বার ইমামের সংক্ষিপ্ত জীবনী

বার ইমামের সংক্ষিপ্ত জীবনী60%

বার ইমামের সংক্ষিপ্ত জীবনী লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ইমামত

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 9 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 18784 / ডাউনলোড: 3706
সাইজ সাইজ সাইজ
বার ইমামের সংক্ষিপ্ত জীবনী

বার ইমামের সংক্ষিপ্ত জীবনী

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

চতুর্থ ইমাম

হযরত আলী বিন হুসাইন (আ.)

তৃতীয় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পুত্র হযরত আলী বিন হুসাইন (আ.) হলেন চতুর্থ ইমাম । তার প্রসিদ্ধ উপাধি হল সাজ্জাদ ও জয়নুল আবেদীন । আর এ দুটো নামেই (উপাধি) তিনি অধিক পরিচিত । তার মা হলেন ইরানের ইয়াযদগের্দের রাজকন্যা । হযরত ইমাম সাজ্জাদই (আ.) ছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.)-এর একমাত্র জীবিত পুত্র । কারণ , ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর অন্য তিন ভাই কারবালায় শাহাদৎ বরণ করেন ।৩৪

অবশ্য হযরত ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-ও পিতার সাথে কারবালায় উপস্থিত ছিলেন । কিন্তু তিনি সেখানে ভীষণভাবে অসুস্থ ছিলেন । যার ফলে অস্ত্র বহন বা যুদ্ধ করার মত দৈহিক সামর্থ তখন তার মোটেই ছিল না । তাই তিনি জিহাদে অংশ গ্রহণ বা শাহাদত বরণ করতে পারেননি । যুদ্ধশেষে ইমাম পরিবারের নারী ও কন্যাদের সাথে বন্দী অবস্থায় তাকে দামেস্কে পাঠানো হয় । তারপর সেখানে কিছুদিন বন্দী জীবন কাটানোর পর গণসন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ইয়াযিদের নির্দেশে সসম্মানে তাকে মদীনায় পা ঠানো হয় । পরবর্তীতে আব্দুল মালেক নামক জনৈক উমাইয়া খলিফার নির্দেশে চতুর্থ ইমামকে পুনরায় বন্দী করে শিকল দিয়ে হাত পা বেধে দামেস্কে পাঠানো হয় । অবশ্য দামেস্ক থেকে আবার তাকে মদীনায় ফেরৎ পাঠানো হয় ।৩৫

চতুর্থ ইমাম হযরত জয়নুল আবেদীন (আ.) মদীনায় ফেরার পর ঘরকুণো জীবন যাপন করতে শুরু করেন । অপরিচিতদেরকে সাক্ষাত প্রদান থেকে তিনি বিরত থাকেন । তখন থেকেই সর্বক্ষণ তিনি নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে ব্যস্ত রাখেন । হযরত আবু হামজা সামালী (রা.) ও হযরত আবু খালেদ কাবুলীর (রা.) মত বিশিষ্ট শীয়া ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও সাথেই তিনি যোগাযোগ করতেন না । ইমামের ঐ বিশিষ্ট সাহাবীরা তার কাছ থেকে যেসব জ্ঞান আরহণ করতেন , তা তারা শীয়াদের মধ্যেই বিতরণ করতেন । এভাবে শীয়া মতাদর্শের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে । আর এর প্রভাব পরবর্তীতে পঞ্চম ইমামের যুগে প্রকাশিত হয় । সাহিফাতুস সাজ্জাদিয়াহ নামক চতুর্থ ইমামের দোয়ার সংকলন তার অবদান সমূহের অন্যতম । এই ঐতিহাসিক দোয়ার গ্রন্থটিতে ৫৭টি দোয়া রয়েছে । যার মধ্যে ইসলামের সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ জ্ঞান রয়েছে । এই গ্রন্থ কে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের যাবুর (হযরত দাউদের (আ.) কাছে অবতির্ণ ঐশী গন্থ) বলে অভিহিত করা হয় । বেশকিছু শীয়া সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) ৩৫ বছর যাবৎ ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন । এরপর উমাইয়া খলিফা হিশামের প্ররোচণায় ওয়লিদ। ইবনে আব্দুল মালেক নামক জনৈক ব্যক্তি বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইমাম (আ.)-কে হত্যা করে ।৩৬ এভাবে হিজরী ৯৫ সনে ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) শাহাদত বরণ করেন ।

পঞ্চম ইমাম

ইমাম বাকের (আ.)

হযরত মুহাম্মদ বিন আলী ওরফে বাকের (আ.) হলেন পঞ্চম ইমাম । বাকের অর্থ পরিস্ফুটনকারী । মহানবী (সা.) স্বয়ং তাকে এই উপাধিতে ভূষিত করেন ।৩৭ তিনি ছিলেন চতুর্থ ইমাম হযরত জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর পুত্র । তিনি হিজরী ৫৭ সনে জন্মগ্রহণ করেন । ঐতিহাসিক কারবালার ঘটনার সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র চার বছর । কারবালায় তিনি স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন । পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পূর্ব পুরুষদের ওসিয়তের মাধ্যমে তিনি ইমামতের আসনে সমাসীন হন ।

হিজরী ১১৪ অথবা ১১৭ সনে (কিছু শীয় বর্ণনা অনুযায়ী) উমাইয়া খলিফা হিশামের ভ্রাতুষ্পুত্র ইব্রাহীম বিন ওয়লিদ বিন আব্দুল মালেকের দ্বারা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।৩৮

পঞ্চম ইমামের যুগে ইসলামী খেলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে উমাইয়া শাসক গোষ্ঠির অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিন গণঅভ্যুত্থান ও যুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে । এমনকি স্বয়ং উমাইয়া পরিবারের মধ্যেও মতভেদ শুরু হয় । এ সব সমস্যা উমাইয়া প্রশাসনকে এতই ব্যস্ত রাখে যে , পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি সদাসতর্ক দৃষ্টি দেয়ার সুযোগ তাদের তেমন একটা হয়ে উঠতো না । যার ফলে পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি তাদের অত্যাচারের মাত্রা অনেকটা কমে যায় । এছাড়া কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা এবং পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) নির্যাতিত অবস্থা জনগণের হৃদয়ের আবেগ অনুভুতিকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করেছিল । আর চতুর্থ ইমাম ছিলেন কারবালার সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার অন্যতম সাক্ষী । এর ফলে ক্রমেই মুসলমানরা পবিত্র আহলে বাইতগণের প্রতি আকৃষ্ট ও অনুরক্ত হয়ে পড়েন । এ সব কারণে , পঞ্চম ইমামের দর্শন লাভের সৌভাগ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে মদীনায় জনগণ এবং বিশেষ করে শীয়াদের গণস্রোতের ঢল নামে । যার ফলে ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান ও পবিত্র আহলে বাইতের শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের ব্যাপক সুযোগ ইমাম বাকের (আ.)-এর জন্যে সৃষ্টি হয় । এমনকি তার পূর্ববতী ইমামগণের (আ.) জীবনেও এমন সুবর্ণ সুযোগ কখনও আসেনি । এ যাবৎ প্রাপ্ত অসংখ্য হাদীসই এ বক্তব্যের উত্তম সাক্ষী । শীয়া সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট জ্ঞানী গুণী , পণ্ডিত ও ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশেষজ্ঞ অসংখ্য বিখ্যাত আলেমই হযরত ইমাম বাকেরর (আ.) পবিত্র জ্ঞান নিকেতনে প্রতিপালিত ও শিক্ষিত হয়েছেন । ঐসব বিশ্ববিখ্যাত আলেম ও পণ্ডিতগণের পূর্ণ পরিচিতি রিজাল (ইসলামী ঐতিহাসিক জ্ঞানী গুণীদের পরিচিতি শাস্ত্র) শাস্ত্রের গ্রন্থ সমূহে উল্লেখিত আছে ।৩৯

ষষ্ঠ ইমাম

ইমাম জাফর আস্ সাদেক (আ.)

পঞ্চম ইমামের পুত্র হযরত জাফর বিন মুহাম্মদ আস্ সাদেক (আ.) ছিলেন ষষ্ঠ ইমাম । তিনি হিজরী ৮৩ সনে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি হিজরী ১৪৮ সনে (শীয়া সূত্রে বর্ণিত হাদীস অনুসারে) আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের চক্রান্তে বিষ প্রয়োগের ফলে শাহাদত বরণ করেন ।৪০ ষষ্ঠ ইমামের ইমামতের যুগে তদানিন্তন ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একের পর এক উমাইয়া শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল । ঐসবের মধ্যে উমাইয়া শাসক গোষ্ঠিকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে মুসাওয়াদাহু বিদ্রোহের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । কেননা , ঐ বিদ্রোহের মাধ্যমেই উমাইয়া শাসকগোষ্ঠি সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাচ্যুত হয় । এছাড়াও ঐসময়ে সংঘটিত বেশকিছু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধও উমাইয়া খেলাফতের পতনের কারণ ঘটিয়েছিল । পঞ্চম ইমাম তার দীর্ঘ বিশ বছরের ইমামতের যুগে উমাইয়া খেলাফতের বিশৃংখল ও অরাজক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করেন । এর মাধ্যমে তিনি জনগণের মাঝে ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান ও পবিত্র আহলে বাইতের পবিত্র শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার করেন । এভাবে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের জ্ঞান শিক্ষা দেয়া এবং তার প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফর সাদেক (আ.)-এর জন্যে এক চমৎকার ও উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয় ।

ষষ্ঠ ইমামের ইমামতের যুগটি ছিল উমাইয়া খেলাফতের শেষ ও আব্বাসীয় খেলাফতের শুরুর সন্ধিক্ষণ । হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ঐ সুবর্ণ সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের প্রয়াস পান । ইসলামী ইতিহাসের অসংখ্য বিখ্যাত পণ্ডিত ও ইসলামের বিভিন্ন শাখায় বিশেষজ্ঞ আলেমগণ তার কাছেই প্রশিক্ষণপ প্রাপ্ত হয়েছেন । যাদের মধ্যে জনাব যরারাহ , মুহাম্মদ বিন মুসলিম , মুমিন তাক , হিশাম বিন হাকাম , আবান বিন তাগলুব , হিশাম বিন সালিম , হারিয , হিশাম কালবী নাসাবাহ , জাবের বিন হাইয়্যান সুফীর (রসায়নবিদ) নাম উল্লেখযোগ্য । এ ছাড়াও আহলে সুন্নাতের অসংখ্য বিখ্যাত আলেমগণও তার শিষ্যত্ব বরণের মাধ্যমে ইসলামী পাণ্ডিত্য অর্জন করেন । যাদের মধ্যে হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা , সুফিয়ান সাওরী , কাযী সাকুনী , কাযী আব্দুল বাখতারী , প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য , যারা ষষ্ঠ ইমামের শিষ্যত্ব বরণের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন । হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত শিষ্যদের মধ্যে ইতিহাস বিখ্যাত প্রায় ১৪ হাজার মুহাদ্দিস (হাদীস বিশারদ) ও ইসলামী পন্ডিতের নাম উল্লেখযোগ্য ।৪১ হযরত ইমাম বাকের (আ.) ও হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর দ্বারা বর্ণিত হাদীস সমূহের পরিমাণ , মহানবী এবং অন্য দশ ইমামের বর্ণিত হাদীসসমূহের চেয়ে অনেক বেশী ।

কিন্তু হযরত জাফর সাদেক (আ.) তাঁর ইমামতের শেষ পর্বে এসে আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের কু-দৃষ্টির শিকার হন । খলিফা মানসুর তাকে সদা কড়া পাহারা , নিয়ন্ত্রণ ও সীমাবদ্ধতার মাঝে বসবাস করতে বাধ্য করেন । আব্বাসীয় খলিফা মানসুর নবীবংশের সাইয়্যেদ বা আলাভীদের উপর অসহ্য নির্যাতন চালাতে শুরু করেন । তার ঐ নির্যাতনের মাত্রা উমাইয়া খলিফাদের নিষ্ঠুরতা ও বিবেকহীন স্পর্ধাকেও হার মানিয়ে দেয় । খলিফা মানসুরের নির্দেশে নবীবংশের লোকদের দলে দলে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরা হত । অন্ধকারাচ্ছান্ন জেলের মধ্যে তাদের উপর সম্পূর্ণ অমানবিকভাবে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয় । নির্যাতনের মাধ্যমে তিলেতিলে তাদের হত্যা করা হত । তাদের অনেকের শিরোচ্ছেদও করা হয়েছে । তাদের বহুজনকে আবার জীবন্ত কবর দেয়া হত । তাদের অনেকের দেহের উপর দেয়াল ও অট্রালিকা নির্মাণ করা হত ।

খলিফা মানসুর হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-কে মদীনা ত্যাগ করে তার কাছে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ জারী করে । অবশ্য হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ইতিপূর্বে একবার আব্বাসীয় খলিফা সাফ্ফাহ-র নির্দেশে তার দরবারের উপস্থিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন । এছাড়াও তার পিতার (পঞ্চম ইমাম) সাথে একবার উমাইয়া খলিফা হিশামের দরবারের তাকে উপস্থিত হতে হয়েছিল । খলিফা মানসুর বেশ কিছুকাল যাবৎ ষষ্ঠ ইমামকে কড়া পাহারার মাঝে নজরবন্দী করে রাখেন । খলিফা মানসুর বহুবার ইমামকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল । সে ইমামকে বহুবারই অপদস্থ করেছিল । অবশেষে সে ইমামকে মদীনায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয় । ইমাম মদীনায় ফিরে যান । ইমাম তার জীবনের বাকী সময়টুকু অত্যন্ত কঠিন তাকীয়ার মাঝে অতিবাহিত করেন । তখন থেকে তিনি স্বেচ্ছায় গণসংযোগবিহীন ঘরকুণো জীবন যাপন করতে শুরু করেন । এরপর এক সময় খলিফা মানসুরের ষড়যন্ত্রে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইমামকে শহীদ করা হয় ।৪২

মানসুর ষষ্ঠ ইমামের শাহাদতের সংবাদ পেয়ে মদীনার প্রশাসককে চিঠি মারফৎ একটি নির্দেশ পাঠালো । ঐ লিখিত নির্দেশে বলা হয়েছে , মদীনার প্রশাসক ষষ্ঠ ইমামের শোকার্ত পরিবারের প্রতি সান্তনা জ্ঞাপনের জন্যে যেন তাঁর বাড়িতে যায় । অতঃপর সে যেন ইমামের ওসিয়ত নামা (উইল) তার পরিবারের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে তা পড়ে দেখে । ইমামের ওসিয়ত নামায় যাকে তার পরবর্তী ইমাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে , তাকে (পরবর্তী ইমাম) যেন তৎক্ষণাৎ সেখানেই শিরোচ্ছেদ করা হয় । এই নির্দেশ জারীর ব্যাপারে মানসুরের মূল উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমে ইমামতের বিষয়টি চিরতরে নিঃশেষ করে দেয়া । কেননা এর ফলে শীয়াদের প্রাণ প্রদীপ চিরতরে নিভে যাবে । খলিফার নির্দেশ অনুসারে মদীনার প্রশাসক ইমামের বাড়িতে গিয়ে তার ওসিয়ত নামা চেয়ে নেয় । কিন্তু তা পড়ার পর সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে । কারণ , ঐ ওসিয়ত নামায় ইমাম পাঁচ ব্যক্তিকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত ও ঘোষণা করেছেন । ঐ পাঁচ ব্যক্তি হচ্ছেন : স্বয়ং মানসুর , মদীনার প্রশাসক , ইমামের সন্তান আব্দুল্লাহ আফতাহ্ , ইমামের ছোট ছেলে মুসা কাজেম এবং হামিদাহ । এ ধরণের অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে খলিফার সকল ষড়যন্ত্র ধুলিষ্যাৎ হয়ে গেল ।৪৩

সপ্তম ইমাম

ইমাম কাযেম (আ .)

ষষ্ঠ ইমামের পুত্র হযরত মুসা বিন জাফরই (কাযিম) (আ.) ছিলেন সপ্তম ইমাম । তিনি হিজরী ১২৮ সনে জন্ম গ্রহণ করেন এবং হিজরী ১৮৩ সনে জেলে বন্দী অবস্থায় বিষ প্রয়োগের ফলে শাহাদত বরণ করেন ।৪৪ পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পূর্ববতী ইমামগণের ওসিয়ত অনুযায়ী ইমামতের পদে আসীন হন । সপ্তম ইমাম হযরত মুসা কাযিম (আ.) আব্বাসীয় খলিফা মানসুর , হাদী , মাহদী , এবং হারুনুর রশিদের সমসাময়িক যুগে বাস করতেন । তার ইমামতের কালটি ছিল অত্যন্ত অন্ধকারাচ্ছান্ন ও সুকঠিন যার ফলে তাকিয়া নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে তার জীবনকাল অতিবাহিত হয় । অবশেষে খলিফা হারুনুর রশিদ হজ্জ উপলক্ষ্যে মদীনায় গিয়ে ইমামকে বন্দী করে । খলিফা হারুনের নির্দেশে মসজিদে নববীতে নামাযরত অবস্থায় ইমামকে গ্রেপ্তার ও শিকল পরানো হয় । শিকল পরানো অবস্থাই ইমামকে মদীনা থেকে বসরায় এবং পরে বাগদাদে বন্দী হিসেবে স্থানান্তর করা হয় । ইমামকে বহু বছর একাধারে জেলে বন্দী অবস্থায় রাখা হয় । এসময় তাকে একের পর এক বিভিন্ন জেলে স্থানান্তর করা হয় । অবশেষে সিন্দি ইবনে শাহেক নামক বাগদাদের এক জেলে বিষ প্রয়োগের ফলে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।৪৫ অতঃপর মাকাবিরে কুরাইশ নামক স্থানে তাকে দাফন করা হয় । ঐ স্থানের বর্তমান নাম কাযেমাইন নগরী ।

অষ্টম ইমাম

ইমাম আলী বিন মুসা আর রেযা (আ.)

সপ্তম ইমামের পুত্র হযরত আলী বিন মুসা আর রেযা (আ.)-ই হলেন অষ্টম ইমাম । তিনি হিজরী ১৪৮ সনে জন্মগ্রহণ করেন এবং হিজরী ২০৩ সনে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।৪৬ পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে ও পূর্ববতী ইমামদের নির্দেশনায় তিনি ইমামতের আসনে সমাসীন হন । আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদের পুত্র খলিফা আমিনের এবং তার অন্য আর এক পুত্র খলিফা মামুনুর রশিদের শাসনামলেই অষ্টম ইমামের ইমামতকাল অতিবাহিত হয় । পিতার মৃত্যুর পর মামুনুর রশিদের সাথে তার ভাই খলিফা আমিনের মতভেদ শুরু হয় । তাদের ঐ মতভেদ শেষ পর্যন্ত একাধিক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায় । অবশেষে খলিফা আমিনের নিহত হওয়ার মাধ্যমে ঐ সব রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটে । আর এর ফলে মামুনুর রশিদ খেলাফতের সিংহাসন ে আরোহণ করতে সমর্থ হয় ।৪৭ মামুনুর রশিদের যুগ পর্যন্ত আলাভী (রাসূল বংশের লোক) সৈয়দদের ব্যাপারে আব্বাসীয় খেলাফত প্রশাসনের নীতি ছিল আক্রোশমূলক ও রক্তলোলুপ । নবীবংশের প্রতি তাদের গৃহীত ঐ হিংসাত্মক নীতি দিনদিন কঠোরতর হতে থাকে । তৎকালীন রাজ্যের কোথাও কোন আলাভী (নবীবংশের লোক) বিদ্রোহ করলেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও মহাবিশৃংখলার সৃষ্টি হত । যে বিষয়টি স্বয়ং রাষ্ট্রিয় প্রশাসনের জন্যেও এক জটিল সমস্যার সৃষ্টি করত । পবিত্র আহলে বাইতের ইমামগণ ঐসব আন্দোলন ও বিদ্রোহের ব্যাপারে আদৌ কোন সহযোগিতা বা হস্তক্ষেপ করতেন না । সেসময় আহলে বাইতের অনুসারী শীয়া জনসংখ্যা ছিল যথেষ্ট লক্ষণীয় । নবীবংশের ইমামগণকে (আ.) তারা তাদের অবশ্য অনুকরণীয় দ্বীনি নেতা এবং মহানবী (সা.)-এর প্রকৃত প্রতিনিধি বা খলিফা হিসেবে বিশ্বাস করত । সেযুগে খেলাফত প্রশাসন কায়সার ও কায়সার রাজ দরবার সদৃশ্য ছিল । ঐ খেলাফত প্রশাসন তখন মুষ্টিমেয় চরিত্রহীন লোকদের দ্বারা পরিচালিত হত । শীয়াদের দৃষ্টিতে তা ছিল এক অপবিত্র প্রশাসন যা তাদের ইমামদের পবিত্রাংগন থেকে ছিল অনেক দূরে । এ ধরণের পরিবেশের অগ্রগতি খেলাফত প্রশাসনের জন্যে ছিল বিপদজনক এক প্রতিবন্ধক , যা খেলাফতকে প্রতিনিয়তই হুমকির সম্মুখীন করছিল । ঐ ধরণের শ্বাসরুকর পরিবেশ থেকে খেলাফত প্রশাসনকে উদ্ধারের জন্যে খলিফা মামুনুর রশিদ ভীষণভাবে চিন্তিত হল । খলিফা মামুন লক্ষ্য করল , ৭০ বছর যাবৎ আব্বাসীয় খেলাফত মরচে পড়া ঐ রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নে ব্যর্থতারই প্রমাণ দিয়েছে । বাপ দাদার আমল থেকে চলে আসা ঐ রাজনীতি সংস্কারের মধ্যেই সে ঐ দূরাবস্থার চির অবসান খুজে পেল । তার গৃহীত নতুন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে অষ্টম ইমাম হযরত রেজা (আ.)-কে তার খেলাফতের পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করে । এই ঘোষণার মাধ্যমে সে খেলাফতের পথকে সম্পূর্ণরূপে কন্টকমুক্ত করতে চেয়েছিল । কেননা , নবীবংশের সৈয়দগণ যখন রাষ্ট্রিয় প্রশাসনের সাথে জড়িত হয়ে পড়বেন , তখন খেলাফতের বিরুদ্ধে যে কোন ধরণের বিদ্রোহ থেকেই তারা বিরত থাকবেন ।

আর আহলে বাইতের অনুসারী শীয়াগণ তখন তাদের ইমামকে খেলাফত প্রশাসনের মাধ্যমে অপবিত্র হতে দেখবে , যে প্রশাসনের পরিচালকদের এক সময় অপবিত্র বলে বিশ্বাস করত । তখন আহলে বাইতের ইমামদের প্রতি শীয়াদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও পরম ভক্তি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাবে । এভাবে তাদের ধর্মীয় সাংগঠনিক কাঠামো ধ্বংস হয়ে যাবে ।৪৮ এর ফলে রাষ্ট্রিয় প্রশাসনের সামনে কোন প্রতিবন্ধকতাই আর অবশিষ্ট থাকবে না । আর এটা খুবই স্বাভাবিক যে , উদ্দেশ্য চারিতার্থের পর ইমাম রেজা (আ.)-কে তার পথের সামনে থেকে চিরদিনের জন্যে সরিয়ে দেয়া খলিফা মামুনের জন্যে কোন কঠিন কাজই নয় । মামুনের ঐ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে হযরত ইমাম রেজা (আ.)-কে মদীনা থেকে মারওয় নামক স্থানে নিয়ে আসে । ইমামের সাথে প্রথম বৈঠকেই মামুন তাকে খেলাফতের দায়িত্ব ভার গ্রহণের প্রস্তাব দেয় । এরপর সে ইমামকে তার মৃত্যুর পর খেলাফতের উত্তাধিকারী হবার প্রস্তাব দেয় । কিন্তু ইমাম রেজা (আ.) মামুনের ঐ প্রস্তাব সম্মানের সাথে প্রত্যাখ্যান করেন । কিন্তু মামুন চরমভাবে পীড়াপীড়ির মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত তার পরবর্তী খেলাফতের উত্তরাধিকার গ্রহণের ব্যাপারে সম্মত হতে ইমামকে বাধ্য করে । কিন্তু হযরত ইমাম রেজা (আ.) এই শর্তে মামুনের প্রস্তাবে সম্মত হন যে , ইমাম প্রশাসনিককারযে লোক নিয়োগ বা বহিস্কারসহ কোন ধরণের রাষ্ট্রিয় কর্মকান্ডে হস্তক্ষেপ করবেন না ।৪৯ এটা ছিল হিজরী ২০০সনের ঘটনা । কিছুদিন না যেতেই মামুন দেখতে পেল যে , শীয়াদের সংখ্যা পূর্বের চেয়েও দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে । এমনকি ইমামের প্রতি সাধারণ জনগণের ভক্তি দিনদিন আশ্চর্যজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে । শুধু তাই নয় , মামুনের সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রিয় প্রশাসনের বহু দায়িত্বশীল ব্যক্তিই ইমামের ভক্ত হয়ে পড়ছে । এ অবস্থাদৃষ্টে খলিফা মামুন তার রাজনৈতিক ভুল বুঝতে পারে । মামুন ঐ জটিল সমস্যার সমাধান কল্পে ইমামকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ করেন । শাহাদতের পর অষ্টম ইমামকে ইরানের তুস নগরীতে (বর্তমানে মাশহাদ নামে পরিচিত) দাফন করা হয় । খলিফা মামুনুর রশিদ দর্শন শাস্ত্রের গ্রন্থ সমূহ আরবী ভাষায় অনুবাদের ব্যাপারে অত্যন্ত আগহ দেখিয়ে ছিল । সে প্রায়ই জ্ঞান- বিজ্ঞান সংক্রান্ত পর্যালোচনার বৈঠকের আয়োজন করত । সে যুগের বিভিন্ন ধর্মের জ্ঞানী গুণী ও পণ্ডিতগণ তার ঐ বৈঠকে উপস্থিত হতেন এবং জ্ঞানমূলক আলোচনায় অংশ নিতেন । অষ্টম ইমাম হযরত রেজা (আ.)-ও ঐ বৈঠকে অংশ গ্রহণ করতেন । দেশ বিদেশের বিভিন্ন ধর্মের জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের সাথে পর্যালোচনা ও তর্কবিতর্কে তিনিও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন । ইমামের ঐসব জ্ঞানমূলক ঐতিহাসিক বিতর্ক অনুষ্ঠানের বর্ণনা শীয়াদের হাদীসসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে ।৫০

নবম ইমাম

ইমাম মুহাম্মদ বিন আলী আত তাকী (আ.)

অষ্টম ইমামের পুত্র হযরত মুহাম্মদ বিন আলী আত তাকী (আ.) হলেন নবম ইমাম । তিনি ইমাম যাওয়াদ এবং ইবনুর রেযা নামেও সম্যক পরিচিত । তিনি হিজরী ১৯৫ সনে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন । শীয়া সূত্রে বর্ণিত হাদীস অনুসারে হিজরী ২২০ সনে আব্বাসীয় খলিফা মু তাসিম বিল্লাহর প্ররোচনায় বিষ প্রয়োগের ফলে তিনি শাহাদত বরণ করেন । আব্বাসীয় খলিফা মামুনের কন্যা ছিল তার স্ত্রী । খলিফা মু তাসিম বিল্লাহর প্ররোচনায় ইমামের স্ত্রী (খলিফা মামুনের কন্যা) ইমামকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ করেন । বাগদাদের কাযেমাইন এলাকায় দাদার (সপ্তম ইমাম) কবরের পাশেই তাকে কবরস্থ করা হয় । পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পূর্ববতী ইমামগণের নির্দেশনায় তিনি ইমামতের পদে অধিষ্ঠিত হন । মহান পিতার মৃত্যুর সময় নবম ইমাম মদীনায় ছিলেন । আব্বাসীয় খলিফা মামুন তাকে বাগদাদে ডেকে পাঠায় । আব্বাসীয় খেলাফতের তৎকালীন রাজধানী ছিল বাগদাদ । খলিফা মামুন প্রকাশ্যে ইমামকে অত্যন্ত সম্মান প্রদর্শন করে এবং তার সাথে নম্র ব্যাবহার করে । এমনকি খলিফা মামুন তার নিজ কন্যাকে ইমামের সাথে বিয়ে দেয় । এভাবে সে ইমামকে বাগদাদেই রেখে দেয় । প্রকৃতপক্ষে ঐ বিয়ের মাধ্যমে ইমামকে ঘরের ভিতরে এবং বাইরে উভয় দিক থেকেই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পায় । ইমাম তাকী (আ.) বেশ কিছুদিন বাগদাদে কাটানোর পর খলিফা মামুনের অনুমতি নিয়ে মদীনায় ফিরে যান । তারপর খলিফা মামুনের মৃত্যু পর্যন্ত তিনি মদীনাতেই ছিলেন । খলিফা মামুনের মৃত্যুর পর মু তাসিম বিল্লাহ খলিফার সিংহাসনে আরোহণ করেন । এরপরই খলিফা মু তাসিম ইমামকে পুনরায় বাগদাদে ডেকে পাঠায় এবং তাকে নজরবন্দী করে রাখা হয় । অতঃপর খলিফা মু তাসিমের প্ররোচনায় ইমামের স্ত্রী (খলিফা মামুনের কন্যা) ইমামকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ করে ।৫১

দশম ইমাম

ইমাম আলী ইবনে মুহাম্মদ আন্ নাকী (আ.)

নবম ইমামের পুত্র হযরত আলী ইবনে মুহাম্মদ আন্ নাকী (আ.)-ই হলেন দশম ইমাম । ইমাম হাদী নামেও তাকে ডাকা হত । তিনি হিজরী ২১২ সনে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন । শীয়া সূত্রে বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী ২৫৪ হিজরী সনে আব্বাসীয় খলিফা মু তায বিল্লাহর নির্দেশে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে তাকে শহীদ করা হয় ।৫২ ইমাম নাকী (আ.) তার জীবদ্দশায় ৭জন আব্বাসীয় খলিফার (মামুন , মুতাসিম , ওয়াসিক , মুতাওয়াক্কিল , মুনতাসির , মুসতাঈন ও মুতায বিল্লাহ) শাসনামল প্রত্যক্ষ করেন । আব্বাসীয় খলিফা মুতাসিমের শাসনামলেই ইমাম নাকী (আ.)-এর মহান পিতা (নবম ইমাম) বিষ প্রয়োগের ফলে হিজরী ২২০ সনে বাগদাদে শাহাদত বরণ করেন । তখন তিনি (দশম ইমাম) মদীনায় অবস্থান করছিলেন । পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পূর্ববতী ইমামদের নির্দেশনায় তিনি ইমামতের পদে অভিষিক্ত হন । তিনি ইসলাম প্রচার ও তার শিক্ষা প্রদানে ব্যাপৃত হয়ে পড়েন । এরপর আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিলের শাসনামল শুরু হয় । ইতিমধ্যে অনেকেই ইমাম নাকী (আ.) সম্পর্কে খলিফার কান গরম করে তোলে । ফলে খলিফা মুতাওয়াক্কিল হিজরী ২৪৩ সনে তার দরবারের জনৈক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে , ইমামকে মদীনা থেকে সামেররা শহরে নিয়ে আসার নির্দেশ দেয় । সামেররা শহর ছিল তৎকালীন আব্বাসীয় খেলাফতের রাজধানী । খলিফা মুতাওয়াক্কিল অত্যন্ত সম্মানসূচক একটি পত্র ইমামের কাছে পাঠায় । পত্রে সে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে ইমামের সাক্ষাত লাভের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে এবং ইমামকে দ্রুত সামেররা শহরের দিকে রওনা হওয়ার জন্যে অনুরোধ জ্ঞাপন করেন ।৫৩ কিন্তু সামেররা শহরে প্রবেশের পর ইমামকে আদৌ কোন অভ্যর্থনা জানান হয়নি । বরং ইমামকে কষ্ট দেওয়া ও অবমাননা করার জন্যে প্রয়োজনীয় সব কিছুরই আয়োজন করা হয়েছিল । এ ব্যাপারে খলিফা বিন্দুমাত্র ত্রুটিও করেনি । এমনকি ইমামকে হত্যা এবং অবমাননা করার লক্ষ্যে বহুবার তাকে খলিফার রাজ দরবারের উপস্থিত করানো হত । খলিফার নির্দেশে বহুবার ইমামের ঘর তল্লাশী করা হয় ।

নবীবংশের সাথে শত্রুতার ব্যাপারে আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে মুতাওয়াক্কিলের জড়িু মেলা ভার । খলিফা মুতাওয়াক্কিল হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর প্রতি মনে ভীষণ বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করত । এমনকি হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর ব্যাপারে প্রকাশ্যে সে অকথ্য মন্তব্য করত । খলিফা কৌতুক অভিনেতাকে বিলাস বহুল পোষাকে হযরত আলী (আ.)-এর অনুকরণমূলক ভঙ্গীতে তার (ইমাম আলী) প্রতি ব্যাঙ্গাত্মক অভিনয় করার নির্দেশ দিত । আর ঐ দৃশ্য অবলোকন খলিফা চরমভাবে উল্লাসিত হত । হিজরী ২৩৭ সনে খলিফা মুতাওয়াক্কিলের নির্দেশেই কারবালায় হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মাযার (রওজা শরীফ) এবং তদসংলগ্ন অসংখ্য ঘরবাড়ী সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয় । তার নির্দেশে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মাযার এলাকায় পানি সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং ইমামের মাযারের উপর চাষাবাদের কাজ শুরু করা হয় । যাতে করে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর নাম এবং মাযারের ঠিকানা চিরতরে ইতিহাস থেকে মুছে যায় ।৫৪ আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিলের শাসন আমলে হেজাজে (বর্তমান সৌদি আরব) বসবাসকারী সাইয়্যেদদের (নবীবংশের লোকজন) দূর্দশা এতই চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌছায় যে , তাদের স্ত্রীদের পরার মত বোরখাও পর্যন্ত ছিল না । অল্প ক জনের জন্যে মাত্র একটি বোরখা ছিল , যা পরে তারা পালাক্রমে নামায পড়তেন ।৫৫ শাসকগোষ্ঠির পক্ষ থেকে ঠিক এমনি ধরণের অত্যাচারমূলক কার্যক্রম মিশরে বসবাসকারী সাইয়্যেদদের (নবীবংশের লোকজন) উপরও করা হয় । দশম ইমাম খলিফা মুতাওয়াক্কিলের সবধরণের অত্যাচার ও শাস্তিই অম্লান বদনে সহ্য করেন ।

এরপর একসময় খলিফা মুতাওয়াক্কিল মৃত্যুবরণ করে । মুতাওয়াক্কিলের মৃত্যুর পর মুনতাসির , মুস্তাঈন ও মু তায একের পর এক খেলাফতের পদে আসীন হয় । অবশেষে খলিফা মু তাযের ষড়যন্ত্রে ইমামকে বিষ প্রয়োগ করা হয় এবং ইমাম শাহাদত বরণ করেন ।

একাদশ ইমাম

ইমাম হাসান বিন আলী আল আসকারী (আ.)

দশম ইমামের পুত্র হযরত হাসান বিন আলী আল আসকারী (আ.) হলেন একাদশ ইমাম । তিনি হিজরী ২৩২ সনে জন্ম গ্রহণ করেন । শীয়া সূত্রে বর্ণিত হাদীস অনুসারে হিজরী ২৬০ সনে আব্বাসীয় খলিফা মু তামিদের দ্বারা বিষ প্রয়োগে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।৫৫

পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পূর্ববতী ইমামদের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি ইমামতের পদ লাভ করেন । তার ইমামতের মেয়াদকাল ছিল মাত্র সাত বছর । ইমাম আসকারী (আ.)-এর যুগে আব্বাসীয় খলিফার সীমাহীন নির্যাতনের কারণে অত্যন্ত কঠিন তাকীয়া নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে তাকে জীবন অতিবাহিত করতে হয় । তিনি হাতে গোনা বিশিষ্ট ক জন শীয়া ব্যতীত অন্য সকল সাধারণ শীয়াদের সাথে গণসংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বাধ্য হন । এরপরও তার ইমামত কালের অধিকাংশ সময় জেলে বন্দী অবস্থায় জীবন কাটাতে হয় ।৫৬ রাষ্ট্রিয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরোপিত ঐ প্রচন্ড রাজনৈতিক চাপের মূল কারণ ছিল এই যে ,

প্রথমত : সে সময় চারিদিকে শীয়াদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে ছিল । শীয়ারা যে ইমামতে বিশ্বাসী এবং কে তাদের ইমাম , এটা তখন সবাই ভাল করেই জানত । এ কারণেই খেলাফতের পক্ষ থেকে ইমামদেরকে অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অধিকতর কড়া নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখার ব্যবস্থা করা হয় । আর এসকল রহস্যময় পরিকল্পনার মাধ্যমে ইমামদেরকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা তারা চালাত ।

দ্বিতীয়ত : খেলাফত প্রশাসন এটা জানতে পরেছিল যে , ইমামের অনুসারী বিশিষ্ট শীয়ারা ইমামের এক বিশেষ সন্তানের আগমনে বিশ্বাসী এবং তাঁর জন্যে প্রতীক্ষারত । এছাড়াও স্বয়ং একাদশ ইমাম এবং তার পূর্ববতী ইমামগণের (আ.) বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী একাদশ ইমামের আসন্ন পুত্র সন্তানই সেই প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী (আ.) যার আগমনের সু সংবাদ স্বয়ং মহানবী (সা.)-ই দিয়েছেন । মহানবী (সা.)-এর ঐ সকল হাদীস শীয়া এবং সুন্নী উভয় সূত্রেই বর্ণিত হয়েছে ।৫৭ আর ঐ নবজাতকই হলেন ইমাম মাহদী (আ.) বা দ্বাদশ ইমাম । এ সকল কারণেই একাদশ ইমামকে খেলাফতের পক্ষ থেকে পূর্ববতী যে কোন ইমামের তুলনায়ই অধিকতর কড়া নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখা হয় । তৎকালীন আব্বাসীয় খলিফা এ ব্যাপারে সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল যে , যে কোন মূল্যেই হোক না কেন , ইমামতের এই বিষয়টিকে চিরদিনের জন্যে নিশ্চিহ্ন করতে হবেই । ইমামতের এই দরজাকে চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে । এ কারণেই যখন আব্বাসীয় খলিফা মু তামিদ ইমামের অসুস্থ অবস্থার সংবাদ পেল , সাথে সাথেই সে ইমামের কাছে একজন ডাক্তার পাঠায় । ঐ ডাক্তারের সাথে খলিফার বেশ ক জন বিশ্বস্থ অনুচরসহ ক জন বিচারককেও ইমামের বাড়িতে পাঠানো হয় । এ জাতীয় পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে তারা ইমামের বাড়ীর আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞাত ও তা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয় । আর এটাই ছিল খলিফা মু তামিদের মূল উদ্দেশ্য ইমামের শাহাদত বরণের পরও তার সমস্ত বাড়ী ঘরে তল্লাশী চালানো হয় । এমনকি ধাত্রীদের দিয়ে ইমামের বাড়ীর মহিলা ও তার দাসীদেরকেও দৈহিক পরীক্ষা করানো হয় । ইমামের শাহাদত বরণের পর প্রায় দু বছর পর্যন্ত খলিফার নির্দেশে ইমামের সন্তানের অস্তিত্ব খুজে পাওয়ার জন্যে সর্বত্র ব্যাপক তল্লাশী অব্যাহত থাকে । দীর্ঘ দু বছর পর খলিফা ঐ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে পড়ে ।৫৮ শাহাদত বরণের পর সামেরা শহরে নিজ গৃহে পিতার (দশম ইমাম) শিয়রে ইমাম আসকারীকে (আ.) দাফন করা হয় । পবিত্র আহলে বাইতের ইমামগণ তাদের জীবদ্দশায় অসংখ্য খ্যাতনামা আলেম ও হাদীস বিশারদ তৈরী করেছিলেন । যাদের সংখ্যা শতাধিক । এই বইয়ের কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় ঐসব (ইমামদের শিষ্যবর্গ) বিশ্ববরেণ্য আলেমদের নাম ও তাদের রচিত গ্রন্থাবলীর বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখে বিরত থেকেছি ।৫৯

দ্বাদশ ইমাম

ইমাম মাহদী (আ .)

একাদশ ইমামের পুত্র হযরত মুহাম্মদ বিন হাসান আল্ মাহদী হলেন দ্বাদশ ইমাম । তিনি মাহদী মাওউদ , ইমামুল আসর এবং সাহেবুজ জামান নামে পরিচিত । হিজরী ২৫৫ অথবা ২৫৬ সনে ইরাকের সামেরা শহরে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন । পিতার শাহাদতের (২৬০ হিঃ) পূর্ব পর্যন্ত তিনি সরাসরি পিতার তত্ত্বাবধানেই লালিত পালিত হন । অবশ্য ঐসময় তাকে লোক চক্ষুর অন্তরালে বসবাস করতে হয় । শুধুমাত্র ইমামের অনুসারী অল্প ক জন বিশিষ্ট শীয়া ব্যতীত তার সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্য আর কারও ঘটেনি । পিতার (একাদশ ইমাম) শাহাদত প্রাপ্তির পর তিনি ইমামতের পদে অভিষিক্ত হন । কিন্তু তার পরপরই মহান আল্লাহর নির্দেশে তিনি আত্মগোপন করেন । দু একটি ব্যতিক্রম ব্যতীত তার বিশেষ প্রতিনিধিবর্গ ছাড়া আর কারো নিকট তিনি আত্মপ্রকাশ করেননি ।৬০

বিশেষ প্রতিনিধি

দ্বাদশ ইমাম হযরত মাহদী (আ.) আত্মগোপন করার পর জনাব ওসমান বিন সাঈদ ওমারীকে (রহঃ) নিজের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ করেন । তিনি ইমামের দাদা (দশম ইমাম) ও বাবার (একাদশ ইমাম) বিশিষ্ট সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন । ব্যক্তিগত ভাবে ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও বিশ্বস্ত । জনাব ওসমান বিন সাঈদ ওমারীর (রহঃ) মাধ্যমেই হযরত ইমাম মাহদী (আ.) শীয়া জনগণের প্রশ্নের উত্তর দিতেন । জনাব ওসমান বিন সাঈদ ওমারীর (রহঃ) মৃত্যুর পর তারই পুত্র মুহাম্মদ বিন ওসমান ইমাম মাহদী (আ.) এর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন । জনাব মুহাম্মদ বিন ওসমান ওমারীর মৃত্যুর পর জনাব আবুল কাসিম হুসাইন বিন রূহ্ আন নওবাখতি (রহঃ) ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন । তার মৃত্যুর পর জনাব আলী বিন মুহাম্মদ সামেরী (রহঃ) ইমাম মাহদী (আ.)-এর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন । জনাব আলী বিন মুহাম্মদ সামেরী (রহঃ) হিজরী ৩২৯ সনে মৃত্যু বরণ করেন । তার মৃত্যুর অল্প ক দিন পূর্বে ইমামের স্বাক্ষরসহ একটি নির্দেশ নামা জনাব আলী বিন মুহাম্মদ সামেরীর হাতে পৌছে । ঐ নির্দেশ লিপিতে ইমাম মাহদী (আ.) তাকে বলেন যে , আর মাত্র ছয় দিন পরই তুমি এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিবে । তার পরপরই বিশেষ প্রতিনিধিত্বের যুগের অবসান ঘটবে এবং দীর্ঘকালীন অর্ন্তধানের যুগ শুরু হবে । মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ইমাম মাহদীর আত্মপ্রকাশের নির্দেশনা আসা পর্যন্ত ঐ দীর্ঘ কালীন অর্ন্তধানের যুগ অব্যাহত থাকবে ।৬১ ইমামের হপ্তলিপি সম্পন্ন ঐ পত্রের বক্তব্য অনুসারে ইমাম মাহদী (আ.)-এর অর্ন্তধানকালীন জীবনকে দু টো পর্যায়ে ভাগ করা যায় ।

প্রথম : স্বল্পকালীন অর্ন্তধান । হিজরী ২৫০ সনে এই অর্ন্তধান শুরু হয় এবং হিজরী ৩২৯ সন পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে । অর্থাৎ প্রায় ৭০ বছর পর্যন্ত এই অর্ন্তধান স্থায়ী ছিল ।

দ্বিতীয় : দীর্ঘকালীন অর্ন্তধান । হিজরী ৩২৯ সন থেকে এই অর্ন্তধান শুরু হয় এবং মহান আল্লাহর ইচ্ছামত এই অর্ন্তধান অব্যাহত থাকবে । মহানবী (সা.)-এর একটি সর্বসম্মত হাদীসে বলা হয়েছে : এ বিশ্বজগত ধ্বংস হওয়ার জন্যে যদি একটি দিনও অবশিষ্ট থাকে , তাহলে মহান আল্লাহ অবশ্যই সে দিনটিকে এতখানি দীর্ঘায়িত করবেন , যাতে আমারই সন্তান মাহদী (আ.) আত্মপ্রকাশ করতে পারে এবং অন্যায় অত্যাচারে পরিপূর্ণ এ পৃথিবীতে সম্পূর্ণরূপে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে ।৬২

ইমাম মাহদী (আ.) এর আবির্ভাব

গণহেদায়েতের নীতি সমগ্র সৃষ্টিজগতের মধ্যে বলবৎ রয়েছে । সেই নীতির , অপরিহার্য ফলাফল স্বরূপ মানবজাতি ওহী নবুয়তের শক্তি সরঞ্জামে সুসজ্জিত । ঐ বিশেষ শক্তিই মানব জাতিকে মানবতার শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌভাগ্যের পথে পরিচালিত করে । আর এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার যে , আল্লাহ প্রদত্ত ঐ বিশেষ শক্তি যদি সামাজিক জীবন যাপনকারী মানবজাতিকে শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌভাগ্যের পথে পরিচালিত করতেই না পারে , তাহলে ঐ বিশেষ শক্তির সরঞ্জাম মানবজাতিকে সুসজ্জিত করার মূলকাজটিই বৃথা বলে প্রমাণিত হবে । অথচ , এ সৃষ্টিজগতে বৃথা বলে কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই । অন্যকথায় বলতে গেলে , মানব জাতি যেদিন থেকে এ জগতে জীবন যাপন করতে শুরু করেছে , সেদিন থেকেই সে সৌভাগ্যপূর্ণ (সার্বিক অর্থে) এক সামাজিক জীবন যাপনের আকাংখা তার হৃদয়ে লালন করে আসছে । আর সেই কাংখিত লক্ষ্যে পৌছার জন্যেই সে প্রয়াজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে । তার হৃদয়ে ঐ আকাংখা সত্যিই যদি অবাস্তব হত , তাহলে নিশ্চয়ই সে ঐ আকাংখার স্বপ্নিল ছবি তার হৃদয় পটে আকতো না । অথচ , আবহমান কাল থেকে জগতের প্রতিটি মানুষই তার জীবনে এমন একটি আকাংখা হৃদয় কঠুরীতে লালন করে আসছে । যদি খাদ্যের অস্তিত্ব না থাকত তা হলে ক্ষুধার অস্তিত্ব থাকত না । পানির অস্তিত্বই যদি না থাকবে , তাহলে কিভাবে তৃষ্ণার অস্তিত্ব থাকতে পারে ? যৌনাংগের অস্তিত্বই যদি না থাকত তা হলে যৌন কামনার অস্তিত্বও থাকত না । এ কারণেই বিশ্ব জগতে এমন এক দিনের আবির্ভাব ঘটবে , যখন মানব সমাজ সম্পূর্ণ রূপে ন্যায়বিচার ভোগ করবে । সমগ্র বিশ্বে তখন শান্তি নেমে আসবে । সবাই শান্তিপূর্ণ ভাবে সহাবস্থান করবে । তখন মানুষ শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের মাঝে নিমিজ্জিত হবে । অবশ্য ঐ ধরণের পরিবেশ টিকিয়ে রাখার ব্যাপরটি তখন মানুষের উপরই নির্ভরশীল হবে । ঐধরণের সমাজের নেতৃত্ব দান করবে বিশ্ব মানবতার মুক্তিদাতা ; হাদীসের ভাষায় যার নাম হবে মাহ্দী (আ.) । পৃথিবীতে প্রচলিত সকল ধর্মেই বিশ্ব মানবতার মুক্তিদাতা সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে এবং সাধারণভাবে তার আবির্ভাবের সুসংবাদও প্রদান করা হয়েছে । যদিও ঐ বক্তব্যের বাস্তব প্রয়োগে কমব েশী মতভেদ রয়েছে । সর্বসম্মত হাদীসে মহানবী (সা.) হযরত ইমাম মাহদী (আ.) সম্পর্কে বলেছেনঃ প্রতিশ্রুত মাহদী আমারই সন্তান ।

মহানবী (সা.) ও পবিত্র আহলে বাইতের ইমামদের পক্ষ থেকে ইমাম মাহদী (আ.)-এর আবির্ভাব সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে । সেখানে বলা হয়েছে যে , ইমাম মাহদী (আ.) তার আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে সমগ্র মানব সমাজকে প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্বে উন্নীত করবে এবং আধ্যাত্মিক জীবন দান করবে ।৬৩ অসংখ্য হাদীসের সাক্ষ্য অনুযায়ী একাদশ ইমাম হযরত হাসান আসকারীর (আ.) সন্তানই ইমাম মাহদী (আ.) ।৬৪ হাদীস সমূহের বক্তব্য অনুযায়ী হযরত ইমাম মাহদী (আ.)-এর জন্মের পরে সুদীর্ঘকালের জন্যে তিনি অদৃশ্যে অবস্থান করবেন । তারপর তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন এবং অন্যায় ও অত্যাচারপূর্ণ বিশ্বে সত্যিকার অর্থে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন ।

সপ্তম ইমাম

ইমাম কাযেম (আ .)

ষষ্ঠ ইমামের পুত্র হযরত মুসা বিন জাফরই (কাযিম) (আ.) ছিলেন সপ্তম ইমাম । তিনি হিজরী ১২৮ সনে জন্ম গ্রহণ করেন এবং হিজরী ১৮৩ সনে জেলে বন্দী অবস্থায় বিষ প্রয়োগের ফলে শাহাদত বরণ করেন ।৪৪ পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পূর্ববতী ইমামগণের ওসিয়ত অনুযায়ী ইমামতের পদে আসীন হন । সপ্তম ইমাম হযরত মুসা কাযিম (আ.) আব্বাসীয় খলিফা মানসুর , হাদী , মাহদী , এবং হারুনুর রশিদের সমসাময়িক যুগে বাস করতেন । তার ইমামতের কালটি ছিল অত্যন্ত অন্ধকারাচ্ছান্ন ও সুকঠিন যার ফলে তাকিয়া নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে তার জীবনকাল অতিবাহিত হয় । অবশেষে খলিফা হারুনুর রশিদ হজ্জ উপলক্ষ্যে মদীনায় গিয়ে ইমামকে বন্দী করে । খলিফা হারুনের নির্দেশে মসজিদে নববীতে নামাযরত অবস্থায় ইমামকে গ্রেপ্তার ও শিকল পরানো হয় । শিকল পরানো অবস্থাই ইমামকে মদীনা থেকে বসরায় এবং পরে বাগদাদে বন্দী হিসেবে স্থানান্তর করা হয় । ইমামকে বহু বছর একাধারে জেলে বন্দী অবস্থায় রাখা হয় । এসময় তাকে একের পর এক বিভিন্ন জেলে স্থানান্তর করা হয় । অবশেষে সিন্দি ইবনে শাহেক নামক বাগদাদের এক জেলে বিষ প্রয়োগের ফলে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।৪৫ অতঃপর মাকাবিরে কুরাইশ নামক স্থানে তাকে দাফন করা হয় । ঐ স্থানের বর্তমান নাম কাযেমাইন নগরী ।

অষ্টম ইমাম

ইমাম আলী বিন মুসা আর রেযা (আ.)

সপ্তম ইমামের পুত্র হযরত আলী বিন মুসা আর রেযা (আ.)-ই হলেন অষ্টম ইমাম । তিনি হিজরী ১৪৮ সনে জন্মগ্রহণ করেন এবং হিজরী ২০৩ সনে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।৪৬ পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে ও পূর্ববতী ইমামদের নির্দেশনায় তিনি ইমামতের আসনে সমাসীন হন । আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদের পুত্র খলিফা আমিনের এবং তার অন্য আর এক পুত্র খলিফা মামুনুর রশিদের শাসনামলেই অষ্টম ইমামের ইমামতকাল অতিবাহিত হয় । পিতার মৃত্যুর পর মামুনুর রশিদের সাথে তার ভাই খলিফা আমিনের মতভেদ শুরু হয় । তাদের ঐ মতভেদ শেষ পর্যন্ত একাধিক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায় । অবশেষে খলিফা আমিনের নিহত হওয়ার মাধ্যমে ঐ সব রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটে । আর এর ফলে মামুনুর রশিদ খেলাফতের সিংহাসন ে আরোহণ করতে সমর্থ হয় ।৪৭ মামুনুর রশিদের যুগ পর্যন্ত আলাভী (রাসূল বংশের লোক) সৈয়দদের ব্যাপারে আব্বাসীয় খেলাফত প্রশাসনের নীতি ছিল আক্রোশমূলক ও রক্তলোলুপ । নবীবংশের প্রতি তাদের গৃহীত ঐ হিংসাত্মক নীতি দিনদিন কঠোরতর হতে থাকে । তৎকালীন রাজ্যের কোথাও কোন আলাভী (নবীবংশের লোক) বিদ্রোহ করলেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও মহাবিশৃংখলার সৃষ্টি হত । যে বিষয়টি স্বয়ং রাষ্ট্রিয় প্রশাসনের জন্যেও এক জটিল সমস্যার সৃষ্টি করত । পবিত্র আহলে বাইতের ইমামগণ ঐসব আন্দোলন ও বিদ্রোহের ব্যাপারে আদৌ কোন সহযোগিতা বা হস্তক্ষেপ করতেন না । সেসময় আহলে বাইতের অনুসারী শীয়া জনসংখ্যা ছিল যথেষ্ট লক্ষণীয় । নবীবংশের ইমামগণকে (আ.) তারা তাদের অবশ্য অনুকরণীয় দ্বীনি নেতা এবং মহানবী (সা.)-এর প্রকৃত প্রতিনিধি বা খলিফা হিসেবে বিশ্বাস করত । সেযুগে খেলাফত প্রশাসন কায়সার ও কায়সার রাজ দরবার সদৃশ্য ছিল । ঐ খেলাফত প্রশাসন তখন মুষ্টিমেয় চরিত্রহীন লোকদের দ্বারা পরিচালিত হত । শীয়াদের দৃষ্টিতে তা ছিল এক অপবিত্র প্রশাসন যা তাদের ইমামদের পবিত্রাংগন থেকে ছিল অনেক দূরে । এ ধরণের পরিবেশের অগ্রগতি খেলাফত প্রশাসনের জন্যে ছিল বিপদজনক এক প্রতিবন্ধক , যা খেলাফতকে প্রতিনিয়তই হুমকির সম্মুখীন করছিল । ঐ ধরণের শ্বাসরুকর পরিবেশ থেকে খেলাফত প্রশাসনকে উদ্ধারের জন্যে খলিফা মামুনুর রশিদ ভীষণভাবে চিন্তিত হল । খলিফা মামুন লক্ষ্য করল , ৭০ বছর যাবৎ আব্বাসীয় খেলাফত মরচে পড়া ঐ রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নে ব্যর্থতারই প্রমাণ দিয়েছে । বাপ দাদার আমল থেকে চলে আসা ঐ রাজনীতি সংস্কারের মধ্যেই সে ঐ দূরাবস্থার চির অবসান খুজে পেল । তার গৃহীত নতুন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে অষ্টম ইমাম হযরত রেজা (আ.)-কে তার খেলাফতের পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করে । এই ঘোষণার মাধ্যমে সে খেলাফতের পথকে সম্পূর্ণরূপে কন্টকমুক্ত করতে চেয়েছিল । কেননা , নবীবংশের সৈয়দগণ যখন রাষ্ট্রিয় প্রশাসনের সাথে জড়িত হয়ে পড়বেন , তখন খেলাফতের বিরুদ্ধে যে কোন ধরণের বিদ্রোহ থেকেই তারা বিরত থাকবেন ।

আর আহলে বাইতের অনুসারী শীয়াগণ তখন তাদের ইমামকে খেলাফত প্রশাসনের মাধ্যমে অপবিত্র হতে দেখবে , যে প্রশাসনের পরিচালকদের এক সময় অপবিত্র বলে বিশ্বাস করত । তখন আহলে বাইতের ইমামদের প্রতি শীয়াদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও পরম ভক্তি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাবে । এভাবে তাদের ধর্মীয় সাংগঠনিক কাঠামো ধ্বংস হয়ে যাবে ।৪৮ এর ফলে রাষ্ট্রিয় প্রশাসনের সামনে কোন প্রতিবন্ধকতাই আর অবশিষ্ট থাকবে না । আর এটা খুবই স্বাভাবিক যে , উদ্দেশ্য চারিতার্থের পর ইমাম রেজা (আ.)-কে তার পথের সামনে থেকে চিরদিনের জন্যে সরিয়ে দেয়া খলিফা মামুনের জন্যে কোন কঠিন কাজই নয় । মামুনের ঐ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে হযরত ইমাম রেজা (আ.)-কে মদীনা থেকে মারওয় নামক স্থানে নিয়ে আসে । ইমামের সাথে প্রথম বৈঠকেই মামুন তাকে খেলাফতের দায়িত্ব ভার গ্রহণের প্রস্তাব দেয় । এরপর সে ইমামকে তার মৃত্যুর পর খেলাফতের উত্তাধিকারী হবার প্রস্তাব দেয় । কিন্তু ইমাম রেজা (আ.) মামুনের ঐ প্রস্তাব সম্মানের সাথে প্রত্যাখ্যান করেন । কিন্তু মামুন চরমভাবে পীড়াপীড়ির মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত তার পরবর্তী খেলাফতের উত্তরাধিকার গ্রহণের ব্যাপারে সম্মত হতে ইমামকে বাধ্য করে । কিন্তু হযরত ইমাম রেজা (আ.) এই শর্তে মামুনের প্রস্তাবে সম্মত হন যে , ইমাম প্রশাসনিককারযে লোক নিয়োগ বা বহিস্কারসহ কোন ধরণের রাষ্ট্রিয় কর্মকান্ডে হস্তক্ষেপ করবেন না ।৪৯ এটা ছিল হিজরী ২০০সনের ঘটনা । কিছুদিন না যেতেই মামুন দেখতে পেল যে , শীয়াদের সংখ্যা পূর্বের চেয়েও দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে । এমনকি ইমামের প্রতি সাধারণ জনগণের ভক্তি দিনদিন আশ্চর্যজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে । শুধু তাই নয় , মামুনের সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রিয় প্রশাসনের বহু দায়িত্বশীল ব্যক্তিই ইমামের ভক্ত হয়ে পড়ছে । এ অবস্থাদৃষ্টে খলিফা মামুন তার রাজনৈতিক ভুল বুঝতে পারে । মামুন ঐ জটিল সমস্যার সমাধান কল্পে ইমামকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ করেন । শাহাদতের পর অষ্টম ইমামকে ইরানের তুস নগরীতে (বর্তমানে মাশহাদ নামে পরিচিত) দাফন করা হয় । খলিফা মামুনুর রশিদ দর্শন শাস্ত্রের গ্রন্থ সমূহ আরবী ভাষায় অনুবাদের ব্যাপারে অত্যন্ত আগহ দেখিয়ে ছিল । সে প্রায়ই জ্ঞান- বিজ্ঞান সংক্রান্ত পর্যালোচনার বৈঠকের আয়োজন করত । সে যুগের বিভিন্ন ধর্মের জ্ঞানী গুণী ও পণ্ডিতগণ তার ঐ বৈঠকে উপস্থিত হতেন এবং জ্ঞানমূলক আলোচনায় অংশ নিতেন । অষ্টম ইমাম হযরত রেজা (আ.)-ও ঐ বৈঠকে অংশ গ্রহণ করতেন । দেশ বিদেশের বিভিন্ন ধর্মের জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের সাথে পর্যালোচনা ও তর্কবিতর্কে তিনিও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন । ইমামের ঐসব জ্ঞানমূলক ঐতিহাসিক বিতর্ক অনুষ্ঠানের বর্ণনা শীয়াদের হাদীসসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে ।৫০

নবম ইমাম

ইমাম মুহাম্মদ বিন আলী আত তাকী (আ.)

অষ্টম ইমামের পুত্র হযরত মুহাম্মদ বিন আলী আত তাকী (আ.) হলেন নবম ইমাম । তিনি ইমাম যাওয়াদ এবং ইবনুর রেযা নামেও সম্যক পরিচিত । তিনি হিজরী ১৯৫ সনে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন । শীয়া সূত্রে বর্ণিত হাদীস অনুসারে হিজরী ২২০ সনে আব্বাসীয় খলিফা মু তাসিম বিল্লাহর প্ররোচনায় বিষ প্রয়োগের ফলে তিনি শাহাদত বরণ করেন । আব্বাসীয় খলিফা মামুনের কন্যা ছিল তার স্ত্রী । খলিফা মু তাসিম বিল্লাহর প্ররোচনায় ইমামের স্ত্রী (খলিফা মামুনের কন্যা) ইমামকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ করেন । বাগদাদের কাযেমাইন এলাকায় দাদার (সপ্তম ইমাম) কবরের পাশেই তাকে কবরস্থ করা হয় । পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পূর্ববতী ইমামগণের নির্দেশনায় তিনি ইমামতের পদে অধিষ্ঠিত হন । মহান পিতার মৃত্যুর সময় নবম ইমাম মদীনায় ছিলেন । আব্বাসীয় খলিফা মামুন তাকে বাগদাদে ডেকে পাঠায় । আব্বাসীয় খেলাফতের তৎকালীন রাজধানী ছিল বাগদাদ । খলিফা মামুন প্রকাশ্যে ইমামকে অত্যন্ত সম্মান প্রদর্শন করে এবং তার সাথে নম্র ব্যাবহার করে । এমনকি খলিফা মামুন তার নিজ কন্যাকে ইমামের সাথে বিয়ে দেয় । এভাবে সে ইমামকে বাগদাদেই রেখে দেয় । প্রকৃতপক্ষে ঐ বিয়ের মাধ্যমে ইমামকে ঘরের ভিতরে এবং বাইরে উভয় দিক থেকেই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পায় । ইমাম তাকী (আ.) বেশ কিছুদিন বাগদাদে কাটানোর পর খলিফা মামুনের অনুমতি নিয়ে মদীনায় ফিরে যান । তারপর খলিফা মামুনের মৃত্যু পর্যন্ত তিনি মদীনাতেই ছিলেন । খলিফা মামুনের মৃত্যুর পর মু তাসিম বিল্লাহ খলিফার সিংহাসনে আরোহণ করেন । এরপরই খলিফা মু তাসিম ইমামকে পুনরায় বাগদাদে ডেকে পাঠায় এবং তাকে নজরবন্দী করে রাখা হয় । অতঃপর খলিফা মু তাসিমের প্ররোচনায় ইমামের স্ত্রী (খলিফা মামুনের কন্যা) ইমামকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ করে ।৫১

দশম ইমাম

ইমাম আলী ইবনে মুহাম্মদ আন্ নাকী (আ.)

নবম ইমামের পুত্র হযরত আলী ইবনে মুহাম্মদ আন্ নাকী (আ.)-ই হলেন দশম ইমাম । ইমাম হাদী নামেও তাকে ডাকা হত । তিনি হিজরী ২১২ সনে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন । শীয়া সূত্রে বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী ২৫৪ হিজরী সনে আব্বাসীয় খলিফা মু তায বিল্লাহর নির্দেশে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে তাকে শহীদ করা হয় ।৫২ ইমাম নাকী (আ.) তার জীবদ্দশায় ৭জন আব্বাসীয় খলিফার (মামুন , মুতাসিম , ওয়াসিক , মুতাওয়াক্কিল , মুনতাসির , মুসতাঈন ও মুতায বিল্লাহ) শাসনামল প্রত্যক্ষ করেন । আব্বাসীয় খলিফা মুতাসিমের শাসনামলেই ইমাম নাকী (আ.)-এর মহান পিতা (নবম ইমাম) বিষ প্রয়োগের ফলে হিজরী ২২০ সনে বাগদাদে শাহাদত বরণ করেন । তখন তিনি (দশম ইমাম) মদীনায় অবস্থান করছিলেন । পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পূর্ববতী ইমামদের নির্দেশনায় তিনি ইমামতের পদে অভিষিক্ত হন । তিনি ইসলাম প্রচার ও তার শিক্ষা প্রদানে ব্যাপৃত হয়ে পড়েন । এরপর আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিলের শাসনামল শুরু হয় । ইতিমধ্যে অনেকেই ইমাম নাকী (আ.) সম্পর্কে খলিফার কান গরম করে তোলে । ফলে খলিফা মুতাওয়াক্কিল হিজরী ২৪৩ সনে তার দরবারের জনৈক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে , ইমামকে মদীনা থেকে সামেররা শহরে নিয়ে আসার নির্দেশ দেয় । সামেররা শহর ছিল তৎকালীন আব্বাসীয় খেলাফতের রাজধানী । খলিফা মুতাওয়াক্কিল অত্যন্ত সম্মানসূচক একটি পত্র ইমামের কাছে পাঠায় । পত্রে সে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে ইমামের সাক্ষাত লাভের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে এবং ইমামকে দ্রুত সামেররা শহরের দিকে রওনা হওয়ার জন্যে অনুরোধ জ্ঞাপন করেন ।৫৩ কিন্তু সামেররা শহরে প্রবেশের পর ইমামকে আদৌ কোন অভ্যর্থনা জানান হয়নি । বরং ইমামকে কষ্ট দেওয়া ও অবমাননা করার জন্যে প্রয়োজনীয় সব কিছুরই আয়োজন করা হয়েছিল । এ ব্যাপারে খলিফা বিন্দুমাত্র ত্রুটিও করেনি । এমনকি ইমামকে হত্যা এবং অবমাননা করার লক্ষ্যে বহুবার তাকে খলিফার রাজ দরবারের উপস্থিত করানো হত । খলিফার নির্দেশে বহুবার ইমামের ঘর তল্লাশী করা হয় ।

নবীবংশের সাথে শত্রুতার ব্যাপারে আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে মুতাওয়াক্কিলের জড়িু মেলা ভার । খলিফা মুতাওয়াক্কিল হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর প্রতি মনে ভীষণ বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করত । এমনকি হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর ব্যাপারে প্রকাশ্যে সে অকথ্য মন্তব্য করত । খলিফা কৌতুক অভিনেতাকে বিলাস বহুল পোষাকে হযরত আলী (আ.)-এর অনুকরণমূলক ভঙ্গীতে তার (ইমাম আলী) প্রতি ব্যাঙ্গাত্মক অভিনয় করার নির্দেশ দিত । আর ঐ দৃশ্য অবলোকন খলিফা চরমভাবে উল্লাসিত হত । হিজরী ২৩৭ সনে খলিফা মুতাওয়াক্কিলের নির্দেশেই কারবালায় হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মাযার (রওজা শরীফ) এবং তদসংলগ্ন অসংখ্য ঘরবাড়ী সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয় । তার নির্দেশে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মাযার এলাকায় পানি সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং ইমামের মাযারের উপর চাষাবাদের কাজ শুরু করা হয় । যাতে করে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর নাম এবং মাযারের ঠিকানা চিরতরে ইতিহাস থেকে মুছে যায় ।৫৪ আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিলের শাসন আমলে হেজাজে (বর্তমান সৌদি আরব) বসবাসকারী সাইয়্যেদদের (নবীবংশের লোকজন) দূর্দশা এতই চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌছায় যে , তাদের স্ত্রীদের পরার মত বোরখাও পর্যন্ত ছিল না । অল্প ক জনের জন্যে মাত্র একটি বোরখা ছিল , যা পরে তারা পালাক্রমে নামায পড়তেন ।৫৫ শাসকগোষ্ঠির পক্ষ থেকে ঠিক এমনি ধরণের অত্যাচারমূলক কার্যক্রম মিশরে বসবাসকারী সাইয়্যেদদের (নবীবংশের লোকজন) উপরও করা হয় । দশম ইমাম খলিফা মুতাওয়াক্কিলের সবধরণের অত্যাচার ও শাস্তিই অম্লান বদনে সহ্য করেন ।

এরপর একসময় খলিফা মুতাওয়াক্কিল মৃত্যুবরণ করে । মুতাওয়াক্কিলের মৃত্যুর পর মুনতাসির , মুস্তাঈন ও মু তায একের পর এক খেলাফতের পদে আসীন হয় । অবশেষে খলিফা মু তাযের ষড়যন্ত্রে ইমামকে বিষ প্রয়োগ করা হয় এবং ইমাম শাহাদত বরণ করেন ।

একাদশ ইমাম

ইমাম হাসান বিন আলী আল আসকারী (আ.)

দশম ইমামের পুত্র হযরত হাসান বিন আলী আল আসকারী (আ.) হলেন একাদশ ইমাম । তিনি হিজরী ২৩২ সনে জন্ম গ্রহণ করেন । শীয়া সূত্রে বর্ণিত হাদীস অনুসারে হিজরী ২৬০ সনে আব্বাসীয় খলিফা মু তামিদের দ্বারা বিষ প্রয়োগে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।৫৫

পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পূর্ববতী ইমামদের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি ইমামতের পদ লাভ করেন । তার ইমামতের মেয়াদকাল ছিল মাত্র সাত বছর । ইমাম আসকারী (আ.)-এর যুগে আব্বাসীয় খলিফার সীমাহীন নির্যাতনের কারণে অত্যন্ত কঠিন তাকীয়া নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে তাকে জীবন অতিবাহিত করতে হয় । তিনি হাতে গোনা বিশিষ্ট ক জন শীয়া ব্যতীত অন্য সকল সাধারণ শীয়াদের সাথে গণসংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বাধ্য হন । এরপরও তার ইমামত কালের অধিকাংশ সময় জেলে বন্দী অবস্থায় জীবন কাটাতে হয় ।৫৬ রাষ্ট্রিয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরোপিত ঐ প্রচন্ড রাজনৈতিক চাপের মূল কারণ ছিল এই যে ,

প্রথমত : সে সময় চারিদিকে শীয়াদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে ছিল । শীয়ারা যে ইমামতে বিশ্বাসী এবং কে তাদের ইমাম , এটা তখন সবাই ভাল করেই জানত । এ কারণেই খেলাফতের পক্ষ থেকে ইমামদেরকে অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অধিকতর কড়া নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখার ব্যবস্থা করা হয় । আর এসকল রহস্যময় পরিকল্পনার মাধ্যমে ইমামদেরকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা তারা চালাত ।

দ্বিতীয়ত : খেলাফত প্রশাসন এটা জানতে পরেছিল যে , ইমামের অনুসারী বিশিষ্ট শীয়ারা ইমামের এক বিশেষ সন্তানের আগমনে বিশ্বাসী এবং তাঁর জন্যে প্রতীক্ষারত । এছাড়াও স্বয়ং একাদশ ইমাম এবং তার পূর্ববতী ইমামগণের (আ.) বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী একাদশ ইমামের আসন্ন পুত্র সন্তানই সেই প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী (আ.) যার আগমনের সু সংবাদ স্বয়ং মহানবী (সা.)-ই দিয়েছেন । মহানবী (সা.)-এর ঐ সকল হাদীস শীয়া এবং সুন্নী উভয় সূত্রেই বর্ণিত হয়েছে ।৫৭ আর ঐ নবজাতকই হলেন ইমাম মাহদী (আ.) বা দ্বাদশ ইমাম । এ সকল কারণেই একাদশ ইমামকে খেলাফতের পক্ষ থেকে পূর্ববতী যে কোন ইমামের তুলনায়ই অধিকতর কড়া নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখা হয় । তৎকালীন আব্বাসীয় খলিফা এ ব্যাপারে সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল যে , যে কোন মূল্যেই হোক না কেন , ইমামতের এই বিষয়টিকে চিরদিনের জন্যে নিশ্চিহ্ন করতে হবেই । ইমামতের এই দরজাকে চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে । এ কারণেই যখন আব্বাসীয় খলিফা মু তামিদ ইমামের অসুস্থ অবস্থার সংবাদ পেল , সাথে সাথেই সে ইমামের কাছে একজন ডাক্তার পাঠায় । ঐ ডাক্তারের সাথে খলিফার বেশ ক জন বিশ্বস্থ অনুচরসহ ক জন বিচারককেও ইমামের বাড়িতে পাঠানো হয় । এ জাতীয় পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে তারা ইমামের বাড়ীর আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞাত ও তা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয় । আর এটাই ছিল খলিফা মু তামিদের মূল উদ্দেশ্য ইমামের শাহাদত বরণের পরও তার সমস্ত বাড়ী ঘরে তল্লাশী চালানো হয় । এমনকি ধাত্রীদের দিয়ে ইমামের বাড়ীর মহিলা ও তার দাসীদেরকেও দৈহিক পরীক্ষা করানো হয় । ইমামের শাহাদত বরণের পর প্রায় দু বছর পর্যন্ত খলিফার নির্দেশে ইমামের সন্তানের অস্তিত্ব খুজে পাওয়ার জন্যে সর্বত্র ব্যাপক তল্লাশী অব্যাহত থাকে । দীর্ঘ দু বছর পর খলিফা ঐ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে পড়ে ।৫৮ শাহাদত বরণের পর সামেরা শহরে নিজ গৃহে পিতার (দশম ইমাম) শিয়রে ইমাম আসকারীকে (আ.) দাফন করা হয় । পবিত্র আহলে বাইতের ইমামগণ তাদের জীবদ্দশায় অসংখ্য খ্যাতনামা আলেম ও হাদীস বিশারদ তৈরী করেছিলেন । যাদের সংখ্যা শতাধিক । এই বইয়ের কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় ঐসব (ইমামদের শিষ্যবর্গ) বিশ্ববরেণ্য আলেমদের নাম ও তাদের রচিত গ্রন্থাবলীর বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখে বিরত থেকেছি ।৫৯

দ্বাদশ ইমাম

ইমাম মাহদী (আ .)

একাদশ ইমামের পুত্র হযরত মুহাম্মদ বিন হাসান আল্ মাহদী হলেন দ্বাদশ ইমাম । তিনি মাহদী মাওউদ , ইমামুল আসর এবং সাহেবুজ জামান নামে পরিচিত । হিজরী ২৫৫ অথবা ২৫৬ সনে ইরাকের সামেরা শহরে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন । পিতার শাহাদতের (২৬০ হিঃ) পূর্ব পর্যন্ত তিনি সরাসরি পিতার তত্ত্বাবধানেই লালিত পালিত হন । অবশ্য ঐসময় তাকে লোক চক্ষুর অন্তরালে বসবাস করতে হয় । শুধুমাত্র ইমামের অনুসারী অল্প ক জন বিশিষ্ট শীয়া ব্যতীত তার সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্য আর কারও ঘটেনি । পিতার (একাদশ ইমাম) শাহাদত প্রাপ্তির পর তিনি ইমামতের পদে অভিষিক্ত হন । কিন্তু তার পরপরই মহান আল্লাহর নির্দেশে তিনি আত্মগোপন করেন । দু একটি ব্যতিক্রম ব্যতীত তার বিশেষ প্রতিনিধিবর্গ ছাড়া আর কারো নিকট তিনি আত্মপ্রকাশ করেননি ।৬০

বিশেষ প্রতিনিধি

দ্বাদশ ইমাম হযরত মাহদী (আ.) আত্মগোপন করার পর জনাব ওসমান বিন সাঈদ ওমারীকে (রহঃ) নিজের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ করেন । তিনি ইমামের দাদা (দশম ইমাম) ও বাবার (একাদশ ইমাম) বিশিষ্ট সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন । ব্যক্তিগত ভাবে ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও বিশ্বস্ত । জনাব ওসমান বিন সাঈদ ওমারীর (রহঃ) মাধ্যমেই হযরত ইমাম মাহদী (আ.) শীয়া জনগণের প্রশ্নের উত্তর দিতেন । জনাব ওসমান বিন সাঈদ ওমারীর (রহঃ) মৃত্যুর পর তারই পুত্র মুহাম্মদ বিন ওসমান ইমাম মাহদী (আ.) এর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন । জনাব মুহাম্মদ বিন ওসমান ওমারীর মৃত্যুর পর জনাব আবুল কাসিম হুসাইন বিন রূহ্ আন নওবাখতি (রহঃ) ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন । তার মৃত্যুর পর জনাব আলী বিন মুহাম্মদ সামেরী (রহঃ) ইমাম মাহদী (আ.)-এর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন । জনাব আলী বিন মুহাম্মদ সামেরী (রহঃ) হিজরী ৩২৯ সনে মৃত্যু বরণ করেন । তার মৃত্যুর অল্প ক দিন পূর্বে ইমামের স্বাক্ষরসহ একটি নির্দেশ নামা জনাব আলী বিন মুহাম্মদ সামেরীর হাতে পৌছে । ঐ নির্দেশ লিপিতে ইমাম মাহদী (আ.) তাকে বলেন যে , আর মাত্র ছয় দিন পরই তুমি এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিবে । তার পরপরই বিশেষ প্রতিনিধিত্বের যুগের অবসান ঘটবে এবং দীর্ঘকালীন অর্ন্তধানের যুগ শুরু হবে । মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ইমাম মাহদীর আত্মপ্রকাশের নির্দেশনা আসা পর্যন্ত ঐ দীর্ঘ কালীন অর্ন্তধানের যুগ অব্যাহত থাকবে ।৬১ ইমামের হপ্তলিপি সম্পন্ন ঐ পত্রের বক্তব্য অনুসারে ইমাম মাহদী (আ.)-এর অর্ন্তধানকালীন জীবনকে দু টো পর্যায়ে ভাগ করা যায় ।

প্রথম : স্বল্পকালীন অর্ন্তধান । হিজরী ২৫০ সনে এই অর্ন্তধান শুরু হয় এবং হিজরী ৩২৯ সন পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে । অর্থাৎ প্রায় ৭০ বছর পর্যন্ত এই অর্ন্তধান স্থায়ী ছিল ।

দ্বিতীয় : দীর্ঘকালীন অর্ন্তধান । হিজরী ৩২৯ সন থেকে এই অর্ন্তধান শুরু হয় এবং মহান আল্লাহর ইচ্ছামত এই অর্ন্তধান অব্যাহত থাকবে । মহানবী (সা.)-এর একটি সর্বসম্মত হাদীসে বলা হয়েছে : এ বিশ্বজগত ধ্বংস হওয়ার জন্যে যদি একটি দিনও অবশিষ্ট থাকে , তাহলে মহান আল্লাহ অবশ্যই সে দিনটিকে এতখানি দীর্ঘায়িত করবেন , যাতে আমারই সন্তান মাহদী (আ.) আত্মপ্রকাশ করতে পারে এবং অন্যায় অত্যাচারে পরিপূর্ণ এ পৃথিবীতে সম্পূর্ণরূপে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে ।৬২

ইমাম মাহদী (আ.) এর আবির্ভাব

গণহেদায়েতের নীতি সমগ্র সৃষ্টিজগতের মধ্যে বলবৎ রয়েছে । সেই নীতির , অপরিহার্য ফলাফল স্বরূপ মানবজাতি ওহী নবুয়তের শক্তি সরঞ্জামে সুসজ্জিত । ঐ বিশেষ শক্তিই মানব জাতিকে মানবতার শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌভাগ্যের পথে পরিচালিত করে । আর এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার যে , আল্লাহ প্রদত্ত ঐ বিশেষ শক্তি যদি সামাজিক জীবন যাপনকারী মানবজাতিকে শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌভাগ্যের পথে পরিচালিত করতেই না পারে , তাহলে ঐ বিশেষ শক্তির সরঞ্জাম মানবজাতিকে সুসজ্জিত করার মূলকাজটিই বৃথা বলে প্রমাণিত হবে । অথচ , এ সৃষ্টিজগতে বৃথা বলে কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই । অন্যকথায় বলতে গেলে , মানব জাতি যেদিন থেকে এ জগতে জীবন যাপন করতে শুরু করেছে , সেদিন থেকেই সে সৌভাগ্যপূর্ণ (সার্বিক অর্থে) এক সামাজিক জীবন যাপনের আকাংখা তার হৃদয়ে লালন করে আসছে । আর সেই কাংখিত লক্ষ্যে পৌছার জন্যেই সে প্রয়াজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে । তার হৃদয়ে ঐ আকাংখা সত্যিই যদি অবাস্তব হত , তাহলে নিশ্চয়ই সে ঐ আকাংখার স্বপ্নিল ছবি তার হৃদয় পটে আকতো না । অথচ , আবহমান কাল থেকে জগতের প্রতিটি মানুষই তার জীবনে এমন একটি আকাংখা হৃদয় কঠুরীতে লালন করে আসছে । যদি খাদ্যের অস্তিত্ব না থাকত তা হলে ক্ষুধার অস্তিত্ব থাকত না । পানির অস্তিত্বই যদি না থাকবে , তাহলে কিভাবে তৃষ্ণার অস্তিত্ব থাকতে পারে ? যৌনাংগের অস্তিত্বই যদি না থাকত তা হলে যৌন কামনার অস্তিত্বও থাকত না । এ কারণেই বিশ্ব জগতে এমন এক দিনের আবির্ভাব ঘটবে , যখন মানব সমাজ সম্পূর্ণ রূপে ন্যায়বিচার ভোগ করবে । সমগ্র বিশ্বে তখন শান্তি নেমে আসবে । সবাই শান্তিপূর্ণ ভাবে সহাবস্থান করবে । তখন মানুষ শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের মাঝে নিমিজ্জিত হবে । অবশ্য ঐ ধরণের পরিবেশ টিকিয়ে রাখার ব্যাপরটি তখন মানুষের উপরই নির্ভরশীল হবে । ঐধরণের সমাজের নেতৃত্ব দান করবে বিশ্ব মানবতার মুক্তিদাতা ; হাদীসের ভাষায় যার নাম হবে মাহ্দী (আ.) । পৃথিবীতে প্রচলিত সকল ধর্মেই বিশ্ব মানবতার মুক্তিদাতা সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে এবং সাধারণভাবে তার আবির্ভাবের সুসংবাদও প্রদান করা হয়েছে । যদিও ঐ বক্তব্যের বাস্তব প্রয়োগে কমব েশী মতভেদ রয়েছে । সর্বসম্মত হাদীসে মহানবী (সা.) হযরত ইমাম মাহদী (আ.) সম্পর্কে বলেছেনঃ প্রতিশ্রুত মাহদী আমারই সন্তান ।

মহানবী (সা.) ও পবিত্র আহলে বাইতের ইমামদের পক্ষ থেকে ইমাম মাহদী (আ.)-এর আবির্ভাব সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে । সেখানে বলা হয়েছে যে , ইমাম মাহদী (আ.) তার আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে সমগ্র মানব সমাজকে প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্বে উন্নীত করবে এবং আধ্যাত্মিক জীবন দান করবে ।৬৩ অসংখ্য হাদীসের সাক্ষ্য অনুযায়ী একাদশ ইমাম হযরত হাসান আসকারীর (আ.) সন্তানই ইমাম মাহদী (আ.) ।৬৪ হাদীস সমূহের বক্তব্য অনুযায়ী হযরত ইমাম মাহদী (আ.)-এর জন্মের পরে সুদীর্ঘকালের জন্যে তিনি অদৃশ্যে অবস্থান করবেন । তারপর তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন এবং অন্যায় ও অত্যাচারপূর্ণ বিশ্বে সত্যিকার অর্থে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন ।


4

5