ধর্মের পুনর্জাগরণে ইমামগণের ভূমিকা

ধর্মের পুনর্জাগরণে ইমামগণের ভূমিকা25%

ধর্মের পুনর্জাগরণে ইমামগণের ভূমিকা লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

ধর্মের পুনর্জাগরণে ইমামগণের ভূমিকা
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 16 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 27462 / ডাউনলোড: 3656
সাইজ সাইজ সাইজ
ধর্মের পুনর্জাগরণে ইমামগণের ভূমিকা

ধর্মের পুনর্জাগরণে ইমামগণের ভূমিকা

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

আল্লাহর রাসূলের (সা.) নাতির শাহাদত

আবু মাখনাফ , সাকআব ইবনে যুবাইরের সূত্রে হামিদ ইবনে মুসলিম হতে বর্ণনা করেছেন : ইমাম হুসাইনের (আ.) শরীরে পশমের একটি জুব্বা ছিল এবং মাথার উপর ছিল একটি পাগড়ি। তিনি নিজের দাড়িসমূহকে রাঙিয়ে ছিলেন। শাহাদতের পূর্বে তিনি পদব্রজে ছিলেন কিন্তু সাহসী বীরের ন্যায় এবং পূর্ণ দক্ষতার সাথে লড়ছিলেন। তিনি অশ্বারোহী শত্রুদের প্রতি হামলা করছিলেন । আমি নিজে শুনেছি , তিনি তাদের সম্বোধন করে বলছিলেন: আমাকে হত্যা করতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়েছো এবং জনগণকে সেই কাজের প্রতি উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করছো ?! আল্লাহর শপথ ! অন্যান্য যে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা অপেক্ষা , আমাকে হত্যা করার জন্যে মহান আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি অধিক রাগান্বিত হবেন। আমি আশা রাখি যে , মহান আল্লাহ্ আমাকে তোমাদের লাঞ্ছনা ও অপমানের বিপরীতে সম্মানিত করবেন। যতখানি তোমরা চিন্তাও করতে পার না ততখানি মহান আল্লাহ্ তোমাদের নিকট থেকে আমার প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন।

আল্লাহর শপথ ! জেনে রাখ যে , আমাকে হত্যা করলে মহান আল্লাহ্ তোমাদের উপর অত্যন্ত কঠোর হবেন , তোমাদের রক্ত ঝরবে , এতেও যথেষ্ট নয় বরং তোমাদের প্রতি তিনি কয়েকগুণ বেশি পীড়াদায়ক শাস্তি ধার্য করবেন ।

হামিদ ইবনে মুসলিম বলেন : ঘণ্টার পর ঘণ্টা অতিবাহিত হচ্ছিল , এই সময়ে কেউ তাঁকে হত্যা করতে চাইলে , হত্যা করতে পারত। কিন্তু তারা অপেক্ষা করছিল যে , অপর কেউ এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটির পদক্ষেপ গ্রহণ করুক যাতে করে তারা নিজেদেরকে এই গুরুতর অপরাধ থেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়। ঠিক এই অবস্থায় শিমর (শিমার) চিৎকার দিয়ে উঠে : তোমাদের প্রতি অভিসম্পাত ! কিসের অপেক্ষায় রয়েছো , তোমাদের মায়েরা তোমাদের জন্য বিলাপ করুক ?!! এই লোকটির কাজ সমাপ্ত কর এবং তাঁকে হত্যা কর !

শিমারের ফরিয়াদের কারণে কুফার লোকেরা চারদিক হতে তাঁর উপর আক্রমণ করে। শুরাইক তামীমী তার তরবারি দ্বারা ইমামের বাম হাতের উপর একটি আঘাত করে। অপর একজন তাঁর কাঁধের উপর একটি আঘাত করে , যার ফলে ইমাম (আ.) কয়েকবার দাঁড়ান এবং মুখ থুবড়ে পড়ে যান। আক্রমণকারীরা এই অবস্থায় তাঁর নিকট হতে দূরে সরে যায়।

যখন ইমাম একবার দাঁড়াচ্ছিলেন আবার মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তখন আমর নাখ্য়ীর নাতি সিনান ইবনে আনাস তার বর্শা দ্বারা তাঁর উপর মারাত্মক একটি আঘাত হানে। ইমাম সেই আঘাতের ফলে লুটিয়ে পড়েন। খাওলা ইবনে ইয়াযীদ আসবাহীর ’ দিকে মুখ ফিরিয়ে সিনান বলে তাঁর দেহ হতে মাথাটি বিচ্ছিন্ন কর ! খাওলা , ইমামের দেহ হতে মাথাটি বিচ্ছিন্ন করার জন্যে সামনে অগ্রসর হলো কিন্তু দুর্বলতা ও আড়ষ্টতা যেন তার সমগ্র অস্তিত্বকে আচ্ছন্ন করলো এবং সে কাঁপতে শুরু করল। সিনান ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে খাওলাকে উদ্দেশ্য করে বলল : আল্লাহ্ তোমার বাহু দু টিকে ভেঙ্গে ফেলুক এবং তোমার হাত দু খানিকে অকেজো করে দিক ! অতঃপর সে নিজেই সামনে অগ্রসর হয়ে নিষ্পাপ সেই ইমামের মাথাটিকে তাঁর পবিত্র শরীর হতে বিচ্ছিন্ন করে। তারপর সেই পবিত্র মাথাটিকে খাওলার নিকট অর্পণ করে ।

ইমাম সাদীকের (আ.) উদ্ধৃতি দিয়ে আবু মাখনাফ বলেনঃ শাহাদতকালে হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদার (আ.) শরীরে ৩৩টি বর্শার আঘাত এবং ৩৪টি তরবারির আঘাত ছিল !

ইমামের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোতে সিনান ইবনে আনাস , ইবনে সা দের অপর সৈন্যদেরকে তাঁর (আ.) নিকটবর্তী হওয়া থেকে কঠিনভাবে বাধা দিচ্ছিল , এই আশঙ্কায় যে , হয়তো বা অপর কেউ তার আগেই ইমামের দেহ হতে মাথাটি বিচ্ছিন্ন করে দেয় ! স্বীয় বাসনা চরিতার্থ করা হলে সে , ইমামের পবিত্র মাথাটিকে খাওলার নিকট অর্পণ করে।

খলীফার সৈন্যরা রাসূলের সন্তানের শরীরের পোশাকগুলি লুণ্ঠন করছে

আবু মাখনাফ বলেন : ইমামের দেহকে তারা বিবস্ত্র করে এবং যা কিছু তাঁর শরীরে ছিল তা লুট করে। বাহর ইবনে কা ব তাঁর জামা এবং কায়েস ইবনে আশ্আছ তাঁর রেশমী আবাটি ছিনিয়ে নেয়। এইরূপ একটি ধৃষ্টতার জন্য সে কাতীফা কায়েস ’ (লুটকারী কায়েস) নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। আসওয়াদ নামের বনী আওদ গোত্রের জনৈক ব্যক্তি তাঁর জুতাগুলি ছিনিয়ে নেয় এবং বনী নাহ্শাল ইবনে দারিম গোত্রের জনৈক ব্যক্তি তাঁর তরবারিখানা নেয়। পরবর্তীতে সেই তরবারিখানা হাবীব ইবনে বুদাইলের পরিবারের হাতে পড়ে।

অতঃপর সৈন্যরা পোশাক আষাক , অলঙ্কারাদি এবং উটগুলি লুট করা শুরু করে। পরিশেষে তারা ইমাম হুসাইনের (আ.) অন্দরমহল অর্থাৎ নারিগণ এবং তাদের আসবাবপত্র ও সাজ সরঞ্জামের দিকে ধাবিত হয়। এমনকি তারা নারিদের মস্তকাবরণ ও তাঁদের চাদরগুলি ছিনিয়ে নিয়েছিল !

সর্বশেষ শহীদ

যুহাইর ইবনে আব্দুর রাহমান খাছ্আমী হতে বর্ণিত হয়েছে : সুওয়াইদ ইবনে আমর ইবনে আবিল মাতা নামের ইমামের একজন সাথি মারাত্মতভাবে আহত হয়ে নিহতদের মাঝে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে ছিলেন। ইমামের শাহাদতের পর কিছুটা তাঁর চেতনা ফিরে আসে এবং তিনি লোকদের বলতে শুনেন: হুসাইন নিহত হয়েছেন ! এই ধ্বনিটি তাঁকে জাগ্রত করে তোলে। তাঁর তরবারিখানা লুট করে নেয়ার কারণে , তিনি নিজের সঙ্গে রাখা চাকু দ্বারা কুফার লোকদের প্রতি আক্রমণ শুরু করেন এবং কিছু সময় ব্যাপী তাদের সাথে যুদ্ধ করেন। পরিশেষে উরওয়াহ্ ইবনে বাত্বার তাগলিবী এবং যায়িদ ইবনে রিক্বাদ জাম্বী ’ র হাতে নিহত হন ও শহীদগণের কাতারে শামিল হন।

হামিদ ইবনে মুসলিম হতে বর্ণনা করা হয়েছে : আমি লুটকারী সৈন্যদের সঙ্গে ইমামের (আ.) তাঁবুগুলিতে প্রবেশ করলাম এবং আলী ইবনে হুসাইন ইবনে আলী অর্থাৎ আলী আসগরের১১২ নিকট উপস্থিত হলাম। তিনি অসুস্থ এবং শয্যাশায়ী ছিলেন। সেই অবস্থায় শিমার ইবনে যিল জাওশান তার পদাতিক লোকদের সাথে এই কথা বলাবলি করছিল : এই রুগ্ন ব্যক্তিটিকে কি হত্যা করব , না করব না ? আমি উপস্থিত হয়ে তাদেরকে সম্বোধন করে বললাম : সুবহানাল্লাহ্ ! তাহলে কি তোমরা কিশোরকেও হত্যা করবে ? এই রুগীটি একজন কিশোর ছাড়া বেশী কিছু নয়। আমি এই কথার দ্বারা , যারাই তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হচ্ছিল তাদেরই পথ রোধ করছিলাম এবং সামনে অগ্রসর হতে দিচ্ছিলাম না। পরিশেষে উমর ইবনে সা দ সেখানে উপস্থিত হয় এবং চিৎকার করে বলে : এই নারিদের তাঁবুতে প্রবেশ করার কারও অধিকার নেই এবং এই রুগ্ন যুবকটিকে কোনোরূপ কষ্ট দিতে পারবে না ; উপরন্তু যারা তাদের কোনো সামগ্রী লুণ্ঠন করেছে তারা যেন সেইগুলি তাঁদের নিকট ফিরিয়ে দেয় ! কিন্তু আল্লাহর শপথ ! তার কথায় কেউ কান দিল না এবং লুণ্ঠনকৃত মাল পত্রের কোনো কিছুই ফিরিয়ে দিল না !

ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন (আ.) ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তিনি আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন : উত্তম কাজ করেছো। কসম খাচ্ছি যে , মহান আল্লাহ্ তোমার কথার দ্বারা তাদের কুকর্ম ও যাতনাকে আমা হতে দূরীভূত করেছেন ।

হুসাইনের (আ.) হন্তা পুরস্কার চায় !

বর্ণনাকারী বলেন : ইমাম হুসাইনের নিহত হওয়ার পর , কুফার সৈন্যদের কয়েকজন লোক সিনান ইবনে আনাসকে বলে: আলী ও আল্লাহর রাসূলের কন্যা ফাতিমার সন্তান হুসাইনকে তুমি হত্যা করেছো এবং আরবের সর্বাধিক অবাধ্য ব্যক্তি যিনি এই ক্ষমতাসীন সরকারের কব্জা থেকে ক্ষমতাকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে ওঁৎ পেতে বসে ছিলেন তাঁকে তুমি পরাজিত করেছো। এখনই সময় তুমি তোমার অধিনায়কদের নিকট যাও এবং তাদের নিকট হতে পুরস্কার চাও। তুমি তাদের জন্যে যে কাজ করেছো ও হুসাইনকে হত্যা করে তাদের যে উপকার করেছো , তার জন্যে তারা যদি তাদের যাবতীয় ধন সম্পদও তোমাকে দান করে তবুও তা তোমার কাজের প্রতিদান হবে না !

সিনান একদিকে যেমন একজন সাহসী পুরুষ অপরদিকে তেমনি বোকা ও বিকৃত মস্তিষ্ক ছিল , তাদের কথায় সে প্রভাবিত হল। তখন সে নিজ ঘোড়ায় আরোহণ করে সরাসরি উমর ইবনে সা দের তাঁবুর দিকে ছুটল এবং সেখানে উপস্থিত হয়ে তার সমস্ত শক্তি দ্বারা চিৎকার দিয়ে বলল :

আউকির রিকাবিয়া ফিযযাতান্ ওয়া যাহাবা আনা ক্বাতালতুল মালেকাল্ মুহাজ্জাবা

ক্বাতালতু খাইরান্নাসি উম্মান্ ওয়া আবা ওয়া খাইরুহুম্ ইয্ ইয়ানসিবূনা নাসাবা ।

অর্থাৎ আমি একজন মহৎপ্রাণ বাদশাহকে হত্যা করেছি , এই সুসংবাদের জন্য তোমরা আমার বাহনকে স্বর্ণ ও রৌপ্য দ্বারা ভরে দাও ! আমি পিতা মাতার দিক থেকে সর্বোত্তম মানুষকে হত্যা করেছি , তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি বংশ কৌলীন্যের দিক হতে তাদের সর্বোত্তম !

সিনানের আওয়াজ , কবিতা ও বীরত্বগাঁথা শুনে উমর ইবনে সা দ তাকে সম্বোধন করে বলে : আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে , তুমি একজন পাগল! তারপর সেই উপস্থিত জনতার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল : ওকে ভিতরে আনো ! সিনান যখন উমর ইবনে সা দের তাঁবুতে পা রাখল তখন সে তার নিজের হাতের লাঠি দ্বারা তাকে আঘাত করে বলল : এই পাগল ! তুমি এই ধরনের কথাবার্তা বলছো ? আল্লাহর শপথ! তোমার এই কথাগুলো যদি ইবনে যিয়াদ শুনে তবে তোমার শিরোচ্ছেদ করবে !

উকবাহ মুক্তি পেল এবং মারকা বন্দী হলো

ইমরুল কায়িসের কন্যা ও সাকীনার মাতা রুবাবের মুক্ত দাস উকবাহ্ ইবনে সাম্আনকে লোকেরা বন্দী করে উমর ইবনে সা দের নিকট নিয়ে যায়। উমর তাকে জিজ্ঞাসা করল: তুমি কি কর ? উকবাহ্ উত্তর দিলেন : আমি একজন কৃতদাস ! এই উত্তরের সাথে সাথে উমর তাঁর উপর হতে হাত গুটিয়ে নেয় এবং তাঁকে ছেড়ে দিল। বলল : সে যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারে। তিনি ও মারক্বা ইবনে ছামামা আসাদী ব্যতীত ইমামের অপর কোনো সাথিই জীবন রক্ষা করতে পারেননি ।

যুদ্ধ ক্ষেত্রে মারক্বা ’ তাঁর সমস্ত তীরকে শত্রুর বক্ষে বসিয়েছিলেন এবং তাঁর ধনুকে আর কোনো তীর অবশিষ্ট ছিল না। তিনি কুচক্রী শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছিলেন , এমন সময়ে তাঁরই কয়েকজন নিকটাত্মীয় তাঁর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল যে , তুমি যুদ্ধ থেকে বিরত হও ; আমরা তোমাকে নিরাপত্তা দান করব। এই কথায় মারক্বা ’ তাদের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। পরিশেষে উমর ইবনে সা দ তাঁদেরকে ইবনে যিয়াদের নিকট নিয়ে যায় এবং তাদের ঘটনা ও মারক্বা ’ কে দেয়া তাদের নিরাপত্তা বিষয়ে ইবনে যিয়াদের নিকট তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। ইবনে যিয়াদও মারক্বা ’ কে হত্যা না করে , যুরারা অঞ্চলে নির্বাসিত করে।

ফাতিমা(আ.) এর নিহত সন্তানের উপর ঘোড়া ছুটানো হয়েছে

ইমাম নিহত হলে , উমর ইবনে সা দ তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল যে , নিহত ইমামের পবিত্র দেহের উপর ঘোড়া চালাতে আগ্রহীরা যেন এগিয়ে আসে !

সেই সৈন্যদের মাঝ হতে দশজন লোক সামনে এগিয়ে আসলো। তাদের মাঝে আলকামা ইবনে সালামা র বংশের ইসহাক ইবনে হায়াত হাযরামী ও আহবাশ ইবনে মুরছেদকে ’ দেখা যাচ্ছিল। বর্ণনাকারী বলেন : প্রথমজন ইমামের শরীর হতে পরিধেয় বস্ত্র খুলে নেয়ার ফলে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়। আর ইবনে মুরছেদ সেই ঘটনার অব্যবহিত পরেই কোনো এক যুদ্ধে , অজানা একটি তীর এসে তার বক্ষ ভেদ করে এবং তাকে জাহান্নামে প্রেরণ করে ।

যা হোক , এই দশজন নিকৃষ্ট ব্যক্তি (আল্লাহ্ ও রাসূলের সামনে লজ্জাবোধ করল না) তাদের নিজ নিজ ঘোড়াগুলিকে হুসাইনের (আ.) মৃতদেহের উপর দিয়ে ছুটালো এবং তাঁর পিঠ ও পাঁজরকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিল !

মদীনায় ইমাম হুসাইনের (আ.) জন্যে শোক পালনকারীরা

১। উম্মে সালমা

সুনানে তিরমিযী , সিয়ারে আ লামিন্ নুবালা , রিয়াযুন্নাযরা , তারীখে ইবনে কাছীর , তারীখুল খামীছ এবং অন্যান্য সূত্রে সালমা র বরাত দিয়ে এসেছে : একদা আমি উম্মে সালমা র খিদমতে উপস্থিত হলাম এবং তাঁকে ক্রন্দনরত দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম , আপনি কেন ক্রন্দন করছেন ? তিনি উত্তর দিলেন , আল্লাহর রাসূলকে (সা.) আমি স্বপ্নে শোকার্ত দেখলাম , তাঁর মাথা ও মুখমণ্ডলে মাটি লেগে ছিল। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম , হে আল্লাহর রাসূল ! আপনার এ কি অবস্থা ? তিনি উত্তরে বললেন , এই কিছুক্ষণ পূর্বেই হুসাইনকে নিহত হতে দেখলাম ! ১১৩

ইয়াকুবী স্বীয় ইতিহাসে লিখেন : ইমাম হুসাইনের (আ.) শোকে মদীনায় সর্বপ্রথম যে ধ্বনি উচ্চারিত হয় তা ছিল রাসূলের স্ত্রী উম্মে সালমা র গৃহ হতে। তার কারণ ছিল এই যে , রাসুল উম্মে সালমা কে একটি বোতলে কিছু মাটি প্রদান করে বলেন যে , জিব্রাঈল (আ.) আমাকে অবগত করলেন , হুসাইনকে আমার উম্মতের এক দল লোক হত্যা করবে। তারপর তিনি বলেন : তুমি যখনই দেখবে যে , এই মাটি টুকু টাট্কা রক্তে রূপান্তরিত হয়েছে তখনই জেনো যে , হুসাইন নিহত হয়েছেন ।

সেই মাটি টুকু তখন থেকে উম্মে সালমা র নিকট ছিল , ইমাম হুসাইনের (আ.) শাহাদতের সময় নিকটবর্তী হলে সেই মহিয়সী নারী সার্বক্ষণিক সেই মাটির দিকে চেয়ে থাকতেন এবং যখন তিনি দেখলেন যে , সেই মাটি টুকু টাট্কা রক্তে রূপান্তরিত হয়ে গেছে তখন তিনি ওয়া হুসাইনা ” ও ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ্ ” বলে চিৎকার করে ক্রন্দন শুরু করলেন। মদীনার নারীরা উম্মে সালমা র আর্তনাদ শুনে মদীনার প্রতিটি কোণায় কোণায় শোকের রোল তুললেন এবং এক সময়ে হুসাইনের শোকে মদীনা শহরে এক বিরাট শোরগোল শুরু হল যা ইতিপূর্বে কোনো দিন শুনা যায় নি । ১১৪

২। ইবনে আব্বাস

আহমাদ ইবনে হাম্বালের মুসনাদ ও ফাযায়েল গ্রন্থে , ত্বাবরানী ’ র মো ’ জামে কাবীর গ্রন্থে , মুস্তাদরাকে হাকিমে , রিয়াযুন্নাযরা গ্রন্থে এবং অন্যান্য সূত্রে আম্মার ইবনে আবী আম্মারের ভাষ্যে ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত হয়েছে যে , তিনি বলেন দিনের মধ্যাহ্নভাগে ঘুমন্ত অবস্থায় আল্লাহর রাসূলকে (সা.) স্বপ্নে দেখলাম। তিনি ধুলা বালি মাখা এবং এলোমেলো চুলসহ খুবই বিমর্ষ অবস্থায় ছিলেন। তাঁর হাতে রক্তে পূর্ণ একটি বোতল ছিল ! তাঁকে সম্বোধন করে আমি বললাম : হে আল্লাহর রাসূল , আপনার জন্যে আমার পিতা মাতা উৎসর্গিত হোক ! আপনার হাতে এটি কি ? তিনি বললেন : এটি ইমাম হুসাইন ও তাঁর সঙ্গী সাথিদের রক্ত , এটি আমি আজই উঠিয়েছি ।

আম্মার বলেন: আমি সেই দিবসটিকে (যে দিনটির প্রতি ইবনে আব্বাস ইশারা করেছিলেন) অনুসন্ধান করে দেখলাম , সেই দিবসেই হুসাইন শহীদ হয়েছেন । ১১৫

তারীখে ইবনে আসাকির ও ইবনে কাছীরে , জিদ্আনের পৌত্র আলী ইবনে যাইদে ’ র ’ বরাত দিয়ে এসেছে : ইবনে আব্বাস ঘুম হতে জেগে উঠেন এবং পুনরায় শুতে গিয়ে বলেন , আল্লাহর শপথ ! হুসাইন নিহত হয়েছেন ! তাঁর একজন সাথি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন : কোথা থেকে তুমি এইরূপ কথা বার্তা বলছ ? তিনি বললেন : স্বপ্নে রাসূলকে রক্তে পূর্ণ একটি বোতলসহ দেখলাম। তিনি আমাকে বললেন : তুমি জান , আমার উম্মতরা আমার পরে কি করেছে ?! তারা হুসাইনকে হত্যা করেছে এবং এই হচ্ছে তাঁর ও তাঁর সঙ্গী সাথিদের রক্ত , আল্লাহর নিকট নিয়ে যাচ্ছি !

তারা সেই দিন ও সেই সময়কে লিখে রাখেন। চব্বিশ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর মদীনায় সংবাদ আসে যে , সেই দিন ও সেই সময়ই হুসাইন (আ.) নিহত হয়েছেন।১১৬

৩। অপর অপরিচিত ব্যক্তি

তাবারী ও অন্যান্যরা আমর ইবনে ইকরামা র উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন : যেই দিন হুসাইন নিহত হন সেই দিনই সকালে আমাদের জনৈক মাওয়ালী (দাস) মদীনায় সংবাদ দিলেন যে ,সে গতকাল কোনো এক ব্যক্তির চিৎকার শুনেছেন ; তিনি হুসাইনের শোকে এই কবিতা পাঠ করছিলেন :

আয়্যুহাল্ ক্বাতিলূনা জাহলান্ হুসাইনা উব্শিরূ বিল্ আযাবি ওয়াত্তানকীলি ;

কুল্লু আহলিস্ সামায়ি ইয়াদ্ আলাইকুম্ মিন্ নাবিয়্যিন্ ওয়া মালায়িকিন্ ওয়া ক্বাবীলি ;

ক্বাদ্ লু ইন্তুম্ আলা লিসানি ইবনি দাঊদা ওয়া মূসা ওয়া হামিলিল্ ইঞ্জীলি ।

অর্থাৎ হে সেই লোকেরা , যারা হুসাইনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছো , শাস্তি ও শিক্ষণীয় কানমলা খাওয়ার অপেক্ষা কর। নবী , ফেরেশ্তা ও অন্যান্যরা সহ আসমানের সমস্ত অধিবাসী তোমাদের উপর অভিসম্পাত বর্ষণ করছেন। তোমরা হযরত সুলায়মান , মূসা ও ঈসা কর্তৃক অভিশপ্ত।

এই পংক্তিগুলি , কিছুটা মতভেদ সহ উম্মে সালমা এবং অন্যান্যদের নিকট থেকেও বর্ণিত হয়েছে। তাঁরা একজন অদৃশ্য লোকের মুখ থেকে সেই পংক্তিগুলি শুনেছেন কিন্তু তাঁকে স্বয়ং দেখেন নি। তিনি হুসাইনের মৃত্যুতে এই কবিতাটি পাঠ করছিলেন । ১১৭

বাঁদুড় পাখি

কখনও কখনও অন্ধকার রাত্রে একটা ব্যতিক্রমধর্মী প্রাণীর আনাগোনা দৃষ্টিগোচর হয়। আমরা দেখতে পাই রাত্রের গভীর অন্ধকারের মধ্যেও এ পাখি সাহসিকতার সাথে খাবারের সন্ধানে এদিক সেদিক ছুটে বেড়ায়। ঘুট ঘুটে অন্ধকার । রাত্রে যখন কোন কিছুই দৃষ্টিগোচন হয় না তখন এরই মাঝে নির্ভয়ে উড়ে বেড়ায় একটি ছোট্ট পাখি। রাতেই তার বিচরণ সময়। খাবার যোগাড় করে সে রাত্রেই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীর শিকার এ গভীর ও ঘন অন্ধকারেই করে থাকে সে। এ ছোট্ট পাখিটির নাম বাঁদুড়। প্রকৃতিতে এটি একটি বিষ্ময়ক র প্রাণী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী আশ্চর্য হলো ঘুট ঘুটে অন্ধকার রাত্রিতে এর বিচরণ।

এ দ্রুতগতি সম্পন্ন ক্ষুদ্র পাখি রাতের আঁধারে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় না। এটা কতই না বিষ্ময়কর! এ ব্যাপারে যতই পর্যবেক্ষণ ও অধ্যায়ন করা হয় ততই এর অন্তর্নিহিত ও গুপ্ত রহস্য আমাদের সামনে আরো অধিক পরিমাণে উদ্ঘাটন হয়ে পড়ে। দিবালোকে একটা দ্রুত উড্ডয়নশীল পাখি যে ভাবে নির্ভয়ে আকাশে উড়ে বেড়ায় এ ক্ষুদ্র বাদুড় পাখিটাও সেভাবে অন্ধকার রাতে নির্ভয়ে আকাশে উড়ে বেড়াতে সক্ষম।

আমরা জানি এ পাখির কোন চোখ নেই। তবুও রাতের অন্ধকার তার জন্যে সমস্যাই নয়। যদি তার উড্ডয়নের পথে প্রতিবন্ধকতার ব্যাপারে কোন প্রকার তথ্য সংগ্রহের মাধ্যম না থাকে তাহলে কিভাবে সে এত অকুতোভয় ? কোথাও তো আঘাত লেগে গতিরোধ হচ্ছে না ?

দেখা গেছে যদি এ পাখিটাকে কোন আঁকাবাঁকা ও অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে ছেড়ে দেয়া হয় আর সুড়ঙ্গ পথের দেয়ালগুলোতে কালি মেখে রাখা হয় তারপরও এ বিষ্ময়কার প্রাণীটি খুব সুন্দরভাবে কোন রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অবস্থায় সুড়ঙ্গের অন্য পথ দিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম। বাদুড় পাখির মধ্যকার এ বিষ্ময়কর অবস্থার সাথে আধুনিক বিশ্বের আবিষ্কার রাডার1 নামক যন্ত্রের তুলনা করা যেতে পারে। বাঁদুড় পাখি সৃষ্টিকর্তার এক আশ্চর্য সৃষ্টি। এর অন্তর্নিহিত ব্যবস্থাপনার গভীরতা উপলব্ধির জন্যে রাডার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা থাকা প্রয়োজন। সাধারণত: পদার্থ বিদ্যায় শব্দের অধ্যায়ে মহাশব্দ বা অতিশব্দ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হয়ে থাকে। এ মহাশব্দের তরঙ্গমালা এত দ্রুতগতিসম্পন্ন ও দীর্ঘ যে মানুষের দ্বারা কোন ক্রমে তা কর্ণগোচন সম্ভব নয়। এটা পরীক্ষিত সত্য যে ,যখন কোন দেয়ালে ছুড়ে মারা হয় তখন তা ঠিক নিক্ষেপের গতিতেই পূর্বস্থানে ফিরে আসতে বাধ্য। যখন আমরা কোন পাহাড়ের নিকট গিয়ে চিৎকার করি তখন এর ধ্বনি একট নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পূর্বস্থানের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। তদ্রুপ কোন মহাশব্দের তরঙ্গ একটা নির্দিষ্ট স্থান থেকে নিক্ষেপ করা হলে তা নির্দিষ্ট গতিতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যখনই কোন কিছুতে বাধাগ্রস্থ হয় তখনই তা পূর্বের অবস্থানের দিকে ফিরে আসে। সচরাচর যুদ্ধের সময় শত্রু বিমানকে চিহ্নিত করার জন্যে এ ধরণের রাডার থেকে একটা বিশেষ শব্দ বিমানের উদ্দেশ্য প্রেরণ করা হয়ে থাকে। আর যখনই তা শত্রু বিমানে আঘাত প্রাপ্ত হয় তখনই একটা নির্দিষ্ট গতিতে প্রত্যাবর্তন করে রাডার যন্ত্রে। এরই মাধ্যমে শত্রু বিমানের গতিবেগ ,দুরত্ব ইত্যাদি নির্ণয় করা হয়ে থাকে।

বিজ্ঞানীরা বলেন ,বাদুড় পাখির দেহে রাডারের ন্যায় একটা যন্ত্র বিদ্যমান। তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন যদি বাদুড় পাখিকে একটা শুন্য কক্ষে ছেড়ে দেয়া হয় আর সেখানে মহাশব্দ ধারণ ও তা সাধারণ শব্দের তরঙ্গে পরিণত করার ক্ষমতাসম্পন্ন কোন মাইক্রোফোন রাখা হয় তাহলে পরিষ্কারভাবে রাডার থেকে নির্গত মহাশব্দ শ্রবণ সম্ভবপর হয়ে উঠবে। প্রতি সেকেন্ডে ত্রিশ থেকে ষাট বার মহাশব্দের তরঙ্গ বাদুড় পাখির নিকট থেকে শোনা যায় বলে তারা ধারনা করে থাকেন।

আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে বাদুড় তার বাকযন্ত্র থেকে শব্দ নির্গত করে তা নাসিকার মাধ্যমে বাইরে ছেড়ে দেয়। আর তা কোন স্থানে বাধাগ্রস্থ হয়ে ফিরে আসে কর্ণে। বাদুড়ের কর্ণ নির্গত তরঙ্গরাজীর ধারক। এ পাখি তার কর্ণের মাধ্যমেই উপলব্ধি করতে পারে কতটুকু দুরত্বে বাধাগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণেই এ ক্ষুদ্র প্রাণী রাতের অন্ধকারে শিকারের খোঁজে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে। কি অবাক সব ক্রিয়া-কান্ড! এতসব জটিল ব্যবস্থাপনা কি কোন একজন বুদ্ধিমান ও সর্বজ্ঞানী ব্যবস্থাপক ব্যতীত অন্য কারো দ্বারা সম্ভব ? আর কোন বুদ্ধিহীন ব্যবস্থাপক তো এ ব্যাপারে কোন ধারণাই রাখতে পারে না। সৃষ্টি জগতের এ বিশাল নৈপূণ্য ক্ষমতা ও জটিলতা দর্শনে এ অবধি অনেক বিজ্ঞানী এমন কোন একক মহাস্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন ,যিনি সকল প্রকৃতির উর্দ্ধে।

পুষ্প ও কীট পতঙ্গ

প্রাকৃতিক জগতে আরেকটি অত্যাশ্চর্য বিষয় হচ্ছে পুষ্প ও কীট পতঙ্গের মাঝে বন্ধুত্ব। বসন্তকালের শেষের দিক যখন ধীরে ধীরে বাতাস গরম হতে শুরু করে তখন ফলের বাগান গুলোতে বিভিন্ন প্রকার কীট পতঙ্গের আনাগোনা দেখা যায়। ছোট-বড় পতঙ্গ ,প্রজাপতি ,মৌমাছি ইত্যাদি কত রকমের প্রাণী। এধরণের প্রাণীর কাজ হলো এরা কোন এক গাছের ফুলের উপর বসে রস আহরণ করে অন্য গাছের পাপড়ির উপর গিয়ে বসে। ওরা পুঃলিঙ্গের গাছের পাপড়ি থেকে পরাগরেণু বহন করে নিয়ে যায় স্ত্রী লিঙ্গের পুষ্পের উপর। এভাবে বৃক্ষরাজীর মাঝে সঙ্গম ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পরিণতিতে বৃক্ষরাজী ফুলে -ফলে ভরপুর হয়ে উঠে।

এ সময়ে বিভিন্ন প্রকার কীট-পতঙ্গের আনাগোনা ,এক ডাল থেকে অন্য ডালে বিচরণ ,গাছে গাছে উড়ে বেড়ানো ইত্যাদি দেখে মনে হয় কোন এক বিশেষ শক্তি তাদেরকে ঠিক একটি উৎপাদনশীল শিল্প কারখানার শ্রমিকদের ন্যায় পরিচালনা করছে। ফলে সকলে নিজ কর্মে পরিপূর্ণ আত্মনিয়োগ করে আছে। কাজের কোন ফাঁকি নেই। পরিশ্রম করছে সবাই একযোগে। যথাযথভাবে সকলে স্ব -স্ব দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। কতই না বিষ্ময়কর এ বিষয়টি !

কখনো কি ভেবে দেখেছি ,যেখানে বৃক্ষ ,তরুলতার নড়াচড়া ও স্থান পরিবর্তন করার ক্ষমতা নেই সেখানে ওগুলো কি ভাবে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয় আর কি পদ্ধতিতে তাদের সঙ্গমক্রিয়া সম্পন্ন হয় ? কিভাবে বৃক্ষরাজীর মাঝে পুরুষ পরাগরেণু ও স্ত্রী ডিম্বানুর মিলন ঘঠে ? অনেক ক্ষেত্রে এ অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজটির দায়িত্ব কীট পতঙ্গের উপর ন্যস্ত। আবার কখনো বায়ু এ মিলন ক্রিয়াতে সাহায্য করে থাকে। যখন কোন ব্যক্তি কীট-পতঙ্গ ও বৃক্ষরাজীর মধ্যকার এ বিষ্ময়কর ঘটনাবলী অধ্যয়ন করে তখন স্বভাবতঃই তার মনে প্রশ্নের উদেয় হয় ,কে কীটপতঙ্গ ও বৃক্ষদের মাঝে এ অপুরম ও মজবুত বন্ধুত্ব স্থাপন করে দিয়েছে ?

আমাদের চারপার্শ্বে রয়েছে এ ধরণের বহু আশ্চর্য ঘটনা যা বিশ্বকে দান করে এক সাবলীল সৌন্দর্য ও বিশেষ নিয়ম-শৃঙ্খলা। বিশ্বজগত চমৎকার ও বিষ্ময়কর সৃষ্টিতে ভরপুর। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে কোন সৃষ্টিকে নিয়ে যদি আমরা সামান্য পরিমাণ অধ্যয়ন ,গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখতে পাব বহু অত্যাশ্চর্য ক্রিয়া-কান্ড ,সুনিপুণ কলা-কৌশল ও ব্যবস্থাপনা। এ প্রসঙ্গে কোরআন উল্লেখ করছে :

) يُنبِتُ لَكُم بِهِ الزَّرْعَ وَالزَّيْتُونَ وَالنَّخِيلَ وَالْأَعْنَابَ وَمِن كُلِّ الثَّمَرَاتِ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ(

অর্থাৎ : (আল্লাহ্) তোমাদের জন্যে ওটার (বৃষ্টির) মাধ্যমে কৃষিকার্য উৎপাদন এবং জলপাই ,খেজুর ও আঙ্গুর ইত্যাদি সব ধরণের ফলাদি বৃক্ষ সমুদগত করেন ,নিশ্চয়ই এগুলোর মধ্যে চিন্তাশীলদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। (আন্ নাহল ,আঃ নং-11 )

আল্লাহ্ অন্যত্র বলেন-

) إ ِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنفَعُ النَّاسَ وَمَا أَنزَلَ اللَّـهُ مِنَ السَّمَاءِ مِن مَّاءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِن كُلِّ دَابَّةٍ وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ(

অর্থাৎ : নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও যমীন এবং দিবা-রাত্রির পালা বদল এবং মানুষের উপকারার্থে চলন্ত জাহাজসমূহ এবং আল্লাহ্ কর্তৃক আসমান থেকে বারিবর্ষন যার ফলে মৃত যমীন পুনরায় প্রাণ ফিরে পায় এবং যমীনের বুকে চতুষ্পদ জন্তুর উত্থান আর বায়ুরাশির গতি পরিবর্তন এবং আসমান ও যমীনের মাঝখানে সংরক্ষিত ও করতলগত মেঘ খণ্ড চিন্তাশীলদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। (আল্ বাক্বারা ,আঃ নং-164। )

6

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি

শিশু জন্মলগ্ন থেকেই তার চার পাশে অনেককে দেখতে পায়। সর্বপ্রথম যার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে তিনি হলেন নবজাত শিশুর মা। ধীরে ধীরে যখন শিশু বড় হতে থাকে তখন সে মা ছাড়াও আরো অনেকের সাখে পরিচয় লাভ করে। আস্তে আস্তে বিভিন্ন ধরনের বস্তুর সাথেও পরিচিত হতে থাকে। এভাবে শুরু হয় একটি শিশুর জীবনযাত্রা।

মানুষ স্বভাবগত ভাবেই কৌতুহলী। তার চারপাশের বিভিন্ন বস্তু ও ব্যক্তি সন্বন্ধে জানার কৌতুহলী মনোভাব শৈশবেই প্রতিটি শিশুর মাঝে পরিলক্ষিত হয়। প্রথমে সে ক্ষুদ্র জিনিষ থেকেই শুরু করে ,পরে বয়স যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে ততই জীজ্ঞাসার মাত্রা ও পরিমাপও বেশী হতে থাকে।

একটি শিশু যখন পাঠশালায় গমন করে তখন সে তার চতুষ্পার্শ্বে অনেক ধরনের সৃষ্টির সাথে পরিচয় লাভ করে। আর প্রথম থেকেই তো এ আকাশ তার মাথার উপর ছেয়ে আছে। অক্সিজেন অনবরত গ্রহণ করছে। পানি পান করছে। এভাবে সে ধীরে ধীরে পাহাড়-পর্বত ও নদ-নদী এবং অনেক ধরনের গৃহপালিত পশু-পাখির সাথে পরিচয় লাভ করতে থাকে। ঐ শিশুর কৌতুহলী মনে একটি মাত্র জিজ্ঞাসা এত সব কিছু ,কে সৃষ্টি করলো ? সৃষ্টির পেছনে কি উদ্দেশ্য নিহিত আছে ? সূর্য প্রভাতে পূর্বাকাশে উদয় হয় আবার সন্ধ্যাবেলা পশ্চিমাকাশে অস্ত যায় প্রতিদিন ,এ নিয়ম-শৃঙ্খলা কে তৈরী করলো ? রাত্রে যখন সে আকাশের তারকারাজীর দিকে তাকায় তখন আবারও তার মনে প্রশ্নের উদেয় ঘটে ,এত সুন্দর মনোরম নক্ষত্রমণ্ডলীকে কনো অভিজ্ঞ চিত্রকর আকাশের বুকে সাজিয়ে রেখেছে ? এসব প্রশ্নের উত্তরই হল বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি। বিশ্ব অস্তিত্ত্ব ও ব্যবস্থাপনা এবং মানুষ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিই হল অন্তরের এতসব প্রশ্নের উত্তর।

অনেকে বিশ্বাস করেন এ বিশ্বের সৃষ্টির পেছনে কোন পরিকল্পনা প্রণেতার প্রয়োজন নেই। এর পেছনে কোন উদ্দেশ্যও নেই। স্বয়ংক্রিয়ভাবে উদ্ভব হয়েছে এ সৃষ্টিজগত। প্রকৃতিই স্বয়ং সকল বস্তুর সৃষ্টিকর্তা। আর একেই বলে বস্তুবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি। প্রাক ইসলামী যুগে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীদের বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হতো। তন্মোধ্যে প্রাকৃতিবাদী ,যিনদিক ,দাহরী ও নাস্তিক অন্যতম। কিন্তু বর্তমান আধুনিক ,শিল্পোন্নত ও ইলেকট্রোনিক্স যুগে তাদের মুখোশ পরিবর্তন হতে দেখা যায়। বর্তমান বিশ্বে বস্তুবাদীদের বিভিন্নমুখী মতাদর্শের মধ্যে অতি পরিচিত নামটি হচ্ছে যুক্তিবাদী বস্তুবাদ বা Dialectic Materialism । আর মার্ক্সবাদী দর্শন এরই উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে।

আবার অনেকে বিশ্বাস করেন এ বিশ্ব জগতের বালু কণা থেকে শুরু করে প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে একটি নির্দিষ্ট কার্যকারণ ও উদ্দেশ্য রয়েছে। কোন কিছুই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হয়নি। বরং প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে কোন স্বাধীন সত্তার শক্তিমত্তা কাজ করছে। এ ধরনের চিন্তা ভাবনার নাম বিশ্ব সম্পর্কে আস্তিকবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।

আমাদের মনে রাখতে হবে বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি আর বিশ্ব পরিচিতি এক কথা নয়। এরা দুটি পৃথক পরিভাষা। দৃষ্টান্তস্বরূপ ,পৃথিবীতে পানির পরিমান মাটির চেয়ে কতগুণ বেশী ? অথবা সৌর জগতে বিরাজমান গ্রহের সংখ্যা কত ? ইত্যাদি সৃষ্টি জগতের পরিচয় নিয়ে আলোচনা মাত্র। এগুলোতে বিশ্ব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নয়। আর যখন আমরা সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করি ,যেমন ধরুন যদি বলি যে ,সমগ্র বস্তুজগত কোন অবস্তুগত সৃষ্টিকর্তার উপর নির্ভরশীল -তাহলে এ বিষয়টি বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্ভুক্ত বলে পরিগণিত হবে।

7

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির ফলশ্রুতি

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও বিজ্ঞানের উন্নতি

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশা

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন , আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে ,তা তো আছেই। আমাদের বিভিন্ন প্রকার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এগুলোর তো কোন পরিবর্তন আসবে না। তাহলে এ বিষয়ে এত আলোচনার কি প্রয়োজন ? এর আলোচনা আমাদের জন্যে কি ফলাফল বয়ে আনতে পারে ?

উক্ত প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় ,হ্যাঁ ,আমাদের চারদিকে কোন সৃষ্টির উপর প্রভাব ফেলবে না সত্য ,কিন্তু তাই বলে আমাদের কাজ-কর্ম ,আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হবে না এটা বলা মনে হয় সঠিক হবে না।

অধিকন্তু বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাবিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিষয়টির স্পষ্টতার জন্যে নিন্মে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা গেল।

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও বিজ্ঞানের উন্নতি

চিন্তা করে দেখুন ,আপনার বন্ধু সফর থেকে ফিরে এসেছে। সে আপনাকে একটি বই উপহার দিয়ে বললো এ চমৎকার বইটির লেখক একজন বড় চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ,বুদ্ধিমান ও বিজ্ঞ এবং উচ্চজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অধিকারী। নিশ্চয়ই আপনি সে বইটা হালকাভাবে রিডিং পড়েই ক্ষান্ত হবেন না। বরং এর প্রতিটি শব্দ ,বাক্য ও তাদের গঠন বর্ণনা ও পরিবর্তন সবকিছুকে খুব সূক্ষ্মভাবে মনযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করবেন। যদি কোথাও না বুঝে থাকেন তা হলে ঘন্টার পর ঘন্টা ,দিনের পরদিন মোট কথা সুযোগ পেলেই এ বিষয় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করবেন ,বোঝার চেষ্টা করবেন। সাধ্যমত পরিশ্রম করতেও আপনি কুন্ঠাবোধ করবেন না। কেননা ,এ বইয়ের গ্রন্থকার কোন সাধারণ লোক নন। তিনি একজন শীর্ষস্থানীয় গবেষক ,চিন্তাবিদ। তার কোন কথাই অযথা নয়। কোন বাক্যই তার অপরিকল্পিত নয়।

অপরদিকে যদি আপনাকে বলা হয় এ বইটা যদিও বাহ্যিকভাবে চমৎকার বলে মনে হবে কিন্তু এর পুস্তকার একজন অজ্ঞ ,মুর্খ ,নির্বোধ ও বুদ্ধিহীন ব্যক্তি। আপনি নিখুত ভাবে এ বইটার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন নাকি শুধুমাত্র একটু চোখ বুলিয়ে রেখে দিবেন ? কেননা আপনি জানেন এ বইয়ের কোন মূল্য নেই। কোন জ্ঞান-গর্ভ আলোচনা এ বইতে নেই। মোট কথা এ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করা অযথা সময় নষ্ট করারই নামান্তর বলে বিবেচনা করবেন। এ বিশ্বজগতও একটি বৃহৎ গ্রন্থের ন্যায়। এ জগতের প্রতিটি সৃষ্টি এক একটি বাক্য ,যার সমম্বয়ে গঠিত হয়েছে এ বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ।

যদি আমরা আস্তিকবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অনুগামী হই তাহলে এ বিশ্বের প্রতিটি বস্তু ,প্রতিটি সৃষ্টিকেই আমরা মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করবো আর খুব মনোযোগ সহকারে তাঁর প্রতিটি বিষয়ের অধ্যায়নে গুরুত্বারোপ করবো এবং কৌতুহলী অন্তঃকরণ নিয়ে প্রতিটি সৃষ্টির অন্তর্নিহিত রহস্যাবলী উদ্ঘাটনের জন্যে উদ্গ্রীব হবো। কেননা আমরা বিশ্বাস করি প্রতিটি সৃষ্টি বস্তুর পেছনে নিশ্চয়ই কোন শক্তিশালী ও বিশাল বুদ্ধিমান শক্তিমত্তা বা সৃষ্টিকর্তা ক্রিয়শীল রয়েছেন। তিনি অতিশয় বুদ্ধিমান ,প্রজ্ঞাবান ,শিল্পী ও জ্ঞানী। তিনি মহাবিজ্ঞানী ও দার্শনিক। সুতরাং তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। আর এ দৃষ্টিভঙ্গির কারনেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও উন্নতি সম্ভব হয়েছে।

আর যদি আমরা বস্তুবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হই তা হলে এ বিশ্বের রহস্যময় সৃষ্টিকুলের ব্যাপারে সামান্যতম চিন্তা-ভাবণা করারও মনোভাব তৈরী হবে না। কেনান ,বস্তুবাদীরা এ বিশ্বজগতের সৃষ্টিকারক হিসেবে বুদ্ধি ও জ্ঞানহীন প্রকৃতিকেই মনে করেন। আর এতসব কিছুর স্রষ্টা যদি এক নির্বোধ ও জ্ঞানহীন প্রকৃতি হয়ে থাকে তা হলে তার সৃষ্টির-ই বা কি মূল্য হতে পারে ?

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশা

কথায় বলে , নদীর এপাড় ভাঙ্গে ওপাড় গড়ে -এই তো নদীর খেলা। আর এ খেলা মানুষের জীবনেও ঘটে থাকে অহরহ। সাধারণতঃ মানুষের এ ক্ষণকালীন জীবনও বহু চড়াই-উৎরাই এর মধ্য দিয়ে বিকশিত হয় । তাই কখনো একজন মানুষের জীবনের দ্বারে কিছু অনাকঙ্খিত বিপদও কড়া নাড়তে পারে। অনেক সময় এমনও হয় যে এ অপ্রত্যাশিত সমস্যা থেকে তার পালানের কোন পথ থাকে না। তখন চতুর্দিকে পথরুদ্ধ অবস্থায় পড়ে যায় সে। এমতাবস্থায় সে নিজেকে অতিশয় দুর্বল ও অসহায় অবস্থার মুখোমুখি দেখতে পায়। আর এরকম কঠিন বিপদের মুহুর্তে একমাত্র আস্তিকবাদী দৃষ্টি-ভঙ্গিই তাকে মুক্তির সন্ধান দিতে পারে। কেননা ,সে তখন তার চেয়ে বড় ও বিশাল কোন অস্তিত্বের আশ্রয়ের সন্ধান খুঁজে পায়। তিনি জানেন এ বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টিই একজন পরম পরাক্রমশালী ও বুদ্ধিমান সৃষ্টিকর্তার অধীন। আর আমাদের পরিত্রানদাতাও তিনি। ফলে একজন আস্তিক ব্যক্তি এ ধরনের কঠিন ও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মোকাবলা করার জন্যে যথেষ্ট দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে থাকেন।

অপর দিকে একজন বস্তুবাদী ব্যক্তি এ ধরনের পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। হতাশা ও ভয় তাকে অক্টোপাসের মত ঘিরে ফেলে একটি ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের ন্যায়। এমতাবস্থায় সে নিরাশ্রিত অবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। আর এ কারনেই বস্তুবাদীরা এহেন তহাশাগস্থ অবস্থায় আত্মহত্যার ঘৃন্য পথের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে আস্তিকবাদীরা সর্বাবস্থায় তাদের মহাপরাক্রমশালী পরিত্রানদাতার আশ্রয় কামনা করে থাকেন। আর এ কারনেই তারা কখনো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন না।

আর এক ন্যায়সংগত কারণে ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা মহাপাপ বলে পরিগণিত। কেননা আত্মহত্যা হতাশা ও পরাজয়ের মনোভাব থেকেই জন্ম লাভ করে থাকে।

8

আস্তিকবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ

কার্যকারণ

শৃঙ্খলীয় প্রমাণ

মানব প্রকৃতি ও সত্যান্বেষী স্বভাব

অস্তিত্ব বিভক্তির প্রমাণ

বাঁদুড় পাখি

কখনও কখনও অন্ধকার রাত্রে একটা ব্যতিক্রমধর্মী প্রাণীর আনাগোনা দৃষ্টিগোচর হয়। আমরা দেখতে পাই রাত্রের গভীর অন্ধকারের মধ্যেও এ পাখি সাহসিকতার সাথে খাবারের সন্ধানে এদিক সেদিক ছুটে বেড়ায়। ঘুট ঘুটে অন্ধকার । রাত্রে যখন কোন কিছুই দৃষ্টিগোচন হয় না তখন এরই মাঝে নির্ভয়ে উড়ে বেড়ায় একটি ছোট্ট পাখি। রাতেই তার বিচরণ সময়। খাবার যোগাড় করে সে রাত্রেই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীর শিকার এ গভীর ও ঘন অন্ধকারেই করে থাকে সে। এ ছোট্ট পাখিটির নাম বাঁদুড়। প্রকৃতিতে এটি একটি বিষ্ময়ক র প্রাণী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী আশ্চর্য হলো ঘুট ঘুটে অন্ধকার রাত্রিতে এর বিচরণ।

এ দ্রুতগতি সম্পন্ন ক্ষুদ্র পাখি রাতের আঁধারে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় না। এটা কতই না বিষ্ময়কর! এ ব্যাপারে যতই পর্যবেক্ষণ ও অধ্যায়ন করা হয় ততই এর অন্তর্নিহিত ও গুপ্ত রহস্য আমাদের সামনে আরো অধিক পরিমাণে উদ্ঘাটন হয়ে পড়ে। দিবালোকে একটা দ্রুত উড্ডয়নশীল পাখি যে ভাবে নির্ভয়ে আকাশে উড়ে বেড়ায় এ ক্ষুদ্র বাদুড় পাখিটাও সেভাবে অন্ধকার রাতে নির্ভয়ে আকাশে উড়ে বেড়াতে সক্ষম।

আমরা জানি এ পাখির কোন চোখ নেই। তবুও রাতের অন্ধকার তার জন্যে সমস্যাই নয়। যদি তার উড্ডয়নের পথে প্রতিবন্ধকতার ব্যাপারে কোন প্রকার তথ্য সংগ্রহের মাধ্যম না থাকে তাহলে কিভাবে সে এত অকুতোভয় ? কোথাও তো আঘাত লেগে গতিরোধ হচ্ছে না ?

দেখা গেছে যদি এ পাখিটাকে কোন আঁকাবাঁকা ও অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে ছেড়ে দেয়া হয় আর সুড়ঙ্গ পথের দেয়ালগুলোতে কালি মেখে রাখা হয় তারপরও এ বিষ্ময়কার প্রাণীটি খুব সুন্দরভাবে কোন রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অবস্থায় সুড়ঙ্গের অন্য পথ দিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম। বাদুড় পাখির মধ্যকার এ বিষ্ময়কর অবস্থার সাথে আধুনিক বিশ্বের আবিষ্কার রাডার1 নামক যন্ত্রের তুলনা করা যেতে পারে। বাঁদুড় পাখি সৃষ্টিকর্তার এক আশ্চর্য সৃষ্টি। এর অন্তর্নিহিত ব্যবস্থাপনার গভীরতা উপলব্ধির জন্যে রাডার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা থাকা প্রয়োজন। সাধারণত: পদার্থ বিদ্যায় শব্দের অধ্যায়ে মহাশব্দ বা অতিশব্দ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হয়ে থাকে। এ মহাশব্দের তরঙ্গমালা এত দ্রুতগতিসম্পন্ন ও দীর্ঘ যে মানুষের দ্বারা কোন ক্রমে তা কর্ণগোচন সম্ভব নয়। এটা পরীক্ষিত সত্য যে ,যখন কোন দেয়ালে ছুড়ে মারা হয় তখন তা ঠিক নিক্ষেপের গতিতেই পূর্বস্থানে ফিরে আসতে বাধ্য। যখন আমরা কোন পাহাড়ের নিকট গিয়ে চিৎকার করি তখন এর ধ্বনি একট নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পূর্বস্থানের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। তদ্রুপ কোন মহাশব্দের তরঙ্গ একটা নির্দিষ্ট স্থান থেকে নিক্ষেপ করা হলে তা নির্দিষ্ট গতিতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যখনই কোন কিছুতে বাধাগ্রস্থ হয় তখনই তা পূর্বের অবস্থানের দিকে ফিরে আসে। সচরাচর যুদ্ধের সময় শত্রু বিমানকে চিহ্নিত করার জন্যে এ ধরণের রাডার থেকে একটা বিশেষ শব্দ বিমানের উদ্দেশ্য প্রেরণ করা হয়ে থাকে। আর যখনই তা শত্রু বিমানে আঘাত প্রাপ্ত হয় তখনই একটা নির্দিষ্ট গতিতে প্রত্যাবর্তন করে রাডার যন্ত্রে। এরই মাধ্যমে শত্রু বিমানের গতিবেগ ,দুরত্ব ইত্যাদি নির্ণয় করা হয়ে থাকে।

বিজ্ঞানীরা বলেন ,বাদুড় পাখির দেহে রাডারের ন্যায় একটা যন্ত্র বিদ্যমান। তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন যদি বাদুড় পাখিকে একটা শুন্য কক্ষে ছেড়ে দেয়া হয় আর সেখানে মহাশব্দ ধারণ ও তা সাধারণ শব্দের তরঙ্গে পরিণত করার ক্ষমতাসম্পন্ন কোন মাইক্রোফোন রাখা হয় তাহলে পরিষ্কারভাবে রাডার থেকে নির্গত মহাশব্দ শ্রবণ সম্ভবপর হয়ে উঠবে। প্রতি সেকেন্ডে ত্রিশ থেকে ষাট বার মহাশব্দের তরঙ্গ বাদুড় পাখির নিকট থেকে শোনা যায় বলে তারা ধারনা করে থাকেন।

আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে বাদুড় তার বাকযন্ত্র থেকে শব্দ নির্গত করে তা নাসিকার মাধ্যমে বাইরে ছেড়ে দেয়। আর তা কোন স্থানে বাধাগ্রস্থ হয়ে ফিরে আসে কর্ণে। বাদুড়ের কর্ণ নির্গত তরঙ্গরাজীর ধারক। এ পাখি তার কর্ণের মাধ্যমেই উপলব্ধি করতে পারে কতটুকু দুরত্বে বাধাগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণেই এ ক্ষুদ্র প্রাণী রাতের অন্ধকারে শিকারের খোঁজে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে। কি অবাক সব ক্রিয়া-কান্ড! এতসব জটিল ব্যবস্থাপনা কি কোন একজন বুদ্ধিমান ও সর্বজ্ঞানী ব্যবস্থাপক ব্যতীত অন্য কারো দ্বারা সম্ভব ? আর কোন বুদ্ধিহীন ব্যবস্থাপক তো এ ব্যাপারে কোন ধারণাই রাখতে পারে না। সৃষ্টি জগতের এ বিশাল নৈপূণ্য ক্ষমতা ও জটিলতা দর্শনে এ অবধি অনেক বিজ্ঞানী এমন কোন একক মহাস্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন ,যিনি সকল প্রকৃতির উর্দ্ধে।

পুষ্প ও কীট পতঙ্গ

প্রাকৃতিক জগতে আরেকটি অত্যাশ্চর্য বিষয় হচ্ছে পুষ্প ও কীট পতঙ্গের মাঝে বন্ধুত্ব। বসন্তকালের শেষের দিক যখন ধীরে ধীরে বাতাস গরম হতে শুরু করে তখন ফলের বাগান গুলোতে বিভিন্ন প্রকার কীট পতঙ্গের আনাগোনা দেখা যায়। ছোট-বড় পতঙ্গ ,প্রজাপতি ,মৌমাছি ইত্যাদি কত রকমের প্রাণী। এধরণের প্রাণীর কাজ হলো এরা কোন এক গাছের ফুলের উপর বসে রস আহরণ করে অন্য গাছের পাপড়ির উপর গিয়ে বসে। ওরা পুঃলিঙ্গের গাছের পাপড়ি থেকে পরাগরেণু বহন করে নিয়ে যায় স্ত্রী লিঙ্গের পুষ্পের উপর। এভাবে বৃক্ষরাজীর মাঝে সঙ্গম ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পরিণতিতে বৃক্ষরাজী ফুলে -ফলে ভরপুর হয়ে উঠে।

এ সময়ে বিভিন্ন প্রকার কীট-পতঙ্গের আনাগোনা ,এক ডাল থেকে অন্য ডালে বিচরণ ,গাছে গাছে উড়ে বেড়ানো ইত্যাদি দেখে মনে হয় কোন এক বিশেষ শক্তি তাদেরকে ঠিক একটি উৎপাদনশীল শিল্প কারখানার শ্রমিকদের ন্যায় পরিচালনা করছে। ফলে সকলে নিজ কর্মে পরিপূর্ণ আত্মনিয়োগ করে আছে। কাজের কোন ফাঁকি নেই। পরিশ্রম করছে সবাই একযোগে। যথাযথভাবে সকলে স্ব -স্ব দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। কতই না বিষ্ময়কর এ বিষয়টি !

কখনো কি ভেবে দেখেছি ,যেখানে বৃক্ষ ,তরুলতার নড়াচড়া ও স্থান পরিবর্তন করার ক্ষমতা নেই সেখানে ওগুলো কি ভাবে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয় আর কি পদ্ধতিতে তাদের সঙ্গমক্রিয়া সম্পন্ন হয় ? কিভাবে বৃক্ষরাজীর মাঝে পুরুষ পরাগরেণু ও স্ত্রী ডিম্বানুর মিলন ঘঠে ? অনেক ক্ষেত্রে এ অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজটির দায়িত্ব কীট পতঙ্গের উপর ন্যস্ত। আবার কখনো বায়ু এ মিলন ক্রিয়াতে সাহায্য করে থাকে। যখন কোন ব্যক্তি কীট-পতঙ্গ ও বৃক্ষরাজীর মধ্যকার এ বিষ্ময়কর ঘটনাবলী অধ্যয়ন করে তখন স্বভাবতঃই তার মনে প্রশ্নের উদেয় হয় ,কে কীটপতঙ্গ ও বৃক্ষদের মাঝে এ অপুরম ও মজবুত বন্ধুত্ব স্থাপন করে দিয়েছে ?

আমাদের চারপার্শ্বে রয়েছে এ ধরণের বহু আশ্চর্য ঘটনা যা বিশ্বকে দান করে এক সাবলীল সৌন্দর্য ও বিশেষ নিয়ম-শৃঙ্খলা। বিশ্বজগত চমৎকার ও বিষ্ময়কর সৃষ্টিতে ভরপুর। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে কোন সৃষ্টিকে নিয়ে যদি আমরা সামান্য পরিমাণ অধ্যয়ন ,গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখতে পাব বহু অত্যাশ্চর্য ক্রিয়া-কান্ড ,সুনিপুণ কলা-কৌশল ও ব্যবস্থাপনা। এ প্রসঙ্গে কোরআন উল্লেখ করছে :

) يُنبِتُ لَكُم بِهِ الزَّرْعَ وَالزَّيْتُونَ وَالنَّخِيلَ وَالْأَعْنَابَ وَمِن كُلِّ الثَّمَرَاتِ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ(

অর্থাৎ : (আল্লাহ্) তোমাদের জন্যে ওটার (বৃষ্টির) মাধ্যমে কৃষিকার্য উৎপাদন এবং জলপাই ,খেজুর ও আঙ্গুর ইত্যাদি সব ধরণের ফলাদি বৃক্ষ সমুদগত করেন ,নিশ্চয়ই এগুলোর মধ্যে চিন্তাশীলদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। (আন্ নাহল ,আঃ নং-11 )

আল্লাহ্ অন্যত্র বলেন-

) إ ِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنفَعُ النَّاسَ وَمَا أَنزَلَ اللَّـهُ مِنَ السَّمَاءِ مِن مَّاءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِن كُلِّ دَابَّةٍ وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ(

অর্থাৎ : নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও যমীন এবং দিবা-রাত্রির পালা বদল এবং মানুষের উপকারার্থে চলন্ত জাহাজসমূহ এবং আল্লাহ্ কর্তৃক আসমান থেকে বারিবর্ষন যার ফলে মৃত যমীন পুনরায় প্রাণ ফিরে পায় এবং যমীনের বুকে চতুষ্পদ জন্তুর উত্থান আর বায়ুরাশির গতি পরিবর্তন এবং আসমান ও যমীনের মাঝখানে সংরক্ষিত ও করতলগত মেঘ খণ্ড চিন্তাশীলদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। (আল্ বাক্বারা ,আঃ নং-164। )

6

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি

শিশু জন্মলগ্ন থেকেই তার চার পাশে অনেককে দেখতে পায়। সর্বপ্রথম যার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে তিনি হলেন নবজাত শিশুর মা। ধীরে ধীরে যখন শিশু বড় হতে থাকে তখন সে মা ছাড়াও আরো অনেকের সাখে পরিচয় লাভ করে। আস্তে আস্তে বিভিন্ন ধরনের বস্তুর সাথেও পরিচিত হতে থাকে। এভাবে শুরু হয় একটি শিশুর জীবনযাত্রা।

মানুষ স্বভাবগত ভাবেই কৌতুহলী। তার চারপাশের বিভিন্ন বস্তু ও ব্যক্তি সন্বন্ধে জানার কৌতুহলী মনোভাব শৈশবেই প্রতিটি শিশুর মাঝে পরিলক্ষিত হয়। প্রথমে সে ক্ষুদ্র জিনিষ থেকেই শুরু করে ,পরে বয়স যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে ততই জীজ্ঞাসার মাত্রা ও পরিমাপও বেশী হতে থাকে।

একটি শিশু যখন পাঠশালায় গমন করে তখন সে তার চতুষ্পার্শ্বে অনেক ধরনের সৃষ্টির সাথে পরিচয় লাভ করে। আর প্রথম থেকেই তো এ আকাশ তার মাথার উপর ছেয়ে আছে। অক্সিজেন অনবরত গ্রহণ করছে। পানি পান করছে। এভাবে সে ধীরে ধীরে পাহাড়-পর্বত ও নদ-নদী এবং অনেক ধরনের গৃহপালিত পশু-পাখির সাথে পরিচয় লাভ করতে থাকে। ঐ শিশুর কৌতুহলী মনে একটি মাত্র জিজ্ঞাসা এত সব কিছু ,কে সৃষ্টি করলো ? সৃষ্টির পেছনে কি উদ্দেশ্য নিহিত আছে ? সূর্য প্রভাতে পূর্বাকাশে উদয় হয় আবার সন্ধ্যাবেলা পশ্চিমাকাশে অস্ত যায় প্রতিদিন ,এ নিয়ম-শৃঙ্খলা কে তৈরী করলো ? রাত্রে যখন সে আকাশের তারকারাজীর দিকে তাকায় তখন আবারও তার মনে প্রশ্নের উদেয় ঘটে ,এত সুন্দর মনোরম নক্ষত্রমণ্ডলীকে কনো অভিজ্ঞ চিত্রকর আকাশের বুকে সাজিয়ে রেখেছে ? এসব প্রশ্নের উত্তরই হল বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি। বিশ্ব অস্তিত্ত্ব ও ব্যবস্থাপনা এবং মানুষ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিই হল অন্তরের এতসব প্রশ্নের উত্তর।

অনেকে বিশ্বাস করেন এ বিশ্বের সৃষ্টির পেছনে কোন পরিকল্পনা প্রণেতার প্রয়োজন নেই। এর পেছনে কোন উদ্দেশ্যও নেই। স্বয়ংক্রিয়ভাবে উদ্ভব হয়েছে এ সৃষ্টিজগত। প্রকৃতিই স্বয়ং সকল বস্তুর সৃষ্টিকর্তা। আর একেই বলে বস্তুবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি। প্রাক ইসলামী যুগে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীদের বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হতো। তন্মোধ্যে প্রাকৃতিবাদী ,যিনদিক ,দাহরী ও নাস্তিক অন্যতম। কিন্তু বর্তমান আধুনিক ,শিল্পোন্নত ও ইলেকট্রোনিক্স যুগে তাদের মুখোশ পরিবর্তন হতে দেখা যায়। বর্তমান বিশ্বে বস্তুবাদীদের বিভিন্নমুখী মতাদর্শের মধ্যে অতি পরিচিত নামটি হচ্ছে যুক্তিবাদী বস্তুবাদ বা Dialectic Materialism । আর মার্ক্সবাদী দর্শন এরই উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে।

আবার অনেকে বিশ্বাস করেন এ বিশ্ব জগতের বালু কণা থেকে শুরু করে প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে একটি নির্দিষ্ট কার্যকারণ ও উদ্দেশ্য রয়েছে। কোন কিছুই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হয়নি। বরং প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে কোন স্বাধীন সত্তার শক্তিমত্তা কাজ করছে। এ ধরনের চিন্তা ভাবনার নাম বিশ্ব সম্পর্কে আস্তিকবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।

আমাদের মনে রাখতে হবে বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি আর বিশ্ব পরিচিতি এক কথা নয়। এরা দুটি পৃথক পরিভাষা। দৃষ্টান্তস্বরূপ ,পৃথিবীতে পানির পরিমান মাটির চেয়ে কতগুণ বেশী ? অথবা সৌর জগতে বিরাজমান গ্রহের সংখ্যা কত ? ইত্যাদি সৃষ্টি জগতের পরিচয় নিয়ে আলোচনা মাত্র। এগুলোতে বিশ্ব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নয়। আর যখন আমরা সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করি ,যেমন ধরুন যদি বলি যে ,সমগ্র বস্তুজগত কোন অবস্তুগত সৃষ্টিকর্তার উপর নির্ভরশীল -তাহলে এ বিষয়টি বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্ভুক্ত বলে পরিগণিত হবে।

7

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির ফলশ্রুতি

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও বিজ্ঞানের উন্নতি

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশা

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন , আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে ,তা তো আছেই। আমাদের বিভিন্ন প্রকার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এগুলোর তো কোন পরিবর্তন আসবে না। তাহলে এ বিষয়ে এত আলোচনার কি প্রয়োজন ? এর আলোচনা আমাদের জন্যে কি ফলাফল বয়ে আনতে পারে ?

উক্ত প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় ,হ্যাঁ ,আমাদের চারদিকে কোন সৃষ্টির উপর প্রভাব ফেলবে না সত্য ,কিন্তু তাই বলে আমাদের কাজ-কর্ম ,আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হবে না এটা বলা মনে হয় সঠিক হবে না।

অধিকন্তু বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাবিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিষয়টির স্পষ্টতার জন্যে নিন্মে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা গেল।

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও বিজ্ঞানের উন্নতি

চিন্তা করে দেখুন ,আপনার বন্ধু সফর থেকে ফিরে এসেছে। সে আপনাকে একটি বই উপহার দিয়ে বললো এ চমৎকার বইটির লেখক একজন বড় চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ,বুদ্ধিমান ও বিজ্ঞ এবং উচ্চজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অধিকারী। নিশ্চয়ই আপনি সে বইটা হালকাভাবে রিডিং পড়েই ক্ষান্ত হবেন না। বরং এর প্রতিটি শব্দ ,বাক্য ও তাদের গঠন বর্ণনা ও পরিবর্তন সবকিছুকে খুব সূক্ষ্মভাবে মনযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করবেন। যদি কোথাও না বুঝে থাকেন তা হলে ঘন্টার পর ঘন্টা ,দিনের পরদিন মোট কথা সুযোগ পেলেই এ বিষয় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করবেন ,বোঝার চেষ্টা করবেন। সাধ্যমত পরিশ্রম করতেও আপনি কুন্ঠাবোধ করবেন না। কেননা ,এ বইয়ের গ্রন্থকার কোন সাধারণ লোক নন। তিনি একজন শীর্ষস্থানীয় গবেষক ,চিন্তাবিদ। তার কোন কথাই অযথা নয়। কোন বাক্যই তার অপরিকল্পিত নয়।

অপরদিকে যদি আপনাকে বলা হয় এ বইটা যদিও বাহ্যিকভাবে চমৎকার বলে মনে হবে কিন্তু এর পুস্তকার একজন অজ্ঞ ,মুর্খ ,নির্বোধ ও বুদ্ধিহীন ব্যক্তি। আপনি নিখুত ভাবে এ বইটার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন নাকি শুধুমাত্র একটু চোখ বুলিয়ে রেখে দিবেন ? কেননা আপনি জানেন এ বইয়ের কোন মূল্য নেই। কোন জ্ঞান-গর্ভ আলোচনা এ বইতে নেই। মোট কথা এ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করা অযথা সময় নষ্ট করারই নামান্তর বলে বিবেচনা করবেন। এ বিশ্বজগতও একটি বৃহৎ গ্রন্থের ন্যায়। এ জগতের প্রতিটি সৃষ্টি এক একটি বাক্য ,যার সমম্বয়ে গঠিত হয়েছে এ বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ।

যদি আমরা আস্তিকবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অনুগামী হই তাহলে এ বিশ্বের প্রতিটি বস্তু ,প্রতিটি সৃষ্টিকেই আমরা মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করবো আর খুব মনোযোগ সহকারে তাঁর প্রতিটি বিষয়ের অধ্যায়নে গুরুত্বারোপ করবো এবং কৌতুহলী অন্তঃকরণ নিয়ে প্রতিটি সৃষ্টির অন্তর্নিহিত রহস্যাবলী উদ্ঘাটনের জন্যে উদ্গ্রীব হবো। কেননা আমরা বিশ্বাস করি প্রতিটি সৃষ্টি বস্তুর পেছনে নিশ্চয়ই কোন শক্তিশালী ও বিশাল বুদ্ধিমান শক্তিমত্তা বা সৃষ্টিকর্তা ক্রিয়শীল রয়েছেন। তিনি অতিশয় বুদ্ধিমান ,প্রজ্ঞাবান ,শিল্পী ও জ্ঞানী। তিনি মহাবিজ্ঞানী ও দার্শনিক। সুতরাং তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। আর এ দৃষ্টিভঙ্গির কারনেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও উন্নতি সম্ভব হয়েছে।

আর যদি আমরা বস্তুবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হই তা হলে এ বিশ্বের রহস্যময় সৃষ্টিকুলের ব্যাপারে সামান্যতম চিন্তা-ভাবণা করারও মনোভাব তৈরী হবে না। কেনান ,বস্তুবাদীরা এ বিশ্বজগতের সৃষ্টিকারক হিসেবে বুদ্ধি ও জ্ঞানহীন প্রকৃতিকেই মনে করেন। আর এতসব কিছুর স্রষ্টা যদি এক নির্বোধ ও জ্ঞানহীন প্রকৃতি হয়ে থাকে তা হলে তার সৃষ্টির-ই বা কি মূল্য হতে পারে ?

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশা

কথায় বলে , নদীর এপাড় ভাঙ্গে ওপাড় গড়ে -এই তো নদীর খেলা। আর এ খেলা মানুষের জীবনেও ঘটে থাকে অহরহ। সাধারণতঃ মানুষের এ ক্ষণকালীন জীবনও বহু চড়াই-উৎরাই এর মধ্য দিয়ে বিকশিত হয় । তাই কখনো একজন মানুষের জীবনের দ্বারে কিছু অনাকঙ্খিত বিপদও কড়া নাড়তে পারে। অনেক সময় এমনও হয় যে এ অপ্রত্যাশিত সমস্যা থেকে তার পালানের কোন পথ থাকে না। তখন চতুর্দিকে পথরুদ্ধ অবস্থায় পড়ে যায় সে। এমতাবস্থায় সে নিজেকে অতিশয় দুর্বল ও অসহায় অবস্থার মুখোমুখি দেখতে পায়। আর এরকম কঠিন বিপদের মুহুর্তে একমাত্র আস্তিকবাদী দৃষ্টি-ভঙ্গিই তাকে মুক্তির সন্ধান দিতে পারে। কেননা ,সে তখন তার চেয়ে বড় ও বিশাল কোন অস্তিত্বের আশ্রয়ের সন্ধান খুঁজে পায়। তিনি জানেন এ বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টিই একজন পরম পরাক্রমশালী ও বুদ্ধিমান সৃষ্টিকর্তার অধীন। আর আমাদের পরিত্রানদাতাও তিনি। ফলে একজন আস্তিক ব্যক্তি এ ধরনের কঠিন ও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মোকাবলা করার জন্যে যথেষ্ট দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে থাকেন।

অপর দিকে একজন বস্তুবাদী ব্যক্তি এ ধরনের পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। হতাশা ও ভয় তাকে অক্টোপাসের মত ঘিরে ফেলে একটি ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের ন্যায়। এমতাবস্থায় সে নিরাশ্রিত অবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। আর এ কারনেই বস্তুবাদীরা এহেন তহাশাগস্থ অবস্থায় আত্মহত্যার ঘৃন্য পথের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে আস্তিকবাদীরা সর্বাবস্থায় তাদের মহাপরাক্রমশালী পরিত্রানদাতার আশ্রয় কামনা করে থাকেন। আর এ কারনেই তারা কখনো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন না।

আর এক ন্যায়সংগত কারণে ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা মহাপাপ বলে পরিগণিত। কেননা আত্মহত্যা হতাশা ও পরাজয়ের মনোভাব থেকেই জন্ম লাভ করে থাকে।

8

আস্তিকবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ

কার্যকারণ

শৃঙ্খলীয় প্রমাণ

মানব প্রকৃতি ও সত্যান্বেষী স্বভাব

অস্তিত্ব বিভক্তির প্রমাণ


5

6

7

8

9

10

11

12