রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ

রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ16%

রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 15 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 22550 / ডাউনলোড: 3799
সাইজ সাইজ সাইজ
রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ

রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

পরিশিষ্ট-৩

কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে ছ্বাহাবী ও রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) যুগের মুনাফিক্ব্

বহুল প্রচলিত সংজ্ঞা অনুযায়ী হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ছ্বাহাবী ছিলেন তাঁরা যারা তাঁকে খুব সামান্য সময়ের জন্য হলেও ঈমানের ঘোষণার পরে তাঁকে চাক্ষুষভাবে দেখেছেন এবং মৃত্যুর আগে এ ঘোষণা পরিত্যাগ করেন নি। এছাড়া রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর উক্তি হিসেবে দাবী করে একটি খব্ রে ওয়াহেদ্ হাদীছে বলা হয়েছে যে , তিনি এরশাদ করেছেন :

اصحابی کالنجوم بایهم اقتدیتم اهتدیتم .- আমার ছ্বাহাবীরা হচ্ছে নক্ষত্রতুল্য ; তাদের মধ্য থেকে যে কাউকে অনুসরণ করলেই তোমরা হেদায়াত পাবে। ” আরেকটি খব্ রে ওয়াহেদ্ হাদীছে বলা হয়েছে যে , রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ) দশজন ছ্বাহাবীকে নামোল্লেখ করে তাঁদের জীবদ্দশায় বেহেশতের সুসংবাদ দিয়েছেন। এ দু টি খব্ রে ওয়াহেদ্ হাদীছের ভিত্তিতে , প্রচলিত সংজ্ঞার ছ্বাহাবীগণকে সমালোচনার উর্ধে গণ্য করা হয় ; এমনকি তাঁদের কারো সমালোচনা করলে সমালোচনাকারীকে কাফের বলেও ঘোষণা করা হয় , যদিও উক্ত সংজ্ঞা ও কুফরীর ফত্ওয়া ইসলামের কোনো অকাট্য জ্ঞানসূত্র (আক্ব্ল্ , কোরআন , মুতাওয়াতির্ হাদীছ ও প্রথম যুগ থেকে চলে আসা উম্মাহর মতৈক্য ভিত্তিক বিষয়াদি) থেকে গৃহীত হয় নি।

অন্যদিকে মুনাফিক্বের সংজ্ঞা কোরআন মজীদের একাধিক আয়াত্ থেকে সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। মুনাফিক্ব্ হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে মুখে ঈমানের দাবী করলেও অন্তরে ঈমানদার নয়। সুতরাং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর যুগের মুনাফিক্ব্ ছিলো সেই সব লোক যারা মুখে ঈমানের ঘোষণা দিলেও এবং বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের ন্যায় আমল করলেও অন্তরে ঈমান পোষণ করতো না ; এরা রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ) , ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর অকল্যাণ কামনা করতো , গোপনে কাফেরদের সাথে যোগাযোগ রাখতো এবং সুযোগ পেলেই রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ) , ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করতো ; নিঃসন্দেহে তাদের ও রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর ওফাতের পরে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যকার মুনাফিক্বদের এ চরিত্র ও অপচেষ্টা রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর ওফাত-পরবর্তী যুগ সমূহেও অব্যাহত থাকে।

এবার আমরা দেখবো যে , কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে ছ্বাহাবী সংক্রান্ত বহুলপ্রচলিত সংজ্ঞাটি সঠিক কিনা এবং বহুলপ্রচলিত সংজ্ঞাটি সঠিক হলে ছ্বাহাবীদের নক্ষত্রতুল্য বলে অভিহিতকারী হাদীছটি ও দশজন ছ্বাহাবীকে জীবদ্দশায় বেহেশতের সুসংবাদ প্রদানকারী হাদীছটি-যে দু টি হাদীছের ভিত্তিতে বহুলপ্রচলিত সংজ্ঞার ছ্বাহাবীদের কারো সমালোচনাকারীকে কাফের বলে ফত্ওয়া দেয়া হয়-ছ্বহীহ্ কিনা।

যারা উপরোক্ত প্রচলিত সংজ্ঞার ছ্বাহাবীদের মর্যাদা ও জীবদ্দশায় দশজন ছ্বাহাবীর বেহেশতের সুসংবাদ লাভের ধারণায় বিশ্বাসী তাঁরা সাধারণতঃ তাঁদের মতের সপক্ষে কোরআন মজীদের দু টি আয়াত্ উদ্ধৃত করে থাকেন ; একটি হচ্ছে সূরাহ্ আত্-তাওবাহর ১০০ নং আয়াত্ এবং আরেকটি হচ্ছে সূরাহ্ আল্-ফাত্ হ্-এর ২৯ নং আয়াত্।

সূরাহ্ আত্-তাওবাহর ১০০ নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

) وَالسَّابِقُونَ الأوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالأنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الأنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ(

“ আর মুহাজিরদের মধ্যকার প্রথম অগ্রবর্তীগণ ও তাদেরকে সাহায্যকারীগণ (আন্ ছ্বার্ গণ) এবং যারা (এ ব্যাপারে) তাদেরকে উত্তমভাবে অনুসরণ করেছে , আল্লাহ্ তাদের ওপর সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর (আল্লাহর) ওপর সন্তুষ্ট। আর আল্লাহ্ তাদেরকে সেই জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হচ্ছে ; তারা সেখানে চিরদিন থাকবে ; বস্তুতঃ এ এক বিরাট সাফল্য। ”

আর সূরাহ্ আল্-ফাত্ হ্-এর ২৯ নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

) مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنْهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا(

“ আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ ও যারা তাঁর সাথে আছে তারা কাফেরদের ওপর অত্যন্ত কঠোর এবং পরস্পরের প্রতি দয়াশীল তাদের মধ্যকার যারা ঈমান এনেছে ও যথাযথ আমল করেছে আল্লাহ্ তাদেরকে ক্ষমা ও বিরাট পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ”

এখানে আলোচনার শুরুতেই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে , কোরআন মজীদে বিশেষভাবে বা সুনির্দিষ্টভাবে নামোল্লেখ করে কোনো মানুষকেই জীবদ্দশায় বেহেশতের আগাম সুসংবাদ দেয়া হয় নি ; সুসংবাদ দেয়া হয়েছে ঈমান ও আমলের শর্তে সাধারণভাবে। যদিও আমরা জানি যে , নবী-রাসূলগণ ( আঃ) সহ আল্লাহর খাছ্ব বান্দাহ্ গণ-যারা আল্লাহ্ তা আলার পরিপূর্ণ আনুগত্যের ওপর ইন্তেকাল করেছেন-অবশ্যই বেহেশতে যাবেন , কিন্তু জীবদ্দশায় তাঁদের কাউকেই , এমনকি হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)কে-যাকে আল্লাহ্ তা আলা জগতসমগ্রের জন্য তথা সমগ্র সৃষ্টিকুলের জন্য রহমত্ বলে উল্লেখ করেছেন , তাঁকেও বেহেশতের আগাম সুসংবাদ দেয়া হয় নি। আল্লাহ্ তা আলা নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর উদ্দেশে এরশাদ করেন :

) قُلْ مَا كُنْتُ بِدْعًا مِنَ الرُّسُلِ وَمَا أَدْرِي مَا يُفْعَلُ بِي وَلا بِكُمْ إِنْ أَتَّبِعُ إِلا مَا يُوحَى إِلَيَّ وَمَا أَنَا إِلا نَذِيرٌ مُبِينٌ(

“ (হে রাসূল!) বলুন , আমি রাসূলদের মধ্যে কোনো অভিনব রাসূল নই এবং আমি জানি না আমার কাছে যা ওয়াহী করা হয়েছে তা ব্যতীত আমি যদি অন্য কিছুর অনুসরণ করি তাহলে আমার ও তোমাদের সাথে কী আচরণ করা হবে। আর আমি তো সুস্পষ্ট ভাষায় সতর্ককারী বৈ নই। ” (সূরাহ্ আল্-আহ্ ক্বাফ্ : ৯)

এমতাবস্থায় এটা কী করে সম্ভব যে , আল্লাহ্ তা আলা নামোল্লেখ করে দশজন ছ্বাহাবীকে বেহেশতের আগাম সুসংবাদ দিয়ে থাকবেন ? সুতরাং সংশ্লিষ্ট হাদীছটি রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর নামে রচিত একটি মিথ্যা হাদীছ তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

এখানে বিস্তারিত আলোচনার মতো অবকাশ নেই। তা সত্ত্বেও সংক্ষেপে এতোটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট বলে মনে হয় যে , যেহেতু মানুষকে আল্লাহর গুণাবলী দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আল্লাহ্ তা আলা নিরঙ্কুশ স্বাধীন সেহেতু যে কোনো মানুষের পক্ষেই নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ভোগ করতে চাওয়া অর্থাৎ আল্লাহর আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করে বসা অসম্ভব নয় , এমনকি নবী-রাসূলগণের ( আঃ) পক্ষেও নয়। উপরোদ্ধৃত আয়াতে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)কে যে বলতে বলা হয়েছে আমার কাছে যা ওয়াহী করা হয়েছে তা ব্যতীত আমি যদি অন্য কিছুর অনুসরণ করি ” -এতেই এ সত্য নিহিত রয়েছে যে , তাঁর নাফরমানী করার ক্ষমতা বিলুপ্ত করা হয় নি।

এর সাথে অবশ্য ইছ্বমাত্ (নিষ্পাপত্ব)-এর কোনো সাংঘর্ষিকতা নেই। কারণ , নবী-রাসূলগণ ( আঃ) ও আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমামগণের ( আঃ) নিষ্পাপত্বের মানে এই নয় যে , তাঁদের মধ্য থেকে গুনাহ্ করার ক্ষমতা বিলুপ্ত করে দেয়া হয়েছে। তাহলে তো তাঁরা ফেরেশতা সমতুল্য হয়ে যেতেন এবং সে ক্ষেত্রে তাঁদের মাধ্যমে আমাদের জন্য আল্লাহ্ তা আলার হুজ্জাত্ পূর্ণ হতো না। কারণ , সে ক্ষেত্রে তাঁদেরকে আমাদের জন্য অনুসরণযোগ্য হিসেবে নির্ধারণ করা আল্লাহ্ তা আলার সুবিচারের ছ্বিফাতের বরখেলাফ হতো। তাই তাঁদের ইছ্বমাতের স্বরূপ হচ্ছে এই যে , তাঁদের মধ্য থেকে নাফরমানীর ক্ষমতা বিলুপ্ত না করা সত্ত্বেও রক্তধারার পবিত্রতা , জন্মের পর থেকেই পূতপবিত্র জীবনের অভ্যস্ততা ও খোদায়ী ওয়াহীর জ্ঞানের কারণে , বিশেষতঃ ইল্ মে হুযূরীর কারণে , তাঁরা ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর নাফরমানী থেকে দূরে থাকেন।

এখানে বিষয়টি অত্যন্ত সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। তা হচ্ছে , মা ছূম্ ” একটি পরিভাষা ; ওপরে যে অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে সে অর্থেই নবী-রাসূলগণ ( আঃ) ও আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমামগণ ( আঃ) মা ছূম্ ছিলেন , নচেৎ শব্দটি যদি অক্ষরিকভাবে নিষ্পাপ ’ অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে গুনাহ্ করার ক্ষমতা আছে এমন কোনো ব্যক্তিকেই জীবদ্দশায় মা ছূম্ বলে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। যদিও নবী-রাসূলগণ ( আঃ) ও আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমামগণ ( আঃ) গুনাহ্ করার ক্ষমতা ও এখতিয়ারের অধিকারী থাকা সত্ত্বেও তাঁদের অবস্থার আলোকে এটা সুস্পষ্ট যে , বাস্তবে তাঁদের পক্ষে গুনাহ্ করার সম্ভাবনা ছিলো এতোই ক্ষীণ যে , তা শতাংশের ভগ্নাংশেও প্রকাশ করা সম্ভব নয় , তথাপি যেহেতু তাঁরা এ ব্যাপারে অক্ষম ছিলেন না সেহেতু প্রচলিত পারিভাষিক অর্থে তাঁরা অবশ্যই মা ছূম্ ছিলেন এবং তাঁরা যে বেহেশতে যাবেন এ ব্যাপারে মানুষের পক্ষে সন্দেহ করার বিন্দুমাত্র কারণ ছিলো না , বরং নির্দ্বিধায় বলা সম্ভব ছিলো যে , তাঁরা অবশ্যই বেহেশতে যাবেন এবং বেহেশতবাসীদের মধ্যে অগ্রবর্তী হবেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে তাঁদেরকে বেহেশতী হিসেবে অগ্রিম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া সম্ভবপর ছিলো না।

বিষয়টি মানুষের আচরণ থেকে দৃষ্টান্তের মাধ্যমেও অনুধাবন করা যেতে পারে। তাঁদের ইছ্বমাতের (নিষ্পাপত্বের) দৃষ্টান্ত হচ্ছে অত্যন্ত উন্নত রুচিবোধসম্পন্ন ব্যক্তির ন্যায় যিনি চরম ক্ষুধার্ত অবস্থায়ও ফুটপাতে খোলা অবস্থায় বিক্রি করা হয় এমন খাবার খান না। এহেন ব্যক্তি যদি এমন অবস্থার মুখোমুখি হন যে , ক্ষুধার কারণে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন এবং সেখানে খাবার মতো কিছুই নেই এমতাবস্থায় তিনি যদি কোথাও মানুষের মল পেয়ে যান এবং জানেন যে , তাতে পুষ্টি আছে বলেই কুকুর তা খায় , সুতরাং তা খেয়ে জীবন বাঁচানো সম্ভব , তথাপি তিনি তা খেয়ে জীবন বাঁচাবেন এমন সম্ভাবনা বিন্দুমাত্রও আছে বলে আমরা মনে করি না। কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে ও আক্ষরিকভাবে তাঁর পক্ষে তা খাওয়া অসম্ভব বলা যাবে না। সুতরাং এ বিষয়টির ওপরে কোনো বুদ্ধিমান মানুষ বাযী (ধরুন বিলিয়ন ডলারের) ধরবেন না।

আর মানুষের পক্ষ থেকে মা ছূমগণকে ( আঃ) জীবদ্দশায় বেহেশতী বলে অভিহিত করা ও আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদেরকে বেহেশতের প্রতিশ্রুতি না দেয়ার উপমা হচ্ছে একজন ব্যতিক্রমী প্রতিভাবান ছাত্রের ন্যায় যার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক ও আশেপাশের লোকদের সকলেই নিশ্চয়তার সাথে জানে যে , বরাবরের মতো আগামী পরীক্ষায়ও সে প্রথম হবে এবং নতুন ক্লাসে তার ক্রমিক নম্বর হবে এক ’ , তাই তারা নিশ্চয়তার সাথে বলে যে , আগামী বছরের ক্লাসে সে-ই প্রথম ছাত্র ’ , তথাপি স্কুলের প্রধান শিক্ষক পরীক্ষা গ্রহণ সমাপ্ত হবার আগে পরবর্তী বছরের ছাত্রহাযিরা খাতায় তার নাম প্রথম ক্রমিকে তুলে রাখবেন না। কারণ , তা করলে ঐ ছাত্রের পক্ষে আলসেমি বা দুষ্টামি করে হলেও পরীক্ষা দেয়া হতে বিরত থাকা অসম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষকের উক্ত কাজ হবে তাঁর পদমর্যাদার অনুপযোগী একটি ভ্রান্ত পদক্ষেপ।

একইভাবে নবী-রাসূলগণ সহ মা ছূমগণকে ( আঃ) যদি জীবদ্দশায় বেহেশতের সুসংবাদ দেয়া হতো তাহলে তাঁদের পক্ষে মানুষের মধ্যে নিহিত নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার ঐশী গুণের ব্যবহার করে আল্লাহর নাফরমানী করে বসা অসম্ভব হতো না। আর যেহেতু আল্লাহ্ তা আলা ওয়াদা বরখেলাফ করেন না সেহেতু নাফরমানী করলেও তাঁদেরকে বেহেশতে নিতে হতো। কিন্তু কোনো নবী গুনাহর কাজ করলে বান্দাহ্ দের জন্য খোদায়ী হুজ্জাত পূর্ণ হতো না , কারণ , মুখ্ লিছ্ব লোকদের পক্ষেও এ ধরনের নবীর নবুওয়াতের ব্যাপারে ইয়াক্বীনের অধিকারী হওয়া সম্ভব হতো না। তাই , এ কালের পরিভাষায় বলা যেতে পারে যে , আল্লাহ্ তা আলা কোনো নবীকে ব্লাঙ্ক চেক্ দেন নি। তাহলে তা দশজন ছ্বাহাবীকে কী করে দেয়া হতে পারে ?

এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হয়েছে যে , ইসলামের সকল ধারার হাদীছগ্রন্থে বর্ণিত হাদীছ্ অনুযায়ী নবী করীম (ছ্বাঃ) যে হযরত ফাত্বেমাহ্ (সালামুল্লাহ্ আলাইহা)কে বেহেশতে নারীদের নেত্রী ’ এবং হযরত ইমাম হাসান্ ও হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)কে বেহেশতে যুবকদের নেতা ’ বলে উল্লেখ করেছেন তার ব্যাখ্যা কী ?

এর ব্যাখ্যাও ওপরের আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট। এটা স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক ও আশেপাশের লোকদের পক্ষ থেকে পরীক্ষার আগেই কোনো ছাত্রকে পরবর্তী ক্লাসের প্রথম ছাত্র ’ হিসেবে উল্লেখ করার ন্যায় আক্ষরিকভাবে ও সন্দেহাতীতভাবে সত্য , তবে তাতে ঠিকভাবে পরীক্ষা দেয়া সাপেক্ষে ’ শর্তটি উহ্য থাকে এবং এর মানে এ নয় যে , প্রধান শিক্ষক তার নাম পরীক্ষা সমাপ্ত হবার আগেই পরবর্তী বছরের ছাত্রহাযিরা খাতায় তুলে রেখেছেন।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি যে , আমি হাদীছের বিরোধী নই ; যারা নিঃশর্তভাবে সমস্ত হাদীছই প্রত্যাখ্যান করে তাদের বিরুদ্ধে আমি লিখেছি এবং তা পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। কিন্তু আমার বক্তব্য হচ্ছে এই যে , প্রচলিত হাদীছগ্রন্থ সমূহ হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ওফাতের দুই শতাধিক বছর পরে সংকলন করা হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ে মুখে মুখে বহু স্তরে একেকটি হাদীছ বর্ণিত হয়ে এরপর সংকলক পর্যন্ত পৌঁছেছে। সংকলকগণ নিজেরাও মিথ্যা হাদীছের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন এবং তাঁরা যে সব হাদীছ সংগ্রহ করেছেন সেগুলোর মধ্য থেকে লক্ষ লক্ষ হাদীছকে মিথ্যা , বিকৃত , পরিবর্তিত ও দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁদের হাদীছসংকলন সমূহে স্থান দেয়া থেকে বিরত থাকেন। এমতাবস্থায় তাঁরা বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যে সব হাদীছকে ছ্বহীহ্ মনে করে তাঁদের সংকলনে স্থান দিয়েছেন সে সবের মধ্যেও বহু জাল ও বিকৃত হাদীছ থেকে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ , তাঁরা নবী-রাসূল ও খোদায়ী ওয়াহীপ্রাপ্ত ছিলেন না এবং তাঁরা নবী-রাসূলগণের ( আঃ) ন্যায় মা ছূম্ ছিলেন না। সুতরাং তাঁরা আমাদের মতোই গুনাহ্ ও ভুলের উর্ধে ছিলেন না যে , তাঁদের কাজ অবশ্যই নির্ভুল হবে।

অন্যদিকে মুসলমান হওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর ওপর ঈমান আনা শর্ত , এ ব্যক্তিদের ওপর ঈমান আনা শর্ত নয়। তেমনি যদিও রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর দ্বীন ও শরী আত্ সংশ্লিষ্ট এবং আদর্শিক , শিক্ষামূলক ও তথ্যমূলক যে কোনো কথাই ওয়াহী (মাত্ লূ বা গ্বায়রে মাত্ লূ) হিসেবে মেনে নেয়া যরূরী , কিন্তু তাঁর কথা হিসেবে দাবী করে বলা হয়েছে অন্য লোকদের এ ধরনের যে কোনো কথাকেই তাঁর কথা বলে মেনে নেয়া একটি ভ্রান্ত ও অসতর্ক কর্মনীতি এবং তা দ্বীন ও ঈমানের জন্য খুবই ঝুঁকির ব্যাপার। তাই খব্ রে ওয়াহেদ অর্থাৎ কোনো না কোনো স্তরে , বিশেষ করে প্রথম দিককার কোনো স্তরে কম সূত্রে বর্ণিত হাদীছ অবশ্যই কেবল চার অকাট্য দলীল (আক্বল্ , কোরআন , মুতাওয়াতির্ হাদীছ ও প্রথম যুগ থেকে সমগ্র উম্মাহর মতৈক্যভিত্তিক বিষয়াদি)-এর সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়া সাপেক্ষে কেবল গৌণ (মুস্তাহাব্ ও মাক্ রূহ্) ও প্রায়োগিক বিষয়াদিতে গ্রহণযোগ্য।

এবার আমরা ছ্বাহাবীদের সংজ্ঞা ও মর্যাদার প্রতি দৃষ্টি দেবো।

কেউ ঈমানের ঘোষণা সহকারে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)কে চাক্ষুষভাবে এক নযর দেখে থাকলে তিনিই ছ্বাহাবী-বহুলপ্রচলনকৃত এ সংজ্ঞাকে সঠিক বলে গ্রহণ করা হলে বলতে হবে ছ্বাহাবী ” স্রেফ একটি জনগোষ্ঠীর কালিক পরিচয় মাত্র ; ছ্বাহাবী হওয়ার মধ্যে কোনো বিশেষ ফযীলত্ নিহিত নেই। কারণ , রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)কে চাক্ষুষভাবে এক নযর দেখা এমন কোনো কাজ নয় যা কাউকে আল্লাহ্ তা আলার আদেশ-নিষেধের অনুবর্তিতার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। কারণ , ছ্বাহাবীর এ সংজ্ঞা কোরআন মজীদে বা মুতাওয়াতির হাদীছে আসে নি এবং এ ব্যাপারে সমগ্র উম্মাহর মধ্যে মতৈক্য (ইজমা )ও নেই। আর আক্বল্ ও এটা গ্রহণ করে না। এ সংজ্ঞা আপনার-আমার মতো মানুষের দেয়া যারা ভুল ও স্বার্থের উর্ধে ছিলেন না।

অন্যদিকে ছ্বাহাবী হওয়াকে যদি ফযীলতের ব্যাপার বলে গণ্য করতে হয় তাহলে এ সংজ্ঞা প্রত্যাখ্যাত এবং ছ্বাহাবীর সংজ্ঞা নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে। সংক্ষেপে তা হচ্ছে , যারা অন্তরে ও মুখে ঈমান এনেছিলেন এবং তদনুযায়ী আমল করতেন ও ইখলাছ্বের সাথে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)কে ভালোবাসতেন তাঁকে চাক্ষুষভাবে দর্শনকারী এমন ব্যক্তিগণই ছ্বাহাবী। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর সাথে কারো বাহ্যিক সাহচর্য (মা য়িয়াতে জিস্ মানী)ই কাউকে তাঁর ছ্বাহাবীতে পরিণত করে নি , বরং কেবল তাঁকে চাক্ষুষভাবে দর্শনকারী কোনো ব্যক্তির তাঁর সাথে আত্মিক সাহচর্য (মা য়িয়াতে রূহানী)ই তাঁকে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর ছ্বাহাবীতে পরিণত করে।

সূরাহ্ আল্-ফাত্ হ্-এর ২৯ নম্বর আয়াতে ওয়াল্লাযীনা মা আহু ” বলতে দৃশ্যতঃ মা য়িয়াতে জিস্ মানী বুঝানো হয়েছে বলে তাৎপর্য গ্রহণের সুযোগ আছে বটে , তবে আল্লাহ্ তা আলা ক্ষমা ও বিরাট পুরষ্কারের ’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কেবল তাঁদেরকে যারা তাঁর সাথে মা য়িয়াতে জিস্ মানী ও মা য়িয়াতে রূহানী এ উভয় ধরনের সাহচর্য রক্ষা করতেন। কারণ , আয়াতের শেষাংশে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেয়া হয়েছে : তাদের মধ্যকার যারা ঈমান এনেছে ও যথাযথ আমল করেছে তাদেরকে ক্ষমা ও বিরাট পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ”

এ থেকে এটাও সুস্পষ্ট যে , নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর বাহ্যিক সহচরদের মধ্যে এমন কিছু লোকও ছিলো দৃশ্যতঃ যারা বর্ণিত সকল গুণের আধার হলেও তাদের অন্তরে ঈমান ছিলো না , বরং তারা কোনো বিশেষ কারণে বা বিশেষ উদ্দেশ্য হাছ্বিলের লক্ষ্যে ঈমানের ঘোষণা দিয়েছিলো এবং বাহ্যিকভাবে প্রকৃত ছ্বাহাবীদের ন্যায়-যারা আন্তরিকতার সাথে ঈমান এনেছিলেন-আমল করতো ।

এছাড়াও আয়াতের শুরুর দিকে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর সহচরদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে , তারা কাফেরদের ওপর অত্যন্ত কঠোর এবং পরস্পরের প্রতি দয়াশীল ” । কিন্তু পরবর্তীকালে যখন একাধিক বার এরূপ ঘটেছে যে , তাঁরা পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন ও পরস্পরকে হত্যা করেছেন , তখন নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যকার একদল প্রকৃত ঈমান পোষণকারী ও যথাযথ আমল সম্পাদনকারী ” ছিলো না অর্থাৎ মুনাফিক্ব্ ছিলো যা-দেরীতে প্রকাশ পায়।

সূরাহ্ আত্-তাওবাহর ১০০ নং আয়াতের দলীল উপস্থাপন প্রসঙ্গে বিনয়ের সাথে বলতে চাই যে , কোরআন মজীদ এবং তাঁর সূরাহ্ সমূহ ও আয়াত সমূহ থেকে সঠিক অর্থ গ্রহণের জন্য কিছু পূর্বপ্রস্তুতির (মুক্বাদ্দামাত্) শর্ত আছে ; কেবল তরযমার ওপর নির্ভর করা যথেষ্ট নয় , এমনকি কেবল আরবী ভাষা জানা থাকাও কোরআন থেকে অর্থ গ্রহণের জন্য যথেষ্ট নয়। যেহেতু কোরআন মজীদ একটি একক পূর্ণাঙ্গ সত্তা তাই এর অংশগুলো পরস্পর সম্পৃক্ত এবং এর একেকটি অংশ অপর এক বা একাধিক অংশকে ব্যাখ্যা করে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সমস্ত পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করার অবকাশ এখানে নেই। এখানে শুধু একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই , তা হচ্ছে , কোরআন মজীদে অনেক আয়াতে সাধারণ ” ( আম্) বক্তব্য পেশ করা হয়েছে এবং অন্য আয়াতে হয়তো তার তাৎপর্যকে সীমিত করা (তাখ্ ছ্বীছ্ব) করা হয়েছে। সূরাহ্ আত্-তাওবাহর ১০০ নম্বর আয়াত্ টি এ ধরনের একটি সাধারণ তথ্য সম্বলিত আয়াত্। এতে সাধারণভাবে ‍মুহাজেরিন ও আন্ ছ্বারদের মধ্যকার অগ্রবর্তীদের কথা বলা হয়েছে যাদের মধ্যে ব্যতিক্রম থাকা অসম্ভব নয়। কারণ , যে কোনো উত্তম জনগোষ্ঠীর মধ্যেই অনুপ্রবেশকারী থাকতে পারে। তাছাড়াالسَّابِقُونَ الأوَّلُونَ কতোজন ও কারা ছিলেন সে সম্পর্কে অকাট্য দলীলে , বিশেষতঃ কোরআন মজীদে সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত নেই। তাছাড়া হিজরত ও সাহায্যকরণের ব্যাপারে তাঁদের অনুসরণকারীদের বেলায়بِإِحْسَانٍ শর্ত যোগ করা হয়েছে এবং সে ক্ষেত্রেও তাঁরা ক জন ও কে কে তা কোনো অকাট্য দলীল থেকে জানা যায় না।

অন্যদিকে কোরআন মজীদে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর যুগের যে মুনাফিক্ব্ দের কথা বলা হয়েছে তাদের সকলেই ছিলো ঈমানের ঘোষণা সহ তাঁকে দর্শনকারী তথা প্রচলিত সংজ্ঞার ছ্বাহাবী। কারণ , আল্লাহ্ তাআলা এরশাদ করেছেন :

) إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُونَ قَالُوا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ اللَّهِ(

“ (হে রাসূল!) মুনাফিক্ব্ রা যখন আপনার কাছে আসবে তখন বলবে , আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে , অবশ্যই আপনি আল্লাহর রাসূল। ” (সূরাহ্ আল্-মুনাফিক্বুন্ : ১) অতএব , তাদের ঈমানের ঘোষণা সহ রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)কে চাক্ষুষভাবে দেখার ব্যাপারে সন্দেহ নেই।

প্রশ্ন হচ্ছে , মুনাফিক্বরা সংখ্যায় ক জন ছিলো ?

প্রণিধানযোগ্য যে , সূরাহ্ আত্-তাওবাহর উক্ত ১০০ নম্বর আয়াতের পরেই অর্থাৎ ১০১ নম্বর আয়াতেই এদের বিরাট সংখ্যার ব্যাপারে আভাস দেয়া হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

) وَمِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِنَ الأعْرَابِ مُنَافِقُونَ وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ مَرَدُوا عَلَى النِّفَاقِ لا تَعْلَمُهُمْ نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ(

“ আর তোমাদের আশেপাশে যারা আছে তাদের মধ্যকার আরবদের মধ্যে মুনাফিক্বরা আছে এবং মদীনাহ্ বাসীদের মধ্যেও (মুনাফিক্বরা আছে)-যারা নেফাক্বের ওপরে খুবই কঠোর। (হে রাসূল!) আপনি তাদেরকে (মুনাফিক্ব হিসেবে) চিনেন না , কিন্তু আমি তাদেরকে চিনি। ”

অনেকে অবশ্যأعْرَابِ -এর মানে করেন (বেদুঈন বা যাযাবর আরব) যদিওأعْرَابِ হচ্ছেعرب শব্দের বহুবচন এবংأعْرَبِ মানে বিশুদ্ধ আরব বা বেদুঈন যাযাবর আরব। এমনকি যদি বেদুঈন বা যাযাবর আরব ’ অর্থকেই সঠিক বলে ধরা হয় তাতেও পার্থক্য হচ্ছে না। কারণ , তারা ঈমানের ঘোষণা প্রদানকারী ছিলো এবং এ কারণে ছ্বাহাবী হিসেবে পরিচিত ছিলো। অর্থাৎ মুহাজির ও আন্ ছ্বার নির্বিশেষে তৎকালীন মুসলমানদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক মুনাফিক্ব লুকিয়ে ছিলো। আর এই বিপুল সংখ্যক মুনাফিক্বের মধ্যে কেবল আব্ দুল্লাহ্ ইব্ নে উবাই সহ দু চার জন ছাড়া অকাট্যভাবে আর কাউকেই মুনাফিক্ব্ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় নি এবং এদের সকলেই ছ্বাহাবী হিসেবে পরিচিত।

এছাড়া মক্কাহ্ বিজয়ের দিনে যারা পরিস্থিতির চাপে পড়ে ঈমানের ঘোষণা দিয়েছিলো তাদের ঈমান আল্লাহ্ তা আলা কবূল করেন নি (সূরাহ্ আস্-সাজদাহ্ : ২৮-২৯) । কিন্তু তারাও ছ্বাহাবী হিসেবে পরিচিত হয়েছে।

সুতরাং ছ্বাহাবীর প্রচলিত সংজ্ঞাকে মানলে ছ্বাহাবী হওয়াকে কোনো ফযীলতের ব্যাপার বলে গণ্য করা চলে না। অতএব , তাঁদের কাজকর্ম বিচার করে তাঁদের প্রত্যেকের অবস্থা সম্বন্ধে আলাদা আলাদা ভাবে ধারণা নিতে হবে। আর ছ্বাহাবী হওয়াকে ফযীলতের ব্যাপার বলে গণ্য করতে হলে ছ্বাহাবীর সংজ্ঞা পরিবর্তন করতে হবে এবং তৎকালীন লোকদের আমল বিচার করে কে ছ্বাহাবী ও কে নয় তা নির্ধারণ করতে হবে।

মক্কাহ্ বিজয়ের দিনে ঈমান

সূরাহ্ আস্-সাজদাহর ২৮ ও ২৯ নং আয়াতের ভিত্তিতে মক্কাহ্ বিজয়ের দিনে যারা পরিস্থিতির চাপে পড়ে ঈমানের ঘোষণা দিয়েছিলো তাদের ঈমান আল্লাহ্ তা আলা কবূল করেন নি ’ -এ অভিমতের সাথে অনেকের দ্বিমত আছে , বিশেষ করে এ কারণে যে , কোনো কোনো তাফসীরে ও রেওয়াইয়াতে ২৯ নং আয়াতেরيَوْمَ الْفَتْحِ কথাটির অর্থ করা হয়েছে ফয়ছ্বালার দিন ’ অর্থাৎ শেষ বিচারের দিন। তাই এ বিষয়ে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে হয়।

উক্ত আয়াতদ্বয়ে এরশাদ হয়েছে :

) وَيَقُولُونَ مَتَى هَذَا الْفَتْحُ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ. قُلْ يَوْمَ الْفَتْحِ لا يَنْفَعُ الَّذِينَ كَفَرُوا إِيمَانُهُمْ(

“ আর তারা বলে: এ বিজয় কখন (আসবে) যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো ? (হে রাসূল!) বলুন , বিজয়ের দিনে কাফেরদের ঈমান তাদেরকে কোনো কল্যাণ দেবে না। ”

কোরআন মজীদ প্রধানতঃ তার সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফাছ্বাহাত্-বালাগ্বাতের কারণে মু ’ জিযাহ্। আর ফাছ্বীহ্ ও বালীগ্ব বক্তার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে , যে কথা ও শব্দ তাঁর উদ্দেশ্য বুঝাবার জন্য সর্বাধিক উপযোগী তা-ই তিনি ব্যবহার করবেন। অন্যদিকে বহু অর্থবোধক শব্দের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ অর্থ বুঝাবার নিদর্শন না থাকলে বহুল প্রচলিত অর্থটিই গ্রহণ করতে হবে।

“ ফয়ছ্বালা ” শব্দটিও আরবী এবং কোরআন মজীদে শেষ বিচারের দিন বুঝাতে বেশ কয়েক জায়গায়يوم الفصل ব্যবহৃত হয়েছে। এমতাবস্থায় আলোচ্য আয়াতদ্বয়ে (সূরাহ্ আস্-সাজদাহ্: ২৮-২৯) আল্লাহ্ তা আলা ফয়ছ্বালার দিন ” বুঝাতে চাইলে ফাছ্বাহাত্-বালাগ্বাতের দাবী অনুযায়ীيوم الفصل ব্যবহার করতেন।

অন্যদিকে ঈমান আনয়ন ” কথাটি শেষ বিচারের দিনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় যে , মনে করতে হবে , তারা সেখানে ঈমান আনবে , কিন্তু তা কাজে লাগবে না। আর যদি দুনিয়ার বুকে ঈমান আনে এবং আল্লাহর কাছে তাদের ঈমান আনয়ন কবূল হয় তো শেষ বিচারের দিনে কাফেরদের ঈমান কল্যাণ দেবে না ” উল্লেখ করার প্রশ্ন ওঠে না। সুতরাং এর মানে একটাই যে , যে সব কাফের (মক্কাহ্-)বিজয়ের দিনে নিরুপায় হয়ে জীবন বাঁচানোর লক্ষ্যে ঈমানের ঘোষণা দিয়েছিলো তাদের ঈমান প্রকৃত ঈমান নয় এবং এ কারণে তা আল্লাহ্ তা আলার কাছে কবূল হয় নি। আর ইসলামের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে , এ ধরনের লোকেরা ইসলামী উম্মাহর জন্য বিরাট বিপর্যয়ের কারণ হয়েছিলো এবং তা যে তাদের নেফাক্বের কারণে হয়েছিলো তাতে সন্দেহ নেই।

মা ছূমগণের ( আঃ) প্রশ্নে ইত্ মামে হজ্জাত্ বনাম নেফাক্ব্

এখানে বিভ্রান্তি এড়ানোর লক্ষ্যে একটি বিষয়ে আলোকপাত করা যরূরী মনে করছি। এটা অনস্বীকার্য ঐতিহাসিক সত্য যে , হযরত রাসূলের আকরাম (ছ্বাঃ)-এর জীবদ্দশায় ঈমানের ঘোষণা প্রদানকারী কোনো কোনো লোক তাঁর কোনো কোনো কথা বা সিদ্ধান্তকে সঠিক নয় ’ বলে মত প্রকাশ করেছেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁর আদেশ বা সিদ্ধান্ত অমান্য করেছেন। অন্যদিকে এ-ও অনস্বীকার্য ঐতিহাসিক সত্য যে , নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের পর তৎকালীন মুসলমানদের বেশীর ভাগই প্রথমেই আহ্ লে বাইতের ( আঃ) অন্যতম মা ছূম ব্যক্তিত্ব হযরত আলী (আঃ)-এর নেতৃত্ব মেনে নেন নি এবং কেউ কেউ তাঁদের সাথে শত্রুতা-বিদ্বেষের পরিচয় দেয় , এমনকি আরো পরে কতক লোক তাঁদের ওপর যুলুম-নির্যাতন চালায় ও তাঁদের অনেককে হত্যা করে। প্রশ্ন হচ্ছে , এরা কি মুসলমান ছিলো , নাকি মুনাফিক্ব ছিলো ?

এ ব্যাপারে সংক্ষেপে বলতে হয় যে , বিষয়টি ইত্ মামে হুজ্জাত্ ও সতর্কতার নীতির দৃষ্টিতে দেখতে হবে। (ইত্ মামে হুজ্জাত্ ও সতর্কতার নীতি সম্পর্কে আমি স্বতন্ত্র প্রবন্ধে অপেক্ষাকৃত বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি।) তা হচ্ছে , যে ব্যক্তি ইখ্ লাছ্বের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত নবী বা ইমামের ( আঃ) পরিচয় ইয়াক্বীন্ সৃষ্টিকারী পর্যায়ে অকাট্যভাবে লাভ না করার কারণে তাঁকে নবী বা ইমাম হিসেবে গ্রহণ করে নি এ জন্য তাকে পাকড়াও হতে হবে না , বরং তাওহীদ ও আখেরাতে ঈমান এবং আমলে ছ্বালেহর কারণে এমন ব্যক্তি নাজাত্ লাভ করবেন , তবে এরূপ ব্যক্তি ইখ্ লাছ্বের অধিকারী হলে অন্ততঃ পূতচরিত্র ব্যক্তি হিসেবে নবী বা ইমামের ( আঃ) সরাসরি বিরোধিতা করা হতে বিরত থাকবেন। অন্যথায় অবশ্যই তাকে পাকড়াও হতে হবে।

হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ওফাতের পর মুসলমানদের আচরণকে এর আলোকেই বিবেচনা করতে হবে। অর্থাৎ মা ছূম্ ইমামের ( আঃ) মা ছূম্ ও আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমাম হবার ব্যাপারে যাদের জন্য ইত্ মামে হুজ্জাত্ না হওয়ার কারণে তাঁকে গ্রহণ করেন নি কিন্তু তাঁর সহ আহ্ লে বাইত ও আলে মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর সাথে প্রকাশ্য বিরোধিতা ও শত্রুতা-বিদ্বেষের আশ্রয় নেন নি তাঁদেরকে কিছুতেই মুনাফিক্ব্ বলা যাবে না। আর যদি বিষয়টি এমন হয় যে , তাঁদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি এ ব্যাপারে ইত্ মামে হুজ্জাত্ হওয়া সত্ত্বেও কোনো পার্থিব স্বার্থে সুবিধাবাদী নীতির কারণে তাঁদেরকে স্বীকার করা হতে বিরত থেকে থাকে , কিন্তু প্রকাশ্য বিরোধিতা ও শত্রুতা-বিদ্বেষের আশ্রয় না নিয়ে থাকে তো এ ধরনের লোকদের বিষয়টি আল্লাহ্ তা আলার ওপরে সোপর্দ ; কারণ , অন্তরের খবর কেবল তিনিই রাখেন।

সুতরাং কেবল আহ্ লে বাইত ও আলে মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে গ্রহণ করা হতে বিরত থাকার জন্যই কাউকে মুনাফিক্ব বলে গণ্য করা যাবে না , যদি না সরাসরি তাঁদের সাথে বিরোধিতা ও শত্রুতা-বিদ্বেষের আশ্রয় না নিয়ে থাকেন।

এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর যুগে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন , অনেক লোকের অন্ধ বিশ্বাসের বিপরীতে , তাঁদের মধ্যে এমন একটি বিরাট সংখ্যক লোক ছিলেন যাদের কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞান ছিলো খুবই সীমিত কারণ , তখন লেখাপড়ার প্রচলন ছিলো খুবই অল্প এবং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের সময় যাদের হাতে পুরো কোরআন মজীদের কপি ছিলো বা যারা পুরো কোরআন মজীদ মুখস্ত করেছিলেন তাঁদের সংখ্যা তৎকালীন মোট মুসলমান-সংখ্যার তুলনায় শতকরা হারের দৃষ্টিতে দেখলে এক শতাংশেরও ভগ্নাংশ ছিলো। শুধু তা-ই নয় , অনেকের ঈমান ছিলো খুবই দুর্বল ও ভাসাভাসা। আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

) قَالَتِ الأعْرَابُ آمَنَّا قُلْ لَمْ تُؤْمِنُوا وَلَكِنْ قُولُوا أَسْلَمْنَا وَلَمَّا يَدْخُلِ الإيمَانُ فِي قُلُوبِكُمْ وَإِنْ تُطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ لا يَلِتْكُمْ مِنْ أَعْمَالِكُمْ شَيْئًا(

“ আরবগণ বলে : আমরা ঈমান এনেছি। (হে রাসূল! আপনি তাদেরকে) বলুন , তোমরা এখনো ঈমান আনয়ন করো নি , বরং তোমরা বলো যে. আমরা আত্মসমর্পণ করেছি (মুসলমান হয়েছি) , কিন্তু এখনো তোমাদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করে নি। তবে তোমরা যদি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর তাহলে তোমাদের আমল সমূহ থেকে কিছুই নিষ্ফল হবে না। ” (সূরাহ্ আল্-হুজুরাত্ : ১৪)

অনেকে অবশ্য উপরোক্ত আয়াতেরالأعْرَابُ শব্দের অর্থ করেছেন মরুবাসীগণ ’ বা বেদুঈন আরবগণ ’ । যদিও এরূপ অর্থ করা ঠিক নয় , কারণ , ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করেছি ,اعْرَابُ হচ্ছেعرب শব্দের বহুবচন , সুতরাং এতে মদীনাহর বাইরের শহর ও মরু নির্বিশেষে সকল এলাকার আরবদেরকে বুঝানো হয়েছে যাদের সকলেই নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর জীবদ্দশায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলো এবং তারা সংখ্যায় ছিলো অনেক। এমতাবস্থায় এ ধরনের যে সব লোকের ব্যাপারে আহ্ লে বাইত ও আলে মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর সাথে সরাসরি বিরোধিতা বা শত্রুতা-বিদ্বেষের অকাট্য প্রমাণ নেই তাদেরকে মুনাফিক্ব্ হিসেবে গণ্য করা যাবে না , যদিও সূরাহ্ আত্-তাওবাহর ১০১ নং আয়াত্ অনুযায়ী এদের মধ্যেও বহু মুনাফিক্ব্ ছিলো।

পরিশিষ্ট-১

হযরত ইমাম হোসেনের (আঃ) আন্দোলনের তাৎপর্য

কারবালায় হযরত ইমাম হোসেনের ( আঃ) শাহাদাত অনন্ত কাল ধরে সত্যসংগ্রামীদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তবে তাঁর আন্দোলনের কারণ ও শিক্ষা সম্বন্ধে যুগে যুগে যে সব মূল্যায়ন হয়েছে সে সবের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

বলা বাহুল্য যে , এ সব মূল্যায়নে তাঁর এবং তাঁর সঙ্গীসাথী ও পরিবারের প্রতি ভক্তি , ভালোবাসা ও সমবেদনা অভিন্ন উপাদান। কিন্তু তাঁর আন্দোলনের স্বরূপ ও কারণ সম্বন্ধে বিভিন্ন মত প্রকাশিত হয়েছে। বলা বাহুল্য যে , এ আন্দোলনের স্বরূপ ও কারণ সম্পর্কিত মূল্যায়ন যতো বেশী নির্ভুল হবে তাঁর এবং তাঁর সঙ্গীসাথী ও পরিবারের ত্যাগ ও আত্মত্যাগ থেকে আমরা ততো বেশী সঠিক শিক্ষা লাভ করতে ও উপকৃত হতে পারবো।

এ প্রসঙ্গে অতি সংক্ষেপে হলেও প্রথমে ইসলামী আক্বাএদে অর্থাৎ ইসলামের তাত্ত্বিক ভিত্তিতে হযরত ইমাম হোসেনের ( আঃ) মর্যাদা সম্পর্কে আভাস দেয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়।

একজন মানুষের অনেকগুলো মর্যাদা থাকতে পারে এবং তাঁর সবগুলো মর্যাদা সম্বন্ধে সকলের মধ্যে মতৈক্য না-ও থাকতে পারে। তবে হযরত ইমাম হোসেনের ( আঃ) যে মর্যাদা সম্পর্কে ইসলামের সকল মাযহাব ও ফিরক্বাহ্ অভিন্ন মত পোষণ করে তা হচ্ছে , তিনি এবং তাঁর বড় ভাই হযরত ইমাম হাসান (আঃ) রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর আহলে বাইতের সদস্য ; অপর দু জন তাঁদের পিতা-মাতা হযরত আলী ( আঃ) ও হযরত ফাতেমাহ্ (সালামুল্লাহি আলাইহা) ; এ চারজনের ব্যাপারে এমন কোনো ভিন্নমত নেই যা এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও সংশয় সৃষ্টি করতে পারে। আর আহলে বাইতের ( আঃ) সদস্যগণ শুধু গুনাহ্ থেকেই মুক্ত নন বরং সকল প্রকার চারিত্রিক ও আচরণগত অপকৃষ্টতা থেকেও মুক্ত (সূরাহ্ আল্-আহযাব : ৩৩) ।

পাপমুক্ততার এ দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের মর্যাদা নবী-রাসূলগণের ( আঃ) মর্যাদার সমস্তরের। যদিও রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর পরে আর কোনো নবী আসবেন না এবং কারো প্রতি নতুন কোনো আয়াত বা শরঈ বিধান নাযিল হবে না , তবে তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী তাঁর উম্মাতের ওলামায়ে কেরামের মর্যাদা বানী ইসরাঈলের নবী-রাসূলগণের ( আঃ) সমান এবং তাঁরা নবী-রাসূলগণের ( আঃ) উত্তরাধিকারী ও প্রতিনিধি ; এ তিনটি মর্যাদা আহলে বাইতের সদস্যদের ক্ষেত্রে শতকরা একশ ’ ভাগ প্রযোজ্য। তাই তাঁদের প্রতি দরূদ বর্ষণ ছাড়া আমাদের নামায ও খুত্ববাহ্ ছহীহ্ হয় না। এ কারণে নামাযের দরূদে বলতে হয় : হে আল্লাহ্! মুহাম্মাদ ও আলে মুহাম্মাদের (অর্থাৎ আহলে বাইতের) প্রতি দরূদ প্রেরণ করো যেভাবে তুমি ইবরাহীম্ ও আলে ইবরাহীমের প্রতি দরূদ প্রেরণ করেছো । হে আল্লাহ্! মুহাম্মাদ ও আলে মুহাম্মাদের (অর্থাৎ আহলে বাইতের) প্রতি বরকত নাযিল করো যেভাবে তুমি ইবরাহীম্ ও আলে ইবরাহীমের প্রতি বরকত নাযিল করেছো । ” আর হাদীছের (তিরমিযী , ইবনে মাজাহ্ , মুস্তাদরাকে হাকেম , কানযুল্ উম্মাল্ , ...) ভিত্তিতে খুত্ববায় আমরা হযরত ইমাম হোসেন ও হযরত ইমাম হাসান ( আঃ)কে বেহেশতে যুবকদের নেতা ’ বলে উল্লেখ করি।

শুধু তা-ই নয় , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেনের ( আঃ) সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টিকে তাঁর সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি বলে (ইবনে মাজাহ্) এবং তাঁর সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টিতে আল্লাহ্ তা আলার সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি ও বেহেশত-দোযখের পরিণতি বলে (মুস্তাদরাকে হাকেম্ , হাইছামী , ত্বিবরানী ও কানযুল্ উম্মাল্) উল্লেখ করেছেন। এছাড়া যারা হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)কে ভালোবাসে তাদেরকে ভালোবাসার জন্য তিনি আল্লাহ্ তা আলার কাছে দোআ করেন (তিরমিযী) ।

আল্লাহর রাসূল হযরত ইবরাহীম্ ( আঃ) সকল কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর আল্লাহ্ তা আলা তাঁকে মানব জাতির জন্য ইমাম বা নেতা মনোনীত করেন এবং তাঁর প্রশ্নের জবাবে জানান যে , তাঁর বংশের নেককারদেরও [অর্থাৎ আলে ইবরাহীমকে তথা তাঁর বংশের নবী-রাসূলগণ ও বিশেষ নেককার লোকদেরকে ( আঃ)] ইমাম বা নেতা বানানো হলো (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ১২৪) । অতএব , নামাযের বিশেষ দরূদে আলে ইবরাহীমের সাথে আলে মুহাম্মাদের তুলনা থেকে উম্মাতের ওপর আলে মুহাম্মাদের দ্বীনী নেতৃত্ব এবং সেই সাথে রাজনৈতিক নেতৃত্বের হক্ব্ অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়।

সংক্ষেপে এই হলো আমাদের আক্বাএদে হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)-এর বিতর্কাতীত মর্যাদা। আর বিচারবুদ্ধির আলোকে ও সাধারণ দৃষ্টিতেও একটি ইসলামী সমাজের নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্ব অর্পিত হতে হবে দ্বীনী জ্ঞান , আচরণ ও যোগ্যতার বিচারে শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তির ওপরে।

অন্যদিকে বিচারবুদ্ধির রায় অনুযায়ী , ইসলামী সমাজের নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্বের ভার সরাসরি আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে কারো ওপর অর্পণ করা না হলে বা এরূপ ব্যক্তি সমাজে উপস্থিত না থাকলে এ দায়িত্ব অর্পণের জন্য জনগণের দ্বারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্ভাব্য সর্বাধিক যোগ্যতার অধিকারী কাউকে বেছে নিতে হবে ; রাজতন্ত্র , স্বৈরতন্ত্র , ক্ষমতা জবর দখল , জোর করে জনগণের ওপর শাসন-কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেয়া , ধোঁকা-প্রতারণা , ষড়যন্ত্র , উৎকোচ প্রদান বা অন্য যে কোনো অনৈতিক পন্থার আশ্রয় নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্তকরণ তথা ধর্মসম্পর্কহীন (সেক্যুলার) নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্ব ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। এ সব বিষয়কে বিবেচনায় রাখলে এটা সন্দেহাতীত যে , ইসলামী উম্মাহর ওপর ইয়াযীদের নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্ব ছিলো পুরোপুরি অবৈধ।

অবশ্য সত্যিকারের দ্বীনী নেতৃত্ব অবৈধ নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের মোকাবিলায় কখন কোন্ কর্মনীতি অনুসরণ করবেন তা নির্ভর করে স্থান-কাল ও পরিস্থিতির ওপর এবং এ সবের মূল্যায়ন করে তিনি নিজেই তা নির্ধারণ করবেন। স্বয়ং রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নবুওয়াতের দায়িত্বে অভিষিক্ত হবার পর মক্কায় প্রথম তিন বছর গোপনে দ্বীনী দাও ’ আতের কাজ করেন , অতঃপর দশ বছর স্থানীয় কুফরী নেতৃত্বের যুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোনোরূপ প্রতিরোধে না গিয়ে প্রকাশ্যে দ্বীনের দাও ’ আত দেন এবং এরপর মদীনায় গিয়ে ইসলামী হুকূমাত্ প্রতিষ্ঠা করেন। আর তাঁর মদীনাহর জীবনের দশ বছরে তাঁকে পরিস্থিতিভেদে যুদ্ধ , সন্ধি , কূটনৈতিক যোগাযোগ ও দাও ’ আত ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের কর্মনীতি অনুসরণ করতে দেখা যায়। পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের ( আঃ) অনুসৃত কর্মনীতিও ছিলো অভিন্ন।

এ বিষয়টির প্রতি এ কারণে বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করা প্রয়োজন যে , আমাদের মধ্যে হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ) ও হযরত ইমাম হাসান ( আঃ)কে দুই ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় ; একজনকে অসম সাহসী বীর পুরুষ ও একজনকে খুবই নরম মনের মানুষ গণ্য করা হয় , অথচ আমাদের আক্বাএদে (নামাযের দরূদ ও খুত্ববাহর ভিত্তিতে) উভয়ের মর্যাদা অভিন্ন। বিষয়টির প্রতি অগভীর দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করার কারণেই আমরা এরূপ মনে করে থাকি , অথচ হযরত ইমাম হাসান ( আঃ) তাঁর জীবনে অনেকগুলো যুদ্ধে সশরীরে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

অন্যদিকে মু আভীয়াহর বিশ বছর ব্যাপী রাজত্বকালের দশ বছর পর হযরত ইমাম হাসান ( আঃ)কে বিষপ্রয়োগে শহীদ করা হয়। তাঁর শাহাদাতের পর আহলে বাইতের এবং তাঁদের ভক্ত-অনুরক্ত-অনুসারীদের নেতৃত্বে আসেন হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ) । কিন্তু তিনি মু আভীয়াহর শাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য প্রচারে অবতীর্ণ হন নি-যা তিনি ইয়াযীদের বিরুদ্ধে করেছিলেন। এর কারণ তাঁদের দুই ভাইয়ের মধ্যকার চরিত্রবৈশিষ্ট্যের পার্থক্য নয় , বরং পরিস্থিতির পার্থক্য।

ইসলামের সকল মাযহাব ও ফিরক্বাহ্ হযরত আলীর ( আঃ) খেলাফতের বৈধতার ব্যাপারে একমত এবং বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে , সাধারণ জনগণের অনুরোধে তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ; স্বল্পসংখ্যক লোক তাঁকে খলীফাহ্ বানান নি। এতদসত্ত্বেও মু আভীয়াহ্ তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন।

হযরত আলীর ( আঃ) শাহাদাতের পর শহীদ বৈধ খলীফাহর অনুসারী জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হযরত ইমাম হাসান ( আঃ)কে খলীফাহ্ হিসেবে বরণ করে নেন। কিন্তু মু আভীয়াহ্ যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা দখল করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। ঐ সময় হযরত ইমাম হাসান ( আঃ)-এর অধীনে চল্লিশ হাজার সৈন্য ছিলো। এমতাবস্থায় তিনি যুদ্ধ করলে সে যুদ্ধে হার-জিত যার যা-ই হতো না কেন , বিপুল সংখ্যক হতাহতের কারণে মুসলমানদের সামরিক শক্তি নিঃশেষ হয়ে যেতো এবং এই সুযোগে রোম সাম্রাজ্য হামলা চালিয়ে খুব সহজেই গোটা ইসলামী ভূখণ্ডকে দখল করে নিতো। এ কারণে , ইসলাম ও মুসলমানদের বৃহত্তর কল্যাণ তথা অস্তিত্ব রক্ষার লক্ষ্যে হযরত ইমাম হাসান ( আঃ) তাঁর বৈধ খেলাফতকে মু আভীয়াহর হাতে ছেড়ে দেন।

অবশ্য মু আভীয়াহ্ লিখিতভাবে এ মর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিলেন যে , তাঁর পরে হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ) খলীফাহ্ হবেন। কিন্তু তিনি সে অঙ্গীকার রক্ষা করেন নি এবং স্বীয় চরিত্রহীন অযোগ্য পুত্র ইয়াযীদকে পরবর্তী খলীফাহ্ তথা যুবরাজ হিসেবে মনোনীত করে যান।

এতো কিছু সত্ত্বেও হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ) মু আভীয়াহর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিরোধিতা ও প্রচারে অবতীর্ণ হন নি। কারণ , সর্বসম্মত বৈধ খলীফাহ্ হযরত আলীর ( আঃ) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ইয়াযীদকে যুবরাজ মনোনীত করার মধ্য দিয়ে অনৈসলামী রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার গোড়াপত্তন সহ মু আভীয়াহর বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিচার-বিশ্লেষণ করা ও তা বোঝা তৎকালীন পরিবেশে সাধারণ মুসলিম জনগণের পক্ষে সম্ভব ছিলো না এবং তাদেরকে তা বুঝানোও সম্ভব ছিলো না। কারণ , সাধারণ মানুষ জানতো যে , মু আভীয়াহ্ ছিলেন হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ছাহাবী ও ওয়াহী-লেখকদের অন্যতম। কারণ , মু আভীয়াহর সমর্থকদের পক্ষ থেকে বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার করা হতো। অন্যদিকে দৃশ্যতঃ জনগণের চোখে পড়ার মতো বাহ্যিক দ্বীনী আমলের ক্ষেত্রে তাঁর মধ্যে কোনো শৈথিল্য ছিলো না। এছাড়া (এবং অংশতঃ এ কারণেও) অনেক ছাহাবীও তাঁর সাথে ছিলেন। তাই হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ) মু আভীয়াহর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক বিরোধিতায় ও প্রচারে অবতীর্ণ হলে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতো এবং মু আভীয়াহর পক্ষে তাঁর বিরাট প্রশাসন ও প্রচারযন্ত্র কাজে লাগিয়ে হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)কে ক্ষমতালোভী হিসেবে জনগণকে বিশ্বাস করানো সম্ভব হতো। এটাই ছিলো ঐ সময় তাঁর নীরবতার কারণ।

কিন্তু ইয়াযীদ ক্ষমতায় বসার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। কারণ , ইয়াযীদের অনৈসলামী চরিত্রবৈশিষ্ট্য ছিলো এমনই সুস্পষ্ট যে , জনগণ কখনোই তাকে দ্বীনদার মনে করতো না , ফলে হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)-এর পক্ষ থেকে তার বিরোধিতায় বিভ্রান্তির কোনো কারণ ছিলো না।

শুধু তা-ই নয় , এ ক্ষেত্রে হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)-এর নীরবতাও হতো ইসলামের জন্য বিপর্যয়কর। কারণ , নবী-রাসূলগণের ( আঃ) সমতুল্য মর্যাদা নিয়েও তিনি যদি কেবল প্রাণ বাঁচানোর লক্ষ্যে নীরব থাকতেন তাহলে এটা সকল মুসলমানের জন্য সুবিধাবাদ ও কাপুরুষতার দৃষ্টান্ত হতো। তাই তিনি স্বল্পসংখ্যক অনুসারী নিয়েও প্রকাশ্যে সত্যের পতাকা উত্তোলন করেন।

এখানে এ কথাটিও স্মরণ করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে যে , হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ) ইয়াযীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ ঘোষণা করেন নি। তিনি কেবল ইয়াযীদের মতো চরিত্রহীন ব্যক্তিকে খলীফাহ্ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং জনগণের কাছে সত্যকে তুলে ধরেন। তিনি তাঁর বিভিন্ন ভাষণে সুস্পষ্টভাবে বলেন যে , তাঁর আন্দোলন ক্ষমতা দখলের জন্য নয় , বরং তাঁর নানার [রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর] আদর্শ পুনরুজ্জীবিত করা এবং ভালো কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজে নিষেধ করা ’ র লক্ষ্যে।

লক্ষণীয় , হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ) ইয়াযীদের অনুকূলে বাইআত হন নি , অতএব , ইয়াযীদের বিরুদ্ধে তাঁর উত্থানকে বিদ্রোহ বলা চলে না। তিনি যা করেন তা ছিলো জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও জাগরণ সৃষ্টির চেষ্টা। অন্য কথায় , তিনি স্বীয় মত প্রচারের মাধ্যমে জনমত গঠনের চেষ্টা চালিয়েছিলেন।

আজকের দিনে বিশ্বের অধিকাংশ অমুসলিম দেশেও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সরকারের বিরোধিতা , এমনকি জনমত গঠনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের প্রচেষ্টাকে বৈধ গণ্য করা হয়। কিন্তু খলীফাতুল মুসলিমীন হবার দাবীদার ইয়াযীদের স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক শাসনে সে অধিকারটুকুও স্বীকার করা হচ্ছিলো না।

এখানে উল্লেখ্য যে , বর্তমান যুগের পার্থিব [সেক্যুলার] রাজনৈতিক বিবেচনায় মু আভীয়াহ্ অত্যন্ত দূরদর্শী রাজনীতিক ছিলেন , এ কারণে তিনি বুঝতে পারেন যে , হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)-এর কাছ থেকে জোর করে বাইআত আদায় করতে গেলে তার পরিণতিতে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠবে। তাই তিনি ইয়াযীদকে হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)-এর কাছ থেকে বাইআত আদায়ের চেষ্টা করতে নিষেধ করে যান এবং তাঁকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়ার জন্য উপদেশ দিয়ে যান।

কিন্তু উদ্ধত অহঙ্কারী ইয়াযীদ তাঁর পিতার উপদেশ উপেক্ষা করে হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)-এর ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাঁর কাছ থেকে বাইআত আদায়ের জন্য মদীনাহর উমাইয়াহ্ প্রশাসকের প্রতি নির্দেশ দেয়। এমতাবস্থায় হযরত ইমামের ( আঃ) অনুসারীরা জীবন দিয়ে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত থাকলেও যেহেতু তাঁর উদ্দেশ্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা ’ ছিলো না , সেহেতু তিনি রক্তপাত এড়ানোর জন্য রাতের অন্ধকারে মদীনাহ্ ত্যাগ করে মক্কাহর পথে রওয়ানা হন এবং মক্কায় এসে আল্লাহর ঘরের পাশে আশ্রয় নিয়ে তাঁর সত্যপ্রকাশের দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখেন। এ অবস্থায় ইয়াযীদ হজ্বের সমাবেশে ভীড়ের মধ্যে তাঁকে হত্যা করার জন্য গুপ্তঘাতক পাঠায়। হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ) তা জানতে পারেন। কিন্তু তিনি মসজিদুল হারামে বা পবিত্র আরাফাহর ময়দানে তাঁর রক্তপাত হোক তা চান নি। অন্যদিকে কূফাহবাসীরা সেখানে গিয়ে তাদেরকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তাঁকে শত শত পত্র লিখে ও সেগুলো সহ তাঁর কাছে বহু প্রতিনিধি পাঠায়। এমতাবস্থায় তিনি হজ্বের আগের দিন (হিজরী ৬০ সালের ৮ই যীল্-হাজ্ব্) মক্কাহ্ ত্যাগ করে কূফাহর পথে রওয়ানা হন।

হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ) কূফাহর জনগণের চরিত্রবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতেন যে , তাদের অঙ্গীকারের ওপর আস্থা রাখা যায় না। কিন্তু যেহেতু কেউ কার্যতঃ অপরাধ না করা পর্যন্ত তাকে অপরাধী গণ্য করা চলে না সেহেতু তিনি তাদের ডাকে সাড়া না দিলে এটা ইসলামী আচরণবিধি অনুযায়ী খারাপ দৃষ্টান্ত হতো এবং যে কারো জন্য যে কারো সাথে কেবল সন্দেহবশে আচরণ করার বৈধতা সৃষ্টি হয়ে যেতো।

অবশ্য কারবালায় উপনীত হবার পর তাঁর কাছে কূফাহ-বাসীদের (অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে) বিশ্বাসভঙ্গের বিষয়টি প্রমাণিত হয়ে যায়। অতঃপর আর তাঁর জন্য কূফায় যাওয়ার নৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকে নি। এমতাবস্থায় তিনি অন্যত্র চলে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু স্বীয় তাবেদারদের প্রতি ইয়াযীদের নির্দেশ ছিলো এই যে , হযরত ইমামের ( আঃ) কাছ থেকে বাইআত আদায় করতে হবে , আর তিনি তাতে সম্মত না হলে তাঁকে হত্যা করতে হবে।

বলা বাহুল্য যে , হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)-এর পক্ষে ইয়াযীদের অনুকূলে বাইআত করা সম্ভব ছিলো না। এমতাবস্থায় তিনি নীরবে যালেমের তলোয়ারের নীচে মাথা পেতে দেবেন এটাও ছিলো অচিন্ত্যনীয়। অতএব , এর মানে ছিলো সশস্ত্র প্রতিরোধ। কিন্তু তিনি যুদ্ধ ও রক্তপাতে আগ্রহী ছিলেন না এবং এ জন্য তিনি আসেনও নি। তাই তিনি যেখান থেকে এসেছেন সেখানে (মদীনায়) ফিরে যাবার বা দেশের সীমান্তের বাইরে হিজরত করার বিকল্প প্রস্তাব দেন।

কিন্তু ইয়াযীদের বাহিনী তা প্রত্যাখ্যান করে , বরং ইয়াযীদের পক্ষ থেকে যে দু টি বিকল্প দেয়া হয়েছিলো তার ভিত্তিতে তার অনুগত বাহিনী হযরত ইমামের ( আঃ) ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে বাধ্য হয়ে হযরত ইমামকে অস্ত্র হাতে নিতে হয় এবং ইসলামী আদর্শকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে যে প্রয়োজনে জীবন দিতে হবে তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এ অসম যুদ্ধে বাহাত্তর জন সঙ্গীসাথী সহ তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

কেবল স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ ও সত্য প্রচারের কারণে হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ) ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের যেভাবে হত্যা করা হয় তা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর চেতনাকে এমনভাবে নাড়া দেয় যে , তা তাদের মধ্যে ঈমানদীপ্ত নতুন প্রাণের সঞ্চার করে এবং ইসলামের ইতিহাসে সত্যের জন্য আত্মত্যাগের এক নতুন ধারা সৃষ্টি করে , শুধু তা-ই নয় , তিনি সমগ্র মানবতার জন্য সংগ্রামী প্রেরণার দৃষ্টান্তে পরিণত হন। তাঁর শাহাদাতের মাধ্যমে তিনি দ্বীনের যে খেদমত আঞ্জাম দিলেন তিনি বেঁচে থাকলে এবং অনুসারীগণ সহ সর্বস্ব বিনিয়োগ করে প্রচারকার্য চালিয়েও তা পারতেন না।

এ থেকে সুস্পষ্ট যে হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ) যুদ্ধবায ছিলেন না , কিন্তু তিনি ছিলেন স্বীয় নীতি-আদর্শ ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের প্রশ্নে আপোসহীন। তিনি ছিলেন স্বৈরতন্ত্র ও সুবিধাবাদ উভয়কে প্রত্যাখ্যানের প্রতীক-অটল পাহাড়ের ন্যায়।

যারা আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে চান তাঁদেরকে হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)-উভয় কর্তৃক বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অনুসৃত বিভিন্ন কর্মনীতি বিশ্লেষণ করে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে স্বীয় পরিস্থিতি অনুযায়ী কর্মনীতি নির্ধারণ করতে হবে। কেবল তাহলেই তাঁদের প্রতি আমাদের আন্তরিক ভালোবাসার সার্থকতা।


10

11

12