বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্23%

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্ লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 18 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 26156 / ডাউনলোড: 4692
সাইজ সাইজ সাইজ
বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মৃত্যুপারের জীবন সম্পর্কে মানুষের ঔৎসুক্য চিরন্তন। এ ঔৎসুক্যের পরিপূর্ণ নিবৃত্তি জীবদ্দশায় সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব নয় জেনেও মানুষ কখনোই এ বিষয়ে জানার আগ্রহ পরিত্যাগ করতে পারে না। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মে যেমন বিভিন্ন ধারণা দেয়া হয়েছে, তেমনি এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা তথ্য ও কল্পনা। তাই এ ব্যাপারে সম্ভব সর্বাধিক মাত্রায় সঠিক ধারণার প্রয়োজনীয়তা সব সময়ই অনুভূত হয়ে আসছে।

ইসলামী মতে, সাধারণভাবে মৃত্যুপরবর্তী সময়ের দু’টি পর্যায় রয়েছে : মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত সময় এবং পুনরুত্থান পরবর্তী সময় অর্থাৎ শেষ বিচার ও তদ্পরবর্তী জান্নাতী বা জাহান্নামী অনন্ত জীবন। পুনরুত্থান, শেষ বিচার এবং বেহেশত বা দোযখ বাস তথা আখেরাতের ওপর ঈমান পোষণ ইসলামের মৌলিক চৈন্তিক ভিত্তি (উছূলে ‘আক্বাএদ্)-এর অন্যতম। এ কারণে এ সম্পর্কে কোরআন মজীদে বিস্তারিত বক্তব্য রয়েছে।

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে আালামে বারযাখ্

নূর হোসেন মজিদী

এই বইটি আল হাসানাইন (আ.) ওয়েব সাইট কর্তৃক আপলোড করা হয়েছে ।

http://alhassanain.org/bengali

বিসমিল্লাহির্ রাহমানির্ রাহীম্।

মুখবন্ধ

মৃত্যুপারের জীবন সম্পর্কে মানুষের ঔৎসুক্য চিরন্তন। এ ঔৎসুক্যের পরিপূর্ণ নিবৃত্তি জীবদ্দশায় সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব নয় জেনেও মানুষ কখনোই এ বিষয়ে জানার আগ্রহ পরিত্যাগ করতে পারে না। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মে যেমন বিভিন্ন ধারণা দেয়া হয়েছে , তেমনি এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা তথ্য ও কল্পনা। তাই এ ব্যাপারে সম্ভব সর্বাধিক মাত্রায় সঠিক ধারণার প্রয়োজনীয়তা সব সময়ই অনুভূত হয়ে আসছে।

ইসলামী মতে , সাধারণভাবে মৃত্যুপরবর্তী সময়ের দু টি পর্যায় রয়েছে : মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত সময় এবং পুনরুত্থান পরবর্তী সময় অর্থাৎ শেষ বিচার ও তদ্পরবর্তী জান্নাতী বা জাহান্নামী অনন্ত জীবন। পুনরুত্থান , শেষ বিচার এবং বেহেশত বা দোযখ বাস তথা আখেরাতের ওপর ঈমান পোষণ ইসলামের মৌলিক চৈন্তিক ভিত্তি (উছূলে আক্বাএদ্)-এর অন্যতম। এ কারণে এ সম্পর্কে কোরআন মজীদে বিস্তারিত বক্তব্য রয়েছে।

অন্যদিকে সুস্থ বিচারবুদ্ধি পুনরুত্থান , শেষ বিচার এবং শাস্তি ও পুরষ্কারের প্রয়োজনীয়তাকে যেমন অনস্বীকার্য গণ্য করে তেমনি তার সম্ভব হওয়াও স্বীকার করে। বিশেষ করে কোরআন মজীদে এ ব্যাপারে যে সব বিচারবুদ্ধির দলীল উপস্থাপন করা হয়েছে তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তা হচ্ছে , যিনি প্রথম বার সৃষ্টি করেছেন তিনিই পুনঃসৃষ্টি করবেন অর্থাৎ প্রথম বার সৃষ্টির তুলনায় পুনঃসৃষ্টি অপেক্ষাকৃত সহজ। তাই মৃত্যুপরবর্তী পুনরুত্থানের প্রয়োজনীয়তা ও তা সম্ভব হওয়ার বিষয়টিকে অস্বীকার করা একমাত্র বিচারবুদ্ধি বর্জনকারী ও নাস্তিকতায় অন্ধ বিশ্বাসী একগুঁয়ে ব্যক্তি ব্যতীত কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।

কিন্তু মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মধ্যবর্তী সময়টিতে মৃত ব্যক্তিদের অবস্থা সংক্রান্ত ধারণা শেষ বিচারের ধারণার গুরুত্বের অনুরূপ গুরুত্বের অধিকারী না হলেও খুব কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন্যদিকে এ অধ্যায়টি সম্বন্ধেই মানুষের ঔৎসুক্য সবচেয়ে বেশী।

মানবিক বিচারবুদ্ধি পুনরুত্থানের সম্ভাব্যতাকে খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারে। কারণ , মহাজ্ঞানময় ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তা আলার পক্ষে প্রতিটি প্রাণশীল সৃষ্টির মৃতদেহের বিক্ষিপ্ত বস্তুকণাগুলোকে কেবল তাঁর ইচ্ছাশক্তিবলে একত্রিত করে তাদেরকে পুনঃসৃষ্টিকরণ মোটেই কঠিন হতে পারে না। কিন্তু মানুষ জানতে চায় , মৃত্যুর পরে শরীর থেকে আত্মা ’ বিচ্ছিন্ন হবার পর মানুষের অবস্থা কী হয়ে থাকে।

অবশ্য ওয়ায্-নছ্বীহতে ও এতদসংক্রান্ত বই-পুস্তকে ক্ববর আযাব্ ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। কিন্তু এতে সাধারণতঃ প্রকৃত ছ্বহীহ্ হাদীছের সাথে নিখুঁত বিচারে ছ্বহীহ্ নয় এমন বহু হাদীছ এবং বহু ভিত্তিহীন কিচ্ছা-কাহিনীর সমাহার ঘটে থাকে। এ সব ওয়ায্-নছ্বীহত্ ও এতদসংক্রান্ত বই-পুস্তকে বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্) ও কোরআন মজীদের দলীলের ব্যবহার কদাচিৎ দেখা যায়। তাছাড়া এ বিষয়ে এমনভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয় যা চিন্তাশীল শ্রোতা বা পাঠক-পাঠিকাদের নিকট গ্রহণযোগ্য হয় না। ফলে বহু প্রশ্নের জন্ম হয়। কিন্তু এ সব প্রশ্নের জবাব দেয়া হয় না। যেমন : ক্ববরের জিজ্ঞাসাবাদ এবং শাস্তি ও পুরষ্কারের কথা বলা হয় , কিন্তু সে ক্ষেত্রে ক্ববর ’ বলতে মাটির বুকে খননকৃত ক্ববরকে বুঝানো হয় - যা আদৌ ঠিক নয়।

ওয়ায্-নছ্বীহতে ও এতদসংক্রান্ত বই-পুস্তকে যা বলা হয় মোটামুটিভাবে তা হচ্ছে এরূপ যে , মৃত ব্যক্তিকে ক্ববরস্থ করার পর পরই মাটির ক্ববরের ভিতরেই তার বস্তুগত শরীরে তার রূহ্ ’ কে ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং তাকে তুলে বসানো হয়। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অতঃপর , ক্ববরস্থ ব্যক্তি গুনাহ্গার হলে ক্ববরের দু পাশের মাটি এসে তার শরীরকে পিষে ফেলে। এ থেকে মনে হয় যে , এরূপ ব্যক্তির ক্ববর খুলে দেখলে তার শরীরকে পিষে ফেলা মণ্ডের অবস্থায় পাওয়া যাবে। কিন্তু আসলে তা ঘটে না। চরম পাপাচারী ব্যক্তির মৃতদেহ মৃত্যুর অল্প কয়েক দিনের মধ্যে পোস্ট্ মর্টেমের জন্য তুললে দেখা যায় যে , মৃতদেহটি ঠিক যেরূপ রাখা হয়েছিলো ঠিক সে রকমই রয়েছে।

অবশ্য মাঝে মাঝে বিভিন্ন ধরনের ব্যতিক্রমী ঘটনার কথা মুখে মুখে প্রচার হতে শুনা যায়। যেমন : বলা হয় যে , অমুক জায়গায় জনৈক পাপাচারী ব্যক্তির ক্ববর থেকে আগুন বেরিয়েছে , বা ক্ববর খুঁড়তে গিয়ে কিছুতেই খোঁড়া সম্ভব হচ্ছিলো না ; চারপাশ থেকে মাটি এসে ক্ববর ভরে যাচ্ছিলো বিধায় তাকে মাটিচাপা দেয়া হয় , ইত্যাদি। এগুলো সাধারণতঃ বানানো গল্প অথবা কারসাযী। ক্ষেত্রবিশেষে শুনা যায় যে , ক্ববর স্থানান্তরের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন পরেও নেককার ব্যক্তির মৃতদেহ স্যাঁতসেঁতে জায়গায়ও পচনমুক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এর অবশ্য স্বাস্থ্যবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছে।

অবশ্য আল্লাহ্ তা আলা চাইলে বান্দাহদের শিক্ষা দেয়া ও সতর্ক করার জন্য যে কোনো সময় যে কোনো ধরনের অলৌকিক বা অসাধারণ ঘটনা সংঘটিত করতে পারেন , কিন্তু মানুষকে আল্লাহ্ আক্বল্ দিয়েছেন এবং এরপরও তার হেদায়াতের জন্য কোরআন মজীদ নাযিল করেছেন ; অতঃপর সাধারণভাবে কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির বরখেলাফে কোনো কিছু না করাই আল্লাহ্ তা আলার সুন্নাত্। এমনকি যে সব ক্ষেত্রে গণ-আযাব্ বা ব্যক্তিগত আযাব নাযিল করা হয় তা-ও সাধারণতঃ প্রাকৃতিক বিধানে শক্তিসঞ্চারের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে।

ক্ববর আযাব্ সংক্রান্ত ঐ সব ব্যাখ্যায় আরো সমস্যা আছে। তা হচ্ছে , ক্ববর আযাবের জন্য মাটির ক্ববর এবং মরদেহে রূহ্ ” প্রত্যাবর্তন করানো শর্ত হলে যাদের দেহ মমি করে রাখা হয় বা পুড়িয়ে ফেলা হয় অথবা পচেগলে পানিতে মিশে যায় বা মাছের পেটে চলে যায় অথবা পচেগলে না গিয়েই বাঘের পেটে বা কুমীরের পেটে চলে যায় তাদের জন্য ক্ববর আযাব হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ার কথা। তাহলে অবস্থাটা কেমন দাঁড়ালো ? একজন গুনাহ্গার মুসলমান ক্ববরের সওয়াল্-জবাব ও ক্ববর আযাবের মুখোমুখি হবে , আর যে অমুসলিমের মৃতদেহ মমি করে রাখা হয়েছে সে এ আযাব থেকে বেঁচে যাবে ?! সুতরাং সুস্পষ্ট যে , সওয়াল্-জবাব্ ও ক্ববর আযাবের এ ধরনের ব্যাখ্যা আদৌ ঠিক নয়।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা অপরিহার্য মনে করছি যে , সমস্ত মানুষের মধ্যে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে প্রদত্ত সর্বজনীন মানদণ্ড ‘ আক্বল্ (বিচারবুদ্ধি)- যা প্রয়োগের জন্য কোরআন মজীদ বার বার তাকিদ করা হয়েছে , আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ হেদায়াত্ কোরআন মজীদ , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) থেকে প্রতিটি স্তরে বিরাট সংখ্যক সূত্রে বর্ণিত তথা মুতাওয়াতির্ হাদীছ - যা তাঁর পক্ষ থেকে বর্ণিত বলে প্রত্যয় সৃষ্টি হয় এবং ইসলামের প্রথম যুগের সমগ্র উম্মাহর সর্বসম্মত বিষয়সমূহ (ইজমা ‘ এ উম্মাহ্) - যা নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর সুন্নাতের উদ্ঘাটনকারী-ব্যতীত অন্য কোনো দলীলের দ্বারাই ইসলামী আক্বাএদের তিন মূলনীতির (তাওহীদ্ , আখেরাত্ ও নবুওয়াতের) শাখা-প্রশাখা সমূহ এবং ফরয ও হারামের কোনো বিষয়ই প্রমাণিত হয় না।

হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের দুই শতাধিক বছর পরে সংকলিত হাদীছগ্রন্থ সমূহে স্থানপ্রাপ্ত কোনো না কোনো স্তরে , বিশেষ করে প্রথম দিককার কোনো স্তরে কম সূত্রে বর্ণিত (খবরে ওয়াহেদ্) হাদীছ কেবল উপরোক্ত চার অকাট্য জ্ঞানসূত্রের কোনোটির সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়া সাপেক্ষে গৌণ (মুস্তাহাব্ ও মাকরূহ্) ও প্রায়োগিক বিষয়ে গ্রহণযোগ্য। এমনকি মুতাওয়াতির্ হাদীছ্ বা ইজমা ‘ এ উম্মাহ্ও যদি আক্বল্ বা কোরআন মজীদের সাথে সাংঘর্ষিক হয় (যদিও কার্যতঃ এরূপ হয় না , তবুও তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি যে , যদি হয়) তাহলে সংশ্লিষ্ট হাদীছের তাওয়াতোরে সন্দেহ করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট ইজমা ভুলের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে গণ্য করতে হবে। মোদ্দা কথা , আক্বল্ ও কোরআন মজীদের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু গ্রহণযোগ্য নয় এবং এমন যা কিছু নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর নামে বর্ণিত হয়েছে তাকে তাঁর নামে রচিত বলে গণ্য করতে হবে।

সুতরাং মৃত্যুর অব্যবহিত পরবর্তী ও পুনরুত্থান পূর্ববর্তী জগত অর্থাৎ আালামে বারযাখের অবস্থা সম্বন্ধে কথা বলার জন্য আক্বল্ ও কোরআন মজীদের দলীল অপরিহার্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে , এ বিষয়ে ওয়ায্-নছ্বীহতে ও বই-পুস্তকে আক্বল্ ও কোরআন মজীদের দলীল ব্যবহার করতে দেখা যায় না। ফলে ইসলামের সকল বিষয়ের ব্যাপারেই সংশয় সৃষ্টি করা যাদের কাজ তারা ক্ববর আযাব্ সংক্রান্ত প্রচলিত ধারণা প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে আালামে বারযাখের সত্যতাই অস্বীকার করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেদেরকে খাঁটি ইসলামের সমর্থক হিসেবে দাবী করে ওলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালাতে গিয়ে এ সব বিষয়কে কাজে লাগায় এবং বলে যে , ক্ববর আযাবের বিষয়টি মোল্লা ’ দের আবিষ্কার ; ইসলামে এর কোনো ভিত্তি নেই। আর যেহেতু প্রচলিত ধারণায় মৃত্যুর পরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী অবস্থা বলতে কেবল সওয়াল-জবাব ও ক্ববর আযাবের কথা বলা হয় , ফলে এটি অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে কার্যতঃ আালামে বারযাখের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হয়।

বিশেষ করে বিগত বিংশ শতাব্দীর নব্বই-এর দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশে ইসলাম , ইসলামের মৌলিক চৈন্তিক ভিত্তিসমূহ ও এর শাখা-প্রশাখা সমূহ এবং এর গুরুত্বপূর্ণ বিধি-বিধানসমূহের ওপর পরিকল্পিত হামলা চালানো হচ্ছে। এক শ্রেণীর পত্রপত্রিকা এবং বুদ্ধিজীবী হবার দাবীদার এক শ্রেণীর লোক এ অভিযানের প্রথম কাতারে স্থান গ্রহণ করেছে। তারা ইসলামের বিরুদ্ধে হামলা চালাবার ছোট-বড় কোনো সুযোগই হাতছাড়া করে না। এদের মধ্যে কতক লোক নিজেদেরকে ইসলাম সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ বলেও দাবী করে থাকে , যদিও ইসলাম সম্পর্কে তাদের কোনো মৌলিক জ্ঞান নেই. বরং ইসলাম-বিদ্বেষী পশ্চিমা প্রাচ্যবিদদের বিদ্বিষ্ট বই-পুস্তক থেকে প্রাপ্ত বিকৃত ধারণাই হচ্ছে এদের ইসলাম সংক্রান্ত জ্ঞানের একমাত্র সম্বল।

এ ধরনের একজন ইসলাম-বিশেষজ্ঞ সাজা ব্যক্তি ইসলাম-বিরোধী হিসেবে কুখ্যাত একটি দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন। ১৯৯৬-র মাঝামাঝি সময়ে পত্রিকাটির এক সংখ্যায় তিনি ক্ববর আযাব্ অস্বীকার করে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। তিনি দাবী করেন যে , ইসলামে এর কোনো ভিত্তি নেই। এছাড়াও ঐ ব্যক্তি উক্ত কলামে আমার ইসলামী রাষ্ট্র ও নেতৃত্ব গ্রন্থের মনগড়া সমালোচনা করেন , কিন্তু আমি তা খণ্ডন করে বক্তব্য দিলে তা প্রকাশ করা হয় নি। এছাড়াও তাঁর আরো কতক লেখার ভ্রান্তি নির্দেশ করে বক্তব্য দিলে তা-ও প্রকাশ করা হয় নি।

পরবর্তীকালে ঐ ব্যক্তি সাপ্তাহিক রোববার-এ নিয়মিত ইসলাম বিষয়ক কলাম লিখতে শুরু করলে এবং তাতে বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকলে আমি তা খণ্ডন করে বক্তব্য দিতে থাকি এবং রোববার কর্তৃপক্ষ তা প্রকাশ করতে থাকেন। পর পর অনেকগুলো সপ্তাহ্ উভয়ের মধ্যে বিতর্ক চলতে থাকলে এবং ঐ ব্যক্তির প্রতিটি লেখাই ফালতু প্রমাণিত হলে রোববার কর্তৃপক্ষ ঐ ব্যক্তির কলামটি বন্ধ করে দেন। সম্ভবতঃ একই কারণে , উল্লিখিত দৈনিকটি থেকেও তাঁকে বিতাড়িত হতে হয়।

ইসলাম-বিরোধী হিসেবে কুখ্যাত দৈনিকটিতে যখন ক্ববর আযাব অস্বীকার করে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় আমি তখন দৈনিক আল্-মুজাদ্দেদ-এর ইসলাম ও ঐতিহ্য ’ বিভাগে কর্মরত ছিলোম। তখন আমাকে ক্ববর আযাব বিষয়ে একটি প্রামাণ্য প্রবন্ধ লিখতে বলা হয়। কিন্তু প্রস্তুতি নিতে গিয়ে অনুভব করলাম যে , এ বিষয়ে বিস্তারিত ও দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

ঐ সময় দৈনিক আল্-মুজাদ্দেদ-এ (অন্য এক বিভাগে) কর্মরত আমার সাবেক সহকর্মী (আমি বার্তাবিভাগে কর্মরত থাকাকালীন সহকর্মী) হিরণ ভাই (শহীদুল হক হিরণ -মরহূম কবি মোজাম্মেল হক-এর পুত্র) এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখার জন্য অমাকে বার বার অনুরোধ জানান। কিন্তু আল্-মুজাদ্দেদ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বেশী দীর্ঘ লেখা না লেখার জন্য নির্দেশ ছিলো। এ সত্ত্বেও আমি আমার নিজস্ব বিন্যাসে ইসলামের দৃষ্টিতে আালামে বারযাখ্ ” প্রবন্ধ রচনা করি। ১৯৯৬-র ১৬ই ও ২১শে নভেম্বর সংখ্যায় প্রবন্ধটির প্রথম দুই অংশ প্রকাশিত হবার পর এটির প্রকাশ তিন সপ্তাহ্ স্থগিত থাকে। এরপর ১৫ই , ১৮ই ও ১৯শে ডিসেম্বর প্রবন্ধটির বাকী তিন অংশ প্রকাশিত হয়।

ঐ সময়ই পরবর্তীকালে প্রবন্ধটিকে পুস্তিকা আকারে প্রকাশের চিন্তা মাথায় আসে। হিরণ ভাইও এর প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

মূল প্রবন্ধটি যে বিন্যাসে লিখেছিলাম আল্-মুজাদ্দেদে প্রকাশকালে তাতে কিছু পরিবর্তন আনা হয় -যার উদ্দেশ্য ছিলো সংক্ষেপকরণ। ফলে বক্তব্যে সামান্য বিন্যাসদুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। তাই অত্র গ্রন্থে প্রবন্ধটি পুনর্বিন্যস্ত করি , কিন্তু তাতে হয়তো বিন্যাসের দুর্বলতা পুরোপুরি দূরীভূত হয় নি। এতে উপশিরোনামসমূহ ও কোরআন মজীদের মূল আয়াত সমূহ পরে সংযোজন করি। এছাড়া প্রয়োজন অনুভূত হওয়ায় আরো কিছু বক্তব্য সংযোজন করি যার ফলে মূল প্রবন্ধটির আয়তন বৃদ্ধি পায়।

অভিন্ন বিষয়বস্তুর সাথে সংশ্লিষ্ট বিধায় তখন এ গ্রন্থে“‘ আালামে বারযাখে শহীদের জীবন ” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ সংযুক্ত করি। প্রবন্ধটির মূল শিরোনাম এটি হলেও সামান্য পরিবর্তিত শিরোনামে এটি ২৭শে সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সংখ্যা আল্-মুজাদ্দেদ-এ প্রকাশিত হয়েছিলো। গ্রন্থের বক্ষ্যমাণ বিন্যাসে উক্ত প্রবন্ধটিকে মূল আলোচনায় একীভূত করেছি।

আলোচ্য বিষয় অনুধাবনে সহায়ক হবে বিবেচনায় গ্রন্থের শেষাংশে রূহ্ , নাফ্স্ ও জিসমে মিছালী ” এবং“‘ আলামে মিছাল্ ও আালামে বারযাখ্ ” শীর্ষক আরো দু টি প্রবন্ধ সংযোজন করি। প্রবন্ধ দু টি একাধিক বার যথেষ্ট পরিবর্তনের মাধ্যমে সর্বশেষ রূপ লাভ করে। এছাড়া আল্-মুজাদ্দেদ-এ কর্মরত থাকাকালে কর্তৃপক্ষীয় তাগাদায় দর্শন , ইরফান্ ও কোরআনের দৃষ্টিতে রূহ্ ও নাফ্স্ ” শীর্ষক আরেকটি প্রামাণ্য প্রবন্ধ রচনায় হাত দেই। কিন্তু প্রবন্ধটির প্রথম কিস্তি লেখার পরে পরিকল্পনায় পরিবর্তন ঘটে এবং লিখিত অংশের প্রথমার্ধ নিয়ে একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধের রূপ দেয়া হয়। পারবর্তীকালে এটিকে কিঞ্চিৎ সম্প্রসারিত করে আমার লেখা নূরে মুহাম্মাদীর মর্মকথা গ্রন্থে পরিশিষ্ট আকারে সংযোজন করি। এটিকে অধিকতর সম্প্রসারিত ও পুনর্বিন্যস্ত করে বর্তমান গ্রন্থে সন্নিবেশিত রূহ্ , নাফ্স্ ও জিসমে মিছালী ” প্রবন্ধের রূপ দেই। গ্রন্থের বক্ষ্যমাণ বিন্যাসে এটি সংশোধিত রূপে কোরআন মজীদে ও দর্শনে আালামে বারযাখের তাৎপর্য ’ শিরোনামে সংযোজিত হয়েছে। এছাড়া ঐ সব লেখা পুনর্বিন্যাসকালে কিছু নতুন উপশিরোনাম যোগ করেছি।

এখানে কৈফিয়ত স্বরূপ দু টি বিষয় উল্লেখ করা যরূরী মনে করছি। প্রথম বিষয়টি এই যে , অত্র গ্রন্থটি গ্রন্থরচনার পরিকল্পনার ভিত্তিতে রচিত হয় নি , বরং , ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , পত্রিকায় প্রকাশের জন্য প্রবন্ধ হিসেবে লেখা হয়েছিলো। পরে এটিকে সম্প্রসারিত করে গ্রন্থের রূপ দেয়ার ফলে বিন্যাসে দুর্বলতা ছাড়াও কিছু কথার পুনরুক্তি এড়ানো সম্ভবপর হয় নি। দ্বিতীয় বিষয়টি এই যে , মানুষের অবস্তুগত সত্তার সংখ্যা ও নাম নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। এ নিয়ে অত্র গ্রন্থে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করা হলেও মূল প্রবন্ধটি রচনাকালে সংবাদপত্রের সাধারণ পাঠক-পাঠিকাদের বোধগম্যতার প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রধানতঃ রূহ্ ’ বা আত্মা ’ ব্যবহার করা হয়েছে। অবশ্য পরবর্তীকালীন সংযোজনসমূহে প্রধানতঃ নাফ্স্ ’ বা ব্যক্তিসত্তা ’ ব্যবহার করা হয়েছে - যা অধিকতর যথার্থ। এ ক্ষেত্রে পরিভাষার বিভিন্নতা সত্ত্বেও যা বুঝাতে চাওয়া হয়েছে তা অভিন্ন অস্তিত্ব।

গ্রন্থটি একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশের কথা হলে তার ভিত্তিতে এটি কম্পোজ করা হয় এবং ২০০৩ সালের আগস্ট মাসে ট্রেসিং-প্রিন্ট্ তোলা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রকাশনাপ্রতিষ্ঠানটি গ্রন্থটি প্রকাশ করতে পারে নি। কয়েক বছর পর সংশ্লিষ্ট কম্পিউটারটির হার্ড ডিস্ক্ ক্র্যাশ্ করে এবং ট্রেসিংটিও নষ্ট হয়ে যায়। তবে সৌভাগ্যক্রমে এর সর্বশেষ প্রুফ্ কপিটি পাওয়া যায়। তা থেকেই বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটি কম্পোজ করা হলো ; কম্পোজের কাজ আমার নিজেকেই করতে হয়েছে। অবশ্য অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই নতুন কম্পোজকালে , বিশেষ করে স্বয়ং লেখক কর্তৃক কম্পোজের কারণে কিছু অংশ অপরিহার্য প্রয়োজনীয় নয় বা অকাট্য নয় বিবেচনায় বাদ দেয়া হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় বিবেচনায় নতুন কিছু বক্তব্য সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়া গ্রন্থের বিন্যাসকেও পূর্বাপেক্ষা উন্নততর করার চেষ্টা করা হয়েছে , যদিও পুরো দুর্বলতা দূর করা সম্ভব হয় নি। কারণ , তা করতে গেলে অনেক বেশী সময় ব্যয় করতে হতো , কিন্তু সে ক্ষেত্রে অন্যান্য ব্যস্ততার মাঝে তা কবে সমাপ্ত করা যেতো তার কোনো নিশ্চয়তা ছিলো না। বিশেষ করে কোনো কোনো ঘনিষ্ঠ জন এটির সফ্ট্ কপি পাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন , অন্যদিকে জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই সংক্ষিপ্ততম সময়ে যেভাবে সম্ভব হয়েছে কাজটি সমাপ্ত করার চেষ্টা করেছি।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা উল্লেখ করা প্রযোজন মনে করছি। তা হচ্ছে , গ্রন্থটি মূলতঃ বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্) ও কোরআন মজীদের দলীলের ভিত্তিতে প্রণীত। তা সত্ত্বেও এটি পত্রিকার জন্য রচনাকালে কোরআন মজীদের কতক তরজমা ও তাফসীর এবং কতক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ থেকে সাহায্য নেয়া রয়েছে। কিন্তু সে সব সূত্রের বক্তব্য হয় বিচারবুদ্ধির কাছে গ্রহণযোগ্য বিধায় গ্রহণ করা হয়েছে অথবা কোরআন মজীদের আয়াতের অধিকতর সঠিক অর্থ গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ঐ সব সূত্রের গৃহীত অর্থের সাথে গ্রন্থকার কর্তৃক গৃহীত অর্থকে মিলিয়ে দেখা হয়েছে। তাই দু একটি ব্যতিক্রম বাদে গ্রন্থমধ্যে কোথাও সুনির্দিষ্টভাবে ঐ সব সূত্রের সূত্রনির্দেশ করা হয় নি এবং আক্বল্ ও কোরআন ভিত্তিক রচনা হিসেবে তা উচিতও হতো না। তবে কোনো কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্যের ক্ষেত্রে সূত্রনির্দেশ করলে ভালো হতো। কিন্তু আমাদের দেশের দৈনিক পত্রিকার লেখায় সাধারণতঃ মশহূর বা সর্বজনস্বীকৃত তথ্যের ক্ষেত্রে লেখার ভিতরে প্রতিটি স্থানে সূত্রনির্দেশ করা প্রয়োজন মনে করা হয় না। তাই এ লেখাগুলোতেও তা করা হয় নি। পরে তা গ্রন্থের রূপ দেয়ার সময় কতক সূত্র হাতের কাছে না থাকায় এবং কতক সূত্র হাতের আওতায় থাকলেও সময়াভাবে তা নতুন করে খুঁজে বের করে যথাস্থানে নির্দেশ করা হয় নি। তবে গ্রন্থের শেষে এ ধরনের সবগুলো সহায়ক সূত্রের কথা এজমালীভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এখানে অকপটে স্বীকার করছি যে , কোরআন মজীদ ও আক্বলী দলীলের বাইরে যে সব তথ্যসূত্রের সাহায্য নিয়েছি তার মানে এ নয় যে , সে সব সূত্রের বক্তব্যকে অকাট্য বলে গণ্য করেছি। যেহেতু আলোচ্য বিষয়টি এমন যে , এ ক্ষেত্রে আক্বলের পক্ষে অনেক প্রশ্নের অকাট্য জবাব দেয়া দুরূহ ব্যাপার এবং কোরআন মজীদেও এ ব্যাপারে খুব বেশী কিছু বলা হয় নি ; অবশ্য কোরআন মজীদে যতোটুকু বলা হয়েছে তা থেকে সাধারণভাবে আালামে বারযাখের অস্তিত্ব এবং সেখানকার শাস্তি ও পুরষ্কারের বিষয়টি অকাট্য ; এবং অপরিহার্য তথ্য হিসেবে তা-ই যথেষ্ট। আর কোরআন মজীদ যেহেতু প্রতিটি বিষয়ের বর্ণনাকারী সেহেতু কোরআন থেকে সকল বিষয়ে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় বক্তব্যের বেশী আশা করা যায় না। কারণ , সব কিছুর বিস্তারিত বিবরণ দিতে গেলে তা এতো বিশাল আকার ধারণ করতো যে , তা আর সকলের জন্য ব্যবহারযোগ্য থাকতো না।

কিন্তু মানুষের ঔৎসুক্য অনেক বেশী। এ কারণেই অনেক আনুষঙ্গিক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আক্বল্ ও কোরআন মজীদ ছাড়াও অন্যান্য সূত্রের সাহায্য নিতে হয়েছে। তাই এ সব সূত্রের তথ্য উল্লেখ মানেই এ নয় যে , এগুলোকে অকাট্য গণ্য করছি। তেমনি এগুলো নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে যে সব যুক্তিতর্কের আশ্রয় নেয়া হয়েছে সেগুলোর অবস্থাও তা-ই। কারণ , কোনো অকাট্য বিষয়কে কেন্দ্র করে যুক্তিপ্রয়োগ থেকেই অকাট্য উপসংহারে উপনীত হওয়া যায় ; মূল বিষয়টি অকাট্য না হলে তা থেকে যুক্তিতর্ক ভিত্তিক উপসংহার দৃশ্যতঃ অকাট্য হলেও আসলে তা অকাট্য হবার নিশ্চয়তা থাকে না। যা-ই হোক , এ থেকে ভুল ধারণা সৃষ্টি না হয় সে উদ্দেশ্যেই বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন মনে করেছি।

আল্লাহ্ রাব্বুল আালামীনের দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া যে , অবশেষে গ্রন্থটি পুনরায় প্রকাশোপযোগী করা সম্ভবপর হলো। মূল গ্রন্থের পাদটীকাগুলো ইউনিকোডে মূল পাঠের ভিতরে তৃতীয় বন্ধনীর ভিতরে উল্লেখ করা হয়েছে।

মহান আল্লাহ্ এ গ্রন্থটিকে এর লেখক এবং পাঠক-পাঠিকাদের জন্য বারযাখী জীবনের ও পুনরুত্থানপরবর্তী জীবনের পাথেয়স্বরূপ করে দিন। আমীন।

নূর হোসেন মজিদী

ঢাকা

২৫শে রামাযান ১৪৩৬

২৯শে আষাঢ় ১৪২২

১৩ই জুলাই ২০১৫।

কালো পোশাক পরিধান

39 নং প্রশ্ন : শোক প্রকাশের দিনে কালো পোশাক পরিধানের দর্শন কী ?

কালো রং বিভিন্ন দিক থেকে ভিন্ন প্রভাব এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী । এর বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা অনুসারে কিছু বা বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ কোন ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠী নিজেদের প্রয়োজন অনুসারে এর ব্যবহার করে থাকে । কালো রং একদিকে বস্তুকে অন্ধকারে গোপন ও ঢেকে রাখে তাই কখনও কখনও এ রঙ কোন কিছুকে ঢেকে রাখা বা গোপন রাখার জন্য ব্যবহৃত হয় ।357 আবার অন্যদিকে তা ব্যক্তিত্বের নিদর্শন হিসেবে পরিচিত । এ কারণেই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের আনুষ্ঠানিক পোশাক (বিশেষত বহিরাবরণ ,যেমন কোট ,ব্লেজার ইত্যাদি) সাধারণত কালো বা গাঢ় সুরমা রঙের হয় । ইতিহাসে এরূপ অনেক বর্ণনা পাওয়া যায় যে ,বিশেষ ব্যক্তি ,গোষ্ঠী এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ব্যক্তিত্ব প্রকাশের জন্য এ ধরনের রঙ ব্যবহার করতেন ।358

কালো রঙের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব হলো ,এ রঙটি প্রকৃতিগতভাবে দুঃখ ,বিষাদ ও বিষণ্ণতার পরিচায়ক যা শোক প্রকাশের উপযোগী । এ কারণে বিশ্বের অনেক মানুষ এ রঙকে তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুর দুঃখ ,শোক ও বিষণ্ণতা প্রকাশে ব্যবহার করে থাকে ।

এ বিষয়টি স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে ,শোক প্রকাশের দিনগুলোতে কালো রঙ নির্বাচনের মধ্যে উপরোল্লিখিত যুক্তিগুলো ছাড়াও আবেগ-অনুভূতির বিষয়ও জড়িত রয়েছে । যে ব্যক্তি তার প্রিয় মানুষের শোকে নিজে কালো পোশাক পরিধান করে এবং দেওয়ালগুলোকে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয় প্রকৃতপক্ষে সে এ কাজ দ্বারা বলতে ও বুঝাতে চায়- (হে বিদায়ী) তুমি আমার চোখের জ্যোতি ও মণি ছিলে ,তোমার মরদেহ মাটিতে দাফন হওয়া আমার কাছে পশ্চিম আকাশে চন্দ্র ও সূর্যের অস্তমিত হওয়ার মতো ;(তোমার বিদায়) জীবনকে আমার চোখে অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছে ;সময় ও স্থানকে গ্রাস করে ফেলেছে ।

হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর অষ্টম দিনে পিতার কবরের নিকট গিয়ে ক্রন্দন করে নিম্নলিখিত কবিতাটি পাঠ করেছিলেন

یا ابتاه انقطعت بك الدنیا بانوارها و زوت زهرتها کانت ببهجتك زاهرة فقد اسود نهارها فصار يحکی حنادسها رطبها و یا بسها...والْسی... لازمنا

হে পিতা! তুমি চলে গেছ ,তোমার চলে যাওয়ার কারণে দুনিয়া এর আলো আমাদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে ,এর নেয়ামতসমূহ থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছে ,বিশ্বজগৎ তোমার সৌন্দর্যে উজ্জ্বল ও আলোকিত ছিল ,(কিন্তু তোমার বিদায়ের পর) এর দিনের আলো অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছে ,এর (দুনিয়ার) সিক্ততা ও শুষ্কতা ,এর অন্ধকার রাতের নির্দেশ করে... এবং দুঃখ ও মর্মবেদনা আমাদের সবসময়ের সঙ্গী... । 359

এ কারণেই কালো পোশাক পরিধান করার কারণ কালো রঙে লুক্কায়িত থাকা গোপন রহস্যের মধ্যে নিহিত এবং এর প্রকৃতিগত (দুঃখ ও শোকবাহী) রূপটিই একে যুক্তিসঙ্গত একটি প্রথায় পরিণত করেছে । আহলে বাইত (আ.)-এর অনুসারীরা শোক প্রকাশের দিনগুলোতে কালো পোশাক পরিধান করে । কারণ ,এ পোশাক তাঁদের প্রতি প্রেম ও বন্ধুত্বের নিদর্শন বহন করে ,স্বাধীনচেতাদের মহান নেতা ও আদর্শপুরুষ ইমাম হোসাইনের প্রতি নিবেদিত থাকার প্রতিশ্রুতি দান করে । এর মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার রণাঙ্গনে তাঁকে সহযোগিতার ঘোষণা দেয় ও নৈতিকভাবে তাঁর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ।360 ইমামদের বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকানুষ্ঠানে কালো পোশাক পরে বাহ্যিক কালোর অবয়বে তাঁর সাথে সহমর্মিতা দেখানোর মাধ্যমে নিজের অন্তরকে আলোকিত করা হয় ;যদিও বাহ্যিকভাবে তা কালো ,কিন্তু ভেতরে উজ্জ্বল ও তাঁর আদর্শে আলোকিত ।

40 নং প্রশ্ন : অন্যান্য জাতির মধ্যে কালো পোশাক পরিধান করার প্রচলন রয়েছে কি ? কালো পোশাক পরিধান করার সংস্কৃতি ইসলামের আগমনের পর আব্বাসী খলিফা অথবা আরব জাতি থেকে ইরানে প্রবেশ করেছে ,ইরানী সভ্যতায় এ ধরনের সংস্কৃতি ছিল না ।

উত্তর : প্রথমত ,শোকের সময় কালো পোশাক পরিধানের রীতি বিভিন্ন জাতির মধ্যে গ্রহণযোগ্য এক প্রথা হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে প্রচলিত ছিল । প্রাচীন ইরান থেকে শুরু করে গ্রীক সভ্যতা ,এমনকি আরবের জাহেলী সংস্কৃতিতেও এর প্রচলন ছিল ।

দ্বিতীয়ত ,কালো পোশাক পরিধান আব্বাসী খলিফাদের সময় অথবা ইসলাম আগমনের পর আরবদের নিকট থেকে ইরানে প্রবেশ করেনি ;বরং এর মূল প্রাচীনকাল থেকেই ইরানী সংস্কৃতিতে নিহিত ছিল এবং বাহ্যিকভাবে তাদের ব্যবহারিক জীবনে এর প্রচলন ছিল । নিচের বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করলে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে :

1. অনেক ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক বর্ণনা এ বিষয়টি স্পষ্ট করে যে ,পৃথিবীর অনেক জাতি ও গোষ্ঠী প্রাচীনকাল থেকে শোকের দিনগুলোতে কালো পোশাক পরিধান করত । উদাহরণস্বরূপ ইরান ,গ্রীক ও আরব সংস্কৃতির কিছু নমুনা তুলে ধরলাম :

ক. প্রাচীন ইরানের কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : প্রাচীন ইরানের পাণ্ডুলিপিগুলোতে অনেক প্রমাণ রয়েছে যে ,কালো পোশাক শোকের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হতো । ইরানী বিখ্যাত সাহিত্যিক ফেরদৌসী শাহনামা তে ইরানী প্রাচীন সংস্কৃতির বিভিন্ন ঘটনাতে কালো পোশাক শোকের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করেছেন ।

বিশেষ করে যখন রুস্তমের ভাই শুগাদ তাকে কাপুরুষের মতো হত্যা করেছিল ,ফেরদৌসী তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন :

এক বছর সিস্তানে শোক ছিল ,তাদের জামাসমূহ কালো ছিল ।

সাসানীদের যুগে যখন বাহরাম গুর দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল ,তার উত্তরাধিকারী ইয়াজ্দর্গাদ শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ।

পথে চল্লিশ দিন পিতার শোক পালন করেছিল ,

সৈন্যরা কালো পোশাক পরিধান করেছিল ।

ফেরেইদুন যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল তার উত্তরাধিকারী ও সন্তানরা এ কাজ করেছিল :

মানুচেহর এক সপ্তাহ যন্ত্রণায় ছিল ,দুই চোখ অশ্রুপূর্ণ ও চেহারা হলুদ ছিল ;সকলে পরেছিল কালো পোশাক ,রাজা পেলেন মনোবল সৈন্যদের সম্মিলিত সমবেদনা প্রকাশে ।

এ কালো পোশাক পরার সংস্কৃতি এখন পর্যন্ত ইরানে চালু রয়েছে ।361

খ. গ্রীক সভ্যতায় কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : গ্রীসের প্রাচীন কল্পকাহিনীতে এসেছে : হেক্টরের হাতে প্রটিসিলাস নিহত হওয়ার ঘটনায় টাইটাস অত্যন্ত ভারাক্রান্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে শোকের চিহ্ন হিসেবে সবচেয়ে কালো পোশাক পরিধান করেছিল ।

এ বিষয়টি গ্রীক সভ্যতায় কবি হোমারের যুগে কালো পোশাক পরিধান করার প্রথার প্রমাণ বহন করে । ইহুদিদের মধ্যে প্রাচীনকালে আত্মীয়-স্বজনের শোকে এ প্রথা প্রচলিত ছিল যে ,সকলে মাথা কামিয়ে ছাই মাখত এবং তাদের পোশাক কালো অথবা কালোর কাছাকাছি কোন রংয়ের ছিল ।362

বুসতানী তাঁর বিশ্বকোষ -এ কালো রঙ ইউরোপীয় সভ্যতার সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোতে শোক পালনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত রং হিসেবে গণ্য হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন এবং লিখেছেন : শোক পালনের সময় মৃত ব্যক্তির আত্মীয়তার নৈকট্যের শ্রেণিভেদে তারা এক সপ্তাহ থেকে এক বছর পর্যন্ত শোকানুষ্ঠান পালন করে । বিশেষ করে বিধবা নারীরা কমপক্ষে এক বছর শোক পালন করে এবং এই সময়ে তাদের পোশাক থাকে কোন ধরনের নকশা ও অলংকার ছাড়া কালো রংয়ের ।363

আরব জাতির কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : আরবদের ইতিহাস ,কবিতা ও ভাষা সাক্ষ্য দেয় যে ,মিশর হতে সিরিয়া ,ইরাক ও সৌদি আরবসহ সব জায়গায় কালো রঙ শোকের রঙ হিসেবে পরিচিত ছিল ।

ষষ্ঠ শতাব্দীর আরব সাহিত্যিক ও কোরআনের মুফাস্সির যামাখশারী লিখেছেন : একজন সাহিত্যিক বলেছেন : কালো পোশাক পরিধানকারী সন্যাসীকে দেখে প্রশ্ন করেছিলাম : কেন কালো পোশাক পরিধান করেছ ? বলল : আরবরা যখন তাদের মধ্য হতে কেউ মারা যায় তখন কোন্ ধরনের পোশাক পরিধান করে ? সন্যাসী বলল : আমিও আমার গুনাহের শোকে কালো পোশাক পরিধান করেছি । 364

ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত হয়েছে যে ,আরব জাতি তাদের মুসিবতের সময় নিজেদের পোশাককে কালো করত ।365

রাসূল (সা.)-এর যুগে বদরের যুদ্ধের শেষে যখন 70 জন মুশরিক ও কুরাইশ মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছিল তখন মক্কার নারীরা তাদের নিহতদের শোকে কালো পোশাক পরিধান করেছিল ।366

এসকল ঐতিহাসিক বর্ণনা এবং সাহিত্যিক রচনা ও কবিতা প্রমাণ করে যে ,কালো রং প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর মধ্যে শোকের চিহ্ন হিসেবে প্রচলিত ছিল । এ বিষয়টি ইরান বা ইসলামী যুগের সাথে বিশেষ ভাবে সম্পৃক্ত নয় ;বরং ইসলামের পূর্বে ইরানীরা ও প্রাচীন গ্রীসের আধিবাসীরাও শোক প্রকাশের প্রথা হিসেবে কালো অথবা গাঢ় নীল রংয়ের পোশাক পরিধান করত ।367

2. আহলে বাইত (আ.)-এর মাঝে কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : তথ্যভিত্তিক সংবাদ এই বিষয়টির সুস্পষ্ট বর্ণনা করে যে ,রাসূল (সা.) এবং পবিত্র ইমামগণও এই যৌক্তিক প্রকৃতিগত পথকে সমর্থন করেছেন এবং নিজেদের প্রিয় ব্যক্তির শোকে তাঁরা নিজেরাও কালো পোশাক পরিধান করেছেন ।

নাহজুল বালাগার শারহ (ব্যাখ্যা গ্রন্থ)-এ ইবনে আবিল হাদীদ বর্ণনা করেছেন : ইমাম হাসান (আ.) তাঁর পিতা আলী (আ.)-এর শাহাদাতের শোকে কালো পোশাক পরিধান করে মানুষের মাঝে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন ।368

এ কারণে যে হাদীসটি সকল হাদীসবিদ বর্ণনা করেছেন যে ,ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন : বনি হাশিমের নারীরা আবা-আবদিল্লাহ হোসাইন (আ.)-এর শোকে কালো পোশাক পরিধান করতেন ।

لما قتل الحسین بن علی)ع ( لیس نساء بنی هاشم السواد و المسوح و کن لاتشتکین من حر ولابرد و کان علی بن الحسین)ع ( یعمل لهن الطعام للمأتم

যখন ইমাম হোসাইন (আ.) শহীদ হলেন তখন বনি হাশিমের নারীরা কালো ও রুক্ষ-পশমের পোশাক পরিধান করেছিলেন ,গরম বা ঠাণ্ডার বিষয়ে তাঁদের কোন অভিযোগ ছিল না ,তাঁরা শোক পালনে রত থাকার কারণে (আমার পিতা) আলী ইবনে হোসাইন (আ.) তাঁদের জন্য খাবার তৈরি করতেন ।

আব্বাসীদের কালো পোশাক পরিধান করার কারণ

আব্বাসী খলিফারা উমাইয়া খলিফাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর সময় থেকে বাহ্যিকভাবে নিজেদেরকে আহলে বাইতের শহীদদের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণকারী হিসেবে দাবি করেছিল । এ কারণে যখন তারা ক্ষমতা অর্জন করেছিল তখন তাদের শাসনকে আলে মুহাম্মাদ (সা.)-এর শাসন হিসেবে অভিহিত করত এবং বলত যে ,এই খেলাফত হচ্ছে আলী (আ.)-এর খেলাফতেরই ধারাবাহিকতা । তাদের প্রধানমন্ত্রী আবু সালামা খাল্লালকে আলে মুহাম্মাদের প্রধানমন্ত্রী এবং তাদের সামরিক বাহিনীর প্রধান আবু মুসলিম খোরাসানিকে আলে মুহাম্মাদের আমিন (বিশ্বস্ত ব্যক্তি) বা নেতা হিসেবে নামকরণ করেছিল ।

কালো পোশাক রাসূল (সা.)-এর অবমাননা ও তাঁর আহলে বাইতের ওপর ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক ঘটনার শোকের প্রতীক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে ।369 আব্বাসী খলিফারা কালো পোশাক পরিধানের প্রথা ইরানে এবং অন্যান্য ইসলামী শহরে প্রবর্তন করে নি ;কেননা ,মৃত ব্যক্তির শোকে কালো পোশাক পরিধানের প্রথা সামাজিকভাবে এবং বিশেষভাবে শহীদদের সর্দার ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকে প্রথম থেকেই প্রচলিত ছিল ।

কারবালার মযলুম শহীদ ইমাম হোসাইন এবং বনি উমাইয়ার হাতে নিহত তাঁর নাতি যাইদ ইবনে আলী ও ইয়াহিয়া ইবনে যাইদের রক্তের প্রতিশোধের অজুহাতে আব্বাসী খলিফারা কালো পতাকা ও কালো পোশাক পরিধান করাকে আহলে বাইতের শহীদদের শোক প্রকাশের উপকরণরূপে ব্যবহার করেছে । এই ধরনের কৌশল ব্যবহার করে তারা আহলে বাইতের অনুসারীদের প্রতারিত করে নিজেদের দলে আনার চেষ্টা করেছে এবং এ ধরনের প্রচার-প্রপাগান্ডার মাধ্যমে মানুষের মনে নিজেদের স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছে । তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও কালো পতাকা ও পোশাককে সবসময়ের জন্য নিজেদের নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছিল ।370

এই প্রতারণার কারণেই ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এবং অন্যান্য ইমাম কালো রঙের পোশাকের বিরুদ্ধে ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলতেন । আব্বাসী খলিফারা আনুষ্ঠানিকভাবে কালো পোশাককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কারণে ইমামরা এই বিষয়ে তাদের বিরোধিতা করেছেন । তাদের সাথে এ বিষয়ে (কালো পোশাক ব্যবহার) একাত্মতা প্রকাশ করা অত্যাচারী শাসককে স্বীকৃতি দান বলে মনে করা হতো । কিন্তু তাঁরা সার্বিকভাবে আহলে বাইতের শহীদদের শোকে শোকাহত হয়ে কালো পোশাকের সংস্কৃতির বিরোধী ছিলেন না ।371

শোক প্রকাশের পদ্ধতি

41 নং প্রশ্ন : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য কী পরিমাণ শোক প্রকাশ করা বৈধ ?

ইসলামী শরিয়তের বিধান শোক প্রকাশের পেছনে নিহিত দর্শন ও বুদ্ধিমান সমাজের কাছে সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য নীতিই আহলে বাইত বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোক প্রকাশের সীমানা নির্ধারণ করবে । যদি শোকের আবেগ-উদ্দীপনার মাত্রা তার বুদ্ধিবৃত্তির ওপর এমনভাবে প্রাধ্যান্য লাভ করে যে ,এর দর্শন থেকে বিচ্যুত হয় তাহলে তা শরিয়ত ও বৃদ্ধিবৃত্তির সীমানা থেকে দূরে সরে যাবে । যদি এর ধরন এমন হয় যা বুদ্ধিবৃত্তিগতভাবে সমাজ অপছন্দ ও ঘৃণা করে ,তা শিয়া মাযহাব ও এর প্রকৃত শিক্ষার সাথে অবমাননাকর মনে হয় তাহলে অবশ্যই এ ধরনের শোক প্রকাশ অনাকাঙ্ক্ষিত ও বর্জিত হবে ।

বলা বাহুল্য ,শোক প্রকাশের ধরন এমন হওয়া উচিত যাতে এর শিক্ষার প্রকৃত বিষয়বস্তুকে মানুষের মাঝে সঠিকভাবে প্রচার করতে পারে এবং ইমামদের সম্পর্কে মানুষের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে । যদি এ শোক প্রকাশের বাহ্যিক রূপ এমন হয় যে ,অভ্যন্তরীণ রূপের আদৌ প্রকাশ না ঘটায় ;বরং মূল বিষয়বস্তুকেই বিতর্কিত করে তোলে তাহলে এ বিষয়টি সঠিক রূপে প্রকাশ লাভ করবে না ;আ তা আশুরার রূপকেই বেমানান করে তুলবে । উদাহরণস্বরূপ ,কিছুসংখ্যক লোক ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজেদের শরীরে আঘাত করার মাধ্যমে শোক প্রকাশ করে থাকে । এ ধরনের ব্যক্তিরা শুধু আশুরার প্রকৃত আদর্শকে বিকৃতরূপে প্রচার করল না ;বরং যেমনভাবে ইসলামী বিপ্লবের নেতা আলী খামেনেয়ী বলেছেন ,তারা আশুরার শিক্ষার প্রতি অবমাননা করল এবং এ অবমাননার কারণে এ ধরনের কাজ বৈধ হবে না ।372

42 নং প্রশ্ন : যদিও ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব অতুলনীয় তবুও কেন কিছু শোকানুষ্ঠানে তাঁর কেবল হীন ও মযলুম অবস্থা প্রর্দশন করা হয় । কিভাবে এগুলোকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব ?

উত্তর : عزت শব্দটির অর্থ কঠিন ,শক্তিশালী ,দৃঢ় হওয়া । শব্দটি কোরআনের বেশ কিছু আয়াতে পছন্দনীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে গুরুত্ব সহকারে বর্ণিত হয়েছে এবং এ বৈশিষ্ট্যকে আল্লাহ ,রাসূল (সা.) এবং মুমিনদের অনন্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করেছে ।

ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা কোরআনের এই শিক্ষার অনুসরণের ক্ষেত্রে সবসময় অগ্রগামী ছিলেন । কখনই অপমান ও লাঞ্ছনাকে সহ্য করেননি । ফলে এই বিষয়টিهیهات م نّا الذلة অপমান ও লাঞ্ছনা আমাদের থেকে অনেক দূরে -আশুরার আন্দোলনের অন্যতম স্লোগানে রূপান্তরিত হয়েছে ।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে ,কিছু সূত্র ও লেখনিতে এমন বিষয় উল্লিখিত হয়েছে যার ভিত্তিতে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নামে আয়োজিত কিছু শোকানুষ্ঠানে এমন কথা বলা হয়ে থাকে যেগুলোতে তাঁর আন্দোলনে বিদ্যমান সম্মান ও মর্যাদার উপাদানগুলোকে উপেক্ষা করা হয় ।

এ পদ্ধতির পেছনে নিহিত মনস্তাত্ত্বিক মূল কারণ হলো হোসাইনী আন্দোলনের প্রচারকারী কতিপয় ব্যক্তি ইমামের আন্দোলনের শিক্ষামূলক বিভিন্ন দিক তুলে ধরার পরিবর্তে শুধু তাদের কান্নার অনুভূতিকে জাগ্রত করার জন্য চেষ্টা করে । এ কারণে অগ্রহণযোগ্য ও অবিশ্বস্ত সূত্র থেকে শোকের বিষয়বস্তু বর্ণনা করে এবং হোসাইনী আন্দোলনের অপমানজনক ও লাঞ্ছনাময় চেহারা মানুষের সামনে চিত্রায়িত করে ।

যে সকল বিষয়বস্তু বর্ণনার ফলে ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সাহাবীদের সম্মান ও মর্যাদার হানি ঘটে এবং যার বর্ণনা ইসলাম ,রাসূল (সা.) ,আলী (আ.) এবং আহলে বাইতের সুন্নাতের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তা অগ্রহণযোগ্য ও অনাকাঙ্ক্ষিত ;এ ধরনের বিষয়বস্তুকে অবশ্যই বর্জন করতে হবে ।

তবে দলিল সহকারে ও সঠিক সূত্র থেকে হোসাইন (আ.) ও তাঁর সাহাবীরা যে সকল অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছেন তা বর্ণনা ও বিশ্লেষণের অর্থ তাঁদের মর্যাদার হানি ঘটা নয় ;বরং এর মাধ্যমে তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা মানুষের নিকট আরো সুস্পষ্ট করা হয় । কেননা ,শত্রুদের অত্যাচারের ঘটনার বর্ণনা এবং তাদের মোকাবেলায় ইমাম হোসাইনের সাহসী ও ও সংগ্রামী ভূমিকার বিশ্লেষণ এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করে যে ,কিভাবে অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা সম্ভব ।

44 নং প্রশ্ন : আশুরার মহত্ত্ব প্রকাশ ও এর গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য কেন আলোচনা-সংলাপকে যথেষ্ট গণ্য করা হয় না ? কেন এ ধারণা করা হয় যে ,আশুরার ঘটনাকে জীবন্ত রাখার একমাত্র পদ্ধতি হলো মানুষকে অবশ্যই বুক চাপড়িয়ে ক্রন্দন করতে হবে ,শহরকে কালো রঙে ঢেকে দিতে হবে ,অর্ধরাত্রি পর্যন্ত শোকানুষ্ঠান পালন করতে হবে ;এমনকি দিনের কিছু সময়ে বা আশুরার পুরো দিন কাজ-কর্ম পরিহার করে রাস্তায় বের হয়ে

সমবেতভাবে মাতম করতে করতে দীর্ঘ পথ হেঁটে যেতে হবে ? বিশেষ করে যখন এ ধরনের কাজ অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয় ;অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি সাধন ছাড়া এ অনুষ্ঠান পালন করা সম্ভব নয় কি ? এমন কোন পদ্ধতি কি অবলম্বন করা যায় না যাতে এ ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা কম হবে ? উদাহরণস্বরূপ টক শো ,বৈঠক অথবা সেমিনারের ব্যবস্থা করা যেখানে শ্রোতারা এ ধরনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আশুরার স্মৃতিকে জাগ্রত করবে ?

উত্তর : শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ব্যক্তিত্বের ওপর এ ধরনের বৈঠক ,সেমিনার ,আলোচনার অনুষ্ঠান ,প্রবন্ধ লিখন ,সাংস্কৃতিক ,তাত্ত্বিক ,গবেষণামূলক কাজ অত্যন্ত কার্যকরী ও জরুরি ;তবে ইমামের নাম এবং শোকানুষ্ঠানের বরকতে আমাদের সমাজে এ ধরনের কাজ অনেক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে ;সাধারণ মানুষরাও এ থেকে জ্ঞান লাভ করে ।

এ ধরনের কর্মতৎপরতার স্বস্থানে প্রয়োজন রয়েছে । কিন্তু আশুরার শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণরূপে উপকৃত হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট কি ? নাকি অন্যান্য প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান ,যেমন শোকানুষ্ঠান-যার সঙ্গে মানুষ আগে থেকেই পরিচিত ,তারও প্রয়োজন আছে ?

এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের মনোবিদ্যার দৃষ্টিতে মানুষের দিকে দৃষ্টি আরোপ করতে হবে এবং দেখতে হবে আমাদের সচেতনমূলক আচরণের পেছনে কোন্ ধরনের উপাদান অধিক কার্যকর । শুধু জ্ঞান ও প্রজ্ঞাই কি আমাদের সামাজিক আচরণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখে ,নাকি এর সাথে অন্য কোন উপাদান রয়েছে ।

আমাদের আচরণগুলোর দিকে মনোনিবেশ করলে দেখতে পাব যে ,আমাদের আচরণের মধ্যে কমপক্ষে দু টি উপাদান মূল ভূমিকা পালন করে । একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও পরিচিতিমূলক উপাদান অপরটি অভ্যন্তরীণ মনোগত উপাদান । এক ধরনের পরিচিতিমূলক উপাদান রয়েছে যার কারণে মানুষ কোন বিষয় সম্পর্কে ধারণা লাভ করে ও একে গ্রহণ করে । স্বাভাবিক ভাবেই যে কোন বিষয় সম্পর্কে জানতে তার উপযোগী বৃদ্ধিবৃত্তিক বা অভিজ্ঞতামূলক অথবা অন্য যে কোন দলিল ব্যবহার করা হয় ।

নিশ্চিতভাবে কোন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান আমাদের আচরণের ওপর অনেক প্রভাব রাখে ,কিন্তু তা একমাত্র কার্যকরী উপাদান নয় । আরো অনেক

ধরনের উপাদান রয়েছে ,হয়তো আমাদের আচরণের ওপর সেগুলোর প্রভাব পরিচিতিমূলক উপাদানের চেয়েও অধিক । এ ধরনের উপাদানকে সার্বিকভাবে আবেগ ,অনুভূতি ও প্রবণতা নামকরণ করা হয় । এগুলো অভ্যন্তরীণ ও মনোগত উপাদান হিসেবে আমাদের আচরণের ওপর কার্যকর ভূমিকা রাখে ।

যখনই আপনি আপনার আচরণকে-হোক তা ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অথবা সামাজিক বা রাজনৈতিক-পর্যালোচনা করবেন ,লক্ষ্য করবেন যে ,যে মূল উপাদানটি আপনাকে এ ধরনের আচরণ করতে বাধ্য করেছে তা হলো উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী কোন উপাদান ।

শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মুতাহ্হারী এ বিষয়ে বলেন : আমাদের অভ্যন্তরে কোন উপাদান থাকতে হবে যা আমাদেরকে উদ্দীপ্ত করবে । কোন কাজের জন্য আমাদের আগ্রহ থাকতে হবে ,তবেই আমরা কাজটি সম্পাদন করতে উদ্যোগী হব । শুধু কোন কাজ সম্পর্কে জ্ঞান ঐ কাজ করতে আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে না ,এর সাথে মনোগত কারণও রয়েছে যা ঐ কাজের দিকে উদ্বুদ্ধ করে । এ ধরনের উপাদানকে অভ্যন্তরীণ ও মনোগত উপাদান বলা হয় । এ উপাদানই সার্বিকভাবে কোন কাজে পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে আগ্রহ ,ভালোবাসা ও উদ্দীপনা তৈরি করে । এ উপাদান না থাকলে কোন কাজ সম্পন্ন হয় না । এমনকি যদি মানুষ কোন খাদ্যের বিষয়ে এ জ্ঞান রাখে যে ,তা শরীরের জন্য উপকারী ,কিন্তু ঐ খাদ্য খাওয়ার প্রতি তার আগ্রহ না থাকে তাহলে সে ঐ খাদ্য গ্রহণ করবে না । যদি কোন ব্যক্তির খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে যায় ,খাওয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ,যতই তাকে বলা হোক যে ,খাদ্যটি শরীরের জন্য উপকারী ,তবু সে খাদ্যটি খাওয়ার ব্যপারে কোন আগ্রহ খুঁজে পাবে না । অতএব ,কোন কাজের ক্ষেত্রে জ্ঞান ও পরিচিতি ছাড়াও মানুষের মনের আগ্রহ-উদ্দীপনারও প্রয়োজন রয়েছে । সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ও ঠিক একই রকম । কোন ব্যক্তি কোন আন্দোলনকে ভালো ও উপকারী মনে করলেও যতক্ষণ পর্যন্ত না ঐ আন্দোলনের ব্যাপারে উৎসাহ-উদ্দীপনা খুঁজে পায় ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে না ।

এখন এ বিষয়টিকে আমরা গ্রহণ করেছি যে ,মানুষের সচেতনমূলক যে কোন পদক্ষেপ বা আচরণের পেছনে দুই ধরনের উপাদান থাকা অত্যন্ত জরুরি । প্রথম ,ঐ বিষয় সম্পর্কে পরিচিতিমূলক জ্ঞান । দ্বিতীয় ,ঐ কাজের

জন্য অভ্যন্তরীণ মনোগত উপাদান অর্থাৎ উৎসাহ-উদ্দীপনা । আমরা শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন মানবজাতির সৌভাগ্যের জন্য কী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তা জানার পরও বুঝতে পারি যে ,শুধু এ ঘটনা সম্পর্কে তথ্য ও জ্ঞান আমাদেরকে এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী করে তোলে না ;বরং যখন ঐ বিষয়ের প্রতি আমাদের মনে উদ্দীপনা ও আগ্রহ সৃষ্টি হবে তখনই কেবল ঐ আন্দোলনকে স্মরণ করে ইমাম হোসাইনের মতো নিজেকে উৎসর্গ করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করব ।

শুধু কোন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান ও পরিচিতি ঐ বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করে না ;বরং অভ্যন্তরীণ উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হতে হয় যা আমাদেরকে ঐ কাজের প্রতি আগ্রহী করে তোলে ।

সভা-সমাবেশ ,আলোচনা-পর্যালোচনা ,বক্তব্য প্রথম উপাদানের অর্থাৎ পরিচিতি ,তথ্য ও জ্ঞানের চাহিদা পূরণ করে ,কিন্তু আমাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য অন্য উপাদানের প্রয়োজন রয়েছে । কোন ঘটনার পরিচিতি ,স্মরণ ও পর্যালোচনা ঐ কাজে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে ,তবে যে উপাদানটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল ভূমিকা পালন করে তা হলো মনের দিক-যা সরাসরি মানুষের আবেগ-অনুভূতির সাথে জড়িত ।

যখন কোন মর্মান্তিক ঘটনাকে মঞ্চায়িত করা হয় এবং মানুষ এ ঘটনাকে খুব নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করে তখন সেটার সাথে বই পড়ে অথবা অন্য কারো নিকট থেকে ঐ ঘটনা জানতে পারার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে ।

এ রকম অভিজ্ঞতা আপনারা নিজেরা অনেকবার অর্জন করেছেন । অনেকবার আশুরার ঘটনা শুনেছেন একং জেনেছেন যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) কীভাবে কারবালার প্রান্তরে শহীদ হয়েছেন । কিন্তু শুধু এ ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞান কি আপনাদের চোখের অশ্রু প্রবাহিত করে ? অবশ্যই ,না । অথচ যখন আপনি কোন শোকানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন এবং শোকগাথা পাঠকারী কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা আকর্ষণীয় কণ্ঠে বর্ণনা করেন ,বিশেষ করে যদি তাঁর সুর ভালো হয় ,তাহলে অনিচ্ছাকৃতভাবেই আপনার চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়বে ।

এ পদ্ধতি আপনার অনুভূতির ওপর অধিক প্রভাব বিস্তার করতে পারে যা শুধু অধ্যয়ন ও জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে সম্ভব নয় । এ কারণেই যা প্রত্যক্ষ করা হয় তা শোনার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি প্রভাব রাখে । এ বিষয়গুলো বর্ণনা করার উদ্দেশ্য ছিল এ বিষয়টি বোঝানো যে ,আমাদের অবশ্যই জানতে হবে কেন আবু আবদিল্লাহ (আ.) বিদ্রোহ করেছেন ,মযলুম অবস্থায় শহীদ হয়েছেন । কিন্তু এর পাশাপাশি আশুরার ঘটনাকে আমাদের সামনে বর্ণনা বা মঞ্চায়নের মাধ্যমে এমনভাবে সাজাতে ও চিত্রায়িত করতে হবে যাতে তা বেশি পরিমাণে আমাদের হৃদয় ও অনুভূতিকে নাড়া দেয় এবং আমাদের মধ্যে আবেগের সৃষ্টি হয় । যত বেশি এ আবেগ সৃষ্টি হবে তত বেশি আমাদের জীবনে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে ।

এ কারণেই আশুরার ঘটনার ওপর শুধু তত্ত্বগত আলোচনা প্রকৃত ভূমিকা পালনে অক্ষম । বরং সামাজিকভাবে এমনভাবে শোকানুষ্ঠান পালন করতে হবে যা মানুষের অনুভূতিকে জাগ্রত করবে । যখন কেউ সকালে ঘর থেকে বাহিরে বের হয়ে দেখতে পায় সম্পূর্ণ শহরকে কালো কাপড়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে এবং সর্বত্র কালো পতাকা স্থাপন করা হয়েছে ,এ পরিবর্তনটি মানুষের অন্তরকে অধিক নাড়া দেয় ।

যদিও মানুষ জানে আগামীকাল মুহররমের প্রথম দিন ,কিন্তু এ তথ্য তাদের অন্তরকে ঐ রকম প্রভাবিত করতে পারে না যতটা সকল স্থানে কালো পতাকা ও সকলকে কালো পোশাক পরিহিত দেখা তাকে প্রভাবিত করবে । তাই সামষ্টিক ভাবে বিশেষ উৎসাহ ও উদ্দীপনা সহকারে মর্সিয়া পাঠ ও বুক চাপড়ানোর অনুষ্ঠান পালন করার মাধ্যমে যতটা প্রভাব ফেলা সম্ভব ,অন্য কোন কিছুতে তা সম্ভব নয় ।

এখান থেকে ইমাম খোমেইনী (রহ.) যে বক্তব্যগুলো অসংখ্য বার পুনরাবৃত্তি করতেন সেগুলোর কারণ অনুধাবন করা সম্ভব । তিনি বলতেন : আমাদের যা কিছু (মূল্যবোধ) রয়েছে তা মুহররম ও সফর থেকে । তিনি শোকানুষ্ঠানকে ঐত্যিহ্যবাহী প্রচলিত পদ্ধতিতে পালন করার ওপর গুরুত্ব দিতেন । কেননা ,গত তের শতাব্দীর অভিজ্ঞতায় প্রমাণ হয়েছিল যে ,আবেগময় পদ্ধতিতে শোক পালনের বিষয়টি মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আত্মত্যাগী অনুভূতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে কত বেশি ভূমিকা রাখে এবং কীরূপ অলৌকিক পরিবর্তন ঘটায়!

অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে ,ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও সাদ্দামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে যে সকল বিজয় অর্জিত হয়েছে তার সবই আশুরার শিক্ষা এবং শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নামের বরকতে অর্জিত হয়েছে । এই প্রভাব অত্যন্ত গভীর ও অচিন্তনীয় ছিল । কোন বস্তুর বিনিময়ে এ ধরনের মহামূল্যবান অনুভূতি সমাজের মধ্যে সৃষ্টি করা সম্ভব ? এরূপ শোকানুষ্ঠানগুলো কি ধরনের পবিত্র প্রেমের সৃষ্টি করে যা মানুষকে শাহাদাত বরণ করার জন্য প্রস্তুত করে ? যদি বলি যে ,প্রকৃত ইসলাম ছাড়া অন্য কোন সমাজ ও মতাদর্শেই এ ধরনের উপাদানের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না ,তাহলে অর্থহীন কোন কথা বলি নি ।

শোকানুষ্ঠান পালন করার সময়

44 নং প্রশ্ন : কেন আমরা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ক্ষেত্রে তাঁর শাহাদাতের দিন আসার পূর্বেই (আশুরার দিনের পূর্বে) শোক পালন শুরু করি ?

উত্তর : আশুরার পূর্বে শোকানুষ্ঠান পালন হচ্ছে আশুরার শোকানুষ্ঠানের ভূমিকাস্বরূপ । আবু আবদিল্লাহ (আ.)-এর জন্য শোক পালনের মূলনীতি ইসলামী শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাবের অন্তর্ভুক্ত । কিন্তু এ অনুষ্ঠানের ধরন ও সময় বিভিন্ন সমাজ ও জাতিতে প্রচলিত প্রথা ও রীতি দ্বারা প্রভাবিত হয় । যেমন কিছু অঞ্চলে ইমাম হোসাইনের শোকানুষ্ঠান 7 মুহররম থেকে শুরু হয়ে 3রা সফর পর্যন্ত চলতে থাকে ,কিছু অঞ্চলে 1লা মুহররম থেকে আশুরার দিন পর্যন্ত চলে ;কিছু অঞ্চলে সারা বছর বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে শোকগাথার অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় ;কিছু অঞ্চলে মুহররম মাসের শুরু থেকে সফর মাসের শেষ দিন পর্যন্ত শোকানুষ্ঠান চলে ।

এ সকল ধরন আসলে কোন সমস্যা নয় । কারণ ,শোকানুষ্ঠান এবং মৃত্যুবার্ষিকী পালন বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি ও রীতিনীতির সাথে সম্পর্কিত । সাধারণত মৃত্যুবার্ষিকী পরবর্তী বছরগুলোতে মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর রাতে পালন করা হয় । যেহেতু শাহাদাত অনেক বছর পূর্বে সংঘটিত হয়েছে সেহেতু শোকানুষ্ঠানগুলো বছরের যে কোন সময়ে পালন করা হোক না কেন ,এ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরে ঘটেছে ।

কালো পোশাক পরিধান

39 নং প্রশ্ন : শোক প্রকাশের দিনে কালো পোশাক পরিধানের দর্শন কী ?

কালো রং বিভিন্ন দিক থেকে ভিন্ন প্রভাব এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী । এর বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা অনুসারে কিছু বা বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ কোন ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠী নিজেদের প্রয়োজন অনুসারে এর ব্যবহার করে থাকে । কালো রং একদিকে বস্তুকে অন্ধকারে গোপন ও ঢেকে রাখে তাই কখনও কখনও এ রঙ কোন কিছুকে ঢেকে রাখা বা গোপন রাখার জন্য ব্যবহৃত হয় ।357 আবার অন্যদিকে তা ব্যক্তিত্বের নিদর্শন হিসেবে পরিচিত । এ কারণেই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের আনুষ্ঠানিক পোশাক (বিশেষত বহিরাবরণ ,যেমন কোট ,ব্লেজার ইত্যাদি) সাধারণত কালো বা গাঢ় সুরমা রঙের হয় । ইতিহাসে এরূপ অনেক বর্ণনা পাওয়া যায় যে ,বিশেষ ব্যক্তি ,গোষ্ঠী এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ব্যক্তিত্ব প্রকাশের জন্য এ ধরনের রঙ ব্যবহার করতেন ।358

কালো রঙের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব হলো ,এ রঙটি প্রকৃতিগতভাবে দুঃখ ,বিষাদ ও বিষণ্ণতার পরিচায়ক যা শোক প্রকাশের উপযোগী । এ কারণে বিশ্বের অনেক মানুষ এ রঙকে তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুর দুঃখ ,শোক ও বিষণ্ণতা প্রকাশে ব্যবহার করে থাকে ।

এ বিষয়টি স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে ,শোক প্রকাশের দিনগুলোতে কালো রঙ নির্বাচনের মধ্যে উপরোল্লিখিত যুক্তিগুলো ছাড়াও আবেগ-অনুভূতির বিষয়ও জড়িত রয়েছে । যে ব্যক্তি তার প্রিয় মানুষের শোকে নিজে কালো পোশাক পরিধান করে এবং দেওয়ালগুলোকে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয় প্রকৃতপক্ষে সে এ কাজ দ্বারা বলতে ও বুঝাতে চায়- (হে বিদায়ী) তুমি আমার চোখের জ্যোতি ও মণি ছিলে ,তোমার মরদেহ মাটিতে দাফন হওয়া আমার কাছে পশ্চিম আকাশে চন্দ্র ও সূর্যের অস্তমিত হওয়ার মতো ;(তোমার বিদায়) জীবনকে আমার চোখে অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছে ;সময় ও স্থানকে গ্রাস করে ফেলেছে ।

হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর অষ্টম দিনে পিতার কবরের নিকট গিয়ে ক্রন্দন করে নিম্নলিখিত কবিতাটি পাঠ করেছিলেন

یا ابتاه انقطعت بك الدنیا بانوارها و زوت زهرتها کانت ببهجتك زاهرة فقد اسود نهارها فصار يحکی حنادسها رطبها و یا بسها...والْسی... لازمنا

হে পিতা! তুমি চলে গেছ ,তোমার চলে যাওয়ার কারণে দুনিয়া এর আলো আমাদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে ,এর নেয়ামতসমূহ থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছে ,বিশ্বজগৎ তোমার সৌন্দর্যে উজ্জ্বল ও আলোকিত ছিল ,(কিন্তু তোমার বিদায়ের পর) এর দিনের আলো অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছে ,এর (দুনিয়ার) সিক্ততা ও শুষ্কতা ,এর অন্ধকার রাতের নির্দেশ করে... এবং দুঃখ ও মর্মবেদনা আমাদের সবসময়ের সঙ্গী... । 359

এ কারণেই কালো পোশাক পরিধান করার কারণ কালো রঙে লুক্কায়িত থাকা গোপন রহস্যের মধ্যে নিহিত এবং এর প্রকৃতিগত (দুঃখ ও শোকবাহী) রূপটিই একে যুক্তিসঙ্গত একটি প্রথায় পরিণত করেছে । আহলে বাইত (আ.)-এর অনুসারীরা শোক প্রকাশের দিনগুলোতে কালো পোশাক পরিধান করে । কারণ ,এ পোশাক তাঁদের প্রতি প্রেম ও বন্ধুত্বের নিদর্শন বহন করে ,স্বাধীনচেতাদের মহান নেতা ও আদর্শপুরুষ ইমাম হোসাইনের প্রতি নিবেদিত থাকার প্রতিশ্রুতি দান করে । এর মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার রণাঙ্গনে তাঁকে সহযোগিতার ঘোষণা দেয় ও নৈতিকভাবে তাঁর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ।360 ইমামদের বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকানুষ্ঠানে কালো পোশাক পরে বাহ্যিক কালোর অবয়বে তাঁর সাথে সহমর্মিতা দেখানোর মাধ্যমে নিজের অন্তরকে আলোকিত করা হয় ;যদিও বাহ্যিকভাবে তা কালো ,কিন্তু ভেতরে উজ্জ্বল ও তাঁর আদর্শে আলোকিত ।

40 নং প্রশ্ন : অন্যান্য জাতির মধ্যে কালো পোশাক পরিধান করার প্রচলন রয়েছে কি ? কালো পোশাক পরিধান করার সংস্কৃতি ইসলামের আগমনের পর আব্বাসী খলিফা অথবা আরব জাতি থেকে ইরানে প্রবেশ করেছে ,ইরানী সভ্যতায় এ ধরনের সংস্কৃতি ছিল না ।

উত্তর : প্রথমত ,শোকের সময় কালো পোশাক পরিধানের রীতি বিভিন্ন জাতির মধ্যে গ্রহণযোগ্য এক প্রথা হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে প্রচলিত ছিল । প্রাচীন ইরান থেকে শুরু করে গ্রীক সভ্যতা ,এমনকি আরবের জাহেলী সংস্কৃতিতেও এর প্রচলন ছিল ।

দ্বিতীয়ত ,কালো পোশাক পরিধান আব্বাসী খলিফাদের সময় অথবা ইসলাম আগমনের পর আরবদের নিকট থেকে ইরানে প্রবেশ করেনি ;বরং এর মূল প্রাচীনকাল থেকেই ইরানী সংস্কৃতিতে নিহিত ছিল এবং বাহ্যিকভাবে তাদের ব্যবহারিক জীবনে এর প্রচলন ছিল । নিচের বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করলে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে :

1. অনেক ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক বর্ণনা এ বিষয়টি স্পষ্ট করে যে ,পৃথিবীর অনেক জাতি ও গোষ্ঠী প্রাচীনকাল থেকে শোকের দিনগুলোতে কালো পোশাক পরিধান করত । উদাহরণস্বরূপ ইরান ,গ্রীক ও আরব সংস্কৃতির কিছু নমুনা তুলে ধরলাম :

ক. প্রাচীন ইরানের কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : প্রাচীন ইরানের পাণ্ডুলিপিগুলোতে অনেক প্রমাণ রয়েছে যে ,কালো পোশাক শোকের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হতো । ইরানী বিখ্যাত সাহিত্যিক ফেরদৌসী শাহনামা তে ইরানী প্রাচীন সংস্কৃতির বিভিন্ন ঘটনাতে কালো পোশাক শোকের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করেছেন ।

বিশেষ করে যখন রুস্তমের ভাই শুগাদ তাকে কাপুরুষের মতো হত্যা করেছিল ,ফেরদৌসী তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন :

এক বছর সিস্তানে শোক ছিল ,তাদের জামাসমূহ কালো ছিল ।

সাসানীদের যুগে যখন বাহরাম গুর দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল ,তার উত্তরাধিকারী ইয়াজ্দর্গাদ শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ।

পথে চল্লিশ দিন পিতার শোক পালন করেছিল ,

সৈন্যরা কালো পোশাক পরিধান করেছিল ।

ফেরেইদুন যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল তার উত্তরাধিকারী ও সন্তানরা এ কাজ করেছিল :

মানুচেহর এক সপ্তাহ যন্ত্রণায় ছিল ,দুই চোখ অশ্রুপূর্ণ ও চেহারা হলুদ ছিল ;সকলে পরেছিল কালো পোশাক ,রাজা পেলেন মনোবল সৈন্যদের সম্মিলিত সমবেদনা প্রকাশে ।

এ কালো পোশাক পরার সংস্কৃতি এখন পর্যন্ত ইরানে চালু রয়েছে ।361

খ. গ্রীক সভ্যতায় কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : গ্রীসের প্রাচীন কল্পকাহিনীতে এসেছে : হেক্টরের হাতে প্রটিসিলাস নিহত হওয়ার ঘটনায় টাইটাস অত্যন্ত ভারাক্রান্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে শোকের চিহ্ন হিসেবে সবচেয়ে কালো পোশাক পরিধান করেছিল ।

এ বিষয়টি গ্রীক সভ্যতায় কবি হোমারের যুগে কালো পোশাক পরিধান করার প্রথার প্রমাণ বহন করে । ইহুদিদের মধ্যে প্রাচীনকালে আত্মীয়-স্বজনের শোকে এ প্রথা প্রচলিত ছিল যে ,সকলে মাথা কামিয়ে ছাই মাখত এবং তাদের পোশাক কালো অথবা কালোর কাছাকাছি কোন রংয়ের ছিল ।362

বুসতানী তাঁর বিশ্বকোষ -এ কালো রঙ ইউরোপীয় সভ্যতার সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোতে শোক পালনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত রং হিসেবে গণ্য হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন এবং লিখেছেন : শোক পালনের সময় মৃত ব্যক্তির আত্মীয়তার নৈকট্যের শ্রেণিভেদে তারা এক সপ্তাহ থেকে এক বছর পর্যন্ত শোকানুষ্ঠান পালন করে । বিশেষ করে বিধবা নারীরা কমপক্ষে এক বছর শোক পালন করে এবং এই সময়ে তাদের পোশাক থাকে কোন ধরনের নকশা ও অলংকার ছাড়া কালো রংয়ের ।363

আরব জাতির কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : আরবদের ইতিহাস ,কবিতা ও ভাষা সাক্ষ্য দেয় যে ,মিশর হতে সিরিয়া ,ইরাক ও সৌদি আরবসহ সব জায়গায় কালো রঙ শোকের রঙ হিসেবে পরিচিত ছিল ।

ষষ্ঠ শতাব্দীর আরব সাহিত্যিক ও কোরআনের মুফাস্সির যামাখশারী লিখেছেন : একজন সাহিত্যিক বলেছেন : কালো পোশাক পরিধানকারী সন্যাসীকে দেখে প্রশ্ন করেছিলাম : কেন কালো পোশাক পরিধান করেছ ? বলল : আরবরা যখন তাদের মধ্য হতে কেউ মারা যায় তখন কোন্ ধরনের পোশাক পরিধান করে ? সন্যাসী বলল : আমিও আমার গুনাহের শোকে কালো পোশাক পরিধান করেছি । 364

ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত হয়েছে যে ,আরব জাতি তাদের মুসিবতের সময় নিজেদের পোশাককে কালো করত ।365

রাসূল (সা.)-এর যুগে বদরের যুদ্ধের শেষে যখন 70 জন মুশরিক ও কুরাইশ মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছিল তখন মক্কার নারীরা তাদের নিহতদের শোকে কালো পোশাক পরিধান করেছিল ।366

এসকল ঐতিহাসিক বর্ণনা এবং সাহিত্যিক রচনা ও কবিতা প্রমাণ করে যে ,কালো রং প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর মধ্যে শোকের চিহ্ন হিসেবে প্রচলিত ছিল । এ বিষয়টি ইরান বা ইসলামী যুগের সাথে বিশেষ ভাবে সম্পৃক্ত নয় ;বরং ইসলামের পূর্বে ইরানীরা ও প্রাচীন গ্রীসের আধিবাসীরাও শোক প্রকাশের প্রথা হিসেবে কালো অথবা গাঢ় নীল রংয়ের পোশাক পরিধান করত ।367

2. আহলে বাইত (আ.)-এর মাঝে কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : তথ্যভিত্তিক সংবাদ এই বিষয়টির সুস্পষ্ট বর্ণনা করে যে ,রাসূল (সা.) এবং পবিত্র ইমামগণও এই যৌক্তিক প্রকৃতিগত পথকে সমর্থন করেছেন এবং নিজেদের প্রিয় ব্যক্তির শোকে তাঁরা নিজেরাও কালো পোশাক পরিধান করেছেন ।

নাহজুল বালাগার শারহ (ব্যাখ্যা গ্রন্থ)-এ ইবনে আবিল হাদীদ বর্ণনা করেছেন : ইমাম হাসান (আ.) তাঁর পিতা আলী (আ.)-এর শাহাদাতের শোকে কালো পোশাক পরিধান করে মানুষের মাঝে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন ।368

এ কারণে যে হাদীসটি সকল হাদীসবিদ বর্ণনা করেছেন যে ,ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন : বনি হাশিমের নারীরা আবা-আবদিল্লাহ হোসাইন (আ.)-এর শোকে কালো পোশাক পরিধান করতেন ।

لما قتل الحسین بن علی)ع ( لیس نساء بنی هاشم السواد و المسوح و کن لاتشتکین من حر ولابرد و کان علی بن الحسین)ع ( یعمل لهن الطعام للمأتم

যখন ইমাম হোসাইন (আ.) শহীদ হলেন তখন বনি হাশিমের নারীরা কালো ও রুক্ষ-পশমের পোশাক পরিধান করেছিলেন ,গরম বা ঠাণ্ডার বিষয়ে তাঁদের কোন অভিযোগ ছিল না ,তাঁরা শোক পালনে রত থাকার কারণে (আমার পিতা) আলী ইবনে হোসাইন (আ.) তাঁদের জন্য খাবার তৈরি করতেন ।

আব্বাসীদের কালো পোশাক পরিধান করার কারণ

আব্বাসী খলিফারা উমাইয়া খলিফাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর সময় থেকে বাহ্যিকভাবে নিজেদেরকে আহলে বাইতের শহীদদের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণকারী হিসেবে দাবি করেছিল । এ কারণে যখন তারা ক্ষমতা অর্জন করেছিল তখন তাদের শাসনকে আলে মুহাম্মাদ (সা.)-এর শাসন হিসেবে অভিহিত করত এবং বলত যে ,এই খেলাফত হচ্ছে আলী (আ.)-এর খেলাফতেরই ধারাবাহিকতা । তাদের প্রধানমন্ত্রী আবু সালামা খাল্লালকে আলে মুহাম্মাদের প্রধানমন্ত্রী এবং তাদের সামরিক বাহিনীর প্রধান আবু মুসলিম খোরাসানিকে আলে মুহাম্মাদের আমিন (বিশ্বস্ত ব্যক্তি) বা নেতা হিসেবে নামকরণ করেছিল ।

কালো পোশাক রাসূল (সা.)-এর অবমাননা ও তাঁর আহলে বাইতের ওপর ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক ঘটনার শোকের প্রতীক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে ।369 আব্বাসী খলিফারা কালো পোশাক পরিধানের প্রথা ইরানে এবং অন্যান্য ইসলামী শহরে প্রবর্তন করে নি ;কেননা ,মৃত ব্যক্তির শোকে কালো পোশাক পরিধানের প্রথা সামাজিকভাবে এবং বিশেষভাবে শহীদদের সর্দার ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকে প্রথম থেকেই প্রচলিত ছিল ।

কারবালার মযলুম শহীদ ইমাম হোসাইন এবং বনি উমাইয়ার হাতে নিহত তাঁর নাতি যাইদ ইবনে আলী ও ইয়াহিয়া ইবনে যাইদের রক্তের প্রতিশোধের অজুহাতে আব্বাসী খলিফারা কালো পতাকা ও কালো পোশাক পরিধান করাকে আহলে বাইতের শহীদদের শোক প্রকাশের উপকরণরূপে ব্যবহার করেছে । এই ধরনের কৌশল ব্যবহার করে তারা আহলে বাইতের অনুসারীদের প্রতারিত করে নিজেদের দলে আনার চেষ্টা করেছে এবং এ ধরনের প্রচার-প্রপাগান্ডার মাধ্যমে মানুষের মনে নিজেদের স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছে । তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও কালো পতাকা ও পোশাককে সবসময়ের জন্য নিজেদের নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছিল ।370

এই প্রতারণার কারণেই ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এবং অন্যান্য ইমাম কালো রঙের পোশাকের বিরুদ্ধে ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলতেন । আব্বাসী খলিফারা আনুষ্ঠানিকভাবে কালো পোশাককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কারণে ইমামরা এই বিষয়ে তাদের বিরোধিতা করেছেন । তাদের সাথে এ বিষয়ে (কালো পোশাক ব্যবহার) একাত্মতা প্রকাশ করা অত্যাচারী শাসককে স্বীকৃতি দান বলে মনে করা হতো । কিন্তু তাঁরা সার্বিকভাবে আহলে বাইতের শহীদদের শোকে শোকাহত হয়ে কালো পোশাকের সংস্কৃতির বিরোধী ছিলেন না ।371

শোক প্রকাশের পদ্ধতি

41 নং প্রশ্ন : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য কী পরিমাণ শোক প্রকাশ করা বৈধ ?

ইসলামী শরিয়তের বিধান শোক প্রকাশের পেছনে নিহিত দর্শন ও বুদ্ধিমান সমাজের কাছে সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য নীতিই আহলে বাইত বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোক প্রকাশের সীমানা নির্ধারণ করবে । যদি শোকের আবেগ-উদ্দীপনার মাত্রা তার বুদ্ধিবৃত্তির ওপর এমনভাবে প্রাধ্যান্য লাভ করে যে ,এর দর্শন থেকে বিচ্যুত হয় তাহলে তা শরিয়ত ও বৃদ্ধিবৃত্তির সীমানা থেকে দূরে সরে যাবে । যদি এর ধরন এমন হয় যা বুদ্ধিবৃত্তিগতভাবে সমাজ অপছন্দ ও ঘৃণা করে ,তা শিয়া মাযহাব ও এর প্রকৃত শিক্ষার সাথে অবমাননাকর মনে হয় তাহলে অবশ্যই এ ধরনের শোক প্রকাশ অনাকাঙ্ক্ষিত ও বর্জিত হবে ।

বলা বাহুল্য ,শোক প্রকাশের ধরন এমন হওয়া উচিত যাতে এর শিক্ষার প্রকৃত বিষয়বস্তুকে মানুষের মাঝে সঠিকভাবে প্রচার করতে পারে এবং ইমামদের সম্পর্কে মানুষের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে । যদি এ শোক প্রকাশের বাহ্যিক রূপ এমন হয় যে ,অভ্যন্তরীণ রূপের আদৌ প্রকাশ না ঘটায় ;বরং মূল বিষয়বস্তুকেই বিতর্কিত করে তোলে তাহলে এ বিষয়টি সঠিক রূপে প্রকাশ লাভ করবে না ;আ তা আশুরার রূপকেই বেমানান করে তুলবে । উদাহরণস্বরূপ ,কিছুসংখ্যক লোক ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজেদের শরীরে আঘাত করার মাধ্যমে শোক প্রকাশ করে থাকে । এ ধরনের ব্যক্তিরা শুধু আশুরার প্রকৃত আদর্শকে বিকৃতরূপে প্রচার করল না ;বরং যেমনভাবে ইসলামী বিপ্লবের নেতা আলী খামেনেয়ী বলেছেন ,তারা আশুরার শিক্ষার প্রতি অবমাননা করল এবং এ অবমাননার কারণে এ ধরনের কাজ বৈধ হবে না ।372

42 নং প্রশ্ন : যদিও ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব অতুলনীয় তবুও কেন কিছু শোকানুষ্ঠানে তাঁর কেবল হীন ও মযলুম অবস্থা প্রর্দশন করা হয় । কিভাবে এগুলোকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব ?

উত্তর : عزت শব্দটির অর্থ কঠিন ,শক্তিশালী ,দৃঢ় হওয়া । শব্দটি কোরআনের বেশ কিছু আয়াতে পছন্দনীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে গুরুত্ব সহকারে বর্ণিত হয়েছে এবং এ বৈশিষ্ট্যকে আল্লাহ ,রাসূল (সা.) এবং মুমিনদের অনন্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করেছে ।

ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা কোরআনের এই শিক্ষার অনুসরণের ক্ষেত্রে সবসময় অগ্রগামী ছিলেন । কখনই অপমান ও লাঞ্ছনাকে সহ্য করেননি । ফলে এই বিষয়টিهیهات م نّا الذلة অপমান ও লাঞ্ছনা আমাদের থেকে অনেক দূরে -আশুরার আন্দোলনের অন্যতম স্লোগানে রূপান্তরিত হয়েছে ।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে ,কিছু সূত্র ও লেখনিতে এমন বিষয় উল্লিখিত হয়েছে যার ভিত্তিতে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নামে আয়োজিত কিছু শোকানুষ্ঠানে এমন কথা বলা হয়ে থাকে যেগুলোতে তাঁর আন্দোলনে বিদ্যমান সম্মান ও মর্যাদার উপাদানগুলোকে উপেক্ষা করা হয় ।

এ পদ্ধতির পেছনে নিহিত মনস্তাত্ত্বিক মূল কারণ হলো হোসাইনী আন্দোলনের প্রচারকারী কতিপয় ব্যক্তি ইমামের আন্দোলনের শিক্ষামূলক বিভিন্ন দিক তুলে ধরার পরিবর্তে শুধু তাদের কান্নার অনুভূতিকে জাগ্রত করার জন্য চেষ্টা করে । এ কারণে অগ্রহণযোগ্য ও অবিশ্বস্ত সূত্র থেকে শোকের বিষয়বস্তু বর্ণনা করে এবং হোসাইনী আন্দোলনের অপমানজনক ও লাঞ্ছনাময় চেহারা মানুষের সামনে চিত্রায়িত করে ।

যে সকল বিষয়বস্তু বর্ণনার ফলে ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সাহাবীদের সম্মান ও মর্যাদার হানি ঘটে এবং যার বর্ণনা ইসলাম ,রাসূল (সা.) ,আলী (আ.) এবং আহলে বাইতের সুন্নাতের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তা অগ্রহণযোগ্য ও অনাকাঙ্ক্ষিত ;এ ধরনের বিষয়বস্তুকে অবশ্যই বর্জন করতে হবে ।

তবে দলিল সহকারে ও সঠিক সূত্র থেকে হোসাইন (আ.) ও তাঁর সাহাবীরা যে সকল অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছেন তা বর্ণনা ও বিশ্লেষণের অর্থ তাঁদের মর্যাদার হানি ঘটা নয় ;বরং এর মাধ্যমে তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা মানুষের নিকট আরো সুস্পষ্ট করা হয় । কেননা ,শত্রুদের অত্যাচারের ঘটনার বর্ণনা এবং তাদের মোকাবেলায় ইমাম হোসাইনের সাহসী ও ও সংগ্রামী ভূমিকার বিশ্লেষণ এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করে যে ,কিভাবে অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা সম্ভব ।

44 নং প্রশ্ন : আশুরার মহত্ত্ব প্রকাশ ও এর গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য কেন আলোচনা-সংলাপকে যথেষ্ট গণ্য করা হয় না ? কেন এ ধারণা করা হয় যে ,আশুরার ঘটনাকে জীবন্ত রাখার একমাত্র পদ্ধতি হলো মানুষকে অবশ্যই বুক চাপড়িয়ে ক্রন্দন করতে হবে ,শহরকে কালো রঙে ঢেকে দিতে হবে ,অর্ধরাত্রি পর্যন্ত শোকানুষ্ঠান পালন করতে হবে ;এমনকি দিনের কিছু সময়ে বা আশুরার পুরো দিন কাজ-কর্ম পরিহার করে রাস্তায় বের হয়ে

সমবেতভাবে মাতম করতে করতে দীর্ঘ পথ হেঁটে যেতে হবে ? বিশেষ করে যখন এ ধরনের কাজ অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয় ;অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি সাধন ছাড়া এ অনুষ্ঠান পালন করা সম্ভব নয় কি ? এমন কোন পদ্ধতি কি অবলম্বন করা যায় না যাতে এ ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা কম হবে ? উদাহরণস্বরূপ টক শো ,বৈঠক অথবা সেমিনারের ব্যবস্থা করা যেখানে শ্রোতারা এ ধরনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আশুরার স্মৃতিকে জাগ্রত করবে ?

উত্তর : শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ব্যক্তিত্বের ওপর এ ধরনের বৈঠক ,সেমিনার ,আলোচনার অনুষ্ঠান ,প্রবন্ধ লিখন ,সাংস্কৃতিক ,তাত্ত্বিক ,গবেষণামূলক কাজ অত্যন্ত কার্যকরী ও জরুরি ;তবে ইমামের নাম এবং শোকানুষ্ঠানের বরকতে আমাদের সমাজে এ ধরনের কাজ অনেক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে ;সাধারণ মানুষরাও এ থেকে জ্ঞান লাভ করে ।

এ ধরনের কর্মতৎপরতার স্বস্থানে প্রয়োজন রয়েছে । কিন্তু আশুরার শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণরূপে উপকৃত হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট কি ? নাকি অন্যান্য প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান ,যেমন শোকানুষ্ঠান-যার সঙ্গে মানুষ আগে থেকেই পরিচিত ,তারও প্রয়োজন আছে ?

এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের মনোবিদ্যার দৃষ্টিতে মানুষের দিকে দৃষ্টি আরোপ করতে হবে এবং দেখতে হবে আমাদের সচেতনমূলক আচরণের পেছনে কোন্ ধরনের উপাদান অধিক কার্যকর । শুধু জ্ঞান ও প্রজ্ঞাই কি আমাদের সামাজিক আচরণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখে ,নাকি এর সাথে অন্য কোন উপাদান রয়েছে ।

আমাদের আচরণগুলোর দিকে মনোনিবেশ করলে দেখতে পাব যে ,আমাদের আচরণের মধ্যে কমপক্ষে দু টি উপাদান মূল ভূমিকা পালন করে । একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও পরিচিতিমূলক উপাদান অপরটি অভ্যন্তরীণ মনোগত উপাদান । এক ধরনের পরিচিতিমূলক উপাদান রয়েছে যার কারণে মানুষ কোন বিষয় সম্পর্কে ধারণা লাভ করে ও একে গ্রহণ করে । স্বাভাবিক ভাবেই যে কোন বিষয় সম্পর্কে জানতে তার উপযোগী বৃদ্ধিবৃত্তিক বা অভিজ্ঞতামূলক অথবা অন্য যে কোন দলিল ব্যবহার করা হয় ।

নিশ্চিতভাবে কোন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান আমাদের আচরণের ওপর অনেক প্রভাব রাখে ,কিন্তু তা একমাত্র কার্যকরী উপাদান নয় । আরো অনেক

ধরনের উপাদান রয়েছে ,হয়তো আমাদের আচরণের ওপর সেগুলোর প্রভাব পরিচিতিমূলক উপাদানের চেয়েও অধিক । এ ধরনের উপাদানকে সার্বিকভাবে আবেগ ,অনুভূতি ও প্রবণতা নামকরণ করা হয় । এগুলো অভ্যন্তরীণ ও মনোগত উপাদান হিসেবে আমাদের আচরণের ওপর কার্যকর ভূমিকা রাখে ।

যখনই আপনি আপনার আচরণকে-হোক তা ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অথবা সামাজিক বা রাজনৈতিক-পর্যালোচনা করবেন ,লক্ষ্য করবেন যে ,যে মূল উপাদানটি আপনাকে এ ধরনের আচরণ করতে বাধ্য করেছে তা হলো উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী কোন উপাদান ।

শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মুতাহ্হারী এ বিষয়ে বলেন : আমাদের অভ্যন্তরে কোন উপাদান থাকতে হবে যা আমাদেরকে উদ্দীপ্ত করবে । কোন কাজের জন্য আমাদের আগ্রহ থাকতে হবে ,তবেই আমরা কাজটি সম্পাদন করতে উদ্যোগী হব । শুধু কোন কাজ সম্পর্কে জ্ঞান ঐ কাজ করতে আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে না ,এর সাথে মনোগত কারণও রয়েছে যা ঐ কাজের দিকে উদ্বুদ্ধ করে । এ ধরনের উপাদানকে অভ্যন্তরীণ ও মনোগত উপাদান বলা হয় । এ উপাদানই সার্বিকভাবে কোন কাজে পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে আগ্রহ ,ভালোবাসা ও উদ্দীপনা তৈরি করে । এ উপাদান না থাকলে কোন কাজ সম্পন্ন হয় না । এমনকি যদি মানুষ কোন খাদ্যের বিষয়ে এ জ্ঞান রাখে যে ,তা শরীরের জন্য উপকারী ,কিন্তু ঐ খাদ্য খাওয়ার প্রতি তার আগ্রহ না থাকে তাহলে সে ঐ খাদ্য গ্রহণ করবে না । যদি কোন ব্যক্তির খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে যায় ,খাওয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ,যতই তাকে বলা হোক যে ,খাদ্যটি শরীরের জন্য উপকারী ,তবু সে খাদ্যটি খাওয়ার ব্যপারে কোন আগ্রহ খুঁজে পাবে না । অতএব ,কোন কাজের ক্ষেত্রে জ্ঞান ও পরিচিতি ছাড়াও মানুষের মনের আগ্রহ-উদ্দীপনারও প্রয়োজন রয়েছে । সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ও ঠিক একই রকম । কোন ব্যক্তি কোন আন্দোলনকে ভালো ও উপকারী মনে করলেও যতক্ষণ পর্যন্ত না ঐ আন্দোলনের ব্যাপারে উৎসাহ-উদ্দীপনা খুঁজে পায় ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে না ।

এখন এ বিষয়টিকে আমরা গ্রহণ করেছি যে ,মানুষের সচেতনমূলক যে কোন পদক্ষেপ বা আচরণের পেছনে দুই ধরনের উপাদান থাকা অত্যন্ত জরুরি । প্রথম ,ঐ বিষয় সম্পর্কে পরিচিতিমূলক জ্ঞান । দ্বিতীয় ,ঐ কাজের

জন্য অভ্যন্তরীণ মনোগত উপাদান অর্থাৎ উৎসাহ-উদ্দীপনা । আমরা শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন মানবজাতির সৌভাগ্যের জন্য কী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তা জানার পরও বুঝতে পারি যে ,শুধু এ ঘটনা সম্পর্কে তথ্য ও জ্ঞান আমাদেরকে এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী করে তোলে না ;বরং যখন ঐ বিষয়ের প্রতি আমাদের মনে উদ্দীপনা ও আগ্রহ সৃষ্টি হবে তখনই কেবল ঐ আন্দোলনকে স্মরণ করে ইমাম হোসাইনের মতো নিজেকে উৎসর্গ করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করব ।

শুধু কোন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান ও পরিচিতি ঐ বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করে না ;বরং অভ্যন্তরীণ উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হতে হয় যা আমাদেরকে ঐ কাজের প্রতি আগ্রহী করে তোলে ।

সভা-সমাবেশ ,আলোচনা-পর্যালোচনা ,বক্তব্য প্রথম উপাদানের অর্থাৎ পরিচিতি ,তথ্য ও জ্ঞানের চাহিদা পূরণ করে ,কিন্তু আমাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য অন্য উপাদানের প্রয়োজন রয়েছে । কোন ঘটনার পরিচিতি ,স্মরণ ও পর্যালোচনা ঐ কাজে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে ,তবে যে উপাদানটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল ভূমিকা পালন করে তা হলো মনের দিক-যা সরাসরি মানুষের আবেগ-অনুভূতির সাথে জড়িত ।

যখন কোন মর্মান্তিক ঘটনাকে মঞ্চায়িত করা হয় এবং মানুষ এ ঘটনাকে খুব নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করে তখন সেটার সাথে বই পড়ে অথবা অন্য কারো নিকট থেকে ঐ ঘটনা জানতে পারার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে ।

এ রকম অভিজ্ঞতা আপনারা নিজেরা অনেকবার অর্জন করেছেন । অনেকবার আশুরার ঘটনা শুনেছেন একং জেনেছেন যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) কীভাবে কারবালার প্রান্তরে শহীদ হয়েছেন । কিন্তু শুধু এ ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞান কি আপনাদের চোখের অশ্রু প্রবাহিত করে ? অবশ্যই ,না । অথচ যখন আপনি কোন শোকানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন এবং শোকগাথা পাঠকারী কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা আকর্ষণীয় কণ্ঠে বর্ণনা করেন ,বিশেষ করে যদি তাঁর সুর ভালো হয় ,তাহলে অনিচ্ছাকৃতভাবেই আপনার চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়বে ।

এ পদ্ধতি আপনার অনুভূতির ওপর অধিক প্রভাব বিস্তার করতে পারে যা শুধু অধ্যয়ন ও জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে সম্ভব নয় । এ কারণেই যা প্রত্যক্ষ করা হয় তা শোনার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি প্রভাব রাখে । এ বিষয়গুলো বর্ণনা করার উদ্দেশ্য ছিল এ বিষয়টি বোঝানো যে ,আমাদের অবশ্যই জানতে হবে কেন আবু আবদিল্লাহ (আ.) বিদ্রোহ করেছেন ,মযলুম অবস্থায় শহীদ হয়েছেন । কিন্তু এর পাশাপাশি আশুরার ঘটনাকে আমাদের সামনে বর্ণনা বা মঞ্চায়নের মাধ্যমে এমনভাবে সাজাতে ও চিত্রায়িত করতে হবে যাতে তা বেশি পরিমাণে আমাদের হৃদয় ও অনুভূতিকে নাড়া দেয় এবং আমাদের মধ্যে আবেগের সৃষ্টি হয় । যত বেশি এ আবেগ সৃষ্টি হবে তত বেশি আমাদের জীবনে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে ।

এ কারণেই আশুরার ঘটনার ওপর শুধু তত্ত্বগত আলোচনা প্রকৃত ভূমিকা পালনে অক্ষম । বরং সামাজিকভাবে এমনভাবে শোকানুষ্ঠান পালন করতে হবে যা মানুষের অনুভূতিকে জাগ্রত করবে । যখন কেউ সকালে ঘর থেকে বাহিরে বের হয়ে দেখতে পায় সম্পূর্ণ শহরকে কালো কাপড়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে এবং সর্বত্র কালো পতাকা স্থাপন করা হয়েছে ,এ পরিবর্তনটি মানুষের অন্তরকে অধিক নাড়া দেয় ।

যদিও মানুষ জানে আগামীকাল মুহররমের প্রথম দিন ,কিন্তু এ তথ্য তাদের অন্তরকে ঐ রকম প্রভাবিত করতে পারে না যতটা সকল স্থানে কালো পতাকা ও সকলকে কালো পোশাক পরিহিত দেখা তাকে প্রভাবিত করবে । তাই সামষ্টিক ভাবে বিশেষ উৎসাহ ও উদ্দীপনা সহকারে মর্সিয়া পাঠ ও বুক চাপড়ানোর অনুষ্ঠান পালন করার মাধ্যমে যতটা প্রভাব ফেলা সম্ভব ,অন্য কোন কিছুতে তা সম্ভব নয় ।

এখান থেকে ইমাম খোমেইনী (রহ.) যে বক্তব্যগুলো অসংখ্য বার পুনরাবৃত্তি করতেন সেগুলোর কারণ অনুধাবন করা সম্ভব । তিনি বলতেন : আমাদের যা কিছু (মূল্যবোধ) রয়েছে তা মুহররম ও সফর থেকে । তিনি শোকানুষ্ঠানকে ঐত্যিহ্যবাহী প্রচলিত পদ্ধতিতে পালন করার ওপর গুরুত্ব দিতেন । কেননা ,গত তের শতাব্দীর অভিজ্ঞতায় প্রমাণ হয়েছিল যে ,আবেগময় পদ্ধতিতে শোক পালনের বিষয়টি মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আত্মত্যাগী অনুভূতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে কত বেশি ভূমিকা রাখে এবং কীরূপ অলৌকিক পরিবর্তন ঘটায়!

অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে ,ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও সাদ্দামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে যে সকল বিজয় অর্জিত হয়েছে তার সবই আশুরার শিক্ষা এবং শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নামের বরকতে অর্জিত হয়েছে । এই প্রভাব অত্যন্ত গভীর ও অচিন্তনীয় ছিল । কোন বস্তুর বিনিময়ে এ ধরনের মহামূল্যবান অনুভূতি সমাজের মধ্যে সৃষ্টি করা সম্ভব ? এরূপ শোকানুষ্ঠানগুলো কি ধরনের পবিত্র প্রেমের সৃষ্টি করে যা মানুষকে শাহাদাত বরণ করার জন্য প্রস্তুত করে ? যদি বলি যে ,প্রকৃত ইসলাম ছাড়া অন্য কোন সমাজ ও মতাদর্শেই এ ধরনের উপাদানের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না ,তাহলে অর্থহীন কোন কথা বলি নি ।

শোকানুষ্ঠান পালন করার সময়

44 নং প্রশ্ন : কেন আমরা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ক্ষেত্রে তাঁর শাহাদাতের দিন আসার পূর্বেই (আশুরার দিনের পূর্বে) শোক পালন শুরু করি ?

উত্তর : আশুরার পূর্বে শোকানুষ্ঠান পালন হচ্ছে আশুরার শোকানুষ্ঠানের ভূমিকাস্বরূপ । আবু আবদিল্লাহ (আ.)-এর জন্য শোক পালনের মূলনীতি ইসলামী শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাবের অন্তর্ভুক্ত । কিন্তু এ অনুষ্ঠানের ধরন ও সময় বিভিন্ন সমাজ ও জাতিতে প্রচলিত প্রথা ও রীতি দ্বারা প্রভাবিত হয় । যেমন কিছু অঞ্চলে ইমাম হোসাইনের শোকানুষ্ঠান 7 মুহররম থেকে শুরু হয়ে 3রা সফর পর্যন্ত চলতে থাকে ,কিছু অঞ্চলে 1লা মুহররম থেকে আশুরার দিন পর্যন্ত চলে ;কিছু অঞ্চলে সারা বছর বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে শোকগাথার অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় ;কিছু অঞ্চলে মুহররম মাসের শুরু থেকে সফর মাসের শেষ দিন পর্যন্ত শোকানুষ্ঠান চলে ।

এ সকল ধরন আসলে কোন সমস্যা নয় । কারণ ,শোকানুষ্ঠান এবং মৃত্যুবার্ষিকী পালন বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি ও রীতিনীতির সাথে সম্পর্কিত । সাধারণত মৃত্যুবার্ষিকী পরবর্তী বছরগুলোতে মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর রাতে পালন করা হয় । যেহেতু শাহাদাত অনেক বছর পূর্বে সংঘটিত হয়েছে সেহেতু শোকানুষ্ঠানগুলো বছরের যে কোন সময়ে পালন করা হোক না কেন ,এ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরে ঘটেছে ।


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13