অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম 20%

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 22 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 20101 / ডাউনলোড: 3820
সাইজ সাইজ সাইজ
অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

আল্লাহ্ তা‘আলার সৃষ্টিনিচয়ের মধ্যে মানুষের রয়েছে এক অনন্য অবস্থান। আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকল মানুষের নিকট এটা সুস্পষ্ট ও স্বীকৃত যে, প্রাণী প্রজাতিসমূহের মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্ব যতোটা তার সৃজনশীলতার কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশী তার বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্) ও ইচ্ছাশক্তির কারণে। এ দু’টি বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ তার সহজাত প্রকৃতিকে পরাভূত করতে সক্ষম। যে সব বিষয় গোটা মানব জাতির কর্ম ও আচরণকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতা থাকা-নাথাকা সংক্রান্ত ধারণা। এ ক্ষেত্রে বেশীর ভাগ মানুষই তাত্ত্বিকভাবে বিশ্বাস করে যে, মানুষের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতা বলতে কিছুই নেই, বরং তার জন্ম-মৃত্যু এবং সারা জীবনের কার্যাবলী ও সুখ-দুঃখ পূর্ব থেকেই নির্ধারিত হয়ে আছে বা তার প্রতিটি কাজই আল্লাহ্ তা‘আলা তার দ্বারা করিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু তাদের বেশীর ভাগ কাজকর্ম ও কথাবার্তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, তারা নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতায় বিশ্বাসী। বস্তুতঃ তাদের তাত্ত্বিক বিশ্বাস তাদের কর্ম ও আচরণের ওপর খুব কমই ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে, বরং তা কেবল ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাবই বিস্তার করে থাকে। মানব জাতিকে, বিশেষ করে মুসলমানদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্যে এ প্রশ্নটির সঠিক সমাধান উদ্ভাবন অপরিহার্য। এ লক্ষ্যেই অত্র গ্রন্থ রচনার প্রয়াস।

 


1

2

শয়তানের হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গ

অনেক মানুষই মনে করে যে , মানুষের গোমরাহীর জন্য কেবল শয়তানই দায়ী। তাদের ধারণা , শয়তানকে সৃষ্টি করা না হলে হযরত আদম ও হযরত হাওয়া (আঃ) বেহেশত থেকে বহিষ্কৃত হতেন না এবং আমরা (মানব প্রজাতি) বেহেশতেই থাকতাম। কেউ কেউ অজ্ঞতাবশতঃ এতদূর পর্যন্ত বলে যে , আল্লাহ্ তা আলা মানুষকে গোমরাহ্ করার উদ্দেশ্যেই আগেই শয়তানকে (অর্থাৎ আযাযীল বা ইবলীসকে) সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। বলা বাহুল্য যে , এটা মহান আল্লাহ্ তা আলা সম্পর্কে অত্যন্ত হীন ধারণা।

যেহেতু বিষয়টি মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ সংক্রান্ত ধারণারই অংশবিশেষ এবং বিশেষ করে এ ধারণায় মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় নিপতিত হওয়া ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তা আলাকেই দায়ী করা হয় সেহেতু এ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলা জরুরী বলে মনে হয়।

প্রথম কথা হচ্ছে এই যে , শয়তানের গোমরাহ্ করার ক্ষমতা অদৃষ্টবাদ প্রমাণ করে না , বরং অদৃষ্টবাদকে খণ্ডন করে। কারণ , এ থেকে প্রমাণিত হয় যে , আল্লাহ্ তা আলা সৃষ্টির সূচনার পূর্বে মানুষ সহ প্রতিটি প্রাণশীল সৃষ্টির ভবিষ্যতের ছোটবড় সবকিছু নির্ধারণ করে রাখেন নি। কেননা , আল্লাহ্ তা আলা সৃষ্টির সূচনার পূর্বে সব কিছু নির্ধারণ করে রেখে থাকলে শয়তানের কোনো ক্ষমতা থাকার প্রশ্ন ওঠে না। তেমনি শয়তানের ক্ষমতা এ-ও প্রমাণ করে যে , প্রতি মুহূর্তে মানুষ সহ সকল সৃষ্টির প্রতিটি কাজ স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা করেন বা করিয়ে নেন-এ ধারণাও পুরোপুরি ভ্রান্ত।

এ প্রসঙ্গে আরো কয়েকটি আনুষঙ্গিক ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করা যরূরী বলে মনে হয়। এসব ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে , আযাযীল (শয়তান) ফেরেশতা ছিলো এবং ফেরেশতাদের শিক্ষক ছিলো। অবশ্য যারা জানে যে , কোরআন মজীদে আযাযীলের জিন্ প্রজাতির সদস্য হওয়ার কথা উল্লেখ আছে , তাদের অনেকে মনে করে যে , সে জিন্ হলেও ফেরেশতাদের শিক্ষক ছিলো। আর এদের সকলেই মনে করে যে , সে অত্যন্ত উঁচু স্তরের আাবেদ (আল্লাহ্ তা আলার ইবাদতকারী) ছিলো ; অতঃপর আল্লাহ্ তা আলার একটিমাত্র হুকুম অমান্য করে [হযরত আদম (আঃ)কে সিজদাহ্ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে] আল্লাহর অভিসম্পাতের শিকার হয়। এজন্য অনেকে বিস্ময়করভাবে দাবী করে যে , আযাযীল ছিলো সবচেয়ে বড় তাওহীদবাদী , এ কারণে সে আল্লাহ্ ছাড়া আর কাউকে সিজদাহ্ করতে রাযী হয় নি। (!!!)

এসব দাবী অকাট্য দলীল বিহীন ভিত্তিহীন কাল্পনিক দাবী মাত্র। কারণ , আযাযীল বা ইবলীস ফেরেশতা ছিলো না। ফেরেশতারা আল্লাহ্ তা আলার নাফরমানী করতে পারে না ; নাফরমানীর মূল চালিকাশক্তি স্বাধীনতা ভোগের প্রবণতা , বিশেষতঃ কুপ্রবৃত্তি থেকে তারা মুক্ত। বরং আযাযীল জিন্ প্রজাতির সদস্য ছিলো (সূরাহ্ আল্-কাহ্ফ্: ৫০) ।

আর যারা স্বীকার করেন যে , আযাযীল জিন্ প্রজাতির সদস্য ছিলো , কিন্তু অত্যন্ত উঁচু দরের আলেম ও আাবেদ ছিলো বিধায় আল্লাহ্ তা আলা তাকে ফেরেশতাদের শিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন। এ দাবীরও কোনো ভিত্তি নেই। বিশেষ করে ফেরেশেতাদের সম্পর্কে ইসলামের অকাট্য সূত্রসমূহ থেকে যে ধারণা পাওয়া যায় তা হচ্ছে তাদের মধ্যে অজ্ঞতা , সুপ্ত প্রতিভা ও প্রতিভার বিকাশ ও জ্ঞানার্জন বলতে কোনো কিছু নেই। বরং সৃষ্টিগতভাবেই তারা আল্লাহ্ তা আলা সম্পর্কিত , স্বীয় নিয়মিত দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কিত ও আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে সৃষ্টি সম্পর্কে প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী এবং সেই সাথে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে যখনই যে হুকুম দেয়া হয় তা পালনের প্রবণতার অধিকারী। এমতাবস্থায় তাদের জন্য শিক্ষক নিয়োগের ধারণা একটি একান্তই অবান্তর ধারণা।

অন্যদিকে জিন্ প্রজাতির সদস্য আযাযীল আদৌ কোনো আাবেদ ছিলো না। বরং হযরত আদম (আঃ)-এর সৃষ্টির পূর্ব থেকেই সে নাফরমান ছিলো। হযরত আদম (আঃ)কে সিজদাহ্ করতে আযাযীল ইবলীসের অস্বীকৃতি প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন:

( أَبَى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ)

সে (আল্লাহর হুকুম পালনে) অস্বীকৃতি জানালো ও বড়ত্ব দাবী করলো (অহঙ্কার করলো) ; আর সে ছিলো কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ৩৪)

অনেকে এ আয়াতের শেষ বাক্যের অর্থ করেন: আর সে কাফের হয়ে গেলো। বা আর সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলো। কিন্তু এরূপ অর্থ গ্রহণ করা ঠিক নয়। সে মুসলমান (আল্লাহর অনুগত) ছিলো , কিন্তু কাফের হয়ে গেলো-এটা বুঝাতে চাওয়া হলে বলা হতো:فاصبح کافراً (ফলে সে কাফের হয়ে গেলো)। কিন্তু আয়াতে যা বলা হয়েছে তা থেকে সুস্পষ্ট যে , সে পূর্ব থেকেই কাফের ছিলো। শুধু তা-ই নয় , আয়াত থেকে এ-ও বুঝা যায় যে , হযরত আদম (আঃ)কে সিজদাহ্ করার জন্য আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে যখন হুকুম দেয়া হয় তখন সে একাই কাফের ছিলো না , বরং পূর্ব থেকেই একটি গোষ্ঠী (একদল জিন্) কাফের ছিলো ; ইবলীস ছিলো তাদের নেতা।

এমনকি আল্লাহ্ তা আলা হযরত আদম (আঃ)কে সিজদাহ্ করার জন্য ইবলীসকে হুকুম না দিলে সে হযরত আদম (আঃ) ও মানব প্রজাতির ক্ষতি করার (তাদেরকে গোমরাহ্ করার) চেষ্টা করতো না-এরূপ মনে করাও ঠিক নয়। কারণ , কুফর্ বা খোদাদ্রোহিতার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে মু মিনদেরকে কুফরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা।

অন্যদিকে ঐ সময় ইবলীসের অস্তিত্ব না থাকলেও তথা ইবলীসকে আদৌ সৃষ্টি করা না হলেও মানব প্রজাতিকে বেহেশতে রাখা হতো না। কারণ , মানুষকে সৃষ্টি করাই হয়েছিলো ধরণীর বুকে আল্লাহ্ তা আলার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ৩০)।

অবশ্য বেহেশতে থাকাকালে ইবলীসের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার ঘটনা না ঘটলে কোনোরূপ তিক্ত অভিজ্ঞতা ছাড়াই হযরত আদম ও হযরত হাওয়া (আঃ)কে বেহেশত ছেড়ে যমীনে আসতে হতো।

ইবলীসের অস্তিত্ব না থাকলে কোনো মানুষই নাফরমান হতো না তা নয়। কারণ , স্বাধীনতার মানেই হচ্ছে নাফরমানী ও ফরমানবরদারী উভয়েরই সম্ভাবনা। আল্লাহ্ তা আলা যখন ধরণীর বুকে তাঁর প্রতিনিধি (খলীফাহ্) পাঠাবার কথা ঘোষণা করেন (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ৩০) তখনই ফেরেশতারা ধারণা করে নেয় যে , আল্লাহর প্রতিনিধিগণ (অন্ততঃ তাদের একাংশ) নাফরমানী করবে (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ৩০)। কারণ , খলীফাহ্ (স্থলাভিষিক্ত) শব্দ থেকেই তারা বুঝতে পেরেছিলো যে , আল্লাহ্ তা আলার ক্ষমতা , এখতিয়ার ও গুণাবলীর অনুরূপ ক্ষমতা , এখতিয়ার ও গুণাবলী এ নতুন সৃষ্টিকে (সীমিত পরিমাণে হলেও) দেয়া হবে , কিন্তু সৃষ্টি হওয়া জনিত সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার কারণে তাদের দ্বারা স্বীয় ক্ষমতা ও এখতিয়ারের অপব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। অসম্ভব নয় যে , ইতিপূর্বে বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন ও স্বাধীনতার অধিকারী সৃষ্টি জিন্ প্রজাতির সদস্যদের একাংশের নাফরমানী দেখেই তাদের এ ধারণা হয়ে থাকবে। বিশেষ করে জিন্ প্রজাতি আল্লাহ্ তা আলার খলীফাহ্ ছিলো না বিধায় তাদের ক্ষমতা , এখতিয়ার ও স্বাধীনতা ছিলো অপেক্ষাকৃত সীমিত , কিন্তু আল্লাহ্ তা আলার খলীফাহ্ হওয়ার কারণে মানুষের ক্ষমতা , এখতিয়ার ও স্বাধীনতা হবে তাদের চেয়ে অনেক বেশী। এমতাবস্থায় তাদের মধ্যকার অন্ততঃ একাংশের পক্ষ থেকে নাফরমানী হওয়াই স্বাভাবিক।

মোদ্দা কথা , নাফরমান ইবলীস না থাকলেও কতক মানুষ নাফরমান হতো।

বস্তুতঃ শয়তান কোনো ব্যক্তিবাচক নাম নয় , বরং গুণবাচক নাম। তাই আল্লাহ্ তা আলার এ সৃষ্টিলোকে ইবলীস বা আযাযীল একাই শয়তান নয়। কোরআন মজীদে শাইত্বান শব্দের বহু বচন শায়াত্বীন্ শব্দটি ১৮ বার ব্যবহৃত হয়েছে। জিন্ ও মানুষ উভয় প্রজাতির মধ্যেই শয়তান রয়েছে (সূরাহ্ আল্-আন্ আম্: ১১২)। শুধু মানুষ শয়তানদের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ১৪)। প্রায় অভিন্ন অর্থে খান্নাস্ শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে , যে মানুষের অন্তরে ওয়াস্ওয়াসাহ্ (কুমন্ত্রণা ও সন্দেহ-সংশয়) সৃষ্টি করে এবং এ ধরনের খান্নাস্ মানুষ ও জিন্ উভয় প্রজাতির মধ্যেই রয়েছে (সূরাহ্ আন্-নাস্: ৫-৬)।

প্রকৃত পক্ষে মানুষকে গোমরাহ্ করার ক্ষেত্রে মানুষের নিজের ভূমিকা ইবলীসের চেয়ে বেশী। তাই যে ব্যক্তি গোমরাহ্ হতে চায় না তাকে গোমরাহ্ করার কোনো ক্ষমতাই ইবলীসের নেই (সূরাহ্ ইবরাহীম: ২২ ; আল্-হিজর্: ৪২ ; আন্-নাহল্: ৯৯ ; ইসরা / বানী ইসরাঈল: ৬৫)। অন্যদিকে কতক লোক স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে প্রবৃত্তিপূজায় লিপ্ত হয় , কোরআন মজীদের ভাষায় , স্বীয় প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহ্ রূপে গ্রহণ করে (সূরাহ্ আল্-ফুরক্বান্: ৪৩ ; আল্-জাছিয়াহ্: ২৩)। এ ধরনের লোককে হেদায়াত করা স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর জন্যও সম্ভব ছিলো না (সূরাহ্ আল্-ফুরক্বান্: ৪৩)।

অতএব , সুস্পষ্ট যে , মানুষের গোমরাহীর জন্য সে নিজেই মুখ্য কারণ ; ইবলীস সহ অন্যান্য শয়তান গৌণ কারণ মাত্র।

একাধিক সম্ভাবনাযুক্ত ও অনিশ্চিত ভবিষ্যত

আমরা ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করেছি , ভবিষ্যতের একটি অংশ সুনিশ্চিতরূপে এবং একটি অংশ দুই বা ততোধিক সম্ভাবনাযুক্ত রয়েছে। আল্লাহ্ তা আলার ভবিষ্যত বিষয়ক জ্ঞানে এ উভয় ধরনের বিষয়াদিই শামিল রয়েছে। অবশ্য ভবিষ্যতের আরো একটি অংশ রয়েছে যা শূন্য তথা পুরোপুরি অনিশ্চিত।

যে সব বিষয় সংঘটিত হওয়ার পূর্ণ কারণ বিদ্যমান তা সংঘটিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। এই পূর্ণ কারণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আল্লাহ্ তা আলার মূল সৃষ্টিলক্ষ্য ও সৃষ্টি পরিকল্পনা , প্রাকৃতিক বিধিবিধানের প্রতিক্রিয়া , প্রাণীজ ও মানবিক কার্যক্রমের প্রতিক্রিয়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে আল্লাহ্ তা আলার প্রাজ্ঞ হস্তক্ষেপের ফল। এর কোনো একটি বা একাধিক বা সবগুলো কারণ যা অনিবার্য করে তোলে তা সংঘটিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। তবে প্রথম ও শেষ কারণ অর্থাৎ আল্লাহ্ তা আলার মূল সৃষ্টিলক্ষ্য ও সৃষ্টি পরিকল্পনা এবং তাঁর হস্তক্ষেপের প্রতিক্রিয়া ব্যতীত অন্যান্য কারণের প্রতিক্রিয়াকে ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলা চাইলে পরিবর্তিত করে দেন। কিন্তু যেহেতু আল্লাহ্ তা আলার তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ ব্যতিক্রম , সেহেতু ভবিষ্যতের এ অংশটিকে অর্থাৎ পূর্ণ কারণ যা অনিবার্য করে ফেলেছে তাকে আমরা অনিবার্য বলে গণ্য করতে পারি।

অন্যদিকে পূর্ণ কারণ ভবিষ্যতের একটি অংশকে দুই বা ততোধিক সম্ভাবনাযুক্ত করে রেখেছে-ভবিষ্যতে কোনো না কোনো কারণ যার একটি বাদে অপর সম্ভাবনাটিকে বা সম্ভাবনাগুলোকে বিলুপ্ত করে দেবে এবং যে সম্ভাবনাটি অবশিষ্ট থাকবে তা অনিবার্য হয়ে উঠবে।

এছাড়া ভবিষ্যতের রয়েছে এক সীমাহীন শূন্য দিগন্ত যেখানে কোনো কারণ কোনো কিছুকে অনিবার্য অথবা দুই বা ততোথিক সম্ভাবনাযুক্ত করে তোলে নি। অন্য কথায় , ভবিষ্যতের একটি অংশে কোনই কারণ বিদ্যমান নেই অর্থাৎ আল্লাহ্ তা আলা ভবিষ্যতের একটি অংশকে সকল প্রকার কারণ থেকে মুক্ত রেখেছেন। এরূপ ক্ষেত্রে কেবল আল্লাহ্ তা আলার ভবিষ্যত ইচ্ছাই কোনো কিছুকে অনিবার্য অথবা দুই বা ততোধিক সম্ভাবনাযুক্ত করে তুলতে পারে।

আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন:

( يَمْحُو اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ وَعِنْدَهُ أُمُّ الْكِتَابِ)

আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করেন নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং (যা ইচ্ছা করেন) স্থির করে দেন। আর তাঁর সামনে রয়েছে গ্রন্থজননী (উম্মুল কিতাব)। (সূরাহ্ আর্-রা দ্: ৩৯) অর্থাৎ উম্মুল কিতাবে কতগুলো ভবিষ্যত বিষয় একাধিক সম্ভাবনাযুক্ত রূপে নিহিত রয়েছে।

তিনি আরো এরশাদ করেন:

( الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلً)

[তিনি (অর্থাৎ আল্লাহ্) পরম বরকতময়] যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যাতে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন যে , তোমাদের মধ্যে কর্মের বিচারে কে অধিকতর উত্তম। (সূরাহ্ আল্-মুলক্: ২)

এর মানে আল্লাহ্ তা আলা সৃষ্টির শুরুতেই নির্ধারণ করে রাখেন নি যে , কর্মের বিচারে কে ভালো হবে ও কে মন্দ হবে। অর্থাৎ তিনি মানুষকে ভালো-মন্দের উভয় সম্ভাবনাযুক্ত করে সৃষ্টি করেছেন। যেহেতু পরীক্ষা করাই উদ্দেশ্য সেহেতু তিনি ব্যক্তি-মানুষের ভবিষ্যতকে ভালো ও মন্দের সমান সম্ভাবনাযুক্ত করে দিয়েছেন , অতঃপর বিভিন্ন কারণ তাকে প্রভাবিত করে , তবে ভালো-মন্দ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি সবচেয়ে বেশী প্রভাবশালী কারণ যা অন্য সমস্ত কারণ ও তজ্জনিত সম্ভাবনা সমূহকে পরাভূত করতে সক্ষম।

এছাড়া কোরআন মজীদে এমন বহু আয়াত রয়েছে যাতে কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার বিষয়কে শর্তযুক্ত করে উপস্থাপন করা হয়েছে যা একাধিক সম্ভাবনাযুক্ত ভবিষ্যতেরই প্রমাণ বহন করে। এখানে আমরা মাত্র কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেই ক্ষান্ত থাকবো। যেমন , এরশাদ হয়েছে:

( وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ)

আর জনপদের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনতো ও তাক্বওয়া অবলম্বন করতো তাহলে অবশ্যই আমি তাদের জন্য আসমান ও যমীন থেকে বরকত সমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম। (সূরাহ্ আল্-আ রাফ্: ৯৬)

এ আয়াতে বরকত প্রাপ্তির জন্য ঈমান আনয়ন ও তাক্বওয়া অবলম্বনের শর্ত আরোপ করা হয়েছে , বলা হয় নি যে , তাদের ভাগ্যে বরকত লিপিবদ্ধ ছিলো না বিধায় তাদেরকে বরকত প্রদান করা হয় নি। আর এ আয়াত থেকে এ-ও সুস্পষ্ট যে , ঈমান আনয়ন ও তাক্বওয়া অবলম্বন করা তাদের এখতিয়ারাধীন বিষয় , নইলে আল্লাহ্ তা আলা বলতেন না যদি ঈমান আনতো ও তাক্বওয়া অবলম্বন করতো

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:

( يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَنْصُرُوا اللَّهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُم)

হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য করো তাহলে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের কদম সমূহকে সুদৃঢ় করে দেবেন। (সূরাহ্ মুহাম্মাদ: ৭)

এখানে আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্তিকে তাঁকে সাহায্য করার (তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য চেষ্টা-সাধনার) সাথে শর্তযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁকে সাহায্য না করলে তথা তাঁর রাস্তায় চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রাম না করলে তিনি মু মিনদেরকে সাহায্য করবেন না ।

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:

( إِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ عِشْرُونَ صَابِرُونَ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ وَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِائَةٌ يَغْلِبُوا أَلْفًا مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا)

তোমাদের মধ্য থেকে যদি ধৈর্য ও দৃঢ়তার অধিকারী বিশ জন হয় তাহলে কাফেরদের দুইশ জনকে পরাজিত করবে এবং তোমাদের মধ্য থেকে (এরূপ) একশ জন হলে তাদের এক হাজার জনকে পরাজিত করবে। (সূরাহ্ আল্-আনফাল্: ৬৫)

এখানে ধৈর্য ও দৃঢ়তাকে বিজয়ের শর্ত করা হয়েছে , ভাগ্যলিপিকে নয়।

অন্যদিকে শূন্য বা পুরোপুরি অনিশ্চিত ভবিষ্যত হচ্ছে এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে না কিছু নিশ্চিত হয়ে আছে , না সুনির্দিষ্ট একাধিক সম্ভাবনা আছে , বরং তা হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার ভবিষ্যত ইচ্ছার সীমাহীন দিগন্ত। এরূপ একটি সীমাহীন দিগন্ত আল্লাহ্ তা আলার চিরন্তন সৃষ্টিশীলতা গুণের জন্য অপরিহার্য। শুধু বর্তমান সৃষ্টিনিচয়ের অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টিশীলতাকে (তা যতই না দৃশ্যতঃ সীমাহীন হোক) সীমাবদ্ধ গণ্য করা মানে তাঁর সৃষ্টিক্ষমতাকে সীমিত গণ্য করা-যা থেকে তিনি পরম প্রমুক্ত।

আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টিশীলতার ওপরে সীমাবদ্ধতা কল্পনাকারী চিন্তাধারা বর্তমানে প্রাপ্ত বিকৃত তাওরাতে লক্ষ্য করা যায় । তাওরাত নামে দাবীকৃত বাইবেলের প্রথম পুস্তকে (আদি/ সৃষ্টি পুস্তক) বলা হয়েছে: পরে ঈশ্বর সপ্তম দিনে আপনার কৃত কার্য হতে নিবৃত্ত হলেন ; সেই সপ্তম দিবসে আপনার কৃত সমস্ত কার্য হতে বিশ্রাম করলেন। (২:২)

কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে:

( وَقَالَتِ الْيَهُودُ يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ)

আর ইয়াহূদীরা বলে: আল্লাহর হাত সংবদ্ধ। তাদেরই হাত সংবদ্ধ হোক এবং তারা যা বলেছে সে কারণে তারা অভিশপ্ত হোক। বরং তাঁর (আল্লাহর) উভয় (কুদরাতী) হাতই সম্প্রসারিত। (সূরাহ্ আল্-মাএদাহ্: ৬৪)

অবশ্য উক্ত আয়াতের ধারাবাহিকতায় এরশাদ হয়েছে:ينفق کيف يشاء - তিনি যেভাবে চান ব্যয় করেন। এ থেকে বাহ্যতঃ আল্লাহ্ তা আলার কুদরাতী হাতের প্রসারতা তাঁর নে আমত প্রদান সংক্রান্ত বলে মনে হলেও এ আয়াতের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যে আল্লাহ্ তা আলার সীমাহীন সৃষ্টিশীলতাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কারণ , আল্লাহ্ তা আলা অন্যত্র এরশাদ করেছেন:

( إِنَّ رَبَّكَ هُوَ الْخَلَّاقُ الْعَلِيم)

নিঃসন্দেহে (হে রাসূল!) আপনার রব অনবরত সৃষ্টিকারী সদাজ্ঞানী। (সূরাহ্ আল্-হিজর্: ৮৬)

অন্য এক আয়াত থেকেও অনিশ্চিত ভবিষ্যত প্রমাণিত হয়। আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন:

( يَاأَيُّهَا النَّاسُ أَنْتُمُ الْفُقَرَاءُ إِلَى اللَّهِ وَاللَّهُ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ (১৫) إِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ وَيَأْتِ بِخَلْقٍ جَدِيدٍ (১৬) وَمَا ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ بِعَزِيزٍ)

হে মানব মণ্ডলী! তোমরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী। আর আল্লাহ্ ; তিনি হচ্ছেন অ-মুখাপেক্ষী সদাপ্রশংসনীয়। তিনি যদি চান তাহলে তোমাদেরকে অপসারিত (বিলুপ্ত) করে দেবেন এবং (তোমাদের স্থলে) কোনো নতুন সৃষ্টিকে নিয়ে আসবেন (ও তাদেরকে ধরণীর বুকে স্বীয় খেলাফত প্রদান করবেন)। আর আল্লাহর জন্য এটা মোটেই কঠিন নয়। (সূরাহ্ আল্-ফাতের: ১৫-১৭)

সূরাহ্ ইবরাহীমের ১৯ ও ২০তম আয়াতেও একই কথা বলা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এখানে নতুন সৃষ্টি (خلق جديد ) বলতে এমন সৃষ্টিকে বুঝানো হয়েছে যা সৃষ্টি করার ইচ্ছা তিনি এখনো করেন নি।

অপর এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে:

( إِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ أَيُّهَا النَّاسُ وَيَأْتِ بِآخَرِينَ وَكَانَ اللَّهُ عَلَى ذَلِكَ قَدِيرًا)

হে মানবমণ্ডলী! তিনি যদি চান তাহলে তোমাদেরকে অপসারিত (বিলুপ্ত) করে দেবেন এবং (তোমাদের স্থলে) অন্য কাউকে (কোনো নতুন সৃষ্টিকে) নিয়ে আসবেন (ও তাদেরকে ধরণীর বুকে স্বীয় খেলাফত প্রদান করবেন)। আর এটা করতে আল্লাহ্ পুরোপুরি সক্ষম। (সূরাহ্ আন্-নিসা : ১৩৩)

অনেকে উপরোক্ত আয়াত সমূহের তাৎপর্য করেছেন এই যে , আল্লাহ্ তা আলা এক জনগোষ্ঠীকে সরিয়ে দিয়ে অন্য জনগোষ্ঠীকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করার কথা বলেছেন। অথচ প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। কারণ , আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকেايها الناس (হে মানবমণ্ডলী!) সম্বোধন থেকে সুস্পষ্ট যে , তিনি সমগ্র মানব প্রজাতিকে সরিয়ে দেয়ার ও তাদের পরিবর্তে অন্য কোনো নতুন প্রজাতি সৃষ্টির কথা বলেছেন। তবে তা করা বা না-করার ব্যাপারে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেন নি।

বস্তুতঃ ভবিষ্যতের একাধিক সম্ভাবনা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যত থেকে আশা এরী ও মু তাযিলী উভয় চিন্তাধারাই ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়।

আল্লাহর হস্তক্ষেপ

মানুষ আল্লাহ্ তা আলার শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি। কিন্তু শ্রেষ্ঠতম হলেও সে সৃষ্টি বৈ নয়। তাই সৃষ্টি হিসেবে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই তার মধ্যে বহু দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এতদ্সত্ত্বেও আল্লাহ্ তা আলা তাকে ধরণীর বুকে স্বীয় স্থলাভিষিক্ত (খলীফাহ্) নিযুক্ত করেছেন। এ কারণে তার পক্ষে আল্লাহ্ তা আলার দেয়া গুণাবলীর ভুল প্রয়োগ অসম্ভব ব্যাপার নয়। তাই তার জন্য আল্লাহ্ তা আলার পথনির্দেশ , পর্যবেক্ষণ ও হস্তক্ষেপ অপরিহার্য । সে যদি পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যলিপি অনুযায়ী পরিচালিত হতো তাহলে তার জন্য আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে হেদায়াত ও ওয়াহীর প্রয়োজন হতো না এবং আল্লাহ্ তা আলার হস্তক্ষেপেরও প্রয়োজন হতো না , বরং সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূর্বনির্ধারিত কাজ সমূহ সম্পাদন করতো। তা নয় বলেই তার জন্য হেদায়াত ও ওয়াহীর আগমন ঘটে এবং তার কাজে কখনো কখনো আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে হস্তক্ষেপ করা হয়।

বস্তুতঃ নবী-রাসূল (আঃ) প্রেরণ ও ওয়াহী নাযিলই একটি বিরাট ইতিবাচক হস্তক্ষেপ। এমনকি যে সব হস্তক্ষেপ দৃশ্যতঃ নেতিবাচক , যেমন: আযাব নাযিল করণ , সে সবেরও উদ্দেশ্য ইতিবাচক । কারণ , এর মাধ্যমে অন্যদেরকে ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে অনন্ত দুর্ভাগ্যের পথ থেকে অবিনশ্বর সাফল্যের পথের দিকে প্রত্যাবর্তনে উদ্বুদ্ধ করা হয়। শুধু তা-ই নয় , যাদেরকে আযাবের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয় তাদের জন্যও তা ইতিবাচক। কারণ , পরকালীন জীবনে তথা অনন্ত সৌভাগ্য ও অনন্ত দুর্ভাগ্যের জীবনে ব্যক্তির কর্ম অনুযায়ী তার নে আমত ও শাস্তির পরিমাণ ও মাত্রায় পার্থক্য হবে। তাই পাপীর ধ্বংস সাধনের ফলে তার পাপের বোঝা আর বেশী ভারী হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় তা তার নিজের জন্যও কমবেশী কল্যাণকর।

আল্লাহ্ তা আলা তাঁর রাসূল (ছ্বাঃ)কে সম্বোধন করে এরশাদ করেন:

( مَا أَصَابَكَ مِنْ حَسَنَةٍ فَمِنَ اللَّهِ وَمَا أَصَابَكَ مِنْ سَيِّئَةٍ فَمِنْ نَفْسِكَ)

আপনার জন্য যে কল্যাণের আগমন ঘটে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং আপনার ওপর যে অকল্যাণ আপতিত হয় তা আপনার নিজের কারণে। (সূরাহ্ আন্-নিসা : ৭৯)

মানুষের কাজে আল্লাহ্ তা আলার ইতিবাচক হস্তক্ষেপের অন্যতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে বদর যুদ্ধে মু মিনদেরকে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে বিশেষভাবে সাহায্যকরণ (সূরাহ্ আালে ইমরান্: ১২৩) যার ফলে মুসলমানরা সংখ্যা ও অস্ত্রশক্তিতে দুর্বল হয়েও বিজয়ী হয়েছিলেন।

আল্লাহ্ তা আলা মানুষের দো আ কবুল করেন ; এ-ও মানবিক জগতে আল্লাহ্ তা আলার হস্তক্ষেপের দৃষ্টান্ত। যেমন , এরশাদ হয়েছে:

( أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ)

কোনো আহবানকারী (দো আ-কারী/ প্রার্থনাকারী) যখন আমাকে আহবান করে (দো আ করে) তখন আমি তার আহবানে সাড়া দেই (তার দো আ কবুল করি)। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ১৮৬)

অন্য এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে:

( أَمَّنْ يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ)

কে অসহায়ের ডাকে সাড়া দেন যখন সে ডাকে এবং তার কষ্ট দূর করে দেন ? (সূরাহ্ আন্-নামল্: ৬২)

বস্তুতঃ সৃষ্টিলোকের চলমান প্রক্রিয়ায় , বিশেষ করে মানবিক ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলার তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ জাবারীয়াহ্ ও মু তাযিলী উভয় ধরনের প্রান্তিক চিন্তাধারাকেই ভ্রান্ত প্রমাণ করে।

আমরা এবং ইসলাম

ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী আমরা ইরানীরা কয়েক সহস্রাব্দ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে কখনও বন্ধুত্বপূর্ণ আবার কখনও শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করেছি। এ সম্পর্কের কারণে তাদের অনেক চিন্তা ও বিশ্বাস যেমন আমাদের মধ্যে এসেছে তেমনি আমাদের অনেক চিন্তা ও বিশ্বাসও তাদের ওপর প্রভাব ফেলেছে। যখনই অন্য জাতি ও গোষ্ঠীর জাতিসত্তা ও প্রভুত্বের কথা এসেছে আমরা তাদের মাঝে বিলুপ্ত হইনি ;বরং অন্য জাতিসত্তাকে প্রতিরোধ করেছি। তবে আমরা নিজ জাতিসত্তাকে ভালবাসার কারণে এটি করলেও এর মধ্যে কোন গোঁড়ামি বা অন্ধ বিশ্বাস ছিল না। কারণ মনের কোন অন্ধত্বই আমাদের সত্য হতে দূরে রাখতে এবং সত্যের বিরোধী ও শত্রু করতে পারেনি।

হাখামানেশী রাজত্বের সময় যখন ইরান বর্তমান সীমার বাইরেও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশসহ একই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল তখন হতে বর্তমানে দু হাজার পাঁচশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। পঁচিশ শতাব্দীর মধ্যে চৌদ্দ শতাব্দী ধরে আমরা ইসলামের ছায়ায় বাস করছি এবং এ ধর্ম আমাদের জীবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। এ দীনের রীতি ও শিক্ষাতেই আমরা আমাদের শিশুদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছি ,আমাদের জীবন পরিচালিত করেছি ,এক আল্লাহর ইবাদাত করেছি ,এ দীনের রীতিতেই আমাদের মৃতদের কবরস্থ করেছি। আমাদের ইতিহাস ,রাজনীতি ,বিচার ব্যবস্থা ,আইন ,সংস্কৃতি ,সভ্যতা ,সামাজিক আচার-এক কথায় সকল কিছু ইসলামের সঙ্গে মিশে গেছে। সকল জ্ঞানী ব্যক্তিই স্বীকার করেছেন ,ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে শতাব্দীকাল ধরে আমরা অসাধারণ ও মহা মূল্যবান অবদান রেখেছি যা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না ,এমনকি অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে দীনের প্রচার-প্রসার এবং উন্নয়নে আরবদের চেয়েও অধিক অবদান রেখেছি। কোন জাতিই আমাদের মত এ দীনের প্রচার-প্রসার ও বিস্তৃতিতে ভূমিকা রাখতে পারেনি।

এ জন্যই ইসলাম ও ইরানের সম্পর্ককে বিভিন্ন আঙ্গিকে পর্যালোচনার অধিকার আমরা রাখি। ইসলামী জ্ঞানের প্রসারে আমাদের ভূমিকা এবং আমাদের আত্মিক ও বস্তুগত উন্নয়নে ইসলামের অবদান পূর্ণাঙ্গ ও যথার্থরূপে ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্য প্রমাণসহ স্পষ্ট করে তুলে ধরতেই আমাদের এ আলোচনা।

বর্তমান সময়ে জাতি আরাধনা

বর্তমান শতাব্দীর বহুল আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হলো জাতীয়তা। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক জাতিগোষ্ঠীই ,এমনকি মুসলমানদের মধ্যে ইরানী ও অ-ইরানী সকলেই এ বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তাদের অনেকে এ আলোচনায় এতটা ডুবে গিয়েছেন ,যার কোন সীমা-পরিসীমা নেই।

বাস্তবতা হলো বর্তমান সময়ে জাতীয়তাবাদ মুসলিম বিশ্বের জন্য এক বিরাট সমস্যা। জাতীয়তাবাদের ধারণা ইসলামী মৌল প্রশিক্ষণের নীতির বিরোধী ও এ চিন্তাধারা মুসলিম ঐক্যের পথে বড় প্রতিবন্ধক।

আমরা জানি ইসলামী সমাজ বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে গঠিত এবং অতীতে ইসলাম বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে ইসলামী সমাজের ছায়ায় একত্রিত করেছে। এ একতা এখনও বাস্তবে বিদ্যমান। এটি বাস্তব সত্য ,এখনও সত্তর কোটি1 মানুষের বৃহত্তর একটি জনগোষ্ঠী এক চিন্তা ,মূল্যবোধ ,অনুভূতি এবং সহাবস্থানের ধারণায় বিশ্বাসী। তাদের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে তা তাদের নিজস্ব নয় ;বরং তা সরকারসমূহ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে এবং সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোতে যার কারণ আমেরিকা ও ইউরোপের শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ। তদুপরি এ সকল কারণ মানুষের অন্তরের এ ভিত্তিকে ধ্বংস করতে পারেনি। ইকবাল লাহোরীর ভাষায় :

সত্যের প্রমাণ মোদের নিকট রয়েছে একটিই ,

তাঁবুগুলো বিচ্ছিন্ন মোদের ,হৃদয় তো একটিই।

অধিবাসী মোরা কেউ হিজায ,চীন ,ইরান ও ভারতের ,

সকলে মোরা যেন শিশির একই প্রভাতের।

এই একক জনগোষ্ঠী হতেই প্রতি বছর হজ্বের মৌসুমে পনেরো লক্ষ মানুষের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় ।

জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদ এমন এক চিন্তা যা বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীকে একে অপরের বিপরীতে দাঁড় করায়। গত শতাব্দী2 হতে ইউরোপে এ চিন্তার ঢেউ উচ্চকিত হয়েছে । হয়তো বা সেখানে এটি স্বাভাবিক। কারণ ইউরোপে এমন কোন মতবাদ ছিল না যা সেখানকার বিভিন্ন জাতিকে উচ্চতর পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। পরবর্তীতে সাম্রাজ্যবাদীদের মাধ্যমে এ ঢেউয়ের ধাক্কা প্রাচ্যের জাতিগুলোর মধ্যেও লাগে। সাম্রাজ্যবাদ বিভেদের জন্ম দাও ও শাসন কর নীতি প্রয়োগ শুরু করে। এ নীতি বাস্তবায়নের জন্য সর্বোত্তম পথ হিসেবে ইসলামী জাতি-গোষ্ঠীসমূহকে নিজ নিজ বর্ণ ও জাতিসত্তার প্রতি মনোনিবেশের দিকে পরিচালিত করার প্রচেষ্টা নেয় এবং এক কাল্পনিক আত্মগর্বে নিমজ্জিত হতে উদ্বুদ্ধ করে ,যেমন ভারতীয়কে বলে ,তোমার অতীত এরূপ গৌরবময় ,তুর্কীকে বলে ,প্যানতুর্কী ইজম ধারণায় নব্য তুর্কী আন্দোলন শুরু কর ,আরবকে বলে ,তাদের মধ্যে পূর্ব হতেই গোত্রবাদের ধারণাসহ আরব জাতিত্বের ধারণা প্রকট ছিল-আরবী ভাষার ওপর ভিত্তি করে প্যান আরব ইজম আন্দোলনের সূচনা কর। ইরানীকে বলে ,তুমি আর্য জাতিভুক্ত এবং সেমিটিক জাতিভুক্ত আরব হতে ভিন্ন ,তোমার চিন্তা-ধারণা সবই ভিন্ন।

জাতীয়তাবাদী ধারণা জাতীয় চিন্তা ও অনুভূতির জাগরণের মাধ্যমে হয়তো অনেক জাতিরই স্বাধীন অস্তিত্বের বিষয়ে ইতিবাচক ও কল্যাণকর কিছু প্রভাব রাখতে পারে ,কিন্তু ইসলামী জাতিগুলোর মধ্যে এর কল্যাণকর কোন প্রভাব তো পড়েইনি ;বরং অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতার কারণ হয়ে দেখা দেয়। ইসলামী জাতিসমূহ শতাব্দীকাল পূর্বে ঐক্যের আরো উচ্চতর পর্যায় অতিক্রম করেছিল। কারণ ইসলাম শতাব্দীকাল পূর্বে একক চিন্তা ,বিশ্বাস ও আদর্শের ভিত্তিতে অনন্য ঐক্য সৃষ্টি করেছিল ,এমনকি বিংশ শতাব্দীতেও ইসলাম প্রমাণ করেছে এ ঐক্যের ভিত্তি উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর!

বিংশ শতাব্দীতে মুসলমানরা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যে সব আন্দোলনের মাধ্যমে উপনিবেশবাদীদের প্রভাব হতে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে তার পেছনে জাতিগত কারণ অপেক্ষা ইসলামী কারণই মুখ্য ও অধিকতর ফলপ্রসূ ছিল। উদাহরণস্বরূপ আলজিরিয়া ,ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের কথা বলতে পারি।

হ্যাঁ ,এ জাতিসমূহ শতাব্দীকাল হতে প্রমাণ দিয়েছে এক চিন্তা ,বিশ্বাস ও মতাদর্শের ভিত্তি এমন এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সৃষ্টি করতে পারে যা তাদেরকে সাম্রাজ্যবাদের থাবা হতে মুক্ত করতে সক্ষম। তাই এরূপ জাতি-গোষ্ঠীকে জাতীয়তাবাদের মত চিন্তার দিকে পরিচালিত করা প্রতিক্রিয়াশীলতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

সুতরাং বর্ণ ও জাতীয়তাবাদের উদ্গাতা হলো ইউরোপ এবং এ চিন্তাধারা ইসলামী বিশ্বের জন্য অনেক বড় সমস্যার সৃষ্টি করেছে। সাইয়্যেদ জামালউদ্দীন আসাদাবাদীর (আফগানী) নিজ জাতিসত্তা গোপন করার কারণ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে ,তিনি চান নি তাঁকে বিশেষ কোন জাতিভুক্ত বলে পরিচিত করানো হোক যা উপনিবেশবাদীদের হাতে একটি হাতিয়ার হতে পারে এবং অন্য জাতিভুক্তদের তাঁর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে পারে।

আমরা যেহেতু এক ধর্ম ,একই মতাদর্শ ও পথের ওপর রয়েছি যার নাম ইসলাম এবং যার মধ্যে জাতিগত ধারণার উপাদান নেই সেহেতু এ মতাদর্শের বিপরীতে বর্ণ ও জাতিগত যে কোন ধারণার বিরুদ্ধে আমরা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারি না। আমরা অবহিত ,সম্প্রতি অনেক ব্যক্তিই ইরানী জাতিসত্তা সংরক্ষণের নামে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেছে এবং আরব ও আরবী ভাষার বিরুদ্ধে সংগ্রামের নামে ইসলামের পবিত্র অনুভূতির প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করছে।3

ইরানে ইসলামের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধের নমুনা আমরা বই-পুস্তক ,দৈনিক ,সাপ্তাহিক ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে লক্ষ্য করছি। এটি আকস্মিক কোন বিষয় নয় ;বরং একটি পরিকল্পিত নকশা ও লক্ষ্যের ফলশ্রুতি।

বর্তমানে যারথুষ্ট্র ( Zoroastrian)ধর্মের প্রচারণা বেড়ে গিয়েছে এবং এটি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক কার্যক্রমে পরিণত হয়েছে। সকলেই জানেন আজকের ইরানীরা কখনই যারথুষ্ট্র ধর্মে ফিরে যাবে না এবং যারথুস্ট্র ধর্মের শিক্ষাও ইসলামের স্থান দখল করতে পারবে না। যে সকল ব্যক্তি মাযদাকী , মনী এবং যারথুষ্ট্র ধর্মের ব্যক্তিত্ব বলে পরিচিত তাদের সকলেই আজ জাতীয় মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিহিত এবং ইসলামী শিক্ষা হতে বিচ্যুত চরিত্র বৈ তাদের ভিন্ন কোন চরিত্র ছিল না। এখানে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই হোক বা আরব জাতির বাহানা এনেই হোক কার্যক্রম চালিয়ে ইরানীদের মন হতে ইসলামের প্রসিদ্ধ বীরদের স্মৃতি মুছে দিতে পারবে না। কখনই আল মুকান্না , মিনবাদ , ববাকে খুররামদীন এবং মজিয়ররা ইরানীদের অন্তরে আলী ইবনে আবি তালিব , হুসাইন ইবনে আলী , এমনকি সালমান ফারসীর স্থান অধিকারে সক্ষম নয়। সকলেই তা জানে।

যদিও এর মাধ্যমে হয়তো অপরিপক্ব ও বুদ্ধিহীন যুবকদের মধ্যে দেশ ,জাতি ও রাষ্ট্রীয় চেতনা ও অনুভূতি জাগরিত করা এবং তাদের সঙ্গে ইসলামের ব্যবধান ও সম্পর্কচ্ছেদ সৃষ্টি সম্ভব। অর্থাৎ যদিও ইসলামী অনুভূতির স্থলাভিষিক্ত হিসেবে অন্য ধর্মানুভূতি প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয় ,কিন্তু ইসলামী অনুভূতির পরিবর্তন ঘটিয়ে তার বিপরীত অনুভূতি সৃষ্টি করে সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতা করা সম্ভব। এজন্যই লক্ষ্য করি ধর্ম ও আল্লাহ্বিরোধী ব্যক্তিরা বুদ্ধিহীন মগজ হতে উৎসারিত অর্থহীন লেখাগুলোতে যারথুষ্ট্র এবং ইসলাম পূর্ববর্তী ইরানের অবস্থাকে সমর্থন করে চলেছে। তাদের লক্ষ্য আমাদের নিকট স্পষ্ট।

আমরা আমাদের এ আলোচনায় ঐ যুক্তি এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আলোচনা করব যে যুক্তি ও দৃষ্টিকোণ থেকে এই ব্যক্তিরা বিষয়টিকে দেখে। আর তা হলো জাতীয়তা ,জাতীয় চেতনা এবং জাতীয়তাবাদ। হ্যাঁ ,এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আমরা আলোচনা রাখব। যদিও আমরা ইকবাল লাহোরীর এ কথা ভুলে যাই নি- জাতিভক্তি ও আরাধনা এক প্রকার অসভ্যতা । এ বিষয়টির প্রতি আমাদের দৃষ্টি রয়েছে যে ,জাতীয় চেতনা ও অনুভূতির ইতিবাচকতা ততক্ষণ পর্যন্ত রয়েছে যতক্ষণ এর মাধ্যমে স্বদেশের মানুষের সেবা করা যায। কিন্তু কখনও কখনও অনুভূতি ও চেতনা নেতিবাচকতার জন্ম দেয় ,বৈষম্যের সৃষ্টি করে ,ভাল-মন্দ বিচারে অন্ধত্ব ও পক্ষপাতিত্ব এবং নৈতিকতা ও মানবিকতাবিরোধী চেতনার উৎপত্তি ঘটায়।

আমরা জানি জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় চেতনার যুক্তি অপেক্ষা উচ্চতর যুক্তি আমাদের নিকট রয়েছে যেখানে জ্ঞান ,দর্শন ও ধর্ম আবেগ-অনুভূতির ঊর্ধে অবস্থান করছে। জাতীয় অনুভূতির চেতনা সকল স্থানে গ্রহণীয় হলেও জ্ঞান ,দর্শন ও ধর্মের অনুসন্ধানে গ্রহণযোগ্য নয়। জ্ঞান ,দর্শন ও ধর্মীয় কোন বিষয়ে তা রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় হলেই গ্রহণযোগ্য হবে এমনটি নয়। তেমনিভাবে চিন্তাগত কোন বিষয় বিদেশী ও বিজাতীয় হলেই তা বর্জনীয় এমনও নয়। এ কথা সত্য যে ,জ্ঞান ,ধর্ম ও দর্শনের কোন রাষ্ট্র নেই । কারণ এগুলো সর্বজনীন। তাই ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ,বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদেরও কোন নির্দিষ্ট রাষ্ট্র নেই ,তাঁরাও বিশ্বজনীন। তাঁরা সমগ্র বিশ্বের ,সকল রাষ্ট্রই তাঁদের রাষ্ট্র এবং সকল মানুষই তাঁদের স্বদেশী।

যদিও বিষয়গুলো আমরা জানি তদুপরি এখানে মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতর এ যুক্তিকে আমরা আপাতত দূরে রাখছি এবং অপূর্ণাঙ্গ মানুষদের উপযোগী অনুভূতি ও আবেগকেন্দ্রিক যুক্তির ওপর নির্ভর করেই এ আলোচনা শুরু করছি।

আমরা দেখতে চাই জাতীয় চেতনা ও অনুভূতির দৃষ্টিতে যদি ইসলামকে যাচাই করি তা কি বিজাতীয় বলে পরিগণিত হবে ? আমরা দেখতে চাই জাতীয়তার মানদণ্ডে ইসলাম ইরানী জাতীয়তা ও ইরানী জাতীয়তাবাদী চেতনার অন্তর্ভুক্ত নাকি এর বহির্ভূত।

এ লক্ষ্যে আমাদের আলোচনাকে দু টি অংশে ভাগ করব। প্রথমত আমরা জাতীয়তার মানদণ্ড অর্থাৎ কোন বস্তুকে জাতীয়তার অন্তর্ভুক্ত ও বহির্ভূত বলার মানদণ্ড কি তা দেখব। দ্বিতীয়ত দেখব এ মানদণ্ডের আলোকে ইসলাম ইরানী জাতীয়তার অভ্যন্তরের বিষয় নাকি বিজাতীয় ? বাস্তবে আমাদের আলোচনায় দু টি প্রতিজ্ঞা রয়েছে। প্রথম অংশ বৃহত্তর প্রতিজ্ঞা ( major premise) এবং দ্বিতীয় অংশ ক্ষুদ্রতর প্রতিজ্ঞা ( minor premise) ।

প্রসঙ্গত ইসলাম ও যারথুষ্ট্র প্রবণতার (যারথুষ্ট্র ধর্ম প্রবণতা) মধ্যে একটি তুলনামূলক আলোচনা রাখব এবং তাতে প্রমাণিত হবে জাতীয়তার মানদণ্ডে ইসলাম ইরানী জাতিসত্তার অধিকতর নিকটবর্তী নাকি যারথুষ্ট্র প্রবণতা ?

আমরা এবং ইসলাম

ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী আমরা ইরানীরা কয়েক সহস্রাব্দ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে কখনও বন্ধুত্বপূর্ণ আবার কখনও শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করেছি। এ সম্পর্কের কারণে তাদের অনেক চিন্তা ও বিশ্বাস যেমন আমাদের মধ্যে এসেছে তেমনি আমাদের অনেক চিন্তা ও বিশ্বাসও তাদের ওপর প্রভাব ফেলেছে। যখনই অন্য জাতি ও গোষ্ঠীর জাতিসত্তা ও প্রভুত্বের কথা এসেছে আমরা তাদের মাঝে বিলুপ্ত হইনি ;বরং অন্য জাতিসত্তাকে প্রতিরোধ করেছি। তবে আমরা নিজ জাতিসত্তাকে ভালবাসার কারণে এটি করলেও এর মধ্যে কোন গোঁড়ামি বা অন্ধ বিশ্বাস ছিল না। কারণ মনের কোন অন্ধত্বই আমাদের সত্য হতে দূরে রাখতে এবং সত্যের বিরোধী ও শত্রু করতে পারেনি।

হাখামানেশী রাজত্বের সময় যখন ইরান বর্তমান সীমার বাইরেও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশসহ একই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল তখন হতে বর্তমানে দু হাজার পাঁচশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। পঁচিশ শতাব্দীর মধ্যে চৌদ্দ শতাব্দী ধরে আমরা ইসলামের ছায়ায় বাস করছি এবং এ ধর্ম আমাদের জীবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। এ দীনের রীতি ও শিক্ষাতেই আমরা আমাদের শিশুদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছি ,আমাদের জীবন পরিচালিত করেছি ,এক আল্লাহর ইবাদাত করেছি ,এ দীনের রীতিতেই আমাদের মৃতদের কবরস্থ করেছি। আমাদের ইতিহাস ,রাজনীতি ,বিচার ব্যবস্থা ,আইন ,সংস্কৃতি ,সভ্যতা ,সামাজিক আচার-এক কথায় সকল কিছু ইসলামের সঙ্গে মিশে গেছে। সকল জ্ঞানী ব্যক্তিই স্বীকার করেছেন ,ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে শতাব্দীকাল ধরে আমরা অসাধারণ ও মহা মূল্যবান অবদান রেখেছি যা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না ,এমনকি অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে দীনের প্রচার-প্রসার এবং উন্নয়নে আরবদের চেয়েও অধিক অবদান রেখেছি। কোন জাতিই আমাদের মত এ দীনের প্রচার-প্রসার ও বিস্তৃতিতে ভূমিকা রাখতে পারেনি।

এ জন্যই ইসলাম ও ইরানের সম্পর্ককে বিভিন্ন আঙ্গিকে পর্যালোচনার অধিকার আমরা রাখি। ইসলামী জ্ঞানের প্রসারে আমাদের ভূমিকা এবং আমাদের আত্মিক ও বস্তুগত উন্নয়নে ইসলামের অবদান পূর্ণাঙ্গ ও যথার্থরূপে ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্য প্রমাণসহ স্পষ্ট করে তুলে ধরতেই আমাদের এ আলোচনা।

বর্তমান সময়ে জাতি আরাধনা

বর্তমান শতাব্দীর বহুল আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হলো জাতীয়তা। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক জাতিগোষ্ঠীই ,এমনকি মুসলমানদের মধ্যে ইরানী ও অ-ইরানী সকলেই এ বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তাদের অনেকে এ আলোচনায় এতটা ডুবে গিয়েছেন ,যার কোন সীমা-পরিসীমা নেই।

বাস্তবতা হলো বর্তমান সময়ে জাতীয়তাবাদ মুসলিম বিশ্বের জন্য এক বিরাট সমস্যা। জাতীয়তাবাদের ধারণা ইসলামী মৌল প্রশিক্ষণের নীতির বিরোধী ও এ চিন্তাধারা মুসলিম ঐক্যের পথে বড় প্রতিবন্ধক।

আমরা জানি ইসলামী সমাজ বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে গঠিত এবং অতীতে ইসলাম বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে ইসলামী সমাজের ছায়ায় একত্রিত করেছে। এ একতা এখনও বাস্তবে বিদ্যমান। এটি বাস্তব সত্য ,এখনও সত্তর কোটি1 মানুষের বৃহত্তর একটি জনগোষ্ঠী এক চিন্তা ,মূল্যবোধ ,অনুভূতি এবং সহাবস্থানের ধারণায় বিশ্বাসী। তাদের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে তা তাদের নিজস্ব নয় ;বরং তা সরকারসমূহ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে এবং সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোতে যার কারণ আমেরিকা ও ইউরোপের শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ। তদুপরি এ সকল কারণ মানুষের অন্তরের এ ভিত্তিকে ধ্বংস করতে পারেনি। ইকবাল লাহোরীর ভাষায় :

সত্যের প্রমাণ মোদের নিকট রয়েছে একটিই ,

তাঁবুগুলো বিচ্ছিন্ন মোদের ,হৃদয় তো একটিই।

অধিবাসী মোরা কেউ হিজায ,চীন ,ইরান ও ভারতের ,

সকলে মোরা যেন শিশির একই প্রভাতের।

এই একক জনগোষ্ঠী হতেই প্রতি বছর হজ্বের মৌসুমে পনেরো লক্ষ মানুষের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় ।

জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদ এমন এক চিন্তা যা বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীকে একে অপরের বিপরীতে দাঁড় করায়। গত শতাব্দী2 হতে ইউরোপে এ চিন্তার ঢেউ উচ্চকিত হয়েছে । হয়তো বা সেখানে এটি স্বাভাবিক। কারণ ইউরোপে এমন কোন মতবাদ ছিল না যা সেখানকার বিভিন্ন জাতিকে উচ্চতর পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। পরবর্তীতে সাম্রাজ্যবাদীদের মাধ্যমে এ ঢেউয়ের ধাক্কা প্রাচ্যের জাতিগুলোর মধ্যেও লাগে। সাম্রাজ্যবাদ বিভেদের জন্ম দাও ও শাসন কর নীতি প্রয়োগ শুরু করে। এ নীতি বাস্তবায়নের জন্য সর্বোত্তম পথ হিসেবে ইসলামী জাতি-গোষ্ঠীসমূহকে নিজ নিজ বর্ণ ও জাতিসত্তার প্রতি মনোনিবেশের দিকে পরিচালিত করার প্রচেষ্টা নেয় এবং এক কাল্পনিক আত্মগর্বে নিমজ্জিত হতে উদ্বুদ্ধ করে ,যেমন ভারতীয়কে বলে ,তোমার অতীত এরূপ গৌরবময় ,তুর্কীকে বলে ,প্যানতুর্কী ইজম ধারণায় নব্য তুর্কী আন্দোলন শুরু কর ,আরবকে বলে ,তাদের মধ্যে পূর্ব হতেই গোত্রবাদের ধারণাসহ আরব জাতিত্বের ধারণা প্রকট ছিল-আরবী ভাষার ওপর ভিত্তি করে প্যান আরব ইজম আন্দোলনের সূচনা কর। ইরানীকে বলে ,তুমি আর্য জাতিভুক্ত এবং সেমিটিক জাতিভুক্ত আরব হতে ভিন্ন ,তোমার চিন্তা-ধারণা সবই ভিন্ন।

জাতীয়তাবাদী ধারণা জাতীয় চিন্তা ও অনুভূতির জাগরণের মাধ্যমে হয়তো অনেক জাতিরই স্বাধীন অস্তিত্বের বিষয়ে ইতিবাচক ও কল্যাণকর কিছু প্রভাব রাখতে পারে ,কিন্তু ইসলামী জাতিগুলোর মধ্যে এর কল্যাণকর কোন প্রভাব তো পড়েইনি ;বরং অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতার কারণ হয়ে দেখা দেয়। ইসলামী জাতিসমূহ শতাব্দীকাল পূর্বে ঐক্যের আরো উচ্চতর পর্যায় অতিক্রম করেছিল। কারণ ইসলাম শতাব্দীকাল পূর্বে একক চিন্তা ,বিশ্বাস ও আদর্শের ভিত্তিতে অনন্য ঐক্য সৃষ্টি করেছিল ,এমনকি বিংশ শতাব্দীতেও ইসলাম প্রমাণ করেছে এ ঐক্যের ভিত্তি উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর!

বিংশ শতাব্দীতে মুসলমানরা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যে সব আন্দোলনের মাধ্যমে উপনিবেশবাদীদের প্রভাব হতে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে তার পেছনে জাতিগত কারণ অপেক্ষা ইসলামী কারণই মুখ্য ও অধিকতর ফলপ্রসূ ছিল। উদাহরণস্বরূপ আলজিরিয়া ,ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের কথা বলতে পারি।

হ্যাঁ ,এ জাতিসমূহ শতাব্দীকাল হতে প্রমাণ দিয়েছে এক চিন্তা ,বিশ্বাস ও মতাদর্শের ভিত্তি এমন এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সৃষ্টি করতে পারে যা তাদেরকে সাম্রাজ্যবাদের থাবা হতে মুক্ত করতে সক্ষম। তাই এরূপ জাতি-গোষ্ঠীকে জাতীয়তাবাদের মত চিন্তার দিকে পরিচালিত করা প্রতিক্রিয়াশীলতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

সুতরাং বর্ণ ও জাতীয়তাবাদের উদ্গাতা হলো ইউরোপ এবং এ চিন্তাধারা ইসলামী বিশ্বের জন্য অনেক বড় সমস্যার সৃষ্টি করেছে। সাইয়্যেদ জামালউদ্দীন আসাদাবাদীর (আফগানী) নিজ জাতিসত্তা গোপন করার কারণ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে ,তিনি চান নি তাঁকে বিশেষ কোন জাতিভুক্ত বলে পরিচিত করানো হোক যা উপনিবেশবাদীদের হাতে একটি হাতিয়ার হতে পারে এবং অন্য জাতিভুক্তদের তাঁর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে পারে।

আমরা যেহেতু এক ধর্ম ,একই মতাদর্শ ও পথের ওপর রয়েছি যার নাম ইসলাম এবং যার মধ্যে জাতিগত ধারণার উপাদান নেই সেহেতু এ মতাদর্শের বিপরীতে বর্ণ ও জাতিগত যে কোন ধারণার বিরুদ্ধে আমরা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারি না। আমরা অবহিত ,সম্প্রতি অনেক ব্যক্তিই ইরানী জাতিসত্তা সংরক্ষণের নামে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেছে এবং আরব ও আরবী ভাষার বিরুদ্ধে সংগ্রামের নামে ইসলামের পবিত্র অনুভূতির প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করছে।3

ইরানে ইসলামের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধের নমুনা আমরা বই-পুস্তক ,দৈনিক ,সাপ্তাহিক ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে লক্ষ্য করছি। এটি আকস্মিক কোন বিষয় নয় ;বরং একটি পরিকল্পিত নকশা ও লক্ষ্যের ফলশ্রুতি।

বর্তমানে যারথুষ্ট্র ( Zoroastrian)ধর্মের প্রচারণা বেড়ে গিয়েছে এবং এটি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক কার্যক্রমে পরিণত হয়েছে। সকলেই জানেন আজকের ইরানীরা কখনই যারথুষ্ট্র ধর্মে ফিরে যাবে না এবং যারথুস্ট্র ধর্মের শিক্ষাও ইসলামের স্থান দখল করতে পারবে না। যে সকল ব্যক্তি মাযদাকী , মনী এবং যারথুষ্ট্র ধর্মের ব্যক্তিত্ব বলে পরিচিত তাদের সকলেই আজ জাতীয় মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিহিত এবং ইসলামী শিক্ষা হতে বিচ্যুত চরিত্র বৈ তাদের ভিন্ন কোন চরিত্র ছিল না। এখানে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই হোক বা আরব জাতির বাহানা এনেই হোক কার্যক্রম চালিয়ে ইরানীদের মন হতে ইসলামের প্রসিদ্ধ বীরদের স্মৃতি মুছে দিতে পারবে না। কখনই আল মুকান্না , মিনবাদ , ববাকে খুররামদীন এবং মজিয়ররা ইরানীদের অন্তরে আলী ইবনে আবি তালিব , হুসাইন ইবনে আলী , এমনকি সালমান ফারসীর স্থান অধিকারে সক্ষম নয়। সকলেই তা জানে।

যদিও এর মাধ্যমে হয়তো অপরিপক্ব ও বুদ্ধিহীন যুবকদের মধ্যে দেশ ,জাতি ও রাষ্ট্রীয় চেতনা ও অনুভূতি জাগরিত করা এবং তাদের সঙ্গে ইসলামের ব্যবধান ও সম্পর্কচ্ছেদ সৃষ্টি সম্ভব। অর্থাৎ যদিও ইসলামী অনুভূতির স্থলাভিষিক্ত হিসেবে অন্য ধর্মানুভূতি প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয় ,কিন্তু ইসলামী অনুভূতির পরিবর্তন ঘটিয়ে তার বিপরীত অনুভূতি সৃষ্টি করে সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতা করা সম্ভব। এজন্যই লক্ষ্য করি ধর্ম ও আল্লাহ্বিরোধী ব্যক্তিরা বুদ্ধিহীন মগজ হতে উৎসারিত অর্থহীন লেখাগুলোতে যারথুষ্ট্র এবং ইসলাম পূর্ববর্তী ইরানের অবস্থাকে সমর্থন করে চলেছে। তাদের লক্ষ্য আমাদের নিকট স্পষ্ট।

আমরা আমাদের এ আলোচনায় ঐ যুক্তি এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আলোচনা করব যে যুক্তি ও দৃষ্টিকোণ থেকে এই ব্যক্তিরা বিষয়টিকে দেখে। আর তা হলো জাতীয়তা ,জাতীয় চেতনা এবং জাতীয়তাবাদ। হ্যাঁ ,এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আমরা আলোচনা রাখব। যদিও আমরা ইকবাল লাহোরীর এ কথা ভুলে যাই নি- জাতিভক্তি ও আরাধনা এক প্রকার অসভ্যতা । এ বিষয়টির প্রতি আমাদের দৃষ্টি রয়েছে যে ,জাতীয় চেতনা ও অনুভূতির ইতিবাচকতা ততক্ষণ পর্যন্ত রয়েছে যতক্ষণ এর মাধ্যমে স্বদেশের মানুষের সেবা করা যায। কিন্তু কখনও কখনও অনুভূতি ও চেতনা নেতিবাচকতার জন্ম দেয় ,বৈষম্যের সৃষ্টি করে ,ভাল-মন্দ বিচারে অন্ধত্ব ও পক্ষপাতিত্ব এবং নৈতিকতা ও মানবিকতাবিরোধী চেতনার উৎপত্তি ঘটায়।

আমরা জানি জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় চেতনার যুক্তি অপেক্ষা উচ্চতর যুক্তি আমাদের নিকট রয়েছে যেখানে জ্ঞান ,দর্শন ও ধর্ম আবেগ-অনুভূতির ঊর্ধে অবস্থান করছে। জাতীয় অনুভূতির চেতনা সকল স্থানে গ্রহণীয় হলেও জ্ঞান ,দর্শন ও ধর্মের অনুসন্ধানে গ্রহণযোগ্য নয়। জ্ঞান ,দর্শন ও ধর্মীয় কোন বিষয়ে তা রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় হলেই গ্রহণযোগ্য হবে এমনটি নয়। তেমনিভাবে চিন্তাগত কোন বিষয় বিদেশী ও বিজাতীয় হলেই তা বর্জনীয় এমনও নয়। এ কথা সত্য যে ,জ্ঞান ,ধর্ম ও দর্শনের কোন রাষ্ট্র নেই । কারণ এগুলো সর্বজনীন। তাই ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ,বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদেরও কোন নির্দিষ্ট রাষ্ট্র নেই ,তাঁরাও বিশ্বজনীন। তাঁরা সমগ্র বিশ্বের ,সকল রাষ্ট্রই তাঁদের রাষ্ট্র এবং সকল মানুষই তাঁদের স্বদেশী।

যদিও বিষয়গুলো আমরা জানি তদুপরি এখানে মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতর এ যুক্তিকে আমরা আপাতত দূরে রাখছি এবং অপূর্ণাঙ্গ মানুষদের উপযোগী অনুভূতি ও আবেগকেন্দ্রিক যুক্তির ওপর নির্ভর করেই এ আলোচনা শুরু করছি।

আমরা দেখতে চাই জাতীয় চেতনা ও অনুভূতির দৃষ্টিতে যদি ইসলামকে যাচাই করি তা কি বিজাতীয় বলে পরিগণিত হবে ? আমরা দেখতে চাই জাতীয়তার মানদণ্ডে ইসলাম ইরানী জাতীয়তা ও ইরানী জাতীয়তাবাদী চেতনার অন্তর্ভুক্ত নাকি এর বহির্ভূত।

এ লক্ষ্যে আমাদের আলোচনাকে দু টি অংশে ভাগ করব। প্রথমত আমরা জাতীয়তার মানদণ্ড অর্থাৎ কোন বস্তুকে জাতীয়তার অন্তর্ভুক্ত ও বহির্ভূত বলার মানদণ্ড কি তা দেখব। দ্বিতীয়ত দেখব এ মানদণ্ডের আলোকে ইসলাম ইরানী জাতীয়তার অভ্যন্তরের বিষয় নাকি বিজাতীয় ? বাস্তবে আমাদের আলোচনায় দু টি প্রতিজ্ঞা রয়েছে। প্রথম অংশ বৃহত্তর প্রতিজ্ঞা ( major premise) এবং দ্বিতীয় অংশ ক্ষুদ্রতর প্রতিজ্ঞা ( minor premise) ।

প্রসঙ্গত ইসলাম ও যারথুষ্ট্র প্রবণতার (যারথুষ্ট্র ধর্ম প্রবণতা) মধ্যে একটি তুলনামূলক আলোচনা রাখব এবং তাতে প্রমাণিত হবে জাতীয়তার মানদণ্ডে ইসলাম ইরানী জাতিসত্তার অধিকতর নিকটবর্তী নাকি যারথুষ্ট্র প্রবণতা ?


6

7

8

9

10

11

12

13

14

15