ধর্মের পুনর্জাগরণে ইমামগণের ভূমিকা

ধর্মের পুনর্জাগরণে ইমামগণের ভূমিকা25%

ধর্মের পুনর্জাগরণে ইমামগণের ভূমিকা লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

ধর্মের পুনর্জাগরণে ইমামগণের ভূমিকা
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 16 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 27466 / ডাউনলোড: 3656
সাইজ সাইজ সাইজ
ধর্মের পুনর্জাগরণে ইমামগণের ভূমিকা

ধর্মের পুনর্জাগরণে ইমামগণের ভূমিকা

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

সিরিয়ায় আলে মুহাম্মদের (সা.) বন্দিগণ

আল্লাহর রাসূলের (সা.) বংশধরগণকে দামেশক শহরে নিয়ে যাওয়া হল এবং তাঁদেরকে অমুসলিম বন্দিদের রাখার স্থানে , মসজিদের প্রবেশ দ্বারের সম্মুখে রাখা হল। এই অবস্থায় একজন বৃদ্ধলোক সামনে আসে এবং তাঁদের সন্নিকটে এসে বলে: সেই সত্য আল্লাহর প্রশংসা যিনি তোমাদেরকে হত্যা করেছেন , তোমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করেছেন এবং জনগণকে তোমাদের কর্তৃত্ব ও যন্ত্রণা হতে নিরাপত্তা দান করেছেন আর আমীরুল মু মিনীনকে তোমাদের উপর আধিপত্য দান করেছেন !

ইমাম আলী ইবনিল হুসাইন (আ.) তাকে বলেন : হে বৃদ্ধ ! আপনি কি কুরআন পড়েছেন ? ॥ সে বলে : হ্যাঁ , পড়েছি । তিনি বলেন : এই আয়াতটি নিশ্চয় জানেন যে , মহান আল্লাহ্ বলেছেন : বল , আমি এই রিসালতের জন্যে , আমার অতি নিকট আত্মীয়দের প্রতি ভালবাসা ও বন্ধুত্ব ব্যতীত তোমাদের নিকট অন্য কোনো বিনিময় কামনা করি না । ১২১

বৃদ্ধ লোকটি বলে : হ্যাঁ , এই আয়াতটি তো পড়েছি। ’ ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বলেন : এই আয়াতে নিকট আত্মীয়ের অর্থ আমরাই ! অতঃপর তিনি বলেন : সূরা বনী ইস্রাঈলের এই আয়াতটি কি পড়েছেন যেখানে আল্লাহ্ বলছেন : নিকট আত্মীয়দের হক প্রদান কর । ১২২

বৃদ্ধলোকটি বলে : হ্যাঁ , এই আয়াতটি তো পড়েছি ।

ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বলেন : আমরাই হচ্ছি নিকট আত্মীয় , হে বৃদ্ধ ! এই আয়াতটিও কি পড়েছেন যেখানে আল্লাহ্ বলছেন : সাবধান থেক এবং জেনে রেখ , যা কিছু তোমাদের হস্তগত হয় তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ , আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর নিকট আত্মীয়দের জন্যে । ১২৩ )

বৃদ্ধলোকটি বলে : হ্যাঁ , এই আয়াতটি তো পড়েছি ।

ইমাম সাজ্জাদ বলেন : হে বৃদ্ধ , নিকট আত্মীয় হচ্ছি আমরাই। এই আয়াতটিও নিশ্চয় পড়েছেন যেখানে আল্লাহ্ বলছেন : হে আহলে বাইত! নিশ্চয় মহান আল্লাহ্ তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে চান । ১২৪ বৃদ্ধলোকটি বলে : হ্যাঁ , এটিও তো পড়েছি। ’ ইমাম (আ.) বলেন : আমরাই সেই আহলে বাইত। পবিত্র আল্লাহ আমাদেরকে আয়াতে তাত্বহীরের মাধ্যমে বিশেষত্ব দান করেছেন। ’

বর্ণনাকারী বলেন : বৃদ্ধলোকটি কিছু সময় নীরব , বিস্মিত ও অনুতপ্ত হয়ে নিজ স্থানে দাঁড়িয়ে থাকেন। অতঃপর , আসমানের দিকে মাথা উঁচু করে বলেন : হে আল্লাহ্ ! আমি যে কথাগুলি বলেছি এবং এই ব্যক্তিবর্গের সাথে শত্রুতামূলক যে আচরণ করেছি তার জন্যে তওবা করছি ও তোমার নিকট প্রত্যাবর্তন করছি। হে আল্লাহ! মুহাম্মদ ও আলে মুহাম্মদের (সা.) প্রতি শত্রুতা পোষণকারীরা , জ্বিন ইনসান যে কেউই হোক , আমি তাদের থেকে বিমুখতা প্রকাশ করছি এবং তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি । ১২৫

ইয়াযীদের দরবারে আহলে বাইতের (আ.) প্রবেশ

ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়া খিলাফত মসনদে বসার পর সিরিয়ার সম্মানিত লোকদেরকে ডাকে এবং তাদেরকে তার পাশে স্থান দেয়। অতঃপর , আলী ইবনে হুসাইন (আ.) , ইমাম হুসাইনের (আ.) বংশের নারীগণ ও শিশুদেরকে তার নিকটে আনতে আদেশ দেয় , এই অবস্থায় আল্লাহর রাসূলের (সা.) কচি শিশুদেরকে রশি দিয়ে একে অপরের সাথে বেঁধে রেখেছিল এবং লোকেরা সে দৃশ্য দেখছিল । ১২৬

ইমাম হুসাইনের পবিত্র মস্তকটি যখন আহলে বাইতের (আ.) সদস্যগণ এবং তাঁর অন্যান্য সহযোগীদের মাথার সাথে ইয়াযীদের সামনে রাখা হয় তখন ইমাম আলী ইবনে হুসাইন (আ.) ইয়াযীদকে বলেন: তুমি কি আমাকে কথা বলার অনুমতি দিবে ? ইয়াযীদ বলে: বল , তবে বাজে কথা বলবে না ! ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বলেন : আমি এমন এক স্থানে দণ্ডায়মান হয়েছি যে , প্রলাপ বকা এবং অর্থহীন কথাবার্তা বলা আমার মত লোকের জন্যে শোভা পায় না। হে ইয়াযীদ ! আল্লাহর রাসূলের (সা.) সম্পর্কে কি উপলব্ধি করছ , যদি তিনি আমাদেরকে জিঞ্জির ও শিকলে বাঁধা এ অবস্থায় দেখেন ? ইয়াযীদ তার চতুষ্পার্শ্বস্থ লোকদেরকে বলে : তার হতে শিকলগুলি খুলে নাও ! ১২৭

ইয়াযীদের প্রতি ইহুদী এক পণ্ডিতের অভিযোগ

উক্ত সভায় একজন ইহুদী পণ্ডিত উপস্থিত ছিলেন , তিনি জিজ্ঞেস করেন : হে আমীরুল মু মিনীন! এই যুবকটি কে ? ইয়াযীদ বলে : এই মাথার অধিকারী ব্যক্তিটি হল তার পিতা ! ইহুদী বলেন : হে আমীরুল মু মিনীন ! এটি কার মাথা ? ইয়াযীদ বলে : আবু তালিবের পুত্র আলী , তার পুত্র হুসাইন , এটি তারই মাথা। ’ ইহুদী বলেন : তাঁর মাতা কে ? ইয়াযীদ বলে : রাসূলের কন্যা ফাতিমা। ’ ইহুদী পণ্ডিত বিস্ময়ের সাথে বলেন: সুবহানাল্লাহ! ইনি তোমাদের রাসূলের কন্যার সন্তান ! তাঁর ইন্তেকালের পর স্বল্প সময়ের মধ্যেই (এত দ্রুত) তোমরা তাঁকে হত্যা করলে ?! তাঁর সন্তানদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে স্বীয় রাসূলের জন্যে তোমরা কত মন্দ স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তি! আল্লাহর কসম ! মূসা ইবনে ইমরান যদি তাঁর বংশের কোনো ব্যক্তিকে আমাদের মাঝে রেখে যেতেন তবে আমরা আল্লাহ্ ব্যতীত তাঁরই উপাসনা করতাম ! তোমরা এমন লোক যে , এই গতকাল তোমাদের রাসূল তোমাদের মাঝ হতে বিদায় নিয়েছেন , আর তোমরা তাঁর সন্তানের উপর চেপে বসলে এবং তাঁকে হত্যা করলে ! ধিক তোমাদের উপর ! তোমরা কতই না নিকৃষ্ট! ১২৮

ইয়াযীদ আদেশ দিল: তার কণ্ঠ রুদ্ধ কর ! ইহুদী পণ্ডিত বললেন : আমার ব্যাপারে যা মনে কর তাই কর ; আমাকে মার কিংবা হত্যা কর অথবা জীবিত রাখ। আমি তওরাতে এইরূপ দেখেছি যে , যদি কোনো ব্যক্তি কোনো রাসূলের সন্তানকে হত্যা করে তবে সে যতদিন জীবিত থাকবে ততদিন পরাজিত হবে এবং তার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহ্ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন !

সিরিয়ার জনৈক পুরুষ এবং রাসূলুল্লাহর (সা.) বংশের এক নারীকে দাসী হিসেবে পাওয়ার আকাঙ্খা প্রকাশ

সে সভায় সিরিয়ার অধিবাসীদের মাঝ হতে জনৈক পুরুষ উঠে দাঁড়ায় এবং বলে : হে আমীরুল মু মিনীন ! এই মেয়েটিকে (হুসাইনের (আ.) কন্যা ফাতিমাকে উদ্দেশ্য করে) আমাকে প্রদান করুন , তাকে আমার দাসী হিসেবে গ্রহণ করব। ’ ফাতিমা বলেন : আমি কেঁপে উঠি , কাঁদতে শুরু করি এবং ধারণা করি যে , এই কাজটি তাদের জন্যে আইনসিদ্ধ। আমার ফুফু যয়নবের বুকে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করি , তিনি আমার চেয়ে বয়সে বড় এবং বুদ্ধিমতী ছিলেন , আর তিনি জানতেন যে , এই কাজটি হওয়ার যোগ্য নয় । যয়নব (আ.) সেই পুরুষটির উত্তরে বলেন : আল্লাহর কসম ! তুমি মিথ্যা বলেছো এবং নীচুতার পরিচয় দিয়েছো , এইরূপ বিষয় না তোমার জন্যে ন্যায়সঙ্গত হবে , আর না তার জন্যে ।

ইয়াযীদ ক্রোধান্বিত হয়ে বলে: আল্লাহর কসম! তুমি মিথ্যা বলছ , এই কাজটি আমার জন্যে আইনসিদ্ধ , আমি যদি সেটি বাস্তবায়ন করতে চাই তবে বাস্তবায়ন করব ! যয়নব (আ.) বলেন : আল্লাহর কসম ! এইরূপ নয় ! মহান আল্লাহ্ এইটিকে তোমার জন্যে আইনসিদ্ধ করেন নি , তবে যদি আমাদের ধর্ম হতে বেরিয়ে যেতে চাও এবং নিজের জন্যে অন্য ধর্মকে বেছে নাও ! ইয়াযীদের ক্রোধ বৃদ্ধি পেয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ছাড়িয়ে গিয়েছিল , সে বলল: আমার মত লোকের সাথে এইরূপ বিতর্ক করছ ? যারা ধর্ম হতে বেরিয়ে গেছে তারা হল তোমার বাবা ও ভাই ! যয়নব (আ.) বলেন : তুমি , তোমার পিতা এবং তোমার দাদা আল্লাহর দিকে আমার পিতা , ভ্রাতা ও নানার দ্বীনের মাধ্যমে সুপথ প্রাপ্ত হয়েছো । ইয়াযীদ বলে: হে আল্লাহর শত্রু! তুমি মিথ্যা বলছ ! যয়নব(আ.) বলেন: তুমি এখন অধিনায়ক , আধিপত্যশীল এবং পরাভূতকারী তাই অন্যায়ভাবে গালি দিচ্ছ এবং নিজ কর্তৃত্বের শক্তি দেখাচ্ছ ।

ইমাম হুসাইনের (আ.) কন্যা ফাতিমা বলেন : আল্লাহর শপথ ! মনে হল ইয়াযীদ লজ্জিত হল এবং নীরব হয়ে গেল । সিরিয়ার লোকটি পুনরায় নিজ প্রার্থনা পুনরাবৃত্তি করে বলে : হে আমীরুল মু মিনীন ! এই মেয়েটিকে আমাকে প্রদান করুন ! ইয়াযীদ যেহেতু সুদৃঢ় ও দাঁতভাঙ্গা প্রতি উত্তর পেয়েছিল তাই সে ক্রোধান্বিত হয়ে অতি কর্কশভাবে তাকে বলল : ধ্বংস হও ! আল্লাহ্ তোমাকে অকস্মাৎ এবং দ্রুত মৃত্যু দান করুন ! ১২৯

মুসলমানদের খলীফার সামনে রাসূল(সা.) এর সন্তানের মাথা

ইমাম হুসাইনের (আ.) মাথাটি স্বর্ণের একটি বড় পাত্রে করে মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াযীদের সামনে রাখা হল। সে একখানা বেতের লাঠি চাইল এবং সেটি দ্বারা সে ইমাম হুসাইনের (আ.) দাঁতগুলির উপর আঘাত করতে লাগল এবং বলল : আবু আব্দিল্লাহর কি চমৎকার দাঁত ছিল !

এই সময়ে আবু বারযা আসলামী১৩০ নামক রাসূলের জনৈক সাহাবী ইয়াযীদকে বলেন : তোমার লাঠি দ্বারা কি ইমাম হুসাইনের (আ.) ঠোঁট ও দাঁতে মারছো ?! সাবধান থেক ! তোমার লাঠি দ্বারা হুসাইনের ঠোঁট দু টির যে স্থানে আঘাত করছ , আল্লাহর রাসূলকে (সা.) আমি অসংখ্যবার সে স্থানে চুমু দিতে এবং চোষণ করতে দেখেছি। ইয়াযীদ ! তুমি কিয়ামত দিবসে এমন অবস্থায় উত্থিত হবে যে , তোমার শাফাআতকারী হবে ইবনে যিয়াদ ! আর এই হুসাইন (আ.) কিয়ামত দিবসে আসবেন এবং তাঁর শাফাআতকারী হবেন মুহাম্মদ (সা.) ! অতঃপর তিনি তাঁর স্থান হতে উঠে দাঁড়ান এবং বেরিয়ে যান।১৩১

ইয়াযীদ নিজ কুফরীকে প্রকাশ করছে

ইয়াযীদ , বিজয় ও অহংকারের নেশায় অন্ধ হয়ে ইবনে যেবা ’ রীর কবিতার পংক্তিগুলির মাধ্যমে উদাহরণ দেয় এবং এইরূপ আবৃত্তি করে :

১। হায় ! বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আমার বংশের মহান ব্যক্তিরা যদি উপস্থিত থাকত এবং দেখত যে , আমি কি করেছি ,

২। তাহলে মারহাবা বলত , উৎফুল্ল হত এবং বলত : ইয়াযীদ তোমাকে ধন্যবাদ। ’

৩। আমরা এই কওমের মহান ও সর্দার ব্যক্তিগণকে হত্যা করেছি , বদরের দিনের উচিৎ জবাব দিয়েছি (প্রতিশোধ নিয়েছি) এবং সমান সমান হয়েছি। ’

অতঃপর সে এই পংক্তিটি নিজ থেকে যুক্ত করে এবং আবৃত্তি করে : যদি আমি মুহাম্মদের সন্তান সন্ততি এবং তাদের কৃত কাজের প্রতিশোধ গ্রহণ না করি তবে আমি উৎবা ’ র বংশ নই !

‘ তাযকিরায়ে খাওয়াসসিল উম্মা ’ গ্রন্থে এসেছে : সকল বর্ণনাতেই এ বিষয়টি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যে , ইয়াযীদ যখন হুসাইনের (আ.) মাথাটিকে তার সম্মুখে দেখে তখন সিরিয়ার অধিবাসীদেরকে একত্রিত করে এবং তাদের উপস্থিতিতে তার হাতের লাঠি দ্বারা মাথাটিকে আঘাত করে ও ইবনে যেবা ’ রীর কবিতার পংক্তিগুলি আবৃত্তি করে , আর নিম্নোক্ত পংক্তি দু টি সেইগুলির সাথে যোগ করে :

‘ বনী হাশিম গোত্র রাজত্ব ও ক্ষমতা নিয়ে খেলা করেছে , না আসমান হতে কোনো সংবাদ এসেছে আর না কোনো ওহী অবতীর্ণ হয়েছে !

যদি আহমদের সন্তান সন্ততি এবং তাদের যাবতীয় কৃতকর্মের প্রতিশোধ গ্রহণ না করি তবে আমি খিন্দিফ গোত্রের লোক নই ! ১৩২

কারবালায় ইমাম হোসেইন (আ.)-এর প্রবেশ

হুর বিন ইয়াযীদ ইমাম হোসেইন (আ.)-কে কুফায় যাওয়ার পথে বাধা দিলে তিনি থেমে যান। এরপর তার সন্তানদের , ভাইদের ও আত্মীয়দেরকে নিজের চারদিকে জড়ো করলেন এবং কিছু সময়ের জন্য কাঁদলেন ও বললেন , হে আল্লাহ , আমরা আপনার রাসূলের বংশধর। লোকজন আমাদেরকে আমাদের বাড়িঘর থেকে টেনে বের করেছে এবং আমাদেরকে তাড়া করেছে এবং আমাদেরকে আমাদের নানার জায়গা [মদীনা] থেকে চাপ প্রয়োগ করে বের করে দিয়েছে। বনি উমাইয়া আমাদের উপর অত্যাচার করেছে। হে আল্লাহ , আমাদের অধিকারকে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিন এবং এ অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।

এরপর তিনি সেখান থেকে অগ্রসর হলেন এবং 61 হিজরির 2রা মহররমের দিন বুধবার অথবা মঙ্গলবার কারবালায় প্রবেশ করলেন। এরপর তিনি তার সাথীদের দিকে ফিরে বললেন ,

লোকজন পৃথিবীর দাস এবং ধর্ম শুধু তাদের মুখের কথা এবং তারা এর যত্ন নিবে যতক্ষণ পর্যন্ততা তাদের জন্য আনন্দদায়ক এবং যখন পরীক্ষার উত্তপ্ত পাত্র এসে যায় তখন থাকে শুধু গুটি-কয়েক ধার্মিক ব্যক্তি।

এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন , এটি কি কারবালা ?

লোকজন উত্তর দিলো , হ্যাঁ। তিনি বললেন , এ জায়গা হলো দুঃখ ও মুসিবতের জায়গা এবং এ জায়গা আমাদের উটগুলোর বিশ্রামের স্থান , আমাদের থামার জায়গা , আমাদের শাহাদাতের জায়গা যেখানে আমাদের রক্ত ঝরানো হবে।

ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কাছে উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের চিঠি

ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া কর্তৃক নিয়োজিত কুফার গভর্নর ইমাম হোসেইন (আ.)-কে একটি চিঠি প্রদান করে যা নিম্নরূপ: আম্মা বা আদ , হে হোসেইন , আমাকে জানানো হয়েছে যে , তুমি কারবালায় থেমেছো। ইয়াযীদ আমাকে লিখেছে , আমি যেন বিছানায় মাথা না রাখি এবং সন্তুষ্ট না হই যতক্ষণ পর্যন্তনা আমি তোমাকে আল্লাহর কাছে পাঠাচ্ছি , অথবা তুমি আমার কাছে এবং ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ কর। সালাম।

যখন এ চিঠি ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কাছে পৌঁছলো , তিনি তা পড়লেন এবং তা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন , যে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি খোঁজে সে কখনোই সফলতা লাভ করে না। দূত তাকে চিঠির উত্তর দিতে বললে ইমাম বললেন , তার জন্য কোন উত্তর নেই , আছে গযব [আল্লাহর]।

আশুরার (দশ মহররম) রাতের ঘটনাবলী

[ ইরশাদ গ্রন্থে আছে ] ইমাম হোসেইন ( আ .) তার সাথীদের রাতের বেলা জড়ো করলেন , ইমাম আলী যায়নুল আবেদীন ( আ .) বলেন যে , আমি তাদের কছে গেলাম শোনার জন্য তারা কী বলেন এবং সে সময় আমি অসুস্থ ছিলাম। আমি শুনলাম ইমাম তার সাথীদের বলছেন ,

আমি আল্লাহর প্রশংসা করি সর্বোত্তম প্রশংসার মাধ্যমে এবং তাঁর প্রশংসা করি সমৃদ্ধির সময়ে এবং দুঃখ দুর্দশার মাঝেও। হে আল্লাহ , আমি আপনার প্রশংসা করি এ জন্য যে , আপনি আমাদের পরিবারে নবুয়াত দান করতে পছন্দ করেছেন। আপনি আমাদের কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন এবং ধর্মে আমাদেরকে বিজ্ঞজন করেছেন এবং আমাদেরকে দান করেছেন শ্রবণ শক্তি ও দূরদৃষ্টি এবং আলোকিত অন্তর। তাই আমাদেরকে আপনার কৃতজ্ঞ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন।

আম্মা বা আদ , আমি তোমাদের চেয়ে বিশস্ত এবং ধার্মিক কোন সাথীকে পাই নি , না আমি আমার পরিবারের চাইতে বেশী বিবেচক , স্নেহশীল , সহযোগিতাকারী ও সদয় কোন পরিবারকে দেখেছি। তাই আল্লাহ আমার পক্ষ থেকে তোমাদেরকে উত্তমভাবে পুরস্কৃত করুন এবং আমি মনে করি শত্রুরা একদিনও অপেক্ষা করবে না এবং আমি তোমাদের সবাইকে অনুমতি দিচ্ছি স্বাধীনভাবে চলে যাওয়ার জন্য এবং আমি তা তোমাদের জন্য বৈধ করছি। আমি তোমাদের উপর থেকে আনুগত্য ও শপথের দায়ভার তুলে নিচ্ছি ( যা তোমরা আমার হাতে হাত দিয়ে শপথ করেছিলে ) । রাতের অন্ধকার তোমাদের ঢেকে দিয়েছে , তাই নিজেদের মুক্ত করো ঘূর্ণিপাক থেকে অন্ধকারের ঢেউয়ের ভেতরে। আর তোমাদের প্রত্যেকে আমার পরিবারের একজনের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ো গ্রাম ও শহরগুলোতে , যতক্ষণ না আল্লাহ তোমাদের মুক্তি দান করেন। কারণ এ লোকগুলো শুধু আমাকে চায় এবং আমার গায়ে হাত দেয়ার পরে তারা আর কারো পেছনে ধাওয়া করবে না।

এ কথা শুনে তার ভাইয়েরা , সন্তানরা , ও ভাতিজারা এবং আব্দুল্লাহ বিন জাফরের সন্তানরা বললেন , আামরা তা কখনোই করবো না আপনার পরে বেঁচে থাকার জন্য। আল্লাহ যেন কখনো তা না করেন। হযরত আব্বাস বিন আলী ( আ .) সর্বপ্রথম এ ঘোষণা দিলেন এবং অন্যরা তাকে অনুসর ণ করলেন।

ইমাম তখন আক্বীল বিন আবি তালিবের সন্তানদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন , মুসলিমের আত্মত্যাগ তোমাদের জন্য যথেষ্ট হয়েছে , তাই আমি তোমাদের অনমতি দিচ্ছি চলে যাওয়ার জন্য। তারা বললেন , সুবহানাল্লাহ , লোকেরা কী বলবে ? তারা বলবে আমরা আমাদের প্রধানকে , অভিভাবককে এবং চাচাতো ভাইকে , যে শ্রেষ্ঠ চাচাতো ভাই , পরিত্যাগ করেছি এবং আমরা তার সাথে থেকে তীর ছুড়িনি , বর্শা দিয়ে আঘাত করি নি এবং তার সাথে থেকে তরবারি চালাই নি এবং তখন আমরা ( এ অভিযোগের মুখে ) বুঝতে পারবো না কী করবো ; আল্লাহর শপথ , আমরা তা কখনোই করবো না। প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের জীবন , সম্পদ ও পরিবার আপনার জন্য কোরবানী করবো। আমরা আপনার পাশে থেকে যুদ্ধ করবো এবং আপনার পাশে থেকে পরিণতিতে পৌঁছে যাবো। আপনার পরে জীবন কুৎসিত হয়ে যাক ( যদি বেঁচে থাকি ) ।

হোসেইন বিন হামদান হাযীনি তার বর্ণনা ধারা বজায় রেখে আবু হামযা সূমালি থেকে বর্ণনা করেন এবং সাইয়েদ বাহরানি বর্ণনার ক্রমধারা উল্লেখ না করেই তার কাছ থেকে নবণার্ করেছেন যে , তিনি বলেছেন: আমি ইমাম আলী আল-যায়নুল আবেদীনকে বলতে শুনেছি , শাহাদাতের আগের রাতে আমার বাবা তার পরিবার এবং সাথীদের জড়ো করলেন এবং বললেন , হে আমার পরিবারের সদস্যরা এবং আমার শিয়ারা [অনুসারীরা] , এ রাতকে ভেবে দেখো যা তোমাদের কাছে বহনকারী উট হয়ে এসেছে এবং নিজেদেরকে রক্ষা করো , কারণ লোকেরা আমাকে ছাড়া কাউকে চায় না। আমাকে হত্যা করার পর তারা তোমাদেরকে তাড়া করবে না। আল্লাহ তোমাদের উপর রহমত করুন। নিজেদেরকে রক্ষা করো। নিশ্চয়ই আমি আনুগত্য ও শপথের দায়ভার তুলে নিলাম যা তোমরা আমার হাতে করেছো। এ কথা শুনে তার ভাইয়েরা , আত্মীয়-স্বজন ও সাথীরা একত্রে বলে উঠলো , আল্লাহর শপথ হে আমাদের অভিভাবক , হে আবা আবদিল্লাহ , আমরা আপনার সাথে কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করবো না , তাতে লোকেরা বলতে পারে যে আমরা আমাদের ইমামকে , প্রধানকে এবং অভিভাবককে পরিত্যাগ করেছি এবং তাকে শহীদ করা হয়েছে। তখন আমরা আমাদের ও আল্লাহর মাঝে ওজর খুঁজবো। আমরা আপনাকে কখনোই পরিত্যাগ করবো না যতক্ষণ পর্যন্তনা আমরা আপনার জন্য কোরবান হই। ইমাম বললেন , নিশ্চয়ই আগামীকাল আমাকে হত্যা করা হবে এবং তোমাদের সবাইকে আমার সাথে হত্যা করা হবে এবং তোমাদের কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না। তারা বললেন , সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যে তিনি আমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন আপনাকে সাহায্য করার জন্য এবং আমাদেরকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন আপনার সাথে শহীদ হওয়ার জন্য। তাহলে কি আমরা পছন্দ করবো না যে আমরা আপনার সাথে উচ্চ মাক্বামে [বেহেশতে] থাকবো , হে রাসূলুল্লাহর সন্তান ? ইমাম বললেন , আল্লাহ তোমাদের উদারভাবে পুরস্কৃত করুন। এরপর তিনি তাদের জন্য দোআ করলেন।

তখন ক্বাসিম বিন হাসান (আ.) জিজ্ঞেস করলেন , আমি কি শহীদদের তালিকায় আছি ? তা শুনে ইমাম আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন এবং বললেন , হে আমার প্রিয় সন্তান , তুমি মৃত্যুকে কিভাবে দেখো ?

ক্বাসিম বললেন , মধুর চেয়ে মিষ্টি।

ইমাম বললেন , নিশ্চয়ই , আল্লাহর শপথ , তোমার চাচা তোমার জন্য কোরবান হোক , তুমি তাদের একজন যাদেরকে শহীদ করা হবে আমার সাথে কঠিন অবস্থার শিকার হওয়ার পর এবং আমার [শিশু] সন্তান আব্দুল্লাহকেও [আলী আসগার] শহীদ করা হবে।

আশুরার দিনে ইমাম হোসেইন ( আ .)- এর খোতবা

আশুরার দিনে ইমাম হোসেইন (আ.) একটি খোতবায় বলেন: আম্মা বা আদ , বিবেচনা করো আমার পরিবার সম্পর্কে এবং গভীরভাবে ভাবো আমি কে , এরপর নিজেরদের তিরস্কার করো। তোমরা কি মনে করো যে আমাকে হত্যা করা এবং আমার পবিত্রতা ও সম্মান লুট করা তোমাদের জন্য বৈধ ? আমি কি তোমাদের নবীর নাতি , তার ওয়াসী ও তার চাচাতো ভাইয়ের সন্তান নই , যিনি ছিলেন বিশ্বাস গ্রহণে সবার আগে এবং সাক্ষী ছিলেন সে সবকিছুর ওপরে যা মহানবী আল্লাহর কাছ থেকে এনেছেন ? শহীদদের সর্দার হামযা কি আমার পিতার চাচা ছিলেন না ? জাফর , যিনি বেহেশতে দুপাখা নিয়ে উড়েন , তিনি কি আমার চাচা নন ? নবীর হাদীস কি তোমাদের কাছে পৌঁছে নি যেখানে তিনি আমার সম্পর্কে ও আমার ভাই সম্পর্কে বলেছেন : আমরা দুজন জান্নাতের যুবকদের সর্দার ? তাই যদি আমি যা বলছি তার সাথে একমত হও , এবং নিশ্চয়ই আমি যা বলেছি তা সত্য ছাড়া কিছু নয় , তাহলে তা উত্তম , কারণ আল্লাহর শপথ , যে সময় থেকে আমি বুঝেছি আল্লাহ মিথ্যাবাদীদের অপছন্দ করেন তখন থেকে আমি কখনোই কোন মিথ্যা বলি নি। আর যদি তোমরা আমি যা বলছি তা বিশ্বাস না কর , তাহলে তোমাদের মাঝে নবীর জীবিত সাহাবীগণ আছে , তাদের কাছে যাও এবং তাদেরকে জিজ্ঞেস কর এবং তারা আমার বক্তব্যের সত্যতার সাক্ষ্য দিবে। জাবির বিন আব্দুল্লাহ আনসারি , আবু সাঈদ খুদরি , সাহল বিন সাদ সা য়েদি , যায়েদ বিন আরক্বাম এবং আনাস বিন মালিককে জিজ্ঞেস কর , তারা তোমাদের বলবে যে তারা আল্লাহর রাসূলের কাছ থেকে আমার ও আমার ভাই সম্পর্কে এ হাদীসটি শুনেছে। এটি কি তোমাদের জন্য আমার রক্ত ঝরানোর চাইতে যথেষ্ট নয় ?

তখন অভিশপ্ত শিমর বিন যিলজাওশান বললো , আমি আল্লাহর ইবাদত করি ঠোঁট দিয়ে এবং তুমি যা বলছো তা আমি বুঝি না। এ কথা শুনে হাবীব বিন মুযাহির [ইমামের সাথী] বললেন , আমি দেখছি তুমি আল্লাহর ইবাদত করো সত্তুর ধরনের সন্দেহ নিয়ে এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তুমি সত্য কথা বলেছো এবং তুমি বুঝতে পারো না ইমাম যা বলেন , কারণ আল্লাহ তোমার হৃদয়ের ওপরে একটি [মূর্খতার] মোহর মেরে দিয়েছেন।

ইমাম বললেন , যদি তোমরা এতে সন্দেহ পোষণ কর , তোমরা কি এতেও সন্দেহ কর যে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নাতি ? আল্লাহর শপথ , পূর্বে ও পশ্চিমে , আমি ছাড়া নবীর কোন নাতি নেই তোমাদের মধ্যে অথবা অন্যদের মধ্যে। দুর্ভোগ তোমাদের জন্য , আমি কি তোমাদের মধ্য থেকে কাউকে হত্যা করেছি যে তোমরা তার প্রতিশোধ নিতে চাও ? অথবা আমি কি কারো সম্পদ বেদখল করেছি , অথবা কাউকে আহত করেছি যার প্রতিশোধ তোমরা আমার ওপর নিতে চাও ?

যখন কেউ তাকে উত্তর দিলো না , তিনি উচ্চ কণ্ঠে বললেন , হে শাবাস বিন রাব ঈ , হে হাজ্জার বিন আবজার , হে ক্বায়েস বিন আল-আশআস , হে ইয়াযীদ বিন হুরেইস , তোমরা কি আমার কাছে চিঠি লিখোনি যে , ফল পেকেছে এবং আশপাশের ভূমিতে ফুল ফুটেছে এবং একটি বিশাল সেনাবাহিনীর কাছে আসুন , যা আপনার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে ?

তারা উত্তর দিলো যে তারা এ ধরনের কোন চিঠি লিখেনি। ইমাম বললেন , সুবহানাল্লাহ , আল্লাহর শপথ অবশ্যই তোমরা তা লিখেছিলে।

এরপর তিনি বললেন , হে জনতা , এখন যদি তোমরা আমার আগমনকে পছন্দ না কর , তাহলে আমাকে ছেড়ে দাও যেন আমি কোন আশ্রয়ের জায়গায় চলে যেতে পারি।

ক্বায়েস বিন আল-আশআস বললো , তুমি যা বলছো তা আমরা জানি না , আমার চাচাতো ভাইদের [বনি উমাইয়ার] কাছে আত্মসমর্পণ কর , তারা তোমার সাথে সেভাবে আচরণ করবে যেভাবে তুমি চাও। ইমাম বললেন , আল্লাহর শপথ , নিকৃষ্ট মানুষের মতো আমি তোমাদের হাতে হাত দিবোনা , না আমি পালিয়ে যাবো কোন দাসের মতো।

এরপর তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন , হে আল্লাহর দাসেরা ,

) و َإِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُمْ أَن تَرْجُمُونِ(

নিশ্চয়ই আমি আমার ও তোমাদের রবের কাছে আশ্রয় নিচ্ছি ,পাছে তোমরা আমাকে পাথর মারো [হত্যা করো]। [সূরা দুখান: 20]

) إ ِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُم مِّن كُلِّ مُتَكَبِّرٍ لَّا يُؤْمِنُ بِيَوْمِ الْحِسَابِ(

আমি আশ্রয় নিই আমার ও তোমাদের রবের কাছে , প্রত্যেক দাম্ভিক থেকে , যে হিসাব দিনে বিশ্বাস করে না। [সূরা মু মিন: 27]

ইমাম আরো অগ্রসর হলেন এবং তাদের সামনে দাঁড়ালেন এবং তাদের সারিগুলোর দিকে তাকালেন শান্তবৃষ্টির মতো। তিনি উমর বিন সা আদকে কুফার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন এবং বললেন , ধন্যবাদ আল্লাহর প্রাপ্য , যিনি এ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং একে মৃত্যু ও ক্ষয়ের বাড়ি বানিয়েছেন এবং যিনি এর মানুষদেরকে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তন করেন। সে ব্যক্তি ধোঁকা খেয়েছে যে এ পৃথিবীর প্রতারণার শিকার হয়েছে , কারণ যে এর ওপর নির্ভর করে সে তাকে হতাশ করে। যে এখানে আকাঙ্ক্ষা করে সে তাকে রিক্তহস্ত করে। আমি দেখতে পাচ্ছি তোমরা জড়ো হয়েছো এমন একটি কাজের জন্য যা তোমাদের ওপর আল্লাহর ক্রোধ আনবে। তিনি তোমাদের দিক থেকে তার চেহারা ঘুরিয়ে নিয়েছেন এবং তোমাদেরকে তার ক্রোধে ঢেকে দিয়েছেন এবং তোমাদের কাছ থেকে তার রহমত সরিয়ে নিয়েছেন। তাই আমাদের রব হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ , আর তোমরা হচ্ছো নিকৃষ্টতম দাস। তোমরা আল্লাহকে মেনে চলার অঙ্গীকার করেছো এবং তার রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-কে বিশ্বাস করেছো। এরপরও তোমরা তার পরিবারকে এবং বংশধরকে আক্রমণ করেছো এবং তাদেরকে হত্যা করতে চাও। [ইরশাদ] শয়তান তোমাদের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং তোমাদেরকে সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ভুলিয়ে দিয়েছে। দুর্ভোগ তোমাদের জন্য তোমাদের পথ ও লক্ষ্যের ওপর। নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয়ই আমরা তার কাছে ফেরত যাবো। এ এক জাতি যারা বিশ্বাস গ্রহণের পর কুফুরী গ্রহণ করেছে , তাই বিদায় হে অত্যাচারী জাতি।

তখন উমর বিন সা আদ বললো , তোমাদের জন্য আক্ষেপ , তাকে উত্তর দাও , কারণ সে আলীর সন্তান। সে যদি সারা দিন তোমাদের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকে তার বক্তব্য শেষ হবে না , না সে ক্লান্তহবে। তখন শিমর এগিয়ে এলো এবং বললো , হে হোসেইন , তুমি কী বলছো ব্যাখ্যা কর যেন আমরা বুঝতে পারি। ইমাম বললেন , আমার বক্তব্যের মূল কথা হলো যে আমি তোমাদের বলছি আল্লাহকে ভয় করার জন্য এবং আমাকে হত্যা করো না। কারণ আমাকে হত্যা ও আমার পবিত্রতা ধ্বংস করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। কারণ আমি তোমাদের নবী (সা.)-এর কন্যার সন্তান এবং আমার নানী খাদিজা ( আ .) তোমাদের নবীর স্ত্রী। তোমরা হয়তো আমার নানাকে বলতে শুনে থাকবে যে , হাসান এবং হোসেইন বেহেশতের যুবকদের সর্দার।

এরপর তারা ইমাম হোসেইন (আ.)-কে সবদিক থেকে ঘেরাও করে ফেললো। তিনি তাদের কাছে এগিয়ে গেলেন এবং তাদেরকে চুপ থাকার ইঙ্গিত করলেন , কিন্তু তারা তা শুনতে অস্বীকার করলো। তখন ইমাম বললেন , তোমাদের জন্য দুর্ভোগ , তোমাদের কী হয়েছে যে তোমরা চুপ করছো না এবং আমি যা বলছি তা শুনছো না ? আমি তোমাদেরকে ধার্মিকতার পথে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। যে আমাকে মান্য করবে সে প্রজ্ঞাবান হবে। আর যে আমাকে মান্য করবে না সে ধ্বংস হবে। তোমরা সবাই আমার অবাধ্য হচ্ছো এবং আমার কথায় কান দিচ্ছো না। এর কারণ হলো তোমরা তোমাদের পেট হারামে পূর্ণ করেছো এবং তোমাদের হৃদয়গুলোতে মোহর মারা হয়েছে। আক্ষেপ তোমাদের জন্য। তোমরা কি ন্যায়পরায়ণ নও এবং শুনতে অক্ষম ?

কুফাবাসীদের লক্ষ্য করে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর বক্তব্য

সাইয়্যেদ ইবনে তাউস বর্ণনা করেছেন যে , ইমাম হোসেইন (আ.) তার উটে চড়লেন [অন্যরা বলেন তার ঘোড়ায়] এবং তাদের ইশারা করলেন চুপ করার জন্য। এরপর তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ ও মর্যাদা বর্ণনা করলেন যা তার প্রাপ্য। তিনি অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় সালাম পাঠালেন ফেরেশতা , নবী ও রাসূলদের ওপর। তারপর বললেন , হে জনতা , তোমরা যেন ধ্বংস হও , দুর্দশাগ্রস্ত হও। তোমরা উৎসাহের সাথে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলে তোমাদের সাহায্য করার জন্য এবং আমরা তা করার জন্য দ্রুত অগ্রসর হয়েছি। কিন্তু তোমরা এখন সে তরবারিগুলো কোষমুক্ত করেছো যা আমরা তোমাদের দিয়েছি এবং তোমরা আমাদের জন্য আগুন জ্বালিয়েছো যা আমরা তোমাদের ও আমাদের শত্রুদের জন্য জ্বালিয়েছিলাম। তোমরা তোমাদের শত্রুদের পক্ষ নিয়েছো এবং তাদের সাথে থেকে তোমাদের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অগ্রসর হয়েছো , যদিও তারা তোমাদের সাথে ন্যায়পরায়ণ আচরণ করে নি , না তোমরা তাদের কাছ থেকে কোন দয়া ও সদয় আচরণ আশা কর। তোমাদের ওপর শত দুর্ভোগ আসুক। তোমরা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো যখন তরবারিগুলো এখনও তাদের খাপে রয়েছে , হৃদয়গুলো শান্তিতে আছে , মতামতগুলো যথাযথভাবে স্পষ্ট এবং ভুল থেকে মুক্ত। কিন্তু তোমরা পঙ্গপালের মতো , যারা যুদ্ধের দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়েছে এবং মথের [প্রজাপতি] মতো , একজনের ওপর আরেকজন যেমন পড়ে। তোমরা ধ্বংস হও , হে যারা দাসীদের প্রেমিক , যারা দলত্যাগ করেছো , যারা কোরআন পরিত্যাগ করেছো , যারা সঠিক বক্তব্যকে বদলে নিয়েছো , যারা খারাপের স্তম্ভ , হে যারা শয়তানদের দ্বারা উস্কানি পাচ্ছো এবং যারা আসমানী আদেশ ছিন্নকারী , তোমরা তাদের পক্ষ নিচ্ছো এবং আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো ? হ্যাঁ , নিশ্চয়ই প্রতারণা ও বিশ্বাস ভঙ্গ করা তোমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য , যা তোমাদের পিতৃপুরুষেরা প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তা থেকে শাখা বেরিয়েছে। তোমরা নোংরা এবং এর বিস্বাদ ফল যা এর বপনকারীর গলায় আটকে যায় এবং তা অত্যাচারীদের কাছে আনন্দের। সাবধান , এখন অবৈধ পিতার অবৈধ সন্তান [উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ] আমাকে তরবারি কোষমুক্ত করা ও অপমান সহ্য করার মাঝে স্থাপন করেছে এবং আমরা অপমান গ্রহণ করবো তা কখনোই হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার রাসূল এবং পবিত্র কোলগুলো যা আমাদের দুধ খাইয়েছে , যারা ভদ্র ও যারা অপমান ঘৃণা করে তারা এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে যে , আমরা ঘৃণ্য মানুষদের কাছে মাথা নোয়াবো এবং তারা আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন এ বিষয়ে যুদ্ধের ময়দানে পৌরুষের সাথে নিহত হতে। জেনে রাখো , আমি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো যদিও আমার সাথে রয়েছে অল্প কয়েকজন মানুষ এবং যদিও কিছু ব্যক্তি আমাকে পরিত্যাগ করে চলে গেছে।

নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর ওপর নির্ভর করি , আমার রব এবং তোমাদের রব , কোন জীবিত প্রাণী নেই , যার কপালের চুল তার হাতে নেই। নিশ্চয়ই আমার রব সঠিক পথের ওপরে আছেন। [সূরা হুদ: 56]

হে আল্লাহ , তাদের কাছ থেকে আকাশের বৃষ্টি তুলে নিন এবং তাদেরকে অনাবৃষ্টিতে জড়িয়ে যেতে দিন ইউসুফ (আ.)-এর সময়ের মতো এবং বনি সাকীহর এক ব্যক্তিকে [মুখতার বিন আবু উবায়দা সাক্বাফীকে] তাদের ওপর নিয়োগ দিন , যে তাদের গলায় তিক্ত পেয়ালা ঢেলে দিবে। কারণ তারা মিথ্যা বলেছে এবং আমাদের পরিত্যাগ করেছে। আপনি আমাদের রব , আপনার ওপরে আমরা নির্ভর করি এবং আপনার দিকেই আমরা ফিরি এবং আপনার সামনেই (সবকিছুর) শেষ।

এরপর তিনি তার উট থেকে নামলেন এবং রাসূল (সা.)-এর ঘোড়ায় চড়লেন , যার নাম ছিলো মুরতাজায এবং তার সাথীদেরকে সাজাতে শুরু করলেন।

[ মালহুফ গ্রন্থে আছে] উমর বিন সা আদ সামনে এগিয়ে এলো এবং ইমামের সেনাদলের দিকে একটি তীর ছুঁড়লো এবং বললো , সেনাপতির সামনে সাক্ষী থেকো যে আমিই ছিলাম যে প্রথম তীর ছুঁড়েছিল।’’ তখন তার অধীনে যারা ছিলো তারা বিরাট সংখ্যায় তীর ছুঁড়তে লাগলো যা পাখির মত দেখাতে লাগলো। ইমাম তার সাথীদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন ,

আল্লাহ তাঁর রহমত তোমাদের ওপর বর্ষণ করুন , জাগো অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর মুখোমুখি হতে এবং এ তীরগুলো সেনাবাহিনীর দূত যা আমাদের দিকে আসছে।’’

এরপর তারা আক্রমণ করে এবং ইমামের একদল বিশ্বস্তও পরহেজগার সাথী নিহত হন।

বর্ণনাকারী বলেন যে ইমাম হোসেইন (আ.) নিজের দাড়ি ধরে বললেন ,

আল্লাহর ক্রোধ চরম হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইহুদীদের ওপর যখন তারা বলেছিল তাঁর একটি ছেলে আছে এবং তাঁর রাগ খ্রিষ্টানদের ওপর পড়ে যখন তারা তাঁকে তিন জনের একজন বানিয়েছিল এবং তাঁর ক্রোধ গিয়ে অগ্নি উপাসকদের [মাজুসদের] ওপর পড়েছিল যখন তারা তাঁর পরিবর্তে সূর্য ও চাঁদের ইবাদত করতে শুরু করেছিল এবং এখন আল্লাহর ক্রোধ পড়বে এ সম্প্রদায়ের ওপর যারা একত্রিত হয়েছে নবীর নাতিকে হত্যার জন্য। সাবধান , আল্লাহর শপথ , আমি তাদের আশার সাথে একমত হবো না , যতক্ষণ পর্যন্তনা আমি আমার রবের সাথে মিলিত হই আমার রক্তে ভিজে।’’

বর্ণিত আছে আমর বিন হাজ্জাজ ইমাম হোসেইন (আ.)-এর সাথীদের দিকে অগ্রসর হলো এবং বললো ,‘‘ হে কুফাবাসী , তাদেরকে দৃঢ়ভাবে ধরে থাকো যারা তোমাদের এবং তোমাদের সম্প্রদায়ের কথা শোনে এবং তাকে হত্যা করতে দ্বিধা করো না যে ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে এবং ইমামকে অমান্য করেছে।’’ ইমাম হোসেইন (আ.) বললেন ,‘‘ হে আমর বিন হাজ্জাজ , তুমি কি লোকজনকে আমার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করছো ? আমরা কি ধর্ম থেকে বেরিয়ে গেছি , আর তোমরা তার ওপর দৃঢ় আছো ? আল্লাহর শপথ , যখন তুমি তোমার এ খারাপ কাজগুলো নিয়ে মরবে তখন তুমি জানতে পারবে যে , কে ধর্ম থেকে বেরিয়ে গেছে এবং কে জাহান্নামের [আগুনের] জন্য যোগ্য।’’

কারবালায় ইমাম হোসেইন (আ.)-এর প্রবেশ

হুর বিন ইয়াযীদ ইমাম হোসেইন (আ.)-কে কুফায় যাওয়ার পথে বাধা দিলে তিনি থেমে যান। এরপর তার সন্তানদের , ভাইদের ও আত্মীয়দেরকে নিজের চারদিকে জড়ো করলেন এবং কিছু সময়ের জন্য কাঁদলেন ও বললেন , হে আল্লাহ , আমরা আপনার রাসূলের বংশধর। লোকজন আমাদেরকে আমাদের বাড়িঘর থেকে টেনে বের করেছে এবং আমাদেরকে তাড়া করেছে এবং আমাদেরকে আমাদের নানার জায়গা [মদীনা] থেকে চাপ প্রয়োগ করে বের করে দিয়েছে। বনি উমাইয়া আমাদের উপর অত্যাচার করেছে। হে আল্লাহ , আমাদের অধিকারকে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিন এবং এ অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।

এরপর তিনি সেখান থেকে অগ্রসর হলেন এবং 61 হিজরির 2রা মহররমের দিন বুধবার অথবা মঙ্গলবার কারবালায় প্রবেশ করলেন। এরপর তিনি তার সাথীদের দিকে ফিরে বললেন ,

লোকজন পৃথিবীর দাস এবং ধর্ম শুধু তাদের মুখের কথা এবং তারা এর যত্ন নিবে যতক্ষণ পর্যন্ততা তাদের জন্য আনন্দদায়ক এবং যখন পরীক্ষার উত্তপ্ত পাত্র এসে যায় তখন থাকে শুধু গুটি-কয়েক ধার্মিক ব্যক্তি।

এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন , এটি কি কারবালা ?

লোকজন উত্তর দিলো , হ্যাঁ। তিনি বললেন , এ জায়গা হলো দুঃখ ও মুসিবতের জায়গা এবং এ জায়গা আমাদের উটগুলোর বিশ্রামের স্থান , আমাদের থামার জায়গা , আমাদের শাহাদাতের জায়গা যেখানে আমাদের রক্ত ঝরানো হবে।

ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কাছে উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের চিঠি

ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া কর্তৃক নিয়োজিত কুফার গভর্নর ইমাম হোসেইন (আ.)-কে একটি চিঠি প্রদান করে যা নিম্নরূপ: আম্মা বা আদ , হে হোসেইন , আমাকে জানানো হয়েছে যে , তুমি কারবালায় থেমেছো। ইয়াযীদ আমাকে লিখেছে , আমি যেন বিছানায় মাথা না রাখি এবং সন্তুষ্ট না হই যতক্ষণ পর্যন্তনা আমি তোমাকে আল্লাহর কাছে পাঠাচ্ছি , অথবা তুমি আমার কাছে এবং ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ কর। সালাম।

যখন এ চিঠি ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কাছে পৌঁছলো , তিনি তা পড়লেন এবং তা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন , যে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি খোঁজে সে কখনোই সফলতা লাভ করে না। দূত তাকে চিঠির উত্তর দিতে বললে ইমাম বললেন , তার জন্য কোন উত্তর নেই , আছে গযব [আল্লাহর]।

আশুরার (দশ মহররম) রাতের ঘটনাবলী

[ ইরশাদ গ্রন্থে আছে ] ইমাম হোসেইন ( আ .) তার সাথীদের রাতের বেলা জড়ো করলেন , ইমাম আলী যায়নুল আবেদীন ( আ .) বলেন যে , আমি তাদের কছে গেলাম শোনার জন্য তারা কী বলেন এবং সে সময় আমি অসুস্থ ছিলাম। আমি শুনলাম ইমাম তার সাথীদের বলছেন ,

আমি আল্লাহর প্রশংসা করি সর্বোত্তম প্রশংসার মাধ্যমে এবং তাঁর প্রশংসা করি সমৃদ্ধির সময়ে এবং দুঃখ দুর্দশার মাঝেও। হে আল্লাহ , আমি আপনার প্রশংসা করি এ জন্য যে , আপনি আমাদের পরিবারে নবুয়াত দান করতে পছন্দ করেছেন। আপনি আমাদের কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন এবং ধর্মে আমাদেরকে বিজ্ঞজন করেছেন এবং আমাদেরকে দান করেছেন শ্রবণ শক্তি ও দূরদৃষ্টি এবং আলোকিত অন্তর। তাই আমাদেরকে আপনার কৃতজ্ঞ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন।

আম্মা বা আদ , আমি তোমাদের চেয়ে বিশস্ত এবং ধার্মিক কোন সাথীকে পাই নি , না আমি আমার পরিবারের চাইতে বেশী বিবেচক , স্নেহশীল , সহযোগিতাকারী ও সদয় কোন পরিবারকে দেখেছি। তাই আল্লাহ আমার পক্ষ থেকে তোমাদেরকে উত্তমভাবে পুরস্কৃত করুন এবং আমি মনে করি শত্রুরা একদিনও অপেক্ষা করবে না এবং আমি তোমাদের সবাইকে অনুমতি দিচ্ছি স্বাধীনভাবে চলে যাওয়ার জন্য এবং আমি তা তোমাদের জন্য বৈধ করছি। আমি তোমাদের উপর থেকে আনুগত্য ও শপথের দায়ভার তুলে নিচ্ছি ( যা তোমরা আমার হাতে হাত দিয়ে শপথ করেছিলে ) । রাতের অন্ধকার তোমাদের ঢেকে দিয়েছে , তাই নিজেদের মুক্ত করো ঘূর্ণিপাক থেকে অন্ধকারের ঢেউয়ের ভেতরে। আর তোমাদের প্রত্যেকে আমার পরিবারের একজনের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ো গ্রাম ও শহরগুলোতে , যতক্ষণ না আল্লাহ তোমাদের মুক্তি দান করেন। কারণ এ লোকগুলো শুধু আমাকে চায় এবং আমার গায়ে হাত দেয়ার পরে তারা আর কারো পেছনে ধাওয়া করবে না।

এ কথা শুনে তার ভাইয়েরা , সন্তানরা , ও ভাতিজারা এবং আব্দুল্লাহ বিন জাফরের সন্তানরা বললেন , আামরা তা কখনোই করবো না আপনার পরে বেঁচে থাকার জন্য। আল্লাহ যেন কখনো তা না করেন। হযরত আব্বাস বিন আলী ( আ .) সর্বপ্রথম এ ঘোষণা দিলেন এবং অন্যরা তাকে অনুসর ণ করলেন।

ইমাম তখন আক্বীল বিন আবি তালিবের সন্তানদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন , মুসলিমের আত্মত্যাগ তোমাদের জন্য যথেষ্ট হয়েছে , তাই আমি তোমাদের অনমতি দিচ্ছি চলে যাওয়ার জন্য। তারা বললেন , সুবহানাল্লাহ , লোকেরা কী বলবে ? তারা বলবে আমরা আমাদের প্রধানকে , অভিভাবককে এবং চাচাতো ভাইকে , যে শ্রেষ্ঠ চাচাতো ভাই , পরিত্যাগ করেছি এবং আমরা তার সাথে থেকে তীর ছুড়িনি , বর্শা দিয়ে আঘাত করি নি এবং তার সাথে থেকে তরবারি চালাই নি এবং তখন আমরা ( এ অভিযোগের মুখে ) বুঝতে পারবো না কী করবো ; আল্লাহর শপথ , আমরা তা কখনোই করবো না। প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের জীবন , সম্পদ ও পরিবার আপনার জন্য কোরবানী করবো। আমরা আপনার পাশে থেকে যুদ্ধ করবো এবং আপনার পাশে থেকে পরিণতিতে পৌঁছে যাবো। আপনার পরে জীবন কুৎসিত হয়ে যাক ( যদি বেঁচে থাকি ) ।

হোসেইন বিন হামদান হাযীনি তার বর্ণনা ধারা বজায় রেখে আবু হামযা সূমালি থেকে বর্ণনা করেন এবং সাইয়েদ বাহরানি বর্ণনার ক্রমধারা উল্লেখ না করেই তার কাছ থেকে নবণার্ করেছেন যে , তিনি বলেছেন: আমি ইমাম আলী আল-যায়নুল আবেদীনকে বলতে শুনেছি , শাহাদাতের আগের রাতে আমার বাবা তার পরিবার এবং সাথীদের জড়ো করলেন এবং বললেন , হে আমার পরিবারের সদস্যরা এবং আমার শিয়ারা [অনুসারীরা] , এ রাতকে ভেবে দেখো যা তোমাদের কাছে বহনকারী উট হয়ে এসেছে এবং নিজেদেরকে রক্ষা করো , কারণ লোকেরা আমাকে ছাড়া কাউকে চায় না। আমাকে হত্যা করার পর তারা তোমাদেরকে তাড়া করবে না। আল্লাহ তোমাদের উপর রহমত করুন। নিজেদেরকে রক্ষা করো। নিশ্চয়ই আমি আনুগত্য ও শপথের দায়ভার তুলে নিলাম যা তোমরা আমার হাতে করেছো। এ কথা শুনে তার ভাইয়েরা , আত্মীয়-স্বজন ও সাথীরা একত্রে বলে উঠলো , আল্লাহর শপথ হে আমাদের অভিভাবক , হে আবা আবদিল্লাহ , আমরা আপনার সাথে কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করবো না , তাতে লোকেরা বলতে পারে যে আমরা আমাদের ইমামকে , প্রধানকে এবং অভিভাবককে পরিত্যাগ করেছি এবং তাকে শহীদ করা হয়েছে। তখন আমরা আমাদের ও আল্লাহর মাঝে ওজর খুঁজবো। আমরা আপনাকে কখনোই পরিত্যাগ করবো না যতক্ষণ পর্যন্তনা আমরা আপনার জন্য কোরবান হই। ইমাম বললেন , নিশ্চয়ই আগামীকাল আমাকে হত্যা করা হবে এবং তোমাদের সবাইকে আমার সাথে হত্যা করা হবে এবং তোমাদের কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না। তারা বললেন , সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যে তিনি আমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন আপনাকে সাহায্য করার জন্য এবং আমাদেরকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন আপনার সাথে শহীদ হওয়ার জন্য। তাহলে কি আমরা পছন্দ করবো না যে আমরা আপনার সাথে উচ্চ মাক্বামে [বেহেশতে] থাকবো , হে রাসূলুল্লাহর সন্তান ? ইমাম বললেন , আল্লাহ তোমাদের উদারভাবে পুরস্কৃত করুন। এরপর তিনি তাদের জন্য দোআ করলেন।

তখন ক্বাসিম বিন হাসান (আ.) জিজ্ঞেস করলেন , আমি কি শহীদদের তালিকায় আছি ? তা শুনে ইমাম আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন এবং বললেন , হে আমার প্রিয় সন্তান , তুমি মৃত্যুকে কিভাবে দেখো ?

ক্বাসিম বললেন , মধুর চেয়ে মিষ্টি।

ইমাম বললেন , নিশ্চয়ই , আল্লাহর শপথ , তোমার চাচা তোমার জন্য কোরবান হোক , তুমি তাদের একজন যাদেরকে শহীদ করা হবে আমার সাথে কঠিন অবস্থার শিকার হওয়ার পর এবং আমার [শিশু] সন্তান আব্দুল্লাহকেও [আলী আসগার] শহীদ করা হবে।

আশুরার দিনে ইমাম হোসেইন ( আ .)- এর খোতবা

আশুরার দিনে ইমাম হোসেইন (আ.) একটি খোতবায় বলেন: আম্মা বা আদ , বিবেচনা করো আমার পরিবার সম্পর্কে এবং গভীরভাবে ভাবো আমি কে , এরপর নিজেরদের তিরস্কার করো। তোমরা কি মনে করো যে আমাকে হত্যা করা এবং আমার পবিত্রতা ও সম্মান লুট করা তোমাদের জন্য বৈধ ? আমি কি তোমাদের নবীর নাতি , তার ওয়াসী ও তার চাচাতো ভাইয়ের সন্তান নই , যিনি ছিলেন বিশ্বাস গ্রহণে সবার আগে এবং সাক্ষী ছিলেন সে সবকিছুর ওপরে যা মহানবী আল্লাহর কাছ থেকে এনেছেন ? শহীদদের সর্দার হামযা কি আমার পিতার চাচা ছিলেন না ? জাফর , যিনি বেহেশতে দুপাখা নিয়ে উড়েন , তিনি কি আমার চাচা নন ? নবীর হাদীস কি তোমাদের কাছে পৌঁছে নি যেখানে তিনি আমার সম্পর্কে ও আমার ভাই সম্পর্কে বলেছেন : আমরা দুজন জান্নাতের যুবকদের সর্দার ? তাই যদি আমি যা বলছি তার সাথে একমত হও , এবং নিশ্চয়ই আমি যা বলেছি তা সত্য ছাড়া কিছু নয় , তাহলে তা উত্তম , কারণ আল্লাহর শপথ , যে সময় থেকে আমি বুঝেছি আল্লাহ মিথ্যাবাদীদের অপছন্দ করেন তখন থেকে আমি কখনোই কোন মিথ্যা বলি নি। আর যদি তোমরা আমি যা বলছি তা বিশ্বাস না কর , তাহলে তোমাদের মাঝে নবীর জীবিত সাহাবীগণ আছে , তাদের কাছে যাও এবং তাদেরকে জিজ্ঞেস কর এবং তারা আমার বক্তব্যের সত্যতার সাক্ষ্য দিবে। জাবির বিন আব্দুল্লাহ আনসারি , আবু সাঈদ খুদরি , সাহল বিন সাদ সা য়েদি , যায়েদ বিন আরক্বাম এবং আনাস বিন মালিককে জিজ্ঞেস কর , তারা তোমাদের বলবে যে তারা আল্লাহর রাসূলের কাছ থেকে আমার ও আমার ভাই সম্পর্কে এ হাদীসটি শুনেছে। এটি কি তোমাদের জন্য আমার রক্ত ঝরানোর চাইতে যথেষ্ট নয় ?

তখন অভিশপ্ত শিমর বিন যিলজাওশান বললো , আমি আল্লাহর ইবাদত করি ঠোঁট দিয়ে এবং তুমি যা বলছো তা আমি বুঝি না। এ কথা শুনে হাবীব বিন মুযাহির [ইমামের সাথী] বললেন , আমি দেখছি তুমি আল্লাহর ইবাদত করো সত্তুর ধরনের সন্দেহ নিয়ে এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তুমি সত্য কথা বলেছো এবং তুমি বুঝতে পারো না ইমাম যা বলেন , কারণ আল্লাহ তোমার হৃদয়ের ওপরে একটি [মূর্খতার] মোহর মেরে দিয়েছেন।

ইমাম বললেন , যদি তোমরা এতে সন্দেহ পোষণ কর , তোমরা কি এতেও সন্দেহ কর যে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নাতি ? আল্লাহর শপথ , পূর্বে ও পশ্চিমে , আমি ছাড়া নবীর কোন নাতি নেই তোমাদের মধ্যে অথবা অন্যদের মধ্যে। দুর্ভোগ তোমাদের জন্য , আমি কি তোমাদের মধ্য থেকে কাউকে হত্যা করেছি যে তোমরা তার প্রতিশোধ নিতে চাও ? অথবা আমি কি কারো সম্পদ বেদখল করেছি , অথবা কাউকে আহত করেছি যার প্রতিশোধ তোমরা আমার ওপর নিতে চাও ?

যখন কেউ তাকে উত্তর দিলো না , তিনি উচ্চ কণ্ঠে বললেন , হে শাবাস বিন রাব ঈ , হে হাজ্জার বিন আবজার , হে ক্বায়েস বিন আল-আশআস , হে ইয়াযীদ বিন হুরেইস , তোমরা কি আমার কাছে চিঠি লিখোনি যে , ফল পেকেছে এবং আশপাশের ভূমিতে ফুল ফুটেছে এবং একটি বিশাল সেনাবাহিনীর কাছে আসুন , যা আপনার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে ?

তারা উত্তর দিলো যে তারা এ ধরনের কোন চিঠি লিখেনি। ইমাম বললেন , সুবহানাল্লাহ , আল্লাহর শপথ অবশ্যই তোমরা তা লিখেছিলে।

এরপর তিনি বললেন , হে জনতা , এখন যদি তোমরা আমার আগমনকে পছন্দ না কর , তাহলে আমাকে ছেড়ে দাও যেন আমি কোন আশ্রয়ের জায়গায় চলে যেতে পারি।

ক্বায়েস বিন আল-আশআস বললো , তুমি যা বলছো তা আমরা জানি না , আমার চাচাতো ভাইদের [বনি উমাইয়ার] কাছে আত্মসমর্পণ কর , তারা তোমার সাথে সেভাবে আচরণ করবে যেভাবে তুমি চাও। ইমাম বললেন , আল্লাহর শপথ , নিকৃষ্ট মানুষের মতো আমি তোমাদের হাতে হাত দিবোনা , না আমি পালিয়ে যাবো কোন দাসের মতো।

এরপর তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন , হে আল্লাহর দাসেরা ,

) و َإِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُمْ أَن تَرْجُمُونِ(

নিশ্চয়ই আমি আমার ও তোমাদের রবের কাছে আশ্রয় নিচ্ছি ,পাছে তোমরা আমাকে পাথর মারো [হত্যা করো]। [সূরা দুখান: 20]

) إ ِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُم مِّن كُلِّ مُتَكَبِّرٍ لَّا يُؤْمِنُ بِيَوْمِ الْحِسَابِ(

আমি আশ্রয় নিই আমার ও তোমাদের রবের কাছে , প্রত্যেক দাম্ভিক থেকে , যে হিসাব দিনে বিশ্বাস করে না। [সূরা মু মিন: 27]

ইমাম আরো অগ্রসর হলেন এবং তাদের সামনে দাঁড়ালেন এবং তাদের সারিগুলোর দিকে তাকালেন শান্তবৃষ্টির মতো। তিনি উমর বিন সা আদকে কুফার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন এবং বললেন , ধন্যবাদ আল্লাহর প্রাপ্য , যিনি এ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং একে মৃত্যু ও ক্ষয়ের বাড়ি বানিয়েছেন এবং যিনি এর মানুষদেরকে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তন করেন। সে ব্যক্তি ধোঁকা খেয়েছে যে এ পৃথিবীর প্রতারণার শিকার হয়েছে , কারণ যে এর ওপর নির্ভর করে সে তাকে হতাশ করে। যে এখানে আকাঙ্ক্ষা করে সে তাকে রিক্তহস্ত করে। আমি দেখতে পাচ্ছি তোমরা জড়ো হয়েছো এমন একটি কাজের জন্য যা তোমাদের ওপর আল্লাহর ক্রোধ আনবে। তিনি তোমাদের দিক থেকে তার চেহারা ঘুরিয়ে নিয়েছেন এবং তোমাদেরকে তার ক্রোধে ঢেকে দিয়েছেন এবং তোমাদের কাছ থেকে তার রহমত সরিয়ে নিয়েছেন। তাই আমাদের রব হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ , আর তোমরা হচ্ছো নিকৃষ্টতম দাস। তোমরা আল্লাহকে মেনে চলার অঙ্গীকার করেছো এবং তার রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-কে বিশ্বাস করেছো। এরপরও তোমরা তার পরিবারকে এবং বংশধরকে আক্রমণ করেছো এবং তাদেরকে হত্যা করতে চাও। [ইরশাদ] শয়তান তোমাদের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং তোমাদেরকে সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ভুলিয়ে দিয়েছে। দুর্ভোগ তোমাদের জন্য তোমাদের পথ ও লক্ষ্যের ওপর। নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয়ই আমরা তার কাছে ফেরত যাবো। এ এক জাতি যারা বিশ্বাস গ্রহণের পর কুফুরী গ্রহণ করেছে , তাই বিদায় হে অত্যাচারী জাতি।

তখন উমর বিন সা আদ বললো , তোমাদের জন্য আক্ষেপ , তাকে উত্তর দাও , কারণ সে আলীর সন্তান। সে যদি সারা দিন তোমাদের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকে তার বক্তব্য শেষ হবে না , না সে ক্লান্তহবে। তখন শিমর এগিয়ে এলো এবং বললো , হে হোসেইন , তুমি কী বলছো ব্যাখ্যা কর যেন আমরা বুঝতে পারি। ইমাম বললেন , আমার বক্তব্যের মূল কথা হলো যে আমি তোমাদের বলছি আল্লাহকে ভয় করার জন্য এবং আমাকে হত্যা করো না। কারণ আমাকে হত্যা ও আমার পবিত্রতা ধ্বংস করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। কারণ আমি তোমাদের নবী (সা.)-এর কন্যার সন্তান এবং আমার নানী খাদিজা ( আ .) তোমাদের নবীর স্ত্রী। তোমরা হয়তো আমার নানাকে বলতে শুনে থাকবে যে , হাসান এবং হোসেইন বেহেশতের যুবকদের সর্দার।

এরপর তারা ইমাম হোসেইন (আ.)-কে সবদিক থেকে ঘেরাও করে ফেললো। তিনি তাদের কাছে এগিয়ে গেলেন এবং তাদেরকে চুপ থাকার ইঙ্গিত করলেন , কিন্তু তারা তা শুনতে অস্বীকার করলো। তখন ইমাম বললেন , তোমাদের জন্য দুর্ভোগ , তোমাদের কী হয়েছে যে তোমরা চুপ করছো না এবং আমি যা বলছি তা শুনছো না ? আমি তোমাদেরকে ধার্মিকতার পথে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। যে আমাকে মান্য করবে সে প্রজ্ঞাবান হবে। আর যে আমাকে মান্য করবে না সে ধ্বংস হবে। তোমরা সবাই আমার অবাধ্য হচ্ছো এবং আমার কথায় কান দিচ্ছো না। এর কারণ হলো তোমরা তোমাদের পেট হারামে পূর্ণ করেছো এবং তোমাদের হৃদয়গুলোতে মোহর মারা হয়েছে। আক্ষেপ তোমাদের জন্য। তোমরা কি ন্যায়পরায়ণ নও এবং শুনতে অক্ষম ?

কুফাবাসীদের লক্ষ্য করে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর বক্তব্য

সাইয়্যেদ ইবনে তাউস বর্ণনা করেছেন যে , ইমাম হোসেইন (আ.) তার উটে চড়লেন [অন্যরা বলেন তার ঘোড়ায়] এবং তাদের ইশারা করলেন চুপ করার জন্য। এরপর তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ ও মর্যাদা বর্ণনা করলেন যা তার প্রাপ্য। তিনি অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় সালাম পাঠালেন ফেরেশতা , নবী ও রাসূলদের ওপর। তারপর বললেন , হে জনতা , তোমরা যেন ধ্বংস হও , দুর্দশাগ্রস্ত হও। তোমরা উৎসাহের সাথে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলে তোমাদের সাহায্য করার জন্য এবং আমরা তা করার জন্য দ্রুত অগ্রসর হয়েছি। কিন্তু তোমরা এখন সে তরবারিগুলো কোষমুক্ত করেছো যা আমরা তোমাদের দিয়েছি এবং তোমরা আমাদের জন্য আগুন জ্বালিয়েছো যা আমরা তোমাদের ও আমাদের শত্রুদের জন্য জ্বালিয়েছিলাম। তোমরা তোমাদের শত্রুদের পক্ষ নিয়েছো এবং তাদের সাথে থেকে তোমাদের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অগ্রসর হয়েছো , যদিও তারা তোমাদের সাথে ন্যায়পরায়ণ আচরণ করে নি , না তোমরা তাদের কাছ থেকে কোন দয়া ও সদয় আচরণ আশা কর। তোমাদের ওপর শত দুর্ভোগ আসুক। তোমরা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো যখন তরবারিগুলো এখনও তাদের খাপে রয়েছে , হৃদয়গুলো শান্তিতে আছে , মতামতগুলো যথাযথভাবে স্পষ্ট এবং ভুল থেকে মুক্ত। কিন্তু তোমরা পঙ্গপালের মতো , যারা যুদ্ধের দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়েছে এবং মথের [প্রজাপতি] মতো , একজনের ওপর আরেকজন যেমন পড়ে। তোমরা ধ্বংস হও , হে যারা দাসীদের প্রেমিক , যারা দলত্যাগ করেছো , যারা কোরআন পরিত্যাগ করেছো , যারা সঠিক বক্তব্যকে বদলে নিয়েছো , যারা খারাপের স্তম্ভ , হে যারা শয়তানদের দ্বারা উস্কানি পাচ্ছো এবং যারা আসমানী আদেশ ছিন্নকারী , তোমরা তাদের পক্ষ নিচ্ছো এবং আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো ? হ্যাঁ , নিশ্চয়ই প্রতারণা ও বিশ্বাস ভঙ্গ করা তোমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য , যা তোমাদের পিতৃপুরুষেরা প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তা থেকে শাখা বেরিয়েছে। তোমরা নোংরা এবং এর বিস্বাদ ফল যা এর বপনকারীর গলায় আটকে যায় এবং তা অত্যাচারীদের কাছে আনন্দের। সাবধান , এখন অবৈধ পিতার অবৈধ সন্তান [উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ] আমাকে তরবারি কোষমুক্ত করা ও অপমান সহ্য করার মাঝে স্থাপন করেছে এবং আমরা অপমান গ্রহণ করবো তা কখনোই হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার রাসূল এবং পবিত্র কোলগুলো যা আমাদের দুধ খাইয়েছে , যারা ভদ্র ও যারা অপমান ঘৃণা করে তারা এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে যে , আমরা ঘৃণ্য মানুষদের কাছে মাথা নোয়াবো এবং তারা আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন এ বিষয়ে যুদ্ধের ময়দানে পৌরুষের সাথে নিহত হতে। জেনে রাখো , আমি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো যদিও আমার সাথে রয়েছে অল্প কয়েকজন মানুষ এবং যদিও কিছু ব্যক্তি আমাকে পরিত্যাগ করে চলে গেছে।

নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর ওপর নির্ভর করি , আমার রব এবং তোমাদের রব , কোন জীবিত প্রাণী নেই , যার কপালের চুল তার হাতে নেই। নিশ্চয়ই আমার রব সঠিক পথের ওপরে আছেন। [সূরা হুদ: 56]

হে আল্লাহ , তাদের কাছ থেকে আকাশের বৃষ্টি তুলে নিন এবং তাদেরকে অনাবৃষ্টিতে জড়িয়ে যেতে দিন ইউসুফ (আ.)-এর সময়ের মতো এবং বনি সাকীহর এক ব্যক্তিকে [মুখতার বিন আবু উবায়দা সাক্বাফীকে] তাদের ওপর নিয়োগ দিন , যে তাদের গলায় তিক্ত পেয়ালা ঢেলে দিবে। কারণ তারা মিথ্যা বলেছে এবং আমাদের পরিত্যাগ করেছে। আপনি আমাদের রব , আপনার ওপরে আমরা নির্ভর করি এবং আপনার দিকেই আমরা ফিরি এবং আপনার সামনেই (সবকিছুর) শেষ।

এরপর তিনি তার উট থেকে নামলেন এবং রাসূল (সা.)-এর ঘোড়ায় চড়লেন , যার নাম ছিলো মুরতাজায এবং তার সাথীদেরকে সাজাতে শুরু করলেন।

[ মালহুফ গ্রন্থে আছে] উমর বিন সা আদ সামনে এগিয়ে এলো এবং ইমামের সেনাদলের দিকে একটি তীর ছুঁড়লো এবং বললো , সেনাপতির সামনে সাক্ষী থেকো যে আমিই ছিলাম যে প্রথম তীর ছুঁড়েছিল।’’ তখন তার অধীনে যারা ছিলো তারা বিরাট সংখ্যায় তীর ছুঁড়তে লাগলো যা পাখির মত দেখাতে লাগলো। ইমাম তার সাথীদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন ,

আল্লাহ তাঁর রহমত তোমাদের ওপর বর্ষণ করুন , জাগো অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর মুখোমুখি হতে এবং এ তীরগুলো সেনাবাহিনীর দূত যা আমাদের দিকে আসছে।’’

এরপর তারা আক্রমণ করে এবং ইমামের একদল বিশ্বস্তও পরহেজগার সাথী নিহত হন।

বর্ণনাকারী বলেন যে ইমাম হোসেইন (আ.) নিজের দাড়ি ধরে বললেন ,

আল্লাহর ক্রোধ চরম হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইহুদীদের ওপর যখন তারা বলেছিল তাঁর একটি ছেলে আছে এবং তাঁর রাগ খ্রিষ্টানদের ওপর পড়ে যখন তারা তাঁকে তিন জনের একজন বানিয়েছিল এবং তাঁর ক্রোধ গিয়ে অগ্নি উপাসকদের [মাজুসদের] ওপর পড়েছিল যখন তারা তাঁর পরিবর্তে সূর্য ও চাঁদের ইবাদত করতে শুরু করেছিল এবং এখন আল্লাহর ক্রোধ পড়বে এ সম্প্রদায়ের ওপর যারা একত্রিত হয়েছে নবীর নাতিকে হত্যার জন্য। সাবধান , আল্লাহর শপথ , আমি তাদের আশার সাথে একমত হবো না , যতক্ষণ পর্যন্তনা আমি আমার রবের সাথে মিলিত হই আমার রক্তে ভিজে।’’

বর্ণিত আছে আমর বিন হাজ্জাজ ইমাম হোসেইন (আ.)-এর সাথীদের দিকে অগ্রসর হলো এবং বললো ,‘‘ হে কুফাবাসী , তাদেরকে দৃঢ়ভাবে ধরে থাকো যারা তোমাদের এবং তোমাদের সম্প্রদায়ের কথা শোনে এবং তাকে হত্যা করতে দ্বিধা করো না যে ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে এবং ইমামকে অমান্য করেছে।’’ ইমাম হোসেইন (আ.) বললেন ,‘‘ হে আমর বিন হাজ্জাজ , তুমি কি লোকজনকে আমার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করছো ? আমরা কি ধর্ম থেকে বেরিয়ে গেছি , আর তোমরা তার ওপর দৃঢ় আছো ? আল্লাহর শপথ , যখন তুমি তোমার এ খারাপ কাজগুলো নিয়ে মরবে তখন তুমি জানতে পারবে যে , কে ধর্ম থেকে বেরিয়ে গেছে এবং কে জাহান্নামের [আগুনের] জন্য যোগ্য।’’


7

8

9

10

11

12