বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্15%

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্ লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 18 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 26157 / ডাউনলোড: 4692
সাইজ সাইজ সাইজ
বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মৃত্যুপারের জীবন সম্পর্কে মানুষের ঔৎসুক্য চিরন্তন। এ ঔৎসুক্যের পরিপূর্ণ নিবৃত্তি জীবদ্দশায় সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব নয় জেনেও মানুষ কখনোই এ বিষয়ে জানার আগ্রহ পরিত্যাগ করতে পারে না। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মে যেমন বিভিন্ন ধারণা দেয়া হয়েছে, তেমনি এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা তথ্য ও কল্পনা। তাই এ ব্যাপারে সম্ভব সর্বাধিক মাত্রায় সঠিক ধারণার প্রয়োজনীয়তা সব সময়ই অনুভূত হয়ে আসছে।

ইসলামী মতে, সাধারণভাবে মৃত্যুপরবর্তী সময়ের দু’টি পর্যায় রয়েছে : মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত সময় এবং পুনরুত্থান পরবর্তী সময় অর্থাৎ শেষ বিচার ও তদ্পরবর্তী জান্নাতী বা জাহান্নামী অনন্ত জীবন। পুনরুত্থান, শেষ বিচার এবং বেহেশত বা দোযখ বাস তথা আখেরাতের ওপর ঈমান পোষণ ইসলামের মৌলিক চৈন্তিক ভিত্তি (উছূলে ‘আক্বাএদ্)-এর অন্যতম। এ কারণে এ সম্পর্কে কোরআন মজীদে বিস্তারিত বক্তব্য রয়েছে।

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে আালামে বারযাখ্

নূর হোসেন মজিদী

এই বইটি আল হাসানাইন (আ.) ওয়েব সাইট কর্তৃক আপলোড করা হয়েছে ।

http://alhassanain.org/bengali

বিসমিল্লাহির্ রাহমানির্ রাহীম্।

মুখবন্ধ

মৃত্যুপারের জীবন সম্পর্কে মানুষের ঔৎসুক্য চিরন্তন। এ ঔৎসুক্যের পরিপূর্ণ নিবৃত্তি জীবদ্দশায় সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব নয় জেনেও মানুষ কখনোই এ বিষয়ে জানার আগ্রহ পরিত্যাগ করতে পারে না। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মে যেমন বিভিন্ন ধারণা দেয়া হয়েছে , তেমনি এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা তথ্য ও কল্পনা। তাই এ ব্যাপারে সম্ভব সর্বাধিক মাত্রায় সঠিক ধারণার প্রয়োজনীয়তা সব সময়ই অনুভূত হয়ে আসছে।

ইসলামী মতে , সাধারণভাবে মৃত্যুপরবর্তী সময়ের দু টি পর্যায় রয়েছে : মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত সময় এবং পুনরুত্থান পরবর্তী সময় অর্থাৎ শেষ বিচার ও তদ্পরবর্তী জান্নাতী বা জাহান্নামী অনন্ত জীবন। পুনরুত্থান , শেষ বিচার এবং বেহেশত বা দোযখ বাস তথা আখেরাতের ওপর ঈমান পোষণ ইসলামের মৌলিক চৈন্তিক ভিত্তি (উছূলে আক্বাএদ্)-এর অন্যতম। এ কারণে এ সম্পর্কে কোরআন মজীদে বিস্তারিত বক্তব্য রয়েছে।

অন্যদিকে সুস্থ বিচারবুদ্ধি পুনরুত্থান , শেষ বিচার এবং শাস্তি ও পুরষ্কারের প্রয়োজনীয়তাকে যেমন অনস্বীকার্য গণ্য করে তেমনি তার সম্ভব হওয়াও স্বীকার করে। বিশেষ করে কোরআন মজীদে এ ব্যাপারে যে সব বিচারবুদ্ধির দলীল উপস্থাপন করা হয়েছে তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তা হচ্ছে , যিনি প্রথম বার সৃষ্টি করেছেন তিনিই পুনঃসৃষ্টি করবেন অর্থাৎ প্রথম বার সৃষ্টির তুলনায় পুনঃসৃষ্টি অপেক্ষাকৃত সহজ। তাই মৃত্যুপরবর্তী পুনরুত্থানের প্রয়োজনীয়তা ও তা সম্ভব হওয়ার বিষয়টিকে অস্বীকার করা একমাত্র বিচারবুদ্ধি বর্জনকারী ও নাস্তিকতায় অন্ধ বিশ্বাসী একগুঁয়ে ব্যক্তি ব্যতীত কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।

কিন্তু মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মধ্যবর্তী সময়টিতে মৃত ব্যক্তিদের অবস্থা সংক্রান্ত ধারণা শেষ বিচারের ধারণার গুরুত্বের অনুরূপ গুরুত্বের অধিকারী না হলেও খুব কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন্যদিকে এ অধ্যায়টি সম্বন্ধেই মানুষের ঔৎসুক্য সবচেয়ে বেশী।

মানবিক বিচারবুদ্ধি পুনরুত্থানের সম্ভাব্যতাকে খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারে। কারণ , মহাজ্ঞানময় ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তা আলার পক্ষে প্রতিটি প্রাণশীল সৃষ্টির মৃতদেহের বিক্ষিপ্ত বস্তুকণাগুলোকে কেবল তাঁর ইচ্ছাশক্তিবলে একত্রিত করে তাদেরকে পুনঃসৃষ্টিকরণ মোটেই কঠিন হতে পারে না। কিন্তু মানুষ জানতে চায় , মৃত্যুর পরে শরীর থেকে আত্মা ’ বিচ্ছিন্ন হবার পর মানুষের অবস্থা কী হয়ে থাকে।

অবশ্য ওয়ায্-নছ্বীহতে ও এতদসংক্রান্ত বই-পুস্তকে ক্ববর আযাব্ ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। কিন্তু এতে সাধারণতঃ প্রকৃত ছ্বহীহ্ হাদীছের সাথে নিখুঁত বিচারে ছ্বহীহ্ নয় এমন বহু হাদীছ এবং বহু ভিত্তিহীন কিচ্ছা-কাহিনীর সমাহার ঘটে থাকে। এ সব ওয়ায্-নছ্বীহত্ ও এতদসংক্রান্ত বই-পুস্তকে বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্) ও কোরআন মজীদের দলীলের ব্যবহার কদাচিৎ দেখা যায়। তাছাড়া এ বিষয়ে এমনভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয় যা চিন্তাশীল শ্রোতা বা পাঠক-পাঠিকাদের নিকট গ্রহণযোগ্য হয় না। ফলে বহু প্রশ্নের জন্ম হয়। কিন্তু এ সব প্রশ্নের জবাব দেয়া হয় না। যেমন : ক্ববরের জিজ্ঞাসাবাদ এবং শাস্তি ও পুরষ্কারের কথা বলা হয় , কিন্তু সে ক্ষেত্রে ক্ববর ’ বলতে মাটির বুকে খননকৃত ক্ববরকে বুঝানো হয় - যা আদৌ ঠিক নয়।

ওয়ায্-নছ্বীহতে ও এতদসংক্রান্ত বই-পুস্তকে যা বলা হয় মোটামুটিভাবে তা হচ্ছে এরূপ যে , মৃত ব্যক্তিকে ক্ববরস্থ করার পর পরই মাটির ক্ববরের ভিতরেই তার বস্তুগত শরীরে তার রূহ্ ’ কে ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং তাকে তুলে বসানো হয়। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অতঃপর , ক্ববরস্থ ব্যক্তি গুনাহ্গার হলে ক্ববরের দু পাশের মাটি এসে তার শরীরকে পিষে ফেলে। এ থেকে মনে হয় যে , এরূপ ব্যক্তির ক্ববর খুলে দেখলে তার শরীরকে পিষে ফেলা মণ্ডের অবস্থায় পাওয়া যাবে। কিন্তু আসলে তা ঘটে না। চরম পাপাচারী ব্যক্তির মৃতদেহ মৃত্যুর অল্প কয়েক দিনের মধ্যে পোস্ট্ মর্টেমের জন্য তুললে দেখা যায় যে , মৃতদেহটি ঠিক যেরূপ রাখা হয়েছিলো ঠিক সে রকমই রয়েছে।

অবশ্য মাঝে মাঝে বিভিন্ন ধরনের ব্যতিক্রমী ঘটনার কথা মুখে মুখে প্রচার হতে শুনা যায়। যেমন : বলা হয় যে , অমুক জায়গায় জনৈক পাপাচারী ব্যক্তির ক্ববর থেকে আগুন বেরিয়েছে , বা ক্ববর খুঁড়তে গিয়ে কিছুতেই খোঁড়া সম্ভব হচ্ছিলো না ; চারপাশ থেকে মাটি এসে ক্ববর ভরে যাচ্ছিলো বিধায় তাকে মাটিচাপা দেয়া হয় , ইত্যাদি। এগুলো সাধারণতঃ বানানো গল্প অথবা কারসাযী। ক্ষেত্রবিশেষে শুনা যায় যে , ক্ববর স্থানান্তরের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন পরেও নেককার ব্যক্তির মৃতদেহ স্যাঁতসেঁতে জায়গায়ও পচনমুক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এর অবশ্য স্বাস্থ্যবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছে।

অবশ্য আল্লাহ্ তা আলা চাইলে বান্দাহদের শিক্ষা দেয়া ও সতর্ক করার জন্য যে কোনো সময় যে কোনো ধরনের অলৌকিক বা অসাধারণ ঘটনা সংঘটিত করতে পারেন , কিন্তু মানুষকে আল্লাহ্ আক্বল্ দিয়েছেন এবং এরপরও তার হেদায়াতের জন্য কোরআন মজীদ নাযিল করেছেন ; অতঃপর সাধারণভাবে কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির বরখেলাফে কোনো কিছু না করাই আল্লাহ্ তা আলার সুন্নাত্। এমনকি যে সব ক্ষেত্রে গণ-আযাব্ বা ব্যক্তিগত আযাব নাযিল করা হয় তা-ও সাধারণতঃ প্রাকৃতিক বিধানে শক্তিসঞ্চারের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে।

ক্ববর আযাব্ সংক্রান্ত ঐ সব ব্যাখ্যায় আরো সমস্যা আছে। তা হচ্ছে , ক্ববর আযাবের জন্য মাটির ক্ববর এবং মরদেহে রূহ্ ” প্রত্যাবর্তন করানো শর্ত হলে যাদের দেহ মমি করে রাখা হয় বা পুড়িয়ে ফেলা হয় অথবা পচেগলে পানিতে মিশে যায় বা মাছের পেটে চলে যায় অথবা পচেগলে না গিয়েই বাঘের পেটে বা কুমীরের পেটে চলে যায় তাদের জন্য ক্ববর আযাব হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ার কথা। তাহলে অবস্থাটা কেমন দাঁড়ালো ? একজন গুনাহ্গার মুসলমান ক্ববরের সওয়াল্-জবাব ও ক্ববর আযাবের মুখোমুখি হবে , আর যে অমুসলিমের মৃতদেহ মমি করে রাখা হয়েছে সে এ আযাব থেকে বেঁচে যাবে ?! সুতরাং সুস্পষ্ট যে , সওয়াল্-জবাব্ ও ক্ববর আযাবের এ ধরনের ব্যাখ্যা আদৌ ঠিক নয়।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা অপরিহার্য মনে করছি যে , সমস্ত মানুষের মধ্যে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে প্রদত্ত সর্বজনীন মানদণ্ড ‘ আক্বল্ (বিচারবুদ্ধি)- যা প্রয়োগের জন্য কোরআন মজীদ বার বার তাকিদ করা হয়েছে , আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ হেদায়াত্ কোরআন মজীদ , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) থেকে প্রতিটি স্তরে বিরাট সংখ্যক সূত্রে বর্ণিত তথা মুতাওয়াতির্ হাদীছ - যা তাঁর পক্ষ থেকে বর্ণিত বলে প্রত্যয় সৃষ্টি হয় এবং ইসলামের প্রথম যুগের সমগ্র উম্মাহর সর্বসম্মত বিষয়সমূহ (ইজমা ‘ এ উম্মাহ্) - যা নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর সুন্নাতের উদ্ঘাটনকারী-ব্যতীত অন্য কোনো দলীলের দ্বারাই ইসলামী আক্বাএদের তিন মূলনীতির (তাওহীদ্ , আখেরাত্ ও নবুওয়াতের) শাখা-প্রশাখা সমূহ এবং ফরয ও হারামের কোনো বিষয়ই প্রমাণিত হয় না।

হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের দুই শতাধিক বছর পরে সংকলিত হাদীছগ্রন্থ সমূহে স্থানপ্রাপ্ত কোনো না কোনো স্তরে , বিশেষ করে প্রথম দিককার কোনো স্তরে কম সূত্রে বর্ণিত (খবরে ওয়াহেদ্) হাদীছ কেবল উপরোক্ত চার অকাট্য জ্ঞানসূত্রের কোনোটির সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়া সাপেক্ষে গৌণ (মুস্তাহাব্ ও মাকরূহ্) ও প্রায়োগিক বিষয়ে গ্রহণযোগ্য। এমনকি মুতাওয়াতির্ হাদীছ্ বা ইজমা ‘ এ উম্মাহ্ও যদি আক্বল্ বা কোরআন মজীদের সাথে সাংঘর্ষিক হয় (যদিও কার্যতঃ এরূপ হয় না , তবুও তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি যে , যদি হয়) তাহলে সংশ্লিষ্ট হাদীছের তাওয়াতোরে সন্দেহ করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট ইজমা ভুলের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে গণ্য করতে হবে। মোদ্দা কথা , আক্বল্ ও কোরআন মজীদের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু গ্রহণযোগ্য নয় এবং এমন যা কিছু নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর নামে বর্ণিত হয়েছে তাকে তাঁর নামে রচিত বলে গণ্য করতে হবে।

সুতরাং মৃত্যুর অব্যবহিত পরবর্তী ও পুনরুত্থান পূর্ববর্তী জগত অর্থাৎ আালামে বারযাখের অবস্থা সম্বন্ধে কথা বলার জন্য আক্বল্ ও কোরআন মজীদের দলীল অপরিহার্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে , এ বিষয়ে ওয়ায্-নছ্বীহতে ও বই-পুস্তকে আক্বল্ ও কোরআন মজীদের দলীল ব্যবহার করতে দেখা যায় না। ফলে ইসলামের সকল বিষয়ের ব্যাপারেই সংশয় সৃষ্টি করা যাদের কাজ তারা ক্ববর আযাব্ সংক্রান্ত প্রচলিত ধারণা প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে আালামে বারযাখের সত্যতাই অস্বীকার করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেদেরকে খাঁটি ইসলামের সমর্থক হিসেবে দাবী করে ওলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালাতে গিয়ে এ সব বিষয়কে কাজে লাগায় এবং বলে যে , ক্ববর আযাবের বিষয়টি মোল্লা ’ দের আবিষ্কার ; ইসলামে এর কোনো ভিত্তি নেই। আর যেহেতু প্রচলিত ধারণায় মৃত্যুর পরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী অবস্থা বলতে কেবল সওয়াল-জবাব ও ক্ববর আযাবের কথা বলা হয় , ফলে এটি অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে কার্যতঃ আালামে বারযাখের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হয়।

বিশেষ করে বিগত বিংশ শতাব্দীর নব্বই-এর দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশে ইসলাম , ইসলামের মৌলিক চৈন্তিক ভিত্তিসমূহ ও এর শাখা-প্রশাখা সমূহ এবং এর গুরুত্বপূর্ণ বিধি-বিধানসমূহের ওপর পরিকল্পিত হামলা চালানো হচ্ছে। এক শ্রেণীর পত্রপত্রিকা এবং বুদ্ধিজীবী হবার দাবীদার এক শ্রেণীর লোক এ অভিযানের প্রথম কাতারে স্থান গ্রহণ করেছে। তারা ইসলামের বিরুদ্ধে হামলা চালাবার ছোট-বড় কোনো সুযোগই হাতছাড়া করে না। এদের মধ্যে কতক লোক নিজেদেরকে ইসলাম সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ বলেও দাবী করে থাকে , যদিও ইসলাম সম্পর্কে তাদের কোনো মৌলিক জ্ঞান নেই. বরং ইসলাম-বিদ্বেষী পশ্চিমা প্রাচ্যবিদদের বিদ্বিষ্ট বই-পুস্তক থেকে প্রাপ্ত বিকৃত ধারণাই হচ্ছে এদের ইসলাম সংক্রান্ত জ্ঞানের একমাত্র সম্বল।

এ ধরনের একজন ইসলাম-বিশেষজ্ঞ সাজা ব্যক্তি ইসলাম-বিরোধী হিসেবে কুখ্যাত একটি দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন। ১৯৯৬-র মাঝামাঝি সময়ে পত্রিকাটির এক সংখ্যায় তিনি ক্ববর আযাব্ অস্বীকার করে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। তিনি দাবী করেন যে , ইসলামে এর কোনো ভিত্তি নেই। এছাড়াও ঐ ব্যক্তি উক্ত কলামে আমার ইসলামী রাষ্ট্র ও নেতৃত্ব গ্রন্থের মনগড়া সমালোচনা করেন , কিন্তু আমি তা খণ্ডন করে বক্তব্য দিলে তা প্রকাশ করা হয় নি। এছাড়াও তাঁর আরো কতক লেখার ভ্রান্তি নির্দেশ করে বক্তব্য দিলে তা-ও প্রকাশ করা হয় নি।

পরবর্তীকালে ঐ ব্যক্তি সাপ্তাহিক রোববার-এ নিয়মিত ইসলাম বিষয়ক কলাম লিখতে শুরু করলে এবং তাতে বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকলে আমি তা খণ্ডন করে বক্তব্য দিতে থাকি এবং রোববার কর্তৃপক্ষ তা প্রকাশ করতে থাকেন। পর পর অনেকগুলো সপ্তাহ্ উভয়ের মধ্যে বিতর্ক চলতে থাকলে এবং ঐ ব্যক্তির প্রতিটি লেখাই ফালতু প্রমাণিত হলে রোববার কর্তৃপক্ষ ঐ ব্যক্তির কলামটি বন্ধ করে দেন। সম্ভবতঃ একই কারণে , উল্লিখিত দৈনিকটি থেকেও তাঁকে বিতাড়িত হতে হয়।

ইসলাম-বিরোধী হিসেবে কুখ্যাত দৈনিকটিতে যখন ক্ববর আযাব অস্বীকার করে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় আমি তখন দৈনিক আল্-মুজাদ্দেদ-এর ইসলাম ও ঐতিহ্য ’ বিভাগে কর্মরত ছিলোম। তখন আমাকে ক্ববর আযাব বিষয়ে একটি প্রামাণ্য প্রবন্ধ লিখতে বলা হয়। কিন্তু প্রস্তুতি নিতে গিয়ে অনুভব করলাম যে , এ বিষয়ে বিস্তারিত ও দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

ঐ সময় দৈনিক আল্-মুজাদ্দেদ-এ (অন্য এক বিভাগে) কর্মরত আমার সাবেক সহকর্মী (আমি বার্তাবিভাগে কর্মরত থাকাকালীন সহকর্মী) হিরণ ভাই (শহীদুল হক হিরণ -মরহূম কবি মোজাম্মেল হক-এর পুত্র) এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখার জন্য অমাকে বার বার অনুরোধ জানান। কিন্তু আল্-মুজাদ্দেদ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বেশী দীর্ঘ লেখা না লেখার জন্য নির্দেশ ছিলো। এ সত্ত্বেও আমি আমার নিজস্ব বিন্যাসে ইসলামের দৃষ্টিতে আালামে বারযাখ্ ” প্রবন্ধ রচনা করি। ১৯৯৬-র ১৬ই ও ২১শে নভেম্বর সংখ্যায় প্রবন্ধটির প্রথম দুই অংশ প্রকাশিত হবার পর এটির প্রকাশ তিন সপ্তাহ্ স্থগিত থাকে। এরপর ১৫ই , ১৮ই ও ১৯শে ডিসেম্বর প্রবন্ধটির বাকী তিন অংশ প্রকাশিত হয়।

ঐ সময়ই পরবর্তীকালে প্রবন্ধটিকে পুস্তিকা আকারে প্রকাশের চিন্তা মাথায় আসে। হিরণ ভাইও এর প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

মূল প্রবন্ধটি যে বিন্যাসে লিখেছিলাম আল্-মুজাদ্দেদে প্রকাশকালে তাতে কিছু পরিবর্তন আনা হয় -যার উদ্দেশ্য ছিলো সংক্ষেপকরণ। ফলে বক্তব্যে সামান্য বিন্যাসদুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। তাই অত্র গ্রন্থে প্রবন্ধটি পুনর্বিন্যস্ত করি , কিন্তু তাতে হয়তো বিন্যাসের দুর্বলতা পুরোপুরি দূরীভূত হয় নি। এতে উপশিরোনামসমূহ ও কোরআন মজীদের মূল আয়াত সমূহ পরে সংযোজন করি। এছাড়া প্রয়োজন অনুভূত হওয়ায় আরো কিছু বক্তব্য সংযোজন করি যার ফলে মূল প্রবন্ধটির আয়তন বৃদ্ধি পায়।

অভিন্ন বিষয়বস্তুর সাথে সংশ্লিষ্ট বিধায় তখন এ গ্রন্থে“‘ আালামে বারযাখে শহীদের জীবন ” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ সংযুক্ত করি। প্রবন্ধটির মূল শিরোনাম এটি হলেও সামান্য পরিবর্তিত শিরোনামে এটি ২৭শে সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সংখ্যা আল্-মুজাদ্দেদ-এ প্রকাশিত হয়েছিলো। গ্রন্থের বক্ষ্যমাণ বিন্যাসে উক্ত প্রবন্ধটিকে মূল আলোচনায় একীভূত করেছি।

আলোচ্য বিষয় অনুধাবনে সহায়ক হবে বিবেচনায় গ্রন্থের শেষাংশে রূহ্ , নাফ্স্ ও জিসমে মিছালী ” এবং“‘ আলামে মিছাল্ ও আালামে বারযাখ্ ” শীর্ষক আরো দু টি প্রবন্ধ সংযোজন করি। প্রবন্ধ দু টি একাধিক বার যথেষ্ট পরিবর্তনের মাধ্যমে সর্বশেষ রূপ লাভ করে। এছাড়া আল্-মুজাদ্দেদ-এ কর্মরত থাকাকালে কর্তৃপক্ষীয় তাগাদায় দর্শন , ইরফান্ ও কোরআনের দৃষ্টিতে রূহ্ ও নাফ্স্ ” শীর্ষক আরেকটি প্রামাণ্য প্রবন্ধ রচনায় হাত দেই। কিন্তু প্রবন্ধটির প্রথম কিস্তি লেখার পরে পরিকল্পনায় পরিবর্তন ঘটে এবং লিখিত অংশের প্রথমার্ধ নিয়ে একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধের রূপ দেয়া হয়। পারবর্তীকালে এটিকে কিঞ্চিৎ সম্প্রসারিত করে আমার লেখা নূরে মুহাম্মাদীর মর্মকথা গ্রন্থে পরিশিষ্ট আকারে সংযোজন করি। এটিকে অধিকতর সম্প্রসারিত ও পুনর্বিন্যস্ত করে বর্তমান গ্রন্থে সন্নিবেশিত রূহ্ , নাফ্স্ ও জিসমে মিছালী ” প্রবন্ধের রূপ দেই। গ্রন্থের বক্ষ্যমাণ বিন্যাসে এটি সংশোধিত রূপে কোরআন মজীদে ও দর্শনে আালামে বারযাখের তাৎপর্য ’ শিরোনামে সংযোজিত হয়েছে। এছাড়া ঐ সব লেখা পুনর্বিন্যাসকালে কিছু নতুন উপশিরোনাম যোগ করেছি।

এখানে কৈফিয়ত স্বরূপ দু টি বিষয় উল্লেখ করা যরূরী মনে করছি। প্রথম বিষয়টি এই যে , অত্র গ্রন্থটি গ্রন্থরচনার পরিকল্পনার ভিত্তিতে রচিত হয় নি , বরং , ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , পত্রিকায় প্রকাশের জন্য প্রবন্ধ হিসেবে লেখা হয়েছিলো। পরে এটিকে সম্প্রসারিত করে গ্রন্থের রূপ দেয়ার ফলে বিন্যাসে দুর্বলতা ছাড়াও কিছু কথার পুনরুক্তি এড়ানো সম্ভবপর হয় নি। দ্বিতীয় বিষয়টি এই যে , মানুষের অবস্তুগত সত্তার সংখ্যা ও নাম নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। এ নিয়ে অত্র গ্রন্থে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করা হলেও মূল প্রবন্ধটি রচনাকালে সংবাদপত্রের সাধারণ পাঠক-পাঠিকাদের বোধগম্যতার প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রধানতঃ রূহ্ ’ বা আত্মা ’ ব্যবহার করা হয়েছে। অবশ্য পরবর্তীকালীন সংযোজনসমূহে প্রধানতঃ নাফ্স্ ’ বা ব্যক্তিসত্তা ’ ব্যবহার করা হয়েছে - যা অধিকতর যথার্থ। এ ক্ষেত্রে পরিভাষার বিভিন্নতা সত্ত্বেও যা বুঝাতে চাওয়া হয়েছে তা অভিন্ন অস্তিত্ব।

গ্রন্থটি একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশের কথা হলে তার ভিত্তিতে এটি কম্পোজ করা হয় এবং ২০০৩ সালের আগস্ট মাসে ট্রেসিং-প্রিন্ট্ তোলা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রকাশনাপ্রতিষ্ঠানটি গ্রন্থটি প্রকাশ করতে পারে নি। কয়েক বছর পর সংশ্লিষ্ট কম্পিউটারটির হার্ড ডিস্ক্ ক্র্যাশ্ করে এবং ট্রেসিংটিও নষ্ট হয়ে যায়। তবে সৌভাগ্যক্রমে এর সর্বশেষ প্রুফ্ কপিটি পাওয়া যায়। তা থেকেই বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটি কম্পোজ করা হলো ; কম্পোজের কাজ আমার নিজেকেই করতে হয়েছে। অবশ্য অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই নতুন কম্পোজকালে , বিশেষ করে স্বয়ং লেখক কর্তৃক কম্পোজের কারণে কিছু অংশ অপরিহার্য প্রয়োজনীয় নয় বা অকাট্য নয় বিবেচনায় বাদ দেয়া হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় বিবেচনায় নতুন কিছু বক্তব্য সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়া গ্রন্থের বিন্যাসকেও পূর্বাপেক্ষা উন্নততর করার চেষ্টা করা হয়েছে , যদিও পুরো দুর্বলতা দূর করা সম্ভব হয় নি। কারণ , তা করতে গেলে অনেক বেশী সময় ব্যয় করতে হতো , কিন্তু সে ক্ষেত্রে অন্যান্য ব্যস্ততার মাঝে তা কবে সমাপ্ত করা যেতো তার কোনো নিশ্চয়তা ছিলো না। বিশেষ করে কোনো কোনো ঘনিষ্ঠ জন এটির সফ্ট্ কপি পাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন , অন্যদিকে জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই সংক্ষিপ্ততম সময়ে যেভাবে সম্ভব হয়েছে কাজটি সমাপ্ত করার চেষ্টা করেছি।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা উল্লেখ করা প্রযোজন মনে করছি। তা হচ্ছে , গ্রন্থটি মূলতঃ বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্) ও কোরআন মজীদের দলীলের ভিত্তিতে প্রণীত। তা সত্ত্বেও এটি পত্রিকার জন্য রচনাকালে কোরআন মজীদের কতক তরজমা ও তাফসীর এবং কতক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ থেকে সাহায্য নেয়া রয়েছে। কিন্তু সে সব সূত্রের বক্তব্য হয় বিচারবুদ্ধির কাছে গ্রহণযোগ্য বিধায় গ্রহণ করা হয়েছে অথবা কোরআন মজীদের আয়াতের অধিকতর সঠিক অর্থ গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ঐ সব সূত্রের গৃহীত অর্থের সাথে গ্রন্থকার কর্তৃক গৃহীত অর্থকে মিলিয়ে দেখা হয়েছে। তাই দু একটি ব্যতিক্রম বাদে গ্রন্থমধ্যে কোথাও সুনির্দিষ্টভাবে ঐ সব সূত্রের সূত্রনির্দেশ করা হয় নি এবং আক্বল্ ও কোরআন ভিত্তিক রচনা হিসেবে তা উচিতও হতো না। তবে কোনো কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্যের ক্ষেত্রে সূত্রনির্দেশ করলে ভালো হতো। কিন্তু আমাদের দেশের দৈনিক পত্রিকার লেখায় সাধারণতঃ মশহূর বা সর্বজনস্বীকৃত তথ্যের ক্ষেত্রে লেখার ভিতরে প্রতিটি স্থানে সূত্রনির্দেশ করা প্রয়োজন মনে করা হয় না। তাই এ লেখাগুলোতেও তা করা হয় নি। পরে তা গ্রন্থের রূপ দেয়ার সময় কতক সূত্র হাতের কাছে না থাকায় এবং কতক সূত্র হাতের আওতায় থাকলেও সময়াভাবে তা নতুন করে খুঁজে বের করে যথাস্থানে নির্দেশ করা হয় নি। তবে গ্রন্থের শেষে এ ধরনের সবগুলো সহায়ক সূত্রের কথা এজমালীভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এখানে অকপটে স্বীকার করছি যে , কোরআন মজীদ ও আক্বলী দলীলের বাইরে যে সব তথ্যসূত্রের সাহায্য নিয়েছি তার মানে এ নয় যে , সে সব সূত্রের বক্তব্যকে অকাট্য বলে গণ্য করেছি। যেহেতু আলোচ্য বিষয়টি এমন যে , এ ক্ষেত্রে আক্বলের পক্ষে অনেক প্রশ্নের অকাট্য জবাব দেয়া দুরূহ ব্যাপার এবং কোরআন মজীদেও এ ব্যাপারে খুব বেশী কিছু বলা হয় নি ; অবশ্য কোরআন মজীদে যতোটুকু বলা হয়েছে তা থেকে সাধারণভাবে আালামে বারযাখের অস্তিত্ব এবং সেখানকার শাস্তি ও পুরষ্কারের বিষয়টি অকাট্য ; এবং অপরিহার্য তথ্য হিসেবে তা-ই যথেষ্ট। আর কোরআন মজীদ যেহেতু প্রতিটি বিষয়ের বর্ণনাকারী সেহেতু কোরআন থেকে সকল বিষয়ে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় বক্তব্যের বেশী আশা করা যায় না। কারণ , সব কিছুর বিস্তারিত বিবরণ দিতে গেলে তা এতো বিশাল আকার ধারণ করতো যে , তা আর সকলের জন্য ব্যবহারযোগ্য থাকতো না।

কিন্তু মানুষের ঔৎসুক্য অনেক বেশী। এ কারণেই অনেক আনুষঙ্গিক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আক্বল্ ও কোরআন মজীদ ছাড়াও অন্যান্য সূত্রের সাহায্য নিতে হয়েছে। তাই এ সব সূত্রের তথ্য উল্লেখ মানেই এ নয় যে , এগুলোকে অকাট্য গণ্য করছি। তেমনি এগুলো নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে যে সব যুক্তিতর্কের আশ্রয় নেয়া হয়েছে সেগুলোর অবস্থাও তা-ই। কারণ , কোনো অকাট্য বিষয়কে কেন্দ্র করে যুক্তিপ্রয়োগ থেকেই অকাট্য উপসংহারে উপনীত হওয়া যায় ; মূল বিষয়টি অকাট্য না হলে তা থেকে যুক্তিতর্ক ভিত্তিক উপসংহার দৃশ্যতঃ অকাট্য হলেও আসলে তা অকাট্য হবার নিশ্চয়তা থাকে না। যা-ই হোক , এ থেকে ভুল ধারণা সৃষ্টি না হয় সে উদ্দেশ্যেই বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন মনে করেছি।

আল্লাহ্ রাব্বুল আালামীনের দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া যে , অবশেষে গ্রন্থটি পুনরায় প্রকাশোপযোগী করা সম্ভবপর হলো। মূল গ্রন্থের পাদটীকাগুলো ইউনিকোডে মূল পাঠের ভিতরে তৃতীয় বন্ধনীর ভিতরে উল্লেখ করা হয়েছে।

মহান আল্লাহ্ এ গ্রন্থটিকে এর লেখক এবং পাঠক-পাঠিকাদের জন্য বারযাখী জীবনের ও পুনরুত্থানপরবর্তী জীবনের পাথেয়স্বরূপ করে দিন। আমীন।

নূর হোসেন মজিদী

ঢাকা

২৫শে রামাযান ১৪৩৬

২৯শে আষাঢ় ১৪২২

১৩ই জুলাই ২০১৫।

আালামে বারযাখ্ প্রসঙ্গ ও তার পটভূমি

তাওহীদ ও নবুওয়াতের পাশাপাশি আখেরাত্ বা মৃত্যুর পরে পুনর্জীবন ও পার্থিব জীবনের ভালো-মন্দ কর্মের প্রতিদানের ধারণা ইসলামের তিনটি মূলনীতির অন্যতম। তবে মানুষের জীবনে প্রভাবের বিচারে আখেরাতের ধারণাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ , আখেরাতের ধারণা গ্রহণ না করলে তাওহীদ ও নবুওয়াতের ধারণার বাস্তব জীবনে কোনো প্রভাবই হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। সে ক্ষেত্রে তাওহীদ ও নবুওয়াতের ধারণা স্রেফ একটি তাত্ত্বিক জ্ঞানের বিষয়ে পর্যবসিত হতে বাধ্য।

মুসলমানদের মধ্যে আখেরাত্ সংক্রান্ত বিস্তারিত ধারণায় খুটিনাটি মতপার্থক্য থাকলেও , বিশেষ করে কোরআন মজীদের বহু আয়াতে এ সম্বন্ধে উল্লেখ থাকায় এ সংক্রান্ত মৌলিক ধারণা ও এর গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো সম্বন্ধে সকলেই অভিন্ন মত পোষণ করে থাকে। তা হচ্ছে , আল্লাহ্ তা আলার ইচ্ছায় এক সময় গোটা সৃষ্টিলোক ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং ঐ সময় জীবিত প্রতিটি প্রাণশীল সৃষ্টিই মৃত্যুবরণ করবে। এরপর আল্লাহ্ তা আলার ইচ্ছায় এক নতুন জগত সৃষ্টি হবে। তখন সৃষ্টির শুরু থেকে ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে আগত ও আগতব্য সকল প্রাণশীল সৃষ্টিকেই দেহধারী করে পুনর্জীবিত করা হবে। অতঃপর ইহজীবনে তারা যা কিছু করেছে তার ভালো-মন্দ বিচার করে পুরষ্কার ও শাস্তি প্রদান করা হবে।

কিন্তু ক্বিয়ামত্ সংঘটিত হতে এখনো বাকী আছে। ঠিক কী পরিমাণ সময় বাকী আছে তা স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা ব্যতীত কারো জানা নেই ; হতে পারে তা কয়েক বছর , হতে পারে কয়েক কোটি বছর। তবে এটা সুস্পষ্ট যে , যারা অনেক আগেই মৃতুবরণ করেছে তারা এখন শেষ বিচারের জন্য অপেক্ষা করছে এবং যারা এখন মৃত্যুবরণ করছে ও পরে মৃত্যুবরণ করবে তাদেরকেও অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু মৃত্যুর পরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী সময়টা তাদের কী অবস্থায় কাটছে ও কাটবে - এ ব্যাপারে মানুষের ঔৎসুক্যের কোনো সীমা নেই।

আমাদের বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে প্রায় সর্বজনীনভাবে প্রচলিত সাধারণ আক্বীদাহ্ এই যে , মৃত্যুর পরে যখন একজন মানুষকে ক্ববর দেয়া হয় তখন দু জন ফেরেশতা এসে তাকে ঈমান ও আক্বীদাহ্ সম্পর্কে প্রশ্ন করে এবং গুনাহ্গার লোকেরা সে সব প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারে না বিধায় তাদেরকে ক্ববরে শস্তি দেয়া হয়। এরপর ভালো লোকদের আত্মাকে ইল্লীন্ (সমুন্নত ধাম) নামক উত্তম স্থানে আরামে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় এবং গুনাহ্গারদের আত্মাকে সীজ্জীন্ (কারাগার) নামক এক কষ্টকর অবস্থায় রাখা হয় ; পুনরুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত তারা এ অবস্থায়ই থাকবে। অবশ্য কিছু কিছু বই-পুস্তকে মৃত্যুর পরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী জগতকে আালামে বারযাখ্ বলে উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় বটে - যার নামকরণ অবশ্যই সঠিক , কিন্তু এ জগতের অবস্থা সম্বন্ধে উপরোক্ত সওয়াল্-জবাব ও ক্ববর আযাব ছাড়া আর কোনো কিছুর উল্লেখ তেমন একটা দেখা যায় না।

এ বিষয়ে আমাদের দেশে প্রচলিত দ্বীনী বই-পুস্তকে ও ওয়ায্ মাহ্ফিলে মৃত্যুপরবর্তী জগত প্রসঙ্গে স্ববিরোধিতাও দেখা যায়। কারণ , অনেক সময় ক্ববরের সওয়াল-জবাবের পর পরই গুনাহ্গারদের জন্য ক্ববর আযাব ও এরপর দ্বীনদারদের জন্য ঈল্লীন্ ও গুনাহ্গারদের জন্য সিজ্জীনের কথা বলা হয়। আবার অনেক সময় গুনাহ্গারদের জন্য দীর্ঘস্থায়ী আযাবের কথা এবং নেককারদের আত্মাকে কোনোরূপ পুরষ্কার না দিয়ে আচ্ছন্ন অবস্থায় রেখে দেয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু ক্ববরের জগতে অর্থাৎ আালামে বারযাখে যে সুখ-শান্তি আছে সে সম্পর্কে তেমন কোনো আলোচনা করা হয় না। এছাড়া দো ‘ আ ও দান-ছ্বাদাক্বাহ্ থেকে ছ্বাওয়াব্ পাওয়ার আশায় আত্মাদের স্বজনদের কাছে এসে ঘোরাফেরার কথাও বলা হয়।

মোদ্দা কথা , এ বিষয়ে প্রচলিত ধ্যানধারণায় কোনো একক ও সুনির্দিষ্ট কাঠামো অনুপস্থিত এবং এতে অস্পষ্টতা , বিক্ষিপ্ততা ও স্ববিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। তবে ক্ববর আযাব্ ” একটি সর্বজনীন ও বহুলপরিচিত পরিভাষা। যেহেতু এ বিষয়ে যারা আলোচনা করেন তাঁদের আলোচনার পিছনে মূল উদ্দেশ্য হয় মানুষকে ভয় দেখিয়ে গুনাহ্ থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করা , সেহেতু এতদসংক্রান্ত লেখা ও ওয়ায্-নছ্বীহতের শতকরা পঁচানব্বই ভাগই ক্ববর আযাব ” সংক্রান্ত।

এছাড়া একদিকে যেমন আালামে বারযাখ্ বা ক্ববরের জগতের প্রকৃত অবস্থা তথা সেখানকার সুখ-দুঃখ সম্বন্ধে যেমন অস্পষ্টতা ও বিতর্ক রয়েছে , তেমনি সাম্প্রতিক কালে ইসলাম-বিশেষজ্ঞ হবার দাবীদার কোনো কোনো লোকের পক্ষ থেকে এরূপ একটি জগতের অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে অর্থাৎ তাঁরা আত্মার অস্তিত্ব ও শেষ বিচারের বিষয়টি স্বীকার করলেও আালামে বারযাখ্ বা ক্ববরের জীবনের অস্তিত্ব অস্বীকার করছেন।

এদের মতে , মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মধ্যবর্তী সময়টা ঘুমের মতো। অর্থাৎ মৃতদের আত্মা কোটি কোটি বছর ঘুমের মতো অবস্থায় কাটিয়ে দেবে , এরপর তারা দেহধারী হয়ে পুনরুত্থিত হবে। তাঁরা মৃত্যুর পরে ও পুনরুত্থানের আগে মৃতদের নাফ্স্-এর (প্রচলিত কথায় আত্মার) জন্য কোনোরূপ আনন্দ-বিষাদ , ভালো-মন্দ বা পুরষ্কার ও শাস্তির ধারণা মেনে নিতে রাযী নন। এ প্রসঙ্গে তাঁরা যুক্তি উপস্থাপন করেন যে , ব্যক্তি পাপ-পুণ্য যা-ই করে থাকুক না কেন , বিচারের আগে তাদের শাস্তি বা পুরষ্কার লাভের (অল্প মাত্রায় হলেও) ধারণা অযৌক্তিক।

বিষয়টি এখানেই শেষ নয় , সাম্প্রতিক কালে এ ব্যাপারে দৃশ্যতঃ বুদ্ধিবৃত্তিক ধরনের কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ভ্রমাত্মক এমন ধরনের প্রচারণাও চালানো হয়েছে এবং প্রচারমাধ্যমের বদৌলতে তা বহু মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে - যা অনেকের মনে সংশয় ও চৈন্তিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে থাকতে পারে।

অবশ্য আলমে বারযাখ্ অস্বীকারকারীদেরকে একতরফাভাবে দোষারোপ করা ঠিক হবে না। কারণ , ইসলামের দৃষ্টিতে আালামে বারযাখ্ সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা পেশ না করা এবং ক্ববরের জীবনের অবস্থা সংক্রান্ত প্রচলিত ওয়ায্-নছ্বীহত্ ও এতদসংক্রান্ত বই-পুস্তকে সুচিন্তিত ও সুবিন্যস্ত বক্তব্যের পরিবর্তে এলোমেলো ও অগভীর বক্তব্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তাশীল লোকদের মনে এ ব্যাপারে সংশয় সৃষ্টি করবে - এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে ঐ সব ওয়ায্-নছ্বীহত্ ও এতদ্সংক্রান্ত বই-পুস্তকে আক্বল্ ও কোরআন মজীদের দলীল - যা অকাট্য দলীল - কদাচিৎ ব্যবহার করা হয় এবং যে সব হাদীছ উদ্ধৃত করা হয় সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা পরীক্ষা করা হয় না। এছাড়া কোরআন-হাদীছ বহির্ভূত এমন অনেক কিচ্ছা-কাহিনী জুড়ে দেয়া হয় যেগুলো প্রামাণ্য নয় এবং দলীল হিসেবে যেগুলোর কোনোই গ্রহণযোগ্যতা নেই। ফলে এ ধরনের দুর্বল উপস্থাপনা মূল প্রতিপাদ্য বিষয়কেই দুর্বল হিসেবে প্রতিপন্ন করে।

কিন্তু কোনো প্রতিপাদ্য বিষয়কে দুর্বলভাবে উপস্থাপন করা হলেই যে , মূল বিষয়টি বাত্বিল বলে গণ্য হবে এমন কোনো কথা নয়। বরং কোনো বিষয়কে (মূল বিষয়কে , বিস্তারিত বক্তব্যকে নয়) গ্রহণ ও বর্জন উভয় ক্ষেত্রেই অকাট্য দলীল-প্রমাণ অপরিহার্য। তাই মৃত্যুপরবর্তী ও পুনরুত্থানপূর্ববর্তী জগতের সুখ-দুঃখের বিষয়টিকেও কেবল অকাট্য দলীল-প্রমাণের আলোকে গ্রহণ বা বর্জন করতে হবে।

এখানে আলোচ্য বিষয়টিকে দুই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে : মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সর্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে এবং বিশেষভাবে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে।

এ প্রসঙ্গে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে , যেহেতু বিষয়টি জীবিত মানুষদের অভিজ্ঞতার জগতের বহির্ভূত একটি বিষয় সেহেতু এ ব্যাপারে সর্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো ফয়ছ্বালায় উপনীত হওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। আর সর্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো ফয়ছ্বালায় উপনীত হওয়া সম্ভব না হলে সে ক্ষেত্রে বিষয়টি যেমন সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়া অপরিহার্য হবে না তেমনি তা অকাট্যভাবে বাত্বিল বা বর্জনীয় বলেও গণ্য করা যাবে না। কারণ , কোনো বিষয়ে অকাট্য জ্ঞানে উপনীত হতে না পারার মানে কখনোই মূল জ্ঞাতব্য অজ্ঞেয় বিষয়টির অনস্তিত্ব নয়। অন্যদিকে বিষয়টি জীবিত মানুষদের অভিজ্ঞতার বহির্ভূত বিধায় এ ব্যাপারে ইসলামী সূত্রসমূহের অকাট্য ফয়ছ্বালা মেনে নেয়া মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য। তবে কোনো ফয়ছ্বালা কেবল তখনই ইসলামী ফয়ছ্বালা হিসেবে পরিগণিত হবে যখন তা অকাট্য দলীলের ভিত্তিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি প্রমাণের জন্য অবশ্যই যে কোনো ধরনের দুর্বল , বিতর্কিত ও সংশয়মূলক দলীলের (তাকে যদি ছ্বহীহ্ বলে দাবী ’ করা হয়েও থাকে) আশ্রয়গ্রহণ পরিহার করতে হবে। কারণ , কোনো সঠিক বিষয় প্রমাণের ক্ষেত্রে দুর্বল , বিতর্কিত ও সংশয়মূলক দলীলের আশ্রয়গ্রহণ মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতাকেই সংশয়াপন্ন করে তোলে , এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তাকে প্রত্যাখ্যাত করে তোলে। তাই এ বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টি প্রমাণের বেলায় কেবল অকাট্য ইসলামী জ্ঞানসূত্র অর্থাৎ আক্বল্ ও কোরআন মজীদ এবং এ দুই মানদণ্ডের বিচারে অকাট্য প্রমাণিত সূত্রের আশ্রয় নেয়া যাবে ; এর বহির্ভূত অন্য যে কোনো দলীল থেকে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়। অবশ্য যে সব ক্ষেত্রে , প্রধানতঃ শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ে , ফয়ছ্বালায় উপনীত হওয়ার জন্য অকাট্য দলীল পাওয়া যায় না সে সব ক্ষেত্রে কেবল সম্ভাব্য জবাব ’ হিসেবে অন্যান্য সূত্রের বক্তব্যকে বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্)-এর আলোকে বিশ্লেষণ করে গ্রহণ করা যেতে পারে।

বিচারবুদ্ধির মানদণ্ড কেন

আমরা আমাদের আলোচনায় প্রধানতঃ তিনটি অকাট্য জ্ঞানসূত্রের আশ্রয় নিয়েছি , তা হচ্ছে : বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্) , কোরআন মজীদ ও প্রথম যুগ থেকে চলে আসা মুসলমানদের সর্বসম্মত মত ও আমল - যাকে আমরা ইজমা ‘ এ উম্মাহ্ নামকরণ করেছি - যা অকাট্যভাবে সুন্নাতে রাসূল (ছ্বাঃ)-এর উদ্ঘাটনকারী। অবশ্য আমরা বস্তুবিজ্ঞানের ও অভিজ্ঞতার অকাট্য দলীলও বিবেচনায় নিয়েছি , তবে তা বিচারবুদ্ধির দলীলেরই সম্প্রসারণ হিসেবে মাত্র।

তিনটি কারণে আলোচ্য বিষয়ে বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্)কে অন্যতম মানদণ্ড বা অকাট্য জ্ঞানসূত্র হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। প্রথমতঃ প্রতিপাদ্য বিষয়কে সর্বজনীনকরণ অর্থাৎ বিষয়টিকে শুধু মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখা , দ্বিতীয়তঃ সাম্প্রতিককালে মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী চিন্তাধারার প্রভাব বৃদ্ধির কারণে যে সব ক্ষেত্রে কোরআন মজীদে সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে এমন অনেক বিষয়েও বিচারবুদ্ধির দলীল ছাড়া অনেক লোকের পক্ষেই মানসিক নিশ্চিন্ততার অধিকারী হওয়া সম্ভবপর হয় না। তৃতীয়তঃ স্বয়ং কোরআন মজীদ বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্) কাজে লাগানোর ওপর বার বার তাকিদ করেছে।

বস্তুবাদীরা বস্তুর বাইরে কোনো অবস্তুগত অস্তিত্ব আছে বলে স্বীকার করে না। এ কারণে তারা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণশীল অস্তিত্বকে বস্তুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল বলে দাবী করে অর্থাৎ তারা বস্তু-উর্ধ আত্মার (নাফ্স্-এর) এবং সৃষ্টিকর্তা ও পরকালের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। ফলে স্বভাবতঃই তারা আালামে বারযাখ্ বা ক্ববরের জীবনের অস্তিত্বও স্বীকার করে না। কিন্তু সুস্থ বিচারবুদ্ধি মানুষের বস্তুগত শরীর জুড়ে অবস্থানরত বস্তু-উর্ধ সত্তা (নাফ্স্/ আত্মা) ও সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব এবং পরকালের দৃঢ় সম্ভাবনার পক্ষে রায় প্রদান করে ; কেবল অন্ধ প্রবৃত্তিপূজারীদের পক্ষেই সে রায় প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব। [এ বিষয়ে আমি আমার জীবন জিজ্ঞাসা গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।]

দ্বিতীয়তঃ বিচারবুদ্ধির দলীল পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী চিন্তাধারায় প্রভাবিত মুসলমানদের ঈমানী দুর্বলতা দূরীকরণে সহায়ক হয়। বিশেষ করে যারা বস্তুবাদী চিন্তাধারার প্রভাবে কোরআন মজীদের আয়াতের সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বক্তব্যকেও রূপকভাবে ব্যাখ্যা করতে অভ্যস্ত বিচারবুদ্ধির দলীল তাদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূরীকরণে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়।

বিচারবুদ্ধির মানদণ্ডের গ্রহণযোগ্যতা

[এ সম্পর্কে আমার জীবন জিজ্ঞাসা গ্রন্থের বিচারবুদ্ধি ও ইসলাম ’ শীর্ষক প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি ; এখানে সংক্ষিপ্ত আভাস দেয়া হলো।]

ইসলামের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে সুস্থ বিচারবুদ্ধির প্রয়োগে উৎসাহিত করা এবং ইসলাম তার মৌলিক দাও ‘ আত্-কে সুস্থ বিচারবুদ্ধির কাছেই উপস্থাপন করেছে। কিন্তু এ বিষয়টি সম্বন্ধে সচেতন না থাকার কারণে অনেকেই দ্বীনের মৌলিক উপস্থপনাসমূহের ব্যাপারে বিচারবুদ্ধির দ্বারস্থ হওয়ার বিরোধিতা করেন। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে : বিচারবুদ্ধি ভুল করতে পারে।

তাঁদের এ যুক্তির জবাব হচ্ছে এই যে , জীবন ও জগতের পিছনে নিহিত মহাসত্য সম্পর্কিত মৌলিক প্রশ্নাবলীর জবাবে সুস্থ বিচারবুদ্ধি ( আক্বলে সালীম্)-এর ভুল করার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়। আর বিচারবুদ্ধি যদি ভুল করেও , তো তা বিচারবুদ্ধিভিত্তিক পর্যালোচনার সাহায্যে চিহ্নিত করতে সক্ষম। অর্থাৎ কেউ যদি বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভুল করে থাকে তো পরবর্তীতে তার নিজের বিচারবুদ্ধিই , অথবা অন্যদের কারো না কারো বিচারবুদ্ধি তা ধরতে সক্ষম হবে।

এ প্রসঙ্গে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে , ইসলাম অন্যান্য ধর্মের ন্যায় কোনো ধর্ম নয়। অন্য সমস্ত ধর্ম অন্ধ বিশ্বাসের নিকট আবেদন করে , কিন্তু ইসলাম তার বিপরীতে মানুষের বিচারবুদ্ধির নিকট আবেদন করে। যারা একাধিক খোদার বা দেবদেবীর অস্তিত্বে বিশ্বাস পোষণ করে তাদের সে বিশ্বাসের পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। আসলে একই বিষয়ে অন্ধ বিশ্বাস ও যুক্তি একত্রে চলতে পারে না। অন্যদিকে ইসলাম জীবন ও জগতের পিছনে নিহিত মহাসত্য সম্বন্ধে বিচারবুদ্ধির দলীল অর্থাৎ যুক্তি উপস্থাপন করেছে। স্বয়ং কোরআন মজীদ আল্লাহ্ তা আলার অস্তিত্ব ও একত্ব প্রমাণ করার জন্য যুক্তি উপস্থাপন করেছে , যেমন , আল্লাহ্ তা আলার একত্ব প্রমাণের লক্ষ্যে বলেছে :

) لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ إِلا اللَّهُ لَفَسَدَتَا(

“ এতদুভয়ে (আসমান ও যমীনে) যদি আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোনো ইলাহ্ থাকতো তাহলে এতদুভয় ধ্বংস হয়ে যেতো। ” (সূরাহ্ আল্-আম্বিয়া ’ : ২২)

এভাবে তাওহীদ , আখেরাত ও নবুওয়াত্ প্রশ্নে কোরআন মজীদ বহু বিচারবুদ্ধিগ্রাহ্য দলীল বা যুক্তি উপস্থাপন করেছে। এভাবে বিচারবুদ্ধির দলীল উপস্থাপনের কারণ এই যে , আল্লাহ্ তা আলা সকল মানুষকে জীবন ও জগতের পিছনে নিহিত মহাসত্য খুঁজে পাবার ক্ষমতা স্বরূপই বিচারবুদ্ধি দান করেছেন। তাই সকল মানুষের নিকট অভিন্নভাবে গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড হচ্ছে বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্) । অন্যান্য ধর্ম যেভাবে তাদের মৌলিক উপস্থাপনাগুলোকে অন্ধ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তিশীল করেছে ইসলামও যদি সেভাবেই মানুষের কাছে অন্ধ বিশ্বাসের ভিত্তিতে আবেদন পেশ করতো তাহলে ইসলামের আবেদন সত্য হওয়া সত্ত্বেও কেউ তা গ্রহণ করতো না। কারণ , অন্ধ বিশ্বাসের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এই যে , প্রতিটি ব্যক্তিই নিজ নিজ বিশ্বাসের অনুসরণ করবে। তাই কোরআন মজীদ বার বার বিচারবুদ্ধির কাছে আবেদন জানিয়েছে। কোরআন মজীদে কম পক্ষে তেরো বার এরশাদ হয়েছে :افلا تعقلون؟ - অতঃপর তোমরা কি বিচারবুদ্ধি কাজে লাগাবে না ?

বিচারবুদ্ধি অবশ্য খুঁটিনাটি ও বিশেষজ্ঞত্ব পর্যায়ের বিষয়াদিতে স্বাধীনভাবে ফয়ছ্বালা দিতে সক্ষম নয় , কিন্তু জীবন ও জগতের পিছনে নিহিত মৌলিকতম সত্যসমূহ উদ্ঘাটনে সক্ষম। সুতরাং যে কেউ এ বিষয়ে বিচারবুদ্ধি কাজে লাগাবে সে-ই তাওহীদ , আখেরাত্ ও নবুওয়াতে মুহাম্মাদী (ছ্বাঃ)-এর সত্যতায় উপনীত হবে। অন্যদিকে কোরআন মজীদের তাৎপর্য গ্রহণের ক্ষেত্রেও , বিশেষ করে মতপার্থক্যের ক্ষেত্রগুলোতে বিচারবুদ্ধি সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।

সুতরাং মত্যুপরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী জগত - যা আখেরাত সংক্রান্ত ধারণারই একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা , সে সম্পর্কে প্রথমেই আমরা বিচারবুদ্ধির দ্বারস্থ হবো। কারণ , যদিও বিচারবুদ্ধি এতদসংক্রান্ত খুঁটিনাটি উদ্ঘাটনে সক্ষম নয় , তবে মত্যুপরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী জগতের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদেরকে পথনির্দেশ দানে সক্ষম। এরপর আমরা দেখবো যে , এ সম্পর্কে কোরআন মজীদে কী আছে।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13