বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্23%

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্ লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 18 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 26162 / ডাউনলোড: 4693
সাইজ সাইজ সাইজ
বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মৃত্যুপারের জীবন সম্পর্কে মানুষের ঔৎসুক্য চিরন্তন। এ ঔৎসুক্যের পরিপূর্ণ নিবৃত্তি জীবদ্দশায় সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব নয় জেনেও মানুষ কখনোই এ বিষয়ে জানার আগ্রহ পরিত্যাগ করতে পারে না। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মে যেমন বিভিন্ন ধারণা দেয়া হয়েছে, তেমনি এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা তথ্য ও কল্পনা। তাই এ ব্যাপারে সম্ভব সর্বাধিক মাত্রায় সঠিক ধারণার প্রয়োজনীয়তা সব সময়ই অনুভূত হয়ে আসছে।

ইসলামী মতে, সাধারণভাবে মৃত্যুপরবর্তী সময়ের দু’টি পর্যায় রয়েছে : মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত সময় এবং পুনরুত্থান পরবর্তী সময় অর্থাৎ শেষ বিচার ও তদ্পরবর্তী জান্নাতী বা জাহান্নামী অনন্ত জীবন। পুনরুত্থান, শেষ বিচার এবং বেহেশত বা দোযখ বাস তথা আখেরাতের ওপর ঈমান পোষণ ইসলামের মৌলিক চৈন্তিক ভিত্তি (উছূলে ‘আক্বাএদ্)-এর অন্যতম। এ কারণে এ সম্পর্কে কোরআন মজীদে বিস্তারিত বক্তব্য রয়েছে।


1

2

3

4

কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে নাফ্স্

কোরআন মজীদে হায়াত্ (জীবন) , নাফ্স্ (ব্যক্তিসত্তা) ও রূহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিশেষভাবে রূহের স্বরূপ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলেও কোরআন মজীদে এর স্বরূপ সম্পর্কে কিছু বলা হয় নি। বলা হলে তৎকালীন মানুষদের বোধগম্য হতো না , বরং কোরআন মজীদের ঐশিতা প্রশ্নবিদ্ধ হতো। হয়তো এ কারণেই এ সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয় নি (আল্লাহ্ই ভালো জানেন) । এ সম্পর্কে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)কে প্রশ্ন করা হলে তার জবাবে আল্লাহ্ তা আলা কোরআন মজীদে এরশাদ করেন :

) وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلا قَلِيلا(

“ (হে রাসূল!) তারা আপনাকে রূহ্ সম্পর্কে প্রশ্ন করে ; আপনি বলুন : রূহ্ হচ্ছে আমার রবের আদেশ (বা কাজ) এবং তোমাদেরকে ইলম্ থেকে সামান্য বৈ দেয়া হয় নি। ” (সূরাহ্ আল্-ইসরা ’ / বানী ইসরাঈল্ : ৮৫)

আরবী ভাষায় রূহ্ ” শব্দটি বিভিন্ন অর্থ বুঝাতে ব্যবহৃত হয় - যা প্রাণহীন জড় পদার্থের বেলায় প্রযোজ্য নয়। এর একটি অর্থ হচ্ছে শারীরিক অনুভূতি , যেমন : বলা হয় , নখ , দাঁত , হাড় ও চুলে রূহ্ (অনুভূতি) নেই। এর অন্য একটি অর্থ হচ্ছে মানসিক চেতনা , যেমন : আমরা বলি , খোদায়ী চেতনা , শয়ত্বানী চেতনা , আদর্শিক চেতনা ইত্যাদি। ওপরের আয়াতে যে রূহ্ ” সম্পর্কে প্রশ্ন করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাতে সম্ভবতঃ মানুষের মধ্যকার সেই মানবিক চেতনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিলো যা মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে পৃথক করে। আর এটা হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার গুণাবলীর অনুরূপ গুণাবলী (যদিও অপূর্ণ মাত্রায়) এবং এটাই খোদায়ী চেতনা। এ খোদায়ী চেতনার কারণেই মানুষ বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্) , ও স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী এবং সে তা কাজে লাগাতে পারে।

কোরআন মজীদে হযরত আদম ( আঃ)-এর মধ্যে এ ধরনের রূহ্ ফুঁকে দেয়ার কথাই বলা হয়েছে এবং হযরত ঈসা ( আঃ)কে এ অর্থেই রূহুল্লাহ্ বলা হয়েছে। কিন্তু আরবী ভাষা থেকে অন্য ভাষায় স্থানান্তরের সময় অসাবধানতাবশতঃ রূহ্ ” থেকে ব্যক্তিসত্তা ’ অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। আর এ থেকেই হযরত আদম ( আঃ) ও হযরত ঈসা ( আঃ)-এর মধ্যে আল্লাহর প্রবেশের এবং সকল মানুষের মধ্যে আল্লাহ্ আছেন - এমন উদ্ভট ধারণা সমূহ গড়ে উঠেছে।

প্রকৃত পক্ষে রূহ্ ফুঁকে দেয়ার বিষয়টি হচ্ছে আগুনের স্পর্শে কোনো দাহ্য পদার্থে আগুন ধরানোর মতো যার ফলে মূল আগুন স্বস্থানেই থেকে যায় , সংশ্লিষ্ট দাহ্য পদার্থে প্রবেশ করে না। অথবা এ যুগের পরিভাষায় এর অধিকতর উত্তম তুলনা হতে পারে কোনো কম্পিউটারের অনেকগুলো ফাইলের মধ্য থেকে অন্য কোনো কম্পিউটারে কোনো একটি ফাইল কপি করার সাথে - যার ফলে মূল কম্পিউটার থেকে ফাইলটি বিলুপ্ত হয়ে যায় না।

অতীতে বিভিন্ন অংশীবাদী ধর্মে যে পূর্ববর্তী ধর্মনেতার মৃত্যুতে তার আত্মা পরবর্তী ধর্মনেতার মধ্যে প্রবেশের ধারণা গড়ে ওঠে (যেমন : বৌদ্ধ ধর্মের লামা ’ ) - আরবী ভাষায় যাকেحلول روح (কারো শরীরে অন্য কারো রূহের প্রবেশ) বলা হয় , শুরুতে হয়তো তা থেকে পূর্ববর্তী ব্যক্তির দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট চেতনা অর্থ বুঝানো হতো , কিন্তু পরে এ থেকে ব্যক্তিসত্তা অর্থ গ্রহণ করা হয়।

কোরআন মজীদে জীবন (হায়াত্)-এর কথা বলা হয়েছে , কিন্তু এর কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয় নি। প্রশ্ন হচ্ছে , দেহ ও আত্মা (নাফ্স্)-এর সংযুক্ত অবস্থার প্রতিক্রিয়াই কি জীবন , নাকি এ ছাড়াও জীবন বা প্রাণের স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব রয়েছে ? নাকি সুনির্দিষ্ট শৃঙ্খলা থেকে গড়ে ওঠা দেহের সক্রিয়তারূপ আপেক্ষিক অস্তিত্বই প্রাণ এবং তা-ই জীবনের কারণ ?

এ সম্পর্কে কোরআন মজীদে সরাসরি কিছু বলা হয় নি , তবে কোরআন মজীদের কোনো কোনো আয়াত থেকে এই শেষোক্ত তাৎপর্যই নিষ্পন্ন হয়। কারণ , কোরআন মজীদে হায়াত্ ” (জীবন) ছাড়াও নাফ্স্ ” (ব্যক্তিসত্তা)-এর কথা বলা হয়েছে , কিন্তু শরীর থেকে ব্যক্তিসত্তা (নাফ্স্) স্থায়ীভাবে বেরিয়ে যাবার কারণে মত্যু ঘটার কথা বলা হয় নি , বরং মৃত্যুঘটা তথা শরীরযন্ত্র অকেজো হয়ে যাবার কারণে ” শরীর থেকে ব্যক্তিসত্তা (নাফ্স্) স্থায়ীভাবে বেরিয়ে যাবার কথা বলা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় যে , আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্ট সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা থেকে গড়ে ওঠা দেহের সক্রিয়তারূপ আপেক্ষিক অস্তিত্বই প্রাণ এবং তা-ই জীবনের কারণ।

কোরআন মজীদে রূহ্ ও হায়াত্ ছাড়াও নাফ্স্-এর কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে - যা থেকে প্রমাণিত হয় যে , নাফ্স্ এতদুভয় থেকে স্বতন্ত্র এবং এটাই হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিসত্তা। এরশাদ হয়েছে :

) اللَّهُ يَتَوَفَّى الأنْفُسَ حِينَ مَوْتِهَا وَالَّتِي لَمْ تَمُتْ فِي مَنَامِهَا فَيُمْسِكُ الَّتِي قَضَى عَلَيْهَا الْمَوْتَ وَيُرْسِلُ الأخْرَى إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى(

“ আল্লাহ্ নাফ্স্ সমূহকে ফওত্ করিয়ে দেন (অধিগ্রহণ করেন) তার মৃত্যুর সময় এবং যে মারা যায় নি তার ঘুমের মধ্যে , অতঃপর , যার ওপরে মৃত্যুর ফয়ছ্বালা কার্যকর হয়েছে তাকে রেখে দেন এবং অপরটিকে তার আজালে মুসাম্মা (মৃত্যুর সময়) না আসা পর্যন্ত সময়ের জন্য পাঠিয়ে দেন। ” (সূরাহ্ আয্-যুমার্ : ৪২)

এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে , ঘুমন্ত ও মৃত ব্যক্তি উভয়ের নাফসকেই আল্লাহ্ তা আলা এক বিশেষ ব্যবস্থাপনাধীনে অর্থাৎ আালামে বারযাখে নিয়ে নেন , তবে ঘুমন্ত ব্যক্তির নাফসকে পুনরায় ফিরিয়ে দেন , কিন্তু মৃত ব্যক্তির নাফসকে আর ফিরিয়ে দেন না। বলা বাহুল্য যে , নাফসকে অধিগ্রহণ করা সত্ত্বেও ঘুমন্ত ব্যক্তির শরীরের স্বয়ংক্রিয় কাজগুলো চলতে থাকে এবং সে জাগ্রত না থাকলেও জীবিত। অতএব , বুঝা যাচ্ছে যে , শরীর জীবিত থাকার কারণ (عامل -factor ) নাফ্স্ নয় , বরং অন্য কিছু। তা হচ্ছে শরীরের যান্ত্রিক ক্রিয়া (ন্যূনতম ক্রিয়াগুলো হলেও) চালু থাকা , আর এ থেকেই প্রাণের আপেক্ষিক ধারণা নিষ্পন্ন হয়। সুতরাং প্রাণ ও নাফ্স্ স্বতন্ত্র।

‘ আারেফগণ (ইসলামী আধ্যাত্মসাধকগণ) অবশ্য একই ব্যক্তিসত্তায় একাধিক নাফ্স্-এর প্রবক্তা। তাঁরা নাফ্স্-এর ক্ষেত্রে নাফসে আম্মারাহ্ (কুপ্রবৃত্তি বা কুপ্রবণ নাফ্স্) , নাফসে লাওয়ামাহ্ (অনুগত নাফ্স্) ও নাফসে মুতমায়িন্নাহ্ (প্রশান্ত নাফ্স্) - এই তিন ধরনের নাফ্স্-এর কথা বলেন।

অবশ্য কোরআন মজীদে সুস্পষ্ট ভাষায় নাফসে আম্মারাহ্ ও নাফসে মুতমায়িন্নাহর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তা থেকে একই ব্যক্তির মধ্যে একাধিক নাফ্স্ রয়েছে এরূপ মনে করার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। কারণ , এ সব ক্ষেত্রে আম্মারাহ্ ” , লাওয়ামাহ্ ” ও মুতমায়িন্নাহ্ ” হচ্ছে নাফ্স্ ” -এর বিশেষণ। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির পক্ষে ভালো বা মন্দ হওয়া সম্ভব , তেমনি অনুগত , বিদ্রোহী , অস্থিরচিত্ত ও প্রশান্তচিত্ত হওয়া সম্ভবপর। এ থেকে একটি দেহে একাধিক ব্যক্তিসত্তার উপস্থিতি প্রমাণিত হয় না। কারণ , নাফসকে বিভিন্ন ধরনের বিশেষণে বিশেষায়িত করা হলে তা থেকে নাফসের সংখ্যার একাধিক্য বুঝায় না। বস্তুতঃ কোনো নাফসের মধ্যে যেমন ভালো বা মন্দ কোনো একটি গুণের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে , তেমনি তাতে বিভিন্ন গুণের সংমিশ্রণও হতে পারে। তেমনি বিভিন্ন গুণের পরিবর্তন ও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটতে পারে। সুতরাং একটি দেহে যে একটিমাত্র নাফ্স্ বা ব্যক্তিসত্তা থাকে এতে সন্দেহের কোনোই অবকাশ নেই।

প্রতিটি বস্তুকণাতেই চেতনা

এ প্রসঙ্গে চমক সৃষ্টিকারী একটি তথ্য হচ্ছে এই যে , সাম্প্রতিক কালে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন যে , প্রতিটি বস্তুকণাতেই চেতনা বিদ্যমান। এ কথা মেনে নিলে বলা যায় যে , অনেকগুলো বস্তুকণার সুনির্দিষ্ট বিন্যাসের ফলে যেভাবে বিভিন্ন ধরনের বস্তুর একেকটি সুনির্দিষ্ট আকার-আকৃতি বিশিষ্ট একক গড়ে ওঠে অথচ মুল কণাগুলো কণাই থেকে যাচ্ছে ঠিক সেভাবে একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় বস্তু-এককটি একটি উচ্চতর চেতনার অধিকারী হয় অথচ বস্তুকণাগুলোর মূল চেতনা যথাস্থানেই থেকে যাচ্ছে। একে বিভিন্ন সজীব কোষ এবং অণুজীব (যেমন : শ্বেতকণিকা) সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আমাদের বস্তুদেহের সাথে তুলনা করা যায় - যাতে উচ্চতর স্বতন্ত্র প্রাণসত্তা গড়ে উঠেছে যদিও অণুজীবগুলোর প্রাণশীলতা বিলুপ্ত হয়ে যায় নি।

যদিও মুসলমানদের অধিকাংশের মধ্যে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে এই যে , শরীর গঠনের এক পর্যায়ে বাইরে থেকে তাতে নাফ্স্ প্রবেশ করানো হয় , কিন্তু অনেক মুসলিম দার্শনিক ও বিজ্ঞানী মনে করতেন যে , আল্লাহ্ তা আলা বস্তুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শরীর গঠনের এক পর্যায়ে তাতে নাফসের উদ্ভব হওয়ার ব্যবস্থা নিহিত রেখেছেন।

প্রতিটি অণুতে চেতনা থাকার ধারণা সঠিক হবার সম্ভাবনার সপক্ষে কোরআন মজীদ থেকে সমর্থন পাওয়া যায়। কারণ , আমরা যে সব অস্তিত্বকে স্রেফ্ বস্তুগত সত্তা বা জড়বস্তু বলে থাকি কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে সেগুলোরও প্রাণ ও ব্যক্তিসত্তা আছে। কোরআন মজীদে বিভিন্ন প্রাকৃতিক অস্তিত্ব কর্তৃক আল্লাহ্ তা আলাকে সিজদাহ্ করার ও তাঁর তাসবীহ্ করার কথা বলা হয়েছে , যদিও সে সিজদাহ্ ও তাসবীহর ধরন আমাদের সিজদাহ্ ও তাসবীহ্ করার অনুরূপ নয় , তবে বিভিন্ন আয়াতের উক্তি থেকে প্রমাণিত হয় যে , তাদের সিজদাহ্ ও তাসবীহর কথা রূপক অর্থে বলা হয় নি , বরং আক্ষরিক অর্থেই বলা হয়েছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে :

) تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالأرْضُ وَمَنْ فِيهِنَّ وَإِنْ مِنْ شَيْءٍ إِلا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَكِنْ لا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ(

“ সাত আসমান ও পৃথিবী এবং এ সবের মধ্যে যা কিছু আছে সব কিছুই তাঁর (আল্লাহর) তাসবীহ্ (মহিমা বর্ণনা) করে এবং এমন কোনো কিছু নেই যা (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে) তাঁর তাসবীহ্ না করে। কিন্তু তোমরা তাদের তাসবীহ্ অনুধাবন করতে পারো না। ” (সূরাহ্ আল্-ইসরা ’ / বানী ইসরাঈল্ : ৪৪)

এখানে তাসবীহ্ করার কথাটা যদি রূপকার্থক হতো , অর্থাৎ সব কিছুই আল্লাহ্ তা আলার তৈরী প্রাকৃতিক বিধানের শৃঙ্খলে আবদ্ধ - এটা বুঝানোই উদ্দেশ্য হতো , তাহলে এ কথা বলার প্রয়োজন হতো না যে , আমরা তাদের তাসবীহ্ অনুধাবন করতে পারি না। বরং এ কথা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে , সব কিছু স্বেচ্ছায় তাসবীহ্ করে।

অবশ্য কেউ হয়তো এ প্রশ্ন তুলতে পারে যে , কাফের-নাস্তিকরা তো আল্লাহ্ তা আলার অস্তিত্বকেই স্বীকার করে না , তাই তাদের পক্ষ থেকে আল্লাহ্ তা আলার তাসবীহ্ করার কথা আসে কীভাবে ? এর জবাব হচ্ছে এই যে , তারা তাদের প্রবৃত্তির দাসত্বের কারণে আল্লাহকে স্বীকার করে না বটে , কিন্তু তারা তাদের সহজাত জ্ঞানের দ্বারা জানে যে , একজন মহাজ্ঞানময় সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত এ জগত অস্তিত্বলাভ করে নি। অন্যদিকে তারা যখন আল্লাহ্ তা আলার কোনো সৃষ্টির সৃষ্টিকুশলতা ও গুণাবলীর প্রশংসা করে তখন কার্যতঃ তারা আল্লাহ্ তা আলারই প্রশংসা করে , ঠিক যেভাবে কোনো শিল্পকর্মের প্রশংসা করা মানেই তার শিল্পীর প্রশংসা।

অন্য এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

) ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ وَهِيَ دُخَانٌ فَقَالَ لَهَا وَلِلأرْضِ اِئْتِيَا طَوْعًا أَوْ كَرْهًا قَالَتَا أَتَيْنَا طَائِعِينَ(

“ অতঃপর তিনি (আল্লাহ্) আসমানের প্রতি মনোযোগ দিলেন , আর তখন তা ছিলো ধূম্র (গ্যাসীয় আকারে) ; তখন তিনি তাকে ও পৃথিবীকে বললেন : উভয়ই (নিয়ন্ত্রণে) এসো স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছাক্রমে। তখন উভয় বললো : আমরা স্বেচ্ছায় (নিয়ন্ত্রণে) এলাম। ” (সূরাহ্ ফুছ্বছ্বিলাত্/ হা-মীম্-আস্-সাজদাহ্ : ১১)

এখানে উভয় স্বেচ্ছায় (নিয়ন্ত্রণে) এলো ’ না বলে উভয় বললো : বলা থেকে সুস্পষ্ট যে , বিষয়টি রূপক বা ভাবার্থক নয় , বরং আসমান ও যমীনের প্রাণ ও ব্যক্তিসত্তা আছে। সুতরাং যা কিছু তাসবীহ্ করে সেগুলোর প্রত্যেকটিরই প্রাণ ও ব্যক্তিসত্তা আছে - তা যে স্তরেরই হোক না কেন।

ইসলাম চৌদ্দশ ’ বছর আগে উদ্ভিদ কর্তৃক আল্লাহকে সিজদাহ্ করার কথা বলেছে এবং তাদের প্রাণ , চেতনা , সুখ-দুঃখ ও ব্যথা-বেদনা থাকার কথা বলেছে তথা তাদের প্রতি ব্যক্তিত্ব আরোপ করেছে - কেবল বিংশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞানীরা যার সন্ধান পেয়েছেন। বর্তমান যুগের অনেক বিজ্ঞানী ভিন্ন মাত্রার (Dimension ) প্রাণের সম্ভাবনা স্বীকার করেছেন। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো তাঁরা পৃথিবী , আগুন , বাতাস ইত্যাদিতেও প্রাণের ও ব্যক্তিসত্তার সন্ধান পাবেন।

সব কিছুতে প্রাণ থাকার বিষয়টি কোরআন মজীদের অন্য এক আয়াত থেকেও প্রমাণিত হয়। এরশাদ হয়েছে :

) وَمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلا لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ(

“ আর এ দুনিয়ার জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক বৈ নয় এবং নিঃসন্দেহে আখেরাতের গৃহ প্রাণময় ; যদি তারা জানতো! (সূরাহ্ আল্- আনকাবূত্ : ৬৪)

এ থেকে সুস্পষ্ট যে , সব কিছুতেই প্রাণ আছে , কিন্তু আমরা আমাদের শারীরিক ইন্দ্রিয়নিচয়ের ধারণক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে সকল কিছুর প্রাণ সম্পর্কে বুঝতে পারি না। আখেরাতের জীবনে এ সীমাবদ্ধতা থাকবে না বলেই সেখানে সকল প্রাণ সম্পর্কে বুঝতে পারা সম্ভব হবে।

যা-ই হোক , প্রতিটি বস্তুকণায় চেতনা আছে , এর মানে হচ্ছে প্রতিটি বস্তুকণাকে জুড়ে একটি অবস্তুগত অস্তিত্বও রয়েছে। তেমনি সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক বিধিবিধানের আওতায় যখন বস্তুকণাসমূহ মিলে একটি উচ্চতর বস্তু-একক গড়ে ওঠে , সাথে সাথে তার মধ্যে একটি উচ্চতর চেতনা ও ব্যক্তিসত্তা গড়ে ওঠে - যা বস্তু থেকে গড়ে উঠলেও এবং বস্তুকে আশ্রয় করে অবস্থান করলেও তা ভিন্ন মাত্রার অবস্তুগত স্বতন্ত্র অস্তিত্ব। ফলে বস্তুসত্তা বিশ্লিষ্ট ও বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলেও সে অবস্তুগত সত্তা বিলুপ্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই , বরং তা এক ভিন্ন মাত্রার জগতে অবস্থান গ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক।

এভাবে কার্যতঃ বস্তুগত এককসমূহ , বিশেষতঃ শরীর সমূহ যেমন বিভিন্ন বস্তুগত এককের সমন্বয়ে গঠিত অথচ সে এককগুলোর স্বতন্ত্র অস্তিত্বও অব্যাহত থাকে , তেমনি তাকে আশ্রয় করে স্বতন্ত্র উচ্চতর নাফ্স্ গড়ে উঠলেও তার এককসমূহের নাফ্স্ স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বমান থাকে।

নাফসের এ ধরনের ধারণা কোরআন মজীদের আয়াত থেকেও পাওয়া যায়। এরশাদ হয়েছে :

) حَتَّى إِذَا مَا جَاءُوهَا شَهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعُهُمْ وَأَبْصَارُهُمْ وَجُلُودُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ. وَقَالُوا لِجُلُودِهِمْ لِمَ شَهِدْتُمْ عَلَيْنَا قَالُوا أَنْطَقَنَا اللَّهُ الَّذِي أَنْطَقَ كُلَّ شَيْءٍ(

“ আর তারা যখন তার (জাহান্নামের) কাছে পৌঁছবে তখন তাদের কান , চোখ ও ত্বক তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে। তখন তারা তাদের ত্বককে বলবে : কেন তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে ? তখন তারা (চামড়া সমূহ) বলবে : যে আল্লাহ্ সব কিছুকেই বাকশক্তি দিয়েছেন তিনিই আমাদেরকে বাকশক্তি দিয়েছেন। ” (সূরাহ্ ফুছ্বছ্বিলাত্/ হা-মীম্-আস্-সাজদাহ্ : ২০-২১)

এ থেকে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা এবং সেই সাথে ব্যক্তির নিজস্ব স্বতন্ত্র ও উচ্চতর ব্যক্তিসত্তা প্রমাণিত হয়। এটা অনেকটা একটা গাড়ীর ব্যাটারী , রেডিও , ইঞ্জিন , লাইট ইত্যাদির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও এতদসহ গাড়ীটির স্বতন্ত্র উচ্চতর অস্তিত্বের ন্যায় , যদিও প্রাণীদেহের সাথে এর তুলনা এক ধরনের দুর্বল উপমা মাত্র।

মোদ্দা কথা , শরীর যেমন বিভিন্ন একক সমন্বয়ে গঠিত এককসমূহের স্বাতন্ত্র্য সহকারেই একটি উচ্চতর যৌগিক সত্তা তেমনি একটি প্রাণীর ব্যক্তিসত্তা (নাফ্স্)ও কতক স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তার স্বাতন্ত্র্য সহকারেই একটি উচ্চতর ব্যক্তিসত্তা (নাফ্স্) । আর আখেরাতে যেভাবে সকল কিছুতে প্রাণের অস্তিত্ব সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়বে এবং নাফসের এ ধরনের যৌগিকতার ওপর থেকে অজ্ঞানতার পর্দা উন্মোচিত হয়ে যাবে , আালামে বারযাখ্ আখেরাতের জীবনের অবস্তুগত নমুনা বিধায় সেখানেও এ পর্দা উন্মোচিত হয়ে যাবে বলে যৌক্তিক উপসংহারে উপনীত হওয়া যেতে পারে।

বাঁদুড় পাখি

কখনও কখনও অন্ধকার রাত্রে একটা ব্যতিক্রমধর্মী প্রাণীর আনাগোনা দৃষ্টিগোচর হয়। আমরা দেখতে পাই রাত্রের গভীর অন্ধকারের মধ্যেও এ পাখি সাহসিকতার সাথে খাবারের সন্ধানে এদিক সেদিক ছুটে বেড়ায়। ঘুট ঘুটে অন্ধকার । রাত্রে যখন কোন কিছুই দৃষ্টিগোচন হয় না তখন এরই মাঝে নির্ভয়ে উড়ে বেড়ায় একটি ছোট্ট পাখি। রাতেই তার বিচরণ সময়। খাবার যোগাড় করে সে রাত্রেই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীর শিকার এ গভীর ও ঘন অন্ধকারেই করে থাকে সে। এ ছোট্ট পাখিটির নাম বাঁদুড়। প্রকৃতিতে এটি একটি বিষ্ময়ক র প্রাণী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী আশ্চর্য হলো ঘুট ঘুটে অন্ধকার রাত্রিতে এর বিচরণ।

এ দ্রুতগতি সম্পন্ন ক্ষুদ্র পাখি রাতের আঁধারে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় না। এটা কতই না বিষ্ময়কর! এ ব্যাপারে যতই পর্যবেক্ষণ ও অধ্যায়ন করা হয় ততই এর অন্তর্নিহিত ও গুপ্ত রহস্য আমাদের সামনে আরো অধিক পরিমাণে উদ্ঘাটন হয়ে পড়ে। দিবালোকে একটা দ্রুত উড্ডয়নশীল পাখি যে ভাবে নির্ভয়ে আকাশে উড়ে বেড়ায় এ ক্ষুদ্র বাদুড় পাখিটাও সেভাবে অন্ধকার রাতে নির্ভয়ে আকাশে উড়ে বেড়াতে সক্ষম।

আমরা জানি এ পাখির কোন চোখ নেই। তবুও রাতের অন্ধকার তার জন্যে সমস্যাই নয়। যদি তার উড্ডয়নের পথে প্রতিবন্ধকতার ব্যাপারে কোন প্রকার তথ্য সংগ্রহের মাধ্যম না থাকে তাহলে কিভাবে সে এত অকুতোভয় ? কোথাও তো আঘাত লেগে গতিরোধ হচ্ছে না ?

দেখা গেছে যদি এ পাখিটাকে কোন আঁকাবাঁকা ও অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে ছেড়ে দেয়া হয় আর সুড়ঙ্গ পথের দেয়ালগুলোতে কালি মেখে রাখা হয় তারপরও এ বিষ্ময়কার প্রাণীটি খুব সুন্দরভাবে কোন রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অবস্থায় সুড়ঙ্গের অন্য পথ দিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম। বাদুড় পাখির মধ্যকার এ বিষ্ময়কর অবস্থার সাথে আধুনিক বিশ্বের আবিষ্কার রাডার1 নামক যন্ত্রের তুলনা করা যেতে পারে। বাঁদুড় পাখি সৃষ্টিকর্তার এক আশ্চর্য সৃষ্টি। এর অন্তর্নিহিত ব্যবস্থাপনার গভীরতা উপলব্ধির জন্যে রাডার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা থাকা প্রয়োজন। সাধারণত: পদার্থ বিদ্যায় শব্দের অধ্যায়ে মহাশব্দ বা অতিশব্দ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হয়ে থাকে। এ মহাশব্দের তরঙ্গমালা এত দ্রুতগতিসম্পন্ন ও দীর্ঘ যে মানুষের দ্বারা কোন ক্রমে তা কর্ণগোচন সম্ভব নয়। এটা পরীক্ষিত সত্য যে ,যখন কোন দেয়ালে ছুড়ে মারা হয় তখন তা ঠিক নিক্ষেপের গতিতেই পূর্বস্থানে ফিরে আসতে বাধ্য। যখন আমরা কোন পাহাড়ের নিকট গিয়ে চিৎকার করি তখন এর ধ্বনি একট নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পূর্বস্থানের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। তদ্রুপ কোন মহাশব্দের তরঙ্গ একটা নির্দিষ্ট স্থান থেকে নিক্ষেপ করা হলে তা নির্দিষ্ট গতিতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যখনই কোন কিছুতে বাধাগ্রস্থ হয় তখনই তা পূর্বের অবস্থানের দিকে ফিরে আসে। সচরাচর যুদ্ধের সময় শত্রু বিমানকে চিহ্নিত করার জন্যে এ ধরণের রাডার থেকে একটা বিশেষ শব্দ বিমানের উদ্দেশ্য প্রেরণ করা হয়ে থাকে। আর যখনই তা শত্রু বিমানে আঘাত প্রাপ্ত হয় তখনই একটা নির্দিষ্ট গতিতে প্রত্যাবর্তন করে রাডার যন্ত্রে। এরই মাধ্যমে শত্রু বিমানের গতিবেগ ,দুরত্ব ইত্যাদি নির্ণয় করা হয়ে থাকে।

বিজ্ঞানীরা বলেন ,বাদুড় পাখির দেহে রাডারের ন্যায় একটা যন্ত্র বিদ্যমান। তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন যদি বাদুড় পাখিকে একটা শুন্য কক্ষে ছেড়ে দেয়া হয় আর সেখানে মহাশব্দ ধারণ ও তা সাধারণ শব্দের তরঙ্গে পরিণত করার ক্ষমতাসম্পন্ন কোন মাইক্রোফোন রাখা হয় তাহলে পরিষ্কারভাবে রাডার থেকে নির্গত মহাশব্দ শ্রবণ সম্ভবপর হয়ে উঠবে। প্রতি সেকেন্ডে ত্রিশ থেকে ষাট বার মহাশব্দের তরঙ্গ বাদুড় পাখির নিকট থেকে শোনা যায় বলে তারা ধারনা করে থাকেন।

আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে বাদুড় তার বাকযন্ত্র থেকে শব্দ নির্গত করে তা নাসিকার মাধ্যমে বাইরে ছেড়ে দেয়। আর তা কোন স্থানে বাধাগ্রস্থ হয়ে ফিরে আসে কর্ণে। বাদুড়ের কর্ণ নির্গত তরঙ্গরাজীর ধারক। এ পাখি তার কর্ণের মাধ্যমেই উপলব্ধি করতে পারে কতটুকু দুরত্বে বাধাগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণেই এ ক্ষুদ্র প্রাণী রাতের অন্ধকারে শিকারের খোঁজে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে। কি অবাক সব ক্রিয়া-কান্ড! এতসব জটিল ব্যবস্থাপনা কি কোন একজন বুদ্ধিমান ও সর্বজ্ঞানী ব্যবস্থাপক ব্যতীত অন্য কারো দ্বারা সম্ভব ? আর কোন বুদ্ধিহীন ব্যবস্থাপক তো এ ব্যাপারে কোন ধারণাই রাখতে পারে না। সৃষ্টি জগতের এ বিশাল নৈপূণ্য ক্ষমতা ও জটিলতা দর্শনে এ অবধি অনেক বিজ্ঞানী এমন কোন একক মহাস্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন ,যিনি সকল প্রকৃতির উর্দ্ধে।

পুষ্প ও কীট পতঙ্গ

প্রাকৃতিক জগতে আরেকটি অত্যাশ্চর্য বিষয় হচ্ছে পুষ্প ও কীট পতঙ্গের মাঝে বন্ধুত্ব। বসন্তকালের শেষের দিক যখন ধীরে ধীরে বাতাস গরম হতে শুরু করে তখন ফলের বাগান গুলোতে বিভিন্ন প্রকার কীট পতঙ্গের আনাগোনা দেখা যায়। ছোট-বড় পতঙ্গ ,প্রজাপতি ,মৌমাছি ইত্যাদি কত রকমের প্রাণী। এধরণের প্রাণীর কাজ হলো এরা কোন এক গাছের ফুলের উপর বসে রস আহরণ করে অন্য গাছের পাপড়ির উপর গিয়ে বসে। ওরা পুঃলিঙ্গের গাছের পাপড়ি থেকে পরাগরেণু বহন করে নিয়ে যায় স্ত্রী লিঙ্গের পুষ্পের উপর। এভাবে বৃক্ষরাজীর মাঝে সঙ্গম ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পরিণতিতে বৃক্ষরাজী ফুলে -ফলে ভরপুর হয়ে উঠে।

এ সময়ে বিভিন্ন প্রকার কীট-পতঙ্গের আনাগোনা ,এক ডাল থেকে অন্য ডালে বিচরণ ,গাছে গাছে উড়ে বেড়ানো ইত্যাদি দেখে মনে হয় কোন এক বিশেষ শক্তি তাদেরকে ঠিক একটি উৎপাদনশীল শিল্প কারখানার শ্রমিকদের ন্যায় পরিচালনা করছে। ফলে সকলে নিজ কর্মে পরিপূর্ণ আত্মনিয়োগ করে আছে। কাজের কোন ফাঁকি নেই। পরিশ্রম করছে সবাই একযোগে। যথাযথভাবে সকলে স্ব -স্ব দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। কতই না বিষ্ময়কর এ বিষয়টি !

কখনো কি ভেবে দেখেছি ,যেখানে বৃক্ষ ,তরুলতার নড়াচড়া ও স্থান পরিবর্তন করার ক্ষমতা নেই সেখানে ওগুলো কি ভাবে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয় আর কি পদ্ধতিতে তাদের সঙ্গমক্রিয়া সম্পন্ন হয় ? কিভাবে বৃক্ষরাজীর মাঝে পুরুষ পরাগরেণু ও স্ত্রী ডিম্বানুর মিলন ঘঠে ? অনেক ক্ষেত্রে এ অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজটির দায়িত্ব কীট পতঙ্গের উপর ন্যস্ত। আবার কখনো বায়ু এ মিলন ক্রিয়াতে সাহায্য করে থাকে। যখন কোন ব্যক্তি কীট-পতঙ্গ ও বৃক্ষরাজীর মধ্যকার এ বিষ্ময়কর ঘটনাবলী অধ্যয়ন করে তখন স্বভাবতঃই তার মনে প্রশ্নের উদেয় হয় ,কে কীটপতঙ্গ ও বৃক্ষদের মাঝে এ অপুরম ও মজবুত বন্ধুত্ব স্থাপন করে দিয়েছে ?

আমাদের চারপার্শ্বে রয়েছে এ ধরণের বহু আশ্চর্য ঘটনা যা বিশ্বকে দান করে এক সাবলীল সৌন্দর্য ও বিশেষ নিয়ম-শৃঙ্খলা। বিশ্বজগত চমৎকার ও বিষ্ময়কর সৃষ্টিতে ভরপুর। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে কোন সৃষ্টিকে নিয়ে যদি আমরা সামান্য পরিমাণ অধ্যয়ন ,গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখতে পাব বহু অত্যাশ্চর্য ক্রিয়া-কান্ড ,সুনিপুণ কলা-কৌশল ও ব্যবস্থাপনা। এ প্রসঙ্গে কোরআন উল্লেখ করছে :

) يُنبِتُ لَكُم بِهِ الزَّرْعَ وَالزَّيْتُونَ وَالنَّخِيلَ وَالْأَعْنَابَ وَمِن كُلِّ الثَّمَرَاتِ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ(

অর্থাৎ : (আল্লাহ্) তোমাদের জন্যে ওটার (বৃষ্টির) মাধ্যমে কৃষিকার্য উৎপাদন এবং জলপাই ,খেজুর ও আঙ্গুর ইত্যাদি সব ধরণের ফলাদি বৃক্ষ সমুদগত করেন ,নিশ্চয়ই এগুলোর মধ্যে চিন্তাশীলদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। (আন্ নাহল ,আঃ নং-11 )

আল্লাহ্ অন্যত্র বলেন-

) إ ِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنفَعُ النَّاسَ وَمَا أَنزَلَ اللَّـهُ مِنَ السَّمَاءِ مِن مَّاءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِن كُلِّ دَابَّةٍ وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ(

অর্থাৎ : নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও যমীন এবং দিবা-রাত্রির পালা বদল এবং মানুষের উপকারার্থে চলন্ত জাহাজসমূহ এবং আল্লাহ্ কর্তৃক আসমান থেকে বারিবর্ষন যার ফলে মৃত যমীন পুনরায় প্রাণ ফিরে পায় এবং যমীনের বুকে চতুষ্পদ জন্তুর উত্থান আর বায়ুরাশির গতি পরিবর্তন এবং আসমান ও যমীনের মাঝখানে সংরক্ষিত ও করতলগত মেঘ খণ্ড চিন্তাশীলদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। (আল্ বাক্বারা ,আঃ নং-164। )

6

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি

শিশু জন্মলগ্ন থেকেই তার চার পাশে অনেককে দেখতে পায়। সর্বপ্রথম যার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে তিনি হলেন নবজাত শিশুর মা। ধীরে ধীরে যখন শিশু বড় হতে থাকে তখন সে মা ছাড়াও আরো অনেকের সাখে পরিচয় লাভ করে। আস্তে আস্তে বিভিন্ন ধরনের বস্তুর সাথেও পরিচিত হতে থাকে। এভাবে শুরু হয় একটি শিশুর জীবনযাত্রা।

মানুষ স্বভাবগত ভাবেই কৌতুহলী। তার চারপাশের বিভিন্ন বস্তু ও ব্যক্তি সন্বন্ধে জানার কৌতুহলী মনোভাব শৈশবেই প্রতিটি শিশুর মাঝে পরিলক্ষিত হয়। প্রথমে সে ক্ষুদ্র জিনিষ থেকেই শুরু করে ,পরে বয়স যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে ততই জীজ্ঞাসার মাত্রা ও পরিমাপও বেশী হতে থাকে।

একটি শিশু যখন পাঠশালায় গমন করে তখন সে তার চতুষ্পার্শ্বে অনেক ধরনের সৃষ্টির সাথে পরিচয় লাভ করে। আর প্রথম থেকেই তো এ আকাশ তার মাথার উপর ছেয়ে আছে। অক্সিজেন অনবরত গ্রহণ করছে। পানি পান করছে। এভাবে সে ধীরে ধীরে পাহাড়-পর্বত ও নদ-নদী এবং অনেক ধরনের গৃহপালিত পশু-পাখির সাথে পরিচয় লাভ করতে থাকে। ঐ শিশুর কৌতুহলী মনে একটি মাত্র জিজ্ঞাসা এত সব কিছু ,কে সৃষ্টি করলো ? সৃষ্টির পেছনে কি উদ্দেশ্য নিহিত আছে ? সূর্য প্রভাতে পূর্বাকাশে উদয় হয় আবার সন্ধ্যাবেলা পশ্চিমাকাশে অস্ত যায় প্রতিদিন ,এ নিয়ম-শৃঙ্খলা কে তৈরী করলো ? রাত্রে যখন সে আকাশের তারকারাজীর দিকে তাকায় তখন আবারও তার মনে প্রশ্নের উদেয় ঘটে ,এত সুন্দর মনোরম নক্ষত্রমণ্ডলীকে কনো অভিজ্ঞ চিত্রকর আকাশের বুকে সাজিয়ে রেখেছে ? এসব প্রশ্নের উত্তরই হল বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি। বিশ্ব অস্তিত্ত্ব ও ব্যবস্থাপনা এবং মানুষ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিই হল অন্তরের এতসব প্রশ্নের উত্তর।

অনেকে বিশ্বাস করেন এ বিশ্বের সৃষ্টির পেছনে কোন পরিকল্পনা প্রণেতার প্রয়োজন নেই। এর পেছনে কোন উদ্দেশ্যও নেই। স্বয়ংক্রিয়ভাবে উদ্ভব হয়েছে এ সৃষ্টিজগত। প্রকৃতিই স্বয়ং সকল বস্তুর সৃষ্টিকর্তা। আর একেই বলে বস্তুবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি। প্রাক ইসলামী যুগে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীদের বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হতো। তন্মোধ্যে প্রাকৃতিবাদী ,যিনদিক ,দাহরী ও নাস্তিক অন্যতম। কিন্তু বর্তমান আধুনিক ,শিল্পোন্নত ও ইলেকট্রোনিক্স যুগে তাদের মুখোশ পরিবর্তন হতে দেখা যায়। বর্তমান বিশ্বে বস্তুবাদীদের বিভিন্নমুখী মতাদর্শের মধ্যে অতি পরিচিত নামটি হচ্ছে যুক্তিবাদী বস্তুবাদ বা Dialectic Materialism । আর মার্ক্সবাদী দর্শন এরই উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে।

আবার অনেকে বিশ্বাস করেন এ বিশ্ব জগতের বালু কণা থেকে শুরু করে প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে একটি নির্দিষ্ট কার্যকারণ ও উদ্দেশ্য রয়েছে। কোন কিছুই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হয়নি। বরং প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে কোন স্বাধীন সত্তার শক্তিমত্তা কাজ করছে। এ ধরনের চিন্তা ভাবনার নাম বিশ্ব সম্পর্কে আস্তিকবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।

আমাদের মনে রাখতে হবে বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি আর বিশ্ব পরিচিতি এক কথা নয়। এরা দুটি পৃথক পরিভাষা। দৃষ্টান্তস্বরূপ ,পৃথিবীতে পানির পরিমান মাটির চেয়ে কতগুণ বেশী ? অথবা সৌর জগতে বিরাজমান গ্রহের সংখ্যা কত ? ইত্যাদি সৃষ্টি জগতের পরিচয় নিয়ে আলোচনা মাত্র। এগুলোতে বিশ্ব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নয়। আর যখন আমরা সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করি ,যেমন ধরুন যদি বলি যে ,সমগ্র বস্তুজগত কোন অবস্তুগত সৃষ্টিকর্তার উপর নির্ভরশীল -তাহলে এ বিষয়টি বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্ভুক্ত বলে পরিগণিত হবে।

7

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির ফলশ্রুতি

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও বিজ্ঞানের উন্নতি

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশা

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন , আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে ,তা তো আছেই। আমাদের বিভিন্ন প্রকার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এগুলোর তো কোন পরিবর্তন আসবে না। তাহলে এ বিষয়ে এত আলোচনার কি প্রয়োজন ? এর আলোচনা আমাদের জন্যে কি ফলাফল বয়ে আনতে পারে ?

উক্ত প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় ,হ্যাঁ ,আমাদের চারদিকে কোন সৃষ্টির উপর প্রভাব ফেলবে না সত্য ,কিন্তু তাই বলে আমাদের কাজ-কর্ম ,আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হবে না এটা বলা মনে হয় সঠিক হবে না।

অধিকন্তু বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাবিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিষয়টির স্পষ্টতার জন্যে নিন্মে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা গেল।

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও বিজ্ঞানের উন্নতি

চিন্তা করে দেখুন ,আপনার বন্ধু সফর থেকে ফিরে এসেছে। সে আপনাকে একটি বই উপহার দিয়ে বললো এ চমৎকার বইটির লেখক একজন বড় চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ,বুদ্ধিমান ও বিজ্ঞ এবং উচ্চজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অধিকারী। নিশ্চয়ই আপনি সে বইটা হালকাভাবে রিডিং পড়েই ক্ষান্ত হবেন না। বরং এর প্রতিটি শব্দ ,বাক্য ও তাদের গঠন বর্ণনা ও পরিবর্তন সবকিছুকে খুব সূক্ষ্মভাবে মনযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করবেন। যদি কোথাও না বুঝে থাকেন তা হলে ঘন্টার পর ঘন্টা ,দিনের পরদিন মোট কথা সুযোগ পেলেই এ বিষয় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করবেন ,বোঝার চেষ্টা করবেন। সাধ্যমত পরিশ্রম করতেও আপনি কুন্ঠাবোধ করবেন না। কেননা ,এ বইয়ের গ্রন্থকার কোন সাধারণ লোক নন। তিনি একজন শীর্ষস্থানীয় গবেষক ,চিন্তাবিদ। তার কোন কথাই অযথা নয়। কোন বাক্যই তার অপরিকল্পিত নয়।

অপরদিকে যদি আপনাকে বলা হয় এ বইটা যদিও বাহ্যিকভাবে চমৎকার বলে মনে হবে কিন্তু এর পুস্তকার একজন অজ্ঞ ,মুর্খ ,নির্বোধ ও বুদ্ধিহীন ব্যক্তি। আপনি নিখুত ভাবে এ বইটার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন নাকি শুধুমাত্র একটু চোখ বুলিয়ে রেখে দিবেন ? কেননা আপনি জানেন এ বইয়ের কোন মূল্য নেই। কোন জ্ঞান-গর্ভ আলোচনা এ বইতে নেই। মোট কথা এ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করা অযথা সময় নষ্ট করারই নামান্তর বলে বিবেচনা করবেন। এ বিশ্বজগতও একটি বৃহৎ গ্রন্থের ন্যায়। এ জগতের প্রতিটি সৃষ্টি এক একটি বাক্য ,যার সমম্বয়ে গঠিত হয়েছে এ বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ।

যদি আমরা আস্তিকবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অনুগামী হই তাহলে এ বিশ্বের প্রতিটি বস্তু ,প্রতিটি সৃষ্টিকেই আমরা মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করবো আর খুব মনোযোগ সহকারে তাঁর প্রতিটি বিষয়ের অধ্যায়নে গুরুত্বারোপ করবো এবং কৌতুহলী অন্তঃকরণ নিয়ে প্রতিটি সৃষ্টির অন্তর্নিহিত রহস্যাবলী উদ্ঘাটনের জন্যে উদ্গ্রীব হবো। কেননা আমরা বিশ্বাস করি প্রতিটি সৃষ্টি বস্তুর পেছনে নিশ্চয়ই কোন শক্তিশালী ও বিশাল বুদ্ধিমান শক্তিমত্তা বা সৃষ্টিকর্তা ক্রিয়শীল রয়েছেন। তিনি অতিশয় বুদ্ধিমান ,প্রজ্ঞাবান ,শিল্পী ও জ্ঞানী। তিনি মহাবিজ্ঞানী ও দার্শনিক। সুতরাং তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। আর এ দৃষ্টিভঙ্গির কারনেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও উন্নতি সম্ভব হয়েছে।

আর যদি আমরা বস্তুবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হই তা হলে এ বিশ্বের রহস্যময় সৃষ্টিকুলের ব্যাপারে সামান্যতম চিন্তা-ভাবণা করারও মনোভাব তৈরী হবে না। কেনান ,বস্তুবাদীরা এ বিশ্বজগতের সৃষ্টিকারক হিসেবে বুদ্ধি ও জ্ঞানহীন প্রকৃতিকেই মনে করেন। আর এতসব কিছুর স্রষ্টা যদি এক নির্বোধ ও জ্ঞানহীন প্রকৃতি হয়ে থাকে তা হলে তার সৃষ্টির-ই বা কি মূল্য হতে পারে ?

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশা

কথায় বলে , নদীর এপাড় ভাঙ্গে ওপাড় গড়ে -এই তো নদীর খেলা। আর এ খেলা মানুষের জীবনেও ঘটে থাকে অহরহ। সাধারণতঃ মানুষের এ ক্ষণকালীন জীবনও বহু চড়াই-উৎরাই এর মধ্য দিয়ে বিকশিত হয় । তাই কখনো একজন মানুষের জীবনের দ্বারে কিছু অনাকঙ্খিত বিপদও কড়া নাড়তে পারে। অনেক সময় এমনও হয় যে এ অপ্রত্যাশিত সমস্যা থেকে তার পালানের কোন পথ থাকে না। তখন চতুর্দিকে পথরুদ্ধ অবস্থায় পড়ে যায় সে। এমতাবস্থায় সে নিজেকে অতিশয় দুর্বল ও অসহায় অবস্থার মুখোমুখি দেখতে পায়। আর এরকম কঠিন বিপদের মুহুর্তে একমাত্র আস্তিকবাদী দৃষ্টি-ভঙ্গিই তাকে মুক্তির সন্ধান দিতে পারে। কেননা ,সে তখন তার চেয়ে বড় ও বিশাল কোন অস্তিত্বের আশ্রয়ের সন্ধান খুঁজে পায়। তিনি জানেন এ বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টিই একজন পরম পরাক্রমশালী ও বুদ্ধিমান সৃষ্টিকর্তার অধীন। আর আমাদের পরিত্রানদাতাও তিনি। ফলে একজন আস্তিক ব্যক্তি এ ধরনের কঠিন ও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মোকাবলা করার জন্যে যথেষ্ট দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে থাকেন।

অপর দিকে একজন বস্তুবাদী ব্যক্তি এ ধরনের পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। হতাশা ও ভয় তাকে অক্টোপাসের মত ঘিরে ফেলে একটি ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের ন্যায়। এমতাবস্থায় সে নিরাশ্রিত অবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। আর এ কারনেই বস্তুবাদীরা এহেন তহাশাগস্থ অবস্থায় আত্মহত্যার ঘৃন্য পথের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে আস্তিকবাদীরা সর্বাবস্থায় তাদের মহাপরাক্রমশালী পরিত্রানদাতার আশ্রয় কামনা করে থাকেন। আর এ কারনেই তারা কখনো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন না।

আর এক ন্যায়সংগত কারণে ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা মহাপাপ বলে পরিগণিত। কেননা আত্মহত্যা হতাশা ও পরাজয়ের মনোভাব থেকেই জন্ম লাভ করে থাকে।

8

আস্তিকবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ

কার্যকারণ

শৃঙ্খলীয় প্রমাণ

মানব প্রকৃতি ও সত্যান্বেষী স্বভাব

অস্তিত্ব বিভক্তির প্রমাণ

বাঁদুড় পাখি

কখনও কখনও অন্ধকার রাত্রে একটা ব্যতিক্রমধর্মী প্রাণীর আনাগোনা দৃষ্টিগোচর হয়। আমরা দেখতে পাই রাত্রের গভীর অন্ধকারের মধ্যেও এ পাখি সাহসিকতার সাথে খাবারের সন্ধানে এদিক সেদিক ছুটে বেড়ায়। ঘুট ঘুটে অন্ধকার । রাত্রে যখন কোন কিছুই দৃষ্টিগোচন হয় না তখন এরই মাঝে নির্ভয়ে উড়ে বেড়ায় একটি ছোট্ট পাখি। রাতেই তার বিচরণ সময়। খাবার যোগাড় করে সে রাত্রেই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীর শিকার এ গভীর ও ঘন অন্ধকারেই করে থাকে সে। এ ছোট্ট পাখিটির নাম বাঁদুড়। প্রকৃতিতে এটি একটি বিষ্ময়ক র প্রাণী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী আশ্চর্য হলো ঘুট ঘুটে অন্ধকার রাত্রিতে এর বিচরণ।

এ দ্রুতগতি সম্পন্ন ক্ষুদ্র পাখি রাতের আঁধারে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় না। এটা কতই না বিষ্ময়কর! এ ব্যাপারে যতই পর্যবেক্ষণ ও অধ্যায়ন করা হয় ততই এর অন্তর্নিহিত ও গুপ্ত রহস্য আমাদের সামনে আরো অধিক পরিমাণে উদ্ঘাটন হয়ে পড়ে। দিবালোকে একটা দ্রুত উড্ডয়নশীল পাখি যে ভাবে নির্ভয়ে আকাশে উড়ে বেড়ায় এ ক্ষুদ্র বাদুড় পাখিটাও সেভাবে অন্ধকার রাতে নির্ভয়ে আকাশে উড়ে বেড়াতে সক্ষম।

আমরা জানি এ পাখির কোন চোখ নেই। তবুও রাতের অন্ধকার তার জন্যে সমস্যাই নয়। যদি তার উড্ডয়নের পথে প্রতিবন্ধকতার ব্যাপারে কোন প্রকার তথ্য সংগ্রহের মাধ্যম না থাকে তাহলে কিভাবে সে এত অকুতোভয় ? কোথাও তো আঘাত লেগে গতিরোধ হচ্ছে না ?

দেখা গেছে যদি এ পাখিটাকে কোন আঁকাবাঁকা ও অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে ছেড়ে দেয়া হয় আর সুড়ঙ্গ পথের দেয়ালগুলোতে কালি মেখে রাখা হয় তারপরও এ বিষ্ময়কার প্রাণীটি খুব সুন্দরভাবে কোন রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অবস্থায় সুড়ঙ্গের অন্য পথ দিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম। বাদুড় পাখির মধ্যকার এ বিষ্ময়কর অবস্থার সাথে আধুনিক বিশ্বের আবিষ্কার রাডার1 নামক যন্ত্রের তুলনা করা যেতে পারে। বাঁদুড় পাখি সৃষ্টিকর্তার এক আশ্চর্য সৃষ্টি। এর অন্তর্নিহিত ব্যবস্থাপনার গভীরতা উপলব্ধির জন্যে রাডার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা থাকা প্রয়োজন। সাধারণত: পদার্থ বিদ্যায় শব্দের অধ্যায়ে মহাশব্দ বা অতিশব্দ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হয়ে থাকে। এ মহাশব্দের তরঙ্গমালা এত দ্রুতগতিসম্পন্ন ও দীর্ঘ যে মানুষের দ্বারা কোন ক্রমে তা কর্ণগোচন সম্ভব নয়। এটা পরীক্ষিত সত্য যে ,যখন কোন দেয়ালে ছুড়ে মারা হয় তখন তা ঠিক নিক্ষেপের গতিতেই পূর্বস্থানে ফিরে আসতে বাধ্য। যখন আমরা কোন পাহাড়ের নিকট গিয়ে চিৎকার করি তখন এর ধ্বনি একট নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পূর্বস্থানের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। তদ্রুপ কোন মহাশব্দের তরঙ্গ একটা নির্দিষ্ট স্থান থেকে নিক্ষেপ করা হলে তা নির্দিষ্ট গতিতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যখনই কোন কিছুতে বাধাগ্রস্থ হয় তখনই তা পূর্বের অবস্থানের দিকে ফিরে আসে। সচরাচর যুদ্ধের সময় শত্রু বিমানকে চিহ্নিত করার জন্যে এ ধরণের রাডার থেকে একটা বিশেষ শব্দ বিমানের উদ্দেশ্য প্রেরণ করা হয়ে থাকে। আর যখনই তা শত্রু বিমানে আঘাত প্রাপ্ত হয় তখনই একটা নির্দিষ্ট গতিতে প্রত্যাবর্তন করে রাডার যন্ত্রে। এরই মাধ্যমে শত্রু বিমানের গতিবেগ ,দুরত্ব ইত্যাদি নির্ণয় করা হয়ে থাকে।

বিজ্ঞানীরা বলেন ,বাদুড় পাখির দেহে রাডারের ন্যায় একটা যন্ত্র বিদ্যমান। তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন যদি বাদুড় পাখিকে একটা শুন্য কক্ষে ছেড়ে দেয়া হয় আর সেখানে মহাশব্দ ধারণ ও তা সাধারণ শব্দের তরঙ্গে পরিণত করার ক্ষমতাসম্পন্ন কোন মাইক্রোফোন রাখা হয় তাহলে পরিষ্কারভাবে রাডার থেকে নির্গত মহাশব্দ শ্রবণ সম্ভবপর হয়ে উঠবে। প্রতি সেকেন্ডে ত্রিশ থেকে ষাট বার মহাশব্দের তরঙ্গ বাদুড় পাখির নিকট থেকে শোনা যায় বলে তারা ধারনা করে থাকেন।

আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে বাদুড় তার বাকযন্ত্র থেকে শব্দ নির্গত করে তা নাসিকার মাধ্যমে বাইরে ছেড়ে দেয়। আর তা কোন স্থানে বাধাগ্রস্থ হয়ে ফিরে আসে কর্ণে। বাদুড়ের কর্ণ নির্গত তরঙ্গরাজীর ধারক। এ পাখি তার কর্ণের মাধ্যমেই উপলব্ধি করতে পারে কতটুকু দুরত্বে বাধাগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণেই এ ক্ষুদ্র প্রাণী রাতের অন্ধকারে শিকারের খোঁজে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে। কি অবাক সব ক্রিয়া-কান্ড! এতসব জটিল ব্যবস্থাপনা কি কোন একজন বুদ্ধিমান ও সর্বজ্ঞানী ব্যবস্থাপক ব্যতীত অন্য কারো দ্বারা সম্ভব ? আর কোন বুদ্ধিহীন ব্যবস্থাপক তো এ ব্যাপারে কোন ধারণাই রাখতে পারে না। সৃষ্টি জগতের এ বিশাল নৈপূণ্য ক্ষমতা ও জটিলতা দর্শনে এ অবধি অনেক বিজ্ঞানী এমন কোন একক মহাস্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন ,যিনি সকল প্রকৃতির উর্দ্ধে।

পুষ্প ও কীট পতঙ্গ

প্রাকৃতিক জগতে আরেকটি অত্যাশ্চর্য বিষয় হচ্ছে পুষ্প ও কীট পতঙ্গের মাঝে বন্ধুত্ব। বসন্তকালের শেষের দিক যখন ধীরে ধীরে বাতাস গরম হতে শুরু করে তখন ফলের বাগান গুলোতে বিভিন্ন প্রকার কীট পতঙ্গের আনাগোনা দেখা যায়। ছোট-বড় পতঙ্গ ,প্রজাপতি ,মৌমাছি ইত্যাদি কত রকমের প্রাণী। এধরণের প্রাণীর কাজ হলো এরা কোন এক গাছের ফুলের উপর বসে রস আহরণ করে অন্য গাছের পাপড়ির উপর গিয়ে বসে। ওরা পুঃলিঙ্গের গাছের পাপড়ি থেকে পরাগরেণু বহন করে নিয়ে যায় স্ত্রী লিঙ্গের পুষ্পের উপর। এভাবে বৃক্ষরাজীর মাঝে সঙ্গম ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পরিণতিতে বৃক্ষরাজী ফুলে -ফলে ভরপুর হয়ে উঠে।

এ সময়ে বিভিন্ন প্রকার কীট-পতঙ্গের আনাগোনা ,এক ডাল থেকে অন্য ডালে বিচরণ ,গাছে গাছে উড়ে বেড়ানো ইত্যাদি দেখে মনে হয় কোন এক বিশেষ শক্তি তাদেরকে ঠিক একটি উৎপাদনশীল শিল্প কারখানার শ্রমিকদের ন্যায় পরিচালনা করছে। ফলে সকলে নিজ কর্মে পরিপূর্ণ আত্মনিয়োগ করে আছে। কাজের কোন ফাঁকি নেই। পরিশ্রম করছে সবাই একযোগে। যথাযথভাবে সকলে স্ব -স্ব দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। কতই না বিষ্ময়কর এ বিষয়টি !

কখনো কি ভেবে দেখেছি ,যেখানে বৃক্ষ ,তরুলতার নড়াচড়া ও স্থান পরিবর্তন করার ক্ষমতা নেই সেখানে ওগুলো কি ভাবে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয় আর কি পদ্ধতিতে তাদের সঙ্গমক্রিয়া সম্পন্ন হয় ? কিভাবে বৃক্ষরাজীর মাঝে পুরুষ পরাগরেণু ও স্ত্রী ডিম্বানুর মিলন ঘঠে ? অনেক ক্ষেত্রে এ অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজটির দায়িত্ব কীট পতঙ্গের উপর ন্যস্ত। আবার কখনো বায়ু এ মিলন ক্রিয়াতে সাহায্য করে থাকে। যখন কোন ব্যক্তি কীট-পতঙ্গ ও বৃক্ষরাজীর মধ্যকার এ বিষ্ময়কর ঘটনাবলী অধ্যয়ন করে তখন স্বভাবতঃই তার মনে প্রশ্নের উদেয় হয় ,কে কীটপতঙ্গ ও বৃক্ষদের মাঝে এ অপুরম ও মজবুত বন্ধুত্ব স্থাপন করে দিয়েছে ?

আমাদের চারপার্শ্বে রয়েছে এ ধরণের বহু আশ্চর্য ঘটনা যা বিশ্বকে দান করে এক সাবলীল সৌন্দর্য ও বিশেষ নিয়ম-শৃঙ্খলা। বিশ্বজগত চমৎকার ও বিষ্ময়কর সৃষ্টিতে ভরপুর। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে কোন সৃষ্টিকে নিয়ে যদি আমরা সামান্য পরিমাণ অধ্যয়ন ,গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখতে পাব বহু অত্যাশ্চর্য ক্রিয়া-কান্ড ,সুনিপুণ কলা-কৌশল ও ব্যবস্থাপনা। এ প্রসঙ্গে কোরআন উল্লেখ করছে :

) يُنبِتُ لَكُم بِهِ الزَّرْعَ وَالزَّيْتُونَ وَالنَّخِيلَ وَالْأَعْنَابَ وَمِن كُلِّ الثَّمَرَاتِ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ(

অর্থাৎ : (আল্লাহ্) তোমাদের জন্যে ওটার (বৃষ্টির) মাধ্যমে কৃষিকার্য উৎপাদন এবং জলপাই ,খেজুর ও আঙ্গুর ইত্যাদি সব ধরণের ফলাদি বৃক্ষ সমুদগত করেন ,নিশ্চয়ই এগুলোর মধ্যে চিন্তাশীলদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। (আন্ নাহল ,আঃ নং-11 )

আল্লাহ্ অন্যত্র বলেন-

) إ ِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنفَعُ النَّاسَ وَمَا أَنزَلَ اللَّـهُ مِنَ السَّمَاءِ مِن مَّاءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِن كُلِّ دَابَّةٍ وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ(

অর্থাৎ : নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও যমীন এবং দিবা-রাত্রির পালা বদল এবং মানুষের উপকারার্থে চলন্ত জাহাজসমূহ এবং আল্লাহ্ কর্তৃক আসমান থেকে বারিবর্ষন যার ফলে মৃত যমীন পুনরায় প্রাণ ফিরে পায় এবং যমীনের বুকে চতুষ্পদ জন্তুর উত্থান আর বায়ুরাশির গতি পরিবর্তন এবং আসমান ও যমীনের মাঝখানে সংরক্ষিত ও করতলগত মেঘ খণ্ড চিন্তাশীলদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। (আল্ বাক্বারা ,আঃ নং-164। )

6

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি

শিশু জন্মলগ্ন থেকেই তার চার পাশে অনেককে দেখতে পায়। সর্বপ্রথম যার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে তিনি হলেন নবজাত শিশুর মা। ধীরে ধীরে যখন শিশু বড় হতে থাকে তখন সে মা ছাড়াও আরো অনেকের সাখে পরিচয় লাভ করে। আস্তে আস্তে বিভিন্ন ধরনের বস্তুর সাথেও পরিচিত হতে থাকে। এভাবে শুরু হয় একটি শিশুর জীবনযাত্রা।

মানুষ স্বভাবগত ভাবেই কৌতুহলী। তার চারপাশের বিভিন্ন বস্তু ও ব্যক্তি সন্বন্ধে জানার কৌতুহলী মনোভাব শৈশবেই প্রতিটি শিশুর মাঝে পরিলক্ষিত হয়। প্রথমে সে ক্ষুদ্র জিনিষ থেকেই শুরু করে ,পরে বয়স যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে ততই জীজ্ঞাসার মাত্রা ও পরিমাপও বেশী হতে থাকে।

একটি শিশু যখন পাঠশালায় গমন করে তখন সে তার চতুষ্পার্শ্বে অনেক ধরনের সৃষ্টির সাথে পরিচয় লাভ করে। আর প্রথম থেকেই তো এ আকাশ তার মাথার উপর ছেয়ে আছে। অক্সিজেন অনবরত গ্রহণ করছে। পানি পান করছে। এভাবে সে ধীরে ধীরে পাহাড়-পর্বত ও নদ-নদী এবং অনেক ধরনের গৃহপালিত পশু-পাখির সাথে পরিচয় লাভ করতে থাকে। ঐ শিশুর কৌতুহলী মনে একটি মাত্র জিজ্ঞাসা এত সব কিছু ,কে সৃষ্টি করলো ? সৃষ্টির পেছনে কি উদ্দেশ্য নিহিত আছে ? সূর্য প্রভাতে পূর্বাকাশে উদয় হয় আবার সন্ধ্যাবেলা পশ্চিমাকাশে অস্ত যায় প্রতিদিন ,এ নিয়ম-শৃঙ্খলা কে তৈরী করলো ? রাত্রে যখন সে আকাশের তারকারাজীর দিকে তাকায় তখন আবারও তার মনে প্রশ্নের উদেয় ঘটে ,এত সুন্দর মনোরম নক্ষত্রমণ্ডলীকে কনো অভিজ্ঞ চিত্রকর আকাশের বুকে সাজিয়ে রেখেছে ? এসব প্রশ্নের উত্তরই হল বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি। বিশ্ব অস্তিত্ত্ব ও ব্যবস্থাপনা এবং মানুষ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিই হল অন্তরের এতসব প্রশ্নের উত্তর।

অনেকে বিশ্বাস করেন এ বিশ্বের সৃষ্টির পেছনে কোন পরিকল্পনা প্রণেতার প্রয়োজন নেই। এর পেছনে কোন উদ্দেশ্যও নেই। স্বয়ংক্রিয়ভাবে উদ্ভব হয়েছে এ সৃষ্টিজগত। প্রকৃতিই স্বয়ং সকল বস্তুর সৃষ্টিকর্তা। আর একেই বলে বস্তুবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি। প্রাক ইসলামী যুগে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীদের বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হতো। তন্মোধ্যে প্রাকৃতিবাদী ,যিনদিক ,দাহরী ও নাস্তিক অন্যতম। কিন্তু বর্তমান আধুনিক ,শিল্পোন্নত ও ইলেকট্রোনিক্স যুগে তাদের মুখোশ পরিবর্তন হতে দেখা যায়। বর্তমান বিশ্বে বস্তুবাদীদের বিভিন্নমুখী মতাদর্শের মধ্যে অতি পরিচিত নামটি হচ্ছে যুক্তিবাদী বস্তুবাদ বা Dialectic Materialism । আর মার্ক্সবাদী দর্শন এরই উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে।

আবার অনেকে বিশ্বাস করেন এ বিশ্ব জগতের বালু কণা থেকে শুরু করে প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে একটি নির্দিষ্ট কার্যকারণ ও উদ্দেশ্য রয়েছে। কোন কিছুই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হয়নি। বরং প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে কোন স্বাধীন সত্তার শক্তিমত্তা কাজ করছে। এ ধরনের চিন্তা ভাবনার নাম বিশ্ব সম্পর্কে আস্তিকবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।

আমাদের মনে রাখতে হবে বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি আর বিশ্ব পরিচিতি এক কথা নয়। এরা দুটি পৃথক পরিভাষা। দৃষ্টান্তস্বরূপ ,পৃথিবীতে পানির পরিমান মাটির চেয়ে কতগুণ বেশী ? অথবা সৌর জগতে বিরাজমান গ্রহের সংখ্যা কত ? ইত্যাদি সৃষ্টি জগতের পরিচয় নিয়ে আলোচনা মাত্র। এগুলোতে বিশ্ব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নয়। আর যখন আমরা সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করি ,যেমন ধরুন যদি বলি যে ,সমগ্র বস্তুজগত কোন অবস্তুগত সৃষ্টিকর্তার উপর নির্ভরশীল -তাহলে এ বিষয়টি বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্ভুক্ত বলে পরিগণিত হবে।

7

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির ফলশ্রুতি

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও বিজ্ঞানের উন্নতি

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশা

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন , আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে ,তা তো আছেই। আমাদের বিভিন্ন প্রকার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এগুলোর তো কোন পরিবর্তন আসবে না। তাহলে এ বিষয়ে এত আলোচনার কি প্রয়োজন ? এর আলোচনা আমাদের জন্যে কি ফলাফল বয়ে আনতে পারে ?

উক্ত প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় ,হ্যাঁ ,আমাদের চারদিকে কোন সৃষ্টির উপর প্রভাব ফেলবে না সত্য ,কিন্তু তাই বলে আমাদের কাজ-কর্ম ,আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হবে না এটা বলা মনে হয় সঠিক হবে না।

অধিকন্তু বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাবিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিষয়টির স্পষ্টতার জন্যে নিন্মে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা গেল।

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও বিজ্ঞানের উন্নতি

চিন্তা করে দেখুন ,আপনার বন্ধু সফর থেকে ফিরে এসেছে। সে আপনাকে একটি বই উপহার দিয়ে বললো এ চমৎকার বইটির লেখক একজন বড় চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ,বুদ্ধিমান ও বিজ্ঞ এবং উচ্চজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অধিকারী। নিশ্চয়ই আপনি সে বইটা হালকাভাবে রিডিং পড়েই ক্ষান্ত হবেন না। বরং এর প্রতিটি শব্দ ,বাক্য ও তাদের গঠন বর্ণনা ও পরিবর্তন সবকিছুকে খুব সূক্ষ্মভাবে মনযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করবেন। যদি কোথাও না বুঝে থাকেন তা হলে ঘন্টার পর ঘন্টা ,দিনের পরদিন মোট কথা সুযোগ পেলেই এ বিষয় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করবেন ,বোঝার চেষ্টা করবেন। সাধ্যমত পরিশ্রম করতেও আপনি কুন্ঠাবোধ করবেন না। কেননা ,এ বইয়ের গ্রন্থকার কোন সাধারণ লোক নন। তিনি একজন শীর্ষস্থানীয় গবেষক ,চিন্তাবিদ। তার কোন কথাই অযথা নয়। কোন বাক্যই তার অপরিকল্পিত নয়।

অপরদিকে যদি আপনাকে বলা হয় এ বইটা যদিও বাহ্যিকভাবে চমৎকার বলে মনে হবে কিন্তু এর পুস্তকার একজন অজ্ঞ ,মুর্খ ,নির্বোধ ও বুদ্ধিহীন ব্যক্তি। আপনি নিখুত ভাবে এ বইটার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন নাকি শুধুমাত্র একটু চোখ বুলিয়ে রেখে দিবেন ? কেননা আপনি জানেন এ বইয়ের কোন মূল্য নেই। কোন জ্ঞান-গর্ভ আলোচনা এ বইতে নেই। মোট কথা এ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করা অযথা সময় নষ্ট করারই নামান্তর বলে বিবেচনা করবেন। এ বিশ্বজগতও একটি বৃহৎ গ্রন্থের ন্যায়। এ জগতের প্রতিটি সৃষ্টি এক একটি বাক্য ,যার সমম্বয়ে গঠিত হয়েছে এ বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ।

যদি আমরা আস্তিকবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অনুগামী হই তাহলে এ বিশ্বের প্রতিটি বস্তু ,প্রতিটি সৃষ্টিকেই আমরা মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করবো আর খুব মনোযোগ সহকারে তাঁর প্রতিটি বিষয়ের অধ্যায়নে গুরুত্বারোপ করবো এবং কৌতুহলী অন্তঃকরণ নিয়ে প্রতিটি সৃষ্টির অন্তর্নিহিত রহস্যাবলী উদ্ঘাটনের জন্যে উদ্গ্রীব হবো। কেননা আমরা বিশ্বাস করি প্রতিটি সৃষ্টি বস্তুর পেছনে নিশ্চয়ই কোন শক্তিশালী ও বিশাল বুদ্ধিমান শক্তিমত্তা বা সৃষ্টিকর্তা ক্রিয়শীল রয়েছেন। তিনি অতিশয় বুদ্ধিমান ,প্রজ্ঞাবান ,শিল্পী ও জ্ঞানী। তিনি মহাবিজ্ঞানী ও দার্শনিক। সুতরাং তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। আর এ দৃষ্টিভঙ্গির কারনেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও উন্নতি সম্ভব হয়েছে।

আর যদি আমরা বস্তুবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হই তা হলে এ বিশ্বের রহস্যময় সৃষ্টিকুলের ব্যাপারে সামান্যতম চিন্তা-ভাবণা করারও মনোভাব তৈরী হবে না। কেনান ,বস্তুবাদীরা এ বিশ্বজগতের সৃষ্টিকারক হিসেবে বুদ্ধি ও জ্ঞানহীন প্রকৃতিকেই মনে করেন। আর এতসব কিছুর স্রষ্টা যদি এক নির্বোধ ও জ্ঞানহীন প্রকৃতি হয়ে থাকে তা হলে তার সৃষ্টির-ই বা কি মূল্য হতে পারে ?

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশা

কথায় বলে , নদীর এপাড় ভাঙ্গে ওপাড় গড়ে -এই তো নদীর খেলা। আর এ খেলা মানুষের জীবনেও ঘটে থাকে অহরহ। সাধারণতঃ মানুষের এ ক্ষণকালীন জীবনও বহু চড়াই-উৎরাই এর মধ্য দিয়ে বিকশিত হয় । তাই কখনো একজন মানুষের জীবনের দ্বারে কিছু অনাকঙ্খিত বিপদও কড়া নাড়তে পারে। অনেক সময় এমনও হয় যে এ অপ্রত্যাশিত সমস্যা থেকে তার পালানের কোন পথ থাকে না। তখন চতুর্দিকে পথরুদ্ধ অবস্থায় পড়ে যায় সে। এমতাবস্থায় সে নিজেকে অতিশয় দুর্বল ও অসহায় অবস্থার মুখোমুখি দেখতে পায়। আর এরকম কঠিন বিপদের মুহুর্তে একমাত্র আস্তিকবাদী দৃষ্টি-ভঙ্গিই তাকে মুক্তির সন্ধান দিতে পারে। কেননা ,সে তখন তার চেয়ে বড় ও বিশাল কোন অস্তিত্বের আশ্রয়ের সন্ধান খুঁজে পায়। তিনি জানেন এ বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টিই একজন পরম পরাক্রমশালী ও বুদ্ধিমান সৃষ্টিকর্তার অধীন। আর আমাদের পরিত্রানদাতাও তিনি। ফলে একজন আস্তিক ব্যক্তি এ ধরনের কঠিন ও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মোকাবলা করার জন্যে যথেষ্ট দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে থাকেন।

অপর দিকে একজন বস্তুবাদী ব্যক্তি এ ধরনের পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। হতাশা ও ভয় তাকে অক্টোপাসের মত ঘিরে ফেলে একটি ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের ন্যায়। এমতাবস্থায় সে নিরাশ্রিত অবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। আর এ কারনেই বস্তুবাদীরা এহেন তহাশাগস্থ অবস্থায় আত্মহত্যার ঘৃন্য পথের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে আস্তিকবাদীরা সর্বাবস্থায় তাদের মহাপরাক্রমশালী পরিত্রানদাতার আশ্রয় কামনা করে থাকেন। আর এ কারনেই তারা কখনো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন না।

আর এক ন্যায়সংগত কারণে ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা মহাপাপ বলে পরিগণিত। কেননা আত্মহত্যা হতাশা ও পরাজয়ের মনোভাব থেকেই জন্ম লাভ করে থাকে।

8

আস্তিকবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ

কার্যকারণ

শৃঙ্খলীয় প্রমাণ

মানব প্রকৃতি ও সত্যান্বেষী স্বভাব

অস্তিত্ব বিভক্তির প্রমাণ


8

9

10

11

12

13