বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্0%

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্ লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 20619
ডাউনলোড: 3155

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 18 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 20619 / ডাউনলোড: 3155
সাইজ সাইজ সাইজ
বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মৃত্যুপারের জীবন সম্পর্কে মানুষের ঔৎসুক্য চিরন্তন। এ ঔৎসুক্যের পরিপূর্ণ নিবৃত্তি জীবদ্দশায় সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব নয় জেনেও মানুষ কখনোই এ বিষয়ে জানার আগ্রহ পরিত্যাগ করতে পারে না। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মে যেমন বিভিন্ন ধারণা দেয়া হয়েছে, তেমনি এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা তথ্য ও কল্পনা। তাই এ ব্যাপারে সম্ভব সর্বাধিক মাত্রায় সঠিক ধারণার প্রয়োজনীয়তা সব সময়ই অনুভূত হয়ে আসছে।

ইসলামী মতে, সাধারণভাবে মৃত্যুপরবর্তী সময়ের দু’টি পর্যায় রয়েছে : মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত সময় এবং পুনরুত্থান পরবর্তী সময় অর্থাৎ শেষ বিচার ও তদ্পরবর্তী জান্নাতী বা জাহান্নামী অনন্ত জীবন। পুনরুত্থান, শেষ বিচার এবং বেহেশত বা দোযখ বাস তথা আখেরাতের ওপর ঈমান পোষণ ইসলামের মৌলিক চৈন্তিক ভিত্তি (উছূলে ‘আক্বাএদ্)-এর অন্যতম। এ কারণে এ সম্পর্কে কোরআন মজীদে বিস্তারিত বক্তব্য রয়েছে।

কোরআন মজীদে ও দর্শনে আালামে বারযাখের তাৎপর্য

এমন অনেক পরিভাষা আছে যা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যবহৃত হয় , কিন্তু প্রতিটি শাস্ত্রে তার নিজস্ব তাৎপর্য আছে। ফলে অনেক সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি শাখার সাথে পরিচিত ব্যক্তি তার জানা একটি পরিভাষা অন্য একটি শাস্ত্রে তার জানা সংজ্ঞা ও অর্থ থেকে ভিন্ন একটি সংজ্ঞা ও অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখে ঐ সংজ্ঞা ও তাৎপর্যের যথার্থতা সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়তে পারেন। তবে ব্যক্তি যদি পরিভাষাটির বিভিন্ন শাস্ত্রে ব্যবহৃত সংজ্ঞা ও তাৎপর্যের সাথে পরিচিত থাকেন তাহলে তিনি এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন না।

অন্য কথায় বলা চলে যে , লেখা ও শোনার দিক থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যবহৃত অভিন্ন পরিভাষা , এমনকি ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে অভিন্ন উৎস থেকে উৎসারিত হলেও , ব্যবহারিক তাৎপর্যের বিচারে তা অভিন্ন শব্দ বা পরিভাষা নয়। বরং এগুলো হচ্ছে সমুচ্চারিত ও সমরূপে লেখ্য ভিন্নার্থক শব্দ ও পরিভাষা। ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে অভিন্ন হলেও বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞান তাতে নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন পারিভাষিক তাৎপর্য আরোপ করেছে , ফলে কার্যতঃ তা ভিন্ন ভিন্ন শব্দে পরিণত হয়েছে। ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে , শাহীদ ” পরিভাষাটি কোরআন মজীদে ও প্রচলিত পরিভাষায় সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। রূহ্ , নাফ্স্ , বারযাখ্ ইত্যাদি পরিভাষাও এ পর্যায়ের ; কোরআন মজীদে , দর্শনে ও ইরফানে (তাছ্বাওওফে) এ সব পরিভাষা নিজস্ব বিশেষ বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তেমনি সাধারণ মানুষও এ সব পরিভাষা থেকে কতোগুলো সাধারণ অর্থ গ্রহণ করে থাকে।

অত্র গ্রন্থের আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে , আমরা আালামে বারযাখ্ পরিভাষাটি কোরআন মজীদে যে অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে কেবল সে অর্থেই ব্যবহার করেছি , তা হচ্ছে , মৃত্যুর পরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী নাফসের জগত। (অবশ্য প্রসঙ্গক্রমে স্বপ্নের জগতের কথাও উল্লেখ করেছি , তবে তা-ও কোরআনের দলীলের ভিত্তিতে।)

দর্শনশাস্ত্রে একই পরিভাষা ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। দর্শনে আালামে বারযাখ্ হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার সেই সব সৃষ্টির জগত যে সব সৃষ্টি বস্তুগত সত্তাও নয় , আবার নিরঙ্কুশ নিরাকার অবস্তুগত সত্তাও নয়। বরং তারা হচ্ছে এক ধরনের সূক্ষ্ম সত্তা (موجود لطيف ) । এ সব সত্তার আকার-আকৃতি ইত্যাদি রয়েছে , কিন্তু তা বস্তুগত অস্তিত্ব নয় , বরং সূক্ষ্ম সত্তা। আবার অনেক দার্শনিক সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধগম্য ভাষায় উপস্থাপনের লক্ষ্যে উক্ত জগতের সৃষ্টিসমূহকে সূক্ষ্ম পদার্থ ’ (مادة لطيف ) দ্বারা সৃষ্ট সৃষ্টিনিচয় বলে উল্লেখ করেছেন , যদিও তাঁরা সাথে সাথেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে , ঐ সব সৃষ্টি বস্তুগত সৃষ্টি নয়।

বিষয়টি সহজবোধ্য করার জন্য আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে এর কাছাকাছি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। যেমন : তাপ , আগুন , বিদ্যুত ও চৌম্বক ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা আমাদের সকলেরই রয়েছে। কিন্তু পদার্থ বা বস্তু থেকে উৎপন্ন হলেও এগুলো পদার্থ বা বস্তুর সংজ্ঞার আওতায় পড়ে না , বরং এগুলো হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শক্তি। অবশ্য এগুলো নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানেই আলোচনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় , কিন্তু তা সত্ত্বেও সত্য এটাই যে , এগুলো পদার্থ থেকে স্বতন্ত্র ; অবশ্য এগুলোকে সূক্ষ্ম পদার্থ বলা যেতে পারে। এগুলো নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে - যা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। এখানে মোদ্দা কথা হচ্ছে এই যে , বস্তুগত ও অবস্তুগত অস্তিত্বের মাঝামাঝি সূক্ষ্ম অস্তিত্ব রয়েছে। আর প্রাণহীন সূক্ষ্ম অস্তিত্ব যখন রয়েছে তখন প্রাণশীল ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সূক্ষ্ম অস্তিত্ব থাকতে কোনো বাধা নেই।

এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে , আমদের বস্তুজগতেও হাল্কা শরীরের দৃষ্টান্ত রয়েছে - যা সূক্ষ্ম অস্তিত্ব না হলেও সূক্ষ্মতার কাছাকাছি। আগুন বা আলোর দ্বারা গঠিত প্রাণশীল সৃষ্টির বিষয়টি অনেকের পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন এ সব উপাদানের অণুসমূহের গতিশীলতা ও এ ধরনের শরীরের স্থিতিস্থাপকতার কারণে। কিন্তু জেলি ফিশের শরীরের পেশীগুলো যেমন হাল্কা তেমনি সেগুলোর মধ্যে ফাঁক অনেক বেশী , এ কারণে সেগুলোর শরীর খুবই স্থিতিস্থাপক। বলা হয় যে , একটি বড় আকারের ছুরি দ্বারা একটি জেলি ফিশের শরীরকে কেটে ফেললেও তা পুনরায় পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে। শামুকের শিং দু টিও অতোটা না হলেও যথেষ্ট স্থিতিস্থাপক।

বস্তুতঃ প্রাণশীল ও প্রাণহীন নির্বিশেষে বস্তুনিচয়ের পদার্থগুলোকে আমরা ঘনিষ্ঠ সংবদ্ধ বলে মনে করলেও প্রকৃত পক্ষে এ সবের অণুগুলোর মধ্যে এতোই ফাঁক যে , বলা হয় , গোটা পৃথিবীকে পুরোপুরি ঘনসংবদ্ধ করা সম্ভব হলে তা একটি ব্রিফকেসে রাখা যাবে। কিন্তু এতো ফাঁক সত্ত্বেও বিভিন্ন বস্তু ও প্রাণী যে তাদের বস্তুগত আকৃতি ও দেহকাঠামোর অধিকারী আছে তার কারণ এগুলোর অণু পরস্পরকে আকর্ষণ করে এবং বাইরে থেকে যথেষ্ট পরিমাণে শক্তি প্রয়োগ করে বিচ্ছিন্ন করা না হলে এগুলো বিচ্ছিন্ন হয় না। সুতরাং সূক্ষ্ম পদার্থের তৈরী স্থিতিস্থাপক দেহের অধিকারী প্রাণশীল সৃষ্টির অস্তিত্ব (যেমন : জিন ও ফেরেশতা) থাকার সম্ভাবনা অস্বীকার করা অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক আচরণ বৈ নয়।

যা-ই হোক , শাইখুর্ রাঈস্ ” নামে খ্যাত দার্শনিক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী আবূ আলী ইবনে সীনা তাঁর কিতাবুল্ আসফার্ গ্রন্থে (৪র্থ খণ্ড , পৃঃ ১৮৯) বলেছেন , আালামে বারযাখ্ কথাটির অর্থ কোনো কোনো ক্ষেত্রে করা হয় মত্যুর পূর্ববর্তী এবং হাশর ও ক্বিয়ামতের পূর্ববর্তী জগত , আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর অর্থ আালামে মাছালে মু ‘ আল্লাক্বাহ্ (মাঝামাঝি ধরনের সদৃশ জগত) এবং সর্বোপরি এর অর্থ হচ্ছে নিরঙ্কুশ অবস্তুগত জগত (عالم مجردات محض ) ও শরীরী বা বস্তুগত জগতের মাঝামাঝি একটি জগত। একেই আালামে বারযাখ্ বলা হয়। (فرهنگ معارف اسلامی، مدخل: عالم برزخ )

‘ আালামে বারযাখের দার্শনিক সংজ্ঞা ও কোরআন মজীদে বর্ণিত আালামে বারযাখের অর্থাৎ মৃত্যুপরবর্তী ও পুনরুত্থানপূর্ববর্তী জগতের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তা হচ্ছে , অনেকে মনে করেন যে , মৃত্যুর পরে মানুষের অবস্তুগত নাফসকে একটি সূক্ষ্ম শরীরে প্রবেশ করিয়ে আালামে বারযাখে রাখা হয় ; অনেকে এটিকে জিসমে মিছালী ” (সদৃশ শরীর) নামকরণ করেছেন। এ মতের সপক্ষে অবশ্য কোরআন মজীদের কোনো দলীল নেই। অন্যদিকে এরূপ সম্ভাবনাও ব্যক্ত করা হয়েছে যে , আসলে নাফ্স্ নিরঙ্কুশ অবস্তুগত (مجرد محض ) অস্তিত্ব নয় , বরং তা হচ্ছে এক ধরনের সূক্ষ্ম সত্তা বা আলোর সত্তা - যা দেখতে হুবহু বস্তুদেহের অনুরূপ , তবে তাতে জড়বস্তু নেই এবং মানুষ ও অন্য যে কোনো প্রাণীর জীবিত অবস্থায় তা তার গোটা জড়দেহ জুড়ে অবস্থান করে।

কিরলিয়ান ফটোগ্রাফিতে মানুষ সহ সমস্ত প্রাণীর , এমনকি উদ্ভিদেরও এ ধরনের আলোর শরীর ধরা পড়েছে ; এমনকি মানুষের শরীরের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা হলেও তার আলোর শরীরে সে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যথাস্থানে বহাল থাকে। তবে এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় না যে , এ আলোর দেহই নাফ্স্ , বরং এ-ও হতে পারে যে , নাফ্স্ একই সাথে বস্তুদেহ ও আলোর দেহের অধিকারী এবং মৃত্যুর সময় নাফসকে তার আলোর শরীর তথা মিছালী শরীর সহই আালামে বারযাখে নিয়ে যাওয়া হয়।

তবে , যেহেতু মানুষ যে বয়সে যে ধরনের শারীরিক কাঠামো সহকারে মারা যায় তার এ আলোর দেহ সে আকারেরই হয়ে থাকে - যা থেকে বুঝা যায় যে , মানুষ বড় হওয়ার সাথে সাথে তার আলোর দেহও বড় হয় , সেহেতু ঐ আলোর দেহই নাফ্স্ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। নইলে ঘুমিয়ে পড়লে একজন মানুষকে একেক বয়সে একেক আকারের আলোর দেহে বা মিছালী শরীরে প্রবেশ করিয়ে আালামে বারযাখে নিতে হয় এবং সে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির জন্য সুনির্দিষ্ট মিছালী শরীর থাকার ধারণাটি বাত্বিল্ হয়ে যায়।

অনুরূপভাবে রূহ্ , নাফ্স্ , প্রাণ ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার নিজস্ব বক্তব্য রয়েছে।

রূহ্ ও নাফ্স্ এবং জিসমে মিছালী

মানুষ শুধু একটি বস্তুদেহের নাম নয় , বরং তার মধ্যে বস্তুদেহ ছাড়াও অবস্তুগত সত্তা রয়েছে - এ এক অনস্বীকার্য সত্য। তথাপি বস্তুবাদী নাস্তিক চিন্তাবিদরা দাবী করেন যে , মানুষের চিন্তা-চেতনা , সুখ-দুঃখ ও আবেগ-অনুভূতির ন্যায় বিষয়গুলো শুধুই বস্তুগত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার তথা মস্তিষ্কের নিউরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলমাত্র ; মৃত্যুতে মস্তিষ্কের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তার অবসান ঘটে।

বস্তুবাদীদের এ মত নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করার মতো অবকাশ নেই এবং তার প্রয়োজন আছে বলেও মনে হয় না। কারণ , এ এক দীর্ঘ বিতর্কের বিষয় - যার সাথে এ জীবন ও জগতের উৎস তথা আল্লাহ্ তা আলার অস্তিত্ব সংক্রান্ত আলোচনা সম্পৃক্ত এবং এ ব্যাপারে আমরা স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করেছি।

তাদের জবাবে আপাততঃ এখানে আমরা এতোটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট বলে মনে করি যে , এমনকি উন্নততম বস্তুগত যন্ত্রের কর্মতৎপরতাও একমুখী এবং সৃজনশীলতাবিহীন। উন্নততম বস্তুগত যন্ত্রের দৃষ্টান্ত হচ্ছে সুপার কম্পিউটার , কিন্তু সুপার কম্পিউটার কেবল সে কাজই আঞ্জাম দেবে যে কাজের জন্য তাকে প্রোগ্রাম দেয়া হয়েছে। এমনকি আমরা অনেক সময় তার মধ্যে যে নির্বাচনক্ষমতার পরিচয় পাই তা-ও তার মধ্যে প্রদত্ত কর্মসূচীরই ফল। সে তার মধ্যে প্রদত্ত কর্মসূচীর বাইরে নিজে নিজে কোনো মৌলিক বা স্বাধীন কর্মসূচী তৈরী করতে ও তা কাজে লাগাতে পারে না , বিশেষ করে যার অস্তিত্ব নেই এমন কিছু কল্পনা করতে পারে না।

এ ব্যাপারে একটি চমৎকার উদাহরণ দেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে , একটি সাধারণ কম্পিউটারকেও বহু সংখ্যা বিশিষ্ট , ধরুন , পঞ্চাশ সংখ্যা বিশিষ্ট , জটিল ধরনের একটি অঙ্ক কষতে দিলে সে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার জবাব দিতে সক্ষম হবে। কিন্তু একটি উন্নততম সুপার কম্পিউটারকে - যার মেমোরিতে প্রচুর ছোটগল্প , উপন্যাস ও কবিতা সঞ্চিত রয়েছে , পাঁচ পৃষ্ঠার একটি ছোটগল্প থেকে এক পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্তসার পেশ করতে বললে সে কিছুতেই তা পারবে না , অথচ সাত বছরের একটি শিশু তা করতে পারবে। আর তাকে (সুপার কম্পিউটারকে) যদি মাত্র দুই ছত্রের একটি কবিতা রচনা করতে বলা হয় তাহলে সে ক্ষেত্রেও সে অক্ষমতা পেশ করবে।

এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে , প্রাণীদেহে , বিশেষতঃ মানুষের মধ্যে এক বা একাধিক বস্তু-উর্ধ সত্তা রয়েছে যা বস্তুগত অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত। সুতরাং এখানে আমরা মানুষের মধ্যে বস্তু-উর্ধ সত্তার অস্তিত্বের বিষয়টি অকাট্য ধরে নিয়ে আলোচনা করবো।

এ ক্ষেত্রেও অবশ্য প্রশ্ন আছে যে , মানুষ সহ প্রাণীদেহের মধ্যকার বস্তু-উর্ধ সত্তা কি আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টিপ্রকৃতির বিধান অনুযায়ী শরীর গঠনের একটি পর্যায়ে তাতে তৈরী হয় , নাকি সরাসরি আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে তাতে যোগ করা হয় তা এক স্বতন্ত্র আলোচ্য বিষয় , কিন্তু প্রাণীদেহে স্বতন্ত্র বস্তু-উর্ধ সত্তার অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। [তবে তা সরাসরি আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে যোগ করার ধারণা যদি সঠিকও হয়ে থাকে তথাপি যারা মনে করেন যে , হযরত আদম ( আঃ)কে পৃথিবীতে পাঠোনোর আগেই তাঁর বংশধর সকল মানুষের নাফ্স্ সৃষ্টি করা হয়েছিলো তাঁদের সে ধারণা ঠিক নয়। কারণ , সংশ্লিষ্ট আয়াতে (সূরাহ্ আল্-আ ‘ রাফ্ : ১৭২) হযরত আদম ( আঃ)-এর সন্তানদের বংশধরদের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে।]

যা-ই হোক , প্রশ্ন হচ্ছে , মানুষের মধ্যে যে বস্তু-উর্ধ সত্তা রয়েছে তার বা সেগুলোর সংখ্যা ক ’ টি এবং স্বরূপ কী ?

এ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত ধারণা সহজবোধগম্য , কিন্তু এ ব্যাপারে দার্শনিক ও ইরফানী মতের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে এবং তার মধ্যে কোনটি কোরআন-সম্মত , নাকি কোরআন মজীদ থেকে তৃতীয় কোনো মত পাওয়া যায় তা পর্যালোচনা করে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।

এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত ধারণা থেকে উপরোক্ত প্রশ্নের জবাব মিলে না। অন্যদিকে দার্শনিক ও আারেফগণের মতামত যেমন জটিল তেমনি তাঁদের মধ্যে বহুমুখী মতপার্থক্য রয়েছে - যার বিস্তারিত উদ্ধৃতি থেকে এমনকি বিশেষজ্ঞগণের পক্ষেও একটি সুনির্দিষ্ট উপসংহারে উপনীত হওয়া কঠিন ব্যাপার। তাই এখানে বিষয়টি সংক্ষেপে এবং এমনভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন যা বুদ্ধিবৃত্তিকদের পক্ষে সহজে অনুধাবন করা সম্ভব হয়।

সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে এই যে , মানুষ শরীর ও রূহ্ বা আত্মার সমন্বয়ে গঠিত। সাধারণ পাঠক-পাঠিকাদের জন্য - যারা নিঃসন্দেহে দর্শন , ইরফান্ ও উলূমে ইলাহীয়াত্-এ বিশেষজ্ঞ নন - এই রূহ্ বা আত্মার হাক্বীক্বাত্ বা স্বরূপকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা চলে : আত্মা হচ্ছে ব্যক্তির দেহজুড়ে অবস্থানরত ক্রমবর্ধমান ও ক্রমহ্রাসমান বিভিন্ন গুণাবলীর অধিকারী হবার এবং সবল ও দুর্বল মাত্রার হবার সম্ভাবনাসম্পন্ন বস্তু-উর্ধ যৌগিক সত্তা। ”

যদিও এ সংজ্ঞা বিতর্কাতীত নয় , তবে বিতর্কাতীত না হলেও কেবল এ সংজ্ঞা সহকারেই মানুষ দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে সৃষ্টি ’ - এ মতকে সঠিক ধরে নিয়ে এ সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। অবশ্য ইরফান্ , দর্শন ও কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে বিষয়টি হুবহু এরূপ নয় অর্থাৎ মানুষ একটিমাত্র বস্তুদেহের অধিকারী হলেও একটিমাত্র বস্তু-উর্ধ অস্তিত্বের অধিকারী নয়। আর এ বিষয়টি মাথায় রেখেই আমরা আমাদের সংজ্ঞায় রূহ্ ” পরিভাষা ব্যবহার না করে আত্মা ” পরিভাষা ব্যবহার করেছি এবং এতে যৌগিক ’ বিশেষণ যোগ করেছি।

অবশ্য এখানে স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন যে , এ ব্যাপারে যে মতপার্থক্য রয়েছে তা কোনো গুরুতর ব্যাপার নয়। কারণ , একই পরিভাষা বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এবং বিভিন্ন শাস্ত্রে বিভিন্ন তাৎপর্য বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ , সাধারণ্যে প্রচলিত পরিভাষায় ছ্বালাত্ ” মানে নামায , কিন্তু কোরআন মজীদের পরিভাষায় ছ্বালাত্ ” মানে কখনো দো ‘ আ/ দুরূদ্ ” ও কখনো নামায ” । এ কারণেই যখন হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর প্রতি ছ্বালাত্ ” প্রেরণ করতে বলা হয় তখন শব্দগত অভিন্নতা সত্ত্বেও তা থেকে নামায ” বুঝায় না , দুরূদ্ ” বুঝায়। অনুরূপভাবে দর্শনে ওজূদ্ ” বলতে বস্তুগত ও অবস্তুগত নির্বিশেষে অস্তিত্ব ’ বুঝায় , কিন্তু তাছ্বাওওফে ওজূদ্ ” বলতে বস্তুদেহ ’ কে বুঝানো হয়। একইভাবে সাধারণ মানুষ যখন বলে যে , মানুষ দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে সৃষ্ট , তখন তাতে আত্মা ’ একক , নাকি যৌগিক এবং যৌগিক হলে সে যৌগিকতা সত্তাগত , নাকি গুণগত , নাকি মাত্রাগত তা বিবেচ্য বিষয় নয়। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে যে বস্তুদেহ ছাড়াও অবস্তুগত সত্তা রয়েছে এটাই বুঝানো হয়। অতএব , এ দৃষ্টিতে এ মতকে ভুল বলা চলে না।

কিন্তু বিশেষজ্ঞত্ব পর্যায়ে মানবদেহে বিদ্যমান বস্তু-উর্ধ অস্তিত্ব নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয় এবং বিশেষজ্ঞগণের অনেকে মানবদেহে একাধিক বস্তু-উর্ধ অস্তিত্বের সন্ধান পান - যেগুলোর মধ্য থেকে তাঁরা একটিকে রূহ্ ” বলে অভিহিত করে থাকেন। এর ফলে দেখা যাচ্ছে যে , সাধারণ মানুষ “ রূহ্ ” (আত্মা) বলতে যা বুঝায় এখানে রূহ্ ” পরিভাষাটি তা থেকে স্বতন্ত্র তাৎপর্য বহন করে। সুতরাং যারা শরীর ও রূহ্/আত্মা ’ র কথা বলছেন তাঁরা মানবদেহে নাফ্স্ ” বা অন্যান্য অবস্তুগত সত্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ , তাঁরা শরীর বাদে মানব-অস্তিত্বের গোটা বস্তু-উর্ধ দিককেই রূহ্ বা আত্মা বলে থাকেন।

তথাপি এ ব্যাপারে অধিকতর বিস্তারিত ধারণায় উপনীত হওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে , কারণ , ক্ষেত্রবিশেষে বিস্তারিত ধারণা না থাকার কারণে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়। উদাহরণস্বরূপ , যেহেতু আল্লাহ্ তা আলা কোরআন মজীদে বলেছেন যে , তিনি হযরত আদম ( আঃ)-এর মধ্যে স্বীয় রূহ্ ফুঁকে দিয়েছেন , আর যেহেতু আল্লাহ্ তা আলা কোনো শরীরী সত্তা নন , সেহেতু অনেকে মনে করে নিয়েছেন যে , স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলাই আদম ( আঃ)-এর শরীরে প্রবেশ করেছেন। অনুরূপভাবে কোরআন মজীদে হযরত ঈসা ( আঃ) সম্বন্ধে বলেছেন :روح منه - তাঁর (আল্লাহর) রূহ্ ” - এ থেকে খৃস্টানরা দাবী করে যে , কোরআনের মত অনুযায়ী হযরত ঈসা ( আঃ)ই খোদা (না ‘ উযূ বিল্লাহ্) ।

কোরআন মজীদে রূহ্ ” কথাটি কী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে সে সম্পর্কে আদৌ ধারণা না থাকার কারণেই এ ধরনের বিভ্রান্তিকর ধারণার সৃষ্টি। কোরআন মজীদে অন্য আয়াতে যেখানে রূহ্ ” কে আল্লাহর কাজ বা আদেশ (امر ) বলা হয়েছে - এ নিয়ে সামান্য চিন্তা করলেই সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে , আল্লাহর রূহ্ ” মানে স্বয়ং আল্লাহ্ নন।

যা-ই হোক , মানুষের মধ্যকার অবস্তুগত অস্তিত্বের প্রকৃত সংখ্যা ও স্বরূপ সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত ও বিতর্কাতীত উপসংহারে উপনীত হওয়া হয়তো আপাততঃ সম্ভব হবে না , তবে এ সম্পর্কে অস্বচ্ছতা ও অস্পষ্টতা বহুলাংশে দূর করা যেতে পারে সন্দেহ নেই। বিশেষ করে এ ব্যাপারে কোরআন মজীদ থেকে যে ধারণা পাওয়া যাবে সে ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক ধারণা পোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমরা চেষ্টা করতে পারবো।

মানুষের মধ্যকার অবস্তুগত অস্তিত্ব কি একটি নাকি একাধিক এবং তা কী বা সেগুলো কী কী - এ ব্যাপারে দর্শন , ইরফান্ ও ধর্মতত্ত্বের বিভিন্ন মতকে নিম্নলিখিত কয়েকটি মতে সমন্বিত ও সংক্ষিপ্ত করা যেতে পারে :

(১) একটিমাত্র অবস্তুগত সত্তা : রূহ্ বা আত্মা। এ ক্ষেত্রে তা একক , নাকি যৌগিক এবং যৌগিক হলে তার যৌগিকতা কি সত্তাগত , নাকি গুণগত , নাকি মাত্রাগত তা বিবেচ্য নয়।

(২) দু টি অবস্তুগত সত্তা : প্রাণ এবং রূহ্ বা আত্মা।

(৩) দু টি অবস্তুগত সত্তা : জীবাত্মা (روح حيوانی ) ও মানবাত্মা (روح انسانی ) ।

(৪) দু টি অবস্তুগত সত্তা : রূহ্ ও নাফ্স্।

(৫) তিনটি অবস্তুগত সত্তা : জীবসত্তা , প্রাণ এবং রূহ্ বা আত্মা।

(৬) তিনটি অবস্তুগত সত্তা : প্রাণ , নাফ্স্ ও রূহ্।

(৭) চারটি অবস্তুগত সত্তা : জীবসত্তা , প্রাণ , রূহ্ ও নাফ্স্।

(৮) প্রাণ , রূহ্ ও নাফ্স্ ছাড়াও একটি অবস্তুগত শরীর রয়েছে - মৃত্যুর সময় নাফসকে এ শরীর সহকারে আালামে বারযাখে নিয়ে যাওয়া হয়।

যারা প্রতিটি প্রাণী বা জীবে একটিমাত্র অবস্তুগত অস্তিত্ব তথা রূহ্ বা আত্মা আছে বলে মনে করেন তাঁরা গুণ-বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন পর্যায়ের বা স্তরের রূহের কথা বলেন - যার মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে সজীব বস্তু বা উদ্ভিদ এবং সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে মানুষ। এতদুভয়ের মাঝখানে বিভিন্ন স্তরে রয়েছে রোগজীবাণু থেকে শুরু করে কীট-পতঙ্গ , পশু-পাখী , জলচর প্রাণী , সরীসৃপ ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে স্তরগত দিক থেকে উচ্চতর ও নিম্নতর রয়েছে। তেমনি যারা প্রাণ ও আত্মা নামে দু টি স্বতন্ত্র অস্তিত্বের প্রবক্তা তাঁরাও এতদুভয়ের বিভিন্ন স্তরের প্রবক্তা।

আবার অনেকে মনে করেন , আসলে মানুষ বা প্রাণীকুলের মধ্যে স্বতন্ত্র কোনো বস্তু-উর্ধ সত্তা নেই , বরং সমগ্র সৃষ্টিলোকে একটিমাত্র রূহ্ রয়েছে অর্থাৎ আল্লাহ্ তা আলা একটিমাত্র রূহ্ সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীতে তা প্রতিবিম্বিত হচ্ছে ; এ প্রতিবিম্ব সরে গেলেই মানুষ বা প্রাণীর মৃত্যু হয়।

অনেকে মনে করেন , মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে রূহানী বা আত্মিক সত্তা আছে , তবে তা নির্গুণ। উর্ধলোকে বিভিন্ন ধরনের রূহানী বা আত্মিক সত্তা আছে ; মানুষ ও প্রাণীকুলের ভালো-মন্দ গুণাবলী হচ্ছে উক্ত রূহানী বা আত্মিক সত্তাসমূহের প্রভাবেরই ফল।

মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে এই যে , প্রতিটি প্রাণীর , বিশেষতঃ মানুষের রূহ্ বা নাফ্স্ স্বতন্ত্র ও পূর্ব থেকে সৃষ্ট - যা শরীর গঠনের এক পর্যায়ে তাতে প্রবেশ করানো হয়। আবার অনেকে মনে করেন যে , আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিধানের আওতায় শরীর গঠনের এক বিশেষ পর্যায়ে এসে বস্তুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে নাফ্স্ সৃষ্টি হয় ও ক্রমবিকশিত হয় অর্থাৎ শরীরে প্রাণের উদ্ভবের পরে নাফসের উদ্ভব হয় , তবে বস্তুদেহ থেকে উদ্ভূত হলেও তা অবস্তুগত , ঠিক যেভাবে বস্তু থেকে সৃষ্ট শক্তি (যেমন : বিদ্যুত) বস্তু থেকে স্বতন্ত্র ধরনের অস্তিত্ব অর্থাৎ এক ধরনের সূক্ষ্ম অস্তিত্ব।

যে সব দার্শনিক অবস্তুগত দেহ বা সূক্ষ্ম দেহের কথা বলেছেন তাঁরা মনে করেন যে , অবস্তুগত নাফ্স্ কোনো না কোনো ধরনের দেহ ছাড়া অবস্থান করতে পারে না। কিন্তু তাঁদের মধ্যে এ ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েছে যে , এ সূক্ষ্ম দেহ কি বস্তুদেহের ভিতরেই অবস্থান করে , নাকি মৃত্যুর সময় বাইরে থেকে এ সূক্ষ্ম দেহ এনে নাফসকে তাতে প্রবেশ করিয়ে আালামে বারযাখে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে এ সূক্ষ্ম দেহ যদি বাইরে থেকেও আনা হয় তো সে ক্ষেত্রেও তা বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্যই সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। এ কারণেই আালামে বারযাখের অধিবাসীদেরকে সুনির্দিষ্টভাবে চেনা যায় অর্থাৎ তারা পার্থিব জগতে দেখতে যেমন আালামে বারযাখেও তেমনি , কেবল তাতে বস্তু থাকে না , ঠিক আয়নায় প্রতিফলিত প্রতিবিম্বের মতো।

তাঁরা এ ব্যাপারে স্বপ্নের উদাহরণ দিয়েছেন ; ঘুমের সময় মানুষের নাফ্স্ তার শরীরে থাকে না , কিন্তু স্বপ্নে মানুষ নিজেকে জাগ্রত অবস্থার অনুরূপ দেখতে পায় অর্থাৎ ঘুমের সময় নাফ্স্ তার সূক্ষ্ম দেহ সহকারে বস্তুদেহ থেকে বেরিয়ে যায় , মতান্তরে , বস্তুদেহ থেকে বেরিয়ে সূক্ষ্ম দেহে প্রবেশ করে। এ সূক্ষ্ম দেহকেجسم مثالی (জিসমে মিছালী - সদৃশ দেহ) হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

যারা মনে করেন যে , সদৃশ দেহ বা সূক্ষ্ম দেহ নাফ্স্ সহ বস্তুদেহে অবস্থান করে না বরং তা স্বতন্ত্র , তাঁদের মতে , মৃত্যুর সময় নাফসকে বস্তুদেহ থেকে বের করে এতে প্রবেশ করিয়ে আালামে বারযাখে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পুনরুত্থানের সময় তা থেকে বের করে নবসৃষ্ট বস্তুদেহে প্রবেশ করানো হবে।

বিশেষ করে মানুষ বিভিন্ন বয়সে যখন স্বপ্ন দেখে তখন তাতে নিজেকে সাধারণতঃ সে বয়সেরই দেখে থাকে। এ থেকে বুঝা যায় যে , তার সদৃশ শরীরেরও বয়স বৃদ্ধি পায় এবং এটা প্রমাণ করে যে , তার এ সূক্ষ্ম দেহ মৃত্যুর সময় বাইরে থেকে ( আালামে বারযাখ্ থেকে) আনা হয় না , বরং এ সদৃশ দেহ সহই নাফ্স্ বস্তুদেহে অবস্থান করে এবং মৃত্যুর সময় তদ্সহই বের করে নেয়া হয়।

আরো একটি কারণে এই শেষোক্ত মতটি সঠিক বলে মনে হয়। তা হচ্ছে , মানুষের মৃত্যুর সময় তার সদৃশ দেহ যদি বাইরে থেকে এনে নাফসকে তাতে প্রবেশ করানো হয় এবং পুনরুত্থানের সময় যদি পুনরায় তা থেকে বের করে নবসৃষ্ট বস্তুদেহে প্রবেশ করানো হবে , তাহলে অতঃপর ঐ সদৃশ দেহ কী কাজে লাগবে ? কারণ , পুনরুত্থানের পর মানুষ যে অনন্ত জীবনের অধিকারী হবে তাতে না মৃত্যু থাকবে , না থাকবে স্বপ্ন। সুতরাং মানুষের জন্য ঐ সদৃশ দেহের আর কোনো প্রয়োজনই থাকবে না। এমতাবস্থায় তা কী কাজে লাগবে ?

এর একটাই সমাধান। তা হচ্ছে , সদৃশ দেহ বাইরে থাকে না , বরং নাফ্স্ সদৃশ দেহ সহকারেই বস্তুদেহে অবস্থান করে , ঘুমের মধ্যে ও মৃত্যুকালে তদ্সহই তাকে বের করে নেয়া হয় এবং পুনরুত্থানের সময় তদ্সহই তাকে নবসৃষ্ট বস্তুদেহে প্রবেশ করানো হবে।

কিন্তু এরপরও প্রশ্ন থেকে যায় , তা হচ্ছে : এই সদৃশ দেহ কি স্বতন্ত্র কিছু , নাকি এটাই নাফ্স্ ? বিশেষ করে কোরআন মজীদে নাফ্স্-এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে , কিন্তু জিসমে মিছালী-র কথা উল্লেখ নেই। এ থেকে মনে হয় , এই সদৃশ দেহই নাফ্স্।

কিরলিয়ান্ ফটোগ্রাফির আলোর শরীর

মানুষের এ সূক্ষ্ম দেহের বিষয়টি বিজ্ঞানের দ্বারাও স্বীকৃত হয়েছে। কিরলিয়ান্ ফটোগ্রাফি-তে শুধু মানুষের নয় , প্রতিটি সজীব অস্তিত্বেরই একটি আলোর দেহ রয়েছে বলে ধরা পড়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে এটাই কি সদৃশ দেহ ? অথবা এটাই কি নাফ্স্ ?

কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী ক্রাসনোদার্ শহরের তুখোর বিদ্যুতবিজ্ঞানী সেমিওন্ দাভিদোভিচ্ কিরলিয়ান ১৯৩৯ সালে এক বিশেষ ধরনের যন্ত্রের সাহায্যে আবিষ্কার করেন যে , প্রতিটি জীবিত শরীর এবং তার যে কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা অংশ থেকে এক ধরনের আলোকরশ্মি বের হয়ে থাকে। তিনি ও মিসেস কিরলিয়ান এর ছবি তুলতে সক্ষম হন। তাঁরা আরো প্রমাণ করেন যে , এই আলো অসুস্থতা ও মৃত্যুর পূর্বাভাস দিতে পারে। তা হচ্ছে , চিকিৎসাবিজ্ঞানে ধরা না পড়লেও , যার শরীরে রোগের উপাদান প্রবেশ করেছে ও শীঘ্রই সে রোগাক্রান্ত হতে বা মৃত্যুবরণ করতে যাচ্ছে তার শরীর থেকে বহির্গত আলো ম্লান হয়ে থাকে।

কিরলিয়ান দম্পতি ছাড়াও মার্কিন মহিলা সাইকিক এলিন গ্যারেটও মানুষসহ সকল প্রাণীর দেহের চারদিকে কুয়াশাচ্ছন্ন আলোর আভা লক্ষ্য করেন। এর আগে খৃস্টীয় ১৯০০ অব্দের প্রথম দিকে লন্ডনের সেন্ট টমাস হাসপাতালের ড. ওয়াল্টার কিলনার্ লক্ষ্য করেন যে , ডিসাইয়ানিন ডাই রঞ্জিত কাঁচের ভিতর দিয়ে তাকালে মানুষের দেহের চারপাশে উজ্জ্বল আলোর একটা আভা দেখতে পাওয়া যায়। শরীরের চারপাশে ছয় থেকে আট সেন্টিমিটার জায়গা জুড়ে এ আভা মেঘের মতো ভাসছে। এছাড়া এক শতাব্দীকাল পূর্বে বিখ্যাত জার্মান রসায়নবিদ ব্যারোন্ ভন্ রিচেনবাখ্ গবেষণা করে বলেছিলেন যে , মানুষ , গাছপালা ও পশুপাখীর শরীর থেকে এক ধরনের জ্যোতি বের হয়। বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে সোভিয়েত বিজ্ঞানী ড. আলেকজান্ডার গুরভিচ আবিষ্কার করেন যে , জীবন্ত সব কিছু থেকেই এক ধরনের শক্তি আলোর আকারে বের হয় যা দেখা যায় না। তিনি প্রমাণ করেন যে , পিয়াযের একটি শিকড় কীভাবে দূর থেকে অন্য একটি শিকড়ে আলো বিকিরণ করে তার কোষসংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। (কিরলিয়ান ফটোগ্রাফি : কবির আশরাফ , রহস্য পত্রিকা , জুন ১৯৮৫ -Psychic Discoveries Behind the Iron Curtain গ্রন্থ অবলম্বনে।)

এ থেকে কারো মনে হতে পারে যে , উক্ত বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার বোধ হয় স্রেফ বিশেষ ধরনের আলো যা সাধারণভাবে চোখে ধরা পড়ে না। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা শরীর থেকে নির্গত নেহায়েত আলোমাত্র নয় যা অনবরত বেরোচ্ছে ও বাইরে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য আলোর ন্যায় হারিয়ে যাচ্ছে। বরং এটা হচ্ছে এক ধরনের স্থির আলো যা শরীরকে ঘিরে অবস্থান করছে যদিও তার কিছুটা রশ্মি ছড়িয়ে পড়ছে। অর্থাৎ এটা শরীর থেকে নির্গত আলোমাত্র নয় , বরং এ হচ্ছে শরীরকে ঘিরে বা শরীর জুড়ে এক আলোর শরীর। কেননা কিরলিয়ান ফটোগ্রাফি প্রমাণ করেছে যে , মানুষের হাত বা পা কেটে ফেললেও তার আলোর হাত বা পা সেখানে রয়ে যায়। ” (প্রাগুক্ত)

এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে , কিরলিয়ান দম্পতি যা আবিষ্কার করেন তা শরীর থেকে নির্গত আলো নয় , বরং তা হচ্ছে আলোর শরীর। আরো অনেক বিজ্ঞানী এ ধারণা সমর্থন করেছেন।

“ অনেক গবেষণার পর ইনুশিন্ , গ্রিশ্চেংকো ও অন্য কয়েক জন রুশ বিজ্ঞানী সিদ্ধান্তে আসেন যে , সমস্ত জীবন্ত প্রাণীরই রয়েছে একটি দ্বিতীয় শরীর বা প্রতিদেহ (counter-body ) যা সম্পূর্ণ বায়বীয় , ইথারীয় ও আলোকময়। তাঁরা এর নাম দিয়েছেনBiological Plasma body ; এটাই হচ্ছে আসল শরীর যার মধ্য দিয়ে প্রাণ ’ বা জীবনীশক্তি চলাচল করে। যে সমস্ত ভারতীয় যোগী দাবী করেন যে , তাঁরা নিজের শরীর থেকে বের হয়ে যেতে পারেন , সম্ভবতঃ তাঁদের এই আলোর দেহটিই ভৌত শরীর ’ থেকে বের হয়ে যায়। তাঁদের ইচ্ছা মতো সেটা আবার দেহে ফেরত আসে। ” (প্রাগুক্ত)

বলা বাহুল্য যে , এটা আলোমাত্র হলে দেহের কর্তিত অঙ্গের শূন্যস্থানে আলোর অঙ্গ থাকতো না। অতএব , এটা যে , একটি অবস্তুগত দেহ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে , মানুষের বস্তুগত দেহের অভ্যন্তরে বা দেহকে ঘিরে বা দেহজুড়ে কি কেবল এই একটিমাত্র অবস্তুগত আলোর দেহ রয়েছে , নাকি আরো কোনো অস্তিত্ব রয়েছে যা কিরলিয়ান ফটোগ্রাফিতেও ধরা পড়ে নি ? এরূপ থাকতেও পারে। আর যদি না-ই থাকে তো বলতে হবে যে , এই আলোর দেহটাই মানুষের প্রাণ বা প্রাণের মূল কারণ তথা এটাই ব্যক্তিসত্তা বা নাফ্স্।

এখানে স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন মনে করি যে , আমরা ইতিপূর্বে যে সব অবস্তুগত অস্তিত্ব সম্বন্ধে আলোচনা করেছি অর্থাৎ আগুন , শক্তি , আলো , বিদ্যুত ও চৌম্বক ক্ষেত্র , সেগুলো অবস্তুগত অস্তিত্ব হলেও প্রাণ বা প্রাণের বাহক নয়। কিন্তু কিরলিয়ান দম্পতি যা আবিষ্কার করলেন তা হচ্ছে প্রাণ বা প্রাণের বাহক। অর্থাৎ পর্যায় ও মর্যাদাগত দিক থেকে এটি উচ্চতর অবস্তুগত অস্তিত্ব। এমতাবস্থায় অনুরূপ উচ্চতর অবস্তুগত অস্তিত্ব , যেমন : জিন্ ও ফেরেশতার অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব বলার কোনো উপায় নেই , যদিও আরো উচ্চতর হবার কারণে তাকে বস্তুবিজ্ঞানীদের অভিজ্ঞতার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব নয়।