পালানোর উপায় নেই

পালানোর উপায় নেই 0%

পালানোর উপায় নেই লেখক:
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

পালানোর উপায় নেই

লেখক: মোহাম্মদ নূরে আলম
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বিভাগ:

ভিজিট: 15649
ডাউনলোড: 3803

পালানোর উপায় নেই
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 18 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 15649 / ডাউনলোড: 3803
সাইজ সাইজ সাইজ
পালানোর উপায় নেই

পালানোর উপায় নেই

লেখক:
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বাংলা

যে মৃত্যু আমাদের নিত্য মুহূর্তের সাথী সেই মৃত্যুকে আমরা আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে দেয়ার চেষ্টা করি । অথচ এ মৃত্যুর কথা আমরা স্মরণ করি বা না-ই করি তা আমাদের সকলের দুয়ারে একদিন হানা দেবেই। আমরা নিজেদেরকে আপাততঃ ফাঁকি দিলেও মৃত্যুকে ফাঁকি দেয়ার কোন জো নেই। মৃত্যু এবং পরকালের হিসেব নিকেশের স্মরণ একজন মানুষকে তার দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করে সমাজে গঠনমূলক ও উপকারী অনেক কাজের অবদান রাখতে অনুপ্রেরণা যোগায়। আজকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যে সকল অন্যায় অবিচার ও পাপাচার বিদ্যমান তার মুলৎপাটনও ঘটাতে পারে উক্ত বিষয়ে স্মরণ। আর এ কথা ভেবেই মহাপুরুষদের জীবনী থেকে নির্বাচিত উপদেশবাণী সম্বলিত বিভিন্ন কাহিনী নিয়ে একটি পুস্তক রচনা করার চেষ্টা করেছি।

 

(৬০)

মূর্তির লজ্জা

হযরত ইউসুফ (আঃ) যৌবনকালে অনেকদিন মিসরের বাদশাহর হাতে ছিলেন বন্দি। বন্দি অবস্থাতেই তাঁর সৌন্দর্য ও গুণের সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি আযিযে মিসরের পরমা সুন্দরী স্ত্রী জুলাইখাও তাঁর দর্শনে মুগ্ধ হয়ে প্রেমাসক্ত হয়ে পড়েন।

একদিন বাদশাহর স্ত্রী জেলখানা থেকে হযরত ইউসুফকে ডেকে এনে সম্মানের সাথে তার একান্ত কক্ষে আসন করে দেন। বাদশাহর স্ত্রীর যে মতলব খারাপ তা হযরত ইউসুফ (আঃ) মোটেই টের পাননি। তাকে আপন করে পাবার নেশায় মত্ত জুলাইখা। কিন্তু আল্লাহর কি শান। জুলাইখা হযরতকে অবৈধ যৌনচর্চার আহ্বান জানানোর পূর্বে সে তার কক্ষে সংরক্ষিত পূজিত মূর্তিটির উপর একটি কাপড় ছড়িয়ে দেয় যেন তার অবৈধ কাজটি মূর্তির চোখের সামনে না ঘটে। এ ঘটনা পরিদর্শনে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হযরত ইউসুফ (আঃ) জুলাইখার উদ্দেশ্যে বলেন : হে জুলাইখা ! তুমি এ পাথরের তৈরী একটি জড় মূর্তির কাছে লজ্জা পাচ্ছো আর আমি আমার মহান প্রতিপালক , সাত আসমান ও জমিনের মালিকের কাছে কি করে লজ্জিত হবো না ? তিনি যে সব কিছু শোনেন এবং সকল কিছু দেখেন ! ৬০

(৬১)

নিয়তের ফলাফল

দূর্ভিক্ষ দেশের সর্বস্তরের বহু মানুষকে অপরিমিত দুঃখ ও কষ্টের মধ্যে নিক্ষেপ করে দিয়েছিলো। সে সময়ে কোথাও কোন ফসল ফলছিলো না। এক টুকরো রুটির সন্ধানে মানুষ হণ্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতো। এরি মধ্যে বনি ইসরাইলের এক ব্যক্তি ঘুরতে ঘুরতে মরুভূমির এক প্রান্তে একটি পাহাড়ের পাদদেশে এসে হাজির। এ পাহাড়টিকে ঘিরে রেখেছে অসংখ্য ছোট বড় নুড়ি পাথর। লোকটি ভাবতে লাগলো :

হায়রে কপাল! যদি এ পাহাড়ের উপর নুড়ি পাথর না থেকে সম পরিমান গমের দানা থাকতো তাহলে আমি তা দিয়ে আমার জাতির লোকদের ক্ষুধা নিবারন করাতে পারতাম। সে এ কথা ভাবতে ভাবতে পুনরায় শহরের দিকে ফিরে আসতে লাগলো। বনি ইসরাইলের গোত্রে আল্লাহ শত-সহস্র নবী প্রেরণ করেছিলেন। লোকটি যখন নগরীতে পৌছলো তখন তৎকালীন আল্লাহর নবী তাকে জিজ্ঞেস করেন : এই যে ভাই! আপনি শহরের বাইরে কী দেখলেন আর কী চাইলেন ?

সে লোকটি উত্তরে বলো : শহরের বাইরে আমি একটি বিশাল পাহাড় আর তাকে ঘিরে অসংখ্য নুড়ি পাথর দেখতে পেলাম। তখন আমি আপন মনে ভেবেছিলাম , হায় যদি এগুলো নুড়িপাথর না হয়ে গমের দানা হতো তাহলে তা আমার জাতির লোকদের জন্যে নিয়ে যেতে পারতাম এবং তা দিয়ে তাদের ক্ষুধা নিবারন করাতে পারতাম। ”

লোকটির কথা শুনে বনি ইসরাইলের নবী ব ললেন : “ তোমার জন্যে সুসংবাদ। কিছূক্ষন পূর্বে আল্লাহর ফেরেস্তা আমাকে জানালেন যে আল্লাহ তায়ালা তোমার দোয়া কবুল করেছেন। আল্লাহ ঐ পাহাড় পরিমান গমের দানার সমতুল্য নেকী তোমাকে দান করেছেন। ৬১

(৬২)

সুস্থ কে

একদা হযরত ইসা (আঃ) একটি পথ অতিক্রমকালে এমন এক লোকের সাক্ষাত পেলেন যে ছিলো বহু ধরনের রোগে আক্রান্ত। তার না ছিলো দৃষ্টি শক্তি , না ছিলো পায়ে চলার বল। তিনি দেখতেও পারতেন না আর হাটতেও পারতেন না। কুষ্ঠ রোগে তার দেহ ছিলো জরাকীর্ণ। রাস্তার এক পাশে অসাঢ় হয়ে পড়ে থাকা লোকটিকে আবাক হয়ে দেখছিলেন আল্লাহর নবী হযরত ইসা (আঃ) ।

এত কিছুর পরও সে লোকটি গুণ গুণ করে বলে যাচ্ছিলোঃ হে আমার প্রভু ! তোমাকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ। কেননা তুমি যে আমাকে সুস্থ রেখেছো আর করেছো রোগমুক্ত। এ কথা শুনে হযরত ইসা (আঃ) যার পর নেই অবাক হলেন। তিনি রুগ্ন লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন : হে আল্লাহর বান্দা ! আর কোন্ রোগ নেই যে তোমাকে ধরেনি , যে জন্যে তুমি আল্লাহকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছো ?

রুগ্ন ব্যক্তি : হে ইসা নবী ! জেনে রেখো আমার সুস্থতা ঐ ব্যক্তির চেয়ে অনেক বেশী যার অন্তরে হাক্বতায়ালার কোন মা 'রেফাত নেই। ”

হযরত ইসা(আঃ) : হ্যাঁ , তুমি ঠিকই বলেছো। ”

অতঃপর ইসা নবী ঐ লোকটির গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। আল্লাহর রহমতে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন। ইতিহাসে আছে , তিনি এরপর সুস্থভাবে বহু দিন বেঁ চে ছিলেন আর মৃত্যু অবধি আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে কাটিয়ে দিয়েছিলেন।৬২

[যে অন্তরে আল্লাহর স্মরণ নেই সে অন্তর রুগ্ন অন্তর। আর রুগ্ন অন্তরের মানুষ দৈহিকভাবে সুস্থ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে সে-ই রোগী। তার উচিত আরোগ্য কামনা করা। অপর পক্ষে যার অন্তরে আল্লাহর পরিচয় বা মারেফাত বিদ্যমান , আল্লাহর স্মরণে যে অন্তর সিক্ত তার দেহ কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেও প্রকৃতপক্ষে সে-ই সুস্থ।]

(৬৩)

জ্ঞানীর দুঃখ

একবার দার্শনিক প্লেটো আপন মনে নিরবে বসে কি যেন ভাবছিলেন। সহসা এক ব্যক্তি তার পাশে এসে বসলো। বসেই সে গল্প শুরু করে দিলো। অনেক কথা ব ললো সে। লোকটি শুধু বলেই যাচ্ছিলো আর তিনি শুনেই যাচ্ছিলেন।

এক পর্যায়ে লোকটি দার্শনিক প্লেটোকে বলো : হে মহান দার্শনিক ! হে প্রজ্ঞাবান ! আজকে এমন একজন লোকের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম যে আপনার জন্যে শুধু দোয়াই করে যাচ্ছিলো , আর সে আপনার প্রশংসায় ছিলো পঞ্চমুখ। সে বলছিলো , জনাব প্লেটো এমন একজন মহান ব্যক্তি যার মত পৃথিবীতে কোন মানুষ জন্মায়নি আর জন্মাবেও না। আমি তার প্রশংসার বাণী আপনাকে জানাতে এসেছি। ”

প্লেটো তাঁর নিজের সম্পর্কে এ ধরনের প্রশংসার কথা শুনে যার পর নেই অসন্তুষ্ট হলেন। তিনি মাথা অবনত করে ভাব গম্ভীরভাবে কাঁদতে লাগলেন। দার্শনিকের কান্না দেখে উপস্থিত লোকটি থতমত খেয়ে গেলো। অবশেষে অনেক কষ্টে বুকে সাহস নিয়ে বিনয়ের সাথে সে জনাব প্লেটোকে জিজ্ঞেস করে : হে মহোদয় ! আমার কাছ থেকে এমন কি বেয়াদবী হয়েছে , যে কারণে আপনি এমন দুঃখ পেয়েছেন ?

উত্তরে দার্শনিক প্লেটো ব ললেন : তোমার কাছ থেকে আমি কোন কষ্ট পাইনি। তবে এর চেয়ে বড় মুসিবত আর কি হতে পারে যে , একজন মূর্খ ব্যক্তি আমার প্রশংসা করবে এবং তার কাছে আমার কাজ পছন্দনীয় হবে ? জানি না , আমি এমন কোন্ অজ্ঞ কাজ করে ফেলেছি যা তার কাছে ভাল লেগেছে , যার কারণে সে আমার প্রশংসা করেছে ? আমার দুঃখ এখানেই যে , আমি এখনো মূর্খ ও অজ্ঞ রয়ে গেছি। কেননা , জাহেলের প্রশংসা জাহেলই করে থাকে। ৬৩

(৬৪)

জানা আর দেখা সমান নয়

একদা হযরত আবু সাইদ আবুল খাইর(রহঃ) নিশাপুরের এক ওয়াজ মাহ্ফিল শেষে নিজ গৃহের দিকে রওয়ানা হয়েছেন। পথিমধ্যে তৎকালীন খ্যাতনামা দার্শনিক ও বিজ্ঞ চিকিৎসাবিদ আবু আলী সিনার সাথে তার সাক্ষাত ঘটে। এর পূর্বে তারা কখনো পরস্পরকে স্বচক্ষে দেখেননি। যদিও তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে পত্র বিনিময় হয়েছিলো। হযরত আবুল খাইর আবু আলী সিনাকে নিজ গৃহে আমন্ত্রন জানালেন। হযরত আবু আলী সিনা নিমন্ত্রন গ্রহণ করলে হযরত আবুল খাইর সম্মানের সাথে তাকে ম্বাগতম জানালেন। তার জন্যে বহু সুস্বাদু খাবারের আয়োজনও করলেন তিনি। তারা দু জন একান্ত নিরিবিলি আলাপ আলোচনা করলেন তিন দিবা রাত্রি। এ তিন দিন নিশাপুরের জনগণ তাদেরকে মসজিদে জামায়েতের নামাজে ছাড়া অন্য কোথাও দেখেনি। তিন দিন তিন রাত পর যখন হযরত আবু আলী সিনা শহর ত্যাগের নিমিত্তে শেইখের গৃহ থেকে বের হলেন তখন তার ছাত্ররা তাকে ঘিরে ধরলো।

তারা খাজা আবু আলীকে জিজ্ঞেস করলো : শেইখ আবুল খাইরকে আপনি কেমন দেখলেন ? উত্তরে আবু আলী সিনা বলেন : আমি যা জানি শেইখ (দিব্য শক্তি বলে) তা দেখেন। ” অপরদিকে শেইখের মুরীদরা খাজা আবু আলী সিনা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন : আমি যা দেখি তিনি তা জানেন। ৬৪ হ্যাঁ , জানা আর দেখার মধ্যে আছে অনেক তফাৎ।

(৬৫)

বন্ধুর পরিচয়

[যুন নুন মিসরী ছিলেন ইসলামী ইরফানের একজন অগ্রদূত। একবার আব্বাসীয় জালিম খলীফা আল্ মুতাওয়াক্কিল তাকে কুফরী ও বেদ্বীনির অভিযোগে কারাবন্দি করে। কিন্তু কিছুদিন পর তার বিভিন্ন ইরফানি ও আধ্যাত্মিক কথাবার্তা শুনে তাকে কারামুক্ত করে দেয়। হযরত যুন নুন (রহঃ) হিজরী দু শত পয়তা ল্লিশ সনে পরলোকগমন করেন।]

যখন তিনি মস্তিষ্ক বিকৃতি ও বেদ্বীনির অভিযোগে কারাবন্দি জীবন যাপন করছিলেন তখন একদিন তার কিছু ভক্তবৃন্দ তাকে কারাগারে দেখতে আসে। হযরত যুন নুন তাদেরকে দেখে জিজ্ঞেস করেন তোমরা কারা ? তারা সকলে উচ্চ কন্ঠে উত্তর দিলো , আমরা আপনার মুরীদান। আমরা আপনার শুভাকাঙ্খী।

হযরতও উচ্চ স্বরে তাদেরকে বকাবকি করে তাড়িয়ে দিলেন। তিনি হাতের কাছে যা পেয়েছেন তাই তাদের দিকে ছুড়ে মেরেছেন। হযরতের এহেন অবস্থা পরিদর্শনে মুরীদরা সকলে ছুটে পালালো। কিছুক্ষনের মধ্যেই হযরত আবারও লোকশূণ্য ও কোলাহল মুক্ত হয়ে গেলেন।

লোকজন সকলে চলে গেলে হযরত হেসে ফেললেন। তিনি দুঃখের সাথে মাথা নেড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেনঃ তোমাদের লজ্জা পাওয়া উচিত। তোমরা ব লছো তোমরা আমার ভক্ত। না , তোমরা ঠিক বলনি। যদি তোমরা সত্যিকার অর্থে আমার প্রেমিক হতে তাহলে আমার পক্ষ থেকে আরোপিত কষ্টের সময় ধৈর্যধারণ করতে আর আমাকে ত্যাগ করতে না। হ্যাঁ , বন্ধুর পক্ষ থেকে আরোপিত কষ্ট বন্ধু বুকে পেতে নেয় , তাকে ত্যাগ করে না। ৬৫

(৬৬)

গোলামের কৃতজ্ঞতা

একবার কোন এক শহরের এক মনিব খাওয়ার জন্যে তার গোলামের হাতে একটি তিতো ফল তুলে দিলেন। দাস সম্মানের সাথে ফলটি গ্রহণ করেই তৃপ্তভরে খাওয়া শুরু করে দিলো। কি মজা ও সুস্বাদু ফল। এমন মজা ফল কেউ কখনো খেয়েছে কিনা মনিবের জানা নেই।

গোলামের খাওয়া দেখে মনিবের লোভ হলো। এখান থেকে একটু ফল খেতে পারলে নিজেকে ধন্য জ্ঞান করা হবে , ভাবতে লাগলেন মনিব। তিনি নিজেকে বলতে লাগলেন আমার দাস যেভাবে তৃপ্তির সাথে ফলটি খাচ্ছে নিশ্চয়ই তা অত্যন্ত মিষ্টি ও সুস্বাদু হবে। তাই তিনি দাসকে বললেন : হে আমার প্রিয় দাস! তুমি যে ফলটি এত তৃপ্তির সাথে খাচ্ছো তা থেকে আমাকে একটু দাও। আমিও তোমার মত সুস্বাদু ফল খেতে চাই। দাস তার মনিবের নির্দেশ মোতাবেক ফলের অর্ধেক তার মনিবকে ফেরত দিলো।

মনিব ফলটি হাতে পেয়ে আর দেরী না করে দাত দিয়ে ফলটিতে কামড় দিলো। যেই মনিব ফলটি মুখে পুড়েছে অমনি এক বিভৎস চেহারার মাধ্যমে ফলটিকে ছুড়ে ফেলে দিলো। তিনি ফলটি মুখে দিয়েই বুঝতে পেরেছিলেন যে আসলে ফলটি অত্যন্ত তিতো। এ অবস্থায় তিনি খুব বিরক্ত বোধ করলেন। কিন্তু করার কিছুই তার ছিলো না। শুধু তিনি তার দাসকে ধমক দিয়ে বললেন : এরকম তিতো ফল এরকম তৃপ্তির সাথে খাচ্ছিলে ?

তখন গোলাম বিনয়ের সাথে উত্তর দেয় : হে মনিব ! আমি আপনার কাছ থেকে কত যে মিষ্টি ফল খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। এখন যে তিতো ফল আমাকে খাবার জন্যে দিয়েছেন কেমন করে আমি তা বিরক্তের সাথে প্রত্যাখ্যান করি ? এ কাজ যে সৎসাহস ও দাসত্বের বরখেলাফ! এ অল্প তিক্ততার উপর ধৈর্যধারণ আপনার পক্ষ থেকে আগত অসংখ্য সুখকর ও সুস্বাদু মিষ্টি ফলের কৃতজ্ঞতারই শামিল। ৬৬

(৬৭)

মঙ্গলময় আঘাত

একদা এক দরবেশ গ্রামের একটি সরু পথ দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তিনি কিছু দূরে একটি গাছের ছায়ায় নিদ্রারত অবস্থায় একটি যুবকে দেখতে পান। তাঁর দৃষ্টি আকর্ষন হলো ঐ যুবকটির উপর । তিনি যখন দূর থেকে মনযোগ দিয়ে যুবকের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন দেখতে পান যে ঐ যুবকের দিকে একটি বিষাক্ত সাপ ধেয়ে ছুটছে। তিনি দ্রুত যুবকের দিকে ছুটে চললেন।কিন্তু তাঁর পৌছার পূর্বেই সাপটি যুবকের মুখ দিয়ে পেটের ভিতর চলে যায়।

সাধক চিন্তা করে দেখলেন যদি এ মুহুর্তে যুবককে সাপের সংবাদ দেয়া হয় তাহলে সে ভয়েই মারা যাবে। তাই তিনি একটি বিকল্প চিন্তা করলেন। তিনি একটি লাঠি দিয়ে ঘুমন্ত যুবকের গায়ে আঘাত করতে শুরু করলেন। যুবক ঘুম থেকে জাগ্রত হলো ঠিকই কিন্তু একেবারে আধমরা। দরবেশের হাতে পিটুনি খেয়ে সে আর উচ্চ বাক্য করার সাহস পেলো না। তিনি যুবককে আঘাত করেই চলছেন।

অবশেষে যখন বুঝতে পারলেন এখন যদি যুবককে কিছু বলা হয় তাহলে সে নির্দ্বিধায় তা মেনে নেবে তখন তিনি নির্দেশ দিলেন গাছের নিচে পড়ে থাকা পচাঁ ফলগুলো খেতে। যুবক নিরূপায় হয়ে দরবেশের কথা মেনে যাচ্ছিলো। সে ভয়ে ও আতংকে পচাঁ ও দুর্গন্ধময় ফলগুলো খাচ্ছিলো আর দরবেশকে গালিগালাজ করছিলো। সে পচাঁ ফলগুলো খেতে খেতে বলছিলো : কি দুঃসময় আমার! আমি আজ তোমার পালায় পড়েছি। তুমি আমার মধুর ঘুম ভেঙ্গে দিয়ে নির্যাতন চালাচ্ছো। আল্লাহ তোমার বিচার করুক। কিন্তু দরবেশ যুবকের কোন কথারই ভ্রুক্ষেপ করলেন না। তিনি লাঠি দিয়ে আঘাত করছিলেন আর সে যুবক পচাঁ ফল খেয়েই যাচ্ছিল। একদিকে পচাঁ ফল আর অন্যদিকে গলা পর্যন্ত খাওয়া। কাজ যা হবার তাই হলো। অবশেষে যুবকের ভীষণ বমির উদ্রেক হয়। এক পর্যায়ে সে এতক্ষন যা খেয়েছিলো তা বমি করে বের করে দেয়। যুবকের তখনই টনক নড়ে যখন সে দেখতে পায় তার মুখ দিয়ে এক বিষাক্ত সাপ বের হয়ে এসেছে। এ বিষধর সাপ দেখে যুবকের স্বম্বিত ফিরে এলো। সে বুঝতে পারে এত আঘাত , এত কষ্ট ভোগ কি জন্যে ?

এবার সে বলতে লাগলো : আমার কপাল ভালো যে আমি একজন বিদ্বান ও মঙ্গলকামী লোকের হাতে পড়েছিলাম। সবশেষে যুবক সকল কিছু বুঝতে পেরে দরবেশের পা জড়িয়ে ধরে। সে বুঝতে পারলো এ পৃথিবীতে এমন অনেক দুঃখ ও কষ্ট আছে যার কারণে একজন মানুষের জীবন সুখকর হয়ে উঠতে পারে। কেননা এর মাধ্যমে তার অভ্যন্তরীণ বিষাক্ত সাপকে বের করার এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায়।৬৭

(৬৮)

ষ্টেশন , গন্তব্যস্থল নয়

বর্ণিত আছে যে একদিন হযরত ইয়াহ্হিয়া ইবনে মায়াজ আপন প্রভুর ধ্যানে যখন ছিলেন মগ্ন তখন তারই দু জন বন্ধুর আগমনে তার ধ্যান চ্যুতি ঘটে। বন্ধু দু জন পরস্পর বিভিন্ন বিষয়ে অনেক কথা বললেন। হযরত খুব ধৈর্য ধরে তাদের কথা শ্রবন করছিলেন। এক পর্যায়ে তাদের একজন অপরজনকে বলেন : এ দুনিয়া যেহেতু মৃত্যুর সাথে ওতপ্রতভাবে জড়িত তাই এর এক কানা কড়িও মূল্য নেই।

উত্তরে অপরজন বলেন : এ দুনিয়া খুবই আনন্দময় হয়ে উঠতো যদি এর মাঝে মৃত্যু না থাকতো। যখন তাদের কথোপকথন এ পর্যায়ে এসে উপনীত হয় তখন হযরত ইবনে মায়াজ মুখ খুললেন।

তিনি ব ললেন : আমার বন্ধুরা! তোমরা ভুল বলছো। মৃত্যু যদি না থাকতো তাহলে এ দুনিয়ার কোন মূল্যই হতো না।

তারা বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলেন , আমাদেরকে এর কারণ বলে দিন হে মহান!

তখন তিনি বললেনঃ মৃত্যু এমন একটি সেতু বন্ধন যার মাধ্যমে বন্ধু বন্ধুর সাক্ষাতে ধন্য হয়। এটা কী কেউ চায় যে সে আজীবন তার মা শুকের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হোক ? মৃত মানুষের অনুতাপ এটা নয় যে সে কেন মৃত্যুবরণ করেছে। বরং তাদের অনুতাপ হচ্ছে কেন তারা রসদ ছাড়া এসেছে ?! মৃত্যু তোমাকে কুয়া থেকে তুলে উ ন্মুক্ত মরুভূমিতে ছুঁড়ে মারে আর খাঁচা থেকে করে দেয় মু ক্তি।

মৃত্যু যাত্রাপথের শুরু , শেষ নয়। প্রভাত ,সন্ধ্যা নয়। ষ্টেশন , গন্তব্যস্থল নয়। ৬৮

(৬৯)

স্মৃতি ভুলে যেও না

অনেক অনেক দিন আগের কথা। একবার আল্লাহর এই জগতের এক অংশে ঘটেছিলো এক আশ্চর্য ঘটনা। ঘটনাক্রমে কোন এক দেশে এক রাখাল রাজ্যের প্রধান উজিরের পদ লাভ করেন। তখনকার দিনে প্রধান উজিরের পদটির গুরুত্ব আজকের প্রধান মন্ত্রির পদের ন্যায় ছিল। কিন্তু সেই রাখাল দেশের এত উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পদের অধিকারী হওয়া সত্বেও প্রতিদিন নিজের পূর্বের বাড়ীটিতে কিছুক্ষন অবস্থান নিতেন। তিনি নিয়মিত কিছুক্ষন সেখানে কাটিয়ে অবশেষে রাজ দরবারে বাদশাহর হুকুমের অপেক্ষায় থাকতেন। এভাবে তার অনেক দিন কেটে যায়।

একদিনের ঘটনা। সরকারের গুপ্তচররা জনাব উজিরের এ ধরনের কার্যকলাপ বাদশাহর কর্ণগোচর করে। তারা বাদশাহকে বলে : জনাব উজির প্রতিদিন একান্ত গোপনে তার পূর্বের বাড়ীতে কিছুক্ষন নিঃসঙ্গ সময় কাটান। তার এ কাজের ব্যাপারে কেউ কোন কিছু অবগত নয়।

গুপ্তচরদের রিপোর্ট শ্রবন করে বাদশাহর মনে সন্দেহের সৃষ্টি হলো। তিনি স্বয়ং ব্যাপারটি দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। তাই নিত্যদিনের ন্যায় উজির যখন তার পুরাতন বাড়ীতে নিঃসঙ্গ সময় কাটাচ্ছেন তখন অতর্কিতে একদিন তিনি সেই বাড়ীতে ঢুকে পড়েন। উজিরের কক্ষে প্রবেশ করা মাত্রই তার চোখে ধাঁধা লেগে যায়। বাদশাহ নিজের চোখের প্রতি সন্দেহ করতে লাগলো। তিনি যা দেখছেন ঠিক দেখছেন তো ? তিনি উজিরকে দেখতে পেলেন যে , উজির সাহেব রাখালের পোশাক পড়ে লাঠি নিয়ে রাখালের আওয়াজ তুলছেন।

অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলেন বাদশাহ্ : আমি এ কি দেখছি , উজির ?

উজির একেবারে বুঝতেই পারেননি যে এখানে বাদশাহ্ উপস্থিত আছেন। তিনি প্র থমে হতচকিত হয়ে যান। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে উত্তর দিলেনঃ জি , আপনি যা দেখছেন ঠিকই দেখছেন। আমি এখানে প্রতিদিন আসি। যেন আমার জীবনের শুরুর কথা ভুলে না যাই এবং কাজে কর্মে ভুল না করে বসি। কেননা যে তার জীবনের দূর্বল সময়গুলোর স্মৃতি মনে রাখে শক্তিমত্তার সময়ে অহংকার তাকে আক্রমন করতে পারে না। ”

বাদশাহ্ তার উজিরের এমন প্রজ্ঞাময় কথা শুনে একেবারে থ ’ হয়ে গেলেন।৬৯