৃত শব্দে যার অর্থ একটি অপরটির সঙ্গে সংযুক্ত বা সংমিশ্রিত হয়ে একাকার অবস্থায় ছিল । ভিন্ন ভিন্ন দুটি বস্তু মিলে একটি অখণ্ড বস্তু তৈরী করে - এটি উল্লেখ করতেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আমি সেলাই খুলে বিযুক্ত করেছি -এই শব্দ সমষ্টি আরবীতে একটি ক্রিয়াপদ ফাতাক্ব্ (fataqa ) দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এই শব্দটি এটাই সূচিত করে যে , কোন কিছু রাতক্ব অবস্থায় পূর্বে ছিল , এখন সেটি ছিঁড়ে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন আলাদা জিনিষ অস্তিত্ত্বে এসেছে। মাটি ভেদ করে একটি বীজ থেকে অংকুর বের হওয়ার কাজেও এই ক্রিয়াপদটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

চলুন আমরা হৃদয়ে এ ধারণাটি পোষণ করে আয়াতটির উপর আরেকবার দৃষ্টিপাত করি। এ আয়াতটি অনুসারে প্রথমে পৃথিবী আর গগনমন্ডল সংযুক্ত অবস্থায় রাতক্ব হিসেবে ছিল। এদের একটি অপরটি থেকে বের হয়ে আলাদা হয়েছে (ফাতাক্বা হয়েছে)। আগ্রহের সঙ্গে আমরা যখন মহাবিস্ফোরণের (Big Bang ) প্রথম মুহূর্তগুলো স্মরণ করে দেখি , তবে আমরা দেখতে পাই যে , মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তু বা পদার্থ একটি মাত্র বিন্দুতে বিদ্যমান ছিল। অন্যকথায় গগনমন্ডলী ও পৃথিবী - যখন তখনো সৃষ্টি - হয়নি তখন রাতক্ব অবস্থায় ছিল । প্রচন্ড বা ভয়ংকরভাবে বিন্দুটি বিস্ফোরিত হয় - যারই ফলে বিদ্যমান সমস্ত বস্তুগুলো - ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় ( ফাতাক্বাতে ) ; আর এ প্রক্রিয়াতেই সৃষ্ট হয়েছে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মান্ড।

বৈজ্ঞানিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যাবলীর সঙ্গে আয়াতটির অভিব্যক্তিগুলো তুলনা করে আমরা দেখতে পাই যে , এরা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে নিখুঁতভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যথেষ্ট কৌতুহলের ব্যাপার এটি যে বিংশ শতাব্দীর আগে এই তথ্যগুলো পাওয়া যায়নি।

কক্ষপথরাজি

পবিত্র কোরআনে যখনই চন্দ্র আর সূর্যের কথা বলা হয়েছে তখনই অত্যন্ত গুরুত্বের সহিত উল্লেখ করা হয়েছে যে , চন্দ্র আর সূর্য দুটিই নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় রয়েছে।

আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিন এবং চন্দ্র ও সূর্য। সবাই নিজ নিজ কক্ষপথে বিচরণ করে। (কোরআন , ২১ : ৩৩)-

সূর্য যে স্থির অবস্থায় নেই বরং একটি সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে বিচরণ করছে এ বিষয়টি আরেকটি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে : আর সূর্য স্বীয় গন্তব্য স্থানের দিকে চলতে থাকে। এটা পরাক্রমশালী , সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ। (কোরআন , ৩৬ : ৩৮)

এই যে বিষয়সমূহ কোরআনের মাধ্যমে আমরা অবগত হয়েছি সেগুলো আমাদের যুগে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ দ্বারা উদঘাটিত হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানে অভিজ্ঞজনদের গণনানুসারে সূর্যSolar Apex নামক একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘন্টায় ৭২০ ,০০০ কিলোমিটার বেগেVega নামক একটি নক্ষত্রের দিকে গতিশীল বা ভ্রমণরত রয়েছে। এর অর্থ এই দাড়ায় যে , সূর্য প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৭ ,২৮০ ,০০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে থাকে। সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের মাধ্যাকর্ষণজনিত সিস্টেমের আওতায় অন্তর্ভূক্ত অন্যান্য গ্রহ , নক্ষত্রগুলোও একই দূরত্ব অতিক্রম করে। অধিকন্তু বিশ্বব্রহ্মান্ডের সমস্ত নক্ষত্রপুঞ্জ ঠিক অনুরূপভাবে পরিকল্পিত গতিতে চলনশীল রয়েছে।

ঠিক এর মতোই গোটা বিশ্বব্রহ্মান্ড যে একই ধরণের পথ আর কক্ষপথে পরিপূর্ণ তা নিম্নরূপে কোরআনে বর্ণিত রয়েছে :

কসম বহু পথ আর কক্ষপথ বিশিষ্ট আসমানের। (কোরআন , ৫১ : ৭)

মহাবিশ্বে প্রায় ২০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে , যাদের প্রতিটি ২০০ বিলিয়ন নক্ষত্রপুঞ্জ নিয়ে গঠিত। বেশীর ভাগ নক্ষত্রের রয়েছে গ্রহ আর গ্রহের রয়েছে উপগ্রহ। গগনমন্ডলের সমস্ত বস্তুগুলোই সঠিকভাবে গণনাকৃত কক্ষপথসমূহে ঘুর্ণায়মানরত রয়েছে। মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে এদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে পরস্পরের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য ও সঠিক বিন্যাস রেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ ছাড়াও বহু ধুমকেতু রয়েছে যারা তাদের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষপথে বিচরণ করে।

মহাবিশ্বের কক্ষপথরাজি কেবলি এই গগনমন্ডলীর গ্রহ -নক্ষত্রের জন্য নয়। গ্যালাক্সিগুলোও সঠিকভাবে গণনাকৃত পরিকল্পিত কক্ষপথসমূহে বিশাল বেগে বিচরণ করে। এই বিচরণের সময় মহাকাশের কোন বস্তু একটি আরেকটির পথে চলে যায়না কিংবা সংঘর্ষে লিপ্ত হয় না।

এটা সুনিশ্চিত যে , কোরআন নাযিল হওয়ার কালে এখনকার মতো টেলিস্কোপ আবিষ্কৃত হয়নি , ছিলনা পর্যবেক্ষণের জন্য উন্নত প্রযুক্তি যার সাহায্যে এখন মহাশূণ্যের মিলিয়ন মিলিয়ন জায়গা পর্যবেক্ষণ করা যায় , ছিলনা পদার্থবিদ্যা বা জ্যোতির্বিদ্যার আধুনিক জ্ঞান ভান্ডার। কোরআনে যেমন বলা হয়েছে যে মহাশূণ্য পথ আর কক্ষপথসমূহে পরিপূর্ণ - যদিও তখনকার সময় তা নির্ণয় করা সম্ভব ছিল না। অথচ কোরআনে বেশ স্পষ্টভাবে বিষয়টি বর্ণিত রয়েছে - কেননা এই কোরআন মহাপরাক্রমশালী , মহাজ্ঞানী আল্লাহ তাআলার বাণী।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোরআনের অলৌকিকতা

অবতরণিকা

চৌদ্দশত বছর পূর্বে আল্লাহ তা আলা মানবজাতির পথচালিকা স্বরূপ কোরআন প্রেরণ করেছিলেন। এ স্বর্গীয় গ্রন্থখানা দৃঢ়ভাবে সমর্থন আর অনুসরণ করে মানবজাতি যেন সঠিক পথে পরিচালিত হয় এ আহ্বান করেছিলেন তিনি। নাযিল হওয়ার দিন থেকে শুরু করে শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত এ স্বর্গীয় আর সর্বশেষ বই খানা মানবজাতির জন্য একমাত্র পথচালিকা হিসেবে থেকে যাবে।

পবিত্র কোরআনের অসমকক্ষ আর অতুলনীয় রচনাশৈলী এবং এর মাঝে বিদ্যমান প্রকৃষ্ট , গভীর ও বিস্তৃত জ্ঞানই সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে এটি মহান আল্লাহ্ তাআলার বাণী। এ ছাড়াও কোরআনের এমন বহু অলৌকিক বৈশিষ্ট্যাবলী রয়েছে যেগুলো প্রমাণ করে যে এটি পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলারই নাযিলকৃত গ্রন্থ । এ সমস্ত গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যাদির একটি হলো-অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক যথার্থতা বা সত্যতা আজ থেকে ১৪০০ বছর আগেই কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছিল -যেগুলো কিনা আমরা সেদিন বিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিমালা দিয়ে আবিষ্কার বা সন্ধান করতে সক্ষম হয়েছি।

অবশ্যই কোরআন কোন বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ নয়। কিন্তু এরপরও বিজ্ঞান সংক্রান্ত বহু বিষয়াদি এ গ্রন্থটিতে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত রূপে ও সারগর্ভ হিসেবে বর্ণিত রয়েছে-যেগুলো বিংশ শতাব্দীর টেকনোলজী বা প্রযুক্তির মাধ্যমে কেবল সেদিন মানব জাতির সমক্ষে উন্মোচিত হয়েছে। কোরআন যখন নাযিল হয় , সে সময় এ বিষয়গুলো ছিল অজানা , এটি আরো প্রমাণ করে যে কোরআন আল্লাহর বাণী।

কোরআনে বর্ণিত বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয়াদি বুঝতে হলে আমাদের নজর দিতে হবে সে বিষয়টিতে যে কোরআন যখন নাযিল হয় বিজ্ঞান তখন কোন স্তরে ছিল।

সপ্তম শতাব্দীতে যখন কোরআন নাযিল হয় , সে সময়কার আরব সমাজে বৈজ্ঞানিক বিষয়াদিতে বহুবিধ কুসংস্কার আর ভিত্তিহীন বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। মহাবিশ্ব আর প্রকৃতি পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ করার মত কলাকৌশল বিদ্যমান না থাকায় সে সময়কার আদি আরব সমাজের মানুষ তাদের পূর্বপুরুষ থেকে প্রাপ্ত উপাখ্যান সমূহে বিশ্বাস করত। এরই একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায় যে , পৃথিবীর উপরিস্থিত আকাশই ধারণ করে আছে পর্বতসমূহকে। তাদের বিশ্বাস ছিল যে , পৃথিবী সমতল (গোলাকার নয়) ; আর পৃথিবীর-দু প্রান্তে রয়েছে উঁচু , উঁচু পর্বতমালা , ধারণা করা হত যে পর্বতমালাসমূহ স্তম্ভের ন্যায় পৃথিবীর উপরিস্থিত খিলান আকৃতির আকাশকে ধারণ করে আছে।

তবে যাই হোক কোরআন নাযিল হওয়ায় আরব সমাজের এসব কুসংস্কার দূরীভূত হয়ে যায়। সূরা রাদের দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে : তিনিই আল্লাহ যিনি কোন প্রকার অবলম্বন বা স্তম্ভের সাহায্য ছাড়াই আকাশসমূহকে সমুন্নত রেখেছেন । পর্বতমালা বিদ্যমান থাকার ফলেই গগনমন্ডল উপরে স্থির থাকতে পারছে - এরূপ বিশ্বাস উক্ত আয়াত দ্বারাই মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যায়। কোরআনে সেই সময়ে অন্যান্য বহু বিষয়াদি সংক্রান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী প্রকাশিত হয়েছিল যখন তা কারো পক্ষেই জানতে পারার কথা নয়। সে সময় মানুষ জ্যোতির্বিদ্যা , পদার্থবিদ্যা , কিংবা জীববিদ্যা বিষয়ে খুবই অল্প জ্ঞান রাখত। ঠিক তেমনি এক সময়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি , মানব সৃষ্টি , বায়ু মন্ডলের গঠন আর যে সুক্ষ্ম ভারসাম্য পৃথিবীর বুকে জীবের বা প্রাণের টিকে থাকা সম্ভব করে আছে - এ ধরণের বহু বিষয়াদির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী কোরআনে প্রকাশিত হয়েছে।

এখন চলুন আমরা কোরআনে প্রকাশিত বিজ্ঞান সংক্রান্ত কিছু অলৌকিক বিষয়াদির দিকে দৃষ্টিপাত করি।

মহাবিশ্ব সৃষ্টি

নিম্নের আয়াতটিতে বিশ্বব্রহ্মান্ডের উৎপত্তির কথা বর্ণিত রয়েছে :

তিনিই আদি স্রষ্টা আসমান ও জমিনের। ( কোরআন , ৬ : ১০১ )

পবিত্র কোরআনে প্রদত্ত এ তথ্যটি সমসাময়িক বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্যাবলীর সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সংগতিপূর্ণ । আজ জ্যোতির্বিদ্যা যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছেছে তা হলো-বস্তু আর সময়ের-পরিধিসহ গোটা মহাবিশ্ব অস্তিত্ত্বে এসেছে বিরাট এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে-যা কিনা খুব তড়িৎ গতিতে ঘটেছিল। মহাবিস্ফোরণ (Big Bang ) নামের এই ঘটনাটি একটিমাত্র ক্ষুদ্র বিন্দুর বিস্ফোরণের ফলে মহাবিশ্ব অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্ত্বে এসেছে। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি আর কিভাবে তা অস্তিত্ত্বে এসেছে-এ ব্যাপারে আধুনিক বিজ্ঞান পরিষদ একই মত পোষণ করে যে-মহাবিস্ফোরণই মহাবিশ্বের উৎপত্তি আর অস্তিত্ত্বের একমাত্র যৌক্তিক আর গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদান করে।

মহাবিস্ফোরণের পূর্বে পদার্থ বা বস্তু বলে কিছূ ছিলনা। এমনি এক অস্তিত্বহীন বা শূণ্যাবস্থা , যেথায় বিদ্যমান ছিল না কোন পদার্থ , না কোন শক্তি , এমনকি সময়ের অস্তিত্ত্ব ছিলনা-যা কেবল অধিবিদ্যামূলক (Metaphysically ) কিংবা বিমূর্ত আলোচনায় বর্ণনা করা যায় তেমনি একটি অবস্থা থেকে পদার্থ , শক্তি আর সময়ের সৃষ্টি হয়েছে। এই যে বিষয়টি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের মাধ্যমে কেবলি সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে-তাই ১৪০০ বছর আগে কোরআন মানবজাতির উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেছিল।

১৯৯২ সালে নাসা( NASA) Cobe Space স্যাটেলাইট পাঠায় যার সংবেদনশীল সেন্সরগুলো মহাবিস্ফোরণের ঘটনামূলক অবশিষ্টাংশ বা ছিটেফোটা ধরে রাখতে সক্ষম হয়। এই আবিষ্কার মহাবিস্ফোরণের প্রমাণ বহন করে , যা কিনা মহাবিশ্ব যে শূণ্যাবস্থা থেকে সৃষ্ট হয়েছে তারই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।

মহাবিশ্বের প্রসারণ

১৪০০ বছর পূর্বে যখন জ্যোতির্বিদ্যা ছিল তখনও আদিম অবস্থায় , তখনই আল্লাহ্ তাআলা কর্তৃক নাযিলকৃত কোরআনে বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রসারণের বিষয়টি এমনভাবে বর্ণিত হয় :

আর আমি স্বীয় ক্ষমতাবলে আসমানকে সৃষ্টি করেছি আর আমি অবশ্যই নিয়মিতভাবে তা প্রসারিত করছি। ( কোরআন , ৫১ : ৪৭ )

এই আয়াতটিতে উক্ত“Heavens” শব্দটি দিয়ে কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় মহাশূণ্য আর বিশ্বব্রহ্মান্ডকে নির্দেশ করা হয়েছে। এখানে শব্দটি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্য কথায় মহাবিশ্বের প্রসারণের ব্যাপারটি কোরআনে প্রকাশ হয়েছে। আর এটাই সেই পরম সিদ্ধান্ত বা কথা যেখানে বিজ্ঞান আজ পৌছেছে।

বিংশ শতাব্দীর উষালগ্ন পর্যন্ত বিজ্ঞান জগতে এই একটিমাত্র ধারণা প্রচলিত ছিল যে , মহাবিশ্বের রয়েছে একটি স্থির বা অপরিবর্তনীয় প্রকৃতি বা অবস্থা এবং অননন্তকাল -ধরেই এর অস্তিত্ব রয়েছে। অর্থাৎ এর কোন শুরু নেই , পরিবর্তনও নেই। যাই হোক প্রকৃতপক্ষেই মহাবিশ্বেরও যে একটি সূচনা বা আরম্ভ ছিল আর এটি ক্রমাগতই প্রসারিত হচ্ছে-আধুনিক প্রযুক্তিসমূহ দ্বারা গবেষণা , পর্যবেক্ষণ আর গণনা চালিয়ে এ তথ্যটি পাওয়া গেছে।

বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে রাশিয়ান পদার্থবিদAlexander Friedmann এবং বেলজিয়ামের মহাবিশ্ববিষয়ক বিজ্ঞানীGeorges Lemaitre থিওরী দিয়ে বা তত্ত্বগতভাবে গণনা করে দেখেন যে বিশ্বব্রহ্মান্ড বিরামহীনভাবে নিয়তই গতিশীল রয়েছে আর এটি প্রসারিতও হচ্ছে।

১৯২৯ সালে পর্যবেক্ষণমূলক ডাটার মাধ্যমেও এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়। আমেরিকান জ্যোতির্বিদEdwin Hubble একটি টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন যে নক্ষত্রপুঞ্জ আর গ্যালক্সিগুলো পরস্পর থেকে ক্রমাগতই দূরে সরে যাচ্ছে । বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে সবকিছু পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে , এতেই প্রমাণিত হয় যে এই মহাবিশ্ব নিয়ত প্রসারিত মহাবিশ্ব ।

মহাবিস্ফোরণের মুহূর্ত থেকেই বিশ্বব্রহ্মান্ড এক বিশাল বেগে ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীগণ মহাবিশ্বের এই প্রসারণকে বাতাসে ফোলানো একটি বেলুনের পৃষ্ঠের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

মহাবিশ্ব যে প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে - এটির সত্যতা পরবর্তী বছরসমূহের পর্যবেক্ষণ দ্বারা প্রমাণিত হয়। অথচ এই বিষয়টি পবিত্র কোরআনে যে সময়টিতে ব্যাখ্যা করা হয় তখন তা কেউ জানতো না। কেননা কোরআন আল্লাহর বাণী , যিনি সমগ্র বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা ও শাসনকর্তা।

আকাশ ও পৃথিবীর বিভক্তি ও পৃথকীকরন

গগনমন্ডলীর সৃষ্টি প্রসঙ্গে আরেকটি আয়াতে নিম্নের উক্তিটি করা হয়েছে :

অবিশ্বাসীরা কি ইহা লক্ষ্য করে নাই যে আকাশ ও পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল ( সংযুক্ত অবস্থায় ছিল ) , তারপর আমি উভয়কে আলাদা করে দিলাম এবং প্রাণবান সমস্ত কিছু আমি সৃষ্টি করলাম পানি থেকে। তবুও কি তারা ঈমান আনবে না ? (কোরআন , ২১ : ৩০)

আরবী অভিধানে রাত্ক্ব (RATQ ) শব্দটি অনূদিত হয়েছে সেলাইকৃত , বুননকৃত শব্দে যার অর্থ একটি অপরটির সঙ্গে সংযুক্ত বা সংমিশ্রিত হয়ে একাকার অবস্থায় ছিল । ভিন্ন ভিন্ন দুটি বস্তু মিলে একটি অখণ্ড বস্তু তৈরী করে - এটি উল্লেখ করতেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আমি সেলাই খুলে বিযুক্ত করেছি -এই শব্দ সমষ্টি আরবীতে একটি ক্রিয়াপদ ফাতাক্ব্ (fataqa ) দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এই শব্দটি এটাই সূচিত করে যে , কোন কিছু রাতক্ব অবস্থায় পূর্বে ছিল , এখন সেটি ছিঁড়ে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন আলাদা জিনিষ অস্তিত্ত্বে এসেছে। মাটি ভেদ করে একটি বীজ থেকে অংকুর বের হওয়ার কাজেও এই ক্রিয়াপদটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

চলুন আমরা হৃদয়ে এ ধারণাটি পোষণ করে আয়াতটির উপর আরেকবার দৃষ্টিপাত করি। এ আয়াতটি অনুসারে প্রথমে পৃথিবী আর গগনমন্ডল সংযুক্ত অবস্থায় রাতক্ব হিসেবে ছিল। এদের একটি অপরটি থেকে বের হয়ে আলাদা হয়েছে (ফাতাক্বা হয়েছে)। আগ্রহের সঙ্গে আমরা যখন মহাবিস্ফোরণের (Big Bang ) প্রথম মুহূর্তগুলো স্মরণ করে দেখি , তবে আমরা দেখতে পাই যে , মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তু বা পদার্থ একটি মাত্র বিন্দুতে বিদ্যমান ছিল। অন্যকথায় গগনমন্ডলী ও পৃথিবী - যখন তখনো সৃষ্টি - হয়নি তখন রাতক্ব অবস্থায় ছিল । প্রচন্ড বা ভয়ংকরভাবে বিন্দুটি বিস্ফোরিত হয় - যারই ফলে বিদ্যমান সমস্ত বস্তুগুলো - ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় ( ফাতাক্বাতে ) ; আর এ প্রক্রিয়াতেই সৃষ্ট হয়েছে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মান্ড।

বৈজ্ঞানিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যাবলীর সঙ্গে আয়াতটির অভিব্যক্তিগুলো তুলনা করে আমরা দেখতে পাই যে , এরা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে নিখুঁতভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যথেষ্ট কৌতুহলের ব্যাপার এটি যে বিংশ শতাব্দীর আগে এই তথ্যগুলো পাওয়া যায়নি।

কক্ষপথরাজি

পবিত্র কোরআনে যখনই চন্দ্র আর সূর্যের কথা বলা হয়েছে তখনই অত্যন্ত গুরুত্বের সহিত উল্লেখ করা হয়েছে যে , চন্দ্র আর সূর্য দুটিই নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় রয়েছে।

আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিন এবং চন্দ্র ও সূর্য। সবাই নিজ নিজ কক্ষপথে বিচরণ করে। (কোরআন , ২১ : ৩৩)-

সূর্য যে স্থির অবস্থায় নেই বরং একটি সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে বিচরণ করছে এ বিষয়টি আরেকটি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে : আর সূর্য স্বীয় গন্তব্য স্থানের দিকে চলতে থাকে। এটা পরাক্রমশালী , সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ। (কোরআন , ৩৬ : ৩৮)

এই যে বিষয়সমূহ কোরআনের মাধ্যমে আমরা অবগত হয়েছি সেগুলো আমাদের যুগে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ দ্বারা উদঘাটিত হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানে অভিজ্ঞজনদের গণনানুসারে সূর্যSolar Apex নামক একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘন্টায় ৭২০ ,০০০ কিলোমিটার বেগেVega নামক একটি নক্ষত্রের দিকে গতিশীল বা ভ্রমণরত রয়েছে। এর অর্থ এই দাড়ায় যে , সূর্য প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৭ ,২৮০ ,০০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে থাকে। সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের মাধ্যাকর্ষণজনিত সিস্টেমের আওতায় অন্তর্ভূক্ত অন্যান্য গ্রহ , নক্ষত্রগুলোও একই দূরত্ব অতিক্রম করে। অধিকন্তু বিশ্বব্রহ্মান্ডের সমস্ত নক্ষত্রপুঞ্জ ঠিক অনুরূপভাবে পরিকল্পিত গতিতে চলনশীল রয়েছে।

ঠিক এর মতোই গোটা বিশ্বব্রহ্মান্ড যে একই ধরণের পথ আর কক্ষপথে পরিপূর্ণ তা নিম্নরূপে কোরআনে বর্ণিত রয়েছে :

কসম বহু পথ আর কক্ষপথ বিশিষ্ট আসমানের। (কোরআন , ৫১ : ৭)

মহাবিশ্বে প্রায় ২০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে , যাদের প্রতিটি ২০০ বিলিয়ন নক্ষত্রপুঞ্জ নিয়ে গঠিত। বেশীর ভাগ নক্ষত্রের রয়েছে গ্রহ আর গ্রহের রয়েছে উপগ্রহ। গগনমন্ডলের সমস্ত বস্তুগুলোই সঠিকভাবে গণনাকৃত কক্ষপথসমূহে ঘুর্ণায়মানরত রয়েছে। মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে এদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে পরস্পরের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য ও সঠিক বিন্যাস রেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ ছাড়াও বহু ধুমকেতু রয়েছে যারা তাদের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষপথে বিচরণ করে।

মহাবিশ্বের কক্ষপথরাজি কেবলি এই গগনমন্ডলীর গ্রহ -নক্ষত্রের জন্য নয়। গ্যালাক্সিগুলোও সঠিকভাবে গণনাকৃত পরিকল্পিত কক্ষপথসমূহে বিশাল বেগে বিচরণ করে। এই বিচরণের সময় মহাকাশের কোন বস্তু একটি আরেকটির পথে চলে যায়না কিংবা সংঘর্ষে লিপ্ত হয় না।

এটা সুনিশ্চিত যে , কোরআন নাযিল হওয়ার কালে এখনকার মতো টেলিস্কোপ আবিষ্কৃত হয়নি , ছিলনা পর্যবেক্ষণের জন্য উন্নত প্রযুক্তি যার সাহায্যে এখন মহাশূণ্যের মিলিয়ন মিলিয়ন জায়গা পর্যবেক্ষণ করা যায় , ছিলনা পদার্থবিদ্যা বা জ্যোতির্বিদ্যার আধুনিক জ্ঞান ভান্ডার। কোরআনে যেমন বলা হয়েছে যে মহাশূণ্য পথ আর কক্ষপথসমূহে পরিপূর্ণ - যদিও তখনকার সময় তা নির্ণয় করা সম্ভব ছিল না। অথচ কোরআনে বেশ স্পষ্টভাবে বিষয়টি বর্ণিত রয়েছে - কেননা এই কোরআন মহাপরাক্রমশালী , মহাজ্ঞানী আল্লাহ তাআলার বাণী।


6

7

8

9

10

11

12

13

14

15