বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্23%

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্ লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 18 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 26168 / ডাউনলোড: 4693
সাইজ সাইজ সাইজ
বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মৃত্যুপারের জীবন সম্পর্কে মানুষের ঔৎসুক্য চিরন্তন। এ ঔৎসুক্যের পরিপূর্ণ নিবৃত্তি জীবদ্দশায় সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব নয় জেনেও মানুষ কখনোই এ বিষয়ে জানার আগ্রহ পরিত্যাগ করতে পারে না। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মে যেমন বিভিন্ন ধারণা দেয়া হয়েছে, তেমনি এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা তথ্য ও কল্পনা। তাই এ ব্যাপারে সম্ভব সর্বাধিক মাত্রায় সঠিক ধারণার প্রয়োজনীয়তা সব সময়ই অনুভূত হয়ে আসছে।

ইসলামী মতে, সাধারণভাবে মৃত্যুপরবর্তী সময়ের দু’টি পর্যায় রয়েছে : মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত সময় এবং পুনরুত্থান পরবর্তী সময় অর্থাৎ শেষ বিচার ও তদ্পরবর্তী জান্নাতী বা জাহান্নামী অনন্ত জীবন। পুনরুত্থান, শেষ বিচার এবং বেহেশত বা দোযখ বাস তথা আখেরাতের ওপর ঈমান পোষণ ইসলামের মৌলিক চৈন্তিক ভিত্তি (উছূলে ‘আক্বাএদ্)-এর অন্যতম। এ কারণে এ সম্পর্কে কোরআন মজীদে বিস্তারিত বক্তব্য রয়েছে।


1

2

3

4

5

6

স্বপ্ন : বিজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে

বস্তুবিজ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নাফ্স্ সংক্রান্ত প্রশ্নসমূহের নির্ভুল জবাবদানে সক্ষম নয় , তবে এ ব্যাপারে বিচারবুদ্ধিকে সহায়তা দিতে সক্ষম। তাই এতদসংক্রান্ত কয়েকটি তথ্য বিবেচনাযোগ্য।

অবশ্য প্রকৃত ও অকাট্য বৈজ্ঞানিক তথ্য এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার নামে কাল্পনিক ব্যাখ্যার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ , স্বপ্নের যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদানে ব্যর্থ হয়ে অনেকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার নামে একে মস্তিষ্কের স্বয়ংক্রিয় কর্মতৎপরতা ও স্নায়বিক উত্তেজনার ফসল বলে দাবী করেছেন। কিন্তু এ দাবীর পিছনে কোনো যুক্তি নেই এবং অভিজ্ঞতাও তা সমর্থন করে না।

প্রকৃত পক্ষে মানুষ কেবল শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্লান্ত হয়ে পড়লেই ঘুমিয়ে পড়ে না , বরং মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে পড়লেই ঘুমিয়ে পড়ে - যে কারণে কর্মক্ষম ও কাজ করতে অভ্যস্ত ব্যক্তি কাজ না করলেও এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। কারণ , তার শরীর ক্লান্ত না হলেও জাগ্রত অবস্থায় মস্তিষ্কের কর্মতৎপরতার কারণে মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে পড়ে বিধায় সে ঘুমিয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় ঘুমের মধ্যে তার মস্তিষ্ক সক্রিয় হয়ে ওঠা বা উত্তেজিত হওয়ার পিছনে কোনো শারীরিক তথা বস্তুগত কারণ ধরে নেয়াটা স্রেফ্ কল্পনামাত্র ; কেবল কোনো অবস্তুগত কারণ তাকে সক্রিয় করে তোলে। তা হচ্ছে , সৃষ্টিজগতের ঐশী ব্যবস্থাধীনে তার অবস্তুগত ব্যক্তিসত্তা (নাফ্স্)কে এক অবস্তুজগতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নাফ্স্ তার সেখানকার অভিজ্ঞতাকে স্মরণে রাখার জন্যই স্বীয় ক্লান্ত মস্তিষ্ককে সক্রিয় করে তোলে।

যারা বলেন যে , স্বপ্ন পূর্ব-অভিজ্ঞতার স্মৃতির প্রত্যাবর্তন বা স্নায়বিক উত্তেজনার ফসল বা অপূর্ণ আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রভাব তাঁদের কথা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ , মানুষ এমন অনেক স্বপ্নও দেখে যা তার অভিজ্ঞতাবহির্ভূত। যেমন : কেউ যখন স্বপ্নে নিজেকে উড়তে দেখে তখন তা তার পূর্ব-অভিজ্ঞতার প্রত্যাবর্তন নয়। তেমনি তা অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার প্রভাবও নয়। কারণ , মানুষ আকাশে ওড়ার আকাঙ্ক্ষা করলে নিজের পিঠে দু টো পাখা কল্পনা করে , কিন্তু যারা স্বপ্নে নিজেকে উড়তে দেখে তারা পাখা ছাড়াই উড়তে দেখে। এ ক্ষেত্রে বরং অনেকের অভিজ্ঞতা থেকেই স্বপ্নব্যাখ্যাকারীদের ব্যাখ্যার যথার্থতা পাওয়া যায় - যারা বলেন যে , স্বপ্নে উড়তে দেখলে সে ব্যক্তি কোনো দূরবর্তী জায়গায় , বিশেষতঃ বিদেশে সফর করবে এবং প্রায়শঃই দেখা যায় যে , ঐ রকম দূরবর্তী জায়গায় সফরের কথা সে পূর্বে কখনো কল্পনা করে নি।

অন্যদিকে স্নায়বিক উত্তেজনা সুশৃঙ্খল পূর্বস্মৃতিকে এলোমেলোভাবে উপস্থাপন করতে পারে , সুবিন্যস্তভাবে নয় ; পূর্ব-অভিজ্ঞতাবিহীন একটি সুশৃঙ্খল মধুর স্বপ্ন তৈরী করার তো প্রশ্নই ওঠে না।

শুধু তা-ই নয় , অভিজ্ঞতায় দেখা যায় , অনেক ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি স্বপ্ন দেখছে তাকে সহসাই কেউ ডাক দিয়ে বা ধাক্কা দিয়ে জাগ্রত করার চেষ্টা করলে সে নিজেকে সংশ্লিষ্ট স্বপ্নদৃশ্যের ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত ছুটে আসতে এবং নিজেকে নিজের শরীরে প্রবেশ করতে দেখে। বিশেষ করে নিজেকে নিজের শরীরে প্রবেশ করতে দেখার কাজটি প্রায়জাগ্রত অবস্থায় ঘটে থাকে। অর্থাৎ স্বপ্নদর্শনকারীর অবস্তুগত শরীর (নাফ্স্) তার বস্তুদেহে প্রবেশ করার পর পরই বস্তুদেহ মোটামুটি চেতনা ফিরে পায়।

জাগ্রত ব্যক্তির নাফ্স্ কি শরীর থেকে বের হতে পারে ?

অনেকে আধ্যাত্মিক সাধনা বলে জাগ্রত অবস্থায়ই স্বীয় দেহ থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন (অর্থাৎ তাঁর নাফ্স্ বা আত্মা তাঁর দেহ থেকে বেরিয়ে গিয়েছে) এবং দূরবর্তী কোথাও পরিভ্রমণ শেষে পুনরায় ফিরে এসে দেহে প্রবেশ করেছেন - এ মর্মে বহু বর্ণনা পাওয়া যায়। এ সব ক্ষেত্রে ব্যক্তির দেহ থেকে তার অবস্তুগত ব্যক্তিসত্তা বেরিয়ে যাবার পর দেহ ঘুমন্ত অবস্থা বা প্রায় মৃত অবস্থা লাভ করে , এমনকি তার শ্বাস-প্রশ্বাস এবং রক্তচলাচলও এতোই কমে যায় যে , দৃশ্যতঃ মনে হয় যে , তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ তাতে প্রাণের চিহ্ন প্রায় স্থগিত হয়ে যায়। বলা হয় যে , দেহ থেকে বেরিয়ে যাবার প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও সাহসের কারণেই তা সম্ভবপর হয়। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার দেহের ক্ষতি হবার আশঙ্কাকে উপেক্ষা করার কারণেই এভাবে দেহ থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এরূপ অবস্থায় সে দূরবর্তী কোনো স্থানে গিয়ে সেখানকার ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করেছে এবং ফিরে এসে দেহে প্রবেশের পর তার হুবহু বর্ণনা দিয়েছে , আর যাচাই করার ফলে তা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে।

এ ধরনের বর্ণনার সত্যতা সম্পর্কে শতকরা একশ ’ ভাগ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। তবে এ ধরনের অনেক ঘটনার বর্ণনা সাম্প্রতিক কালের (বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের) - যখন যোগাযোগ ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতির কারণে এ ব্যাপারে পুরোপুরি ভিত্তিহীন বর্ণনা চালিয়ে দেয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার ছিলো। তাছাড়া বিচারবুদ্ধির বিশ্লেষণ ও আরো কতক ধরনের অভিজ্ঞতা থেকে এ ধরনের কাজ অসম্ভব বলে মনে হয় না।

বস্তুতঃ মানুষ যখন জাগ্রত থাকে এবং শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকে তখন তার মনোযোগের বেশীর ভাগই তার শরীরের প্রতি নিবদ্ধ থাকে যাতে তার শরীর ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং তার কাজকর্মে ভুল না হয়। আর মনোযোগের বিষয়টি পুরোপুরি নাফসের কাজ এবং এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ইন্দ্রিয়নিচয় নাফসের মনোযোগের অনুবর্তিতা করে মাত্র। কিন্তু ঘুমিয়ে থাকার সময় শরীরের ক্ষতি না হওয়ার বা শরীরের দ্বারা ভুল কাজ সম্পাদিত না হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়ার কারণেই নাফসের পক্ষে শরীরকে ঘুমাবার সুযোগ দেয়া সম্ভব হয়। তাই দেখা যায় , ভয়-ভীতির পরিস্থিতিতে বা কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে শরীর ও মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে পড়া সত্ত্বেও মানুষ না ঘুমিয়ে জেগে থাকার চেষ্টা করে এবং নিয়মিত অভ্যাসের তুলনায় অনেক দেরীতে বা খুব কম সময়ের জন্য অথবা খুব হাল্কাভাবে ঘুমায় ; এটা নাফসের সিদ্ধান্তের ফলেই হয়ে থাকে।

অবশ্য নাফসের পক্ষে শরীরের সহনক্ষমতার একটা সুনির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত তাকে জাগ্রত রাখা সম্ভব হয়। তবে শরীরের ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় তার পক্ষে ইন্দ্রিয়নিচয় থেকে পুরোপুরি সেবা লাভ করা সম্ভব হয় না। তাই দেখা যায় যে , সে সব কিছু ঠিকমতো দেখতে পায় না , সব শব্দ বা কথা ঠিকমতো শুনতে পায় না , সব স্পর্শ ঠিকমতো অনুভব করতে পারে না। কিন্তু যখন সে ঘুমিয়ে পড়ে তখন স্বপ্ন দেখলে তা অধিকতর সুস্পষ্টরূপে দেখতে পায় এবং স্বপ্নে যে সব কথা শোনে তা অধিকতর সুস্পষ্টরূপে শুনতে পায়। অর্থাৎ জাগ্রত অবস্থায় নাফসের মনোযোগের সিংভাগ শরীরের প্রতি নিবদ্ধ রাখতে হলেও ঘুমন্ত অবস্থায় তার আর দরকার না থাকায় স্বপ্নলোকে নাফসের অবস্তুগত ইন্দ্রিয়নিচয় অধিকতর ভালোভাবে কাজ করে। তবে ঘুমের সময় নাফ্স্ আর জাগ্রত অবস্থার ন্যায় স্বাধীন থাকে না , বরং তাকে ঐশী ব্যবস্থাপনাধীন আালামে বারযাখের একটি অংশে নিয়ে যাওয়া হয় বিধায় তার পক্ষে বস্তুজগতের অভিজ্ঞতা অর্জন করা সম্ভব হয় না। কিন্তু আত্মিক সাধনাবলে কারো নাফ্স্ যদি খুবই সাহসী ও নির্ভয় হয়ে উঠতে পারে সে ক্ষেত্রে জাগ্রত অবস্থায় তার পক্ষে সাময়িকভাবে শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়া ও বস্তুজগতে বিচরণ করা অসম্ভব না-ও হতে পারে।

জাদুবিদ্যা : নাফসের শক্তির নিদর্শন

নাফসের শক্তি ও সাহস বৃদ্ধির একটা দৃষ্টান্ত হচ্ছে জাদুবিদ্যা। এখানে আমরা জাদুবিদ্যা বলতে আধুনিক কালের বস্তুবিজ্ঞান ও বিভিন্ন কলাকৌশলের আশ্রয় নিয়ে যে সব ম্যাজিক দেখানো হয় তার কথা বলছি না , বরং মানসিক শক্তির দ্বারা লোকদেরকে সম্মোহিত করে কাল্পনিক দৃশ্য ও ঘটনা দেখানো অথবা কোনো কাজ করতে বাধ্য করার কথা বলছি।

প্রকৃত জাদুকর বর্তমান যুগে হয়তো আদৌ নেই , তবে অতীতে ছিলো এবং জাদু ও জাদুকরের কথা কোরআন মজীদেও উল্লেখ করা হয়েছে।

মনোবিজ্ঞানীদের দ্বারা রোগীর চিকিৎসার জন্য রোগীকে সম্মোহিত করা ও জাদুকরের দ্বারা কৃত সম্মোহনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে এই যে , মনোরোগী স্বীয় সুস্থতার লক্ষ্যে মনোবিজ্ঞানীর নির্দেশিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে স্বেচ্ছায় সম্মোহিত হয় , কিন্তু জাদুকর কেবল স্বীয় মানসিক শক্তির বলে অনিচ্ছুক ব্যক্তিকে সম্মোহিত করে।

অতীতে ভারত উপমহাদেশে উল্লেখযোগ্যভাবে জাদুচর্চা ছিলো এবং জাদুশিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে আসামের কামরূপ-কামাখ্যা বিখ্যাত ছিলো। জাদুশিক্ষার পর তার চূড়ান্ত পরীক্ষার পদ্ধতি সম্পর্কে যা শোনা যেতো তা হচ্ছে , জাদু শিক্ষাকারী ব্যক্তিকে অমাবস্যার রাতে জনবিচ্ছিন্ন শ্মশানে সারারাত রাত কাটাতে হতো ; সে যদি নির্ভয়ে সেখানে একাকী রাত কাটাতে পারতো তাহলে প্রমাণিত হতো যে , সে জাদু আয়ত্ত করতে পেরেছে।

আসলে শ্মশানে ভয়ের কিছু আছে কিনা সে বিতর্কে না গিয়েও বলা চলে যে , এ ধরনের জায়গায় একা যেতে এমনিতেই মানুষের মনে ভয় সৃষ্টি হয় , তা সে ভয়ের পিছনে কোনো যৌক্তিক কারণ থাকুক বা না-ই থাকুক। এমতাবস্থায় অমাবস্যার ঘুরঘুট্টি অন্ধকারের মধ্যে এহেন জায়গায় সারা রাত কাটানোর জন্য লৌহকঠিন মানসিক শক্তির প্রয়োজন। নাফসের এ শক্তিই অন্য মানুষের মনকে প্রভাবিত করে তাকে সম্মোহিত করতে পারে।

সাপুড়ে যেভাবে সাপ ধরে

সাপুড়ে কর্তৃক সাপ ধরার কাজটিও পুরোপুরি নাফসের মানসিক শক্তি তথা সাহসিকতার নিদর্শন।

সাপ ধরার সময় বা সাপকে নিয়ে খেলা দেখানোর সময় সাপুড়ে যে মন্ত্র আওড়ায় তা আসলে কতোগুলো অর্থহীন কথা মাত্র ; স্বীয় মানসিক শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করার লক্ষ্যেই সে এ কথাগুলো আওড়ায়। কিন্তু সাপুড়ে যেভাবে সাপ ধরে অন্য কেউ এ মন্ত্র আওড়ালেও তার মনে যদি সাপ থেকে ভয় থাকে তো সে সাপ ধরতে পারবে না , বরং সাপই তাকে দংশন করবে।

প্রকৃত পক্ষে সাপুড়ে যে কারণে সাপ ধরতে সক্ষম হয় তা তার দীর্ঘদিনের চর্চাজাত মানসিক শক্তির কারণে মাত্র। আসলে সাপুড়ে তার নাফসের শক্তি তথা সাহসের কারণে সাপকে এক হাতের মুঠোয় ধরার উপযোগী একটা নিরীহ মাছকে ধরার মতোই অবলীলাক্রমে ধরে ফেলে।

আমরা ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করেছি , বিভিন্ন ইতর প্রাণী এমন অনেক আলোকতরঙ্গ ও শব্দতরঙ্গ দেখতে ও শুনতে পায় যা মানুষ দেখতে বা শুনতে পায় না। তেমনি এ-ও খুবই সম্ভব যে , ইতর প্রাণীরা মানুষের নাফসের স্বরূপ দেখতে পায়। এ কারণেই সাপ কোনো সাপুড়েকে দেখলে দিশাহারা হয়ে পড়ে , ঠিক যেভাবে পুলিশ যাকে খুঁজছে এমন কোনো ব্যক্তি পুলিশের সামনে পড়লে দিশাহারা হয়ে পড়ে এবং কী করবে বুঝতে পারে না ; পালাবার চেষ্টা করার মতো সাহসও হারিয়ে ফেলে।

সাপুড়ের শিশুসন্তানরা যেভাবে সাপধরা শেখে তা হচ্ছে , প্রথমে তারা তাদের বাবা-মা ’ র সাথে থেকে সাপ ধরে। শিশু যখন সাপকে ধরে মূলতঃ তার বাবা বা মা সাপুড়ের উপস্থিতির কারণেই সাপ তখন শিশুটিকে দংশন করে না। এভাবে শিশু সাপ ধরতে ধরতে বড় হয় এবং ক্রমান্বয়ে তার নাফ্স্ও তারা বাবা-মা ’ র মতোই শক্তি ও সাহসের অধিকারী হয়ে ওঠে , অতঃপর কৈশোরে বা যৌবনে সে একাই সাপ ধরতে সক্ষম হয়।

ধ্যানে বসে অজানা তথ্য প্রদান

অনেক আল্লাহ্ওয়ালা লোকের ক্ষেত্রে দেখা গেছে , তাঁরা ধ্যানে বসে অতীতের অনেক ঘটনাবলী বলে দিয়েছেন অথবা তাঁদের থেকে অনেক দূরে অবস্থিত কোনো কিছু বা কোনো মানুষ সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন - যে সম্পর্কে তাঁদের আদৌ জানা না থাকার বিষয়টি অকাট্য। এটা ধ্যানমগ্ন অবস্থায় নাফসের ইন্দ্রিয়নিচয়ের কর্মক্ষমতার আওতা ও মাত্রা বৃদ্ধিরই প্রমাণ বহন করে , অবশ্য কেবল আল্লাহ্ তা আলার বিশেষ অনুগ্রহেই কোনো ব্যক্তির পক্ষে এটা সম্ভব হতে পারে।

প্রায়মৃত্যুর অভিজ্ঞতা

প্রায়মৃত্যুর অভিজ্ঞতা (Near Death Experience ) অর্জন করেছে এমন লোকদের বর্ণনা থেকেও ব্যক্তিসত্তার শরীর থেকে বেরিয়ে গিয়ে কেবল নাফসের ইন্দ্রিয়নিচয়ের সাহায্যে পার্থিব জগতের অভিজ্ঞতা অর্জনের কথা জানা যায় - যা ব্যক্তিসত্তার স্বাতন্ত্র্য ও বস্তুদেহ থেকে মুখাপেক্ষিতাহীনতার প্রমাণ বহন করে।

প্রায়মৃত্যুর অভিজ্ঞতার অধিকারী অনেক লোক অচেতন থাকার পর চেতনা ফিরে পেয়ে স্বীয় অস্ত্রোপচারের বিস্তারিত ও নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছে এবং অস্ত্রোপচারের সময় ডাক্তার ও নার্সদের মধ্যে যে সব কথাবার্তা হয়েছে তার বর্ণনাও দিয়েছে। তারা আরো বলেছে যে , এ সময় তারা অস্ত্রোপচারের খাটে শোয়ানো তাদের বস্তুদেহ দেখেছে এবং একই সাথে তারা নিজেদেরকে এক ধরনের হাল্কা শরীরের অধিকারী অবস্থায় অস্ত্রোপচারকক্ষের সিলিং সংলগ্ন হয়ে ভাসমান অবস্থায় দেখেছে। আর ঐ অবস্থায় তারা অস্ত্রোপচারের পুরো ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করেছে এবং সকল কথাবার্তা শুনেছে। আর তাদের সে সব বর্ণনা সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। অবশ্য তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদেরকে হাল্কা শরীর সহকারে আকাশে উড়তে দেখেছে এবং কেউ কেউ নিজেকে কোনো এক অচেনা জগতে প্রবেশ করতে ও অনেক চেষ্টায় ফিরে আসতে দেখেছে।

এ ধরনের ঘটনাবলী বস্তুবিজ্ঞানীদের সামনে এমন এক প্রশ্ন তুলে ধরেছে যার জবাব তাঁদের জানা নেই। তবে ইতিপূর্বে যে কিরলিয়ান ফটোগ্রাফির কথা বলা হয়েছে তা থেকে এর জবাব মিলে , তা হচ্ছে , মানুষ সহ সকল প্রাণশীল ও সজীব অস্তিত্বেরই বস্তুদেহ ছাড়াও একটি আলোর দেহও রয়েছে এবং সন্দেহ নেই যে , প্রায় অবস্তুগত অস্তিত্ব এ আলোর দেহই হচ্ছে নাফ্স্ অথবা অবস্তুগত নাফসের ধারক।

ইয়াযীদের দরবারে হযরত যয়নবের (আ.) বক্তব্য

ইমাম আলী ইবনে আবী তালিবের (আ.) কন্যা যয়নব , ইয়াযীদের সভায় দণ্ডায়মান হয়ে বলেন :

“ বিশ্বের প্রতিপালকের জন্যে সমস্ত প্রশংসা ও স্তুতি এবং রাসূল ও তাঁর বংশধরের উপর আল্লাহর করুণা অবতীর্ণ হোক ! পরম পবিত্র আল্লাহ্ তায়ালা কতটা সত্য কথা বলেছেন ! তিনি বলেন : গোনাহ্গার ও মন্দ লোকদের পরিণতি এই হবে যে ,আমাদের নিদর্শনগুলিকে মিথ্যা মনে করবে এবং সেইগুলিকে উপহাসের বস্তু হিসেবে গ্রহণ করবে। ’ ইয়াযীদ ! তুমি কি ধারণা করেছো ? তুমি কি ধারণা করছ যে , তুমি এখন আমাদের জন্য পৃথিবী ও আকাশকে সংকীর্ণ করে দিয়েছো এবং আমাদেরকে এই অবস্থায় উপনীত করেছো যে , বন্দিদের মত আমাদেরকে এদিক সেদিক নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । ভেবেছো এই কাজটি আমাদেরকে আল্লাহর নিকট হীন ও অযোগ্য করে দিবে এবং তোমাকে সম্মানিত ও মহত্বে পৌঁছাবে ; আর আল্লাহর নিকট তোমার উচ্চমর্যাদার কারণে এই বাহ্যিক বিজয় ঘটেছে ? এই কারণে তুমি চরম আনন্দিত এবং নিজের অতীতে ফিরে গেছ , পৃথিবীকে নিজের জন্যে প্রস্তুত , সুসজ্জিত ও সুস্বাদু দেখে তুমি খুশী ও আনন্দে বাগ বাগ হয়েছো ? আমাদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা যখন তোমার করতলগত হয়েছে এইরূপ করছ ? শান্ত হও , শান্ত হও ! মহান আল্লাহর বাণী কি ভুলে গেছ ( ?) তিনি বলেছেন : যারা কুফরী করে তারা যেন এইরূপ ধারণা না করে যে , পৃথিবীর যে সব সুযোগ সুবিধা আমরা তাদেরকে দান করি সেগুলি তাদের জন্যে কল্যাণকর। আমরা এই সুযোগ সুবিধাগুলি তাদেরকে এই উদ্দেশ্যে দান করি যে , সেইগুলি যেন তাদের পাপসমূহকে বৃদ্ধি করে এবং আগামীতে তাদের জন্যে রয়েছে অপমানজনক শাস্তি ।

হে আমাদের নানার মুক্তকৃত লোকদের সন্তান ! এইটি কি ন্যায়বিচার যে , তুমি নিজ নারী ও দাসীদেরকে পর্দায় রাখছ আর রাসূলুল্লাহর কন্যাগণকে বন্দী হিসেবে ইসলামী দেশের চতুর্দিকে ঘোরাচ্ছ ? তাঁদের পর্দা কেড়ে মুখমণ্ডলসমূহকে প্রকাশ করছ ? শত্রুদের দ্বারা তাঁদেরকে শহর হতে শহরে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতে বাধ্য করছ ? তাঁদেরকে শহরের লোকজনদের নিকট বিনোদনের উপাদান বানাচ্ছ , যাতে পরিচিত অপরিচিত এবং উত্তম অধম সবাই তাঁদের মুখমণ্ডলগুলিকে লক্ষ্য করে। আর এই অবস্থায় তাঁদের সাথে তাঁদের কোনো অভিভাবক নেই এবং তাঁদের পুরুষগণের পক্ষ হতে তত্ত্বাবধায়ন হচ্ছে না ?!

না , হে আল্লাহ্ , কি বলব ! নিরাপত্তার ব্যাপারে কি করে তাদের প্রতি আশা করা যায় ( ?) যারা সায়্যিদুশ্ শুহাদা হযরত হামযা ’ র মত পবিত্রতম ব্যক্তিত্বের কলিজা চিবিয়েছে এবং ওহুদের শহীদগণের রক্তের দ্বারা যাদের রক্ত মাংসের বৃদ্ধি ঘটেছে ? আমাদের আহলে বাইতের প্রতি শত্রুতার ক্ষেত্রে নরম আচরণ করবে বলে তাদের উপর কি করে আশা করা যায় যারা আমাদেরকে অস্বীকার করে , শত্রুতা , ঈর্ষা ও বিদ্বেষের দৃষ্টিতে আমাদেরকে দেখে এবং তাদের মধ্যে গুনাহর কোন অনুভূতিই নেই , এই কাজটিকে বড় কোন অন্যায় বলে মনে করে না ? বরং বলছে : লোকেরা যেন আনন্দ করে , খুশীতে থাকে , উল্লাস করে ! আর বলে , এ কর্মের জন্যে হে ইয়াযীদ! তোমাকে ধন্যবাদ। ’ এই অবস্থায় , বেহেশ্তের যুবকদের সর্দার হযরত আবু আব্দিল্লাহর দাঁতগুলিকে তুমি তোমার লাঠি দ্বারা আঘাত করছ ! কেনই বা তুমি এইরূপ কাজ করবে না ?! মুহাম্মদের (সা.) নাতি ও আলে আব্দিল মুত্তালিবের আকাশের তারকাগণের রক্তপাতের মাধ্যমে তুমি যে , তোমার হিংসা বিদ্বেষপূর্ণ নোংরা বস্তুগত চেহারার পর্দা উন্মুক্ত করেছো এবং তোমার মূলে ফিরে গেছ , তোমার পিতৃপুরুষদের স্মরণ করছ ও তাদেরকে আহ্বান করাকে কল্যাণকর ধারণা করছ , অথচ খুব শীঘ্রই তুমি তাদের প্রবেশের স্থানে প্রবেশ করবে ! সেইখানে তুমি চাইবে যে , যদি তুমি খোঁড়া , অক্ষম ও বোবা হতে এবং এই সব না বলতে ও এইরূপ কর্ম না করতে !

হে আল্লাহ্ ! আমাদের প্রতিশোধ গ্রহণ কর ! যে ব্যক্তি আমাদের প্রতি অত্যাচার করেছে তার নিকট হতে প্রতিশোধ নাও ! যে ব্যক্তি আমাদের রক্তপাত করেছে ও আমাদের অভিভাবকগণকে হত্যা করেছে তুমি তাদের উপর তোমার ক্রোধ ও অভিসম্পাত প্রেরণ কর !

ইয়াযীদ ! আল্লাহর শপথ ! তুমি তোমার নিজের চামড়া ব্যতীত অন্য কিছু চিরনি এবং তোমার নিজেরই মাংস ব্যতিত অন্য কিছুই কাটনি ! আল্লাহর রাসূলের সন্তান সন্ততির রক্তপাত ,তাঁর ইতরাত (বংশধর) ও তাঁর শরীরের অংশসমূহের সম্মান বিনষ্ট করার ফলে যেসব অপরাধ তোমার কাঁধে চেপেছে সেসব সহকারে তুমি নিঃসন্দেহে তাঁর (রাসূল) নিকট প্রবেশ করবে ! আল্লাহ্ তাঁদের বিক্ষিপ্ত অংশসমূহকে সংযোজন করবেন , তাঁদের বিচ্ছিন্ন অংশগুলিকে সংযুক্ত করবেন এবং তাঁদের প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন ! আর তোমরা এইরূপ ধারণা করো না যে , যাঁরা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছেন তাঁরা মারা গেছেন , বরং তাঁরা জীবিত আছেন এবং তাঁদের প্রতিপালকের নিকট হতে রিয্ক গ্রহণ করেন।

তোমার জন্যে এই যথেষ্ট যে , মহান আল্লাহ্ তোমার নিকট হিসাব গ্রহণ করবেন , মুহাম্মদ (সা.) তোমার সাথে দুশমনি করবেন এবং জিব্রাঈল (আ.) আমাদের পৃষ্ঠপোষক হবেন। যে ব্যক্তি তোমার জন্যে এইরূপ অপরাধকে সুসজ্জিত করেছে এবং মুসলমানদের উপর তোমাকে কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের অধিকারী করেছে সে অচিরেই বুঝবে যে , অত্যাচারীর জন্যে জাহান্নামের মন্দ স্থান নির্ধারিত রয়েছে এবং তুমিও বুঝবে যে , তোমাদের ও আমাদের মাঝে কারা মন্দ স্থানে রয়েছে এবং কারা দুর্বলতর শক্তির অধিকারী।

ইয়াযীদ ! বর্তমান কঠিন অবস্থা ও সমস্যাদি আমাকে এমন স্থানে উপনীত করেছে , যার ফলে তোমার সাথে কথা বলছি ! তবে তুমি জেনে রেখ ! আমি তোমাকে এতটা নগণ্য ও ক্ষুদ্র জ্ঞান করি যে , তোমাকে ভর্ৎসনা করাটাও তোমার সত্তার চেয়ে বড় মনে করি এবং তোমার জন্যে তিরস্কার করাটাও বেশী মনে করি (অর্থাৎ তুমি ভর্ৎসনা ও তিরস্কারের অযোগ্য) ! কিন্তু কি করি ! ? চক্ষুগুলি অশ্রুতে পূর্ণ এবং অন্তরসমূহ অগ্নিদগ্ধ ! জেনে রেখ ! বিস্ময়কর ! সবই বিস্ময়কর !! শয়তানের দলের মুক্তিপ্রাপ্ত লোকদের হাতে হিযবুল্লাহর মহানুভব ব্যক্তিগণ নিহত হচ্ছেন ! এই হাতগুলি হতে আমাদের রক্ত ঝরছে , এই মুখগুলি আমাদের মাংসকে চোষণ করছে এবং আমাদের পবিত্র ব্যক্তিগণের দেহসমূহকে নেকড়েরা ছিন্নভিন্ন করছে , হায়েনারা মাটির উপর টানাটানি করছে !

ইয়াযীদ ! তুমি যদি আমাদেরকে তোমার জন্য গনিমত মনে করে থাক তবে এইটি জেনে রেখ যে , খুব শীঘ্রই আমাদেরকে তোমার ক্ষতির কারণ হিসেবে দেখবে ! পূর্বে প্রেরিত আমলগুলি ছাড়া সেইখানে আর অন্য কিছু পাবে না ! তোমার প্রতিপালক অত্যাচারী লোকদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেন না ! আমি আল্লাহর নিকট অভিযোগ করছি এবং তাঁর উপর আমার ভরসা আছে।

ইয়াযীদ ! তুমি তোমার প্রতারণাকে কাজে লাগাও , তোমার চেষ্টাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাও এবং তোমার প্রচেষ্টাকে বিস্তৃত কর ! আল্লাহর শপথ ! তুমি আমাদের স্মরণকে বিলুপ্ত করতে পারবে না এবং আমাদের ঐশী প্রেরণাকে নস্যাৎ করতে পারবে না। এই অপরাধের লজ্জা ও অপমান তোমার থেকে কখনই মুছে যাবে না। দুর্বল (যুক্তি)ও মিথ্যা(ভাষ্য) ব্যতীত তোমার কি মত আছে ? মুষ্টিমেয় কয়েকটি দিন এবং বিক্ষিপ্ত জনতা ছাড়া তোমার আর কি আছে ? যে দিন আহ্বানকারী আহ্বান করবেন : জেনে রাখ ! জালিমের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হোক ! বিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যে সমস্ত প্রশংসা , যিনি আমাদের পূর্ববর্তীগণকে সৌভাগ্য ও মাগফিরাতসহ গন্তব্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছিয়েছেন এবং আমাদের উত্তরসুরিগণকে শাহাদত ও রহমত দ্বারা নৈকট্য দান করেছেন। মহান আল্লাহর নিকট কামনা করব , তিনি যেন তাঁদেরকে অফুরন্ত নিয়ামত দান করেন এবং তাঁদের শাহাদতকে তাঁর নিয়ামত বৃদ্ধির উপকরণ বানিয়ে দেন ! আমাদেরকে তাঁদের উত্তম প্রতিনিধি হিসেবে নির্ধারণ করেন ! তিনি হচ্ছেন করুণাময় ও দয়ালু। তিনিই আমাদের জন্যে যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম ভরসাস্থল । ১৩৩

দামেশকের জামে মসজিদে হযরত ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এর ভাষণ

ইয়াযীদ দামেশকের জামে মসজিদে স্বীয় খতীবকে আদেশ প্রদান করে যে , সে যেন মিম্বরে আরোহণ করে মুয়াবিযা ও ইয়াযীদের প্রশংসা করে এবং ইমাম আলী ও ইমাম হুসাইনের (আ.) সমালোচনা করে। খতীব মিম্বরে আরোহণ করে আল্লাহর প্রশংসা ও স্তুতির পর যথাসাধ্য আলী ও হুসাইনের (আ.) নিন্দা এবং মুয়াবিয়া ও ইয়াযীদের প্রশংসা করে।

এ অবস্থায় হুসাইনের পুত্র আলী (আ.) তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেন : হে বক্তা , তোমার অকল্যাণ হোক ! সৃষ্টির সন্তুষ্টিকে স্রষ্টার ক্রোধের সাথে বিনিময় করলে এবং জাহান্নামে তোমার জায়গা বেছে নিলে ?!

অতঃপর তিনি বলেন : ইয়াযীদ ! তুমি আমাকে অনুমতি দাও , আমি এই কাঠের (মিম্বারের দিকে নির্দেশ করে) উপর আরোহণ করে এমন কিছু কথা বলব যে , তা আল্লাহর সন্তুষ্টিরও কারণ হবে এবং উপস্থিত জনগণও ছাওয়াব ও কল্যাণ লাভ করবে । ইয়াযীদ গ্রহণ করল না। উপস্থিত জনতা বলল : হে আমীরুল মু মিনীন ! তাঁকে আরোহণ করার অনুমতি দিন , আমরা তাঁর নিকট হতে সম্ভবতঃ কিছু শুনতে পাব । ইয়াযীদ তাদেরকে বলল : যদি এই ব্যক্তিটি মিম্বরে আরোহণ করেন তবে আমার এবং আবু সুফিয়ানের বংশের মান সম্মান ধুলিস্যাত না করে নামবেন না ! লোকেরা বলল : কোন্ লোক তাঁর ও তাঁর বক্তব্যের পক্ষ নেবে ? ইয়াযীদ বলল : সে এমন এক পরিবারের সদস্য যারা জ্ঞানকে সর্বোত্তমরূপে আস্বাদন করেছে ! কিন্তু উপস্থিত লোকেরা এতবেশী পীড়াপীড়ি করতে লাগল যে , শেষে ইয়াযীদ অনুমতি দিতে বাধ্য হল। ইমাম (আ.) মিম্বরে আরোহণ করে আল্লাহর প্রশংসা , স্তুতি ও গুণগান করে বললেন :

“ হে উপস্থিত জনতা ! রাসূলের বংশধর হিসেবে আমাদেরকে ছয়টি বিশেষত্ব দান করা হয়েছে এবং অন্যদের উপর আমাদের সাতটি বিষয়ে প্রাধান্য রয়েছে। আমাদের প্রতি দানকৃত জিনিসগুলি হচ্ছে : জ্ঞান প্রজ্ঞা , ধৈর্য , মহানুভবতা , বাকপটুতা , সাহসিকতা ও মু মিনদের অন্তরসমূহে আমাদের প্রতি ভালবাসা। আর অন্যদের চেয়ে আমাদের প্রাধান্যের বিষয়গুলো হচ্ছে :আমরা হচ্ছি আল্লাহর নির্বাচিত নবী মুহাম্মদ মোস্তফার (সা.) বংশভুক্ত , আর সিদ্দীক , আসাদুল্লাহ্ ,ও আসাদুর রাসূল আলী , বিশ্বের নারীদের নেত্রী ফাতিমা বাতুল ,এই বংশের দুই সন্তান জান্নাতের যুবকদের দুই সর্দার , জাফর তাইয়ার সকলেই আমাদের অন্তর্ভুক্ত। অতঃপর বলেন: যারা আমাকে চিনেন তারা তো চিনেনই ; আর যারা আমাকে চিনেন না তাদেরকে এখন আমার বংশকৌলীন্য সম্পর্কে অবহিত করব ।

আমি মক্কা ও মিনার সন্তান। আমি জমজম ও সাফার সন্তান। আমি সেই ব্যক্তির সন্তান যিনি চাদরের আঁচলে করে যাকাত নিয়ে চারদিকে ছুটে যেতেন। সর্বোত্তম লুঙ্গি ও চাদর পরিধানকারী লোকের আমি সন্তান। আমি সর্বোত্তম খড়ম পরিধানকারীর সন্তান। আমি সেই সর্বোত্তম ব্যক্তিত্বের সন্তান যিনি তাওয়াফ ও সাঈ ’ করেছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি হজ্জ করেছেন ও লাব্বাইক বলেছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি বোরাকে আরোহণ করে আসমানে ভ্রমণ করেছেন। আমি তাঁর সন্তান যাঁকে নৈশকালে মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর তিনি কত পবিত্র সত্ত্বা যিনি তাঁকে নৈশকালে ভ্রমণ করিয়েছেন।)১৩৪ আমি তাঁর সন্তান যাঁকে জিব্রাঈল (আ.) সিদ্রাতুল মুন্তাহায় ’ পৌঁছিয়েছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি নিকটবর্তী হয়েছেন এবং দুই বিঘত পরিমাণ অথবা তদোপেক্ষা নিকটবর্তী হয়েছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি আসমানসমূহের ফেরেশ্তাদের সাথে নামায আদায় করেছেন। আমি তাঁর সন্তান যাঁর নিকটে মহান আল্লাহর যা কিছু ওহী করার ছিল তা ওহী করেছেন। আমি মুহাম্মদ মোস্তফার (সা.) সন্তান , তাঁর সন্তান যিনি মানুষের নাসিকা ধুলায় ধুসরিত করেছেন ফলে তারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ ’ বলতে বাধ্য হয়েছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি দুইবার বাইআত করেছেন। দুই কিবলার দিকে নামায আদায় করেছেন। বদর ও হুনাইনে যুদ্ধ করেছেন। চোখের পলক পড়ার সমান পরিমাণ সময়ও আল্লাহকে অস্বীকার করেন নি। মুসলমানদের অগ্রপথিক। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী , অত্যাচারী ও খারিজীদেরকে হত্যাকারী। মহানুভব ও দাতা , পবিত্রদের নেতা , হেজাজের সিংহ , ইরাকের ব্যাঘ্র , মক্কী , মাদানী , আবতাহী , তাহামী , খাইফী , আকাবী , বদরী , ওহুদী , শাজারী , মুহাজেরী , সিবতাইনের (হাসান ও হুসাইন) পিতা আলী ইবনে আবী তালিবের সন্তান। আমি ফাতিমা যাহরার সন্তান। আমি নারীদের নেত্রীর সন্তান। আমি রাসূলের দেহের অংশের সন্তান ।

বর্ণনাকারী বলেন : মানুষের কান্না ও চিৎকার ধ্বনি উত্থিত হওয়া পর্যন্ত ইমাম অব্যাহতভাবে আমি , আমি , বলে যাচ্ছিলেন। হট্টগোল সৃষ্টি হওয়ার ভয়ে ইয়াযীদ মুয়াজ্জিনকে আযান দিতে আদেশ দেয় এবং ইমামের বক্তব্যের ছেদ ঘটায়। ইমামও নীরব হয়ে যান। মুয়াজ্জিন আল্লাহু আকবার ’ বলল , ইমাম (আ.) বলেন : তিনি মহান , এমন মহান সত্তা যে , কোনো কিছুর সাথে তুলনা করা যাবে না। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে ধারণযোগ্য নন। কোনো বস্তুই তাঁর চেয়ে মহান নয় । মুয়াজ্জিন আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ ’ বলল ইমাম (আ.) বললেন : এই বাণীর প্রতি আমার সমস্ত অস্তিত্ব সাক্ষ্য দিচ্ছে ; আমার লোম , চামড়া , মাংস , রক্ত , মেধা , অস্থি সবই তার প্রতি সাক্ষ্য দিচ্ছে । মুয়াজ্জিন আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলল , ইমাম আলী ইবনিল হুসাইন (আ.) মিম্বরের উপর হতে ইয়াযীদের দিকে মুখ করে বলেন : ইয়াযীদ ! এই মুহাম্মদ (সা.) আমার নানা , না তোমার নানা ? যদি তোমার নানা বলে দাবি কর তবে নিশ্চয় তুমি মিথ্যা বলছ , আর যদি আমার নানা বলে স্বীকার কর তবে তাঁর ইতরাতকে (বংশধর) কেন হত্যা করলে ?

বর্ণনাকারী বলেন : মুয়াজ্জিন আযান সমাপ্ত করলে , ইয়াযীদ সামনে যায় এবং যোহরের নামায আদায় করে। ’১৩৫

খিলাফতের রাজধানীতে শোকানুষ্ঠান পালন

দামেশকের মসজিদে ইমামের (আ.) বক্তব্যের পর , ইয়াযীদ নামায সম্পন্ন করে আদেশ দেয় যে , প্রস্তুতকৃত ঘরটিতে যেন ইমাম আলী ইবনিল হুসাইন (আ.) এবং তাঁর ভগ্নীগণ ও ফুফুদেরকে স্থান দেয়া হয়। তাঁরাও সেইখানে কয়েকদিন যাবৎ শোকানুষ্ঠান পালন করেন এবং হুসাইনের (আ.) জন্যে ক্রন্দন করেন ও শোকগাথাঁ পাঠ করেন।

এই অনুষ্ঠানের পরে , ইয়াযীদ রাসূলের (সা.) সন্তান সন্ততির সাথে আচরণ পরিবর্তন করতে এবং কতকগুলি সীমাবদ্ধতাকে উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয় ও তাঁদের শহীদগণের জন্যে শোকানুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ।

অতঃপর ইয়াযীদ দামেশক শহরের অবস্থা শোচনীয় দেখে বন্দী কাফেলাকে সম্মানের সাথে মদীনায় পাঠায়।

ইয়াযীদের দরবারে হযরত যয়নবের (আ.) বক্তব্য

ইমাম আলী ইবনে আবী তালিবের (আ.) কন্যা যয়নব , ইয়াযীদের সভায় দণ্ডায়মান হয়ে বলেন :

“ বিশ্বের প্রতিপালকের জন্যে সমস্ত প্রশংসা ও স্তুতি এবং রাসূল ও তাঁর বংশধরের উপর আল্লাহর করুণা অবতীর্ণ হোক ! পরম পবিত্র আল্লাহ্ তায়ালা কতটা সত্য কথা বলেছেন ! তিনি বলেন : গোনাহ্গার ও মন্দ লোকদের পরিণতি এই হবে যে ,আমাদের নিদর্শনগুলিকে মিথ্যা মনে করবে এবং সেইগুলিকে উপহাসের বস্তু হিসেবে গ্রহণ করবে। ’ ইয়াযীদ ! তুমি কি ধারণা করেছো ? তুমি কি ধারণা করছ যে , তুমি এখন আমাদের জন্য পৃথিবী ও আকাশকে সংকীর্ণ করে দিয়েছো এবং আমাদেরকে এই অবস্থায় উপনীত করেছো যে , বন্দিদের মত আমাদেরকে এদিক সেদিক নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । ভেবেছো এই কাজটি আমাদেরকে আল্লাহর নিকট হীন ও অযোগ্য করে দিবে এবং তোমাকে সম্মানিত ও মহত্বে পৌঁছাবে ; আর আল্লাহর নিকট তোমার উচ্চমর্যাদার কারণে এই বাহ্যিক বিজয় ঘটেছে ? এই কারণে তুমি চরম আনন্দিত এবং নিজের অতীতে ফিরে গেছ , পৃথিবীকে নিজের জন্যে প্রস্তুত , সুসজ্জিত ও সুস্বাদু দেখে তুমি খুশী ও আনন্দে বাগ বাগ হয়েছো ? আমাদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা যখন তোমার করতলগত হয়েছে এইরূপ করছ ? শান্ত হও , শান্ত হও ! মহান আল্লাহর বাণী কি ভুলে গেছ ( ?) তিনি বলেছেন : যারা কুফরী করে তারা যেন এইরূপ ধারণা না করে যে , পৃথিবীর যে সব সুযোগ সুবিধা আমরা তাদেরকে দান করি সেগুলি তাদের জন্যে কল্যাণকর। আমরা এই সুযোগ সুবিধাগুলি তাদেরকে এই উদ্দেশ্যে দান করি যে , সেইগুলি যেন তাদের পাপসমূহকে বৃদ্ধি করে এবং আগামীতে তাদের জন্যে রয়েছে অপমানজনক শাস্তি ।

হে আমাদের নানার মুক্তকৃত লোকদের সন্তান ! এইটি কি ন্যায়বিচার যে , তুমি নিজ নারী ও দাসীদেরকে পর্দায় রাখছ আর রাসূলুল্লাহর কন্যাগণকে বন্দী হিসেবে ইসলামী দেশের চতুর্দিকে ঘোরাচ্ছ ? তাঁদের পর্দা কেড়ে মুখমণ্ডলসমূহকে প্রকাশ করছ ? শত্রুদের দ্বারা তাঁদেরকে শহর হতে শহরে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতে বাধ্য করছ ? তাঁদেরকে শহরের লোকজনদের নিকট বিনোদনের উপাদান বানাচ্ছ , যাতে পরিচিত অপরিচিত এবং উত্তম অধম সবাই তাঁদের মুখমণ্ডলগুলিকে লক্ষ্য করে। আর এই অবস্থায় তাঁদের সাথে তাঁদের কোনো অভিভাবক নেই এবং তাঁদের পুরুষগণের পক্ষ হতে তত্ত্বাবধায়ন হচ্ছে না ?!

না , হে আল্লাহ্ , কি বলব ! নিরাপত্তার ব্যাপারে কি করে তাদের প্রতি আশা করা যায় ( ?) যারা সায়্যিদুশ্ শুহাদা হযরত হামযা ’ র মত পবিত্রতম ব্যক্তিত্বের কলিজা চিবিয়েছে এবং ওহুদের শহীদগণের রক্তের দ্বারা যাদের রক্ত মাংসের বৃদ্ধি ঘটেছে ? আমাদের আহলে বাইতের প্রতি শত্রুতার ক্ষেত্রে নরম আচরণ করবে বলে তাদের উপর কি করে আশা করা যায় যারা আমাদেরকে অস্বীকার করে , শত্রুতা , ঈর্ষা ও বিদ্বেষের দৃষ্টিতে আমাদেরকে দেখে এবং তাদের মধ্যে গুনাহর কোন অনুভূতিই নেই , এই কাজটিকে বড় কোন অন্যায় বলে মনে করে না ? বরং বলছে : লোকেরা যেন আনন্দ করে , খুশীতে থাকে , উল্লাস করে ! আর বলে , এ কর্মের জন্যে হে ইয়াযীদ! তোমাকে ধন্যবাদ। ’ এই অবস্থায় , বেহেশ্তের যুবকদের সর্দার হযরত আবু আব্দিল্লাহর দাঁতগুলিকে তুমি তোমার লাঠি দ্বারা আঘাত করছ ! কেনই বা তুমি এইরূপ কাজ করবে না ?! মুহাম্মদের (সা.) নাতি ও আলে আব্দিল মুত্তালিবের আকাশের তারকাগণের রক্তপাতের মাধ্যমে তুমি যে , তোমার হিংসা বিদ্বেষপূর্ণ নোংরা বস্তুগত চেহারার পর্দা উন্মুক্ত করেছো এবং তোমার মূলে ফিরে গেছ , তোমার পিতৃপুরুষদের স্মরণ করছ ও তাদেরকে আহ্বান করাকে কল্যাণকর ধারণা করছ , অথচ খুব শীঘ্রই তুমি তাদের প্রবেশের স্থানে প্রবেশ করবে ! সেইখানে তুমি চাইবে যে , যদি তুমি খোঁড়া , অক্ষম ও বোবা হতে এবং এই সব না বলতে ও এইরূপ কর্ম না করতে !

হে আল্লাহ্ ! আমাদের প্রতিশোধ গ্রহণ কর ! যে ব্যক্তি আমাদের প্রতি অত্যাচার করেছে তার নিকট হতে প্রতিশোধ নাও ! যে ব্যক্তি আমাদের রক্তপাত করেছে ও আমাদের অভিভাবকগণকে হত্যা করেছে তুমি তাদের উপর তোমার ক্রোধ ও অভিসম্পাত প্রেরণ কর !

ইয়াযীদ ! আল্লাহর শপথ ! তুমি তোমার নিজের চামড়া ব্যতীত অন্য কিছু চিরনি এবং তোমার নিজেরই মাংস ব্যতিত অন্য কিছুই কাটনি ! আল্লাহর রাসূলের সন্তান সন্ততির রক্তপাত ,তাঁর ইতরাত (বংশধর) ও তাঁর শরীরের অংশসমূহের সম্মান বিনষ্ট করার ফলে যেসব অপরাধ তোমার কাঁধে চেপেছে সেসব সহকারে তুমি নিঃসন্দেহে তাঁর (রাসূল) নিকট প্রবেশ করবে ! আল্লাহ্ তাঁদের বিক্ষিপ্ত অংশসমূহকে সংযোজন করবেন , তাঁদের বিচ্ছিন্ন অংশগুলিকে সংযুক্ত করবেন এবং তাঁদের প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন ! আর তোমরা এইরূপ ধারণা করো না যে , যাঁরা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছেন তাঁরা মারা গেছেন , বরং তাঁরা জীবিত আছেন এবং তাঁদের প্রতিপালকের নিকট হতে রিয্ক গ্রহণ করেন।

তোমার জন্যে এই যথেষ্ট যে , মহান আল্লাহ্ তোমার নিকট হিসাব গ্রহণ করবেন , মুহাম্মদ (সা.) তোমার সাথে দুশমনি করবেন এবং জিব্রাঈল (আ.) আমাদের পৃষ্ঠপোষক হবেন। যে ব্যক্তি তোমার জন্যে এইরূপ অপরাধকে সুসজ্জিত করেছে এবং মুসলমানদের উপর তোমাকে কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের অধিকারী করেছে সে অচিরেই বুঝবে যে , অত্যাচারীর জন্যে জাহান্নামের মন্দ স্থান নির্ধারিত রয়েছে এবং তুমিও বুঝবে যে , তোমাদের ও আমাদের মাঝে কারা মন্দ স্থানে রয়েছে এবং কারা দুর্বলতর শক্তির অধিকারী।

ইয়াযীদ ! বর্তমান কঠিন অবস্থা ও সমস্যাদি আমাকে এমন স্থানে উপনীত করেছে , যার ফলে তোমার সাথে কথা বলছি ! তবে তুমি জেনে রেখ ! আমি তোমাকে এতটা নগণ্য ও ক্ষুদ্র জ্ঞান করি যে , তোমাকে ভর্ৎসনা করাটাও তোমার সত্তার চেয়ে বড় মনে করি এবং তোমার জন্যে তিরস্কার করাটাও বেশী মনে করি (অর্থাৎ তুমি ভর্ৎসনা ও তিরস্কারের অযোগ্য) ! কিন্তু কি করি ! ? চক্ষুগুলি অশ্রুতে পূর্ণ এবং অন্তরসমূহ অগ্নিদগ্ধ ! জেনে রেখ ! বিস্ময়কর ! সবই বিস্ময়কর !! শয়তানের দলের মুক্তিপ্রাপ্ত লোকদের হাতে হিযবুল্লাহর মহানুভব ব্যক্তিগণ নিহত হচ্ছেন ! এই হাতগুলি হতে আমাদের রক্ত ঝরছে , এই মুখগুলি আমাদের মাংসকে চোষণ করছে এবং আমাদের পবিত্র ব্যক্তিগণের দেহসমূহকে নেকড়েরা ছিন্নভিন্ন করছে , হায়েনারা মাটির উপর টানাটানি করছে !

ইয়াযীদ ! তুমি যদি আমাদেরকে তোমার জন্য গনিমত মনে করে থাক তবে এইটি জেনে রেখ যে , খুব শীঘ্রই আমাদেরকে তোমার ক্ষতির কারণ হিসেবে দেখবে ! পূর্বে প্রেরিত আমলগুলি ছাড়া সেইখানে আর অন্য কিছু পাবে না ! তোমার প্রতিপালক অত্যাচারী লোকদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেন না ! আমি আল্লাহর নিকট অভিযোগ করছি এবং তাঁর উপর আমার ভরসা আছে।

ইয়াযীদ ! তুমি তোমার প্রতারণাকে কাজে লাগাও , তোমার চেষ্টাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাও এবং তোমার প্রচেষ্টাকে বিস্তৃত কর ! আল্লাহর শপথ ! তুমি আমাদের স্মরণকে বিলুপ্ত করতে পারবে না এবং আমাদের ঐশী প্রেরণাকে নস্যাৎ করতে পারবে না। এই অপরাধের লজ্জা ও অপমান তোমার থেকে কখনই মুছে যাবে না। দুর্বল (যুক্তি)ও মিথ্যা(ভাষ্য) ব্যতীত তোমার কি মত আছে ? মুষ্টিমেয় কয়েকটি দিন এবং বিক্ষিপ্ত জনতা ছাড়া তোমার আর কি আছে ? যে দিন আহ্বানকারী আহ্বান করবেন : জেনে রাখ ! জালিমের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হোক ! বিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যে সমস্ত প্রশংসা , যিনি আমাদের পূর্ববর্তীগণকে সৌভাগ্য ও মাগফিরাতসহ গন্তব্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছিয়েছেন এবং আমাদের উত্তরসুরিগণকে শাহাদত ও রহমত দ্বারা নৈকট্য দান করেছেন। মহান আল্লাহর নিকট কামনা করব , তিনি যেন তাঁদেরকে অফুরন্ত নিয়ামত দান করেন এবং তাঁদের শাহাদতকে তাঁর নিয়ামত বৃদ্ধির উপকরণ বানিয়ে দেন ! আমাদেরকে তাঁদের উত্তম প্রতিনিধি হিসেবে নির্ধারণ করেন ! তিনি হচ্ছেন করুণাময় ও দয়ালু। তিনিই আমাদের জন্যে যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম ভরসাস্থল । ১৩৩

দামেশকের জামে মসজিদে হযরত ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এর ভাষণ

ইয়াযীদ দামেশকের জামে মসজিদে স্বীয় খতীবকে আদেশ প্রদান করে যে , সে যেন মিম্বরে আরোহণ করে মুয়াবিযা ও ইয়াযীদের প্রশংসা করে এবং ইমাম আলী ও ইমাম হুসাইনের (আ.) সমালোচনা করে। খতীব মিম্বরে আরোহণ করে আল্লাহর প্রশংসা ও স্তুতির পর যথাসাধ্য আলী ও হুসাইনের (আ.) নিন্দা এবং মুয়াবিয়া ও ইয়াযীদের প্রশংসা করে।

এ অবস্থায় হুসাইনের পুত্র আলী (আ.) তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেন : হে বক্তা , তোমার অকল্যাণ হোক ! সৃষ্টির সন্তুষ্টিকে স্রষ্টার ক্রোধের সাথে বিনিময় করলে এবং জাহান্নামে তোমার জায়গা বেছে নিলে ?!

অতঃপর তিনি বলেন : ইয়াযীদ ! তুমি আমাকে অনুমতি দাও , আমি এই কাঠের (মিম্বারের দিকে নির্দেশ করে) উপর আরোহণ করে এমন কিছু কথা বলব যে , তা আল্লাহর সন্তুষ্টিরও কারণ হবে এবং উপস্থিত জনগণও ছাওয়াব ও কল্যাণ লাভ করবে । ইয়াযীদ গ্রহণ করল না। উপস্থিত জনতা বলল : হে আমীরুল মু মিনীন ! তাঁকে আরোহণ করার অনুমতি দিন , আমরা তাঁর নিকট হতে সম্ভবতঃ কিছু শুনতে পাব । ইয়াযীদ তাদেরকে বলল : যদি এই ব্যক্তিটি মিম্বরে আরোহণ করেন তবে আমার এবং আবু সুফিয়ানের বংশের মান সম্মান ধুলিস্যাত না করে নামবেন না ! লোকেরা বলল : কোন্ লোক তাঁর ও তাঁর বক্তব্যের পক্ষ নেবে ? ইয়াযীদ বলল : সে এমন এক পরিবারের সদস্য যারা জ্ঞানকে সর্বোত্তমরূপে আস্বাদন করেছে ! কিন্তু উপস্থিত লোকেরা এতবেশী পীড়াপীড়ি করতে লাগল যে , শেষে ইয়াযীদ অনুমতি দিতে বাধ্য হল। ইমাম (আ.) মিম্বরে আরোহণ করে আল্লাহর প্রশংসা , স্তুতি ও গুণগান করে বললেন :

“ হে উপস্থিত জনতা ! রাসূলের বংশধর হিসেবে আমাদেরকে ছয়টি বিশেষত্ব দান করা হয়েছে এবং অন্যদের উপর আমাদের সাতটি বিষয়ে প্রাধান্য রয়েছে। আমাদের প্রতি দানকৃত জিনিসগুলি হচ্ছে : জ্ঞান প্রজ্ঞা , ধৈর্য , মহানুভবতা , বাকপটুতা , সাহসিকতা ও মু মিনদের অন্তরসমূহে আমাদের প্রতি ভালবাসা। আর অন্যদের চেয়ে আমাদের প্রাধান্যের বিষয়গুলো হচ্ছে :আমরা হচ্ছি আল্লাহর নির্বাচিত নবী মুহাম্মদ মোস্তফার (সা.) বংশভুক্ত , আর সিদ্দীক , আসাদুল্লাহ্ ,ও আসাদুর রাসূল আলী , বিশ্বের নারীদের নেত্রী ফাতিমা বাতুল ,এই বংশের দুই সন্তান জান্নাতের যুবকদের দুই সর্দার , জাফর তাইয়ার সকলেই আমাদের অন্তর্ভুক্ত। অতঃপর বলেন: যারা আমাকে চিনেন তারা তো চিনেনই ; আর যারা আমাকে চিনেন না তাদেরকে এখন আমার বংশকৌলীন্য সম্পর্কে অবহিত করব ।

আমি মক্কা ও মিনার সন্তান। আমি জমজম ও সাফার সন্তান। আমি সেই ব্যক্তির সন্তান যিনি চাদরের আঁচলে করে যাকাত নিয়ে চারদিকে ছুটে যেতেন। সর্বোত্তম লুঙ্গি ও চাদর পরিধানকারী লোকের আমি সন্তান। আমি সর্বোত্তম খড়ম পরিধানকারীর সন্তান। আমি সেই সর্বোত্তম ব্যক্তিত্বের সন্তান যিনি তাওয়াফ ও সাঈ ’ করেছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি হজ্জ করেছেন ও লাব্বাইক বলেছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি বোরাকে আরোহণ করে আসমানে ভ্রমণ করেছেন। আমি তাঁর সন্তান যাঁকে নৈশকালে মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর তিনি কত পবিত্র সত্ত্বা যিনি তাঁকে নৈশকালে ভ্রমণ করিয়েছেন।)১৩৪ আমি তাঁর সন্তান যাঁকে জিব্রাঈল (আ.) সিদ্রাতুল মুন্তাহায় ’ পৌঁছিয়েছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি নিকটবর্তী হয়েছেন এবং দুই বিঘত পরিমাণ অথবা তদোপেক্ষা নিকটবর্তী হয়েছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি আসমানসমূহের ফেরেশ্তাদের সাথে নামায আদায় করেছেন। আমি তাঁর সন্তান যাঁর নিকটে মহান আল্লাহর যা কিছু ওহী করার ছিল তা ওহী করেছেন। আমি মুহাম্মদ মোস্তফার (সা.) সন্তান , তাঁর সন্তান যিনি মানুষের নাসিকা ধুলায় ধুসরিত করেছেন ফলে তারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ ’ বলতে বাধ্য হয়েছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি দুইবার বাইআত করেছেন। দুই কিবলার দিকে নামায আদায় করেছেন। বদর ও হুনাইনে যুদ্ধ করেছেন। চোখের পলক পড়ার সমান পরিমাণ সময়ও আল্লাহকে অস্বীকার করেন নি। মুসলমানদের অগ্রপথিক। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী , অত্যাচারী ও খারিজীদেরকে হত্যাকারী। মহানুভব ও দাতা , পবিত্রদের নেতা , হেজাজের সিংহ , ইরাকের ব্যাঘ্র , মক্কী , মাদানী , আবতাহী , তাহামী , খাইফী , আকাবী , বদরী , ওহুদী , শাজারী , মুহাজেরী , সিবতাইনের (হাসান ও হুসাইন) পিতা আলী ইবনে আবী তালিবের সন্তান। আমি ফাতিমা যাহরার সন্তান। আমি নারীদের নেত্রীর সন্তান। আমি রাসূলের দেহের অংশের সন্তান ।

বর্ণনাকারী বলেন : মানুষের কান্না ও চিৎকার ধ্বনি উত্থিত হওয়া পর্যন্ত ইমাম অব্যাহতভাবে আমি , আমি , বলে যাচ্ছিলেন। হট্টগোল সৃষ্টি হওয়ার ভয়ে ইয়াযীদ মুয়াজ্জিনকে আযান দিতে আদেশ দেয় এবং ইমামের বক্তব্যের ছেদ ঘটায়। ইমামও নীরব হয়ে যান। মুয়াজ্জিন আল্লাহু আকবার ’ বলল , ইমাম (আ.) বলেন : তিনি মহান , এমন মহান সত্তা যে , কোনো কিছুর সাথে তুলনা করা যাবে না। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে ধারণযোগ্য নন। কোনো বস্তুই তাঁর চেয়ে মহান নয় । মুয়াজ্জিন আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ ’ বলল ইমাম (আ.) বললেন : এই বাণীর প্রতি আমার সমস্ত অস্তিত্ব সাক্ষ্য দিচ্ছে ; আমার লোম , চামড়া , মাংস , রক্ত , মেধা , অস্থি সবই তার প্রতি সাক্ষ্য দিচ্ছে । মুয়াজ্জিন আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলল , ইমাম আলী ইবনিল হুসাইন (আ.) মিম্বরের উপর হতে ইয়াযীদের দিকে মুখ করে বলেন : ইয়াযীদ ! এই মুহাম্মদ (সা.) আমার নানা , না তোমার নানা ? যদি তোমার নানা বলে দাবি কর তবে নিশ্চয় তুমি মিথ্যা বলছ , আর যদি আমার নানা বলে স্বীকার কর তবে তাঁর ইতরাতকে (বংশধর) কেন হত্যা করলে ?

বর্ণনাকারী বলেন : মুয়াজ্জিন আযান সমাপ্ত করলে , ইয়াযীদ সামনে যায় এবং যোহরের নামায আদায় করে। ’১৩৫

খিলাফতের রাজধানীতে শোকানুষ্ঠান পালন

দামেশকের মসজিদে ইমামের (আ.) বক্তব্যের পর , ইয়াযীদ নামায সম্পন্ন করে আদেশ দেয় যে , প্রস্তুতকৃত ঘরটিতে যেন ইমাম আলী ইবনিল হুসাইন (আ.) এবং তাঁর ভগ্নীগণ ও ফুফুদেরকে স্থান দেয়া হয়। তাঁরাও সেইখানে কয়েকদিন যাবৎ শোকানুষ্ঠান পালন করেন এবং হুসাইনের (আ.) জন্যে ক্রন্দন করেন ও শোকগাথাঁ পাঠ করেন।

এই অনুষ্ঠানের পরে , ইয়াযীদ রাসূলের (সা.) সন্তান সন্ততির সাথে আচরণ পরিবর্তন করতে এবং কতকগুলি সীমাবদ্ধতাকে উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয় ও তাঁদের শহীদগণের জন্যে শোকানুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ।

অতঃপর ইয়াযীদ দামেশক শহরের অবস্থা শোচনীয় দেখে বন্দী কাফেলাকে সম্মানের সাথে মদীনায় পাঠায়।


10

11

12

13