রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ

রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ16%

রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 15 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 23897 / ডাউনলোড: 4116
সাইজ সাইজ সাইজ
রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ

রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

ইসলামে আহলে বাইত-এর মর্যাদা

কোরআন মজীদে ও বিভিন্ন হাদীছে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর আহলে বাইত ( আঃ)-এর দ্বীনী মর্যাদা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বহু উল্লেখ রয়েছে। বিশেষ করে কোরআন মজীদের যে সব আয়াতে এ সম্বন্ধে পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে ইখলাছের সাথে ও নিরপেক্ষভাবে অর্থগ্রহণ ও ব্যাখ্যা করা হলে সে সব আয়াত থেকেও হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর আহলে বাইত-এর বিশেষ দ্বীনী মর্যাদা সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। তেমনি বিভিন্ন মুতাওয়াতির্ হাদীছেও এ সম্বন্ধে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এখানে আমরা কেবল সেই সব দলীলেরই আশ্রয় নেবো যার তাৎপর্যের ব্যাপারে দ্বিমতের অবকাশ নেই।

আহলে বাইতের (আঃ) প্রতি ভালোবাসা ফরয

এ পর্যায়ে প্রথমেই আমরা যা উল্লেখ করতে চাই তা হচ্ছে , আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসাকে মু মিনাদের জন্য ফরয করেছেন ; এরশাদ হয়েছে :

) قُلْ لا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى(

“ (হে রাসূল!) বলুন , আমি এ জন্য (আল্লাহর হেদায়াত পৌঁছে দেয়ার বিনিময়ে) তোমাদের কাছে আমার ঘনিষ্ঠতমদের জন্য ভালোবাসা ব্যতীত কোনো বিনিময় চাই না। ” (সূরাহ্ আশ্-শূরা : ২৩)

এ আয়াতে মু মিনাদের জন্য হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর স্বজনদের (قربی ) প্রতি ভালোবাসা পোষণ করাকে অপরিহার্য করা হয়েছে। কারণ , এ ব্যাপারে দ্বিমতের অবকাশ নেই যে , এতে নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর স্বজন (قربی ) বলতে তাঁর আহলে বাইতকেই ( আঃ) বুঝানো হয়েছে। আর এতে যদি ব্যাপকতর অর্থে তাঁর আত্মীয়-স্বজন বা বানী হাশেমকে বুঝানো হয়ে থাকে তাহলেও তাঁদের মধ্যে তাঁর আহলে বাইত ( আঃ) অগ্রগণ্য।

ইসলামের সকল মাযহাব ও ফিরক্বাহর সূত্রে হযরত ফাতেমাহ্ যাহরা ’ (সালামুল্লাহি আলাইহা) এবং হযরত আলী , হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)-এর মর্যাদা সম্পর্কে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে যার বিষয়বস্তুসমূহ মুতাওয়াতির্ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। অবশ্য তা সত্ত্বেও কেউ হয়তো সে সবের তাওয়াতুর্ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে পারেন , কিন্তু এ সবের মধ্যে এমন কতোগুলো বিষয় রয়েছে যা বিতর্কের উর্ধে এবং যে সব ব্যাপারে ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই মতৈক্য রয়েছে এবং বর্তমানে দু একটি নব উদ্ভূত চরমপন্থী ফিরক্বাহ্ ব্যতীত সকলেই একমত। এ সব বিতর্কাতীত বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর উম্মাতের মধ্যে হযরত আলী ( আঃ) ছিলেন সর্বাধিক জ্ঞানী।

হযরত আলীর (আঃ) ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব

হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) এরশাদ করেন :

انا مدينة العلم و علی بابها

“ আমি জ্ঞানের নগরী , আর আলী তার দরযা। ”

আমরা জানি যে , কোরআন মজীদ হচ্ছে সমস্ত জ্ঞানের আধার (تبيانا لکل شيء ) । সুতরাং কোরআন মজীদের পরিপূর্ণ জ্ঞান ব্যতীত কারো পক্ষে ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানী হওয়া সম্ভবপর নয়। আর এটা অনস্বীকার্য যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ছাহাবীগণের মধ্যে তাঁর জীবদ্দশায় মাত্র হাতেগণা কয়েক জন ব্যক্তিগতভাবে পুরো কোরআন মজীদ লিপিবদ্ধ বা মুখস্ত করেছিলেন। আর যে স্বল্পসংখ্যক ছাহাবী পুরো কোরআন মজীদ লিপিবদ্ধ করে স্বীয় ব্যক্তিগত সংগ্রহে রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে হযরত আলী ( আঃ) ছিলেন অন্যতম।

কিন্তু কারো কাছে পুরো কোরআন মজীদ থাকলেই বা কারো পুরো কোরআন মজীদ মুখস্ত থাকলেই যে তিনি ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হবেন তা নয়। এটা আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারি। কারণ , আরব-অনারব নির্বিশেষে আমাদের মুসলমানদের ঘরে ঘরে পুরো কোরআন মজীদ মওজূদ রয়েছে এবং আমরা তা নিয়মিত তেলাওয়াত করি ও অনেকে নিয়মিত অধ্যয়ন করি ; এছাড়া অনেকে আছেন যারা পুরো কোরআনে হাফেয , কিন্তু তাঁদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী এমন ব্যক্তি ক জন ?

অন্যদিকে যার কাছে পুরো কোরআন মজীদ গ্রন্থাকারে মওজূদ ছিলো না বা নেই অথবা মুখস্ত ছিলো না বা নেই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এমন কারো পক্ষে ইসলামের পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

তবে কোরআন মুখস্ত থাকা বা তা নিয়মিত তেলাওয়াত ও অধ্যয়ন করাই ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হবার জন্য জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ , একদিকে পুরো কোরআন মজীদের জ্ঞান যথাযথভাবে বুঝতে পারার জন্য কতক পূর্বশর্ত রয়েছে যে সব পূর্বশর্ত কেবল কোরআন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের কাছ থেকে বা এতদ্বিষয়ক তথ্যসূত্রাদি থেকে অর্জন করা যেতে পারে। বর্তমান যুগে এ ধরনের বিশেষজ্ঞ শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞত্বমূলক তথ্যসূত্রাদি সহজলভ্য হলেও হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর যুগে তিনি স্বয়ং ব্যতীত এ ধরনের কোনো বিশেষজ্ঞ শিক্ষক বা এতদ্বিষয়ক বিশেষজ্ঞত্বমূলক তথ্যসূত্রের অস্তিত্ব ছিলো না।

দ্বিতীয়তঃ যে সব শাস্ত্রের প্রায়োগিক দিক থাকে সে ধরনের যে কোনো শাস্ত্রেরই প্রায়োগিক দিকের বাস্তব প্রয়োগ পর্যবেক্ষণ ব্যতীত সে শাস্ত্রের পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়। আর হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর যুগে কোরআন মজীদের বাস্তব প্রয়োগ করেছেন তিনি স্বয়ং।

তৃতীয়তঃ আল্লাহ্ তা আলা কোরআন মজীদ নাযিল করা ছাড়াও স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)কে কতক বিধিবিধান প্রণয়ন ও প্রয়োগের এখতিয়ার প্রদান করেন। উদাহরণস্বরূপ , তিনি বিবাহিত ব্যভিচারীর জন্য প্রস্তরাঘাতে হত্যার শাস্তি কার্যকর করতেন-এ ব্যাপারে মতৈক্য রয়েছে , যদিও কোরআন মজীদে এ শাস্তির উল্লেখ নেই।

[যারা মনে করেন যে , কোরআন মজীদে বিবাহিত ব্যভিচারীকে সঙ্গে সার্ (প্রস্তরাঘাতে হত্যা) করার শাস্তির নির্দেশ সম্বলিত আয়াত ছিলো , কিন্তু পরে সে আয়াতের তেলাওয়াত্ মানসূখ্ করা হয় ও হুকূম্ বহাল থেকে যায় , তাঁদের এ মত মোটেই ঠিক নয়। প্রকৃত পক্ষে কোরআন মজীদের অভ্যন্তরে নাসেখ্ ও মানসূখের কোনোই কার্যকরিতা নেই। বরং কোরআন মজীদ হচ্ছে নাসেখ্ ও পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব্ সমূহ হচ্ছে মানসূখ্। এ ব্যাপারে আমি আমার কোরআনের পরিচয় গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।]

তেমনি নামায পাঁচ ওয়াক্তে সতর রাক্ আত্ ফরয তিনিই নির্ধারণ করে দেন। এছাড়া তিনি কোরআন মজীদে অনুল্লেখিত এমন উত্তম জিনিসগুলোকে হালাল করে দেন ও নোংরা জিনিসগুলোকে হারাম করে দেন (সূরাহ্ আল্-আ রাফ্ : ১৫৭) ।

সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর পরিপূর্ণ সাহচর্য ছাড়া কারো পক্ষে ইসলামের পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সম্ভবপর ছিলো না। আর এটা সর্বজনবিদিত সত্য যে , হযরত আলী ( আঃ) ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর পুরো নবুওয়াতী যিন্দেগীর পরিপূর্ণ সাহচর্য লাভ করেছিলেন ; অন্য কেউই তাঁর মতো এ সাহচর্যের অধিকারী হন নি।

এর মানে হচ্ছে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ছাহাবীগণের মধ্যে কোরআন মজীদ ও সুন্নাতে রাসূলের (ছ্বাঃ) তথা ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ও পুরোপুরি নির্ভুল জ্ঞান কেবল হযরত আলী ( আঃ)-এর কাছেই ছিলো এবং ইসলামের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান পেতে হলে তাঁর দ্বারস্থ হওয়া অপরিহার্য।

হযরত ফাতেমাহ্ ও হাসান-হোসেন (আঃ)-এর মর্যাদা

অন্যদিকে মুসলমানদের মধ্যে এ ব্যাপারে ইজমা রয়েছে এবং এ কারণে জুমু ’ আহ্ নামাযের খোত্ববাহ্ সমূহে উল্লেখ করা হয় যে , হযরত ফাতেমাহ্ (সালামুল্লাহি আলাইহা) বেহেশতে নারীদের নেত্রী (سيدة نساء اهل الجنة ) এবং হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ) বেহেশতে যুবকদের নেতা (سيدا شباب اهل الجنة ) ।

এ হচ্ছে এমন মর্যাদা যা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর কোনো বিবি বা অন্য কোনো ছাহাবীর জন্য বর্ণিত হয় নি।

নামাযের দরূদে আলে মুহাম্মাদের (ছ্বাঃ) মর্যাদা

অন্যদিকে , অত্র গ্রন্থের ভূমিকায় যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , যে কোনো নামাযের শেষ রাক্ ’ আতে বসা অবস্থায় হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর সাথে সাথে তাঁর আহলে বাইত-এর প্রতি দরূদ প্রেরণের জন্য আল্লাহ্ তা আলার কাছে আবেদন জানানো অপরিহার্য , নচেৎ নামায ছহীহ্ হবে না। বিশেষ করে হানাফী মায্হাবের অনুসারীরা এ দরূদটি এভাবে পড়ে থাকেন :

اللهم صلِّ علی محمد و علی آل محمد کما صلَّيت علی ابراهيم و علی آل ابراهيم؛ انک حميد مجيد. اللهم بارک علی محمد و علی آل محمد کما بارکت علی ابراهيم و علی آل ابراهيم؛ انک حميد مجيد

“ হে আল্লাহ্! মুহাম্মাদ ও আলে মুহাম্মাদের প্রতি ছালাত্ করো ঠিক যেভাবে ছালাত্ করেছো ইবরাহীম্ ও আলে ইবরাহীমের প্রতি ; অবশ্যই তুমি পরম প্রশংসিত মহামহিম। হে আল্লাহ্! মুহাম্মাদ ও আলে মুহাম্মাদের প্রতি বরকত নাযিল করো ঠিক যেভাবে বরকত নাযিল করেছো ইবরাহীম্ ও আলে ইবরাহীমের প্রতি ; অবশ্যই তুমি পরম প্রশংসিত মহামহিম। ”

এ দরূদটি দরূদে ইবরাহীমী নামে মশহূর্। এ দরূদের মধ্যে বিরাট চিন্তার খোরাক রয়েছে। তা হচ্ছে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর প্রতি ছালাত্ করা ও বরকত নাযিলের জন্য আবেদনের সাথে সাথে তাঁর আহলে বাইত-এর প্রতি কেবল ছালাত্ করা ও বরকত নাযিলের আবেদনই করা হয় নি , বরং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর প্রতি ঠিক সেভাবে ছালাত্ করা ও বরকত নাযিলের জন্য আল্লাহ্ তা আলার কাছে আবেদন করা হয়েছে যেভাবে হযরত ইবরাহীম্ ( আঃ)-এর প্রতি আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে ছালাত্ করা ও বরকত নাযিল করা হয়েছিলো। অন্যদিকে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর আহলে বাইত-এর প্রতি ঠিক সেভাবে ছালাত্ করা ও বরকত নাযিলের জন্য আল্লাহ্ তা আলার কাছে আবেদন জানানো হয়েছে যেভাবে আলে ইবরাহীম্ ( আঃ)-এর প্রতি আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে ছালাত্ করা ও বরকত নাযিল করা হয়েছিলো। এখানে সুস্পষ্ট ভাষায় হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর আহলে বাইতকে আলে ইবরাহীমের ( আঃ)-এর সমপর্যায়ের গণ্য করা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , আলে ইবরাহীম্ ( আঃ) কারা ছিলেন ?

এখানে আলে ইবরাহীম্ ” কথাটি যে আভিধানিক অর্থে ব্যবহৃত হয় নি , বরং পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে সে ব্যাপারে বিতর্কের কোনোই অবকাশ নেই। কারণ , এখানে আলে ইবরাহীম্ ” বলতে নিঃশর্তভাবে হযরত ইবরাহীম্ ( আঃ)-এর পরিবার , বা সন্তানগণ বা বংশধরগণকে বুঝানো হয় নি। কারণ , তাঁর বংশধরগণের মধ্যকার নাফরমানদেরকে মুসলমানদের নামায-মধ্যস্থ দরূদে শরীক করা হবে এ প্রশ্নই ওঠে না।

রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ

আলোচনার মানদণ্ড

অত্র আলোচনার শুরুতে আমরা দ্বীনী বিষয়াদিতে আলোচনার ক্ষেত্রে সর্বজনগ্রহণযোগ্য অকাট্য মানদণ্ড সম্পর্কে সংক্ষেপে উল্লেখ করতে চাই। কারণ , আমরা যাতে সন্দেহাতীত উপসংহারে উপনীত হতে পারি সে লক্ষ্যে আমাদেরকে কেবল ঐ সব মানদণ্ডের ভিত্তিতে আলোচনা করতে হবে যেগুলো অকাট্য এবং মাযহাব ও ফিরক্বাহ্ নির্বিশেষে সকল মুসলমানের কাছে সমভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়া অপরিহার্য।

মাযহাব ও ফিরক্বাহ্ নির্বিশেষে সকল মুসলমানের জন্য দ্বীনী বিষয়াদিতে আলোচনার ক্ষেত্রে যে সব মানদণ্ড অকাট্যভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়া অপরিহার্য সেগুলো হচ্ছে আক্বল্ (বিচারবুদ্ধি) , কোরআন মজীদ , মুতাওয়াতির্ হাদীছ ও ইজমা এ উম্মাহ্।

সংক্ষেপে বলতে হয় , আক্বল্-কে এ কারণে মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করতে হবে যে , তা সমস্ত মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য সর্বজনীন মানদণ্ড ও জ্ঞানসূত্র-যার ভিত্তিতে পর্যালোচনা করে একজন অমুসলিম ইসলামের সত্যতায় উপনীত হয় ও তা গ্রহণ করে এবং কোরআন মজীদ সহ অন্য সমস্ত জ্ঞানসূত্র থেকে সঠিক তাৎপর্য গ্রহণের ক্ষেত্রে আক্বল্ সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই কোরআন মজীদে আক্ব্ল্-এর প্রয়োগের ওপর বার বার গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

[আমি আমার জ্ঞানতত্ত্ব ও ইসলাম এবং জীবন জিজ্ঞাসা গ্রন্থ দু টিতে আক্বলের সর্বজনীন মানদণ্ড ও জ্ঞানসূত্র হওয়া সম্পর্কে এবং কোরআন মজীদে এর ওপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ , বিশেষ করে আক্ব্লী মানদণ্ডের ভিত্তিতে ইসলামী আক্বাএদের মৌলিক বিষয়গুলোর দাও আত্ প্রদান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। উভয় গ্রন্থইalhassanain.org/Bengali ওয়েব সাইটে প্রকাশিত হয়েছে।]

অন্যদিকে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সর্বশেষ , পূর্ণাঙ্গ ও সংরক্ষিত কিতাব হিসেবে কোরআন মজীদকে মুসলমানদের জন্য মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণের অপরিহার্যতা সম্পর্কে আলাদা কোনো দলীল উপস্থাপনের প্রয়োজন নেই। কারণ , কেউ যদি কোরআন মজীদকে অকাট্য মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ না করে তাহলে তার ঈমানই থাকে না।

আর যেহেতু মুতাওয়াতির্ হাদীছ হচ্ছে তা-ই যা ছাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে গ্রন্থাবদ্ধকরণ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে এতো বেশী সংখ্যক ব্যক্তি থেকে বর্ণিত হয়েছে মিথ্যা রচনার জন্য যতো লোকের পক্ষে একমত হওয়া বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে অসম্ভব বলে মনে হয় সেহেতু এ ধরনের হাদীছ যে সত্যি সত্যিই হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) থেকে এসেছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

এছাড়া যে সব আমল বা যে সব মত হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে মাযহাব ও ফিরক্বাহ্ নির্বিশেষে মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়ে এসেছে সেগুলো উপরোক্ত তিন সূত্রের কোনোটির সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়া সাপেক্ষে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) থেকে চলে আসার ক্ষেত্রে তার নির্ভুলতা সম্পর্কেও সন্দেহের অবকাশ নেই। এ ধরনের আমল বা মতের সাথে পরবর্তীকালে-ধরা যাক , পাঁচশ ’ বা হাজার বছর পরে-কেউ দ্বিমত করলে তার কোনোই মূল্য হতে পারে না।

এ ধরনের আমল ও মতকে আমরা ইজমা এ উম্মাহ্ হিসেবে অভিহিত করছি। বলা বাহুল্য যে , এ পরিভাষাটি আমরা ফিক্বাহ্ শাস্ত্রের আলোচনায় অন্যতম তথ্যসূত্র হিসেবে যে ইজমা -র কথা বলা হয় তা থেকে ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছি-যে অর্থ আমরা এখানে উল্লেখ করেছি। আর এ ইজমা এ উম্মাহ্ হচ্ছে অকাট্যভাবে সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর উদ্ঘাটনকারী।

ইসলামী আক্বাএদের মূলনীতি ও এর শাখা-প্রশাখাসমূহ এবং ফরয ও হারামের বিষয়গুলো কেবল এ চার অকাট্য তথ্যসূত্রের কোনোটি দ্বারা প্রমাণিত হতে পারে। এর বাইরে , কমপক্ষে বর্ণনা ধারাক্রমের প্রথম স্তরে তথা ছাহাবী স্তরে স্বল্পসংখ্যক সূত্রে বর্ণিত হাদীছ (মনীষীদের পরিভাষায় যা খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ নামে পরিচিত) ও ইসলাম বিশেষজ্ঞ মনীষীদের মতামত কেবল উক্ত চার সূত্রের কোনোটির সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়া সাপেক্ষে গৌণ (মুস্তাহাব্ ও মাকরূহ্) ও প্রায়োগিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য।

তবে অত্র আলোচনায় আমরা প্রধানতঃ আক্ব্ল্ ও কোরআন মজীদের ভিত্তিতেই ফয়ছালায় উপনীত হবার জন্য চেষ্টা করবো। কারণ , আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে যথাসম্ভব সংক্ষেপে অকাট্য ফয়ছালায় উপনীত হওয়া। এ ক্ষেত্রে অবশিষ্ট দলীলগুলোর আশ্রয় নিতে গেলে আলোচনা শুধু দীর্ঘই হবে না , বরং অবিতর্কিত ফয়ছালায় উপনীত হওয়াও বেশ কঠিন হয়ে পড়তে পারে। কারণ , এমনকি কোনো মুতাওয়াতির্ হাদীছ সম্পর্কেও কেউ তার মুতাওয়াতির্ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করতে পারে। ফলে এরূপ সম্ভাব্য সন্দেহ মোকাবিলার জন্য অনেক বেশী বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন হয়ে পড়ে ; খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা তো খুবই সাধারণ ব্যাপার , বিশেষ করে যখন পরস্পর বিরোধী হাদীছের অস্তিত্ব থাকে। তাই অত্র গ্রন্থে আলোচ্য প্রসঙ্গে আমরা কেবল এমন খুবই সীমিত সংখ্যক হাদীছের দলীল গ্রহণ করেছি যেগুলোর যথার্থতা সম্বন্ধে ইজমা এ উম্মাহরয়েছে। এর বাইরে কদাচিৎ অন্য কোনো দলীল উপস্থাপন করলে তা কেবল সহায়ক হিসেবে , মূল দলীল হিসেবে নয়।

সর্বোপরি , যদি আক্বল্ ও কোরআন মজীদ কোনো বিষয়ে অকাট্য ফয়ছালায় উপনীত হবার জন্য যথেষ্ট হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে অন্যান্য দলীলের দ্বারস্থ হয়ে আলোচনার কলেবর বৃদ্ধি করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না।

কোরআন মজীদে রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন কোরআন মজীদের সূরাহ্ আল্-আহযাবের ২৮ নং আয়াত থেকে ৩৩ নং আয়াতের প্রথমাংশ পর্যন্ত হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর বিবিগণ সম্পর্কে নির্দেশাদি দিয়েছেন এবং এরপর ৩৩ নং আয়াতের দ্বিতীয়াংশে আহলে বাইতের কথা উল্লেখ করেছেন। আয়াতগুলো হচ্ছে :

( يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لأزْوَاجِكَ إِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا فَتَعَالَيْنَ أُمَتِّعْكُنَّ وَأُسَرِّحْكُنَّ سَرَاحًا جَمِيلا. وَإِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالدَّارَ الآخِرَةَ فَإِنَّ اللَّهَ أَعَدَّ لِلْمُحْسِنَاتِ مِنْكُنَّ أَجْرًا عَظِيمًا. يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ مَنْ يَأْتِ مِنْكُنَّ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ يُضَاعَفْ لَهَا الْعَذَابُ ضِعْفَيْنِ وَكَانَ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرًا. وَمَنْ يَقْنُتْ مِنْكُنَّ لِلَّهِ وَرَسُولِهِ وَتَعْمَلْ صَالِحًا نُؤْتِهَا أَجْرَهَا مَرَّتَيْنِ وَأَعْتَدْنَا لَهَا رِزْقًا كَرِيمًا. يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلا مَعْرُوفًا. وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الأولَى وَأَقِمْنَ الصَّلاةَ وآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا)

“ হে নবী! আপনার স্ত্রীদেরকে বলুন , তোমরা যদি পার্থিব জীবন ও তার সৌন্দর্য (ভোগ-বিলাসিতা) কামনা কর তাহলে এসো , আমি তোমাদেরকে ভোগ্য উপকরণাদির ব্যবস্থা করে দেই এবং তোমাদেরকে উত্তমভাবে বিদায় করে দেই। আর তোমরা যদি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে এবং পরকালের গৃহকে কামনা কর তাহলে অবশ্যই (জেনো যে ,) আল্লাহ্ তোমাদের মধ্যকার উত্তম কর্ম সম্পাদনকারীদের জন্য মহাপুরষ্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন। হে নবী-পত্নীগণ! তোমাদের মধ্য থেকে যে প্রকাশ্যে অশ্লীল কাজ করবে তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হবে এবং এটা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ। আর তোমাদের মধ্য থেকে যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অনুগত থাকবে এবং নেক আমল সম্পাদন করবে সে জন্য তাকে আমি দুই বার পুরষ্কার প্রদান করবো এবং আমি তার জন্য সম্মানজনক রিয্ক্ব প্রস্তুত করে রেখেছি। হে নবী-পত্নীগণ! তোমরা অন্য কোনো নারীর মতো নও ; (অতএব ,) তোমরা যদি তাক্ব্ওয়া অবলম্বন করে থাকো তাহলে তোমরা (পরপুরুষদের সাথে) তোমাদের কথায় কোমলতার (ও আকর্ষণীয় ভঙ্গির) আশ্রয় নিয়ো না , কারণ , তাহলে যার অন্তরে ব্যাধি আছে সে প্রলুব্ধ হবে। বরং তোমরা স্বাভাবিকভাবে কথা বলো। আর তোমরা তোমাদের গৃহে অবস্থান করো এবং পূর্বতন জাহেলীয়াত্-যুগের সাজসজ্জা প্রদর্শনীর ন্যায় সাজসজ্জা প্রদর্শন করে বেড়িয়ো না। আর তোমরা নামায কায়েম রাখো , যাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো। হে আহলে বাইত! আল্লাহ্ অবশ্যই তোমাদের থেকে অপকৃষ্টতা অপসারিত করতে এবং তোমাদেরকে পরিপূর্ণরূপে পূতপবিত্র করতে চান। ”

এখানে সর্বপ্রথম লক্ষণীয় বিষয় এই যে , ৩৩ নং আয়াতের শেষাংশে আহলে বাইতকে সম্বোধন করে কথা বলার পূর্ব পর্যন্ত আলোচনা ও নির্দেশাদির লক্ষ্য হচ্ছেন হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর বিবিগণ। প্রথমে নবী করীম (ছ্বাঃ)কে সম্বোধন করে তাঁর স্ত্রীগণকে ’ সতর্ক করার জন্য তাঁকে নির্দেশ দান করা হয়েছে। এরপর সরাসরি তাঁদেরকে হে নবী-পত্নীগণ! বলে সম্বোধন করা হয়েছে এবং তাঁদেরকে বুঝাবার জন্যکُنتُنَّ, تُرِدنَ, مِنکُنَّ ইত্যাদিতে বহুবচনে স্ত্রীবাচক সংযুক্ত সর্বনাম ব্যবহার থেকে এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহের অবকাশ থাকছে না যে , এ সব কথার লক্ষ্য তাঁরাই। কিন্তু ৩৩ নং আয়াতের শেষাংশে আহলে বাইতকে সম্বোধন করে কথা বলার ক্ষেত্রেعَنکُميُطَهِّرَکُم বলা হয়েছে-যাতে বহুবচনে পুরুষবাচক সংযুক্ত সর্বনাম ব্যবহার করা হয়েছে। আর আরবী ভাষায় বহুবচনে দু টি ক্ষেত্রে পুরুষবাচক সর্বনাম ব্যবহার করা হয় : শুধু পুরুষ বুঝাতে এবং নারী ও পুরুষ একত্রে বুঝাতে।

অতএব , এ থেকে সুস্পষ্ট যে , এখানে আহলে বাইত ” কথাটি আভিধানিক অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। কারণ , যেহেতু হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর পরিবারে কেবল তাঁর স্ত্রীগণ ছিলেন ; কোনো নাবালেগ (এমনকি সাবালেগও) পুরুষ সন্তান ছিলেন না , সেহেতু আহলে বাইত ” কথাটি আভিধানিক অর্থে ব্যবহার করা হলে আগের মতোই বহুবচনে স্ত্রীবাচক সম্বোধন ব্যবহার করা হতো। অতএব , এতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে , এখানে কথাটি বিশেষ পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে , আর সে অর্থে নারী ও পুরুষ উভয়ই হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর আহলে বাইত-এর মধ্যে শামিল রয়েছেন।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে এই যে , আহলে বাইত-এ শামিলকৃত পুরুষ সদস্য কে বা কারা এবং নারী সদস্যই বা কে অথবা কারা ? এ নারী সদস্য কি হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর বিবিগণ , নাকি অন্য কেউ , নাকি তাঁর বিবিগণের সাথে অন্য কেউ ?

এখানে আমাদেরকে আয়াতের বক্তব্যের ও তার বাচনভঙ্গির প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে।

উল্লিখিত আয়াত সমূহে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর বিবিগণ সম্পর্কে এবং তাঁদেরকে সম্বোধন করে যে সব কথা বলা হয়েছে তাতে তাঁদেরকে কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে , বরং চরম পত্র দেয়া হয়েছে , কয়েকটি বিষয়ে নিষেধ করা হয়েছে এবং কয়েকটি বিষয়ে আদেশ দেয়া হয়েছে। চরম পত্রের বিষয় হচ্ছে এই যে , তাঁরা পার্থিব জীবন ও তার সৌন্দর্য (ভোগ-বিলাসিতা) কামনা করলে তাঁদেরকে বিদায় করে দেয়া হবে। এতে এ ইঙ্গিত রয়েছে যে , তাঁরা পার্থিব উপায়-উপকরণাদির জন্য হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন।

এছাড়া তাঁদেরকে পরবর্তী বক্তব্যে যে সব বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে ও নিষেধ করা হয়েছে সে সব বিষয়ে কোরআন মজীদের অন্যত্র সাধারণভাবে এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সকল মু ’ মিনা নারীকেই সতর্ক ও নিষেধ করা হয়েছে , কিন্তু এ সত্ত্বেও নবী-পত্নীগণকে স্বতন্ত্রভাবে সতর্কীকরণ ও নিষেধকরণ থেকে এ ইঙ্গিত মিলে যে , অন্য মু ’ মিনা নারীদের মতোই তাঁদেরও ঐ সব বিষয় থেকে মুক্ত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত নয় , কিন্তু রাসূলের (ছ্বাঃ)-এর বিবি হিসেবে তাঁর মর্যাদার সাথে জড়িত বিধায় তাঁদের এ সব থেকে মুক্ত থাকা অনেক বেশী প্রয়োজন এবং এ কারণেই তাঁদেরকে আলাদাভাবে সতর্ক করা ও নিষেধ করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। সুস্পষ্ট যে , একই অপরাধ করলে সাধারণ মু ’ মিনা নারীর তুলনায় তাঁদের দ্বিগুণ শাস্তি দেয়ার ফয়ছালার কারণও এটাই যে , তাঁদের আচরণের সাথে রাসূলের (ছ্বাঃ) ব্যক্তিগত মর্যাদা ও আল্লাহর দ্বীনের মর্যাদা জড়িত।

এখানে আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় এই যে , বিদায় করে দেয়ার হুমকির ক্ষেত্রে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর বিবিগণের সকলকে একত্রে শামিল করা হয়েছে যা থেকে প্রমাণিত হয় যে , এ ব্যাপারে দাবী তোলা বা চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁরা সকলেই শামিল ছিলেন।

যদিও , উল্লেখ না করলে নয় যে , স্ত্রী বা স্ত্রীগণ স্বামীর কাছে স্বাভাবিক ভরণ-পোষণ ও ভোগোপকরণ দাবী ’ করলে , এবং এমনকি তার অতিরিক্ত অলঙ্কারাদি ও আরাম-আয়েশের উপকরণাদির জন্য আবদার ’ করলে তা গুনাহর কাজ নয় , তেমনি স্বামীর জন্যও স্ত্রীকে বা স্ত্রীদেরকে তালাক্ব্ দেয়া নাজায়েয নয়। কিন্তু রাসূলের (ছ্বাঃ) বিবি হওয়ার মর্যাদার এটাই দাবী ছিলো যে , তিনি যা কিছু দিতে সক্ষম তার চেয়ে বেশী দাবী করে (এমনকি বৈধ হলেও) তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হবে না , কিন্তু তা সত্ত্বেও চাপ সৃষ্টি করা হলে তা আল্লাহ্ তা আলার পসন্দনীয় হয় নি।

কিন্তু গুনাহর জন্য শাস্তির ভয় দেখানো ও নেক আমলের পুরষ্কারের সুসংবাদের বিষয়গুলোতে তাঁদের সকলকে সম্মিলিতভাবে শামিল না করে প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক করা হয়েছে ও সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।

অতঃপর আহলে বাইত সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে :

( إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا)

“ হে আহলে বাইত! আল্লাহ্ অবশ্যই তোমাদের থেকে অপকৃষ্টতা অপসারিত করতে এবং তোমাদেরকে পরিপূর্ণরূপে পূতপবিত্র করতে চান। ”

আয়াতের এ অংশে ব্যবহৃত শব্দাবলীর প্রতি সতর্কতার সাথে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই যে , এখানে আল্লাহ্ তা আলা আহলে বাইতকে সম্বোধন করলেও হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর বিবিগণের ন্যায় তাঁদেরকে কোনোরূপ সতর্কীকরণ তো দূরের কথা , কোনো আদেশ দেন নি বা নছীহতও করেন নি। বরং এখানে আল্লাহ্ তা আলা আহলে বাইত সম্পর্কে তাঁর দু টি ফয়ছালা বা সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছেন। তা হচ্ছে , তিনি তাঁদের থেকে অপকৃষ্টতা অপসারিত করতে এবং তাঁদেরকে পরিপূর্ণরূপে পূতপবিত্র করতে চান। আর এ সিদ্ধান্ত ঘোষণার বাক্য শুরু করা হয়েছেانما (অবশ্যই) শব্দ দ্বারা। এর মানে হচ্ছে , এটি একটি অপরিবর্তনীয় সিদ্ধান্ত ; কোনোরূপ দুই সম্ভাবনাযুক্ত বিকল্প সিদ্ধান্ত নয়। এ থেকে আহলে বাইতের ( আঃ) পাপমুক্ততা (عصمة )-ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়।

কিন্তু এর বাইরে কোরআন মজীদে কোথাওই হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর বিবিগণের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই পাপমুক্ততা (عصمة )-এর ঘোষণা দেয়া হয় নি।

[এখানে আমরা বলে রাখতে চাই যে , কারো মা ছূম্ (معصوم -পাপমুক্ত) হওয়ার মানে এই যে , তিনি নিশ্চিতভাবেই পাপমুক্ত ছিলেন , কিন্তু কারো মা ছূম্ না হওয়ার মানে এই নয় যে , তিনি নিশ্চিতভাবেই পাপ করেছেন। বরং মা ছূম্ না হওয়ার মানে হচ্ছে , পাপ থেকে মুক্ত থাকার নিশ্চয়তা না থাকা। এমতাবস্থায় কারো পাপে লিপ্ত হওয়ার বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে পাপী বলে গণ্য করা চলে না।]

কোরআন মজীদের উপরোদ্ধৃত আয়াত সমূহে ব্যবহৃত বাচনভঙ্গি থেকেই সুস্পষ্ট যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর বিবিগণ মা ছূম্ ছিলেন না। অবশ্য কোরআন মজীদে তাঁদেরকে মু মিনাদের মাতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে (সূরাহ্ আল্-আহযাব্ : ৬) এবং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের পর তাঁদের কাউকে বিবাহ করা মু মিনাদের জন্য হারাম করে দেয়া হয় (সূরাহ্ আল্-আহযাব্ : ৫৩) । এ কারণে তাঁদের সাথে মু মিনাদের যে সম্মানার্হ সম্পর্ক তার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে তাঁদের মর্যাদাকে পাপমুক্ততার পর্যায়ে উন্নীত করার চেষ্টা করেন।

কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো মু মিনাদের জন্য মাতৃস্বরূপ হওয়া আর মা ছূম্ হওয়ার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই , ঠিক যেমন কোনো মু মিনা ব্যক্তির জন্মদাত্রী মায়ের সাথে তার সম্মানার্হ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তার মাকে অনিবার্যভাবেই মা ছূম্ বলে গণ্য করা সঠিক হতে পারে না। এমনকি কোনো মু মিনা ব্যক্তির পিতা-মাতা যদি কাফেরও হয় তাহলেও তাদের সাথে সম্মানার্হ ও সৌজন্যমূলক আচরণ অব্যাহত রাখার জন্য কোরআন মজীদে নির্দেশ দেয়া হয়েছে , কিন্তু ঐ মু মিনা ব্যক্তির এ আচরণ তার পিতা-মাতাকে মু ’ মিনে পরিণত করবে না।

মু মিনাদের জন্য হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর বিবিগণকে মায়ের ন্যায় সম্মানার্হ গণ্য করার বিষয়টিও একই ধরনের। প্রকৃত পক্ষে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর স্ত্রীর মর্যাদাই তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকে মু মিনাদের জন্য অপরিহার্য করেছে। কারণ , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) মু মিনাদের জন্য পিতৃতুল্য , বরং তিনি পিতার চেয়েও অধিকতর সম্মান , শ্রদ্ধা , ভক্তি ও ভালোবাসা পাবার হক্বদার। এমতাবস্থায় তাঁর পরে তাঁর কোনো স্ত্রীকে বিবাহ করলে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর প্রতি পূর্বানুরূপ সম্মান , শ্রদ্ধা , ভক্তি ও ভালোবাসা বজায় থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। এমতাবস্থায় তাঁর পরে তাঁর বিবিগণকে বিবাহ করা হারাম হওয়া ও তাঁদেরকে মাতৃতুল্য গণ্য করা অপরিহার্য ছিলো। কিন্তু এর দ্বারা কিছুতেই তাঁদেরকে মা ছূম্ বলে গণ্য করা চলে না।

যদিও অনুরূপ ক্ষেত্রে অতীতের নবী-রাসূলগণের ( আঃ) বিবিগণের ব্যাপারে আল্লাহ্ তা আলার বিধান কী ছিলো তা কোরআন মজীদে উল্লেখ করা হয় নি (এবং তা উল্লেখের প্রয়োজনও ছিলো না) । তবে আমরা নিদ্বির্ধায় ধরে নিতে পারি যে , অতীতের নবী-রাসূলগণের ( আঃ) বিবিগণের ক্ষেত্রেও আল্লাহ্ তা আলার বিধান অভিন্ন ছিলো। কিন্তু তাঁদের ক্ষেত্রেও মা ছূম্ হওয়ার বিষয় প্রমাণিত হয় না। অর্থাৎ তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মা ছূম্ থেকে থাকলে তা ব্যক্তি হিসেবে , নবী-রাসূলের ( আঃ) স্ত্রী হিসেবে নয়। তার প্রমাণ , কোরআন মজীদে হযরত নূহ্ ( আঃ) ও হযরত লূত্ব ( আঃ)-এর স্ত্রীর কুফরী ও জাহান্নামী হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লিখিত হয়েছে। একটি ঐশী মূলনীতি হিসেবে নবী-রাসূলের ( আঃ) স্ত্রী তথা মু মিনাদের মাতা হওয়া যদি কারো পাপমুক্ততা নিশ্চিত করতো তাহলে ঐ দু জন নারী তার ব্যতিক্রম হতো না।

নীতিগতভাবে তথা একটি ঐশী মূলনীতি হিসেবে উম্মাহাতুল মু ’ মিনীন অর্থাৎ হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর বিবিগণ-এর মা ছূম্ না হওয়ার তথা আহলে বাইত-এর অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার বিষয়টি উল্লিখিত আয়াত সমূহ ও উপরোক্ত আলোচনা থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। কোরআন মজীদের আরো কতক আয়াত থেকে এ বিষয়টি অধিকতর সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ এখানে যা এজমালীভাবে প্রমাণিত হয় অন্য কতক আয়াত থেকে তা দৃষ্টান্ত সহকারে প্রমাণিত হয়।

কোরআন মজীদের সূরাহ্ আত্-তাহরীম্ থেকে জানা যায় যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) তাঁর কোনো একজন স্ত্রীর কাছে একটি গোপন কথা বললে তিনি গোপনীয়তা ভঙ্গ করে তা রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর অপর এক স্ত্রীর কাছে বলে দেন। এছাড়া তাঁর দুই স্ত্রী[ যথাসম্ভব দু জনই অর্থাৎ যারা একজন আরেক জনের কাছে রাসূলুল্লাহ্ ( ছ্বাঃ )- এর গোপন কথা বলে দিয়েছিলেন ] রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর বিরুদ্ধে ” পরস্পরকে সাহায্য করতে তথা তাঁর বিরুদ্ধে কোনো একটি বিষয়ে চক্রান্ত করতে যাচ্ছিলেন। এ জন্য আল্লাহ্ তা আলা তাঁদেরকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেন ও সতর্ক করে দেন এবং তাওবাহ্ করার জন্য নছীহত্ করেন।

[আহলে সুন্নাতের ওলামায়ে কেরামের দৃষ্টিতে নির্ভরযোগ্য বলে পরিগণিত বিভিন্ন হাদীছ-গ্রন্থ ও তাফসীরে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর এ দু জন স্ত্রীর নাম সুনির্দিষ্টভাবে এবং সংশ্লিষ্ট গোপন কথা সংক্রান্ত ঘটনা ও চক্রান্তের বর্ণনা সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লিখিত আছে। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে তাঁদেরকে চিহ্নিত করা আমাদের অত্র আলোচনার জন্য অপরিহার্য নয়। তাই এখানে আমরা তাঁদের কারো নামোল্লেখ থেকে বিরত থাকছি। বরং আমাদের আলোচনা হচ্ছে একটি নীতিগত আলোচনা। এ কারণে , তাঁদের মধ্য থেকে একজনের ব্যাপারেও যদি মা ছূম্ না হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয় (তা যিনিই হোন না কেন) তাহলে তা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে , কেবল হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর স্ত্রীর মর্যাদা কাউকে মা ছূম্ বানাতে পারে না।]

এরশাদ হয়েছে :

) وَإِذْ أَسَرَّ النَّبِيُّ إِلَى بَعْضِ أَزْوَاجِهِ حَدِيثًا فَلَمَّا نَبَّأَتْ بِهِ وَأَظْهَرَهُ اللَّهُ عَلَيْهِ عَرَّفَ بَعْضَهُ وَأَعْرَضَ عَنْ بَعْضٍ فَلَمَّا نَبَّأَهَا بِهِ قَالَتْ مَنْ أَنْبَأَكَ هَذَا قَالَ نَبَّأَنِيَ الْعَلِيمُ الْخَبِيرُ(

“ আর নবী যখন তাঁর স্ত্রীদের কারো কাছে কোনো একটি কথা গোপনে বললেন , অতঃপর সে (অন্য কাউকে) তা জানিয়ে দিলো এবং আল্লাহ্ তাঁর [রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর] কাছে তা প্রকাশ করে দিলেন তখন তিনি (তাঁর ঐ স্ত্রীকে) তার কিছুটা জানালেন এবং কিছুটা জানালেন না। আর তিনি যখন তাকে তা জানালেন তখন সে বললো : কে আপনাকে এটি জানিয়েছে ? তিনি বললেন : পরম জ্ঞানী সর্বজ্ঞ (আল্লাহ্)ই আমাকে জানিয়েছেন। ” (সূরাহ্ আত্-তাহরীম : ৩)

এতে কোনোই সন্দেহ নেই যে , যে কোনো ঈমানদার কর্তৃক , বিশেষ করে নবীর (ছ্বাঃ) একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি কর্তৃক-যাকে তিনি বিশ্বাস করে কোনো গোপন কথা বলেছিলেন-তাঁর গোপন কথা অন্যের কাছে বলে দেয়া একটি গুরুতর বিষয় ছিলো।

কিন্তু বিষয়টি এখানেই শেষ নয়।

আল্লাহ্ তা আলা এরপর এরশাদ করেছেন :

) إِنْ تَتُوبَا إِلَى اللَّهِ فَقَدْ صَغَتْ قُلُوبُكُمَا وَإِنْ تَظَاهَرَا عَلَيْهِ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ مَوْلاهُ وَجِبْرِيلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمَلائِكَةُ بَعْدَ ذَلِكَ ظَهِيرٌ( .

“ তোমাদের দু জনের অন্তর অন্যায়ের প্রতি ঝুঁকে পড়ার কারণে তোমরা যদি তাওবাহ্ করো (তো ভালো কথা) , নচেৎ তোমরা দু জন যদি তাঁর (রাসূলের) বিরুদ্ধে পরস্পরকে সহায়তা করো (তথা তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করো) তাহলে (জেনে রেখো ,) অবশ্যই আল্লাহ্ই তাঁর অভিভাবক , আর এছাড়াও জিবরাঈল , উপযুক্ত মু মিনাগণ ও ফেরেশতাগণ তাঁর সাহায্যকারী। ” (সূরাহ্ আত্-তাহরীম : ৪)

পরবর্তী আয়াত থেকে মনে হয় যে , তাঁদের দু জনের কাজটি এমনই গুরুতর ছিলো যে কারণে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর পক্ষ থেকে তাঁদেরকে তালাক্ব প্রদান করা হলেও অস্বাভাবিক হতো না। আর তাতে দ্বিবচনের পরিবর্তে স্ত্রীবাচক বহুবচন ব্যবহার থেকে মনে হয় যে , রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর স্ত্রীগণের মধ্যে যারা এ চক্রান্তে অংশ নেন নি সম্ভবতঃ তাঁরাও বিষয়টি জানার পরে তাতে বাধা দেন নি বা রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-কে সাথে সাথে অবগত করেন নি , তাই এ শৈথিল্যের কারণে তাঁদেরকেও তালাক্ব দেয়া হলে তা-ও অস্বাভাবিক হতো না।

এরশাদ হয়েছে :

) عَسَى رَبُّهُ إِنْ طَلَّقَكُنَّ أَنْ يُبْدِلَهُ أَزْوَاجًا خَيْرًا مِنْكُنَّ مُسْلِمَاتٍ مُؤْمِنَاتٍ قَانِتَاتٍ تَائِبَاتٍ عَابِدَاتٍ سَائِحَاتٍ ثَيِّبَاتٍ وَأَبْكَارًا(

“ তিনি (রাসূল) যদি তোমাদেরকে তালাক্ব প্রদান করেন তাহলে হয়তো তাঁর রব তোমাদের পরিবর্তে তাঁকে তোমাদের চেয়ে উত্তম এমন স্ত্রীবর্গ প্রদান করবেন যারা হবে (আল্লাহর কাছে) আত্মসমর্পিত , মু ’ মিনাহ্ , আজ্ঞাবহ , তাওবাহ্কারিনী , ইবাদত-কারিনী ও (আল্লাহর পথে) পরিভ্রমণকারিনী এবং পবিত্রা ও কুমারী। ” (সূরাহ্ আত্-তাহরীম : ৫)

এ আয়াতে এ ধরনের ইঙ্গিতও রয়েছে যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ঐ সময় জীবিত বিবিগণের কারো মধ্যেই এতে উল্লিখিত সবগুলো গুণ-বৈশিষ্ট্য বাঞ্ছিত সর্বোচ্চ মাত্রায় ছিলো না।

এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর বিবিগণ মা ছূম্ ছিলেন না এবং তাঁরা আহলে বাইত-এর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। কিন্তু এরপরও অনেকে ভাবাবেগের বশে কেবল আল্লাহর রাসূলের স্ত্রী হবার কারণে তাঁদেরকে পাপ ও ভুলের উর্ধে গণ্য করেন। তাঁদের এ ভুল ভেঙ্গে যাওয়ার জন্য কোরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতই যথেষ্ট হওয়া উচিত-যা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর স্ত্রীগণের সমালোচনা ও তাঁদের উদ্দেশে উচ্চারিত হুমকির ধারাবাহিকতায় তাঁদেরকে সতর্ক করার লক্ষ্যে নাযিল হয়েছে :

) ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلا لِلَّذِينَ كَفَرُوا اِمْرَأَةَ نُوحٍ وَامْرَأَةَ لُوطٍ كَانَتَا تَحْتَ عَبْدَيْنِ مِنْ عِبَادِنَا صَالِحَيْنِ فَخَانَتَاهُمَا فَلَمْ يُغْنِيَا عَنْهُمَا مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَقِيلَ ادْخُلا النَّارَ مَعَ الدَّاخِلِينَ(

“ যারা কাফের হয়েছে তাদের জন্য আল্লাহ্ নূহের স্ত্রী ও লূত্বের স্ত্রীর উপমা প্রদান করেছেন ; তারা দু জন আমার দু জন নেক বান্দাহর আওতায় (বিবাহাধীনে) ছিলো , কিন্তু তারা উভয়ই তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। ফলে তারা দু জন (নূহ্ ও লূত্ব) তাদের দু জনকে আল্লাহর (শাস্তি) থেকে রক্ষা করতে পারলো না ; আর তাদেরকে বলা হলো : (অন্যান্য) প্রবেশকারীদের সাথে দোযখে প্রবেশ করো। ” (সূরাহ্ আত্-তাহরীম্ : ১০)

এছাড়াও আল্লাহ্ তা আলা কোরআন মজীদে বিশেষভাবে উম্মাহাতুল্ মু ’ মিনীনকে সম্বোধন করে বলেছেন : (وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ )- আর তোমরা তোমাদের গৃহে অবস্থান কর। ” (সূরাহ্ আল্-আহযাব্ : ৩৩) কিন্তু তা সত্ত্বেও সর্বসম্মত ও মশহূর ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী তাঁদের একজন আল্লাহ্ তা আলার এ বিশেষ আদেশ অমান্য করে বৈধ খলীফাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং রণাঙ্গনে গিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করেন যার পরিণতিতে হাজার হাজার মুসলমানের প্রাণহানি ঘটে। এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে , উম্মাহাতুল্ মু ’ মিনীন্ মা ছূম্ ছিলেন না এবং আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12