রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ

রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ0%

রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 17654
ডাউনলোড: 2593

পাঠকের মতামত:

রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 15 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 17654 / ডাউনলোড: 2593
সাইজ সাইজ সাইজ
রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ

রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) আহলে বাইত ও বিবিগণ

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

ইমামত কেবল ইমাম হোসেনের (আঃ) বংশধারায় কেন

অনেককে প্রশ্ন তুলতে দেখা যায় যে , আহলে বাইতের ( আঃ) ধারাবাহিকতায় ইমামতের বিষয়টি যদি সত্য হবে তো সে ক্ষেত্রে শেষ নয় জন ইমামের সকলেই হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)-এর বংশধরদের মধ্য থেকে কেন ? হযরত ইমাম হাসান ( আঃ)-এর বংশধরদের মধ্য থেকে কোনো ইমাম নেই কেন ?

বস্তুতঃ ইমামতের আক্বীদাহর বিষয়টির ভিত্তির প্রতি দৃষ্টি না দেয়ার কারণেই এ ধরনের প্রশ্নর উদ্রেক হয়। ইমামতের আক্বীদাহর ভিত্তি এ নয় যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার দাবী অনুযায়ী লোকেরা তাঁর আহলে বাইতের ( আঃ) মধ্য থেকে ইমাম বেছে নেবে , বরং ইমামত আক্বীদাহর ভিত্তি হচ্ছে এই যে , স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর পর্যায়ক্রমিক স্থলাভিষিক্ত হিসেবে তাঁর আহলে বাইত ( আঃ) থেকে বারো জন ইমাম মনোনীত করেছেন এবং তাঁর মাধ্যমে তা উম্মাহকে জানিয়ে দিয়েছেন। আর আল্লাহ্ তা আলা আহলে বাইতের ( আঃ) মধ্য থেকে কাকে এবং কার বংশধরদের মধ্য থেকে কতো জনকে ইমাম নিয়োগ করবেন এটা একান্তই তাঁর ইচ্ছা ও এখতিয়ারাধীন ব্যাপার। এ ব্যাপারে কারোই প্রশ্ন করার অধিকার নেই। যে সব হাদীছে বারো জন ইমামের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাতে হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)-এর পর্যায়ক্রমিক বংশধরদের মধ্য থেকে নাম ও কার পুত্র কে তা সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রশ্নের জবাব হিসেবে এটাই যথেষ্ট। তবে আমরা যদি বাস্তবতাকে পর্যালোচনা করি তাহলেও একই উপসংহারে উপনীত হতে বাধ্য হই।

কারবালায় হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)-এর শাহাদাতের সময় তাঁর পুত্র আলী ইবনে হোসেন ( আঃ)-যিনি হযরত ইমাম যায়নুল্ আবেদীন্ ( আঃ) নামে সমধিক পরিচিত-ছিলেন যুবক এবং সে হিসেবে তাঁর ইয়াযীদী বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার কথা। কিন্তু আল্লাহ্ তা আলার ইচ্ছায় তিনি ঐ সময় গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে মরণাপন্ন অবস্থায় ছিলেন বিধায় ইয়াযীদী সৈন্যরা তাঁকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকে। আল্লাহর ইচ্ছায় পরে শীঘ্রই তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং ইমামতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

এখানে আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত হওয়ার বিষয়টি তর্কের খাতিরে বিবেচনার বাইরে রাখলেও ইলম্ ও তাক্ব্ওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে , তাঁর যুগে ইসলামী উম্মাহর মধ্যে দ্বীনী নেতৃত্বের জন্য তাঁর তুলনায় যোগ্যতর ব্যক্তিত্বের অস্তিত্ব ছিলো না। অনুরূপভাবে তাঁর পুত্র হযরত মুহাম্মাদ বিন্ আলী ( আঃ)- যিনি ইমাম বাক্বের্ ( আঃ) নামে সমধিক পরিচিত- ইলমী বিচারে স্বীয় যুগের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং তাঁকে বাক্বেরুল্ উলূম্ ” (জ্ঞানসমূহের ব্যবচ্ছেদকারী) হিসেবে অভিহিত করা হতো। আর তাঁর পুত্র হযরত ইমাম জা ফার্ ছাদেক্ব্ ( আঃ) সম্পর্কে বেশী কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ , আহলে সুন্নাতের চার জন ইমাম ছিলেন তাঁর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ছাত্র এবং ইসলামী উম্মাহর ইতিহাসে হযরত আলী ( আঃ)-এর মাধ্যমে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া ইলম্ তাঁর মাধ্যমে সর্বাধিক মাত্রায় ফুলে-ফলে বিকশিত হয়-যার সমতুল্য দ্বিতীয় ব্যক্তি পরবর্তী কোনো প্রজন্মেই জন্মগ্রহণ করেন নি। পরবর্তী ইমামগণ ( আঃ) এ ইলম্-কেই স্বীয় ভক্ত-অনুসারীদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত ইমাম হাসান ( আঃ)-এর বংশে বহু আলেম , বুযুর্গ ও মুজাহিদ ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটলেও এ ইমামগণের ( আঃ) সমতুল্য কোনো ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে নি এবং তাঁরা সাধারণতঃ এ ইমামগণেরই ( আঃ) অনুসরণ করেছেন।

উপরোক্ত প্রশ্নের জবাবে যরূরী না হলেও প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে , হযরত ইমাম যায়নুল্ আবেদীন ( আঃ)-এর পুত্র হযরত যায়দ্ (রাহ্ঃ)-এর নামে যে যায়দী মাযহাব তৈরী হয়েছে তা তিনি নিজে তৈরী করেন নি , বরং তাঁর নামে তৈরী করা হয়েছে। অন্যদিকে হযরত ইমাম জা ফার্ ছাদেক্ব্ ( আঃ)-এর পুত্র ইসমা ঈল (রাহ্ঃ)-যার নামে ইসমা ঈলীয়াহ্ মাযহাব তৈরী করা হয়-তাঁর পিতার জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন , সুতরাং তাঁর পক্ষে হযরত ইমাম জা ফার্ ছাদেক্ব্ ( আঃ)-এর পরে ইমামতে অধিষ্ঠিত হবার প্রশ্নই ওঠে না।

তাছাড়া বারো ইমামের ধারা থেকে [বিশেষ করে হযরত ইমাম জা ফার্ ছাদেক্ব্ ( আঃ) থেকে] যেভাবে সমগ্র উম্মাহর জন্য ইলমী দিকনির্দেশনা পাওয়া গিয়েছে অন্য কোনো ধারা থেকে তা পাওয়া যায় নি। এ বাস্তবতা হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)-এর বংশধরদের মধ্য থেকে পরবর্তী ইমামগণের ( আঃ) মনোনীত হওয়া সংক্রান্ত হাদীছের বাস্তব প্রতিফলনই প্রমাণিত হয়।

রক্তধারার পবিত্রতা : একটি বিভ্রান্তির নিরসন

ইতিপুর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে (সূরাহ্ আলে ইমরান্ : ৩৩-৩৪) নবী-রাসূলগণ ( আঃ) হচ্ছেনذُرِّيَّةً بَعْضُهَا مِنْ بَعْضٍ (কতক অপর কতকের বংশধর) । এ আয়াতাংশ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে , কোনো নবী-রাসূলের ( আঃ) (তেমনি আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত যে কোনো নিষ্পাপ ইমামের) পূর্বতন রক্তধারায় কখনোই শিরক ও গুনাহের সংমিশ্রণ ঘটে নি। যদিওذُرِّيَّةً بَعْضُهَا مِنْ بَعْضٍ বলতে কেবল একে অপরের অব্যবহিত বংশধরই বুঝায় না , বরং মধ্যবর্তী স্তরে এক বা একাধিক অ-নবী সহ পরবর্তী বংশধরও বুঝায় , কিন্তু এ মধ্যবর্তী স্তরগুলোতে যদি শিরক ও গুনাহের সংমিশ্রণ ঘটে তাহলে পরবর্তী স্তরের নবীকে (এবং সেই সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত নবীর গুণাবলী সম্পন্ন নিষ্পাপ ইমামকে) পূর্ববর্তী নবীর বংশধর বুঝাতেذُرِّيَّةً بَعْضُهَا مِنْ بَعْضٍ -এর উল্লেখ অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ , সে ক্ষেত্রে কথাটি দাঁড়ায় আল্লাহর নবী হযরত আদম ( আঃ)-এর বংশধর হিসেবে নমরূদ ও ফির ’ আউন্ সহ সমস্ত মানুষকে নবীর বংশধর বলে উল্লেখ করার অনুরূপ-যার উল্লেখ অর্থহীন বৈ নয়। আর আল্লাহ্ তা আলা যে কোনো ধরনের অর্থহীন কথা ও কাজ থেকে প্রমুক্ত। অতএব , সন্দেহ নেই যে , এটি আল্লাহ্ তা আলার একটি নীতি যে , তিনি যে কোনো নবী-রাসূলকেই (এবং তাঁর পক্ষ থেকে মনোনীত নবীর গুণাবলী সম্পন্ন নিষ্পাপ ইমামকে) এমন রক্তধারায় পাঠিয়েছেন যাতে কখনোই শিরক বা গুনাহের সংমিশ্রণ ঘটে নি।

কিন্তু হযরত ইবরাহীম্ ( আঃ)-এর পিতৃপরিচয় সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার কারণে অনেকেই এটিকে আল্লাহ্ তা আলার একটি নীতি হিসেবে গণ্য করতে প্রস্তুত নন।

যদিও এ বিষয়টি নবী-রাসূলগণের ( আঃ) পাপমুক্ততা (عصمة الانبياء ) সম্পর্কিত আলোচনায় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা সর্বোত্তম এবং অত্র গ্রন্থকারের গ্রন্থ নবী-রাসূলগণের ( আঃ) পাপমুক্ততা ” -য় এ সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে , তবে আলোচ্য পুস্তকের বিষয়বস্তুর সাথে প্রাসঙ্গিক বিধায় এখানেও আমরা সংক্ষেপে বিষয়টির ওপর আলোকপাত করছি।

কোরআন মজীদের সূরাহ্ আল্-আন্ ’ আমের ৭৪ নং আয়াতে হযরত ইবরাহীম্ ( আঃ) কর্তৃক আযার্ ও তার সম্প্রদায়ের মূর্তিপূজার সমালোচনার কথা উল্লেখ করতে গিয়েابيه آزر (তার আব্ আযার্) উল্লেখ করা হয়েছে এবং এ থেকেই আযার্-কে হযরত ইবরাহীম্ ( আঃ)-এর জন্মদাতা পিতা ’ বলে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে উক্ত আয়াতের ভিত্তিতে এটা নিশ্চিতরূপে ধরে নেয়া সম্ভব নয় যে , আযার্ তাঁর জন্মদাতা পিতা ছিলো। কারণ , আরবী ভাষায় আব্ (বাক্যমধ্যে ভূমিকাভেদেابو/ ابا/ ابی ) শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক যা দ্বারা জন্মদাতা পিতা ছাড়াও দাদা , চাচা , পালক পিতা ও বিপিতাকে এবং দাদার পূর্ববর্তী যে কোনো পূর্বপুরুষকেও বুঝানো হয়। কিন্তু শুধু জন্মদাতা পিতা বুঝানো উদ্দেশ্য হলে ওয়ালেদ ” (والد ) বলা হয়।

এমতাবস্থায় কয়েকটি কারণে উক্ত আয়াতে আযারকে হযরত ইবরাহীম্ ( আঃ)-এর জন্মদাতা পিতা বুঝানো হয়েছে বলে মনে করা যায় না। তা হচ্ছে :

১) আল্লাহ্ তা আলা জানতেন যে , এ বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে , এমতাবস্থায় জন্মদাতা পিতা বুঝানো উদ্দেশ্য হলেابيه না বলেوالده বললে বিভ্রান্তির কোনোই অবকাশ থাকতো না। অথবা শুধুابيه বলা হতো , আযরের নামোল্লেখ করার প্রয়োজন ছিলো না। কারণ , যেহেতু শব্দটির প্রথম অর্থ জন্মদাতা পিতা ’ সেহেতু এর সাথে অন্য অর্থজ্ঞাপক নিদর্শন না থাকলে এ থেকে জন্মদাতা পিতা ’ ছাড়া অন্য অর্থ গ্রহণের কোনোই কারণ থাকতো না। এমতাবস্থায় নিদর্শন জুড়ে দেয়া অর্থাৎ আযারের নামোল্লেখ থেকে সুস্পষ্ট যে , এখানে শব্দটিকে এর প্রথম অর্থে ব্যবহার করা হয় নি , বরং বুঝানো হয়েছে যে , এখানেابيه বলতে তাঁর জন্মদাতাকে বুঝানো হয় নি , বরং আযারকে (যে সম্ভবতঃ তাঁর পালক পিতা ছিলো) বুঝানো হয়েছে।

২) বিদ্যমান তাওরাতে হযরত ইবরাহীম্ ( আঃ)-এর জন্মদাতা পিতার নাম তেরহ্ ’ বা তারেহ্ ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এমতাবস্থায় কোরআন মজীদে তাঁর জন্মদাতা পিতার নাম আযার্ ” বলে উল্লেখ করা হলে তৎকালীন ইয়াহূদী ও খৃস্টান পণ্ডিতরা এর বিরুদ্ধে আপত্তি জানাতো ও এর ভিত্তিতে দাবী করতো যে , কোরআন আল্লাহর কালাম নয় বলেই এতে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে এবং এ নিয়ে তারা ব্যাপক প্রচার চালাতো। কিন্তু এ ধরনের প্রতিবাদ ও দাবীর কথা জানা যায় না। এ থেকে বুঝা যায় যে , তৎকালীন ইয়াহূদী ও খৃস্টান পণ্ডিতরাابيه থেকে তার জন্মদাতা পিতা ’ অর্থ গ্রহণ করে নি।

৩) হযরত ইবরাহীম্ ( আঃ) তাঁর নম্রহৃদয় বৈশিষ্ট্যের কারণে আযারের জন্য আল্লাহ্ তা আলার কাছে মাগফেরাত কামনা করতেন , কিন্তু তাঁর কাছে যখন অকাট্যভাবে সুস্পষ্ট হয়ে গেলো যে , সে আল্লাহর শত্রু তখন তিনি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন (এবং তার জন্য মাগফেরাত কামনা বন্ধ করে দিলেন) । (সূরাহ্ আত্-তাওবাহ্ : ১১৪) ।

এটা কখনকার ঘটনা কোরআন মজীদে তা উল্লেখ করা হয় নি (উল্লেখের প্রয়োজনও ছিলো না) , তবে এটা নিঃসন্দেহে ধরে নেয়া যায় যে , হযরত ইবরাহীম্ ( আঃ) অগ্নিকুণ্ড থেকে নিরাপদে বেরিয়ে এসে ফিলিস্তিনে হিজরতের আগেই তাঁর কাছে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে , আযারের ঈমান আনার আর কোনোই সম্ভাবনা নেই। এ কারণে তিনি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং তার জন্য মাগফেরাত কামনা বন্ধ করে দেন (সূরাহ্ আত্-তাওবাহ্ : ১১৪) । কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে , হিজরতের বহু বছর পরে তরুণ হযরত ইসমা ঈল ( আঃ)কে মক্কায় আল্লাহর ঘরের পাশে রেখে আসার (সূরাহ্ ইবরাহীম্ : ৩৭) সময়-যার আগেই হযরত ইসহাক্ব ( আঃ)-এর জন্ম হয়েছে ও তিনি [ইবরাহীম্ ( আঃ)] বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন (সূরাহ্ ইবরাহীম্ : ৩৯) (যখন তাঁর বয়স একশ ’ বছর পেরিয়ে গেছে) , তখন তিনি তাঁর পিতা-মাতার (والدي ) মাগফেরাতের জন্য আল্লাহ্ তা আলার কাছে দোআ করেন (সূরাহ্ ইবরাহীম্ : ৪১) । এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে , আযার্ তাঁর জন্মদাতা পিতা ছিলো না।

এ উপসংহার থেকে আরো একটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে , যেহেতু হযরত আলী ( আঃ)-এর আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার , উম্মাতে মুহাম্মাদীর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি হওয়ার , দ্বীনী নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের জন্য উপযুক্ততম ব্যক্তি হওয়ার এবং নবী না হয়েও পাপমুক্ততা সহ নবী-রাসূলগণের ( আঃ) গুণাবলী সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণিত সেহেতু তাঁর পিতৃপুরুষদের রক্তধারায় কখনো শিরক ও গুনাহের সংমিশ্রণ ঘটে নি। অতএব , তাঁর পিতা হযরত আবূ ত্বালিবের মুশরিক হওয়ার ও ইসলাম গ্রহণ না করার দাবী চরম রাজনৈতিক মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। বরং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর পিতা আবদুল্লাহ্ ও দাদা আবদুল মুত্তালিবের ন্যায় তাঁর চাচা ও হযরত আলী ( আঃ)-এর পিতা হযরত আবূ ত্বালিব্-ও শিরক ও গুনাহ্ থেকে মুক্ত তাওহীদবাদী ছিলেন , আর নবী করীম (ছ্বাঃ) কর্তৃক ইসলাম প্রচারের সূচনাতেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ কারণেই তিনি তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নবী করীম (ছ্বাঃ)কে সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করেছিলেন।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে , হযরত আবূ ত্বালিব্ কর্তৃক নবী করীম (ছ্বাঃ)কে আশ্রয় , পৃষ্ঠপোষকতা ও সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের বিষয়টি ইসলামের ইতিহাসের একটি বিতর্কাতীত বিষয় যে ব্যাপারে ইসলামের সকল মাযহাব ও ফিরক্বাহর মধ্যে মতৈক্য রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে , এটা কি সম্ভব যে , নবীকুলশিরোমণি হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ লাভের পরেও বছরের পর বছর ধরে একজন মুশরিকের আশ্রয়ে থাকবেন এবং তার কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণ করবেন ? এরূপ হলে তা কি ইসলামের জন্য একটি লজ্জাজনক ও অপমানজনক বিষয় হতো না ? এমনকি স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার জন্যও কি তাঁর শ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূলকে এরূপ লজ্জাজনক ও অপমানজনক অবস্থায় রেখে দেয়া সম্ভব ? অতএব , হযরত আবূ ত্বালিব্ মুশরিক ছিলেন বলে যে দাবী করা হয়েছে তা যে স্রেফ রাজনৈতিক মিথ্যাচার ছিলো এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই।

[এ ধরনের রাজনৈতিক মিথ্যাচারের দৃষ্টান্ত ইসলামের ইতিহাসে আরো অনেক আছে। হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)কে ক্ষমতালোভী বলে প্রচার করা হয়েছিলো। তেমনি এ মর্মে মিথ্যা হাদীছ রচনা করা হয়েছিলো যে , নবী করীম (ছ্বাঃ) তাঁর সামনে বসা ছাহাবীদের উদ্দেশে বলেন : এখন একজন জাহান্নামী ব্যক্তি এখানে প্রবেশ করবে , আর হযরত আলী ( আঃ) সেখানে প্রবেশ করলেন। (!!!)]

পাপমুক্ততা ও এখ্তিয়ার-এর সমন্বয় কীভাবে

অনেকের ধারণা যে , নবী-রাসূলগণ এবং আল্লাহ্ তা আলার মনোনীত ইমামগণ ও অন্যান্য খাছ বান্দাহর ( আঃ) পাপমুক্ততা (عصمة )-এর মানে এই যে , তাঁদের মধ্যে গুনাহ্ করার ক্ষমতাই দেয়া হয় নি। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। কারণ , তাঁদের মধ্যে গুনাহ্ করার ক্ষমতা না থাকলে তাঁরা ফেরেশতার পর্যায়ে গণ্য হতেন এবং সে ক্ষেত্রে তাঁরা মানুষের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ হতেন না। বস্তুতঃ তাঁদের মধ্যে গুনাহ্ করার ক্ষমতাই ছিলো না বলে ধরে নেয়ার কারণে অনেক লোক নিজেদের গুনাহর সপক্ষে এটিকে বাহানা হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো তাঁদের মধ্য থেকে গুনাহ্ করার ক্ষমতা বিলুপ্ত করা হয় নি , সুতরাং তাঁদের অবস্থাকে বাহানা হিসেবে গণ্য করে কারো পক্ষে গুনাহ্ করে পার পেয়ে যাবার কোনোই সুযোগ নেই।

এ বিষয়টিও মূলতঃ নবী-রাসূলগণের ( আঃ) পাপমুক্ততা ’ সংক্রান্ত আলোচনায় আলোচনার বিষয় এবং উপরোক্ত শিরোনামে অত্র গ্রন্থকারের গ্রন্থে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তবে অত্র পুস্তকের আলোচ্য বিষয়ের সাথে এর সম্পর্ক থাকায় এখানেও বিষয়টির ওপর সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো।

বস্তুতঃ নিষ্পাপ ব্যক্তিগণের মধ্যে গুনাহ্ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা স্বেচ্ছায় গুনাহ্ থেকে বিরত থাকেন। এটা সম্ভব হয় তাঁদের রক্তধারার পবিত্রতা , ঈমানের গভীরতা ও দৃঢ়তা এবং পূত-পবিত্র জীবন যাপনে অভ্যস্ততার কারণে। এর ফলে তাঁদের মধ্যে পাপ না করার বিষয়টি তাঁদের গোটা সত্তার (শরীর ও নাফ্স্ উভয়ের) অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়ে যায়। ফলে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কিছুতেই তাঁরা গুনাহে লিপ্ত হন না এবং তাঁদের সত্তা গুনাহকে গ্রহণ করে না।

[গ্রন্থকারের বাল্যকালে শোনা একটি ঘটনার দৃষ্টান্ত দেয়া হলে বিষয়টি বুঝতে পারা সহজতর হবে বলে মনে করি। ঘটনাটি যেভাবে বর্ণিত হয়েছে সংক্ষেপে তা হলো : দু জন (বা তিনজন) মুসলমান (!) চোর একজন হিন্দুর ঘরে সিঁদেল চুরি করে বিভিন্ন মালামাল বাইরে এনে এরপর হাঁড়িপাতিল নেয়ার জন্য রান্নাঘরে প্রবেশ করে। সেখানে একটি পাত্রে তৈরী রুটি ও একটি পাতিলে রান্না করা মাংস পেয়ে তাকে পাঠার মাংস মনে করে তারা রুটি ও মাংস খেতে শুরু করে। এক পর্যায়ে মাংসের ভিতর কাছিমের পা আবিষ্কৃত হলে তাদের বমি শুরু হয়ে যায় এবং পেট পুরোপুরি খালি হয়ে যাবার পরেও বমির ভাব বন্ধ হয় না , বরং নাড়িভুঁড়িও বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়।

এমনটা কেন হলো ?

চুরি করে অন্যের সম্পদ ভোগ করা এবং চুরি করে অন্যের খাবার খাওয়া হারাম জানা সত্ত্বেও তাদের জ্ঞান ও ঈমান তাদেরকে চুরি থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারে নি , কারণ , তাদের সে ঈমান ছিলো অগভীর। কিন্তু কাছিম হারাম হবার ব্যাপারে তাদের জ্ঞান ও ঈমান তাদের সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। এ কারণে তাদের পাকস্থলী কাছিমকে কাছিম বলে জানার পরে আর তার মাংসকে গ্রহণ করতে রাযী হয় নি , যদিও পাঠা বলে জানা অবস্থায় তা গ্রহণ করতে আপত্তি করে নি। অথচ ইসলামী শারী আতে যা কিছু খাওয়া হারাম করা হয়েছে জীবন বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পরিমাণে তা খাওয়ার অনুমতি আছে এবং তাতে গুনাহ্ হবে না ; জীবন বাঁচানোর জন্যও চুরি করে গরুর গোশত খাওয়ার তুলনায় ইঁদুর-বিড়ালের মাংস খাওয়া অপেক্ষাকৃত উত্তম , কারণ , প্রথম ক্ষেত্রে কম হলেও গুনাহ্ হবে , কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে গুনাহ্ হবে না।

উপরোক্ত ঘটনায় কাছিম হারাম হওয়ার জ্ঞান ও ঈমান যেভাবে চোরদের সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো , একইভাবে আল্লাহ্ তা আলার যে কোনো নাফরমানী তথা যে কোনো গুনাহর কাজ সংক্রান্ত জ্ঞান ও ঈমান মা ছূম ব্যক্তিদের ( আঃ) সত্তার অংশে পরিণত হয়ে যায়।]

কিন্তু যেহেতু তাঁদের গুনাহ্ করার ক্ষমতা হরণ করা হয় নি সেহেতু এ সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি হলেও একেবারে শূন্য নয়। এ কারণেই আল্লাহ্ তা আলা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) সম্পর্কে বলেছেন যে , তিনি যদি আল্লাহর নামে কোনো কথা বানিয়ে বলতেন তাহলে তাঁকে কঠিনভাবে পাকড়াও করা হতো (সূরাহ্ আল-হাক্বক্বাহ্ : ৪৪-৪৬) । এ থেকে প্রমাণিত হয় যে , তাঁর থেকে আল্লাহর নামে কোনো কথা বানিয়ে বলার তথা যে কোনো ধরনের গুনাহে লিপ্ত হবার ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া হয় নি।[ অবশ্য ইন্তেকালের পরে রাসূলুল্লাহ্ ( ছ্বাঃ ) সহ যে কোনো মা ছূম্ ব্যক্তিরই ( আঃ ) মা ছূম্ থাকার বিষয়টি সম্পর্কে আর কোনোরূপ অনিশ্চয়তা থাকে নি। ]

সুতরাং কারো জন্য মা ছূমগণের ( আঃ) নিষ্পাপ অবস্থাকে নিজের জন্য গুনাহর অনুকূলে বাহানা হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ নেই। অন্যদিকে মা ছূম্ না হওয়ার মানেও এ নয় যে , কারো পক্ষেই সারা জীবন পাপমুক্ত থাকা সম্ভব নয় , বরং সারা জীবন ছোট-বড় যে কোনো ধরনের গুনাহ্ থেকে মুক্ত থাকা অন্যদের জন্য খুবই দুরূহ তথা প্রায় অসম্ভব ’ হলেও পুরোপুরি অসম্ভব ’ নয়।

সতর্কতার নীতি যা দাবী করে

কেউ যদি মনে করে যে , হযরত আলী ( আঃ)কে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর অব্যবহিত পরবর্তী দ্বীনী নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের জন্য মনোনীত করার বিষয়টি আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে ছিলো না , বরং রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ) তা নিজের পক্ষ থেকে করেছিলেন তাহলেও তা মেনে নেয়া উম্মাহর জন্য অপরিহার্য ছিলো। কারণ , সে ক্ষেত্রে নবী যে তাঁর অনুসারীদের ওপর তাদের নিজেদের চেয়েও অধিকতর অধিকার রাখেন (সূরাহ্ আল্-আহযাব্ : ৬) সে কারণে তাঁর সিদ্ধান্তের কাছে আত্মসমর্পণ করা অপরিহার্য ছিলো। কারণ , তিনি ( ভাত খাবেন , নাকি রুটি খাবেন ’ -এ জাতীয় নেহায়েতই পার্থিব মোবাহ্ বিষয়াদি ব্যতীত) স্বীয় দায়িত্ব পালনের সাথে সম্পৃক্ত যে কোনো বিষয়ে আল্লাহ্ তা আলার প্রত্যক্ষ ওয়াহী (وحی متلو ) বা পরোক্ষ ওয়াহী (وحی غير متلو )-এর ভিত্তিতে ছাড়া কখনো কিছু বলতেন না বা করতেন না। আর বলা বাহুল্য যে , নেতা বা উত্তরাধিকারী মনোনয়ন একটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ দায়িত্বপূর্ণ কাজ।

আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

) وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى. إِنْ هُوَ إِلا وَحْيٌ يُوحَى عَلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَى(

“ তিনি (রাসূল) স্বীয় প্রবৃত্তি থেকে কোনো কথা বলেন না ; তা (তিনি যা বলেন) তো ওয়াহী ছাড়া আর কিছু নয়-যা তাঁকে পরম শক্তিধর সত্তা শিক্ষা দান করেন। ” (সূরাহ্ আন্-নাজম্ : ৩-৫)

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা আলা মু মিনাদেরকে আরো নির্দেশ দিয়েছেন :

) وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا(

“ আর রাসূল তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা গ্রহণ করো এবং তিনি যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো। ” (সূরাহ্ আল্-হাশর্ : ৭)

আর , খোদা না করুন , কেউ যদি মনে করে যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারণ ছাড়াই , বা (এরূপ নির্ধারণ না থাকার ক্ষেত্রে) সর্বোচ্চ যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও , কেবল স্বীয় জামাতা হওয়ার কারণেই হযরত আলী ( আঃ)কে উম্মাহর জন্য পরবর্তী নেতা ও শাসক মনোনীত করে গেছেন তাহলে রিসালাত সম্পর্কে এরূপ ভ্রান্ত আক্বীদাহ্ পোষণের কারণে তার ঈমানই বিনষ্ট হয়ে যেতে বাধ্য। কারণ , পক্ষপাতিত্ব অত্যন্ত খারাপ ধরনের একটি বৈশিষ্ট্য হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) সহ সকল নবী-রাসূল ( আঃ)ই যা থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিলেন।

অন্যদিকে কারো কাছে যদি ইখ্লাছ সত্ত্বেও এরূপ মনে হয় যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) গাদীরে খুমের ভাষণে হযরত আলী ( আঃ)কে যে উম্মাহর জন্যمولی বলে ঘোষণা করেছেন তাতে তিনি এ শব্দ দ্বারা বন্ধু ’ বুঝাতে চেয়েছেন , সে ক্ষেত্রেও যেহেতু এ শব্দের অন্যতম অর্থ শাসক এবং স্বয়ং হযরত আলী ( আঃ) সহ কতক ছাহাবী এ থেকে এই শেষোক্ত অর্থই গ্রহণ করেছিলেন এবং এর ভিত্তিতে খেলাফতকে তাঁর হক্ব্ বলে গণ্য করতেন সেহেতু ইসলামের সকল মাযহাব ও ফিরক্বাহর কাছে গৃহীত সতর্কতার নীতি ’ র দাবী অনুযায়ী তাঁকেই খেলাফত প্রদান করা কর্তব্য ছিলো। কারণ , যেহেতু , তাঁদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো অকাট্য দলীল ছিলো না যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) এর দ্বারা বন্ধু ’ বুঝিয়েছেন সেহেতু এতে বন্ধু ’ বুঝানো হলেও হযরত আলী ( আঃ)কে খলীফাহ্ করা হলে কোনো সমস্যা ছিলো না , কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ) যদি এর দ্বারা শাসক বুঝিয়ে থাকেন সে ক্ষেত্রে তাঁকে শাসকের দায়িত্ব প্রদান না করায় রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর সিদ্ধান্ত কার্যকর করা থেকে বিরত থাকা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তা আলার সুস্পষ্ট নির্দেশ অমান্য করা হয়েছে।

এছাড়া আহলে বাইতের ( আঃ) পাপমুক্ততার অকাট্যতার কারণে বিচারবুদ্ধির অকাট্য রায় অনুযায়ী ইসলামের পরবর্তী নেতৃত্ব-কর্তৃত্বও আহলে বাইতের ( আঃ) ধারাবাহিকতায় থাকা অপরিহার্য ছিলো। এমনকি নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব তাঁদেরকে অর্পণের বিষয়টি কারো কাছে যদি ফরয বলে পরিগণিত না-ও হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রেও সতর্কতার নীতির দাবী অনুযায়ী তা তাঁদেরকে অর্পণের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার প্রদান করা যরূরী ছিলো।

ইতিপূর্বে আমরা ইসলামের চারটি অকাট্য দ্বীনী জ্ঞানসূত্রের কথা উল্লেখ করেছি এবং খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ সমূহ গ্রহণকে এ চার জ্ঞানসূত্রের সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়ার শর্তসাপেক্ষ বলে উল্লেখ করেছি। এর মানে হচ্ছে , খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ চোখ বুঁজে গ্রহণ করা যাবে না , তেমনি তা চোখ বুঁজে বর্জন করাও যাবে না ; কেবল চারটি অকাট্য সূত্রের কোনোটির সাথে সাংঘর্ষিক হলেই তা বর্জন করতে হবে।

আমরা যেমন দেখেছি আহলে বাইতের (চার ব্যক্তিত্বের) পবিত্রতা ও পাপমুক্ততা এবং নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের অধিকার-অন্ততঃ অগ্রাধিকার-কোরআন মজীদ , মুতাওয়াতির্‌ হাদীছ ও (সতর্কতার নীতি সহ) আক্বলের অকাট্য রায়ের দ্বারা প্রমাণিত। অনুরূপভাবে যেহেতু হযরত আলী ( আঃ)-এর মাওলা ’ হবার বিষয়টিও মুতাওয়াতির্ সূত্রে প্রমাণিত এবং প্রাপ্ত আক্ব্লী (বিচারবুদ্ধিজাত) ও নাক্ব্লী (বর্ণিত) সকল নিদর্শন থেকে এখানে এ পরিভাষাটির নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্ব ’ তাৎপর্য প্রমাণিত হয় , সেহেতু অন্ততঃ সতর্কতার নীতির দাবী অনুযায়ী এ তাৎপর্যের ভিত্তিতে আমল করা অপরিহার্য ছিলো।

এর সাথে যোগ করতে হয় যে , আরো বিভিন্ন হাদীছে , বিশেষ করে আহলে সুন্নাতের ধারাবাহিকতার অনেক হাদীছে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ওফাতের পরে হযরত আলী ( আঃ) , হযরত ইমাম হাসান ( আঃ) ও হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ) এবং হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)-এর অধস্তন পুরুষ নয়জন পবিত্র ব্যক্তিত্বের নামোল্লেখ সহ পর্যায়ক্রমিক ইমামতের কথা বর্ণিত হয়েছে।

অনেক হাদীছ বিশেষজ্ঞের মতে এ সব হাদীছের মূল বক্তব্য মুতাওয়াতির্ পর্যায়ের। অবশ্য এর তাওয়াতুরের বিষয়টি গাদীরে খুমে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) কর্তৃক হযরত আলী ( আঃ)কে উম্মাহর জন্য মাওলা ’ ঘোষণার তাওয়াতুরের ন্যায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের নয়। এমতাবস্থায় অপর এগারো জন ব্যক্তিত্বের ইমামত সংক্রান্ত হাদীছ মুতাওয়াতির্ কিনা এ ব্যাপারে কারো পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলার অবকাশের কথা মাথায় রেখে এ সব হাদীছকে যুক্তির খাতিরে খবরে ওয়াহেদ্ বলে গণ্য করলেও একই বিষয়বস্তুতে এর সাথে সাংঘর্ষিক অনুরূপ পর্যায়ের হাদীছ না থাকায় এর ভিত্তিতে আমল করা অপরিহার্য। অর্থাৎ যেহেতু হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) থেকে অন্য কোনো লোকদের সম্পর্কে তাঁর পরে পর্যায়ক্রমিক ইমামতের কথা বর্ণিত হয় নি সেহেতু সতর্কতার নীতি অনুযায়ী তাঁদের ইমামতের বিষয়টি মেনে নেয়া অপরিহার্য।

আহলে সুন্নাতের ধারাবাহিকতার শীর্ষস্থানীয় অনেক দ্বীনী ব্যক্তিত্বই আহলে বাইতের ধারাবাহিকতার উক্ত বারো জন পবিত্র ব্যক্তিত্বের ইমামতকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে না নিলেও তাঁদের অনেকের উক্তি ও আচরণে আমরা দেখতে পাই যে , তাঁরা উক্ত ব্যক্তিত্ববর্গকে উম্মাহর মধ্যে বিশিষ্ট দ্বীনী মর্যাদার অধিকারী বলে গণ্য করতেন। তাঁরা কখনোই উক্ত বারো জন ব্যক্তিত্বের সমালোচনা করতেন না এবং তাঁদের নিষ্পাপত্ব (عصمة )কে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও কখনোই বলেন নি যে , তাঁরা মা ছূম্ ছিলেন না বা আর দশজন দ্বীনী বুযুর্গ ব্যক্তিত্বের অনুরূপ ছিলেন। এর ফলে সামগ্রিকভাবে আহলে সুন্নাতের অনুসারীদের কাছে তাঁরা অনুরূপ মর্যাদা লাভ করেছেন।

বিশেষ করে আমরা হযরত ইমাম আবূ হানীফাহ্ (রাহ্ঃ)কে-যার নামে পরবর্তীকালে হানাফী মাযহাব্ তৈরী ও প্রবর্তন করা হয়-আহলে বাইতের ( আঃ) ধারাবাহিকতার ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফার্‌ ছাদেক্ব ( আঃ)-এর নিকট দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ করতে ও তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করতে দেখি। হযরত ইমাম জা ফার্ ছাদেক্ব ( আঃ) সম্পর্কে হযরত ইমাম আবূ হানীফাহর একটি উক্তি খুবই বিখ্যাত , তা হচ্ছে , তিনি বলেন : আমি জা ফার্ ইবনে মুহাম্মাদের চেয়ে বড় কোনো আলেমের সাক্ষাৎ পাই নি। ” এছাড়াও তিনি যে ইমাম ছাদেক্ব্ ( আঃ)-এর কাছে দুই বছর দ্বীনী ইলম্ শিক্ষা করেন সে সম্পর্কে তিনি বলেন : ঐ দুই বছর না হলে নুমান্ ধ্বংস হয়ে যেতো। ” উল্লেখ্য , ইমাম আবূ হানীফাহর মূল নাম নুমান্ বিন্ ছাবেত্।

এছাড়া হযরত ইমাম মালেক্ও হযরত ইমাম জা ফার্ ছাদেক্ব্ ( আঃ)-এর কাছে দ্বীনী ইলম্ শিক্ষা করেন এবং তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন।

ইমাম আবূ হানীফাহ্ ও ইমাম মালেক যে আহলে বাইত ( আঃ)-কে কোন্ দৃষ্টিতে দেখতেন তা তাঁদের আরো কোনো কোনো আচরণ থেকে প্রকাশ পায়। তা হচ্ছে , এমনকি আহলে বাইতের ধারাবাহিকতার যে সব বুযুর্গ ব্যক্তিত্বের জন্য উক্ত বারো জন ব্যক্তিত্বের ন্যায় আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে মনোনীত ইমাম হওয়া সংক্রান্ত হাদীছের বর্ণনা বিদ্যমান নেই কেবল আহলে বাইতের ধারাবাহিকতার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে এ দু জন ইমাম অন্যদের তুলনায় তাঁদেরকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করতেন।

উদাহরণস্বরূপ , উমাইয়াহ্ শাসনামলের শেষ দিকে হযরত ইমাম যায়নুল আবেদীন ( আঃ)-এর পুত্র ও হযরত ইমাম বাক্বের ( আঃ)-এর ভ্রাতা হযরত ইমাম যায়দ (রাহ্ঃ) স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলে হযরত ইমাম আবূ হানীফাহ্ তাঁকে সত্যিকারের ইমাম ’ (ইমামে হাক্ব্) বলে ঘোষণা করেন এবং এ জিহাদে অংশগ্রহণের জন্যে লোকদেরকে উৎসাহিত করেন। এছাড়া তিনি এ জিহাদে হযরত ইমাম যায়দকে দশ হাজার দেরহাম আর্থিক সাহায্য দেন এবং বলেন যে , তাঁর নিকট লোকদের বহু আমানত না থাকলে তিনি এ জিহাদে সশরীরে অংশগ্রহণ করতেন। এছাড়া পরবর্তীকালে হযরত ইমাম হাসান ( আঃ)-এর বংশধর হযরত ইমাম মুহাম্মাদ নাফ্সে যাকীয়্যাহ্ (রাহ্ঃ) ও হযরত ইমাম ইবরাহীম্ (রাহ্ঃ)-দুই ভাই- আব্বাসী স্বৈরশাসক মানছূরের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলে হযরত ইমাম আবূ হানীফাহ্ এ জিহাদের পক্ষে ফত্ওয়া দেন ও এতে অংশগ্রহণের জন্যে লোকদেরকে উৎসাহিত করেন। বিশেষ করে মানছূরের একজন সেনাপতি পর্যন্ত হযরত ইমাম আবূ হানীফাহর নির্দেশে উক্ত ভ্রাতৃদ্বয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানান।

অনুরূপভাবে হযরত ইমাম মালেকও আব্বাসী স্বৈরশাসক মানছূরের বিরুদ্ধে হযরত ইমাম মুহাম্মাদ নাফ্সে যাকীয়্যাহ্ (রাহ্ঃ) ঘোষিত জিহাদকে সমর্থন করে ফত্ওয়া দেন। শুধু তা-ই নয় , স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এ জিহাদের যথার্থতা জানা সত্ত্বেও মানছূরের অনুকূলে ইতিপূর্বে কৃত বাইআত ভঙ্গ করা জায়েয হবে কিনা এ ব্যাপারে অনেকের মনে সংশয় দেখা দিলে তাঁরা যখন হযরত ইমাম মালেকের মত জানতে চান তখন তিনি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত ফয়ছালাহর দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন : যাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য করা হয়েছে তার জন্যে অঙ্গীকার নেই। ” অর্থাৎ বলপ্রয়োগ বা চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে যে বাইআত আদায় করা হয়েছে অথবা ভয়ের কারণে লোকেরা যে বাইআত করেছে তা আদৌ বাইআত নয় , অতএব , তা রক্ষা করা অপরিহার্য নয় এবং তা ভঙ্গ করলে গুনাহ্ হবে না। তাঁর এ ফত্ওয়ার ভিত্তিতে বহু লোক মানছূরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ইমাম নাফসে যাকীয়্যাহ্ (রাহ্ঃ)-এর সাথে জিহাদে যোগদান করেন। এ ফত্ওয়া দেয়ার কারণে ইমাম মালেককে গ্রেফতার করা হয় এবং তাঁর শরীর থেকে পোশাক খুলে নিয়ে তাঁকে চাবূক মারা হয়। এর ফলে কাঁধ থেকে তাঁর হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।[ অবশ্য পরে তিনি ( হয়তোবা জীবন বাঁচানোর লক্ষ্যে ) মানছূরের সাথে আপোস করেন তার সাথে সহযোগিতা করেন। ]

এ থেকে সুস্পষ্ট যে , হযরত ইমাম জা ফার্ ছাদেক্ব ( আঃ) ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা দিলে ও হুকুমতের ওপর স্বীয় দাবী উপস্থাপন করলে হযরত ইমাম আবূ হানীফাহ্ ও হযরতে ইমাম মালেক একইভাবে তা সমর্থন করতেন , যদিও হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)-এর পরবর্তী আহলে বাইতের ইমামগণ ( আঃ) হুকুমতের ওপর স্বীয় অধিকারের প্রবক্তা হওয়া সত্ত্বেও স্বীয় বাছীরাত্ দ্বারা পর্যালোচনা করে নিজ নিজ সমকালীন পরিস্থিতিকে বিপ্লবের পতাকা উত্তোলনের জন্য উপযোগী মনে করেন নি এবং সশস্ত্র যুদ্ধকে তখনকার পরিবেশে ইসলামের স্বার্থের জন্য সহায়ক গণ্য করেন নি বলে জিহাদ ঘোষণা করেন নি।

হযরত ইমাম শাফেঈ ও হযরত ইমাম আহমাদ্ ইবনে হাম্বালও আহলে বাইত ( আঃ)কে ভালোবাসতেন এবং তাঁদের সাথে যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক রাখতেন। আর এ জন্য তাঁদের উভয়কেই আহলে বাইতের ( আঃ) প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণকারীদের পক্ষ থেকে সৃষ্ট বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আহলে বাইতের ( আঃ) প্রতি ভালোবাসা পোষণের কারণে ইমাম শাফেঈকে রাফেযী ” ( শিয়া ’ বুঝাতে গালি) বলে অভিহিত করা হয় এবং ইমাম আহমাদ্ ইবনে হাম্বালের গৃহে তল্লাশী চালানো হয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , হযরত ইমাম আবূ হানীফাহ্ সহ আহলে সুন্নাতের চার ইমাম ও শীর্ষস্থানীয় দ্বীনী মনীষীগণের অনেকেই আহলে বাইত ( আঃ) সম্পর্কে , বিশেষ করে আহলে বাইতের ইমামগণ ( আঃ) সম্পর্কে স্বীয় কথা ও কাজে যে সম্মান , সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার পরিচয় দিয়েছেন তা কী প্রমাণ করে ? তাঁরা কি সংশ্লিষ্ট হাদীছগুলোর ভিত্তিতে এবং ইমামগণের ( আঃ) ইলম্ ও আমলের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমাম ’ বলে গণ্য করতেন , কিন্তু সমকালীন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না করাকেই নিজেদের জন্য কল্যাণকর বিবেচনা করেছিলেন ? নাকি এ ব্যাপারে অকাট্য আক্বীদায় উপনীত হতে না পারলেও এমনটি হবার সম্ভাবনায় সতর্কতার নীতি ’ অনুযায়ী তাঁদের প্রতি সম্মান , সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার পরিচয় দিয়েছিলেন ?

এ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন।

প্রথমতঃ বিশেষ করে হযরত ইমাম আবূ হানীফাহ্ (রাহ্ঃ) সহ আহলে সুন্নাতের ইমামগণ ফিক্ব্হী বিষয়াদিতে স্বীয় মতামত ব্যক্ত করলেও বর্তমানে মাযহাব্ বলতে যা বুঝায় সেভাবে তাঁরা নিজেরা কোনো মাযহাবের প্রচলন করে যান নি। বরং পরবর্তীকালে তাঁদের নামে মাযহাবের প্রচলন করা হয়েছে এবং এর ভিত্তিতে মুসলমানদের বিভক্ত করা হয়েছে।

দ্বিতীয়তঃ আহলে সুন্নাতের ইমামগণ তাঁদের সমসাময়িক রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারী সরকারগুলোর বিরোধী ছিলেন এবং তাদের সাথে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানানোর ও আহলে বাইতের সাথে সম্পর্কের কারণে তাঁদেরকে হত্যা , নির্যাতন বা হয়রানির শিকার হতে হয়।[ বিশেষ করে হযরত ইমাম আবূ হানীফাহ্কে কারাগারে নিক্ষেপ করে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে , ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , হযরত ইমাম মালেককে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। এছাড়া ইমাম শাফেঈ ইমাম আহমাদ্ ইবনে হাম্বাল্ হয়রানির শিকার হন। ] আর এ কারণে তাঁদের কেউ কেউ , স্বীয় বিবেচনায় , ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে , সরকারের সাথে বাহ্যতঃ সমঝোতার নীতি অনুসরণ করেন। কিন্তু তাঁদের পরবর্তীকালে তাঁদের শিষ্য-শাগরিদগণ তাঁদের নামে বিভিন্ন মাযহাবের প্রচলন করে স্বৈরাচারী সরকারগুলোর সাথে সার্বিক সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করেন। এর ফলে , আহলে বাইতের ইমামগণের ( আঃ) সাথে ক্ষমতাসীনদের দুশমনীর প্রেক্ষাপটে দলীয় অনুভূতি ও শিয়া-সুন্নী পার্থক্য ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে।

তৃতীয়তঃ চার সুন্নী মায্হাব্ যে ইমামগণের নামে প্রবর্তিত হয়েছে তাঁদের প্রত্যকের ইন্তেকালের পরে বহুলাংশে তৎকালীন সরকারগুলোর সাথে ঐ সব মায্হাবের শীর্ষস্থানীয় আলেমগণের সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রভাবেই পরবর্তীকালে ফিক্ব্হী ক্ষেত্রে আহলে বাইতের ( আঃ) সাথে এ সব মায্হাবের পার্থক্য ব্যাপকতর হয়ে ওঠে।

[এ সব পার্থক্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এক বৈঠকে প্রদত্ত তিন তালাক্বকে চূড়ান্ত তালাক্ব্ বলে গণ্যকরণ অন্যতম , অথচ মশহূর এই যে , হযরত ইমাম আবূ হানীফাহ্ (রাহ্ঃ) একে এক বার তালাক্ব্ বলে গণ্য করতেন। স্মর্তব্য , ইমাম আবূ হানীফাহর নামে হানাফী মায্হাব্ প্রবর্তন করা হলেও এ মায্হাবের মূল নায়ক ছিলেন ক্বাযী আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ বিন্ হাসান্ শায়বানী। স্বয়ং ইমাম আবূ হানীফাহর ফিক্বাহ্ কী ছিলো তা কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রেই জানা যায় না। অনেকের ধারণা , ক্বাযীর চাকরি গ্রহণ না করার কারণে নয় , বরং হযরত ইমাম জা ফার্ ছাদেক্ব্ ( আঃ)কে ইমাম হিসেবে স্বীকার করার কারণেই তাঁকে কারারুদ্ধ ও হত্যা করা হয়।]

চতুর্থতঃ একান্তই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আহলে বাইতের ( আঃ) ইমামগণের অনুসারীদেরকে সুন্নাতে রাসূল (ছ্বাঃ)-এর অনুসারী নয় বলে জনমনে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টির রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আহলে সুন্নাত্ ওয়াল্ জামা আত্ ” নাম তৈরী করা হয় এবং সে নামে চার মায্হাবকে অভিহিত করা হয়।

পঞ্চমতঃ ছিহাহ্ সিত্তাহ্ ” নামে পরিচিত হাদীছ-গ্রন্থ সমূহ সহ আহলে সুন্নাতের অন্যান্য হাদীছ-গ্রন্থ হযরত ইমাম আবূ হানীফাহ্ ও হযরত ইমাম মালেকের শতাব্দীকাল পরে বা তারও বেশী পরে সংকলিত হলেও সেগুলোকে গ্রহণ করার ফলে শিয়া-সুন্নী ব্যবধান আরো বেশী ব্যাপকতা লাভ করে। [বলা বাহুল্য যে , ছিহাহ্ সিত্তাহ্ ” বিশেষণটিও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। কারণ , বিচারবুদ্ধির অকাট্য রায় অনুযায়ী বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে বর্ণনাস্তরসংখ্যা যতো বেশী হবে তথ্যবিকৃতির আশঙ্কাও ততো বেশী থাকে এবং বর্ণনাস্তরসংখ্যা যতো কম হবে নির্ভরযোগ্যতার সম্ভাবনাও ততো বেশী হবে। এ কারণেই সুন্নী ধারার হাদীছ-গ্রন্থাবলীর মধ্যে হযরত ইমাম মালেক কর্তৃক সংকলিত মুওয়াত্বত্বা ” র হাদীছ সমূহে অন্যান্য গ্রন্থের হাদীছ সমূহের তুলনায় জাল হাদীছের অনুপ্রবেশ এবং বিকৃতি , ভুল-ভ্রান্তি ও দুর্বলতার আশঙ্কা অপেক্ষাকৃত কম ছিলো , (তাই শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ দেহলাভী মুওয়াত্বত্বা ” কে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য হাদীছ-গ্রন্থ বলে গণ্য করতেন) যদিও মুওয়াত্বত্বা ” ও ভুলভ্রান্তির উর্ধে ছিলো না। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মুওয়াত্বত্বা ” কে ছহীহ্ নয় ” বলে জনমনে ধারণা সৃষ্টির লক্ষ্যে পরবর্তী কালে ছয়টি হাদীছ-সংকলনকে ছিহাহ্ সিত্তাহ্ ” (ছয়টি ছহীহ্) বলে চিহ্নিত করা হয় , যদিও সেগুলো মুওয়াত্বত্বা ” সংকলনের শতাব্দী কালেরও বেশী পরে সংকলিত হয়।] বিশেষ করে হযরত ইমাম আবূ হানীফাহ্ যেখানে ফিক্ব্হী ব্যাপারে খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছকে নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করতেন না , সেখানে পরবর্তীকালে খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ ব্যাপকভাবে গ্রহণের ফলে বিশেষ করে হানাফী মাযহাবের চেহারা অনেক বেশী পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং বিভিন্ন মাযহাবের মধ্যে পার্থক্য তীব্রতর হয়ে ওঠে।

এতে কোনোই সন্দেহ নেই যে , উমাইয়াহ্ ও আব্বাসী যুগে অসংখ্য জাল হাদীছ রচিত হওয়া এবং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ওফাতের শতাব্দীকালেরও বেশী সময় পরে অনেকগুলো স্তরের নামে বর্ণিত খবরে ওয়াহেদ্ জাল ও ছহীহ্ হাদীছের মধ্যে নিশ্চিতভাবে পার্থক্য করতে পারা অসম্ভব ’ না হলেও প্রায় অসম্ভব ’ ছিলো , বিশেষ করে হযরত ইমাম আবূ হানীফাহ্ (রাহ্ঃ) তা অসম্ভব মনে করতেন বলেই তা গ্রহণ করেন নি। এ থেকে আরো শতাব্দীকাল পরে সংগৃহীত হাদীছ সমূহের অবস্থা অনুমান করা যেতে পারে। বস্তুতঃ মুসলমানদের মধ্যে মাযহাবী বিষয়াদির ক্ষেত্রে মতপার্থক্যের সিংহ ভাগের জন্যই জাল হাদীছ দায়ী।

[এ প্রসঙ্গে পুনরায় উল্লেখ করতে হয় যে , খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছকে চোখ বুঁজে প্রত্যাখ্যান করা ঠিক নয় , বরং ইসলামের চারটি অকাট্য জ্ঞানসূত্র গ্রহণের পরে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সে সবের সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়ার শর্তে খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে এটা অনস্বীকার্য যে , চার অকাট্য জ্ঞানসূত্র গ্রহণ করার পর আক্বাএদের শাখা-প্রশাখা এবং ফরয ও হারাম সহ কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নই জবাববিহীন থাকে না ; কেবল কতক গৌণ ও খুটিনাটি (মুস্তাহাব্ ও মাকরূহ্) এবং প্রায়োগিক বিষয় অবশিষ্ট থাকে। আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে , আজকের দিনে উক্ত চার জ্ঞানসূত্রের ব্যবহার ও তার ভিত্তিতে খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ পরীক্ষা করা যতোখানি সহজ তৎকালে তা অতো সহজ ছিলো না।

এ প্রসঙ্গেই আরো উল্লেখ করতে হয় যে , অনেক পরবর্তীকালে আহলে সুন্নাতের ধারাবাহিকতায় উদ্ভূত আহলে হাদীছ নামক ফিরক্বাহর অনুসারীদের অনেকে হানাফীদের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন যে , তারা রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর কথা মানে না , আবূ হানীফাহর কথা মানে। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হলো , রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর কথা বলে দাবীকৃত কথা ও প্রকৃতই রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর কথা কখনোই এক নয় এবং ইমাম বুখারী সহ হাদীছ সংকলকগণের বিচারক্ষমতার ওপরে অন্ধভাবে আস্থা পোষণের পক্ষে কোনো দলীল নেই , বিশেষ করে তাঁরা যখন না মা ছূম্ ছিলেন , না অকাট্যভাবে ঐশী ইলহামের অধিকারী ছিলেন , না রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর নিকটবর্তী কালের ছিলেন , বরং তাঁদেরকে হাদীছের ব্যাপারে অনেকগুলো স্তরের বর্ণনাকারীদের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিলো যেগুলোর গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে তাঁদের পক্ষে শতকরা একশ ভাগ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব ছিলো না।]

ইতিহাসের পৃষ্ঠা ওল্টানো কেন

অনেককেই ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসের বিরোধ-বিসম্বাদ সংক্রান্ত পৃষ্ঠাগুলো ওল্টানোর বিরোধিতা করতে দেখা যায়। তাঁদের মতে , এর ফলে কেবল মুসলমানদের মধ্যে বিরাজমান বিভেদ-অনৈক্যই বৃদ্ধি পাবে এবং তা ফিরক্বাহ্ ও মায্হাবের উর্ধে উঠে বৃহত্তর ইসলামী ঐক্য গড়ে তোলার বিষয়টিকে সুদূরপরাহত করে তুলবে।

আসলেও ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক যুগের তিক্ত বিষয়গুলোর স্মৃতিচারণ না করাই ভালো। প্রথমতঃ এর সাথে যারা জড়িত তাঁদের কেউই বেঁচে নেই এবং এখন ইতিহাসকে বদলে দেয়া যাবে না। আর প্রত্যেকেই নিজ নিজ আমল সহকারে আল্লাহ্ তা আলার কাছে হাযির হবেন। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন যেমন এরশাদ করেছেন :

) تِلْكَ أُمَّةٌ قَدْ خَلَتْ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَلَكُمْ مَا كَسَبْتُمْ وَلا تُسْأَلُونَ عَمَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ(

“ তারা ছিলো একটি জনগোষ্ঠী যারা অতীত হয়ে গিয়েছে ; তারা (ভালো) যা কিছু অর্জন করেছে তা তাদেরই জন্য এবং তারা (মন্দ) যা কিছু অর্জন করেছে তা তাদেরই ওপরে আপতিত হবে। আর তারা যা কিছু করেছে সে জন্য তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না। ” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ১৩৪)

দ্বিতীয়তঃ শিয়া মাযহাবের অনুসারীরা যে বারো জন বুযুর্গ ব্যক্তিকে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে মনোনীত ইমাম বলে আক্বীদাহ্ পোষণ করে তাঁদের মধ্য থেকে এগারো জন এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যকার দ্বাদশ ইমাম-শিয়া মাযহাবের অনুসারীরা যাকে ইমাম মাহ্দী ( আঃ) বলে আক্বীদাহ্ পোষণ করে , তাদের আক্বীদাহ্ অনুযায়ীই আল্লাহ্ তা আলা তাঁকে দীর্ঘজীবী করলেও তিনি আল্লাহর ইচ্ছায়ই আত্মপরিচয় গোপন করে আছেন এবং উপযুক্ত সময়ে আত্মপ্রকাশ করবেন।

যেহেতু শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে সকল মুসলমানই হযরত ইমাম মাহ্দী ( আঃ)-এর আবির্ভাব ও তাঁর দ্বারা বিশ্বব্যাপী ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আক্বীদাহ্ পোষণ করে , সেহেতু তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন কি করেন নি এ প্রশ্নে মতপার্থক্য থাকলেও তাঁর আত্মপ্রকাশের পর তাঁকে গ্রহণ-বর্জনের ওপরই যে কারো হেদায়াত ও গোমরাহী নির্ভর করবে। কিন্তু এখন যেহেতু উক্ত বারো জন বুযুর্গ ব্যক্তির কেউই আমাদের সামনে ইমামতের দাবী নিয়ে উপস্থিত নন , এমতাবস্থায় তাঁদের ইমামত নিয়ে বিতর্ক প্রধানতঃ একটি তাত্ত্বিক বিতর্ক বৈ নয় , যদিও শারীআতের গৌণ বিষয়াদিতে খবরে ওয়াহেদ হাদীছ ও রেওয়াইয়াত্ গ্রহণের ব্যাপারে এর ভূমিকা আছে। এর মানে হচ্ছে , ইমামতের আক্বীদাহ্ পোষণ করলে যে কোনো হাদীছ ও রেওয়াইয়াতের রাভী (বর্ণনাকারী) বিচার শুরু হবে মা ছূম্ ( আঃ)-এর পর থেকে।

অবশ্য এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই যে , আসলেই আমাদের উচিত অতীত হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের আমলের সাথে নিজেদেরকে না জড়ানো। কারণ , আমাদের বিতর্ক তাঁদের আমলের ভালো-মন্দ কোনো কিছুতেই কিছু হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটাতে পারবে না। কিন্তু আমরা যখন নিজেদেরকে তাঁদের আমলের সাথে জড়িয়ে ফেলি তখন অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের আমলের পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

বিশেষ করে অনেক সময় বলা হয় যে , অন্যান্য ছাহাবায়ে কেরাম ও অতীতের মনীষীগণ ইসলাম সম্পর্কে ও কোরআন মজীদের তাৎপর্য আমাদের চেয়ে কম বুঝতেন না। অথচ এটা অনস্বীকার্য যে , তাঁরা না মা ছূম্ ছিলেন , না অকাট্যভাবে ঐশী ইলহামের অধিকারী ছিলেন। অতএব , তাঁদের পক্ষে ভুল করা সম্ভব এবং পূর্বোল্লিখিত আয়াত অনুযায়ী , তাঁরা ভুল করে থাকলে আমাদের জন্য তার অনুসরণ করা উচিত হবে না। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের কথা ও কাজের বর্ণনা কতোখানি সঠিকভাবে আমাদের কাছে পৌঁছেছে তা-ও প্রশ্নের উর্ধে নয়।

আরো বলা হয় যে , আমরা তো কোরআন মজীদ ও ইসলাম ছাহাবীদের মাধ্যমেই পেয়েছি , সুতরাং তাঁদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না।

কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো , আমরা কোরআন ও ইসলাম তাঁদের ব্যক্তিবিশেষের কাছ থেকে পাই নি , বরং মুতাওয়াতির্ সূত্রে তাঁদের সকলের কাছ থেকে ’ পেয়েছি-যার নির্ভুলতা ও গ্রহণযোগ্যতা সন্দেহাতীত। এর সাথে যে সব বিষয়ে তাঁদের নিজেদের মধ্যেই পারস্পরিক মতপার্থক্য ছিলো সে সব বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে তাঁদেরকে নির্ভুল গণ্য করা ঠিক হবে না। আর ইসলাম ও কোরআন মজীদকে পরবর্তী প্রজন্মসমূহের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন বলেই যে তাঁরা তা পরবর্তী প্রজন্মসমূহের তুলনায় অধিকতর সঠিকভাবে বুঝেছিলেন এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। কেননা , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) এরশাদ করেছেন যে , জ্ঞানপূর্ণ কথা অনেক সময় কেউ এমন ব্যক্তির কাছে বহন করে নিয়ে যায় যে বহনকারীর তুলনায় অধিকতর সমঝদার।

[হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস্ ’ উদ (রাঃ) বর্ণনা করেন , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) এরশাদ করেছেন :

نَضَّرَ الله عَبداً سَمِعَ مَقالَتی فَحَفِظَها و وَعاها وَاَدَّها کَما سَمِعَها فَرُبَّ مُبَلّغٍ اَوعی لَها مِن سامِعٍ

“ আল্লাহ্ চিরসতেজ করে রাখুন (তাঁর) সেই বান্দাহকে যে আমার কথা শুনলো , অতঃপর তা সংরক্ষণ করে রাখলো ও স্মরণ রাখলো এবং তা যেভাবে শুনলো হুবহু সেভাবেই (অন্যের কাছে) পৌঁছে দিলো ; আর অনেক সময় এমন হয় যে , (পরোক্ষভাবে) যার কাছে তা পৌঁছেছে সে তা (আমার কাছ থেকে) শ্রবণকারীর তুলনায় উত্তমরূপে গ্রহণ করেছে। ” (আবূ দাউদ ; তিরমিযী)

বস্তুতঃ আমরা যদি বিচারবুদ্ধির কাছে গ্রহণযোগ্য ইসলামের সর্বজনগ্রহণযোগ্য চারটি অকাট্য সূত্রের ওপর নির্ভর করে তার দাবী অনুযায়ী আমাদের জীবনে সকল ক্ষেত্রে চলার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মনীতি ও বিধিবিধান লাভের ও তদনুযায়ী চলার চেষ্টা করতাম তাহলে উপরোল্লিখিত ঐতিহাসিক বিতর্ক এমনিতেই গুরুত্ব হারিয়ে ফেলতো। কিন্তু আমরা তা না করার কারণেই এ বিতর্কের উপযোগিতা থেকে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে। কারণ , বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্) , কোরআন মজীদ , মুতাওয়াতির্ হাদীছ ও ইজমা এ উম্মাহর মানদণ্ডে যেখানে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর আহলে বাইতের পবিত্রতা ও পাপমুক্ততা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় এবং জ্ঞানগত যোগ্যতার সাথে পবিত্রতা ও পাপমুক্ততা যুক্ত হওয়ার কারণে কেবল তাঁদের কাছ থেকেই নির্ভুল দ্বীনী জ্ঞান লাভ করা যেতে পারে , এমতাবস্থায় আমরা যদি অন্য কারো কাছ থেকে এ সব মানদণ্ডের কোনো না কোনোটির সাথে সাংঘর্ষিক কোনো ফয়ছালাহ্ মেনে না চলতাম এবং তার ওপরে একগুঁয়েমি না করতাম তাহলে আজ আর ইতিহাস পর্যালোচনার প্রয়োজন হতো না।

উদাহরণস্বরূপ এক বৈঠকে তিন তালাক্ব্ সংক্রান্ত ফত্ওয়ার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।

আল্লাহ্ তা আলা যেখানে ফেরতযোগ্য তালাক্ব (طلاق رجعی ) সম্পর্কে এরশাদ করেছেন যে ,الطلاق مرتان -তালাক্ব দুই বার (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ২২৯) অতঃপর ভালোভাবে রাখতে হবে অথবা (তৃতীয় দফা তালাক্ব্ দিয়ে) ভদ্রভাবে বিদায় করে দিতে হবে (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ২২৯) এমতাবস্থায় কেউ যে কোনো কথা বলেই (যেমন : তিন তালাক্ব ’ শব্দ উচ্চারণ করে বা তালাক্ব ’ শব্দটি তিন বার পুনরাবৃত্তি করে) স্ত্রীকে তালাক্ব দিক না কেন , অবশ্যই তা এক বার ’ ও ফেরতযোগ্য তালাক্ব হবে। অতঃপর সে তার ঐ তালাক্ব দেয়া স্ত্রীকে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত তার পক্ষে ঐ স্ত্রীকে দ্বিতীয় বার তালাক্ব দেয়া সম্ভব নয়। কারণ , প্রথম বার তালাক্ব দেয়ার সাথে সাথেই সে আর তার স্ত্রী থাকলো না এবং যে সব কাজের দ্বারা তালাক্ব দেয়া স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনা ’ প্রমাণিত হয় এমন কোনো কাজের মাধ্যমে তাকে ফিরিয়ে এনে স্ত্রীর মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার আগে তাকে দ্বিতীয় বার ’ তালাক্ব দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এ সত্ত্বেও কেবল দ্বিতীয় খলীফাহর মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের লক্ষ্যে মুসলমানদের মধ্যকার বৃহত্তর অংশের মধ্যে এক বৈঠকে প্রদত্ত তিন তালাক্ব ’ কে ফেরত-অযোগ্য চূড়ান্ত তালাক্ব বলে গণ্য করা হচ্ছে।

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই যে , মশহূর্ মত অনুযায়ী , স্বয়ং হযরত ইমাম আবূ হানীফাহ্ (রাহ্ঃ)-যার নামে হানাফী মায্হাবের প্রচলন করা হয়েছে-যেখানে এক বৈঠকে প্রদত্ত তিন তালাক্ব ’ কে ফেরতযোগ্য এক বার ’ তালাক্ব বলে গণ্য করতেন সেখানে পরবর্তীকালে হানাফী মাযহাবের মত ’ নামে প্রদত্ত ফত্ওয়া হচ্ছে এই যে , এক বৈঠকে প্রদত্ত তিন তালাক্ব ’ ফেরত-অযোগ্য চূড়ান্ত তালাক্ব বলে গণ্য হবে। আর এর ফলে যে কেবল আল্লাহ্ তা আলার বিধানে মানুষের জীবনের জন্য প্রদত্ত প্রশস্ততা ও সহজতা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা হচ্ছে শুধু তা-ই নয় , বরং উদ্ভূত কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার লক্ষ্যে অনেককে কঠিন ধরনের গুনাহে লিপ্ত হবার পথে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

[বাংলাদেশে (এবং হয়তো আরো কোথাও কোথাও) অনেক লোক রাগের মাথায় স্ত্রীকে এক বৈঠকে তিন তালাক্ব দেয়ার পর জীবনের প্রয়োজনে , বিশেষতঃ সন্তানদের কারণে স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে হীলা র (শব্দটি আরবী হলেও ফার্সী ভাষায় প্রতারণা অর্থে ব্যবহৃত হয়) আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। যেহেতু চূড়ান্ত তালাক্বের পর তালাক্বপ্রাপ্তা স্ত্রী অন্য কোনো পুরুষের সাথে স্থায়ীভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার ও সে স্বামীর মৃত্যু ঘটা বা সে স্বামী কর্তৃক তালাক্বপ্রাপ্তা হওয়ার পূর্বে প্রথম স্বামীর জন্য তাকে বিবাহ করার সুযোগ নেই এবং যেহেতু নতুন স্বামীর মৃত্যু ঘটা বা তার পক্ষ থেকে ঐ স্ত্রীকে তালাক্ব দেয়ার কোনোই নিশ্চয়তা থাকে না সেহেতু এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার লক্ষ্যে আপোসে কোনো ব্যক্তিকে এ শর্তে ঐ নারীকে বিবাহ করার জন্য রাযী করানো হয় যে , বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রী মাত্র এক রাতের জন্য একত্রবাস করার পরই নতুন স্বামী তাকে তালাক্ব দেবে।

বলা বাহুল্য যে , এ ধরনের বিবাহ ইসলামের কোনো মাযহাবের দৃষ্টিতেই ছহীহ্ নয়। কারণ , প্রকাশ্য বা গোপন যে কোনোভাবেই হোক না কেন তালাক্ব দেয়ার পূর্বশর্ত বিশিষ্ট বিবাহ ইসলামসম্মত কোনো বিবাহের আওতায় পড়ে না। এ ধরনের বিবাহ না স্থায়ী বিবাহ , না অস্থায়ী বিবাহ। ইসলামের সকল ফিরক্বাহ্ ও মাযহাবের সর্বসম্মত মত অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে তালাক্বপ্রাপ্তা নারী কেবল স্থায়ী বিবাহের পরেই এ স্বামীর মৃত্যু বা তালাক্বের পরে পূর্ববর্তী স্বামীর সাথে পুনর্বিবাহিত হতে পারবে। এমতাবস্থায় স্থায়ী বিবাহ হিসেবে পাতানো এই তথাকথিত বিবাহ সুস্পষ্টতঃই ব্যভিচার বৈ নয়। কারণ , যেহেতু অস্থায়ী বিবাহের ক্ষেত্রে অস্থায়ী হিসেবেই ও মেয়াদ নির্দিষ্ট করে আক্ব্দ্ পড়ানো হয় এবং মেয়াদশেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিবাহের সমাপ্তি ঘটে ; তালাক্ব দেয়ার প্রয়োজন হয় না , সেহেতু এ ধরনের পাতানো বিবাহ অস্থায়ী বিবাহ ও নয়।

অন্যদিকে যারা এ ধরনের হীলা (প্রতারণা)র ঘৃণ্য নাজায়েয কাজ হওয়ার কারণে এর আশ্রয় গ্রহণ করে না প্রচলিত ফত্ওয়ার কারণে তারা তালাক্ব দেয়া স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে পারে না , ফলে অনেক সময় তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের ওপর অন্ধকার নেমে আসে-যা আল্লাহ্ তা আলার পসন্দনীয় নয় বলেই তিনি দু -দুই বার তালাক্বের পর স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দিয়েছেন।]

এখানে মাত্র একটি দৃষ্টান্ত দেয়া হলো। এ ধরনের আরো অনেক দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। এভাবে অনেক ছাহাবীর-যাদের নিষ্পাপ হওয়ার সপক্ষে কোনোই দলীল নেই-মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের লক্ষ্যে এ ধরনের আরো অনেক ভ্রান্ত ফত্ওয়া দেয়া হয়েছে-যা মুসলমানদের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধির কারণ হয়েছে।

আজকের করণীয়

ইসলামের দৃষ্টিতে আজকের দিনে মুসলমানদের দ্বীনী সমস্যাবলীকে তিনটি সমস্যার মধ্যে সমন্বিত করা যায় ; তাদের অন্যান্য পার্থিব ও অপার্থিব সমস্যাবলী এ তিনটির কোনোটি না কোনোটির আওতাভুক্ত এবং উক্ত তিনটি সমস্যার সমাধান হলে অন্যান্য সমস্যার সমাধানও খুব সহজেই সম্ভব হবে। এ তিনটি সমস্যা হচ্ছে আক্বাএদের সমস্যা , ফিক্বহী সমস্যা এবং নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্বের সমস্যা।

ইসলাম তার মৌলিক আক্বাএদের (اصول دين ) ক্ষেত্রে কোনোরূপ অন্ধ বিশ্বাসকে প্রশ্রয় দেয় নি-যা বর্তমানে মুসলিম উম্মাহকে গ্রাস করে নিয়েছে। বরং ইসলাম তার মৌলিক আক্বাএদের তিনটি বিষয়কে অর্থাৎ তাওহীদ , আখেরাত ও রিসালাত্-কে বিশ্বের সকল মানুষের জন্য সমানভাবে গ্রহণীয় সর্বজনীন মানদণ্ড বিচারবুদ্ধি (عقل )-এর ওপর ভিত্তিশীল করেছে-যাতে কারো জন্য নিজ নিজ অন্ধ বিশ্বাসের ওপর অটল থাকার পক্ষে কোনো দলীল না থাকে।

আল্লাহ্ তা আলা কোরআন মজীদে বার বার আক্বল্-এর আশ্রয় গ্রহণের জন্য সকল মানুষের প্রতি আহবোন জানিয়েছেন এবং যারা আক্বল্-এর আশ্রয় গ্রহণ করে না তাদেরকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছেন। আল্লাহ্ তা আলা স্বীয় অস্তিত্ব ও তাওহীদ , আখেরাত এবং নবুওয়াতে মুহাম্মাদী (ছ্বাঃ) ও কোরআন মজীদের ঐশী গ্রন্থ হওয়ার সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। অতএব , মুসলমানদেরকে ইসলামের উছূলে আক্বাএদকে আক্ব্লী দলীলের ভিত্তিতে নতুন করে জানতে ও গ্রহণ করতে হবে এবং অমুসলিমদেরকে এরই ভিত্তিতে ইসলামের দিকে আহবান করতে হবে।

অতঃপর আক্বাএদের বিস্তারিত বিষয়াদির ক্ষেত্রে কোরআন মজীদকে ও তার সহায়ক ব্যাখ্যাকারী শক্তি হিসেবে আক্বল্-কে এবং মুতাওয়াতির্ হাদীছ সমূহ ও ইজমা এ উম্মাহকে (প্রথম যুগের মুসলমানদের মধ্যকার মতৈক্যকে , কোনো ফিরক্বাহ্ বা মাযহাব বিশেষের ইজমা কে নয়) গ্রহণ করতে হবে। হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর সর্বশেষ নবী হওয়া , কোরআন মজীদের সর্বশেষ এবং একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ও সংরক্ষিত ঐশী কিতাব হওয়া , আর রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ততার বিষয়গুলো এ সব সূত্র থেকেই অকাট্যভাবে পাওয়া যায়।

বলা বাহুল্য যে , আক্বাএদের মূল বিষয় সমূহ ও শাখা-প্রশাখা সমূহ এবং মূল ও গুরুত্বপূর্ণ ফিক্ব্হী জিজ্ঞাসাবলীর জবাব অর্থাৎ ফরয ও হারাম সম্পর্কিত বিষয়গুলো উপরোক্ত চারটি মৌলিক দ্বীনী সূত্র থেকেই পাওয়া যায় ; অতঃপর উপরোক্ত চার সূত্রের কোনোটির সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়া সাপেক্ষে গৌণ (মুস্তাহাব্ ও মাকরূহ্) এবং প্রায়োগিক বিষয়াদিতে খবরে ওয়াহেদ হাদীছ গ্রহণযোগ্য। সুতরাং এগুলোর ও এ নীতির ভিত্তিতে ইজতিহাদকে অব্যাহত রাখতে হবে এবং যে সব ফিরক্বাহ্ ও মাযহাব ইজতিহাদের দরযাহ্ বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে মনে করে তাদেরকে সে দরযাহ্ পুনরায় খুলে দিতে হবে। কারণ , ইসলামে ইজতিহাদের বৈধতা থাকলে-যার বৈধতার ব্যাপারে সকলেই একমত-তার দরযাহ্ কেউ কখনো বন্ধ করতে পারে না। বিশেষ করে কোরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াত থেকে মুসলিম সমাজে ইজতিহাদের অস্তিত্ব থাকা ফরযে কেফায়ী হিসেবে প্রমাণিত হয়।

আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

) فَلَوْلا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ(

“ কেন এমন হলো না যে , তাদের (মু মিনাদের) প্রতিটি গোষ্ঠীর মধ্য থেকে কতক লোক বেরিয়ে পড়বে এবং দ্বীনের গভীর সমঝ অর্জনের পর যখন স্বীয় ক্বওমের কাছে ফিরে যাবে তখন তাদেরকে সতর্ক করবে যাতে তারা (আল্লাহর নাফরমানী থেকে) বেঁচে থাকে। ” (সূরাহ্ আত্-তাওবাহ্ : ১২২)

অন্যদিকে যাদের মধ্যে ইজতিহাদ অব্যাহত রয়েছে তাদেরকে পূর্ব থেকে চলে আসা ইজতিহাদের মূলনীতি ও জ্ঞানসূত্রসমূহ সম্পর্কে সব সময়ই এ কথা মনে রাখতে হবে যে , ছাহাবীগণ সহ সকল স্তরের হাদীছ বর্ণনাকারীগণ ও অতীতের মনীষীগণের কেউই মা ছূম্ ছিলেন না , সুতরাং তাঁদের মধ্যেও ভুল ও দুর্বলতা থাকতে পারে। বিশেষ করে তাঁদের কারো কোনো মত বা বর্ণনা যদি কোরআন মজীদের কোনো আয়াতের সাথে বা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর মত বলে ইয়াক্বীন সৃষ্টি হয় এমন কোনো মতের সাথে অথবা আক্বল্-এর অকাট্য রায় বা উম্মাহর প্রথম যুগের মতৈক্যের কোনো বিষয়ের সাথে সাংঘর্ষিক হয় সে ক্ষেত্রে কিছুতেই তাঁর সে মত বা বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বরং তা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর বা অন্য কোনো মা ছূমের ( আঃ) মত বলে দাবী করা হলেও প্রকৃত পক্ষে তা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর বা অন্য কোনো মা ছূমের ( আঃ) মত নয় , বরং তা মিথ্যা রচনা বলে গণ্য করতে হবে।

এখানে আরো উল্লেখ্য যে , ইজতিহাদের ক্ষেত্রে ক্বিয়াস্ নিয়ে বিতর্ক আছে। এ প্রসঙ্গে অনস্বীকার্য যে , কোরআন ও সুন্নাতে রাসূল (ছ্বাঃ)-এর মোকাবিলায় ক্বিয়াস্-এর কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। তবে এর বাইরে ক্বিয়াস্-এর গ্রহণযোগ্যতা আছে কিনা তা স্বতন্ত্রভাবে বিচার্য বিষয়।

প্রকৃত পক্ষে ওপরে যে , চারটি সর্বসম্মত অকাট্য দ্বীনী সূত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাকে চূড়ান্ত ও বিতর্কাতীত সূত্র হিসেবে এবং সেই সাথে এ চার মানদণ্ডের বিচারে উৎরে যাওয়া খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ সমূহকে পঞ্চম উৎস হিসেবে গ্রহণ করা হলে এগুলোর সাহায্যে সমাধান করা যাবে না এমন কোনো দ্বীনী জিজ্ঞাসা থাকতে পারে না।

এমতাবস্থায় মুজতাহিদের কাজ হবে উপরোক্ত সূত্রসমূহ নিয়ে গবেষণা করে নবজাগ্রত বা বিতর্কিত সমস্যাবলী সম্পর্কে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের (ছ্বাঃ) ফয়ছালাহ্ উদ্ঘাটন করা। অতঃপর আর কোনো প্রশ্ন অবশিষ্ট থাকতে পারে না। এতদ্সত্ত্বেও আমরা যদি ধরে নেই যে , আরো কিছু প্রশ্ন অবশিষ্ট থাকতে পারে এবং তার সমাধানের জন্য ক্বিয়াসের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তো সে সব প্রশ্ন হবে খুবই গৌণ বিষয়াদিতে-মুস্তাহাব ও মাকরূহ্ সংক্রান্ত বিষয়াদিতে। এর ফলে ক্বিয়াসের ক্ষেত্র খুবই সীমিত হয়ে আসবে এবং মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ফিক্ব্হী মতপার্থক্যও প্রায় শূন্যের কাছাকাছি চলে আসবে , অন্ততঃ কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই মতপার্থক্য থাকবে না।

বস্তুতঃ মুসলমানদের মধ্যে যে সব ফিক্বহী মতপার্থক্য রয়েছে তার বেশীর ভাগেরই কারণ হচ্ছে সরাসরি কোরআন মজীদ থেকে ফিক্বহী জিজ্ঞাসাবলীর জবাব সন্ধানে যথাযথ প্রচেষ্টা না চালানো এবং এ ব্যাপারে খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ ও অতীতের মনীষীদের ওপর অনেক বেশী মাত্রায় এবং অনেক ক্ষেত্রে অন্ধভাবে নির্ভরতা , অথচ হাদীছের রাভীগণ ও সংকলকগণ এবং অতীতের মনীষীগণ না মা ছূম্ ছিলেন , না সরাসরি ঐশী জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। আল্লাহ্ তা আলা যেখানে কোরআন মজীদকে সকল জ্ঞানের আধার ’ (تبياناً لکل شيء ) বলে উল্লেখ করেছেন সেখানে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফিক্বহী সমস্যা তথা ফরয ও হারাম সংক্রান্ত কোনো সমস্যাই সমাধানবিহীন থাকতে পারে না।

অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে , আক্বাএদ্-কে ওপরে যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সেভাবে গ্রহণ করার পর কোরআন নিয়ে গভীরভাবে চর্চা করা হলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফিক্ব্হী সমস্যাই সমাধানবিহীন থাকে না। ওযূ , তালাক্ব , অস্থায়ী বিবাহ , ওয়াছীয়্যাত্ , ইফ্তারের সময় ও কোনো কোনো মীরাছী বিষয় সহ যে সব গুরুত্বপূর্ণ ফিক্বহী বিষয়ে মুসলমানদের মধ্যে গুরুতর মতভেদ রয়েছে তার সবগুলোর সমাধানই কোরআন মজীদে নিহিত রয়েছে ; আক্বল্ , মুতাওয়াতির্ হাদীছ ও ইজমা এ উম্মাহর সাহায্য নিয়ে এর সবগুলোই উদ্ঘাটন করা সম্ভব।

অবশ্য কোরআন মজীদ থেকে সঠিক তাৎপর্য গ্রহণের ক্ষেত্রে স্থানগত , কালগত , ভাষাগত ও পরিবেশগত ব্যবধানের কারণে যে সব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠা অপরিহার্য এবং তা কাটিয়ে ওঠার জন্য সংশ্লিষ্ট জ্ঞানগবেষক (মুজতাহিদ)গণকে কোরআন নাযিলের যুগের আরবী ভাষার জ্ঞানের সাথে সাথে সঠিক জ্ঞান ও ভুল জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্যকরণে সহায়ক শাস্ত্রসমূহেরও (যেমন : জ্ঞানতত্ত্ব , তাৎপর্যবিজ্ঞান , যুক্তিবিজ্ঞান ও দর্শন) আশ্রয় নিতে হবে।

উপরোক্ত চার মৌলিক সূত্র থেকে ফিক্বহী জিজ্ঞাসাবলীর জবাব সন্ধান করা হলে এরপর মাত্র কতক গৌণ বিষয়ই অবশিষ্ট থাকতে পারে। কারণ , আল্লাহ্ তা আলা যে সব উদ্দেশ্যে নবী-রাসূলগণকে ( আঃ) প্রেরণ করেন তার মধ্যে সর্বপ্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে লোকদেরকে আল্লাহ্ তা আলার সাথে পরিচিত করানো এবং দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদেরকে আল্লাহ্ তা আলা কর্তৃক নির্ধারিত ফরয ও হারামগুলো সম্বন্ধে জানিয়ে দেয়া। এমতাবস্থায় এটা সম্ভব নয় যে , একজন রাসূল এ সম্পর্কে তাঁর স্বল্পসংখ্যক ছাহাবীকে জানাবেন , বরং এ ধরনের আহ্কাম বিপুল সংখ্যক ছাহাবীর জানা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আর যেহেতু হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ওফাতের সময় তাঁর ছাহাবীর সংখ্যা ছিলো লক্ষাধিক , সুতরাং খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছের দ্বারা ফরয বা হারাম প্রমাণিত হতে পারে না। অবশ্য বিস্তারিত তথা খুটিনাটি , বিশেষতঃ প্রায়োগিক বিধান ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ গ্রহণযোগ্য , কিন্তু তার গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে উপরোক্ত চার সূত্রের কোনোটির সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়ার ওপরে।

বলা বাহুল্য যে , কোরআন মজীদের ব্যাখ্যা ও বিস্তারিত আহ্কামের ক্ষেত্রে নিষ্পাপ (মা ছূম্) ব্যক্তিত্ববর্গের কথা ও কাজ নির্দ্বিধায় মেনে নেয়া মুসলমানদের কর্তব্য , কিন্তু কোনো হাদীছ গ্রন্থে কোনো কিছু মা ছূমের কথা বা কাজ হিসেবে উল্লেখ থাকা মানেই যে সত্যি সত্যিই তা মা ছূমের কথা ও কাজ এটা নিশ্চিত করে বলা চলে না। বরং একজন মুজতাহিদ যে কোনো খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছকে উপরোক্ত চার দলীলের মানদণ্ডে ও হাদীছ বিচারের আরো বহু মানদণ্ডে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যখন এ প্রত্যয়ে উপনীত হবেন যে , তা সত্যি সত্যিই মা ছূমের কথা বা কাজ কেবল তখনি তিনি তা গ্রহণ করবেন।

এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় হচ্ছে এই যে , কোনো হাদীছের ক্ষেত্রে মা ছূম্ ও হাদীছ-সংকলকের মাঝে বর্ণনাস্তরের (রাভী) সংখ্যা যতো কম হবে হাদীছে ভ্রান্তি বা বিকৃতি প্রবেশ বা পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা ততোটা কম এবং বর্ণনাস্তরের আধিক্যের ক্ষেত্রে ভ্রান্তি , বিকৃতি ও পরিবর্তনের সম্ভাবনা ততো বেশী। মোদ্দা কথা , শিয়া ও সুন্নী নির্বিশেষে কোনো ধারার কোনো হাদীছ-গ্রন্থেরই সকল হাদীছকে চোখ বুঁজে গ্রহণ বা চোখ বুঁজে প্রত্যাখ্যান করার উপায় নেই।

বস্তুতঃ আক্বাএদী ও ফিক্বহী উভয় ক্ষেত্রেই শিয়া-সুন্নী দুস্তর ব্যবধান গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ হচ্ছে হয় ইজতিহাদকে অবৈধ গণ্য করা , নয়তো বৈধ গণ্য করা সত্ত্বেও অতীতের ইজতিহাদ সমূহকে যথেষ্ট গণ্য করে ইজতিহাদের দরযাহ্ বন্ধ গণ্য করা। বাছ-বিচার না করে অন্ধভাবে খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ গ্রহণ করার কারণও তা-ই। ইজতিহাদ অব্যাহত থাকলে এর ধারাক্রমে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এক সময় হাদীছের ক্ষেত্রে এ ভ্রান্ত কর্মনীতির বিলুপ্তি ঘটতে বাধ্য। তাই দেখা যায় , যারা ইজতিহাদ করছেন তাঁরা বহুলাংশে এ অন্ধত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন।

সুন্নীদের মধ্যে যেমন আহলে হাদীছ নামে পরিচিত একটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ফিরক্বাহ্ ইজতিহাদকে অবৈধ গণ্য করে , তেমনি শিয়াদের মধ্যেও আখবারী নামে পরিচিত একটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ফিরক্বাহ্ ইজতিহাদকে অবৈধ গণ্য করে। অন্যদিকে উছূলী নামে পরিচিত বেশীর ভাগ শিয়াদের মধ্যেই ইজতিহাদ প্রচলিত আছে এবং এ ধারার মুজতাহিদগণ ইজতিহাদের ক্ষেত্রে সুন্নী ধারার হাদীছ , তাফসীর ও ফিক্বাহ্ থেকেও সাহায্য নিয়ে থাকেন এবং দেখা গেছে যে , একজন শিয়া মুজতাহিদ কতক ক্ষেত্রে পূর্ব থেকে শিয়া মাযহাবের অনুসারীদের মধ্যে চলে আসা পূর্ববর্তী খ্যাতনামা মুজতাহিদগণের ফত্ওয়া পরিত্যাগ করে সুন্নী ধারার মধ্যে প্রচলিত ফত্ওয়ার অনুরূপ ফত্ওয়া দিয়েছেন , কিন্তু এ কারণে তাঁকে কোনোরূপ বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হতে হয় নি।

[উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে , কোরআন মজীদের আয়াত

) انما المشرکون نجس(

“ অবশ্যই মুশরিকরা অপবিত্র। ” (সূরাহ্ আত্-তাওবাহ্ : ২৮)

এ আয়াতের ভিত্তিতে শিয়া মাযহাবের মুজতাহিদগণের বেশীর ভাগেরই ফত্ওয়া হচ্ছে এই যে , মূলগতভাবে যে খাবার হালাল তা-ও মুশরিকের দ্বারা প্রস্তুত হলে খাওয়া জায়েয নয়। যদিও অতীতের কতক শিয়া মুজতাহিদ জায়েয বলেছেন , তবে সাধারণভাবে শিয়া মাযহাবের অনুসারীগণ নাজায়েয হওয়ার ফত্ওয়া অনুযায়ীই আমল করে থাকে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে ক্বোমের দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্রের অন্যতম শিক্ষক আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মাদ জান্নাতী (রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বনামখ্যাত আয়াতুল্লাহ্ আহমাদ জান্নাতী নন) তাঁর এক গবেষণামূলক প্রবন্ধে এ বিষয়ে শিয়া-সুন্নী উভয় ধারার হাদীছ ও মুজতাহিদগণের ফত্ওয়া পর্যালোচনা করে সুন্নী ফত্ওয়ার অনুরূপ উপসংহারে উপনীত হন যে , সংশ্লিষ্ট আয়াতে শারীরিক অপবিত্রতার (نجاسة جسمانی ) কথা বলা হয় নি , বরং আত্মিক অপবিত্রতার (نجاسة روحانی ) কথা বলা হয়েছে , অতএব , বাহ্যতঃ নাপাকীর প্রমাণ বা নিদর্শন না থাকলে হালাল খাবার মুশরিকের দ্বারা প্রস্তুত হলেও তা হালাল। প্রবন্ধটি ক্বোমের দ্বীনী জ্ঞানকেন্দ্রের মুখপত্রکيهان انديشه তে প্রকাশিত হয় এবং এর বিরুদ্ধে কোনো মহল থেকেই কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শিত হয় নি।]

এ পর্যায়ে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে মুসলমানদের শাসন-কর্তৃত্বের বিষয়।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ক প্রশ্নটির জবাব সবচেয়ে সহজ বলে মনে করি। কারণ , ছাহাবীদের যুগ অনেক আগেই গত হয়ে গিয়েছে এবং শিয়া মাযহাবের অনুসারীগণ যে বারো জন পবিত্র ব্যক্তিত্বকে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে মনোনীত ইমাম বলে আক্বীদাহ্ পোষণ করে তাঁদের মধ্যে এগারো জন অনেক আগেই এ পার্থিব দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন এবং শিয়া আক্বীদাহ্ অনুযায়ীই দ্বাদশ ইমাম [ইমাম মাহ্দী ( আঃ)] স্বীয় পরিচিতি ও দাবী সহকারে সমাজে বিচরণ করছেন না , বরং স্বীয় পরিচিতি গোপন করে অবস্থান করছেন। ফলে তাঁর নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের দাবী কার্যতঃ মেনে নেয়া বা না মানার প্রশ্নটি আপাততঃ বিদ্যমান নেই। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের প্রশ্নে শিয়া-সুন্নী উভয় ধারার মুসলমানরাই অভিন্ন অবস্থানে এসে উপনীত হয়েছে।

এ সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে , হযরত ইমাম মাহ্দী ( আঃ)-এর আবির্ভাবের পূর্ববর্তী বর্তমান অন্তর্বর্তীকালে মুসলমানদের শাসনকর্তৃত্বের ভার এমন ব্যক্তিদের হাতে অর্পণ করতে হবে যারা মা ছূম্ না হলেও ইতিপূর্বে উল্লিখিত দ্বীনী নেতৃত্বের জন্য অপরিহার্য তিনটি গুণের অধিকারী। বলা বাহুল্য যে , এ ধরনের গুণাবলীর অধিকারী ব্যক্তিত্ব কেবল মুজতাহিদগণের মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে। আর কোরআন-সুন্নাহর দাবীও এটাই। কারণ , ইসলামের সকল মাযহাব ও ফিরক্বাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) থেকে বর্ণিত এমন একটি হাদীছ হচ্ছে :

العلماء ورثة الانبياء

“ আলেমগণ নবী-রাসূলগণের ( আঃ) উত্তরাধিকারী। ”

আর বলা বাহুল্য যে , এ হাদীছে আলেম ” বলতে বর্তমান যুগে প্রচলিত পরিভাষায় ঢালাওভাবে যাদেরকে আলেম ” বলা হয় তাঁদেরকে বুঝানো হয় নি , বরং কোরআন মজীদে যাদের সম্পর্কেيتفقهوا فی الدين বলা হয়েছে কেবল তাঁদের ক্ষেত্রেই তথা মুজতাহিদগণের ক্ষেত্রেই উল্লিখিত হাদীছের এ শব্দটি প্রযোজ্য। তেমনি এ ধরনের ব্যক্তির জন্য চিন্তা ও আচরণের ক্ষেত্রে ভারসাম্য ( আদ্ল্ বা তাক্ব্ওয়া)-এর অধিকারী হওয়া তথা চরম পন্থা ও শিথিল পন্থা থেকে মুক্ত হওয়া এবং দূরদৃষ্টির (بصيرة ) অধিকারী হওয়াও অপরিহার্য। আর বিচারবুদ্ধির অকাট্য রায়ও এটাকেই সমর্থন করে।

এ বিষয়টি ইসলামে কোনো নতুন বিষয় নয় , যদিও বহু শতাব্দী যাবত বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয় নি। অতঃপর খৃস্টীয় বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) এ বিষয়টিকে ভেলায়াতে ফাক্বীহ্ ” (ولاية فقيه -মুজতাহিদের শাসন-কর্তৃত্ব) শিরোনামে একটি তত্ত্ব হিসেবে উপস্থাপন করেন। অতঃপর তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে ইরানের মুসলিম জনগণ ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটানোর পর সেখানে এ তত্ত্ব ভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তন করে।

দুর্ভগ্যজনক যে , সুন্নী জগতের কতক ইসলামী নেতা ও আলেম ভেলায়াতে ফাক্বীহ্ ” তত্ত্বকে শিয়া মাযহাবের একান্ত নিজস্ব বিষয় বলে অভিহিত করে উপেক্ষা করার চেষ্টা করেছেন , অথচ প্রকৃত ব্যাপার হলো এই যে , তত্ত্বটির নামের প্রতি দৃষ্টি না দিলেও এর মূল বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে , শিয়া মাযহাবের অনুসারীদের অনেক আগে থেকেই (এমনকি হযরত ইমাম খোমেইনী কর্তৃক তত্ত্ব হিসেবে উপস্থাপনেরও বহু আগে-হাজার বছরেরও বেশীকাল পূর্ব থেকেই) সুন্নী মাযহাবের অনুসারীরা এ তত্ত্বের মূল বক্তব্যের মুখাপেক্ষী ছিলো।

বস্তুতঃ শিয়া মাযহাবের অনুসারীরা সমাজে মা ছূম্ ইমামগণের ( আঃ) প্রকাশ্য উপস্থিতি কালে ইজতিহাদ ও ভেলায়াতে ফাক্বীহ্ ” তত্ত্ব-কোনোটিরই মুখাপেক্ষী ছিলো না। কারণ , মা ছূম্ (নবীই হোন বা ইমামই হোন) যখন সমাজে উপস্থিত থাকেন তখন দ্বীনী জিজ্ঞাসার চূড়ান্ত জবাব দানের অধিকার এবং শাসন-কর্তৃত্বের অধিকার একমাত্র তাঁরই ; কেবল মা ছূমের অনুপস্থিতিতেই ইজতিহাদ ও ভেলায়াতে ফাক্বীহ্ ” র প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু সুন্নী আক্বীদাহ্ অনুযায়ী যেহেতু হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ওফাতের সাথে সাথে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে মনোনীত ’ দ্বীন-ব্যাখাকারী এবং নেতা ও শাসনকর্তার পদের সমাপ্তি ঘটেছে সেহেতুيتفقهوا فی الدين সম্বলিত আয়াত ওالعلماء ورثة الانبياء হাদীছ অনুযায়ী , রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর ওফাতের পর মুহূর্ত থেকেই তাদের জন্য ওলামা তথা মুজতাহিদগণের দ্বীনী নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্ব অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

এ ক্ষেত্রে দ্বীনের ব্যাখ্যা ও শাসন-কর্তৃত্বের জন্য হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ছাহাবী , তাবেঈন্ বা তাবে তাবেঈন্-এর কথা চিন্তা করা হলে তা একটি তত্ত্ব হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ , তাঁরা কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রজন্ম মাত্র। অন্যদিকে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ততার প্রশ্নটি কোনো সাময়িক প্রশ্ন নয় , বরং তাঁর ওফাতের পর মুহূর্ত থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত একটি স্থায়ী প্রশ্ন। তাই আল্লাহর মনোনীত স্থলাভিষিক্ততা তথা ইমামতের আক্বীদাহ্ গ্রহণ না করলে তত্ত্ব হিসেবে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিক্তিতার বিষয়টি ব্যক্তি বা গোষ্ঠী প্রশ্নের উর্ধে চিন্তা করতে হবে এবং ভেলায়াতে ফক্বীহ্ ” তত্ত্বটি এ ধরনেরই একটি তত্ত্ব। আর এ তত্ত্ব ছাহাবী , তাবেঈন্ বা তাবে তাবেঈন্ সহ যে কোনো প্রজন্মের জন্য প্রযোজ্য।

বস্তুতঃ বাস্তবে মুসলমানদের একজন দ্বীনী নেতা ও শাসক বা খলীফাহ্ ভেলায়াতে ফাক্বীহ্ ” র জন্য অপরিহার্য গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন কিনা তা একটি স্বতন্ত্র প্রশ্ন-যা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে , কিন্তু একজন দ্বীনী নেতা ও শাসকের জন্য যে এর সবগুলো গুণের অধিকারী হওয়া অপরিহার্য সে ব্যাপারে বিতর্ক থাকতে পারে না।

এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে , অতীতে সুন্নী জগতের মনীষীগণও যে এ বিষয়টির প্রতি মোটেই দৃষ্টি দেন নি তা নয়। কারণ , তাঁদের অনেকে খলীফাহ্ বা শাসক মনোনয়নের এখতিয়ারاهل الحل والعقد (চূড়ান্ত মতামত প্রদানের এখতিয়ারের অধিকারীগণ)-এর বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। এ পরিভাষাটির বিভিন্ন সংজ্ঞা দেয়া হলেও এর অন্যতম সংজ্ঞা হচ্ছে দ্বীনী বিষয়ে মতামত প্রদানের যোগ্যতার অধিকারী ব্যক্তিগণ ” -যা কেবল মুজতাহিদগণের বেলায়ই প্রযোজ্য হতে পারে।

মোদ্দা কথা , আজকের দিনে শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে মুসলিম সমাজের দ্বীনী নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের একমাত্র সমাধান হচ্ছে ভেলায়াতে ফাক্বীহ্ ” বা মুজতাহিদের শাসন-কর্তৃত্ব ’ ।

হযরত ইমামে খোমেইনী (রহ্ঃ) কেবল যে এ তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন তা নয় , তিনি এর প্রায়োগিক পদ্ধতিও প্রদর্শন করে গেছেন। যেহেতু কোরআন মজীদের যে আয়াত ও হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর যে হাদীছ এ তত্ত্বের ভিত্তি তাতে মাত্র একজন আলেম বা মুজতাহিদকে দ্বীনী নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্বের অধিকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয় নি , বরং উভয় সূত্রেই বহুবচন বাচক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে সেহেতু এ অধিকার ও দায়িত্ব সমাজে বিদ্যমান সকল মুজতাহিদের। তবে যেহেতু রাষ্ট্রক্ষমতার চূড়ান্ত কর্তৃত্ব কেবল একজনের ওপরই ন্যস্ত করা যেতে পারে সেহেতু তাঁরা তাঁদের শাসনকর্তৃত্বের দায়িত্বটি নিজেদের মধ্য থেকে একজনের ওপর অর্পণ করবেন।

কিন্তু এ অর্পণের মানে শাসনকর্তৃত্বের ক্ষেত্রে তাঁদের অধিকার ও কর্তব্যের পরিসমাপ্তি ঘটা নয়। সুতরাং তাঁরা সব সময়ই শাসকের কাজের প্রতি দৃষ্টি রাখবেন ও তাঁকে পরামর্শ দেবেন এবং শাসক যদি কখনো শারীরিক , মানসিক , নৈতিক বা রাজনৈতিক দিক থেকে যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন তাহলে তাঁরা যে কোনো মুহূর্তে তাঁকে অপসারিত করে তাঁর স্থলে অন্য কারো ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করতে পারবেন।

অন্যদিকে দ্বীনী বিষয়াদির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অধিকার ও কর্তব্য সর্বাবস্থায়ই ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক মুজতাহিদেরই থাকবে এবং এ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রত্যেকের অনুসারীগণ নিজ নিজ অনুসৃত মুজতাহিদকেই অনুসরণ করতে থাকবে ; রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রেই শাসক-মুজতাহিদের মতের অনুসরণ সকলের জন্য বাধ্যতামূলক হবে না। শুধু তা-ই নয় , যে সব বিষয়ে রাষ্ট্রের বাস্তবায়ন-কর্তৃত্ব বা বিচারিক কর্তৃত্ব থাকে এমন বিষয়াদিতেও যদি বিভিন্ন মাযহাব বা বিভিন্ন মুজতাহিদের রায়ের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে মতপার্থক্য থাকে (যেমন : বিবাহ-তালাক্ব ও মীরাছ বণ্টনের ক্ষেত্রে কতক শাখাগত বিষয়) সে সব ক্ষেত্রেও সকলের ওপরে শাসক-মুজতাহিদের মত বা সংখ্যাগুরু মাযহাবের রায় চাপিয়ে দেয়া যাবে না। বরং বিবদমান পক্ষদ্বয় একই মাযহাবের বা একই মুজতাহিদের অনুসারী হলে তাদের ব্যাপারে তাদের অনুসৃত মাযহাব বা মুজতাহিদের রায় অনুযায়ী ফয়ছালাহ্ করতে হবে , তবে বিবদমান পক্ষদ্বয় যদি দুই ভিন্ন মাযহাব বা মুজতাহিদের অনুসারী হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সংশ্লিষ্ট জনপদে যারা সংখ্যাগুরু তাদের ফিক্ব্হী রায় অনুযায়ী ফয়ছালাহ্ করতে হবে।

অমুসলিম সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রেও এ নীতিই প্রযোজ্য হবে।

অবশ্য ফৌজদারী দণ্ডবিধি , পররাষ্ট্রনীতি , সশস্ত্র বাহিনী , যুদ্ধ , সন্ধি , আমদানী-রফতানী নীতি , মুদ্রানীতি ইত্যাদি একান্তভাবেই মুজতাহিদ শাসকের এখতিয়ারাধীনে থাকবে-যে সব ক্ষেত্রে তিনি তাঁকে নির্বাচনকারী মুজতাহিদগণের এবং তাঁকে সহায়তাকারী আইন বিভাগ , প্রশাসন ইত্যাদির সাহায্যক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং প্রশাসন ও স্বাধীন বিচার বিভাগের মাধ্যমে কার্যকর করবেন। বস্তুতঃ এর চেয়ে উত্তম ও ভারসাম্যপূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা চিন্তা করা সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) স্বয়ং শিয়া মাযহাবের অনুসারী একজন মুজতাহিদ ছিলেন বটে , কিন্তু তিনি যে ভেলায়াতে ফাক্বীহ্ ” তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন তা শিয়া-সুন্নী যে কোনো দেশে সমানভাবে প্রযোজ্য ; এ তত্ত্ব প্রয়োগের জন্য শিয়া মাযহাবের অনুসারী কোনো মুজতাহিদকে শাসনকর্তৃত্ব প্রদান করা জরুরী নয়। বরং সুন্নী মুসলমানদের দ্বারা অধ্যুষিত কোনো দেশে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার শাসনকর্তৃত্ব সে দেশেরই কোনো মুজতাহিদের ওপর অর্পিত হবে।

[যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে সুন্নী সমাজে ইজতিহাদের দরযাহ্ বন্ধ গণ্য করার কারণে কোনো মুজতাহিদ নেই , কিন্তু এখানে যা আলোচনা করা হয়েছে কোনো সমাজে তা গ্রহণযোগ্য হিসেবে পরিগণিত হলে ফরযে কেফায়ী হিসেবে অবশ্যই সেখানে ইজতিহাদ শুরু হবে এবং এরই ধারাবাহিকতায় এক সময় হয়তো সেখানে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা ভেলায়াতে ফাক্বীহ্ তত্ত্ব বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। অতএব , সুন্নী সমাজে কোনো শিয়া মুজতাহিদকে এনে শাসনকর্তৃত্ব দিতে হবে বা ইরান থেকে কোনো মুজতাহিদকে ধার করে এনে শাসনকর্তৃত্বে বসাতে হবে এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। তার চেয়েও বড় কথা এই যে , সুন্নী সমাজে ইজতিহাদের ধারা পুনঃপ্রবর্তিত হলে বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে যে শিয়া-সুন্নী বিভক্তি ও ব্যবধান রয়েছে তার পুরোপুরি বিলুপ্তি না ঘটলেও প্রায় বিলুপ্তি ঘটবে। কারণ , একজন প্রকৃত মুজতাহিদ মাযহাবী সঙ্কীর্ণতার উর্ধে থেকে সত্যকে উদ্ঘাটন করেন এবং তিনি সত্য হিসেবে যে উপসংহারে উপনীত হন তা-ই সমাজের কাছে পেশ করেন।

এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে , সুন্নী জগতে নতুন ইজতিহাদের দরযা আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ ঘোষণা করার পরেও বিভিন্ন শতাব্দীতে কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে কতক বিষয়ে ইজতিহাদ করেছেন , এমনকি বিংশ শতাব্দীতেও কোনো কোনো ব্যক্তিত্বের পক্ষ থেকে এ ধরনের উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এগুলো ছিলো নেহায়েতই বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ ; সুন্নী জগতে আনুষ্ঠানিকভাবে ইজতিহাদের দরযা বন্ধই রয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয়তঃ যারা এভাবে ইজতিহাদ করেছেন তাঁরাও আক্বাএদ্ , ফরয ও হারাম এবং ইজতিহাদী মূলনীতি সমূহের মধ্যকার বিতর্কিত বিষয়গুলোকে সাধারণতঃ স্পর্শ করেন নি , বরং পূর্বসুরিদের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার চেষ্টা করে কিছু বিষয়ে স্বীয় মত ব্যক্ত করেছেন। তাই তাঁদের ইজতিহাদকে ইজতিহাদে তাক্বলীদী হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। যেহেতু অত্র গ্রন্থের বিষয়বস্তুর জন্য এ বিষয়ে আলোকপাত করা যরূরী নয় সেহেতু আমরা এখানে তাঁদের নামোল্লেখ ও সুনির্দিষ্টভাবে তাঁদের কৃত ইজতিহাদের দুর্বলতা সমূহের উল্লেখ থেকে বিরত থাকছি। ]