মিরেকলস অব দ্য কোরআন

মিরেকলস অব দ্য কোরআন 30%

মিরেকলস অব দ্য কোরআন লেখক:
: ডাঃ উম্মে কাউসার হক
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

মিরেকলস অব দ্য কোরআন
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 14 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 25317 / ডাউনলোড: 4265
সাইজ সাইজ সাইজ
মিরেকলস অব দ্য কোরআন

মিরেকলস অব দ্য কোরআন

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মিরেকলস অব দ্য কোরআন

(কোরআনের অলৌকিকতা)

নিশ্চয়ই এ কোরআন রাব্বুল আলামীনের নাযিলকৃত

(কোরআন , ২৬ : ১৯২)

মূল : হারুন ইয়াহিয়া

ভাষান্তর : ডাঃ উম্মে কাউসার হক

এই বইটি আল হাসানাইন (আ.) ওয়েব সাইট কর্তৃক আপলোড করা হয়েছে ।

http://alhassanain.org/bengali

বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম

পাঠকের প্রতি

বিবর্তন থিওরীর পতনের জন্য কেন একটি বিশেষ অধ্যায় সংযোজন করা হলো তার কারণ- এই থিওরীটি সব ধরণের আধ্যাত্মবাদ বিরোধী দর্শনের ভিত্তি নির্মান করে। ডারউইনবাদ যেহেতু সৃষ্টির সত্যকে অস্বীকার করে আর এভাবে আল্লাহর অস্তিত্বকেও প্রত্যাখ্যান করে ; তাই বিগত ১৪০ বছর যাবৎ এই ডারউইনবাদ বহু লোকের বেলায় বিশ্বাস পরিত্যাগ করতে কিংবা সন্দেহে পতিত হবার কাজ করে যাচ্ছে । তাই এই থিওরী যে একটি প্রবঞ্চণা তা প্রমাণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যা কিনা ধর্মের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সম্পর্কিত। তাই এটি অত্যাবশ্যক বা জরুরী যে এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব খানা সকলের উপর বর্তায়। আমাদের কিছু কিছু পাঠক হয়তো বা জীবনে একটি মাত্র বই পড়ার সুযোগ পাবেন। তাই এ বিষয়ের সারসংক্ষেপের জন্য একটি অধ্যায় বরাদ্দ করাকেই আমরা উচিৎ বলে মনে করছি।

লেখকের সবখানা বইয়েই বিশ্বাস সম্পর্কিত বিষয়গুলো কোরআনে আয়াতের আলোকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে আর মানব সমাজকে আল্লাহ তাআলার বাণীগুলো সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে এবং সেগুলো অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা করার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলার আয়াতসমূহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবগুলো বিষয় এমনভাবে খণ্ডন করা হয়েছে যেন তা পাঠকের মনে কোন ধরণের সন্দেহের উদ্রেক না করে কিংবা কোন প্রশ্ন রেখে না যায়। এখানে আন্তরিক , সরল আর সাবলীল রচনাশৈলীর ব্যবহার করা হয়েছে যেন প্রতিটি বয়সের এবং সমাজের প্রত্যেক স্তরের প্রতিটি মানুষ এই বইগুলো সহজেই হৃদয়ংগম করতে পারে। মনে দাগ কেটে যাওয়া এই সহজবোধ্য বৃত্তান্তসমূহ বইখানিকে পাঠকের পক্ষে একটি বার বসে সমাপ্ত করে উঠতে পারাকে সম্ভব করে তুলেছে। এমনকি যারা আধ্যাত্মিক বিষয়টিকে প্রচণ্ডভাবে অস্বীকার করে তারাও এই বইগুলোতে বর্ণিত প্রকৃত সত্য তথ্যগুলো দিয়ে প্রভাবিত হয় আর তাই বইগুলোর বিষয়বস্তুসমূহকে তারা আর অসত্য বা অমূলক বলে প্রতিপন্ন করতে পারে না।

এই বইখানাসহ লেখকের অন্যান্য সব সৃষ্টিকর্মগুলো একাকী পড়া যায় কিংবা দলবদ্ধ হয়ে আলাপচারীতায় আলোচনা করা যেতে পারে। আর পাঠকগণ যারা এই গ্রন্থগুলো হতে সুফল পেতে ইচ্ছুক হন তারা এ অর্থে আলোচনা করাকে খুবই ফলপ্রসূ পাবেন যে , তারা তাদের নিজেদের ভাবনা আর অভিজ্ঞতাগুলো একে অপরের কাছে বর্ণনা করতে সক্ষম হবেন।

তদুপরি একমাত্র মহান আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির নিমিত্তে লেখা এই বইগুলো বিভিন্ন উপস্থাপনায় ব্যবহার করে আর পঠনের মাধ্যমে ধর্মের এক বিরাট সেবা করা হবে। লেখকের সবগুলো বই দৃঢ় প্রত্যয় উৎপাদন করে (আর বিশ্বাসযোগ্য)। এ কারণেই যারা মানব সমাজকে ধর্ম সম্পর্কে অবহিত করতে ইচ্ছুক তাদের জন্য সবচাইতে কার্যকরী ব্যবস্থা হলো - এই বইগুলি পড়ার ব্যাপারে মানুষকে উৎসাহিত করা।

আশা করা যায় যে পাঠকগণ বইয়ের শেষের পাতাগুলোয় অন্যান্য কিছু বইয়ের নিবন্ধসমূহে কিছূ সময় ধরে চোখ বুলিয়ে যাবেন আর আকীদা (বিশ্বাস) সম্পর্কিত বিষয়গুলোর সমৃদ্ধ উৎস গুলো - যা কিনা খুবই উপকারী ও পড়তেও আনন্দদায়ক - সেগুলোর সঠিক মূল্যায়ন করবেন।

এই বইগুলোতে অন্যান্য কিছু বইয়ের ন্যায় আপনি লেখকের ব্যক্তিগত মতামত , সন্দেহপূর্ণ (অনির্ভর যোগ্য) সূত্র হতে নেয়া ব্যাখ্যাবলী , রচনা শৈলী যা পবিত্র বিষয়ের কারণে সম্মান ও গভীর শ্রদ্ধা ও ভয়ের ব্যাপারে অমনোযোগী , হতাশাব্যঞ্জক , সন্দেহ উদ্রেককারী এবং নৈরাশ্যজনক বর্ণনা যা পাঠকের অন্তরে বিচ্যূতির সৃষ্টি করে - এগুলোর কোন কিছুই আপনি পাবেন না।

লেখক পরিচিতি

লেখন হারুন ইয়াহিয়া ছদ্মনামে লেখালেখি করছেন। তিনি ১৯৫৬ সালে আংকারায় জন্ম গ্রহন করেন। তিনি ইস্তাম্বুলের মিমার সিনান ইউনিভার্সিটিতে আর্টস আর ইস্তাম্বুল ইউনিভার্সিটিতে দর্শন শাস্ত্রে পড়াশুনা করেন। ১৯৮০ সন থেকে তিনি রাজ নৈ তিক বিশ্বাস সংক্রান্ত এবং বিজ্ঞান বিষয়ক ব্যাপারগুলো নিয়ে বহু গ্রন্থ প্রকাশ করে আসছেন। গ্রন্থকার হিসেবে হারুন ইয়াহিয়া একটি সুপরিচিত নাম যিনি বিবর্তনবাদীদের প্রবঞ্চণা , তাদের দাবিসমূহের অসিদ্ধতা আর ডারউইনবাদ এবং রক্তপাতে বিশ্বাসী ভাবাদর্শের মধ্যকার যোগাযোগ সংক্রান্ত বিষয়গুলো ফাঁস করে দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বহু গ্রন্থ তিনি লিখেছেন।

তার ছদ্মনাম হা রু ন ও ইয়াহিয়া এ দুটি নাম নিয়ে গঠিত। দুজন শ্রদ্ধেয় নবীর নাম থেকে এ দুটি নাম নেয়া হয়েছে , যাঁরা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। লেখকের বইগুলোর প্রচ্ছদসমূহে যে সীল রয়েছে তা এদের বিষয়সমূহের সংযোগে প্রতীকি অর্থ বহন করে। এই মোহর আল্লাহ তাআলার সর্বশেষ গ্রন্থ ও বাণী হিসাবে কোরআনকে আর হযরত মুহম্মদ (দঃ) কে সর্বশেষ নবী হিসেবে তুলে ধরে। পবিত্র কোরআন আর সুন্নাহের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে লেখক তাঁর মূখ্য উদ্দেশ্য হিসেবে এটি ধরে নিয়েছেন যে , তিনি যেন অবিশ্বাস জন্মানো ভাবাদর্শগুলোর প্রতিটি মৌলিক বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণিত করতে পারেন আর এমনভাবে তিনি তারঁ শেষ কথা বলে দিতে চান যা কিনা ধর্মের বিরুদ্ধে উত্থাপিত আপত্তিসমূহ সম্পূর্ণরূপে স্তব্ধ করে দিতে পারে। সর্বোচ্চ প্রজ্ঞা ও নৈতিক পূর্ণতা অর্জনকারী নবীর (দঃ) সীল বা মোহরটি লেখকের এই শেষ কথা বলার নিয়ত হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। লেখকের সমস্ত কার্যাবলীই একটি উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে , যা হলো : মানুষের কাছে কোরআনের বার্তা পৌছে দেয়া , আর আকীদা বা মৌলিক বিশ্বাস সম্পর্কিত বস্তুগুলো যেমন : আল্লাহর অস্তিত্ত্ব , তারঁ একত্ব ও পরকাল - এগুলো সম্পর্কে চিন্তা করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা ; আর তাদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী স্মরণ করিয়ে দেয়া ।

লেখক হারুন ইয়াহিয়া অসংখ্য দেশ যেমন ভারত , ইংল্যান্ড , ইন্দোনেশিয়া , পোল্যান্ড ,বসনিয়া , স্পেন , ব্রাজিল ইত্যাদি নানা দেশের পাঠকদের অনুরাগ অর্জন করেছেন। অসংখ্য ভাষায় তার বই অনূদিত হয়েছে। আর ইংরেজী , ফরাসী , জার্মানী , ইতালিয়ান , পর্তুগীজ , উর্দু , আরবী , আলবেনিয়ান , রাশিয়ান , বসনিয়ান , তার্কিশ ভাষায় অনূদিত বইসমূহ পাওয়া যাচ্ছে। (বর্তমানে বাংলা ভাষায়ও গুটিকতেক বই পাওয়া যাচ্ছে)।

অত্যন্ত স্বীকৃত এই সৃষ্টিকর্মগুলো পৃথিবীর সর্বত্র বহুলোকের ক্ষেত্রে আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করতে ও অন্যান্য বহু লোকের বেলায় তাদের ঈমানের গভীরতর অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করার ক্ষেত্রে নিমিত্ত বা উপায় স্বরূপ কাজ করছে। এই বইগুলোতে যে প্রজ্ঞা আর আন্তরিক ও সহজবোধগম্য শৈলী ব্যবহৃত হয়েছে তা বইগুলোতে এক স্বতন্ত্র ছোঁয়া রেখে গিয়েছে - ফলে যারা এই বইগুলো পড়ে আর পর্যবেক্ষণ করে তাদেরকে বইগুলো প্রত্যক্ষভাবে নাড়া দেয়। আপত্তিমুক্ত এই লেখাগুলোতে দ্রুত কার্যকারীতা , সুস্পষ্ট ফলাফল , অকাট্যতা , এ সমস্ত গুণাবলীমণ্ডিত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে। এই বইগুলোতে যে ব্যাখ্যাবলী প্রদান করা হয়েছে তা অবশ্যস্বীকার্য , সুস্পষ্ট এবং আন্তরিক আর এগুলোর সুস্পষ্ট উত্তরে পাঠকগণের মনোন্নয়ন ঘটে। যারা এই বইগুলো পড়বেন আর অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করবেন তাদের পক্ষে আর কখনও বস্তুবাদ দর্শন , নাস্তিকতা আর অন্যান্য যে কোন ধরণের বিকৃত ভাবাদর্শ কিংবা দর্শনকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করা সম্ভব হবে না। এমনকি যদিও তারা সমর্থন করেই যায় , এগুলো হবে কেবল ভাবাবেগপূর্ণ জেদেরই ফলাফল : কেননা এই বইগুলো উক্ত ভাবাদর্শগুলোর অত্যন্ত মূল বা ভিত্তি হতেই অসত্য বা অমূলক প্রতিপন্ন করে। হারুন ইয়াহিয়ার লেখা বইগুলোর বদৌলতে সমসাময়িক সব ধরণের অস্বীকারের আন্দোলন আজ আদর্শগতভাবেই পরাজিত হয়েছে।

এতে কোনই সন্দেহ নেই যে , এগুলোর বৈশিষ্ট্যাবলী- এদের প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত প্রজ্ঞা ও সহজ বোধ্যতারই ফলস্বরূপ। এটা নিশ্চিৎ যে , লেখক নিজে কখনও গর্ববোধ করেন না ; তিনি কেবল আল্লাহর সঠিক পথ সন্ধানের ক্ষেত্রে উপায় হিসেবে সাহায্য করার নিয়ত করেন। অধিকন্তু লেখক তার বইগুলো হতে পার্থিব অর্জনের চেষ্টা করেন না। এই লেখক তো নয়ই এমনকি অন্যান্য যারাই এই বইগুলোর প্রকাশ কিংবা পাঠকদের নিকট পৌছে দেয়ার কাজে জড়িত , তারা কেউই পার্থিব কোন লাভ অর্জন করেন না।

এ সমস্ত তথ্যগুলো বিবেচনা করে যারা মানুষের অন্তরের চোখ খুলে দেয়ার আর মানুষকে আল্লাহর আরো অনুগত বান্দা হতে পরিচালনাকারী এই বই গুলো সবাইকে পড়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করবেন , তারা নিঃসন্দেহে অমূল্য এক সেবা করে যাবেন।

ইতিমধ্যে , যে বইগুলো মানুষের অন্তরের সংশয় সৃষ্টি করে , ভাবাদর্শগত গোলমালের দিকে পরিচালিত করে এবং মানুষের মনের সন্দেহ দূরীকরণের ব্যাপারে যে বইগুলোর সুস্পষ্টভাবে কোন শক্তিশালী ও সঠিক প্রভাব নেই , এগুলোর প্রচার করা কেবলই সময় ও শক্তির অপচয় হবে মাত্র। এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান যে পথহারা মানুষকে মুক্ত করা ছাড়া শুধুমাত্র লেখকের সাহিত্যিক দক্ষতার উপর জোর দিয়ে রচিত বইয়ের পক্ষে এমন বড় ধরণের প্রভাব ফেলা অসম্ভব। এতে যারা সন্দেহ করে তারা সহজেই দেখতে পাবে যে , হারুন ইয়াহিয়ার বইগুলোর একমাত্র উদ্দেশ্য হলো অবিশ্বাসসমূহ দূর্বল করে দেয়া আর কোরআনের নৈতিক মূল্যবোধগুলো ছড়িয়ে দেয়া। এই সেবাকাজগুলি যে ধরণের সাফল্য , প্রভাব কিংবা আন্তরিকতা অর্জনে সহযোগী তা পাঠকদের বিশ্বাস উৎপাদন হতেই প্রকাশিত হয়।

একটি বিষয় মনে রাখা দরকার : মুসলমানগণ যে অবিরাম নিষ্ঠুরতা , দ্বন্দ্ব আর যে সমস্ত অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হচ্ছে তা ধর্মহীন আদর্শগত প্রচারের ফলাফল। এগুলোর অবসান হতে পারে বিশ্বাসহীন ভাবাদর্শের পরাজয়ের মাধ্যমে আর এটা নিশ্চিত করার মাধ্যমে যে , প্রতিটি ব্যক্তি সৃষ্টির রহস্য ও কোরআনের মূল্যবোধ সম্পর্কে এমন জ্ঞান রাখে যেন তারই মাধ্যমে জীবন যাপন করতে পারে। পৃথিবীর এখনকার হাল চাল বিবেচনা করলে যা কিনা মানুষকে সহিংসতা , দুর্নীতি ও দ্বন্দের সর্পিল নিম্নগতির দিকে পরিচালিত করতে বাধ্য করছে -এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে , এই কাজটি আরো দ্রুতগতিতে আর কার্যকারীরূপে করে যাওয়া দরকার। অন্যথায় তখন অত্যন্ত বিলম্ব হয়ে যাবে।

এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে , হারুন ইয়াহিয়ার ধারাবাহিক সৃষ্টিকর্মগুলো অগ্রনী ভূমিকা গ্রহন করেছে। আল্লাহর ইচ্ছায় এই বইগুলো একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের জন্য কোরআনে প্রতিশ্রুত শান্তি , রহমত , সুবিচার ও সুখের সন্ধান খুঁজে পাওয়ার উপায় বের করবে।

16

হযরত আলী ( আঃ ) ও আছেম

জাঙ্গে জামাল বা উষ্ট্রের যুদ্ধ24 শেষ হবার পর হযরত আলী (আঃ) একবার বসরা শহরে গেলেন। বসরায় অবস্থানকালে একদিন তিনি তাঁর এক অসুস্থ বন্ধু আলা ইবনে যিয়াদ হারেছীকে দেখতে বাড়িতে গেলেন। তার বাড়িটি ছিল খুব প্রকাণ্ড ও জাঁকজমকপূর্ণ। হযরত আলী (আঃ) তাঁর বন্ধুর এ বিরাট বাড়ির সৌন্দর্য দেখে তাকে বললেন , এ দুনিয়াতে তোমার এতো বিরাট ও সুন্দর একটা বাড়ি কোন্ কাজের জন্য , তুমি যখন পরকালে একটা প্রশস্তও সুন্দর বাড়ির অধিক দরকার মনে করছো ? কিন্তু তুমি যদি এখন চাও তবে দুনিয়াতে তোমার এ বাড়িটিকে আখেরাতের একটি জাঁকমজকপূর্ণ বাড়ি লাভ করার উসিলা বানাতে পারো। তার পন্থা হলো যে , তুমি তোমার এ বাড়িতে মেহমানদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করবে। লোকদের সাথে নম্র ও ভালোবাসার মন নিয়ে আচার-ব্যবহার করবে। এ বাড়িতে মুসলমানদের যে হক অধিকার রয়েছে তা যথাযথ আদায় করো এবং লোকদেরকে তাদের হক অধিকার প্রদানের ব্যাপারে সম্ভাব্য সব রকমের সাহায্য-সহযোগিতা করবে যাতে করে লোকেরা এ বাড়িটিকে তাদের প্রাপ্য অধিকার পাওয়ার কেন্দ্র বলে স্বীকার করে নেয়। আসল কথা হলো তুমি এ বাড়িটিকে কেবল তোমার নিজের কাজের জন্যই ব্যবহার করবে না , বরং সাধারণ মুসলমানদের উপকার ও কল্যাণের কেন্দ্র বানিয়ে দাও দেবে।

আলা : হে আমীরুল মুমিনীন (আঃ)! আমি আমার ভাই আছেম সম্পর্কে আপনার কাছে একটি অভিযোগ পেশ করতে চাই।

বলো , তোমার কি অভিযোগ ? সে দুনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করেছে এবং ছেঁড়া-ফাঁড়া জামা-কাপড় পরিধান করে বৈরাগ্যবাদ গ্রহণ করেছে। কারো সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।

তাকে আমার সামনে হাজির করো।

আছেমকে তাঁর সামনে হাজির করা হলো। হযরত আলী (আঃ) তাকে বললেন , হে নিজের জীবনের দুশমন! শয়তান তোমার জ্ঞান-বুদ্ধি হরণ করে নিয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না যে , তোমার স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি কেন তোমার মায়া-দয়া হচ্ছে না ? তুমি কি এ কথা মনে করে নিয়েছো যে , যে মহান আল্লাহ এ দুনিয়ার সমস্ত পাক-পবিত্র নিয়ামত তোমার জন্য হালাল ও বৈধ বলে ঘোষণা করেছেন , তিনিই আবার তোমার উপর এ কারণে নারাজ হয়ে যাবেন যে , তুমি সে সমস্ত নেয়ামত উপভোগ করছো ? তুমি কি খোদার কাছে এ নিয়ামতসমূহ থেকে তুচ্ছ ?

জবাবে আছেম বললো , হে আমীরুল মোমিনীন! আপনিও তো আমার মতোই। আপনিও তো নিজের ওপর অনেক কষ্ট দিচ্ছেন। আপনিও তো নরম কাপড়-চোপড় পরিধান করেন না এবং রুচিসম্পন্ন খাদ্য খাবার খাচ্ছেন না। এভাবে আমিও সে সমস্ত কাজই করছি যা আপনি করছেন। আমি সে পথেরই অনুসরণ করে চলেছি যে পথে আপনি চলছেন।

হযরত আলী (আঃ) বললেন , হে আছেম! তুমি ভুল করছো। আমার ও তোমার মাঝে একটা পার্থক্য রয়েছে। আমি যে পদে অধিষ্ঠিত আছি তুমি তা নও। আমি উম্মতের নেতা , শাসক ও পথ প্রদর্শকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। আর শাসক ও পথ প্রদর্শকের জীবন যাপনের পদ্ধতি ও দায়-দায়িত্ব সাধারণ মানুষদের চাইতে ভিন্নতর অর্থাৎ একজন শাসন কর্তার যে কর্তব্য একজন সাধারণ মানুষের তা নয়। মহান আল্লাহ ন্যায়পরায়ণ শাসকদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন যে , সে তার জাতির দুর্বল ও নিম্নস্ত রের লোকদের জীবন যাপনের প্রতি দৃষ্টি রেখে নিজের জীবন পরিচালনা করবে। মহান আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ন্যায়পরায়ণ শাসকের এভাবে জীবন যাপন করা উচিত যেভাবে গরিব ও নিম্নস্তরের লোকদের অন্তরে দুঃখ না থাকে এবং দারিদ্র্য ও অভাব-অনটন তাদের অন্তরে কোন প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। এ কারণে আমার কর্তব্য এক রূপ আর তোমার কর্তব্য অন্যরূপ।25

17

ধনী ও দরিদ্র

হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) তাঁর সব সময়ের নিয়ম মোতাবেক নিজের বাড়িতে দরবারে বসেছিলেন। তাঁর সাথী ও বন্ধুগণ আশপাশে তাঁকে এভাবে ঘিরে রেখেছিল , যেমন আংটির মাঝে পাথর। এমন সময় ছেঁড়াফাঁড়া জামা-কাপড় পরিহিত একজন গরিব লোক রাসূলের (সাঃ) এ মজলিসে হাজির হলো। ইসলামী রীতিনীতির দৃষ্টিতে মজলিসে উপস্থিত প্রত্যেকেই সমমর্যাদার অধিকারী এবং বৈঠকের আদব ও রীতি হচ্ছে নবাগত ব্যক্তি যেখানেই খালি স্থান দেখবে সেখাবেই বসে যাবে। কারো এটা মনে করা উচিত হবে না যে , অমুক স্থান আমার মর্যাদার সাথে মানানসই নয়। সে হিসাবে উক্ত গরিব লোকটি বসার জন্য একটি খালি জায়গা খুঁজতে লাগলো। সে চারদিকে তাকিয়ে এক কোণায় একটি খালি জায়গা দেখতে পেলো। তাই চুপচাপ সেখানে গিয়ে বসে পড়লো। ঘটনাক্রমে সেখানে পূর্ব থেকেই একজন ধনী লোক বসা ছিল। ঐ গরীব লোকটিকে তার পাশে বসতে দেখে সে তার মূল্যবান জামাকাপড় টেনে নিল এবং এক পাশে সরে গেল। রাসূলে খোদা (সাঃ) খুব লক্ষ্য করে এ দৃশ্যটি দেখছিলেন। ধনী লোকটির এ আচরণ দেখে মহানবী (সাঃ) তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন , তুমি ভয় পেয়েছো যে , এ গরিব লোকটির দারিদ্র্য ও অভাব অনটনের ছায়া আবার তোমার উপরও যেন না পড়ে।

সে বললো , না! হে আল্লাহর রাসূল! এমনটা নয়।

রাসূল (সাঃ) বললেন , তাহলে এমন কি কারণ ছিল যে , তমিু এ গরিব লোকটিকে দেখেই এক পাশে সরে গেলে ?

সে বললো , হে আল্লাহর রাসূল! আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আমার অন্যায় স্বীকার করছি। এখন আমি এ অপরাধের কাফফারা দিতে প্রস্তুত আছি। আমি আমার এ অপরাধের কাফফারা হিসাবে আমার সম্পদের অর্ধেক অংশ এ গরিব ভাইকে দান করে দিতে চাই।

ধনী লোকটির এ কথা শুনে সে গরিব লোকটি বলে উঠলো , কিন্তু আমি তা গ্রহণ করার জন্য মোটেও প্রস্তুত নই।

রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে বসা অন্য সমস্তলোকেরা জিজ্ঞাসা করলো , কেন ?

উত্তরে সে বললো , আমার ভয় হচ্ছে যে , আবার ধন-সম্পদের প্রাচুর্যে একদিন আমিও এরূপ অহংকারী হয়ে না যাই। আমিও আমার অপর মুসলিম ভাইয়ের সাথে এধরনের আচরণ শুরুকরে না দেই , যেমনটি আজ এ ব্যক্তি আমার সাথে করেছে।26

18

এক দোকানী ও এক পথিক

উঁচু-লম্বা ও প্রশস্তদেহের অধিকারী এক ব্যক্তি একদিন কুফার বাজারের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার চেহারায় এমন সব নিদর্শন পরিলক্ষিত হচ্ছিল , যেগুলোকে রণাঙ্গনের স্মৃতিচিহ্ন বলা যেতে পারে। তার চোখের পাশ দিয়ে কাটা চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল। এদিকে এক দোকানি তার দোকানে বসেছিল। বন্ধুদেরকে হাসানোর জন্য সে এক মুষ্টি ময়লা তার উপর নিক্ষেপ করলো। দোকানদারের এ অভদ্র আচরণের জন্য সে পথিক কোন প্রকার রাগ বা ক্রোধ প্রকাশ না করে অত্যন্ত প্রশস্তিও নিশ্চিন্তমনে এভাবে পথ এগিয়ে চললেন যেন কোন কিছুই ঘটেনি। পথিক কিছু দূর চলে যাবার পর দোকানির এক বন্ধু তাকে বললো , তুমি যে পথিকের উপর ময়লা নিক্ষেপ করে তার অবমাননা করেছো , তিনি কে তা কি তুমি জানো ? দোকানি বললো , না , অমি তো তাকে মোটেও চিনি না। আমি তো মনে করেছি সহস্র পথিকের ন্যায় তিনিও একজন। তোমার যদি জানা থাকে তাহলে বলো , এ লোকটি কে ?

বন্ধুটি বললো , আসলেই তুমি তাকে চেন না ? বড় আশ্চর্যের বিষয়! তিনি আর কেউ নন। তিনি হলেন ইসলামী সেনাবাহিনীর প্রখ্যাত সেনাপতি জনাব মালিক আশতার নাখঈ। বড় আশ্চর্যের কথা! তিনি বিখ্যাত সেনাপতি মালিক আশতার ? সেই মালিক আশতার ,যার ভয়ে বাঘের কলিজাও পানি হয়ে যায়। যার নাম শুনে শত্রুপক্ষের দেহ-মন কেপেঁ ওঠে!

:হ ্যাঁ! হ্যাঁ!! তিনি সে মালিক আশতার।

:হ ায় অফসোস! আমি তো অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি। এক্ষণই তিনি হুকুম দিবেন আমার অপরাধের কঠিন শাস্তি দেয়া হোক! আমি এক্ষণই তার পিছু পিছু দৌঁড়ে যাই এবং তার কাছে নিবেদন করি যে , আমার অপরাধ ক্ষমা করে দিন। না জেনে আমি এ অন্যায় কাজ করে ফেলেছি।

এ কথা বলেই দোকানদার জনাব মালিক আশতারের পেছনে পেছনে দৌঁড়াতে লাগলো। কিছু দূর যাবার পর সে দেখতে পেলো যে , মালিক আশতার একটা মসজিদের দিকে যাচ্ছেন। দোকানীও তার পিছে পিছে মসজিদে প্রবেশ করলো। দেখতে পেলো তিনি নামায আদায় করছেন। কিছুক্ষণ পর্যন্ত সে সেখানে অপেক্ষা করলো। নামায শেষ হবার সাথেই সাথেই দোকানি জনাব মালিক আশতারের সামনে এসে অত্যন্ত লজ্জিত ও বিনম্রভাবে নিজের পরিচয় দিয়ে বললো , আমি সে লোক , যে নিজের অজ্ঞতা ও বোকামির কারণে আপনার সাথে অন্যায় করেছি। হযরত মালিক আশতার বললেন , খোদার কসম করে বলছি , মসজিদে আসার আমার আদৌ ইচ্ছা ছিল না। আমি তো কেবল তোমার জন্যই এখানে এসেছি। কেননা আমি বুঝতে পারলাম যে , তুমি একটা অজ্ঞ , জাহেল ও পথভ্রষ্ট লোক। আর লোকদেরকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দিয়ে থাকো। তোমার এ অজ্ঞতা দেখে আমার মনে ব্যথা পেলাম। তাই আমি মসজিদে চলে এসেছি এ জন্য যে , আল্লাহর নিকট তোমার সঠিক পথে হেদায়েত লাভের জন্য দোয়া করবো। তুমি যে ভয় পাচ্ছ তেমন কোনো উদ্দেশ্য আমার ছিল না।27

19

ইমাম গাযযালী ও ডাকাত দল

ইসলামী জ্ঞান রাজ্যের প্রখ্যাত পন্ডিত ব্যক্তি ইমাম গাযযালী ইরানের তুস নগরীর অধিবাসী ছিলেন। পবিত্র মাশহাদের নিকটতম একটি এলাকার নাম তুস। সেকালে নিশাপুর ছিল ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার প্রাণকেন্দ্র।

পঞ্চম হিজরী শতাব্দীর কথা। নিশাপুর শহরটি তখন ইসলামী জ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হতো। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা অর্জনের জন্য এখানে আসতো। তাই গাযযালীও জ্ঞান অর্জনের জন্য এখানে আসলেন। দীর্ঘদিন পর্যন্ত সুযোগ্য ওস্তাদ ও ওলামাগণের তত্ত্বাবধানে বিশেষ মনোযোগ ও আগ্রহের সাথে জ্ঞান শিক্ষা করতে থাকেন। তার নিয়ম ছিল এই যে , অভিজ্ঞ আলেম ও পন্ডিত ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে বসে যে সব জ্ঞান অর্জন করতেন তা তিনি খাতায় লিপিবদ্ধ করতেন যাতে ওস্তাদের সে শিক্ষা ভুলে না যান এবং প্রয়োজনের সময় তা দ্বারা আরো বেশী উপকার লাভ করতে পারেন। এভাবে ছাত্র জীবনে জনাব গাযযালী বিভিন্ন বিষয়ের উপর এক মূল্যবান জ্ঞান- ভাণ্ডার জমা করলেন যা তার নিকট নিজের জীবনের চাইতেও অধিক মূল্যবান ও প্রিয় ছিল।

কয়েক বছর পর্যন্ত নিশাপুরে ছাত্র জীবন অতিবাহিত করার পর যখন গাযযালী নিজের দেশে ফিরে যাবার মনস্থ করলেন তখন নিজের জমাকৃত সমস্ত জ্ঞান-ভাণ্ডার একত্র করে একটি পুটুলি বাঁধলেন এবং তা সাথে নিয়ে দেশের দিকে যাত্রা করলেন।

পথে একদল ডাকাত তাদের কাফেলার উপর আক্রমণ করলো। ডাকাতরা কাফেলাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে লোকদের জিনিসপত্র মালামাল ও টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিয়ে এক জায়গায় জমা করতে লাগলো।

এভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাকাত দল ইমাম গাযযালীর মালামালের নিকট এসে গেল। ডাকাতরা ইমাম গাযযালীর নিকট এসে তার পুটুলি ছিনিয়ে নিতে চাইল। এমন সময় তিনি ডাকাতদের সামনে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন এবং ডাকাতদের বললেন , দেখো এ পুটুলি ব্যতীত তোমরা আর যা কিছু নিতে চাও সব নিয়ে যাও। কিন্তু আমার নিবেদন হচ্ছে এটি তোমরা আমার কাছেই রেখে দাও।

গাযযালীর কথা শুনে ডাকাতরা ভাবলো মনে হয় পুটুলিতে অনেক টাকা রয়েছে। এ জন্যই লোকটি এটি হাতছাড়া করতে চায় না। তাই তারা এটা কেড়ে নিল। যখন তারা সেটা খুললো তখন দেখলো যে , এর মধ্যে কাগজের জমাকৃত স্তুপ ব্যতীত আর কিছুই নেই। তারপর ডাকাতরা ইমাম গাযযালীকে জিজ্ঞাসা করলো , এ পুটুলিতে কি এমন বিরাট সম্পদ ছিল যা রক্ষা করার জন্য তুমি এভাবে হাউমাউ করে কাঁদছিলে ? আমাদের চিন্তায় আসে না যে , এসব কাগজপত্র দিয়ে তুমি কি উপকর লাভ করবে ? এ কাগজগুলো তোমার কি কাজে আসবে ?

ইমাম গাযযালী বললেন , এ পুটুলিতে যা আছে নিঃসন্দেহে তা তোমাদের কোন কাজে আসবে না। কিন্তু আমার জন্য তা অনেক উপকারী ও মূল্যবান সম্পদ।

: কিন্তু এ কথাও তো বলবে যে , এগুলো তোমার কোন কাজের জন্য ?

:এ কাগজগুলো আমার এ পর্যন্তকার ছাত্র জীবনের মূল্যবান সম্পদ যা আমি আমার উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ওস্তাদগণের সাহায্যে জমা করেছি। তোমরা যদি আমার এ জ্ঞান-ভাণ্ডার ছিনিয়ে নাও তাহলে আমার সমস্ত জ্ঞান-ভাণ্ডার ধ্বংস হয়ে যাবে। আর আমার এতো বছরের মেহনত হবে বৃথা। : এটাই কি সত্য কথা যে , তোমার সারা জীবনের সমস্ত জ্ঞান-ভাণ্ডার এ পুটুলিতে রয়েছে ?

: জ্বী হ্যাঁ!

: যে জ্ঞান কোন পুটুলি কিংবা সিন্ধুকের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা যায় বা চোর-ডাকাত ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে প্রকৃতপক্ষে তা জ্ঞানই নয়। যাও এবং নিজের অজ্ঞতা ও বোকামির উপর চিন্তা-ভাবনা করো। আমাদের ভেবে পাই না , সেটা কি ধরনের ও জ্ঞান যা চোর-ডাকাতরা চুরি করে নিয়ে যেতে পারে ?

ডাকাতদের এ সহজ-সরল ও সাধারণ কথায় গাযযালীর মতো যোগ্য ও পরিশ্রমী ছাত্রের অন্তরে দাগ কাটলো। যে গাযযালী এতদিন ওস্তাদের কাছ থেকে শোনা প্রতিটি কথাই খাতায় লিখে রাখতেন এখন তিনিই এ চেষ্টায় লিপ্ত হলেন যে , চিন্তা-ভাবনা দ্বারা নিজের জ্ঞান-বুদ্ধির লালন করবেন। আর অনুসন্ধান ও যাচাই-বাছাই করে নিজের স্মৃতির খাতায় লিখে রাখবেন।

ইমাম গাযযালী নিজেই বলেছেন , ডাকাতদের মুখ থেকে নিঃসৃত কথা আমার জন্য ছিল উত্তম উপদেশ এ উপদেশই আমার জীবনে চিন্তা-গবেষণার দিকনির্দেশনা দান করেছে।28

20

ইবনে সীনা ও মাসকুবিয়্যাহ

আবু আলী ইবনে সীনা বিশ বছর বয়সেই জ্ঞানের সকল বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করে নিয়েছিলেন। খোদাতত্ত্ব , প্রাকৃতিক বিজ্ঞান গণিতশাস্ত্র ও ধর্মতত্ত্বে ইবনে সীনা ছিলেন তার সময়ে শ্রেষ্ঠতম পন্ডিত। একদিন তিনি সেকালের বিখ্যাত ও নামকরা বিজ্ঞ আলেম জনাব ইবনে মাসকুবিয়্যাহর এক ক্লাসে গেলেন এবং অত্যন্তগর্ব ও অহংকারের সাথে একটি আখরোট ফল ইবনে মাসকুবিয়্যাহর সামনে রেখে বললেন , এ আখরোটটির পরিধি কতো ?

ইবনে মাসকুবিয়্যাহ তার রচিত কিতাবো তাহারাতুল আ রাক নামক গ্রন্থটি ইবনে সীনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন , প্রথমে তুমি তোমার চরিত্র সংশোধন করো। আর আমি এ আখরোটটির পরিধি বের করি। এ আথরোটটির পরিধি নির্ণয় করা আমার জন্য যতটা না প্রয়োজন তার চেয়ে তোমার নিজের চরিত্র সংশোধন করা তোমার জন্য বেশি প্রয়োজন।

আবু আলী ইবনে সীনা জনাব ইবনে মাসকুবিয়্যাহর কথা শুনে খুবই লজ্জিত হলেন। আর আজীবন এ কথাটিকে তার চরিত্রের পথনির্দেশক হিসাবে স্থান দিলেন।29

21

দুনিয়াত্যাগীর উপদেশ

গ্রীষ্মকাল। প্রচণ্ড গরম ও প্রখর রৌদ্রতাপে মদীনা শহর ও তার আশপাশের বাগ-বাগিচা ও ক্ষেত- খামারগুলো ঝলসে যাচ্ছিল। এমন সময় মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদির নামে এক ব্যক্তি যে নিজেকে একজন বড় মোত্তাকী , পরহেযগার , খোদাভীরু ইবাদতকারী ও দুনিয়াত্যাগী মনে করতো , ঘটনাক্রমে কোন এক কাজে মদীনা শহর থেকে বের হলো। হঠাৎ তার দৃষ্টি এমন একজন স্বাস্থ্যবান লোকের উপর পড়লো যিনি প্রখর রোদের পরোয়া না করে নিজের কিছু সংখ্যক সাথীকে সাথে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। মোটা-তাজা দেহের অধিকারী সে লোকটির চলার ধরনে বোঝা যাচ্ছিল যে , তিনি তার ক্ষেত-খামার দেখাশুনার জন্য যাচ্ছিলেন। আর তার সাথের লোকজন চাকর-বাকর ইত্যাদি হবে।

দুনিয়াত্যাগী সে লোকটি ভাবলো , এ লোকটি কে যিনি এ কঠোর গরমের দিনে রোদের মধ্যেও নিজেকে দুনিয়াদারীর মধ্যে লিপ্ত রেখেছে ? এ কথা ভেবেই দ্রুত পদে সে লোকটির নিকট পৌঁছে গেল। তার নিকটে পৌঁছে সে আরো আশ্চর্য হলো যে , তিনি আর কেউ নন , স্বয়ং মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনিল হোসাইন (আঃ)। অর্থাৎ ইমাম মুহাম্মদ বাক্বের (আঃ)।

দুনিয়াত্যাগী লোকটি ভাবতে লাগলো , এ সম্ভ্রান্ত লোকটি এভাবে দুনিয়াদারীর পিছনে কেন লেগে আছে ? যাই হোক না কেন , আমার তো একটা কর্তব্য আছে। আমি এ সম্ভ্রান্ত লোকটিকে কিছু উপদেশ দেবো যাতে করে তিনি দুনিয়াদারী থেকে বিরত থাকেন।

এ কথা ভেবে দুনিয়াত্যাগী লোকটি হযরত ইমাম বাক্বের (আঃ)-এর নিকট এসে তাকে সালাম জানালো। ইমাম (আঃ) নিজের ঘাম মুছতে মুছতে তার সালামের জবাব দিলেন। দুনিয়াত্যাগী লোকটি বললো , এটা কি সঙ্গত কাজ হবে যে , আপনার মত একজন সম্ভ্রান্তব্যক্তি এ প্রচণ্ডগরম রোদের মধ্যে দুনিয়াদারীর পিছনে ঘর থেকে বের হবেন , বিশেষত আপনার মতো একজন স্থুল দেহের অধিকারী লোকের জন্য তো এ রোদ ও গরম আরো অধিক কষ্টদায়ক।

সে আরো বললো , মৃত্যুর সংবাদ কে জানে ? কেই বা জানে যে , সে কখন মত্যর সাথে আলিঙ্গন করবে ? হতে পারে এখনই আপনার মৃত্যু এসে যাবে। আল্লাহ এমনটি না করুন , যদি এ অবস্থায় আপনার মৃত্যু এসে যায় তাহলে আপনার কি অবস্থা হবে ? আমার মতে আপনার মতো লোকদের পক্ষে শোভা পায় না যে , এতো কড়া রোদে ও এতো কঠোর গরমের মধ্যে এভাবে কষ্ট করবেন। যা হোক আমি আপনাকে পরামর্শ দেবো যে , আপনার মতো লোকের পক্ষে এভাবে দুনিয়াদারীতে লিপ্ত হওয়াটা কখনই উচিত হবে না।

হযরত ইমাম বাক্বের (আঃ) তার একজন সাথীর কাঁধে হাত রেখে একটা দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে বললেন , যদি এ সময় আমার মৃত্যু এসে যায় তাহলে আমার মৃত্যু হবে ইবাদতরত অবস্থায় এবং আমি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অপির্ত ফরজ কাজ পালনরত অবস্থায় এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেবো। তোমার হয়তো জানা নেই যে , এখন আমি যে কাজে লিপ্ত আছি তা আল্লাহর প্রকৃত আনুগত্য ও ইবাদত-বন্দেগীরই একটা কাজ। তুমি মনে করে নিয়েছো যে , শুধু আল্লাহর যিকির , নামায ও দোয়া করাটাই আল্লাহর ইবাদত। আমারও তো নিজের জীবন আছে। আমি যদি পরিশ্রম ও কষ্ট না করি তাহলে আমার জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও খরচাদির জন্য তোমার বা তোমার মতো অন্যদের কাছে হাত পাততে হবে। আমি এখন রিযিকের সন্ধানে ও জীবন সামগ্রীর তালাশে যাচ্ছি যাতে করে আমার প্রয়োজনের সময় অপরের সাহায্য গ্রহণ করতে না হয়। মৃত্যুর ভয় তো মানুষকে তখন করা উচিত যখন সে গুণাহের কাজ , অন্যায় ও আল্লাহর হুকুমের বরখেলাফ কাজ করবে। মানুষ যখন আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকবে তখন নয়। আমি এ সময় আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য করছি। যিনি আমাদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন যে , অপরের স্কন্ধের বোঝা হয়ো না , বরং নিজের শ্রম-সাধনার দ্বারা নিজের আয়-রুজীর ব্যবস্থা করো।

দুনিয়াত্যাগী লোকটি বললো : আমি তো একটা আশ্চর্যজনক বিভ্রান্তিও অজ্ঞতার শিকার ছিলাম। আমি নিজের মনে ধারণা করে রেখেছিলাম যে , এ ব্যাপারে অন্যদেরকে উপদেশ দেবো। কিন্তু এখন বুঝতে পারলাম যে , আমি নিজেই একটা ভুলের মধ্যে লিপ্ত ছিলাম। আমি একটা ভ্রান্তধারণা পোষণ করে ভুলের মধ্যে জীবন যাপন করছিলাম এবং আমার নিজেরই সংশোধনের প্রয়োজন ছিল অতীব জরুরী।30

22

খলিফার দরবারে

মুতাওয়াককিল একজন স্বৈরাচারী আব্বাসীয় শাসক। সে হযরত ইমাম হাদী (আঃ)-এর প্রতি জনগণের আধ্যাত্মিক টান প্রত্যক্ষ করে সব সময় ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতো। তার মনঃকষ্টের শেষ ছিল না যখন দেখতো লোকেরা আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধার সাথে ইমামের হুকুম ও নির্দেশবালীর আনুগত্য করার জন্য প্রস্তুত। শাসকের পরামর্শদাতারা তাকে আগেই বলে রেখেছিল যে , আলী ইবনে মুহাম্মদ আন নাকী (আঃ) অথার্ৎ ইমাম হাদী (আঃ) আপনার শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গোপনে বিদ্রোহ ও বিপ্লব করার ইচ্ছা রাখে। কাজেই এটা অসম্ভব কিছু নয় যে , তার বাড়ী থেকে এমন সব কাগজপত্র ও সাজ সরঞ্জাম বেরিয়ে পড়বে যা এ কথাকে প্রমাণ করবে। তাই মুতাওয়াককিল এক রাত্রে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়লো , মধ্য রাতের নীরব নিশীথে তার একদল জলাদ প্রকৃতির নির্দয় লোককে হুকুম দিল যে , ইমাম হাদী (আঃ)-এর ঘর তলাশি করো । তারপর তাকে আমার দরবারে হাজির করো। মুতাওয়াককিল এ সিদ্ধান্তটি তখন নিয়েছিল যখন সে তার শরাবখোর বন্ধুদের সাথে মদ্যপানে লিপ্ত ছিল।

যা হোক , মুতাওয়াককিলের নির্দেশ পাওয়া মাত্র তার লোকেরা আনন্দ-উলাস করে ইমামের বাড়িতে হানা দিল। তারা সর্বপ্রথম ইমাম (আঃ)-কেই খুঁজে বের করলো। দেখতে পেলো ইমাম (আঃ) একটি কক্ষ নির্জন করা এবং কার্পেটটি একপাশে গোটানো। আর তিনি বালু ও নুড়ির উপর বসে বসে আল্লাহর যিকির ও তার সাথে মনের গোপন ভেদ প্রকাশের কথাবার্তায় মশগুল আছেন। তারপর শাসক সেবাদাসরা ইমামের ঘর তলাশি শুরু করলো। তারা ঘরের আনাচে-কানাচে তলাশি করছিল। তারা যা চাচ্ছিল তেমন কিছুই হস্তগত হলো না বাধ্য হয়ে তারা কেবল ইমাম (আঃ)-কে ধরে এনে মুতাওয়াককিলের সামনে হাজির করলো।

হযরত ইমাম হাদী (আঃ) যখন উপস্থিত হলেন তখন দেখতে পেলেন মদ্যপানের আসর জমজমাট। আর মুতাওয়াককিল তার মাঝে বসে মদ পানে লিপ্ত। ইমামকে দেখে সে বললো , তাকে আমার পাশেই বসার আসন দাও। ইমাম বসলেন। মুতাওয়াককিল ইমামের দিকে মদের পেয়ালা এগিয়ে দিল। তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন এবং বললেন , খোদার কসম। আমার রক্ত-মাংসে কোন দিন মদ প্রবেশ করেনি। সুতরাং এ বিষয়ে তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

মুতাওয়াককিল ইমামের আপত্তি মেনে নিল এবং বললো , তাহলে কিছু কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। গযলের মন-মাতানো ছন্দের সূরে আমাদের এ আসরকে আরো সৌন্দর্য-মন্ডিত ও আনন্দদায়ক করে তুলুন।

ইমাম (আঃ) বললেন , আমি কোন কবি নই। পূর্বতন কবিদের কবিতা সামান্যই আমার স্মরণে আছে। মুতাওয়াককিল বললো , উপায় নেই। কবিতা আপনাকে পড়তেই হবে।

ইমাম (আঃ) কবিতা আবৃত্তি আরম্ভ করলেন।31 যার বিষয়বস্তু এই :

*অনেক লোকেরাই এ পৃথিবীতে নিরাপদ-নিশ্চিন্তে ও আরাম-আয়েশে বসবাস করার জন্য উঁচু উঁচু বিরাট বিশাল দালান-কোঠা ও মজবুত দুর্গ গড়ে তুলেছে। তাদের নিরাপত্তা ও হেফাযতের জন্য তারা সব সময় সশস্ত্র সান্ত্রী পাহারাদার নিয়োগ করে রেখেছে। কিন্তু সশস্ত্র এ সিপাহী-লশকররা কেউই তাদের মৃত্যুর সাথে মোকাবিলা করতে পারেনি। আর না তাদের বিপদের সময় তাদেরকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে সফলতা লাভ করতে পেরেছে।

*অবশেষে একদিন তাদেরকে এসব উঁচু উঁচু অট্টালিকা , সুরম্য মহল ও সুদৃঢ়-মজবুত কিলাথেকে টেনে-হেঁচড়ে কবর বাড়ির ছোট্ট অন্ধকার কবরের গর্তের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অতীব দুর্ভাগ্যজনকভাবে ও অত্যন্ত অসহায় অবস্থার মতো ছোট্ট একটি সংকীর্ণ পরিসরে নিস্প্রদীপ আঁধার গোরে , চিরদিনের জন্য বসবাসের ঠিকানা বানাতে বাধ্য হয়েছে।

*এমতাবস্থায় অদৃশ্য আহবানকারী ডেকে জিজ্ঞেস করে তাদের তোমাদের সে শান-শওকত আর তখত ও তাজ কোথায় চলে গেছে আজ ? কোথায় রেখে এসেছো তোমাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর অহংবোধ ?

*কোথায় তোমাদের সে চেহারাটি , যা তোমরা নাজ-নেয়ামত খেয়ে খেয়ে নাদুশ-নুদুশ করে লালন করেছিল ? চকচকে ঝলমল রেশমী মিহি পর্দার আড়ালের গর্ব-অহংকারে ভরপুর সে মুখটি কোথায় , যা তোমরা গণমানষ থেকে অনেক দূরে লুকিয়ে রেখেছিলে ?

*ভাগ্য বিপর্যয় কবর দিয়েছে তাদেরকে পরিণতি লাঞ্ছনা আর অবমাননার। ভোগ-বিলাসে লালিত দেহটিকে সঁপে দিয়েছে লোকেরা সে মাটির দয়ার কাছে , যে মাটিকে পদতলে পিষে চলতো দম্ভ অহংকার ভরে।

*দীর্ঘকাল ধরে এরা পৃথিবীতে স্বাদ-আস্বাদের রকমারি খাদ্য খাবার ভক্ষণ করে চলে এসেছিল। কিন্তু আজ তারাই পরিণত হয়েছে মাটির খাদ্যরূপে। আর তারা মাটির গর্ভেই তাদের পরিণতি ভুগতে থাকবে চিরকাল-চিরদিন।32

হযরত ইমাম (আঃ) নিজস্ব বিশেষ ভঙ্গিতে এ কবিতাটি আবৃত্তি করলেন এমনভাবে যে , উপস্থিত সকলের এমন কি স্বয়ং মুতাওয়াককিলের অন্তরের গভীরে গিয়ে দাগ কেটেছে। কবিতা আবৃত্তি শেষ হবার সাথে সাথে মদ্যপানের এ আসরে অংশগ্রহণকারী সকলের মদের নেশা কেটে গেল। মুতাওয়াককিল মদের পেয়ালাটি ছুঁড়ে মারলো। আর তার চোখ দিয়ে অশ্রুপ্রবাহিত হতে লাগলো।

এভাবে মদ্যপানের এ আসরটির পরিসমাপ্তি ঘটলো। প্রকৃত সত্যের আলো একজন জালিম প্রকৃতির শাসকের অন্তরে বিরাজিত গর্ব-অহংকারের কালিমাকে পরিষ্কার করে দিল , যদিও তার প্রতিক্রিয়া অল্প কিছুক্ষণই অবশিষ্ট ছিল।33

16

হযরত আলী ( আঃ ) ও আছেম

জাঙ্গে জামাল বা উষ্ট্রের যুদ্ধ24 শেষ হবার পর হযরত আলী (আঃ) একবার বসরা শহরে গেলেন। বসরায় অবস্থানকালে একদিন তিনি তাঁর এক অসুস্থ বন্ধু আলা ইবনে যিয়াদ হারেছীকে দেখতে বাড়িতে গেলেন। তার বাড়িটি ছিল খুব প্রকাণ্ড ও জাঁকজমকপূর্ণ। হযরত আলী (আঃ) তাঁর বন্ধুর এ বিরাট বাড়ির সৌন্দর্য দেখে তাকে বললেন , এ দুনিয়াতে তোমার এতো বিরাট ও সুন্দর একটা বাড়ি কোন্ কাজের জন্য , তুমি যখন পরকালে একটা প্রশস্তও সুন্দর বাড়ির অধিক দরকার মনে করছো ? কিন্তু তুমি যদি এখন চাও তবে দুনিয়াতে তোমার এ বাড়িটিকে আখেরাতের একটি জাঁকমজকপূর্ণ বাড়ি লাভ করার উসিলা বানাতে পারো। তার পন্থা হলো যে , তুমি তোমার এ বাড়িতে মেহমানদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করবে। লোকদের সাথে নম্র ও ভালোবাসার মন নিয়ে আচার-ব্যবহার করবে। এ বাড়িতে মুসলমানদের যে হক অধিকার রয়েছে তা যথাযথ আদায় করো এবং লোকদেরকে তাদের হক অধিকার প্রদানের ব্যাপারে সম্ভাব্য সব রকমের সাহায্য-সহযোগিতা করবে যাতে করে লোকেরা এ বাড়িটিকে তাদের প্রাপ্য অধিকার পাওয়ার কেন্দ্র বলে স্বীকার করে নেয়। আসল কথা হলো তুমি এ বাড়িটিকে কেবল তোমার নিজের কাজের জন্যই ব্যবহার করবে না , বরং সাধারণ মুসলমানদের উপকার ও কল্যাণের কেন্দ্র বানিয়ে দাও দেবে।

আলা : হে আমীরুল মুমিনীন (আঃ)! আমি আমার ভাই আছেম সম্পর্কে আপনার কাছে একটি অভিযোগ পেশ করতে চাই।

বলো , তোমার কি অভিযোগ ? সে দুনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করেছে এবং ছেঁড়া-ফাঁড়া জামা-কাপড় পরিধান করে বৈরাগ্যবাদ গ্রহণ করেছে। কারো সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।

তাকে আমার সামনে হাজির করো।

আছেমকে তাঁর সামনে হাজির করা হলো। হযরত আলী (আঃ) তাকে বললেন , হে নিজের জীবনের দুশমন! শয়তান তোমার জ্ঞান-বুদ্ধি হরণ করে নিয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না যে , তোমার স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি কেন তোমার মায়া-দয়া হচ্ছে না ? তুমি কি এ কথা মনে করে নিয়েছো যে , যে মহান আল্লাহ এ দুনিয়ার সমস্ত পাক-পবিত্র নিয়ামত তোমার জন্য হালাল ও বৈধ বলে ঘোষণা করেছেন , তিনিই আবার তোমার উপর এ কারণে নারাজ হয়ে যাবেন যে , তুমি সে সমস্ত নেয়ামত উপভোগ করছো ? তুমি কি খোদার কাছে এ নিয়ামতসমূহ থেকে তুচ্ছ ?

জবাবে আছেম বললো , হে আমীরুল মোমিনীন! আপনিও তো আমার মতোই। আপনিও তো নিজের ওপর অনেক কষ্ট দিচ্ছেন। আপনিও তো নরম কাপড়-চোপড় পরিধান করেন না এবং রুচিসম্পন্ন খাদ্য খাবার খাচ্ছেন না। এভাবে আমিও সে সমস্ত কাজই করছি যা আপনি করছেন। আমি সে পথেরই অনুসরণ করে চলেছি যে পথে আপনি চলছেন।

হযরত আলী (আঃ) বললেন , হে আছেম! তুমি ভুল করছো। আমার ও তোমার মাঝে একটা পার্থক্য রয়েছে। আমি যে পদে অধিষ্ঠিত আছি তুমি তা নও। আমি উম্মতের নেতা , শাসক ও পথ প্রদর্শকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। আর শাসক ও পথ প্রদর্শকের জীবন যাপনের পদ্ধতি ও দায়-দায়িত্ব সাধারণ মানুষদের চাইতে ভিন্নতর অর্থাৎ একজন শাসন কর্তার যে কর্তব্য একজন সাধারণ মানুষের তা নয়। মহান আল্লাহ ন্যায়পরায়ণ শাসকদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন যে , সে তার জাতির দুর্বল ও নিম্নস্ত রের লোকদের জীবন যাপনের প্রতি দৃষ্টি রেখে নিজের জীবন পরিচালনা করবে। মহান আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ন্যায়পরায়ণ শাসকের এভাবে জীবন যাপন করা উচিত যেভাবে গরিব ও নিম্নস্তরের লোকদের অন্তরে দুঃখ না থাকে এবং দারিদ্র্য ও অভাব-অনটন তাদের অন্তরে কোন প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। এ কারণে আমার কর্তব্য এক রূপ আর তোমার কর্তব্য অন্যরূপ।25

17

ধনী ও দরিদ্র

হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) তাঁর সব সময়ের নিয়ম মোতাবেক নিজের বাড়িতে দরবারে বসেছিলেন। তাঁর সাথী ও বন্ধুগণ আশপাশে তাঁকে এভাবে ঘিরে রেখেছিল , যেমন আংটির মাঝে পাথর। এমন সময় ছেঁড়াফাঁড়া জামা-কাপড় পরিহিত একজন গরিব লোক রাসূলের (সাঃ) এ মজলিসে হাজির হলো। ইসলামী রীতিনীতির দৃষ্টিতে মজলিসে উপস্থিত প্রত্যেকেই সমমর্যাদার অধিকারী এবং বৈঠকের আদব ও রীতি হচ্ছে নবাগত ব্যক্তি যেখানেই খালি স্থান দেখবে সেখাবেই বসে যাবে। কারো এটা মনে করা উচিত হবে না যে , অমুক স্থান আমার মর্যাদার সাথে মানানসই নয়। সে হিসাবে উক্ত গরিব লোকটি বসার জন্য একটি খালি জায়গা খুঁজতে লাগলো। সে চারদিকে তাকিয়ে এক কোণায় একটি খালি জায়গা দেখতে পেলো। তাই চুপচাপ সেখানে গিয়ে বসে পড়লো। ঘটনাক্রমে সেখানে পূর্ব থেকেই একজন ধনী লোক বসা ছিল। ঐ গরীব লোকটিকে তার পাশে বসতে দেখে সে তার মূল্যবান জামাকাপড় টেনে নিল এবং এক পাশে সরে গেল। রাসূলে খোদা (সাঃ) খুব লক্ষ্য করে এ দৃশ্যটি দেখছিলেন। ধনী লোকটির এ আচরণ দেখে মহানবী (সাঃ) তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন , তুমি ভয় পেয়েছো যে , এ গরিব লোকটির দারিদ্র্য ও অভাব অনটনের ছায়া আবার তোমার উপরও যেন না পড়ে।

সে বললো , না! হে আল্লাহর রাসূল! এমনটা নয়।

রাসূল (সাঃ) বললেন , তাহলে এমন কি কারণ ছিল যে , তমিু এ গরিব লোকটিকে দেখেই এক পাশে সরে গেলে ?

সে বললো , হে আল্লাহর রাসূল! আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আমার অন্যায় স্বীকার করছি। এখন আমি এ অপরাধের কাফফারা দিতে প্রস্তুত আছি। আমি আমার এ অপরাধের কাফফারা হিসাবে আমার সম্পদের অর্ধেক অংশ এ গরিব ভাইকে দান করে দিতে চাই।

ধনী লোকটির এ কথা শুনে সে গরিব লোকটি বলে উঠলো , কিন্তু আমি তা গ্রহণ করার জন্য মোটেও প্রস্তুত নই।

রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে বসা অন্য সমস্তলোকেরা জিজ্ঞাসা করলো , কেন ?

উত্তরে সে বললো , আমার ভয় হচ্ছে যে , আবার ধন-সম্পদের প্রাচুর্যে একদিন আমিও এরূপ অহংকারী হয়ে না যাই। আমিও আমার অপর মুসলিম ভাইয়ের সাথে এধরনের আচরণ শুরুকরে না দেই , যেমনটি আজ এ ব্যক্তি আমার সাথে করেছে।26

18

এক দোকানী ও এক পথিক

উঁচু-লম্বা ও প্রশস্তদেহের অধিকারী এক ব্যক্তি একদিন কুফার বাজারের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার চেহারায় এমন সব নিদর্শন পরিলক্ষিত হচ্ছিল , যেগুলোকে রণাঙ্গনের স্মৃতিচিহ্ন বলা যেতে পারে। তার চোখের পাশ দিয়ে কাটা চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল। এদিকে এক দোকানি তার দোকানে বসেছিল। বন্ধুদেরকে হাসানোর জন্য সে এক মুষ্টি ময়লা তার উপর নিক্ষেপ করলো। দোকানদারের এ অভদ্র আচরণের জন্য সে পথিক কোন প্রকার রাগ বা ক্রোধ প্রকাশ না করে অত্যন্ত প্রশস্তিও নিশ্চিন্তমনে এভাবে পথ এগিয়ে চললেন যেন কোন কিছুই ঘটেনি। পথিক কিছু দূর চলে যাবার পর দোকানির এক বন্ধু তাকে বললো , তুমি যে পথিকের উপর ময়লা নিক্ষেপ করে তার অবমাননা করেছো , তিনি কে তা কি তুমি জানো ? দোকানি বললো , না , অমি তো তাকে মোটেও চিনি না। আমি তো মনে করেছি সহস্র পথিকের ন্যায় তিনিও একজন। তোমার যদি জানা থাকে তাহলে বলো , এ লোকটি কে ?

বন্ধুটি বললো , আসলেই তুমি তাকে চেন না ? বড় আশ্চর্যের বিষয়! তিনি আর কেউ নন। তিনি হলেন ইসলামী সেনাবাহিনীর প্রখ্যাত সেনাপতি জনাব মালিক আশতার নাখঈ। বড় আশ্চর্যের কথা! তিনি বিখ্যাত সেনাপতি মালিক আশতার ? সেই মালিক আশতার ,যার ভয়ে বাঘের কলিজাও পানি হয়ে যায়। যার নাম শুনে শত্রুপক্ষের দেহ-মন কেপেঁ ওঠে!

:হ ্যাঁ! হ্যাঁ!! তিনি সে মালিক আশতার।

:হ ায় অফসোস! আমি তো অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি। এক্ষণই তিনি হুকুম দিবেন আমার অপরাধের কঠিন শাস্তি দেয়া হোক! আমি এক্ষণই তার পিছু পিছু দৌঁড়ে যাই এবং তার কাছে নিবেদন করি যে , আমার অপরাধ ক্ষমা করে দিন। না জেনে আমি এ অন্যায় কাজ করে ফেলেছি।

এ কথা বলেই দোকানদার জনাব মালিক আশতারের পেছনে পেছনে দৌঁড়াতে লাগলো। কিছু দূর যাবার পর সে দেখতে পেলো যে , মালিক আশতার একটা মসজিদের দিকে যাচ্ছেন। দোকানীও তার পিছে পিছে মসজিদে প্রবেশ করলো। দেখতে পেলো তিনি নামায আদায় করছেন। কিছুক্ষণ পর্যন্ত সে সেখানে অপেক্ষা করলো। নামায শেষ হবার সাথেই সাথেই দোকানি জনাব মালিক আশতারের সামনে এসে অত্যন্ত লজ্জিত ও বিনম্রভাবে নিজের পরিচয় দিয়ে বললো , আমি সে লোক , যে নিজের অজ্ঞতা ও বোকামির কারণে আপনার সাথে অন্যায় করেছি। হযরত মালিক আশতার বললেন , খোদার কসম করে বলছি , মসজিদে আসার আমার আদৌ ইচ্ছা ছিল না। আমি তো কেবল তোমার জন্যই এখানে এসেছি। কেননা আমি বুঝতে পারলাম যে , তুমি একটা অজ্ঞ , জাহেল ও পথভ্রষ্ট লোক। আর লোকদেরকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দিয়ে থাকো। তোমার এ অজ্ঞতা দেখে আমার মনে ব্যথা পেলাম। তাই আমি মসজিদে চলে এসেছি এ জন্য যে , আল্লাহর নিকট তোমার সঠিক পথে হেদায়েত লাভের জন্য দোয়া করবো। তুমি যে ভয় পাচ্ছ তেমন কোনো উদ্দেশ্য আমার ছিল না।27

19

ইমাম গাযযালী ও ডাকাত দল

ইসলামী জ্ঞান রাজ্যের প্রখ্যাত পন্ডিত ব্যক্তি ইমাম গাযযালী ইরানের তুস নগরীর অধিবাসী ছিলেন। পবিত্র মাশহাদের নিকটতম একটি এলাকার নাম তুস। সেকালে নিশাপুর ছিল ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার প্রাণকেন্দ্র।

পঞ্চম হিজরী শতাব্দীর কথা। নিশাপুর শহরটি তখন ইসলামী জ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হতো। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা অর্জনের জন্য এখানে আসতো। তাই গাযযালীও জ্ঞান অর্জনের জন্য এখানে আসলেন। দীর্ঘদিন পর্যন্ত সুযোগ্য ওস্তাদ ও ওলামাগণের তত্ত্বাবধানে বিশেষ মনোযোগ ও আগ্রহের সাথে জ্ঞান শিক্ষা করতে থাকেন। তার নিয়ম ছিল এই যে , অভিজ্ঞ আলেম ও পন্ডিত ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে বসে যে সব জ্ঞান অর্জন করতেন তা তিনি খাতায় লিপিবদ্ধ করতেন যাতে ওস্তাদের সে শিক্ষা ভুলে না যান এবং প্রয়োজনের সময় তা দ্বারা আরো বেশী উপকার লাভ করতে পারেন। এভাবে ছাত্র জীবনে জনাব গাযযালী বিভিন্ন বিষয়ের উপর এক মূল্যবান জ্ঞান- ভাণ্ডার জমা করলেন যা তার নিকট নিজের জীবনের চাইতেও অধিক মূল্যবান ও প্রিয় ছিল।

কয়েক বছর পর্যন্ত নিশাপুরে ছাত্র জীবন অতিবাহিত করার পর যখন গাযযালী নিজের দেশে ফিরে যাবার মনস্থ করলেন তখন নিজের জমাকৃত সমস্ত জ্ঞান-ভাণ্ডার একত্র করে একটি পুটুলি বাঁধলেন এবং তা সাথে নিয়ে দেশের দিকে যাত্রা করলেন।

পথে একদল ডাকাত তাদের কাফেলার উপর আক্রমণ করলো। ডাকাতরা কাফেলাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে লোকদের জিনিসপত্র মালামাল ও টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিয়ে এক জায়গায় জমা করতে লাগলো।

এভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাকাত দল ইমাম গাযযালীর মালামালের নিকট এসে গেল। ডাকাতরা ইমাম গাযযালীর নিকট এসে তার পুটুলি ছিনিয়ে নিতে চাইল। এমন সময় তিনি ডাকাতদের সামনে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন এবং ডাকাতদের বললেন , দেখো এ পুটুলি ব্যতীত তোমরা আর যা কিছু নিতে চাও সব নিয়ে যাও। কিন্তু আমার নিবেদন হচ্ছে এটি তোমরা আমার কাছেই রেখে দাও।

গাযযালীর কথা শুনে ডাকাতরা ভাবলো মনে হয় পুটুলিতে অনেক টাকা রয়েছে। এ জন্যই লোকটি এটি হাতছাড়া করতে চায় না। তাই তারা এটা কেড়ে নিল। যখন তারা সেটা খুললো তখন দেখলো যে , এর মধ্যে কাগজের জমাকৃত স্তুপ ব্যতীত আর কিছুই নেই। তারপর ডাকাতরা ইমাম গাযযালীকে জিজ্ঞাসা করলো , এ পুটুলিতে কি এমন বিরাট সম্পদ ছিল যা রক্ষা করার জন্য তুমি এভাবে হাউমাউ করে কাঁদছিলে ? আমাদের চিন্তায় আসে না যে , এসব কাগজপত্র দিয়ে তুমি কি উপকর লাভ করবে ? এ কাগজগুলো তোমার কি কাজে আসবে ?

ইমাম গাযযালী বললেন , এ পুটুলিতে যা আছে নিঃসন্দেহে তা তোমাদের কোন কাজে আসবে না। কিন্তু আমার জন্য তা অনেক উপকারী ও মূল্যবান সম্পদ।

: কিন্তু এ কথাও তো বলবে যে , এগুলো তোমার কোন কাজের জন্য ?

:এ কাগজগুলো আমার এ পর্যন্তকার ছাত্র জীবনের মূল্যবান সম্পদ যা আমি আমার উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ওস্তাদগণের সাহায্যে জমা করেছি। তোমরা যদি আমার এ জ্ঞান-ভাণ্ডার ছিনিয়ে নাও তাহলে আমার সমস্ত জ্ঞান-ভাণ্ডার ধ্বংস হয়ে যাবে। আর আমার এতো বছরের মেহনত হবে বৃথা। : এটাই কি সত্য কথা যে , তোমার সারা জীবনের সমস্ত জ্ঞান-ভাণ্ডার এ পুটুলিতে রয়েছে ?

: জ্বী হ্যাঁ!

: যে জ্ঞান কোন পুটুলি কিংবা সিন্ধুকের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা যায় বা চোর-ডাকাত ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে প্রকৃতপক্ষে তা জ্ঞানই নয়। যাও এবং নিজের অজ্ঞতা ও বোকামির উপর চিন্তা-ভাবনা করো। আমাদের ভেবে পাই না , সেটা কি ধরনের ও জ্ঞান যা চোর-ডাকাতরা চুরি করে নিয়ে যেতে পারে ?

ডাকাতদের এ সহজ-সরল ও সাধারণ কথায় গাযযালীর মতো যোগ্য ও পরিশ্রমী ছাত্রের অন্তরে দাগ কাটলো। যে গাযযালী এতদিন ওস্তাদের কাছ থেকে শোনা প্রতিটি কথাই খাতায় লিখে রাখতেন এখন তিনিই এ চেষ্টায় লিপ্ত হলেন যে , চিন্তা-ভাবনা দ্বারা নিজের জ্ঞান-বুদ্ধির লালন করবেন। আর অনুসন্ধান ও যাচাই-বাছাই করে নিজের স্মৃতির খাতায় লিখে রাখবেন।

ইমাম গাযযালী নিজেই বলেছেন , ডাকাতদের মুখ থেকে নিঃসৃত কথা আমার জন্য ছিল উত্তম উপদেশ এ উপদেশই আমার জীবনে চিন্তা-গবেষণার দিকনির্দেশনা দান করেছে।28

20

ইবনে সীনা ও মাসকুবিয়্যাহ

আবু আলী ইবনে সীনা বিশ বছর বয়সেই জ্ঞানের সকল বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করে নিয়েছিলেন। খোদাতত্ত্ব , প্রাকৃতিক বিজ্ঞান গণিতশাস্ত্র ও ধর্মতত্ত্বে ইবনে সীনা ছিলেন তার সময়ে শ্রেষ্ঠতম পন্ডিত। একদিন তিনি সেকালের বিখ্যাত ও নামকরা বিজ্ঞ আলেম জনাব ইবনে মাসকুবিয়্যাহর এক ক্লাসে গেলেন এবং অত্যন্তগর্ব ও অহংকারের সাথে একটি আখরোট ফল ইবনে মাসকুবিয়্যাহর সামনে রেখে বললেন , এ আখরোটটির পরিধি কতো ?

ইবনে মাসকুবিয়্যাহ তার রচিত কিতাবো তাহারাতুল আ রাক নামক গ্রন্থটি ইবনে সীনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন , প্রথমে তুমি তোমার চরিত্র সংশোধন করো। আর আমি এ আখরোটটির পরিধি বের করি। এ আথরোটটির পরিধি নির্ণয় করা আমার জন্য যতটা না প্রয়োজন তার চেয়ে তোমার নিজের চরিত্র সংশোধন করা তোমার জন্য বেশি প্রয়োজন।

আবু আলী ইবনে সীনা জনাব ইবনে মাসকুবিয়্যাহর কথা শুনে খুবই লজ্জিত হলেন। আর আজীবন এ কথাটিকে তার চরিত্রের পথনির্দেশক হিসাবে স্থান দিলেন।29

21

দুনিয়াত্যাগীর উপদেশ

গ্রীষ্মকাল। প্রচণ্ড গরম ও প্রখর রৌদ্রতাপে মদীনা শহর ও তার আশপাশের বাগ-বাগিচা ও ক্ষেত- খামারগুলো ঝলসে যাচ্ছিল। এমন সময় মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদির নামে এক ব্যক্তি যে নিজেকে একজন বড় মোত্তাকী , পরহেযগার , খোদাভীরু ইবাদতকারী ও দুনিয়াত্যাগী মনে করতো , ঘটনাক্রমে কোন এক কাজে মদীনা শহর থেকে বের হলো। হঠাৎ তার দৃষ্টি এমন একজন স্বাস্থ্যবান লোকের উপর পড়লো যিনি প্রখর রোদের পরোয়া না করে নিজের কিছু সংখ্যক সাথীকে সাথে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। মোটা-তাজা দেহের অধিকারী সে লোকটির চলার ধরনে বোঝা যাচ্ছিল যে , তিনি তার ক্ষেত-খামার দেখাশুনার জন্য যাচ্ছিলেন। আর তার সাথের লোকজন চাকর-বাকর ইত্যাদি হবে।

দুনিয়াত্যাগী সে লোকটি ভাবলো , এ লোকটি কে যিনি এ কঠোর গরমের দিনে রোদের মধ্যেও নিজেকে দুনিয়াদারীর মধ্যে লিপ্ত রেখেছে ? এ কথা ভেবেই দ্রুত পদে সে লোকটির নিকট পৌঁছে গেল। তার নিকটে পৌঁছে সে আরো আশ্চর্য হলো যে , তিনি আর কেউ নন , স্বয়ং মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনিল হোসাইন (আঃ)। অর্থাৎ ইমাম মুহাম্মদ বাক্বের (আঃ)।

দুনিয়াত্যাগী লোকটি ভাবতে লাগলো , এ সম্ভ্রান্ত লোকটি এভাবে দুনিয়াদারীর পিছনে কেন লেগে আছে ? যাই হোক না কেন , আমার তো একটা কর্তব্য আছে। আমি এ সম্ভ্রান্ত লোকটিকে কিছু উপদেশ দেবো যাতে করে তিনি দুনিয়াদারী থেকে বিরত থাকেন।

এ কথা ভেবে দুনিয়াত্যাগী লোকটি হযরত ইমাম বাক্বের (আঃ)-এর নিকট এসে তাকে সালাম জানালো। ইমাম (আঃ) নিজের ঘাম মুছতে মুছতে তার সালামের জবাব দিলেন। দুনিয়াত্যাগী লোকটি বললো , এটা কি সঙ্গত কাজ হবে যে , আপনার মত একজন সম্ভ্রান্তব্যক্তি এ প্রচণ্ডগরম রোদের মধ্যে দুনিয়াদারীর পিছনে ঘর থেকে বের হবেন , বিশেষত আপনার মতো একজন স্থুল দেহের অধিকারী লোকের জন্য তো এ রোদ ও গরম আরো অধিক কষ্টদায়ক।

সে আরো বললো , মৃত্যুর সংবাদ কে জানে ? কেই বা জানে যে , সে কখন মত্যর সাথে আলিঙ্গন করবে ? হতে পারে এখনই আপনার মৃত্যু এসে যাবে। আল্লাহ এমনটি না করুন , যদি এ অবস্থায় আপনার মৃত্যু এসে যায় তাহলে আপনার কি অবস্থা হবে ? আমার মতে আপনার মতো লোকদের পক্ষে শোভা পায় না যে , এতো কড়া রোদে ও এতো কঠোর গরমের মধ্যে এভাবে কষ্ট করবেন। যা হোক আমি আপনাকে পরামর্শ দেবো যে , আপনার মতো লোকের পক্ষে এভাবে দুনিয়াদারীতে লিপ্ত হওয়াটা কখনই উচিত হবে না।

হযরত ইমাম বাক্বের (আঃ) তার একজন সাথীর কাঁধে হাত রেখে একটা দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে বললেন , যদি এ সময় আমার মৃত্যু এসে যায় তাহলে আমার মৃত্যু হবে ইবাদতরত অবস্থায় এবং আমি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অপির্ত ফরজ কাজ পালনরত অবস্থায় এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেবো। তোমার হয়তো জানা নেই যে , এখন আমি যে কাজে লিপ্ত আছি তা আল্লাহর প্রকৃত আনুগত্য ও ইবাদত-বন্দেগীরই একটা কাজ। তুমি মনে করে নিয়েছো যে , শুধু আল্লাহর যিকির , নামায ও দোয়া করাটাই আল্লাহর ইবাদত। আমারও তো নিজের জীবন আছে। আমি যদি পরিশ্রম ও কষ্ট না করি তাহলে আমার জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও খরচাদির জন্য তোমার বা তোমার মতো অন্যদের কাছে হাত পাততে হবে। আমি এখন রিযিকের সন্ধানে ও জীবন সামগ্রীর তালাশে যাচ্ছি যাতে করে আমার প্রয়োজনের সময় অপরের সাহায্য গ্রহণ করতে না হয়। মৃত্যুর ভয় তো মানুষকে তখন করা উচিত যখন সে গুণাহের কাজ , অন্যায় ও আল্লাহর হুকুমের বরখেলাফ কাজ করবে। মানুষ যখন আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকবে তখন নয়। আমি এ সময় আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য করছি। যিনি আমাদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন যে , অপরের স্কন্ধের বোঝা হয়ো না , বরং নিজের শ্রম-সাধনার দ্বারা নিজের আয়-রুজীর ব্যবস্থা করো।

দুনিয়াত্যাগী লোকটি বললো : আমি তো একটা আশ্চর্যজনক বিভ্রান্তিও অজ্ঞতার শিকার ছিলাম। আমি নিজের মনে ধারণা করে রেখেছিলাম যে , এ ব্যাপারে অন্যদেরকে উপদেশ দেবো। কিন্তু এখন বুঝতে পারলাম যে , আমি নিজেই একটা ভুলের মধ্যে লিপ্ত ছিলাম। আমি একটা ভ্রান্তধারণা পোষণ করে ভুলের মধ্যে জীবন যাপন করছিলাম এবং আমার নিজেরই সংশোধনের প্রয়োজন ছিল অতীব জরুরী।30

22

খলিফার দরবারে

মুতাওয়াককিল একজন স্বৈরাচারী আব্বাসীয় শাসক। সে হযরত ইমাম হাদী (আঃ)-এর প্রতি জনগণের আধ্যাত্মিক টান প্রত্যক্ষ করে সব সময় ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতো। তার মনঃকষ্টের শেষ ছিল না যখন দেখতো লোকেরা আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধার সাথে ইমামের হুকুম ও নির্দেশবালীর আনুগত্য করার জন্য প্রস্তুত। শাসকের পরামর্শদাতারা তাকে আগেই বলে রেখেছিল যে , আলী ইবনে মুহাম্মদ আন নাকী (আঃ) অথার্ৎ ইমাম হাদী (আঃ) আপনার শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গোপনে বিদ্রোহ ও বিপ্লব করার ইচ্ছা রাখে। কাজেই এটা অসম্ভব কিছু নয় যে , তার বাড়ী থেকে এমন সব কাগজপত্র ও সাজ সরঞ্জাম বেরিয়ে পড়বে যা এ কথাকে প্রমাণ করবে। তাই মুতাওয়াককিল এক রাত্রে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়লো , মধ্য রাতের নীরব নিশীথে তার একদল জলাদ প্রকৃতির নির্দয় লোককে হুকুম দিল যে , ইমাম হাদী (আঃ)-এর ঘর তলাশি করো । তারপর তাকে আমার দরবারে হাজির করো। মুতাওয়াককিল এ সিদ্ধান্তটি তখন নিয়েছিল যখন সে তার শরাবখোর বন্ধুদের সাথে মদ্যপানে লিপ্ত ছিল।

যা হোক , মুতাওয়াককিলের নির্দেশ পাওয়া মাত্র তার লোকেরা আনন্দ-উলাস করে ইমামের বাড়িতে হানা দিল। তারা সর্বপ্রথম ইমাম (আঃ)-কেই খুঁজে বের করলো। দেখতে পেলো ইমাম (আঃ) একটি কক্ষ নির্জন করা এবং কার্পেটটি একপাশে গোটানো। আর তিনি বালু ও নুড়ির উপর বসে বসে আল্লাহর যিকির ও তার সাথে মনের গোপন ভেদ প্রকাশের কথাবার্তায় মশগুল আছেন। তারপর শাসক সেবাদাসরা ইমামের ঘর তলাশি শুরু করলো। তারা ঘরের আনাচে-কানাচে তলাশি করছিল। তারা যা চাচ্ছিল তেমন কিছুই হস্তগত হলো না বাধ্য হয়ে তারা কেবল ইমাম (আঃ)-কে ধরে এনে মুতাওয়াককিলের সামনে হাজির করলো।

হযরত ইমাম হাদী (আঃ) যখন উপস্থিত হলেন তখন দেখতে পেলেন মদ্যপানের আসর জমজমাট। আর মুতাওয়াককিল তার মাঝে বসে মদ পানে লিপ্ত। ইমামকে দেখে সে বললো , তাকে আমার পাশেই বসার আসন দাও। ইমাম বসলেন। মুতাওয়াককিল ইমামের দিকে মদের পেয়ালা এগিয়ে দিল। তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন এবং বললেন , খোদার কসম। আমার রক্ত-মাংসে কোন দিন মদ প্রবেশ করেনি। সুতরাং এ বিষয়ে তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

মুতাওয়াককিল ইমামের আপত্তি মেনে নিল এবং বললো , তাহলে কিছু কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। গযলের মন-মাতানো ছন্দের সূরে আমাদের এ আসরকে আরো সৌন্দর্য-মন্ডিত ও আনন্দদায়ক করে তুলুন।

ইমাম (আঃ) বললেন , আমি কোন কবি নই। পূর্বতন কবিদের কবিতা সামান্যই আমার স্মরণে আছে। মুতাওয়াককিল বললো , উপায় নেই। কবিতা আপনাকে পড়তেই হবে।

ইমাম (আঃ) কবিতা আবৃত্তি আরম্ভ করলেন।31 যার বিষয়বস্তু এই :

*অনেক লোকেরাই এ পৃথিবীতে নিরাপদ-নিশ্চিন্তে ও আরাম-আয়েশে বসবাস করার জন্য উঁচু উঁচু বিরাট বিশাল দালান-কোঠা ও মজবুত দুর্গ গড়ে তুলেছে। তাদের নিরাপত্তা ও হেফাযতের জন্য তারা সব সময় সশস্ত্র সান্ত্রী পাহারাদার নিয়োগ করে রেখেছে। কিন্তু সশস্ত্র এ সিপাহী-লশকররা কেউই তাদের মৃত্যুর সাথে মোকাবিলা করতে পারেনি। আর না তাদের বিপদের সময় তাদেরকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে সফলতা লাভ করতে পেরেছে।

*অবশেষে একদিন তাদেরকে এসব উঁচু উঁচু অট্টালিকা , সুরম্য মহল ও সুদৃঢ়-মজবুত কিলাথেকে টেনে-হেঁচড়ে কবর বাড়ির ছোট্ট অন্ধকার কবরের গর্তের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অতীব দুর্ভাগ্যজনকভাবে ও অত্যন্ত অসহায় অবস্থার মতো ছোট্ট একটি সংকীর্ণ পরিসরে নিস্প্রদীপ আঁধার গোরে , চিরদিনের জন্য বসবাসের ঠিকানা বানাতে বাধ্য হয়েছে।

*এমতাবস্থায় অদৃশ্য আহবানকারী ডেকে জিজ্ঞেস করে তাদের তোমাদের সে শান-শওকত আর তখত ও তাজ কোথায় চলে গেছে আজ ? কোথায় রেখে এসেছো তোমাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর অহংবোধ ?

*কোথায় তোমাদের সে চেহারাটি , যা তোমরা নাজ-নেয়ামত খেয়ে খেয়ে নাদুশ-নুদুশ করে লালন করেছিল ? চকচকে ঝলমল রেশমী মিহি পর্দার আড়ালের গর্ব-অহংকারে ভরপুর সে মুখটি কোথায় , যা তোমরা গণমানষ থেকে অনেক দূরে লুকিয়ে রেখেছিলে ?

*ভাগ্য বিপর্যয় কবর দিয়েছে তাদেরকে পরিণতি লাঞ্ছনা আর অবমাননার। ভোগ-বিলাসে লালিত দেহটিকে সঁপে দিয়েছে লোকেরা সে মাটির দয়ার কাছে , যে মাটিকে পদতলে পিষে চলতো দম্ভ অহংকার ভরে।

*দীর্ঘকাল ধরে এরা পৃথিবীতে স্বাদ-আস্বাদের রকমারি খাদ্য খাবার ভক্ষণ করে চলে এসেছিল। কিন্তু আজ তারাই পরিণত হয়েছে মাটির খাদ্যরূপে। আর তারা মাটির গর্ভেই তাদের পরিণতি ভুগতে থাকবে চিরকাল-চিরদিন।32

হযরত ইমাম (আঃ) নিজস্ব বিশেষ ভঙ্গিতে এ কবিতাটি আবৃত্তি করলেন এমনভাবে যে , উপস্থিত সকলের এমন কি স্বয়ং মুতাওয়াককিলের অন্তরের গভীরে গিয়ে দাগ কেটেছে। কবিতা আবৃত্তি শেষ হবার সাথে সাথে মদ্যপানের এ আসরে অংশগ্রহণকারী সকলের মদের নেশা কেটে গেল। মুতাওয়াককিল মদের পেয়ালাটি ছুঁড়ে মারলো। আর তার চোখ দিয়ে অশ্রুপ্রবাহিত হতে লাগলো।

এভাবে মদ্যপানের এ আসরটির পরিসমাপ্তি ঘটলো। প্রকৃত সত্যের আলো একজন জালিম প্রকৃতির শাসকের অন্তরে বিরাজিত গর্ব-অহংকারের কালিমাকে পরিষ্কার করে দিল , যদিও তার প্রতিক্রিয়া অল্প কিছুক্ষণই অবশিষ্ট ছিল।33


4

5

6

7

8

9

10