পালানোর উপায় নেই

পালানোর উপায় নেই 0%

পালানোর উপায় নেই লেখক:
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

পালানোর উপায় নেই

লেখক: মোহাম্মদ নূরে আলম
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বিভাগ:

ভিজিট: 14607
ডাউনলোড: 3071

পালানোর উপায় নেই
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 18 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 14607 / ডাউনলোড: 3071
সাইজ সাইজ সাইজ
পালানোর উপায় নেই

পালানোর উপায় নেই

লেখক:
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বাংলা

যে মৃত্যু আমাদের নিত্য মুহূর্তের সাথী সেই মৃত্যুকে আমরা আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে দেয়ার চেষ্টা করি । অথচ এ মৃত্যুর কথা আমরা স্মরণ করি বা না-ই করি তা আমাদের সকলের দুয়ারে একদিন হানা দেবেই। আমরা নিজেদেরকে আপাততঃ ফাঁকি দিলেও মৃত্যুকে ফাঁকি দেয়ার কোন জো নেই। মৃত্যু এবং পরকালের হিসেব নিকেশের স্মরণ একজন মানুষকে তার দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করে সমাজে গঠনমূলক ও উপকারী অনেক কাজের অবদান রাখতে অনুপ্রেরণা যোগায়। আজকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যে সকল অন্যায় অবিচার ও পাপাচার বিদ্যমান তার মুলৎপাটনও ঘটাতে পারে উক্ত বিষয়ে স্মরণ। আর এ কথা ভেবেই মহাপুরুষদের জীবনী থেকে নির্বাচিত উপদেশবাণী সম্বলিত বিভিন্ন কাহিনী নিয়ে একটি পুস্তক রচনা করার চেষ্টা করেছি।

 

(৪০)

নেক নিয়ত

নুতন জামা পরিধান করেছিলেন তিনি। তিনি সালাত আদায় করতে মনন্থ করলেন। তাই অযু করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তিনি প্র থমে শৌচাগারে গেলেন। সহসা সেখানে মনে পড়ে গেল যে তার এ নতুন জামাটা দান (সদ্কা) করে দিতে হবে। তৎক্ষনাত জামাটি শরীর থেকে খুলে শৌচাগারের দরজায় ঝুলিয়ে রাখলেন। অতঃপর বাইরে দাড়িয়ে থাকা সাথীদের মধ্যে একজনকে ডাকলেন। সাথী ব লল : হে শেইখ! আপনার হুকুম ?

শৌচাগারের ভিতর থেকে শেইখ বললেন : এই ঝুলিয়ে রাখা জামাটি নিয়ে গিয়ে কোন মুখোপেক্ষী লোককে দান করে দাও।

লোকটি ব লল : হে শেইখ! আপনি কি অপেক্ষা করতে পারতেন না ? ওখান থেকে বেরিয়ে এসে সদ্কা দিতে পারতেন না ?

তখন আধ্যাত্মিক সাধক ব ললেন : আমার ভয় হচ্ছে আমি বাইরে আসলে শয়তান আমাকে এই নেক নিয়ত থেকে ফিরিয়ে দেবে। নিয়তের উপর শয়তানের হস্তক্ষেপ করার ফলে আমার অনুতপ্ত হওয়ার পূর্বে এটাকে নিয়ে কোন গরীব লোককে দান করে দাও। ৪০

(৪১)

আত্মনির্ভরশীলতা

[আবু আবদুল্লাহ মাগরিবি একজন বিশিষ্ট ও বিখ্যাত আরেফ-অলী ছিলেন। তিনি মুরিদদের প্রশিক্ষণে যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন। তার তরিকায় তাওয়াক্কুল (ভরসা) ও রিয়াযাত (কৃচ্ছ সাধন) অসামান্য গুরুত্বের অধিকারী ছিল। তিনি একশত বিশ বছর বেঁচে ছিলেন এবং দু শত উনানব্বই হিজরীতে পরজগতে তার মা বুদের সান্নিধ্যে চলে যান।]

বর্ণিত আছে যে , আবু আব্দুলাহ্ মাগরিবির চারজন পুত্র সন্তান ছিল। তিনি প্রত্যেককে এক একটি পেশায় প্রশিক্ষন দিয়েছিলেন। তার মুরিদরা বলেছিলো : আপনার সন্তানদের পেশা ও কাজের কোন প্রয়োজন নেই। যতদিন পর্যন্ত তারা জীবিত থাকবেন ততদিন আপনার মুরিদেরা তাদের ভরণ-পোষন করবে। এ কথা শুনে হযরত আবু আবদুল্লাহ্ : আল্লাহ না করুন! এ রকমটি যেন না হয়। ওদের প্রত্যেককে এক একটি পেশায় নিয়োজিত করেছি যেন আমার মৃত্যুর পর আমার সন্তান হওয়ার কারণে অন্যের প্রিয়পাত্র না হয় এবং পিতার নাম ভাঙ্গিয়ে যেন না চলে।

যখনি ওরা প্রয়োজন অনুভব করবে তখনি যেন ওদের শেপাগত যোগ্যতা কাজে লাগাতে পারে। ৪১

(৪২)

মায়ের দোয়া

[মুহাম্মাদ ইব্নে আলী তারমাযি (রহঃ) আল্লাহ ওয়ালা একজন আলেম এবং স্বনামধন্য আরেফ ছিলেন। তিনি তাঁর তরিকায় জ্ঞানার্জন ও ইরফান চর্চার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই তাঁকে হাকিমুল আওলিয়া ’ বলা হয়ে থাকে।]

তিনি যৌবনকালে তাঁর দুই বন্ধুসহ জ্ঞান অর্জনের সিদ্ধান্ত নিলেন। তাই অনেক চিন্তা-ভাবনা করে নিজ শহর থেকে হিজরত করে এমন এক জায়গায় যাওয়ার মনস্থ করলেন যেখানে জ্ঞানের বাজার ছিল খুব জমজমাট।

অবশেষে তিনি তাঁর মনের কথা তাঁর মাকে বললেন। মা এ কথা শুনে যার পর নেই দুঃখিত হলেন। মা হযরত মুহাম্মাদ ইবনে আলী তারমাযিকে বলেন : আমি দূর্বল এবং সহায়হীন বৃদ্ধা। তুমি আমার সাহায্যকারী। তুমি যদি চলে যাও আমি কিভাবে দিনকাল কাটাবো। তুমি আমাকে কার কাছে ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছো ?

মায়ের কথা শুনে তাঁর অন্তরে ব্যথা অনুভব হলো। তিনি শহর ত্যাগ করার চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে দিলেন। তাঁর দুই বন্ধু তাঁকে ছাড়াই জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে শহর ত্যাগ করলো। কিছুকাল এভাবেই পার হলো। হযরত শেইখ মুহাম্মাদ তারমাযি (রহঃ) শুধু অনুতাপ করতে থাকেন আর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে থাকেন। একবার তিনি শহরের কোন এক গোরস্থানে বসে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন : আমি এখানে বেকার এবং জাহেল ও অজ্ঞ রয়ে গেলাম আর আমার বন্ধুরা জ্ঞান অর্জন করছে। যখন তারা ফিরে আসবে তখন তারা আলেম হিসেবে গণ্য হবে আর আমি তখন অজ্ঞ ও জাহেল রয়ে যাবো।

হঠাৎ একজন উজ্জ্বল চেহারাসম্পন্ন বৃদ্ধ তাঁর মাথার কাছে এসে ব ললেন : হে পুত্র! কেন কাঁদছো ? শেইখ তার অবস্থার কথা বর্ণনা করলেন।

বৃদ্ধ লোকটি ব ললেন : তুমি কী চাও যে আমি প্রতিদিন তোমাকে জ্ঞান শিক্ষা দিই যেন খুব শিগগির তুমি তোমার বন্ধুদের চেয়েও বেশী জ্ঞানী হয়ে যাও। ”

শেইখ বললেন : হ্যাঁ! আমি চাই। অতঃপর সে বৃদ্ধ তাঁকে জ্ঞান দান করতে থাকলেন। এভাবে তিনটি বছর কেটে গেলো। পরে জানা গেল সেই বৃদ্ধ লোকটি ছিলেন হযরত খিজির (আঃ) ।

শেইখ মুহাম্মাদ তাঁর মায়ের দোয়া ও সন্তুষ্টির কারণে এ মহা মর্যাদা অর্জনে ধন্য হয়েছিলেন।৪২

(৪৩)

ইবলিসের বন্ধু এবং শত্রু

আল্লাহর নবী হযরত যাকারিয়ার পুত্র হযরত ইয়াহ্হিয়া (আঃ) একদিন ইবলি সকে দেখে ব ললেন : হে ইবলিস! তুমি কাকে সবচেয়ে বেশী দুশমন মনে করো আর কাকে বেশী ভালবাস ?

ইবলিস উত্তরে ব লল : সৎ ও ধর্মপ্রাণ অথচ কৃপন ব্যক্তিকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসি। কেননা সে প্রাণপণে আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকে। কিন্তু তার কৃপনতা ঐ সব ইবাদত বন্দেগীকে ব্যর্থ করে দেয়। আর পাপাচারী দাতাকে আমি সবচেয়ে বেশী শত্রু গণ্য করি। কারণ এই ব্যক্তি নিজেও ভাল জীবন-যাপন করে আর অন্যেকেও দান করতে কৃপনতা করে না। তাই আমার ভয় হয় , না জানি ঐ লোকের দানের কারণে আল্লাহ তার প্রতি রহমতের দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তাওবা করার তৌফিক দান করেন। ৪৩

(৪৪)

পরনিন্দা ভাল নয়

একবার বনি ইসরাঈল গোত্রে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। মাটি শুকিয়ে চৌচির। শষ্যক্ষেতে আর ফসল ফলছে না। জনগণ নিরুপায় হয়ে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইলো। তারা সকলে মিলে আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা করলো। তারা বৃষ্টির নামাজ আদায়ের পরও মেঘের কোন রকম চিহ্ন আকাশে দেখতে পেল না।

হযরত মুসা (আঃ) আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। পরক্ষনে হযরত মুসা (আঃ)-এর কাছে অহি আসলো। বলা হলো : হে মুসা! তোমাদের মাঝে একজন পরনিন্দাকারী আছে। যার কারণে তোমাদের দোয়া কবুল হচ্ছে না। যতক্ষণ পর্যন্ত পরনিন্দাকারী তোমাদের মাঝে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তোমাদের দোয়া কবুল করবো না।

হযরত মুসা (আঃ) তার গোত্রের লোকজনের মাঝে ঘোষণা করে দিলেন : যে ব্যক্তি পাপী এবং গিবত চর্চাকারী সে যেন এ সমাবেশ থেকে বের হয়ে যায়।

অতঃপর দেখা গেল কেউ সে সমাবেশ থেকে বের হয়নি। হযরত মুসা বিষয়টির সমাধানের জন্যে আল্লাহর নিকট আরজ করলেন : বারে ইলাহী! ঐ ব্যক্তিকে আমাদের মাঝে পরিচয় করিয়ে দাও যেন ওকে আমরা আমাদের মাঝ থেকে বিতাড়িত করতে পারি। ”

আবারো অহি আসলো : হে মুসা! আমি পরচর্চাকারীর দুশমন হয়ে কি করে আমি স্বয়ং পরচর্চা করতে পারি ? কেমন করে অন্যের দোষ তোমার কাছে বলি ? চিন্তার রেখা আল্লাহর নবীর চেহারাতে ভেসে উঠলো। কি করবেন ভেবে না পেয়ে আবারো আল্লাহর কাছে আরজ করেন : হে আমার রব! তাহলে এখন আমার করণীয় ?

আল্লাহ পুনরায় বলেন : হে মুসা! তুমি সবাইকে বল সবাই যেন আমার কাছে তওবা করে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে , যেন তোমাদের মাঝে কেউ পরনিন্দুক না থাকে।

অতঃপর হযরত মুসা (আঃ)-এর জাতির লোকেরা সকলে তাওবা করলে আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি তাদের উপর বর্ষিত হয়।৪৪

(৪৫)

ইবলিসের রাগ

রাসূলে খোদার (সা.) আহলে বাইতের সদস্য হযরত আলী বিন হুসাইন যয়নুল আবেদীন (আঃ)-এর নিকট থেকে বর্ণিত যে একদা তিনি তাঁর ক্রীতদাসকে দু বার উচ্চ স্বরে ডাকলেন কিন্তু তাঁর দাস কোন সাড়া দিল না। কোন উত্তরও দিলো না। তৃতীয়বার যখন ডাকলেন তখন উত্তর দিলে তাকে তিনি বলেন : এর পূর্বের ডাকগুলো কি শুনতে পাওনি ?

দাস : জি! শুনেছিলাম। ”

ইমাম : তাহলে উত্তর দাওনি কেন ?

দাস : আপনার নেক ব্যবহার ও আচরণের কারণে নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করিনি এবং আমি জানতাম যে আপনি আমাকে কোন অত্যাচার করবেন না। ”

ইমাম : আল্লাহর শোকর! আমার দাস আমার কাছ থেকে নিরাপদ। ”

ইমামের আরো একটি দাস ছিলো। একদিন সেই দাসটি ইমামের দুম্বার পা ভেঙ্গে দিয়েছিলো। ইমাম তাকে বলেন : আচ্ছা! তুমি কেন এ কাজটি করলে ?

দাস : ইচ্ছা করেই এমনটি করলাম যেন আপনি রাগান্বিত হয়ে যান। ”

ইমাম : তাহলে আমি এমন কাজ করবো , যে ব্যক্তি (ইবলিস) তোমাকে এমন কাজ শিখিয়েছে সে যেন রাগান্বিত হয়ে যায়। দাস তো নিশ্চুপ। ইমাম কাল বিলম্ব না করে তাঁর ঐ দাসকে বিনামূল্যে আল্লাহর পথে মুক্ত করে দিলেন।৪৫

(৪৬)

সিংহ পুরুষ

জনৈক ব্যক্তি রাসূলে খোদা (সা.)-এর নিকট এসে ব লল :‘‘ ঐ ব্যক্তিটি অত্যন্ত শক্তিশালী। লেকেরা বলে , যার সাথেই কুস্তি লড়ে তাকেই ভূ-পাতিত করে দেয় এবং তাকে পরাজিত করে বিজয়ের সম্মান কেড়ে নেয়।

এ কথার জবাবে রাসূলে খোদা (সা.) ব ললেন : শক্তিশালী ও পৌরুষ ঐ ব্যক্তি যে তার রাগের উপর বিজয়ী হয় , ঐ ব্যক্তি নয় যে অন্যকে মাটিতে ফেলে দেয়। ”

কবির ভাষায় :

‘‘ সারিবদ্ধ প্রাণীকে ভূপাতিত করলেই হয় না সিংহ সিংহসম সেই , যে নিজের নফ সকে পরাজিত করে । ৪৬

(৪৭)

নেয়ামতের শোকরগুজারী

জনৈক ব্যক্তি আল্লাহর এক বুযুর্গ বান্দার কাছে তার অভাবের কথা ব্যক্ত করলে তিনি বলেনঃ দশ হাজার দেরহামের বিনিময়ে তুমি কি তোমার চক্ষুযুগল বিক্রি করে দিতে পছন্দ করবে ?

লোকটি ব লল : তা কি করে হয় ? আমার এই দু চোখ সারা দুনিয়ার বিনিময়েও দিবো না। ”

বুযুর্গঃ তোমার বুদ্ধিবৃত্তি কি দশ হাজার দেরহামের সাথে বিনিময় করবে ?

অভাবী : জী-না। ”

বুযুর্গ : তোমার হাত , পা আর কান ?

অভাবী : কক্ষনো না। ”

বুযুর্গ : তাহলে শোন! আল্লাহ শত-সহস্র দেরহাম তোমাকে দান করেছেন। এর পরও অভাবের অভিযোগ। এখনো এমন অনেক লোক এ পৃথিবীতে বসবাস করছে যাদের অবস্থা তোমার চেয়ে অনেক বেশী শোচনীয়। তুমি নিশ্চয়ই তাদের অবস্থার সাথে নিজের অবস্থার বিনিময় করবে না ? সুতরাং যা তোমাকে দেয়া হয়েছে তা অনেকের চেয়ে অনেক বেশী দেয়া হয়েছে। তুমি এখনো এতসব নেয়ামতের শোকরগুজার করনি অথচ আরো নেয়ামতের আশা করছো ?! ৪৭

(৪৮)

অভাবীর আর্তনাদ

কোন এক অভাবী পরিবারের কথা । দুঃখের শেষ নেই। দুঃখ-কষ্ট ছিল তাদের জীবনের নিত্য সঙ্গী। পরিবারের কর্তা অতি কষ্টে সন্তান-সন্ততি নিয়ে দিন যাপন করছেন। উপায়ান্তর না দেখে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন তাদের এই দুরাবস্থার কথা কোন এক আল্লাহর অলীকে ব্যক্ত করবেন। তিনি শুনে তাদের জন্যে দোয়া করবেন এই আশায়। আর তাঁর দোয়ার বরকতে তাদের সংসারের অভাব মিটে যাবে।

পরিশেষে পুরুষ লোকটি এলাকার স্বনামধন্য অলী দরবেশ হযরত বিশর হাফীর নিকট গমন করলেন। লোকটি হযরত বিশর হাফীকে আরজ করলো :

হযরত! আপনি তো আল্লাহর প্রিয়জন। আমি আমার পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। আমার অনুরোধ যে দয়া করে আপনি আমার জন্যে দোয়া করবেন। ”

হযরত বিশর প্রতিত্তোরে বললেন : হে আমার ভাই! যখন তোমার স্ত্রী সন্তানরা অনেক আশা করে তোমার কাছ থেকে খাবার অথবা পোশাক পরি চ্ছদ কামনা করে আর তখন তুমি তা দিতে অপারগতা পোষন করো , সে সময় তুমি তোমার জন্যে দোয়া করবে। কেননা তখন তোমার দোয়া আমার চেয়ে বেশী কাজে লাগবে এবং আমার চেয়ে দ্রুততর আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে।

জেনে রেখো! সে অবস্থায় একজন মানুষের মনের নৌকা দুশ্চিন্তা ও ব্যথার সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকে। তখন কী তার সামনে মুক্তির সকল দুয়ার বন্ধ মনে হয় না ? যে কেউ এহেন অবস্থায় আল্লাহর কাছে হাত তোলে তখন তার দোয়া কবুল হওয়ার জন্যে অন্যদের চেয়ে বেশী উপযুক্ত। ৪৮

(৪৯)

হতাশার বাণী

বর্ণিত আছে যে , বনি ইসরাইলের জনৈক আলেম তার জাতির লোকদেরকে আল্লাহর রহমত থেকে হতাশ করে দিতেন। তিনি কাজকে মানুষের সামনে কঠিন করে উপস্থাপন করতেন। যে কেউ তার কাছে তাওবার জন্যে আসতো তাকেই তিনি নিরাশ করে দিতেন আর বলতেন আযাবের অপেক্ষায় থাকো , আযাবের অপেক্ষায় থাকো । অবশেষে একদিন সে আলেম লোকটি মারা গেলো। অনেকেই তাকে স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পেলো।

তারা জিজ্ঞেস করলোঃ আল্লাহকে কেমন পেলেন ?

ঐ মৃত আলেম স্বপ্নে বললেনঃ প্রতিদিন আমার কাছে শব্দ আসে , আমি তোমাকে আমার রহমত ও কৃপা থেকে বঞ্চিত ও নিরাশ করবো। কেননা পৃথিবীতে তুমি আমার বান্দাদের হতাশ করেছো। ৪৯

(৫০)

ধর্মজ্ঞানী বেদুঈন

একদা এক বেদুঈন রাসূলকে (সা.) প্রশ্ন করলো : ইয়া রাসূলু ল্লাহ্! ক্বিয়ামতের দিনে কে আমাদের কাছ থেকে হিসাব নিকাশ নেবে ?

আল্লাহর হাবীব বললেন : আল্লাহ তায়ালা। ”

আবারো জিজ্ঞেস করলো : এই হিসেব স্বয়ং আল্লাহ নেবেন নাকি অন্য কারো উপর তিনি দায়িত্ব ন্যস্ত করবেন ?

রাসূল(স.) : স্বয়ং আল্লাহ। বেদুঈন হেসে উঠলো। হাসির কারণ কী , জানতে চাইলেন আল্লাহর রাসূল(সা.) ।

বেদুঈন : হ্যাঁ , মহাদয়াবান যখন কাউকে হাতের নাগালে পান তখন তিনি ক্ষমা করেন , আর যখন তিনি হিসেব নেন তখন কঠিন করে নেন না। ”

রাসূল(সা.) : হ্যাঁ , সত্য বলেছো। পৃথিবীর কোন দয়াবানই আল্লাহর চেয়ে বেশী দয়াপরবশ নয়। ”

অতঃপর তিনি বললেন : এই বেদুঈন একজন ধর্মজ্ঞানী। ৫০

(৫১)

অন্যায় পথে উপার্জিত অর্থ ন্যায় পথে ব্যয় হয় না

একবার এক ব্যক্তি হযরত বিশর হাফীর সাথে পরামর্শ করার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলো : আমার দুই হাজার দেরহাম আছে তা দিয়ে আমি হজ্বে যেতে চাই। এ ব্যাপারে আপনার মত কী ?

হযরত বিশর বললেন : তোমার হজ্বে যাওয়ার উদ্দেশ্য কি পথের শহর-বন্দর তামাশা করা নাকি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা ?

লোকটি বলো : আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চাই। ”

হযরত বিশর : যদি এই হজ্ব তোমার জন্যে ফরজ না হয়ে থাকে তাহলে এ অর্থ গরীব , মিসকিন , ইয়াতিম ও ঋণগ্রস্থ মুসলিম পরিবারগুলোর মধ্যে দান করে দাও। ফলে তারা দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে। ”

লোকটি ব লল , হজ্বে যাওয়ার ব্যাপারে মন বেশী সায় দিচ্ছে। এ কথা শুনে হযরত বিশর (রহঃ) বলেন : হ্যাঁ , পরিস্কার হয়ে গেছে। এ অর্থ সঠিক পথে অর্জন করনি বলে সঠিক পথে খরচ করতে পারছো না। যে অর্থ ন্যায় পথে অর্জিত নয় , সেই অর্থ ন্যায় পথে ব্যয় হয় না। ৫১

(৫২)

অহংকর পতনের মূল

একবার কোন এক স্থানে হযরত বিশর বিন মানসূর সালাত আদায় করছিলেন। জনৈক ব্যক্তি তাঁর পাশে বসে তাঁর সালাত লক্ষ্য করছিলো। ঐ ব্যক্তিটি মনে মনে বিশরকে অত্যন্ত প্রশংসা করতে লাগলো আর নিজের অবস্থা স্মরণ করে হায় আফসোস! হায় আফসোস করতে লাগলো। সেজদা ও রুকুর দীর্ঘতা আর সালাতে তাঁর এহেন ধ্যানমগ্ন অবস্থা দেখে সেই লোকটি বিষ্ময়াভূত হয়ে যায়। অন্তর দিয়ে ঐ ব্যক্তিটি বলতে লাগলো , সাব্বাস! এটাই তো বান্দার কাজ।

হযরত বিশর সালাত সমাপ্ত করে লোকটির প্রতি দৃষ্টি দিয়ে বললেন : এই সাহসী মানুষ! বিস্মিত হয়ো না। আমি এমন একজনকে চিনি যে একসময় সালাতে দাড়ালে ফেরেস্তারা পর্যন্ত তার পেছনে কাতারবদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে যেতো। আর এখন তার অবস্থা এমন যে জাহান্নামীরা পর্যন্ত তার প্রতি ঘৃনা পোষন করে। লোকটি বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করলো , সে কে ? সে হচ্ছে ইবলিস! হযরত বিশর বললেন। তাই তো কোন এক বুযুর্গ বলেছেনঃ সারারাত যদি ঘুমিয়ে কাটিয়ে দাও আর সকালে আল্লাহর ভয়ে অন্তর কম্পিত থাকে , এটা ঐ ব্যক্তির চেয়ে উত্তম যে রাত্রিভর ইবাদত বন্দেগীর পর প্রভাতে অহংকার ও আত্মতুষ্টির শিকার হয়ে যায়। এ বিশ্বে সর্বপ্রথম যে পাপ প্রকাশিত হয় তা ছিল শয়তানের অহংকার। ৫২

(৫৩)

আল্লাহর প্রতি সম্মানের প্রতিদান

[বিশর ইবনে হারেস(রহঃ) ছিলেন মারভের অধিবাসী। তবে তিনি তার জীবনের শুরু থেকে মৃত্যু অবধি বাগদাদেই অতিবাহিত করেছেন। এখন যে ঘটনাটি নিচে উ ল্লেখ করবো সেটি ছিলো তার তওবার কারণ। আর এই তওবা করেই তিনি বিশ্বখ্যাত আরেফদের মধ্যে গণ্য হতে পেরেছিলেন।]

একদা হযরত বিশর ইবনে হারেস কোথাও যাচ্ছিলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর তিনি পথিমধ্যে এক টুকরো কাগজ দেখতে পেলেন। তাতে লেখা ছিলো বিসমি ল্লাহির রা হমানির রাহিম ” । তিনি সে কাগজটি অতি য ত্নের সাথে মাটি থেকে তুলে ভালোভাবে চুমু খেলেন। অতঃপর সামনের একটি দোকান থেকে এক শিশি আতর ক্রয় করলেন। তিনি কাগজটিকে আতর দিয়ে মেখে খুব সম্মানের সাথে রাস্তার পাশে এক দেয়ালে গুঁ জে রাখলেন। এই ঘটনাটি কেউ জানতে পারলো না। তিনি পথচলা অব্যাহত রাখলেন। অবশেষে গন্তব্য স্থলে পৌছে তিনি রাতে বিশ্রাম গ্রহণ করেন। রাত যখন প্রায় শেষের দিকে তখন তিনি স্বপ্নে দেখতে পেলেন কে যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তিনি অবাক হয়ে সেই আওয়াজের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।

অদৃশ্য থেকে তাকে বলা হচ্ছে : হে বিশর! তুমি আমার নাম সুগন্ধযুক্ত এবং সম্মানিত করেছো। সে কারণে আমিও দুনিয়া ও আখেরাতে তোমার নাম সম্মানিত করবো। একথা শেষ হতেই হযরত বিশর ঘুম থেকে জেগে উঠলেন আর এভাবেই তিনি সাধনার সিঁড়িপথ বেয়ে ইরফানের উচ্চ মাক্বামে পৌছুতে পেরেছিলেন।৫৩

(৫৪)

বিন্দু বিন্দু জল

দুম্বার কোন অভাব ছিলো না তার। কয়েক শত দুম্বা চড়ানোর জন্যে এই আল্লাহর বান্দা একজন রাখাল নিয়োগ করলো। রাখাল ছেলেটি দুম্বা চড়ানো ছাড়া দুধ দোহানের কাজটিও করতো। আর এভাবে প্রতিদিন সে নিষ্ঠার সাথে দুধ মালিকের হাতে তুলে দিতো। তবে দুষ্ট মালিক প্রতিদিন সে দুধের সাথে পানি মিশিয়ে বাজারে বিক্রি করে আসতো। কিন্তু রাখাল ছেলেটি ছিলো একজন ন্যায়পরায়ণ ও সত্যবাদী মানুষ। সে মালিককে এই অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার জন্যে সবসময় গুরুজনদের উপদেশবাণী শোনাতো। কিন্তু মালিক রাখালের ভাল কথায় কোন কর্ণপাত করেনি। সে প্রতিদিন একই কাজ করে যাচ্ছিলো। কিন্তু রাখালের মনে কোন সুখ ছিলো না।

কোন একদিনের কথা। অন্যান্য দিনের মত আজও রাখাল দুম্বাগুলোকে মাঠে চড়াতে ও ঘাস খাওয়াতে মরুভূমিতে নিয়ে এসেছে। বেলা যখন প্রায় দুপুর তখন সে দুম্বাগুলোকে মাঠে রেখে পাহাড়ের উপর চলে আসে। এখানে বসে সে পশুগুলোর তদারকি করছিলো। কোথাও কোন বাধা নেই। দুম্বাগুলো আপন মনে চড়ে বেড়াচ্ছিল আর কখনো মে মে বলে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলছিলো। এভাবে বেলা গড়িয়ে যখন বিকেল হয়ে আসে তখন আকস্মিকভাবে আকাশ গর্জন করা শুরু করে দেয়। সাথে সাথে আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। সেদিন তাড়াতাড়িই অন্ধকার চলে আসে। আর রাখাল ছেলেটির কিছু বুঝার আগেই শুরু হয়ে যায় প্রবল বর্ষণ। সে পাহাড় থেকে নেমে আসতে না আসতেই পাহাড়ী ঢলে দুম্বাগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রাখাল তো কিংকর্তব্যবিমুঢ়। যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। রাখাল ছেলেটির আর কিছু করার থাকলো না। মনের দুঃখে মালিকের বাড়িতে ফিরলো সে। বাড়িতে রাখালকে খালি হাতে দেখে মালিক জিজ্ঞেস করে : কি ব্যাপার! আজকে যে আমাদের জন্যে দুধ আনলে না ?

রাখাল : হে মনিব! আমি আপনাকে কতবার বলেছি যে দুধে পানি মেশাবেন না। কিন্তু আপনি সে কথায় ভ্রুক্ষেপও করেন নি। আমি বলিনি এভাবে জনগণের সাথে প্রতারণা করবেন না ? আজকে দুধে মেশানো আপনার সেই জলবিন্দুসমূহ একত্রিত হয়ে প্লাবনের আকার ধারন করেছিলো। সেই প্লাবনের ঢল আপনার দুম্বাগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ৫৪

কবির ভাষায় :

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।

(৫৫)

স্বপ্নের প্রেমিক

[শাহ্ সোজাহ্ কেরমানী ছিলেন হিজরী তৃতীয় শতাব্দির একজন খ্যাতনামা আরেফ। তাকে শাহ্ বলা হয় এ কারণে যে কিছুকাল তার পিতা পারস্যের কেরমান প্রদেশের আমির ছিলেন। তিনি হিজরী দুই শত সত্তুর সনে এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চিরস্থায়ী জগতে পদার্পন করেন।]

কথিত যে তিনি চ ল্লিশ বৎসর অনিদ্রায় কাটিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি যখন নিদ্রায় যান স্বপ্নে আল্লাহকে অবলোকন করেন। আল্লাহর সাক্ষাৎ পেয়ে তো তিনি খুশীতে বাগ বাগ। তবে স্বপ্নেই তিনি আল্লাহ কে প্রশ্ন করেন :

হে মহান প্রতিপালক ! জাগ্রত অবস্থায় আমি তোমাকে কতই না খুজেছি , আর এতকাল পর নিদ্রাবস্থায় আমি তোমাকে পেলাম !! ?

প্রতিত্তোরে দয়াবান আল্লাহ ব ললেন : হে আমার বান্দা ! ঐ দীর্ঘ জাগ্রতবস্থার কারণেই তো আমাকে এই স্বপ্নে পেয়েছো। যদি তোমার জীবনে সেই দীর্ঘ অনিদ্রা না থাকতো তাহলে আজকে এরকম স্বপ্ন তুমি দেখতে না। সে রাত্রিতে আল্লাহর সাথে এর বেশী আর কোন কথপোকথন হয়নি। তার পর দিন থেকেই তিনি তার মাশুকের প্রেম মিলনের আকাঙ্খায় আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যেখানেই যেতেন সঙ্গে একটি বালিশ রাখতেন। তিনি চাইতেন ঘুম আসলেই কালবিলম্ব না করেই যেন সেই বালিশের উপর দেহ এলিয়ে দিতে পারেন। আর এভাবে তিনি যেন আবারো স্বপ্নে আল্লাহকে দেখতে পান। সেই স্বপ্নের পর থেকে তিনি প্রায় বলতেনঃ হায় ! ওরকম স্বপ্ন যদি আমি জীবনে আর একবার দেখতাম ! তিনি একেবারে স্বপ্নের প্রেমিক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সর্বদা একটি কথা উচ্চারণ করতেন : বিশ্বব্যাপি প্রাণী জগতের সকল অনিদ্রার বিনিময়ে হলেও ঐ একটু স্বপ্ন হাতছাড়া করতে আমি প্রস্তুত নই। ৫৫