বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্15%

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্ লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 18 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 27445 / ডাউনলোড: 5024
সাইজ সাইজ সাইজ
বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মৃত্যুপারের জীবন সম্পর্কে মানুষের ঔৎসুক্য চিরন্তন। এ ঔৎসুক্যের পরিপূর্ণ নিবৃত্তি জীবদ্দশায় সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব নয় জেনেও মানুষ কখনোই এ বিষয়ে জানার আগ্রহ পরিত্যাগ করতে পারে না। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মে যেমন বিভিন্ন ধারণা দেয়া হয়েছে, তেমনি এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা তথ্য ও কল্পনা। তাই এ ব্যাপারে সম্ভব সর্বাধিক মাত্রায় সঠিক ধারণার প্রয়োজনীয়তা সব সময়ই অনুভূত হয়ে আসছে।

ইসলামী মতে, সাধারণভাবে মৃত্যুপরবর্তী সময়ের দু’টি পর্যায় রয়েছে : মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত সময় এবং পুনরুত্থান পরবর্তী সময় অর্থাৎ শেষ বিচার ও তদ্পরবর্তী জান্নাতী বা জাহান্নামী অনন্ত জীবন। পুনরুত্থান, শেষ বিচার এবং বেহেশত বা দোযখ বাস তথা আখেরাতের ওপর ঈমান পোষণ ইসলামের মৌলিক চৈন্তিক ভিত্তি (উছূলে ‘আক্বাএদ্)-এর অন্যতম। এ কারণে এ সম্পর্কে কোরআন মজীদে বিস্তারিত বক্তব্য রয়েছে।


1

বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে আালামে বারযাখ্

সর্বজনীনভাবে মানবপ্রজাতির অনুভূতি মৃত ব্যক্তিদের আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার সচেতন উপস্থিতির সপক্ষে রায় দেয় , অচেতন বা ঘুমন্ত অবস্থার সপক্ষে রায় দেয় না। আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকলেই সদ্যমৃত ব্যক্তি সম্পর্কে অনুভব করে যে , যেন সে আশেপাশেই আছে , যেন সব কিছু দেখছে ও শুনছে , কিন্তু কথা বলতে পারছে না অর্থাৎ জীবিতদের শোনার মতো করে কথা বলতে পারছে না।

এমনকি নাস্তিক লোকেরা পর্যন্ত তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মৃতদেহের প্রতি সম্মান দেখায় এবং তাদের স্মৃতির প্রতি ঠিক সেভাবেই ভক্তি , শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করে যেভাবে ভক্তি , শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করতো তাদের জীবদ্দশায় ; তাদের চেতনার অসম্মান হোক এটা তারা কিছুতেই মানতে পারে না। এ ব্যাপারে তাদের প্রায় সকলেই আন্তরিক। বিশেষ করে মৃত ব্যক্তিদের জীবিত থাকাকালে যাদের সাথে তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা , স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো তার মৃত্যুর পরেও তারা তার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা , স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসা অনুভব করে। কিন্তু যে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে তথা অস্তিত্বহীন হয়ে গিয়েছে তার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা , স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসা পোষণের তো কোনোই অর্থ হয় না। আসলে তারা অবচেতনভাবে হলেও মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তার অমরত্ব ও কাছাকাছি উপস্থিতির প্রত্যয় পোষণ করে। অন্যদিকে যারা আস্তিক , ধর্ম নির্বিশেষে তাদের সকলেই সচেতনভাবেই এ প্রত্যয় পোষণ করে থাকে।

মানুষ সাধারণতঃ এমন কিছু করতে চায় না তার মৃত স্বজন বেঁচে থাকলে যা অপসন্দ করতো। তারা মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তাকে পর্যবেক্ষণক্ষমতাসহ উপস্থিত অনুভব করে বলেই এরূপ আচরণ করে থাকে। মৃত ব্যক্তিদের ব্যক্তিসত্তাকে বিলুপ্ত বা ঘুমন্ত মনে করলে তারা কখনোই এরূপ আচরণ করতো না , কারণ , সে ক্ষেত্রে এরূপ আচরণ হতো অযৌক্তিক ও অর্থহীন। মৃত ব্যক্তিদের দেহভস্ম সসম্মানে সংরক্ষণ অথবা তাদের ক্ববরে বা তাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের কাছে বা তাদের মমিকৃত মৃতদেহের সামনে গিয়ে ভক্তি-শ্রদ্ধা , ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের পিছনেও তাদের একই অনুভূতি কাজ করে থাকে।

মানবপ্রকৃতির আরেকটি সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , সে প্রিয় স্বজনদের কাছাকাছি থাকতে চায় , প্রয়োজনে দূরে কোথাও গেলেও যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব কাছে ফিরে আসতে চায় এবং নিয়মিত পরস্পরের খোঁজখবর জানতে চায়। তাই মৃত্যুর পরেও প্রিয় স্বজনদের কাছ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকার চিন্তা তাদের মধ্যে হতাশা ও বিমর্ষতার সৃষ্টি করে। তাই সকলেই সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে এ আশাই পোষণ করে যে , মৃত্যুর পরেও সে প্রিয় স্বজনদের কাছাকাছি থাকবে। নিজ বাড়ীতে বা বাড়ীর যথাসম্ভব কাছাকাছি প্রিয় স্বজনদের ক্ববরের পাশে ক্ববর দেয়ার জন্য ওয়াছ্বীয়াত্ করে যাবার পিছনেও একই অনুভূতির প্রভাব বিদ্যমান। নয়তো মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা অনন্ত নিদ্রায় নিদ্রিত থাকে বলে ধারণা পোষণ করলে মৃত ব্যক্তির বা তার জীবিত প্রিয় স্বজনদের কারো কাছেই এ ধরনের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনোই মূল্য হতে পারে না।

মানবপ্রকৃতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , সে দীর্ঘ ঘুম পসন্দ করে না - না তার নিজের জন্য , না তার প্রিয় স্বজনদের জন্য। তাই ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা হাজার হাজার বা কোটি কোটি বছর ঘুমিয়ে থাকবে এটা নিজের বা প্রিয়জনদের জন্য চিন্তা করতেই মানুষ বিষণ্ন ও বিমর্ষ হতে বাধ্য। তাই তারা মৃত ব্যক্তিদের ব্যক্তিসত্তার জাগ্রত অবস্থাই কামনা করে।

মানবপ্রকৃতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , সে তার নিজের ভালো কাজের পুরষ্কার ও তার শত্রুর বা তাকে কষ্টদানকারীর জোর-যুলুম ও মন্দ কাজের শাস্তির ব্যাপারে অতি বিলম্ব পসন্দ করে না। অবশ্য সে নিজের পুরষ্কার ও প্রতিপক্ষের শাস্তির ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা অপরিহার্য লক্ষ্য করলে সে ক্ষেত্রেও যথাসময়ের পূর্বে ভালো ও মন্দ কাজের কিছু না কিছু প্রভাব আশা করে। উদাহরণস্বরূপ , যাকে পুরষ্কার দেয়া হবে তাকে নির্ধারিত অনুষ্ঠানের আগেই অনুষ্ঠানস্থলে এলে সেখানেই বা তার কাছাকাছি কোনো ভালো ও আরামদায়ক অবস্থানস্থলে সাদরে বিশ্রাম নিতে দেয়া হয় এবং হাল্কাভাবে হলেও আদর-আপ্যায়ন করা হয়। তেমনি বিবাহ বা অন্যবিধ আনন্দ-অনুষ্ঠানেও মেহমানদেরকে মূল ভোজনপর্বের আগেই অনুষ্ঠানস্থলে বা কাছাকাছি অন্য কোনো উত্তম পরিবেশে বিশ্রাম ও আরাম করতে দেয়া হয় এবং হাল্কাভাবে হলেও , আন্তরিক আদর-আপ্যায়ন করা হয়। বস্তুতঃ সকলে এটাই আশা করে। অন্যদিকে একজন সন্দেহাতীত ফৌজদারী অপরাধীকে গ্রেফতারের পর থেকে বিচার শুরু হবার পূর্ব পর্যন্ত এমন অবস্থায় রাখা ও আনা-নেয়া করা হয় যাকে শাস্তি বলা না গেলেও তা মোটেই আরামদায়ক বা সম্মানজনক নয় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় - যা এক ধরনের মানসিক শাস্তি বটে। আর সাধারণভাবে লোকেরা এটাই পসন্দ ও আশা করে।

তাছাড়া শাস্তি ও পুরষ্কার উভয়ই যদি হাজার হাজার বছর , এমনকি কোটি কোটি বছর দূরবর্তী হয় ; তার ছিটেফোঁটাও যদি আশুপ্রাপ্তি না ঘটে , বরং হাজার হাজার বছর , এমনকি কোটি কোটি বছর যদি ভালো ও মন্দ উভয় ব্যক্তিকে পাশাপাশি অভিন্ন অবস্থায় ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় তাহলে মানবমনে তা অন্যায় বলে প্রতিভাত হয় এবং তা মানুষের মনে ও আচরণে হতাশা সহ বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে বাধ্য। কারণ , অতি বিলম্বিত পুরষ্কারের প্রতি আকর্ষণ হ্রাস পায় এবং অতি বিলম্বিত শাস্তির প্রতি ভীতিও হ্রাস পায়।

ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , মানবপ্রকৃতিতে যতো প্রয়োজন ও কামনা-বাসনা নিহিত রাখা হয়েছে তার সবই পূরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তাই সর্বজনীনভাবে যেহেতু মানবপ্রকৃতি তার ব্যক্তিসত্তার অমরত্ব এবং সচেতন জাগ্রত অবস্থা , স্বীয় সৎকর্মের পুরো পুরষ্কার প্রাপ্তিতে বিলম্ব হলেও অবিলম্বে অন্ততঃ কিছুটা সম্মান-আপ্যায়ন এবং অপরাধীর বিচার ও পুরো শাস্তিতে বিলম্ব হলেও তার জন্য অবিলম্বে অন্ততঃ অপসন্দনীয় অবস্থা দাবী করে , তখন এমনটি হওয়াই অপরিহার্য। অন্যথায় সৃষ্টিকর্তা মানবপ্রকৃতিতে এ ধরনের কামনা-বাসনা প্রদান করতেন না।

দেহবিহীন আত্মার অনুভূতিশক্তি

এরপরও প্রশ্ন উঠতে পারে যে , মৃত্যুর পরে দেহবিহীন আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার অনুভূতিশক্তি থাকবে কিনা ? এ প্রশ্নের ভিত্তি হচ্ছে এই যে , দুনিয়ায় আমরা দেহের মাধ্যমে তথা দৈহিক ইন্দ্রিয়নিচয়ের মাধ্যমে বাইরের জগত সম্পর্কে তথ্যাদি আহরণ করি এবং সুখ-দুঃখের অনুভূতি অর্জন করি। দুনিয়ার বুকে আনন্দভোগ ও শাস্তিভোগ উভয়ই দেহের মাধ্যমে হয়ে থাকে। অন্যদিকে শেষ বিচারের জন্য দেহসহ পুনরুত্থান সংঘটিত হবে এবং দেহসহই ব্যক্তিকে পুরষ্কার বা শাস্তি দেয়া হবে। ধর্মীয় সূত্রও এটাই বলে এবং বিচারবুদ্ধিও এটাই দাবী করে। এমতাবস্থায় দেহবিহীন আত্মার সুখ-দুঃখের অনুভূতির সম্ভাবনা কতোখানি ?

এ প্রসঙ্গে বলতে হয় যে , পার্থিব জীবনেও মানুষ পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্য ছাড়াই আনন্দ ও বেদনার অনেক অনুভূতি অর্জন করে থাকে। আর ক্ষেত্রবিশেষে তা দৈহিক ইন্দ্রিয়নিচয়ের মাধ্যমে অর্জিত অনুভূতির তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী হয়ে থাকে। একজন মানুষকে প্রকাশ্য রাস্তায় অসম্মানজনক কথা বললে বা গালি দিলে ক্ষেত্রবিশেষে তা বেত্রাঘাত বা ছুরিকাঘাতের চেয়েও অনেক বেশী যন্ত্রণাদায়ক হয়ে থাকে।

অবশ্য পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যে সুখ-দুঃখের অনুভূতি হয়ে থাকে তা-ও গুরুত্বহীন নয়। এ কারণেই পুনরুত্থান সংঘটিত হবে পার্থিব জীবনের ন্যায় দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে এবং বিচারবুদ্ধির দাবী অনুযায়ী এমনটিই হওয়া উচিত। (এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা অত্র গ্রন্থের বিষয়বস্তুর জন্য অপরিহার্য নয়।) তবে পার্থিব জীবনে দেহ কেবল ব্যক্তিসত্তাকে অনুভূতি অর্জনে সহায়তাই করে না , বরং অনুভূতিঅর্জনক্ষমতার ওপর সীমাবদ্ধতাও আরোপ করে। কারণ , পার্থিব জীবনে ব্যক্তিসত্তার মনোযোগের একটি বিরাট অংশ , বরং সিংহভাগই তার দেহের প্রতি নিবদ্ধ থাকে - যাতে দেহ কোনো ভুল কাজ না করে , ভুলবশতঃ নিজের ক্ষতি না করে এবং বিপদে না পড়ে। ফলে জাগ্রত অবস্থায় অন্যান্য ক্ষেত্রে আত্মার বিচরণ ও অনুভূতি তার মধ্যে নিহিত সম্ভাবনার তুলনায় খুবই সীমাবদ্ধ থাকে।

এছাড়া দেহের দুর্বলতা ও ক্লান্তি-শ্রান্তির কারণে ব্যক্তির জন্য ঘুম ও বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা অবস্তুগত বিধায় তার ক্ষয় , দুর্বলতা ও ক্লান্তি-শ্রান্তি থাকতে পারে না , ফলে তার ঘুম বা বিশ্রামের প্রয়োজন থাকতে পারে না। তেমনি জীবিত ও জাগ্রত অবস্থায় দেহের প্রতি আত্মার যে সিংহভাগ মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে মৃত্যুর পরে তার আর প্রয়োজন না থাকায় আত্মার অনুভূতি পূর্ণ মাত্রায় কার্যকর থাকে এবং তার তৎপরতার ক্ষেত্র হয় ব্যাপকবিস্তৃত। এটাই স্বাভাবিক। অবশ্য মৃত্যুর পর ব্যক্তির আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা আাল্লাহ্ তা আলা কর্তৃক ফেরেশেতাদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত একটি জগতে সীমাবদ্ধতার আওতায় আসে। তবে এটা একটি স্বতন্ত্র আলোচ্য বিষয়।

মোদ্দা কথা , মৃত্যুর ফলে দেহযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার ভালো-মন্দের অনুভূতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে বা তার সকল প্রকার কর্মতৎপরতা অসম্ভব হয়ে পড়বে - বিচারবুদ্ধি এটা মানতে পারে না।

অবশ্য এটা অনস্বীকার্য যে , দেহযন্ত্র অচল হয়ে পড়ায় আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার কর্মতৎপরতার আওতা সীমিত হয়ে পড়তে বাধ্য। কিন্তু তার অনুভূতি না থাকার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কারণ , জীবদ্দশায় শরীরের যে অনুভূতি তা আসলে শরীরযন্ত্রের মাধ্যমে আত্মার অর্জিত অনুভূতি বৈ নয়। এমতাবস্থায় মৃত্যুর পরেও যদি আত্মা টিকে থাকে (এবং আসলেই টিকে থাকে) তাহলে তার সুখ-দুঃখের উর্ধে ওঠার ধারণার পিছনে কোনোই যৌক্তিকতা নেই।

দুনিয়ার জীবনে মানুষের আত্মা অতীতের ভালো ও সুখকর স্মৃতির কথা স্মরণ করে আনন্দিত হয় , ভবিষ্যতের শুভ সম্ভাবনার কথা ভেবে আশান্বিত হয়ে ওঠে , অতীতের তিক্ত স্মৃতি বা বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য খারাপ পরিণতি আনয়নকারী অতীত ভুলভ্রান্তি এবং ভবিষ্যতের অনিবার্য দুঃখ-দুর্দশার কথা চিন্তা করে হতাশ , ব্যথিত ও যন্ত্রণাকাতর হয়ে পড়ে। ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের আনন্দের অনুভূতি এমন চরমে উপনীত হতে পারে যে , এর আতিশয্যে তার মৃত্যু ঘটতে পারে। তেমনি ভবিষ্যত বিপদাশঙ্কাও এমন হতে পারে যে , তা তার মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। অন্যদিকে ভবিষ্যত দুঃখকষ্টের দুঃসহতার কথা চিন্তা করে তার হাত থেকে বাঁচার জন্য অনেক সময় আত্মহত্যার পথও বেছে নিতে দেখা যায়। যুদ্ধে শত্রুর হাতে বন্দী হয়ে নির্যাতিত হবার ভয়ে আহত সৈনিকের আত্মহত্যার ঘটনার কথাও অনেক শোনা যায়।

এ থেকে সুস্পষ্ট যে , আত্মা কেবল অতীত ও ভবিষ্যতের ভালো-মন্দের কারণেও বর্তমানে সুখ বা দুঃখ অনুভব করতে পারে। আর বলা বাহুল্য যে , এ ধরনের সুখ ও দুঃখ বস্তুগত বা দৈহিক নয় , বরং পুরোপুরি আত্মিক ব্যাপার। এমতাবস্থায় মৃত্যুর তথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর ব্যক্তির আত্মা অতীতের ভালো-মন্দ আমল এবং ভবিষ্যতের পুরষ্কার ও শাস্তির কথা চিন্তা করে আনন্দিত বা যন্ত্রণাকাতর ও অনুতপ্ত হবে এটাই স্বাভাবিক।

অবশ্য ব্যক্তির মৃত্যুর পরে তার আত্মা বস্তুগত দেহের অধিকারী না থাকায় শারীরিক তৎপরতা চালাতে সক্ষম হয় না। তেমনি সুচিন্তা ও অনুতাপ সহ যে সব আত্মিক কর্ম দুনিয়ার বুকে আঞ্জাম দিলে তা থেকে শেষ বিচারে ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতো মৃত্যুর পরে সে সব কাজ আঞ্জাম দিলে শেষ বিচারে লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তাই বলে মৃত্যুপরবর্তী জগতে ব্যক্তির আত্মিক তৎপরতা ও আত্মিক অনুভূতি বন্ধ হয়ে যাবে - তার কোনোই কারণ নেই। তবে আত্মা দুনিয়ার বুকে যে সব আত্মিক তৎপরতা চালায় মৃত্যুর পরে তার কতোখানি চালাতে পারে বা কতোখানি চালাবার স্বাধীনতা লাভ করে এবং কোন্ ধরনের ব্যক্তিদের আত্মা স্বাধীনতা লাভ করে এবং যারা তা লাভ করেন তাঁদের মধ্যে কে কতোখানি স্বাধীনতা লাভ করেন তা এক ভিন্ন বিষয়। এ সম্পর্কে বিচারবুদ্ধি কিছুটা ধারণায় উপনীত হতে পারলেও বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভে সক্ষম নয়। কিন্তু ব্যক্তির মৃত্যুর পরে তার আত্মার সুখ-দুঃখের অনুভূতি এবং অতীত ও ভবিষ্যতের প্রতিক্রিয়া গ্রহণ বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে এক অনস্বীকার্য ব্যাপার।

বিষয়টি একটি পার্থিব দৃষ্টান্তের সাহায্যে বোঝার জন্য চেষ্টা করলে বুঝতে পারা সহজ হতে পারে। যেমন : ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দেয়ার পর যখন ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে তখন যারা খারাপ পরীক্ষা দিয়েছে তারা তাদের অতীতের ভুলের জন্য মনস্তাপে ভুগতে থাকে এবং ফলাফল ঘোষণার পরে সম্ভাব্য অকৃতকার্যতা তার জন্য যে নিন্দা ও ধিক্কার ডেকে আনবে এ ব্যাপারে দুশ্চিন্তা তার মধ্যে চরম যন্ত্রণার সৃষ্টি করতে থাকে। অন্যদিকে যে ছাত্র ভালো পরীক্ষা দিয়েছে সে তার এ পরীক্ষার কারণে মানসিক প্রশান্তির অধিকারী থাকে এবং ভবিষ্যত শুভ ফলাফলের চিন্তা তার মধ্যে আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টি করে। শুধু তা-ই নয় , ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত না হওয়া সত্ত্বেও যারা এ দু জন ছাত্রের পড়াশুনা ও পরীক্ষার অবস্থা সম্পর্কে অবগত তারা খারাপ ছাত্রটির প্রতি অবজ্ঞা বা ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায় এবং আত্মীয়-স্বজন তাকে সমাদর করে না , অন্যদিকে সকলেই ভালো ছাত্রটির প্রতি স্নেহ-মমতার দৃষ্টিতে তাকায় ও তাকে খাতির করে , সমাদর করে। এ দুই বিপরীত আচরণও দুই ছাত্রের মধ্যে পরস্পরবিরোধী অনুভূতির সৃষ্টি করে থাকে। মৃত্যুর পরমুহূর্ত থেকে শুরু করে পুনরুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে আত্মার অবস্থা এ অবস্থার সাথে তুলনীয়।

মোদ্দা কথা , বিচারবুদ্ধি মৃত্যুর পরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী সময়ে আত্মার অনুভূতি , সুখ-দুঃখ এবং তার ওপরে অতীত-ভবিষ্যতের প্রতিক্রিয়াকে একটি অপরিহার্য বিষয় বলে গণ্য করে।

আালামে বারযাখ্ কোথায় ?

বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে আালামে বারযাখ্ বা মৃত্যুর পরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী জগত সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রশ্ন হচ্ছে : এ জগত কোথায় অবস্থিত ?

নিঃসন্দেহে এ জগতের বিস্তারিত অবস্থা সম্পর্কে অকাট্যভাবে জানা বিচারবুদ্ধির পক্ষে সম্ভব নয়। তেমনি এর অবস্থান সম্পর্কে যেমন বিচারবুদ্ধির দাবী থাকতে পারে , তেমনি বিচারবুদ্ধি এ সংক্রান্ত কোনো কোনো সমস্যা উপস্থাপন করতে ও তার সম্ভাব্য জবাব প্রদান করতে পারে।

আমরা ইতিপূর্বে যেমন আলোচনা করেছি , বিচারবুদ্ধি মৃত প্রিয়জনদের আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা ও জীবিত প্রিয়জনদের মধ্যে নৈকট্য কামনা করে এবং এ কারণেই মৃতদের ব্যক্তিসত্তার ঘুমন্ত অবস্থা পসন্দ করে না , বরং জাগ্রত অবস্থা পসন্দ করে। অতএব , এ নৈকট্যের দাবী অনুযায়ী মৃতদের ব্যক্তিসত্তার জীবিতদের কাছাকাছি অবস্থানই কাম্য। অবশ্য কোনো মৃত ব্যক্তির আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা আালামে বারযাখে কতোখানি স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে ও জীবিত প্রিয়জনদের কাছাকাছি আসতে পারবে অথবা আদৌ সে সুযোগ পাবে কিনা তা স্বতন্ত্র বিষয় ; বিচারবুদ্ধি এ ব্যাপারে স্বাধীনভাবে ও নিশ্চিতভাবে মতামত ব্যক্ত করতে সক্ষম নয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে , বিচারবুদ্ধি মৃতদের ব্যক্তিসত্তার জীবিতদের কাছাকাছি অবস্থান কামনা করে। অতএব , বিচারবুদ্ধির দাবী অনুযায়ী , আালামে বারযাখ্ এই পৃথিবীর বুকে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। পৃথিবীর পরিবর্তে দূরবর্তী কোনো নক্ষত্রলোকে বা অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে আালামে বারযাখের অবস্থান হলে মানবমন প্রিয়জনদের ব্যক্তিসত্তার সুদূর লোকে অবস্থানজনিত বিষাদ অনুভব করতে বাধ্য। তাই এটা কাম্য নয়। বিশেষ করে আালামে বারযাখের অবস্থান এ পৃথিবীর বুকে হতে যখন কোনো বাধা নেই এমতাবস্থায় তা দূরবর্তী কোনো নক্ষত্রলোকে বা গ্যালাক্সিতে তা হওয়ার কোনো কারণ নেই।

তবে বিচারবুদ্ধি আালামে বারযাখের অনিবার্যভাবে মাটির নীচে হওয়াকেও মানতে পারে না। কারণ , এমন অনেক মানুষ আছে যাদের মৃতদেহকে মাটির নীচে ক্ববর দেয়া হয় না , বরং পুড়িয়ে ফেলা হয় , বা শীতল গৃহে সংরক্ষণ করা হয়। তাছাড়া অনেক লোক বন্যজন্তুর বা সামুদ্রিক প্রাণীর পেটে গিয়েছে এবং অনেকের শরীর পচেগলে পানিতে মিশে গিয়েছে ; তাদের জন্য মাটির ক্ববরের প্রশ্ন আসে না। তাই শরীরবিহীন ব্যক্তিসত্তার জন্য আালামে বারযাখ্ কোথায় হবে তার সাথে তার মৃতদেহ কোথায় আছে তার সম্পর্ক থাকা অপরিহার্য নয়। সুতরাং আালামে বারযাখ্ যেমন এ পৃথিবীর বুকে হওয়া কাম্য তেমনি তা মাটির নীচে না হয়ে মাটির ওপরে হওয়াও কাম্য। আর আল্লাহ্ তা আলার পক্ষে তা খুবই সহজসাধ্য। অবশ্য অধিকতর সঠিকভাবে বললে বলতে হয় , যেহেতু আালামে বারযাখ্ একটি ভিন্ন মাত্রার অবস্তুগত জগত সেহেতু তার জন্য মাটির ওপর-নীচ ও এতদুভয়ের কোনো কিছুই বাধা নয় , বরং তার ক্ষেত্রে মাটির ওপর-নীচ কথাটা আদৌ প্রযোজ্য নয়।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে , আালামে বারযাখ্ যদি এ পৃথিবীর বুকেই থেকে থাকে তাহলে আমরা কেন মৃত ব্যক্তিদের ব্যক্তিসত্তাকে ও সে জগতের নিদর্শনাদি দেখতে পাই না ? তাছাড়া যে সব জনাকীর্ণ জনপদে মানুষ ব্যাপকভাবে বিচরণশীল ও কর্মতৎপর সে সব জায়গায় আরেকটি জগতের অস্তিত্ব কীভাবে সম্ভব ?

এ প্রশ্নের জবাবে আমাদের স্মরণ করা প্রয়োজন যে , আালামে বারযাখ্ হচ্ছে আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার জগত। তাই তা এক ভিন্ন মাত্রার (Dimension ) জগত। এ কারণে একদিকে যেমন সে জগত আমাদের ইন্দ্রিয়নিচয়ের ধারণক্ষমতার বাইরে অন্যদিকে একই কারণে বস্তুজগতের সাথে সে জগতের সাংঘর্ষিকতার প্রশ্ন আসে না।

এমনকি আমাদের পার্থিব জগতেও অভিন্ন স্থান-কালে কোনোরূপ সাংঘর্ষিকতা ব্যতীতই একাধিক অস্তিত্বের অবস্থানের দৃষ্টান্ত আছে। উদাহরণস্বরূপ , কাঁচ , বায়ু ও পানির মধ্য দিয়ে আলো অবাধে যাতায়াত করে এবং যাতায়াতকালে খুবই অল্প সময়ের জন্য হলেও (সেকেণ্ডের ক্ষুদ্রাংশের জন্য হলেও) এ সবের মধ্যে অবস্থান করে (যদিও স্থির অবস্থান নয় , বরং গতিশীল অবস্থায় অবস্থান , তবে অবস্থান করে অবশ্যই) । কিন্তু ঐ সব বস্তুর ভিতরে আলোর অবস্থান বা ওগুলোর ভিতর দিয়ে অতিক্রম করার জন্য ওগুলোকে অপসারণ করার প্রয়োজন হয় না।

একইভাবে , বিদ্যুত ধাতব পদার্থ , মাটি ও পানির মধ্য দিয়ে চলাচল করে এবং বিদ্যুততরঙ্গ এতদসহ সব কিছুর মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে ; এ জন্য কোনো কিছুকে অপসারণ করতে হয় না। চৌম্বক ক্ষেত্রও কোনো কিছু অপসারণ না করে অবস্থান করে। সর্বোপরি আমাদের দেহ জুড়ে যে আত্মার অবস্থান তা-ও বস্তুদেহের কোনো অংশকে অপসারণ না করেই অবস্থান করে। অতএব , এতে সন্দেহের কোনোই কারণ নেই যে , আালামে বারযাখ্ ভিন্ন মাত্রার জগত হবার কারণে এ বস্তুজগতের কোনো কিছুর অবস্থানকে বাধাগ্রস্ত না করেই এখানে অবস্থিত হতে পারে। আর ভিন্ন মাত্রার জগত হবার কারণেই আমরা আমাদের বস্তুদেহের পঞ্চেন্দ্রিয়ের দ্বারা আালামে বারযাখের অস্তিত্ব ও সে জগতের ঘটনাবলী অনুভব করতে সক্ষম হচ্ছি না।

আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার জগতেও অনেক কিছু বস্তুদেহের পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করতে ব্যর্থ হই। বায়ু পুরোপুরি অদৃশ্য এবং পূর্ণ স্বচ্ছ কাঁচ ও পানি প্রায় অদৃশ্য। অবশ্য এগুলোকে আমরা আমাদের স্পর্শেন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব করতে পারি। কিন্তু আমরা আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের কোনোটি দ্বারাই আলো-কে সরাসরি অনুভব করতে পারি না ; কেবল কোনো বস্তুতে আলো পতিত হলে তা দেখা যাওয়ার কারণে আমরা আলোর অস্তিত্ব বুঝতে পারি। বিদ্যুত ও চৌম্বক ক্ষেত্রের ব্যাপারটিও অনুরূপ ; আমরা এতদুভয়ের অস্তিত্ব কেবল উভয়ের প্রতিক্রিয়া থেকেই বুঝতে পারি। অন্যদিকে রঞ্জন রশ্মি ও অতি লাল রশ্মি সহ এমন কতক রশ্মি আছে যা বায়ু , কাঁচ ও পানি ছাড়াও অন্যান্য স্থূল বস্তুকে - আমাদের প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতার সাধারণ অলোকরশ্মি যেগুলোকে ভেদ করতে পারে না - ভেদ করে চলে যায় বিধায় সাধারণ আলোকরশ্মির মতো তা বস্তুতে পতিত হবার পর প্রতিফলিত হয় না , ফলে সাধাণভাবে আমরা ঐ সব রশ্মির অস্তিত্ব সরাসরি ইন্দ্রিয়নিচয়ের দ্বারা পরোক্ষভাবেও অনুভব করি না ; কেবল বিশেষ ধরনের যন্ত্রের সাহায্যেই এ ধরনের আলোর প্রতিক্রিয়া ধরা পড়ে। অথচ সংশ্লিষ্ট যন্ত্র আবিষ্কৃত হবার আগেও এ ধরনের রশ্মির অস্তিত্ব ছিলো এবং তা বস্তুর ওপরে পতিত হয়ে তা ভেদ করে চলে যেতো , কিন্তু আমরা পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা না এ সব রশ্মির অস্তিত্ব বুঝতে পারতাম , না এ সবের প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারতাম।

অতএব , আালামে বারযাখের অস্তিত্ব এ পৃথিবীর বুকে হওয়ার বিষয়টিকে অসম্ভব মনে করার কারণ নেই। তবে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , আালামে বারযাখ্ আমাদের এ পৃথিবীতে হওয়ার মানে এ নয় যে , এ জগতের অস্তিত্ব এবং মৃত ব্যক্তিদের ব্যক্তিসত্তার অবস্থান ও বিচরণ কেবল মাটির ওপরে মানুষের স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হবে। বরং আসমান-যমীনের সর্বত্রই এ জগতের আওতাভুক্ত হওয়া স্বাভাবিক। কারণ , বস্তুদেহের যে সীমাবদ্ধতা আছে আত্মার জন্য সে ধরনের বস্তুগত সীমাবদ্ধতা থাকার প্রশ্ন আসে না যদি না সে জগতের পরিচালনাব্যবস্থার আওতায় বিশেষভাবে কারো ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়। অন্যদিকে বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে যেমন রঞ্জন রশ্মি ও অতি লাল রশ্মির প্রতিক্রিয়া ধরা সম্ভব হচ্ছে তেমনি শক্তিশালী ব্যক্তিসত্তার অধিকারী জীবিত মানুষের পক্ষে আালামে বারযাখের অবস্থা অবহিত হওয়া সম্ভব হতে পারে। এটাই বিচারবুদ্ধির রায়।

বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে স্রষ্টা ও আত্মার অস্তিত্ব

সর্বজনীন মানদণ্ডের দৃষ্টিতে অর্থাৎ বিচারবুদ্ধির আলোকে আালামে বারযাখ্ সংক্রান্ত আলোচনা সৃষ্টিকর্তা ও আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল। কারণ , সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব যদি না থাকে অথবা থাকলেও মানুষের বস্তুগত শরীর ছাড়া কোনো অবস্তুগত সত্তা বা আত্মা যদি না থাকে তাহলে আালামে বারযাখের অস্তিত্ব থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ , মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী যদি কেবল বস্তুগত অস্তিত্ব হয়ে থাকে এবং তার প্রাণশীলতা - নাস্তিকরা যেমন দাবী করে থাকে - যদি কেবল বস্তুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে তো সে ক্ষেত্রে মৃত্যুতেই সব শেষ হয়ে যাবার কথা ; মৃত্যুর পরে সুখ-দুঃখের প্রশ্নই ওঠে না। তাই আমরা প্রথমেই বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিকোণ থেকে স্রষ্টা ও আত্মার অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব সম্বন্ধে ফয়ছ্বালায় উপনীত হবো। [এ বিষয়ে আমার লেখা জীবন জিজ্ঞাসা গ্রন্থে বিচারবুদ্ধির আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করেছি ; এখানে প্রাসঙ্গিক বিধায় বিষয়টির ওপর সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো।]

বিচারবুদ্ধির আলোকে স্রষ্টা ও আত্মা (নাফ্স্) দর্শন ও আক্বাএদের দু টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় এবং এ সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনার অবকাশ রয়েছে। কিন্তু যেহেতু এখানে আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে আালামে বারযাখ্ সেহেতু আমরা এখানে স্রষ্টা ও আত্মা সম্বন্ধে অত্যন্ত সংক্ষেপে আলোচনা করবো।

আমাদের অভিজ্ঞতার আওতাধীন বস্তুজগত হচ্ছে কারণ ও ফলশ্রুতির ( Cause and Effect) প্রাকৃতিক বিধান অনুসরণের জগত - এ এক অনস্বীকার্য সত্য। এ বিশ্বের সদাপরিবর্তনশীলতা এবং এতে কার্যকর কারণ ও ফলশ্রুতির বিধি থেকে প্রমাণিত হয় যে , এর একটি সূচনা আছে। বস্তুবিজ্ঞানীরা এ বিশ্বজগতের সূচনা সম্পর্কে যে সব তত্ত্ব দিয়েছেন তার সবগুলোই অসম্পূর্ণ এবং সেগুলোর কোনোটিতেই বিশ্বজগতের সূচনার পিছনে নিহিত মূল কারণ বা উৎস কী তা বলা সম্ভব হয় নি।

বিশ্বজগতের সূচনা সম্পর্কে প্রদত্ত অনাদি তত্ত্ব অর্থাৎ বিশ্বজগত অনাদি কাল থেকে আছে ; এর কোনো সূচনা নেই ’ - এ তত্ত্ব একটি অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। কারণ , বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির আওতাধীন সদাপরিবর্তনশীল জগত অনাদি হতে পারে না। আর এমন সুশৃঙ্খল ও অসংখ্য প্রাকৃতিক বিধি-বিধান দ্বারা পরিচালিত বিশ্বজগতকে আমরা যদি যুক্তির খাতিরে অনাদি বলে ধরেও নেই তথাপি মানতে হবে যে , এ শৃঙ্খলা এবং কারণ ও ফলশ্রুতি বিধি প্রমাণ করে , এ বিশ্বজগতের অন্তরালে কোনো সর্বজ্ঞানী অসীম শক্তিশালী চিরঞ্জীব সত্তার অস্তিত্ব রয়েছে - যার সুপরিকল্পনা অনুসারে অনাদি কাল থেকে এ বিশ্বজগত চলে আসছে। অর্থাৎ এ বিশ্বজগত সেই পরম জ্ঞানীর অস্তিত্বেরই নিদর্শন মাত্র।

বিশ্বজগতের সূচনা সম্বন্ধে আরেকটি বস্তুবাদী তত্ত্ব হচ্ছে আদি বস্তু ’ র তত্ত্ব। এ তত্ত্ব অনুযায়ী আদিতে সর্বত্র সমভাবে বিরাজিত অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বস্তু ছিলো। তারপর এক সময় তাতে আলোড়ন বা বিস্ফোরণের সৃষ্টি হয়ে গতি সঞ্চার হয় এবং তার ফলে পর্যায়ক্রমে গ্যালাক্সি সমূহ সৃষ্টি হয় ও পরে উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে প্রাণের সৃষ্টি হয়।

বিশ্বজগতের সূচনা সম্বন্ধে ব্যাপকভাবে গৃহীত তত্ত্ব হচ্ছে বিগ্ ব্যাং ’ বা মহাবিস্ফোরণ ’ তত্ত্ব। এ তত্ত্ব অনুযায়ী অসীম ভরযুক্ত একটি আদি বস্তুকণা থেকে এ বিশ্বজগতের সৃষ্টি হয়েছে ; আদি বস্তুকণায় বিস্ফোরণের ফলে প্রথমে গ্যালাক্সিসমূহ ও পরে তা থেকে ধাপে ধাপে অন্য সব কিছু সৃষ্টি হয়।

এ উভয় তত্ত্বই অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এখানে এগুলোর মধ্য থেকে কয়েকটি প্রশ্ন তুলে ধরা হলো :

(১) অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কথিত আদি বস্তু বা অসীম ভরযুক্ত আদি বস্তুকণা ’ কোত্থেকে এলো ?

(২) আদি বস্তুতে বা আদি বস্তুকণায় গতিসঞ্চার , বা বিস্ফোরণ অথবা মহাবিস্ফোরণ সংঘটিত হবার কারণ কী ? বস্তুধর্ম বা কারণ ও ফলশ্রুতির বিধি অনুযায়ী কোনো শক্তির ইতিবাচক বা নেতিবাচক ক্রিয়া না ঘটলে বস্তুর স্থিতাবস্থায় (সে স্থিতাবস্থা স্থিরতা বা গতিশীলতা - যা-ই হোক না কেন) কোনোরূপ পরিবর্তন ঘটতে পারে না। এমতাবস্থায় আদি বস্তু বা আদি বস্তুকণায় সৃষ্ট পরিবর্তনের পিছনে কোন্ কারণ ক্রিয়া করেছিলো ?

(৩) যদি বলা হয় যে , আদি বস্তুতে বা আদি বস্তুকণায় এ পরিবর্তনের সম্ভাবনা ’ পূর্ব থেকেই বিদ্যমান ছিলো এবং তার ফলেই এতে পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছিলো , তাহলে প্রশ্ন : এ সম্ভাবনা কোত্থেকে এলো ? এ সম্ভাবনা ঠিক ঐ সময় কেন বাস্তবে রূপ নিলো ? ঐ সময়ের আগে বা পরে নয় কেন ? তাহলে কি আগে থেকেই নির্ধারিত ছিলো যে , ঐ সময়ই এ সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ নেবে ? যদি তা-ই হয়ে থাকে তো কে তা নির্ধারণ করে দিয়েছিলো ?

(৪) আদি বস্তুতে বিস্ফোরণের পরে বা আদি বস্তুকণায় মহাবিস্ফোরণের পরে যে নিয়মাবলী বা প্রাকৃতিক বিধিবিধান অনুসরণে গ্যালাক্সি সমূহ গড়ে উঠলো , বিভিন্ন মৌলিক উপাদান , বস্তু ও শক্তি তৈরী হলো এবং অসংখ্য প্রাণহীন বস্তু ও প্রাণশীল প্রজাতি অস্তিত্বলাভ করলো ; এ সব প্রাকৃতিক বিধিবিধান - যার সব এখনো আবিষ্কৃত হয় নি - কোত্থেকে এলো ? এতো সব বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক বিধি কোনো মহাবিজ্ঞানীর অস্তিত্ব ছাড়া কীভাবে সম্ভব হতে পারে ?

এ সব প্রশ্নের সঠিক জবাব একটাই হতে পারে। তা হচ্ছে : এ জীবন ও জগতের অন্তরালে এমন এক অবস্তুগত সর্বজ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান চিরন্তন মহাসত্তা রয়েছেন যিনি সকল কারণের আদি কারণ এবং সকল সৃষ্টির উৎস।

সর্বসাম্প্রতিককালে অনেক বিজ্ঞানী দাবী করেছেন যে , ক্বোয়ান্টাম্ ফ্লাকচুয়েশন বিধি অনুযায়ী শূন্য ’ (কিছুই না) থেকে বিশ্বজগতের সৃষ্টির সূচনা হতে পারে এবং এর ভিত্তিতে তাঁরা দাবী করেন যে , সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ নেই।

আসলে এ এক হাস্যকর উদ্ভট দাবী। যদিও ক্বোয়ান্টাম্ ফ্লাকচুয়েশন তত্ত্ব কোনো বিতর্কাতীত বিষয় নয় তথাপি এটিকে সত্য বলে ধরে নিলেও তা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে , আল্লাহ্ তা আলাই শূন্য থেকে এ মহাবিশ্বের সৃষ্টির সূচনা করেছেন এবং (কোরআন মজীদের উক্তি অনুযায়ী) তিনি অনবরত সৃষ্টি করে চলেছেন।

[বস্তুতঃ ক্বোয়ান্টাম্ ফ্লাক্চুয়েশন বিধি পদার্থ বিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞত্ব পর্যায়ের একটি বিষয় , তাই তা সাধারণ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে সহজবোধ্য ভাষায় ব্যাখ্যা করা কঠিন। মোটামুটিভাবে বলা যায় , এ বিধি অনুযায়ী অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য শূন্য থেকে কোনো পরিমাণ এনার্জি তৈরী হতে পারে এবং তৈরী হওয়ার সাথে সাথেই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। এ থেকে উপসংহার টানা হয়েছে যে , শূন্য থেকে একই সময় পার্টিকল্ ও এন্টি-পার্টিকল্ তৈরী হয় এবং সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে এন্টি-পার্টিকল্ পার্টিকলকে ধ্বংস করে দেয়।

আসলে এর পিছনে এমন অজানা প্রাকৃতিক কারণ থাকাও অসম্ভব নয় যা বিজ্ঞানীরা এখনো আবিষ্কার করতে পারেন নি। তাছাড়া বিজ্ঞানীরা যেভাবে শূন্যস্থান দিয়ে মাধ্যম ছাড়া কীভাবে বিদ্যুত তরঙ্গ অতিক্রম করে এটা ব্যাখ্যা করতে না পেরে একটা অজানা মাধ্যম ধরে নিয়ে তার ঈথার ’ নামকরণ করেন , পার্টিকল্ ও এন্টি-পার্টিকল্ সৃষ্টি হওয়ার পিছনেও এমন কোনো অজানা উৎস থাকতে পারে - যা এখনো আবিষ্কৃত হয় নি। আর সর্বোপরি , যে কারণে বা যে উৎস থেকেই তা উদ্ভূত হোক না কেন , অথবা শূন্য থেকে উদ্ভূত হোক , তার পিছনে নিহিত আদি কারণ হচ্ছেন এক অনাদি-অনন্ত অপরিহার্য পরম জ্ঞানময় মহাসত্তা (আমাদের পরিভাষায় যার নাম আল্লাহ্) । নচেৎ আক্ষরিক অর্থে শূন্য ’ অর্থাৎ কিছুই না ’ থেকে কোনো কিছু ’ ই উদ্ভূত হতে পারে না।

অবশ্য স্বয়ং এ তত্ত্বটিতে মৌলিক দুর্বলতা আছে - যা নিয়ে আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়।]

এ ক্ষেত্রে অনেক সময় প্রশ্ন করা হয় : সে সত্তা কোত্থেকে এলেন ? তাঁকে কে সৃষ্টি করেছে ? তাঁর স্বরূপ কী ?

বস্তুতঃ এ ধরনের প্রশ্ন পুরোপুরি বিচারবুদ্ধিবিরুদ্ধ। কারণ , কারণ ও ফলশ্রুতি বিধি ’ এবং তার আওতাধীন জগতের যিনি সৃষ্টিকর্তা তিনি স্বয়ং কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির আওতাভুক্ত হতে পারেন না। যিনি অনাদি-অনন্ত বা চিরন্তন তাঁর সম্বন্ধে সৃষ্ট হওয়া ’ কথাটি প্রযোজ্য নয়। কারণ , যিনি আদি স্রষ্টা তাঁর কোনো স্রষ্টা থাকতে পারে না ; থাকলে তাঁর জন্য আদি স্রষ্টা ’ কথাটি প্রযোজ্য হতে পারে না। তেমনি , বিচারবুদ্ধির রায় অনুযায়ী , সসীম অসীমকে ধারণ করতে পারে না। তাই কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির আওতাধীন সসীম সৃষ্টি মানুষের পক্ষে অসীম সত্তা সৃষ্টিকর্তার স্বরূপ জানা সম্ভব নয়। কিন্তু বিচারবুদ্ধি যার অস্তিত্বমানতার পক্ষে রায় দেয় তাঁর স্বরূপ জানতে না পারার কারণে তাঁর অস্তিত্ব অস্বীকার করা মূর্খতা মাত্র।

এবার আমরা , মানুষের বস্তুগত শরীর ছাড়াও তার মাঝে যে অবস্তুগত ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্ব রয়েছে বিচারবুদ্ধির আলোকে তার ওপর আলোকপাত করবো।

বস্তুতঃ সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণের চেয়েও আত্মা বা নাফ্স্-এর অস্তিত্ব প্রমাণ করা অধিকতর সহজ। আসলে শরীর জুড়ে এক বস্তুউর্ধ সত্তার অবস্থান যুক্তিপ্রমাণ দিয়ে প্রমাণের মুখাপেক্ষী নয়। কারণ , প্রতিটি মানুষ নিজেই তা অনুভব করে।

প্রতিটি মানুষই স্বীয় ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্ব অনুভব করে। এ অনুভূতি এমন একটি গুণ যা জড়বস্তুতে থাকা সম্ভব নয়। (অবশ্য প্রতিটি বস্তুকণায়ই এক ধরনের প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে ; এটা এক ভিন্ন আলোচ্য বিষয় - যে সম্পর্কে আলোচনা করা এখানে অপরিহার্য নয়। এখানে আমরা সাধারণভাবে যাকে জড়বস্তু বলি এবং প্রাণের অনুভূতিহীন বলে অনুভব করি তার এবং প্রচলিত অর্থে প্রাণশীল এমন সৃষ্টি ও জড়বস্তুর মধ্যকার পার্থক্যকেই আত্মা , বা নাফ্স্ বা ব্যক্তিসত্তা বলে গণ্য করছি।)

ভালো-মন্দ , সুখ-দুঃখ , ব্যথা-আনন্দ , হর্ষ-বিষাদ , সন্তোষ-ক্রোধ , আশা-ভয় ইত্যাদি অনুভূতি জড়বস্তুর বৈশিষ্ট্য নয়। তেমনি ন্যায়-অন্যায়বোধ , জ্ঞান ও মূর্খতা এবং সত্য-মিথ্যা নিয়ে বিতর্ক জড়বস্তুর বৈশিষ্ট্য নয়। সহজাত প্রবণতা ও মেধা-প্রতিভার ধারণা জড়বস্তুর জন্য প্রযোজ্য নয়।

বস্তুর একটি ধর্ম হচ্ছে একমুখিতা। অর্থাৎ বস্তুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অনিবার্যভাবেই কোনো ফলাফল প্রদান করবে ; সে ক্ষেত্রে দ্বিধাদ্বন্দ্ব , সন্দেহ বা বিতর্ক সংক্রান্ত ধারণার কোনো স্থান নেই।

জড়বস্তুর উন্নততম সংস্করণ হচ্ছে সুপার কম্পিউটার। কিন্তু সুপার কম্পিউটারে মানুষের গুণাবলী নেই। একটি সুপার কম্পিউটার কেবল সে সব কাজই করতে পারে যে সব কাজের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসূচী তার মধ্যে দেয়া হয়েছে। কম্পিউটার মানুষের মতো নিজে নিজে কোনো কিছু উদ্ভাবন করার মতো শক্তির অধিকারী নয় , কল্পনা করতে সক্ষম নয় , স্বেচ্ছায় মিথ্যা বলতে সক্ষম নয়। মানুষ নিজের সম্পর্কে , বিশ্বজগত সম্পর্কে এবং তার নিজের ও বিশ্বজগতের উৎস সম্বন্ধে চিন্তা করে ; কোনো জড় বস্তু , এমনকি সুপার কম্পিউটারও তা করতে সক্ষম নয়। (বর্তমানে যে জৈবিক কম্পিউটার উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে তা আমাদের আলোচনার সাথে সম্পর্কহীন। কারণ , তা স্রেফ্ জড়বস্তু নয়।)

মানুষ যে শুধু জড়বস্তুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নয় , বরং তার গোটা শরীর জুড়ে একটি অবস্তুগত অস্তিত্ব বিরাজমান - যা বস্তুগত শরীরকে পরিচালনা করে , তা প্রমাণের জন্য ওপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনাই যথেষ্ট বলে মনে করি। (এ অবস্তুগত সত্তা কীভাবে অস্তিত্বলাভ করে তা ভিন্ন একটি আলোচনার বিষয় ; কিন্তু এ সত্তার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য।)

শরীর ও আত্মার সম্পর্ক

এ প্রসঙ্গে শরীর ও আত্মা (নাফ্স্)-এর সম্পর্কের প্রতি দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন।

মানুষ হচ্ছে শরীর ও আত্মার সমন্বিত রূপ। শুধু শরীর বা শুধু আত্মাকে মানুষ বলা হয় না , বরং বলা হয় : মানুষের শরীর ’ ও মানুষের আত্মা ’ । কিন্তু এতদসত্ত্বেও প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে মানবসত্তায় আত্মার ভূমিকাই মুখ্য। আত্মা হচ্ছে শরীরের পরিচালক এবং শরীর হচ্ছে আত্মার বাহন ও হাতিয়ার স্বরূপ। তাই শরীর তার কর্মতৎপরতার জন্য পুরোপুরিভাবে আত্মার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু আত্মা তার সকল কর্মতৎপরতার জন্য শরীরের ওপর নির্ভরশীল নয়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুজগতে যার অস্তিত্ব নেই এমন কিছু সম্পর্কে , যেমন : আত্মা স্বয়ং তার নিজের সম্পর্কে এবং কাল্পনিক বিষয়াদি , দার্শনিক বিষয়াদি ও এ সব কিছুর উর্ধে খোদায়ী সত্তা সম্পর্কে চিন্তা করতে এবং সঠিক হোক বা ভুলই হোক , উপসংহারে উপনীত হতে ও জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম।

আত্মার আরো অনেক কর্মতৎপরতা আছে। আত্মা স্বীয় ইন্দ্রিয়নিচয়ের সাহায্যগ্রহণ ব্যতীতই অন্য আত্মার ওপর এবং বস্তুর ওপর (স্বীয় বা অন্যের শরীরের ওপর) প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা একটি স্বতন্ত্র বিষয় - যার অবকাশ অত্র আলোচনার সীমিত পরিসরে নেই। তবে এখানে উদাহরণস্বরূপ টেলিপ্যাথি , সম্মোহন (হিপনোটিজম্) , স্বপ্ন , হতাশাব্যঞ্জক বা ভয়ানক খবর শুনে সুস্থ ব্যক্তির আকস্মিক মৃত্যুবরণ ইত্যাদি এমন অনেক ধরনের আত্মিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কথা বলা যেতে পারে যা আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকলের নিকটই স্বতঃপ্রমাণিত।

অতএব , এ থেকে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে , আত্মা তার কর্মতৎপরতার জন্য পুরোপুরি শরীরের ওপর নির্ভরশীল নয়।

শরীর জুড়ে অবস্থানকারী অবস্তুগত আত্মিক সত্তা কি শরীরেই সৃষ্টি হয় , নাকি শরীর সৃষ্টির এক বিশেষ পর্যায়ে তা বাইরে থেকে এসে শরীরে যুক্ত হয় তা এক স্বতন্ত্র আলোচ্য বিষয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে , শরীর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট আত্মিক সত্তার ধ্বংস হয়ে যাওয়া কি অনিবার্য ?

বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে , আত্মিক সত্তা বাইরে থেকে এসে শরীরে যুক্ত হয়ে থাক অথবা শরীরেই তৈরী হয়ে থাক , শরীরের ধ্বংসের কারণে তার ধ্বংস হয়ে যাওয়া অপরিহার্য নয়। কারণ , আমরা যখন নিদ্রিত থাকি তখন শরীর তথা শরীরের পঞ্চেন্দ্রিয় নিষ্ক্রিয় থাকে , কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের অবস্তুগত ব্যক্তিসত্তা সক্রিয় থাকে বলেই আমরা স্বপ্ন দেখি। এমনকি জাগ্রত অবস্থায়ও পঞ্চেন্দ্রিয়ের নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বেও আমাদের আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা চিন্তা ও কল্পনায় মশগূল্ হতে পারে। ব্যক্তিসত্তার সক্রিয়তা যখন পঞ্চেন্দ্রিয়ের সক্রিয়তার ওপর নির্ভরশীল নয় তখন পঞ্চেন্দ্রিয় বা শরীর ধ্বংস হলেই তা ধ্বংস হয়ে যাবে - এটা সম্ভব বলে মনে করা যায় না।

এ ব্যাপারে অধিকতর শক্তিশালী প্রমাণ হচ্ছে পঙ্গু মানুষের ব্যক্তিসত্তা। কোনো ব্যক্তির শরীরের কোনো অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গ যদি কেটে ফেলা হয় তার ফলে তার ব্যক্তিসত্তা ধ্বংস বা পঙ্গু হয়ে যায় না। কারো হাত বা পা কেটে ফেললে , বা চোখ তুলে ফেললে , বা কিডনি ফেলে দিয়ে তদস্থলে অন্যের কিডনি সংযোজন করলে , বা কৃত্রিম হৃদপিণ্ডসংযোজন করলে অথবা শরীরের অর্ধাংশ বা তার পেশী (শরীরের এক পাশ বা নিম্নাংশ) পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে অবশ হয়ে গেলে তার ব্যক্তিসত্তা ধ্বংস বা অবশ হয়ে যায় না। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলে দেয়া বা পক্ষাঘাত শরীরের আংশিক মৃত্যুতুল্য , কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন ব্যক্তিসত্তার আংশিক মৃত্যু ঘটে না তখন শরীর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেলেও যে ব্যক্তিসত্তা ধ্বংস হয় না - এ ব্যাপারে সুস্থ বিচারবুদ্ধি মোটেই সন্দেহ পোষণ করে না।

বস্তুতঃ শরীর থেকে আত্মার বিচ্ছিন্ন হওয়া সম্ভব কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহের অন্যতম কারণ হচ্ছে গোটা শরীরের প্রতিটি কোষ জুড়ে আত্মার অবস্থান। এ কারণেই অনেকে বুঝে উঠতে পারে না যে , শরীর ধ্বংস হয়ে গেলে এবং তার কোষগুলো পচেগলে বা ভস্মীভূত হয়ে প্রকৃতিতে মিশে গেলে তার আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা ধ্বংস না হয়ে পারে কীভাবে।

বস্তুতঃ শরীর ও আত্মার ভিন্ন ধরনের অস্তিত্ব হওয়ার প্রতি দৃষ্টি না দেয়ার কারণেই এ ধরনের সংশয় সৃষ্টি হয়ে থাকে। এ সংশয় নিরসনের জন্য বিদ্যুত ও বিদ্যুতবাহী তারের উপমা দেয়া যেতে পারে। তারের মধ্য দিয়ে বিদ্যুত প্রবাহিত হয় এবং যতোক্ষণ পর্যন্ত বিদ্যুতপ্রবাহ অব্যাহত থাকে ততোক্ষণ পর্যন্ত তারের মধ্যে বিদ্যুত অবস্থান করে। কিন্তু বিদ্যুত তার ছাড়াও শূন্যস্থানের মধ্য দিয়ে (তরঙ্গ আকারে) প্রবাহিত হতে পারে (এবং যতোক্ষণ প্রবাহিত হয় ততোক্ষণ তা কোথাও না কোথাও অবস্থানও করে বটে) । আর তার ও বিদ্যুতের মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য যতোখানি বস্তুগত শরীর ও তাতে বিরাজিত আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য তার চেয়ে অনেক বেশী।

ব্যক্তিসত্তার অমরত্ব

মোদ্দা কথা , বিচারবুদ্ধির রায় অনুযায়ী , শরীরের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার ধ্বংস হয়ে যাওয়া অপরিহার্য নয় , বরং তার টিকে থাকাই অপরিহার্য। কারণ , মানবপ্রকৃতি এটাই দাবী করে।

মানুষমাত্রই অনন্তকাল টিকে থাকতে চায়। এই টিকে থাকার আকাঙ্ক্ষা মূলতঃ ব্যক্তিসত্তার টিকে থাকার আকাঙ্ক্ষা। এ কারণেই মানুষ বিকলাঙ্গ বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েও বেঁচে থাকতে চায়। এমনকি কোনো ব্যক্তি যদি পুরোপুরি সংজ্ঞাহারা হয়ে যায় এবং তার সংজ্ঞা ফিরে পাবার আর কোনোই সম্ভাবনা না থাকে তথাপি তার স্বজনরা চায় যে , সে ঐ অবস্থায় হলেও বেঁচে থাক। শুধু তা-ই নয় , কোনো সুস্থ ব্যক্তির কাছে যদি জানতে চাওয়া হয় যে , সে ঐ ধরনের অবস্থার শিকার হলে মৃত্যু বা ঐ ধরনের অবস্থায় বেঁচে থাকার মধ্যে কোনটিকে সে অগ্রাধিকার দেয় , তো সাধারণতঃ সে ঐ অবস্থায় হলেও বেঁচে থাকাকে অগ্রাধিকার দেয়। ঐ অবস্থায় ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা তার শরীরকে আশ্রয় করে অবস্থান করে বিধায়ই স্বজনরা তার ব্যক্তিসত্তাকে তাদের কাছে রাখতে চায় বলে এবং স্বয়ং তার ব্যক্তিসত্তাও স্বজনদের কাছে থাকতে চায় বিধায় ঐ অবস্থায় তাকে বাঁচিয়ে রাখাকে বা ঐ অবস্থায় বেঁচে থাকাকে অগ্রাধিকার প্রদান করে থাকে।

আমরা দেখতে পাই যে , শুধু মানুষের মধ্যে নয় , কম-বেশী স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী যে কোনো প্রাণশীল সৃষ্টির মধ্যে যতো ধরনের কামনা-বাসনা রয়েছে তার সব কিছুই পূরণের ব্যবস্থা বা সম্ভাবনা প্রাকৃতিক জগতে নিহিত রয়েছে। এ ধরনের কোনো প্রাণীর এমন কোনো অভাববোধ নেই যা পূরণের আয়োজন বা উপকরণাদি বা সম্ভাবনা প্রকৃতির বুকে নিহিত রাখা হয় নি। ক্ষুধার জন্য খাদ্য , পিপাসার জন্য পানি , শোনার জন্য সুন্দর সুর , দেখার জন্য মনোরম দৃশ্য , ঘ্রাণ নেয়ার জন্য সুগন্ধি , স্পর্শ করার জন্য মোলায়েম বা পুলকসঞ্চারক বা আরামদায়ক উপায়-উপকরণ , ঊষ্ণতা ও শীতলতা , নারীর যৌন কামনা পূরণের জন্য পুরুষ ও পুরুষের যৌন কামনা পূরণের জন্য নারী ইত্যাদি প্রতিটি কামনা-বাসনা পূরণের জন্যই উপায়-উপকরণ বা সম্ভাবনা নিহিত রাখা হয়েছে। বিশেষ করে মানুষের মধ্যে এমনকি মাছের মতো ডুবে থাকার , পাখীর মতো ওড়ার , শুধু তা-ই নয় , নক্ষত্রলোকে উপনীত হবার আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি সে সব সম্ভব হওয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।

এমতাবস্থায় , মানুষ তার ব্যক্তিসত্তার অমরত্ব কামনা করে , অথচ তা অমর হবে না , বরং শরীরের মৃত্যুর সাথে সাথেই তার ব্যক্তিসত্তার বিলুপ্তি ঘটবে - এটা হতেই পারে না ; এটা কেউ ভাবতেই পারে না।

এমনকি যারা দাবী করে যে , শরীরের মৃত্যুর সাথে সাথেই ব্যক্তিসত্তা ধ্বংস হয়ে যায় তাদেরও অবচেতন মনে ব্যক্তিসত্তার অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। শুধু আকাঙ্ক্ষা নয় , বরং অবচেতন মনে তারাও ব্যক্তিসত্তার অমরত্বে প্রত্যয় পোষণ করে। এ কারণেই দেখা যায় , সারা জীবন সৃষ্টিকর্তা ও আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে এমন বস্তুবাদী নাস্তিক ব্যক্তিরাও মৃত্যুশয্যায় অস্থির ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে , ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে ; মৃত্যুবরণ করতে ভয় পায়। কেন তাদের এ অস্থিরতা ও আতঙ্ক ? কিসের ভয় তাদের ? মৃত্যুতে ব্যক্তিসত্তার বিলুপ্তি ঘটলে তো মৃত্যুতে ভয়ের কিছুই নেই। বরং সুখ-দুঃখের পৃথিবীতে বেঁচে থেকে সুখের লোভে দুঃখ পাওয়ার সম্ভাবনাজনিত দুশ্চিন্তা বয়ে বেড়াবার চেয়ে মরে গিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়াই তো উত্তম।

আসলে মুখে অস্বীকার করলেও সচেতনভাবে বা অবচেতন মনে তারা আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার অমরত্বে প্রত্যয় পোষণ করে। এ কারণেই , মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক অজানা নতুন জগতে প্রবেশ করতে তারা ভয় পায়। কারণ , যে কোনো নতুন ও অজানা জায়গায় ও পরিবেশে প্রবেশ করতে গিয়ে ভয় পাওয়া মানবপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য। এ কারণেই তারা ভয় পায়।

বস্তুতঃ শুধু মরতে না চাওয়ার মধ্যে নয় , এমনকি মরতে চাওয়ার মধ্যেও আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার অমরত্বের প্রমাণ নিহিত রয়েছে।

মানুষ কখন আত্মহত্যা করে ? যখন সে কারো কাছ থেকে বা কোনো বিশেষ অবস্থা থেকে বাঁচতে চায় তখন সে আত্মহত্যা করে। যেহেতু সশরীরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি , সমষ্টি , অবস্থা বা পরিস্থিতি থেকে পলায়ন করা সম্ভব নয় সেহেতু আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা আত্মহত্যা করে দেহের কারাগার থেকে নিজেকে মুক্ত করে সংশ্লিষ্ট কষ্টদায়ক ব্যক্তি বা সমষ্টির ধরাছোঁয়ার বাইরে বা বিশেষ পরিবেশ-পরিস্থিতির বাইরে পালিয়ে যেতে চায়। অর্থাৎ সে তার ব্যক্তিসত্তাকে শরীর থেকে স্বতন্ত্র ও অমর গণ্য করে বলেই আত্মহত্যা করে , যদিও সে সব সময় এ সম্বন্ধে সচেতন থাকে না।


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13