আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আ'রাফ; (২০তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আ'রাফ; আয়াত ৯০-৯৩

সূরা আ'রাফের  ৯০ ও ৯১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَقَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَوْمِهِ لَئِنِ اتَّبَعْتُمْ شُعَيْبًا إِنَّكُمْ إِذًا لَخَاسِرُونَ (90) فَأَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ فَأَصْبَحُوا فِي دَارِهِمْ جَاثِمِينَ ((91

"তার সম্প্রদায়ের কাফের সর্দাররা বলল : যদি তোমরা শোয়াইবের অনুসরণ করো, তবে নিশ্চিত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।" (৭:৯০)

"এরপর তাদেরকে ভূমিকম্প পাকড়াও করলো। ফলে তারা সকাল বেলা ঘরের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে রইল।" (৭:৯১)

আগের পর্বে আমরা বলেছিলাম, মাদায়েনের অধিবাসীরা তাদের গোত্র প্রধানদের কথামতো হযরত শোয়াইব (আ.)-এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। তারা শুধু আল্লাহর একত্ববাদকে প্রত্যাখ্যান করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং আল্লাহর নবী ও তাঁর অনুসারীদের মাদায়েন থেকে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা কোনোভাবেই হযরত শোয়াইব (আ.) এর দাওয়াত মেনে নিতে চায়নি। সে ঘটনার ধারাবাহিকতায় আজকের আয়অতে বলা হচ্ছে- মাদায়েনের নেতৃস্থানীয় লোকজন মানুষকে হযরত শোয়াইবের বক্তব্য শোনা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ জারি করেছিল। তারা বলেছিল, শোয়াইবের বক্তব্য যে শুনবে তাকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। স্বভাবতই তারা 'ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া' থেকে পার্থিব জীবনের অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা বুঝিয়েছিল। কারণ, হযরত শোয়াইব (আ.) মানুষকে বেচাকেনার সময় মাপে কম দিতে নিষেধ করেছিলেন। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে এটি ছিল ক্ষতিকর একটি বিষয়। কারণ, বিক্রি করার সময় মাপে যে যত কম দিতে পারতো তার তাতক্ষণিক লাভ তত বেশি হতো। কিন্তু এ জঘন্য খারাপ কাজের পরিণতি সম্পর্কে যখন আল্লাহর নবী সবাইকে সতর্ক করেন এবং তারা হযরত শোয়াইব (আ.)-এর বক্তব্য পুরোপুরি উপলব্ধি করার পরও নিজেদের খারাপ কাজে অটল থাকে, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের ওপর মহাশাস্তি নেমে আসে। রাতের অন্ধকারে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয় এবং তাদের সবাই নিহত হয়। মাদায়েনের কাফের সম্প্রদায়ের লোকজন পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছিল কিন্তু আল্লাহ তাদের কাউকে পালানোর সুযোগ দেননি। নিজেদের ঘর-বাড়ির নীচে চাপা পড়ে তাদের সবার মৃত্যু হয়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. যুগে যুগে নবী-রাসূলদের বিরোধীরা ছিল সমাজের ধনি ও প্রভাবশালী শ্রেণীর লোকজন।

দুই. আল্লাহর শাস্তি বেশিরভাগ সময় রাতের অন্ধকারে নেমে আসে। একইভাবে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের প্রতি তার দয়াও রাত্রিবেলা নাজিল হয়।

সূরা আ'রাফের ৯২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

الَّذِينَ كَذَّبُوا شُعَيْبًا كَأَنْ لَمْ يَغْنَوْا فِيهَا الَّذِينَ كَذَّبُوا شُعَيْبًا كَانُوا هُمُ الْخَاسِرِينَ ((92

"শোয়াইবের প্রতি মিথ্যা আরোপকারীরা যেন কোনদিনই সেখানে বসবাস করেনি। (এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো) যারা শোয়াইবের প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছিল, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হলো।" (৭:৯২)

এ আয়াতে মাদায়েনবাসীর ওপর আল্লাহর শাস্তির ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, ঘর-বাড়ি চাপা পড়ে এমনভাবে লোকজন মারা গেছে যে, বাইরে থেকে কেউ সেখানে আসলে মনে করতো- ওই এলাকায় কোনদিন কোন জনমানবই ছিল না। পবিত্র কুরআনে এরপর বলা হয়েছে, মাদায়েনবাসী মনে করতো, মাপে কম দেয়া বন্ধ করে দিলেই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু ধ্বংসলীলা নেমে আসার পর প্রমাণিত হলো- আল্লাহর নির্দেশ অমান্য বা কুফরি করলেই মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পার্থিব জীবনের দৃষ্টিতেও জীবন ও সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায় এবং পরকালীন জীবনেও মহাক্ষতির শিকার হয়ে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে হয়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. কাফেরদের এসব কঠিন পরিণতি থেকে শিক্ষা নিতে হবে আমাদের এবং কোনো অবস্থাতেই আল্লাহর অবাধ্য হওয়া যাবে না।

দুই. সব সময় সব কাজে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, আল্লাহকে যারা ফাঁকি দিতে চায় তাদের ধুর্তামি কোন কাজে আসে না। যারা হযরত শোয়াইব (আ.)কে তা মাতৃভূমি থেকে বিতাড়ন করতে চেয়েছিল তারা নিজেরাই নিজেদের ঘর-বাড়ি চাপা পড়ে ভবলীলা সাঙ্গ করেছিলো।

সূরা আ'রাফের ৯৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَتَوَلَّى عَنْهُمْ وَقَالَ يَا قَوْمِ لَقَدْ أَبْلَغْتُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَنَصَحْتُ لَكُمْ فَكَيْفَ آَسَى عَلَى قَوْمٍ كَافِرِينَ ((93

"এরপর সে তাদের কাছ থেকে প্রস্থান করল এবং বলল : হে আমার সম্প্রদায়, আমি তোমাদেরকে প্রতিপালকের বার্তা পৌঁছে দিয়েছি এবং তোমাদের শুভ কামনা করেছি। এখন আমি কাফেরদের (পরিণতির) জন্য কেনো দুঃখ করবো।" (৭:৯৩)

হযরত শোয়াইব (আ.) ও তার সম্প্রদায় অর্থাত মাদায়েনবাসীর পরিণতির কথা উল্লেখের পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে- কাফেররা প্রবল ভূমিকম্পে নিহত হওয়ার পর আল্লাহর নবী তার কওমের নিহত মানুষদের উদ্দেশ্যে বলছেন, আমি কি তোমাদেরকে আল্লাহর অবাধ্য হতে নিষেধ করিনি? আল্লাহর বার্তা তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে আমি কি তার প্রতি ঈমান আনতে বলিনি? কেন তোমরা আমার উপদেশে কান দাওনি? তোমরা কেন তাদের কথা শুনেছো যারা তোমাদেরকে তাদের ক্রীতদাসে পরিণত করে তাদের স্বার্থ উদ্ধারের কাজে তোমাদেরকে ব্যবহার করতো? প্রিয় ভাইসব, আমি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমার দাওয়াতি কাজ সম্পন্ন করেছি, কিন্তু তোমরাই তা গ্রহণ করনি। তোমরা বুঝেশুনে সত্য প্রত্যাখ্যান করে কাফের নেতাদের আহবানে সাড়া দিয়েছো। কাজেই আজ তোমাদের পরিণতিতে আমার কোন দুঃখ বা অনুতাপ নেই।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. মানুষের মধ্যে দাওয়াতি কাজ করতে হবে আন্তরিকতার সঙ্গে এবং বন্ধুপ্রতীম আচরণ করে। আত্মম্ভরিতা ও দম্ভের সঙ্গে কথা বলা যাবে না কিংবা প্রজাদের সঙ্গে রাজা যেমন আচরণ করে তেমন আচরণও করা যাবে না।

দুই. আমাদেরকে আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা চালানোর পরও যদি তাতে ফল পাওয়া না যায়- তাহলে দুঃখ বা অনুতাপ করার কিছু নেই। কারণ, আল্লাহ আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টাটাই দেখবেন-ফলাফলের ওপর বিচার করবেন না।

তিন. আন্তরিকতা এবং সদ্ব্যবহারেরও একটি সীমা আছে। মানুষ যখন কোন অবস্থাতেই সত্যের বাণী গ্রহণ করে না তখন তার প্রতিবাদ জানানো উচিত।

চার. আল্লাহ মানুষের কাছে সত্যের বাণী পৌঁছে দেয়ার পরই কেবল তাদের প্রতি শাস্তি পাঠান। মানুষ সত্য উপলব্ধি না করা পর্যন্ত তাদের ওপর আযাব নাযিল করার আল্লাহর রীতি নয়।

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)