মিরেকলস অব দ্য কোরআন

মিরেকলস অব দ্য কোরআন 40%

মিরেকলস অব দ্য কোরআন লেখক:
: ডাঃ উম্মে কাউসার হক
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

মিরেকলস অব দ্য কোরআন
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 14 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 25316 / ডাউনলোড: 4265
সাইজ সাইজ সাইজ
মিরেকলস অব দ্য কোরআন

মিরেকলস অব দ্য কোরআন

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মিরেকলস অব দ্য কোরআন

(কোরআনের অলৌকিকতা)

নিশ্চয়ই এ কোরআন রাব্বুল আলামীনের নাযিলকৃত

(কোরআন , ২৬ : ১৯২)

মূল : হারুন ইয়াহিয়া

ভাষান্তর : ডাঃ উম্মে কাউসার হক

এই বইটি আল হাসানাইন (আ.) ওয়েব সাইট কর্তৃক আপলোড করা হয়েছে ।

http://alhassanain.org/bengali

বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম

পাঠকের প্রতি

বিবর্তন থিওরীর পতনের জন্য কেন একটি বিশেষ অধ্যায় সংযোজন করা হলো তার কারণ- এই থিওরীটি সব ধরণের আধ্যাত্মবাদ বিরোধী দর্শনের ভিত্তি নির্মান করে। ডারউইনবাদ যেহেতু সৃষ্টির সত্যকে অস্বীকার করে আর এভাবে আল্লাহর অস্তিত্বকেও প্রত্যাখ্যান করে ; তাই বিগত ১৪০ বছর যাবৎ এই ডারউইনবাদ বহু লোকের বেলায় বিশ্বাস পরিত্যাগ করতে কিংবা সন্দেহে পতিত হবার কাজ করে যাচ্ছে । তাই এই থিওরী যে একটি প্রবঞ্চণা তা প্রমাণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যা কিনা ধর্মের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সম্পর্কিত। তাই এটি অত্যাবশ্যক বা জরুরী যে এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব খানা সকলের উপর বর্তায়। আমাদের কিছু কিছু পাঠক হয়তো বা জীবনে একটি মাত্র বই পড়ার সুযোগ পাবেন। তাই এ বিষয়ের সারসংক্ষেপের জন্য একটি অধ্যায় বরাদ্দ করাকেই আমরা উচিৎ বলে মনে করছি।

লেখকের সবখানা বইয়েই বিশ্বাস সম্পর্কিত বিষয়গুলো কোরআনে আয়াতের আলোকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে আর মানব সমাজকে আল্লাহ তাআলার বাণীগুলো সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে এবং সেগুলো অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা করার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলার আয়াতসমূহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবগুলো বিষয় এমনভাবে খণ্ডন করা হয়েছে যেন তা পাঠকের মনে কোন ধরণের সন্দেহের উদ্রেক না করে কিংবা কোন প্রশ্ন রেখে না যায়। এখানে আন্তরিক , সরল আর সাবলীল রচনাশৈলীর ব্যবহার করা হয়েছে যেন প্রতিটি বয়সের এবং সমাজের প্রত্যেক স্তরের প্রতিটি মানুষ এই বইগুলো সহজেই হৃদয়ংগম করতে পারে। মনে দাগ কেটে যাওয়া এই সহজবোধ্য বৃত্তান্তসমূহ বইখানিকে পাঠকের পক্ষে একটি বার বসে সমাপ্ত করে উঠতে পারাকে সম্ভব করে তুলেছে। এমনকি যারা আধ্যাত্মিক বিষয়টিকে প্রচণ্ডভাবে অস্বীকার করে তারাও এই বইগুলোতে বর্ণিত প্রকৃত সত্য তথ্যগুলো দিয়ে প্রভাবিত হয় আর তাই বইগুলোর বিষয়বস্তুসমূহকে তারা আর অসত্য বা অমূলক বলে প্রতিপন্ন করতে পারে না।

এই বইখানাসহ লেখকের অন্যান্য সব সৃষ্টিকর্মগুলো একাকী পড়া যায় কিংবা দলবদ্ধ হয়ে আলাপচারীতায় আলোচনা করা যেতে পারে। আর পাঠকগণ যারা এই গ্রন্থগুলো হতে সুফল পেতে ইচ্ছুক হন তারা এ অর্থে আলোচনা করাকে খুবই ফলপ্রসূ পাবেন যে , তারা তাদের নিজেদের ভাবনা আর অভিজ্ঞতাগুলো একে অপরের কাছে বর্ণনা করতে সক্ষম হবেন।

তদুপরি একমাত্র মহান আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির নিমিত্তে লেখা এই বইগুলো বিভিন্ন উপস্থাপনায় ব্যবহার করে আর পঠনের মাধ্যমে ধর্মের এক বিরাট সেবা করা হবে। লেখকের সবগুলো বই দৃঢ় প্রত্যয় উৎপাদন করে (আর বিশ্বাসযোগ্য)। এ কারণেই যারা মানব সমাজকে ধর্ম সম্পর্কে অবহিত করতে ইচ্ছুক তাদের জন্য সবচাইতে কার্যকরী ব্যবস্থা হলো - এই বইগুলি পড়ার ব্যাপারে মানুষকে উৎসাহিত করা।

আশা করা যায় যে পাঠকগণ বইয়ের শেষের পাতাগুলোয় অন্যান্য কিছু বইয়ের নিবন্ধসমূহে কিছূ সময় ধরে চোখ বুলিয়ে যাবেন আর আকীদা (বিশ্বাস) সম্পর্কিত বিষয়গুলোর সমৃদ্ধ উৎস গুলো - যা কিনা খুবই উপকারী ও পড়তেও আনন্দদায়ক - সেগুলোর সঠিক মূল্যায়ন করবেন।

এই বইগুলোতে অন্যান্য কিছু বইয়ের ন্যায় আপনি লেখকের ব্যক্তিগত মতামত , সন্দেহপূর্ণ (অনির্ভর যোগ্য) সূত্র হতে নেয়া ব্যাখ্যাবলী , রচনা শৈলী যা পবিত্র বিষয়ের কারণে সম্মান ও গভীর শ্রদ্ধা ও ভয়ের ব্যাপারে অমনোযোগী , হতাশাব্যঞ্জক , সন্দেহ উদ্রেককারী এবং নৈরাশ্যজনক বর্ণনা যা পাঠকের অন্তরে বিচ্যূতির সৃষ্টি করে - এগুলোর কোন কিছুই আপনি পাবেন না।

লেখক পরিচিতি

লেখন হারুন ইয়াহিয়া ছদ্মনামে লেখালেখি করছেন। তিনি ১৯৫৬ সালে আংকারায় জন্ম গ্রহন করেন। তিনি ইস্তাম্বুলের মিমার সিনান ইউনিভার্সিটিতে আর্টস আর ইস্তাম্বুল ইউনিভার্সিটিতে দর্শন শাস্ত্রে পড়াশুনা করেন। ১৯৮০ সন থেকে তিনি রাজ নৈ তিক বিশ্বাস সংক্রান্ত এবং বিজ্ঞান বিষয়ক ব্যাপারগুলো নিয়ে বহু গ্রন্থ প্রকাশ করে আসছেন। গ্রন্থকার হিসেবে হারুন ইয়াহিয়া একটি সুপরিচিত নাম যিনি বিবর্তনবাদীদের প্রবঞ্চণা , তাদের দাবিসমূহের অসিদ্ধতা আর ডারউইনবাদ এবং রক্তপাতে বিশ্বাসী ভাবাদর্শের মধ্যকার যোগাযোগ সংক্রান্ত বিষয়গুলো ফাঁস করে দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বহু গ্রন্থ তিনি লিখেছেন।

তার ছদ্মনাম হা রু ন ও ইয়াহিয়া এ দুটি নাম নিয়ে গঠিত। দুজন শ্রদ্ধেয় নবীর নাম থেকে এ দুটি নাম নেয়া হয়েছে , যাঁরা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। লেখকের বইগুলোর প্রচ্ছদসমূহে যে সীল রয়েছে তা এদের বিষয়সমূহের সংযোগে প্রতীকি অর্থ বহন করে। এই মোহর আল্লাহ তাআলার সর্বশেষ গ্রন্থ ও বাণী হিসাবে কোরআনকে আর হযরত মুহম্মদ (দঃ) কে সর্বশেষ নবী হিসেবে তুলে ধরে। পবিত্র কোরআন আর সুন্নাহের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে লেখক তাঁর মূখ্য উদ্দেশ্য হিসেবে এটি ধরে নিয়েছেন যে , তিনি যেন অবিশ্বাস জন্মানো ভাবাদর্শগুলোর প্রতিটি মৌলিক বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণিত করতে পারেন আর এমনভাবে তিনি তারঁ শেষ কথা বলে দিতে চান যা কিনা ধর্মের বিরুদ্ধে উত্থাপিত আপত্তিসমূহ সম্পূর্ণরূপে স্তব্ধ করে দিতে পারে। সর্বোচ্চ প্রজ্ঞা ও নৈতিক পূর্ণতা অর্জনকারী নবীর (দঃ) সীল বা মোহরটি লেখকের এই শেষ কথা বলার নিয়ত হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। লেখকের সমস্ত কার্যাবলীই একটি উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে , যা হলো : মানুষের কাছে কোরআনের বার্তা পৌছে দেয়া , আর আকীদা বা মৌলিক বিশ্বাস সম্পর্কিত বস্তুগুলো যেমন : আল্লাহর অস্তিত্ত্ব , তারঁ একত্ব ও পরকাল - এগুলো সম্পর্কে চিন্তা করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা ; আর তাদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী স্মরণ করিয়ে দেয়া ।

লেখক হারুন ইয়াহিয়া অসংখ্য দেশ যেমন ভারত , ইংল্যান্ড , ইন্দোনেশিয়া , পোল্যান্ড ,বসনিয়া , স্পেন , ব্রাজিল ইত্যাদি নানা দেশের পাঠকদের অনুরাগ অর্জন করেছেন। অসংখ্য ভাষায় তার বই অনূদিত হয়েছে। আর ইংরেজী , ফরাসী , জার্মানী , ইতালিয়ান , পর্তুগীজ , উর্দু , আরবী , আলবেনিয়ান , রাশিয়ান , বসনিয়ান , তার্কিশ ভাষায় অনূদিত বইসমূহ পাওয়া যাচ্ছে। (বর্তমানে বাংলা ভাষায়ও গুটিকতেক বই পাওয়া যাচ্ছে)।

অত্যন্ত স্বীকৃত এই সৃষ্টিকর্মগুলো পৃথিবীর সর্বত্র বহুলোকের ক্ষেত্রে আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করতে ও অন্যান্য বহু লোকের বেলায় তাদের ঈমানের গভীরতর অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করার ক্ষেত্রে নিমিত্ত বা উপায় স্বরূপ কাজ করছে। এই বইগুলোতে যে প্রজ্ঞা আর আন্তরিক ও সহজবোধগম্য শৈলী ব্যবহৃত হয়েছে তা বইগুলোতে এক স্বতন্ত্র ছোঁয়া রেখে গিয়েছে - ফলে যারা এই বইগুলো পড়ে আর পর্যবেক্ষণ করে তাদেরকে বইগুলো প্রত্যক্ষভাবে নাড়া দেয়। আপত্তিমুক্ত এই লেখাগুলোতে দ্রুত কার্যকারীতা , সুস্পষ্ট ফলাফল , অকাট্যতা , এ সমস্ত গুণাবলীমণ্ডিত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে। এই বইগুলোতে যে ব্যাখ্যাবলী প্রদান করা হয়েছে তা অবশ্যস্বীকার্য , সুস্পষ্ট এবং আন্তরিক আর এগুলোর সুস্পষ্ট উত্তরে পাঠকগণের মনোন্নয়ন ঘটে। যারা এই বইগুলো পড়বেন আর অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করবেন তাদের পক্ষে আর কখনও বস্তুবাদ দর্শন , নাস্তিকতা আর অন্যান্য যে কোন ধরণের বিকৃত ভাবাদর্শ কিংবা দর্শনকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করা সম্ভব হবে না। এমনকি যদিও তারা সমর্থন করেই যায় , এগুলো হবে কেবল ভাবাবেগপূর্ণ জেদেরই ফলাফল : কেননা এই বইগুলো উক্ত ভাবাদর্শগুলোর অত্যন্ত মূল বা ভিত্তি হতেই অসত্য বা অমূলক প্রতিপন্ন করে। হারুন ইয়াহিয়ার লেখা বইগুলোর বদৌলতে সমসাময়িক সব ধরণের অস্বীকারের আন্দোলন আজ আদর্শগতভাবেই পরাজিত হয়েছে।

এতে কোনই সন্দেহ নেই যে , এগুলোর বৈশিষ্ট্যাবলী- এদের প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত প্রজ্ঞা ও সহজ বোধ্যতারই ফলস্বরূপ। এটা নিশ্চিৎ যে , লেখক নিজে কখনও গর্ববোধ করেন না ; তিনি কেবল আল্লাহর সঠিক পথ সন্ধানের ক্ষেত্রে উপায় হিসেবে সাহায্য করার নিয়ত করেন। অধিকন্তু লেখক তার বইগুলো হতে পার্থিব অর্জনের চেষ্টা করেন না। এই লেখক তো নয়ই এমনকি অন্যান্য যারাই এই বইগুলোর প্রকাশ কিংবা পাঠকদের নিকট পৌছে দেয়ার কাজে জড়িত , তারা কেউই পার্থিব কোন লাভ অর্জন করেন না।

এ সমস্ত তথ্যগুলো বিবেচনা করে যারা মানুষের অন্তরের চোখ খুলে দেয়ার আর মানুষকে আল্লাহর আরো অনুগত বান্দা হতে পরিচালনাকারী এই বই গুলো সবাইকে পড়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করবেন , তারা নিঃসন্দেহে অমূল্য এক সেবা করে যাবেন।

ইতিমধ্যে , যে বইগুলো মানুষের অন্তরের সংশয় সৃষ্টি করে , ভাবাদর্শগত গোলমালের দিকে পরিচালিত করে এবং মানুষের মনের সন্দেহ দূরীকরণের ব্যাপারে যে বইগুলোর সুস্পষ্টভাবে কোন শক্তিশালী ও সঠিক প্রভাব নেই , এগুলোর প্রচার করা কেবলই সময় ও শক্তির অপচয় হবে মাত্র। এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান যে পথহারা মানুষকে মুক্ত করা ছাড়া শুধুমাত্র লেখকের সাহিত্যিক দক্ষতার উপর জোর দিয়ে রচিত বইয়ের পক্ষে এমন বড় ধরণের প্রভাব ফেলা অসম্ভব। এতে যারা সন্দেহ করে তারা সহজেই দেখতে পাবে যে , হারুন ইয়াহিয়ার বইগুলোর একমাত্র উদ্দেশ্য হলো অবিশ্বাসসমূহ দূর্বল করে দেয়া আর কোরআনের নৈতিক মূল্যবোধগুলো ছড়িয়ে দেয়া। এই সেবাকাজগুলি যে ধরণের সাফল্য , প্রভাব কিংবা আন্তরিকতা অর্জনে সহযোগী তা পাঠকদের বিশ্বাস উৎপাদন হতেই প্রকাশিত হয়।

একটি বিষয় মনে রাখা দরকার : মুসলমানগণ যে অবিরাম নিষ্ঠুরতা , দ্বন্দ্ব আর যে সমস্ত অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হচ্ছে তা ধর্মহীন আদর্শগত প্রচারের ফলাফল। এগুলোর অবসান হতে পারে বিশ্বাসহীন ভাবাদর্শের পরাজয়ের মাধ্যমে আর এটা নিশ্চিত করার মাধ্যমে যে , প্রতিটি ব্যক্তি সৃষ্টির রহস্য ও কোরআনের মূল্যবোধ সম্পর্কে এমন জ্ঞান রাখে যেন তারই মাধ্যমে জীবন যাপন করতে পারে। পৃথিবীর এখনকার হাল চাল বিবেচনা করলে যা কিনা মানুষকে সহিংসতা , দুর্নীতি ও দ্বন্দের সর্পিল নিম্নগতির দিকে পরিচালিত করতে বাধ্য করছে -এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে , এই কাজটি আরো দ্রুতগতিতে আর কার্যকারীরূপে করে যাওয়া দরকার। অন্যথায় তখন অত্যন্ত বিলম্ব হয়ে যাবে।

এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে , হারুন ইয়াহিয়ার ধারাবাহিক সৃষ্টিকর্মগুলো অগ্রনী ভূমিকা গ্রহন করেছে। আল্লাহর ইচ্ছায় এই বইগুলো একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের জন্য কোরআনে প্রতিশ্রুত শান্তি , রহমত , সুবিচার ও সুখের সন্ধান খুঁজে পাওয়ার উপায় বের করবে।

4

উটের কোমর বাঁধা

কাফেলাটি বহুক্ষণ পথ চলেছিল। সকলের চেহারাতেই ক্লান্তির ছাপ। বহনকারী পশুগুলোও। ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এমন একটি স্থানে উপস্থিত হলো যেখানে কিছু পানি ছিল। কাফেলা থেমে গেল। রসুলুলাহ (সাঃ) ও এ কাফেলার সাথে ছিলেন। তিনিও উটের পিঠ থেকে নেমে এলেন। সকলেই চেষ্টা করছিল যে , তাড়াতাড়ি পানির কাছে গিয়ে অযু ইত্যাদি সেরে নামাযের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

মহানবী (সাঃ)ও নামার পর পানির দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু কয়েক ধাপ চলার পর কাউকে কিছু না বলে আবার নিজের উটের দিকে ফিরে এলেন। রাসূলের সাহাবী ও সাথীগণ আশ্চর্য হয়ে পরস্পরে বলাবলি করতে লাগলেন যে , মনে হয় যাত্রা বিরতির জন্য এ স্থানটি আল্লাহর নবীর পছন্দ হয়নি। এখনই হয়তো রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দেবেন। সকলেই রাসূলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন এবং নতুন হুকুমের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। লোকেরা আরো অধিক আশ্চর্য হলেন তখন , যখন তারা দেখলেন যে , মহানবী (সাঃ) নিজের উটের কোমরবন্ধনী (উটের কোমর বাঁধার রশি বিশেষ) হাতে নিলেন এবং নিজের উটের কোমর বাঁধতে শুরু করলেন। তাড়াতাড়ি বাঁধার কাজ শেষ করে তিনি আবার পানির দিকে গেলেন ।

চারদিক থেকে লোকেরা এসে বললেন , হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এ কাজের জন্য আমাদেরকে কেন হুকুম দিলেন না ? আপনি কেন এ কাজটি করতে গেলেন ? এ কাজটির জন্য আপনি আবার ফিরে গেলেন। আমরা তো অত্যন্তগর্বের সাথে এ কাজটি করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম

প্রিয় নবী (সাঃ) তাদের কথার জবাবে বললেন , নিজের কাজে কখনো অপরের সাহায্য নেয়া উচিত নয়। আর কারো ভরসা করাও ঠিক নয়। সেটা একটি মেসওয়াকের ব্যাপারই হোক না কেন অর্থাৎ কাজটি ছোট হোক অথবা বিরাট ,অপরের ভরসায় বসে থাকার চেয়ে নিজেই করা উচিত5

5

হজ্বের সফর সঙ্গী

হজ্ব থেকে ফিরে এসে এক ব্যক্তি তার নিজের ও তার সঙ্গীদের হজ্বের সফরের কাহিনী ইমাম জা ফর সাদিক (আঃ)-কে বর্ণনা করছিল। সে তার সাথীদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তির বিশেষ প্রশংসা করছিল। সে বলতে লাগলো যে , প্রকৃতপক্ষেই সে ব্যক্তিটি খুবই মোত্তাকী-পরহেযগার ও অত্যন্ত ইবাদতকারী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সব সময়ই মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে কাটিয়েছেন। আমরা যখনই কোথাও রাত্রি যাপন করার উদ্দেশ্যে যাত্রা বিরতি করতাম তখনই তিনি এক কিনারে চলে যেতেন এবং সাথে সাথেই জায়নামায বিছিয়ে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হয়ে যেতেন।

ইমাম সাদিক (আঃ) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন : তার কাজ-কর্মগুলো আঞ্জাম দিত কে ? কে তার জন্তুটির দেখাশোনা করতো ?

জবাবে লোকটি বললো : তার সমস্তকাজগুলো করে দেবার সৌভাগ্য আমাদেরই হয়েছিল। তিনি তো শুধু তাঁর নেক আমলের কাজগুলোতে ব্যস্ত থাকতেন। এসব কাজের প্রতি তার কোন মনোযোগ ছিল না।

ইমাম (আঃ) বললেন , এ কারণেই তোমরা সকলে উক্ত মোত্তাকী পরহেযগার ও ইবাদতকারীর চেয়ে অধিক উত্তম

6

বনভোজন

হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গী দল নিজ নিজ বাহনের পিঠ থেকে নিচে নামলেন। মাল সামানগুলোকে খুলে মাটিতে রাখলেন। তারপর সকলে মিলে ঠিক করলেন যে , একটি দুম্বা জবাই করে খাবার তৈরী করা হবে।

একজন সাহাবী বললেন , দুম্বা জবাই করা আমার দায়িত্বে রইলো

আরেকজন বললেন দুম্বার চামড়া ছাড়ানো এবং গোশত কাটার দায়িত্ব আমার।

তৃতীয় জন বললেন , গোশত রান্না করার দায়িত্ব আমার।

চতুর্থ জন বললেন ,

রসুলুলাহ (সাঃ) বললেন , কাঠ কুড়িয়ে আনার দায়িত্ব আমার।

সকল সাহাবী এক সাথে বলে উঠলেন , হে আল্লাহর রাসূল! আমরা উপস্থিত থাকতে আপনি কষ্ট করবেন কেন ? আপনি বিশ্রাম নিন। আমরা গর্বের সাথে সমস্ত কাজ ঠিকঠাক সেটে নিব।। রাসূল (সাঃ) বললেন , আমি জানি এ কাজ তোমরা করে নিতে পারবে। কিন্তু মহান আল্লাহ সে বান্দাকে কখনো ভালোবাসেন না যে নিজের বন্ধুদের মাঝে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম মনে করে এবং নিজেকে অপরের চেয়ে বিশেষ ব্যক্তিত্ব জ্ঞান করে6 এ কথা বলে তিনি বনের দিকে চলে গেলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে জ্বালানী কাঠ ও খড়-কুটো নিয়ে ফিরে এলেন।7

7

হজ্বযাত্রী এক কাফেলা

মুসলমানদের একটি কাফেলা মক্কা যাচ্ছিল। মদীনা পৌঁছেই কাফেলার লোকেরা কয়েক দিনের জন্য যাত্রা বিরতি করলো। কয়েক দিন বিশ্রাম গ্রহণের পর তারা আবার মদীনা থেকে মক্কার দিকে রওয়ানা হলো।

মক্কা ও মদীনার মাঝে এক স্থানে এসে কাফেলা আবার বিশ্রাম গ্রহণের জন্য যাত্রা বিরতি করলো। এ সময় কাফেলার লোকদের সাথে এমন এক ব্যক্তির সাক্ষাত ঘটলো যিনি কাফেলার সকল লোককে চিনতেন ও জানতেন। লোকটি যখন কাফেলার লোকদের সাথে আলাপ-আলোচনায় লিপ্ত তখন তাঁর দৃষ্টি গিয়ে পড়লো এমন এক ব্যক্তির উপর যিনি অত্যন্তহাসি মুখে কাফেলার লোকদের খেদমতে ব্যস্তছিলেন। লোকটি প্রথম দৃষ্টিতেই সে ব্যক্তিকে চিনতে পারলেন , যিনি খুব আনন্দমনে লোকদের খেদমত করে চলছিলেন। তাই অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে কাফেলার লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন , তোমরা কি এ ব্যক্তিকে চেনো যিনি তোমাদের খেদমতে লেগে আছেন ? জবাবে তারা বললো , না ,আমরা এ লোকটিকে মোটেই চিনি না। এ লোকটি তো মদীনা থেকে আমাদের কাফেলার সাথে শামিল হয়েছে। তবে এ কয়েক দিনের সফরের সাথী হিসেবে এতোখানি বলতে পারি যে , এ লোকটি একজন সৎ লোক এবং অত্যন্ত মোত্তাকী-পরহেযগার। আমরা তাকে বলিনি ,আমাদের কাজ করে দাও। কিন্তু সে নিজেই অপরের খেদমতে লেগে আছে এবং সকলেরই সাহায্য-সহযোগিতা করে চলছে

কাফেলার লোকদের বন্ধুটি বললেন , আমি জানি তোমরা তাকে মোটেও চেনো না। যদি তোমরা তাকে চিনতেই পারতে তাহলে কখনও এমন অপরাধজনক কাজ করতে পারতে না যে , একজন সাধারণ খাদেমের ন্যায় তোমাদের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যেতে থাকবেন তিনি । এ কথা শুনে সকলে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো , তিনি কে ?

লোকটি বললেন , তিনি হলেন আলী ইবনুল হোসাইন (আঃ) অর্থাৎ ইমাম যয়নুল আবেদীন (আঃ)

এ কথা শুনেই কাফেলার সমস্তলোক হতবাক হয়ে গেল এবং ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য অত্যন্ত আদবের সাথে ইমামের হাতে চুমু খাওয়ার আশায় তাঁর দিকে এগিয়ে গেল। সমস্তলোক ইমামের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে অনুযোগের সুরে বলতে লাগলো , হে ইমাম! আপনি আমাদের সাথে এমনটি কেন করলেন ? সম্ভাবনা ছিল যে , আমরা অজ্ঞতাবশত আপনার সাথে মারাত্মক কোন অপরাধ করে বসতাম তাতে আমরা বড় গুণাহগার-পাপী হতাম

ইমাম বললেন , যেহেতু তোমরা কেউ আমাকে চিনতে না ,এ জন্যই আমি তোমাদের সফর সঙ্গী হয়েছি । কেননা আমি যখন চেনা-জানা লোকদের সাথে সফর করি তখন লোকেরা রাসূলে খোদা (সাঃ)-এর খাতিরে আমাকে অত্যন্ত ভালোবেসে আমার সাথে সদয় আচরণ করে। আর তারা আমাকে ছোটখাটো কোন কাজও করতে দেয় না। এ জন্যই আমি সফরের জন্য এমন একটি কাফেলা বেছে নিয়েছি যাদের কেউ আমাকে চেনে না যাতে করে আমি নিজের কাজ নিজেই আঞ্জাম দিতে পারি। আর আমি লোকদের কাছে আমার পরিচয় এজন্য গোপন রেখেছি যাতে করে আমি আমার সাথীদের খেদমত করার সুযোগ লাভ করতে পারি8

8

এক মুসলমান ও এক আহলে কিতাব

সে সময় কুফা নগরী ছিল ইসলামী শাসনেরা প্রাণকেন্দ্র। সিরিয়া ছাড়াও ইসলামী সাম্রাজ্যের অন্য সকল স্থানের সকল লোকের নজর তখন সে নগরীর দিকেই নিবন্ধ থাকতো এ জন্য যে , সেখান থেকে কখন কোন নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ হুকুম জারী করা হয়।

এ শহর থেকে অনেক দূরে দুই ব্যক্তির সাথে রাস্তায় দেখা হলো। একজন মুসলমান আর অপরজন আহলে কিতাব (আহলে কিতাব মানে ইয়াহুদী বা খ্রিস্টান কিংবা যারথুস্ত্রীয়)। দুই জনেই একে অপরের গন্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো। জানা গেল যে ,মুসলমান লোকটি কুফা শহরে যাবে। আর আহলে কিতাব লোকটি কুফার নিকটেই অন্য এক স্থানে যাবে। দুইজনে মিলে স্থির করলে যে , তারা এক সাথে সফর করবে। কেননা ,অনেক দূর পর্যন্ত দুইজনের রাস্তা একই। এক সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে পথ চলা যাবে।

দুজনের আন্তরিক আলাপ-আলোচনা ও বিভিন্ন কথাবার্তার মধ্য দিয়ে পথ শেষ হয়ে এলো। অবশেষে তারা একটি দুই রাস্তার মোড়ে এসে উপস্থিত হলো যেখান থেকে দু জনের রাস্তা দু দিকে চলে গেছে। আহলে কিতাব লোকটি তার নিজের পথ ধরে চলতে লাগলো। কিছু দূর পথ চলার পর পিছনে ফিরে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেলো। সে দেখতে পেলো তার মুসলমান বন্ধুটি কুফার দিকে না গিয়ে তারই পিছে পিছে চলে আসছে। এ অবস্থা দেখে সে দাড়িয়ে গেল এবং তার মুসলমান বন্ধুটিকে জিজ্ঞাসা করলো : কি ভাই! তুমি না বলেছিলে যে , তুমি কুফা যাবে ?

জবাবে মুসলমান বন্ধুটি বললো , আমি তো এখনো বলছি যে ,আমি কুফা যাবো

আহলে কিতাব লোকটি বললো , তাহলে তুমি এদিকে আসছো কেন ? এটা তো কুফার রাস্তা নয়। কুফা যাবার রাস্তা তো ঐটা।

মুসলমান বন্ধুটি বললো , আমি জানি। কিন্তু আমার মন চাইলো যে , কিছু দূর পর্যন্তআমি তোমার সঙ্গ দেবো। কেননা আমাদের নবী বলেছেন যখন দু ব্যক্তি এক সাথে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে পথ চলে তখন একে অপরের প্রতি অধিকার লাভ করে। এখন তোমারও আমার ওপর। সতরাং আমি অধিকার রয়েছে। আমি সে অধিকার আদায় করার উদ্দেশ্য কিছু দূর পর্যন্ততোমার সাথে চলতে চাই। এরপর তো আমি আমার পথেই ফিরে যাবো

আহলে কিতাব বললো , ওহ্! তোমাদের নবী যে মানুষের উপর এতোই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন এতো দ্রুত বিশ্বে প্রসার লাভ করেছি ,এটা নিশ্চয় তাঁর এই উত্তম চরিত্রেরই গুণে ছিল।

আহলে কিতাব লোকটি আরো বেশী অবাক হলো তখন যখন সে জানতে পারলো যে , তার সফর সঙ্গী মুসলমান বন্ধুটি আর কেউ নন ,বরং মুসলিম মিলাতের বর্তমান খলিফা হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (আঃ)। তৎক্ষণাত সে আহলে কিতাব লোকটি ইসলাম গ্রহণ করে মসলমান হয়ে গেল এবং হযরত আলীর একজন বিশ্বস্তও অনুগত সাহাবীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো।9

9

খলিফার সান্নিধ্যে

হযরত আলী (আঃ) কুফার দিকে আসছিলেন। পথে আম্বার নামক এক শহরে উপস্থিত হলেন। যেখানকার বেশীর ভাগ অধিবাসী ছিল ইরানী। ইরানী কৃষক ও মাতব্বররা যখন জানতে পারলো যে , তাদের প্রিয় খলিফা তাদেরই শহর দিয়ে অতিক্রম করবেন তখন তাদের আর আনন্দের সীমা রইলো না। সকলে তাদের খলিফাকে স্বাগতম ও খোশ আমদেদ জানাবার জন্য দৌঁড়ে এলো। হযরত আলী (আঃ)-এর বাহন যখন এগিয়ে চললো তখন লোকেরাও বাহনের আগে আগে দৌঁড়াতে লাগলো। হযরত আলী (আঃ) নিজের বাহন থামিয়ে দিয়ে লোকদেরকে ডেকে পাঠালেন। লোকেরা যখন তার কাছে এলো তখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন , তোমরা এভাবে দৌঁড়াদৌড়ি করছো কেন ? এভাবে দৌঁড়াদৌঁড়ির পেছনে তোমাদের উদ্দেশ্য কি ?

লোকেরা বললো , আসলে এটা শাসকবর্গ ও সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটা রীতি। বহুকাল আগ থেকে প্রচলিত আমাদের একটি প্রথা

হযরত আলী (আঃ) তাদেরকে বললেন , তোমাদের এ কাজ দুনিয়াতে তোমাদেরকে কষ্ট দিচ্ছে আর পরকালেও এর কারণে অনেক শাস্তিভোগ করতে হবে। এমন কাজ কখনো করবে না ,যা তোমাদের অপমান ও লাঞ্ছনা ডেকে আনে। আর তোমরাই দেখো যে ,তোমাদের এ কাজের দ্বারা তোমাদের 1 নেতা ও অমীরেরই বা কি লাভ হয় ?10

10

ইমাম বাক্বের ( আঃ ) ও এক খ্রিস্টান

ইমাম বাক্বের (আঃ)। নাম মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনিল হোসাইন (আঃ) । যার উপাধি ছিল বাক্বের । বাক্বের শব্দের আভিধানিক অর্থ ভাগ-বিশেষণকারী। তাকে বলা হতো বাক্বেরুল উলুম যার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাগ-বিশেষণ ও ব্যাখ্যাকারী।

এক খ্রিস্টান বাক্বের শব্দের বিকৃত উচ্চারণ করে ইমামের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে চাইলো। সে ইমামকে উদ্দেশ্যে করে বললো , [আনতা বাক্বার] অর্থাৎ তুমি গাভী

ইমাম কোন প্রকার অসন্তুষ্টি বা রাগান্বিত না হয়ে অত্যন্তসরল ও সহজ ভাষায় বললেন , না ভাই! আমি বাক্বার (গাভী) নই। আমি বাক্বের (বিশেষণকারী)

অতঃপর খ্রিস্টান লোকটি বললো , তুমি একটা রাঁধুনির ছেলে। ইমাম বললেন ,এটা তার পেশা ছিল । এতে কোনো লজ্জা বা ঘৃণার কিছু নেই।

খ্রিস্টান লোকটি আরো বললো , তোমার মা ছিল কালো কুৎসিত। তার লজ্জা-শরম কিছুই ছিল না। আর তার ভাষাও ছিল বিশ্রী

এবারও ইমাম অত্যন্তসহজ-সরল ভাষায় বললেন , আমার মাতা সম্পর্কে তুমি যে সব অপবাদ দিচ্ছো তা যদি সত্য হয় তাহলে মহান আল্লাহ যেন তার গুণাহ খাতা মাফ করে দেন। আর যদি মিথ্যা হয় তাহলে যেনো তোমার অপরাধ ক্ষমা করে দেন। কেননা কারো সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দেয়া বড়ই গুণাহের কাজ

একজন মানুষ যার জন্যে ইসলামের বহির্ভূত একজন লোককে শাস্তি দেয়ার সব ধরনের সামর্থ্য তার ছিল ,অথচ এতটা ধৈর্য্য ধরলেন। এটুকুই ঐ খ্রিস্টান লোকটির মনের ভেতরে বিপ্লব সংঘটনের জন্য এবং তাকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ছিল।

পরবর্তীতে খ্রিস্টান লোকটি মসলমানু হয়।

11

এক আরব বেদুঈন ও রাসূলে আকরাম ( সাঃ )

এক আরব বেঈদুন মদীনা শহরে এসে সোজা মসজিদে নববীতে চলে গেল। তার উদ্দেশ্য ছিল মহানবী (সাঃ)-এর কাছ থেকে সোনা-দানা টাকা-পয়সা নিবে। সে সময় প্রিয় নবী (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন। বেদুঈন লোকটি রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর সামনে এসে তার আরজ পেশ করলো এবং তাকে কিছু দান করার জন্য আবেদন জানালো। আল্লাহর নবী (সাঃ) তাকে কিছু দান করলেন। কিন্তু তাতে সে সন্তুষ্ট হলো না। সে রাসূলের (সাঃ) দানকে সামান্য গণ্য করলো। তাছাড়া সে কিছু বিশ্রী শব্দ ব্যবহার করে রাসল (সাঃ) এর প্রতি বেয়াদবি করলো। এ অবস্থা দেখে রাসূল (সাঃ) এর সাহাবীরা প্রচণ্ড রেগে গেলেন এবং ঐ লোকটিকে কঠিন শাস্তিদেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। কিন্তু মহানবী (সাঃ) তাদেরকে থামিয়ে দিলেন।

এরপর রাসূলে খোদা (সাঃ) লোকটিকে সাথে নিয়ে তাঁর বাড়িতে গেলেন এবং তাকে আরো কিছু সাহায্য দান করলেন। এ সময় বেদুঈন লোকটি নিজের চোখে দেখতে পেলো যে ,রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর জীবন ও অন্যান্য নেতা ও শাসকদের জীবনের অবস্থার মধ্যে কোন মিল নেই। আর সে রাসূলের কাছে যে সোনা দানা আশা করেছিলো আসলেই তা তারঁ কাছে নেই।

বেদুঈন আরব সন্তুষ্টি প্রকাশ করলো এবং মুখে কতৃজ্ঞতার ভাষা উচ্চারণ করলো। তখন মহানবী (সাঃ) আরব বেদঈনকে বললেন , গতকাল তুমি আমার সম্পর্কে বিশ্রী কথাবার্তা বলেছ যা আমার সাহাবীদেরকে উত্তেজিত করে দেয়। তারা তোমার উপর খুবই অসন্তুষ্ট। এখন আমার ভয় হচ্ছে যে ,তারা তোমার কোন ক্ষতি করে বসতে পারে। এখন তুমি আমার সামনে কৃতজ্ঞতার কথা বলেছ। অতএব এটা কি সম্ভব যে ,তুমি তোমার এ কথাটি তাদের সামনেও প্রকাশ করবে যাতে তাদের রাগ দূর হয়ে যায় ? জবাবে সে বললো , এতে আমার কোন আপত্তি নেই

পরদিন বেদুঈন লোকটি মসজিদে নববীতে গেল। যখন সবাই সেখানে সমবেত ছিলেন। রাসূল (সাঃ) তাদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন , লোকসকল! এ লোকটি বলছে যে আমার প্রতি সে সন্তুষ্ট হয়ে গেছে। কি ? এ কথা কি সঠিক ?

বেদুঈন লোকটি বললো , জ্বি ,এটাই সঠিক। অতঃপর সে ঐ কথাটাই বিড়বিড় করে বললো যা ইতোপূর্বে বলেছিল। রসূলে খোদা (সাঃ) এর সাহাবীরা তখন হেসে ফেললেন।

এ সময় আল্লাহর নবী (সাঃ) সকলের উদ্দেশ্যে বললেন , এ লোকটি আর আমার ঘটনাটির উদাহরণ হলো সে ব্যক্তির মতো ,যার উট স্বীয় মালিকের প্রতি আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। আর লোকেরা উটের মালিককে সাহায্য করার উদ্দেশ্য নিয়ে শোরগোল শুরুকরে দিল এবং সে পলায়নকারী উটটির পিছে পিছে দৌঁড়াতে লাগলো। উটটি আরো আতঙ্কিত হয়ে দ্রুত পালাতে লাগলো। এ অবস্থা দেখে উটের মালিক সকল লোককে উদ্দেশ্য করে চিৎকার দিয়ে বললো , ভাইসব! অনুরোধ করছি আমার উটের পিছনে কাউকে দৌঁড়াতে হবে না। আমার উটকে কিভাবে শান্তকরতে হয় সেটা আমি ভালো জানি।

তার এ আহ্বান শুনে উটের পিছে দৌঁড়ানো লোকজন থেমে গেল। তারপর উটের মালিক এক মুষ্টি ঘাস নিজের হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে উটের কাছে পৌঁছে গেল। আর খুব সহজে উটের বলা (লাগাম বিশেষ) নিজের হাতে নিয়ে নিল। উটটি তখন মালিকের সাথে ফিরে এলো।

গতকাল যদি আমি তোমাদেরকে বারণ না করতাম তাহলে এ আরব বেদুঈনকে তার জীবন হারাতে হতো। তোমরা তাকে জীবিত ছেড়ে দিতে না। তাতে লোকটি কুফরী ও মূর্তি পূজারীর অবস্থায় মারা যেতো। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমি তোমাদেরকে কোন পদক্ষেপ নিতে দেইনি। আর এখন তোমরা নিজেরাই দেখতে পেলে যে ,আমি আমার ভালোবাসা ও নম্র ব্যহার দ্বারা লোকটিকে একেবারেই মুগ্ধ করে ফেলেছি11

12

সিরিয়াবাসী এক ব্যক্তি ও ইমাম হোসাইন ( আঃ )

সিরিয়াবাসী এক ব্যক্তি হজ্ব অথবা অন্য কোন উদ্দেশ্য মদীনায় আসলো। মসজিদে নববীতে একদিন হঠাৎ তার নজর গিয়ে পড়লো এমন এক ব্যক্তির উপর যিনি মসজিদের এক কোণে বসেছিলেন। সে ভাবতে লাগলো যে ,এ লোকটি কে ? নিকটেই দাঁড়ানো অপর এক লোককে জিজ্ঞাসা করলো , এ লোকটি কে ভাই ? সে বললো , তিনি হোসাইন ইবনে আলী ইবনে আবী তালিব (আঃ) । পূর্ব থেকেই ভিত্তিহীন মিথ্যা প্রচার-প্রপাগাণ্ডা12 তার মন-মগজকে (ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে) বিগড়ে রেখেছিল।

সুতরাং এ নামটি শোনার সাথে সাথেই ক্রোধ ও ক্ষোভে তার চেহারা লাল হয়ে গেল। আর সে খোদার সন্তুষ্টি লাভের নিয়তে ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে গালি-গালাজের বৃষ্টি বর্ষণ করতে লাগলো। অশ্রাব্য ,বিশ্রী ও কুৎসিত শব্দ ব্যবহার করে সে ইমামকে গালি দিয়ে তার অন্তরের জ্বালা মিটালো এবং তার মনের ক্ষোভ-দুঃখ প্রকাশ করলো। ইমাম হোসাইন (আঃ) তার গালাগালিতে মোটেও রাগ করলেন না , বরং অত্যন্ত ভালোবেসে ও সদ্ব্যবহারের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আল-কোরআনের সে আয়াতগুলো তেলাওয়াত করলেন ,যে আয়াতগুলোতে ভালো ব্যবহার , ক্ষমা প্রদর্শন ও মার্জনা করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। কোরআনের আয়াতগুলো পাঠ করার পর ইমাম হোসাইন (আঃ) সিরিয়ার অধিবাসী সে লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন , আমি তোমার যে কোন খেদমত ও সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত আছি । তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন , তুমি কি সিরিয়ার অধিবাসী ? জবাবে সে বললো , হ্যা! আমি একজন সিরিয়ার অধিবাসী । তখন ইমাম তাকে বললেন , সিরিয়াবাসীদের এরূপ ব্যবহারের অভিজ্ঞতা আমার আছে। আর আমি খব ভালোভাবে জানি ,এ দুর্ব্যবহার ও শত্রুতার কারণ কি ?

অতঃপর ইমাম লোকটিকে বললেন , তুমি এ শহরে একজন মুসাফির । বিদেশের বাড়িতে যদি তোমার কোন কিছুর প্রয়োজন হয় তাহলে তুমি আমাকে বলো। আমি তোমার যে কোন খেদমত করার জন্য প্রস্তুত আছি। আমি তোমাকে আমার মেহমান করতে চাই এবং তোমাকে পোশাক-পরিচ্ছদ ও টাকা-পয়সা ইত্যাদিও দিতে চাই । সিরিয়াবাসী লোকটি তার দুর্ব্যবহার ও গালিগালাজের জন্য একটা কঠোর পরিণতির অপেক্ষা করছিল। সে এমনটি কখনোই আশা করছিল না যে , তার এ অপরাধ ও ধৃষ্টতা একেবারেই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হবে। ইমামের এ সুন্দর ব্যবহার তার মধ্যে এক আত্মিক বিপ্লব এনে দিয়েছে। সে নিজে নিজে বলতে লাগলো , আমার মন চায় যে , মাটি ফেটে দ্বিখন্ডিত হয়ে যাক আর আমি তাতে ঢুকে পড়ি। হায় আফসোস! নিজের অজ্ঞতার কারণে আমি যদি এ অপরাধ না করতাম! এর আগ পর্যন্ত ইমাম হোসাইন (আঃ) ও তাঁর পিতার চেয়ে বড় দুশমন আর কেউ ছিল না। আর এখন আমার দৃষ্টিতে ইমাম হোসাইন (আঃ) ও তাঁর পিতার চাইতে অধিক প্রিয় আর কেউ নেই13

13

উপদেশ প্রার্থী এক ব্যক্তি

এক আরব বেদুঈন মদীনা শহরে এসে রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর খেদমতে হাজির হয়ে আবেদন করলো , হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমাকে কিছু উপদেশ দান করুন । মহানবী (সাঃ) তাকে বললেন , ক্রোধান্বিত হয়ো না । এর বেশি তাকে আর কিছুই বললেন না।

অতঃপর লোকটি তার গোত্রের মাঝে ফিরে গেল। বাড়ি ফিরেই সে জানতে পারলো যে , তার অনুপস্থিতিতে এক মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে। তারই গোত্রের যুবকরা অপর এক গোত্রের কিছু মালামাল জোরপূর্বক লুটপাট করে নিয়ে এসেছে। এর জবাবে সে গোত্রের লোকেরাও এদের অনেক মালামাল লুটপাট করে নিয়ে গেছে। এভাবে লুটপাটের এ ধারা উভয় গোত্রের মাঝে এমন এক পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়েছে যে ,এখন দুই গোত্রের লোকেরাই এক মারাত্মক যুদ্ধ-বিগ্রহ ও খুনাখুনির পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। এ খবর শোনা মাত্রই সে লোকটি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল। তৎক্ষণাত সে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলো এবং রণাঙ্গনের দিকে ছুটলো নিজের গোত্রের সঙ্গ দেবার জন্য।

ঠিক এমন সময় তার মনে পড়লো যে , সে মদীনায় গিয়েছিল এবং রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর কাছে উপদেশ প্রার্থনা করেছিল , তখন মহানবী (সাঃ) বলেছিলেন , নিজের ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণে রাখো

অতঃপর সে মনে মনে ভাবতে লাগলো , কেন আমি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলাম কোন কারণে আমি এভাবে যুদ্ধ করতে এবং খুনাখুনি করতে তৈরি হয়ে গেলাম ? কেনই বা আমি এরূপ ক্রোধান্বিত হয়ে গেলাম ? এসব প্রশ্ন তার মনে জেগে ওঠার পর সে ভাবলো : এখনই উপযুক্ত সময় , রসুলুলাহ (সাঃ) ছোট্ট উপদেশটি পালন করার।

এরপর সে এগিয়ে গেল এবং বিরোধী গোত্রের সরদারকে ডেকে বললো , এ সংঘাত কি জন্যে ? যদি এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য হয় সে সমস্ত মালামাল ফিরে পাওয়া যা আমাদের গোত্রের যুবকরা বোকামি করে তোমাদের থেকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে , তাহলে এসো আমি আমার নিজস্ব সম্পদ থেকে তোমাদের ক্ষতিপূর ণ করে দেই। এটা একটা ভালো কথা নয় যে , এর কারণে আমরা একে অপরের রক্তপিপাসু হয়ে যাবো

প্রতিপক্ষ গোত্রের লোকেরা যখন এ ব্যক্তির যুক্তিপূর্ণ ও উদারতাপূর্ণ কথাগুলো শুনলো তখন তাদের মধ্যেও বীরত্ববোধ জেগে উঠলো। বললো , আমরাও তোমাদের চেয়ে কোন অংশে কম নই। যদি এমনটিই হয় তাহলে আমরা আমাদের দাবি প্রত্যাহার করলাম

তখন উভয় গোত্রের লোকেরা নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেল।14

4

উটের কোমর বাঁধা

কাফেলাটি বহুক্ষণ পথ চলেছিল। সকলের চেহারাতেই ক্লান্তির ছাপ। বহনকারী পশুগুলোও। ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এমন একটি স্থানে উপস্থিত হলো যেখানে কিছু পানি ছিল। কাফেলা থেমে গেল। রসুলুলাহ (সাঃ) ও এ কাফেলার সাথে ছিলেন। তিনিও উটের পিঠ থেকে নেমে এলেন। সকলেই চেষ্টা করছিল যে , তাড়াতাড়ি পানির কাছে গিয়ে অযু ইত্যাদি সেরে নামাযের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

মহানবী (সাঃ)ও নামার পর পানির দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু কয়েক ধাপ চলার পর কাউকে কিছু না বলে আবার নিজের উটের দিকে ফিরে এলেন। রাসূলের সাহাবী ও সাথীগণ আশ্চর্য হয়ে পরস্পরে বলাবলি করতে লাগলেন যে , মনে হয় যাত্রা বিরতির জন্য এ স্থানটি আল্লাহর নবীর পছন্দ হয়নি। এখনই হয়তো রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দেবেন। সকলেই রাসূলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন এবং নতুন হুকুমের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। লোকেরা আরো অধিক আশ্চর্য হলেন তখন , যখন তারা দেখলেন যে , মহানবী (সাঃ) নিজের উটের কোমরবন্ধনী (উটের কোমর বাঁধার রশি বিশেষ) হাতে নিলেন এবং নিজের উটের কোমর বাঁধতে শুরু করলেন। তাড়াতাড়ি বাঁধার কাজ শেষ করে তিনি আবার পানির দিকে গেলেন ।

চারদিক থেকে লোকেরা এসে বললেন , হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এ কাজের জন্য আমাদেরকে কেন হুকুম দিলেন না ? আপনি কেন এ কাজটি করতে গেলেন ? এ কাজটির জন্য আপনি আবার ফিরে গেলেন। আমরা তো অত্যন্তগর্বের সাথে এ কাজটি করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম

প্রিয় নবী (সাঃ) তাদের কথার জবাবে বললেন , নিজের কাজে কখনো অপরের সাহায্য নেয়া উচিত নয়। আর কারো ভরসা করাও ঠিক নয়। সেটা একটি মেসওয়াকের ব্যাপারই হোক না কেন অর্থাৎ কাজটি ছোট হোক অথবা বিরাট ,অপরের ভরসায় বসে থাকার চেয়ে নিজেই করা উচিত5

5

হজ্বের সফর সঙ্গী

হজ্ব থেকে ফিরে এসে এক ব্যক্তি তার নিজের ও তার সঙ্গীদের হজ্বের সফরের কাহিনী ইমাম জা ফর সাদিক (আঃ)-কে বর্ণনা করছিল। সে তার সাথীদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তির বিশেষ প্রশংসা করছিল। সে বলতে লাগলো যে , প্রকৃতপক্ষেই সে ব্যক্তিটি খুবই মোত্তাকী-পরহেযগার ও অত্যন্ত ইবাদতকারী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সব সময়ই মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে কাটিয়েছেন। আমরা যখনই কোথাও রাত্রি যাপন করার উদ্দেশ্যে যাত্রা বিরতি করতাম তখনই তিনি এক কিনারে চলে যেতেন এবং সাথে সাথেই জায়নামায বিছিয়ে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হয়ে যেতেন।

ইমাম সাদিক (আঃ) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন : তার কাজ-কর্মগুলো আঞ্জাম দিত কে ? কে তার জন্তুটির দেখাশোনা করতো ?

জবাবে লোকটি বললো : তার সমস্তকাজগুলো করে দেবার সৌভাগ্য আমাদেরই হয়েছিল। তিনি তো শুধু তাঁর নেক আমলের কাজগুলোতে ব্যস্ত থাকতেন। এসব কাজের প্রতি তার কোন মনোযোগ ছিল না।

ইমাম (আঃ) বললেন , এ কারণেই তোমরা সকলে উক্ত মোত্তাকী পরহেযগার ও ইবাদতকারীর চেয়ে অধিক উত্তম

6

বনভোজন

হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গী দল নিজ নিজ বাহনের পিঠ থেকে নিচে নামলেন। মাল সামানগুলোকে খুলে মাটিতে রাখলেন। তারপর সকলে মিলে ঠিক করলেন যে , একটি দুম্বা জবাই করে খাবার তৈরী করা হবে।

একজন সাহাবী বললেন , দুম্বা জবাই করা আমার দায়িত্বে রইলো

আরেকজন বললেন দুম্বার চামড়া ছাড়ানো এবং গোশত কাটার দায়িত্ব আমার।

তৃতীয় জন বললেন , গোশত রান্না করার দায়িত্ব আমার।

চতুর্থ জন বললেন ,

রসুলুলাহ (সাঃ) বললেন , কাঠ কুড়িয়ে আনার দায়িত্ব আমার।

সকল সাহাবী এক সাথে বলে উঠলেন , হে আল্লাহর রাসূল! আমরা উপস্থিত থাকতে আপনি কষ্ট করবেন কেন ? আপনি বিশ্রাম নিন। আমরা গর্বের সাথে সমস্ত কাজ ঠিকঠাক সেটে নিব।। রাসূল (সাঃ) বললেন , আমি জানি এ কাজ তোমরা করে নিতে পারবে। কিন্তু মহান আল্লাহ সে বান্দাকে কখনো ভালোবাসেন না যে নিজের বন্ধুদের মাঝে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম মনে করে এবং নিজেকে অপরের চেয়ে বিশেষ ব্যক্তিত্ব জ্ঞান করে6 এ কথা বলে তিনি বনের দিকে চলে গেলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে জ্বালানী কাঠ ও খড়-কুটো নিয়ে ফিরে এলেন।7

7

হজ্বযাত্রী এক কাফেলা

মুসলমানদের একটি কাফেলা মক্কা যাচ্ছিল। মদীনা পৌঁছেই কাফেলার লোকেরা কয়েক দিনের জন্য যাত্রা বিরতি করলো। কয়েক দিন বিশ্রাম গ্রহণের পর তারা আবার মদীনা থেকে মক্কার দিকে রওয়ানা হলো।

মক্কা ও মদীনার মাঝে এক স্থানে এসে কাফেলা আবার বিশ্রাম গ্রহণের জন্য যাত্রা বিরতি করলো। এ সময় কাফেলার লোকদের সাথে এমন এক ব্যক্তির সাক্ষাত ঘটলো যিনি কাফেলার সকল লোককে চিনতেন ও জানতেন। লোকটি যখন কাফেলার লোকদের সাথে আলাপ-আলোচনায় লিপ্ত তখন তাঁর দৃষ্টি গিয়ে পড়লো এমন এক ব্যক্তির উপর যিনি অত্যন্তহাসি মুখে কাফেলার লোকদের খেদমতে ব্যস্তছিলেন। লোকটি প্রথম দৃষ্টিতেই সে ব্যক্তিকে চিনতে পারলেন , যিনি খুব আনন্দমনে লোকদের খেদমত করে চলছিলেন। তাই অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে কাফেলার লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন , তোমরা কি এ ব্যক্তিকে চেনো যিনি তোমাদের খেদমতে লেগে আছেন ? জবাবে তারা বললো , না ,আমরা এ লোকটিকে মোটেই চিনি না। এ লোকটি তো মদীনা থেকে আমাদের কাফেলার সাথে শামিল হয়েছে। তবে এ কয়েক দিনের সফরের সাথী হিসেবে এতোখানি বলতে পারি যে , এ লোকটি একজন সৎ লোক এবং অত্যন্ত মোত্তাকী-পরহেযগার। আমরা তাকে বলিনি ,আমাদের কাজ করে দাও। কিন্তু সে নিজেই অপরের খেদমতে লেগে আছে এবং সকলেরই সাহায্য-সহযোগিতা করে চলছে

কাফেলার লোকদের বন্ধুটি বললেন , আমি জানি তোমরা তাকে মোটেও চেনো না। যদি তোমরা তাকে চিনতেই পারতে তাহলে কখনও এমন অপরাধজনক কাজ করতে পারতে না যে , একজন সাধারণ খাদেমের ন্যায় তোমাদের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যেতে থাকবেন তিনি । এ কথা শুনে সকলে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো , তিনি কে ?

লোকটি বললেন , তিনি হলেন আলী ইবনুল হোসাইন (আঃ) অর্থাৎ ইমাম যয়নুল আবেদীন (আঃ)

এ কথা শুনেই কাফেলার সমস্তলোক হতবাক হয়ে গেল এবং ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য অত্যন্ত আদবের সাথে ইমামের হাতে চুমু খাওয়ার আশায় তাঁর দিকে এগিয়ে গেল। সমস্তলোক ইমামের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে অনুযোগের সুরে বলতে লাগলো , হে ইমাম! আপনি আমাদের সাথে এমনটি কেন করলেন ? সম্ভাবনা ছিল যে , আমরা অজ্ঞতাবশত আপনার সাথে মারাত্মক কোন অপরাধ করে বসতাম তাতে আমরা বড় গুণাহগার-পাপী হতাম

ইমাম বললেন , যেহেতু তোমরা কেউ আমাকে চিনতে না ,এ জন্যই আমি তোমাদের সফর সঙ্গী হয়েছি । কেননা আমি যখন চেনা-জানা লোকদের সাথে সফর করি তখন লোকেরা রাসূলে খোদা (সাঃ)-এর খাতিরে আমাকে অত্যন্ত ভালোবেসে আমার সাথে সদয় আচরণ করে। আর তারা আমাকে ছোটখাটো কোন কাজও করতে দেয় না। এ জন্যই আমি সফরের জন্য এমন একটি কাফেলা বেছে নিয়েছি যাদের কেউ আমাকে চেনে না যাতে করে আমি নিজের কাজ নিজেই আঞ্জাম দিতে পারি। আর আমি লোকদের কাছে আমার পরিচয় এজন্য গোপন রেখেছি যাতে করে আমি আমার সাথীদের খেদমত করার সুযোগ লাভ করতে পারি8

8

এক মুসলমান ও এক আহলে কিতাব

সে সময় কুফা নগরী ছিল ইসলামী শাসনেরা প্রাণকেন্দ্র। সিরিয়া ছাড়াও ইসলামী সাম্রাজ্যের অন্য সকল স্থানের সকল লোকের নজর তখন সে নগরীর দিকেই নিবন্ধ থাকতো এ জন্য যে , সেখান থেকে কখন কোন নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ হুকুম জারী করা হয়।

এ শহর থেকে অনেক দূরে দুই ব্যক্তির সাথে রাস্তায় দেখা হলো। একজন মুসলমান আর অপরজন আহলে কিতাব (আহলে কিতাব মানে ইয়াহুদী বা খ্রিস্টান কিংবা যারথুস্ত্রীয়)। দুই জনেই একে অপরের গন্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো। জানা গেল যে ,মুসলমান লোকটি কুফা শহরে যাবে। আর আহলে কিতাব লোকটি কুফার নিকটেই অন্য এক স্থানে যাবে। দুইজনে মিলে স্থির করলে যে , তারা এক সাথে সফর করবে। কেননা ,অনেক দূর পর্যন্ত দুইজনের রাস্তা একই। এক সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে পথ চলা যাবে।

দুজনের আন্তরিক আলাপ-আলোচনা ও বিভিন্ন কথাবার্তার মধ্য দিয়ে পথ শেষ হয়ে এলো। অবশেষে তারা একটি দুই রাস্তার মোড়ে এসে উপস্থিত হলো যেখান থেকে দু জনের রাস্তা দু দিকে চলে গেছে। আহলে কিতাব লোকটি তার নিজের পথ ধরে চলতে লাগলো। কিছু দূর পথ চলার পর পিছনে ফিরে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেলো। সে দেখতে পেলো তার মুসলমান বন্ধুটি কুফার দিকে না গিয়ে তারই পিছে পিছে চলে আসছে। এ অবস্থা দেখে সে দাড়িয়ে গেল এবং তার মুসলমান বন্ধুটিকে জিজ্ঞাসা করলো : কি ভাই! তুমি না বলেছিলে যে , তুমি কুফা যাবে ?

জবাবে মুসলমান বন্ধুটি বললো , আমি তো এখনো বলছি যে ,আমি কুফা যাবো

আহলে কিতাব লোকটি বললো , তাহলে তুমি এদিকে আসছো কেন ? এটা তো কুফার রাস্তা নয়। কুফা যাবার রাস্তা তো ঐটা।

মুসলমান বন্ধুটি বললো , আমি জানি। কিন্তু আমার মন চাইলো যে , কিছু দূর পর্যন্তআমি তোমার সঙ্গ দেবো। কেননা আমাদের নবী বলেছেন যখন দু ব্যক্তি এক সাথে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে পথ চলে তখন একে অপরের প্রতি অধিকার লাভ করে। এখন তোমারও আমার ওপর। সতরাং আমি অধিকার রয়েছে। আমি সে অধিকার আদায় করার উদ্দেশ্য কিছু দূর পর্যন্ততোমার সাথে চলতে চাই। এরপর তো আমি আমার পথেই ফিরে যাবো

আহলে কিতাব বললো , ওহ্! তোমাদের নবী যে মানুষের উপর এতোই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন এতো দ্রুত বিশ্বে প্রসার লাভ করেছি ,এটা নিশ্চয় তাঁর এই উত্তম চরিত্রেরই গুণে ছিল।

আহলে কিতাব লোকটি আরো বেশী অবাক হলো তখন যখন সে জানতে পারলো যে , তার সফর সঙ্গী মুসলমান বন্ধুটি আর কেউ নন ,বরং মুসলিম মিলাতের বর্তমান খলিফা হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (আঃ)। তৎক্ষণাত সে আহলে কিতাব লোকটি ইসলাম গ্রহণ করে মসলমান হয়ে গেল এবং হযরত আলীর একজন বিশ্বস্তও অনুগত সাহাবীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো।9

9

খলিফার সান্নিধ্যে

হযরত আলী (আঃ) কুফার দিকে আসছিলেন। পথে আম্বার নামক এক শহরে উপস্থিত হলেন। যেখানকার বেশীর ভাগ অধিবাসী ছিল ইরানী। ইরানী কৃষক ও মাতব্বররা যখন জানতে পারলো যে , তাদের প্রিয় খলিফা তাদেরই শহর দিয়ে অতিক্রম করবেন তখন তাদের আর আনন্দের সীমা রইলো না। সকলে তাদের খলিফাকে স্বাগতম ও খোশ আমদেদ জানাবার জন্য দৌঁড়ে এলো। হযরত আলী (আঃ)-এর বাহন যখন এগিয়ে চললো তখন লোকেরাও বাহনের আগে আগে দৌঁড়াতে লাগলো। হযরত আলী (আঃ) নিজের বাহন থামিয়ে দিয়ে লোকদেরকে ডেকে পাঠালেন। লোকেরা যখন তার কাছে এলো তখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন , তোমরা এভাবে দৌঁড়াদৌড়ি করছো কেন ? এভাবে দৌঁড়াদৌঁড়ির পেছনে তোমাদের উদ্দেশ্য কি ?

লোকেরা বললো , আসলে এটা শাসকবর্গ ও সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটা রীতি। বহুকাল আগ থেকে প্রচলিত আমাদের একটি প্রথা

হযরত আলী (আঃ) তাদেরকে বললেন , তোমাদের এ কাজ দুনিয়াতে তোমাদেরকে কষ্ট দিচ্ছে আর পরকালেও এর কারণে অনেক শাস্তিভোগ করতে হবে। এমন কাজ কখনো করবে না ,যা তোমাদের অপমান ও লাঞ্ছনা ডেকে আনে। আর তোমরাই দেখো যে ,তোমাদের এ কাজের দ্বারা তোমাদের 1 নেতা ও অমীরেরই বা কি লাভ হয় ?10

10

ইমাম বাক্বের ( আঃ ) ও এক খ্রিস্টান

ইমাম বাক্বের (আঃ)। নাম মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনিল হোসাইন (আঃ) । যার উপাধি ছিল বাক্বের । বাক্বের শব্দের আভিধানিক অর্থ ভাগ-বিশেষণকারী। তাকে বলা হতো বাক্বেরুল উলুম যার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাগ-বিশেষণ ও ব্যাখ্যাকারী।

এক খ্রিস্টান বাক্বের শব্দের বিকৃত উচ্চারণ করে ইমামের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে চাইলো। সে ইমামকে উদ্দেশ্যে করে বললো , [আনতা বাক্বার] অর্থাৎ তুমি গাভী

ইমাম কোন প্রকার অসন্তুষ্টি বা রাগান্বিত না হয়ে অত্যন্তসরল ও সহজ ভাষায় বললেন , না ভাই! আমি বাক্বার (গাভী) নই। আমি বাক্বের (বিশেষণকারী)

অতঃপর খ্রিস্টান লোকটি বললো , তুমি একটা রাঁধুনির ছেলে। ইমাম বললেন ,এটা তার পেশা ছিল । এতে কোনো লজ্জা বা ঘৃণার কিছু নেই।

খ্রিস্টান লোকটি আরো বললো , তোমার মা ছিল কালো কুৎসিত। তার লজ্জা-শরম কিছুই ছিল না। আর তার ভাষাও ছিল বিশ্রী

এবারও ইমাম অত্যন্তসহজ-সরল ভাষায় বললেন , আমার মাতা সম্পর্কে তুমি যে সব অপবাদ দিচ্ছো তা যদি সত্য হয় তাহলে মহান আল্লাহ যেন তার গুণাহ খাতা মাফ করে দেন। আর যদি মিথ্যা হয় তাহলে যেনো তোমার অপরাধ ক্ষমা করে দেন। কেননা কারো সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দেয়া বড়ই গুণাহের কাজ

একজন মানুষ যার জন্যে ইসলামের বহির্ভূত একজন লোককে শাস্তি দেয়ার সব ধরনের সামর্থ্য তার ছিল ,অথচ এতটা ধৈর্য্য ধরলেন। এটুকুই ঐ খ্রিস্টান লোকটির মনের ভেতরে বিপ্লব সংঘটনের জন্য এবং তাকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ছিল।

পরবর্তীতে খ্রিস্টান লোকটি মসলমানু হয়।

11

এক আরব বেদুঈন ও রাসূলে আকরাম ( সাঃ )

এক আরব বেঈদুন মদীনা শহরে এসে সোজা মসজিদে নববীতে চলে গেল। তার উদ্দেশ্য ছিল মহানবী (সাঃ)-এর কাছ থেকে সোনা-দানা টাকা-পয়সা নিবে। সে সময় প্রিয় নবী (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন। বেদুঈন লোকটি রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর সামনে এসে তার আরজ পেশ করলো এবং তাকে কিছু দান করার জন্য আবেদন জানালো। আল্লাহর নবী (সাঃ) তাকে কিছু দান করলেন। কিন্তু তাতে সে সন্তুষ্ট হলো না। সে রাসূলের (সাঃ) দানকে সামান্য গণ্য করলো। তাছাড়া সে কিছু বিশ্রী শব্দ ব্যবহার করে রাসল (সাঃ) এর প্রতি বেয়াদবি করলো। এ অবস্থা দেখে রাসূল (সাঃ) এর সাহাবীরা প্রচণ্ড রেগে গেলেন এবং ঐ লোকটিকে কঠিন শাস্তিদেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। কিন্তু মহানবী (সাঃ) তাদেরকে থামিয়ে দিলেন।

এরপর রাসূলে খোদা (সাঃ) লোকটিকে সাথে নিয়ে তাঁর বাড়িতে গেলেন এবং তাকে আরো কিছু সাহায্য দান করলেন। এ সময় বেদুঈন লোকটি নিজের চোখে দেখতে পেলো যে ,রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর জীবন ও অন্যান্য নেতা ও শাসকদের জীবনের অবস্থার মধ্যে কোন মিল নেই। আর সে রাসূলের কাছে যে সোনা দানা আশা করেছিলো আসলেই তা তারঁ কাছে নেই।

বেদুঈন আরব সন্তুষ্টি প্রকাশ করলো এবং মুখে কতৃজ্ঞতার ভাষা উচ্চারণ করলো। তখন মহানবী (সাঃ) আরব বেদঈনকে বললেন , গতকাল তুমি আমার সম্পর্কে বিশ্রী কথাবার্তা বলেছ যা আমার সাহাবীদেরকে উত্তেজিত করে দেয়। তারা তোমার উপর খুবই অসন্তুষ্ট। এখন আমার ভয় হচ্ছে যে ,তারা তোমার কোন ক্ষতি করে বসতে পারে। এখন তুমি আমার সামনে কৃতজ্ঞতার কথা বলেছ। অতএব এটা কি সম্ভব যে ,তুমি তোমার এ কথাটি তাদের সামনেও প্রকাশ করবে যাতে তাদের রাগ দূর হয়ে যায় ? জবাবে সে বললো , এতে আমার কোন আপত্তি নেই

পরদিন বেদুঈন লোকটি মসজিদে নববীতে গেল। যখন সবাই সেখানে সমবেত ছিলেন। রাসূল (সাঃ) তাদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন , লোকসকল! এ লোকটি বলছে যে আমার প্রতি সে সন্তুষ্ট হয়ে গেছে। কি ? এ কথা কি সঠিক ?

বেদুঈন লোকটি বললো , জ্বি ,এটাই সঠিক। অতঃপর সে ঐ কথাটাই বিড়বিড় করে বললো যা ইতোপূর্বে বলেছিল। রসূলে খোদা (সাঃ) এর সাহাবীরা তখন হেসে ফেললেন।

এ সময় আল্লাহর নবী (সাঃ) সকলের উদ্দেশ্যে বললেন , এ লোকটি আর আমার ঘটনাটির উদাহরণ হলো সে ব্যক্তির মতো ,যার উট স্বীয় মালিকের প্রতি আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। আর লোকেরা উটের মালিককে সাহায্য করার উদ্দেশ্য নিয়ে শোরগোল শুরুকরে দিল এবং সে পলায়নকারী উটটির পিছে পিছে দৌঁড়াতে লাগলো। উটটি আরো আতঙ্কিত হয়ে দ্রুত পালাতে লাগলো। এ অবস্থা দেখে উটের মালিক সকল লোককে উদ্দেশ্য করে চিৎকার দিয়ে বললো , ভাইসব! অনুরোধ করছি আমার উটের পিছনে কাউকে দৌঁড়াতে হবে না। আমার উটকে কিভাবে শান্তকরতে হয় সেটা আমি ভালো জানি।

তার এ আহ্বান শুনে উটের পিছে দৌঁড়ানো লোকজন থেমে গেল। তারপর উটের মালিক এক মুষ্টি ঘাস নিজের হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে উটের কাছে পৌঁছে গেল। আর খুব সহজে উটের বলা (লাগাম বিশেষ) নিজের হাতে নিয়ে নিল। উটটি তখন মালিকের সাথে ফিরে এলো।

গতকাল যদি আমি তোমাদেরকে বারণ না করতাম তাহলে এ আরব বেদুঈনকে তার জীবন হারাতে হতো। তোমরা তাকে জীবিত ছেড়ে দিতে না। তাতে লোকটি কুফরী ও মূর্তি পূজারীর অবস্থায় মারা যেতো। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমি তোমাদেরকে কোন পদক্ষেপ নিতে দেইনি। আর এখন তোমরা নিজেরাই দেখতে পেলে যে ,আমি আমার ভালোবাসা ও নম্র ব্যহার দ্বারা লোকটিকে একেবারেই মুগ্ধ করে ফেলেছি11

12

সিরিয়াবাসী এক ব্যক্তি ও ইমাম হোসাইন ( আঃ )

সিরিয়াবাসী এক ব্যক্তি হজ্ব অথবা অন্য কোন উদ্দেশ্য মদীনায় আসলো। মসজিদে নববীতে একদিন হঠাৎ তার নজর গিয়ে পড়লো এমন এক ব্যক্তির উপর যিনি মসজিদের এক কোণে বসেছিলেন। সে ভাবতে লাগলো যে ,এ লোকটি কে ? নিকটেই দাঁড়ানো অপর এক লোককে জিজ্ঞাসা করলো , এ লোকটি কে ভাই ? সে বললো , তিনি হোসাইন ইবনে আলী ইবনে আবী তালিব (আঃ) । পূর্ব থেকেই ভিত্তিহীন মিথ্যা প্রচার-প্রপাগাণ্ডা12 তার মন-মগজকে (ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে) বিগড়ে রেখেছিল।

সুতরাং এ নামটি শোনার সাথে সাথেই ক্রোধ ও ক্ষোভে তার চেহারা লাল হয়ে গেল। আর সে খোদার সন্তুষ্টি লাভের নিয়তে ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে গালি-গালাজের বৃষ্টি বর্ষণ করতে লাগলো। অশ্রাব্য ,বিশ্রী ও কুৎসিত শব্দ ব্যবহার করে সে ইমামকে গালি দিয়ে তার অন্তরের জ্বালা মিটালো এবং তার মনের ক্ষোভ-দুঃখ প্রকাশ করলো। ইমাম হোসাইন (আঃ) তার গালাগালিতে মোটেও রাগ করলেন না , বরং অত্যন্ত ভালোবেসে ও সদ্ব্যবহারের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আল-কোরআনের সে আয়াতগুলো তেলাওয়াত করলেন ,যে আয়াতগুলোতে ভালো ব্যবহার , ক্ষমা প্রদর্শন ও মার্জনা করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। কোরআনের আয়াতগুলো পাঠ করার পর ইমাম হোসাইন (আঃ) সিরিয়ার অধিবাসী সে লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন , আমি তোমার যে কোন খেদমত ও সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত আছি । তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন , তুমি কি সিরিয়ার অধিবাসী ? জবাবে সে বললো , হ্যা! আমি একজন সিরিয়ার অধিবাসী । তখন ইমাম তাকে বললেন , সিরিয়াবাসীদের এরূপ ব্যবহারের অভিজ্ঞতা আমার আছে। আর আমি খব ভালোভাবে জানি ,এ দুর্ব্যবহার ও শত্রুতার কারণ কি ?

অতঃপর ইমাম লোকটিকে বললেন , তুমি এ শহরে একজন মুসাফির । বিদেশের বাড়িতে যদি তোমার কোন কিছুর প্রয়োজন হয় তাহলে তুমি আমাকে বলো। আমি তোমার যে কোন খেদমত করার জন্য প্রস্তুত আছি। আমি তোমাকে আমার মেহমান করতে চাই এবং তোমাকে পোশাক-পরিচ্ছদ ও টাকা-পয়সা ইত্যাদিও দিতে চাই । সিরিয়াবাসী লোকটি তার দুর্ব্যবহার ও গালিগালাজের জন্য একটা কঠোর পরিণতির অপেক্ষা করছিল। সে এমনটি কখনোই আশা করছিল না যে , তার এ অপরাধ ও ধৃষ্টতা একেবারেই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হবে। ইমামের এ সুন্দর ব্যবহার তার মধ্যে এক আত্মিক বিপ্লব এনে দিয়েছে। সে নিজে নিজে বলতে লাগলো , আমার মন চায় যে , মাটি ফেটে দ্বিখন্ডিত হয়ে যাক আর আমি তাতে ঢুকে পড়ি। হায় আফসোস! নিজের অজ্ঞতার কারণে আমি যদি এ অপরাধ না করতাম! এর আগ পর্যন্ত ইমাম হোসাইন (আঃ) ও তাঁর পিতার চেয়ে বড় দুশমন আর কেউ ছিল না। আর এখন আমার দৃষ্টিতে ইমাম হোসাইন (আঃ) ও তাঁর পিতার চাইতে অধিক প্রিয় আর কেউ নেই13

13

উপদেশ প্রার্থী এক ব্যক্তি

এক আরব বেদুঈন মদীনা শহরে এসে রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর খেদমতে হাজির হয়ে আবেদন করলো , হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমাকে কিছু উপদেশ দান করুন । মহানবী (সাঃ) তাকে বললেন , ক্রোধান্বিত হয়ো না । এর বেশি তাকে আর কিছুই বললেন না।

অতঃপর লোকটি তার গোত্রের মাঝে ফিরে গেল। বাড়ি ফিরেই সে জানতে পারলো যে , তার অনুপস্থিতিতে এক মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে। তারই গোত্রের যুবকরা অপর এক গোত্রের কিছু মালামাল জোরপূর্বক লুটপাট করে নিয়ে এসেছে। এর জবাবে সে গোত্রের লোকেরাও এদের অনেক মালামাল লুটপাট করে নিয়ে গেছে। এভাবে লুটপাটের এ ধারা উভয় গোত্রের মাঝে এমন এক পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়েছে যে ,এখন দুই গোত্রের লোকেরাই এক মারাত্মক যুদ্ধ-বিগ্রহ ও খুনাখুনির পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। এ খবর শোনা মাত্রই সে লোকটি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল। তৎক্ষণাত সে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলো এবং রণাঙ্গনের দিকে ছুটলো নিজের গোত্রের সঙ্গ দেবার জন্য।

ঠিক এমন সময় তার মনে পড়লো যে , সে মদীনায় গিয়েছিল এবং রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর কাছে উপদেশ প্রার্থনা করেছিল , তখন মহানবী (সাঃ) বলেছিলেন , নিজের ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণে রাখো

অতঃপর সে মনে মনে ভাবতে লাগলো , কেন আমি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলাম কোন কারণে আমি এভাবে যুদ্ধ করতে এবং খুনাখুনি করতে তৈরি হয়ে গেলাম ? কেনই বা আমি এরূপ ক্রোধান্বিত হয়ে গেলাম ? এসব প্রশ্ন তার মনে জেগে ওঠার পর সে ভাবলো : এখনই উপযুক্ত সময় , রসুলুলাহ (সাঃ) ছোট্ট উপদেশটি পালন করার।

এরপর সে এগিয়ে গেল এবং বিরোধী গোত্রের সরদারকে ডেকে বললো , এ সংঘাত কি জন্যে ? যদি এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য হয় সে সমস্ত মালামাল ফিরে পাওয়া যা আমাদের গোত্রের যুবকরা বোকামি করে তোমাদের থেকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে , তাহলে এসো আমি আমার নিজস্ব সম্পদ থেকে তোমাদের ক্ষতিপূর ণ করে দেই। এটা একটা ভালো কথা নয় যে , এর কারণে আমরা একে অপরের রক্তপিপাসু হয়ে যাবো

প্রতিপক্ষ গোত্রের লোকেরা যখন এ ব্যক্তির যুক্তিপূর্ণ ও উদারতাপূর্ণ কথাগুলো শুনলো তখন তাদের মধ্যেও বীরত্ববোধ জেগে উঠলো। বললো , আমরাও তোমাদের চেয়ে কোন অংশে কম নই। যদি এমনটিই হয় তাহলে আমরা আমাদের দাবি প্রত্যাহার করলাম

তখন উভয় গোত্রের লোকেরা নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেল।14

4

উটের কোমর বাঁধা

কাফেলাটি বহুক্ষণ পথ চলেছিল। সকলের চেহারাতেই ক্লান্তির ছাপ। বহনকারী পশুগুলোও। ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এমন একটি স্থানে উপস্থিত হলো যেখানে কিছু পানি ছিল। কাফেলা থেমে গেল। রসুলুলাহ (সাঃ) ও এ কাফেলার সাথে ছিলেন। তিনিও উটের পিঠ থেকে নেমে এলেন। সকলেই চেষ্টা করছিল যে , তাড়াতাড়ি পানির কাছে গিয়ে অযু ইত্যাদি সেরে নামাযের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

মহানবী (সাঃ)ও নামার পর পানির দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু কয়েক ধাপ চলার পর কাউকে কিছু না বলে আবার নিজের উটের দিকে ফিরে এলেন। রাসূলের সাহাবী ও সাথীগণ আশ্চর্য হয়ে পরস্পরে বলাবলি করতে লাগলেন যে , মনে হয় যাত্রা বিরতির জন্য এ স্থানটি আল্লাহর নবীর পছন্দ হয়নি। এখনই হয়তো রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দেবেন। সকলেই রাসূলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন এবং নতুন হুকুমের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। লোকেরা আরো অধিক আশ্চর্য হলেন তখন , যখন তারা দেখলেন যে , মহানবী (সাঃ) নিজের উটের কোমরবন্ধনী (উটের কোমর বাঁধার রশি বিশেষ) হাতে নিলেন এবং নিজের উটের কোমর বাঁধতে শুরু করলেন। তাড়াতাড়ি বাঁধার কাজ শেষ করে তিনি আবার পানির দিকে গেলেন ।

চারদিক থেকে লোকেরা এসে বললেন , হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এ কাজের জন্য আমাদেরকে কেন হুকুম দিলেন না ? আপনি কেন এ কাজটি করতে গেলেন ? এ কাজটির জন্য আপনি আবার ফিরে গেলেন। আমরা তো অত্যন্তগর্বের সাথে এ কাজটি করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম

প্রিয় নবী (সাঃ) তাদের কথার জবাবে বললেন , নিজের কাজে কখনো অপরের সাহায্য নেয়া উচিত নয়। আর কারো ভরসা করাও ঠিক নয়। সেটা একটি মেসওয়াকের ব্যাপারই হোক না কেন অর্থাৎ কাজটি ছোট হোক অথবা বিরাট ,অপরের ভরসায় বসে থাকার চেয়ে নিজেই করা উচিত5

5

হজ্বের সফর সঙ্গী

হজ্ব থেকে ফিরে এসে এক ব্যক্তি তার নিজের ও তার সঙ্গীদের হজ্বের সফরের কাহিনী ইমাম জা ফর সাদিক (আঃ)-কে বর্ণনা করছিল। সে তার সাথীদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তির বিশেষ প্রশংসা করছিল। সে বলতে লাগলো যে , প্রকৃতপক্ষেই সে ব্যক্তিটি খুবই মোত্তাকী-পরহেযগার ও অত্যন্ত ইবাদতকারী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সব সময়ই মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে কাটিয়েছেন। আমরা যখনই কোথাও রাত্রি যাপন করার উদ্দেশ্যে যাত্রা বিরতি করতাম তখনই তিনি এক কিনারে চলে যেতেন এবং সাথে সাথেই জায়নামায বিছিয়ে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হয়ে যেতেন।

ইমাম সাদিক (আঃ) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন : তার কাজ-কর্মগুলো আঞ্জাম দিত কে ? কে তার জন্তুটির দেখাশোনা করতো ?

জবাবে লোকটি বললো : তার সমস্তকাজগুলো করে দেবার সৌভাগ্য আমাদেরই হয়েছিল। তিনি তো শুধু তাঁর নেক আমলের কাজগুলোতে ব্যস্ত থাকতেন। এসব কাজের প্রতি তার কোন মনোযোগ ছিল না।

ইমাম (আঃ) বললেন , এ কারণেই তোমরা সকলে উক্ত মোত্তাকী পরহেযগার ও ইবাদতকারীর চেয়ে অধিক উত্তম

6

বনভোজন

হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গী দল নিজ নিজ বাহনের পিঠ থেকে নিচে নামলেন। মাল সামানগুলোকে খুলে মাটিতে রাখলেন। তারপর সকলে মিলে ঠিক করলেন যে , একটি দুম্বা জবাই করে খাবার তৈরী করা হবে।

একজন সাহাবী বললেন , দুম্বা জবাই করা আমার দায়িত্বে রইলো

আরেকজন বললেন দুম্বার চামড়া ছাড়ানো এবং গোশত কাটার দায়িত্ব আমার।

তৃতীয় জন বললেন , গোশত রান্না করার দায়িত্ব আমার।

চতুর্থ জন বললেন ,

রসুলুলাহ (সাঃ) বললেন , কাঠ কুড়িয়ে আনার দায়িত্ব আমার।

সকল সাহাবী এক সাথে বলে উঠলেন , হে আল্লাহর রাসূল! আমরা উপস্থিত থাকতে আপনি কষ্ট করবেন কেন ? আপনি বিশ্রাম নিন। আমরা গর্বের সাথে সমস্ত কাজ ঠিকঠাক সেটে নিব।। রাসূল (সাঃ) বললেন , আমি জানি এ কাজ তোমরা করে নিতে পারবে। কিন্তু মহান আল্লাহ সে বান্দাকে কখনো ভালোবাসেন না যে নিজের বন্ধুদের মাঝে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম মনে করে এবং নিজেকে অপরের চেয়ে বিশেষ ব্যক্তিত্ব জ্ঞান করে6 এ কথা বলে তিনি বনের দিকে চলে গেলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে জ্বালানী কাঠ ও খড়-কুটো নিয়ে ফিরে এলেন।7

7

হজ্বযাত্রী এক কাফেলা

মুসলমানদের একটি কাফেলা মক্কা যাচ্ছিল। মদীনা পৌঁছেই কাফেলার লোকেরা কয়েক দিনের জন্য যাত্রা বিরতি করলো। কয়েক দিন বিশ্রাম গ্রহণের পর তারা আবার মদীনা থেকে মক্কার দিকে রওয়ানা হলো।

মক্কা ও মদীনার মাঝে এক স্থানে এসে কাফেলা আবার বিশ্রাম গ্রহণের জন্য যাত্রা বিরতি করলো। এ সময় কাফেলার লোকদের সাথে এমন এক ব্যক্তির সাক্ষাত ঘটলো যিনি কাফেলার সকল লোককে চিনতেন ও জানতেন। লোকটি যখন কাফেলার লোকদের সাথে আলাপ-আলোচনায় লিপ্ত তখন তাঁর দৃষ্টি গিয়ে পড়লো এমন এক ব্যক্তির উপর যিনি অত্যন্তহাসি মুখে কাফেলার লোকদের খেদমতে ব্যস্তছিলেন। লোকটি প্রথম দৃষ্টিতেই সে ব্যক্তিকে চিনতে পারলেন , যিনি খুব আনন্দমনে লোকদের খেদমত করে চলছিলেন। তাই অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে কাফেলার লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন , তোমরা কি এ ব্যক্তিকে চেনো যিনি তোমাদের খেদমতে লেগে আছেন ? জবাবে তারা বললো , না ,আমরা এ লোকটিকে মোটেই চিনি না। এ লোকটি তো মদীনা থেকে আমাদের কাফেলার সাথে শামিল হয়েছে। তবে এ কয়েক দিনের সফরের সাথী হিসেবে এতোখানি বলতে পারি যে , এ লোকটি একজন সৎ লোক এবং অত্যন্ত মোত্তাকী-পরহেযগার। আমরা তাকে বলিনি ,আমাদের কাজ করে দাও। কিন্তু সে নিজেই অপরের খেদমতে লেগে আছে এবং সকলেরই সাহায্য-সহযোগিতা করে চলছে

কাফেলার লোকদের বন্ধুটি বললেন , আমি জানি তোমরা তাকে মোটেও চেনো না। যদি তোমরা তাকে চিনতেই পারতে তাহলে কখনও এমন অপরাধজনক কাজ করতে পারতে না যে , একজন সাধারণ খাদেমের ন্যায় তোমাদের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যেতে থাকবেন তিনি । এ কথা শুনে সকলে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো , তিনি কে ?

লোকটি বললেন , তিনি হলেন আলী ইবনুল হোসাইন (আঃ) অর্থাৎ ইমাম যয়নুল আবেদীন (আঃ)

এ কথা শুনেই কাফেলার সমস্তলোক হতবাক হয়ে গেল এবং ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য অত্যন্ত আদবের সাথে ইমামের হাতে চুমু খাওয়ার আশায় তাঁর দিকে এগিয়ে গেল। সমস্তলোক ইমামের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে অনুযোগের সুরে বলতে লাগলো , হে ইমাম! আপনি আমাদের সাথে এমনটি কেন করলেন ? সম্ভাবনা ছিল যে , আমরা অজ্ঞতাবশত আপনার সাথে মারাত্মক কোন অপরাধ করে বসতাম তাতে আমরা বড় গুণাহগার-পাপী হতাম

ইমাম বললেন , যেহেতু তোমরা কেউ আমাকে চিনতে না ,এ জন্যই আমি তোমাদের সফর সঙ্গী হয়েছি । কেননা আমি যখন চেনা-জানা লোকদের সাথে সফর করি তখন লোকেরা রাসূলে খোদা (সাঃ)-এর খাতিরে আমাকে অত্যন্ত ভালোবেসে আমার সাথে সদয় আচরণ করে। আর তারা আমাকে ছোটখাটো কোন কাজও করতে দেয় না। এ জন্যই আমি সফরের জন্য এমন একটি কাফেলা বেছে নিয়েছি যাদের কেউ আমাকে চেনে না যাতে করে আমি নিজের কাজ নিজেই আঞ্জাম দিতে পারি। আর আমি লোকদের কাছে আমার পরিচয় এজন্য গোপন রেখেছি যাতে করে আমি আমার সাথীদের খেদমত করার সুযোগ লাভ করতে পারি8

8

এক মুসলমান ও এক আহলে কিতাব

সে সময় কুফা নগরী ছিল ইসলামী শাসনেরা প্রাণকেন্দ্র। সিরিয়া ছাড়াও ইসলামী সাম্রাজ্যের অন্য সকল স্থানের সকল লোকের নজর তখন সে নগরীর দিকেই নিবন্ধ থাকতো এ জন্য যে , সেখান থেকে কখন কোন নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ হুকুম জারী করা হয়।

এ শহর থেকে অনেক দূরে দুই ব্যক্তির সাথে রাস্তায় দেখা হলো। একজন মুসলমান আর অপরজন আহলে কিতাব (আহলে কিতাব মানে ইয়াহুদী বা খ্রিস্টান কিংবা যারথুস্ত্রীয়)। দুই জনেই একে অপরের গন্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো। জানা গেল যে ,মুসলমান লোকটি কুফা শহরে যাবে। আর আহলে কিতাব লোকটি কুফার নিকটেই অন্য এক স্থানে যাবে। দুইজনে মিলে স্থির করলে যে , তারা এক সাথে সফর করবে। কেননা ,অনেক দূর পর্যন্ত দুইজনের রাস্তা একই। এক সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে পথ চলা যাবে।

দুজনের আন্তরিক আলাপ-আলোচনা ও বিভিন্ন কথাবার্তার মধ্য দিয়ে পথ শেষ হয়ে এলো। অবশেষে তারা একটি দুই রাস্তার মোড়ে এসে উপস্থিত হলো যেখান থেকে দু জনের রাস্তা দু দিকে চলে গেছে। আহলে কিতাব লোকটি তার নিজের পথ ধরে চলতে লাগলো। কিছু দূর পথ চলার পর পিছনে ফিরে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেলো। সে দেখতে পেলো তার মুসলমান বন্ধুটি কুফার দিকে না গিয়ে তারই পিছে পিছে চলে আসছে। এ অবস্থা দেখে সে দাড়িয়ে গেল এবং তার মুসলমান বন্ধুটিকে জিজ্ঞাসা করলো : কি ভাই! তুমি না বলেছিলে যে , তুমি কুফা যাবে ?

জবাবে মুসলমান বন্ধুটি বললো , আমি তো এখনো বলছি যে ,আমি কুফা যাবো

আহলে কিতাব লোকটি বললো , তাহলে তুমি এদিকে আসছো কেন ? এটা তো কুফার রাস্তা নয়। কুফা যাবার রাস্তা তো ঐটা।

মুসলমান বন্ধুটি বললো , আমি জানি। কিন্তু আমার মন চাইলো যে , কিছু দূর পর্যন্তআমি তোমার সঙ্গ দেবো। কেননা আমাদের নবী বলেছেন যখন দু ব্যক্তি এক সাথে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে পথ চলে তখন একে অপরের প্রতি অধিকার লাভ করে। এখন তোমারও আমার ওপর। সতরাং আমি অধিকার রয়েছে। আমি সে অধিকার আদায় করার উদ্দেশ্য কিছু দূর পর্যন্ততোমার সাথে চলতে চাই। এরপর তো আমি আমার পথেই ফিরে যাবো

আহলে কিতাব বললো , ওহ্! তোমাদের নবী যে মানুষের উপর এতোই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন এতো দ্রুত বিশ্বে প্রসার লাভ করেছি ,এটা নিশ্চয় তাঁর এই উত্তম চরিত্রেরই গুণে ছিল।

আহলে কিতাব লোকটি আরো বেশী অবাক হলো তখন যখন সে জানতে পারলো যে , তার সফর সঙ্গী মুসলমান বন্ধুটি আর কেউ নন ,বরং মুসলিম মিলাতের বর্তমান খলিফা হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (আঃ)। তৎক্ষণাত সে আহলে কিতাব লোকটি ইসলাম গ্রহণ করে মসলমান হয়ে গেল এবং হযরত আলীর একজন বিশ্বস্তও অনুগত সাহাবীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো।9

9

খলিফার সান্নিধ্যে

হযরত আলী (আঃ) কুফার দিকে আসছিলেন। পথে আম্বার নামক এক শহরে উপস্থিত হলেন। যেখানকার বেশীর ভাগ অধিবাসী ছিল ইরানী। ইরানী কৃষক ও মাতব্বররা যখন জানতে পারলো যে , তাদের প্রিয় খলিফা তাদেরই শহর দিয়ে অতিক্রম করবেন তখন তাদের আর আনন্দের সীমা রইলো না। সকলে তাদের খলিফাকে স্বাগতম ও খোশ আমদেদ জানাবার জন্য দৌঁড়ে এলো। হযরত আলী (আঃ)-এর বাহন যখন এগিয়ে চললো তখন লোকেরাও বাহনের আগে আগে দৌঁড়াতে লাগলো। হযরত আলী (আঃ) নিজের বাহন থামিয়ে দিয়ে লোকদেরকে ডেকে পাঠালেন। লোকেরা যখন তার কাছে এলো তখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন , তোমরা এভাবে দৌঁড়াদৌড়ি করছো কেন ? এভাবে দৌঁড়াদৌঁড়ির পেছনে তোমাদের উদ্দেশ্য কি ?

লোকেরা বললো , আসলে এটা শাসকবর্গ ও সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটা রীতি। বহুকাল আগ থেকে প্রচলিত আমাদের একটি প্রথা

হযরত আলী (আঃ) তাদেরকে বললেন , তোমাদের এ কাজ দুনিয়াতে তোমাদেরকে কষ্ট দিচ্ছে আর পরকালেও এর কারণে অনেক শাস্তিভোগ করতে হবে। এমন কাজ কখনো করবে না ,যা তোমাদের অপমান ও লাঞ্ছনা ডেকে আনে। আর তোমরাই দেখো যে ,তোমাদের এ কাজের দ্বারা তোমাদের 1 নেতা ও অমীরেরই বা কি লাভ হয় ?10

10

ইমাম বাক্বের ( আঃ ) ও এক খ্রিস্টান

ইমাম বাক্বের (আঃ)। নাম মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনিল হোসাইন (আঃ) । যার উপাধি ছিল বাক্বের । বাক্বের শব্দের আভিধানিক অর্থ ভাগ-বিশেষণকারী। তাকে বলা হতো বাক্বেরুল উলুম যার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাগ-বিশেষণ ও ব্যাখ্যাকারী।

এক খ্রিস্টান বাক্বের শব্দের বিকৃত উচ্চারণ করে ইমামের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে চাইলো। সে ইমামকে উদ্দেশ্যে করে বললো , [আনতা বাক্বার] অর্থাৎ তুমি গাভী

ইমাম কোন প্রকার অসন্তুষ্টি বা রাগান্বিত না হয়ে অত্যন্তসরল ও সহজ ভাষায় বললেন , না ভাই! আমি বাক্বার (গাভী) নই। আমি বাক্বের (বিশেষণকারী)

অতঃপর খ্রিস্টান লোকটি বললো , তুমি একটা রাঁধুনির ছেলে। ইমাম বললেন ,এটা তার পেশা ছিল । এতে কোনো লজ্জা বা ঘৃণার কিছু নেই।

খ্রিস্টান লোকটি আরো বললো , তোমার মা ছিল কালো কুৎসিত। তার লজ্জা-শরম কিছুই ছিল না। আর তার ভাষাও ছিল বিশ্রী

এবারও ইমাম অত্যন্তসহজ-সরল ভাষায় বললেন , আমার মাতা সম্পর্কে তুমি যে সব অপবাদ দিচ্ছো তা যদি সত্য হয় তাহলে মহান আল্লাহ যেন তার গুণাহ খাতা মাফ করে দেন। আর যদি মিথ্যা হয় তাহলে যেনো তোমার অপরাধ ক্ষমা করে দেন। কেননা কারো সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দেয়া বড়ই গুণাহের কাজ

একজন মানুষ যার জন্যে ইসলামের বহির্ভূত একজন লোককে শাস্তি দেয়ার সব ধরনের সামর্থ্য তার ছিল ,অথচ এতটা ধৈর্য্য ধরলেন। এটুকুই ঐ খ্রিস্টান লোকটির মনের ভেতরে বিপ্লব সংঘটনের জন্য এবং তাকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ছিল।

পরবর্তীতে খ্রিস্টান লোকটি মসলমানু হয়।

11

এক আরব বেদুঈন ও রাসূলে আকরাম ( সাঃ )

এক আরব বেঈদুন মদীনা শহরে এসে সোজা মসজিদে নববীতে চলে গেল। তার উদ্দেশ্য ছিল মহানবী (সাঃ)-এর কাছ থেকে সোনা-দানা টাকা-পয়সা নিবে। সে সময় প্রিয় নবী (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন। বেদুঈন লোকটি রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর সামনে এসে তার আরজ পেশ করলো এবং তাকে কিছু দান করার জন্য আবেদন জানালো। আল্লাহর নবী (সাঃ) তাকে কিছু দান করলেন। কিন্তু তাতে সে সন্তুষ্ট হলো না। সে রাসূলের (সাঃ) দানকে সামান্য গণ্য করলো। তাছাড়া সে কিছু বিশ্রী শব্দ ব্যবহার করে রাসল (সাঃ) এর প্রতি বেয়াদবি করলো। এ অবস্থা দেখে রাসূল (সাঃ) এর সাহাবীরা প্রচণ্ড রেগে গেলেন এবং ঐ লোকটিকে কঠিন শাস্তিদেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। কিন্তু মহানবী (সাঃ) তাদেরকে থামিয়ে দিলেন।

এরপর রাসূলে খোদা (সাঃ) লোকটিকে সাথে নিয়ে তাঁর বাড়িতে গেলেন এবং তাকে আরো কিছু সাহায্য দান করলেন। এ সময় বেদুঈন লোকটি নিজের চোখে দেখতে পেলো যে ,রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর জীবন ও অন্যান্য নেতা ও শাসকদের জীবনের অবস্থার মধ্যে কোন মিল নেই। আর সে রাসূলের কাছে যে সোনা দানা আশা করেছিলো আসলেই তা তারঁ কাছে নেই।

বেদুঈন আরব সন্তুষ্টি প্রকাশ করলো এবং মুখে কতৃজ্ঞতার ভাষা উচ্চারণ করলো। তখন মহানবী (সাঃ) আরব বেদঈনকে বললেন , গতকাল তুমি আমার সম্পর্কে বিশ্রী কথাবার্তা বলেছ যা আমার সাহাবীদেরকে উত্তেজিত করে দেয়। তারা তোমার উপর খুবই অসন্তুষ্ট। এখন আমার ভয় হচ্ছে যে ,তারা তোমার কোন ক্ষতি করে বসতে পারে। এখন তুমি আমার সামনে কৃতজ্ঞতার কথা বলেছ। অতএব এটা কি সম্ভব যে ,তুমি তোমার এ কথাটি তাদের সামনেও প্রকাশ করবে যাতে তাদের রাগ দূর হয়ে যায় ? জবাবে সে বললো , এতে আমার কোন আপত্তি নেই

পরদিন বেদুঈন লোকটি মসজিদে নববীতে গেল। যখন সবাই সেখানে সমবেত ছিলেন। রাসূল (সাঃ) তাদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন , লোকসকল! এ লোকটি বলছে যে আমার প্রতি সে সন্তুষ্ট হয়ে গেছে। কি ? এ কথা কি সঠিক ?

বেদুঈন লোকটি বললো , জ্বি ,এটাই সঠিক। অতঃপর সে ঐ কথাটাই বিড়বিড় করে বললো যা ইতোপূর্বে বলেছিল। রসূলে খোদা (সাঃ) এর সাহাবীরা তখন হেসে ফেললেন।

এ সময় আল্লাহর নবী (সাঃ) সকলের উদ্দেশ্যে বললেন , এ লোকটি আর আমার ঘটনাটির উদাহরণ হলো সে ব্যক্তির মতো ,যার উট স্বীয় মালিকের প্রতি আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। আর লোকেরা উটের মালিককে সাহায্য করার উদ্দেশ্য নিয়ে শোরগোল শুরুকরে দিল এবং সে পলায়নকারী উটটির পিছে পিছে দৌঁড়াতে লাগলো। উটটি আরো আতঙ্কিত হয়ে দ্রুত পালাতে লাগলো। এ অবস্থা দেখে উটের মালিক সকল লোককে উদ্দেশ্য করে চিৎকার দিয়ে বললো , ভাইসব! অনুরোধ করছি আমার উটের পিছনে কাউকে দৌঁড়াতে হবে না। আমার উটকে কিভাবে শান্তকরতে হয় সেটা আমি ভালো জানি।

তার এ আহ্বান শুনে উটের পিছে দৌঁড়ানো লোকজন থেমে গেল। তারপর উটের মালিক এক মুষ্টি ঘাস নিজের হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে উটের কাছে পৌঁছে গেল। আর খুব সহজে উটের বলা (লাগাম বিশেষ) নিজের হাতে নিয়ে নিল। উটটি তখন মালিকের সাথে ফিরে এলো।

গতকাল যদি আমি তোমাদেরকে বারণ না করতাম তাহলে এ আরব বেদুঈনকে তার জীবন হারাতে হতো। তোমরা তাকে জীবিত ছেড়ে দিতে না। তাতে লোকটি কুফরী ও মূর্তি পূজারীর অবস্থায় মারা যেতো। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমি তোমাদেরকে কোন পদক্ষেপ নিতে দেইনি। আর এখন তোমরা নিজেরাই দেখতে পেলে যে ,আমি আমার ভালোবাসা ও নম্র ব্যহার দ্বারা লোকটিকে একেবারেই মুগ্ধ করে ফেলেছি11

12

সিরিয়াবাসী এক ব্যক্তি ও ইমাম হোসাইন ( আঃ )

সিরিয়াবাসী এক ব্যক্তি হজ্ব অথবা অন্য কোন উদ্দেশ্য মদীনায় আসলো। মসজিদে নববীতে একদিন হঠাৎ তার নজর গিয়ে পড়লো এমন এক ব্যক্তির উপর যিনি মসজিদের এক কোণে বসেছিলেন। সে ভাবতে লাগলো যে ,এ লোকটি কে ? নিকটেই দাঁড়ানো অপর এক লোককে জিজ্ঞাসা করলো , এ লোকটি কে ভাই ? সে বললো , তিনি হোসাইন ইবনে আলী ইবনে আবী তালিব (আঃ) । পূর্ব থেকেই ভিত্তিহীন মিথ্যা প্রচার-প্রপাগাণ্ডা12 তার মন-মগজকে (ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে) বিগড়ে রেখেছিল।

সুতরাং এ নামটি শোনার সাথে সাথেই ক্রোধ ও ক্ষোভে তার চেহারা লাল হয়ে গেল। আর সে খোদার সন্তুষ্টি লাভের নিয়তে ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে গালি-গালাজের বৃষ্টি বর্ষণ করতে লাগলো। অশ্রাব্য ,বিশ্রী ও কুৎসিত শব্দ ব্যবহার করে সে ইমামকে গালি দিয়ে তার অন্তরের জ্বালা মিটালো এবং তার মনের ক্ষোভ-দুঃখ প্রকাশ করলো। ইমাম হোসাইন (আঃ) তার গালাগালিতে মোটেও রাগ করলেন না , বরং অত্যন্ত ভালোবেসে ও সদ্ব্যবহারের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আল-কোরআনের সে আয়াতগুলো তেলাওয়াত করলেন ,যে আয়াতগুলোতে ভালো ব্যবহার , ক্ষমা প্রদর্শন ও মার্জনা করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। কোরআনের আয়াতগুলো পাঠ করার পর ইমাম হোসাইন (আঃ) সিরিয়ার অধিবাসী সে লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন , আমি তোমার যে কোন খেদমত ও সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত আছি । তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন , তুমি কি সিরিয়ার অধিবাসী ? জবাবে সে বললো , হ্যা! আমি একজন সিরিয়ার অধিবাসী । তখন ইমাম তাকে বললেন , সিরিয়াবাসীদের এরূপ ব্যবহারের অভিজ্ঞতা আমার আছে। আর আমি খব ভালোভাবে জানি ,এ দুর্ব্যবহার ও শত্রুতার কারণ কি ?

অতঃপর ইমাম লোকটিকে বললেন , তুমি এ শহরে একজন মুসাফির । বিদেশের বাড়িতে যদি তোমার কোন কিছুর প্রয়োজন হয় তাহলে তুমি আমাকে বলো। আমি তোমার যে কোন খেদমত করার জন্য প্রস্তুত আছি। আমি তোমাকে আমার মেহমান করতে চাই এবং তোমাকে পোশাক-পরিচ্ছদ ও টাকা-পয়সা ইত্যাদিও দিতে চাই । সিরিয়াবাসী লোকটি তার দুর্ব্যবহার ও গালিগালাজের জন্য একটা কঠোর পরিণতির অপেক্ষা করছিল। সে এমনটি কখনোই আশা করছিল না যে , তার এ অপরাধ ও ধৃষ্টতা একেবারেই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হবে। ইমামের এ সুন্দর ব্যবহার তার মধ্যে এক আত্মিক বিপ্লব এনে দিয়েছে। সে নিজে নিজে বলতে লাগলো , আমার মন চায় যে , মাটি ফেটে দ্বিখন্ডিত হয়ে যাক আর আমি তাতে ঢুকে পড়ি। হায় আফসোস! নিজের অজ্ঞতার কারণে আমি যদি এ অপরাধ না করতাম! এর আগ পর্যন্ত ইমাম হোসাইন (আঃ) ও তাঁর পিতার চেয়ে বড় দুশমন আর কেউ ছিল না। আর এখন আমার দৃষ্টিতে ইমাম হোসাইন (আঃ) ও তাঁর পিতার চাইতে অধিক প্রিয় আর কেউ নেই13

13

উপদেশ প্রার্থী এক ব্যক্তি

এক আরব বেদুঈন মদীনা শহরে এসে রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর খেদমতে হাজির হয়ে আবেদন করলো , হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমাকে কিছু উপদেশ দান করুন । মহানবী (সাঃ) তাকে বললেন , ক্রোধান্বিত হয়ো না । এর বেশি তাকে আর কিছুই বললেন না।

অতঃপর লোকটি তার গোত্রের মাঝে ফিরে গেল। বাড়ি ফিরেই সে জানতে পারলো যে , তার অনুপস্থিতিতে এক মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে। তারই গোত্রের যুবকরা অপর এক গোত্রের কিছু মালামাল জোরপূর্বক লুটপাট করে নিয়ে এসেছে। এর জবাবে সে গোত্রের লোকেরাও এদের অনেক মালামাল লুটপাট করে নিয়ে গেছে। এভাবে লুটপাটের এ ধারা উভয় গোত্রের মাঝে এমন এক পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়েছে যে ,এখন দুই গোত্রের লোকেরাই এক মারাত্মক যুদ্ধ-বিগ্রহ ও খুনাখুনির পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। এ খবর শোনা মাত্রই সে লোকটি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল। তৎক্ষণাত সে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলো এবং রণাঙ্গনের দিকে ছুটলো নিজের গোত্রের সঙ্গ দেবার জন্য।

ঠিক এমন সময় তার মনে পড়লো যে , সে মদীনায় গিয়েছিল এবং রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর কাছে উপদেশ প্রার্থনা করেছিল , তখন মহানবী (সাঃ) বলেছিলেন , নিজের ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণে রাখো

অতঃপর সে মনে মনে ভাবতে লাগলো , কেন আমি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলাম কোন কারণে আমি এভাবে যুদ্ধ করতে এবং খুনাখুনি করতে তৈরি হয়ে গেলাম ? কেনই বা আমি এরূপ ক্রোধান্বিত হয়ে গেলাম ? এসব প্রশ্ন তার মনে জেগে ওঠার পর সে ভাবলো : এখনই উপযুক্ত সময় , রসুলুলাহ (সাঃ) ছোট্ট উপদেশটি পালন করার।

এরপর সে এগিয়ে গেল এবং বিরোধী গোত্রের সরদারকে ডেকে বললো , এ সংঘাত কি জন্যে ? যদি এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য হয় সে সমস্ত মালামাল ফিরে পাওয়া যা আমাদের গোত্রের যুবকরা বোকামি করে তোমাদের থেকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে , তাহলে এসো আমি আমার নিজস্ব সম্পদ থেকে তোমাদের ক্ষতিপূর ণ করে দেই। এটা একটা ভালো কথা নয় যে , এর কারণে আমরা একে অপরের রক্তপিপাসু হয়ে যাবো

প্রতিপক্ষ গোত্রের লোকেরা যখন এ ব্যক্তির যুক্তিপূর্ণ ও উদারতাপূর্ণ কথাগুলো শুনলো তখন তাদের মধ্যেও বীরত্ববোধ জেগে উঠলো। বললো , আমরাও তোমাদের চেয়ে কোন অংশে কম নই। যদি এমনটিই হয় তাহলে আমরা আমাদের দাবি প্রত্যাহার করলাম

তখন উভয় গোত্রের লোকেরা নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেল।14


5

6

7

8

9

10