আল হাসানাইন (আ.)

রক্তাক্ত ফিলিস্তিন-৩য় পর্ব

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

বিংশ শতাব্দীতে বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিন
শিল্প বিপ্লবের পর দিন দিন ইউরোপের চেহারা দ্রুত বদলে যেতে থাকে। ইউরোপীয়রা জ্ঞান্তবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলমানদের ছাড়িয়ে যায়। এ সময় ইসলামী জাহান দীর্ঘ অজ্ঞতার ঘুমে নিম্মজিত হয়। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপ বিপুল পরিমান উৎপাদন ও পণ্য সামগ্রী দিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজার ছেয়ে ফেলে। এরপর তাদের বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত পণ্য গুদামে গুদামে পড়ে থাকে। এসব পণ্য সামগ্রী বিক্রি ও প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানীর জন্য বিদেশী বাজারে আবশ্যকতা দেখা দেয়। তখন থেকেই উপনিবেশবাদী যুগের সূচনা ঘটে এবং ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা বাইরের জগতের বাজার দখলের জন্যে লড়াই শুরু করে।
 
আল হোসাইন (আ.) 
ইসরাইল সরকার প্রতিষ্ঠার পটভূমি এবং ফিলিস্তিনী ও আরবদের প্রতিক্রিয়া
ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে ফিলিস্থিনে কতিপয় বিদ্রোহ দেখা দেয়। এ যাবত উসমানীদের সমর্থক বৃটেন তার নীতি বদলায় এবং বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন দান করে। কেননা সে সময় বৃটেনের গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশ এবং বৃটেনের শক্তি ও সম্পদের উৎস ছিল ভারতবর্ষ। তাই ভারতবর্ষকে নিজ হাতে রাখার লক্ষ্যে বৃটেন এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তার আধিপত্য সংরক্ষণ করে এবং দুই ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রান্স ও রাশিয়ার পক্ষ থেকে ভারতে হামলা ঠেকানোর জন্য সুয়েজ খালের উপর দখল প্রতিষ্ঠা করা জরুরী হয়ে পড়ে। ঐ সময় সুয়েজ খাল উসমানীদের হাতে ছিল।
বৃটিশ সরকার আরবদেরকে তুর্কী উসমানীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার উস্কানি দিতে থাকে। যেমন মক্কায় আমীর হিসাবে উসমানীদের প্রতিনিধি ছিল শরীফ হুসাইন। সে খুবই ক্ষমতালিপ্সু ছিল। ইংরেজরা তাকে উস্কানি দিয়ে উসমানীদের থেকে আলাদা করে। ১৯১৬ খৃস্টাব্দে (১৩৩৪ হিঃ) ইউরোপের তিন প্রধান শক্তি রাশিয়া, ফ্রান্স ও বৃটেনের মধ্যে ‘‘সাইকস-পাইকো’’ ও ‘‘সাজোনোভ’’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির কথা ছিল উসমানী সাম্রাজ্যের যেসব এলাকা বিচ্ছিন্ন করা হবে সে সবকে এ তিন শক্তির ভেতর সমানভাবে বন্টন করে দিতে হবে। কিন্তু কিছুকাল পর বৃটেন এই চুক্তিকে সুয়েজ খালে স্বীয় আধিপত্যের বিরোধী হিসাবে দেখতে পায়। তাই ১৯১৭ সনে রাশিয়ার দুর্বলতা ও সেখানে সংঘটিত বিপ্লবের সুযোগ নিয়ে বৃটেন চুক্তি মেনে চলতে অস্বীকৃতি জানায় এবং ফিলিসি-কে নিজের তত্ত্বাবধানে গ্রহণ করে নেয়।
এসব পদক্ষেপ এমনি এক অবস্থায় গৃহীত হয় যখন উসমানী সাম্রাজ্যকে ছত্রভঙ্গ ও দুর্বল করার পথ হিসাবে সাম্রাজ্যবাদী বৃটেনের পক্ষ থেকে তীব্রভাবে জাতীয়তাবাদী চিন্তা প্রচলন ও শক্তিশালী করা হয়। ফলে বেশীর ভাগ ইসলামী দেশেই ক্রমশ জাতীয়তাবাদী চিন্তা দর্শন ইসলামী ঐতিহ্য ও আদর্শের স্থান দখল করে নেয়। আর এ জাতীয়তাবাদই তৎকালীন উপনিবেশবাদীদের নেতা বৃটেনের উপনিবেশবাদী নীতি অবস্থানের স্বার্থ মেটানোর মূল হাতিয়ারে পরিণত হয়। ফলে অনৈক্য সৃষ্টি এবং ইসলামী দেশসমূহ, বিশেষ করে উসমানী সাম্রাজ্যকে ভেঙ্গে তছনছ করার সামপ্রদায়িক ও বর্ণবাদী আন্দোলনসমূহের জন্ম হয়।
অথচ ঠিক এমনি সময় বৃটেনে বিশ্বের ইয়াহুদী জাতির ঐক্যের কুহেলিকাপূর্ণ আহবানের সূত্রপাত ঘটে যা কিনা ঐতিহাসিকভাবে ছিলো অসঙ্গতি পূর্ণ ও ভিত্তিহীন। বৃটিশ সরকার ইয়াহুদী বর্ণবাদী জাতীয়তার প্রচারণা শুরু করে। এতে করে কিছু সংখ্যক ইয়াহুদী একটি একক ইয়াহুদী জাতির চিন্তা ও তাদের জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তৎপরতা শুরু করে। আর এহেন অপতৎপরতার প্রতি সাংঘাতিক শক্তি ও মদদ যোগায় বৃটিশ সরকার।
ওই ইয়াহুদী গোষ্ঠীটি ধনাট্য ইয়াহুদীদের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য সংগ্রহ শুরু করে দেয় এবং নিজেদের লক্ষ্য হাসিলের জন্য একটি দল গঠন করে। এরা ফিলিস্তিনের একটি পাহাড়ের নামে দেশটির নাম রাখে যায়ন (ুরড়হ)। এ যায়ন পাহাড়ের উপরই রয়েছে হযরত দাউদ ও হযরত সুলায়মান আলাইহিমুস সালামসহ বনি ইসরাইলের অনেক নবীর মাজার। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে (১৮৯২-১৮৯৮ খৃঃ) জাতীয়তাবাদী ইয়াহুদীরা বিভিন্ন দেশের ইয়াহুদীদের ফিলিস্থিনে গমন ও অভিভাসন দানে তৎপরত হয়ে ওঠে। তবে ইয়াহুদী আলেমরা এ তৎপরতার হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যাবলী এবং উপনিবেশবাদীদের সাথে এ তৎপরতার যোগসূত্র আবিস্কার করতে পেরে বিরোধিতা করায় এ যায়নবাদী আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়। কিন্তু বিশ শতকের প্রথমদিকে ফিলিস্তিনের ওপর বৃটিশ উপনিবেশবাদীদের প্রভুত্বের সুযোগে বিশ্ব জুড়ে ইয়াহুদীদের সাথে বিরোধিতা ও এদের নিপীড়নের সমাধান হিসাবে সামনে একটি ইয়াহুদী রাস্ট্র প্রতিষ্ঠার ধুয়া তোলা হয়। কেননা যায়নবাদের লক্ষ্যই ছিল প্রাচীন ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস-বায়ন করা। বৃটেনও এ সময় এলাকাতে তার আধিপত্য অব্যাহত রাখার জন্য একটি ঘাটির অভাব বোধ করছিল।
যায়ন পার্টি এ পরিকল্পনার ব্যাপারে অন্যান্য ইয়াহুদী সংস্থার বিরোধিতার সম্মুখীন হলেও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে বসেছিল যারা বিরুদ্ধবাদী ওসব সংস্থার মুকাবিলা শুরু করে। এ দলটি প্রথম মহাযুদ্ধের সময় বৃটেন ও আমেরিকার কাছ থেকে এ প্রতিশ্রুতি আদায় করে যে, যুদ্ধ শেষে জার্মানীর মিত্র উসমানী সরকারের পরাজয় ঘটলে ফিলিস্তিনকে ইয়াহুদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। কেননা প্রথম যুদ্ধের আগ পর্যন্ত বায়তুল মুকাদ্দাস সরকারীভাবে উসমানীদের হাতে ছিল। যায়নবাদীদের চেষ্টা ফলবতী হলো এবং এরা বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এরা আমেরিকাতে সেদেশের ব্যক্তিত্ববর্গের মনোযোগ আদায় করতে সক্ষম হয়।
শেষ পর্যন্ত ১৯১৭ খৃস্টাব্দে ফিলিস্তিন ভূখন্ডে ‘‘ইয়াহুদী জাতির কেন্দ্র’’ স্থাপনের বিষয়টি বৃটিশ মন্ত্রিসভায় স্থান পায়। ইংরেজদের অনুচর এবং মক্কা শরীফের গর্ভনর শরীফ হুসাইন এ ব্যাপারে বৃটিশ সরকারের কাছে ব্যাখ্যা দাবী করেন। বৃটিশ সরকারও জবাব দেয়, ফিলিস্থিনে ইয়াহুদীদের প্রত্যাগমনের সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনী জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতার সাথে বিরোধপূর্ণ নয়। এ জবাবে ইসরাইল সরকার গঠনের কোন কথাই ওঠেনি। যুদ্ধের শেষ দিকে যায়নবাদী সংগঠনের অনুচরবাহিনী ফিলিস্তিনের কিছু অংশ দখল করে নিলে আরবদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এর আগে থেকেই ফিলিস্থিনে ছোট ছোট গ্রুপে কলোনীবাসী হিসাবে ইয়াহুদীদের বসবাস করার সুযোগ দেয়া হয়। এরা স্থানীয় আরবদের কাছ থেকে ভূমি কেনা শুরু করে ও ইয়াহুদী কৃষি খামারের পত্তন ঘটায়।
১৯২০ সালে মিত্র শক্তি ও আন্তর্জাতিক সমাজ ফিলিস্তিনের অভিভাবকত্বকে আনুষ্ঠানিকভাবে বৃটিশ সরকারের হাতে ছেড়ে দেয় এবং সেখানে ইয়াহুদী জাতীয় কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে বেলফোর ঘোষণা বাস-বায়নে সহায়তা করার দায়িত্ব অর্পণ করে। সে সময় ফিলিস্থিনে মাত্র পঞ্চাশ হাজার ইয়াহুদী  ছিল। কিন্তু ইংরেজরা ফিলিস্তিনের শাসনভার একজন ইয়াহুদীর হাতে অর্পণ করায় তাঁর সরকারের অধীনে সেখানে ইয়াহুদীদের আগমনের দরজা খুলে যায়। কিছুকালের মধ্যেই ইয়াহুদীদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তা আরবদের বিরোধিতা ও বিদ্রোহের কারণ ঘটায়। বৃটিশ উপনিবেশ মন্ত্রী চার্চিল তখন বিদ্রোহ ঠেকানোর জন্যে ঘোষণা দেন যে, সমগ্র ফিলিস্তিনকে একটি ইয়াহুদী দেশে পরিণত করার ইচ্ছা বৃটেনের নেই। আর ইয়াহুদী জাতীয় কেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজন অনুপাতে এবং ফিলিস্তিনের অর্থনৈতিক শক্তির আওতায়ই কেবল ইয়াহুদী অভিভাসন অব্যাহত থাকবে।
ইংরেজদের সহায়তায় অতি দ্রুত ফিলিস্থিনে ইয়াহুদীদের বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, এমন কি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন তৈরী হতে থাকে। সারা বিশ্বের ইয়াহুদী পুঁজিপতিরা এদের আর্থিক সাহায্য দিতে থাকে। সে সময় আরবরা ছিল ছত্রভঙ্গ, অসংহত ও বিচ্ছিন্ন। কেবল শ্লোগান ব্যতীত এরা ফিলিস্তিনীদের কোন সাহায্যই করেনি। ফিলিস্তিনের আরব ও খৃস্টান জনতা পারস্পরিক বিভেদ ভুলে গিয়ে অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হলো। ১৯২৯ সালের গ্রীস্মকালে একপক্ষে ফিলিস্তিনের আরব ও খৃস্টান জনতা এবং অন্যপক্ষে ইয়াহুদী মুজাহিরদের মাঝে প্রথম রক্তাক্ত সংঘর্ষ বাঁধে। ইয়াহুদী যায়নবাদীরা ও ইংরেজ সৈন্যরা মিলে ফিলিস্তিনের দিকে গুলী বর্ষণ করলে প্রায় ৩৫১ জন ফিলিস্তিনী শাহাদত বরণ করে এবং কিছু সংখ্যক আহত ও বন্দী হয়। এক প্রহসনমূলক বিচারে একদল ফিলিস্তিনীকে আজীবন কারাদন্ড কিংবা ফাঁসি দেয়া হয়। বিশের দশকের শেষ দিক থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত সময়ে শেখ ইযযাদ্দিন কাসসামের সশস্ত্র অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। তিনি বৃটিশ ও ইয়াহুদী বর্ণবাদী সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ও তাঁর বেশীর ভাগ সাথী শাহাদত বরণ করেন ও অবশিষ্টরা কারারুদ্ধ হন।
১৯৩৭ সালে আব্দুল কাদের হুসাইনী সংগ্রামের নেতৃত্ব হাতে নেন। তিনি বহু যুদ্ধের পর শেষ পর্যন্ত সঙ্গীসাথীসহ শাহাদত বরণ করেন। ১৯৪৪ সালে হাসান সালামা বৃটিশ ও যায়নবাদী যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের নেতৃত্ব দান করেন এবং কিছুকাল পর তিনি শাহাদত বরণ করেন। চল্লিশের দশক থেকে ফিলিস্তিন ইস্যু একটি আরব ইস্যুতে পরিণত হয় এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াদির শীর্ষে স্থান লাভ করে। এ ধরনের একের পর এক সংগ্রাম ও আরবদের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার মুখে বৃটিশ সরকার বেপরোয়া ইয়াহুদী অভিভাসন সীমিত করতে বাধ্য হলে তা যায়নবাদীদের তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। ইয়াহুদী বর্ণবাদীরা এমন কি সন্ত্রাসবাদী কাজেও হাত দেয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে ফিলিস্থিনে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে। কিন্তু ১৯৪৮ সনের ১৪ই মে তারিখে বৃটিশ সরকার ফিলিস্থিনে তার অভিভাবকত্বের অসান ঘটিয়ে সৈন্যদের বের করে নিলে সেদিনই তেলআবীব শহরে ইয়াহুদী জাতীয় পরিষদ গঠিত হয় এবং ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা দেয়। পূর্ব যোগাযোগ অনুসারে এর কয়েক ঘন্টা পরই আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান নয়া ইসরাইল সরকারকে স্বীকৃতি দান করে। ইংরেজরাও সেখান থেকে চলে যাওয়ার সময় তাদের যাবতীয় সাজসরঞ্জাম ইয়াহুদী যায়নবাদীদের হাতে তুলে দেয়। তখন থেকেই ফিলিস্তিনের ব্যাপারে জাতিসংঘ হস-ক্ষেপ শুরু করে। ফলে ফিলিসি-নিদের উপর ইয়াহুদীদের আগ্রাসন ঠেকানোর যাবতীয় প্রচেষ্টা নিস্ফল হয়।
দখলদার যায়নবাদী একের পর এক ফিলিস্তিনী শহর, গঞ্জ ও গ্রাম দখল এবং নিরস্ত্র অসহায় ফিলিস্তিনীদের ঘরবাড়ী থেকে উচ্ছেদ করা শুরু করে। দরিদ্র অসহায় ফিলিস্তিনী মুসলমানরা যায়নবাদীদের বাঁধা দিলে এই হায়েনার দল ১৯৪৮ সনের এপ্রিল মাসে দেইর ইয়াসিন ও কাফার কাসেম গ্রামে গণহত্যার তান্ডবলীলা চালায়। এতে নিরাশ্রয়ী বাস'হারা ফিলিস্তিনীদের ভেতর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং এরা প্রাণের ভয়ে জর্দান সীমানে-র ওপাড়ে পালিয়ে যায়। সে সময় আরবদেশগুলোর সৈন্য বাহিনী ময়দানে নামে। কিন্তু ইসরাইল, ইউরোপ ও আমেরিকার সরাসরি সমর্থন পেয়ে এবং সেখান থেকে বিরামহীনভাবে জঙ্গী বিমান ও সমরাষ্ট্র লাভ করে আরবদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
এ যুদ্ধে দশ লাখের অধিক আরব ফিলিস্তিনী বাস'হারা হয়। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে তখন আরব ও ইয়াহুদী অঞ্চলে ভাগ করে দেয় এবং জেরুজালেমকে সরাসরি আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। কিন্তু ইসরাইল এ পরিকল্পনা মানেনি। অন্যদিকে ফিলিস্তিনীদের মাঝে বিভিন্ন গেরিলা গ্রুপ ও সংগঠন জন্ম নেয়। এরা ফিলিস্তিনীদের ন্যায়সঙ্গত স্বাভাবিক অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য গেরিলা যুদ্ধে নামে। ১৯৬৪ সালের ২৮ শে মে আল কুদস শহরে (বায়তুল মুকাদ্দাস) ফিলিস্তিন কংগ্রেস বসে এবং ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থায় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়। সাথে সাথে ফিলিস্তিন মুক্তিবাহিনীও গঠিত হয়। ফলে সংগ্রাম এক নয়া মোড় গ্রহন করে। এরপর থেকে হাজার হাজার ফিলিস্তিনী স্বদেশের মুক্তির পথে শাহাদত বরণ করতে থাকে। উল্লেখ করা আবশ্যক যে, তখনো পর্যন্ত বেপরোয়া ও বিরামহীন ইয়াহুদী আগমন ও অভিভাসন সত্ত্বেও আরব ও মুসলমানদের তুলনায় ইয়াহুদীরা ছিলো সংখ্যালঘু।
ছয় দিনের যুদ্ধ
১৯৬৭ সালের পাঁচই জুন ইসরাইল অতকির্তে মিশর, সিরিয়া ও জর্দানের বিমানবন্দগুলোতে হামলা চালিয়ে আরবদের সাথে যুদ্ধ শুরু করে। এ যুদ্ধে জর্দান নদীর পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, সিরিয়ার গোলান পার্বত্যাঞ্চল ও মিশরের সিনাই মরু এলাকা ইসরাইলের দখলে চলে যায়। আরব-ইসরাইলের এ যুদ্ধ ছয় দিনের যুদ্ধ বলে পরিচিত। এ যুদ্ধের পরাজয় থেকে আরবরা যে প্রত্যক্ষ শিক্ষা গ্রহন করলো তা হচ্ছে এরা ক্লাসিক যুদ্ধে ইসরাইলকে পরাজিত করতে পারবে না। কেননা ইসরাইলের হাতে রয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকার অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র। তাই তারা গেরিলা গ্রুপগুলোকে শক্তিশালী করে সংগ্রামের সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে জাতিসংঘ ইশতেহার পাশ করে ইসরাইলকে অধিকৃত এলাকাসমূহ হতে পিছিয়ে আসার নির্দেশ দেয়। কিন্তু ইসরাইল তাতে মোটেও কর্ণপাত করেনি। উল্টো জর্দানের পরিচালনাধীনে ন্যস- বায়তুল মুকাদ্দাস শহর, বেথেলহাম (বায়তুল লাহম) এবং ২৭টি গ্রামকে জবরদখল পূর্বক ইসরাইলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে ঘোষণা দেয়। ইসরাইল বায়তুল মুকাদ্দাসের তিন হাজার সংখ্যক ইয়াহুদী জনতাকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়ার লক্ষ্যে এদের সংখ্যা এক লাখ নব্বই হাজারে পৌঁছায়। ১৯৬৯ সালের ১১ই আগষ্ট তারিখে ইয়াহুদীরা মসজিদুল আকসায় আগুন ধরিয়ে দেয় এবং ঘোষণা দেয় যে, বৈদ্যুতিক বিভ্রাটের ফলেই এ ঘটনা ঘটে। অধিকতৃ অঞ্চলগুলোতে ইয়াহুদী শহর তৈরীতে দ্রুত হিড়িক পড়ে যায়। ইসরাইল বায়তুল মুকাদ্দাসের ইসলামী চেহারাকে ইয়াহুদী শহরের চেহেরায় পরিণত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়।
ইয়াহুদী বর্ণবাদী সরকার পুরাকীর্তি, প্রাচীন শিলালিপি ও আম্বিয়া কেরাম এবং অতীত জাতিগুলোর নিদর্শনাদি খঁজে বের করার অজুহাতে মসজিদে ছাখরা, মসজিদে আকসা এবং আল কুদসের নিচে ও আশপাশে খনন কাজে হাত দেয় যাতে করে আরো কিছু সংখ্যক আরব বাশিন্দাকে সেখান থেকে বিতাড়ন পূর্বক ঐসব ঐতিহাসিক স্থাপনাকে ধ্বংস করতে ও নিজেদের খেয়াল খুশীমত গড়ে তুলতে পারে। ইসরাইল আমেরিকা, বৃটেন ও ইউরোপের মদদপুষ্ট হয়ে শক্তি নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে এবং আরব বিশ্ব, এমন কি জাতিসংঘের বিরোধিতা সত্ত্বেও ইসরাইল সরকার তেলআবীবের পরিবর্তে বায়তুল মুকাদ্দাসকে (জেরুজালেম) তার রাজধানী হিসাবে ঘোষণা দেয়।
কারামা যুদ্ধ (১৯৬৮)
১৯৬৭ সনের জুন মাসে অনুষ্ঠিত ছয় দিনের যুদ্ধে আরবদের অবমাননাকর পরাজয়ের পর জর্দান, সিরিয়া ও লেবাননের শরণার্থী শিবিরগুলোতে প্রশিক্ষণ গ্রহণরত ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ সংগঠনগুলো নিজেদের গেরিলা অভিযান তীব্রতর করে। জর্দানের রাজধানী আম্মানের পঁচিশ কিলোমিটার পশ্চিম জর্দান উপত্যকায় অবসি'ত কারামা শহরে বহু সংখ্যক ফিলিস্তিনী শরণার্থী অবস্থান নিয়েছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর কারামা শহর যায়নবাদীদের যুদ্ধ বিরতি লাইন থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরত্বে ও দুশমনের গুলীর আওতায় থাকে। কারামার জনসংখ্যা শরণার্থীদের আগমনে ২৫০০ থেকে বেড়ে দ্বিগুন হয়। আল ফাতাহ গেরিলা সংগঠন যায়নবাদীদের নিকটবর্তী হওয়ায় কারামাকে নিজের কেন্দ্রীয় ঘাঁটিতে পরিণত করে। তখন যায়নবাদী সরকারের যুদ্ধমন্ত্রী ঘোষণা দেয় যে, কারামা ফিলিস্তিনী প্রতিরোধের মূল ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিনীরাও ইয়াহুদী বর্ণবাদীদের হুমকির মুকাবিলায় শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। ফিলিস্তিনীদের এ সিদ্ধানে-র আরেকটি ব্যাখ্যা ছিল এই যে, কারামায় প্রতিরোধ চালিয়ে জর্দান সরকারকেও বুঝিয়ে দেয়া হবে যে, কারামায় ফিলিস্তিনীদের খুন ঝরানো হলে সেখানে তাদের অবস্থান করা ও জর্দান উপত্যকায় গেরিলা যুদ্ধ ছড়িয়ে দেয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
ইসরাইল বাহিনী আপাদমস-ক সজ্জিত হয়ে কারামার উপর আগ্রাসন চালায়। সেখানে তিন’শ ফিলিস্তিনী গেরিলার সাথে হাতাহাতি যুদ্ধে যায়নবাদী সৈন্যদের অনেকে নিহত হলে ইসরাইলী সৈন্যদের অনেকে নিহত হলে ইসরাইলী সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধ ফিলিস্তিনী জাতিকে বিজয় লাভের নয়া পথ ও উপায়ান্তর বাতলে দেয়। তখন থেকে বহু সংখ্যক ফিলিস্তিনী আল ফাতাহ গেরিলা সংগঠনে যোগদান শুরু করে।
আল হোসাইন (আ.)কারামা যুদ্ধে ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রতি ব্যাপকতম জনসমর্থন অর্জিত হয়। আরব সরকারগুলো পর্যন্ত এদের সমর্থন দেয়, বিশেষতঃ জর্দানের সামরিক বাহিনী ফিলিস্তিনের সাহায্য করতে থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ সহযোগিতা ছিল সাময়িক। ইসরাইলের পরবর্তী হুমকি-ধমকি ও ফিলিস্তিনীদের প্রতিরোধের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে গেরিলাদের সাথে জর্দান সরকারের দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রচন্ডতর হয়-যা শেষ পর্যন্ত ১৯৭০ সালের কালো সেপ্টেম্বরের রক্তাক্ত ঘটনার জন্ম দেয়। জর্দানী বাহিনী ফিলিস্তিনী গেরিলা যোদ্ধা ও জনতাকে পাইকারী হারে হত্যা করে।
রমজান যুদ্ধ (অক্টোবর, ১৯৭৩)
১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে মিশরের সামরিক বাহিনী অতর্কিতভাবে আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে সুয়েজ খাল অতিক্রম করে এবং অলঙঘনীয় বলে খ্যাত ইসরাইলের বারলেভ প্রতিরক্ষা লাইন ভেঙ্গে সিনাই মরুভুমি ও ইসরাইলের ভূখন্ডে ঢুকে পড়ে। পূর্বদিক থেকেও একই সময় সিরীয় বিমান বাহিনী ইসরাইলের উপর হামলা চালায় এবং যুদ্ধের প্রথম কয়েক দিনেই ইসরাইলের কয়েক ডজন বিমান ধ্বংসপ্রাপ্ত, হাজার হাজার ইসরাইলী সৈন্য নিহত কিংবা বন্দী হয় এবং ইসরাইলের অপরাজেয় হওয়ার রূপকথা শূন্যে মিলিয়ে যায়। কিন্তু যুদ্ধের পরবর্তী দিনগুলোতে আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের দ্রুত সামরিক সহায়তায় ও সরাসরি অংশগ্রহনে যুদ্ধের গতি ইসরাইলের পক্ষে মোড় নেয়।
অন্যান্য আরব দেশ, মিশর ও সিরিয়াকে সাহায্য না করার একই সময় ইসরাইলী সামরিক বাহিনী হেলিবোর্ড মাধমে সুয়েজ খালের পশ্চিমে মিশরের অভ্যন্তরে একটি ছোট্ট এলাকায় সৈন্য নামিয়ে তা অবরোধ করতে সক্ষম হয়। শেষ পর্যন্ত কায়রো থেকে ৬০১ কিলোমিটার দূরে যুদ্ধাবসানের জন্য আলোচনা শুরু হয় এবং সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটে।
রমজান যুদ্ধের অবসান এবং তারও আগে মিশরের জাতীয় নেতা জামাল আবদুন নাসেরের মৃত্যু ঘটলে মিশরের প্রেসিডেন্ট পদে আনোয়ার সাদাত ক্ষমতাসীন হয়। আর তার হাতেই আমেরিকা ও পাশ্চত্যের সাথে আপোষের ধারা প্রবর্তিত হয়।
১৯৭৪ সালে পি এলও’র প্রতি স্বীকৃতি
১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থাকে (চখঙ) ফিলিস্তিন জনতার একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকৃতি দেয় এবং ইয়াসির আরাফাত এক হাতে মেশিনগান ও অন্য হাতে শান্তির প্রতীক যয়তুনের শাখা নিয়ে জাতিসংঘের অধিবেশনে উপসি'ত হয়। তৃতীয় বিশ্বের ও প্রগতিশীল দেশসমূহের প্রতিনিধিরা তাকে বিপুল সংবর্ধনা দান করেন।
লেবাননে ফিলিস্তিনীদের সংঘর্ষ
১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জর্দান সরকার কর্তৃক ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ আন্দোলন দমন হওয়ার পর লেবাননে ফিলিস্তিনী শরণার্থী শিবিরগুলো ইসরাইলের মদদপুষ্ট ফালাঞ্জীগোষ্ঠী ও ডানপন্থীদের হামলার শিকার হয়। প্রথমতঃ ১৯৭৫ সালের মে মাসে কাতায়েব পার্টির (খৃস্টান) ফালাঞ্জীরা আইনে রুমানাতে ফিলিস্তিন গেরিলা যোদ্ধা ও বেসামরিক শরণার্থীবাহী বাসের উপর গুলী চালায়।  এতে কয়েক ডজন লোক শহীদ ও আহত হয়। এ সংঘর্ষ লেবাননের অন্যান্য এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে, যার চূড়ান্ত পর্যায়ে তেল জেয়তার শরণার্থী শিবির অবরোধ করা হয়। কামান হামলার পাশাপাশি খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধ-পত্রের অভাবে হাজার হাজার ফিলিস্তিন নিহত ও আহত হয়। তখন থেকেই লেবাননে গৃহযুদ্ধ চলতে থাকে যা লেবানন সমাজের রাজনৈতিক ও সরকারী কাঠামোতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি
ফিলিস্তিন বিপ্লবের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যা আরব-ইসরাইল সম্পর্কে নতুন মোড় সৃষ্টি করে, তাহলো ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষর। জামাল আবদুন নাসেরের পর সত্তরের দশকের প্রথম দিক থেকে, বিশেষ করে রমজান যুদ্ধের অবসান ঘটার পর মিশর আপোষের পথ ধরে। ১৯৭২ সালে সাদাত মিশর থেকে সোভিয়েত সামরিক উপদেষ্টাদের বের করে দেয়। ১৯৭৫ সালে সে ইসরাইলের সাথে সিনাই চুক্তি সম্পাদন করে এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭৮ সালে আমেরিকার ক্যাম্প ডেভিড নামক স্থানে ইসরাইলী প্রধান মন্ত্রী মেনাখিম বেগীন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট কার্টারের সাথে হাত মিলিয়ে সে ইসরাইলের সাথে শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এভাবে মিশরই প্রথম আরব দেশ হিসাবে দখলদার ইসরাইলকে স্বীকৃতি দান করে আরব বিশ্বে অনৈক্য ও বিভেদের জন্ম দিলো। আর এ ঘটনাটি ঘটে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের প্রাক্কালে।
অতীতের ঘটনা প্রবাহ এবং ক্যাম্প ডেভিডের বিশ্বাসঘাতকতা যদিও আরব জনতা ও মুসলিম উম্মার মাঝে ব্যাপক হতাশা ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার জন্ম দেয়, তথাপি ১৯৭৯ সালের ফ্রেরুয়ারী মাসে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় এবং এলাকায় পাশ্চাত্য স্বার্থের শক্তিশালীতম পাহাড়াদার ও ইসরাইলের বৃহত্তম পৃষ্ঠপোষক তথা শাহ সরকারের পতন যায়নবাদ বিরোধী সংগ্রামের দেহে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে এবং লেবানন ও ফিলিস্থিনে অভূতপূর্ব উল্লাস উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে এ কারণে যে, ইসলামী বিপ্লবের শ্লোগান সমূহের পুরোভাগে ছিলো ‘আজ ইরান, কাল ফিলিস্তিন’ শ্লোগান। চলবে
 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)