পালানোর উপায় নেই

পালানোর উপায় নেই 28%

পালানোর উপায় নেই লেখক:
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

পালানোর উপায় নেই
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 18 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16405 / ডাউনলোড: 4270
সাইজ সাইজ সাইজ
পালানোর উপায় নেই

পালানোর উপায় নেই

লেখক:
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বাংলা

যে মৃত্যু আমাদের নিত্য মুহূর্তের সাথী সেই মৃত্যুকে আমরা আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে দেয়ার চেষ্টা করি । অথচ এ মৃত্যুর কথা আমরা স্মরণ করি বা না-ই করি তা আমাদের সকলের দুয়ারে একদিন হানা দেবেই। আমরা নিজেদেরকে আপাততঃ ফাঁকি দিলেও মৃত্যুকে ফাঁকি দেয়ার কোন জো নেই। মৃত্যু এবং পরকালের হিসেব নিকেশের স্মরণ একজন মানুষকে তার দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করে সমাজে গঠনমূলক ও উপকারী অনেক কাজের অবদান রাখতে অনুপ্রেরণা যোগায়। আজকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যে সকল অন্যায় অবিচার ও পাপাচার বিদ্যমান তার মুলৎপাটনও ঘটাতে পারে উক্ত বিষয়ে স্মরণ। আর এ কথা ভেবেই মহাপুরুষদের জীবনী থেকে নির্বাচিত উপদেশবাণী সম্বলিত বিভিন্ন কাহিনী নিয়ে একটি পুস্তক রচনা করার চেষ্টা করেছি।

 

পালানোর উপায় নেই

মুহাম্মাদ নূরে আলম

উৎসর্গঃ

নির্লোভ ও দুনিয়াত্যাগী মানবপ্রেমী আধ্যাত্মিক সাধকদের চরণে। বিশেষ করে পারস্যের ভুমিতে শায়িত মহান আধ্যাত্মিক সাধক ও রাসূলের(সা.) অষ্টম পুরুষ হযরত আলী ইবনে মুসা আর রিযার(আঃ) সমাধিতে।

অবতরণিকা

“ এ উট সবার দুয়ারে একদিন আসবে ”-এটি একটি ফারসী প্রবাদবাক্য। এর পেছনে একটি ঐতিহাসিক কাহিনী লুকায়িত আছে। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যখন তাঁর জন্মস্থান মক্কা নগরী ত্যাগ করে ইয়াসরেব তথা মদিনায় উপস্থিত হন তখন মদিনার জনগণ প্রত্যেকে নবীকে নিজের অতিথি হিসেবে পাবার জন্যে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়। তারা কোন একক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারলে মহানবী (সা.) নিজের উটকে ছেড়ে দিয়ে বললেন এ উট যে বাড়ির সামনে গিয়ে বিশ্রাম নেবে সে বাড়িতে তিনি মেহমান হবেন। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছিল। আর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পারস্যের ফারসী ভাষায় গড়ে ওঠেছে উক্ত প্রবাদ বাক্যটি।

এ প্রবাদটিতে একটি গভীর অর্থ ও ব্যাখ্যা বিরাজমান। ফারসী ভাষীরা যখন কোন কিছুর আগমন কারো জন্যে অবধারিত ও নিশ্চিত বলে ধারনা করেন তখন উক্ত প্রবাদ বাক্যটি ব্যবহার করে থাকেন। প্রতিটি প্রাণীর জন্যে এ পৃথিবীতে জীবন জীবিকার একটা নির্দ্দিষ্ট সময়সীমা এটে দেয়া আছে। তাই স্বভাবতঃ মানুষেরও আয়ুষ্কাল সীমিত। এ পৃথিবী ছেড়ে তাকে পরপারে পাড়ি জমাতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই। মৃত্যু তার প্রতিনিয়ত সঙ্গী। এ কারণে পারস্যে যখন কেউ মৃত্যুর এ অবধারিত ব্যবস্থাপনার ব্যাপারটি বোঝাতে চান তখন তিনি এ প্রবাদ বাক্যটি ব্যবহার করে থাকেন। এখানে মৃত্যুকে ঐ উটের সাথে তুলনা করা হয়েছে যা এক সময় সবার দুয়ারে গিয়ে পৌছবে।

যে মৃত্যু আমাদের নিত্য মুহূর্তের সাথী সেই মৃত্যুকে আমরা আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে দেয়ার চেষ্টা করি । অথচ এ মৃত্যুর কথা আমরা স্মরণ করি বা না-ই করি তা আমাদের সকলের দুয়ারে একদিন হানা দেবেই। আমরা নিজেদেরকে আপাততঃ ফাঁকি দিলেও মৃত্যুকে ফাঁকি দেয়ার কোন জো নেই।

মৃত্যু এবং পরকালের হিসেব নিকেশের স্মরণ একজন মানুষকে তার দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করে সমাজে গঠনমূলক ও উপকারী অনেক কাজের অবদান রাখতে অনুপ্রেরণা যোগায়। আজকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যে সকল অন্যায় অবিচার ও পাপাচার বিদ্যমান তার মুলৎপাটনও ঘটাতে পারে উক্ত বিষয়ে স্মরণ। আর এ কথা ভেবেই মহাপুরুষদের জীবনী থেকে নির্বাচিত উপদেশবাণী সম্বলিত বিভিন্ন কাহিনী নিয়ে একটি পুস্তক রচনা করার চেষ্টা করেছি। এখানে আত্ম উন্নয়নমূলক শিক্ষার বিষয়টিও প্রতিটি কাহিনী নির্বাচনে সাহায্য করেছে। পাঠক মহোদয়রা যেন অতি সহজে প্রতিটি কাহিনী থেকে গঠনমূলক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন সেজন্যে প্রতিটি গল্পে কিছু লাইন বোল্ড করে দেয়া আছে। তারা অল্প পরিশ্রমেই গল্পের আসল শিক্ষা সেখান থেকে খুজে নিতে পারবেন। তাই এ বই পড়ে যদি কোন পাঠকের সামান্যতম গঠনমূলক কোন উপকারে আসে এবং তিনি নিজের সংশোধনে মানুষের জন্যে অবদান রেখে যেতে পারেন তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো।

মুহাম্মাদ নূরে আলম-

শেখ সা দির বাণী

পারস্যের মরমী কবি হযরত শেখ সা ’ দি (রহঃ) তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘গুলিস্তান ’ -এ লিখেছেন : “দুই ধরনের মানুষ অনর্থক কষ্ট স্বীকার করে এবং লাভহীন প্রচেষ্টা চালায় : এক : যে বস্তুসম্পদ সঞ্চয় করে ঠিকই কিন্তু ভোগ করতে পারে না। দুই : যে শিক্ষা অর্জন করে ঠিকই কিন্তু সে অনুযায়ী আমল করে না ” । তিনি আরো বলেন : জনৈক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হলো : আমলবিহীন আলেমের (জ্ঞানী ব্যক্তি) তুলনা কিসের ন্যায় ? উত্তরে বলেন : মধুবিহীন মৌমাছির ন্যায়। তিনি বলেন : মৃগনাভী কস্তুরী তো , যার সুগন্ধি মানুষকে বিমোহিত করে , সুগন্ধি বিক্রেতা বললেই তা মৃগনাভী কস্তুরী হয় না। জ্ঞানী ব্যক্তি সুগন্ধি সংরক্ষিত কাঠের বাক্সের ন্যায় নিশ্চুপ , আর মূর্খ ও প্রদর্শনমুখী ব্যক্তি ঢোলের মত বেশী বাজে কিন্তু ভিতর শূন্য। ”

(০১)

লজ্জা

“হাবসা (ইথিওপিয়া) অধিবাসী এক ব্যক্তি রাসূলে খোদা (সা.)-এর খেদমতে হাজির হয়ে বললো : “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পাপ অনেক। আমার জন্যেও কি তাওবার দ্বার খোলা আছে ?”

দয়াল নবী (সা.) বললেন : “হ্যাঁ , তাওবার দরজা সবার জন্যে খোলা। তুমিও তা থেকে উপকৃত হতে পারো। ”

অতঃপর হাবসী লোকটি সন্তুষ্ট চিত্তে আল্লাহর রাসূলের (সা.) কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজ দেশে চলে গেল।

কিছুদিন পরের কথা। সে লোকটি পুনরায় নবীর (সা.) কাছে ফিরে এলো। এবার এসে সে নবীকে (সা.) জিজ্ঞেস করলো : “ইয়া রাসুলালাহ! আমি যখন গুনাহ্ করতাম তখন কি আল্লাহ আমাকে দেখতেন ?”

আল্লাহর নবী (সা.) উত্তরে বলেন : “জি হ্যাঁ , দেখতেন। ”

হাবসী লোকটি মহানবীর এ কথা শুনে বুক থেকে শীতল নিঃশ্বাস ফেলে বললো : “তাওবা পাপের অপরাধ মোচন করতে পারে। গুনাহকে পর্দা দিয়ে ঢেকে দিতে পারে। কিন্তু এ কারণে আল্লাহর কাছে যে লজ্জা পেয়েছি তার কি হবে ?”

(০২)

জাহান্নামী কে ?

[হযরত জা ফর ইবনে ইউনুস (রহ:) শিবলী নামে ছিলেন সুপরিচিত। তিনি ২৪৭ হিজরীতে জন্মগ্রহন আর ৩৫৫ হিজরীতে চিরস্থায়ী আবাস পানে গমন করেন। হিজরী তৃতীয় ও চতু র্থ শতাব্দিতে এ বিখ্যাত অধ্যাত্মিক সাধক ছিলেন বহুল আলোচিত। তিনি ছিলেন আধ্যা ত্মিক জগতের মহাসাধক হযরত জুনাইদে বাগদাদী (রহ:)-এর শিষ্য। তাঁর পরবর্তী সময়ে নামকরা বহু সাধকের গুরু ও ওস্তাদও ছিলেন তিনি।]-

হযরত শিবলী (রহ:) যে শহরে বাস করতেন সেখানে তাঁর বহু সমর্থক এবং অনেক বিরোধী লোকও ছিলো। অনেকে তাকে প্রচন্ডভাবে ভালবাসতেন আবার অনেকে তাকে শহর থেকে নিষ্ঠুরতার সাথে বহিস্কারেরও চেষ্টা করতেন। সে শহরে তাঁর অসংখ্য ভক্তদের মধ্যে এমন একজন রুটি তৈরীকারকও ছিলো যে হযরতকে কখনো চোখে দেখেনি তবে তার নাম শুনেছে মাত্র।

একদিন সাধক সেই রুটি প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতার দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। ক্ষুধার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে আর কোন উপায়ন্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত এক রকম বাধ্য হয়েই সেই রুটি বিক্রেতার কাছে এক টুকরো রুটির আবেদন করলেন হযরত শিবলী (রহঃ) । তিনি একটি রুটি ঋণ চাইলেন সেই রুটি বিক্রেতার কাছে। রুটি বিক্রেতা এ ধরনের আবেদন শুনে রেগে আগুন হয়ে গেল। সে এ অচেনা ব্যক্তিকে যা-তা বলে অপমান করে বিদায় দিলো। ক্ষুধার্ত সাধক সেখান থেকে চলে গেলেন।

এ রুটির দোকানে অন্য একজন লোক বসে তামাশা দেখছিল। সে হযরত শিবলীকে চিনতো। লোকটি রুটি বিক্রেতার সামনে এসে বলো : “যদি তুমি হযরত শিবলীর সাক্ষাৎ পেতে তাহলে কি করতে ?” রুটি বিক্রেতা : “আমি তাকে অনেক সম্মান করতাম , তিনি যা চাইতেন তাই দু ’ হাতে তার পায়ে ঢেলে দিতাম। ”

লোকটি তাকে বললো : “যে লোকটিকে তুমি কিছুক্ষণ পূর্বে তোমার কাছ থেকে তাড়িয়ে দিলে এবং তাকে এক টুকরো রুটি থেকে বঞ্চিত করলে , তিনি ছিলেন সে-ই শিবলী। ” যেই না রুটি বিক্রেতা একথা শুনলো অমনি হায় আফসোস! হায় আফসোস! করতে লাগলো। রুটি বিক্রেতা লজ্জায় সঙ্কুচিত হয়ে গেল। মনে হলো কে যেন তার অন্তরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। পেরেশান ও বিচলিতভাবে সে ছুটে গেলো হযরত শিবলীর সন্ধানে। অবশেষে অনেক খোজাখোজির পর তাকে এক মরুভূমিতে পাওয়া গেল। রুটি প্রস্তুতকারক আর কোন বাক্য উচ্চারণ না করে হযরতের পা জড়িয়ে ধরলো। রুটি বিক্রেতা বিনীত স্বরে বলতে লাগলো , ‘হুজুর দয়া করে আপনি ফিরে আসুন। আমি আপনার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করবো। হুজুর দয়া করে আপনি ফিরে আসুন। আমি আপনার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করবো। ’ হুজুর নিশ্চুপ! কিন্তু রুটি বিক্রেতা তাঁকে আবারো অনুরোধ করতে লাগলো , ‘হযরত! আপনি অধমের প্রতি কৃপা করুন। একরাত আপনি আমার গরীবখানায় থাকুন। আর আমি এই গৌরবময় তৌফিকের কারণে আল্লাহর শোকরগুজারস্বরূপ অনেক মানুষকে খাবারে নিমন্ত্রণ করবো। অনুগ্রহ করে আপনি আমার এই আকুতি প্রত্যাখ্যান করবেন না। ’ এরকম আকুতি মিনতি দেখে এবং তাঁর কারণে অনেক মানুষ খেতে পারবে ভেবে অবশেষে হুজুর রুটিওয়ালার দাওয়াত গ্রহণ করলেন।

দিন শেষে রাত্রি ঘনিয়ে আসলো। রুটিওয়ালার গৃহে খাবারের বিশাল আয়োজন। শতশত মানুষ তার দস্তরখানার চার পাশে জমায়েত। রুটি বিক্রেতা একশত দিনার এই মেহমানদারিতে খরচ করলো। সে তার ঘরে হযরত শিবলীর অবস্থানের সংবাদ উপস্থিত জনতাকে অবহিত করতে ভুললো না।

হযরত শিবলী নৈশভোজে শরিক হলেন। সকলে আহারে ব্যস্ত। হযরত শিবলী ছাড়াও অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক সাধক। তিনি হযরতকে প্রশ্ন করেন : “ইয়া শেখ! আপনি বলে দিতে পারবেন দোযখবাসী ও বেহেস্তবাসীর আলামত কী ?”

জবাবে হযরত শিবলী (রহঃ) বলেন : “জাহান্নামী ঐ ব্যক্তি , যে একখণ্ড রুটি আল্লাহর রাহে দান করে না অথচ শিবলীর মত আল্লাহর এক অপারগ ও অসহায় বান্দার জন্যে একশত দিনার খরচ করতেও দ্বিধাবোধ করে না , আর জান্নাতীরা কিন্তু এরকম নয়। ”

(৩)

উপকারী কাজ

পীর সাহেব তাঁর মুরীদদের জিজ্ঞেস করেন : “তোমরা কি এমন কোন কাজ আঞ্জাম দিয়েছো যা থেকে অন্যেরাও উপকৃত হয়েছে ? ” হুজুরের কথা শুনে মুরীদদের মধ্যে একজন বলে উঠলো : “আমি ছিলাম একজন আমির-বাদশাহ্। একবার একটি ভিক্ষুক আমার বাড়িতে সাহায্যের জন্য আসে। আমি আমার বাদশাহী পোশাক ও আংটি পড়িয়ে তাকে আমার সিংহাসনে বসিয়ে দিলাম। আর আমি সবকিছু ছেড়ে দরবেশী পোশাক পড়ে আল্লাহর সাধকের পথ ধরলাম। ”

অন্য একজন মুরীদ বললো : “আমি এক সময় একটি জায়গা দিয়ে অতিক্রম করছিলাম। দেখলাম সাধারণ মানুষেরা একজন লোককে আটক করেছে। লোকেরা তার হাত কাটার সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করে ফেলেছে। সেখানে আমি নিজের হাত উৎসর্গ করে লোকটিকে মুক্ত করলাম। আর দেখুন এই যে আমার এক হাত নেই। ”

এতক্ষন পীর সাহেব নিশ্চুপ ছিলেন। তিনি মুরীদদের বক্তব্য মনোযোগ সহকারে শুনছিলেন। তাদের কথা শুনার পর তিনি মুখ খুললেন। তিনি বল্লেন : “তোমরা যা করেছো তা নির্দিষ্ট দু ’ জন ব্যক্তির জন্যে করেছো। মু ’ মিন তো সূর্য , তার কাজ সূর্যের তাপের ন্যায় -যা সকলের জন্যে উপকারে আসে এবং কেউ তা থেকে বঞ্চিত হয় না। তোমাদের মধ্য থেকে কি এমন উপকারী কাজ আল্লাহর বান্দাদের কাছে পৌছেছে ?” মুরীদরা হুজুরের এমন কথা শোনে নির্বাক হয়ে মাথা নিচু করে রইলো।

(০৪)

ভিতরে আসতে বাধা

এক কাফের ব্যক্তির একজন মুসলমান দাস ছিল। দাস তার নিজ ধর্মে ছিল অত্যন্ত দৃঢ় ও প্রত্যয়শীল। কাফের লোকটি তাকে ধর্মের কাজে কোনরূপ বাধা প্রদান করতো না।

একদিন মনিব তার গোলামকে বললো : গোসল কারার সরঞ্জাম প্রস্তুত কর , গোসল করার জন্যে হাম্মামের দিকে রওয়ানা হতে হবে। ” তারা যাত্রা শুরু করলে পথিমধ্যে একটি মসজিদের সাক্ষাত পেলো।

দাস বললো : মনিব মহাশয়! আমাকে কী একটু অনুমতি দিবেন , আমি মসজিদের ভিতরে গিয়ে নামাজ আদায় করে আসি।

মনিব বললো : যাও! তবে যখনি নামাজ শেষ করবে তাড়াতাড়ী ফিরে এসো। আমি এখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। তোমার জন্যে অপেক্ষা করবো। ”

মসজিদে জামায়াত সমাপ্ত হয়েছে। ইমাম সাহেব ও অন্যান্য মুস ল্লিরা সকলে এক এক করে বাইরে চলে এসেছে। মনিব বেরিয়ে আসা মুস ল্লিদে র মধ্যে তার দাসকে খুজে পাচ্ছে না। এরকম অনেকক্ষন সে ধৈর্যধারণ করলো। অবশেষে তার ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটলো। তিনি উচ্চ স্বরে চিৎকার করে ডাকলেন : এ-ই গোলাম , বাহিরে এসো। ”

মসজিদের ভিতর থেকে জবাব আসলো : আমাকে বাইরে আসতে দিচ্ছে না। ”

শেষ পর্যন্ত মনিব দেখতে চাইলো কে তার দাসকে বাইরে আসতে দিচ্ছে না। তাই সে মসজিদের দরজার নিকটবর্তি হলো। কাফের মনিব উঁ কি মেরে দেখলো মসজিদের ভিতর এক জোড়া জুতা আর একজন মানুষের ছায়া ছাড়া আর কিছুই তার নজরে পড়লো না। সেখান থেকেই সে চিৎকার করলো : আচ্ছা! কে তোমাকে বাইরে আসতে বাধা দিচ্ছে ?

ম সজিদের ভিতর থেকে দাস উত্তর দিলো : যে আপনাকে ভিতরে আসতে বাধা দিচ্ছে। ”

(০৫)

হুকুমের ব্যাপারে খেয়াল

[আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইব্নে খাফিফ সিরাজী ছিলেন সোরা পীর সুপরিচিত। তিনি ছিলেন হিজরী চতুর্থ শতাব্দির আধ্যাত্মিক মহা সাধকদের অন্যতম। তিনি দীর্ঘায়ু লাভ করেছিলেন। তাঁর বক্তৃতামালা ও বর্ণিত আলোচনা ও কথোপকথন আধ্যাত্মিক সাধকদের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে আসছে। তিনি সব সময় ভ্রমনে কাটাতেন। তাঁর পিতা কিছুকাল পারস্যের ফারস ’ প্রদেশে বাদশাহী করেছেন। তিনি হিজরী ৩৭১-১৪ সনে পরলোকগমন করেন। ইরানের সিরাজ নগরীর এক ময়দানে তাঁর মাজার অবস্থিত।]

জনশ্রুতি আছে যে তাঁর এমন দু জন মুরীদ ছিল যাদের দু জনেরই নাম ছিল আহমাদ ’ । তাই তিনি একজনকে ডাকতেন বড় আহমাদ ’ আর অপরজনকে ডাকতেন ছোট আহমাদ ’ বলে। তিনি ছোট আহমাদ-এর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতেন এবং তাকে বড় আহমাদের চেয়ে বেশী মহব্বত করতেন। মুরীদদের অনেকেই হুজুরের এই অতি স্নেহ এবং দু জনের প্রতি তাঁর বৈষম্য ব্যবহারে অসন্তুষ্ট ছিলো।

একদিন তারা পীরের-এর নিকট আরজ করে বসলো : হুজুর! বড় আহমাদ তো অনেক কঠোর কৃচ্ছসাধনা করেছে এবং আধ্যাত্মিক সাধনার পরিভ্রমনে অনেক ধাপ অতিক্রম করেছে। কেন আপনি তাকে ছোট আহমাদের চেয়ে বেশী ভালবাসছেন না ?

সেদিন শেইখ শুধু এতটুকুই বলেন : ঠিক আছে , আমি তোমাদের সামনে ওদের দু জনের পরীক্ষা নেব। তবেই তো তাদের উভয়ের মর্যাদা ও মাক্বামের স্থান পরিস্কার হবে। ” উপস্থিত মুরীদরা মাথা নেড়ে পীরের কথায় সম্মতি জানালো।

একদিন শেইখ বড় আহমাদকে বল্লেন : আহমাদ! এই উটকে আমাদের ছাদের উপরে নিয়ে যাও। ”

বড় আহমাদ বলো : ইয়া শেখ! উটকে কিভাবে ছাদের উপরে নেয়া সম্ভব ?

শেখ বল্লেন : আচ্ছা ,ওটাকে রেখে দাও। তুমি ঠিকই বলেছো। ”

অতঃপর তিনি ছোট আহমাদকে বল্লেন : এই উটকে আমাদের ছাদের উপর নিয়ে যাও। ” ছোট আহমাদ হুজুরের এই হুকুম পেয়ে তৎক্ষনাৎ কোমরে কাছা বাঁধলো। জামার আস্তিন উপরে তুললো। অতঃপর উটের পেটের নিচে গিয়ে তাকে কাঁধে নেওয়ার অনেক চেষ্টা করলো। উটকে ছাদে নিতে পারলো না সে। তার সকল চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। এ অবস্থা দেখে আল্লাহর অলী , সাধক বড় পীর ছোট আহমাদকে হুকুম দিলেন আর চেষ্টা না করতে।

অতঃপর তিনি উপস্থিত মুরিদদের সম্বোধন করে বল্লেন : যা চেয়েছিলাম তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। মুরিদান সকলে বললো : যা হুজুরের কাছে পরিষ্কার , তা আমাদের কাছে এখনো অস্পষ্ট।

শেখ বললেন : ওদের দু জনের মধ্যে একজন তার শক্তি ও সামর্থের প্রতি দৃষ্টি দিয়েছে , আমাদের হুকুমের প্রতি নয়। অন্যজন আমাদের হুকুমের ব্যাপারে খেয়াল রেখেছে , নিজের সামর্থের দিকে নয়।

একজন মানুষকে অবশ্যই তার কর্তব্যের প্রতি দৃষ্টি দেয়া উচিৎ এবং তা সম্পাদন করার জন্যে আত্মনিয়োগ করা বান্দার একান্ত দায়িত্ব। মনিবের হুকুম পালনে কষ্ট ও অসুবিধার কথা চিন্তা করা অনুচিত। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কাছ থেকে এটাই চান যে তারা যেন কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে দ্বিধাহীন চিত্তে তা আঞ্জাম দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। আর বান্দা যখনি কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের জন্যে মনোনিবেশ করে তখনি তাঁর নির্দেশ পালন করা হয়ে যায় , যদিও তা সম্পাদন করতে অপারগ হয়।

তবে মনে রাখা দরকার আল্লাহ মানুষের জন্যে কোন অসম্ভব কাজের হুকুম জারী করেন না। ”

(০৬)

ধীশক্তির পরিচয়

[হযরত আবুল কাসেম জুনাইদ বিন মুহাম্মাদ বিন জুনাইদ , উপাধি : সাইয়্যেদুত্ তায়িফাহ , ইরফান ও আধ্যাত্মিক সাধনার জগতে একজন উজ্জল নক্ষত্র। তিনি শ্রেষ্ঠ বহুল পরিচিত সাধকদের অন্যতম। তিনি আসলে ইরানের নেহাভান্দের অধিবাসী কিন্তু বাগদাদে বসবাস করতেন। তিনি হযরত সারি সাক্কত্বির ভাগ্নে ছিলেন। তিনি ত্রিশ বার পদভ্রজে হজ্বব্রত পালন করেছেন। তার তরিকা ও আধ্যাত্মিক সাধনার মূল ভিত্তি ছিলো সাহু ’ বা সতর্কতা ও সজীবতা। এর বিপরীতে হযরত বায়েজিদ বোস্তামির অনুসারীরা সুক্র ’ বা অসর্তকতা ও নির্জিবতাকে তাদের তরিকার মূল ভিত্তি হিসেবে নির্দ্ধারন করেছেন।

সাইয়্যেদুত তায়িফাহ্ তার তরিকায় শরিয়াতের পাবন্দির ব্যাপারে বিশেষভাবে জোড় দিয়েছেন। অধিকাংশ তরিকার সিলসিলা তার নিকট পর্যন্ত গিয়ে পৌছায়। তিনি হিজরী ৩৯৭ সানে এ ধরণি থেকে চির বিদায় গ্রহণ করে তার মা বুদের সান্নিধ্যে চলে যান।]

বর্ণিত আছে যে , হযরত শেখ জুনাইদের (রহঃ) একজন প্রিয় মুরীদ ছিল , যাকে তিনি সবচেয়ে বেশী ভালবাসতেন এবং সকলের চাইতে বেশী সম্মান করতেন। এ ব্যাপারটা অনেকের জন্যে হিংসার কারণ হয়ে দাড়িয়েছিল।

শেখ ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই একদিন তিনি ঐ মুরীদ সম্পর্কে তার অন্যান্য মুরীদদের বললেন : তার আদব ও ভদ্রতা এবং বোধশক্তি সকলের চেয়ে বেশী। আমরা সে দিকই দৃষ্টি দিয়ে থাকি। আচ্ছা পরীক্ষা করা যাক্ , তোমাদের কাছে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয় কি না।

শেখ হুকুম দিলেন বিশটি মুরগী আনতে। অতঃপর বললেনঃ যাও , তোমরা প্রত্যেকে একটি করে মুরগী নাও। এমন নির্জন স্থানে গিয়ে মুরগীগুলোকে জবেহ করে নিয়ে আস যেখানে কেউ যেন দেখতে না পায়। ” বিশজন মুরীদ বিশটি মুরগী নিয়ে চলে গেল।

সকলে মুরগী জবেহ করে শেইখের কাছে হাজির করলো। কিন্তু তার ঐ বিশেষ স্নেহভাজন মুরীদ জবেহ না করে জিবন্ত মুরগীটিই ফিরিয়ে নিয়ে আসলো।

শেখ জিজ্ঞেস করলেন : কেন মুরগী জবেহ করনি ? মুরীদ বলো : আমাদের শেখ বলেছিলেন যেখানে কেউ দেখতে না পায় এমন স্থানে মুরগীকে জবেহ করতে। তবে আমি যেখানেই গিয়েছি সেখানেই আল্লাহকে দেখতে পেয়েছি। এমন কোন স্থান খুজে পাইনি যেখানে আল্লাহর উপস্থিতি নেই। ”

এবার শেখ তার মুরীদদের সম্মোধন করে বললেন : তোমরা দেখেছো এর ধীশক্তি ও বুদ্ধিমত্তার পরিমান আর অন্যদের বোধ শক্তিও তো দেখলে। ” তখন সকলে তাওবা করে ঐ মুরীদের সম্মান-মর্যাদাকে বিশেষ ভাবে শ্রদ্ধাজ্ঞান করতে লাগলো।

(০৭)

প্রেমের খেলা

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) বসে বসে তার দুম্বাগুলোর ঘাস খাওয়া দেখছিলেন। তার এই শত শত দুম্বা এই পাহাড়ী এলাকার দৃশ্যকে আরো বেশী মনোরম করে তুলছিলো। তার আশে পাশে ছোট-বড় পাহাড় , টিলা ও পাহাড়ী জঙ্গল সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান। ইব্রাহিম (আঃ) কি চিন্তা করছিলেন ? তিনি কি মনে মনে তার দুম্বার সংখ্যা গণনা করছিলেন ? নাকি সৃষ্টিকর্তার বিস্ময়কর সৃষ্টি নিয়ে ধ্যানমগ্ন ছিলেন ?

তার দৃষ্টি ছিল এমন একটি বাড়ীর দিকে যেখানে চতুর্দিকে শুধু আলোক রশ্মিই প্রতিফলিত হয়। মনে হয় তিনি কোন গোপন রহস্যের উদ্ঘাটন অথবা ধাঁধার সমাধান করতে চিন্তামগ্ন হয়েছেন। না তার দুম্বা , না সূর্য , চন্দ্র , গ্রহ , তাঁরা , না কোন কিছুই তার প্রেমিক হৃদয়ে স্থান করতে পারেনি। শুধুই আল্লাহ। আর আল্লাহ তার প্রনয়সিক্ত মনে অন্য সব সময়ের চেয়ে এ মুহূর্তে আরো বেশী করে অবস্থান নিয়েছিলেন।

দুম্বাগুলো আপন মনে পদচারণা করছিল। কেউ বাধা দেয়ার ছিল না। তবুও ইব্রাহিম (আঃ) তাঁর আপন মা বুদ পরওয়ারদেগারের স্মরণ হতে এক মুহূর্তও দূরে সরে আসেননি। হঠাৎ বিকট এক শব্দ এসে তার কর্ণকুহরে আঘাত হানলো। এ শব্দ কোথা থেকে! এটা তো ছিলো তার বহু বছরের আকাঙ্খা! যা শুনার করার জন্যে তার জাতির কাছ থেকে তিনি আশা করেছিলেন। কিন্তু তার জাতির লোকেরা মূর্তি পূঁজা ছাড়া অন্য কিছুই তাকে উপহার দিতে পারেনি। শব্দটি তার কর্ণকুহরে বলে দিচ্ছে এটা তার মা শুকের নাম। হ্যাঁ , শব্দটি বাতাসের স্পন্দে ভেসে এসে হযরত ইব্রাহিমের মা শুকের নামটিই উচ্চারণ করছে।

ইয়া কুদ্দুস (হে পুতঃ পবিত্র)! ইয়া কুদ্দুস!

ইব্রাহিম (আঃ) এ নাম শুনে আত্মহারা হয়ে গেলেন এবং এই হৃদয়স্পশী ও মর্মভেদী নামের স্বাদ তার মন-মগজকে এমনভাবে আপ্লুত করে দেয় যে তিনি মুহূর্তের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে যান। যখন তার জ্ঞান ফিরে এলো তখন দেখতে পেলেন একজন লোক এক খণ্ড বড় প্রস্তরের উপর বসে আছেন।

ইব্রাহিম (আঃ) বললেন : হে আল্লাহর বান্দা! আরেকবার যদি তুমি এ মধুর নাম উচ্চারণ কর তাহলে আমি আমার দুম্বাগুলোর একাংশ তোমাকে দান করে দিবো। ” তৎক্ষনাৎ ইয়া কুদ্দুসের ধ্বনিপ্রতিধ্বনি আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুললো। পর্বত ও মরুভূমিতে সবদিকে শুধু শোনা যায় ইয়া কুদ্দুস , ইয়া কুদ্দুস।

ইব্রাহিম (আঃ) এই সীমাহীন সু-স্বাদের সাগরে আবারো ডুব দিলেন। বন্ধুর নাম শ্রবনের আনন্দ তাঁর অস্তিত্বে এমনি প্রভাব বিস্তার করেছে যে দ্বিতীয়বার , তৃতীয়বার ও বহুবার এই নাম শ্রবনের চিন্তা ছাড়া অন্য কিছুই তার মস্তিষ্কে জায়গা করে নিতে পারছিল না। তিনি বললেন : আবারো এই নাম পড়। আমি আমার দুম্বাগুলোর আরেক অংশ তোমাকে দান করে দিবো। ” বল : ইয়া কুদ্দুস! আবারো বল : ইয়া কুদ্দুস! এভাবে হযরত ইব্রাহিমের সকল দুম্বা শেষ হয়ে গেল। তবুও তার অন্তর এই পবিত্র মধুর নাম শোনার জন্যে ব্যকুল হয়ে ওঠে। কোন ক্রমেই তৃপ্তি হচ্ছিল না। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেলো তার দুম্বাগুলো পাহারা দেওয়ার জন্যে যে কুকুর তার সাথে এসেছিল তার গলায় ঝুলানো আছে একটি সোনালী শিকল। এবার তিনি সে অচেনা লোকটিকে বললেন , আর একবার তার বন্ধুর নাম উচ্চারণ করতে , তাতে তার শেষ সম্বলটুকুও যদি যায় যাক। লোকটি পড়লো : ইয়া কুদ্দুস! পাহাড়-পর্বত সর্বত্র একই নাম প্রতিধ্বনিত হলো। ইব্রাহিম (আঃ) পুনরায় উদ্বেলিত হয়ে উঠলেন। কিন্তু এবার তাঁর দেয়ার মত আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না। কি করে আবার এই মধুর নাম শোনা যায়। এর আনন্দ ও স্বাদের যে শেষ নেই। কি করা যায় ভেবে পেলেন না। আকষ্মিকভাবে মনে পড়ে গেল তার শেষ সম্বলের কথা। লোকটিকে তিনি বললেন : আরেকবার তুমি সে নামটি উচ্চারণ কর। আমার শেষ সম্বল আমার প্রাণ তোমার জন্য উৎসর্গ করে দিবো। ”

অচিন লোকটির মুখে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠলো। আস্তে আস্তে তিনি হযরত ইব্রাহিমের কাছে আসলেন। ইব্রাহিম তো তার মা শুকের নাম শোনার জন্যে উদ্গ্রীব। কিন্তু মনে হলো ইব্রাহিমের সাথে সেই লোকটির অন্য কিছু বলার আছে। লোকটি বললেন :‘‘ আমি জিব্রাঈল! আল্লাহর নিকটতম ফেরেস্তা। আসমানী জগতে তোমার ব্যাপারে অনেক কথার অবতারণা হয়েছিল। সবাই তোমার কথাই বলতো। অবশেষে আমরা সকলে আল্লাহর কাছে অনুরোধ করেছিলাম , হে ইলাহ্ , মৃত্তিকার তৈরী তোমার ইব্রাহিম কেন এবং কিভাবে খলিলু ল্লাহ্ -এর মাক্বামে পৌছুলো ? তখন আল্লাহ আমাকে হুকুম দিলেন তোমার কাছে আসতে এবং তোমাকে পরীক্ষা করতে। এখন আমার কাছে স্পষ্ট যে কেন তুমি আল্লাহর খলিল বা বন্ধু খেতাব লাভ করেছো। কেননা তুমি আশেক , তাই পূর্ণতার শিখরে পৌছেছো। হে ইব্রাহিম! এই দুম্বাগুলো আমাদের কোন কাজে আসবে না। তোমার দুম্বা তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম।

ইব্রাহিম (আঃ) উত্তর দিলেন : কোন কিছুকে দান করে সেগুলোকে পুনরায় ফিরিয়ে নেয়া মহত্বের শর্ত ও মুক্ত মানুষদের নীতি আদর্শ নয়। আমি ওগুলোকে দান করে দিয়েছি। ফিরিয়ে নিতে পারবো না। ” হযরত জিব্রাইল (আঃ) বললেন : তাহলে ওগুলোকে যমিনের বুকে ছড়িয়ে দিই। ওরা যেখানে খুশি সেখানে বিচরণ করে বেড়াক। কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ এই দুম্বাগুলোকে শিকার করবে তারা সবাই তোমার মে হমান।

(০৮)

অনুগত দুই দাস

বর্ণিত যে , একদা বাদশাহ্ ইস্কান্দার মাকদুনী (আলেকজান্ডার) বাক্যালাপের উদ্দেশ্যে দিভ্জান্স-এর খেদমতে আগমন করেন। দিভ্জান্স ছিলেন একজন নির্জনবাসী ও আধ্যাত্মিক সাধক। বাদশাহ্ ইস্কান্দার তার কাছে গেলে তিনি আশানুরূপ সম্মান পেলেন না। এতে করে তিনি অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে পড়েন। বাদশাহ ক্রোধের স্বরে তাকে বলেন : এটা কি ধরনের আচরণ তুমি আমার সাথে করলে ? তুমি মনে করেছো আমার কাছে তোমার কোন কিছুর প্রয়োজন নেই।

জি হ্যাঁ , প্রয়োজন নেই। ” উত্তর দিলেন সাধক। বাদশাহ্ : তোমাকে তো অ-মুখোপেক্ষী দেখছি না। মাটির উপর বসে আছো দেখছি আর আসমান তো তোমার ঘরের ছাদ। আমার কাছে কিছু চাও যেন তোমাকে দিতে পারি। ”

সাধক : হে বাদশাহ্! আমার একান্ত অনুগত দু টি দাস আছে যারা তোমার মনিব। সেহেতু তুমি আমার দাসদেরও দাস। ”

বাদশাহ্ : তোমার যে দাসেরা আমার মনিব তারা কারা ? সাধক : তারা হলো কাম এবং ক্রোধ। আমি ঐ দু টোকে নিজের অধীনে এনে দাসত্বের শৃংখল গলায় পড়িয়ে দিয়েছি। আর এরাই তোমার উপর কর্তৃত্ব করছে। তারাই তোমার মনিব। তারা যেদিকে তোমাকে নেয় তুমিও সেদিকে চল। এখান থেকে চলে যাও। এখানে এই দু য়ের কোন স্থান নেই।

(০৯)

শূন্য দরগাহ্

[বায়োজিদ বোস্তামী অবশ্যই হাতে গুনা কয়েকজন আল্লাহর মহান অলী ও অত্যন্ত প্রভাবশালী ইসলামী মহা আরেফ ও সাধকদের মধ্যে গণ্য। হকওয়ালার রাহে মহাপুরুষদের উপর তাঁর অবিশ্বাষ্য প্রভাবের কারণে বিভিন্ন কাহিনী ও বক্তব্য অন্যান্য সকল আরেফ-অলীদের চেয়ে বেশী বর্ণিত হয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থাদিতে। হযরত শেখ ফরিদউদ্দিন আত্তার নিশাপুরী তার বিখ্যাত তায্কিরাতুল আওলিয়া ’ কিতাবে -যাতে আরেফ-অলীদের মাক্বাম-মর্যাদা ও অবস্থার বর্ণনা রয়েছে , সেখানে তিনি সবচেয়ে বেশী হযরত বায়োজিদ বোস্তামীর কথা বর্ণনা করেছেন।

দ্বিতীয় হিজরীর শেষাংশে বোস্তাম শহরে (যা এখন ইরানের শাহরুদ শহরের কাছাকাছি অবস্থিত) জন্ম গ্রহণ করেছেন এবং সেখানেই তিনি হিজরী দু শত একষট্টি সনে ইহলোক ত্যাগ করেন। আজকাল তার মাযার শরীফ আধ্যাত্মিক সাধক ও শিষ্য এবং বহু ভক্তবৃন্দের মিলন কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত। তাঁর সম্পর্কে অনেক কথাই লেখা যায়। এখানে এই সংক্ষিপ্ত পরিচয় পর্বে এতটুকুই বলতে পারি যে , তিনি বহু কাল ধরে মুসলিম সমাজে ইসলামী ইরফান বা ইসলামী আধ্যাত্ববাদের মডেল হিসাবে পরিগণিত হয়ে আসছেন। কারণ মা রেফতপন্থি লোকদের মধ্যে তার খ্যাতি ও সুনাম অতুলনীয়। আর এ কারণেই মাওলানা রুমী (রহঃ) তার বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থ মসনাভীয়ে মা নাভী ’ (মাসনভী শরীফ)-তে তাকে হাকিকত ও মহত্ত্বের মডেল এবং পবিত্রতা ও সততার দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মরণ করেছেন।]

বর্ণিত আছে যে , একদিন এক ব্যক্তি হযরত বায়োজিদ বোস্তামীকে (রহঃ) কয়েকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশ্ন করেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন : আপনি এই আধ্যাত্মিক উচ্চ মাক্বামে কিভাবে এবং কোন্ পথে পৌছেছেন ?

উত্তরে হযরত বায়েজিদ বলেন : আমি শৈশবে কোন এক রাতে বোস্তাম নগরী থেকে বেরিয়ে আসি। তখন চন্দ্র আলো বিতরণ করছিল আর পৃথিবী আপন কোলে ছিল ঘুমন্ত। আমি আল্লাহর কুদরতে এমন এক জায়গা দেখতে পেলাম যেখানে আঠারো হাজার পৃথিবী তার সামনে বিন্দুর সমতুল্য মনে হচ্ছিল। তখন আমার অন্তর্জ্বালা আমাকে পীড়িত করে। আর এ কারণে সাংঘাতিকভাবে আমার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। যার ফলে আমি আধ্যাত্মিক সাধনার সুউচ্চ পর্যায়ে পৌছুতে সক্ষম হয়েছি।

সে সময় আমি বলেছিলাম : হে আমার প্রভূ! এরকম বিরাট জায়গা আর এরকম বিশাল শূন্যতা!! এরকম বিস্ময়কর ব্যবস্থাপনা আর এভাবে আমাদের কাছে রয়েছে গোপন!!! তখন অদৃশ্য থেকে ধ্বনি আসলো : আমার দরগাহর শূন্যতার কারণ এই নয় যে , এখানে কেউ আসে না। বস্তুতঃপক্ষে এর কারণ হলো যে , আমি চাই না কোন অনুপযুক্ত ব্যক্তি এখানে আসুক। ’ কেননা সে ব্যক্তি এই দরগাহর উপযুক্ত নয়।

(১০)

আল্লাহর আতিথেয়তা

কথিত আছে যে একবার এক কাফের ব্যক্তি হযরত ইব্রাহিম (আঃ)- এর নিকট একটু খাবারের আবেদন করলো। ইব্রাহিম (আঃ) বললেন : যদি তুমি মুসলমান হও তাহলে তোমাকে আমি আমার মেহমান হিসেবে গ্রহণ করতে পারি এবং পেট পুড়ে খেতে দিতে পারি। ” এ কথা শুনে কাফের লোকটি কিছু না বলে চলে গেলো। কিছুক্ষন পর আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত ইব্রাহিম(আঃ)- এর নিকট অহি আসলো :

হে ইব্রাহিম ! আমি সত্তুর বছর যাবৎ এ কাফেরকে রুজি দিচ্ছি আর তুমি যদি এক রাতে ওকে খাবার দিতে এবং তার দ্বীন সম্পর্কে প্রশ্ন না করতে তোমার কি ক্ষতি হতো ?

ইব্রাহিম(আঃ) অহির মাধ্যমে আল্লাহর বক্তব্য শুনে অত্যন্ত লজ্জিত হলেন। তিনি সে কাফের ব্যক্তির সন্ধানে ছুটে পড়লেন। অবশেষে অনেক কষ্টের পর তাকে খুজে পেলেন। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ঐ কাফেরকে পেট ভরে খাওয়ালেন। খাবার শেষে সেই কাফের লোকটি অবাক হয়ে ইব্রাহিমকে (আঃ) জিজ্ঞেস করলোঃ হে ইব্রাহিম! কি হলো যে তুমি তোমার পূর্বের বক্তব্য থেকে ফিরে এসেছো ? আর আমার জন্যে খুব সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা করেছো ? ইব্রাহিম(আঃ) কাফের লোকটিকে অহি আসার ঘটনা আদ্যপ্রান্ত সব খুলে বললেন। কাফের লোকটি ঘটনাটি শুনে হযরত ইব্রাহিমকে (আঃ) বললো : যদি তোমার প্রভু এ পরিমান দয়ালু হয়ে থাকেন তাহলে তোমার দ্বীন সম্পর্কে আমাকে অবগত করাও যেন আমিও এরকম ধর্ম গ্রহণ করে ধন্য হতে পারি। ১০

(১১)

শত্রুর সাথে যাত্রা

[জনাব ইলিয়াস ছিলেন নিশাপুরের আমির এবং প্রধান সেনাপতি। চতুর্থ শতাব্দিতে নিশাপুর পারস্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহত্তম নগরী হিসেবে পরিগণিত ছিল। সেকালে এই শহরের প্রধান সেনাপতির পদটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক।]

একদিন জনাব ইলিয়াস হযরত আবু আলী দাক্কাক নামে এক স্বদেশী অলীর খেদমতে উপস্থিত হলেন। তিনি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক হাটু গেড়ে সেই দরবেশের সমনে বসে পড়লেন। অতঃপর তিনি হযরত আলী দাক্কাকের কাছে কিছু উপদেশমূলক নসিহত পেশ করার জন্যে অনুরোধ জানালেন। জনাব ইলিয়াসের অনুরোধে আল্লাহর অলী বলেন :

আমি তোমাকে উপদেশ দিবো না। তবে আমি তোমার কাছে একটি প্রশ্নের উত্তর আশা করবো। আশা করি তুমি তার সঠিক উত্তর দান করবে। ”

সেনাপতি : ঠিক আছে আপনি জিজ্ঞেস করুন হুজুর। আমি উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবো। ” হযরত দাক্কান ইলিয়াসের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলেন : আমি জানতে চাই , তুমি ধন-দৌলতকে বেশী ভালবাস নাকি তোমার শত্রুকে ?

সেনাপতি ইলিয়াস এই প্রশ্ন শুনে বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেলেন। কিছুক্ষন চুপ থেকে চিন্তা করে তিনি উত্তর দিলেন : ধন-দৌলতকে আমি বেশী পছন্দ করি। হযরত আবু আলী কিছুক্ষন আত্মমগ্ন অবস্থায় কাটালেন। অতঃপর মাথা তুলে বললেন : আচ্ছা! যদি এরকমই হয় যা তুমি বললে , তাহলে কেন তোমার পছন্দনীয় জিনিষকে তুমি এখানে ছেড়ে যাচ্ছো। কেন তুমি সেগুলোকে নিয়ে যাচ্ছো না। আর যা তুমি পছন্দ কর না এবং যে তোমার শত্রু তাকেই সাথে নিয়ে যাচ্ছো ? দরবেশের এই কথা শুনে সেনাপতির টনক নড়লো। তার চক্ষুযুগল অশ্রুতে ভরে গেল। কিছুক্ষন এভাবেই অতিবাহিত হল। যখন তার স্বম্বিত ফিরে এলো তখন তিনি দরবেশেকে বললেন :

আমাকে ভাল উপদেশ দিলেন। আমাকে তন্দ্রা থেকে জাগ্রত করলেন। আল্লাহ আপনাকে উত্তম পুরস্কার দান করুন , আপনি আমাকে হেদায়েতের পথ দেখালেন। ১১

(১২)

কোথাও খুজে পাবেনা আমাকে

অবশেষে গ্রীসের প্রাচীন দার্শনিক সক্রেটিসের জন্যে মৃত্যুদন্ডের রায় ঘোষনা করা হলো। তিনি মৃত্যুর পথযাত্রী। দিনক্ষন গুণছেন কখন তার মৃত্যুদন্ড কার্যকরী হবে। এ সময়গুলোতে ভক্তবৃন্দরা তার চতুষ্পার্শ্বে জমায়েত হয়েছেন।

অনেকে তাকে বলছেনঃ হে মহান দার্শনিক! আপনি আপনার বিশ্বাস থেকে ফিরে আসুন। এতে করে আদালত আপনার মৃত্যুদন্ডের রায় কার্যকর করতে পারবে না। ” আবার অনেকে বলেন : হে মহান! আপনি ফাঁসি থেকে মুক্তির জন্যে আপনার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কিছু বক্তব্য দিন। যখন আপনার ফাঁসির রায় বাতিল করা হবে তখন আবার আপনি আপনার পূর্ব বিশ্বাসে ফিরে যাবেন। কিন্তু দার্শনিক অনড় , অবিচল। তিনি কোন কিছুতেই তার বিশ্বাস থেকে চুল পরিমানও পিছু হটতে রাজি নন।

তিনি বলেন :‘‘ আমি যে সত্য বুঝেছি তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমি মৃত্যুকে বরণ করতে পারি কিন্তু আমার বিশ্বাস থেকে পিছিয়ে আসতে পারি না। আমি আমার নিজের মুক্তির জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারি না।

যখন তার ভক্ত মুরীদরা দেখলেন কোন কিছুতেই তাকে মৃত্যুদন্ড থেকে বাঁচানো গেল না তখন তারা কাঁদতে লাগলেন। তাদের মধ্যে একজন অশ্রুভেজা চোখ নিয়ে এ শিক্ষককে বললেন : এখন যেহেতু আপনাকে ফাঁসি থেকে রেহাই দেয়া গেল না সেহেতু আপনি আমাদের বলে দিন আপনার মৃত্যুর পর আমরা আপনাকে কোথায় এবং কিভাবে সমাহিত করবো ?

ভক্তদের প্রশ্নের উত্তরে দার্শনিক সক্রেটিস বলেন : আমার মৃত্যুর পর যদি তোমরা আমার নাগাল পাও তাহলে যা মন চায় তাই করো। ” শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারলেন ওস্তাদ জীবনের অন্তিম মুহুর্তেও তাদেরকে মা রেফাত শিক্ষা দিচ্ছেন। তারা উপলব্ধি করলেন যে , মানুষের মৃত্যুর পর যা অবশিষ্ঠ থেকে যায় তা সে নিজে নয় বরং কিছু হাড্ডি-মাংশ বিশিষ্ট একটি মরদেহ -যা দ্রুত দাফন না করলে দূগর্ন্ধ ছড়াতে থাকবে। এ মর দেহ এ জগতেই ছেড়ে যেতে হয়।

সক্রেটিস তাদেরকে এ শিক্ষাই দিলেন যে , মানুষ মৃত্যুর পর এমন স্থানে গমন করে যেখানে জীবিত মানুষেরা পৌঁছুতে পারে না। মানুষের কাছ থেকে যা অবশিষ্ট রয়ে যায় তা তো শুধুমাত্র প্রাণহীন একটি মরদেহ। আর এটা সেই মানুষের (মৃত ব্যক্তির) সাথে কোন সম্পর্ক রাখে না। এ কারণে তিনি তার শিক্ষার্থীদের বলেনঃ যদি তোমরা আমাকে নাগালে পাও তাহলে যা খুশি করো। অর্থাৎ আমার নাগাল পাবে না। ১২

(১৩)

বাদশাহীর মূল্য

[হযরত শাক্বিক বালখী (রহঃ) হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দি ও আব্বাসীয় শাষক হারুন-আর-রাশীদের সমসাময়িক কালের একজন স্বনামধন্য সুফী ও আরেফ ছিলেন। তার শিষ্যদের জন্যে তার সবচে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ছিল তাওয়াক্কুল (আল্লাহর উপর ভরসা) । ]

কথিত আছে যে , একদিন হযরত শাক্বিক (রহঃ) হজ্বব্রত পালনের উদ্দেশ্যে বলখ থেকে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে তিনি বাগদাদে যাত্রবিরতি করেন। বাদশাহ্ হারুন-আর-রাশিদ তাকে দরবারে ডেকে আনলেন। যখন শাক্বিক বালখী (রহঃ) বাদশাহর নিকট পৌঁছালেন তখন বাদশাহ্ হারুন- আর-রাশিদ জিজ্ঞেস করেনঃ তুমিই কি সেই শাক্বিক যাহেদ (দুনিয়াত্যাগী) ?

দরবেশ উত্তর দিলেন : হ্যাঁ , আমি শাক্বিক। কিন্তু যাহেদ নই। ”

বাদশাহ্ : আমাকে উপদেশ দাও। ”

দরবেশ : যদি তুমি উত্তপ্ত মরুভূমিতে পিপাসার্ত হও আর সে কারণে তুমি বাধ্য হও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে , তখন সেই মুহূর্তে যদি কেউ তোমার সামনে পানি এনে উপস্থিত হয় , সে পানি তুমি কত দিনারে কিনবে ?

বাদশাহ্ : বিক্রেতা যে পরিমান অর্থে সন্তুষ্ট হয়। ”

দরবেশ : যদি তোমার বাদশাহীর অর্ধেক ছাড়া সন্তুষ্ট না হয় তখন কি করবে ?

বাদশাহ্ : বাদশাহীর অর্ধাংশ তাকে দিয়ে দেবো। বিনিময়ে তার কাছ থেকে পানি নিয়ে তা দিয়ে মরুভূমিতে আমার প্রাণ রক্ষা করবো। ”

দরবেশ : যদি তাতেও তোমার তৃষ্ণা নিবারণ না হয় তখন তুমি কি করবে ?

বাদশাহ্ : আমার দেশের সকল চিকিৎসকদের ডেকে এনে চিকিৎসা করাবো। ”

দরবেশ : কিন্তু তাতেও যদি কোন কাজ না হয় ? শুধুমাত্র একজন চিকিৎসক তোমার অর্ধ বাদশাহীর বিনিময়ে তোমাকে আরোগ্য দান করতে ইচ্ছুক হয় তখন কি করবে ?

বাদশাহ্ : মৃত্যু থেকে পরিত্রানের জন্যে তার চিকিৎসা বাবদ অর্ধ বাদশাহী দিতে রাজী আছি। ”

দরবেশ : হে হারুন! কিসের জন্যে এতসব বড়াই! যে বাদশাহীর মূল্য এক ঢোক পানি -যা পান করার পর পুনরায় বাইরে নির্গত হয়ে যায় ? একথা শুনে বাদশাহ্ হারুন-আর-রাশিদ মাথা নত করে রইলেন।১৩

(১৪)

উট বাড়ীর ছাদে

[হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দির একজন নামকরা ইসলামী আরেফ ও আল্লাহর অলী এবং খ্যাতনামা দরবেশ হযরত ইব্রাহিম আদহাম। তাঁর সমন্ধে লেখা আছে যে , তিনি যৌবনকালে বলখ ’ রাজ্যের শাসনকর্তা ছিলেন এবং তখন তার শান-শওকত ও মর্যাদার কোন কমতি ছিল না। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি এ জগতের সকল কিছু ছেড়ে দরবেশের পথ ধরেন। তিনি যোহ্দ্ ও ইরফানের রাজ্যে বিচরণের শুরুতেই দুনিয়ার সকল কিছু ত্যাগ করেন। তার এই পরিবর্তনের সঠিক ও সুষ্পষ্ট কারণ আজ অবধি কেউ অবগত হতে পারেনি। তবে শেখ ফরিদউদ্দিন আত্তারে নিশাবুরী ’ -একজন স্বনামধন্য ইরানী সাধক ও অলী-দরবেশ-তার তাজিরাতুল আউলিয়া ’ -কিতাবে ইব্রাহিম আদহামের ব্যাপারে দু টি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। যার দু টিই পৃ থকভাবে আল্লাহর এই অলীর মানসিক ও রুহানী অবস্থার পরিবর্তনের কারণ হিসাবে উলেখ করা যেতে পারে।]

বাদশাহীর আমলে এক রাতে ইব্রাহিম আদহাম পালংঙ্ক বিছিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। হঠাৎ তার প্রাসাদের ছাদের উপর থেকে একটি শব্দ শুনতে পেলেন। দ্রুত বিছানা ছেড়ে প্রাসাদের ছাদে চলে গেলেন। ছাদে গিয়ে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। তিনি দেখলেন একজন সাধা-সিধে মধ্যবয়সী লোক তার ছাদে পায়চারী করছে।

ইব্রাহীম আদহাম জিজ্ঞেস করেন : তুমি কে ?

লোকটি উত্তর দিল : জাহাঁপনা! আমি উট হারিয়ে এখানে আপনার ছাদে তাকে খুজছি। ” ইব্রাহীম বললেন : নির্বোধ! কেউ উট ছাদের উপরে খোজে নাকি ? উটের কি পাখা আছে যে তা উড়ে এসে আমার ছাদে বসে থাকবে ? উট এখানে কি করে আসবে ?

লোকটি সাদা-মাটা উত্তর দিল : হ্যাঁ , জাহাঁপনা! ছাদের উপর উটের খোজ নেয়া একটি আশ্চর্য ও অবাক ব্যাপার। আর তার চেয়ে অনেক বেশী বিস্ময়কর হচ্ছে আপনার কাজ। আপনি কি করে সোনালী সিংহাসনে ও চকচকে রেশমী পোশাকে আল্লাহকে সন্ধান করছেন ? লোকটির এ কথায় ইব্রাহীম আদহামের অন্তরে ঢেউ খেলে গেল।

তার এ ছোট্ট অথচ অর্থপূর্ণ কথা হযরত ইব্রাহীমের উপর এমন প্রভাব বিস্তার করলো যে , তৎক্ষনাৎ তিনি দুনিয়ার সব অর্থ-সম্পদ থেকে নিজের মনকে মুক্ত করে খোলা মরুভূমির পথে যাত্রা শুরু করেন। সেখানে তিনি তার একজন দাসের সাক্ষাৎ লাভ করেন। তখন তার দাস তারই ভেড়ার পাল দেখাশুনা করছিল। তিনি সেখানেই তার অতি সুন্দর ও মহামূল্যবান পোশাক দাসকে দিয়ে নিজে দাসের গায়ের রাখালি পোশাক পড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান।১৪

(১৫)

সরাইখানা

একবার বাদশাহ্ ইব্রাহিম আদহাম দেশের সকল গণ্যমান্য লোকজন , মন্ত্রিবর্গ , উপদেষ্টা পরিষদ ও দাস-দাসী এবং সকল পাইকপিয়াদাকে রাজদরবারে আহ্বান করলেন। রাজার গোলামরা সারিবদ্ধভাবে বুকে হাত রেখে বিনয়ের সাথে দাড়িয়ে আছে। অতিথিবৃন্দ সকলে বলখের মহামান্য বাদশাহর সামনে অবনত মস্তকে দন্ডায়মান। হাঠাৎ একজন অপরিচিত ব্যক্তি কারো কাছে অনুমতি না নিয়েই দরবারে প্রবেশ করলো। ঐ ব্যক্তির ভাব গম্ভিরতা দেখে কারো প্রশ্ন করার সাহস হ য়নি যে , আপনি কে ? এখানে আপনার কি কাজ ? লোকটি সোজা গিয়ে বাদশাহর সামনে উপস্থিত।

বাদশাহ্ ইব্রাহীম চিৎকার দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন : তুমি কি জন্য এখানে এসেছো ? আগন্তুক : এটা হচ্ছে সরাইখানা আর আমি মুসাফির। সরাইখানা মুসাফিরদের জন্যে বিশ্রামের জায়গা। আমি এখানে এসেছি সামান্য বিশ্রাম নেয়ার জন্যে। ”

বাদশাহ্ ইব্রাহীম রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। তিনি বলেনঃ এটা সরাইখানা নয়। এটা আমার রাজপ্রাসাদ। ” লোকটি বললো : এই বাসস্থান তোমার পূর্বে কার বাড়ী ছিল ? ইব্রাহীম : অমুক ব্যক্তির আগন্তুক : তার পূর্বে এই বাড়ীর মালিক কে ছিল ? ইব্রাহীম : অমুক ব্যক্তির বাবা। ” আগন্তুক : এই যারা এই বাড়ীর মালিক ছিল তারা এখন কোথায় ? বাদশাহ্ : তারা সকলে মারা গেছে আর এটা এখন আমাদের হস্তগত হয়েছে। ” আগন্তুক : যে বাড়ী প্রতিদিন একেক জনের বাসস্থান , যে বাড়ীতে তোমার পূর্বে অন্যেরা এখানে বসবাস করেছে আর তোমার পরে আরো কত লোক এখানে বসবাস করবে -তা সত্যিকার অর্থে সরাইখানা। কেননা প্রতিদিন , প্রতিটি মুহূর্তে এটা একেক জনের বাসস্থান। ”

বাদশাহ্ ইব্রাহীম লোকটির কথা শুনে চিন্তামগ্ন হয়ে গেলেন। তিনি জানতে পারলেন যে প্রতিপালক তাকে এই বাড়ী অথবা অন্য বাড়ীর জন্য সৃষ্টি করেননি। তাকে অবশ্যই আখেরাতের বাসস্থানের চিন্তা করা উচিত , কেননা সেটা যে চিরস্থায়ী আবাসস্থল।১৫

(১৬)

নামাজে ঘোড়াকে জলপান

[আবু হামিদ মুহাম্মাদ গাজ্জালী হিজরী পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দির একজন বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ। হিজরী ৪৫০ সনে তিনি ইরানের তুস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন আর ৫৫ বছরে তিনি ইসলামী জগতে একচ্ছত্র সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পঞ্চান্ন বৎসর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইমাম মুহাম্মাদ গাজ্জালীর জীবন ঘিরে ছিল বহুল অলোচিত বিভিন্ন ঘটনাবলী , ভ্রমন , জ্ঞানগর্ভ বিতর্ক ও আলোচনার বাহার। তার এক ভাই ছিল , যিনি ইরফান ও আধ্যাত্মিকতার কারনে জগতে সুনাম অর্জন করেছিলেন। তিনি ইরানের শহর-বন্দর ও গ্রাম-গঞ্জে ঘুরে বেড়াতেন আর জনগণকে আখেরাতের বার্তা শোনাতেন। তার নাম ছিল আহমাদ ’ অর্থাৎ আহমাদ গাজ্জালী। বয়সে ইমাম মুহাম্মাদ গাজ্জালীর কয়েক বছর ছোট। মুহাম্মাদ ও আহমাদ উভয়েই সাধনার জগতে অনেক উচ্চ পর্যায়ে পৌছে ছিলেন। মুহাম্মাদ জ্ঞানের জগতে ছিলেন সর্বাগ্রে আর আহমাদ ছিলেন ইরফান ও আধ্যাত্মিকতায় তারও উপরে। ইমাম মুহাম্মাদ গাজ্জালী তার জ্ঞান ও দক্ষতার কারণে তৎকালীন সালজুক্বী রাজবংশের বাদশাহর যোগ্য মন্ত্রী এবং নিজামিয়্যা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের প্রতিষ্ঠাতা খাজা নিজামুল মুলক তুসীর পক্ষ থেকে ইসলামী বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাগদাদের নিজামিয়ার চ্যান্সেলার পদে নিযুক্ত হন। তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে জামায়েতের নামাজ ইক্বামা করতেন। সেই জামায়েতে অংশগ্রহণ করতেন দূর-দূরান্ত থেকে আগত বহু আলেম-দরবেশ , জ্ঞানী-গুনী , আরেফ-অলী এবং ছাত্র-শিক্ষক।]

একবার ইমাম মুহাম্মাদ গাজ্জালী তার সহোদর ভাই আহমাদকে বলেন : এতসব জ্ঞানী-গুনী ও বিদ্বান ব্যক্তিরা নিকট ও দূর থেকে এখানে আগমন করেন আমার ইমামতিতে এই জামায়েতে শরীক হওয়ার জন্যে। আর তুমি আমার পাশে থেকে এবং ভাই হয়েও এই জামায়েতে অংশগ্রহণ করো না। ” উত্তরে আহমাদ তার বয়োজ্যেষ্ঠ ভাইকে বলেন : আচ্ছা ভাই , ঠিক আছে! এখন থেকে আমি আপনার সাথে নামাজে অংশগ্রহণ করবো। ”

একদিন মুয়াজ্জিনের আজানের মাধ্যমে জামায়াতের কথা ঘোষনা করা হলো। তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্বান ব্যক্তি ইমাম মুহাম্মাদ গাজ্জালী নামাজে ইমামতির জন্যে তাকবীর ধ্বনি দিয়ে দন্ডায়মান হলেন। ছোট ভাই আহমাদও অন্যদের সঙ্গে ইমাম মুহাম্মাদ গাজ্জালীর পিছনে জামায়েতে শরীক হলেন। এখনও ইমামের অর্ধেক নামাজ সমাপ্ত হয়নি এমতাবস্থায় আহমাদ তার নামাজ সংক্ষিপ্ত করে মসজিদ থেকে বের হয়ে গেলেন। তিনি অনত্র গিয়ে বাকী নামাজ সমাপ্ত করলেন। ইমাম মুহাম্মাদ গাজ্জালী নামাজ শেষে বুঝতে পারলেন তার ভাই জামায়েতের নামাজকে একাকী নামাজে রূপান্তরিত করেছেন। তাই ছোট ভাইকে খোজ করে যখন পেলেন অত্যন্ত রাগান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন : এটা কি কাজ করলে ? আহমাদ : ভাই মুহাম্মাদ! আপনি কি চান আমি শরিয়তের পথ থেকে দূরে সরে দাড়াই আর আপন দ্বীনি কর্তব্য পালনে ক্রটি করি ? ইমাম মুহাম্মাদ : না , এটা আমি পছন্দ করি না। ” আহমাদ : আপনি যখন নামাজ আরম্ভ করেছিলেন আমি আপনার পিছনে ইক্বতিদা করেছিলাম আর ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার পিছনে নামাজ অব্যাহত রেখেছিলাম যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি নামাজে ছিলেন। ” ইমাম : আমি কি নামাজের বাইরে চলে গিয়েছিলাম ? আহমাদ : হ্যাঁ! আপনি নামাজের মধ্যভাগে নামাজ থেকে বাইরে চলে গিয়েছিলেন এবং কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ” ইমাম : কিন্ত আমি তো শেষ পর্যন্ত নামাজের মধ্যেই ছিলাম। ” আহমাদ : না ভাই! নামাজের মাঝখানে আপনার ঘোড়ার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। আরো স্মরণ হয়েছিল যে , আপনি ঘোড়াকে পানি পান করাতে ভুলে গিয়েছেন। যখন আমি দেখলাম আপনার চিন্তা ও অন্তর আল্লাহর দিক থেকে ঘুরে ঘোড়ার দিকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তখন আমি কর্তব্য মনে করেছি যে , এই নামাজ ত্যাগ করে অনত্র গিয়ে নামাজ আদায় করি। কেননা তখন আপনি নামাজের মধ্যে ছিলেন না। আর মুস ল্লীর এমন কারোর পিছনে ইক্বতেদা করা উচিৎ যিনি নামাজে মধ্যে মশগুল থাকেন। ”

ইমাম মুহাম্মাদ গাজ্জালী রাগ দমন করে লজ্জায় মস্তক অবনত করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে , তার ভাই তার অন্তরের অবস্থা সম্পর্কে অবগত। অতঃপর তিনি তার আশপাশের লোকজনদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন : আমার ভাই আহমাদ সত্য বলেছে। নামাজের মাঝখানে আমার স্মরণ হয়েছিল যে , আমি আমার ঘোড়াকে পানি দিতে ভুলে গিয়েছি। ১৬

(১৭)

দুনিয়ার প্রেম বনাম আসমানী প্রেম

[বিশর ইবনে হারিস -যিনি বিশর হাফি ’ নামে বিখ্যাত -হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর একজন খ্যাতনাম্য আল্লাহর অলী ছিলেন। তিনি ছিলেন পারস্যের মারভ্ শহরের অধিবাসী যা আজকে তুরকামানিস্থানে অবস্থিত। তবে তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় বাগদাদে কাটিয়েছেন। অতঃপর এই বাগদাদেই তিনি সমাহিত হন। কথিত যে তিনি তার জীবনের প্র থম ভাগে পাপ ও আরাম-আয়েশে অতিবাহিত করেছেন। তবে অকস্মাৎ তিনি যোহ্দ্ ও পারহেজগারীতা এবং অধ্যাত্মিকতায় মনোনিবেশ করেন। তাকে হাফি ’ বলা হয় এ জন্যে যে তিনি সর্বদা নগ্নপায়ে ঘুরে বেড়াতেন। তার কাছ থেকে অনেক ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। নিম্নোক্ত বর্ণনাটি সেগুলোর একটি।]

হযরত বিশর হাফী বলেন : একবার আমি বাগদাদের বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। ঘটনাক্রমে সেখানে একজন ব্যক্তিকে বেত্রাঘাত করা হচ্ছিল। আমি অবাক হয়ে ঘটনাটি দেখছিলাম। আমি দেখতে পেলাম লোকটি বেত্রাঘাত খাচ্ছিল কিন্তু কোন আর্তনাদ ও ফরিয়াদ করছিল না। চাবুকের আঘাতের পর লোকটিকে কারাগারের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আমি উৎসুক চিত্তে ব্যাপারটি জানার জন্যে আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম : তুমি কোন আপরাধে চাবুকের প্রহার ভোগ করলে ? লোকটি বলো : প্রেমের বিনিময় এরকমই। ’ বল্লাম : কেন তুমি কোন ক্রন্দন করোনি ? যদি ক্রন্দন ও আর্তনাদ করতে তাহলে বেত্রাঘাতের পরিত্রান পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ’ লোকটি বলো : উপস্থিত জনগণের মাঝে আমার মা শুক অবস্থান করছিলো। সে আমাকে দেখছিলো আর আমিও তার দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করেছিলাম। প্রেমের পথে ক্রন্দন ও আর্তনাদের স্থান নেই। ’ ব ললাম : যদি তুমি দু চক্ষু উন্মোচন করে আসমানী মা শুকের দিকে দৃষ্টি প্রদান করতে তাহলে তোমার অবস্থা কেমন হতো ? আহত লোকটি এ কথাটির অন্তর্নিহিত ভাব উপলব্ধি করে আকাশ ফাটা চিৎকার দিয়ে সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।১৭

(১৮)

হালুয়ার কত মূল্য ?

হযরত শিবলী (রহঃ) একদিন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত দেহকে বিশ্রাম দেয়ার জন্য ম সজিদে প্রবেশ করলেন। অযু করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে মসজিদের এক কোণে মসজিদের দেয়ালে হেলান দিলেন তিনি। এত ক্লান্তির মধ্যেও তার চক্ষু বন্ধ হচ্ছিল না। তিনি অবাক হয়ে দেখছেন মসজিদের অভ্যন্তরে সদ্য মুক্ত ছাত্রদের দৌড়া-দৌড়ি। তারা তাদের ক্লাশ শেষ করে টিফিনের সময় কাটাচ্ছে। দুটি শিশু হযরত শিবলী (রহঃ)-র নিকট আসন পেতে বসলো। তারা তাদের আপন আপন খাবারের থলে উন্মুক্ত করলো। এদের একজন পোশাক ও পরিচ্ছদে পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি ছিলো। দেখেই স্পষ্ট বুঝা যাবে যে , এটি কোন ধনী পরিবারের সন্তান। ওর থলেতে ছিলো একটি রুটি ও কিছু হালুয়া। আর অন্য শিশুটির থলেতে ছিল শুধু একটি শুকনো রুটি। গরীব ছেলেটি ধনী ছেলেটির থলেতে অসহায় ভাবে তাকালো। গরীব ছেলেটি দেখতে পেলো ধনী ছেলেটি কত মজা করে রুটির সাথে হালুয়া খাচ্ছে। একটি ঢোক গিললো সে। গরীব ছেলেটি অবশেষে লোভ সামলাতে না পেরে বলেই ফেললোঃ এই ছেলে , আমার শুধু একটি শুকনো রুটি , তুমি কি আমাকে একটু হালুয়া দিতে পারবে ? ধনী ছেলেটি উত্তর দিলো : না , দিবো না। ’ গরীব ছেলে : কিন্তু এই শুকনো রুটি যে হালুয়া ছাড়া আমার গলায় প্রবেশ করবে না! ধনী ছেলে : যদি এই হালুয়া থেকে একটু তোমাকে দেই তাহলে কি তুমি আমার কুকুর হতে পারবে ? গরীব ছেলে : জী-হ্যাঁ পারবো। ” ধনী ছেলে : তাহলে তুমি এখন আমার পোষ্য কুকুর। ” গরীব ছেলে : হ্যাঁ , ঠিক বলেছো। ” ধনী ছেলে : তাহলে কেন কুকুরের মতো শব্দ করছো না ? বেচারা গরীব ছেলেটি নিরুপায় হয়ে কুকুরের ডাক দিতে লাগলো আর ধনী ছেলেটি একটু একটু করে হালুয়া দান করতে থাকলো। এভাবে তাদের হালুয়া রুটি খাওয়া শেষ হলো।

হযরত শিবলী (রহঃ) এতক্ষন যাবত ঘটনাটি লক্ষ্য করছিলেন আর কাঁদছিলেন। তার ভক্তবৃন্দরা তাকে মসজিদে পেয়ে তার পাশে বসলেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন : দেখ! লোভ মানুষের জন্যে কি সর্বনাশা পরিণাম ডেকে আনে। যদি এ গরীব শিশুটি ওর নিজের শুকনো রুটিতেই সন্তুষ্ট থাকতো আর অন্যের হালুয়ার প্রতি লোভ না করতো তাহলে কুকুরের ন্যায় অন্যের গোলামী করতে হতো না। ১৮

(১৯)

একটি লুঙ্গি ও একটি বা লতি

[হযরত আবু সাইদ আবুল খাইর (রহঃ) হিজরী চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দির স্বনামধন্য ও সর্বময় খ্যাত একজন আল্লাহর আরেফ ও সাধক ছিলেন। তিনি হিজরী ৩৫৭ সনে মাইহানাহ নামক স্থানে জন্ম গ্রহণ করেন। দৃশ্যত: সর্বপ্র থম তিনিই ইরফানি চিন্তাধারাকে কাব্যের পোশাক পরিধান করিয়েছেন। তাঁর দৌহিত্র মুহাম্মাদ বিন মুনওয়ার ষষ্ঠ হিজরীতে আসরারুত্ তাওহীদ ’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। উক্ত গ্রন্থটিতে হযরত আবু সাইদ আবুল খাইর (রহঃ)-এর আধ্যাত্মিক অবস্থান বা মাক্বমাতের বর্ণনা পাওয়া যায়। তার বর্ণিত ক্ষুদ্র ও ছোট বাক্য এবং সুন্দর সুন্দর ঘটনাবলী সুপ্রসিদ্ধ হয়ে আছে। নিম্নের ঘটনাটি তাঁর প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে।]

একদা আবু মুহাম্মাদ জুভাইনী নামে শেইখের দীর্ঘকালীন ও পুরানো এক বন্ধু ও ছাত্র তাঁর সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে তাঁর বাড়িতে আগমন করেন। বাড়ির লোকজন তাকে বল্লেন যে তিনি হাম্মামখানাতে (গণ গোসলখানা) গিয়েছেন। আবু মুহাম্মাদ জুভাইনী কোন কথা না বলেই সোজা হাম্মামের দিকে ছুটলেন। অবশেষে তিনি হাম্মামের ভিতরে তাঁকে খুজে পেলেন। তারা দু জনে সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করলেন।

এক পর্যায়ে শেইখ আবুল খাইর (রহঃ) আবু মুহাম্মাদ জুভাইনীকে বলেন : তোমার মতে এই হাম্মামখানা কি কোন ভাল ও পছন্দনীয় জায়গা ? উত্তরে আবু মুহাম্মাদ বললেন : জি , হ্যাঁ। শেইখ আবারো প্রশ্ন করেন : কেন ? আবু মুহাম্মাদ বলেন : কারণ জনাব শেইখ এখানে আছেন। আর যেখানেই আমাদের শেইখ , আবুল খাইর আছেন সেখানটাই একটি ভাল জায়গা। এর চেয়ে কোন ভাল যুক্তি আনো। ” শেইখ বল্লেন। আবু মুহাম্মাদ হযরতের কাছে অনুরোধ করলেন যে , তিনি যেন এই হাম্মামখানার জায়গাটা কেন ভাল ও পছন্দনীয় তার কারণ বলে দেন। শেইখ বললেন : হ্যাঁ , এটা ভালো জায়গা , কেননা এখানে তোমার সাথে একটি লুঙ্গি ও একটি বাল্তি ছাড়া আর কিছু নেই , আর এ দু টোও আমানত স্বরূপ নেয়া হয়েছে। ১৯

(২০)

হাক্বিক্বাতের মূল্য

হযরত আলামা শিবলী (রহঃ) হযরত যুনাঈদ বাগদাদী-র (রহঃ) কাছে গিয়ে বলেন : মানুষ বলে , হাক্বিক্বাতের রত্ন আপনার কাছে আছে। ওটাকে হয় আপনি আমার কাছে বিক্রি করুন নতুবা আমাকে দান করে দিন। ”

হযরত যুনাঈদ (রহঃ) উত্তরে বলেন : যদি তোমার কাছে বিক্রি করতে চাই তাহলে তুমি তার মূল্য পরিশোধ করতে পারবে না। আর যদি ওটাকে দান করতে চাই তাহলে তুমি তার মূল্য বুঝতে পারবে না। কেননা যে তাকে স্বল্প মূল্যে খরিদ করে সে সস্তায় হাতছাড়া করে , আর দেখ না শিশুরা মূল্যবান রত্ন এক টুকরো রুটির বদলে দিয়ে দেয়। ”

হযরত শিবলী (রহঃ) বলেন : তাহলে আমার কর্তব্য কী ? ধৈর্য ও প্রতিক্ষার মাক্বামে অবস্থান গ্রহণ কর আর এই ব্যথায় জ্বলে নিজেকে তৈরী করো যেন তা অর্জনের যোগ্যতা লাভ করতে পারো। কেননা , এরকম মহামূল্যবান রত্ন যোগ্য ও সত্যবাদী প্রতীক্ষমাণ ও অন্তরক্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যতীত অন্যদের দেয়া হয় না। ” বললেন হযরত যুনাঈদ বাগদাদী (রহঃ) ।২০

(২১)

বৃদ্ধ বাদক

তিনি মিম্বার থেকে নেমে আসলেন আর জনতা ধীরে ধীরে সভা ত্যাগ করছিলো। শেইখ আবু সাইদ আবুল খাইর আজ রাতে কি উদ্দীপনা সৃষ্টি করলেন ? উপস্থিত জনতা সকলে তাঁর বক্তব্যের মুগ্ধতায় নিজেদের হারিয়ে ফেলেছিল। তিনি তাঁর প্রতিটি বাক্য উচ্চারণে জনতার অন্তরে উদ্দীপনার চারাগাছ বপন করে যাচ্ছিলেন।

আর আমি তখনো আমার ঋণ পরিশোধের চিন্তায় মগ্ন ছিলাম। ঋণের বোঝা আমাকে ধুকে ধুকে খাচ্ছিল। কি করবো , কিভাবে আমার ঋণ পরিশোধ করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তিনি নিশ্চয়ই আমাকে সাহায্য করবেন। শেইখ এক কোনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আর মানুষ তাঁকে ঘিরে রেখেছিল। অকস্মাৎ একজন বৃদ্ধা সামনে এগিয়ে আসলো। শেইখ আমাকে ইশারা করলেন। আমি বুঝতে পারলাম আমাকে বৃদ্ধার কাছে যেয়ে তার হাজত ও অভিপ্রায় জেনে নিতে হবে। বৃদ্ধা বললেন : একশত দিনারের একটি স্বর্ণমূদ্রার থলে নিয়ে এসেছি শেইখকে দেয়ার জন্যে যেন তিনি তা অভাবী লোকদের মাঝে বিতরণ করতে পারেন। তাকে বলবেন আমার জন্যে দোয়া করতে। ” আমি তার কাছ থেকে স্বর্ণমূদ্রার থলেটি নিয়ে শেইখের হাতে তুলে দিলাম। আমি মনে মনে ভাবলাম শেইখ নিশ্চয়ই আমার অভাবের কথা জানতে পেরেছেন এবং এই থলেটি আমাকে দান করবেন। কিন্তু শেইখ আবু সাইদ আবুল খাইর (রহঃ) বল্লেন : এ থলেটি শহরের গোরস্থানে নিয়ে যাও। সেখানে একজন বৃদ্ধ পড়ে আছে। আমাদের সালাম তার কাছে পৌছিয়ে এ স্বর্ণমূদ্রার থলেটা তাকে দিয়ে দেবে। আর বলবে -যদি তুমি চাও আমাদের কাছে আ সতে পারো , তোমাকে আরো অর্থ দান করবো। ”

সেই রাতেই কবরস্থানে পৌছে গেলাম। পথিমধ্যে নিজে নিজে ভাবছিলাম যে , এ লোকটি কে , যার অবস্থার কথা হযরত শেইখ জানেন। আর আমার প্রয়োজনের কথা জানেন না এবং তা মেটানোর কোন প্রচেষ্টাও করেন না। যখন শেইখের দেয়া ঠিকানা মত কবরস্থানের সেই স্থানে পৌছালাম দেখতে পেলাম একজন বৃদ্ধলোক বাদ্যযন্ত্র মাথার নিচে রেখে ঘুমিয়ে আছে। তাকে আমি সালাম দিলাম আর শেইখের সালামও তার কাছে পৌছালাম। তবে সে আমাকে দেখে প্রচন্ডভাবে ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে পড়েছিল। ভয় তাকে অক্টোপাশের মতো ঘিরে ধরলো। তিনি চাচ্ছিলেন আমার পরিচয় জানতে। কিন্তু তার আগেই আমি স্বর্ণমূদ্রার থলেটা তার হাতে রাখলাম। অতঃপর শেইখের পয়গাম তার কাছে পৌছালাম। বৃদ্ধ তখনো হতবাক ও ভীতসন্ত্রস্থ অবস্থায় কাটাচ্ছিল। সে থলেটি খুলে বিস্ময়ের সাথে স্বর্ণমূদ্রা দেখে নিলো। প্র থমতঃ বিশ্বাসই করতে পারছিলো না। মনে করছিলো সে কোন স্বপ্ন দেখছে। তবে যখন স্বর্ণমূদ্রা হাতে ধরে সত্যি বলে অনুভব করলো , তখন তার বিস্ময় কেটে গেলো। সে বুঝতে পারলো এটা কোন স্বপ্ন নয় বরং বিশ্বাসযোগ্য বাস্তাবতা। সেই বৃদ্ধ লোকটি এবার আস্তে আস্তে মাথা উচু করে আমার দিকে তাকালো। অতঃপর বললো : আমাকে তোমার শেইখের কাছে নিয়ে চলো। ”

বল্লাম : চল! তোমাকে নিয়ে যাই। ” যাত্রা পথেও বিস্মিত ও মানসিকভাবে অস্থির ছিল বৃদ্ধ লোকটি। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম : আমি যদি তোমার কাছে একটি প্রশ্ন করি তুমি কি তার উত্তর দেবে ? বৃদ্ধ লোকটি মাথা নিচু করে সম্মতি দিলো। আমি বলাম : তোমার পরিচয় কি ? গোরস্থানে তুমি কি করছিলে ? আর হযরত শেইখ এই স্বর্ণমূদ্রার থলেটা কেন তোমাকে দিলেন ? বৃদ্ধ হাই তুলে খুব দুঃখের সাথে ব লল : আমি একজন দুঃস্থ ফকির মানুষ এবং সকলের কাছ থেকে বিতাড়িত। আমার পেশা বাদ্য-যন্ত্র বাজানো। যখন আমি যুবক ছিলাম তখন লোকজন আমাকে তাদের সভা-সমাবেশে গান ও বাদ্য-বাজনা দিয়ে আনন্দ দেয়ার জন্যে ডাকতো। শহরের সব জায়গায় ছিলো আমার ভীষণ কদর। আর এখন আমি বৃদ্ধ হয়ে পড়েছি। আমার কন্ঠস্বর কাঁপে আর আগের মত হাত দিয়ে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারি না। পূর্বের ন্যায় গলার আওয়াজও আর নেই। তাই কেউ আমাকে তাদের সভায় ডাকে না। কেননা আমি তো এখন একজন নিরস ও অপারগ ব্যক্তি। আমার স্ত্রী ও পরিবারের লোকেরাও আমাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে আজ রাতে শহরের অলি-গলিতে নিঃসঙ্গ পদচারণা করছিলাম। আজকে রাত্রি যাপনের জন্যে একটা জায়গা খুজছিলাম। অবশেষে নিরুপায় হয়ে এই গোরস্থানে আশ্রয় নিলাম এবং ব্যথিত ও বেদনা ভরপুর মনে কিছুক্ষন আল্লাহর কাছে মোনাজাত করলাম।

বল্লাম : হে আমার প্রতিপালক! আমার যৌবন , সহায়-সম্বল সব কিছু চলে গেছে। কোথাও একটুখানি জায়গাও নেই। আমাকে কেউ গ্রহণও করে না। এতকাল মানুষের জন্যে গান গেয়েছি , বাদ্য বাজিয়েছি এবং তাদের আসরগুলো জমিয়ে তুলেছি আর অবশেষে আজকে আমার এই পরিণতি। আজ রাতে আমি তোমাকে গান ও বাদ্য-বাজনা শোনাবো। অনেক রাত পর্যন্ত বাদ্যসহ গান গেলাম আর সে সভায় শুধু আমি এবং আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ছিলো না। বাদ্য বাজিয়ে এবং গান গেয়ে গরম করে তুলেছিলাম। গান গাচ্ছিলাম আর ক্রন্দন করছিলাম। এমনি করে ঘুমিয়ে পড়লাম। ”

এতক্ষনে শেইখের গৃহের কাছাকাছি এসে পড়েছি। বৃদ্ধ চিন্তামগ্ন ছিল এবং কিছইু বুঝে উঠতে পারলো না কি হয়েছে। শেইখের গৃহে প্রবেশ করলাম। তিনি ঘরের এক কোনে বসে ছিলেন। বৃদ্ধ বাদক তৎক্ষনাত হযরতের পায়ে আছাড় খেয়ে পড়লো এবং পূর্বের কৃত-কর্মের কারণে তাঁর কাছে তাওবা করলো।

শেইখ আবু সাইদ আবুল খাইর (রহঃ) বল্লেন : হে সাহসী! এক রাত আল্লাহর জন্যে বাদ্য বাজালে ও গান গেলে , আল্লাহ তোমার কষ্ট ও শ্রমকে নষ্ট করেননি এবং তাঁর বান্দাদের নির্দেশ দিলেন তোমার খোজ-খবর নিতে এবং তোমাকে আশ্রয় দিতে। ”

একদিন অতিবাহিত হয়ে গেল। হযরত শেইখ সবে মাত্র মজলিস ও মিম্বার থেকে নিচে নেমে আসছিলেন। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি দু শত দিনার আমার হাতে দিয়ে বললেন : এই দিনারগুলো নিয়ে হযরত আবু সাইদ আবুল খাইর সাহেবকে দিয়ে এসো। যখন আমি হযরতের খেদমতে পৌছলাম তিনি আমাকে বললেন : এগুলো নিয়ে তোমার পাওনাদারদের বুঝিয়ে দাও। ২১

(২২)

এমন হয়ো না

খাজা আব্দুল করিম ছিলেন হযরত শেইখ আবু সাইদ আবুল খাইর (রহঃ)-এর একজন বিশেষ খাদেম। তিনি বলেছেনঃ একদিন জনৈক ব্যক্তি আমার কাছে শেইখের জীবনের কিছু ঘটনা লিখে দেয়ার জন্যে অনুরোধ করলো। আমি তার অনুরোধ রক্ষার জন্যে লেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এমন সময় কেউ এসে আমাকে বল্লো : শেইখ তোমাকে ডাকছেন ” । শেইখের খেদমতে উপস্থিত হলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন : কি করছিলে ? উত্তরে বললাম : একজন দরবেশ আমাকে আপনার জীবনের কিছু ঘটনা লিখে দেয়ার অনুরোধ করলে আমি তা লেখার জন্যে মনোনিবেশ করেছিলাম। ” একথা শুনে শেইখ বলেন : হে আব্দুল করিম! কাহিনী লেখক হয়ো না , বরং এমন হও যেন তোমার জীবন থেকে অন্যেরা কাহিনী বর্ণনা করতে পারে। ২২

(২৩)

আল্লাহর গোপন রহস্য

একদা জনৈক ব্যক্তি হযরত শেইখ আবুল খাইর (রহঃ)- এর নিকট এসে বলো : এই শেইখ! আমি আপনার কাছে হাক্ব তায়ালার গোপন রহস্য শিক্ষা নেয়ার জন্যে এসেছি। লোকটির কথা শুনে শেইখ বললেন : ফিরে যাও , আগামীকাল এসো। লোকটি ফিরে গেল। শেইখ সেদিনই নির্দেশ দিলেন একটি ইদুর ধরে বাক্সে ভরে তার মুখটা শক্ত করে বেঁধে রাখতে। পরের দিন ঐ লোকটি এসে উপস্থিত। হে শেইখ! গতকাল যা আপনি ওয়াদা করেছিলেন তা আজকে পুরণ করুন লোকটি ব লল।

শেইখ নির্দেশ দিলেন ঐ বাক্সটি যেন লোকটিকে দেয়া হয়। অতঃপর তিনি ব ল্লেন : এই বাক্সের দরজা খুলবে না কিন্তু। লোকটি বাক্সটি নিয়ে বাড়ীর দিকে চলে গেল। বাড়ীতে গিয়ে অধৈর্য হয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করলোঃ আচ্ছা! এই বাক্সের ভিতর আল্লাহর কি গোপন রহস্য লুকায়িত আছে ? যতই চেষ্টা করলো লোকটি তার কৌতূহল সামলাতে পারলো না। অবশেষে সে বাক্সটির দরজা খুলে ফেললো। একটি ইদুর ভিতর থেকে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। লোকটি শেইখের কাছে এসে রাগ করে বললো : এই শেইখ! আমি আপনার কাছে আল্লাহর কোন গোপন রহস্য চেয়েছিলাম। আর আপনি আমাকে একটি ইদুর উপহার দিলেন ? শেইখ বল্লেন : হে দরবেশ! আমরা একটি ইদুর বাক্সের ভিতর ভরে দিয়েছিলাম তা তুমি গোপন করতে পারলে না! আর আল্লাহর গোপন রহস্যের ভেদ তোমার কাছে কিভাবে বলবো ? ২৩

(২৪)

উপযুক্ত ব্যক্তি

একবার কেউ হযরত আবু সাইদ আবুল খাইর (রহঃ)-কে ব লল : আমরা এমন এক ব্যক্তিকে চিনি যার আধ্যাত্মিক মাক্বাম এমন পর্যায়ে যে তিনি পানির উপর দিয়ে পদচারণা করতে পারেন। শেইখ শুনে বললেন : এটা কোন কঠিন কাজ হলো নাকি ? আল্লাহর এ পৃথিবীতে এমন কতো পাখি আছে যারা পানির উপর দিয়ে খুব সহজে হাটা-চলা করতে পারে। ”

ঐ ব্যক্তি ব লল : তিনি বাতাসে উড়ে বেড়ান। শেইখ বললেন : মাছিও তো বাতাসে উড়ে। ঐ ব্যক্তি বলো : আবার এমন কেউ আছেন যিনি এক মুহূর্তে এক শহর থেকে অন্য শহরে চলে যেতে পারেন।

এবার শেইখ আবুল খাইর (রহঃ) ভাবগম্ভীর হয়ে বললেন : শয়তানও তো এক নিমিষে পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে চলে যেতে পারে। এগুলো কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। সাহসী ও উপযুক্ত সাধক ঐ ব্যক্তি যিনি মানুষের মাঝে জীবন-যাপন করেন , উঠা-বসা করেন এবং তাদের সাথে চলা-ফেরা ও মেলা-মেশা করেন কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যেও আল্লাহকে ভুলেন না। ২৪

(২৫)

এক কদম সামনে

শেইখ আবু সাইদ আবুল খাইর (রহঃ) একবার তুস শহরে আ সলেন। জনগণ তাঁকে ঘিরে ধরলো আর তাঁকে কিছু বক্তব্য রাখার জন্যে অনুরোধ করলো। শেইখ তাদের অনুরোধে সম্মতি প্রকাশ করলেন। জনতা আনন্দ-উল্লাসের সাথে শেইখের জন্যে অত্যন্ত জাকজমকপূর্ণ বক্তৃতার আসন প্রস্তত করলো। খবর শুনে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসা শুরু করলো। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই সমাবেশ স্থলে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। হযরত শেইখ (রহঃ) তাঁর আসন অলংকৃত করলে কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে সভা আরম্ভ করা হলো। জনগণ তখনো সমাবেশের দিকে ছুটছে। কিন্তু আর যে কিছুতেই লোকদের জায়গা দেয়া যাচ্ছে না। তিল পরিমান ঠাই নেই। তবুও জনতা সমাবেশ স্থলের দিকে ঠেলে আসছে। এদিকে শেইখ (রহঃ) তাঁর আসনে উপবিষ্ট হয়ে বক্তৃতার জন্যে প্রস্তুত হয়েছেন। হঠাৎ একজন দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে চিৎকার করে ব লল : আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন যিনি তার নিজের অবস্থান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এক কদম সামনে এগিয়ে আসেন।

হযরত আবু সাইদ আবুল খাইর (রহঃ) লোকটির কথা শেষ হলে বল্লেন : ওয়া সা ল্লাল্লাহু আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলিহি আজমায়িন (আল্লাহর দুরুদ ও সালাম মুহাম্মাদ ও তাঁর বংশধরদের সকলের উপর বর্ষিত হোক) । একথা বলেই তিনি আসন থেকে নেমে গেলেন। লোকজন তাঁকে ব লতে লাগলো : ইয়া শেইখ! আপনার বক্তব্য শোনার জন্যে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন জমায়েত হয়েছে আর আপনি আসন ত্যাগ করছেন ?! শেইখ বল্লেন : আমি যা কিছু বলতে চেয়েছিলাম আর আল্লাহর নবী-রসুলেরা যা বলেছেন তার সবটুকু ঐ ব্যক্তি উচ্চস্বরে বলে দিয়েছেন।

সকল আসমানী কিতাব ও নবী-অলীদের ওয়াজ-নসিহতে এটা ব্যতীত আর কি ছিলো যে তারা বলতে চেয়েছেন , হে জনগণ! তোমরা এক কদম সামনে এগিয়ে এসো সেদিন শেইখ এর বেশী আর কিছু বলেন নি।২৫

(২৬)

মানুষের ব র্জ্যের অভিযোগ

হযরত শেইখ আবু সাঈদ আবুল খাইর (রহঃ) তাঁর মুরিদদের সাথে কোন এক স্থান অতিক্রম করছিলেন। সেখানে কোন এক বাড়ীর শৌচাগারের কুয়ো পরিস্কার করা হচ্ছিল। কুয়ো পরিস্কারকারী শ্রমিকরা ময়লাগুলো কুয়ো থেকে তুলে এক পার্শ্বে স্তুপ করে রাখছিল। শেইখের ছাত্ররা কাপড় গুটিয়ে খুব সাবধানে দ্রুত গতিতে সেখান থেকে চলে যাচ্ছিলেন। হযরত তাদেরকে ডেকে বল্লেন : তোমরা দাড়াও! তোমাদেরকে বলে দিই , এই বর্জ্য বস্তুগুলো তাদের ভাষায় আমাদেরকে কি বলছে।

তারা বলছে , আমরা গতকালের সেই সুস্বাদু ও সুঘ্রান খাদ্যসামগ্রী যেগুলোকে আপনারা চড়া দামে কিনেছিলেন আর ওগুলো পাওয়ার জন্যে আপনারা নিজেদের প্রাণ ও অর্থ দিতে এবং যে কোন কষ্ট স্বীকার করতে দ্বিধা বোধ করতেন না। আমরা তো সুঘ্রান ও সুস্বাদু খাবার ছিলাম। যেই না এক রাত্র আপনাদের সাথী হলাম আপনাদের রং ও গন্ধ আমাদের গায়ে মেখে নিলাম। এখন আপনারা আমাদের কাছ থেকে পালাচ্ছেন ? আমাদেরই উচিৎ আপনাদের কাছ থেকে পালানো। ২৬

(২৭)

চোরের পুরস্কার

এক রাত্রিতে চোর হযরত আহমাদ খাজরাবীর (রহঃ) গৃহে প্রবেশ করলো। অনেক খোজা-খুজির পরও চুরি করার মত কোন জিনিষ চোরের দৃষ্টিগোচর হলো না। তাই নিরাশ হয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। এমন সময় সহসা হযরত আহমাদ খাজরাবী চোরকে ডেকে বলেন : এই যুবক! এই বালতিটা নিয়ে কুয়ো থেকে পানি তুলে অযু করে আস আর নামাজে দাড়িয়ে যাও। আর এই সময় যদি কিছু এসে যায় তোমাকে দিয়ে দিবো। তুমি এই বাড়ি থেকে খালি হাতে ফিরে যাবে এটা মোটেও ঠিক নয়। ”

যুবক চোর কুয়ো থেকে পানি তুলে অযু করে নামাজ আদায় করলো। রাত গড়িয়ে দিনের আলো উদ্ভাসিত হলো। জনৈক ব্যক্তি হযরত আহমাদের ঘরের কড়া নাড়লো। সে ভিতরে এসে এক শত পঞ্চাশ দিনার হযরত শেইখের হাতে তুলে দিয়ে বলো : এগুলো হযরত শেইখের জন্যে হাদীয়া। হযরত শেইখ আহমাদ চোরের দিকে তাকিয়ে বললেন : দিনারগুলো নিয়ে চলে যাও। এটা এক রাত্র নামাজের পুরস্কার। চোরের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলো। তার দেহে কম্পন শুরু হলো। কাঁদতে কাঁদতে শেইখকে বলো : এ পর্যন্ত আমি অন্যায় পথে চলেছি। একটি রাত আল্লাহর ধ্যানে কাটালাম এবং নামাজ আদায় করলাম। আল্লাহ আমাকে এরকম সম্মানিত ও অভাব পূরণ করলেন। হে শেইখ! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন এবং আপনার কাছে রেখে আমাকে সত্য পথের শিক্ষা দিন। চোর স্বর্ণমূদ্রার থলেটি শেইখের কাছে ফেরত দিয়ে তার একনিষ্ঠ মুরিদদের মধ্যে গণ্য হয়ে গেল।২৭


3

4

5

6

7