অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম 0%

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 17002
ডাউনলোড: 2571

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 22 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 17002 / ডাউনলোড: 2571
সাইজ সাইজ সাইজ
অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

আল্লাহ্ তা‘আলার সৃষ্টিনিচয়ের মধ্যে মানুষের রয়েছে এক অনন্য অবস্থান। আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকল মানুষের নিকট এটা সুস্পষ্ট ও স্বীকৃত যে, প্রাণী প্রজাতিসমূহের মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্ব যতোটা তার সৃজনশীলতার কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশী তার বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্) ও ইচ্ছাশক্তির কারণে। এ দু’টি বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ তার সহজাত প্রকৃতিকে পরাভূত করতে সক্ষম। যে সব বিষয় গোটা মানব জাতির কর্ম ও আচরণকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতা থাকা-নাথাকা সংক্রান্ত ধারণা। এ ক্ষেত্রে বেশীর ভাগ মানুষই তাত্ত্বিকভাবে বিশ্বাস করে যে, মানুষের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতা বলতে কিছুই নেই, বরং তার জন্ম-মৃত্যু এবং সারা জীবনের কার্যাবলী ও সুখ-দুঃখ পূর্ব থেকেই নির্ধারিত হয়ে আছে বা তার প্রতিটি কাজই আল্লাহ্ তা‘আলা তার দ্বারা করিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু তাদের বেশীর ভাগ কাজকর্ম ও কথাবার্তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, তারা নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতায় বিশ্বাসী। বস্তুতঃ তাদের তাত্ত্বিক বিশ্বাস তাদের কর্ম ও আচরণের ওপর খুব কমই ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে, বরং তা কেবল ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাবই বিস্তার করে থাকে। মানব জাতিকে, বিশেষ করে মুসলমানদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্যে এ প্রশ্নটির সঠিক সমাধান উদ্ভাবন অপরিহার্য। এ লক্ষ্যেই অত্র গ্রন্থ রচনার প্রয়াস।

 

স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির কর্ম আরোপ

কোরআন মজীদের বিরাট সংখ্যক আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে , আল্লাহ্ তা আলা মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা প্রদান করেছেন। কিন্তু কিছু কিছু আয়াতে একই কাজ একই সাথে সৃষ্টির প্রতি এবং আল্লাহ্ তা আলার প্রতি আরোপ করা হয়েছে। অন্যদিকে কতক আয়াতে সৃষ্টির কাজকে আল্লাহ্ তা আলার প্রতি আরোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে যারা প্রথম ও দ্বিতীয় ধরনের আয়াতের প্রতি মনোযোগ দেন না তাঁরা শেষোক্ত ধরনের আয়াত থেকে এরূপ উপসংহারে উপনীত হন যে , সমগ্র অস্তিত্বলোকে একমাত্র আল্লাহ্ তা আলা ছাড়া আর কোনো কর্মসম্পাদনকারী নেই। অন্যদিকে অনেকে দ্বিতীয়োক্ত ধরনের আয়াত থেকে দোদুল্যমান অবস্থার শিকার হন এবং ভেবে পান না যে , সৃষ্টিকুল যে সব কাজ সম্পাদন করে থাকে কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে তা কি তাদেরই কাজ , নাকি আল্লাহ্ তা আলার কাজ ?

এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে , কোরআন মজীদ একদিকে যেমন সকল জ্ঞানের আধার এবং সে হিসেবে এতে ব্যাপকতম , সূক্ষ্মতম ও গভীরতম সকল জ্ঞানের সমাহার ঘটেছে , অন্যদিকে তা সাহিত্যিক মানের দিক থেকেও ব্যাপকতম , সূক্ষ্মতম ও গভীরতম ভাব প্রকাশক। কোরআন মজীদ যে সব বৈশিষ্ট্যের কারণে মু জিযাহ্ তার মধ্যে এ দু টি বৈশিষ্ট্য অন্যতম।

বস্তুতঃ কোরআন মজীদ কোনো সাহিত্য বা কাব্যগ্রন্থ নয় , বরং এটি হচ্ছে তত্ত্ব , তথ্য , আইন , উপদেশ ও নৈতিক শিক্ষার সমাহার। তা সত্ত্বেও এটি কোনো বিশালায়তন গ্রন্থের রূপ পরিগ্রহ করে নি। অন্যদিকে এসব বিচিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ , বিশেষ করে গুরুভার বিষয়বস্তু সম্বলিত মানব রচিত একটি গ্রন্থ সুখপাঠ্য হওয়া একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু কোরআন মজীদ এসব বিষয়বস্তু সত্ত্বেও একটি সুখপাঠ্য গ্রন্থ যার ভাষা যেমন প্রাঞ্জল ও গতিশীল , তেমনি তার সাহিত্যিক ভাবধারা ও বৈশিষ্ট্য মানবিক প্রতিভার উর্ধে। এ কারণেই এতে এমন অনেক আয়াত রয়েছে যা ভাবার্থবাচক। সৃষ্টির কাজকে স্রষ্টার ওপর আরোপ করাও এ ধরনের ভাবার্থবাচক আয়াতের অন্তর্ভুক্ত যার মধ্যে গভীর চিন্তার খোরাক ও তত্ত্বজ্ঞান নিহিত রয়েছে। এখানে উদাহরণ স্বরূপ এ ধরনের কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হলো।

এরশাদ হয়েছে:

( وَإِذَا أَرَدْنَا أَنْ نُهْلِكَ قَرْيَةً أَمَرْنَا مُتْرَفِيهَا فَفَسَقُوا فِيهَا فَحَقَّ عَلَيْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنَاهَا تَدْمِيرًا)

আর আমি যখন কোনো জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি তখন তার সম্পদশালী লোকদেরকে আদেশ দেই , অতঃপর তারা সেখানে পাপাচার করে , ফলে তার (ঐ জনপদের) জন্য (ধ্বংসের) উক্তি অবধারিত হয়ে যায় , অতঃপর আমি তাকে (ঐ জনপদকে) ধ্বংস করে দিই ঠিক যেভাবে ধ্বংস করা উচিত। (সূরাহ্ আল্-ইসরা / বানী ইসরাঈল: ১৬)

বলা বাহুল্য যে , এখানে আদেশ দান বলতে পাপাচারের সুযোগ রুদ্ধ না করা এবং এজন্য প্রাকৃতিক বিধিবিধানকে সহায়ক রাখা। নয়তো আল্লাহ্ তা আলা কখনোই পাপের আদেশ দেন না। বরং কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভালো গুণ ও সংশোধনের সম্ভাবনা নিহিত থাকা সত্ত্বেও মানবিক দুর্বলতা বশে তারা পাপের দিকে অগ্রসর হলে আল্লাহ্ তা আলা বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক ও মানবিক বাধাবিঘ্ন ও বিপদাপদ সৃষ্টি করে তাদের পাপপ্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করেন। কিন্তু কোনো জনগোষ্ঠী যখন পাপাচার ও আল্লাহ্ তা আলার নাফরমানীর ব্যাপারে বেপরোয়া হয়ে ওঠে তখন আল্লাহ্ তা আলা তাদের পাপাচারের পথে বাধা সৃষ্টি করেন না। ফলে তারা পাপাচারে অধিকতর বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং ধ্বংসের উপযুক্ত হয়ে যায়। একেই আল্লাহ্ তা আলা ভাবার্থে তাঁর আদেশ বলে অভিহিত করেছেন।

অনুরূপভাবে বানী ইসরাঈলের নাফরমানী ও সে কারণে তাদেরকে শাস্তিদান প্রসঙ্গে তাদের উদ্দেশে সতর্কীকরণমূলক ভবিষ্যদ্বাণী উদ্ধৃত করে এরশাদ হয়েছে:

( وَقَضَيْنَا إِلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ فِي الْكِتَابِ لَتُفْسِدُنَّ فِي الْأَرْضِ مَرَّتَيْنِ وَلَتَعْلُنَّ عُلُوًّا كَبِيرًا فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ أُولَاهُمَا بَعَثْنَا عَلَيْكُمْ عِبَادًا لَنَا أُولِي بَأْسٍ شَدِيدٍ فَجَاسُوا خِلَالَ الدِّيَارِ و.... فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ الْآخِرَةِ لِيَسُوءُوا وُجُوهَكُمْ وَلِيَدْخُلُوا الْمَسْجِدَ كَمَا دَخَلُوهُ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَلِيُتَبِّرُوا مَا عَلَوْا تَتْبِيرًا)

আর আমি বানী ইসরাঈলের উদ্দেশে কিতাবে ফয়সালা করে দিয়েছিলাম যে , অবশ্যই তোমরা ধরণীর বুকে দুই বার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং অবশ্যই তোমরা গুরুতর ধরণের ঔদ্ধত্যের পরিচয় দেবে। অতঃপর যখন সেই দু টি প্রতিশ্রুতির প্রথমটি এলো তখন আমি তাদের বিরুদ্ধে আমার কঠোর যোদ্ধা বান্দাহদের পাঠালাম যারা সে জনপদের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়লো (এবং তাদেরকে হত্যা করলো।) অতঃপর যখন অপর প্রতিশ্রুতিটি(-এর সময়) সমুপস্থিত হলো তখন তারা (আমার প্রেরিত বান্দাহরা) তোমাদের চেহারা বিকৃত করে দিলো এবং প্রথম বার যেভাবে প্রবেশ করেছিলো সেভাবেই মসজিদে প্রবেশ করলো এবং যেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলো সেখানেই সর্বাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ চালালো। (সূরাহ্ আল্-ইসরা /বানী ইসরাঈল: ৪ , ৫ ও ৭)

এখানে কিতাবে ফয়সালা করে দেয়া মানে বানী ইসরাঈলের মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা ও অন্যান্য কার্যকারণের আলোকে অবধারিত হয়ে যাওয়া ভবিষ্যত সম্পর্কে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাবে (তাওরাতে) ভবিষ্যদ্বাণী ; বিনা কারণে স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারণ করে দেয়া নয়-এটা আমাদের ইতিপূর্বেকার আলোচনা সমূহ থেকে সুস্পষ্ট। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে , উপরোক্ত হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ মুশরিক বাহিনী দ্বারা সংঘটিত হয়েছিলো। কিন্তু আল্লাহ্ তা আলা তাদেরকে স্বীয় কঠোর যোদ্ধা বান্দাহ্ বলে এবং তাদেরকে তিনিই পাঠিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন , যদিও তারা তাদের পররাজ্যগ্রাস ও সম্পদলিপ্সার লক্ষ্যেই এ অভিযান চালিয়েছিলো এবং মসজিদুল আক্বছা -কেও ধ্বংস করেছিলো। যেহেতু বানী ইসরাঈল পাপাচারে লিপ্ত হওয়ায় ও আল্লাহ্ তা আলার নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করায় একদিকে আল্লাহর শাস্তির উপযুক্ত হয়ে গিয়েছিলো অন্যদিকে নৈতিক অধঃপতনের কারণে তাদের বীর্যবত্তা ও প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছিলো , সেহেতু মুশরিক দুশমনরা তাদের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে সাহসী হয়ে উঠেছিলো। আর এভাবে বানী ইসরাঈল তাদের পাপাচার ও সীমালঙ্ঘনের পার্থিব শাস্তি লাভ করেছিলো। তাই আল্লাহ্ তা আলা আক্রমণকারীদেরকে তাঁর নিজস্ব বাহিনী বলে অভিহিত করেন। বিশেষ করে সমগ্র সৃষ্টিলোকের সব কিছুই আল্লাহ্ তা আলার নির্ধারিত প্রাকৃতিক বিধানের আওতায় এবং মানুষকে তাঁরই দেয়া স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতার ব্যবহারের ফলে এ ধরনের ঘটনাবলী সংঘটিত হয়ে থাকে তাই ব্যাপকতর অর্থে এ কাজ তিনিই করেছেন বলে বলা যেতে পারে। কারণ , তিনি যদি চাইতেন যে , এ কাজ না হোক তাহলে তা হতো না।

আল্লাহ্ তা আলা অন্যত্র এরশাদ করেন:

( وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا)

আর , একদল লোক দ্বারা অপর এক দলকে আল্লাহর পক্ষ থেকে দমন করা না হলে খৃস্টানদের গীর্জা ও মঠ , ইয়াহূদীদের ইবাদতখানা এবং মসজিদ সমূহ-যাতে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়-ধ্বংস হয়ে যেতো। (সূরাহ্ আল্-হাজ্ব: ৪০)

বলা বাহুল্য যে , এ হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টিব্যবস্থাপনার অন্যতম প্রাকৃতিক বিধি যার আওতায় জাতি সমূহের উত্থান-পতন সংঘটিত হয়। এজন্য এটা অপরিহার্য নয় যে , সংঘাতে লিপ্ত পক্ষদ্বয়ের একটি অথবা আক্রমণকারী পক্ষ অবশ্যই সত্যপন্থী হবে। বরং উভয় পক্ষই বাতিলপন্থী হতে পারে এবং সত্যপন্থীরা এতই দুর্বল হতে পারে যে , তারা কোনো পক্ষ হিসেবে গণ্য হবার পর্যায়ে না-ও থাকতে পারে। এমতাবস্থায় দুই বাতিল পক্ষের সংঘাত ও একের দ্বারা অপরের ধ্বংসসাধনের ফলে সামগ্রিকভাবে বাতিলই দুর্বল হয়ে যায় এবং সেই অবকাশে দুর্বল অবস্থানের অধিকারী সত্যপন্থীদের জন্য অস্তিত্ব বজায় রাখা ও ধীরে হলেও বিকাশ-বিস্তারের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়। যেহেতু এসব সংঘাতের নায়করা আল্লাহ্ তা আলার উদ্দেশ্যকেই বাস্তবায়িত করছে সেহেতু আল্লাহ্ তা আলাই যেন তাদেরকে দিয়ে এ কাজ করাচ্ছেন।

অনুরূপভাবে আল্লাহ্ তা আলা একই কাজকে যেমন ফেরেশতাদের প্রতি আরোপ করেছেন , তেমনি তা তাঁর নিজের প্রতিও আরোপ করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ , আল্লাহ্ তা আলা মানুষের মৃত্যু ঘটানোর কাজ ফেরেশতাদের ( মালায়েকাহ্ বহুবচন বাচক শব্দ) প্রতি আরোপ করেছেন। এরশাদ হয়েছে:

( فَكَيْفَ إِذَا تَوَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ يَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَارَهُمْ)

তখন তাদের (কাফেরদের) অবস্থা কেমন হয় যখন ফেরেশতারা তাদের প্রাণ গ্রহণকালে তাদের চেহারায় ও তাদের পৃষ্ঠদেশে আঘাত করে। (সূরাহ্ মুহাম্মাদ: ২৭)

অপর এক আয়াতে প্রাণ গ্রহণের বিষয়টি মৃত্যুর ফেরেশতার (মালাকুল মাওত্=এক বচন/ আযরাঈল) প্রতি আরোপ করা হয়েছে:

( قُلْ يَتَوَفَّاكُمْ مَلَكُ الْمَوْتِ الَّذِي وُكِّلَ بِكُمْ ثُمَّ إِلَى رَبِّكُمْ تُرْجَعُونَ)

(নবী!) বলে দিন: মৃত্যুর ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ গ্রহণ করবে যাকে তোমাদের (প্রাণ হরণের) দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়েছে। অতঃপর তোমরা তোমাদের রবের দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে। (সূরাহ্ আস্-সাজদাহ্: ১১)

কিন্তু আল্লাহ্ তা আলা একই কাজ অন্যত্র তাঁর নিজের প্রতি আরোপ করেছেন। এরশাদ হয়েছে:

( اللَّهُ يَتَوَفَّى الْأَنْفُسَ حِينَ مَوْتِهَا وَالَّتِي لَمْ تَمُتْ فِي مَنَامِهَا فَيُمْسِكُ الَّتِي قَضَى عَلَيْهَا الْمَوْتَ وَيُرْسِلُ الْأُخْرَى إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى)

আল্লাহ্ নাফ্স্ সমূহকে পরিগ্রহণ করেন তার মৃত্যুর (প্রতিটি নাফসের) মৃত্যুর সময় এবং যে মারা যায় নি তার ঘুমের সময়। অতঃপর , যার ওপর মৃত্যুর ফয়সালা কার্যকর হয়েছে তাকে রেখে দেন এবং অন্যটিকে তার শেষ সময় পর্যন্ত (জীবন ধারণের জন্য পুনরায় ফেরত) পাঠিয়ে দেন। (সূরাহ্ আয্-যুমার: ৪২)

এ থেকে সুস্পষ্ট যে , মানুষের মৃত্যুর সময় প্রাণ গ্রহণের বিষয়টি একটি সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাধীনে সংঘটিত হয়ে থাকে ; কোনো ফেরেশতা বিশেষ বা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন ফেরেশতার দ্বারা নয়। এ ব্যবস্থার শীর্ষপরিচালক ও দায়িত্ব বণ্টনকারী হচ্ছেন একজন ফেরেশতা ; অন্য ফেরেশতারা তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীনে দায়িত্ব পালন করে। তাই এ কাজকে যেমন সরাসরি প্রাণ গ্রহণকারী ফেরেশতার প্রতি আরোপ করা চলে , তেমনি এ ব্যবস্থাপনার পরিচালক মালাকুল মাওতের প্রতিও আরোপ করা চলে। তেমনি এ ব্যবস্থাপনা আল্লাহ্ তা আলা কর্তৃক নির্ধারিত এবং এর মাধ্যমে তাঁরই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয় বিধায় তা আল্লাহ্ তা আলার প্রতিও আরোপ করা চলে। কিন্তু আল্লাহ্ তা আলার প্রতি আরোপ করার মানে এ নয় যে , স্বয়ং আল্লাহ্ই প্রতিটি প্রাণ গ্রহণ করেন এবং ফেরেশতারা প্রাণ গ্রহণের দায়িত্বে নিয়োজিত নয়।

অনুরূপ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বলা হয় যে , সৃষ্টিজগতের সব কিছুই আল্লাহ্ তা আলা করছেন তাহলে ভুল হবে না। কারণ , ফেরেশতা , মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকুল যা কিছু করছে তা আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টি হিসেবে , তাঁরই দেয়া শক্তি ও ক্ষমতা দ্বারা এবং তাঁরই প্রতিষ্ঠিত যান্ত্রিক নিয়মে বা তাঁরই দেয়া স্বাধীন ইচ্ছার সাহায্যে করছে। আল্লাহ্ তা আলা স্বাধীন ইচ্ছা না দিলে মানুষ স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী হতে পারতো না এবং তার সঠিক বা ভুল প্রয়োগের প্রশ্নও উঠতো না। অতএব , এ দৃষ্টিকোণ থেকে সকল কাজই আল্লাহ্ তা আলার কাজ। কিন্তু এ হচ্ছে উঁচু স্তরের ভাববাচক কথা। এর মানে এ নয় যে , মানুষ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতার অধিকারী নয় এবং তাকে দিয়ে যান্ত্রিকভাবে সব কিছু করিয়ে নেয়া হয়। অর্থাৎ এ ধরনের আয়াত থেকে কোনোভাবেই জাবারীয়াহ্ তত্ত্ব প্রমাণিত হয় না। কারণ , ঐ সব আয়াতের ভিত্তিতে জাবারীয়াহ্ তত্ত্বকে সঠিক মনে করা হলে যে সব আয়াত থেকে সৃষ্টির স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা প্রমাণিত হয় সে সব আয়াতকে উপেক্ষা করা হয়।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে , অধীনস্থদের কাজকে উপরস্থ কর্তা বা মালিকের কাজ বলে উল্লেখ করার রীতি মানবিক সমাজেও প্রচলিত রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ , কোনো সরকারের আমলে কোনো বড় ধরনের কাজ সম্পাদিত হলে , যেমন: বড় কোনো সেতু বা মহাসড়ক বা ভবন নির্মিত হলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে বলা হয় যে , অমুক এটি নির্মাণ করেছেন। আবার সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো সংসদ সদস্যের ভূমিকা থাকলে বলা হয় যে , অমুক এমপি এটি বানিয়েছেন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে যখন বলা হয় যে , অমুক এটি নির্মাণ করেছেন , তখন তা থেকে এমপি কর্তৃক তা নির্মাণের দাবীকে অস্বীকার করা হয় না এবং এমপি কর্তৃক নির্মাণের কথা বলার সময় প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তা নির্মাণের দাবীকে অস্বীকার করা হয় না। অন্যদিকে সেটির নির্মাণ প্রক্রিয়ায় একজন মন্ত্রী (ধরুন , যোগাযোগ মন্ত্রী) জড়িত থাকেন এবং এ কারণে তিনি তা নির্মাণ করেছেন বলেও উল্লেখ করা হয়। আবার এ কাজে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর অধীনস্থ বিভিন্ন কর্মকর্তা , ইঞ্জিনীয়ার ও কর্মচারীগণ এতে জড়িত থাকেন বিধায় তাঁরাও বলেন যে , আমরা এটি নির্মাণ করেছি। অথচ আক্ষরিক অর্থে যাকে নির্মাণকাজ বলা হয় তাতে এদের কেউই জড়িত থাকেন না। বরং বিভিন্ন স্তরের শ্রমিক , যেমন: রাজমিস্ত্রী , রাজ-যোগালী ও সাধারণ শ্রমিক , রংকারক , বিদ্যুত মিস্ত্রী , কাঠমিস্ত্রী , ঝালাইকারক ইত্যাদি বহু লোক জড়িত থাকে এবং তারাও বলে যে , আমরা এটি নির্মাণ করেছি। অনুরূপভাবে এর ত্রুটিগুলোও স্বতন্ত্রভাবে তাদের সকলের প্রতিই আরোপ করা হয়। যেমন: বলা হয় যে , অমুক প্রেসিডেন্ট (বা প্রধান মন্ত্রী বা এমপি বা মন্ত্রী) এ স্থাপনাটি নির্মাণ করেছেন , কিন্তু এর ডিজাইনটা ভালো হয় নি , বা (বলা হয়:) নিম্ন মানের সিমেন্ট ব্যবহার করায় এখনই আস্তরণ উঠে যাচ্ছে , যদিও এসব ত্রুটির সাথে তাঁদের কারোই সরাসরি সম্পর্ক নেই। বরং ডিজাইনের ত্রুটির জন্য ইঞ্জিনীয়ার বা স্থপতি এবং নিম্ন মানের সিমেন্টের জন্য ঠিকাদার দায়ী। অথবা ফেটে যাওয়ার জন্য শ্রমিকদের বা রাজমিস্ত্রীদের দায়িত্বহীনতাও দায়ী হতে পারে।

অনুরূপভাবে একটি সংবাদপত্রের উদাহরণ থেকেও বিষয়টি সহজে বোঝা যেতে পারে। একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক-প্রকাশকের প্রতি পুরো পত্রিকার সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজ আরোপ করা হয় , যদিও এ সব কাজ তাঁর অধীনস্থ লোকেরাই করে থাকেন ; এমনকি সম্পাদকীয় নিবন্ধ পর্যন্ত সহকারী সম্পাদকগণ লিখে থাকেন ; সম্পাদক স্বয়ং কদাচিৎ তা লিখে থাকেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুরো কাজটিই সম্পাদক কর্তৃক নির্ধারিত সম্পাদকীয় নীতিমালার আলোকে সম্পাদিত হয়ে থাকে বিধায় তা সম্পাদকের কাজ বলে বিবেচিত হয় , যদিও প্রতিটি কাজই তাঁর মনমতো বা তাঁর দৃষ্টিতে কাঙ্ক্ষিত মানের হয় না। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবেই সম্পাদকীয় নীতির বরখেলাফ কোনো কাজ করতে পারেন , কিন্তু এ কারণে কাজের প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে না , যদিও এজন্য পরে জবাবদিহি করতে হয় ; এমনকি চাকরিও চলে যেতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে অধীনস্থ লোকের ত্রুটিকেও সম্পাদকের প্রতি আরোপ করা হয় এবং তিনি সে কাজের দায়দায়িত্ব অস্বীকার করেন না। কিন্তু তার মানে এ নয় যে , তিনিই এ ত্রুটি করেছেন বা সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে দিয়ে তিনি তা করিয়েছেন এবং এ কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক দায়ী নন।