মিরেকলস অব দ্য কোরআন

মিরেকলস অব দ্য কোরআন 30%

মিরেকলস অব দ্য কোরআন লেখক:
: ডাঃ উম্মে কাউসার হক
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

মিরেকলস অব দ্য কোরআন
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 14 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 25321 / ডাউনলোড: 4265
সাইজ সাইজ সাইজ
মিরেকলস অব দ্য কোরআন

মিরেকলস অব দ্য কোরআন

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

5

বৈজ্ঞানিকভাবে ডারউইনবাদের পতন

প্রাচীন গ্রীস থেকেই একটি মতবাদ হিসেবে চলে আসলেও বিবর্তন থিওরিটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন ঘটে যখন প্রজাতির উৎস নামক বইখানা প্রকাশিত হয়ে থিওরিটিকে বিজ্ঞান জগতে সর্বশেষ টপিকে নিয়ে আসে। আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন প্রাণী প্রজাতিকে পৃথক পৃথকভাবে সৃষ্টি করেছেন-এটি ডারউইন তার এ বইখানায় অস্বীকার করেন । ডারউইনের মতানুসারে সমস্ত জীবেরই একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল এবং এরা কালের যাত্রায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবর্তনের মাধ্যমে বিচিত্র রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে ।

ডারউইনের থিওরিটি কোন দৃঢ় বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত ছিল না ; তিনি নিজেও মেনে নিয়েছেন যে এটা ছিল নিছকই এক অনুমান অধিকন্তু , ডারউইন তার থিওরীর প্রতিকূলতা নামক বইখানার দীর্ঘ অধ্যায়সমূহে স্বীকার করেছেন যে , থিওরিটি বহু সমালোচনামূলক প্রশ্নের উত্তর প্রদানে ব্যর্থ হ চ্ছিল ।

ডারউইন নব নব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পানে তার সমস্ত আশা নিয়োগ করলেন , যেগুলো তার থিওরির প্রতিকূলতাগুলোর সমাধান নিয়ে আসবে বলে তার প্রত্যাশা ছিল । কিন্তু তার আশার বিপরীতে বৈজ্ঞানিত তথ্যগুলো এই সমস্যাগুলোর পরিধি আরো বাড়িয়ে দিল।

বিজ্ঞানের মোকাবেলায় ডারউইনবাদের এই পরাজয়টিকে তিনটি মূল আলোচ্য বিষয়ে পূণর্নিরীক্ষণ করা যায় :

১) ভূ-পৃষ্ঠে প্রাণের ঊন্মেষ কিভাবে হল-এর ব্যাখ্যা মতবাদটি কোনভাবেই প্রদান করতে পারে না।

২ ) থিওরিটি কর্তৃক প্র স্তাবিত বিবর্তন প্রক্রিয়াগুলোর বিবর্তন ঘটানোর কোন প্রকার ক্ষমতা আদৌ আছে কি নেই - তা প্রমাণ করার জন্য কোন বৈজ্ঞানিক তথ্য নেই ।

৩) জীবাশ্ম রেকর্ডসমূহ বিবর্তন থিওরির প্রস্তাবনাসমূহের সম্পূর্ণ উল্টো তথ্য বা প্রমাণ সরবরাহ করে ।

এই পরিচ্ছেদে আমরা এই তিনটি মূল বিষয় সাধারণ পরিধিতে পর্যবেক্ষণ করব :

অনতিক্রম্য প্রথম ধাপ : প্রাণের ঊন্মেষ

বিবর্তন মতবাদ শুধুমাত্র তর্কের খাতিরে এটাই শুদ্ধ বলে ধরে নেয় যে , ৩ ৮ বিলিয়ন বছর আগে আদি পৃথিবীতে আবির্ভূত একটি মাত্র জীবকোষ হতেই সমস্ত জীবিত প্রজাতির বিকাশ ঘটেছে । কিভাবে একটি মাত্র কোষ হতে মিলিয়ন মিলিয়ন জটিল প্রজাতির উদ্ভব হলো , আর বিবর্তন বলে যদি কিছু ঘটেই থাকে তবে ফসিল রেকর্ডে কেনইবা এর সামান্য কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না - এ ধরণের কোন প্রশ্নের উত্তর প্রদানে মতবাদটি অক্ষম। যাইহোক , সর্বাগ্রে , উক্ত বিবর্তন প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপটি অনুসন্ধান করতে হবে : কিভাবে এই আদি কোষের উৎপত্তি হলো ?

যেহেতু বিবর্তনবাদ সৃষ্টি কৌশলকে অস্বীকার করে আর অতি প্রাকৃতিক কোন প্রকার মধ্যস্থতাকে মেনে নেয় না , সেহেতু তা এতেই অটল থাকে যে , আদিকোষ কোন ডিজাইন , পরিকল্পনা বা কোন ব্যবস্থাপনা ছাড়াই প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী এক আকস্মিক যোগাযোগের মাধ্যমে উৎপত্তি লাভ করেছে। এই মতবাদ অনুযায়ী , যুগপৎ ঘটনাসমূহের ফলস্বরূপই নিশ্চিতভাবে জড় বস্তুগুলোই একটি জীবকোষের জন্ম দিয়েছে । যাহোক , এটা এমনকি জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে অনাক্রম্য নিয়মাবলীর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ একটি দাবী ।

প্রাণী থেকে প্রাণীর উৎপত্তি

ডারউইন তার বইখানায় প্রাণের উদ্ভবের ব্যাপারটি কখনও উল্লেখ করেননি । জীবিত সত্তাগুলোর গঠন কাঠামো অত্যন্ত সরল-এ অনুমানের উপরই তার সময়কার বিজ্ঞানের আদি ধারণা প্রতিষ্ঠিত ছিল । মধ্যযুগ থেকে স্বতঃস্ফুর্ত উৎপাদনের নামে একটি থিওরী দাবী করে আসছিল যে , জড় বস্তুগুলো একত্রে মিলিত হয়েই জীবের উদ্ভব ঘটায় , আর এটি তখন বিস্তৃতভাবে গ্রহনযোগ্য ছিল । সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হতো যে , ফেলে রাখা অতিরিক্ত খাবার থেকে পোকামাকড় আর গম থেকে ইদুঁর জন্ম নেয় । এই মতবাদটি প্রমাণের জন্য মজার মজার গবেষণা চালানো হতো । একটি ময়লা কাপড়ের টুকরায় কিছু গম ফেলে রাখা হতো আর কিছুক্ষন পরেই তা থেকে ইদুঁর জন্ম নেবে বলে বিশ্বাস করা হতো । অনুরূপভাবে মাংস থেকে কীটের উৎপত্তিকে স্বতঃস্ফুর্ত উৎপাদনের একটি প্রমাণ বলে ধারণা করা হতো । অবশ্য মাত্র কিছু দিনের ব্যবধানে এটা বোঝা গেলো যে , কীটগুলো মাংসে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে হাজির হয় না , বরং খালি চোখে দেখা যায় না-এমন কিছু লার্ভার আকারে মাছিগুলো কীটগুলোকে বহন করে নিয়ে আসে ।

এমনকি যে সময়ে ডারউইন তার প্রজাতির উৎপত্তি বইখানা লিখেন তখনও ব্যাকটেরিয়া জড়বস্তু থেকে জন্ম নেয় এমন একটি বিশ্বাস বিজ্ঞান জগতে বহুল প্রচলিত ছিল ।

অবশ্য ডারউইনের বই প্রকাশনার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় লুই পাস্তুরদীর্ঘ পর্যবেক্ষন ও গবেষণা শেষে তার ফলাফল ঘোষণা করেন যা ডারউইনের মতবাদের ভিত্তি স্থাপনকারী এই স্বতঃস্ফুর্ত উৎপাদনকে মিথ্যা প্রমাণ করে । ১৮৬৪ সনে , সর্বোনে দেয়া এক বিজয়ী লেকচারে লুই পাস্তুর বলেন , এই সরল গবেষণাটি হতে প্রাপ্ত গুরুতর আঘাত থেকে স্বতঃস্ফুর্ত উৎপাদনের মতবাদটি আর কখনও পূর্বাবস্থায় ফিরে আসতে সক্ষম হবে না ।

বিবর্তন মতবাদটির সমর্থকগণ পাস্তুরের এই তথ্যগুলোকে দীর্ঘ সময় ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। অবশ্য বিজ্ঞানের জয়যাত্রা যখন জীবকোষের অতি জটিল গঠনের জট খোলে দিল , তার সাথে সাথে যুগপৎ ঘটনায় প্রাণের অস্তিত্ত্বে আসার কাল্পনিক ধারণা সম্পূর্ণ অচলাবস্থার সম্মুখীন হলো ।

বিংশ শতাব্দীতে সিদ্ধান্তহীন প্রচেষ্টা

খ্যাতনামা রুশ জীববিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ওপারিন প্রথম সেই বিবর্তনবাদী , যিনি বিংশ শতাব্দীতে প্রাণের উৎপত্তি বিষয়টিকে নিয়ে আবার নূতন করে কাজ শুরু করেন । ১৯৩০ সনে তিনি বিভিন্ন থিসিস নিয়ে এগিয়ে আসলেন আর প্রমাণ করতে চেষ্টা করলেন যে , জীবকোষ যুগপৎ ঘটনায় উৎপন্ন হতে পারে। অবশ্য এবারও এই অনুসন্ধানগুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো আর ওপারিনকে নিম্নোক্ত স্বীকারোক্তিখানি করতে হলো : যাইহোক , দুর্ভাগ্যজনকভাবে হয়তোবা কোষের উৎপত্তি বিষয়ক সমস্যাটি জীবসমূহের বিবর্তনের পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধানের বেলায় সবচেয়ে অস্পষ্ট একটি পয়েন্ট হিসেবে রয়ে গিয়েছে । ২৫

ওপারিনের বিবর্তনবাদী অনুসারীগণ প্রাণের উৎপত্তি বিষয়ক সমস্যাটির সমাধানকল্পে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে লাগলেন। এই পরীক্ষাগুলোর মাঝে সবচেয়ে সুপরিচিত পরীক্ষাটি সম্পন্ন করেন ১৯৫৩ সনে আমেরিকান রাসায়নবিদ ষ্ট্যানলী মিলার। তিনি গবেষনার একটি সেট তৈরী করলেন ; তার যুক্তি অনুযায়ী পৃথিবীর আদি পরিবেশে কিছু গ্যাস বিদ্যমান ছিল যেগুলোকে তিনি তার সেটটিতে একসংগে মেশালেন ও মিশ্রণটিতে শক্তি সরবরাহ করলেন। অবশেষে সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরণের জৈব অণু (এমাইনো এসিড) উৎপন্ন করলেন যেগুলো প্রোটিনের গঠন কাঠামোতে বিদ্যমান থাকে ।

সে সময় এ পরীক্ষাটিকে বিবর্তনের স্বপক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে উপস্থাপন করা হয়েছিল । কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই এ গবেষণাটি অগ্রহনযোগ্য বলে প্রকাশিত হলো ; কেননা গবেষণায় যে পরিবেশ ব্যবহৃত হয়েছিল তা পৃথিবীর প্রকৃত অবস্থা হতে ছিল অনেক অনেক ভিন্ন ।২৬

দীর্ঘ নীরবতার পর মিলার স্বীকার করে নিলেন যে , তিনি যে পরিবেশের মাধ্যম ব্যবহার করেছিলেন তা বাস্তবে নেই ।২৭

বিংশ শতাব্দী জুড়ে প্রাণের উৎপত্তির ব্যাখ্যা দানে বিবর্তনবাদীদের পেশকৃত সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো । সান্ডিয়াগো স্ক্রিপস ইনস্টিটিউট থেকে ভূ -রসায়নবিদ , জেফরী বাদা , ১৯৯৮ সনে আর্থ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক অনুচ্ছেদে এ সত্যটি মেনে নিয়ে বলেন :

আজ এই বিংশ শতাব্দী ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালেও সবচেয়ে বড় যে অমীমাংসিত সমস্যাটির মুখোমুখি আমরা হচ্ছি , যেমনটি হয়েছিলাম এ শতকে প্রবেশের সময় ; সমস্যাটি হল : ভূ - পৃষ্ঠে প্রাণের সঞ্চার হলো কিভাবে ? ২৮

জীবদেহের জটিল গঠন

প্রাণের উৎপত্তি প্রসংগে বিবর্তন মতবাদ এমন একটি বড় ধরণের অচলাবস্থায় সমাপ্ত হওয়ার একটি প্রাথমিক কারণ যে সমস্ত জীবগুলো অত্যন্ত সরল গঠনের বলে বিবেচনা করা হয়েছিল , সেগুলোরও অবিশ্বাস্য ধরণের জটিল গঠন রয়েছে। মানবপ্রযুক্তি দ্বারা তৈরী সমস্ত পণ্যের চেয়ে একটি জীবকোষ অধিকতর জটিল । আজ এই সময়ে এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত ল্যাবরেটরীগুলোতেও অজৈ ব বস্তুগুলোকে একত্রিত করে একখানি জীবকোষ তৈরী করা যায় না ।

একখানি কোষ তৈরীতে প্রয়োজনীয় শর্তাদির পরিমাণ এত বিপুল যে এটাকে যুগপৎ ঘটনায় সংঘটিত হওয়ার ব্যাখ্যা দেয়াই ভার । কোষের গঠন কাঠামোতে ব্লক হিসেবে ব্যবহৃত হয় যে প্রোটিনগুলো , তাদের প্রতিটি গড়ে ৫০০ এমাইনো এসিড নিয়ে গঠিত ; যুগপৎভাবে সংশ্লেষন প্রক্রিয়ায় সে প্রোটিনগুলোর তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা ১০৯৫০ ভাগেরও এক ভাগ। গাণিতিকভাবে ১০৫০ ভাগের চেয়ে কম কিংবা ক্ষুদ্রতর যে কোন সম্ভাবনা বাস্তবে অসম্ভব।

কোষের কেন্দ্রে অবস্থিতডি . এন একটি অবিশ্বাস্য ডাটা ব্যাংক , যা বংশগতির সমস্ত তথ্যাবলী বহন করে থাকে । গণনা করে দেখা গেছে যে , ডি এন তে যে তথ্যাদি সংকলিত রয়েছে তা যদি লিপিবদ্ধ করা যেতো তাহলে তা ৯০০ ভলিউম এনসাইক্লোপেডিয়ার এক বিশালাকায় লাইব্রেরী তৈরী করতো , যেখানে প্রতি ভলিউম এনসাইক্লোপেডিয়া রয়েছে ৫০০ পৃষ্ঠা ।

এই পয়েন্টটিতে একটি উভয় সংকট তৈরী হয় : ডি.এন.এ. কেবলমাত্র বিশেষ ধরণের কিছু প্রোটিনের (এনজাইম) সহায়তায় বিভাজিত হয় । আবার এ এনজাইমগুলো সংশ্লেষনের মাধ্যমে তৈ রী হওয়ার যাবতীয় তথ্যাবলী ডি.এন.এ. এর গায়ে সংকলিত থাকে । আর এই তথ্যাবলী থেকেই সংশ্লেষণ প্রক্রিয়াগুলো বুঝে নেয়া যায় । দেখা যাচ্ছে যে , উভয়েই পরস্পর পরস্পরের উপর নিভর্রশীল । আর তাই কোষ বিভাজনের সময় তাদের উভয়কে একই সঙ্গে বর্তমান থাকতে হবে। এ কারণেই প্রাণ নিজে নিজেই উৎপত্তি লাভ করবে-এরূপ কাল্পনিক সম্ভাবনাটি বাতিল হয়ে যায়। ক্যালিফোর্নিয়ায় সান্ডিয়াগো ইউানভার্সিটির সুনামধন্য বিবর্তনবাদী , অধ্যাপক রেসলি অরগেল , সায়েন্টিফিক এমেরিকান ম্যাগাজিনের ১৯৯৪ সনের সেপ্টেম্বরের প্রকাশনায় একটি আর্টিকেলে এ সত্যটি স্বীকার করে বলেন :

এটা একেবারেই অসম্ভব যে গঠনগতভাবে জটিল প্রোটিন ও এমাইনো এসিড উভয়েই একই সময়ে একই জায়গা হতে উৎপন্ন হবে । তদুপরি এদের একটি ছাড়া অন্যটির অস্তিত্ব অসম্ভব বলেই মনে হয় । আর তাই , প্রথম দৃষ্টিতে একজন এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন যে , প্রকৃতপক্ষে প্রাণ কখনও রাসায়নিক পদ্ধতিতে তৈরী হতে পারতো না ।২৯

বলতে দ্বিধা নেই যে , যদি প্রকৃতিগত কারণে প্রাণের উৎপত্তির সম্ভাবনা না থাকে , তবে তখন এটাই মেনে নিতে হবে যে , এক অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক উপায়েই প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে। এ সত্যটুকু সুস্পষ্টভাবে সেই বিবর্তন মতবাদকে বাতিল ঘোষণা করে যার প্রকৃত উদ্দেশ্য সৃষ্টি কর্ম কে অস্বীকার করা।

জীবনের অবিশ্বাস্য রকমের জটিল গঠন বিবর্তন থিওরীকে নস্যাৎ করার মত একটি বিষয়। জীব কোষের কেন্দ্রে অবস্থিত ডি.এন.এ এটিরই একটি উদাহরণ। ডি.এন.এ এক প্রকার ডাটা ব্যাংক যা চারটি ভিন্ন ভিন্ন অনু সজ্জিত হয়ে তৈরী হয়। জীবসত্ত্বার দৈহিক বৈশিষ্ট্যগুলোর কোড বহন করে এই ডাটা ব্যাংক। গণনা করে দেখা গেছে যে ,যদি মানুষের ডি.এন.এ লিখার ব্যবস্থা করা হয় তবে তা হবে ৯০০ ভলিউম এনসাইক্লোপেডিয়ার সমান। প্রশ্নাতীতভাবেই এই অসাধারণ তথ্যটি নিশ্চিৎভাবে হঠাৎ যুগপত সংঘটনের ধারণাটি ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করে।

কাল্পনিক বিবর্তন প্রক্রিয়াসমূহ

দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ডারউইনের মতবাদকে বাতিল করে দেয় তা হলো - বিবর্তনের প্রক্রিয়াবলী হিসেবে যে দুটি ধারণার অবতারনা করা হয়েছিল সেগুলোর বাস্তবে বিবর্তন ঘটানোর কোন ক্ষমতা নেই বলে বুঝা গিয়েছে ।

ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে তার উত্থাপিত বিবর্তনবাদের ভিত্তি হিসাবে দাঁড় করান। তিনি এই পদ্ধতির উপর যে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন তা তার বইটির নামকরণেই স্পষ্ট হয়ে উঠে : প্রজাতির উৎপত্তি , প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে

প্রাকৃতিক নির্বাচন বিবেচনা করে যে , যে সমস্ত জীব অধিকতর শক্তিশালী ও যেগুলো তাদের আবাস ভূমির স্বাভাবিক অবস্থায় অধিকতর উপযোগী বা যোগ্যতর বলে বিবেচিত হয় তারাই জীবন সংগ্রামে টিকে থাকবে। উদাহরণস্বরূপ , কোন এক হরিণের পাল যখন অন্য কোন হিংস্র জন্তুর কবলে পতিত হয় , তখন যে হরিণগুলো অধিকতর দ্রুত বেগে দৌড়ে যেতে পারে তারাই কেবল টিকে থাকবে । অবশ্য প্রশ্নাতীতভাবেই , এই পদ্ধতি কোন হরিণের মাঝে বিবর্তন ঘটায় না আর একে বিকশিত করে অন্য কোন প্রজাতি , যেমন , ঘোড়ায় রূপান্তরিত -করে না ।

অতএব বিবর্তন ঘটানোর কোন ক্ষমতাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের নেই । ডারউইন নিজেও এ সত্যটি অবগত ছিলেন আর তাকে তার প্রজাতির উৎস নামক বইটিতে নিম্ন লিখিত উক্তিখানি করতে হয়েছিল : প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুকূল বৈষম্য কিংবা বৈচিত্র্য না ঘটা পর্যন্ত প্রাকৃতিক নির্বাচন কিছুই করতে পারে না । ৩০

ল্যামার্কের প্রভাব

তাহলে কিভাবে এই অনকূল পরিবর্তনগুলো ঘটবে ? ডারউইন তার যুগের বিজ্ঞানের আদি ধারণার দৃষ্টিকোণ থেকে এ প্রশ্নের উত্তর প্রদানের চেষ্টা করেন । ডারউইনের পূর্ব যুগে বিদ্যমান ফ্রান্সের জীববিজ্ঞানী ল্যামার্কের মতানুসারে , জীব তাদের জীবদ্দশায় তাদের অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের পরবর্তী প্রজন্মে প্রেরণ করেছিল আর সেগুলো প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে একত্রীভূত হয়ে নূতন প্রজাতির প্রাণীর উদ্ভব ঘটিয়েছিল । যেমন , ল্যামার্কের মতে , জিরাফগুলো এক ধরণের কৃষ্ণকায় হরিণ থেকে বিকশিত হয়েছিল । যখন হরিণগুলো উঁচু বৃক্ষের পাতা খাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করত , তখন তাদের ঘাড় একটু একটু করে প্রসারিত হয়ে এক প্রজন্ম হতে অন্য প্রজন্মে লম্বা হয়েছে ।

ডারউইন নিজেও একই ধরণের উদাহরণ দিয়েছেন ; দৃষ্টান্ত স্বরূপ তিনি তার প্রজাতির উৎস বইটিতে বলেছেন যে খাবারের খোঁজে পানিতে নামতে গিয়ে কিছু ভালুক কালের পরিক্রমায় নিজেরাই তিমিতে রূপান্তরিত হয়েছিল ।৩১

যাই হোক , বিংশ শতাব্দীতে ম্যান্ডেল উত্তরাধীকার সূত্রাবলী আবিষ্কার করলেন আর বংশানুগতি সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান কর্তৃক সে সূত্রগুলোর যথার্থতা যাচাই করা হলো । বংশানুগতির বা উত্তরাধীকার সূত্রগুলো সে সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে আর অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তী প্রজন্মে প্রেরিত হয়-এ ধরণের উপাখ্যানটি নাকচ করে দেয়। এভাবেই প্রাকৃতিক নির্বাচন , বিবর্তন প্রক্রিয়া হিসেবে সমর্থন পেতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় ।

নব্য -ডারউইনবাদ এবং মিউটেশন

ডারউইন ভক্তরা ১৯৩০ সালের শেষ দিকে একটি সমাধানে পৌছার লক্ষ্যে আধুনিক সংশ্লেষন থিওরী কিংবা আরো সাধারণভাবে যেটি নব্য -ডারউইনবাদ নামে পরিচিত , সেটিকে এগিয়ে নিয়ে যান। নব্য -ডারউইনবাদে মিউটেশন প্রক্রিয়াটি যোগ করা হয় ; আর মিউটেশন হলো - বাহ্যিক কিছু কারণ যেমন , বিকিরণের (Radiation ) কিংবা সংযোজন ভ্রান্তির (Replication error ) কারণে জীবদেহের জীনে সংঘটিত বিকৃতি ; উপরোক্ত ফ্যাক্টরগুলোর জন্য প্রাকৃতিক মিউটেশনের সঙ্গে অনুকল পরিবর্তনের কারণ হিসেবে জীনে এ বিকৃতি ঘটে থাকে ।

বর্তমানে এই পৃথিবীতে বিবর্তনের মডেল হিসেবে আমরা যেটিকে দেখতে পাই তাই হলো নব্য -ডারউইনবাদ । থিওরিটি এটাই বলে যাচ্ছে যে , পৃথিবীতে মিলিয়ন মিলিয়ন জীব এসেছে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে , যদ্দারা জীবগুলোর জটিল অঙ্গাদি যেমন: কান , চোখ , ফুসফুস আর পাখাসমূহে মিউটেশন কিংবা জিনগত বিশৃংখলা সংঘটিত হয় । তথাপি একটি নির্জলা বৈজ্ঞানিক তথ্য রয়েছে যা এ থিওরিটিকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে :

মিউটেশন কখনো জীবদেহের বিকাশ বা উন্নয়ন ঘটায় না বরং তার ক্ষতিসাধন করে ।

এর কারণটি অত্যন্ত সাধারণ : ডি.এন.এ. এর রয়েছে একটি অতি জটিল গঠন আর এলোপাতাড়ি যে কোন পরিবর্তন এ কাঠামোটির ক্ষতি সাধন করে । আমেরিকার জিনতত্ত্ববিদ বি.জি. রাঙ্গানাথান বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করেন :

মিউটেশন হলো ক্ষুদ্র , এলোপাতাড়ি আর ক্ষতিকর প্রক্রিয়া। এগুলো কদাচিৎ ঘটে আর ঘটলেও ভাল লক্ষণ যে , এরা কার্যকরী হবে না। মিউটেশনের ৪টি বৈশিষ্ট্য এটাই সূচিত করে যে , প্রক্রিয়াটি কখনো বিবর্তনজনিত বিকাশ ঘটায় না। অত্যন্ত জটিল জীবদেহে এলোপাতাড়ি পরিবর্তনগুলো হয় ব্যর্থ নচেৎ ক্ষতিকর বলে পরিলক্ষিত হয়। একটি ঘড়িতে এলোপাতাড়ি পরিবর্তন একে কোন উন্নতর ঘড়িতে রূপান্তরিত -করতে পারে না। খুব সম্ভবত এতে ঘড়িটির ক্ষতি হবে অথবা বড়জোর তা ব্যর্থ হবে। ভূমিকম্প কখনও নগরীর সমৃদ্ধি ঘটায় না বরং এর ধ্বংসই ডেকে আনে।৩২

এটা কোন আশ্চর্যের কথা নয় যে , মিউটেশনের কোন উদাহরণই কার্যকরী হয় না , তার মানে , মিউটেশন প্রক্রিয়া জীনের গায়ে বিদ্যমান সংকেতলিপির কোন প্রকার উন্নয়ন ঘটায়-এমন কোন দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয় না। সব ধরণের মিউটেশনই ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। মিউটেশনগুলো-যাদের বিবর্তন প্রক্রিয়া বলে উপস্থাপন করা হয়েছে , তারা প্রকৃতপক্ষে জীবদেহে জীনের কতকগুলো সংঘটনমাত্র , যেগুলো বরং দেহের ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায় বলেই দেখা গিয়েছে। আর সাথে সাথে তা জীবগুলোকে অচল ও পঙ্গু করে দেয়। (মানব দেহে মিউটেশনের ক্ষতিকর প্রভাবের সবচেয়ে সাধারণ উদাহরণ-ক্যান্সার ) এতে কোন সন্দেহ নেই যে , কোন ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া কখনো কোন ক্রমবিকাশ পদ্ধতি হতে পারে না। অন্যদিকে প্রাকৃতিক নির্বাচনও নিজে নিজে কিছু করতে পারে না যা ডারউইন নিজেও মেনে নিয়েছেন। এই তথ্যগুলো আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে যে প্রকৃতিতে কোন বিবর্তন প্রক্রিয়া বিদ্যমান নেই। যেহেতু বিবর্তনের কোন পদ্ধতিরই অস্তিত্ব নেই সেহেতু বিবর্তন নামের কাল্পনিক কোন প্রক্রিয়াও সংঘটিত হয়নি।

ফসিল বা জীবাশ্ম রেকর্ডঃ মধ্যবর্তী কোন আকৃতির অস্তিত্ব নেই

বিবর্তন মতবাদ কর্তৃক প্রস্থাবিত - কোন দৃশ্যকল্প সংঘটিত হয়নি - এ সত্যটির সবচেয়ে পরিষ্কার সাক্ষ্য বহন করছে ফসিল রেকর্ড

বিবর্তন মতবাদ অনুসারে প্রতিটি জীব তার পূর্বসুরী থেকে জন্ম নিয়েছে। পূর্বে বিদ্যমান কোন প্রজাতি সময়ের ধারাবাহিকতায় অন্য কোন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে আর এভাবে বাকী প্রজাতিগুলোও অস্তিত্বে এসেছে। এ মতবাদ অনুসারে , এই রূপান্তর প্রক্রিয়া মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে ধীর গতিতে সম্পন্ন হয়েছে।

এই যদি ব্যাপার হতো তখন অবশ্যই অসংখ্য মধ্যবর্তী প্রজাতির অস্তিত্ব থাকত আর এরা দীর্ঘ পরিবর্তন কাল জুড়ে বর্তমান থাকতো ।

উদাহরণস্বরূপ , অতীতে কিছু অর্ধমাছ / অর্ধসরীসৃপ এর অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকত তাদের পূর্ব থেকে বিদ্যমান মাছের বৈশিষ্টের সঙ্গে সরীসৃপের কিছু বৈশিষ্ট্য যোগ হতো। কিংবা কতক সরীসৃপ পাখি জাতীয় প্রাণী থাকতো যাদের পূর্বে রয়ে যাওয়া সরীসৃপের বৈশিষ্টের সংগে পাখির বৈশিষ্ট্য যোগ হতো। যেহেতু এরা একরূপ হতে অন্য রূপে উত্তরণের সময় জন্ম নিত সেহেতু তাদের অক্ষম , ত্রুটিপূর্ণ , পঙ্গু জীব হিসেবেই বিদ্যমান থাকার কথা । বিবর্তনবাদীরা এমন সব কাল্পনিক জীবের কথা বলে থাকেন যা অতীতে তাদের রূপ পরিবর্তনকালীন সময়ে দুয়ের মধ্যবর্তী আকারে (intermediate forms ) বিদ্যমান ছিল বলে তাদের বিশ্বাস ।

সত্যিই যদি এ ধরণের প্রাণীর অস্তিত্ব থাকত , তারা সংখ্যা ও বৈচিত্র্যে হতো মিলিয়ন থেকে বিলিয়ন অবধি। আরো গুরুত্বপূর্ণ যে , অদ্ভুত এই প্রাণীগুলোর দেহাবশেষ ফসিল রেকর্ডে বিদ্যমান থাকার কথা। প্রজাতির উৎপত্তি বইটিতে ডারউইন বলেছেন :

আমার থিওরীটি যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে একই গ্রুপের সমস্ত প্রজাতির মাঝে ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপনকারী মধ্যবর্তী গঠনের এ ধরণের প্রাণীর সংখ্যা নিশ্চিত ভাবেই হবে অসংখ্য ।

ফলস্বরূপ তাদের অতীতে বিদ্যমান থাকার প্রমাণ কেবলমাত্র তাদের ফসিলসমূহে থেকে পাওয়া যেতে পারে । ৩৩

ডারউইনের স্বপ্ন ভঙ্গ হলো

যদিও বিবর্তনবাদীরা ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শুরু করে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে ফসিল খুঁজে পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন , তথাপি এখনও পর্যন্ত কোথাও কোন অন্তর্বর্তীকালীন গঠনের প্রাণী খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাটি খুঁড়ে তুলে আনা সমস্ত ফসিলগুলো বিবর্তনবাদীদের প্রত্যাশার বিপরীত তথ্য প্রদর্শন করে এটাই প্রমাণ করছে যে , পৃথিবীতে প্রাণ এসেছে আকস্মিকভাবে আর পরিপূর্ণ আকার নিয়ে।

প্রখ্যাত ব্রিটিশ জীবাশ্মবিদ , ডিরেক ভি. এগার নিজে একজন বিবর্তনবাদী হয়েও তিনি এ সত্যটি মেনে নিয়েছেন এভাবে :

যে তথ্যটি বের হয়ে আসে তাহলো যে , ফসিলগুলো বর্গ বা প্রজাতি - এ দুয়ের যে কোন পর্যায়েই থাকুকনা কেন , যেকোন একটি স্তরে আমরা যদি এদের পুংখানুপুংখভাবে পরীক্ষা করে দেখি , তাহলে বারংবার আমরা খুঁজে পাই কোন ক্রমান্বয় বিবর্তন নয় , বরং এক গ্রুপের পরিবর্তে অন্য আরেকটি গ্রুপের যেন আকস্মিক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে । ৩৪

ফসিল রেকর্ড থেকে এটাই বুঝা যাচ্ছে যে , সমস্ত জীব প্রজাতিই কোন দুইটি প্রজাতির অন্তর্বর্তীকালীন কোন গঠন নিয়ে নয় বরং পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। এটি ডারউইনের অনুমানের ঠিক উল্টো। এটি এ বিষয়টিরও একটি অত্যন্ত জ্বলন্ত প্রমাণ যে , সমস্ত জীবকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সমস্ত জীব যে পূর্ববর্তী কোন প্রজন্ম হতে বিকশিত হয়ে নয় বরং আকস্মিকভাবে এবং সম্পূর্ণ অখণ্ড রূপে আবির্ভূত হয়েছে-তার একমাত্র ব্যাখ্যা এটিই হতে পারে যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে । সুপরিচিত বিবর্তনবাদী ও জীববিদ ডগলাস ফুতুইমা ও এ সত্যটি স্বীকার করে নিয়েছেন :

সৃষ্টি আর বিবর্তন - এ দুয়ের মাঝে প্রাণের উৎপত্তির ব্যাখ্যাগুলো ফুরিয়ে যায়। প্রাণীসমূহ পৃথিবীতে এসেছে হয় পূর্ণাঙ্গরূপে নচেৎ আসেনি। যদি তারা পূর্ণাঙ্গরূপে না আসে তবে তারা অবশ্যই পূর্বে বিদ্যমান কোন প্রজাতি হতে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় উদ্ভ ূত হয়েছে । যদি তারা পূর্ণাঙ্গ রূপেই এসে থাকে তবে বাস্তবিকভাবে অবশ্যই তারা কোন সর্বশক্তিমান মহাকৌশলী কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছে।৩৫

ফসিলগুলো থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে , ভূ-পৃষ্ঠে প্রাণসত্ত্বার আবির্ভাব ঘটেছে নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গরূপে। তাতে বুঝা যাচ্ছে যে , প্রজাতির উৎপত্তি হয়েছে সৃষ্টি কৌশলের মধ্য দিয়ে , বিবর্তনের মাধ্যমে নয় ; আর এটা ডারউইনের অনুমানের ঠিক বিপরীত ।

কারবালার পর পবিত্র মক্কা ও মদীনায় ইয়াযিদী তাণ্ডবলীলা

মাওলানা শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.)

[ইয়াযীদ মুসলিম জাহানের ক্ষমতারোহণ করে মাত্র সাড়ে তিন বছর রাজত্ব করে । তার দ্বারা মুসলমানদের কোনো উপকার হয়নি ;বরং যা হয়েছে তা হলো চরম দুঃখ ,লাঞ্ছনা ও লোমহর্ষক গঞ্জনা। তার সৈন্যরা প্রথম বছর কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ.) -কে বাহাত্তর জন সঙ্গী- সাথীসহ হত্যা করে ,দ্বিতীয় বছর পবিত্র মদীনা শরীফে ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে এবং তৃতীয় বছর পবিত্র মক্কা নগরীকে দু মাস ধরে অবরুদ্ধ রেখে পবিত্র কাবা গৃহে অগ্নি সংযোজন করে । এখানে আমরা কারবালার পর ইয়াযীদ বাহিনী কর্তৃক মদীনা ও মক্কায় যে হত্যালীলা ও লোমহর্ষক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল তার কিয়দংশ বর্ণনার আশা রাখি।]

কারবালায় হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর শাহাদাতের পরে মদীনায় ইয়াযীদ কর্তৃক যে লোমহর্ষক ও মর্মান্তিক ঘটনা সংঘটিত হয় এটাই হাররা র ঘটনা নামে অভিহিত। এ স্থানটি মদীনা নগরী থেকে এক মাইল দূরে অবস্থিত। মদীনা তৈয়বাতে যে সব হত্যাকাণ্ড ,সংঘর্ষ ও এ পবিত্র স্থানের অবমাননার ঘটনা ঘটেছে সে সব ঘটনা বর্ণনার দ্বারা যদিওবা পবিত্র অন্তর বিশিষ্ট লোকদের অন্তর দুঃখভারাক্রান্ত হয় ,কিন্তু হুজুর আকরাম (সা.) এ সমুদয় অঘটনের ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন ,তাই এ সম্পর্কে এখানে কিঞ্চিত আভাস দেয়া দরকার । যেমন তিনি এরশাদ করেছেন -যে ব্যক্তি মদিনাবাসীকে কষ্ট দেবে এবং ভীতসন্ত্রস্ত করবে ,সে দুনিয়া ও আখিরাতের আযাবে গ্রেপ্তার হবে । হাররা এলাকায় যে অঘটন ঘটেছে হাদিস দ্বারা এর সত্যতা প্রমাণিত হয়।

কোনো কোনো আলেম বলেছেন যে , হাররা ঘটনা এ হাদিসের দ্বারাও সত্যায়িত করা হয়। তিনি এরশাদ করেছেন-মদীনা শরীফ আবাদ হওয়ার পর আবার বিরান হয়ে যাবে ,মানুষও এ স্থান ছেড়ে চলে যাবে এবং মরু এলাকার পশুপক্ষী এখানে এসে বসবাস করবে। কিন্তু বাস্তব এই যে ,মদীনার এ অবস্থা কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে দেখা দেবে ,ইমাম নববী কথা বলেছেন। কেননা ,কোনো কোনো হাদিসে যে সমুদয় বর্ণনা পাওয়া যায় ,এতে বুঝা যায় যে , হাররা র ঘটনায় এটা পরিলক্ষিত হয়নি। যেমন- ইবনে আবি শাইবা উল্লেখ করেছেন ,এ পবিত্র নগরী চল্লিশ বছর যাবৎ বিরান হয়ে পড়ে থাকবে। তথায় হিংস্র জন্তু এবং পশু-পাখি বসবাস করবে। অতঃপর মুজনিয়া গোত্রের দু জন রাখাল এখানে এসে অবাক হয়ে পরস্পরকে বলবে ,এখানকার জনপদ কোথায় গেল ? তারা সেখানে বন্য জীবজন্তু ব্যতীত আর কিছুই দেখতে পাবে না । এতে বুঝা যায় যে ,এটা কিয়ামত পূর্বকালীন সময়ের ঘটনা হবে ।

হাররা র মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কে অনেক সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত আছে-মদীনার ওপর এমন এক সময় উপস্থিত হবে যে ,মদীনার বাসিদেরকে এ খান থেকে বের করে দেয়া হবে । সাহাবাগণ আরজ করলেন : কে তাদেরকে বের করে দেবে ? এরশাদ করলেন : আমীরগণ । বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিসে বর্ণিত আছে যে ,নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন : কুরাইশ গোত্রীয় লোকের হাতে আমার উম্মত ধ্বংস হবে । সাহাবাগণ আরজ করলেন : হে আল্লাহর রাসূল (সা.) ! তখন আমাদের জন্য কী নির্দেশ ? এরশাদ করলেন : তখন তোমাদের একাকীভাবে জীবন যাপন করা উচিত। অপর এক হাদিসেও হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত আছে যে ,হযরত (সা.) এরশাদ করেছেন : যে মহান সত্তার হাতে আমার জীবন ,তার শপথ করে বলছি ,মদীনায় এমন এক যুদ্ধ সংঘটিত হবে ,যার ফলে‘‘ দ্বীন’’ এখান থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে ,যেমন মাথা মুণ্ডনের ফলে চুল মাথা থেকে খসে পড়ে যায়। সেদিন তোমরা মদীনার বাইরে চলে যেও ,এক মনজিলের ব্যবধান হলেও । হযরত আবু হুরাইরাহ থেকে আরো বর্ণিত আছে যে ,তিনি এভাবে দোয়া করতেন : হে আল্লাহ ! আমাকে ষাট হিজরীর অঘটন এবং ছেলেদের রাজত্ব থেকে রক্ষা করুন। সে আসার পূর্বেই আমাকে দুনিয়া থেকে তুলে নিন। এতে ইয়াযীদের হুকুমতের প্রতিই ইঙ্গিত রয়েছে । কেননা ,সে ষাট হিজরীতে সিংহাসনে আরোহণ করেছে এবং হাররা র ঘটনা তারই রাজত্বকালে সংঘটিত হয়েছে।

ওয়াকেদী হাররা নামক কিতাবে আইয়ুব ইবনে বশর থেকে বর্ণনা করেছেন-রাসূল (সা.) একদা সফর করে হাররা নামক স্থানে পৌছেন ,তখন দাড়িয়ে ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়েন । এতে সাহাবাগণ মনে করলেন যে ,হয়ত সফরের পরিণতি শুভ হবে না। তাকে এ সম্পর্কে অবহিত করা হলো । হযরত ওমর (রা.) আরজ করলেন : হে আল্লাহর রাসূল (সা.) ! আপনি কী ভেবে ইন্নালিল্লাহ পড়লেন ? তিনি বললেন : হাররার এ মরু প্রান্তরে আমার সাহাবাদের পরে আমার উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদেরকে হত্যা করা হবে । অপর এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে যে ,তিনি তার হস্ত মুবারকের দ্বারা ইশারা করে বললেন : এ হাররার মরু প্রান্তরে আমার উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদেরকে হত্যা করা হবে । হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হযরত কা বে আহবার থেকে বর্ণনা করেন যে ,হযরত কাব বলতেন , তাওরাত কিতাবে বর্ণিত আছে যে ,মদীনা মুনাওয়ারার পূর্বদিকের মরু প্রান্তরে উম্মতে মুহাম্মাদীয়া (সা.) -এর এমন কতক লোক শাহাদাত বরণ করবেন ,যাদের চেহারা চৌদ্দ তারিখের চাদের আলো থেকে উজ্জ্বল । ইবনে যুবলা থেকে বর্ণিত আছে- একদা আমিরুল মু মিনীন হযরত ওমর (রা.) এর খেলাফতের আমলে খুব বৃষ্টিপাত হয়। তখন তিনি তার বন্ধু বান্ধবসহ মদীনার বাইরে ভ্রমণে বের হয়েছিলেন । যখন হাররা নামক স্থানে পৌছেন এবং দেখতে পান যে ,চতুর্দিকে পানির ঢেউ বয়ে যাচ্ছে ,তখন তার সাথী হযরত কাবে আহবার (রা.) শপথ গ্রহণ করে বললেন : এখানে যেভাবে পানির স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে ,ঠিক এমনিভাবেই এখানে রক্ত প্রবাহিত হবে । হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) সম্মুখে অগ্রসর হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , এটা কোন সময়ে হবে ? তিনি উত্তর দিলেন : হে যুবাইরের পুত্র ! তুমি এর থেকে সতর্ক থেক যেন তোমার হস্ত-পদের দ্বারা এটা সংঘটিত না হয়।

সীরাত লেখক এবং ঐতিহাসিকরা সংক্ষেপ এবং বিস্তারিতভাবে এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তাদের উদ্ধৃতিসমূহ নিম্নে পেশ করা হলো যাতে আসল ঘটনা অস্পষ্ট না থাকে।

কুরতবী বলেন : মদীনাবাসীর মদীনা থেকে বাইরে চলে যাওয়ার কারণ এ হাররা র মর্মান্তিক ঘটনা । যেমন কোনো কোনো হাদিসে বর্ণিত আছে-যে সময় মদীনা শরীফ অবশিষ্ট সাহাবা এবং তাবেয়ী দ্বারা পরিপূর্ণ এবং লোক বসতিতে ভরপুর এবং তার চিত্তাকর্ষক সাদৃশ্য বিদ্যমান তখন মদীনাবাসীর ওপর একের পর এক বিপর্যয় এবং অঘটন নেমে আসে ফলে তারা মদীনা ছেড়ে বাইরে চলে যান। পাপিষ্ঠ ইয়াযীদ মুসলিম ইবনে উকবার নেতৃত্বে শাম দেশীয় এক বিশাল সৈন্য বাহিনী যুদ্ধ করার জন্য মদীনায় প্রেরণ করে । সৈন্য বাহিনীর বদবখত লোকেরা তিন দিন পর্যন্ত মসজিদে নববীর সম্মান হানিকর কাজে লিপ্ত থাকে। এ কারনেই একে হাররা র ঘটনা বলা হয়। এটা শহর থেকে এক মাইল দূরে অবস্থিত।

এ মর্মান্তিক ঘটনার প্রাক্কালে ইয়াযীদের কুচক্রী দল শিশু এবং নারী ব্যতীত মদীনার বিশিষ্ট ও সম্মানিত বার হাজার চারশ সাতানব্বই জন লোককে হত্যা করে ।

মদীনায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে শহীদানের তালিকা

1. মুহাজির,আনসার ,তাবেয়ীন ,উলামা- 1700 জন

2. সাধারণ লোক 10 ,000 জন

3. কুরআনের হাফিজ 700 জন

4. কুরাইশ 97 জন

সর্বমোট = 12 ,497 জন

হাররাহ এ লোমহর্ষক ঘটনা ছাড়া ও ইয়াযীদের সৈন্যরা নানা প্রকার অত্যাচার ,অনাচার ও ধৃষ্টতাপূর্ণ অপকর্মে লিপ্ত হয় এবং জেনার মতো ঘৃণ্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। বর্ণিত আছে যে ,এ ঘটনার পর এক হাজার অবৈধ সন্তান প্রসব করে । এ সব পাপিষ্ঠ লোক মসজিদে নববীর অমার্জনীয় অবমাননা করে । এ পবিত্র স্থানকে তারা ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করে । হুযুর আকরাম (সা.) -এর রওজায়ে পাক এবং মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থান (যার সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে ,এখানে বেহেশতের বাগান সমূহের একটি বাগান আছে) ঘোড়ার মলমূত্র দ্বারা কলুষিত করে । আর লোকদের থেকে ইয়াযীদের জন্য এভাবে বাইআত নেয়া হয় যে ,ইয়াযীদ যদি ইচ্ছা করে ,তাদেরকে বিক্রয় করতে পারবে অথবা স্বাধীনভাবেও রাখতে পারবে। সে যদি ইচ্ছে করে আল্লাহর বন্দেগীতেও রাখতে পারবে অথবা তার নাফরমানি করারও নির্দেশ দিতে পারে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যমা (রা.) যখন ইয়াযীদকে বললেন যে ,বাইআততো অন্ততঃপক্ষে কুরআন ও সুন্নাতের ওপর গ্রহণ করা চাই। তখনই ইয়াযীদ তাকে হত্যা করে ফেলে।

ইমাম কুরতবী বলেন-ঐতিহাসিকরা লিখেছেন যে ,মদীনা মুনাওয়ারা তখন জন শূন্য হয়ে যায়। তখন মরুর পশুপাখিরা তথায় মলমুত্র ত্যাগ করত। মসজিদে নববী কুকুরের বাসস্থানে পরিণত হয়। এ সকল ঘটনা দ্বারা হুজুর (সা.) -এর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়।

তাবরানী হযরত উরওয়া ইবনে যুবাইর থেকে রেওয়ায়েত করেন যে ,হযরত মু আবিয়া (রা.) -এর ইন্তিকালের পর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) ইয়াযীদের বাইআত এবং আনুগত্য করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন এবং তার নিন্দাবাদ করতে থাকেন। ইয়াযীদ এ কথা শ্রবণে শপথ নিয়ে বলল : খোদার কসম ,আমি আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর গলায় বেড়ী পরাব। অতঃপর সে একজন দূত মারফত তাকে ডেকে পাঠায়। দূত এসে তাকে বলল : আপনি রৌপ্যের একটি ফাদ তৈরী করুন এবং ইয়াযীদের শপথ পূরণকল্পে গলার মধ্যে তা ঝুলিয়ে দিন ,আর এই ওপর স্বীয় কাপড় পরিধান করুন ,তবে আশা করি আপনি রক্ষা পাবেন। আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) বললেন : আল্লাহ তাআল কখনও তার শপথকে বাস্তবায়িত করবেন না। আমি অন্যায়ের কাছে কখনও আত্মসমর্পণ করবো না। যতক্ষণ শক্ত পাথর দাতের নিচে নরম হবে না। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) জনগণকে তার বাইআত গ্রহণ ও আনুগত্য স্বীকারের দাওয়াত দিতে লাগলেন।

এ দিকে পাপিষ্ঠ ইয়াযীদ মুসলিম ইবনে উকবার নেতৃত্বে এক বিশাল সেনাবাহিনী শাম (সিরিয়া) থেকে মদীনা অভিমুখে প্রেরণ করে । তাদেরকে সে এ নির্দেশ দিয়েছিল যে ,মদীনাকে ধ্বংস করে দেয়ার পর মক্কায় চলে যাবে এবং আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরকে হত্যা করবে। মুসলিম ইবনে উকবা যখন মদীনায় পৌছে তখন সকল সাহাবায়ে কেরাম মদীনা শরীফের বাইরে চলে গেলেন। মুসলিম ইবনে উকবা অবশিষ্ট লোকদের হত্যা করার পর মক্কা শরীফ অভিমুখে যাত্রা করল। পথিমধ্যে সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এ সময় সে হোসাইন ইবনে নুমাইর কিন্দিকে স্বীয় প্রতিনিধি নিযুক্ত করে এবং আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) -কে অবরোধ করার জন্য পবিত্র মক্কায় কামানের গোলা নিক্ষেপ এবং অগ্নিসংযোগের নির্দেশ দেয়। হোসাইন পথিমধ্যে থাকাকালেই ইয়াযীদের মৃত্যু সংবাদ পৌছে । হোসাইন পালিয়ে গেল এবং সে তার প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করতে পারল না।

ইবনে জওযী বলেন ,বাষট্টি হজরীতে ইয়াযীদ তার চাচাত ভাই উসমান ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবু সুফিয়ান তার বাইআত গ্রহণের জন্য মদীনায় প্রেরণ করে । উসমান মদীনাবাসীর একটি দলকে ইয়াযীদের নিকটে পাঠিয়ে দেন। যখন তারা ইয়াযীদের কাছ থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন ,তখন তারা ইয়াযীদকে গালিগালাজ করতে লাগলেন ও বললেন যে ,সে ধর্মদ্রোহী ,মদখোর ,ফাসিক । সে কুকুর পালন করে । এ কথা বলে তারা তার বাইআত বর্জন করলেন। ইয়াযীদের নিকট গমনকারী লোকদের মধ্যে হযরত মুনযের (রা.)ও ছিলেন । তিনি বললেন : ইয়াযীদ আমার বড় উপকার করেছে। সে আমাকে একলক্ষ দিরহাম অনুদান দিয়েছে। কিন্তু এজন্য আমি সত্যকে পরিত্যাগ করতে পারিনি। সে মদ্যপায়ী ও বেনামাযী। তার মুখ থেকে এ কথা শোনার সাথে সাথেই লোকজন তার বাইআত প্রত্যাখ্যান করে আবদুল্লাহ ইবনে হানযালার হাতে বাইআত গ্রহণ করল আর উসমানকে মদীনা থেকে বের করে দিল। আবদুল্লাহ ইবনে হানযালা (রা.) বলতেন : যদি আসমান থেকে প্রস্তর বর্ষণের আশংকা না করতাম ,তবে ইয়াযীদের বাইআত প্রত্যাখ্যান করতাম না এবং তার মোকাবিলা করার ঝুকি গ্রহণ করতাম না। ইবনে জওযী আবদুল হাসান মাদাহেনী থেকে বর্ণনা করেন যে ,ইয়াযীদের পাপাচার এবং কর্মসমূহ প্রকাশিত হওয়ার পর মদীনাবাসী মিম্বরের ওপর আরোহণ করে তার বাইআত প্রত্যাখ্যান করেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হাফস মাখযুমী মাথা থেকে পাগড়ি নিক্ষেপ করে বললেন : ইয়াযীদ আমার বড় উপকার করেছে এবং আমাকে বিশেষ অনুদানে সম্মানিত করেছে কিন্তু সে আল্লাহর শত্রু এবং মদপানে আসক্ত ব্যক্তি ;আমি তার বাইআত এভাবে প্রত্যাখ্যান করলাম যেভাবে এ পাগড়িকে নিক্ষেপ করেছি । এক ব্যক্তি দাড়িয়ে জুতা নিক্ষেপ করে তার বাইআত প্রত্যাখ্যান করল। এভাবে পাগড়ি এবং জুতাতে মজলিস ভরে গেল। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে মুতী (রা.) কে কুরাইশের এবং আবদুল্লাহ ইবনে হানযালা (রা.) কে আনসারের প্রশাসক নিযুক্ত করা হলো ।

উমাইয়্যা বংশীয় লোকদেরকে মারওয়ানের গৃহে অবরুদ্ধ করা হলো । উমাইয়্যাগণ তাদের এ দুরবস্থার সংবাদ ইয়াযীদের কাছে পাঠিয়ে সৈন্য দিয়ে সাহায্যের আবেদন জানায়। ইয়াযীদ তাদের সাহায্যার্থে মুসলিম ইবনে উকবাকে মদীনায় প্রেরণ করে । এ হতভাগা যদিও বৃদ্ধ ,কিন্তু মদীনাবাসীকে রক্ত স্রোত প্রবাহিত করার ঝুকি গ্রহণ করে । অতঃপর ইয়াযীদ এ কথাও ঘোষণা করে যে ,যে ব্যক্তি হেজাযে গমন করবে তাকে যুদ্ধের অস্ত্র-শস্ত্র এবং সফরের যাবতীয় আসবাবপত্র ছাড়াও একশ দিনার করে বখশিস দেয়া হবে । এ ঘোষণা শুনে বার হাজার লোক হেজায গমনে রাজি হয়ে গল। এ সব লোককে সেখানে প্রেরণ করে ইবনে ফারজানাকে নির্দেশ দিল যে ,তুমি তথায় গিয়ে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর সাথে যুদ্ধ কর। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন এবং বললেন , আল্লাহর শপথ ,একজন ফাসেকের সন্তুষ্টির নিমিত্তে আমি পয়গম্বর আলাইহিস সালামের একজন আওলাদের হত্যা এবং হেরেম শরীফে আল্লাহর ঘরের মধ্যে লড়াইয়ের ঝুকি নিতে পারি না। এরপর সে মুসলিম ইবনে উকবাকে সেখানে পাঠিয়ে দেয়। সে তাকে নির্দেশ দেয় যে ,যদি কোনো অঘটন ঘটে তবে হোসাইন ইবনে নুমাইরকে তোমার প্রতিনিধি নিযুক্ত করবে। সে আরও নির্দেশ দিল যে ,যার বিরুদ্ধে তোমাকে পাঠানো হচ্ছে তাকে তিনবার দাওয়াত দেবে ,যদি দাওয়াত গ্রহণ করে তবে তাকে ছেড়ে দেবে। আর যদি দাওয়াত কবুল না করে ,তবে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। বিজয় লাভ করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।

সেখানে সম্পদ ,অস্ত্র এবং খাদ্য ইত্যাদি যা কিছু পাও তা সৈন্যদের জন্য হালাল করে দাও । তিনদিন পর যুদ্ধ থেকে বিরত থাকবে। হযরত হোসাইনের পুত্র হযরত আলী ওরফে যায়নুল আবেদীনের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ো না। কেননা ,তিনি ঐ দলকে সমর্থন করেন না। যখন মদীনাবাসীর নিকট এ খবর পৌছে তখন মদীনাবাসী সমবেতভাবে ইয়াযীদের সৈন্যদের মোকাবিলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন । বনী উমাইয়্যার যে দলটি মারওয়ানের গৃহে অবরুদ্ধ ছিল ,তারা তাদের নিকট গিয়ে বললেন : তোমরা এ কথার প্রতিশ্রুতি দাও যে ,তোমরা ধোকাবাজি ,প্রতারণা এবং গোয়োন্দাগিরি করবে না এবং আমাদের শত্রুদের কোনো প্রকার সাহায্য -সহযোগিতা করবে না। তাহলেই আমরা তোমাদেরকে ছেড়ে দিতে পারি ;অন্যথায় আমরা তোমাদেরকে হত্যা করব। বনী উমাইয়্যার ঐসব লোক মুনাফিকী করে মদীনাবাসীর সাথে শামিল হয়ে মুসলিম ইবনে উকবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বেরিয়ে আসে। মারওয়ান ইবনে হাকাম গোপনে স্বীয় পুত্রকে মুসলিম ইবনে উকবার নিকট প্রেরণ করে এ কথা বলে যে ,মদীনায় পৌছে তিনদিন যেন যুদ্ধ স্থগিত রাখে। তিনদিন পর মারওয়ান মদীনাবাসীর সাথে পরামর্শ করে তাদেরকে বলল : তোমরা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ ? তারা বললেন : যুদ্ধ ব্যতীত গতি নেই।

মারওয়ান বলল : যুদ্ধ করা উচিত হবে না। এতে ফাসাদ বড়ে যাবে। ইয়াযীদের হাতে বাইআত করাই আমি সমীচীন বলে মনে করি। কিন্তু মদীনাবাসী তা পছন্দ করলো না এবং ইয়াযীদের বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার জন্য মদীনার বাইরে চলে গেলেন ।

এক দিকে আবদুল্লাহ ইবনে হানযালা (রা.) যুদ্ধের ময়দানে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন ,অপর দিকে মুসলিম ইবনে উকবা বার্ধক্য জনিত কারণে পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করে স্বীয় সেনাবাহিনীকে উৎসাহিত করছিলো। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুতী (রা.) তার সাত পুত্র সহকারে শত্রুর মোকাবিলা করে শাহাদাত বরণ করেন। মুসলিম ইবনে উকবা তার মস্তক মুবারক দ্বিখণ্ডিত করে ইয়াযীদের নিকট পাঠিয়ে দেয়। অবশেষে ইয়াযীদ বাহিনী বিজয় লাভ করে । ইয়াযীদের সৈন্য বাহিনী তার নির্দেশ মোতাবেক মদীনা মুনাওয়ারায় তিনদিন পর্যন্ত অত্যাচার ,অবিচার ও ব্যভিচার চালায় ,সম্পদ লুটপাট করে এবং জেনার মতো জঘন্য কার্যে লিপ্ত হয়।

ওয়াকেদী বলেন : যখন ইয়াযীদের সেনাবাহিনী মদীনার নিকট পৌছে তখন মদীনাবাসী পরস্পরের পরামর্শক্রমে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর মতো মদীনার চতুর্দিকে দীর্ঘ পনের দিন অত্যন্ত দুঃখ কষ্ট সহকরে পরিখা খনন করেন। মদীনার চতুর্দিকে তারকটার বেড়া লাগিয়ে দেন এবং দুশমনের পথ অবরোধ করে চতুর্দিক থেকে তাদের ওপর তীর ও পাথর নিক্ষেপ করতে থাকেন। এতে শাম বাহিনী মদীনায় প্রবেশ করতে বাধার সম্মুখীন হয়। অবস্থা বেগতিক দখে মুসলিম ইবনে উকবা ভীত হয়ে হাররা র এক কোণায় অবস্থান করে এবং মারওয়ানের নিকট এ মর্মে লোক প্রেরণ করে যে ,যুদ্ধে জয়লাভ করার কোনো একটা পথ বের করতে ,যাতে সফলকাম হওয়া যায়। মারওয়ান বনী হারেসার নিকট গমন করে তাদেরকে লোভ-লালসায় আকৃষ্ট করে মদীনার একদিকের রাস্তা খুলে দিল। ইয়াযীদের সেনাবাহিনী সে পথ দিয়ে মদীনায় প্রবেশ করে এবং মদিনাবাসী অপর দিক থেকে গুটিয়ে এসে শুধু সে দিকে এসেই যুদ্ধে লিপ্ত হন।

ইবনে আবি খাইসামা বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে ,মদীনার লোকজন বর্ণনা করেন যে ,হযরত মু আবিয়া তার মৃত্যুকালে ইয়াযীদকে ডেকে বলে ছিলেন : আমার মনে হয় মদীনাবাসীর সাথে একদিন তোমাকে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হবে । সে সময় তুমি মুসলিম ইবনে উকবার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করে নিও ! কেননা ,এ ব্যাপারে তার চেয়ে অধিক বিশ্বস্ত আর কেউ নেই। পিতার মৃত্যুর পর যখন ইয়াযীদ সিংহাসনে আরোহণ করে তখন মদিনাবাসীর সাথে তার দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়। সে পিতার নির্দেশ মতো এ সমস্যার সমাধান করে।

কথিত আছে যে ,এক বৃদ্ধা মুসলিম ইবনে উকবার নিকট এসে কেদে কেদে ফরিয়াদ করলেন : আমার পুত্র বন্দি হয়েছে ,আপনি তাকে মুক্তি দিন। সে তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দিল যে ,তার ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে তার গর্দান দু টুকরা করে যেন মায়ের হাতে তুলে দেয়া হয়। নির্দেশমত কাজ করা হলো এবং বৃদ্ধার হাতে তার পুত্রের মস্তক সোপর্দকরে তাকে বলে দেয়া হলো , তুমি নিজের জীবনের মঙ্গল না চেয়ে পুত্রকে রেহাই দানের সুপারিশ করাতেই এ পরিণতি হয়েছে।

হযরত সাঈদ ইবনে মুসায়্যেব যিনি একজন বিশিষ্ট তাবেয়ী ছিলেন তাকে মুসলিম ইবনে উকবার নিকট হাজির করা হয়। সে তাকে বলল : ইয়াযীদের বাইআত গ্রহণ কর। তিনি বললেন : আমি আবু বকর (রা.) এবং উমর (রা.) এর নীতি মোতাবেক বাইআত করেছি। এ সময় একজন লোক দাড়িয়ে বলল : এ একজন পাগল। এ কথা বলার পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। মুসলিম ইবনে উকবা হত্যাকাণ্ডে এবং ফিতনা-ফাসাদে অতিশয় সীমালঙ্ঘনকারী ছিল বিধায় স মাসরিফ (সীমালঙ্ঘনকারী) নামে অভিহিত ছিল ।

বিখ্যাত ঐতিহাসিক ওয়াকেদী তার কিতাবুল হাররা নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে ,একদা ইয়াযীদ মুসলিমের নিকট এসে দেখতে পায় যে ,সে অর্ধাঙ্গ রোগে আক্রান্ত। ইয়াযীদ তাকে লক্ষ করে বলল : যদি তুমি দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত না হতে তবে আমি তোমাকে মদীনা অভিযানে প্রেরণ করতাম । কেননা ,আমি তোমার চেয়ে আর কাউকে আমার একনিষ্ঠ ভক্ত বলে মনে করিনা । আমার শ্রদ্ধেয় পিতা মু আবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান আমাকে তার মুমূর্ষ অবস্থায় অসিয়ত করেছেন : যদি হেজাযবাসীর সাথে তোমার কোনো অঘটন ঘটে তবে তুমি মুসলিম ইবনে উকবার নিকট তোমার সমস্যার সমাধান চেয়ে নেবে’’ এ কথা শোনামাত্র মুসলিম ইবনে উকবা উঠে দাড়ায় এবং বলে : হে আমীরুল মু মিনীন! আপনাকে শপথ দিয়ে বলছি- একাজ আমি ব্যতীত আর কারও ওপর ন্যস্ত করবেন না। কেননা ,আমার থেকে মদীনাবাসীর আর কোনো বড় শত্রু নেই। এ সম্পর্কে আমি একটি স্বপ্নও দখেছি যে ,জান্নাতুল বাকীর একটি বৃক্ষের শাখা-প্রশাখাসহ হযরত উসমান (রা.) এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়ার ফরিয়াদ করছেন। আমি যখন বৃক্ষটির নিকটে যাই তখন বলতে শুনলাম ,এ কাজ মুসলিম ইবনে উকবার দ্বারাই সম্পন্ন হবে । সে দিন থেকে আমার অন্তরে এ বিশ্বাস জন্মেছে যে ,আমিই মদিনাবাসীকে হত্যা করব এবং এ আশায় মনকে সান্তনা দিয়েছি এই বলে- আমিই হযরত উসমান (রা.) -এর হত্যাকারীদের প্রতিশোধ গ্রহণ করব। যখন ইয়াযীদ মুসলিম ইবনে উকবার মধ্যে এরূপ প্রেরণা ও আগ্রহ দেখতে পেল- তখন তাকে নির্দেশ দিল : সত্বর প্রতিশোধ গ্রহণ কর এবং আল্লাহর নাম নিয়ে মদীনা অভিমুখে যাত্রা কর। যদি মদীনায় প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হও এবং বাইআত গ্রহণে মদিনাবাসী রাজি না হয় ,তবে তুমি ছোট-বড় নির্বিশেষে সকলকে হত্যা করবে। তিনদিন পর্যন্ত একাজ চালিয়ে যাবে। কাউকে বাদ দেবে না। আর তাদের ধন-সম্পদ লুটপাট করে নেবে। অবশ্য যদি তারা বাইআত স্বীকার করে তবে তাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ো না। সেখান থেকে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর কাছে চলে যাবে এবং তার কাজ সম্পন্ন করবে।

বর্ণিত আছে যে ,মদীনার হেরেমের শহীদগণকে দর্শন করে সে বলত : আমি এ সব লোককে হত্যা করার পরও যদি দোযখে যাই তবে আমার থেকে হতভাগা আর কেউ নেই।

মারওয়ানের গোলাম যাকওয়ান বলে : একদা মুসলিম ইবনে উকবা রোগের ঔষধ সেবন করার পর খাবার তলব করল। অথচ ডাক্তার তাকে নিষেধ করে ছিল যে ,ঔষধ সেবনের পর খাদ্য গ্রহণ করলে ঔষধ ক্রিয়াশীল হবে না। সে বলল : এখন আমি জীবিত থাকার আর কোনো আশা করবনা। কারণ ,আমি তো হযরত উসমান (রা.) এর হত্যাকারীদের প্রতিশোধ গ্রহণ করে এখন স্বস্তিবোধ করছি । আমার অন্তরের বাসনা পূর্ণ হয়েছে। মৃত্যু ব্যতীত এখন আমার কাছে আর কোনো কিছু প্রিয় নেই। এখন মৃত্যুই আমার কাছে সবেচেয়ে প্রিয়। আমার বিশ্বাস এ সব নাপাককে হত্যা করার ফলে আল্লাহ তা আলা আমার সমুদয় গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন’’ সৈয়দ আলাহির রহমত বলেন : তার গুনাহ মার্জনার ধারণা নিতান্ত মুর্খতা ,অজ্ঞতা ও দুর্ভাগ্যের পরিচায়ক ;কেননা ,আল্লাহর রহমত প্রাপ্ত এমন একদল বিশিষ্ট সাহাবায়ে করামকে হত্যা করা এমন এক অপরাধ ও পাপের কাজ ,যা ক্ষমা করা দূরের কথা এই অশুভ পরিণতি থেকে তার রেহাই পাওয়াও অসম্ভব ;এ তার দুঃস্বপ্ন মাত্র।

যে সব সাহাবায়ে কেরামকে মদীনায় জোরপূর্বক অমানুষিকভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন ফেরেশতা কর্তৃক গোসলপ্রাপ্ত হযরত হানযালা (রা.) -এর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ (রা.) । তিনি তার সাত পুত্রসহ শহীদ হন। আর রয়েছেন রাসূল (সা.) -এর অজুর বর্ণনা প্রদানকারী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যাইদ (রা.) ও হযরত মাকল ইবনে সিনান (রা.) ,যিনি মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে উপস্থিত ছিলেন এবং স্বীয় গোত্রের পতাকা বহন করেন।

ইবনে জওযী সনদের সূত্র ধরে সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যেব থেকে বর্ণনা করেন ,তিনি বলেছেন : হাররার অঘটনের সময়ে রাত্রিতে আমি ব্যতীত আর কেউ মসজিদে নববীতে উপস্থিত হতো না। শাম দেশীয় লোকজন আমাকে মসজিদে দেখে বলত ,এ পাগল বুড়ো! এখানে কী করছো ? প্রত্যেক নামাযের সময় রাসূলে পাক (সা.) -এর হুজরা শরীফ থেকে আযান ,ইকামাতের আওয়াজ শুনে আমি নামায পড়তাম।

হাররা র এ হৃদয় বিদারক ঘটনার প্রাক্কালে ইয়াযীদ বাহিনীর হাতে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু সাইদ খুদরী (রা.) সর্বশেষ লাঞ্চিত হন। বর্ণিত আছে যে ,এ গুণ্ডাবাহিনী তার দাড়ি মোবারক গোড়া থেকে উপড়ে ফেলে। লোকেরা তার দাড়ির এ অবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা করতো : আপনি কি দাড়ি নিয়ে খেলেছেন এবং দাড়ি উচ্ছেদ করে ফলেছেন ? তিনি উত্তর দিতেন : না। বরং শাম দেশের লোকজন আমার ওপর এ অত্যাচার করেছে। শাম দেশীয় একদল লোক আমার ঘরে প্রবেশ করে ঘরের সমস্ত আসবাব পত্র নিয়ে যায়। তারপর আরেক দল প্রবেশ করে ঘরের মধ্যে কোনো আসবাবপত্র না পেয়ে আমার দাড়ি নির্মম ভাবে উপড়ে ফেলে ,যা তোমরা প্রত্যক্ষ করছো। এ সব দুষ্ট লোক এভাবে আরো কত যে অবর্ণনীয় নিপীড়ন ও নির্যাতন চালিয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না।

এ সব জালিম অশুভ ও ভয়ঙ্কর পরিণতি থেকে মুক্তি পায়নি। বর্ণিত আছে যে ,যখন পাপিষ্ঠ মুসলিম ইবনে উকবা মদীনাবাসী থেকে জোরপূর্বক ইয়াযীদের জন্য বাইআত নিচ্ছিল ,তখন অধিকাংশ লোক ভয়ে বাইআত গ্রহণ করে আনুগত্যের স্বীকৃতি দেয়। এ সময় কুরাইশ বংশীয় একজন লোক বলে : আমি আল্লাহর আনুগত্যের ওপর বাইআত করেছি গুনাহের ওপর নয়। এ কথা বলায় মুসলিম তার বাইআত কবুল না করে তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়। তিনি যখন শহীদ হয়ে যান তখন তার মাতা আল্লাহর নামে শপথ গ্রহণ করেন ,যদি আল্লাহ তা আলা আমাকে শক্তি দান করেন ,তবে আমি এ পাপিষ্ঠ মুসলিমকে মৃত অথবা জীবিত অবস্থায় জ্বালিয়ে ফেলব।

উল্লেখ্য যে ,হতভাগা মুসলিম মদীনা মুনাওয়ারায় লুটপাট এবং হত্যাযজ্ঞ সমাপ্ত করার পর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) এর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য মক্কাভিমুখে রওয়ানা হয়ে যায়। তখন পূর্ব থেকে সে যে রোগে আক্রান্ত ছিলো তিনদিন পর সে রোগেই মৃত্যু বরণ করে জাহান্নামে পৌছে যায়। এ সময় ঐ স্ত্রীলোক তার শপথ মোতাবেক তিনজন গোলামকে সাথে নিয়ে মুসলিমের কবরে উপস্থিত হয়। যখন কবর খনন করা হয় তখন দেখা গেল যে ,একটি বিরাট সাপ তার গর্দান বেষ্টন করে নাকের হাড় চুষে খাচ্ছে। লোকেরা এ অবস্থা দর্শনে ভীত হয়ে পড়ে। তারা সকলে ঐ স্ত্রীলোককে বলল : আল্লাহ তা আলা তার অপকর্মের শাস্তি প্রদান করেছেন এবং তোমার তরফ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছেন। তাই এ শাস্তিই যথেষ্ট । ঐ স্ত্রীলোক বলল : না ,এটা হবে না। খোদার শপথ গ্রহণ করে আমি যে পণ করেছি তা যতক্ষণ পর্যন্ত আমি পূর্ণ করব না ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তাকে ক্ষমা করব না। অতঃপর স্ত্রীলোকটি বলল : তাকে তার পায়ের দিক থেকে বের কর। কিন্তু দেখা গেল- তার পায়েও অপর একটি সাপ বেষ্টন করে আছে। এরপর স্ত্রীলোকটি অজু করে দু রাকাআত নামায পড়ে আল্লাহর নিকট দোয়া করল : খোদাওন্দ করীম! আপনি জানেন ,মুসলিম ইবনে উকবার ওপর আমার রাগ একমাত্র আপনারই সন্তুষ্টির জন্য। সুতরাং আপনি আমাকে সুযোগ দিন যাতে আমি তাকে কবর থেকে বের করো জ্বালিয়ে দিতে পারি। এরপর একখণ্ড গাছের টুকরা নিয়ে সাপের লেজে আঘাত করায় সাপ চলে যায়। অতঃপর সে লাশটি কবর থেকে বের করে জ্বালিয়ে দেয়।

ওয়াকেদী বলেন : আমর যাচাই মতে উক্ত স্ত্রীলোক ছিল ইয়াযীদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে যমআ র মাতা । যখন মুসলিম ইবনে উকবা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) -এর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে মক্কায় যাচ্ছিল তখন এ স্ত্রীলোকও তার পিছনে ধাওয়া করে । যখন মুসলিমের সংবাদ তার কাছে পৌছে তখন সত্বর সে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয় এবং মুসলিম ইবনে উকবাকে কবর থেকে বের করে শূল বিদ্ধ করে ।

জাহহাক বলেন : যে সব লোক মুসলিম ইবনে উকবাকে শূল বিদ্ধ অবস্থায় দেখেছে তারাই আমার কাছে এসে বর্ণনা করেছে যে ,লোকেরা তার ওপর পাথরও নিক্ষেপ করেছে। এ রেওয়ায়েতের মধ্যে জ্বালিয়ে দেয়ার কথা নেই ,হতে পারে শূল বিদ্ধ করার দু তিন দিন পরে জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে এবং যে ব্যক্তি এ ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন সম্ভবত তিনি জ্বালিয়ে দেয়ার আগে তাকে শূলিতে দেখেছেন।

আল্লামা কুরতবী বলেন : মুসলিম ইবনে উকবা হাররার তিন দিন পর মারা যায়। মদীনা মুনাওয়ারার পথে রক্ত এবং পুজে তার পেট পরিপূর্ণ হয়ে যায়। নিতান্ত খারাপ অবস্থায় সে মৃত্যু মুখে পতিত হয়। মৃত্যুকালে সে অত্যন্ত নির্বুদ্ধিতার সাথে বলে : হে আল্লাহ ! কালেমায়ে শাহাদাতের পরে আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় নেক আমল ,যা আপনার দরবারে গ্রহণযোগ্য বলে আমার ধারণা ,তা মদীনাবাসীকে হত্যা ছাড়া আর কিছুই নেই। এখন যদি আমার এমন নেক আমল সত্বেও আপনি আমাকে দোযখে নিয়ে যান তবে আমার মতো হতভাগা আর কেউ হতে পারেনা

এর পর মুসলিম ইবনে উকবা হোসাইন ইবনে নুমাইরকে ডেকে এনে বলল : আমীরুল মু মিনীন (ইয়াযীদ ) আমার পরে তোমাকেই প্রশাসক হিসাবে নিযুক্ত করেছে। তুমি অতি সত্বর মক্কায় পৌছে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর কাজ সম্পন্ন কর। তার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে কোনোরূপ দ্বিধা করবে না। কামানের সাহায্যে পাথর নিক্ষেপ করবে। যদি সে কাবা গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করে তবে এতেও কোনো পরোয়া করো না ,কামান দাগিয়ে যাও । এ বদবখতের নির্দেশমতো হোসাইন ইবনে নুমাইর চল্লিশ দিন (অপর এক রেওয়ায়েত মতে চৌষট্টি দিন) যাবৎ মক্কা শরীফকে ঘেরাও করে রাখে এবং ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয় ,আর কা বা শরীফের দিকে কামানের গোলা ছোড়ে ।

বর্ণিত আছে যে ,এক ব্যক্তি বর্শার মাথায় আগুন লাগিয়ে সজোরে নিক্ষেপ করে এবং হঠাৎ দম্কাকা হাওয়া প্রবাহিত হওয়ায় কা বাগৃহে আগুন ধরে যায়। ইতোমধ্যে ইয়াযীদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে যে ,সে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। এ সংবাদ শ্রবণের পর শামদেশীয় এবং বনী উমাইয়্যার লোকজন চিন্তিত হয়ে পড়ে। অতঃপর সবাই অপমানের বোঝা নিয়ে পরাজয় বরণ করে পলায়ন করে ।

উল্লেখ্য যে , হাররা র ঘটনা তেষট্টি হিজরীর জিলহজ্ব মাসের সাতাশ অথবা আটাশ তারিখ বুধবারে সংঘটিত হয়। মুসলিম ইবনে উকবা চৌষট্টি হিজরীর মুহররম মাসের প্রথম তারিখে মারা যায়। মক্কার সংঘর্ষও কামানের দ্বারা বাইতুল্লাহ শরীফে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে চৌষট্টি হিজরীর তেসরা রবিউসসানী শনিবারে। হাররা র ঘটনার পর রবিউসসানীর প্রথম তারিখে ইয়াযীদের মৃত্যু হয়। সাদী কিতাবুল ওয়াফা নামক গ্রন্থে এভাবই উল্লেখ করেছেন।

অনুবাদ :মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল জববার

পীরসাহেব বায়তুশ শরফ

সৌজন্যে : জয়ুল কুলুব ইলা দিয়ারিল

মাহবুব- হযরত মাওলানা শাহ আবদুল হক দেহলভী (রহ.)

কারবালার পর পবিত্র মক্কা ও মদীনায় ইয়াযিদী তাণ্ডবলীলা

মাওলানা শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.)

[ইয়াযীদ মুসলিম জাহানের ক্ষমতারোহণ করে মাত্র সাড়ে তিন বছর রাজত্ব করে । তার দ্বারা মুসলমানদের কোনো উপকার হয়নি ;বরং যা হয়েছে তা হলো চরম দুঃখ ,লাঞ্ছনা ও লোমহর্ষক গঞ্জনা। তার সৈন্যরা প্রথম বছর কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ.) -কে বাহাত্তর জন সঙ্গী- সাথীসহ হত্যা করে ,দ্বিতীয় বছর পবিত্র মদীনা শরীফে ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে এবং তৃতীয় বছর পবিত্র মক্কা নগরীকে দু মাস ধরে অবরুদ্ধ রেখে পবিত্র কাবা গৃহে অগ্নি সংযোজন করে । এখানে আমরা কারবালার পর ইয়াযীদ বাহিনী কর্তৃক মদীনা ও মক্কায় যে হত্যালীলা ও লোমহর্ষক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল তার কিয়দংশ বর্ণনার আশা রাখি।]

কারবালায় হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর শাহাদাতের পরে মদীনায় ইয়াযীদ কর্তৃক যে লোমহর্ষক ও মর্মান্তিক ঘটনা সংঘটিত হয় এটাই হাররা র ঘটনা নামে অভিহিত। এ স্থানটি মদীনা নগরী থেকে এক মাইল দূরে অবস্থিত। মদীনা তৈয়বাতে যে সব হত্যাকাণ্ড ,সংঘর্ষ ও এ পবিত্র স্থানের অবমাননার ঘটনা ঘটেছে সে সব ঘটনা বর্ণনার দ্বারা যদিওবা পবিত্র অন্তর বিশিষ্ট লোকদের অন্তর দুঃখভারাক্রান্ত হয় ,কিন্তু হুজুর আকরাম (সা.) এ সমুদয় অঘটনের ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন ,তাই এ সম্পর্কে এখানে কিঞ্চিত আভাস দেয়া দরকার । যেমন তিনি এরশাদ করেছেন -যে ব্যক্তি মদিনাবাসীকে কষ্ট দেবে এবং ভীতসন্ত্রস্ত করবে ,সে দুনিয়া ও আখিরাতের আযাবে গ্রেপ্তার হবে । হাররা এলাকায় যে অঘটন ঘটেছে হাদিস দ্বারা এর সত্যতা প্রমাণিত হয়।

কোনো কোনো আলেম বলেছেন যে , হাররা ঘটনা এ হাদিসের দ্বারাও সত্যায়িত করা হয়। তিনি এরশাদ করেছেন-মদীনা শরীফ আবাদ হওয়ার পর আবার বিরান হয়ে যাবে ,মানুষও এ স্থান ছেড়ে চলে যাবে এবং মরু এলাকার পশুপক্ষী এখানে এসে বসবাস করবে। কিন্তু বাস্তব এই যে ,মদীনার এ অবস্থা কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে দেখা দেবে ,ইমাম নববী কথা বলেছেন। কেননা ,কোনো কোনো হাদিসে যে সমুদয় বর্ণনা পাওয়া যায় ,এতে বুঝা যায় যে , হাররা র ঘটনায় এটা পরিলক্ষিত হয়নি। যেমন- ইবনে আবি শাইবা উল্লেখ করেছেন ,এ পবিত্র নগরী চল্লিশ বছর যাবৎ বিরান হয়ে পড়ে থাকবে। তথায় হিংস্র জন্তু এবং পশু-পাখি বসবাস করবে। অতঃপর মুজনিয়া গোত্রের দু জন রাখাল এখানে এসে অবাক হয়ে পরস্পরকে বলবে ,এখানকার জনপদ কোথায় গেল ? তারা সেখানে বন্য জীবজন্তু ব্যতীত আর কিছুই দেখতে পাবে না । এতে বুঝা যায় যে ,এটা কিয়ামত পূর্বকালীন সময়ের ঘটনা হবে ।

হাররা র মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কে অনেক সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত আছে-মদীনার ওপর এমন এক সময় উপস্থিত হবে যে ,মদীনার বাসিদেরকে এ খান থেকে বের করে দেয়া হবে । সাহাবাগণ আরজ করলেন : কে তাদেরকে বের করে দেবে ? এরশাদ করলেন : আমীরগণ । বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিসে বর্ণিত আছে যে ,নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন : কুরাইশ গোত্রীয় লোকের হাতে আমার উম্মত ধ্বংস হবে । সাহাবাগণ আরজ করলেন : হে আল্লাহর রাসূল (সা.) ! তখন আমাদের জন্য কী নির্দেশ ? এরশাদ করলেন : তখন তোমাদের একাকীভাবে জীবন যাপন করা উচিত। অপর এক হাদিসেও হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত আছে যে ,হযরত (সা.) এরশাদ করেছেন : যে মহান সত্তার হাতে আমার জীবন ,তার শপথ করে বলছি ,মদীনায় এমন এক যুদ্ধ সংঘটিত হবে ,যার ফলে‘‘ দ্বীন’’ এখান থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে ,যেমন মাথা মুণ্ডনের ফলে চুল মাথা থেকে খসে পড়ে যায়। সেদিন তোমরা মদীনার বাইরে চলে যেও ,এক মনজিলের ব্যবধান হলেও । হযরত আবু হুরাইরাহ থেকে আরো বর্ণিত আছে যে ,তিনি এভাবে দোয়া করতেন : হে আল্লাহ ! আমাকে ষাট হিজরীর অঘটন এবং ছেলেদের রাজত্ব থেকে রক্ষা করুন। সে আসার পূর্বেই আমাকে দুনিয়া থেকে তুলে নিন। এতে ইয়াযীদের হুকুমতের প্রতিই ইঙ্গিত রয়েছে । কেননা ,সে ষাট হিজরীতে সিংহাসনে আরোহণ করেছে এবং হাররা র ঘটনা তারই রাজত্বকালে সংঘটিত হয়েছে।

ওয়াকেদী হাররা নামক কিতাবে আইয়ুব ইবনে বশর থেকে বর্ণনা করেছেন-রাসূল (সা.) একদা সফর করে হাররা নামক স্থানে পৌছেন ,তখন দাড়িয়ে ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়েন । এতে সাহাবাগণ মনে করলেন যে ,হয়ত সফরের পরিণতি শুভ হবে না। তাকে এ সম্পর্কে অবহিত করা হলো । হযরত ওমর (রা.) আরজ করলেন : হে আল্লাহর রাসূল (সা.) ! আপনি কী ভেবে ইন্নালিল্লাহ পড়লেন ? তিনি বললেন : হাররার এ মরু প্রান্তরে আমার সাহাবাদের পরে আমার উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদেরকে হত্যা করা হবে । অপর এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে যে ,তিনি তার হস্ত মুবারকের দ্বারা ইশারা করে বললেন : এ হাররার মরু প্রান্তরে আমার উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদেরকে হত্যা করা হবে । হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হযরত কা বে আহবার থেকে বর্ণনা করেন যে ,হযরত কাব বলতেন , তাওরাত কিতাবে বর্ণিত আছে যে ,মদীনা মুনাওয়ারার পূর্বদিকের মরু প্রান্তরে উম্মতে মুহাম্মাদীয়া (সা.) -এর এমন কতক লোক শাহাদাত বরণ করবেন ,যাদের চেহারা চৌদ্দ তারিখের চাদের আলো থেকে উজ্জ্বল । ইবনে যুবলা থেকে বর্ণিত আছে- একদা আমিরুল মু মিনীন হযরত ওমর (রা.) এর খেলাফতের আমলে খুব বৃষ্টিপাত হয়। তখন তিনি তার বন্ধু বান্ধবসহ মদীনার বাইরে ভ্রমণে বের হয়েছিলেন । যখন হাররা নামক স্থানে পৌছেন এবং দেখতে পান যে ,চতুর্দিকে পানির ঢেউ বয়ে যাচ্ছে ,তখন তার সাথী হযরত কাবে আহবার (রা.) শপথ গ্রহণ করে বললেন : এখানে যেভাবে পানির স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে ,ঠিক এমনিভাবেই এখানে রক্ত প্রবাহিত হবে । হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) সম্মুখে অগ্রসর হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , এটা কোন সময়ে হবে ? তিনি উত্তর দিলেন : হে যুবাইরের পুত্র ! তুমি এর থেকে সতর্ক থেক যেন তোমার হস্ত-পদের দ্বারা এটা সংঘটিত না হয়।

সীরাত লেখক এবং ঐতিহাসিকরা সংক্ষেপ এবং বিস্তারিতভাবে এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তাদের উদ্ধৃতিসমূহ নিম্নে পেশ করা হলো যাতে আসল ঘটনা অস্পষ্ট না থাকে।

কুরতবী বলেন : মদীনাবাসীর মদীনা থেকে বাইরে চলে যাওয়ার কারণ এ হাররা র মর্মান্তিক ঘটনা । যেমন কোনো কোনো হাদিসে বর্ণিত আছে-যে সময় মদীনা শরীফ অবশিষ্ট সাহাবা এবং তাবেয়ী দ্বারা পরিপূর্ণ এবং লোক বসতিতে ভরপুর এবং তার চিত্তাকর্ষক সাদৃশ্য বিদ্যমান তখন মদীনাবাসীর ওপর একের পর এক বিপর্যয় এবং অঘটন নেমে আসে ফলে তারা মদীনা ছেড়ে বাইরে চলে যান। পাপিষ্ঠ ইয়াযীদ মুসলিম ইবনে উকবার নেতৃত্বে শাম দেশীয় এক বিশাল সৈন্য বাহিনী যুদ্ধ করার জন্য মদীনায় প্রেরণ করে । সৈন্য বাহিনীর বদবখত লোকেরা তিন দিন পর্যন্ত মসজিদে নববীর সম্মান হানিকর কাজে লিপ্ত থাকে। এ কারনেই একে হাররা র ঘটনা বলা হয়। এটা শহর থেকে এক মাইল দূরে অবস্থিত।

এ মর্মান্তিক ঘটনার প্রাক্কালে ইয়াযীদের কুচক্রী দল শিশু এবং নারী ব্যতীত মদীনার বিশিষ্ট ও সম্মানিত বার হাজার চারশ সাতানব্বই জন লোককে হত্যা করে ।

মদীনায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে শহীদানের তালিকা

1. মুহাজির,আনসার ,তাবেয়ীন ,উলামা- 1700 জন

2. সাধারণ লোক 10 ,000 জন

3. কুরআনের হাফিজ 700 জন

4. কুরাইশ 97 জন

সর্বমোট = 12 ,497 জন

হাররাহ এ লোমহর্ষক ঘটনা ছাড়া ও ইয়াযীদের সৈন্যরা নানা প্রকার অত্যাচার ,অনাচার ও ধৃষ্টতাপূর্ণ অপকর্মে লিপ্ত হয় এবং জেনার মতো ঘৃণ্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। বর্ণিত আছে যে ,এ ঘটনার পর এক হাজার অবৈধ সন্তান প্রসব করে । এ সব পাপিষ্ঠ লোক মসজিদে নববীর অমার্জনীয় অবমাননা করে । এ পবিত্র স্থানকে তারা ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করে । হুযুর আকরাম (সা.) -এর রওজায়ে পাক এবং মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থান (যার সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে ,এখানে বেহেশতের বাগান সমূহের একটি বাগান আছে) ঘোড়ার মলমূত্র দ্বারা কলুষিত করে । আর লোকদের থেকে ইয়াযীদের জন্য এভাবে বাইআত নেয়া হয় যে ,ইয়াযীদ যদি ইচ্ছা করে ,তাদেরকে বিক্রয় করতে পারবে অথবা স্বাধীনভাবেও রাখতে পারবে। সে যদি ইচ্ছে করে আল্লাহর বন্দেগীতেও রাখতে পারবে অথবা তার নাফরমানি করারও নির্দেশ দিতে পারে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যমা (রা.) যখন ইয়াযীদকে বললেন যে ,বাইআততো অন্ততঃপক্ষে কুরআন ও সুন্নাতের ওপর গ্রহণ করা চাই। তখনই ইয়াযীদ তাকে হত্যা করে ফেলে।

ইমাম কুরতবী বলেন-ঐতিহাসিকরা লিখেছেন যে ,মদীনা মুনাওয়ারা তখন জন শূন্য হয়ে যায়। তখন মরুর পশুপাখিরা তথায় মলমুত্র ত্যাগ করত। মসজিদে নববী কুকুরের বাসস্থানে পরিণত হয়। এ সকল ঘটনা দ্বারা হুজুর (সা.) -এর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়।

তাবরানী হযরত উরওয়া ইবনে যুবাইর থেকে রেওয়ায়েত করেন যে ,হযরত মু আবিয়া (রা.) -এর ইন্তিকালের পর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) ইয়াযীদের বাইআত এবং আনুগত্য করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন এবং তার নিন্দাবাদ করতে থাকেন। ইয়াযীদ এ কথা শ্রবণে শপথ নিয়ে বলল : খোদার কসম ,আমি আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর গলায় বেড়ী পরাব। অতঃপর সে একজন দূত মারফত তাকে ডেকে পাঠায়। দূত এসে তাকে বলল : আপনি রৌপ্যের একটি ফাদ তৈরী করুন এবং ইয়াযীদের শপথ পূরণকল্পে গলার মধ্যে তা ঝুলিয়ে দিন ,আর এই ওপর স্বীয় কাপড় পরিধান করুন ,তবে আশা করি আপনি রক্ষা পাবেন। আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) বললেন : আল্লাহ তাআল কখনও তার শপথকে বাস্তবায়িত করবেন না। আমি অন্যায়ের কাছে কখনও আত্মসমর্পণ করবো না। যতক্ষণ শক্ত পাথর দাতের নিচে নরম হবে না। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) জনগণকে তার বাইআত গ্রহণ ও আনুগত্য স্বীকারের দাওয়াত দিতে লাগলেন।

এ দিকে পাপিষ্ঠ ইয়াযীদ মুসলিম ইবনে উকবার নেতৃত্বে এক বিশাল সেনাবাহিনী শাম (সিরিয়া) থেকে মদীনা অভিমুখে প্রেরণ করে । তাদেরকে সে এ নির্দেশ দিয়েছিল যে ,মদীনাকে ধ্বংস করে দেয়ার পর মক্কায় চলে যাবে এবং আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরকে হত্যা করবে। মুসলিম ইবনে উকবা যখন মদীনায় পৌছে তখন সকল সাহাবায়ে কেরাম মদীনা শরীফের বাইরে চলে গেলেন। মুসলিম ইবনে উকবা অবশিষ্ট লোকদের হত্যা করার পর মক্কা শরীফ অভিমুখে যাত্রা করল। পথিমধ্যে সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এ সময় সে হোসাইন ইবনে নুমাইর কিন্দিকে স্বীয় প্রতিনিধি নিযুক্ত করে এবং আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) -কে অবরোধ করার জন্য পবিত্র মক্কায় কামানের গোলা নিক্ষেপ এবং অগ্নিসংযোগের নির্দেশ দেয়। হোসাইন পথিমধ্যে থাকাকালেই ইয়াযীদের মৃত্যু সংবাদ পৌছে । হোসাইন পালিয়ে গেল এবং সে তার প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করতে পারল না।

ইবনে জওযী বলেন ,বাষট্টি হজরীতে ইয়াযীদ তার চাচাত ভাই উসমান ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবু সুফিয়ান তার বাইআত গ্রহণের জন্য মদীনায় প্রেরণ করে । উসমান মদীনাবাসীর একটি দলকে ইয়াযীদের নিকটে পাঠিয়ে দেন। যখন তারা ইয়াযীদের কাছ থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন ,তখন তারা ইয়াযীদকে গালিগালাজ করতে লাগলেন ও বললেন যে ,সে ধর্মদ্রোহী ,মদখোর ,ফাসিক । সে কুকুর পালন করে । এ কথা বলে তারা তার বাইআত বর্জন করলেন। ইয়াযীদের নিকট গমনকারী লোকদের মধ্যে হযরত মুনযের (রা.)ও ছিলেন । তিনি বললেন : ইয়াযীদ আমার বড় উপকার করেছে। সে আমাকে একলক্ষ দিরহাম অনুদান দিয়েছে। কিন্তু এজন্য আমি সত্যকে পরিত্যাগ করতে পারিনি। সে মদ্যপায়ী ও বেনামাযী। তার মুখ থেকে এ কথা শোনার সাথে সাথেই লোকজন তার বাইআত প্রত্যাখ্যান করে আবদুল্লাহ ইবনে হানযালার হাতে বাইআত গ্রহণ করল আর উসমানকে মদীনা থেকে বের করে দিল। আবদুল্লাহ ইবনে হানযালা (রা.) বলতেন : যদি আসমান থেকে প্রস্তর বর্ষণের আশংকা না করতাম ,তবে ইয়াযীদের বাইআত প্রত্যাখ্যান করতাম না এবং তার মোকাবিলা করার ঝুকি গ্রহণ করতাম না। ইবনে জওযী আবদুল হাসান মাদাহেনী থেকে বর্ণনা করেন যে ,ইয়াযীদের পাপাচার এবং কর্মসমূহ প্রকাশিত হওয়ার পর মদীনাবাসী মিম্বরের ওপর আরোহণ করে তার বাইআত প্রত্যাখ্যান করেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হাফস মাখযুমী মাথা থেকে পাগড়ি নিক্ষেপ করে বললেন : ইয়াযীদ আমার বড় উপকার করেছে এবং আমাকে বিশেষ অনুদানে সম্মানিত করেছে কিন্তু সে আল্লাহর শত্রু এবং মদপানে আসক্ত ব্যক্তি ;আমি তার বাইআত এভাবে প্রত্যাখ্যান করলাম যেভাবে এ পাগড়িকে নিক্ষেপ করেছি । এক ব্যক্তি দাড়িয়ে জুতা নিক্ষেপ করে তার বাইআত প্রত্যাখ্যান করল। এভাবে পাগড়ি এবং জুতাতে মজলিস ভরে গেল। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে মুতী (রা.) কে কুরাইশের এবং আবদুল্লাহ ইবনে হানযালা (রা.) কে আনসারের প্রশাসক নিযুক্ত করা হলো ।

উমাইয়্যা বংশীয় লোকদেরকে মারওয়ানের গৃহে অবরুদ্ধ করা হলো । উমাইয়্যাগণ তাদের এ দুরবস্থার সংবাদ ইয়াযীদের কাছে পাঠিয়ে সৈন্য দিয়ে সাহায্যের আবেদন জানায়। ইয়াযীদ তাদের সাহায্যার্থে মুসলিম ইবনে উকবাকে মদীনায় প্রেরণ করে । এ হতভাগা যদিও বৃদ্ধ ,কিন্তু মদীনাবাসীকে রক্ত স্রোত প্রবাহিত করার ঝুকি গ্রহণ করে । অতঃপর ইয়াযীদ এ কথাও ঘোষণা করে যে ,যে ব্যক্তি হেজাযে গমন করবে তাকে যুদ্ধের অস্ত্র-শস্ত্র এবং সফরের যাবতীয় আসবাবপত্র ছাড়াও একশ দিনার করে বখশিস দেয়া হবে । এ ঘোষণা শুনে বার হাজার লোক হেজায গমনে রাজি হয়ে গল। এ সব লোককে সেখানে প্রেরণ করে ইবনে ফারজানাকে নির্দেশ দিল যে ,তুমি তথায় গিয়ে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর সাথে যুদ্ধ কর। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন এবং বললেন , আল্লাহর শপথ ,একজন ফাসেকের সন্তুষ্টির নিমিত্তে আমি পয়গম্বর আলাইহিস সালামের একজন আওলাদের হত্যা এবং হেরেম শরীফে আল্লাহর ঘরের মধ্যে লড়াইয়ের ঝুকি নিতে পারি না। এরপর সে মুসলিম ইবনে উকবাকে সেখানে পাঠিয়ে দেয়। সে তাকে নির্দেশ দেয় যে ,যদি কোনো অঘটন ঘটে তবে হোসাইন ইবনে নুমাইরকে তোমার প্রতিনিধি নিযুক্ত করবে। সে আরও নির্দেশ দিল যে ,যার বিরুদ্ধে তোমাকে পাঠানো হচ্ছে তাকে তিনবার দাওয়াত দেবে ,যদি দাওয়াত গ্রহণ করে তবে তাকে ছেড়ে দেবে। আর যদি দাওয়াত কবুল না করে ,তবে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। বিজয় লাভ করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।

সেখানে সম্পদ ,অস্ত্র এবং খাদ্য ইত্যাদি যা কিছু পাও তা সৈন্যদের জন্য হালাল করে দাও । তিনদিন পর যুদ্ধ থেকে বিরত থাকবে। হযরত হোসাইনের পুত্র হযরত আলী ওরফে যায়নুল আবেদীনের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ো না। কেননা ,তিনি ঐ দলকে সমর্থন করেন না। যখন মদীনাবাসীর নিকট এ খবর পৌছে তখন মদীনাবাসী সমবেতভাবে ইয়াযীদের সৈন্যদের মোকাবিলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন । বনী উমাইয়্যার যে দলটি মারওয়ানের গৃহে অবরুদ্ধ ছিল ,তারা তাদের নিকট গিয়ে বললেন : তোমরা এ কথার প্রতিশ্রুতি দাও যে ,তোমরা ধোকাবাজি ,প্রতারণা এবং গোয়োন্দাগিরি করবে না এবং আমাদের শত্রুদের কোনো প্রকার সাহায্য -সহযোগিতা করবে না। তাহলেই আমরা তোমাদেরকে ছেড়ে দিতে পারি ;অন্যথায় আমরা তোমাদেরকে হত্যা করব। বনী উমাইয়্যার ঐসব লোক মুনাফিকী করে মদীনাবাসীর সাথে শামিল হয়ে মুসলিম ইবনে উকবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বেরিয়ে আসে। মারওয়ান ইবনে হাকাম গোপনে স্বীয় পুত্রকে মুসলিম ইবনে উকবার নিকট প্রেরণ করে এ কথা বলে যে ,মদীনায় পৌছে তিনদিন যেন যুদ্ধ স্থগিত রাখে। তিনদিন পর মারওয়ান মদীনাবাসীর সাথে পরামর্শ করে তাদেরকে বলল : তোমরা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ ? তারা বললেন : যুদ্ধ ব্যতীত গতি নেই।

মারওয়ান বলল : যুদ্ধ করা উচিত হবে না। এতে ফাসাদ বড়ে যাবে। ইয়াযীদের হাতে বাইআত করাই আমি সমীচীন বলে মনে করি। কিন্তু মদীনাবাসী তা পছন্দ করলো না এবং ইয়াযীদের বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার জন্য মদীনার বাইরে চলে গেলেন ।

এক দিকে আবদুল্লাহ ইবনে হানযালা (রা.) যুদ্ধের ময়দানে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন ,অপর দিকে মুসলিম ইবনে উকবা বার্ধক্য জনিত কারণে পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করে স্বীয় সেনাবাহিনীকে উৎসাহিত করছিলো। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুতী (রা.) তার সাত পুত্র সহকারে শত্রুর মোকাবিলা করে শাহাদাত বরণ করেন। মুসলিম ইবনে উকবা তার মস্তক মুবারক দ্বিখণ্ডিত করে ইয়াযীদের নিকট পাঠিয়ে দেয়। অবশেষে ইয়াযীদ বাহিনী বিজয় লাভ করে । ইয়াযীদের সৈন্য বাহিনী তার নির্দেশ মোতাবেক মদীনা মুনাওয়ারায় তিনদিন পর্যন্ত অত্যাচার ,অবিচার ও ব্যভিচার চালায় ,সম্পদ লুটপাট করে এবং জেনার মতো জঘন্য কার্যে লিপ্ত হয়।

ওয়াকেদী বলেন : যখন ইয়াযীদের সেনাবাহিনী মদীনার নিকট পৌছে তখন মদীনাবাসী পরস্পরের পরামর্শক্রমে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর মতো মদীনার চতুর্দিকে দীর্ঘ পনের দিন অত্যন্ত দুঃখ কষ্ট সহকরে পরিখা খনন করেন। মদীনার চতুর্দিকে তারকটার বেড়া লাগিয়ে দেন এবং দুশমনের পথ অবরোধ করে চতুর্দিক থেকে তাদের ওপর তীর ও পাথর নিক্ষেপ করতে থাকেন। এতে শাম বাহিনী মদীনায় প্রবেশ করতে বাধার সম্মুখীন হয়। অবস্থা বেগতিক দখে মুসলিম ইবনে উকবা ভীত হয়ে হাররা র এক কোণায় অবস্থান করে এবং মারওয়ানের নিকট এ মর্মে লোক প্রেরণ করে যে ,যুদ্ধে জয়লাভ করার কোনো একটা পথ বের করতে ,যাতে সফলকাম হওয়া যায়। মারওয়ান বনী হারেসার নিকট গমন করে তাদেরকে লোভ-লালসায় আকৃষ্ট করে মদীনার একদিকের রাস্তা খুলে দিল। ইয়াযীদের সেনাবাহিনী সে পথ দিয়ে মদীনায় প্রবেশ করে এবং মদিনাবাসী অপর দিক থেকে গুটিয়ে এসে শুধু সে দিকে এসেই যুদ্ধে লিপ্ত হন।

ইবনে আবি খাইসামা বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে ,মদীনার লোকজন বর্ণনা করেন যে ,হযরত মু আবিয়া তার মৃত্যুকালে ইয়াযীদকে ডেকে বলে ছিলেন : আমার মনে হয় মদীনাবাসীর সাথে একদিন তোমাকে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হবে । সে সময় তুমি মুসলিম ইবনে উকবার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করে নিও ! কেননা ,এ ব্যাপারে তার চেয়ে অধিক বিশ্বস্ত আর কেউ নেই। পিতার মৃত্যুর পর যখন ইয়াযীদ সিংহাসনে আরোহণ করে তখন মদিনাবাসীর সাথে তার দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়। সে পিতার নির্দেশ মতো এ সমস্যার সমাধান করে।

কথিত আছে যে ,এক বৃদ্ধা মুসলিম ইবনে উকবার নিকট এসে কেদে কেদে ফরিয়াদ করলেন : আমার পুত্র বন্দি হয়েছে ,আপনি তাকে মুক্তি দিন। সে তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দিল যে ,তার ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে তার গর্দান দু টুকরা করে যেন মায়ের হাতে তুলে দেয়া হয়। নির্দেশমত কাজ করা হলো এবং বৃদ্ধার হাতে তার পুত্রের মস্তক সোপর্দকরে তাকে বলে দেয়া হলো , তুমি নিজের জীবনের মঙ্গল না চেয়ে পুত্রকে রেহাই দানের সুপারিশ করাতেই এ পরিণতি হয়েছে।

হযরত সাঈদ ইবনে মুসায়্যেব যিনি একজন বিশিষ্ট তাবেয়ী ছিলেন তাকে মুসলিম ইবনে উকবার নিকট হাজির করা হয়। সে তাকে বলল : ইয়াযীদের বাইআত গ্রহণ কর। তিনি বললেন : আমি আবু বকর (রা.) এবং উমর (রা.) এর নীতি মোতাবেক বাইআত করেছি। এ সময় একজন লোক দাড়িয়ে বলল : এ একজন পাগল। এ কথা বলার পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। মুসলিম ইবনে উকবা হত্যাকাণ্ডে এবং ফিতনা-ফাসাদে অতিশয় সীমালঙ্ঘনকারী ছিল বিধায় স মাসরিফ (সীমালঙ্ঘনকারী) নামে অভিহিত ছিল ।

বিখ্যাত ঐতিহাসিক ওয়াকেদী তার কিতাবুল হাররা নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে ,একদা ইয়াযীদ মুসলিমের নিকট এসে দেখতে পায় যে ,সে অর্ধাঙ্গ রোগে আক্রান্ত। ইয়াযীদ তাকে লক্ষ করে বলল : যদি তুমি দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত না হতে তবে আমি তোমাকে মদীনা অভিযানে প্রেরণ করতাম । কেননা ,আমি তোমার চেয়ে আর কাউকে আমার একনিষ্ঠ ভক্ত বলে মনে করিনা । আমার শ্রদ্ধেয় পিতা মু আবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান আমাকে তার মুমূর্ষ অবস্থায় অসিয়ত করেছেন : যদি হেজাযবাসীর সাথে তোমার কোনো অঘটন ঘটে তবে তুমি মুসলিম ইবনে উকবার নিকট তোমার সমস্যার সমাধান চেয়ে নেবে’’ এ কথা শোনামাত্র মুসলিম ইবনে উকবা উঠে দাড়ায় এবং বলে : হে আমীরুল মু মিনীন! আপনাকে শপথ দিয়ে বলছি- একাজ আমি ব্যতীত আর কারও ওপর ন্যস্ত করবেন না। কেননা ,আমার থেকে মদীনাবাসীর আর কোনো বড় শত্রু নেই। এ সম্পর্কে আমি একটি স্বপ্নও দখেছি যে ,জান্নাতুল বাকীর একটি বৃক্ষের শাখা-প্রশাখাসহ হযরত উসমান (রা.) এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়ার ফরিয়াদ করছেন। আমি যখন বৃক্ষটির নিকটে যাই তখন বলতে শুনলাম ,এ কাজ মুসলিম ইবনে উকবার দ্বারাই সম্পন্ন হবে । সে দিন থেকে আমার অন্তরে এ বিশ্বাস জন্মেছে যে ,আমিই মদিনাবাসীকে হত্যা করব এবং এ আশায় মনকে সান্তনা দিয়েছি এই বলে- আমিই হযরত উসমান (রা.) -এর হত্যাকারীদের প্রতিশোধ গ্রহণ করব। যখন ইয়াযীদ মুসলিম ইবনে উকবার মধ্যে এরূপ প্রেরণা ও আগ্রহ দেখতে পেল- তখন তাকে নির্দেশ দিল : সত্বর প্রতিশোধ গ্রহণ কর এবং আল্লাহর নাম নিয়ে মদীনা অভিমুখে যাত্রা কর। যদি মদীনায় প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হও এবং বাইআত গ্রহণে মদিনাবাসী রাজি না হয় ,তবে তুমি ছোট-বড় নির্বিশেষে সকলকে হত্যা করবে। তিনদিন পর্যন্ত একাজ চালিয়ে যাবে। কাউকে বাদ দেবে না। আর তাদের ধন-সম্পদ লুটপাট করে নেবে। অবশ্য যদি তারা বাইআত স্বীকার করে তবে তাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ো না। সেখান থেকে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর কাছে চলে যাবে এবং তার কাজ সম্পন্ন করবে।

বর্ণিত আছে যে ,মদীনার হেরেমের শহীদগণকে দর্শন করে সে বলত : আমি এ সব লোককে হত্যা করার পরও যদি দোযখে যাই তবে আমার থেকে হতভাগা আর কেউ নেই।

মারওয়ানের গোলাম যাকওয়ান বলে : একদা মুসলিম ইবনে উকবা রোগের ঔষধ সেবন করার পর খাবার তলব করল। অথচ ডাক্তার তাকে নিষেধ করে ছিল যে ,ঔষধ সেবনের পর খাদ্য গ্রহণ করলে ঔষধ ক্রিয়াশীল হবে না। সে বলল : এখন আমি জীবিত থাকার আর কোনো আশা করবনা। কারণ ,আমি তো হযরত উসমান (রা.) এর হত্যাকারীদের প্রতিশোধ গ্রহণ করে এখন স্বস্তিবোধ করছি । আমার অন্তরের বাসনা পূর্ণ হয়েছে। মৃত্যু ব্যতীত এখন আমার কাছে আর কোনো কিছু প্রিয় নেই। এখন মৃত্যুই আমার কাছে সবেচেয়ে প্রিয়। আমার বিশ্বাস এ সব নাপাককে হত্যা করার ফলে আল্লাহ তা আলা আমার সমুদয় গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন’’ সৈয়দ আলাহির রহমত বলেন : তার গুনাহ মার্জনার ধারণা নিতান্ত মুর্খতা ,অজ্ঞতা ও দুর্ভাগ্যের পরিচায়ক ;কেননা ,আল্লাহর রহমত প্রাপ্ত এমন একদল বিশিষ্ট সাহাবায়ে করামকে হত্যা করা এমন এক অপরাধ ও পাপের কাজ ,যা ক্ষমা করা দূরের কথা এই অশুভ পরিণতি থেকে তার রেহাই পাওয়াও অসম্ভব ;এ তার দুঃস্বপ্ন মাত্র।

যে সব সাহাবায়ে কেরামকে মদীনায় জোরপূর্বক অমানুষিকভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন ফেরেশতা কর্তৃক গোসলপ্রাপ্ত হযরত হানযালা (রা.) -এর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ (রা.) । তিনি তার সাত পুত্রসহ শহীদ হন। আর রয়েছেন রাসূল (সা.) -এর অজুর বর্ণনা প্রদানকারী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যাইদ (রা.) ও হযরত মাকল ইবনে সিনান (রা.) ,যিনি মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে উপস্থিত ছিলেন এবং স্বীয় গোত্রের পতাকা বহন করেন।

ইবনে জওযী সনদের সূত্র ধরে সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যেব থেকে বর্ণনা করেন ,তিনি বলেছেন : হাররার অঘটনের সময়ে রাত্রিতে আমি ব্যতীত আর কেউ মসজিদে নববীতে উপস্থিত হতো না। শাম দেশীয় লোকজন আমাকে মসজিদে দেখে বলত ,এ পাগল বুড়ো! এখানে কী করছো ? প্রত্যেক নামাযের সময় রাসূলে পাক (সা.) -এর হুজরা শরীফ থেকে আযান ,ইকামাতের আওয়াজ শুনে আমি নামায পড়তাম।

হাররা র এ হৃদয় বিদারক ঘটনার প্রাক্কালে ইয়াযীদ বাহিনীর হাতে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু সাইদ খুদরী (রা.) সর্বশেষ লাঞ্চিত হন। বর্ণিত আছে যে ,এ গুণ্ডাবাহিনী তার দাড়ি মোবারক গোড়া থেকে উপড়ে ফেলে। লোকেরা তার দাড়ির এ অবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা করতো : আপনি কি দাড়ি নিয়ে খেলেছেন এবং দাড়ি উচ্ছেদ করে ফলেছেন ? তিনি উত্তর দিতেন : না। বরং শাম দেশের লোকজন আমার ওপর এ অত্যাচার করেছে। শাম দেশীয় একদল লোক আমার ঘরে প্রবেশ করে ঘরের সমস্ত আসবাব পত্র নিয়ে যায়। তারপর আরেক দল প্রবেশ করে ঘরের মধ্যে কোনো আসবাবপত্র না পেয়ে আমার দাড়ি নির্মম ভাবে উপড়ে ফেলে ,যা তোমরা প্রত্যক্ষ করছো। এ সব দুষ্ট লোক এভাবে আরো কত যে অবর্ণনীয় নিপীড়ন ও নির্যাতন চালিয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না।

এ সব জালিম অশুভ ও ভয়ঙ্কর পরিণতি থেকে মুক্তি পায়নি। বর্ণিত আছে যে ,যখন পাপিষ্ঠ মুসলিম ইবনে উকবা মদীনাবাসী থেকে জোরপূর্বক ইয়াযীদের জন্য বাইআত নিচ্ছিল ,তখন অধিকাংশ লোক ভয়ে বাইআত গ্রহণ করে আনুগত্যের স্বীকৃতি দেয়। এ সময় কুরাইশ বংশীয় একজন লোক বলে : আমি আল্লাহর আনুগত্যের ওপর বাইআত করেছি গুনাহের ওপর নয়। এ কথা বলায় মুসলিম তার বাইআত কবুল না করে তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়। তিনি যখন শহীদ হয়ে যান তখন তার মাতা আল্লাহর নামে শপথ গ্রহণ করেন ,যদি আল্লাহ তা আলা আমাকে শক্তি দান করেন ,তবে আমি এ পাপিষ্ঠ মুসলিমকে মৃত অথবা জীবিত অবস্থায় জ্বালিয়ে ফেলব।

উল্লেখ্য যে ,হতভাগা মুসলিম মদীনা মুনাওয়ারায় লুটপাট এবং হত্যাযজ্ঞ সমাপ্ত করার পর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) এর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য মক্কাভিমুখে রওয়ানা হয়ে যায়। তখন পূর্ব থেকে সে যে রোগে আক্রান্ত ছিলো তিনদিন পর সে রোগেই মৃত্যু বরণ করে জাহান্নামে পৌছে যায়। এ সময় ঐ স্ত্রীলোক তার শপথ মোতাবেক তিনজন গোলামকে সাথে নিয়ে মুসলিমের কবরে উপস্থিত হয়। যখন কবর খনন করা হয় তখন দেখা গেল যে ,একটি বিরাট সাপ তার গর্দান বেষ্টন করে নাকের হাড় চুষে খাচ্ছে। লোকেরা এ অবস্থা দর্শনে ভীত হয়ে পড়ে। তারা সকলে ঐ স্ত্রীলোককে বলল : আল্লাহ তা আলা তার অপকর্মের শাস্তি প্রদান করেছেন এবং তোমার তরফ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছেন। তাই এ শাস্তিই যথেষ্ট । ঐ স্ত্রীলোক বলল : না ,এটা হবে না। খোদার শপথ গ্রহণ করে আমি যে পণ করেছি তা যতক্ষণ পর্যন্ত আমি পূর্ণ করব না ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তাকে ক্ষমা করব না। অতঃপর স্ত্রীলোকটি বলল : তাকে তার পায়ের দিক থেকে বের কর। কিন্তু দেখা গেল- তার পায়েও অপর একটি সাপ বেষ্টন করে আছে। এরপর স্ত্রীলোকটি অজু করে দু রাকাআত নামায পড়ে আল্লাহর নিকট দোয়া করল : খোদাওন্দ করীম! আপনি জানেন ,মুসলিম ইবনে উকবার ওপর আমার রাগ একমাত্র আপনারই সন্তুষ্টির জন্য। সুতরাং আপনি আমাকে সুযোগ দিন যাতে আমি তাকে কবর থেকে বের করো জ্বালিয়ে দিতে পারি। এরপর একখণ্ড গাছের টুকরা নিয়ে সাপের লেজে আঘাত করায় সাপ চলে যায়। অতঃপর সে লাশটি কবর থেকে বের করে জ্বালিয়ে দেয়।

ওয়াকেদী বলেন : আমর যাচাই মতে উক্ত স্ত্রীলোক ছিল ইয়াযীদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে যমআ র মাতা । যখন মুসলিম ইবনে উকবা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) -এর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে মক্কায় যাচ্ছিল তখন এ স্ত্রীলোকও তার পিছনে ধাওয়া করে । যখন মুসলিমের সংবাদ তার কাছে পৌছে তখন সত্বর সে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয় এবং মুসলিম ইবনে উকবাকে কবর থেকে বের করে শূল বিদ্ধ করে ।

জাহহাক বলেন : যে সব লোক মুসলিম ইবনে উকবাকে শূল বিদ্ধ অবস্থায় দেখেছে তারাই আমার কাছে এসে বর্ণনা করেছে যে ,লোকেরা তার ওপর পাথরও নিক্ষেপ করেছে। এ রেওয়ায়েতের মধ্যে জ্বালিয়ে দেয়ার কথা নেই ,হতে পারে শূল বিদ্ধ করার দু তিন দিন পরে জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে এবং যে ব্যক্তি এ ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন সম্ভবত তিনি জ্বালিয়ে দেয়ার আগে তাকে শূলিতে দেখেছেন।

আল্লামা কুরতবী বলেন : মুসলিম ইবনে উকবা হাররার তিন দিন পর মারা যায়। মদীনা মুনাওয়ারার পথে রক্ত এবং পুজে তার পেট পরিপূর্ণ হয়ে যায়। নিতান্ত খারাপ অবস্থায় সে মৃত্যু মুখে পতিত হয়। মৃত্যুকালে সে অত্যন্ত নির্বুদ্ধিতার সাথে বলে : হে আল্লাহ ! কালেমায়ে শাহাদাতের পরে আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় নেক আমল ,যা আপনার দরবারে গ্রহণযোগ্য বলে আমার ধারণা ,তা মদীনাবাসীকে হত্যা ছাড়া আর কিছুই নেই। এখন যদি আমার এমন নেক আমল সত্বেও আপনি আমাকে দোযখে নিয়ে যান তবে আমার মতো হতভাগা আর কেউ হতে পারেনা

এর পর মুসলিম ইবনে উকবা হোসাইন ইবনে নুমাইরকে ডেকে এনে বলল : আমীরুল মু মিনীন (ইয়াযীদ ) আমার পরে তোমাকেই প্রশাসক হিসাবে নিযুক্ত করেছে। তুমি অতি সত্বর মক্কায় পৌছে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর কাজ সম্পন্ন কর। তার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে কোনোরূপ দ্বিধা করবে না। কামানের সাহায্যে পাথর নিক্ষেপ করবে। যদি সে কাবা গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করে তবে এতেও কোনো পরোয়া করো না ,কামান দাগিয়ে যাও । এ বদবখতের নির্দেশমতো হোসাইন ইবনে নুমাইর চল্লিশ দিন (অপর এক রেওয়ায়েত মতে চৌষট্টি দিন) যাবৎ মক্কা শরীফকে ঘেরাও করে রাখে এবং ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয় ,আর কা বা শরীফের দিকে কামানের গোলা ছোড়ে ।

বর্ণিত আছে যে ,এক ব্যক্তি বর্শার মাথায় আগুন লাগিয়ে সজোরে নিক্ষেপ করে এবং হঠাৎ দম্কাকা হাওয়া প্রবাহিত হওয়ায় কা বাগৃহে আগুন ধরে যায়। ইতোমধ্যে ইয়াযীদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে যে ,সে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। এ সংবাদ শ্রবণের পর শামদেশীয় এবং বনী উমাইয়্যার লোকজন চিন্তিত হয়ে পড়ে। অতঃপর সবাই অপমানের বোঝা নিয়ে পরাজয় বরণ করে পলায়ন করে ।

উল্লেখ্য যে , হাররা র ঘটনা তেষট্টি হিজরীর জিলহজ্ব মাসের সাতাশ অথবা আটাশ তারিখ বুধবারে সংঘটিত হয়। মুসলিম ইবনে উকবা চৌষট্টি হিজরীর মুহররম মাসের প্রথম তারিখে মারা যায়। মক্কার সংঘর্ষও কামানের দ্বারা বাইতুল্লাহ শরীফে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে চৌষট্টি হিজরীর তেসরা রবিউসসানী শনিবারে। হাররা র ঘটনার পর রবিউসসানীর প্রথম তারিখে ইয়াযীদের মৃত্যু হয়। সাদী কিতাবুল ওয়াফা নামক গ্রন্থে এভাবই উল্লেখ করেছেন।

অনুবাদ :মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল জববার

পীরসাহেব বায়তুশ শরফ

সৌজন্যে : জয়ুল কুলুব ইলা দিয়ারিল

মাহবুব- হযরত মাওলানা শাহ আবদুল হক দেহলভী (রহ.)


9

10