বার ইমামের সংক্ষিপ্ত জীবনী

বার ইমামের সংক্ষিপ্ত জীবনী0%

বার ইমামের সংক্ষিপ্ত জীবনী লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ইমামত

বার ইমামের সংক্ষিপ্ত জীবনী

লেখক: আল্লামা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হুসাইন তাবাতাবাঈ
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 16996
ডাউনলোড: 3053

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 9 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16996 / ডাউনলোড: 3053
সাইজ সাইজ সাইজ
বার ইমামের সংক্ষিপ্ত জীবনী

বার ইমামের সংক্ষিপ্ত জীবনী

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

প্রথম ইমাম

আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)

আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-ই সর্বপ্রথম ইমাম । তিনি মহানবী (সা.) এর চাচা এবং বনি হাশিম গোত্রের নেতা জনাব আবু তালিবের সন্তান ছিলেন । আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর এই চাচাই শৈশবেও তার অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছিলেন । তিনি নিজের ঘরে মহানবী (সা.)-কে আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং লালন পালনের মাধ্যমে তাকে বড় করেছিলেন । মহানবী (সা.)এর নবুয়ত প্রাপ্তির ঘোষণার পর থেকে নিয়ে যত দিন তিনি (আবু তালিব) জীবিত ছিলেন , মহানবী (সা.)-কে সার্বিক সহযোগিতা ও সমর্থন করেছিলেন । তিনি সবসময়ই মহানবী (সা.)-কে কাফেরদের , বিশেষ করে কুরাইশদের সার্বিক অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেছেন । হযরত ইমাম আলী (আ.) (প্রশিদ্ধ মতানুযায়ী) মহানবী (সা.)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির ঘোষণার প্রায় দশ বছর পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেন । হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর জন্মের প্রায় ছ বছর পর মক্কায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল । মহানবী (সা.)-এর আবেদনক্রমে ঐসময় হযরত আলী (আ.) বাবার বাড়ী থেকে মহানবী (সা.)-এর বাড়িতে স্থানান্তরিত হন । তারপর থেকে হযরত ইমাম আলী (আ.) সরাসরি মহানবী (সা.)-এর অভিভাবকত্ব ও তত্বাবধানে তাঁর কাছে লালিত পালিত ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হন । মহানবী (সা.) হেরা গুহায় অবস্থানকালে তার কাছে সর্বপ্রথম আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী বা ঐশীবাণী অবতির্ণ হয় । যার ফলে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন । এরপর হেরা গুহা থেকে বের হয়ে মহানবী (সা.) নিজ গৃহে যাওয়ার পথে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে তার সাক্ষাত ঘটে এবং তিনি তার কাছে সব ঘটনা খুলে বলেন । হযরত ইমাম আলী (আ.) সাথে সাথেই মহানবী (সা.)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন । অতঃপর নিকট আত্মীয়দেরকে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানানোর উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) তাদের সবাইকে নিজ বাড়িতে খাওয়ার আমন্ত্রন জানিয়ে সমবেত করেন । ঐ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সবার প্রতি লক্ষ্য করে মহানবী (সা.) বলেছিলেন যে , আপনাদের মধ্যে যে সর্বপ্রথম আমার আহবানে (ইসলাম গ্রহণে) সাড়া দেবে , সেই হবে আমার খলিফা , উত্তরাধিকারী এবং প্রতিনিধি । কিন্তু উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে একমাত্র যে ব্যক্তিটি সর্বপ্রথম উঠে দাড়িয়ে সেদিন বিশ্বনবী (সা.)-এর আহবানে সাড়া দিয়েছিল এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল তিনিই হচ্ছেন হযরত ইমাম আলী (আ.) । আর বিশ ্বনবী (সা.) সেদিন (তার প্রতি) হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর ঈমানকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং স্বঘোষিত প্রতিশ্রুতিও তিনি তার ব্যাপারে পালন করেছিলেন । এভাবে হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই ছিলেন সর্বপ্রথম মুসলিম । আর তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি , যিনি কখনই মূর্তি পুজা করেননি । মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় গমনের পূর্ব পর্যন্ত হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই ছিলেন মহানবী (সা.)-এর নিত্যসঙ্গী । মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনা গমনের রাতে হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই মহানবী (সা.) এর বিছানায় শুয়ে ছিলেন । ঐ রাতেই কাফেররা মহানবী (সা.) এর বাড়ী ঘেরাও করে শেষরাতের অন্ধকারে মহানবী (সা.)-কে বিছানায় শায়িত অবস্থায় হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল । মহানবী (সা.) কাফেরদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হবার পূর্বে ই গৃহত্যাগ করে মদীনার পথে পাড়ি দিয়েছিলেন । এরপর হযরত ইমাম আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী তার কাছে গচ্ছিত জনগণের আমানতের মালা- মাল তাদের মালিকদের কাছে পৌছে দেন । তারপর তিনিও নিজের মা , নবী কন্যা হযরত ফাতিমা (আ.) ও অন্য দু জন স্ত্রীলাক সহ মদীনার পথে পাড়ি দেন । এমনকি মদীনাতেও হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই ছিলেন মহানবী (সা.)-এর নিত্যসঙ্গী । নির্জনে অথবা জনসমক্ষে তথা কোন অবস্থাতেই মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে নিজের কাছ থেকে দূরে রাখেননি । তিনি স্বীয় কন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-কেও হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর কাছেই বিয়ে দেন । সাহাবীদের উপস্থিতিতে মহানবী (সা.) , হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপনের ঘোষণা দেন । একমাত্র তাবুকের যুদ্ধ ছাড়া বিশ্বনবী (সা.) (স্বীয় জীবদ্দশায়) যত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন , হযরত ইমাম আলী (আ.)-ও সেসব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন । তাবুকের যুদ্ধে যাওয়ার সময় বিশ্বনবী (সা.) হযরত ইমাম আলী (আ.)- কে মদীনায় তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন । এ ছাড়াও হযরত ইমাম আলী (আ.) কোন যুদ্ধেই আদৌ পিছপা হননি । জীবনে কোন শত্রুর মোকাবিলায় তিনি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেননি । তিনি জীবনে কখনোই মহানবী (সা.)-এর আদেশের অবাধ্যতা করেননি । তাই তার সম্পর্কে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন যে , আলী কখনই সত্য থেকে অথবা সত্য আলী থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না । বিশ্বনবী (সা.)-এর মৃত্যুর সময় হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বয়স ছিল প্রায় তেত্রিশ বছর । বিশ্বনবী (সা.)-এর সকল সাহাবীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ এবং ইসলামের সকল মহত গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন তিনিই । সাহাবীদের মধ্যে হযরত ইমাম আলী (আ.) বয়সের দিক থেকে ছিলেন অপেক্ষাকৃত তরুণ । আর ইতিপূর্বে বিশ্বনবী (আ.)-এর পাশাপাশি অংশগ্রহণকৃত যুদ্ধসমুহে যে রক্তপাত ঘটেছিল , সে কারণে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর প্রতি অনেকেই শত্রুতা পোষণ করত । এসব কারণেই বিশ্বনবী (সা.)-এর পরলোক গমনের পর হযরত আলী (আ.)-কে খেলাফতের পদাধিকার লাভ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল । আর এর মাধ্যমে সকল রাষ্ট্রিয় কাজ থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন । তাই বাধ্য হয়ে তখন তিনি নিরালায় জীবন যাপন করতে শুরু করেন এবং ব্যক্তি প্রশিক্ষণের কাজে নিজেকে ব্যপৃত করেন । মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর প্রায় ২৫ বছর পর তিনজন খলিফার শাসনামল শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি এভাবেই জীবন যাপন করতে থাকেন । তারপর তৃতীয় খলিফা নিহত হবার পর জনগণ হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর কাছে বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করেন এবং তাকে খেলাফতের পদে অধিষ্ঠিত করেন ।

হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতকাল ছিল প্রায় ৪ বছর ৯ মাস । তিনি তার এই খেলাফতের শাসন আমলে সম্পূর্ণরূপে মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করেন । তিনি তার খেলাফতকে আন্দোলনমুখী এক বিপ্লবীরূপ প্রদান করে ছিলেন । তিনি তার শাসন আমলে ব্যাপক সংস্কার সাধান করেন । অবশ্য ইমাম আলী (আ.)-এর ঐসব সংস্কারমূলক কর্মসূচী বেশকিছু সুবিধাবাদী ও স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির ক্ষতির কারণ ঘটিয়ে ছিল । এ কারণে উম্মুল মু মিনীন আয়শা , তালহা , যুবাইর ও মুয়াবিয়ার নেতৃত্বে বেশকিছু সংখ্যক সাহাবী হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন । তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের দাবীর শ্লোগানকে তারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে একটি মোক্ষম রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার করে । আর তারা ইসলামী রাজ্যের সর্বত্র বিদ্রোহের আগুন প্রজ্জলিত করার মাধ্যমে এক ব্যাপক রাজনৈতিক অরাজকতার সৃষ্টি করে । যার ফলে উদ্ভুত ফিৎনা ও অরাজকতা দমনের জন্যে বসরার সন্নিকটে ইমাম আলী (আ.) নবীপ্রত্নি আয়শা , তালহা , ও যুবায়েরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতির্ণ হতে বাধ্য হন । ইসলামী ইতিহাসের ঐ যুদ্ধটিই জঙ্গে জামাল নামে পরিচিত । এ ছাড়াও ইরাক ও সিরিয়া সীমান্তে অনুরূপ কারণে মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে হযরত ইমাম আলী (আ.) সিফফিন নামক আরও একটি যুদ্ধে অবতির্ণ হতে বাধ্য হন । সিফফিন নামক ঐ যুদ্ধ দীর্ঘ দেড় বছর যাবৎ অব্যাহত ছিল । ঐ যুদ্ধ শেষ না হতেই নাহরাওয়ান নামক স্থানে খাওয়ারেজ (ইসলাম থেকে বহিস্কৃত) নামক বিদ্রোহিদের বিরুদ্ধে আরেকটি যুদ্ধ লিপ্ত হতে হয় । ঐ যুদ্ধিটি ইতিহাসে নাহরাওয়ানের যুদ্ধ নামে পরিচিত । এভাবে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সমগ্র খেলাফতকালই আভ্যন্তরীণ মতভেদ জনিত সমস্যা সমাধানের মধ্যেই অতিক্রান্ত হয় । এর কিছুদিন পরই ৪০ হিজরীর রমযান মাসের ১৯ তারিখে কুফার মসজিদে ফজরের নামাযের ইমামতি করার সময় জনৈক খারেজির তলোয়ারের আঘাতে তিনি আহত হন । অতঃপর ২০শে রমযান দিবাগত রাতে তিনি শাহাদত বরণ করেন । ইতিহাসের সাক্ষ্য এবং শত্রু ও মিত্র , উভয়পক্ষের স্বীকারোক্তি অনুসারে মানবীয় গুণাবলীর দিক থেকে আমিরুল মু মিনীন হযরত ইমাম আলী (আ.) ছিলেন সর্বশেষ্ঠ এবং এ ব্যাপারে সামান্যতম ক্রটির অস্তিত্বও তার চরিত্রে ছিল না । আর ইসলামে মহত গুণাবলীর দিক থেকে তিনি ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)-এর আদর্শের এক পূর্ণাঙ্গ প্রতিভু ।

ইমাম আলী (আ.)-এর মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এ যাবৎ যত আলোচনা হয়েছে এবং শীয়া , সুন্নী , জ্ঞানী গুণী ও গবেষকগণ যে পরিমাণ গ্রন্থাবলী তার সম্পর্কে আজ পর্যন্ত রচনা করেছেন , ইতিহাসে এমনটি আর অন্য কারও ক্ষেত্রেই ঘটেনি । হযরত ইমাম আলী (আ.) ছিলেন সকল মুসলমান এবং বিশ্বনবী (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানীব্যক্তি । ইসলামের ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি , যিনি তার অগাধ জ্ঞানগর্ভ বর্ণনার মাধ্যমে ইসলামে যুক্তিভিত্তিক প্রমাণ পদ্ধতির গোড়াপত্তন করেন । এভাবে তিনিই সর্বপ্রথম ইসলামী জ্ঞান ভান্ডারে দর্শন চর্চার মাত্রা যোগ্য করেন । তিনিই কুরআনের জটিল ও রহস্যপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাখা করেন । কুরআনের বাহ্যিক শব্দাবলীকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষার জন্যে তিনি আরবী ভাষার ব্যাকরণ শাস্ত্র রচনা করেন । (এ বইয়ের প্রথম অধ্যায়েও এ সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে) বীরত্বের ক্ষেত্রেও হযরত আলী (আ.) ছিলেন মানবজাতির জন্য প্রতীক স্বরূপ । বিশ্বনবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় এবং তার পরেও জীবনে যত যুদ্ধেই তিনি অংশগ্রহণ করেছেন , কখনোই তাকে ভীত-সন্ত্রস্ত হতে বা মানসিক অস্থিরতায় ভূগতে দেখা যায়নি । এমনকি ওহুদ , হুনাইন , খান্দাক এবং খাইবারের মত কঠিন যুদ্ধগুলো যখন মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের অন্তরাত্মা কাপিয়ে দিয়েছিল এবং সাহাবীরা যুদ্ধক্ষেত্রে ছত্রভঙ্গ হয়ে ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন , সেই কঠিন মূহুর্তগুলোতেও হযরত ইমাম আলী (আ.) কখনোই শত্রুদের সম্মুখে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেননি । ইতিহাসে এমন একটি ঘটনাও খুজে পাওয়া যাবে না , যেখানে কোন খ্যাতিমান বীর যোদ্ধা ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নিরাপদে নিজের প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছে । তিনি এমন মহাবীর হওয়া সত্ত্বেও কখনও কোন দূর্বল লোককে হত্যা করেননি এবং তার নিকট থেকে পালিয়ে যাওয়া (প্রাণ ভয়ে) ব্যক্তির পিছু ধাওয়া করেননি । তিনি কখনোই রাতের আধারে শত্রুর উপর অতর্কিত আক্রমন চালাননি । শত্রুপক্ষের জন্য পানি সরবরাহ কখনোই তিনি বন্ধ করেননি । এটা ইতিহাসের একটি সর্বজন স্বীকৃত ঘটনা যে , ইমাম আলী (আ.) খাইবারের যুদ্ধে শত্রুপক্ষের দূর্গম দূর্গের বিশাল লৌহ তোরণটি তাঁর হাতের সামান্য ধাক্কার মাধ্যমে সম্পূর্ণ রূপে উপড়ে ফেলেছিলেন ।১০

একইভাবে মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে ইমাম আলী (আ.) কা বা ঘরের মূর্তি গুলো ধ্বংস করেন । আকিক পাথরের তৈরী হাবল নামক মক্কার সর্ববৃহৎ মূর্তিটি কা বা ঘরের ছাদে স্থাপিত ছিল । ইমাম আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর কাধে পা রেখে কা বা ঘরের ছাদে উঠে একাই বৃহাদাকার মূর্তিটির মূলোৎপাটন করে নীচে নিক্ষেপ করেন ।১১

খোদাভীতি ও আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে ইমাম আলী (আ.) ছিলেন অনন্য । জনৈক ব্যক্তির প্রতি ইমাম আলী (আ.)-এর রূঢ় ব্যবহারের অভিযোগের উত্তরে মহানবী (সা.) তাকে বলেছিলেন যে , আলীকে তিরস্কার করো না । কেননা সে তো আল্লাহর প্রেমিক ।১২ একবার রাসূল (সা.)-এর সাহাবী হযরত আবু দারদা (রা.) কোন এক খেজর বাগানে ইমাম আলী (আ.)-এর দেহকে শুষ্ক ও নিঃষ্প্রাণ কাঠের মত পড়ে থাকতে দেখেন । তাই সাথে সাথে নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-এর কাছে তার স্বামীর মৃত্যু সংবাদ পৌছালেন এবং নিজের পক্ষ থেকে শোকও জ্ঞাপন করেন । কিন্তু ঐ সংবাদ শুনে হযরত ফাতিমা (আ.) বললেন : না , আমার স্বামী মৃত্যু বরণ করেননি । বরং ইবাদত করার সময় আল্লাহর ভয়ে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছেন । আর এ অবস্থা তার ক্ষেত্রে বহু বারই ঘটেছে । অধীনস্থদের প্রতি দয়াশীলতা , অসহায় ও নিঃস্বদের প্রতি ব্যথিত হওয়া এবং দরিদ্র ও অভাবীদের প্রতি পরম উদারতার ব্যাপার ইমাম আলী (আ.)-এর জীবনে অসংখ্য ঘটনার অস্তিত্ব বিদ্যমান । ইমাম আলী (আ.) যা-ই উপার্জন করতেন , তাই অসহায় ও দরিদ্রদেরকে সাহায্যের মাধ্যমে আল্লাহর পথে দান করতেন । আর তিনি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সহজ সরল ও কষ্টপূর্ণ জীবন যাপন করতেন । ইমাম আলী (আ.) কৃষি কাজকে পছন্দ করতেন । তিনি সাধারণতঃ পানির নালা কেটে সেচের ব্যবস্থা করতেন । বৃক্ষ রোপণ করতেন । চাষের মাধ্যমে মৃত জমি আবাদ করতেন । কিন্তু পানি সেচের নালা ও আবাদকৃত সব জমিই তিনি দরিদ্রদের জন্যে ওয়াকফ (দান) করতেন । হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর পক্ষ থেকে দরিদ্রদের জন্যে ওয়াকফ কৃত ঐসব সম্পত্তির বার্ষিক গড় আয়ের পরিমাণ ২৪ হাজার সোনার দিনারের সমতুল্য ছিল । তার ঐসব ওয়াকফ্ কৃত সম্পত্তি আলী (আ.)-এর সাদ্কা নামে খ্যাত ছিল ।১৩

দ্বিতীয় ইমাম

হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.)

হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.) ছিলেন দ্বিতীয় ইমাম । তিনি আমিরুল মু মিনীন হযরত ইমাম আলী (আ.) এবং নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-এর প্রথম সন্তান এবং তৃতীয় ইমাম হযরত হুসাইন (আ.) এর ভাই ছিলেন । মহানবী (সা.) অসংখ্যবার বলেছেন : হাসান ও হুসাইন আমারই সন্তান । এমনকি হযরত ইমাম আলী (আ.) তার সকল সন্তানদের প্রতি লক্ষ্য করে একই কথার পুনারুক্তি করেছিলেন । তিনি বলেছেনঃ তোমরা আমার সন্তান এবং হাসান ও হুসাইন আল্লাহর নবীর সন্তান ।১৪ হযরত ইমাম হাসান (আ.) হিজরী ৩য় সনে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন ।১৫ তিনি প্রায় সাত বছরেরও কিছু বেশী সময় মহানবী (সা.)-এর সাহচর্য লাভ করতে সক্ষম হন । তিনি বিশ্বনবী (সা.)-এর মৃত্যুর প্রায় তিন বা ছয় মাস পর যখন নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.) পরলোক গমন করেন , তখন তিনি তার মহান পিতা হযরত আলী (আ.)-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হতে থাকেন । পিতার শাহাদতের পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পিতার ওসিয়াত অনুযায়ী তিনি ইমামতের পদে আসীন হন । অতঃপর তিনি প্রকাশ্যে খেলাফতের পদাধিকারীও হন । প্রায় ৬মাস যাবৎ তিনি খলিফা হিসেবে মুসলমানদের রাষ্ট্রিয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন । কিন্তু মুয়াবিয়া ছিলেন নবীবংশের চরম ও চিরশত্রু । ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় খেলাফতের মসনদ অধিকারের লাভে ইতিপূর্বে বহু যুদ্ধের সূত্রপাত সে ঘটিয়ে ছিল (প্রথমত : ৩য় খলিফার রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের ছলনাময়ী রাজনৈতিক শ্লোগানের ধোয়া তুলে এবং পরবর্তীতে সরাসরি খলিফা হওয়ার দাবী করে) । তখন ইরাক ছিল হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর খেলাফতের রাজধানী । মুয়াবিয়া হযরত ইমাম হাসান (আ.)-কে কেন্দ্রীয় খেলাফতের পদ থেকে অপসারণের লক্ষ্যে ইরাক সীমান্তে সেনাবাহিনী প্রেরণ করে । একইসাথে বিপুল পরিমাণ অর্থের ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে গোপনে ইমাম হাসান (আ.)-এর সেনাবাহিনীর বহু অফিসারকে ক্রয় করে । এমনকি ঘুষ ছাড়াও অসংখ্য প্রতারণামূলক লোভনীয় প্রতিশ্রুতি প্রদানের মাধ্যমে মুয়াবিয়া , ইমাম হাসান (আ.)-এর সেনাবাহিনীকে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘটাতে সক্ষম হয় ।১৬

যার পরিণামে হযরত ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন । উক্ত চুক্তি অনুসারে হযরত ইমাম হাসান (আ.) প্রকাশ্যে খেলাফতের পদত্যাগ করতে বাধ্য হন । চুক্তির শর্ত অনুসারে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পরপরই হযরত ইমাম হাসান (আ.) পুনরায় খলিফা হবেন এবং খেলাফতের পদ নবীবংশের নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে । আর এই অন্তর্বর্তী কালীন সময়ে মুয়াবিয়া শীয়াদের যে কোন প্রকারের রাষ্ট্রিয় নিপীড়ন থেকে বিরত থাকবে ।১৭ আর এভাবেই মুয়াবিয়া কেন্দ্রীয় খেলাফতের পদ দখল করতে সমর্থ হয় এবং ইরাকে প্রবেশ করে । কিন্তু ইরাকে প্রবেশ করে সে এক জনসভার আযোজন করে । ঐ জনসভায় প্রকাশ্যভাবে জনসমক্ষে সে ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে ইতিপূর্বে সম্পাদিত চুক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পূর্ণ বাতিল বলে ঘোষণা করে ।১৮ আর তখন থেকেই সে পবিত্র আহলে বাইত (নবীবংশ) ও তাদের অনুসারী শীয়াদের উপর সর্বাত্মক অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাতে শুরু করে । হযরত ইমাম হাসান (আ.) তার দীর্ঘ দশ বছর সময়কালীন ইমামতের যুগে শাসকগোষ্ঠির পক্ষ থেকে সৃষ্ট প্রচন্ড চাপের মুখে এক শ্বাসরূদ্ধকর পরিবেশে জীবন যাপন করতে বাধ্য হন । এমনকি নিজের ঘরের মধ্যকার নিরাপত্তাও তিনি হারাতে বাধ্য হন । অবশেষে হিজরী ৫০সনে মুয়াবিয়ার ষড়যন্তে ইমাম হাসান (আ.) জনৈকা স্ত্রীর দ্বারা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।১৯ মানবীয় গুণাবলীর শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে হযরত ইমাম হাসান (আ.) ছিলেন স্বীয় পিতা ইমাম আলী (আ.) এর স্মৃতিচিহ্ন এবং স্বীয় মাতামহ মহানবী (সা.)-এর প্রতিভু । মহানবী (সা.) যতদিন জীবিত ছিলেন , হযরত ইমাম হাসান (আ.) ও হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) সবসময়ই তাঁর সাথে থাকতেন । এমনকি মহানবী (সা.) প্রায়ই তাদেরকে নিজের কাধেও চড়াতেন ।

শীয়া ও সুন্নী উভয় সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীসে মহানবী (সা.) বলেছেন : আমার এই দু সন্তানই (ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন) ইমাম , তারা আন্দোলন করুকু অথবা না করুক , সব অবস্থাতেই তারা ইমাম (এখানে আন্দোলন বলতে প্রকাশ্যে খেলাফতের অধিকারী হওয়া বা না হওয়ার প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে)২০ । এ ছাড়া হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর ইমামতের পদাধিকার লাভ সম্পর্কে মহানবী (সা.) এবং হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর পক্ষ থেকে অসংখ্য হাদীস বিদ্যমান রয়েছে ।

তৃতীয় ইমাম

হযরত ইমাম হুসাইন ( আ )

শহীদকূলশিরোমণি হযরত ইমাম হুসাইন ( আ ) ছিলেন হযরত ইমাম আলী ( আ ) ও হযরত ফাতিমা ( আ ) - এর দ্বিতীয় সন্তান । তিনি চতুর্থ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন । বড় ভাই হযরত ইমাম হাসানের শাহাদতের পর তিনি মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং ইমাম হাসান ( আ ) - এর ওসিয়ত ক্রমে ৩য় ইমাম হিসেবে মনোনীত হন ।২১ হযরত ইমাম হুসাইন ( আ ) - এর ইমামতকাল ছিল দশ বছর । তার ইমামতের শেষ ৬মাস ছাড়া বাকী সমগ্র ইমামতকালই মুয়াবিয়ার খেলাফতের যুগেই কেটেছিল । তার ইমামতের পুরা সময়টাতেই তিনি অত্যন্ত কঠিন দূরযোগপূর্ণ ও শ্বাসরূদ্ধকর পরিবেশে জীবন যাপন করেন । কারণ , ঐযুগে ইসলামী আইন - কানুন মর্যাদাহীন হয়ে পড়েছিল । তখন খলিফার ব্যক্তিগত ইচ্ছাই আল্লাহ ও তার রাসূল ( সা ) - এর ইচ্ছার স্থলাভিষিক্ত হয়ে পড়ে । মুয়াবিয়া ও তার সঙ্গীসাথীরা পবিত্র আহলে বাইতগণ ( আ ) ও শীয়াদের ধ্বংস করা এবং ইমাম আলী ( আ ) ও তার বংশের নাম নিশ্চিহ্ন করার জন্যে এমন কোন প্রকার কর্মসূচী নেই যা অবলম্বন করেনি । শুধু তাই নয় মুয়াবিয়া স্বীয় পুত্র ইয়াযিদকে তার পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনীত করার মাধ্যমে স্বীয় ক্ষমতার ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে । কিন্তু ইয়াযিদের চরিত্রহীনতার কারণে একদল লোক তার প্রতি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিল । তাই মুয়াবিয়া এ ধরণের বিরোধীতা রোধের জন্যে অত্যন্ত কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করে । ইচ্ছাকৃতভাবে হোক আর অনিচ্ছাকৃত ভাবেই হোক , হযরত ইমাম হুসাইন ( আ ) - কে এক অন্ধকারাচ্ছান্ন দূর্দিন কাটাতে হয়েছে । মুয়াবিয়া ও তার অনুচরদের পক্ষ থেকে সর্বপ্রকার মানসিক অত্যাচার তাকে নিরবে সহ্য করতে হয়েছিল । অবশেষে হিজরী ৬০ সনের মাঝামাঝি সময়ে মুয়াবিয়া মৃত্যু বরণ করে । তার মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র ইয়াযিদ তার স্থলাভিষিক্ত হয় ।২২ সে যুগে বাইয়াত (আনুগত্য প্রকাশের শপথ গ্রহণ ) ব্যবস্থা আরবদের মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রথা হিসেবে প্রচলিত ছিল । বিশেষ করে রাষ্ট্রিয়কার্য পরিচালনার দায়িত্বে নিযুক্তির মত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে বাইয়াত গ্রহণ করা হত । বিশেষ করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের পক্ষ থেকে রাজা বাদশা বা খলিফার প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশের জন্যে অবশ্যই বাইয়াত গ্রহণ করা হত । বাইয়াত প্রদানের পর তার বিরোধীতা করা বিরোধী ব্যক্তির জাতির জন্যে অত্যন্ত লজ্জাকর ও কলঙ্কের বিষয় হিসেবে গণ্য করা হত । এমনকি মহানবী ( সা ) - এর জীবনাদর্শে ও স্বাধীন ও ঐচ্ছিকভাবে প্রদত্ত বাইয়াতে র নির্ভরযোগ্যতার অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল । মুয়াবিয়াও তার জাতীয় প্রথা অনুযায়ী তার পরবর্তী খলিফা হিসেবে জনগণের কাছ থেকে স্বীয়পুত্র ইয়াযিদের জন্যে বাইয়াত সংগ্রহ করে । কিন্তু মুয়াবিয়া এ ব্যাপারে ইমাম হুসাইন ( আ ) - এর বাইয়াত গ্রহণের ব্যাপারে তাকে কোন প্রকার চাপ প্রয়োগ করেনি । শুধু তাই নয় , মৃত্যুর পূর্বে সে ইয়াযিদকে বিশেষভাবে ওসিয়াত করে গিয়েছিল২৩ যে , ইমাম হুসাইন ( আ ) যদি তার ( ইয়াযিদ ) আনুগত্য স্বীকার ( বাইয়াত ) না করে , তাহলে সে ( ইয়াযিদ ) যেন এ নিয়ে আর বেশী বাড়াবাড়ি না করে । বরং নীরব থেকে এ ব্যাপারটা যেন সে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে । কারণঃ মুয়াবিয়া এ ব্যাপারে আদ্যোপান্ত চিন্তা করে এর দুঃসহ পরিণাম সম্পর্কে উপলদ্ধি করতে পরেছিল ।

কিন্তু ইয়াযিদ তার চরম অহংকার ও দুঃসাহসের ফলে পিতার ওসিয়তের কথা ভুলে বসল । তাই পিতার মৃত্যুর পর পরই সে মদীনার গভর্ণরকে তার (ইয়াযিদ) পক্ষ থেকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহণের নির্দেশ দিল । শুধু তাই নয় , ইমাম হুসাইন (আ.) যদি বাইয়াত প্রদান অস্বীকৃতি জানায় , তাহলে তৎক্ষণাৎ তার কর্তিত মস্তক দামেস্কে পাঠানোর জন্যেও মদীনার গভর্ণরের কাছে কড়া নির্দেশ পাঠানো হয় ।২৪

মদীনার প্রশাসক হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে যথা সময়ে ইয়াযিদের নির্দেশ সম্পর্কে অবহিত করেন । ইমাম হুসাইন (আ.) ঐ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে দেখার জন্যে কিছু অবসর চেয়ে নিলেন । আর ঐ রাতেই তিনি স্বপরিবারে মক্কার উদ্দেশ্যে মদীনা নগরী ত্যাগ করেন ।

মহান আল্লাহ ঘোষিত মক্কার হারাম শরীফের নিরাপত্তার বিধান অনুযায়ী তিনি সেখানে আশ্রয় নেন । সময়টা ছিল হিজরী ৬০ সনে রজব মাসের শেষ ও শা বান মাসের প্রথম দিকে । ইমাম হুসাইন (আ.) প্রায় চার মাস যাবৎ মক্কায় আশ্রিত অবস্থায় কাটান । আর ধীরে ধীরে এ সংবাদ তদানিন্তন ইসলামী বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে । মুয়াবিয়ার অত্যাচারমূলক ও অবৈধ শাসনে ক্ষিপ্ত অসংখ্য মুসলমান ইয়াযিদের এহেন কার্যকলাপে আরও অসন্তুষ্ট ও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল । তারা সবাই ইমাম হুসাইন (আ.)-এর প্রতি নিজেদের সহমর্মিতা প্রকাশ করল । পাশাপাশি ইরাকের বিভিন্ন শহর থেকে , বিশেষ করে ইরাকের কুফা শহর থেকে সেখানে গমনের আমন্ত্রনমূলক চিঠির বন্যা মক্কায় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাছে প্রবাহিত হতে লাগলো । ঐসব চিঠির বক্তব্য ছিল একটাই আর তা হল , ইমাম হুসাইন (আ.) যেন অনুগ্রহ পূর্বক ইরাকে গিয়ে সেখানকার জনগণের নেতৃত্বের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন এবং অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ব্যাপারে যেন তাদের নেতৃত্ব প্রদান করেন । এ বিষয়টি ইয়াযিদের জন্যে অবশ্যই অত্যন্ত বিপদজনক ব্যাপার ছিল । মক্কায় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর অবস্থান হজ্জ মৌসুম শুরু হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে । সারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে মুসলমানরা দলে দলে হজ্জ উপলক্ষ্যে মক্কায় সমবেত হতে লাগল । হাজীরা সবাই হজ্জপর্ব সম্পূর্ণের জন্যে পস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে । ইতিমধ্যে গোপন সূত্রে ইমাম হুসাইন (আ.) অবগত হলেন যে , ইয়াযিদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু অনুচর হাজীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করেছে । ইহরামের কাপড়ের ভতর তারা অস্ত্র বহন করছে । তারা হজ্জ চলাকালীন সময়ে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে তাদের ইহরামের কাপড়ের ভেতর লুকানো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করবে ।২৫

ইমাম হুসাইন (আ.) ইয়াযিদের গোপন ষড়যন্ত্রের ব্যাপার টের পেয়ে স্বীয় কর্মসূচী সংক্ষিপ্ত করে মক্কা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন । এ সিদ্ধান্তের পর হজ্জ উপলক্ষ্যে আগত বিশাল জনগোষ্ঠীর সামনে তিনি সংক্ষিপ্ত এক বক্তব্য পেশ করেন ।২৬ ঐ বক্তব্যে তিনি ইরাকের পথে যাত্রা করার ব্যাপারে নিজ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন । একই সাথে তার আসন্ন শাহাদত প্রাপ্তির কথাও তিনি ঐ জনসভায় ব্যক্ত করেন । আর তাকে ঐ মহান লক্ষ্যে (অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ) সহযোগিতা করার জন্যে উপস্থিত মুসলমানদেরকে আহবান্ জানান । উক্ত বক্তব্যের পরপরই তিনি কিছু সংখ্যক সহযোগীসহ স্বপরিবারে ইরাকের পথে যাত্রা করেন ।

হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) কোন ক্রমেই ইয়াযিদের কাছে বাইয়াত প্রদান না করার জন্যে সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত নেন । তিনি ভাল করেই জানতেন যে , এ জন্যে তাকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে । তিনি এটাও জানতেন যে , বনি উমাইয়াদের বিশাল ও ভয়ংকার যোদ্ধা বাহিনীর দ্বারা তাকে সম্পূর্ণ রূপে নিশ্চিহ্ন করা হবে । অথচ , ইয়াযিদের ঐ বাহিনী ছিল সাধারণ মুসলমানদের , বিশেষ করে ইরাকী জনগণেরই সমর্থনপুষ্ট । কেননা , সে যুগের সাধারণ মুসলমানদের বেশীর ভাগই গণদূর্নীতি , সিদ্ধান্ত গ্রহণে দুর্বলতা এবং চিন্তা ও চেতনাগত অধঃপতনে নিমজ্জিত ছিল ।

শুধুমাত্র সে যুগের অল্প ক জন গণ্যমান্য ব্যক্তি হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জ্ঞভাকাংখী হিসাবে ইরাক অভিমুখে যাত্রার ব্যাপারে তাকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন । তারা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ঐ যাত্রা ও আন্দোলনের বিপজ্জনক পরিণতির কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দেন । কিন্তু তাদের প্রতিবাদের উত্তরে ইমাম হুসাইন (আ.) বলেন , আমি কোন অবস্থাতেই ইয়াযিদের বশ্যতা শিকার করব না । অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠিকে আমি কোন ক্রমেই সমর্থন করব না । আমি যেখানেই যাই না কেন , অথবা যেখানেই থাকি না কেন , তারা আমাকে হত্যা করবেই । আমি এ মূহুর্তে মক্কা নগরী এ কারণেই ত্যাগ করছি যে , রক্তপাত ঘটার মাধ্যমে আল্লাহর ঘরের পবিত্রতা যেন ক্ষুন্ন না হয় ।২৭

অতঃপর ইমাম হুসাইন (আ.) ইরাকের কুফা শহরের অভিমুখে রওনা হন । কুফা শহরে পৌছাতে তখনও বেশ ক দিনের পথ বাকী ছিল । এমন সময় পথিমধ্যে তার কাছে খবর পৌছাল যে , ইয়াযিদের পক্ষ থেকে নিযুক্ত কুফার প্রশাসক ইমাম হুসাইন (আ.)-এর প্রেরিত বিশেষ প্রতিনিধিকে হত্যা করেছে । একই সাথে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জনৈক জোরালো সমর্থক এবং কুফা শহরের একজন বিখ্যাত ব্যক্তিকেও হত্যা করা হয়েছে । এমনকি হত্যার পর তাদের পায়ে রশি বেধে কুফা শহরের সকল বাজার এবং অলি গলিতে টেনে হিছড়ে বেড়ানো হয়েছে ।২৮ এছাড়াও সমগ্র কুফা শহর ও তার পার্শ্বস্থ এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে । অসংখ্য শত্রু সৈন্য ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আগমনের প্রতিক্ষায় দিন কাটাচ্ছে । সুতরাং শত্রু হস্তে নিহত হওয়া ছাড়া ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জন্যে আর কোন পথই বাকী রইল না । তখন সবকিছু জানার পর ইমাম সুদৃঢ় ও দ্বিধাহীনভাবে শাহাদত বরণের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং কুফা র পথে যাত্রা অব্যাহত রাখলেন ।২৯

কুফা পৌছার প্রায় ৭০ কিঃ মিঃ পূর্বে কারবালা নামক মরুভুমিতে ইমাম পৌছলেন । তখনই ইয়াযিদের সেনাবাহিনী ইমাম হুসাইন (আ.)-কে ঐ মরু প্রান্তরে ঘেরাও করে ফেললো । ইয়াযিদ বাহিনী আটদিন পর্যন্ত ইমাম হুসাইন (আ.) ও তার সহচরদের সেখানে ঘেরাও করে রাখল । প্রতিদিনই তাদের ঘেরাওকৃত বৃত্তের পরিসীমা সংকীর্ণ হতে থাকে । আর শত্রু সৈন্য ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে লাগল । অবশেষে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) তার স্বীয় পরিবারবর্গ ও অতি নগণ্য সংখ্যক সহচরসহ তিরিশ হাজার যুদ্ধাংদেহী সেনাবাহিনীর মাঝে ঘেরাও হলেন ।৩০ হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) আটকাবস্থায় ঐ দিনগুলোতে স্বীয় অবস্থান সুদৃঢ় করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন । নিজের সহচরদের মধ্যে শুদ্ধিঅভিযান চালান । রাতের বেলা তার সকল সঙ্গীদেরকে বৈঠকে সমবেত করেন । ঐ বৈঠকে সমবেতদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি বলেন : মৃত্যু ও শাহাদত বরণ ছাড়া আমাদের সামনে আর কোন পথ নেই । আমি ছাড়া আর অন্য কারো সাথেই এদের (ইয়াযিদ বাহিনী) কোন কাজ নেই । আমি তোমাদের কাছ থেকে গৃহীত আমার প্রতি বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) এ মূহুর্ত থেকে বাতিল বলে ঘোষণা করছি । তোমাদের যে কেউই ইচ্ছে করলে রাতের এ আধারে এ স্থান ত্যাগ করার মাধ্যমে এই ভয়ংকর মৃত্যু কুপ থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে পারে । ইমামের ঐ বক্তৃতার পর শিবিরের বাতি নিভিয়ে দেয়া হল । তখন পার্থিব উদ্দেশ্যে আগত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর অধিকাংশ সঙ্গীরাই রাতের আধারে ইমামের শিবির ছেড়ে পালিয়ে গেল । যার ফলে হাতে গোনা ইমামের অল্পকিছু অনুরাগী এবং বনি হাশিম গোত্রের অল্প ক জন ছাড়া ইমামের আর কোন সঙ্গী বাকী রইল না । ইমামের ঐসব অবশিষ্ট সঙ্গীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ জন । অতঃপর ইমাম হুসাইন (আ.) পুনরায় তার অবশিষ্ট সঙ্গীদেরকে পরীক্ষা করার জন্যে সমবেত করেন । সমবেত সঙ্গী ও হাশেমীয় গোত্রের আত্মীয় স্বজনদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) বলেন : আমি ছাড়া তোমাদের কারো সাথে এদের কোন কাজ নেই । তোমাদের যে কেউ ইচ্ছে করলে রাতের আধারে আশ্রয় গ্রহণের (পালিয়ে যাওয়া) মাধ্যমে নিজেকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পার ।

কিন্তু এবার ইমামের অনুরাগী ভক্তরা একে একে সবাই দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিল । তারা বললো , আমরা অবশ্যই সে সত্যের পথ থেকে বিমুখ হব না , যে পথের নেতা আপনি । আমরা কখনোই আপনার পবিত্র সহচর্য ত্যাগ করবো না । আমাদের হাতে যদি তলোয়ার থাকে , তাহলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত আপনার স্বার্থ রক্ষার্থে যুদ্ধ করে যাব ।৩১

ইমাম (আ.)-কে প্রদত্ত অবকাশের শেষ দিন ছিল মহররম মাসের ৯ তারিখ । আজ ইমাম হুসাইন (আ.) কে ইয়াযিদের বশ্যতা স্বীকারের (বাইয়াত) ঘোষণা প্রদান করতে হবে অথবা ইয়াযিদ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ লিপ্ত হতে হবে । শত্রু বাহিনীর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে ইমামের জবাব চেয়ে পাঠানো হল । প্রত্যুত্তরে ইমাম (আ.) ঐ রাতে (৯ই মহররমের দিবাগত রাত) সময় টুকু শেষ বারের মত ইবাদত করার জন্যে অবসর প্রদানের আবেদন করলেন । আর পর দিন ইয়াযিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতির্ণ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন ।৩২

হিজরী ৬১ সনের ১০ই মহররম আশুরার দিন , ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৯০জনের চেয়েও কম । যাদের মধ্যে ৪০ জনই ইমামের পুরনো সঙ্গী । আর আনুমানিক ৩০জনেরও কিছু বেশী সৈন্য এক দিনে (১লা মহররম থেকে ১০ই মহররম পর্যন্ত) ইয়াযিদের বাহিনী ত্যাগ করে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বাহিনীতে যোগদান করেছেন । আর অবশিষ্টরা ইমামের হাশেমী বংশীয় আত্মীয় স্বজন , ইমামের ভাই বোনরা ও তাদের সন্তানগণ , চাচাদের সন্তানগণ এবং তার নিজের পরিবারবর্গ । ইয়াযিদের বিশাল বাহিনীর মোকাবিলায় ইমাম হুসাইন (আ.) তার ঐ অতি নগন্য সংখ্যক সদস্যের ক্ষুদ্র বাহিনীকে যুদ্ধের জন্যে বিন্যস্ত করলেন । অতঃপর যুদ্ধ শুরু হল । সেদিন আশুরার সকাল থেকে শুরু করে সারাদিন যুদ্ধ চললো । ইমামের হাশেমী বংশীয় সকল যুবকই একের পর এক শাহাদত বরণ করলেন । ইমামের অন্যান্য সাথীরা একের পর এক সবাই শহীদ হয়ে গেলেন । ঐ সকল শাহাদত প্রাপ্তদের মাঝে ইমাম হাসান (আ.)-এর দু জন কিশোর পুত্র এবং স্বীয় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর একজন নাবালক পুত্র ও একটি দুগ্ধ পোষ্য শিশু ছিলেন ।৩৩ যুদ্ধ শেষে ইয়াযিদ বাহিনী ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পরিবারের মহিলাদের শিবির লুটপাট করার পর তাদের তাবুগুলোতে অগ্নি সংযোগ করে তা জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয় । তারা ইমামের বাহিনীর শহীদদের মাথা কটে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে । শহীদদের লাশগুলোকে তারা বিবস্ত্র করে । দাফন না করেই তারা লাশগুলোকে বিবস্ত্র অবস্থায় মাটিতে ফেলে রাখে । এরপর ইয়াযিদ বাহিনী শহীদদের কর্তিত মস্তকসহ ইমাম পরিবারের বন্দী অসহায় নারী ও কন্যাদের সাথে নিয়ে কুফা শহরের দিকে রওনা হল । ঐসব বন্দীদের মাঝে ইমাম পরিবারের পুরুষ সদস্যের সংখ্যা ছিল মাত্র অল্প ক জন । এদের একজন ছিলেন চরমভাবে অসুস্থ তিনি হলেন , হযরত ইমাম হুসাইনের ২২ বছর বয়স্ক পুত্র হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) । ইনিই সেই চতুর্থ ইমাম । অন্য একজন ছিলেন ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর ৪ বছর বয়স্ক পুত্র মুহাম্মদ বিন আলী । ইনিই হলেন পঞ্চম ইমাম হযরত বাকের (আ.) । আর তৃতীয় জন হলেন , হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জামাতা এবং হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর পুত্র হযরত হাসান মুসান্না (রহঃ) । তিনি চরমভাবে আহত অবস্থায় শহীদদের লাশের মাঝে পড়ে ছিলেন । তখনও তার শ্বাসক্রিয়া চলছিল । শহীদদের মাথা কাটার সময় ইয়াযিদ বাহিনীর জনৈক সেনাপতির নির্দেশে তার মাথা আর কাটা হয়নি । অতঃপর তাকেও সেখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে বন্দীদের সাথে কুফার দিকে নিয়ে যাওয়া হল । তারপর কুফা থেকে সকল বন্দীকে দামেস্কে ইয়াযিদের দরবারের নিয়ে যাওয়া হয় ।

ইমাম পরিবারের নারী ও কন্যাদেরকে বন্দী অবস্থায় এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুড়িয়ে বেড়ানো হয় । পথিমধ্যে আমিরুল মু মিনীন ইমাম আলী (আ.)-এর কন্যা হযরত জয়নাব (আ.) ও ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) জনগণের উদ্দেশ্যে কারবালার ঐ মর্মান্ত্রিক ঘটনার ভয়াবহ বর্ণনা সম্বলিত মর্মস্পর্শী বক্তব্য রাখেন । কুফা ও দামেস্কে তাদের প্রদত্ত ঐ হৃদয়বিদারক গণভাষণ উমাইয়াদেরকে জনসমক্ষে যথেষ্ট অপদস্থ করে । যার ফলে মুয়াবিয়ার বহু বছরের অপপ্রচারের পাহাড় মূহুর্তেই ধুলিসাৎ হয়ে যায় । এমনকি শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে গিয়ে দাড়ালো যে , ইয়াযিদ তার অধীনস্থদের এহেন ন্যক্কারজনক কার্যকলাপের জন্যে বাহ্যিকভাবে জনসমক্ষে অসন্তুষ্টি প্রকাশে বাধ্য হয়েছিল । কারবালার ঐ ঐতিহাসিক মর্মান্তিক ঘটনা এতই শক্তিশালী ছিল যে , অদূর ভবিষ্যতে তারই প্রভাবে উমাইয়া গোষ্ঠি তাদের শাসনক্ষমতা থেকে চিরতরে উৎখাত হয়ে যায় । ঐতিহাসিক কারবালার ঘটনাই শীয়া সম্প্রদায়ের মূলকে অধিকতর শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত করে । শুধু তাই নয় , কারবালার ঐ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একের পর এক বিদ্রোহ , বিপ্লব এবং ছোট বড় অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সংঘাত ঘটতে থাকে । এ অবস্থা প্রায় বার বছর যাবৎ অব্যাহত ছিল । শেষ পর্যন্ত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে হত্যা করার সাথে জড়িত একটি ব্যক্তিও জনগণের প্রতিশোধের হাত থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়নি ।

হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবন ইতিহাস , ইয়াযিদ এবং তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে যার সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ জ্ঞান রয়েছে , তিনি নিঃসন্দেহে জানেন যে , সে দিন হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সামনে শুধুমাত্র একটা পথই খোলা ছিল । আর তা ছিল শাহাদত বরণ । কেননা , ইয়াযিদের কাছে বাইয়াত প্রদান , প্রকাশ্যভাবে ইসলামকে পদদলিত করারই নামান্তর । তাই ঐ কাজটি ইমামের জন্যে আদৌ সম্ভব ছিল না । কারণ , ইয়াযিদ যে শুধুমাত্র ইসলামী আদর্শ ও ইসলামী আইন কানুনকে সম্মান করত না , তাই নয় ; বরং সে ছিল উচ্ছৃংখল চরিত্রের অধিকারী । এমনকি ইসলামের পবিত্র বিষয়গুলো এবং ইসলামী বিধানকে প্রকাশ্যে পদদলিত করার মত স্পর্ধাও সে প্রদর্শন করত । অথচ , ইয়াযিদের পূর্ব পুরুষরা ইসলামের বিরোধী থাকলেও তারা ইসলামী পরিচ্ছদের অন্তরালে ইসলামের বিরোধীতা করত । কিন্তু প্রকাশ্যভাবে তারা ইসলামকে সম্মান করত । তারা প্রকাশ্যে মহানবী (সা.)-কে সহযোগিতা করত এবং ইসলামের গণ্যমান্য ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সম্পর্কে বাহ্যত গর্ববোধ করত । কারবালার ইতিহাসের অন্য বিশ্লেষকই বলে থাকেন যে , ঐ দুই ইমামের [ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.)] মতাদর্শ ছিল দু ধরণের যেমন : ইমাম হাসান (আ.) প্রায় ৪০ হাজার সেনাবাহিনীর অধিকারী হয়েও মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করেন । আর ইমাম হুসাইন (আ.) মাত্র ৪০ জন অনুসারী নিয়েই ইয়াযিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে: অবতির্ণ হন । কিন্তু ইতোপূর্বের আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে , এ ধরণের মন্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন । কারণ , ইমাম হুসাইন (আ.) , যিনি মাত্র একটি দিনের জন্যেও ইয়াযিদের বশ্যতা স্বীকার করেননি , সেই তিনিই ইমাম হাসান (আ.)- এর পরপর দীর্ঘ দশ বছর যাবৎ মুয়াবিয়ার শাসনাধীনে সন্ধিকালীন জীবন যাপন করেন । ঐ সময় তিনি প্রকাশ্যে প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহ করেননি । প্রকৃতপক্ষে , ইমাম হাসান (আ.) এবং ইমাম হুসাইন (আ.) যদি সেদিন মুয়াবিয়ার সংগে যুদ্ধে অবতির্ণ হতেন , তাহলে অবশ্যই তারা নিহত হতেন । আর এর ফলে ইসলামের এক বিন্দু মাত্র উপকারও হত না । কেননা , মুয়াবিয়ার কপটতাপূর্ণ রাজনীতির কারণে , বাহ্যত তাকেই সত্য পথের অনুসারী বলে মনে হত । এছাড়া মুয়াবিয়া নিজেকে রাসূল (সা.)-এর সাহাবী , ওহী লেখক এবং মু মিনদের মামা (মুয়াবিয়ার জনৈকা বোন রাসূলের স্ত্রী ছিলেন) হিসেবে জনসমক্ষে প্রচার করে বেড়াত । আপন স্বার্থ উদ্ধারের প্রয়োজনে এমন কোন চক্রান্ত নেই যা সে অবলম্বন করেনি । এমতাবস্থায় মুয়াবিয়ার এহেন প্রতারণামূলক রাজনীতির মোকাবিলায় ইমাম হাসান (আ.) বা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কোন কর্মসূচীই ফলপ্রসূ হত না ।

মুয়াবিয়া এতই চতুর ছিল যে , সে অতি সহজেই লোক লাগিয়ে ইমামদের হত্যা করত । আর সে নিজেই নিহত ইমামদের জন্যে প্রকাশ্যে শোক অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দিত । কেননা , একই কর্মসূচী সে তৃতীয় খলিফার ক্ষেত্রেও বাস্তবায়িত করেছিল ।