বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্0%

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্ লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 20505
ডাউনলোড: 3122

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 18 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 20505 / ডাউনলোড: 3122
সাইজ সাইজ সাইজ
বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মৃত্যুপারের জীবন সম্পর্কে মানুষের ঔৎসুক্য চিরন্তন। এ ঔৎসুক্যের পরিপূর্ণ নিবৃত্তি জীবদ্দশায় সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব নয় জেনেও মানুষ কখনোই এ বিষয়ে জানার আগ্রহ পরিত্যাগ করতে পারে না। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মে যেমন বিভিন্ন ধারণা দেয়া হয়েছে, তেমনি এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা তথ্য ও কল্পনা। তাই এ ব্যাপারে সম্ভব সর্বাধিক মাত্রায় সঠিক ধারণার প্রয়োজনীয়তা সব সময়ই অনুভূত হয়ে আসছে।

ইসলামী মতে, সাধারণভাবে মৃত্যুপরবর্তী সময়ের দু’টি পর্যায় রয়েছে : মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত সময় এবং পুনরুত্থান পরবর্তী সময় অর্থাৎ শেষ বিচার ও তদ্পরবর্তী জান্নাতী বা জাহান্নামী অনন্ত জীবন। পুনরুত্থান, শেষ বিচার এবং বেহেশত বা দোযখ বাস তথা আখেরাতের ওপর ঈমান পোষণ ইসলামের মৌলিক চৈন্তিক ভিত্তি (উছূলে ‘আক্বাএদ্)-এর অন্যতম। এ কারণে এ সম্পর্কে কোরআন মজীদে বিস্তারিত বক্তব্য রয়েছে।

কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে আালামে বারযাখ্

বারযাখ্ ও আালামে বারযাখ্

মৃত্যুপরবর্তী ও পুনরুত্থানপূর্ববর্তী সময়ে মানুষের আত্মা বা নাফ্স্ (ব্যক্তিসত্তা) যে অবস্থায় থাকে ইসলামী আক্বাএদের বিশেষজ্ঞগণ একে আালামে বারযাখ্ নামকরণ করেছেন। বাংলা ভাষায় আমরা একে অন্তর্বতী জগত ’ বা অন্তর্বর্তীকালীন জগত ’ এবং ইংরেজীতেIntermediate World বলতে পারি।

বারযাখ্ (برزخ ) শব্দের আভিধানিক অর্থ বাধা ’ , বা অন্তরায় ’ । কোরআন মজীদের সূরাহ্ আর্-রাহমান্-এ শব্দটি এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ্ রাব্বুল্ আালামীন্ এরশাদ করেন :

) مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ يَلْتَقِيَانِ. بَيْنَهُمَا بَرْزَخٌ لا يَبْغِيَانِ(

“ তিনি পরস্পরমিলিত দুই সমুদ্রকে প্রবাহিত করেছেন ; (কিন্তু) এতদুভয়ের মাঝে রয়েছে (এমন এক) অন্তরায় (বারযাখ্) এতদুভয় যা অতিক্রম করতে পারে না। ” (১৯-২০)

এখানে যে বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা আমাদের আলোচ্য বিষয়ের জন্য অপরিহার্য নয়। কারণ , যেখানেই দু টি সমুদ্র পরস্পর মিলিত হয়েছে সেখানে উভয় সমুদ্রের পানি স্বীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে অবস্থান করছে এবং কোনো তৃতীয় মিশ্রিত রূপ ধারণ করছে না। বিশেষ করে যেখানে দু টি সমুদ্রের একটি মিঠা পানির ও একটি লোনা পানির এবং উভয়টির পানির রঙে পার্থক্য আছে সেখানে এ অবস্থাটি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। এ ব্যাপারে অনেকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকতে পারে।

তবে এখানে বারযাখ্ ” শব্দের ব্যবহার থেকে সুস্পষ্ট যে , এ অন্তরায় কোনো কঠিন বস্তুর অন্তরায় নয়। উদাহরণস্বরূপ , কোনো নদীর ওপর বাঁধ দিলে তার দুই অংশের মধ্যে যে ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি হয় এখানে তদ্রূপ কোনো অন্তরায়ের কথা বলা হয় নি। বরং এ অন্তরায় হচ্ছে সৃষ্টিপ্রকৃতিগত অন্তরায় , যেমন : তেল আর পানি উভয়ই তরল পদার্থ হওয়া সত্ত্বেও স্বাভাবিকভাবে পরস্পর মিশ্রিত হয় না।

কোরআন মজীদে সরাসরি , মিঠা পানি ও লোনা পানির সমুদ্রের পরস্পর মিশ্রিত না হওয়ার পিছনে নিহিত কারণকেও বারযাখ্ ” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

) وَهُوَ الَّذِي مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ هَذَا عَذْبٌ فُرَاتٌ وَهَذَا مِلْحٌ أُجَاجٌ وَجَعَلَ بَيْنَهُمَا بَرْزَخًا وَحِجْرًا مَحْجُورًا(

“ তিনিই (আল্লাহ্) যিনি পরস্পরমিলিত দুই সমুদ্রকে প্রবাহিত করেছেন ; (এতদুভয়ের মধ্যে) এটি সুমিষ্ট তৃষ্ণানিবারক ও এটি লোনা বিস্বাদ। আর তিনি এতদুভয়ের মাঝখানে একটি অন্তরায় (বারযাখ্) ও অনতিক্রম্য অন্তরাল সৃষ্টি করেছেন। ” (সূরাহ্ আল্-ফুরক্বান্ : ৫৩)

আর আালামে বারযাখ্ হচ্ছে পার্থিব জগত ও পুনরুত্থানপরবর্তী জগতের মাঝখানে উভয় থেকে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী একটি জগত। এ কারণেই এর নামকরণ করা হয়েছে আালামে বারযাখ্।

কোরআন মজীদে অন্যত্র এরশাদ হয়েছে যে , কাফেররা যখন মৃত্যুমুখে পতিত হয় তখন তারা যথাযথ আমল করার জন্য পুনরায় তাদেরকে পার্থিব জীবনে ফেরত পাঠানোর জন্য আল্লাহ্ তা আলার কাছে আবেদন জানায়। কিন্তু আল্লাহ্ তা আলা তাদের সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন এবং এর ফলে তাদের পক্ষে আর পার্থিব জীবনে ফিরে আসা সম্ভব হয় না। কারণ , এরশাদ হয়েছে :

) وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ(

“ আর পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত তাদের পশ্চাতে রয়েছে এক অন্তরায় (বারযাখ্) । ” (সূরাহ্ আল্-মু ’ মিনূন্ : ১০০)

অর্থাৎ পার্থিব জগত ও পুনরুত্থানপরবর্তী জগতের মাঝখানে একটি অন্তরায় রয়েছে যা তাদেরকে পার্থিব জগতে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দিচ্ছে না , বরং তাদেরকে পুনরুত্থান দিবসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

এ থেকেই এ অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থাকে আালামে বারযাখ্ নামকরণ করা হয়েছে।

আালামে বারযাখ্ : জাগ্রত জগত

আালামে বারযাখ্ যে ঘুমন্ত জগত নয় এবং মৃত ব্যক্তির আত্মা সেখানে তার বস্তুদেহের ন্যায় মৃত নয় তা কোরআন মজীদ থেকেই জানা যায়। এরশাদ হয়েছে :

) وَلا تَقُولُوا لِمَنْ يُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتٌ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلَكِنْ لا تَشْعُرُونَ(

আর যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে নিহত হয় তাকে মৃত বলো না। বরং সে জীবিত ; কিন্তু তোমরা তা অনুভব করতে পারো না। ” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ১৫৪)

কিন্তু আল্লাহর পথে নিহত ব্যক্তিদেরকে যে জীবিত বলা হয়েছে তা কেবল সম্মানার্থে নয়। কারণ , মৃত্যুর পরে ও পুনরুত্থানের পূর্বে ব্যক্তিদের পার্থিব জীবনের কর্মের ভিত্তিতে কম-বেশী পুরষ্কার ও শাস্তি প্রদান সম্পর্কে কোরআন মজীদে সুস্পষ্ট উক্তি রয়েছে - যা থেকে প্রমাণিত হয় যে , এ পুরষ্কার ও শাস্তি শুধু ভালো-মন্দের স্বাভাবিক মনস্তাত্বিক প্রতিক্রিয়া মাত্র নয়। বরং সৃষ্টিলোকের ব্যবস্থাপনাগত দিকের বিচারেই ভালো ও মন্দ লোকের প্রতীক্ষাকালীন পরিবেশ ভিন্ন হতে বাধ্য। বিশেষ করে যারা পার্থিব জীবনে যথাযথ আমল সম্পাদনের ক্ষেত্রে অগ্রসর তাঁদের জন্য প্রতীক্ষাকালে অর্থাৎ আালামে বারযাখে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে বিশেষ নে ‘ আমতের ব্যবস্থা থাকা খুবই স্বাভাবিক। কোরআন মজীদে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার রয়েছে।

যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছেন তাঁদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

) وَلا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ. فَرِحِينَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ وَيَسْتَبْشِرُونَ بِالَّذِينَ لَمْ يَلْحَقُوا بِهِمْ مِنْ خَلْفِهِمْ أَلا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلا هُمْ يَحْزَنُونَ(

“ আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে তাদেরকে তোমরা মৃত মনে করো না। বরং তারা তাদের রবের সামনে জীবিত ; তারা রিয্ক্ব্প্রাপ্ত হচ্ছে। আল্লাহ্ স্বীয় অনুগ্রহ থেকে তাদেরকে যা প্রদান করেছেন তাতে তারা আনন্দিত এবং তাদের পিছনে যারা রয়ে গেছে ও এখনো তাদের সাথে মিলিত হয় নি তাদের জন্য তারা আনন্দ উদযাপন করে - এ কারণে যে , তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হবে না। ” (সূরাহ্ আালে ইমরান্ : ১৬৯-১৭০)

এখানে সুস্পষ্ট যে , আল্লাহর রাস্তায় নিহত ব্যক্তিগণ (প্রচলিত পরিভাষায় যাদেরকে শহীদ ’ বলা হয়) আলমে বারযাখে রিয্ক্ব্ লাভ করে থাকেন এবং আনন্দ প্রকাশ করেন।

অন্য এক আয়াতে , দ্বীনের দাও ‘ আত্ প্রদান করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন এমন ব্যক্তি সম্বন্ধে এরশাদ হয়েছে :

) قِيلَ ادْخُلِ الْجَنَّةَ قَالَ يَا لَيْتَ قَوْمِي يَعْلَمُونَ بِمَا غَفَرَ لِي رَبِّي وَجَعَلَنِي مِنَ الْمُكْرَمِينَ(

“ তাকে বলা হলো : বেহেশতে প্রবেশ করো। তখন সে বললো : হায়! আমার ক্বওম্ যদি জানতে পারতো যে , কীসের জন্য আমার রব্ আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিতদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন! (সূরাহ্ ইয়া-সীন : ২৬-২৭)

কেউ কেউ মনে করেন যে , এটা শেষ বিচার পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে , কিন্তু তাঁদের এ ধারণা ঠিক নয়। কারণ , শেষ বিচারের ফয়ছ্বালা অনুযায়ী যারা বেহেশতবাসী ও যারা দোযখবাসী হবে তাদের সকলেরই পরস্পরের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের কারণ জানা থাকবে - জানা থাকবে যে , কেন আল্লাহ্ কাউকে ক্ষমা করবেন ও কেন আরেক জনকে ক্ষমা করবেন না। সুতরাং কারো সৌভাগ্য সম্পর্কে তার ক্বওমের জানা না থাকার কারণে সেখানে কারো আফসোস্ করার প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া শেষ বিচারের দিনে বা তার ফয়ছ্বালার পরে কেউ কোনো নাফরমানের গোমরাহী ও দুর্ভাগ্যের জন্য চিন্তা করবে না , বা আফসোস্ করবে না। বিশেষতঃ হাশরের ময়দানে উত্থিত হবার সাথে সাথেই আত্মীয়তার সম্পর্ক ও পারস্পরিক দরদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে এবং এ জন্য কোনোই অনুভূতি থাকবে না। দ্বিতীয়তঃ চূড়ান্ত ফয়ছ্বালার পরে আফসোস পুরোপুরি অর্থহীন ; আর বেহেশতবাসীরা এ কাজ করতে পারেন না। কারণ , সাধারণতঃ আফসোসের সাথে জড়িত থাকে সংশোধনের আশা অর্থাৎ তারা যদি জানতে পারতো তাহলে নিজেদেরকে সংশোধন করতো। (অবশ্য দোযখবাসীরা নিজেদের অতীত কর্মের জন্য আফসোস্ করবে।)

সুতরাং , এটা যে আালামে বারযাখের বিষয় - যেখানকার অবস্থা সম্পর্কে জীবিত লোকদের জানা থাকে না , তাতে সন্দেহ নেই। উক্ত আয়াত দু টির পরবর্তী দুই আয়াত থেকেও তা-ই প্রমাণিত হয়। কারণ , পরবর্তী দুই আয়াতে (২৮-২৯) তাঁর পরে তাঁর ক্বওমকে বজ্রাঘাতের দ্বারা ’ হত্যা করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁকে যখন বেহেশতে প্রবেশ করতে বলা হয় এবং তিনি তাঁর ক্বওমের লোকদের জন্য আফসোস করেন তখন তাঁর ক্বওমের লোকেরা দুনিয়ার বুকে বেঁচে ছিলো।

আল্লাহর রাস্তায় নিহতদের চেয়ে অগ্রবর্তী যারা

এখানে উল্লেখ্য যে , কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে আল্লাহ্ তা আলার নৈকট্যের ক্ষেত্রে আল্লাহর রাস্তায় নিহত ব্যক্তিগণ অগ্রবর্তী দলের অন্তর্ভুক্ত নন , বরং তাঁরা হচ্ছেন অগ্রবর্তীদের অব্যবহিত পরবর্তী দল। কারণ , এরশাদ হয়েছে :

) وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا(

“ আর যারাই আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য করে তারা তাদের সাথে থাকবে যাদের ওপর আল্লাহ্ নে ‘ আমত বর্ষণ করেছেন ; তারা (নে ‘ আমতপ্রাপ্তগণ) হচ্ছে নবীগণ , ছ্বিদ্দীক্বগণ , শহীদগণ ও ছ্বালেহ্গণ এবং বন্ধু হিসেবে তারাই উত্তম। ” (সূরাহ্ আন্-নিসা ’ : ৬৯)

এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে , আল্লাহ্ তা আলার নে ‘ আমতপ্রাপ্ত হচ্ছেন চার দল এবং আমরা প্রতি রাক্ ‘ আত্ নামাযে (সূরাহ্ ফাতেহায়) আমাদেরকে যে নে ‘ আমতপ্রাপ্তদের পথে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহ্ তা আলার কাছে আবেদন জানাই তাঁরা হচ্ছেন এই চার দল এবং উপরোক্ত আয়াত অনুযায়ী পরকালীন জীবনে তাঁদের সাথে থাকতে পারাটা হবে বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়।

উপরোক্ত আয়াতে উল্লিখিত চার দল লোকের যে উল্লেখ করা হয়েছে তা কা ’ দের বেলা প্রযোজ্য কতক ক্ষেত্রে সে ব্যাপারে মতপার্থক্য আছে। তবে এটা নিশ্চয়তার সাথে বলা চলে যে , যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হন (কোরআন নাযিল সমাপ্ত হবার অনেক পরে যাদের জন্য শহীদ ’ পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে) তাঁরা এ অগ্রবর্তী চার দলের অন্তর্ভুক্ত নন , বরং যারা আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য করেন ’ তাঁদের ন্যায় আল্লাহর রাস্তায় নিহত ব্যক্তিগণও বেহেশতে উপরোক্ত নে ‘ আমতপ্রাপ্তদের সাহচর্য লাভ করে ধন্য হবেন।

নবীগণ ( আঃ) ছিলেন তাঁরা যারা মানুষের হেদায়াতের জন্য আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে মনোনীত - যাদের কাছে দ্বীন ও শরী ‘ আত্ সম্পর্কিত ওয়াহী নাযিল হতো। কোরআন মজীদে আল্লাহ্ তা আলা হযরত ইবরাহীম ( আঃ)-এর বংশধরদের [আালে মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)ও যাদের অন্তর্ভুক্ত] মধ্যকার নিষ্পাপ লোকদেরকে ইমাম মনোনীত করার অঙ্গীকার করেছেন। কিন্তু উপরোক্ত আয়াতে নিষ্পাপ ইমামগণের ( আঃ) কথা স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা হয় নি। সম্ভবতঃ এ কারণে তা উল্লেখ করা হয় নি যে , তাঁরা নবীগণের স্থলাভিষিক্ত ; কেবল তাঁদের ওপর দ্বীন ও শরী ‘ আত্ সংক্রান্ত নতুন ওয়াহী নাযিল না হওয়া (মওজূদ্ ওয়াহী যথেষ্ট বিবেচিত হওয়ায়) ব্যতীত নিষ্পাপত্ব ও অন্যান্য গুণাবলী এবং দায়িত্ব-কর্তব্যের ক্ষেত্রে তাঁদের ও নবীগণের ( আঃ) মধ্যে কোনোই পার্থক্য নেই। সম্ভবতঃ একই কারণে উক্ত আয়াতে রাসূলগণের ( আঃ) কথাও স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা হয় নি। সুতরাং এখানে নবীগণ ’ বলতে রাসূলগণ এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী-রাসূলগণের ( আঃ) স্থলাভিষিক্ততার জন্য মনোনীত নিষ্পাপ ইমামগণ ( আঃ)ও শামিল রয়েছেন।

উক্ত আয়াতে ছ্বিদ্দীক্বীন্ ” শব্দটির মূল ছ্বিদ্দীক্ব্ ” এবং এটি কাজের পুনরাবৃত্তি নির্দেশক (صيغة مبالغة ) ; এর দ্বারা এমন ব্যক্তিদেরকে বুঝানো হয় যারা কথায় ও কাজে সত্যবাদী। কাজে সত্যবাদী বলতে এটাই বুঝায় যে , তাঁদের কাজ তাঁদের কথার অনুরূপ। কারণ , আমল হচ্ছে ব্যক্তির চিন্তা-বিশ্বাসের নিদর্শন। যে ব্যক্তি সত্য কথা বলেন তিনি তাঁর অন্তরের খবর প্রকাশ করেন। তেমনি কথার সত্যতার মানে এ-ও যে , তাঁর যে কোনো কথায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রকৃত অবস্থার প্রতিফলন ঘটবে। আর যেহেতু কথাও এক ধরনের আমল সেহেতু তিনি যা সঠিক বলে মনে করেন এবং সত্য বলে জানেন কেবল তা-ই বলবেন। তাই তাঁর দেয়া তথ্যে তথ্য ও তথ্য প্রদানকারী উভয়ের সত্যতাই একত্রিত হবে। সুতরাং ছ্বিদ্দীক্ব্ হচ্ছেন ঐ ব্যক্তি যিনি কখনোই মিথ্যা বলেন না এবং সঠিক কাজ ব্যতীত কোনো কাজ করেন না। তিনি প্রবৃত্তির অনুসরণ ব্যতীতই যা কিছু সত্য বলে জানেন তা-ই বলেন এবং সত্য ব্যতীত কিছু দেখেন না। সুতরাং তিনি সব কিছুর প্রকৃত অবস্থা দেখতে পান , সত্য কথা বলেন এবং ন্যায় কাজ সম্পাদন করেন।

উক্ত আয়াত সহ কোরআন মজীদে যেشُّهَدَاءِ (শুহাদা ’ ) শব্দের উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছেشهيد (শাহীদ্) শব্দের বহুবচন। আভিধানিক অর্থে শাহীদ্ মানে কোনো কিছুর মূর্ত প্রতীক এবং কোরআন মজীদের পরিভাষায় এর মানে ইসলামের মূর্ত প্রতীক বা মানদণ্ড - যার মানদণ্ডে অন্যদের ভালো-মন্দের অবস্থা পরিমাপ করা হবে। তাই স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)ও শাহীদ। আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

( وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا(

“ আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যম পন্থানুসারী আদর্শিক জনগোষ্ঠী বানিয়েছি যাতে তোমরা মানব জাতির জন্য (ইসলামের) মূর্ত প্রতীক হও এবং রাসূল হন তোমাদের জন্য (ইসলামের) মূর্ত প্রতীক। ” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ১৪৩)

আরصالِحِينَ (ছ্বালেহীন্) হচ্ছেصالِح (ছ্বালেহ্) শব্দের বহুবচন। ছ্বালেহ্ শব্দের প্রকৃত অর্থ উপযুক্ত ’ বা যথাযথ ’ । তাঁরা একজন মুসলমানের যা করা উচিত ঠিক তা-ই করেন এবং যা বর্জন করা উচিত তা বর্জন করেন। এ অর্থেই বাংলায় এ শব্দটির অর্থ করা হয় নেককার। তাঁদের যোগ্যতা ও গুণাবলী কোরআনিক পরিভাষার ছিদ্দীক্ব্ ও শাহীদগণের তুলনায় সীমিত , কিন্তু তাঁরা তাঁদের যোগ্যতা ও গুণাবলী অনুযায়ী দায়িত্ব-কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করে থাকেন।

উপরোক্ত আয়াত (সূরাহ্ আন্-নিসা ’ : ৬৯) নিয়ে এতো বিস্তারিত আলোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে এটাই প্রমাণ করা যে , যেহেতু আল্লাহর রাস্তায় নিহত ব্যক্তিগণ (প্রচলিত পরিভাষায় যাদেরকে শহীদ ’ বলা হয়) - যাদের নিষ্পাপত্বের কোনো নিশ্চয়তা নেই , তাঁরাই যখন আালামে বারযাখে আল্লাহ্ তা আলার কাছে জীবিত ও রিয্ক্ব্প্রাপ্ত এবং আনন্দে মশগূল্ তখন তাঁদের অগ্রবর্তী চারটি দলভুক্ত ব্যক্তিগণ আালামে বারযাখে আল্লাহ্ তা আলার কাছে জীবিত ও রিয্ক্ব্প্রাপ্ত হবেন না বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে এটা অসম্ভব ব্যাপার। কারণ , সুস্থ বিচারবুদ্ধির রায় হচ্ছে এই যে , অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি যে কাম্য সুযোগ-সুবিধার অধিকারী অপেক্ষাকৃত বেশী যোগ্যতার অধিকারী সে কাম্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন না , ঠিক যেভাবে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতর অপরাধে অপরাধী ব্যক্তি শাস্তিযোগ্য হলে অপেক্ষাকৃত গুরুতর অপরাধে অপরাধী ব্যক্তি অবশ্যই শাস্তিযোগ্য হবে।

বারযাখী বেহেশত সকল নেককারের জন্য

‘ আালামে বারযাখে জীবিত থাকা ও রিয্ক্ব্ লাভ করা যে কেবল আল্লাহর রাস্তায় নিহত ব্যক্তিদের জন্য কোনো ব্যতিক্রমী অনুগ্রহ এমনটি মনে করার কারণ নেই। কারণ , স্বয়ং কোরআন মজীদেও আল্লাহর রাস্তায় নিহত হন নি এমন লোকদের জন্যও এ ধরনের অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

) وَالَّذِينَ هَاجَرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ ثُمَّ قُتِلُوا أَوْ مَاتُوا لَيَرْزُقَنَّهُمُ اللَّهُ رِزْقًا حَسَنًا وَإِنَّ اللَّهَ لَهُوَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ. لَيُدْخِلَنَّهُمْ مُدْخَلا يَرْضَوْنَهُ وَإِنَّ اللَّهَ لَعَلِيمٌ حَلِيمٌ(

“ আর যারা আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করেছে , অতঃপর নিহত হয়েছে বা মৃত্যুবরণ করেছে আল্লাহ্ অবশ্যই তাদেরকে উত্তম রিয্ক্ব্ প্রদান করবেন। আর অবশ্যই আল্লাহ্ রিয্ক্ব্দাতাদের মধ্যে সর্বোত্তম। তিনি অবশ্যই তাদেরকে এমন এক স্থানে প্রবেশ করাবেন যা তারা পসন্দ করবে এবং অবশ্যই আল্লাহ্ সদাজ্ঞানী ও সহনশীল। ” (সূরাহ্ আল্-হাজ্ব্ : ৫৮-৫৯)

এখানে মৃত্যুপরবর্তী রিযক্বের অঙ্গীকার শুধু আল্লাহর রাস্তায় নিহতদের জন্যই করা হয় নি , বরং মুহাজিরদের জন্যও (ইখ্লাছ্ব ও আমলের শর্ত উহ্য) করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর জন্য হিজরতকারী ব্যক্তি নিহত না হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করলেও (কোনো বড় ধরনের গুনাহ্ না করে থাকলে) তাঁকেও আালামে বারযাখে রিয্ক্ব্ দেয়া হবে।

এখানে এ অঙ্গীকারকে শেষ বিচার পরবর্তী বেহেশতের অঙ্গীকার মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ , বিভিন্ন আয়াতে যেখানে শেষ বিচার পরবর্তী বেহেশতের অঙ্গীকারের সাথে সাথে তার বিভিন্ন আকর্ষণীয় গুণবৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে বা বিভিন্ন নে ‘ আমতের বর্ণনা দেয়া হয়েছে তার বিপরীতে এখানে স্রেফ উত্তম রিয্ক্ব্ ও পসন্দনীয় স্থানে প্রবেশ করানোর সীমিত নে ‘ আমতের অঙ্গীকার করা হয়েছে অর্থাৎ সীমিত নে ‘ আমত বিশিষ্ট বেহেশতের অঙ্গীকার করা হয়েছে।

অন্য এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

) فَلْيُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يَشْرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا بِالآخِرَةِ وَمَنْ يُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيُقْتَلْ أَوْ يَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا(

“ সুতরাং যারা পরকালের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন বিক্রয় করে দিয়েছে তারা যেন আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে ; অতঃপর সে নিহতই হোক বা বিজয়ীই হোক , সে ক্ষেত্রে অচিরেই ’ আমি তাকে বিরাট পুরষ্কার প্রদান করবো। ” (সূরাহ্ আন্-নিসা ’ : ৭৪)

এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে , আল্লাহর রাস্তায় নিহত ব্যক্তিদেরকে আল্লাহ্ তা আলা যে পুরষ্কার প্রদান করেন সে জন্য ঐ ব্যক্তিকে শেষ বিচারের দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না , বরং অচিরেই ’ অর্থাৎ আালামে বারযাখেই প্রদান করা হয় - যা ইতিপূর্বে উল্লিখিত বিভিন্ন আয়াত থেকেও প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু অত্র আয়াত থেকে এ-ও প্রমাণিত হয় যে , এ পুরষ্কার বিশেষভাবে কেবল আল্লাহর রাস্তায় নিহত ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত নয় , বরং আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে যারা বিজয়ী হয়েছেন তাঁরাও এর মধ্যে শামিল আছেন। অর্থাৎ বারযাখী জীবন ও সে জীবনের রিয্ক্ব্ কেবল আল্লাহর রাস্তায় নিহত ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত কোনো ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা নয়।

আল্লাহ্ তা আলা প্রশান্ত চিত্ত (নাফ্সুল্ মুত্বমাইন্নাহ্)-এর অধিকারী লোকদের মৃত্যুর সাথে সাথে সরাসরি জান্নাতে প্রবেশের কথা বলেছেন ; এরশাদ হয়েছে :

) يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً فَادْخُلِي فِي عِبَادِي وَادْخُلِي جَنَّتِي(

হে প্রশান্ত ব্যক্তিসত্তা! তুমি তোমার রবের দিকে প্রত্যাবর্তন কর সন্তুষ্ট ও সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত অবস্থায় , অতঃপর আমার বান্দাহদের মধ্যে প্রবেশ কর এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর। ” (সূরাহ্ আল্-ফাজর্ : ২৭-৩০)

কোরআন মজীদের আরো বহু আয়াতে আল্লাহর দিকে বান্দাহর প্রত্যাবর্তন করা বলতে তার মৃত্যুবরণকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং এর পর পরই যে বেহেশতে প্রবেশ করতে বলা হয় তা হচ্ছে বারযাখী বেহেশত।

অপর এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

) جَنَّاتُ عَدْنٍ يَدْخُلُونَهَا تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الأنْهَارُ لَهُمْ فِيهَا مَا يَشَاءُونَ كَذَلِكَ يَجْزِي اللَّهُ الْمُتَّقِينَ. الَّذِينَ تَتَوَفَّاهُمُ الْمَلائِكَةُ طَيِّبِينَ يَقُولُونَ سَلامٌ عَلَيْكُمُ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ(

“ অবিনশ্বর জান্নাত্ যাতে তারা প্রবেশ করবে - যার তলদেশ দিয়ে নহর সমূহ প্রবাহিত হচ্ছে ; সেখানে তাদের জন্য রয়েছে তারা যা কিছু ইচ্ছা করবে। এভাবেই আল্লাহ্ সেই মুত্তাক্বীদেরকে প্রতিদান দেবেন ফেরেশতারা যাদেরকে এ কথা বলতে বলতে উত্তম অবস্থায় মৃত্যু প্রদান করবে যে , তোমাদের ওপর সালাম ; তোমরা যে আমল সম্পাদন করছিলে সে জন্য জান্নাতে প্রবেশ কর। ” (সূরাহ্ আন্-নাহল্ : ৩১-৩২)

এখানে উদ্ধৃত আয়াত দু টির প্রথম দিকে অবিনশ্বর জান্নাতের কথা বলা হয়েছে এবং দ্বিতীয়টিতে এ জান্নাতের অধিবাসীদের মৃত্যুকালীন ও মৃত্যুর অব্যবহিত পরবর্তী অবস্থার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ উদ্ধৃত দ্বিতীয় আয়াত অনুযায়ী তাঁদেরকে মৃত্যুর সাথে সাথে সরাসরি বারযাখী বেহেশতে প্রবেশ করতে বলার কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

নাফরমানদের জন্য বারযাখী দোযখ

কোরআন মজীদে শুধু নেককারদের বারযাখী বেহেশতে নে ‘ আমত্ লাভের কথাই বলা হয় নি , বরং নাফরমানদের বারযাখী দোযখে প্রবেশ ও শাস্তিভোগের কথাও বলা হয়েছে। যেমন , নিম্নোক্ত আয়াত সমূহে আালামে বারযাখে নাফরমানদের শাস্তি ও নেককারদের পুরষ্কারের কথা পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়েছে :

) يَوْمَ يَرَوْنَ الْمَلائِكَةَ لا بُشْرَى يَوْمَئِذٍ لِلْمُجْرِمِينَ وَيَقُولُونَ حِجْرًا مَحْجُورًا. وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْثُورًا. أَصْحَابُ الْجَنَّةِ يَوْمَئِذٍ خَيْرٌ مُسْتَقَرًّا وَأَحْسَنُ مَقِيلا(

“ যেদিন তারা ফেরেশতাদেরকে দেখতে পাবে সেদিন অপরাধীদের জন্য কোনো সুসংবাদ থাকবে না এবং তারা (গুনাহ্গাররা) বলবে : অন্তরাল দ্বারা আড়াল (আহা! কোনো অন্তরাল দ্বারা যদি এ অবস্থাটা আড়াল হতো)! আর তারা যে সব (নেক) আমল করেছে আমি সেগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেবো এবং সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করে দেবো। (অন্যদিকে) সেদিন বেহেশতবাসীরা উত্তম অবস্থানস্থল ও উৎকৃষ্টতর কথোপকথনের অধিকারী হবে। ” (সূরাহ্ আল্-ফুরক্বান্ : ২২-২৪)

এখানে সুস্পষ্ট যে , উক্ত তিনটি আয়াতে মৃত্যু ও তার অব্যবহিত পরবর্তী সময়ের কথা বলা হয়েছে। কারণ , সকল মানুষ মৃত্যুর সময় সমুপস্থিত হলে ফেরেশতাদেরকে দেখতে পাবে। তার আগে কারো পক্ষে ফেরেশতাদেরকে দেখতে পাওয়ার বিষয়টি একান্তই বিরল ব্যতিক্রম। তাছাড়া এর পরবর্তী পাঁচটি আয়াতে (২৫-২৯) ক্বিয়ামতের মহাপ্রলয় ও হাশরের মাঠে কাফেরদের বিলাপের কথা স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা হয়েছে - যা থেকে প্রমাণিত হয় যে , উপরোক্ত তিনটি আয়াতে তার পূর্ববর্তী অবস্থা অর্থাৎ মৃত্যু ও তার অব্যবহিত পরবর্তী অবস্থার কথা বলা হয়েছে।

অপর এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

) وَلَوْ تَرَى إِذِ الظَّالِمُونَ فِي غَمَرَاتِ الْمَوْتِ وَالْمَلائِكَةُ بَاسِطُو أَيْدِيهِمْ أَخْرِجُوا أَنْفُسَكُمُ الْيَوْمَ تُجْزَوْنَ عَذَابَ الْهُونِ بِمَا كُنْتُمْ تَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ غَيْرَ الْحَقِّ وَكُنْتُمْ عَنْ آيَاتِهِ تَسْتَكْبِرُونَ(

“ (হে রাসূল!) আপনি যদি দেখেন (তো দেখবেন যে) , যালেমরা যখন মৃত্যুযন্ত্রণায় থাকে , আর ফেরেশতারা তাদের হস্তসমূহ প্রসারিত করে দেয় (এবং তাদেরকে বলে) : তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে (তোমাদের নাফ্স্ সমূহকে) বহির্গত করে দাও ; আজ তোমাদেরকে অপমানজনক শাস্তি দেয়া হবে , এ কারণে যে , তোমরা আল্লাহ্ সম্পর্কে অসত্য কথা বলতে এবং তাঁর আয়াত সম্বন্ধে অহঙ্কার প্রদর্শন করতে। ” (সূরাহ্ আল্-আন্ ‘ আাম্ : ৯৩)

এখানে আজ ’ (الْيَوْمَ ) শব্দের ব্যবহার থেকে সুস্পষ্ট যে , এখানে শেষ বিচার পরবর্তী শাস্তির কথা বলা হয় নি , বরং মৃত্যুপরবর্তী অর্থাৎ আালামে বারযাখের শাস্তির কথা বলা হয়েছে।

‘ আালামে বারযাখে আালে ফির ‘ আউনের শাস্তি সম্পর্কিত আয়াতে এ বিষয়টি আরো সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

) فَوَقَاهُ اللَّهُ سَيِّئَاتِ مَا مَكَرُوا وَحَاقَ بِآلِ فِرْعَوْنَ سُوءُ الْعَذَابِ النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آلَ فِرْعَوْنَ أَشَدَّ الْعَذَابِ(

“ অতঃপর আল্লাহ্ তাকে (ফির ‘ আউনের ক্বওমের মু ’ মিন ব্যক্তিকে) তাদের ষড়যন্ত্রের অপকৃষ্টতা হতে রক্ষা করলেন এবং আালে ফির ‘ আউনকে নিকৃষ্ট আযাব্ গ্রাস করলো , তা হচ্ছে আগুন (দোযখ)- যার ওপরে তাদেরকে সকালে ও সন্ধ্যায় পেশ করা হয়। আর যেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে সেদিন (আল্লাহ্ ফেরেশতাদেরকে আদেশ করবেন) : আালে ফির ‘ আউনকে কঠিনতম শাস্তিতে প্রবেশ করাও। ” (সূরাহ্ আল্-মু ’ মিন্/ আল্-গ্বফির্ : ৪৫-৪৬)

এখানে পর পর দু ধরনের শাস্তির উল্লেখ থেকে সুস্পষ্ট যে , প্রথম বারের শাস্তি শেষ বিচার পরবর্তী শাস্তি নয় অর্থাৎ আালামে বারযাখের শাস্তি।

হযরত নূহ্ ( আঃ) ও হযরত লূত্ব্ ( আঃ)-এর স্ত্রীদ্বয় প্রসঙ্গে নাযিলকৃত এক আয়াত থেকেও নাফরমানদের জন্য বারযাখী জাহান্নামের শাস্তির কথা জানা যায়। এরশাদ হয়েছে :

) ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلا لِلَّذِينَ كَفَرُوا اِمْرَأَةَ نُوحٍ وَامْرَأَةَ لُوطٍ كَانَتَا تَحْتَ عَبْدَيْنِ مِنْ عِبَادِنَا صَالِحَيْنِ فَخَانَتَاهُمَا فَلَمْ يُغْنِيَا عَنْهُمَا مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَقِيلَ ادْخُلا النَّارَ مَعَ الدَّاخِلِينَ(

“ যারা কাফের হয়েছে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ্ নূহের স্ত্রী ও লূত্বের স্ত্রীর উপমা দিয়েছেন ; তাদের উভয়ই আমার উপযুক্ত বান্দাহদের মধ্যকার দু জন বান্দাহর অধীনে (বিবাহাধীনে) ছিলো , কিন্তু তাদের উভয়ই তাদের উভয়ের (নূহের ও লূত্বের) সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। সুতরাং কোনো কিছুই তাদের দু জনকে আল্লাহ্ থেকে বেনিয়ায্ করতে (রক্ষা করতে) পারলো না। আর (তাদের উভয়কে) বলা হলো : উভয়ই (দোযখে) প্রবেশকারী অন্যান্য লোকদের সাথে দোযখে প্রবেশ কর। ” (সূরাহ্ আত্-তাহরীম্ : ১০)

এখানে সুস্পষ্ট যে , তাদের দোযখে প্রবেশের বিষয়টি ইতিমধ্যেই সংঘটিত বিষয় এবং একই সময় আরো যতো নাফরমান ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে তাদের জাহান্নামে প্রবেশের বিষয়টিও ইতিমধ্যেই সংঘটিত। অর্থাৎ এখানে বারযাখী দোযখের কথা বলা হয়েছে।

আত্মা সদাজাগ্রত

কোরআন মজীদের আলোকে ওপরে যে আলোচনা করা হলো তা থেকে সুস্পষ্ট যে , আালামে বারযাখ্ অর্থাৎ মৃত্যুপরবর্তী ও শেষ বিচার পূর্ববর্তী জগত কোনো ঘুমন্ত জগত নয় এবং সেখানে মৃত ব্যক্তিদের ব্যক্তিসত্তা বা আত্মা সমূহ ঘুমিয়ে নেই , বরং সুখে বা দুঃখে তথা বারযাখী বেহেশতে বা দোযখে আছে। অবশ্য তাদের শাস্তি ও নে ‘ আমতে ব্যক্তিভেদে পার্থক্য হবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া অনেকের ব্যক্তিসত্তা এমন অবস্থায় থাকাও স্বাভাবিক যাকে সুখ বা দুঃখ এতদুভয়ের কোনোটি হিসেবে আখ্যায়িত করা চলে না। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ব্যক্তিসত্তাগুলো সেখানে জাগ্রত। তাই বলা যেতে পারে যে , আালামে বারযাখ্ হচ্ছে জাগ্রত জগত।

তবে প্রশ্ন উঠতে পারে যে , আালামে বারযাখ্ কি কেবলই আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার জগত , নাকি সেখানে সে পার্থিব বস্তুদেহের বিকল্প কোনো ভিন্ন ধরনের দেহের অধিকারী থাকে এবং থাকলে সে দেহ ও পার্থিব দেহের মধ্যে কতোখানি মিল আছে ও কতোখানি অমিল আছে ? এ ব্যাপারে নিশ্চিত জবাব দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে ওপরে যে সব আয়াত উদ্ধৃত করা হয়েছে তা থেকে আালামে বারযাখের অস্তিত্ব অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় এবং এ-ও প্রমাণিত হয় যে , আালামে বারযাখ্ কথিত ঘুমের জগত ’ নয়।

এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে , প্রকৃত পক্ষে আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার জন্য ঘুমন্ত ’ কথাটি আদৌ প্রযোজ্য নয়। যদিও দেহধারী অবস্থায় ও দেহবিহীন অবস্থায় আত্মার সময় সংক্রান্ত অনুভূতিতে পার্থক্য হবে এটাই স্বাভাবিক , তেমনি আনন্দ ও বিষাদের অবস্থায়ও তার সময় সংক্রান্ত অনুভূতি অভিন্ন হয় না , তবে যে কোনো অবস্থায়ই তার জন্য ঘুমন্ত ’ অবস্থা অকল্পনীয়। কারণ , ঘুম হচ্ছে এক ধরনের বিশ্রাম - যা বস্তুদেহের জন্য অপরিহার্য। কর্মতৎপরতার কারণে ও সময়ের প্রবাহে দেহে যে ক্ষয় ও ক্লান্তির সৃষ্টি হয় তা পূরণের জন্য খাদ্য-পানীয়ের পাশাপাশি বিশ্রামেরও প্রয়োজন হয় , আর ঘুম হচ্ছে সর্বোচ্চ মানের বিশ্রাম। কিন্তু পার্থিব জগতে বস্তুদেহ ঘুমিয়ে পড়লেও আত্মার কর্মতৎপরতা পুরোপুরি স্থগিত হয়ে যায় না। কারণ , তাহলে মানুষ স্বপ্ন দেখতে পারতো না। বলা বাহুল্য যে , স্বপ্ন সম্পূর্ণরূপে নাফ্স্ বা আত্মার কাজ। কারণ , ঘুমন্ত ব্যক্তির শারীরিক ইন্দ্রিয়নিচয় কর্মতৎপরতা থেকে পুরোপুরি বিরত থাকে। তা সত্ত্বেও সে স্বপ্ন দেখতে পায়। অতএব , নিঃসন্দেহে তা আত্মার কাজ।

এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে , শরীরের স্বয়ংক্রিয় যান্ত্রিক প্রক্রিয়া - যা অব্যাহত থাকলে আমরা কোনো প্রাণশীল সৃষ্টিকে জীবিত বলে গণ্য করি , তার ও শরীরের দ্বারা অ-স্বয়ংক্রিয় ঐচ্ছিক কার্য পরিচালনাকারী আত্মিক শক্তির মধ্যে মৌলিক গুণগত পার্থক্য রয়েছে। শরীরের স্বয়ংক্রিয় যান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুধু শরীরকে ব্যবহারোপযোগী রাখে এবং আত্মা সে শরীরকে ব্যবহার করে। ফলে কারো শরীর স্থায়ীভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়লে অর্থাৎ তার মৃত্যু ঘটলে তার আত্মার জন্য আর তার শরীর ব্যবহারোপযোগী থাকে না। কিন্তু এর ফলে আত্মার নিজের অবস্থায় কোনো পরিবর্তন ঘটে না।

শরীরের সক্রিয়তা বা জীবন এবং আত্মা বা নাফ্স্ যে স্বতন্ত্র সে সম্পর্কে কোরআন মজীদ থেকে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। আল্লাহ্ রাব্বুল্ আলামীন এরশাদ করেন :

) اللَّهُ يَتَوَفَّى الأنْفُسَ حِينَ مَوْتِهَا وَالَّتِي لَمْ تَمُتْ فِي مَنَامِهَا فَيُمْسِكُ الَّتِي قَضَى عَلَيْهَا الْمَوْتَ وَيُرْسِلُ الأخْرَى إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ(

“ আল্লাহ্ নাফসগুলোকে আয়ত্তে নিয়ে নেন তাদের মৃত্যুর সময় এবং যে মৃত্যুবরণ করে না তার নিদ্রার সময়। অতঃপর , যার ওপর মৃত্যুর ফয়ছ্বালা আপতিত হয়েছে তাকে রেখে দেন এবং অন্যদেরকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত (ফেরত) পাঠিয়ে দেন। নিঃসন্দেহে এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাদি রয়েছে। ” (সূরাহ্ আয্-যুমার্ : ৪২)

এখানে লক্ষণীয় যে , মৃত্যু ও ঘুম উভয় অবস্থায়ই আল্লাহ্ তা আলা কর্তৃক নাফসকে স্বীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে নিয়ে নেয়ার কথা বুঝাতে গিয়ে অভিন্ন ক্রিয়াيَتَوَفَّى ব্যবহার করা হয়েছে। আর আমরা জানি যে , ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষ অনেক সময় স্বপ্ন দেখে ; তাতে সুখ-দুঃখের অনুভূতি থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এ অনুভূতির তীব্রতায় মানুষ জাগ্রত হবার সাথে সাথে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে , বা পাগল হয়ে যেতে পারে , এমনকি মারা যেতেও পারে। স্বপ্নে সময়ের অনুভূতি জাগ্রত অবস্থার অনুভূতির তুলনায় শ্লথতর বা দ্রুততর হতে পারে। এখানে ঘুমের ও মৃত্যুর অবস্থায় নাফ্স্ বা আত্মাকে আল্লাহ্ তা আলা কর্তৃক নিয়ন্ত্রণাধীনে নেয়ার মধ্যে পার্থক্য কেবল এই যে , মৃত্যু হলে তার নাফসকে ফিরিয়ে দেয়া হয় না , ঘুমন্ত ব্যক্তির নাফসকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। উভয় ক্ষেত্রেই একই ক্রিয়া ব্যবহার থেকে সুস্পষ্ট যে , উভয় অবস্থায়ই নাফ্স্ বা আত্মার গুণগত অবস্থা অভিন্ন থাকে। এমতাবস্থায় , ঘুমন্ত ব্যক্তির আত্মার জন্য যদি ঘুমন্ত ’ থাকা অপরিহার্য না হয় , বরং সে স্বপ্নে কর্মতৎপর ও অনুভূতিসম্পন্ন থাকতে পারে তাহলে মৃত ব্যক্তির আত্মার ঘুমন্ত থাকার এবং সুখ-দুঃখের অনুভূতিহীন ও কর্মতৎপরতাহীন থাকার কোনো কারণ নেই। অবশ্য আালামে বারযাখে আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা জাগ্রত থাকলেও তার কর্মতৎপরতার ক্ষেত্র ও সে ক্ষেত্রে ব্যবহার্য স্বাধীনতা অবশ্যই আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে আালামে বারযাখের জন্য নির্ধারিত বিধানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকবে।