বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্23%

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্ লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 18 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 26167 / ডাউনলোড: 4693
সাইজ সাইজ সাইজ
বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মৃত্যুপারের জীবন সম্পর্কে মানুষের ঔৎসুক্য চিরন্তন। এ ঔৎসুক্যের পরিপূর্ণ নিবৃত্তি জীবদ্দশায় সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব নয় জেনেও মানুষ কখনোই এ বিষয়ে জানার আগ্রহ পরিত্যাগ করতে পারে না। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মে যেমন বিভিন্ন ধারণা দেয়া হয়েছে, তেমনি এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা তথ্য ও কল্পনা। তাই এ ব্যাপারে সম্ভব সর্বাধিক মাত্রায় সঠিক ধারণার প্রয়োজনীয়তা সব সময়ই অনুভূত হয়ে আসছে।

ইসলামী মতে, সাধারণভাবে মৃত্যুপরবর্তী সময়ের দু’টি পর্যায় রয়েছে : মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত সময় এবং পুনরুত্থান পরবর্তী সময় অর্থাৎ শেষ বিচার ও তদ্পরবর্তী জান্নাতী বা জাহান্নামী অনন্ত জীবন। পুনরুত্থান, শেষ বিচার এবং বেহেশত বা দোযখ বাস তথা আখেরাতের ওপর ঈমান পোষণ ইসলামের মৌলিক চৈন্তিক ভিত্তি (উছূলে ‘আক্বাএদ্)-এর অন্যতম। এ কারণে এ সম্পর্কে কোরআন মজীদে বিস্তারিত বক্তব্য রয়েছে।


1

2

3

4

5

6

7

আালামে বারযাখ্ ও আালামে মিছাল্

দার্শনিক ও আারেফ্গণ মৃত ব্যক্তিদের দেহাতীত সত্তার জগত আালামে বারযাখ্ ছাড়াও আরো একটি বারযাখী জগতের কথা বলেছেন। একে তাঁরা আালামে মিছাল্ বা বারযাখে মিছালী বলে উল্লেখ করেছেন।

‘ আারেফ্কুল শিরোমণি হযরত শায়খ্ মুহীউদ্দীন ইব্নুল্ আরাবী (রহ্.) বলেছেন যে , বারযাখ্ ” পরিভাষাটি দু টি অর্থে ব্যবহৃত হয় : একটি হচ্ছে তা-ই পার্থিব দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর রূহ্ (নাফ্স্) সমূহকে যেখানে রাখা হয় ; এটা ঐ বারযাখ্ থেকে স্বতন্ত্র - যা মুজাররাদ্ রূহ্ সমূহ ও বস্তুগত শরীর সমূহের মাঝামাঝি। (شرح فصص محی الدين ابن العربی، ص ٣٢ )

উল্লেখ্য , দার্শনিক ও আারেফ্গণ বস্তুসম্পর্কহীন স্বাধীন আত্মিক সত্তাসমূহকে (যেগুলো বস্তুদেহে উদ্ভূত নয়) মুজাররাদ্ (مجرد ) বা বস্তুসম্পর্কহীন সত্তা বলে থাকেন , যেমন : ফেরেশতাগণ। এ ধরনের সত্তাকে রূহে মুজাররাদ্-ও বলা হয়। এ ধরনের সত্তাসমূহের জগতকে আালামে মুজাররাদ্ (عالم مجرد - অবস্তুগত সত্তার জগত) বা আালামে আরওয়াহ্ (عالم ارواح - রূহের জগত) বলা হয়। এ জগতের ও তার অধিবাসীদের জন্য কোনো স্থানের প্রয়োজন হয় না অর্থাৎ তাদের অবস্থানের জন্য কোনো বস্তু সরিয়ে দিয়ে তার স্থান দখলের প্রয়োজন হয় না।

দার্শনিক ও আারেফ্গণের মতে , এই আালামে মুজাররাদ্ ও বস্তুজগতের মাঝামাঝি বৈশিষ্ট্য সম্বলিত আরেকটি জগত রয়েছে ; এ জগতের নাম আালামে মিছাল্ বা আালামে বারযাখ্ বা বারযাখে মিছালী। এ জগতের সৃষ্টিনিচয় বস্তুগত সৃষ্টিও নয় , আবার পুরোপুরি মুজাররাদ্ও নয় , বরং এতদুভয়ের মাঝামাঝি ধরনের তথা এক ধরনের সূক্ষ্ম উপাদানে সৃষ্ট।

মৃত্যর পরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী জগতকে দু টি কারণে আালামে বারযাখ্ বলা হয়। প্রথমতঃ এ কারণে যে , তা মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মাঝামাঝি জগত তথা পার্থিব জগত ও আখেরাতের জগতের মাঝামাঝি জগত , দ্বিতীয়তঃ সেখানে মানুষের নাফ্স্ বস্তুদেহবিহীন কিন্তু মিছালী শরীর (জিসমে মিছালী) সহ অবস্থান করে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , আসলেই কি , তাঁরা যেমন বলেছেন , উপরোল্লিখিত আালামে মিছাল ও মৃত ব্যক্তিদের নাফসের জগত অর্থাৎ আালামে বারযাখ্ স্বতন্ত্র , নাকি অভিন্ন ?

বলা বাহুল্য যে , বস্তুজগতে জীবিত মানুষ জাগ্রত অবস্থায়ও সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন গতিবিধির অধিকারী নয় , বরং প্রাকৃতিক , আইনগত , বস্তুগত , বিশেষতঃ আর্থিক এবং সামাজিক ও নৈতিক বাধা তার গতিবিধি ও তৎপরতাকে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রিত করে। আলামে বারযাখে অর্থাৎ মৃত্যুপরবর্তী জগতে নাফ্স্ সমূহের গতিবিধি ঐ জগতের জন্য নির্ধারিত বিশেষ বিধিবিধানের আওতায় ফেরশতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য নবী-রাসূলগণ ( আঃ) সহ আল্লাহ্ তা আলার খাছ্ব্ বান্দাহ্গণ যে ঐ জগতে সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রার স্বাধীনতা ভোগ করবেন এটাই স্বাভাবিক এবং পাপিষ্ঠরা যে বলতে গেলে কোনোই স্বাধীনতা লাভ করবে না এতেও সন্দেহ নেই। অন্য ব্যক্তিরা তাদের অবস্থা অনুযায়ী স্বাধীনতা ও সীমাবদ্ধতার অধিকারী হবে - এটাই বিচারবুদ্ধির দাবী।

অন্যদিকে দার্শনিক ও আারেফ্গণ যে আালামে মিছাল্-এর কথা বলেছেন সে জগতও নিঃসন্দেহে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার জগত হতে পারে না। বরং তা-ও সুনির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি , নৈতিকতা , অতিপ্রাকৃতিক বিধি-বিধান ও ফেরেশতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জগত হতে বাধ্য। এমতাবস্থায় প্রশ্ন জাগে যে , এ দু টি জগত কি বিভিন্ন , নাকি অভিন্ন ?

আল্লাহ্ তা আলা কোরআন মজীদে মৃত ও ঘুমন্ত উভয় ধরনের লোকদের নাফসকে অধিগ্রহণ করেন (يتوفّی ) বলে উল্লেখ করেছেন এবং এ জন্য অভিন্ন ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেছেন। অবশ্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে , তিনি ঘুমন্ত ব্যক্তির নাফসকে ফিরিয়ে দেন এবং মৃত ব্যক্তির নাফসকে ফিরিয়ে দেন না। এ ক্ষেত্রে উভয়ের অধিগ্রহণের জন্য অভিন্ন ক্রিয়াপদ ব্যবহারের কারণে এটা ধরে নেয়া অযৌক্তিক হবে না যে , উভয় ব্যক্তির নাফসকে অভিন্ন জগতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং একেই অধিগ্রহণ করা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এটাই স্বাভাবিক যে , উভয় ধরনের নাফসকে একই জগতের ভিন্ন ভিন্ন অংশে রাখা হয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , মানুষ স্বপ্নে জীবিত ও মৃত উভয় ধরনের মানুষের সাক্ষাৎ পায় কীভাবে ?

মৃত ব্যক্তিদের নাফ্স্ ফেরেশতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আালামে বারযাখে রাখা হয় এ ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই। এমতাবস্থায় মৃত ও ঘুমন্ত ব্যক্তির নাফসকে অভিন্ন জগতে নেয়া না হলে জীবিত ব্যক্তিদের নাফসের পক্ষে মৃত ব্যক্তিদেরকে দেখা সম্ভব হতে পারে না। কারণ , দার্শনিক ও আারেফ্গণ বর্ণিত সূক্ষ্ম সৃষ্টির জগত বা আালামে মিছাল্ স্বতন্ত্র হলে এবং ঘুমন্ত ব্যক্তির নাফসকে সেখানে নিয়ে রাখা হলে সেখানে তাকে যদি মৃত ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করাতে হয় তাহলে মৃত ব্যক্তির নাফসকে আালামে বারযাখ্ থেকে কথিত আালামে মিছালে নিয়ে যাওয়া অপরিহার্য। কিন্তু বিচারবুদ্ধি এটাকে সঠিক বলে মানতে পারে না। কারণ , তাহলে আালামে বারযাখের সীমান্ত তথা সীমাবদ্ধতার প্রাচীর (যদিও অবস্তুগত) লঙ্ঘিত হবে। বরং ঘুমন্ত ব্যক্তির নাফসকে মৃত ব্যক্তিদের নাফসের জগতেরই একটি অংশে নিয়ে গেলে এ সীমারেখা ও সীমাবদ্ধতা লঙ্ঘিত হয় না।

এখানে একটি নতুন প্রশ্নের উদয় হতে পারে , তা হচ্ছে , মানুষ স্বপ্নে শুধু মৃত লোকদেরকেই দেখতে পায় না , বরং অন্য জীবিত লোকদেরকেও দেখতে পায় এবং তাদের সাথে কথাবার্তা বলে ও অন্য ধরনের আন্তঃক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। কিন্তু হতে পারে যে , যে ব্যক্তিকে সে স্বপ্নে দেখেছে সে ব্যক্তি ঐ সময় জাগ্রত ছিলো অথবা ঘুমিয়ে থাকলেও সে হুবহু একই রকম স্বপ্ন দেখে নি। এর মানে দাঁড়ায় , নিঃসন্দেহে ঐ ব্যক্তির নাফ্স্ তখন আালামে বারযাখে বা আালামে মিছালে যায় নি , বা গেলেও প্রথমোক্ত ব্যক্তির নাফসের সাথে মুখোমুখি হয় নি। তাহলে প্রথমোক্ত ব্যক্তি স্বপ্নে কী করে তাকে দেখতে পায় ?

দার্শনিক ও আারেফ্গণের পক্ষ থেকে এর জবাবে যে সব সম্ভাবনা ব্যক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য জবাব হচ্ছে এই যে , আালামে মিছালে বস্তুজগতের প্রাণশীল ও নিষ্প্রাণ নির্বিশেষে সকল সৃষ্টিরই সদৃশ রূপ (صورت مثالی ) রয়েছে এবং সেখানে তাদের তৎপরতাও রয়েছে। আর সে তৎপরতা কেবল স্বপ্নযোগেই ঘটে না , বরং জাগ্রত অবস্থায় ব্যক্তির মধ্যে যে সব চিন্তা-চেতনা দেখা দেয় এবং সে সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে যে সব আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনা পোষণ করে , তেমনি সে যা কিছু কল্পনা করে তার সব কিছুই আালামে মিছালে অবস্তুগত মূর্ত রূপ লাভ করে তথা তৎপরতায় পরিণত হয় , যদিও ব্যক্তি নিজে সে সম্পর্কে বুঝতে পারে না। অন্যদিকে ঘুমন্ত ব্যক্তির নাফ্স্ যেমন জাগ্রত অবস্থায় যে সব চিন্তা ও কল্পনা করতো এবং যে সব আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনা পোষণ করতো সেগুলোও আালামে মিছালে অবস্তুগত মূর্ত রূপ লাভ করে তথা তৎপরতায় পরিণত হয়। ব্যক্তির নাফ্স্ ঘুমের মধ্যে প্রধানতঃ নিজের এবং সেই সাথে অন্যদের কতক চিন্তা-কল্পনা , আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনার অবস্তুগত মূর্ত রূপের মুখোমুখি হয় ও তা পর্যবেক্ষণ করে। এছাড়া উপস্থিতভাবেও সে সেখানে কতক তৎপরতা চালায়। অতঃপর তার নাফ্স্ মিছালী দেহ সহকারে , মতান্তরে মিছালী দেহ থেকে বের হয়ে , বস্তুদেহে ফিরে আসে। আর তখনই সে জাগ্রত হয়।

[উল্লেখ্য , আারেফ্গণের দৃষ্টিতে সামগ্রিকভাবে অস্তিত্বলোককে এক বিবেচনায় তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে : (১)عالم لاهت - আালামে লাহূত্ বা আল্লাহ্ তা আলার নিজ সত্তার রহস্যলোক - যা জানা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। (২)عالم ناسوت - আালামে নাসূত্ বা বস্তুজগত। (৩)عالم ملکوت - আালামে মালাকূত বা অবস্তুলোক।

‘ আালামে মালাকূত্ আবার তিন ভাগে বিভক্ত : (ক)ملکوت اعلی - মালাকূতে আ ‘ লা বা উচ্চতর অবস্তুলোক ; ফেরেশতাগণ সহ সকল বস্তুসম্পর্কহীন নাফ্স্ ও রূহ্ এ জগতের অন্তর্ভুক্ত। (খ)ملکوت سفلی - মালাকূতে সুফলা বা নিম্ন স্তরের মালাকূত্ ; মানুষের চিন্তা , কল্পনা ও পরিকল্পনা এ স্তরের অন্তর্ভুক্ত। (গ)ملکوت وسطی - মালাকূতে উসত্বা বা মধ্যবর্তী মালাকূত্ ; বস্তুগত অস্তিত্বের কাছাকাছি সূক্ষ্ম অস্তিত্বসমূহ এ জগতের অন্তর্ভুক্ত।

অন্যদিকে কোরআন মজীদের আয়াতে প্রতিটি জিনিসেরই মালাকূত্ আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

) فَسُبْحَانَ الَّذِي بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ(

“ অতএব , পরম প্রমুক্ত তিনি (আল্লাহ্) যার হাতে রয়েছে প্রতিটি জিনিসের (شَيْءٍ ) মালাকূত্ এবং তোমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনরত। ” (সূরাহ্ ইয়া-সীন্ : ৮৩)

বস্তুতঃ অন্য কোনো নিদর্শন না থাকলেشَيْءٍ বলতে বস্তুগত সৃষ্টিকে বুঝায় - তা তাতে প্রাণ থাকুক বা না-ই থাকুক। অতএব , বস্তুলোকের প্রাণশীল ও প্রাণহীন নির্বিশেষে প্রতিটি সৃষ্টিরই মালাকূত্ রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে , এ মালাকূত্ কী ? তা কি আলামে মিছালস্থ সৃদৃশ আকৃতি (صورت مثالی ) এবং তা-ই কি নাফ্স্ ? কারণ , আমরা যে সব সৃষ্টিকে নিষ্প্রাণ মনে করি কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে সেগুলোরও প্রাণ আছে তা আমরা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি।]

অনুরূপভাবে , কোনো কোনো মতে , পার্থিব জগতে মানুষ যে সব ভালো-মন্দ চিন্তা-পরিকল্পনা ও কাজকর্ম করে এবং যে সব ভালো-মন্দ কথা বলে তা অবস্তুগত মূর্ত রূপ (صورت مثالی ) ধারণ করে আালামে মিছালে এবং বস্তুগত বা উচ্চতর রূপ (صورت اعلی ) নিয়ে আালামে আখেরাতে মওজূদ হতে থাকে। যেমন : অনেক ভালো চিন্তা-পরিকল্পনা , কথা ও কাজ তার জন্য প্রাসাদ , স্নিগ্ধ হাওয়া , সুপেয় পানি , সুস্বাদু খাবার , ফলবান বৃক্ষ , ফুলের গাছ , পাখীর সুর ইত্যাদিতে পরিণত হয় এবং তার বস্তুগত মূর্ত রূপ আালামে আখেরাতে ও অবস্তুগত মূর্ত রূপ আালামে মিছালে বা আালামে বারযাখে স্থানলাভ করে। তেমনি তার অনেক মন্দ চিন্তা-পরিকল্পনা , কথা ও কাজ আগুন , কঠিন শৈত্য , সাপ-বিচ্ছু , নোংরা ও অপবিত্র বস্তু ইত্যাদিতে পরিণত হয় এবং তার বস্তুগত মূর্ত রূপ আালামে আখেরাতে ও অবস্তুগত মূর্ত রূপ আালামে মিছালে বা আালামে বারযাখে স্থানলাভ করে। তেমনি অন্য লোকেরা তার জন্য ভালো বা মন্দ যে সব চিন্তা বা পরিকল্পনা করে তা-ও প্রতীকীভাবে বস্তুগত ও অবস্তুগত মূর্ত রূপ ধারণ করে যথাক্রমে আালামে আখেরাতে ও আালামে বারযাখে বা আালামে মিছালে স্থিতিলাভ করে।

এ কারণেই ব্যক্তি স্বপ্নে যে সব সুখকর অভিজ্ঞতা লাভ করে তা প্রধানতঃ তার নিজের সুকর্ম ও সুচিন্তা-পরিকল্পনার অথবা অন্যরা তার জন্য যে সুচিন্তা-পরিকল্পনা করে তার অবস্তুগত মূর্ত রূপ। অন্যদিকে সে স্বপ্নে যে সব অসুখকর বা কষ্টকর অভিজ্ঞতা লাভ করে তা প্রধানতঃ তার নিজের মন্দ কর্ম ও মন্দ চিন্তা-পরিকল্পনার অথবা অন্যরা তার জন্য যে মন্দ ও ক্ষতিকর চিন্তা-পরিকল্পনা করে তার অবস্তুগত মূর্ত রূপ। (এখানে প্রধানতঃ ’ বলার কারণ এই যে , ক্ষেত্রবিশেষে এর বাইরে স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার ইচ্ছার অবস্তুগত মূর্ত রূপও অন্তর্ভুক্ত থাকে।)

স্বপ্নলোকে সুখ-শান্তি , ভোগ-আনন্দ ও দুঃখ-কষ্ট একটি বিতর্কাতীত ব্যাপার। এ সময় মানুষের বস্তুদেহের পঞ্চেন্দ্রিয় নিষ্ক্রিয় থাকলেও সে পুরোপুরি পঞ্চেন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতার অধিকারী হয়। বস্তুতঃ স্বপ্নলোকে সুখ-দুঃখের অনুভূতি এবং জাগ্রত অবস্থার সুখ-দুঃখের অনুভূতিতে কোনোই পার্থক্য নেই। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে স্বপ্নে সুখ-দুঃখের অনুভূতি এমনই তীব্র হতে পারে যে , এর ফলে ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে পারে এবং এ ধরনের ঘটনা একান্ত বিরল হলেও ঘটতে দেখা যায়। এমতাবস্থায় মৃত ব্যক্তিদের নাফসকে অনুরূপ বা মাত্রাগতভাবে তার চেয়েও তীব্রতর অনুভূতি প্রদান করে পুরষ্কার ও শাস্তি আস্বাদন করানোর বিষয়টি কেবল কোরআন মজীদের আয়াতের আলোকেই নয় , বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতেও অনস্বীকার্য।

সুতরাং আালামে বারযাখে নে ‘ আমত্ ও শাস্তি যাকে যা-ই ভোগ করানো হোক না কেন , তা প্রকৃতই ভোগ বৈ নয়। তবে তাতে বস্তু থাকে না , কিন্তু বস্তুমধ্যস্থ প্রকৃত ভোগোপকরণ সমূহের (ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ক্ষেত্রেই) সবই থাকে। অর্থাৎ তাতে বর্ণ , গন্ধ , স্বাদ , শ্রবণ , দর্শন ও স্পর্শ সবই থাকে। তবে আালামে বারযাখে খাদ্যদ্রব্যজাত পুষ্টি ও শক্তি নাফ্স্ বা জিসমে মিছালীর জন্য অপরিহার্য বলে মনে হয় না।

অবশ্য বস্তুবিহীন নিরঙ্কুশ স্বাদ এবং তা-ও নে ‘ আমত্ সমূহের আকার-আকৃতি সহ সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে একটি দুর্বল উপমা (مثال ناقص ) থেকে বিষয়টি বুঝতে পারা সহজ হতে পারে। তা হচ্ছে , আমরা বিভিন্ন ধরনের রঙ্গিন বস্তু দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু এর বাইরেও শুধু রং পাওয়া যায় - যা অন্য বস্তুকে আশ্রয়কৃত রং নয় , বরং শুধুই রং।

বারযাখী জীবনের স্বরূপ

আসলে মৃত্যুপরবর্তী আালামে বারযাখের প্রকৃত অবস্থা কেমন ? এ প্রশ্নের জবাব জানার আগ্রহ সকলেরই। কিন্তু এ প্রশ্নের নিশ্চিত জবাব প্রদান করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কারণ , এ জগতের নিশ্চিত অভিজ্ঞতা সহকারে কোনো ব্যক্তিই ফিরে আসে না এবং তার বর্ণনা দেয় না। এমনকি আল্লাহ্ তা আলা কোনো কারণে যদি কাউকে পুনরায় পার্থিব জীবনে ফিরিয়ে দেন - ঠিক যেভাবে হযরত উযাইর্ ( আঃ)কে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন - তো সে ক্ষেত্রেও তার পক্ষে আালামে বারযাখের অবস্থা বর্ণনা করা সম্ভব হবে না।

যেহেতু আল্লাহ্ তা আলা চান যে , মানুষ আখেরাত্ ও আালামে বারযাখের ব্যাপারে কোনোরূপ ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতা অর্জন ছাড়াই কেবল বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্)-এর সাহায্যে পর্যালোচনা করে সত্যে উপনীত হয়ে ঈমান পোষণ করুক , সেহেতু এটাই স্বাভাবিক যে , কাউকে মৃত্যুর পরে পুনরায় পার্থিব জীবনে ফিরিয়ে দিলে তার আালামে বারযাখের স্মৃতিগুলোকে অবচেতনে পাঠিয়ে দেয়া হবে - যার ফলে ব্যক্তির মনেই হবে না যে , সে মারা গিয়েছিলো , বরং মনে হবে যে , সে ঘুমিয়ে ছিলো বা সংজ্ঞাহারা হয়ে ছিলো। এ কারণেই উযাইর্ ( আঃ)কে আল্লাহ্ তা আলার প্রশ্ন ও তাঁর জবাব থেকে সুস্পষ্ট যে , উযাইর্ ( আঃ) বুঝতেই পারেন নি যে , তিনি মারা গিয়েছিলেন।

আল্লাহ্ তা আলা হযরত উযাইর্ ( আঃ)কে যে প্রশ্ন করেন তাতে সরাসরি তাঁর মৃত অবস্থার কথা উল্লেখ করেন নি , বরং জিজ্ঞেস করেন :كَمْ لَبِثْتَ - কতোদিন (এভাবে/ মৃত) ছিলে ? জবাবে উযাইর্ ( আঃ) বলেন :لَبِثْتُ يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ - একদিন বা একদিনের অংশবিশেষ (এভাবে/ ঘুমিয়ে) ছিলাম। ” আর তাই আল্লাহ্ তা আলা তাঁর গাধাটির জরাজীর্ণ অস্থিসমূহ দেখিয়ে তাঁকে বুঝিয়ে দেন যে , তিনি অনেক দিন (একশ ’ বছর) মৃত অবস্থায় ছিলেন। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ২৫৯)

যা-ই হোক , যেহেতু আালামে বারযাখ্ নাফসের জগত বা সূক্ষ্ম শরীর সহ নাফসের জগত সেহেতু অনেকে মনে করেন যে , এ জগতের রূপ খুবই হাল্কা দৃশ্য সম্বলিত অর্থাৎ প্রায় অদৃশ্য।

কিন্তু এ মত সঠিক বলে মনে হয় না। কারণ , স্বপ্নে আমরা যা কিছু দেখি তা প্রায় অদৃশ্য ’ নয় , বরং সুস্পষ্ট। আর ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , স্বপ্নলোক আালামে বারযাখেরই একটি অংশ , সুতরাং স্বপ্নলোকের দৃশ্যাবলী যেহেতু সুস্পষ্ট সেহেতু আালামে বারযাখের দৃশ্যাবলীও অবশ্যই সুস্পষ্ট। তবে আমরা যেহেতু আালামে বারযাখের অবস্থা অবলোকন করার মতো যোগ্যতা ও অনুমতির অধিকারী নেই সেহেতু সে জগত আমাদের কাছে অদৃশ্য , কিন্তু যারা তা অবলোকন করার মতো যোগ্যতা ও অনুমতির অধিকারী তাঁদের কাছে তা অদৃশ্য নয়।

অনেক ইসলামী মনীষী আালামে বারযাখকে আয়নায় পতিত দৃশ্যের সাথে তুলনা করেছেন - যাতে সুস্পষ্টতার কোনোই কমতি নেই , কিন্তু তাতে বস্তু নেই ; বস্তু ছাড়া সব কিছুই আছে। এ তুলনাটি সঠিক বলে মনে হয়।

অনেক ইসলামী মনীষীর মতে , সুস্পষ্টতার বিচারে আালামে বারযাখ্ পার্থিব জীবনের চেয়ে উন্নততর। তাঁদের মতে , আালামে বারযাখের তুলনায় পার্থিব জগত হচ্ছে নিদ্রাতুল্য। কারণ , পার্থিব জীবনে মানুষের জ্ঞানচক্ষুর কার্যক্ষমতা বিভিন্ন কারণে সীমিত হয়ে পড়ে , কিন্তু আালামে বারযাখে এ ধরনের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। পার্থিব জীবনে নিদ্রা , তন্দ্রা , ক্লান্তি ও বিস্মৃতি আছে , কিন্তু আালামে বারযাখে তা নেই। তাছাড়া মানুষ পার্থিব জীবনে আালামে বারযাখের জ্ঞান রাখে না , কিন্তু আালামে বারযাখের জীবনে মানুষ স্বীয় অতীত জীবন , বর্তমান আালামে বারযাখ্ ও বর্তমান বস্তুজগত সম্বন্ধে অবগত থাকে। (অবশ্য ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , আালামে বারযাখের অধিবাসীরা স্বীয় অতীত ব্যতীত পার্থিব জীবন সম্পর্কে কতোখানি জ্ঞানের অধিকারী হতে পারে তা নির্ভর করে তাদেরকে প্রদত্ত সুযোগ বা অনুমতির ওপর।)

বস্তুতঃ একজন নিদ্রিত ব্যক্তি ও একজন জাগ্রত ব্যক্তির মধ্যে একটা বড় ধরনের পার্থক্য এই যে , জাগ্রত ব্যক্তি তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্বন্ধে জানতে পারে , কিন্তু নিদ্রিত ব্যক্তি তা পারে না। তাই আালামে বারযাখের জীবনে যেহেতু পার্থিব জীবনের তুলনায় জ্ঞানের পরিধি বেশী থাকে সেহেতু পারস্পরিক তুলনায় পার্থিব জগতের মোকাবিলায় আালামে বারযাখের জীবনকে ঘুমন্ত ব্যক্তির তুলনায় জাগ্রত ব্যক্তির অবস্থার সাথে তুলনা করা যেতে পারে।

অনুরূপভাবে পুনরুত্থানপরবর্তী জীবনে মানুষের জ্ঞানচক্ষু পুরোপুরি উন্মীলিত হয়ে যাবে। তখন কারো কাছে অজানা বলে কিছু থাকবে না। অর্থাৎ আালামে বারযাখের তুলনায় সে জীবনে জ্ঞানের পরিধি হবে আরো বেশী। এ কারণে হাশরের জীবন হবে পূর্ণ জাগ্রত জীবন এবং সে তুলনায় আালামে বারযাখের জীবন হচ্ছে নিদ্রিত অবস্থা। ফলে মৃত্যুর পরে ব্যক্তির এরূপ মনে হওয়া স্বাভাবিক যে , সে পার্থিব জীবনে আসলে ঘুমিয়ে ছিলো এবং মৃত্যুর মাধ্যমে সে নিদ্রিত অবস্থা থেকে জেগে উঠেছে। তেমনি পুনরুত্থানের পর তার মনে হবে যে , সে আালামে বারযাখে নিদ্রিত ছিলো ; পুনরুত্থানের মাধ্যমে সে নিদ্রা থেকে জেগে উঠেছে।

এ তুলনাটি আরেকভাবেও করা হয়েছে। আালামে বারযাখের জীবনের তুলনায় পার্থিব জীবন মৃত অবস্থার সমতুল্য। অর্থাৎ আালামে বারযাখের জীবনে ব্যক্তির মনে হয় যে , পার্থিব জীবনে আসলে সে মৃত ছিলো এবং পার্থিব পরিভাষায় যাকে মৃত্যু বলা হয় তার মাধ্যমে সে কার্যতঃ জীবন লাভ করেছে। আর পুনরুত্থানের পর আালামে বারযাখের জীবন সম্পর্কেও তার অনুরূপ অনুভূতি হবে।

যারা তিন জীবনের (পার্থিব , বারযাখী ও আখেরাতের) মধ্যে এভাবে তুলনা করেছেন তাঁদের মতে , কোরআন মজীদের কোনো কোনো আয়াত্ থেকে তাঁদের এ মতের প্রতি পরোক্ষ সমর্থন পাওয়া যায়।

বিশেষ করে আখেরাতের জীবন যে পার্থিব জীবনের তুলনায় সীমাহীনভাবে ব্যাপকতর ও গভীরতর এবং স্থায়ী জীবন কোরআন মজীদে তা সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

) وَمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلا لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ(

“ আর এই পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক বৈ নয়: নিঃসন্দেহে পরকালের আবাসস্থল হচ্ছে প্রাণশীল ; যদি তারা জানতো! (সূরাহ্ আল্- আনকাবূত্ : ৬৪)

ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , পার্থিব জীবনে আমরা আমাদের আবাসস্থলে ও বস্তুগত উপায়-উপকরণে প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করি না , কিন্তু আখেরাতের জীবনে অজ্ঞতার পর্দা ছিন্ন হয়ে যাবে , তখন আমরা সব কিছুতেই প্রাণের অস্তিত্ব দেখতে পাবো। অতএব , দেখা যাচ্ছে যে , আখেরাতের জীবন্ত জগতের তুলনায় এ পার্থিব জগত একটি মৃতপুরীর সমতুল্য বৈ নয়।

তাঁদের মতে , অন্য এক আয়াত থেকে তিনটি জীবনের অস্তিত্বের ধারণার প্রতি সমর্থন মিলে। এরশাদ হয়েছে :

) قَالُوا رَبَّنَا أَمَتَّنَا اثْنَتَيْنِ وَأَحْيَيْتَنَا اثْنَتَيْنِ فَاعْتَرَفْنَا بِذُنُوبِنَا فَهَلْ إِلَى خُرُوجٍ مِنْ سَبِيلٍ(

“ (শেষ বিচারের দিনে) তারা (কাফেররা) বলবে : হে আমাদের রব! আপনি আমাদেরকে দুই বার মৃত্যু দিয়েছেন এবং দুই বার জীবিত করেছেন। এমতাবস্থায় আমরা আমাদের গুনাহ্ সমূহ স্বীকার করছি ; অতঃপর (আমাদের জন্য) নিষ্ক্রান্তির কোনো পথ আছে কি ? (সূরাহ্ আল্-গ্বাফির্/ আল্-মু ’ মিন্ : ১১)

তাঁদের মতে , এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে , এখানে দুই বার মৃত্যু বলতে পার্থিব জীবনের মৃত্যু তথা আালামে বারযাখে স্থানান্তর এবং আালামে বারযাখের জীবনের মৃত্যু তথা আখেরাতে প্রবেশ বুঝানো হয়েছে , তেমনি মৃত্যুর পরে জীবিতকরণ বলতে যথাক্রমে পার্থিব জীবনের মৃত্যুর পরে আালামে বারযাখের জীবন দান এবং আালামে বারযাখের জীবনের অবসান ঘটিয়ে আখেরাতে নতুন জীবন দান বুঝানো হয়েছে।

তবে অনেকের মতে , আত্মিক দৃষ্টিতে তথা জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের দৃষ্টিতে , প্রথম বার মৃত্যুদান বলতে জ্ঞানবিহীন অবস্থায় পার্থিব জীবনে প্রেরণ ও প্রথম বার জীবিতকরণ বলতে পার্থিব দেহের মৃত্যুর মাধ্যমে আালামে বারযাখের জীবন প্রদান এবং দ্বিতীয় বার মৃত্যু বলতে আালামে বারযাখের জীবন প্রদান ও দ্বিতীয় বার জীবিতকরণ বলতে আখেরাতে পুনর্জীবিতকরণ বুঝানো হয়েছে।

এ দু টি মত অনুযায়ী , এখানে দুই বার মত্যুর কথা উল্লেখ থেকে আরো একটি সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে , তা হচ্ছে , ক্বিয়ামত বা মহাপ্রলয়ের সময় প্রথমে পার্থিব জগতকে ধ্বংস করে দেয়া হবে এবং এরপর আালামে বারযাখ্ সহ নাফসের জগতসমূহকেও ধ্বংস করে দেয়া হবে। তখন মিছালী দেহ সহ নাফ্স্ (ব্যক্তিসত্তা) সমূহও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কারণ , কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) لا إِلَهَ إِلا هُوَ كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلا وَجْهَهُ(

“ তিনি ব্যতীত আর কোনো ইলাহ্ নেই ; তাঁর সত্তা ব্যতীত সব কিছুই ধ্বংসশীল। ” (সূরাহ্ আল্-ক্বাছ্বাছ্ব্ : ৮৮)

তাঁরা মনে করেন যে , ফেরেশতাদেরও মৃত্যু হবে। এমনকি এরূপ বর্ণনাও রয়েছে যে , সবশেষে আযরা ‘ ঈল্ ( আঃ) তাঁর নিজের জান ক্ববয্ করবেন। এর মানে হচ্ছে , ফেরেশতাদেরও মৃত্যু হবে। আর যেহেতু আালামে বারযাখের নিয়ন্ত্রণ , ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন সন্দেহাতীতভাবেই ফেরেশতাদের হাতে সেহেতু ফেরেশতাদের অবর্তমানে আালামে বারযাখের অস্তিত্ব টিকে থাকা বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে অসম্ভব বলে মনে হয়। অতএব , এমতাবস্থায় আালামে বারযাখের ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া অনিবার্য। অর্থাৎ এ ঘটনা হবে আালামে বারযাখে অবস্থানরত নাফ্স্ বা ব্যক্তিসত্তাদের জন্য পরিপূর্ণ মৃত্যু। অতঃপর একমাত্র মহান আল্লাহ্ রাব্বুল্ আালামীনের সত্তা ছাড়া আর কিছুই ও কেউই থাকবে না।

অবশ্য অনেকে মনে করেন যে , ইতিপূর্বেকার আয়াতে উল্লিখিত দুই বার মৃত্যু ও দুই বার জীবন প্রসঙ্গটি সর্বজনীন নয় , বরং এটা হচ্ছে সেই সীমিত সংখ্যক কাফেরদের কথা যাদের পার্থিব জীবনের মৃত্যুর পর হযরত ইমাম মাহ্দী ( আঃ) আত্মপ্রকাশের পর তাদেরকে জীবিত করবেন ও শাস্তি প্রদান করবেন। সুতরাং ক্বিয়ামতের ধ্বংসের বিষয়টি পার্থিব জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট , আালামে বারযাখ্ বা আালামে মিছালের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এবং ফেরেশেতাদেরও মৃত্যু হবে না।

তাঁদের মতে , ওপরের আয়াতেشَيْء -এর ধ্বংসশীলতার কথা বলা হয়েছে , আরشَيْء বলতে বস্তুগত অস্তিত্বকে বুঝানো হয় , সুতরাং ফেরেশতামণ্ডলী ও আালামে বারযাখ্ ধ্বংস হওয়ার কথা বুঝানো হয় নি। অন্য মত অনুযায়ী , যেহেতু আল্লাহর সত্তা ব্যতীত সব কিছুই ধ্বংসশীল , সেহেতু ফেরেশতারা ও ‘ আালামে বারযাখ্ও ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু প্রথমোক্ত মত অনুযায়ী , এখানে কা ’ রা ধ্বংস হবে তা-ই বুঝানো উদ্দেশ্য এবং আল্লাহ্ যে অবিনশ্বর তা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে ; এর বাইরে আর কী কী ধ্বংস হবে না তা উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে বিবেচিত হয় নি ; আর আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী এ ধরনের প্রকাশের সুযোগ রয়েছে। তাই ফেরেশতা , আালামে বারযাখ্ ও আরো যতো অবস্তুগত সৃষ্টি আছে তার কথা উহ্য রাখা হয়েছে।

এছাড়া লোকদেরকে তাদের ক্ববর থেকে হাশরের মাঠে উত্থিত করা হবে। এরশাদ হয়েছে :

) وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَإِذَا هُمْ مِنَ الأجْدَاثِ إِلَى رَبِّهِمْ يَنْسِلُونَ. قَالُوا يَا وَيْلَنَا مَنْ بَعَثَنَا مِنْ مَرْقَدِنَا(

“ আর শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে এবং তখন তারা তাদের ক্ববরসমূহ থেকে তাদের রবের পানে ছুটে আসবে। তখন তারা বলবে : হায় দুর্ভাগ্য আমাদের! কে আমাদেরকে আমাদের নিদ্রাস্থল থেকে উত্থিত করলো! (সূরাহ্ ইয়া-সীন্ : ৫১-৫২)

বলা বাহুল্য যে , কোরআন মজীদে ক্ববর বলতে মাটির ক্ববরকে বুঝানো হয় নি , কারণ , সকলের মাটির ক্ববর হয় না। তাছাড়া এ পৃথিবী যখন ধ্বংস হয়ে যাবে তখন মাটির ক্ববর সমূহের আর কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট থাকবে না। অতএব , এখানে ক্ববর থেকে রবের পানে ছুটে যাওয়া বলতে সরাসরি আালামে বারযাখ্ থেকে নবসৃষ্ট পৃথিবীর বুকে উত্থিত হওয়াকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং কাফেররা যে দুই বার মৃত্যু ও দুই বার জীবন দানের কথা বলবে তা কেবল সেই কাফেরদের সাথে সংশ্লিষ্ট ও তাদের কথা হবার সম্ভাবনাই বেশী যাদেরকে হযরত ইমাম মাহ্দী ( আঃ) জীবিত করে শাস্তি প্রদান করবেন।

আরো একটি কারণে এ মতটিই সঠিক বলে মনে হয়। তা হচ্ছে , ক্বিয়ামত সংঘটিত হলে তখন বস্তুজগত ধ্বংস হয়ে যাবে এবং সেই সাথে মানুষ সহ এর ওপরকার সকল প্রাণী নিহত হবে। একই সাথে যদি আালামে বারযাখ্ ধ্বংস হয়ে যায় এবং ফেরেশতারাও মৃত্যুবরণ করে তাহলে বস্তুজগত ধ্বংসের সময় যারা মারা যাবে তাদের বারযাখী জীবন হবে না এবং সে জীবনের শাস্তি ও পুরষ্কারও তারা পাবে না এবং ক্ববর অর্থাৎ আালামে বারযাখ্ থেকে হাশরের মাঠে উত্থিত হওয়ার বিষয়টিও তাদের বেলা কার্যকর হবে না। কিন্তু কোরআন মজীদে সকলেরই ক্ববর থেকে হাশরের মাঠে উঠে আসার কথা বলা হয়েছে ; এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রমের কথা বলা হয় নি। এ থেকেও উপসংহারে আসতে হয় যে , ক্বিয়ামতে কেবল বস্তুজগত ধ্বংস হবে ও তার প্রাণীকুল নিহত হবে ; আালামে বারযাখ্ ধ্বংস হবে না এবং ফেরেশতা সহ আল্লাহ্ তা আলার অবস্তুগত সৃষ্টিসমূহ মৃত্যুবরণ করবে না।

‘ আালামে বারযাখকে আালামে মিছাল্ বা সদৃশ জগত কেন বলা হয় - এ সম্পর্কে অনেক ইসলামী মনীষীর মত হচ্ছে এই যে , আালামে বারযাখের একই সাথে পার্থিব জগত ও আখেরাতের জগতের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে বলেই একে আালামে মিছাল্ বলেও অভিহিত করা হয়।

বস্তুতঃ আখেরাতের জগত বহুলাংশেই পার্থিব জীবনের অনুরূপ। আখেরাতের জীবন হবে দেহ ও নাফসের সমন্বিত জীবন ; ঠিক পৃথিবীর জীবনের মতোই। তবে আখেরাতের জীবন হবে চিরস্থায়ী এবং তা হবে পার্থিব জীবনের ভালো-মন্দ কর্মের ফলাফল লাভের জীবন। তাছাড়া সেখানে কোনো সত্য গোপন থাকবে না এবং সেখানে নৈতিক ফলাফলের পরিপূর্ণ প্রতিফলনের পথে সামান্যতম বাধাও থাকবে না। কিন্তু গঠনপ্রকৃতির দিক থেকে আখেরাতের জগত পার্থিব জগতের অনুরূপ হবে।

অন্যদিকে আালামে বারযাখ্ একটি পুরোপুরি ভিন্ন মাত্রার জগত অর্থাৎ অবস্তুগত জগত। কিন্তু সেখানকার সব কিছু আকার-আকৃতির দিক থেকে পার্থিব জগত ও আখেরাতের জগতের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ জগত , তবে তা অবস্তুগত। সুখ-দুঃখ ও উপায়-উপকরণের দিক থেকেও সে জগত পার্থিব জগত ও আখেরাতের জগতের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ , যদিও বস্তুগত নয়। এছাড়া আালামে বারযাখে নৈতিক বিধানের ফলাফল থেকে বেঁচে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই , ঠিক আখেরাতের জগতের ন্যায়ই। তেমনি পার্থিব জগতে যে জ্ঞানগত সীমাবদ্ধতা আছে আালামে বারযাখে তা ঘুচে যাবে এবং এদিক থেকে তার আখেরাতের জীবনের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে , যদিও আখেরাতের জীবনের ন্যায় তা পরিপূর্ণ জ্ঞানের জগত নয়। তাছাড়া আখেরাতের জীবনে যেমন পার্থিব জীবনের আমল অনুযায়ী বিভিন্ন স্তরের বেহেশত ও দোযখ রয়েছে তেমনি আালামে বারযাখের জীবনেও বিভিন্ন ধরনের মানুষের জন্য বিভিন্ন স্তরের পুরষ্কার ও শাস্তি তথা বিভিন্ন স্তরের বারযাখী বেহেশত ও দোযখ রয়েছে।

এ সকল দিক বিবেচনা করেই আালামে বারযাখকে আালামে মিছাল্ বলেও অভিহিত করা হয়েছে।

বিভিন্ন সূত্রের বর্ণনা অনুযায়ী , আালামে বারযাখের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , মানুষের পার্থিব জীবনের ভালো-মন্দ গুণ-বৈশিষ্ট্য ও আমল সমূহ বিভিন্ন ধরনের রূপক মূর্ত রূপ ধারণ করে আালামে বারযাখে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাফসের সঙ্গীরূপে তার সাথে অবস্থান করে তার সুখ-দুঃখের কারণ হবে। যেমন : দুনিয়ার বুকে যার স্বভাব ছিলো নিষ্ঠুর , কুটিল ও হিংস্র সাপের স্বভাব তার এ স্বভাব বিষধর সাপরূপে আালামে বারযাখে তার সাথী হবে এবং তাকে দংশন করতে থাকবে। বলা বাহুল্য যে , সে সাপ বস্তুগত দেহের অধিকারী হবে না , বরং ঐ ব্যক্তির নাফসের ন্যায়ই অবস্তুগত দেহের অধিকারী হবে। অন্যদিকে , বিভিন্ন সূত্রের হাদীছ অনুযায়ী , দুনিয়ার জীবনে যারা নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত্ করেন , কোরআনকে ভালোবাসেন , কোরআনের হুকুম পালন করে চলেন ও কোরআনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চেষ্টা-সাধনা করেন আালামে বারযাখে কোরআন অবস্তুগত মূর্ত রূপ ধারণ করে , কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী , একজন সুদর্শন যুবক রূপে , অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে তাঁকে সাহচর্য দেবে এবং তাঁর বারযাখী জীবনকে আনন্দঘন করে রাখবে - যাতে তিনি একাকিত্ব বোধ না করেন। (অবশ্য বস্তুবাদীরা এর সম্ভাব্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে , কিন্তু আল্লাহ্ তা আলা চাইলে তাঁর পক্ষে এটা করা খুবই সহজসাধ্য ব্যাপার।)

এছাড়া বারযাখী জীবনে নাফ্স্ তার পার্থিব জীবনের ভালো-মন্দ কর্মের স্মৃতিসমূহ থেকে সুখ-দুঃখ বোধ করে। অবশ্য পার্থিব জীবনেও মানুষ এভাবে অতীত স্মৃতির স্মরণে প্রীত বা ক্লেশ বোধ করে। তবে পার্থিব জীবনে মানুষ তার অনেক স্মৃতি একেবারেই ভুলে যায় ; আদৌ মনে করতে পারে না এবং অন্যান্য স্মৃতি সময়ের ব্যবধানে ক্রমেই ফিকে হয়ে আসে , ফলে তার সুখকর ও কষ্টকর প্রতিক্রিয়াও ক্রমেই দুর্বল হয়ে আসে। কিন্তু আালামে বারযাখে তার সমস্ত স্মৃতিই চলমান ঘটনাবলীর ন্যায় সুস্পষ্টরূপে তার স্মরণ হবে। ফলে তার সুখকর ও কষ্টকর প্রতিক্রিয়াও পার্থিব জীবনে অতীত স্মৃতিচারণের তুলনায় অনেক বেশী হবে , বরং ঐ সব ঘটনা সংঘটিত হবার সময়কার অনুভূতির ন্যায় তীব্র অনুভূতি হবে। তবে ব্যক্তি পার্থিব জীবনে যে সব পাপকর্মের মধ্যে সুখ ও আনন্দ লাভ করেছিলো সেগুলোর প্রতিক্রিয়ায় যেহেতু বারযাখী জীবনে তার জন্য বহু শাস্তির উপকরণ তৈরী হয়ে গিয়েছে সেহেতু সে ঐ সব স্মৃতি থেকে চরম আত্মপীড়ন অনুভব করবে ও সে জন্য আফসোস্ করবে। অন্যদিকে পার্থিব জীবনে সে সত্য ও ন্যায়ের পথে যে সব কষ্ট ও যুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছে সেগুলোর প্রতিক্রিয়ায় বারযাখী জীবনে তার জন্য বিভিন্ন নে ‘ আমত তৈরী হয়ে যাবার কারণে ঐ সব স্মৃতি থেকে সে অপার্থিব পরমানন্দ অনুভব করবে।

মানুষ যে তার পার্থিব জীবনের ভালো-মন্দ কর্মসমূহ ঘটমান অবস্থায় আখেরাতের জীবনে দেখতে পাবে কোরআন মজীদে তা সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

) يَوْمَئِذٍ يَصْدُرُ النَّاسُ أَشْتَاتًا لِيُرَوْا أَعْمَالَهُمْ. فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ. وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ(

“ সেদিন (শেষ বিচারের দিনে) লোকেরা দলে দলে বহির্গত হবে যাতে তাদেরকে তাদের আমল সমূহ দেখানো হয়। সুতরাং যে অণু পরিমাণ ভালো কাজ করবে তা সে দেখতে পাবে এবং যে অণু পরিমান মন্দ কাজ করবে সে তা দেখতে পাবে। ” (সূরাহ্ আয্-যিলযাল্ : ৬-৮)

এ থেকে মনে হয় যে , শেষ বিচারের মাঠে লোকেরা তাদের ভালো-মন্দ আমল সমূহ সবাক চলচ্চিত্রের ন্যায় দেখতে পাবে। আর এটা আজ অকাট্য বৈজ্ঞানিক সত্য যে , মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষেই তার সারা জীবনের , এমনকি তার পূর্বপুরুষদের ইতিহাস জেনেটিক কোড আকারে লিপিবদ্ধ আছে। অসম্ভব নয় যে , তা তার শরীরের অধিকতর ক্ষুদ্র অংশে অর্থাৎ প্রতিটি অণু-পরমাণুতে পর্যন্ত লিপিবদ্ধ রয়েছে , যদিও বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত তা চিহ্নিত করার ও তাকে সবাক চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে সক্ষম হন নি , কেবল বড় বড় বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন।

যা-ই হোক , তা শুধু কোষেই রেকর্ডকৃত থাক বা অণু-পরমাণুতেও লিপিবদ্ধ থাক , আল্লাহ্ তা আলা যেহেতু মানুষের আমলকে কোড আকারে রেকর্ড করার ব্যবস্থা করেছেন সেহেতু সে কোডকে সবাক চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করা তাঁর জন্য খুবই সহজসাধ্য। সম্ভবতঃ ফেরেশতাদের লিখিত আমলনামার সত্যায়নের লক্ষ্যে এ সবাক চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হবে। কারণ , নইলে নাস্তিক , কাফের ও পাপাচারী লোকেরা হয়তো ফেরেশতাদের ওপর মিথ্যা লেখার অভিযোগ উত্থাপন করতে পারে।

আর যেহেতু আালামে বারযাখ্ হচ্ছে আখেরাতের জীবনের প্রতিচ্ছবি সেহেতু এটাই স্বাভাবিক যে , সেখানেও লোকেরা তাদের সারা জীবনের কাজকর্ম সবাক চলচ্চিত্রের ন্যায় দেখতে পাবে। অবশ্য সেখানে যদি এভাবে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদর্শন করা না-ও হয় এবং নাফসগুলো কেবল তাদের অতীত জীবনকে স্মরণ করে , তো সে ক্ষেত্রে তাদের সে স্মৃতি হবে চলমান ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণের ন্যায় জ্বলজ্বলে এবং তার সুখকর ও কষ্টকর প্রতিক্রিয়া যে পার্থিব জীবনের অনুরূপ প্রতিক্রিয়ার তুলনায় অনেক বেশী তীব্র হবে তাতে সন্দেহ নেই।

কারবালায় ইমাম হোসেইন (আ.)-এর প্রবেশ

হুর বিন ইয়াযীদ ইমাম হোসেইন (আ.)-কে কুফায় যাওয়ার পথে বাধা দিলে তিনি থেমে যান। এরপর তার সন্তানদের , ভাইদের ও আত্মীয়দেরকে নিজের চারদিকে জড়ো করলেন এবং কিছু সময়ের জন্য কাঁদলেন ও বললেন , হে আল্লাহ , আমরা আপনার রাসূলের বংশধর। লোকজন আমাদেরকে আমাদের বাড়িঘর থেকে টেনে বের করেছে এবং আমাদেরকে তাড়া করেছে এবং আমাদেরকে আমাদের নানার জায়গা [মদীনা] থেকে চাপ প্রয়োগ করে বের করে দিয়েছে। বনি উমাইয়া আমাদের উপর অত্যাচার করেছে। হে আল্লাহ , আমাদের অধিকারকে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিন এবং এ অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।

এরপর তিনি সেখান থেকে অগ্রসর হলেন এবং 61 হিজরির 2রা মহররমের দিন বুধবার অথবা মঙ্গলবার কারবালায় প্রবেশ করলেন। এরপর তিনি তার সাথীদের দিকে ফিরে বললেন ,

লোকজন পৃথিবীর দাস এবং ধর্ম শুধু তাদের মুখের কথা এবং তারা এর যত্ন নিবে যতক্ষণ পর্যন্ততা তাদের জন্য আনন্দদায়ক এবং যখন পরীক্ষার উত্তপ্ত পাত্র এসে যায় তখন থাকে শুধু গুটি-কয়েক ধার্মিক ব্যক্তি।

এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন , এটি কি কারবালা ?

লোকজন উত্তর দিলো , হ্যাঁ। তিনি বললেন , এ জায়গা হলো দুঃখ ও মুসিবতের জায়গা এবং এ জায়গা আমাদের উটগুলোর বিশ্রামের স্থান , আমাদের থামার জায়গা , আমাদের শাহাদাতের জায়গা যেখানে আমাদের রক্ত ঝরানো হবে।

ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কাছে উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের চিঠি

ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া কর্তৃক নিয়োজিত কুফার গভর্নর ইমাম হোসেইন (আ.)-কে একটি চিঠি প্রদান করে যা নিম্নরূপ: আম্মা বা আদ , হে হোসেইন , আমাকে জানানো হয়েছে যে , তুমি কারবালায় থেমেছো। ইয়াযীদ আমাকে লিখেছে , আমি যেন বিছানায় মাথা না রাখি এবং সন্তুষ্ট না হই যতক্ষণ পর্যন্তনা আমি তোমাকে আল্লাহর কাছে পাঠাচ্ছি , অথবা তুমি আমার কাছে এবং ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ কর। সালাম।

যখন এ চিঠি ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কাছে পৌঁছলো , তিনি তা পড়লেন এবং তা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন , যে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি খোঁজে সে কখনোই সফলতা লাভ করে না। দূত তাকে চিঠির উত্তর দিতে বললে ইমাম বললেন , তার জন্য কোন উত্তর নেই , আছে গযব [আল্লাহর]।

আশুরার (দশ মহররম) রাতের ঘটনাবলী

[ ইরশাদ গ্রন্থে আছে ] ইমাম হোসেইন ( আ .) তার সাথীদের রাতের বেলা জড়ো করলেন , ইমাম আলী যায়নুল আবেদীন ( আ .) বলেন যে , আমি তাদের কছে গেলাম শোনার জন্য তারা কী বলেন এবং সে সময় আমি অসুস্থ ছিলাম। আমি শুনলাম ইমাম তার সাথীদের বলছেন ,

আমি আল্লাহর প্রশংসা করি সর্বোত্তম প্রশংসার মাধ্যমে এবং তাঁর প্রশংসা করি সমৃদ্ধির সময়ে এবং দুঃখ দুর্দশার মাঝেও। হে আল্লাহ , আমি আপনার প্রশংসা করি এ জন্য যে , আপনি আমাদের পরিবারে নবুয়াত দান করতে পছন্দ করেছেন। আপনি আমাদের কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন এবং ধর্মে আমাদেরকে বিজ্ঞজন করেছেন এবং আমাদেরকে দান করেছেন শ্রবণ শক্তি ও দূরদৃষ্টি এবং আলোকিত অন্তর। তাই আমাদেরকে আপনার কৃতজ্ঞ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন।

আম্মা বা আদ , আমি তোমাদের চেয়ে বিশস্ত এবং ধার্মিক কোন সাথীকে পাই নি , না আমি আমার পরিবারের চাইতে বেশী বিবেচক , স্নেহশীল , সহযোগিতাকারী ও সদয় কোন পরিবারকে দেখেছি। তাই আল্লাহ আমার পক্ষ থেকে তোমাদেরকে উত্তমভাবে পুরস্কৃত করুন এবং আমি মনে করি শত্রুরা একদিনও অপেক্ষা করবে না এবং আমি তোমাদের সবাইকে অনুমতি দিচ্ছি স্বাধীনভাবে চলে যাওয়ার জন্য এবং আমি তা তোমাদের জন্য বৈধ করছি। আমি তোমাদের উপর থেকে আনুগত্য ও শপথের দায়ভার তুলে নিচ্ছি ( যা তোমরা আমার হাতে হাত দিয়ে শপথ করেছিলে ) । রাতের অন্ধকার তোমাদের ঢেকে দিয়েছে , তাই নিজেদের মুক্ত করো ঘূর্ণিপাক থেকে অন্ধকারের ঢেউয়ের ভেতরে। আর তোমাদের প্রত্যেকে আমার পরিবারের একজনের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ো গ্রাম ও শহরগুলোতে , যতক্ষণ না আল্লাহ তোমাদের মুক্তি দান করেন। কারণ এ লোকগুলো শুধু আমাকে চায় এবং আমার গায়ে হাত দেয়ার পরে তারা আর কারো পেছনে ধাওয়া করবে না।

এ কথা শুনে তার ভাইয়েরা , সন্তানরা , ও ভাতিজারা এবং আব্দুল্লাহ বিন জাফরের সন্তানরা বললেন , আামরা তা কখনোই করবো না আপনার পরে বেঁচে থাকার জন্য। আল্লাহ যেন কখনো তা না করেন। হযরত আব্বাস বিন আলী ( আ .) সর্বপ্রথম এ ঘোষণা দিলেন এবং অন্যরা তাকে অনুসর ণ করলেন।

ইমাম তখন আক্বীল বিন আবি তালিবের সন্তানদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন , মুসলিমের আত্মত্যাগ তোমাদের জন্য যথেষ্ট হয়েছে , তাই আমি তোমাদের অনমতি দিচ্ছি চলে যাওয়ার জন্য। তারা বললেন , সুবহানাল্লাহ , লোকেরা কী বলবে ? তারা বলবে আমরা আমাদের প্রধানকে , অভিভাবককে এবং চাচাতো ভাইকে , যে শ্রেষ্ঠ চাচাতো ভাই , পরিত্যাগ করেছি এবং আমরা তার সাথে থেকে তীর ছুড়িনি , বর্শা দিয়ে আঘাত করি নি এবং তার সাথে থেকে তরবারি চালাই নি এবং তখন আমরা ( এ অভিযোগের মুখে ) বুঝতে পারবো না কী করবো ; আল্লাহর শপথ , আমরা তা কখনোই করবো না। প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের জীবন , সম্পদ ও পরিবার আপনার জন্য কোরবানী করবো। আমরা আপনার পাশে থেকে যুদ্ধ করবো এবং আপনার পাশে থেকে পরিণতিতে পৌঁছে যাবো। আপনার পরে জীবন কুৎসিত হয়ে যাক ( যদি বেঁচে থাকি ) ।

হোসেইন বিন হামদান হাযীনি তার বর্ণনা ধারা বজায় রেখে আবু হামযা সূমালি থেকে বর্ণনা করেন এবং সাইয়েদ বাহরানি বর্ণনার ক্রমধারা উল্লেখ না করেই তার কাছ থেকে নবণার্ করেছেন যে , তিনি বলেছেন: আমি ইমাম আলী আল-যায়নুল আবেদীনকে বলতে শুনেছি , শাহাদাতের আগের রাতে আমার বাবা তার পরিবার এবং সাথীদের জড়ো করলেন এবং বললেন , হে আমার পরিবারের সদস্যরা এবং আমার শিয়ারা [অনুসারীরা] , এ রাতকে ভেবে দেখো যা তোমাদের কাছে বহনকারী উট হয়ে এসেছে এবং নিজেদেরকে রক্ষা করো , কারণ লোকেরা আমাকে ছাড়া কাউকে চায় না। আমাকে হত্যা করার পর তারা তোমাদেরকে তাড়া করবে না। আল্লাহ তোমাদের উপর রহমত করুন। নিজেদেরকে রক্ষা করো। নিশ্চয়ই আমি আনুগত্য ও শপথের দায়ভার তুলে নিলাম যা তোমরা আমার হাতে করেছো। এ কথা শুনে তার ভাইয়েরা , আত্মীয়-স্বজন ও সাথীরা একত্রে বলে উঠলো , আল্লাহর শপথ হে আমাদের অভিভাবক , হে আবা আবদিল্লাহ , আমরা আপনার সাথে কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করবো না , তাতে লোকেরা বলতে পারে যে আমরা আমাদের ইমামকে , প্রধানকে এবং অভিভাবককে পরিত্যাগ করেছি এবং তাকে শহীদ করা হয়েছে। তখন আমরা আমাদের ও আল্লাহর মাঝে ওজর খুঁজবো। আমরা আপনাকে কখনোই পরিত্যাগ করবো না যতক্ষণ পর্যন্তনা আমরা আপনার জন্য কোরবান হই। ইমাম বললেন , নিশ্চয়ই আগামীকাল আমাকে হত্যা করা হবে এবং তোমাদের সবাইকে আমার সাথে হত্যা করা হবে এবং তোমাদের কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না। তারা বললেন , সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যে তিনি আমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন আপনাকে সাহায্য করার জন্য এবং আমাদেরকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন আপনার সাথে শহীদ হওয়ার জন্য। তাহলে কি আমরা পছন্দ করবো না যে আমরা আপনার সাথে উচ্চ মাক্বামে [বেহেশতে] থাকবো , হে রাসূলুল্লাহর সন্তান ? ইমাম বললেন , আল্লাহ তোমাদের উদারভাবে পুরস্কৃত করুন। এরপর তিনি তাদের জন্য দোআ করলেন।

তখন ক্বাসিম বিন হাসান (আ.) জিজ্ঞেস করলেন , আমি কি শহীদদের তালিকায় আছি ? তা শুনে ইমাম আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন এবং বললেন , হে আমার প্রিয় সন্তান , তুমি মৃত্যুকে কিভাবে দেখো ?

ক্বাসিম বললেন , মধুর চেয়ে মিষ্টি।

ইমাম বললেন , নিশ্চয়ই , আল্লাহর শপথ , তোমার চাচা তোমার জন্য কোরবান হোক , তুমি তাদের একজন যাদেরকে শহীদ করা হবে আমার সাথে কঠিন অবস্থার শিকার হওয়ার পর এবং আমার [শিশু] সন্তান আব্দুল্লাহকেও [আলী আসগার] শহীদ করা হবে।

আশুরার দিনে ইমাম হোসেইন ( আ .)- এর খোতবা

আশুরার দিনে ইমাম হোসেইন (আ.) একটি খোতবায় বলেন: আম্মা বা আদ , বিবেচনা করো আমার পরিবার সম্পর্কে এবং গভীরভাবে ভাবো আমি কে , এরপর নিজেরদের তিরস্কার করো। তোমরা কি মনে করো যে আমাকে হত্যা করা এবং আমার পবিত্রতা ও সম্মান লুট করা তোমাদের জন্য বৈধ ? আমি কি তোমাদের নবীর নাতি , তার ওয়াসী ও তার চাচাতো ভাইয়ের সন্তান নই , যিনি ছিলেন বিশ্বাস গ্রহণে সবার আগে এবং সাক্ষী ছিলেন সে সবকিছুর ওপরে যা মহানবী আল্লাহর কাছ থেকে এনেছেন ? শহীদদের সর্দার হামযা কি আমার পিতার চাচা ছিলেন না ? জাফর , যিনি বেহেশতে দুপাখা নিয়ে উড়েন , তিনি কি আমার চাচা নন ? নবীর হাদীস কি তোমাদের কাছে পৌঁছে নি যেখানে তিনি আমার সম্পর্কে ও আমার ভাই সম্পর্কে বলেছেন : আমরা দুজন জান্নাতের যুবকদের সর্দার ? তাই যদি আমি যা বলছি তার সাথে একমত হও , এবং নিশ্চয়ই আমি যা বলেছি তা সত্য ছাড়া কিছু নয় , তাহলে তা উত্তম , কারণ আল্লাহর শপথ , যে সময় থেকে আমি বুঝেছি আল্লাহ মিথ্যাবাদীদের অপছন্দ করেন তখন থেকে আমি কখনোই কোন মিথ্যা বলি নি। আর যদি তোমরা আমি যা বলছি তা বিশ্বাস না কর , তাহলে তোমাদের মাঝে নবীর জীবিত সাহাবীগণ আছে , তাদের কাছে যাও এবং তাদেরকে জিজ্ঞেস কর এবং তারা আমার বক্তব্যের সত্যতার সাক্ষ্য দিবে। জাবির বিন আব্দুল্লাহ আনসারি , আবু সাঈদ খুদরি , সাহল বিন সাদ সা য়েদি , যায়েদ বিন আরক্বাম এবং আনাস বিন মালিককে জিজ্ঞেস কর , তারা তোমাদের বলবে যে তারা আল্লাহর রাসূলের কাছ থেকে আমার ও আমার ভাই সম্পর্কে এ হাদীসটি শুনেছে। এটি কি তোমাদের জন্য আমার রক্ত ঝরানোর চাইতে যথেষ্ট নয় ?

তখন অভিশপ্ত শিমর বিন যিলজাওশান বললো , আমি আল্লাহর ইবাদত করি ঠোঁট দিয়ে এবং তুমি যা বলছো তা আমি বুঝি না। এ কথা শুনে হাবীব বিন মুযাহির [ইমামের সাথী] বললেন , আমি দেখছি তুমি আল্লাহর ইবাদত করো সত্তুর ধরনের সন্দেহ নিয়ে এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তুমি সত্য কথা বলেছো এবং তুমি বুঝতে পারো না ইমাম যা বলেন , কারণ আল্লাহ তোমার হৃদয়ের ওপরে একটি [মূর্খতার] মোহর মেরে দিয়েছেন।

ইমাম বললেন , যদি তোমরা এতে সন্দেহ পোষণ কর , তোমরা কি এতেও সন্দেহ কর যে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নাতি ? আল্লাহর শপথ , পূর্বে ও পশ্চিমে , আমি ছাড়া নবীর কোন নাতি নেই তোমাদের মধ্যে অথবা অন্যদের মধ্যে। দুর্ভোগ তোমাদের জন্য , আমি কি তোমাদের মধ্য থেকে কাউকে হত্যা করেছি যে তোমরা তার প্রতিশোধ নিতে চাও ? অথবা আমি কি কারো সম্পদ বেদখল করেছি , অথবা কাউকে আহত করেছি যার প্রতিশোধ তোমরা আমার ওপর নিতে চাও ?

যখন কেউ তাকে উত্তর দিলো না , তিনি উচ্চ কণ্ঠে বললেন , হে শাবাস বিন রাব ঈ , হে হাজ্জার বিন আবজার , হে ক্বায়েস বিন আল-আশআস , হে ইয়াযীদ বিন হুরেইস , তোমরা কি আমার কাছে চিঠি লিখোনি যে , ফল পেকেছে এবং আশপাশের ভূমিতে ফুল ফুটেছে এবং একটি বিশাল সেনাবাহিনীর কাছে আসুন , যা আপনার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে ?

তারা উত্তর দিলো যে তারা এ ধরনের কোন চিঠি লিখেনি। ইমাম বললেন , সুবহানাল্লাহ , আল্লাহর শপথ অবশ্যই তোমরা তা লিখেছিলে।

এরপর তিনি বললেন , হে জনতা , এখন যদি তোমরা আমার আগমনকে পছন্দ না কর , তাহলে আমাকে ছেড়ে দাও যেন আমি কোন আশ্রয়ের জায়গায় চলে যেতে পারি।

ক্বায়েস বিন আল-আশআস বললো , তুমি যা বলছো তা আমরা জানি না , আমার চাচাতো ভাইদের [বনি উমাইয়ার] কাছে আত্মসমর্পণ কর , তারা তোমার সাথে সেভাবে আচরণ করবে যেভাবে তুমি চাও। ইমাম বললেন , আল্লাহর শপথ , নিকৃষ্ট মানুষের মতো আমি তোমাদের হাতে হাত দিবোনা , না আমি পালিয়ে যাবো কোন দাসের মতো।

এরপর তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন , হে আল্লাহর দাসেরা ,

) و َإِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُمْ أَن تَرْجُمُونِ(

নিশ্চয়ই আমি আমার ও তোমাদের রবের কাছে আশ্রয় নিচ্ছি ,পাছে তোমরা আমাকে পাথর মারো [হত্যা করো]। [সূরা দুখান: 20]

) إ ِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُم مِّن كُلِّ مُتَكَبِّرٍ لَّا يُؤْمِنُ بِيَوْمِ الْحِسَابِ(

আমি আশ্রয় নিই আমার ও তোমাদের রবের কাছে , প্রত্যেক দাম্ভিক থেকে , যে হিসাব দিনে বিশ্বাস করে না। [সূরা মু মিন: 27]

ইমাম আরো অগ্রসর হলেন এবং তাদের সামনে দাঁড়ালেন এবং তাদের সারিগুলোর দিকে তাকালেন শান্তবৃষ্টির মতো। তিনি উমর বিন সা আদকে কুফার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন এবং বললেন , ধন্যবাদ আল্লাহর প্রাপ্য , যিনি এ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং একে মৃত্যু ও ক্ষয়ের বাড়ি বানিয়েছেন এবং যিনি এর মানুষদেরকে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তন করেন। সে ব্যক্তি ধোঁকা খেয়েছে যে এ পৃথিবীর প্রতারণার শিকার হয়েছে , কারণ যে এর ওপর নির্ভর করে সে তাকে হতাশ করে। যে এখানে আকাঙ্ক্ষা করে সে তাকে রিক্তহস্ত করে। আমি দেখতে পাচ্ছি তোমরা জড়ো হয়েছো এমন একটি কাজের জন্য যা তোমাদের ওপর আল্লাহর ক্রোধ আনবে। তিনি তোমাদের দিক থেকে তার চেহারা ঘুরিয়ে নিয়েছেন এবং তোমাদেরকে তার ক্রোধে ঢেকে দিয়েছেন এবং তোমাদের কাছ থেকে তার রহমত সরিয়ে নিয়েছেন। তাই আমাদের রব হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ , আর তোমরা হচ্ছো নিকৃষ্টতম দাস। তোমরা আল্লাহকে মেনে চলার অঙ্গীকার করেছো এবং তার রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-কে বিশ্বাস করেছো। এরপরও তোমরা তার পরিবারকে এবং বংশধরকে আক্রমণ করেছো এবং তাদেরকে হত্যা করতে চাও। [ইরশাদ] শয়তান তোমাদের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং তোমাদেরকে সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ভুলিয়ে দিয়েছে। দুর্ভোগ তোমাদের জন্য তোমাদের পথ ও লক্ষ্যের ওপর। নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয়ই আমরা তার কাছে ফেরত যাবো। এ এক জাতি যারা বিশ্বাস গ্রহণের পর কুফুরী গ্রহণ করেছে , তাই বিদায় হে অত্যাচারী জাতি।

তখন উমর বিন সা আদ বললো , তোমাদের জন্য আক্ষেপ , তাকে উত্তর দাও , কারণ সে আলীর সন্তান। সে যদি সারা দিন তোমাদের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকে তার বক্তব্য শেষ হবে না , না সে ক্লান্তহবে। তখন শিমর এগিয়ে এলো এবং বললো , হে হোসেইন , তুমি কী বলছো ব্যাখ্যা কর যেন আমরা বুঝতে পারি। ইমাম বললেন , আমার বক্তব্যের মূল কথা হলো যে আমি তোমাদের বলছি আল্লাহকে ভয় করার জন্য এবং আমাকে হত্যা করো না। কারণ আমাকে হত্যা ও আমার পবিত্রতা ধ্বংস করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। কারণ আমি তোমাদের নবী (সা.)-এর কন্যার সন্তান এবং আমার নানী খাদিজা ( আ .) তোমাদের নবীর স্ত্রী। তোমরা হয়তো আমার নানাকে বলতে শুনে থাকবে যে , হাসান এবং হোসেইন বেহেশতের যুবকদের সর্দার।

এরপর তারা ইমাম হোসেইন (আ.)-কে সবদিক থেকে ঘেরাও করে ফেললো। তিনি তাদের কাছে এগিয়ে গেলেন এবং তাদেরকে চুপ থাকার ইঙ্গিত করলেন , কিন্তু তারা তা শুনতে অস্বীকার করলো। তখন ইমাম বললেন , তোমাদের জন্য দুর্ভোগ , তোমাদের কী হয়েছে যে তোমরা চুপ করছো না এবং আমি যা বলছি তা শুনছো না ? আমি তোমাদেরকে ধার্মিকতার পথে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। যে আমাকে মান্য করবে সে প্রজ্ঞাবান হবে। আর যে আমাকে মান্য করবে না সে ধ্বংস হবে। তোমরা সবাই আমার অবাধ্য হচ্ছো এবং আমার কথায় কান দিচ্ছো না। এর কারণ হলো তোমরা তোমাদের পেট হারামে পূর্ণ করেছো এবং তোমাদের হৃদয়গুলোতে মোহর মারা হয়েছে। আক্ষেপ তোমাদের জন্য। তোমরা কি ন্যায়পরায়ণ নও এবং শুনতে অক্ষম ?

কুফাবাসীদের লক্ষ্য করে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর বক্তব্য

সাইয়্যেদ ইবনে তাউস বর্ণনা করেছেন যে , ইমাম হোসেইন (আ.) তার উটে চড়লেন [অন্যরা বলেন তার ঘোড়ায়] এবং তাদের ইশারা করলেন চুপ করার জন্য। এরপর তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ ও মর্যাদা বর্ণনা করলেন যা তার প্রাপ্য। তিনি অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় সালাম পাঠালেন ফেরেশতা , নবী ও রাসূলদের ওপর। তারপর বললেন , হে জনতা , তোমরা যেন ধ্বংস হও , দুর্দশাগ্রস্ত হও। তোমরা উৎসাহের সাথে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলে তোমাদের সাহায্য করার জন্য এবং আমরা তা করার জন্য দ্রুত অগ্রসর হয়েছি। কিন্তু তোমরা এখন সে তরবারিগুলো কোষমুক্ত করেছো যা আমরা তোমাদের দিয়েছি এবং তোমরা আমাদের জন্য আগুন জ্বালিয়েছো যা আমরা তোমাদের ও আমাদের শত্রুদের জন্য জ্বালিয়েছিলাম। তোমরা তোমাদের শত্রুদের পক্ষ নিয়েছো এবং তাদের সাথে থেকে তোমাদের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অগ্রসর হয়েছো , যদিও তারা তোমাদের সাথে ন্যায়পরায়ণ আচরণ করে নি , না তোমরা তাদের কাছ থেকে কোন দয়া ও সদয় আচরণ আশা কর। তোমাদের ওপর শত দুর্ভোগ আসুক। তোমরা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো যখন তরবারিগুলো এখনও তাদের খাপে রয়েছে , হৃদয়গুলো শান্তিতে আছে , মতামতগুলো যথাযথভাবে স্পষ্ট এবং ভুল থেকে মুক্ত। কিন্তু তোমরা পঙ্গপালের মতো , যারা যুদ্ধের দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়েছে এবং মথের [প্রজাপতি] মতো , একজনের ওপর আরেকজন যেমন পড়ে। তোমরা ধ্বংস হও , হে যারা দাসীদের প্রেমিক , যারা দলত্যাগ করেছো , যারা কোরআন পরিত্যাগ করেছো , যারা সঠিক বক্তব্যকে বদলে নিয়েছো , যারা খারাপের স্তম্ভ , হে যারা শয়তানদের দ্বারা উস্কানি পাচ্ছো এবং যারা আসমানী আদেশ ছিন্নকারী , তোমরা তাদের পক্ষ নিচ্ছো এবং আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো ? হ্যাঁ , নিশ্চয়ই প্রতারণা ও বিশ্বাস ভঙ্গ করা তোমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য , যা তোমাদের পিতৃপুরুষেরা প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তা থেকে শাখা বেরিয়েছে। তোমরা নোংরা এবং এর বিস্বাদ ফল যা এর বপনকারীর গলায় আটকে যায় এবং তা অত্যাচারীদের কাছে আনন্দের। সাবধান , এখন অবৈধ পিতার অবৈধ সন্তান [উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ] আমাকে তরবারি কোষমুক্ত করা ও অপমান সহ্য করার মাঝে স্থাপন করেছে এবং আমরা অপমান গ্রহণ করবো তা কখনোই হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার রাসূল এবং পবিত্র কোলগুলো যা আমাদের দুধ খাইয়েছে , যারা ভদ্র ও যারা অপমান ঘৃণা করে তারা এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে যে , আমরা ঘৃণ্য মানুষদের কাছে মাথা নোয়াবো এবং তারা আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন এ বিষয়ে যুদ্ধের ময়দানে পৌরুষের সাথে নিহত হতে। জেনে রাখো , আমি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো যদিও আমার সাথে রয়েছে অল্প কয়েকজন মানুষ এবং যদিও কিছু ব্যক্তি আমাকে পরিত্যাগ করে চলে গেছে।

নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর ওপর নির্ভর করি , আমার রব এবং তোমাদের রব , কোন জীবিত প্রাণী নেই , যার কপালের চুল তার হাতে নেই। নিশ্চয়ই আমার রব সঠিক পথের ওপরে আছেন। [সূরা হুদ: 56]

হে আল্লাহ , তাদের কাছ থেকে আকাশের বৃষ্টি তুলে নিন এবং তাদেরকে অনাবৃষ্টিতে জড়িয়ে যেতে দিন ইউসুফ (আ.)-এর সময়ের মতো এবং বনি সাকীহর এক ব্যক্তিকে [মুখতার বিন আবু উবায়দা সাক্বাফীকে] তাদের ওপর নিয়োগ দিন , যে তাদের গলায় তিক্ত পেয়ালা ঢেলে দিবে। কারণ তারা মিথ্যা বলেছে এবং আমাদের পরিত্যাগ করেছে। আপনি আমাদের রব , আপনার ওপরে আমরা নির্ভর করি এবং আপনার দিকেই আমরা ফিরি এবং আপনার সামনেই (সবকিছুর) শেষ।

এরপর তিনি তার উট থেকে নামলেন এবং রাসূল (সা.)-এর ঘোড়ায় চড়লেন , যার নাম ছিলো মুরতাজায এবং তার সাথীদেরকে সাজাতে শুরু করলেন।

[ মালহুফ গ্রন্থে আছে] উমর বিন সা আদ সামনে এগিয়ে এলো এবং ইমামের সেনাদলের দিকে একটি তীর ছুঁড়লো এবং বললো , সেনাপতির সামনে সাক্ষী থেকো যে আমিই ছিলাম যে প্রথম তীর ছুঁড়েছিল।’’ তখন তার অধীনে যারা ছিলো তারা বিরাট সংখ্যায় তীর ছুঁড়তে লাগলো যা পাখির মত দেখাতে লাগলো। ইমাম তার সাথীদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন ,

আল্লাহ তাঁর রহমত তোমাদের ওপর বর্ষণ করুন , জাগো অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর মুখোমুখি হতে এবং এ তীরগুলো সেনাবাহিনীর দূত যা আমাদের দিকে আসছে।’’

এরপর তারা আক্রমণ করে এবং ইমামের একদল বিশ্বস্তও পরহেজগার সাথী নিহত হন।

বর্ণনাকারী বলেন যে ইমাম হোসেইন (আ.) নিজের দাড়ি ধরে বললেন ,

আল্লাহর ক্রোধ চরম হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইহুদীদের ওপর যখন তারা বলেছিল তাঁর একটি ছেলে আছে এবং তাঁর রাগ খ্রিষ্টানদের ওপর পড়ে যখন তারা তাঁকে তিন জনের একজন বানিয়েছিল এবং তাঁর ক্রোধ গিয়ে অগ্নি উপাসকদের [মাজুসদের] ওপর পড়েছিল যখন তারা তাঁর পরিবর্তে সূর্য ও চাঁদের ইবাদত করতে শুরু করেছিল এবং এখন আল্লাহর ক্রোধ পড়বে এ সম্প্রদায়ের ওপর যারা একত্রিত হয়েছে নবীর নাতিকে হত্যার জন্য। সাবধান , আল্লাহর শপথ , আমি তাদের আশার সাথে একমত হবো না , যতক্ষণ পর্যন্তনা আমি আমার রবের সাথে মিলিত হই আমার রক্তে ভিজে।’’

বর্ণিত আছে আমর বিন হাজ্জাজ ইমাম হোসেইন (আ.)-এর সাথীদের দিকে অগ্রসর হলো এবং বললো ,‘‘ হে কুফাবাসী , তাদেরকে দৃঢ়ভাবে ধরে থাকো যারা তোমাদের এবং তোমাদের সম্প্রদায়ের কথা শোনে এবং তাকে হত্যা করতে দ্বিধা করো না যে ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে এবং ইমামকে অমান্য করেছে।’’ ইমাম হোসেইন (আ.) বললেন ,‘‘ হে আমর বিন হাজ্জাজ , তুমি কি লোকজনকে আমার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করছো ? আমরা কি ধর্ম থেকে বেরিয়ে গেছি , আর তোমরা তার ওপর দৃঢ় আছো ? আল্লাহর শপথ , যখন তুমি তোমার এ খারাপ কাজগুলো নিয়ে মরবে তখন তুমি জানতে পারবে যে , কে ধর্ম থেকে বেরিয়ে গেছে এবং কে জাহান্নামের [আগুনের] জন্য যোগ্য।’’

কারবালায় ইমাম হোসেইন (আ.)-এর প্রবেশ

হুর বিন ইয়াযীদ ইমাম হোসেইন (আ.)-কে কুফায় যাওয়ার পথে বাধা দিলে তিনি থেমে যান। এরপর তার সন্তানদের , ভাইদের ও আত্মীয়দেরকে নিজের চারদিকে জড়ো করলেন এবং কিছু সময়ের জন্য কাঁদলেন ও বললেন , হে আল্লাহ , আমরা আপনার রাসূলের বংশধর। লোকজন আমাদেরকে আমাদের বাড়িঘর থেকে টেনে বের করেছে এবং আমাদেরকে তাড়া করেছে এবং আমাদেরকে আমাদের নানার জায়গা [মদীনা] থেকে চাপ প্রয়োগ করে বের করে দিয়েছে। বনি উমাইয়া আমাদের উপর অত্যাচার করেছে। হে আল্লাহ , আমাদের অধিকারকে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিন এবং এ অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।

এরপর তিনি সেখান থেকে অগ্রসর হলেন এবং 61 হিজরির 2রা মহররমের দিন বুধবার অথবা মঙ্গলবার কারবালায় প্রবেশ করলেন। এরপর তিনি তার সাথীদের দিকে ফিরে বললেন ,

লোকজন পৃথিবীর দাস এবং ধর্ম শুধু তাদের মুখের কথা এবং তারা এর যত্ন নিবে যতক্ষণ পর্যন্ততা তাদের জন্য আনন্দদায়ক এবং যখন পরীক্ষার উত্তপ্ত পাত্র এসে যায় তখন থাকে শুধু গুটি-কয়েক ধার্মিক ব্যক্তি।

এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন , এটি কি কারবালা ?

লোকজন উত্তর দিলো , হ্যাঁ। তিনি বললেন , এ জায়গা হলো দুঃখ ও মুসিবতের জায়গা এবং এ জায়গা আমাদের উটগুলোর বিশ্রামের স্থান , আমাদের থামার জায়গা , আমাদের শাহাদাতের জায়গা যেখানে আমাদের রক্ত ঝরানো হবে।

ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কাছে উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের চিঠি

ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া কর্তৃক নিয়োজিত কুফার গভর্নর ইমাম হোসেইন (আ.)-কে একটি চিঠি প্রদান করে যা নিম্নরূপ: আম্মা বা আদ , হে হোসেইন , আমাকে জানানো হয়েছে যে , তুমি কারবালায় থেমেছো। ইয়াযীদ আমাকে লিখেছে , আমি যেন বিছানায় মাথা না রাখি এবং সন্তুষ্ট না হই যতক্ষণ পর্যন্তনা আমি তোমাকে আল্লাহর কাছে পাঠাচ্ছি , অথবা তুমি আমার কাছে এবং ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ কর। সালাম।

যখন এ চিঠি ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কাছে পৌঁছলো , তিনি তা পড়লেন এবং তা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন , যে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি খোঁজে সে কখনোই সফলতা লাভ করে না। দূত তাকে চিঠির উত্তর দিতে বললে ইমাম বললেন , তার জন্য কোন উত্তর নেই , আছে গযব [আল্লাহর]।

আশুরার (দশ মহররম) রাতের ঘটনাবলী

[ ইরশাদ গ্রন্থে আছে ] ইমাম হোসেইন ( আ .) তার সাথীদের রাতের বেলা জড়ো করলেন , ইমাম আলী যায়নুল আবেদীন ( আ .) বলেন যে , আমি তাদের কছে গেলাম শোনার জন্য তারা কী বলেন এবং সে সময় আমি অসুস্থ ছিলাম। আমি শুনলাম ইমাম তার সাথীদের বলছেন ,

আমি আল্লাহর প্রশংসা করি সর্বোত্তম প্রশংসার মাধ্যমে এবং তাঁর প্রশংসা করি সমৃদ্ধির সময়ে এবং দুঃখ দুর্দশার মাঝেও। হে আল্লাহ , আমি আপনার প্রশংসা করি এ জন্য যে , আপনি আমাদের পরিবারে নবুয়াত দান করতে পছন্দ করেছেন। আপনি আমাদের কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন এবং ধর্মে আমাদেরকে বিজ্ঞজন করেছেন এবং আমাদেরকে দান করেছেন শ্রবণ শক্তি ও দূরদৃষ্টি এবং আলোকিত অন্তর। তাই আমাদেরকে আপনার কৃতজ্ঞ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন।

আম্মা বা আদ , আমি তোমাদের চেয়ে বিশস্ত এবং ধার্মিক কোন সাথীকে পাই নি , না আমি আমার পরিবারের চাইতে বেশী বিবেচক , স্নেহশীল , সহযোগিতাকারী ও সদয় কোন পরিবারকে দেখেছি। তাই আল্লাহ আমার পক্ষ থেকে তোমাদেরকে উত্তমভাবে পুরস্কৃত করুন এবং আমি মনে করি শত্রুরা একদিনও অপেক্ষা করবে না এবং আমি তোমাদের সবাইকে অনুমতি দিচ্ছি স্বাধীনভাবে চলে যাওয়ার জন্য এবং আমি তা তোমাদের জন্য বৈধ করছি। আমি তোমাদের উপর থেকে আনুগত্য ও শপথের দায়ভার তুলে নিচ্ছি ( যা তোমরা আমার হাতে হাত দিয়ে শপথ করেছিলে ) । রাতের অন্ধকার তোমাদের ঢেকে দিয়েছে , তাই নিজেদের মুক্ত করো ঘূর্ণিপাক থেকে অন্ধকারের ঢেউয়ের ভেতরে। আর তোমাদের প্রত্যেকে আমার পরিবারের একজনের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ো গ্রাম ও শহরগুলোতে , যতক্ষণ না আল্লাহ তোমাদের মুক্তি দান করেন। কারণ এ লোকগুলো শুধু আমাকে চায় এবং আমার গায়ে হাত দেয়ার পরে তারা আর কারো পেছনে ধাওয়া করবে না।

এ কথা শুনে তার ভাইয়েরা , সন্তানরা , ও ভাতিজারা এবং আব্দুল্লাহ বিন জাফরের সন্তানরা বললেন , আামরা তা কখনোই করবো না আপনার পরে বেঁচে থাকার জন্য। আল্লাহ যেন কখনো তা না করেন। হযরত আব্বাস বিন আলী ( আ .) সর্বপ্রথম এ ঘোষণা দিলেন এবং অন্যরা তাকে অনুসর ণ করলেন।

ইমাম তখন আক্বীল বিন আবি তালিবের সন্তানদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন , মুসলিমের আত্মত্যাগ তোমাদের জন্য যথেষ্ট হয়েছে , তাই আমি তোমাদের অনমতি দিচ্ছি চলে যাওয়ার জন্য। তারা বললেন , সুবহানাল্লাহ , লোকেরা কী বলবে ? তারা বলবে আমরা আমাদের প্রধানকে , অভিভাবককে এবং চাচাতো ভাইকে , যে শ্রেষ্ঠ চাচাতো ভাই , পরিত্যাগ করেছি এবং আমরা তার সাথে থেকে তীর ছুড়িনি , বর্শা দিয়ে আঘাত করি নি এবং তার সাথে থেকে তরবারি চালাই নি এবং তখন আমরা ( এ অভিযোগের মুখে ) বুঝতে পারবো না কী করবো ; আল্লাহর শপথ , আমরা তা কখনোই করবো না। প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের জীবন , সম্পদ ও পরিবার আপনার জন্য কোরবানী করবো। আমরা আপনার পাশে থেকে যুদ্ধ করবো এবং আপনার পাশে থেকে পরিণতিতে পৌঁছে যাবো। আপনার পরে জীবন কুৎসিত হয়ে যাক ( যদি বেঁচে থাকি ) ।

হোসেইন বিন হামদান হাযীনি তার বর্ণনা ধারা বজায় রেখে আবু হামযা সূমালি থেকে বর্ণনা করেন এবং সাইয়েদ বাহরানি বর্ণনার ক্রমধারা উল্লেখ না করেই তার কাছ থেকে নবণার্ করেছেন যে , তিনি বলেছেন: আমি ইমাম আলী আল-যায়নুল আবেদীনকে বলতে শুনেছি , শাহাদাতের আগের রাতে আমার বাবা তার পরিবার এবং সাথীদের জড়ো করলেন এবং বললেন , হে আমার পরিবারের সদস্যরা এবং আমার শিয়ারা [অনুসারীরা] , এ রাতকে ভেবে দেখো যা তোমাদের কাছে বহনকারী উট হয়ে এসেছে এবং নিজেদেরকে রক্ষা করো , কারণ লোকেরা আমাকে ছাড়া কাউকে চায় না। আমাকে হত্যা করার পর তারা তোমাদেরকে তাড়া করবে না। আল্লাহ তোমাদের উপর রহমত করুন। নিজেদেরকে রক্ষা করো। নিশ্চয়ই আমি আনুগত্য ও শপথের দায়ভার তুলে নিলাম যা তোমরা আমার হাতে করেছো। এ কথা শুনে তার ভাইয়েরা , আত্মীয়-স্বজন ও সাথীরা একত্রে বলে উঠলো , আল্লাহর শপথ হে আমাদের অভিভাবক , হে আবা আবদিল্লাহ , আমরা আপনার সাথে কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করবো না , তাতে লোকেরা বলতে পারে যে আমরা আমাদের ইমামকে , প্রধানকে এবং অভিভাবককে পরিত্যাগ করেছি এবং তাকে শহীদ করা হয়েছে। তখন আমরা আমাদের ও আল্লাহর মাঝে ওজর খুঁজবো। আমরা আপনাকে কখনোই পরিত্যাগ করবো না যতক্ষণ পর্যন্তনা আমরা আপনার জন্য কোরবান হই। ইমাম বললেন , নিশ্চয়ই আগামীকাল আমাকে হত্যা করা হবে এবং তোমাদের সবাইকে আমার সাথে হত্যা করা হবে এবং তোমাদের কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না। তারা বললেন , সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যে তিনি আমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন আপনাকে সাহায্য করার জন্য এবং আমাদেরকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন আপনার সাথে শহীদ হওয়ার জন্য। তাহলে কি আমরা পছন্দ করবো না যে আমরা আপনার সাথে উচ্চ মাক্বামে [বেহেশতে] থাকবো , হে রাসূলুল্লাহর সন্তান ? ইমাম বললেন , আল্লাহ তোমাদের উদারভাবে পুরস্কৃত করুন। এরপর তিনি তাদের জন্য দোআ করলেন।

তখন ক্বাসিম বিন হাসান (আ.) জিজ্ঞেস করলেন , আমি কি শহীদদের তালিকায় আছি ? তা শুনে ইমাম আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন এবং বললেন , হে আমার প্রিয় সন্তান , তুমি মৃত্যুকে কিভাবে দেখো ?

ক্বাসিম বললেন , মধুর চেয়ে মিষ্টি।

ইমাম বললেন , নিশ্চয়ই , আল্লাহর শপথ , তোমার চাচা তোমার জন্য কোরবান হোক , তুমি তাদের একজন যাদেরকে শহীদ করা হবে আমার সাথে কঠিন অবস্থার শিকার হওয়ার পর এবং আমার [শিশু] সন্তান আব্দুল্লাহকেও [আলী আসগার] শহীদ করা হবে।

আশুরার দিনে ইমাম হোসেইন ( আ .)- এর খোতবা

আশুরার দিনে ইমাম হোসেইন (আ.) একটি খোতবায় বলেন: আম্মা বা আদ , বিবেচনা করো আমার পরিবার সম্পর্কে এবং গভীরভাবে ভাবো আমি কে , এরপর নিজেরদের তিরস্কার করো। তোমরা কি মনে করো যে আমাকে হত্যা করা এবং আমার পবিত্রতা ও সম্মান লুট করা তোমাদের জন্য বৈধ ? আমি কি তোমাদের নবীর নাতি , তার ওয়াসী ও তার চাচাতো ভাইয়ের সন্তান নই , যিনি ছিলেন বিশ্বাস গ্রহণে সবার আগে এবং সাক্ষী ছিলেন সে সবকিছুর ওপরে যা মহানবী আল্লাহর কাছ থেকে এনেছেন ? শহীদদের সর্দার হামযা কি আমার পিতার চাচা ছিলেন না ? জাফর , যিনি বেহেশতে দুপাখা নিয়ে উড়েন , তিনি কি আমার চাচা নন ? নবীর হাদীস কি তোমাদের কাছে পৌঁছে নি যেখানে তিনি আমার সম্পর্কে ও আমার ভাই সম্পর্কে বলেছেন : আমরা দুজন জান্নাতের যুবকদের সর্দার ? তাই যদি আমি যা বলছি তার সাথে একমত হও , এবং নিশ্চয়ই আমি যা বলেছি তা সত্য ছাড়া কিছু নয় , তাহলে তা উত্তম , কারণ আল্লাহর শপথ , যে সময় থেকে আমি বুঝেছি আল্লাহ মিথ্যাবাদীদের অপছন্দ করেন তখন থেকে আমি কখনোই কোন মিথ্যা বলি নি। আর যদি তোমরা আমি যা বলছি তা বিশ্বাস না কর , তাহলে তোমাদের মাঝে নবীর জীবিত সাহাবীগণ আছে , তাদের কাছে যাও এবং তাদেরকে জিজ্ঞেস কর এবং তারা আমার বক্তব্যের সত্যতার সাক্ষ্য দিবে। জাবির বিন আব্দুল্লাহ আনসারি , আবু সাঈদ খুদরি , সাহল বিন সাদ সা য়েদি , যায়েদ বিন আরক্বাম এবং আনাস বিন মালিককে জিজ্ঞেস কর , তারা তোমাদের বলবে যে তারা আল্লাহর রাসূলের কাছ থেকে আমার ও আমার ভাই সম্পর্কে এ হাদীসটি শুনেছে। এটি কি তোমাদের জন্য আমার রক্ত ঝরানোর চাইতে যথেষ্ট নয় ?

তখন অভিশপ্ত শিমর বিন যিলজাওশান বললো , আমি আল্লাহর ইবাদত করি ঠোঁট দিয়ে এবং তুমি যা বলছো তা আমি বুঝি না। এ কথা শুনে হাবীব বিন মুযাহির [ইমামের সাথী] বললেন , আমি দেখছি তুমি আল্লাহর ইবাদত করো সত্তুর ধরনের সন্দেহ নিয়ে এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তুমি সত্য কথা বলেছো এবং তুমি বুঝতে পারো না ইমাম যা বলেন , কারণ আল্লাহ তোমার হৃদয়ের ওপরে একটি [মূর্খতার] মোহর মেরে দিয়েছেন।

ইমাম বললেন , যদি তোমরা এতে সন্দেহ পোষণ কর , তোমরা কি এতেও সন্দেহ কর যে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নাতি ? আল্লাহর শপথ , পূর্বে ও পশ্চিমে , আমি ছাড়া নবীর কোন নাতি নেই তোমাদের মধ্যে অথবা অন্যদের মধ্যে। দুর্ভোগ তোমাদের জন্য , আমি কি তোমাদের মধ্য থেকে কাউকে হত্যা করেছি যে তোমরা তার প্রতিশোধ নিতে চাও ? অথবা আমি কি কারো সম্পদ বেদখল করেছি , অথবা কাউকে আহত করেছি যার প্রতিশোধ তোমরা আমার ওপর নিতে চাও ?

যখন কেউ তাকে উত্তর দিলো না , তিনি উচ্চ কণ্ঠে বললেন , হে শাবাস বিন রাব ঈ , হে হাজ্জার বিন আবজার , হে ক্বায়েস বিন আল-আশআস , হে ইয়াযীদ বিন হুরেইস , তোমরা কি আমার কাছে চিঠি লিখোনি যে , ফল পেকেছে এবং আশপাশের ভূমিতে ফুল ফুটেছে এবং একটি বিশাল সেনাবাহিনীর কাছে আসুন , যা আপনার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে ?

তারা উত্তর দিলো যে তারা এ ধরনের কোন চিঠি লিখেনি। ইমাম বললেন , সুবহানাল্লাহ , আল্লাহর শপথ অবশ্যই তোমরা তা লিখেছিলে।

এরপর তিনি বললেন , হে জনতা , এখন যদি তোমরা আমার আগমনকে পছন্দ না কর , তাহলে আমাকে ছেড়ে দাও যেন আমি কোন আশ্রয়ের জায়গায় চলে যেতে পারি।

ক্বায়েস বিন আল-আশআস বললো , তুমি যা বলছো তা আমরা জানি না , আমার চাচাতো ভাইদের [বনি উমাইয়ার] কাছে আত্মসমর্পণ কর , তারা তোমার সাথে সেভাবে আচরণ করবে যেভাবে তুমি চাও। ইমাম বললেন , আল্লাহর শপথ , নিকৃষ্ট মানুষের মতো আমি তোমাদের হাতে হাত দিবোনা , না আমি পালিয়ে যাবো কোন দাসের মতো।

এরপর তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন , হে আল্লাহর দাসেরা ,

) و َإِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُمْ أَن تَرْجُمُونِ(

নিশ্চয়ই আমি আমার ও তোমাদের রবের কাছে আশ্রয় নিচ্ছি ,পাছে তোমরা আমাকে পাথর মারো [হত্যা করো]। [সূরা দুখান: 20]

) إ ِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُم مِّن كُلِّ مُتَكَبِّرٍ لَّا يُؤْمِنُ بِيَوْمِ الْحِسَابِ(

আমি আশ্রয় নিই আমার ও তোমাদের রবের কাছে , প্রত্যেক দাম্ভিক থেকে , যে হিসাব দিনে বিশ্বাস করে না। [সূরা মু মিন: 27]

ইমাম আরো অগ্রসর হলেন এবং তাদের সামনে দাঁড়ালেন এবং তাদের সারিগুলোর দিকে তাকালেন শান্তবৃষ্টির মতো। তিনি উমর বিন সা আদকে কুফার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন এবং বললেন , ধন্যবাদ আল্লাহর প্রাপ্য , যিনি এ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং একে মৃত্যু ও ক্ষয়ের বাড়ি বানিয়েছেন এবং যিনি এর মানুষদেরকে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তন করেন। সে ব্যক্তি ধোঁকা খেয়েছে যে এ পৃথিবীর প্রতারণার শিকার হয়েছে , কারণ যে এর ওপর নির্ভর করে সে তাকে হতাশ করে। যে এখানে আকাঙ্ক্ষা করে সে তাকে রিক্তহস্ত করে। আমি দেখতে পাচ্ছি তোমরা জড়ো হয়েছো এমন একটি কাজের জন্য যা তোমাদের ওপর আল্লাহর ক্রোধ আনবে। তিনি তোমাদের দিক থেকে তার চেহারা ঘুরিয়ে নিয়েছেন এবং তোমাদেরকে তার ক্রোধে ঢেকে দিয়েছেন এবং তোমাদের কাছ থেকে তার রহমত সরিয়ে নিয়েছেন। তাই আমাদের রব হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ , আর তোমরা হচ্ছো নিকৃষ্টতম দাস। তোমরা আল্লাহকে মেনে চলার অঙ্গীকার করেছো এবং তার রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-কে বিশ্বাস করেছো। এরপরও তোমরা তার পরিবারকে এবং বংশধরকে আক্রমণ করেছো এবং তাদেরকে হত্যা করতে চাও। [ইরশাদ] শয়তান তোমাদের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং তোমাদেরকে সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ভুলিয়ে দিয়েছে। দুর্ভোগ তোমাদের জন্য তোমাদের পথ ও লক্ষ্যের ওপর। নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয়ই আমরা তার কাছে ফেরত যাবো। এ এক জাতি যারা বিশ্বাস গ্রহণের পর কুফুরী গ্রহণ করেছে , তাই বিদায় হে অত্যাচারী জাতি।

তখন উমর বিন সা আদ বললো , তোমাদের জন্য আক্ষেপ , তাকে উত্তর দাও , কারণ সে আলীর সন্তান। সে যদি সারা দিন তোমাদের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকে তার বক্তব্য শেষ হবে না , না সে ক্লান্তহবে। তখন শিমর এগিয়ে এলো এবং বললো , হে হোসেইন , তুমি কী বলছো ব্যাখ্যা কর যেন আমরা বুঝতে পারি। ইমাম বললেন , আমার বক্তব্যের মূল কথা হলো যে আমি তোমাদের বলছি আল্লাহকে ভয় করার জন্য এবং আমাকে হত্যা করো না। কারণ আমাকে হত্যা ও আমার পবিত্রতা ধ্বংস করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। কারণ আমি তোমাদের নবী (সা.)-এর কন্যার সন্তান এবং আমার নানী খাদিজা ( আ .) তোমাদের নবীর স্ত্রী। তোমরা হয়তো আমার নানাকে বলতে শুনে থাকবে যে , হাসান এবং হোসেইন বেহেশতের যুবকদের সর্দার।

এরপর তারা ইমাম হোসেইন (আ.)-কে সবদিক থেকে ঘেরাও করে ফেললো। তিনি তাদের কাছে এগিয়ে গেলেন এবং তাদেরকে চুপ থাকার ইঙ্গিত করলেন , কিন্তু তারা তা শুনতে অস্বীকার করলো। তখন ইমাম বললেন , তোমাদের জন্য দুর্ভোগ , তোমাদের কী হয়েছে যে তোমরা চুপ করছো না এবং আমি যা বলছি তা শুনছো না ? আমি তোমাদেরকে ধার্মিকতার পথে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। যে আমাকে মান্য করবে সে প্রজ্ঞাবান হবে। আর যে আমাকে মান্য করবে না সে ধ্বংস হবে। তোমরা সবাই আমার অবাধ্য হচ্ছো এবং আমার কথায় কান দিচ্ছো না। এর কারণ হলো তোমরা তোমাদের পেট হারামে পূর্ণ করেছো এবং তোমাদের হৃদয়গুলোতে মোহর মারা হয়েছে। আক্ষেপ তোমাদের জন্য। তোমরা কি ন্যায়পরায়ণ নও এবং শুনতে অক্ষম ?

কুফাবাসীদের লক্ষ্য করে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর বক্তব্য

সাইয়্যেদ ইবনে তাউস বর্ণনা করেছেন যে , ইমাম হোসেইন (আ.) তার উটে চড়লেন [অন্যরা বলেন তার ঘোড়ায়] এবং তাদের ইশারা করলেন চুপ করার জন্য। এরপর তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ ও মর্যাদা বর্ণনা করলেন যা তার প্রাপ্য। তিনি অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় সালাম পাঠালেন ফেরেশতা , নবী ও রাসূলদের ওপর। তারপর বললেন , হে জনতা , তোমরা যেন ধ্বংস হও , দুর্দশাগ্রস্ত হও। তোমরা উৎসাহের সাথে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলে তোমাদের সাহায্য করার জন্য এবং আমরা তা করার জন্য দ্রুত অগ্রসর হয়েছি। কিন্তু তোমরা এখন সে তরবারিগুলো কোষমুক্ত করেছো যা আমরা তোমাদের দিয়েছি এবং তোমরা আমাদের জন্য আগুন জ্বালিয়েছো যা আমরা তোমাদের ও আমাদের শত্রুদের জন্য জ্বালিয়েছিলাম। তোমরা তোমাদের শত্রুদের পক্ষ নিয়েছো এবং তাদের সাথে থেকে তোমাদের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অগ্রসর হয়েছো , যদিও তারা তোমাদের সাথে ন্যায়পরায়ণ আচরণ করে নি , না তোমরা তাদের কাছ থেকে কোন দয়া ও সদয় আচরণ আশা কর। তোমাদের ওপর শত দুর্ভোগ আসুক। তোমরা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো যখন তরবারিগুলো এখনও তাদের খাপে রয়েছে , হৃদয়গুলো শান্তিতে আছে , মতামতগুলো যথাযথভাবে স্পষ্ট এবং ভুল থেকে মুক্ত। কিন্তু তোমরা পঙ্গপালের মতো , যারা যুদ্ধের দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়েছে এবং মথের [প্রজাপতি] মতো , একজনের ওপর আরেকজন যেমন পড়ে। তোমরা ধ্বংস হও , হে যারা দাসীদের প্রেমিক , যারা দলত্যাগ করেছো , যারা কোরআন পরিত্যাগ করেছো , যারা সঠিক বক্তব্যকে বদলে নিয়েছো , যারা খারাপের স্তম্ভ , হে যারা শয়তানদের দ্বারা উস্কানি পাচ্ছো এবং যারা আসমানী আদেশ ছিন্নকারী , তোমরা তাদের পক্ষ নিচ্ছো এবং আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো ? হ্যাঁ , নিশ্চয়ই প্রতারণা ও বিশ্বাস ভঙ্গ করা তোমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য , যা তোমাদের পিতৃপুরুষেরা প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তা থেকে শাখা বেরিয়েছে। তোমরা নোংরা এবং এর বিস্বাদ ফল যা এর বপনকারীর গলায় আটকে যায় এবং তা অত্যাচারীদের কাছে আনন্দের। সাবধান , এখন অবৈধ পিতার অবৈধ সন্তান [উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ] আমাকে তরবারি কোষমুক্ত করা ও অপমান সহ্য করার মাঝে স্থাপন করেছে এবং আমরা অপমান গ্রহণ করবো তা কখনোই হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার রাসূল এবং পবিত্র কোলগুলো যা আমাদের দুধ খাইয়েছে , যারা ভদ্র ও যারা অপমান ঘৃণা করে তারা এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে যে , আমরা ঘৃণ্য মানুষদের কাছে মাথা নোয়াবো এবং তারা আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন এ বিষয়ে যুদ্ধের ময়দানে পৌরুষের সাথে নিহত হতে। জেনে রাখো , আমি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো যদিও আমার সাথে রয়েছে অল্প কয়েকজন মানুষ এবং যদিও কিছু ব্যক্তি আমাকে পরিত্যাগ করে চলে গেছে।

নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর ওপর নির্ভর করি , আমার রব এবং তোমাদের রব , কোন জীবিত প্রাণী নেই , যার কপালের চুল তার হাতে নেই। নিশ্চয়ই আমার রব সঠিক পথের ওপরে আছেন। [সূরা হুদ: 56]

হে আল্লাহ , তাদের কাছ থেকে আকাশের বৃষ্টি তুলে নিন এবং তাদেরকে অনাবৃষ্টিতে জড়িয়ে যেতে দিন ইউসুফ (আ.)-এর সময়ের মতো এবং বনি সাকীহর এক ব্যক্তিকে [মুখতার বিন আবু উবায়দা সাক্বাফীকে] তাদের ওপর নিয়োগ দিন , যে তাদের গলায় তিক্ত পেয়ালা ঢেলে দিবে। কারণ তারা মিথ্যা বলেছে এবং আমাদের পরিত্যাগ করেছে। আপনি আমাদের রব , আপনার ওপরে আমরা নির্ভর করি এবং আপনার দিকেই আমরা ফিরি এবং আপনার সামনেই (সবকিছুর) শেষ।

এরপর তিনি তার উট থেকে নামলেন এবং রাসূল (সা.)-এর ঘোড়ায় চড়লেন , যার নাম ছিলো মুরতাজায এবং তার সাথীদেরকে সাজাতে শুরু করলেন।

[ মালহুফ গ্রন্থে আছে] উমর বিন সা আদ সামনে এগিয়ে এলো এবং ইমামের সেনাদলের দিকে একটি তীর ছুঁড়লো এবং বললো , সেনাপতির সামনে সাক্ষী থেকো যে আমিই ছিলাম যে প্রথম তীর ছুঁড়েছিল।’’ তখন তার অধীনে যারা ছিলো তারা বিরাট সংখ্যায় তীর ছুঁড়তে লাগলো যা পাখির মত দেখাতে লাগলো। ইমাম তার সাথীদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন ,

আল্লাহ তাঁর রহমত তোমাদের ওপর বর্ষণ করুন , জাগো অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর মুখোমুখি হতে এবং এ তীরগুলো সেনাবাহিনীর দূত যা আমাদের দিকে আসছে।’’

এরপর তারা আক্রমণ করে এবং ইমামের একদল বিশ্বস্তও পরহেজগার সাথী নিহত হন।

বর্ণনাকারী বলেন যে ইমাম হোসেইন (আ.) নিজের দাড়ি ধরে বললেন ,

আল্লাহর ক্রোধ চরম হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইহুদীদের ওপর যখন তারা বলেছিল তাঁর একটি ছেলে আছে এবং তাঁর রাগ খ্রিষ্টানদের ওপর পড়ে যখন তারা তাঁকে তিন জনের একজন বানিয়েছিল এবং তাঁর ক্রোধ গিয়ে অগ্নি উপাসকদের [মাজুসদের] ওপর পড়েছিল যখন তারা তাঁর পরিবর্তে সূর্য ও চাঁদের ইবাদত করতে শুরু করেছিল এবং এখন আল্লাহর ক্রোধ পড়বে এ সম্প্রদায়ের ওপর যারা একত্রিত হয়েছে নবীর নাতিকে হত্যার জন্য। সাবধান , আল্লাহর শপথ , আমি তাদের আশার সাথে একমত হবো না , যতক্ষণ পর্যন্তনা আমি আমার রবের সাথে মিলিত হই আমার রক্তে ভিজে।’’

বর্ণিত আছে আমর বিন হাজ্জাজ ইমাম হোসেইন (আ.)-এর সাথীদের দিকে অগ্রসর হলো এবং বললো ,‘‘ হে কুফাবাসী , তাদেরকে দৃঢ়ভাবে ধরে থাকো যারা তোমাদের এবং তোমাদের সম্প্রদায়ের কথা শোনে এবং তাকে হত্যা করতে দ্বিধা করো না যে ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে এবং ইমামকে অমান্য করেছে।’’ ইমাম হোসেইন (আ.) বললেন ,‘‘ হে আমর বিন হাজ্জাজ , তুমি কি লোকজনকে আমার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করছো ? আমরা কি ধর্ম থেকে বেরিয়ে গেছি , আর তোমরা তার ওপর দৃঢ় আছো ? আল্লাহর শপথ , যখন তুমি তোমার এ খারাপ কাজগুলো নিয়ে মরবে তখন তুমি জানতে পারবে যে , কে ধর্ম থেকে বেরিয়ে গেছে এবং কে জাহান্নামের [আগুনের] জন্য যোগ্য।’’


11

12

13