আল হাসানাইন (আ.)

মুয়াবিয়ার সঙ্গে হাসান (আ)'র যুদ্ধ-বিরতির রহস্য

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

আজ আমরা এমন একজনের কথা বলব যাকে রাসূল (সা.) নিজের প্রিয় সন্তান বলে উল্লেখ করেছেন, যিনি ছিলেন রেসালাতের প্রোজ্জ্বল প্রদীপের শিখা এবং এমন এক আহলে বাইতের সদস্য যাদেরকে আল্লাহ সব সব ধরনের পাপ-পঙ্কিলতা ও দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত রেখেছেন; এমনকি কুরআনের আয়াত অনুযায়ী যাদেরকে ভালবাসা ফরজ বলে ঘোষণা করেছেন।

তিনি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন তৃতীয় হিজরির ১৫ ই রমজানে। আর শাহাদত বরণ করেন ৫০ হিজরির ২৮ শে সফর। ইনি হলেন বেহেশতি যুবকদের অন্যতম সর্দার এবং বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য ও অন্যতম প্রিয় নাতি হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.)। তিনি ছিলেন আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ.) ও হযরত ফাতিমা (সা.)'র প্রথম সন্তান এবং সে যুগের সব মু’মিন মুসলমানের দৃষ্টিতে সবচেয়ে প্রিয় শিশু।

বিশ্বনবী (সা.) মহান আল্লাহর নির্দেশে প্রিয় প্রথম নাতীর নাম রাখেন হাসান। হাসান শব্দের অর্থ সবচেয়ে ভাল বা উত্তম, পছন্দনীয় ইত্যাদি। ইমাম হাসান (আ.)'র সাত বছর বয়স পর্যন্ত মহানবী (সা.) বেঁচে ছিলেন। রাসূল (সা.) বহুবার প্রিয় এই নাতিকে কাঁধে নিয়ে বলেছেন, “হে প্রভু, আমি ওকে ভালবাসি, আপনিও তাকে ভালবাসুন।“তিনি আরও বলতেন, “যারা হাসান ও হুসাইনকে ভালবাসবে তারা আমাকেই ভালবাসল। আর যারা এ দুজনের সঙ্গে শত্রুতা করবে তারা আমাকেই তাদের শত্রু হিসেবে গণ্য করল।” বিশ্বনবী (সা.) হাসান ও হুসাইন (আ.)-কে “বেহেশতের যুবকদের নেতা”ও “মুসলিম উম্মাহর দুই সুবাসিত ফুল” বলে উল্লেখ করেছেন এবং তিনি আরও বলেছেন, “আমার এই দুই নাতি উভয়ই মুসলমানদের ইমাম বা নেতা, তা তারা (তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে) রুখে দাঁড়াক বা না দাঁড়াক।”বিশ্বনবী (সা.) এই দুই নাতির (শৈশবে) সঙ্গে খেলতেন, তাদের বুকে চেপে ধরতেন, চুমু খেতেন এবং তাদের ঘ্রাণ নিতেন। তারা বিশ্বনবী (সা.)’র নামাজের সময় নানার গলায় বসে পড়লে নানা সিজদা থেকে উঠতেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরাই উঠে যেতেন।

বিশ্বনবী (সা.) ইমাম হাসান ও হুসাইন (আ.)-কে তাঁদের শৈশবেই অনেক চুক্তিপত্রের সাক্ষী হিসেবে মনোনীত করেছেন। যখন মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) নাজরানের খ্রিস্টানদের সঙ্গে মুবাহিলা করার ( তথা যারা সত্য ধর্মের বিরোধিতায় লিপ্ত তারা আল্লাহর অভিশাপে ধ্বংস হয়ে যাবে –বিতর্ককারী খ্রিস্টানদের সঙ্গে যৌথভাবে এমন ঘোষণা দেয়ার) সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তখন আল্লাহর নির্দেশেই সঙ্গে নিয়েছিলেন হযরত ইমাম হাসান ও হুসাইন (আ.)সহ ইমাম আলী (আ.) ও ফাতিমা (সালামুল্লাহি আলাইহা)-কে। আর সে সময়ই আলী (আ.)সহ নবী-পরিবারের এই সদস্যরা যে পবিত্র সে বিষয়ে কুরআনের আয়াত নাজেল হয়েছিল।

বিশ্বনবী (সা.) ওফাতের পর থেকে ইমাম হাসান (আ.) ছিলেন তাঁর পিতার অনুসারী এবং পিতার মতই অত্যাচারীদের সমালোচনা করতেন ও মজলুমদের সমর্থন দিতেন। তিনি জামাল ও সিফফিন যুদ্ধে পিতার পক্ষে অংশ নিয়েছিলেন এবং অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। জামাল যুদ্ধের আগুন নেভানোর জন্য তিনি পিতার নির্দেশে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে সঙ্গে নিয়ে কুফায় গিয়ে সেখানকার জনগণকে পিতার পক্ষে সংঘবদ্ধ করে তাদেরকে বসরায় নিয়ে এসেছিলেন।

আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.) নিজের ইন্তিকালের সময় ইমাম হাসান (আ.)-কে তার খেলাফতের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন। বিশ্বনবী (সা.)ই তা করার জন্য ইমাম আলী (আ.)-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন নিজের জীবদ্দশায়।

ইমাম হাসান (আ.) যখন ওজু করতেন তখন আল্লাহর ভয়ে তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেত এবং তিনি কাঁপতে থাকতেন। মৃত্যু ও পুনরুত্থানের কথা যখন স্মরণ করতেন তখন তিনি কাঁদতেন ও বেহাল হয়ে পড়তেন। তিনি পায়ে হেটে এবং কখনও নগ্ন পায়ে ২৫ বার মদিনা থেকে মক্কায় গিয়ে হজ্ব বা ওমরাহ করেছেন। ইমাম হাসান (আ.) জীবনে অন্ততঃ দুবার তাঁর ব্যক্তিগত সব সম্পদ দান করে দিয়েছেন এবং বেশ কয়েকবার অর্ধেক বা তারও বেশি সম্পদ দান করে দিয়েছিলেন। নিষ্পাপ ইমাম হওয়া সত্ত্বেও তিনি আল্লাহর দরবারে নিজেকে পাপী বলে অভিহিত করে আল্লাহর ক্ষমা ও দয়া ভিক্ষা করতেন। কোনো প্রার্থীকে বিমুখ করতেন না ইমাম হাসান (আ.)। তিনি বলতেন, “আমি নিজেই যখন আল্লাহর দরবারে ভিখারি (ও তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করি) তখন কোনো প্রার্থীকে বিমুখ করতে আমার লজ্জা হয়।”

মানুষের সমস্যা সমাধানে তিন এত উদগ্রীব ও ব্যস্ত থাকতেন যেন এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজের কথা তাঁর জানা ছিল না। তিনি নিজেই এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.)’র একটি বাণী তুলে ধরে বলতেন, রাসূল (সা.) বলেছেন যে তার মুমিন ভাইয়ের কোনো একটি সমস্যা সমাধান করবে সে যেন নয় হাজার বছর ধরে আল্লাহর এমন গভীর ইবাদত করল যেন ওই নয় হাজার বছরের দিনগুলোতে সে রোজা রেখেছে ও রাতে ইবাদত করেছে।

ইমাম হাসান মুজতাবা(আ.)’র ক্ষমাশীলতা,পরোপোকারিতা, ধৈর্য ও সহনশীলতা শত্রুদেরও মুগ্ধ করত। মারওয়ান হাকাম এই মহান ইমামকে সব ধরনের কষ্ট দিয়েছে ও বিরক্ত করেছিল। কিন্তু ইমামের শাহাদতের পর মারওয়ান তাঁর জন্য কাঁদতে বাধ্য হয়েছিল এবং ইমামের জানাজার মিছিলেও অংশ নেয়। মারওয়ান বলেছিল, ইমামের সহনশীলতা ছিল (মদীনার) এই পাহাড়ের চেয়েও অনেক বেশি।

ইমাম হাসান (আ.) খলিফা হওয়ার পর মুয়াবিয়া তা মেনে নেয়নি। আলী (আ.)'র বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ষড়যন্ত্রের যে ধারা মুয়াবিয়া সূচিত করেছিল এই নতুন ইমামের বিরুদ্ধেও সেই একই ধারা অব্যাহত রাখে। ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার কাছে এক দীর্ঘ চিঠি লিখে তাকে সুপথে আনার চেষ্টা করেছিলেন। সেই চিঠির একাংশে তিনি লিখেছিলেন, “তুমিও অন্যদের মতই আমার হাতে বাইয়্যাত গ্রহণ কর। তুমি নিজেই ভাল করে জান যে আমি তোমার চেয়ে বেশি যোগ্যতার অধিকারী। আল্লাহকে ভয় কর এবং অত্যাচারী জালিমদের মধ্যে গণ্য হয়ো না।”

মুয়াবিয়া যদি এখনও ভুল করে (অর্থাত বিদ্রোহ অব্যাহত রাখে) তাহলে ইমাম হাসান (আ.) মুসলমানদেরকে নিয়ে তাকে শাস্তি দেবেন বলেও সতর্ক করে দিয়েছিলেন ওই চিঠিতে। তিনি তাকে এও লিখেছিলেন যে, “আল্লাহকে ভয় কর, জুলুম ও মুসলমানদের রক্তপাত বন্ধ কর। অনুগত ও শান্তিকামী হও। আর এমন লোকদের সঙ্গে কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধ করো না যারা তোমার চেয়ে এ কাজে বেশি যোগ্য।”

কিন্তু মুয়াবিয়া চিঠির উত্তরে নিজেকে বেশি অভিজ্ঞ বলে দাবি করে। অবশ্য সে প্রলোভন দেখানোর জন্য বলে যে, ইমাম হাসান (আ.) তাকে খলিফা হিসেবে মেনে নিলে পরবর্তী খলিফা ইমামকেই করা হবে।

মুয়াবিয়া এখানেই ক্ষান্ত হয়নি। সে ইমামকে গোপনে হত্যার জন্য কিছু লোককে নিয়োজিত করে। খলিফা হিসেবে ইমাম হাসান (আ.)-কে মেনে না নেয়ার কারণ হিসেবে ইমামের বয়সের স্বল্পতার অজুহাত দেখানো সত্ত্বেও মুয়াবিয়া নিজের তরুণ সন্তান ইয়াজিদকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনীত করে। এছাড়াও মুয়াবিয়া ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য লোকজন জড় করে তাদেরকে ইরাকে পাঠায়।

এ অবস্থায় ইমামও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন এবং ইমামের কয়েকজন অনুসারী যুদ্ধের জন্য জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে জনগণের এক বিশাল অংশকে যুদ্ধের জন্য সংঘবদ্ধ করেন। কিন্তু এদের মধ্যে একদল ছিল খারেজি। এরা মুয়াবিয়ার বিরোধী হলেও ইমামের অনুগত ছিল না। আর একদল এসেছিল কেবল গণিমতের লোভে। আর একদল ছিল গোত্রবাদের কারণে গোত্রীয় সর্দারদের নির্দেশে যুদ্ধ করতে আসা ব্যক্তি। এদের কোনো ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছিল না। আর অতি অল্প কয়েক জন ছিল ইমামের খাঁটি সমর্থক।

ইমাম হাসান (আ.) তাঁর বাহিনীর একাংশকে পাঠান আনবার শহরে হাকামের সেনাপতিত্বে। হাকাম মুয়াবিয়ার সঙ্গে আঁতাত করে বসে। পরবর্তী সেনাপতির অবস্থাও হয়েছিল একই রকম। ইমাম নিজে মাদায়েনের সাবাত্ব এলাকায় গিয়ে সেখান থেকে বারো হাজার সেনাকে ওবায়দুল্লাহ বিন আব্বাসের সেনাপতিত্বে মুয়াবিয়ার সঙ্গে লড়াই করার জন্য পাঠান। আর কেইস বিন সা'দ বিন ইবাদাহকে উপ-সেনাপতি করেন যেন ওবায়দুল্লাহর অনুপস্থিতিতে তিনি সেনাপতির দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

এদিকে মুয়াবিয়া কেইসকে ধোঁকা দেয়ার ফন্দি করে। সে তার সঙ্গে সহযোগিতা অথবা অন্ততঃ ইমামের পক্ষ ত্যাগ করার জন্য কেইসের কাছে এক মিলিয়ন দেরহাম পাঠায়। কেইস জবাবে বলে: “প্রতারণার মাধ্যমে তুমি আমার ধর্মকে কেড়ে নিতে পারবে না।”কিন্তু প্রধান সেনাপতি ওবায়দুল্লাহ ইবনে আব্বাস কেবল সেই অর্থেই প্রতারিত হয় এবং রাতের অন্ধকারে তার একদল একনিষ্ঠ অনুসারী নিয়ে মুয়াবিয়ার দিকে পালিয়ে যায়। কেইস এই ঘটনা ইমাম হাসান (আ.)-কে জানান এবং বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন। এ অবস্থায় মুয়াবিয়া ইমামের সেনাবাহিনীতে গুপ্তচর পাঠিয়ে মুয়াবিয়ার সঙ্গে কেইসের সন্ধি হওয়ার বানোয়াট সংবাদ প্রচার করতে থাকে। আর মুয়াবিয়ার আরেক দল গোয়েন্দা কেইসের সেনাবাহিনীতে ঢুকে এ কথা প্রচার করতে থাকে যে ইমাম হাসান (আ.) নিজেই মুয়াবিয়ার সঙ্গে সন্ধি করেছেন। এভাবে খারেজি ও সন্ধি-বিরোধীরা প্রতারিত হয়। তারা বিদ্রোহ করে ও হঠাত ইমামের তাবুতে হামলা চালায় ও লুট-তরাজ করে। এমনকি ইমামের বিছানা পর্যন্ত লুট করে এবং ইমামের উরুতে তলোয়ার দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত হানে। ফলে তিনি শোচনীয়ভাবে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ইমামের সঙ্গীরা তাঁকে মাদায়েনের গভর্নরের বাড়ীতে নিয়ে যান। সেখানে কিছুদিন তাঁর চিকিতসা চলে।

এ সময় ইমাম হাসান (আ.) জানতে পারেন যে অনেক গোত্র-প্রধান বা সর্দার তাঁকে মুয়াবিয়ার কাছে তুলে দিতে প্রস্তুত বলে গোপনে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। মুয়াবিয়া হুবহু তাদের চিঠিগুলো ইমামের কাছে পাঠিয়ে সন্ধির অনুরোধ করে এবং বলে যে এই সন্ধিপত্রে ইমাম যেই শর্তই দেন না কেন, তা-ই মেনে নেয়া হবে।

এ অবস্থায় ইমাম হাসান (আ.) যখন একদিকে অসুস্থ ও তাঁর অনুসারীরা নানা দিকে বিক্ষিপ্ত ও ছিন্ন-ভিন্ন এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে পথ ও মতের মিল ছিল না তখন যুদ্ধ অব্যাহত রাখা আর ইসলামের স্বার্থের অনুকূল রইল না। কারণ, মুয়াবিয়া যুদ্ধে জয়ী হলে ইসলামের মূলোতপাটন করে ছাড়ত। তাই ইমাম বেশ কিছু কঠিন শর্ত দিয়ে সন্ধি-চুক্তি তথা যুদ্ধ-বিরতি করতে সম্মত হলেন।

উল্লেখ্য, বিদ্রোহী মুয়াবিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে উতসাহিত করার জন্য হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.) খেলাফতের দায়িত্ব নেয়ার পর পরই যোদ্ধাদের বেতন শতকরা ১০০ ভাগ বৃদ্ধি করেছিলেন। তাই এ ধারণা ঠিক নয় যে ইমাম হাসান (আ.) সাহসী ও জিহাদপন্থী ছিলেন না। মিথ্যা প্রচারে অভ্যস্ত উমাইয়ারাই ইমামকে ভীরু ও বিলাসী হিসেবে ইতিহাসে তুলে ধরতে চেয়েছে। তিনি যদি জিহাদকে ভয় পেতেন তাহলে বাবার সঙ্গে জামাল ও সিফফিন যুদ্ধে অংশ নিতেন না।

এ ছাড়াও হাসান (আ.) জানতেন যে মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে এই সুযোগে বাইজান্টাইন সম্রাট ‘চতুর্থ কনস্তানতিন’ মুসলমানদের প্রথম কিবলা অধ্যুষিত বায়তুল মোকাদ্দাস শহরটি দখলের পদক্ষেপ নেবে। তাই ইমাম শান্তি ও কূটনৈতিক পন্থার মাধ্যমে প্রিয় নানার ধর্মের বার্তা তথা খাঁটি মুহাম্মদী ইসলামকে রক্ষার জন্য ও ইসলামকে দূষণমুক্ত করার যে কাজ পিতা হযরত আলী (আ.) শুরু করেছিলেন সেই মিশনকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে মুয়াবিয়ার সঙ্গে সন্ধি করার সিদ্ধান্ত নেন। মূলত সমর্থকদের নিষ্ক্রিয়তা ও আদর্শিক বিচ্যুতির কারণেই ইমাম হাসান (আ.)-কে যুদ্ধ-বিরতির পথ বেছে নিতে হয়েছিল।

ইমাম (আ.) এও জানতেন যে তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতা বা শাসন-ক্ষমতা হাতে না পেলেও মুসলমানদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমামই থেকে যাবেন। তাই মুয়াবিয়ার স্বরূপ বা আসল চেহারা জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্য তাকে কিছু (নোংরা কাজের সুযোগ) অবকাশ দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে এ সন্ধির ফলে মুসলমানদের রক্তপাত বন্ধ করা সম্ভব হয়েছিল।

অবশ্য ইমাম হাসান (আ.) ছোট ভাই ইমাম হুসাইন (আ.)’র মতই জালেম শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদের পথই ধরতেন যদি তিনি দেখতেন যে, অল্প কিছু সংখ্যক হলেও তাঁর কিছু একনিষ্ঠ ও নিবেদিত-প্রাণ সমর্থক রয়েছেন যারা ইসলামের জন্য যুদ্ধ করতে ও শহীদ হতে প্রস্তুত। ইতিহাসে দেখা যায় শেষ পর্যন্ত প্রায় ১০০ জন (বা কিছু কম/বেশি) শাহাদত-পাগল ও আহলে-বাইত প্রেমিক মুসলমান ইমাম হুসাইন (আ.)’র সঙ্গে স্বেচ্ছায় থেকে গেছেন এবং মহাবীরের মত লড়াই করে শহীদ হয়েছেন। ইমাম হুসাইন (আ.) কুফার প্রায় সব মানুষের সমর্থন পেয়েছিলেন প্রথম দিকে। তারা পরবর্তীতে এই ইমামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। অন্যদিকে ইমাম হাসান (আ.)’র সঙ্গীরা প্রথম দিকেই তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং এমনকি গোপনে শত্রু -শিবিরে যোগ দেয়। তাই ইমাম হাসান (আ.)’র নিবেদিত-প্রাণ সমর্থকের সংখ্যা ছিল ইমাম হুসাইন (আ.)’র নিবেদিত-প্রাণ সঙ্গীদের সংখ্যার চেয়েও অনেক কম বা হাতে গোনা যে কয়জন সঙ্গী ছিল তাদের ওপর ভরসা করতে পারেননি বড় ভাই ইমাম হাসান (আ.)। কারণ, আদর্শিক দৃঢ়তা তাদের মধ্যে ছিল না।

উল্লেখ্য, মুয়াবিয়ার বাবা আবু সুফিয়ান ছিল ইসলামের ও বিশ্বনবী (সা.)’র কঠোরতম শত্রু । মক্কা বিজয়ের পর (অষ্টম হিজরিতে) অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুয়াবিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইত (আ.)-এর সঙ্গে তার শত্রুতা অব্যাহত থাকে। হযরত আলী (আ.)’র বিরুদ্ধে এক মিথ্যা অজুহাতে সে সিরিয়া থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। সিফফিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এই বিদ্রোহের কারণে। এই যুদ্ধে মুয়াবিয়ার পক্ষে ৪৫ হাজার নিহত এবং হযরত আলী (আ.)’র পক্ষে শহীদ হন পঁচিশ হাজার মুজাহিদ।

হযরত আলী (আ.)’র বিরুদ্ধে সিরিয়ায় বিদ্রোহ শুরু করার পেছনে মুয়াবিয়ার অজুহাত ছিল তৃতীয় খলিফার হত্যাকাণ্ডের বিচার। এটা যে নিছক অজুহাতই ছিল তার প্রমাণ হল হযরত আলী (আ.)’র শাহাদতের পর মুসলিম বিশ্বের সব অঞ্চল ছলে বলে কৌশলে করায়ত্ত করা সত্ত্বেও মুয়াবিয়া আর কখনও তৃতীয় খলিফার হত্যাকারীদের বিচারের কথা মুখেও উচ্চারণ করেনি। দ্বিতীয় খলিফার শাসনামল থেকেই সিরিয়ায় প্রায় স্বাধীন রাষ্ট্র প্রধানের মত চালচলনে অভ্যস্ত মুয়াবিয়া জানত যে হযরত আলী (আ.)’র মত কঠোর ন্যায়-বিচারক শাসক তাকে কখনও ছোট বা বড় কোন পদ দেবেন না। তাই আলী (আ.) খলিফা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য অনেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার মত মুয়াবিয়াকেও পদচ্যুত করলে ইসলামের ইতিহাসে রাজতন্ত্র প্রবর্তনকারী মুয়াবিয়া সিরিয়ায় বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করে।

মুয়াবিয়ার সঙ্গে ইমাম হাসান (আ.)র সন্ধির কিছু শর্ত:

-আহলে বাইতের অনুসারীদের রক্ত সম্মানিত ও হেফাজত থাকবে এবং তাদের অধিকার পদদলিত করা যাবে না।

-মুয়াবিয়াকে হযরত আলী (আ.)’র বিরুদ্ধে মিথ্যাচার, গালি-গালাজ, অপবাদ ও প্রচারণা বন্ধ করতে হবে।

-জামাল ও সিফফিনের যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারগুলোকে এক মিলিয়ন দেরহাম অর্থ সাহায্য দিতে হবে ইরানি প্রদেশগুলোর সরকারি আয় থেকে।

-ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়াকে আমিরুল মু’মিনিন বলে উল্লেখ করবেন না।

-মুয়াবিয়াকে অনৈসলামী আচার-আচরণ পরিহার করতে হবে এবং আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাত অনুযায়ী আমল করতে হবে।

-মুয়াবিয়া কোনো ব্যক্তিকেই (খেলাফতের জন্য) নিজের উত্তরসূরি মনোনীত করতে পারবে না। মুয়াবিয়া মারা গেলে খেলাফত ফেরত দিতে হবে ইমাম হাসান (আ.)’র কাছে।

-ইমাম হাসান (আ.) যদি মারা যান, তাহলে মুসলিম জাহানের খেলাফত হস্তান্তর করতে হবে রাসূল(সা.)’র ছোট নাতি হযরত ইমাম হুসাইন(আ.)’র কাছে।

কিন্তু মুয়াবিয়াপ্রকাশ্যেই নির্লজ্জভাবে সন্ধির শর্তগুলো লঙ্ঘন করেছিল। মুয়াবিয়া ৫০ হিজরিতে গোপনে বিষ প্রয়োগ করে ইমাম হাসান(আ.)-কে শহীদ করে। ৬০ হিজরিতে মৃত্যুর কিছু দিন আগে মুয়াবিয়া তার মদ্যপ ও লম্পট ছেলে ইয়াজিদকে মুসলমানদের খলিফা বলে ঘোষণা করে।

মুয়াবিয়া বলত যেখানে টাকা দিয়ে কাজ হয় সেখানে আমি টাকা বা ঘুষ ব্যবহার করি, যেখানে চাবুক দিয়ে কাজ হয় সেখানে আমি তরবারি ব্যবহার করি না, আর যেখানে তরবারি দরকার হয় সেখানে তরবারি ব্যবহার করি। মুয়াবিয়া রাজ-কোষাগারকে ব্যবহার করত প্রভাবশালী লোকদের পক্ষে আনার কাজে।

মুয়াবিয়া ইমাম হাসান (আ.)’র সঙ্গে স্বাক্ষরিত সন্ধি-চুক্তির অপব্যবহার করেছিল। সে কুফায় প্রবেশ করে বক্তৃতার আসনে এটা বলে যে “হাসান আমাকে যোগ্য মনে করেছে, নিজেকে নয়। এ জন্য সে খেলাফত আমার কাছে ছেড়ে দিয়েছে।” ইমাম হাসান (আ.) সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “মুয়াবিয়া মিথ্যাচার করছে।“এরপর তিনি তার যোগ্যতা ও মর্যাদার ব্যাপারে বিস্তারিত বক্তব্য রাখেন। সেসবের মধ্যে মুবাহিলাতে তাঁর অংশ গ্রহণের কথা তুলে ধরেন। অবশেষে তিনি বলেন, “আমরা কুরআন এবং নবীর সুন্নত মতে সবার চেয়ে উত্তম এবং এ কারণেই সবার চেয়ে যোগ্যতর।”

ইমাম সন্ধির শর্তেই এটা উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি মুয়াবিয়াকে আমিরুল মু’মিনিন বলবেন না। এরই আলোকে তিনি কখনও মুয়াবিয়ার হাতে বাইয়্যাত হননি এবং মুয়াবিয়ার কোনো নির্দেশই মান্য করতেন না। যেমন, মুয়াবিয়া খারেজিদের বিদ্রোহ দমনে ইমামের সহায়তা চান এবং তাঁকে খারিজিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নির্দেশ দেন। কিন্তু ইমাম হাসান (আ.) তাঁর কথায় মোটেও কর্ণপাত করেননি।

অনেকে এ প্রশ্ন করেন যে, একদল লোক তো মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিল। তাহলে ইমাম হাসান (আ.) কেন যুদ্ধ করলেন না? এর উত্তর হল, সে সময় যুদ্ধ করাটা ছিল মুসলমানদের বৃহত্তর স্বার্থের পরিপন্থী, তাই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দাবি যারা করেছিল তা মেনে নেয়াকে ইমাম যৌক্তিক মনে করেননি। নবী ও ইমামরা কখনও ভুল করেন না, যদিও জনগণ অনেক সময় এই ঐশী নেতৃবৃন্দের দূরদৃষ্টিপূর্ণ সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে না বরং বহু পরে বুঝতে পারে। যেমন, বিশ্বনবী (সা.)’র সম্পাদিত হুদায়বিয়ার সন্ধি। যেমন, ওমর ইবনে খাত্তাব (দ্বিতীয় খলিফা) হুদায়বিয়া সন্ধির অপমানজনক (দৃশ্যত)শর্তগুলোর আলোকে এ সন্ধির সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করছিলেন। কিন্তু রাসূল (সা.) তখন বলেছিলেন, “আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। আমি কখনও তাঁর নির্দেশের বিরোধিতা করি না এবং তিনি কখনও আমার কোনো ক্ষতি করেন না”। আর তাই হয়েছিল। কিছু দিন পর এই শান্তি চুক্তির কল্যাণকর দিকগুলো সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। কারণ, যুদ্ধের আগুন নিভে যাওয়ায় ও মক্কাতে মুসলমানদের গমনাগমনের কারণে মুশরিকরা ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ বোঝার সুযোগ পেয়েছিল এবং তাদের অনেকেই মুসলমান হয়ে যায়। ফলে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই মক্কার অধিবাসীদের বেশিরভাগই ইসলামে দীক্ষিত হয়।

ইমাম হাসান (আ.) –কে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল মুয়াবিয়া জালিম হওয়া সত্ত্বেও আপনি নিজে সত্য পথে থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও কেন তার সঙ্গে যুদ্ধ-বিরতি বা সন্ধি করেছেন? ইমাম তখন হুদায়বিয়ার সন্ধির দৃষ্টান্ত দেন এবং খিজির (আ.)’র কাজগুলোর রহস্যময় উদ্দেশ্য বুঝতে না পারার কারণে হযরত মুসা নবী (আ.)’র রাগের কথা তুলে ধরেন। তিনি আরো জানান যে, মুয়াবিয়ার সঙ্গে ওই সন্ধি না করলে পৃথিবীর বুকে আহলে বাইতের কোনো অনুসারী টিকে থাকত না।

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সর্বোচ্চনেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এক বিশ্লেষণে বলেছেন, “ইমাম হাসান (আ.)’র যুগে কপটতা বা মুনাফিকির মাত্রা তাঁর বাবার যুগের তুলনায় এত বেশি বেড়ে গিয়েছিল যে ইমাম জানতেন তিনি যদি তাঁর মুষ্টিমেয় সঙ্গীদের নিয়ে যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে যান তাহলে নৈতিক অধঃপতনে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ততকালীন মুসলিম সমাজ তাঁর রক্তের বদলা নেয়ার কোনো চেষ্টাই করত না। বরং মুয়াবিয়ার প্রচারণা, অর্থ বা ঘুষ ও কূট-কৌশলগুলো সবাইকে এমনভাবে বশে নিয়ে আসত যে দুই-এক বছর পর লোকেরা বলবে, ইমাম হাসান (আ.) বৃথাই বা অনর্থক মুয়াবিয়ার মোকাবেলায় রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাই ইমাম সব ধরনের কষ্ট নিজের জন্য ডেকে এনে সেসব সহ্য করলেন, কিন্তু তবুও শাহাদতের পথ ধরেননি; কারণ, তিনি জানতেন যে তাঁর শাহাদত বৃথাই যেত।”

উল্লেখ্য, ইমামদের কর্মপদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য থেকে থাকলেও তা নিছক পরিবেশ ও পরিস্থিতির দাবিতেই হয়, কখনও তা তাদের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য থেকে উদ্ভুত হয় না। তাই এটা বলা ভিত্তিহীন যে যদি ইয়াজিদের সময় ইমাম হাসান (আ.) জীবিত থাকতেন তবে তিনি যুদ্ধ-বিরতির নীতি গ্রহণ করতেন। না, কখনই এ দাবি সত্য নয় যে, ইমাম হাসান (আ.) যুদ্ধ পছন্দ করতেন না বলে শান্তিপূর্ণ পথকে প্রাধান্য দিতেন।

এর প্রমাণ হল, প্রথমত মৌলিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন (আ.) উভয়েই একরূপ ছিলেন এবং নীতির ক্ষেত্রেও তাঁদের মধ্যে অভিন্নতা ছিল। তাঁরা উভয়েই একদিকে অত্যন্ত সাহসী ও অন্যদিকে বীর যোদ্ধা ছিলেন। নাহজুল বালাগার ২০৭ নং খুতবায় হজরত আলীর বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, তিনি সিফফিনের যুদ্ধে ইমাম হাসানের দুঃসাহসিকতায় এতটা শঙ্কিত হন যে স্বীয় সঙ্গীদের বলেন : ‘হাসানকে এভাবে মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করা থেকে নিবৃত কর আমি তাকে হারানোর আশঙ্কা করছি।’তা্ই নিঃসন্দেহে বলা যায় মুয়াবিয়ার সাথে তিনি সঙ্গীদের অসহযোগিতার কারণে যুদ্ধ-বিরতির সন্ধি করতে বাধ্য হন, ভীরুতার কারণে নয়। ঐতিহাসিক মাসউদী তার ‘ইসবাতুল ওয়াসিয়া’গ্রন্থে ইমাম হাসানের যে বক্তব্যটি উল্লেখ করেছেন তাতে তিনি বলেছেন : ‘আমি যদি উপযুক্ত সঙ্গী পেতাম তবে খেলাফত লাভের জন্য এমন বিপ্লব ও আন্দোলন করতাম যে কেউ তার নজির দেখেনি।’

দ্বিতীয়ত মুয়াবিয়ার বাহ্যিক ধার্মিকতার বিষয়টি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার বৈধতাকে জনগণের সামনে স্পষ্ট করা বেশ কঠিন ছিল। একারণে আমরা দেখি ইমাম হাসানের (আ.) মৃত্যুর পর মুয়াবিয়া দশ বছর জীবিত থাকলেও ইমাম হোসাইন (আ.) তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের আহ্বান জানাননি। এর বিপরীতে ইয়াজিদের সময় যেভাবে অধার্মিকতা প্রকাশ্য রূপ লাভ করেছিল ইমাম হাসানের (আ.) জীবদ্দশায় এরূপ অবস্থার সৃষ্টি হলে সেক্ষেত্রে তিনিও বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ইমাম হোসাইনের (আ.) মতই বিদ্রোহ করতেন।

ইমাম যে অত্যন্ত দূরদর্শী ছিলেন তার সাক্ষ্য বহু আগেই দিয়ে গিয়েছিলেন প্রিয় নানাজি বিশ্বনবী (সা.)। তিনি বলেছিলেন, “বুদ্ধিমত্তা যার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে সে হল হাসান বিন আলী।“

মুয়াবিয়া ইমাম হাসানের (আ.) সঙ্গে সন্ধির পর যখন সব কিছুর ওপর নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় তখন সে প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়ে সন্ধির শর্তগুলো লঙ্ঘন করবে বলে জানিয়ে দেয়। মুয়াবিয়া ইমামকে মদীনায় সব ধরনের কষ্ট দেয়ার চেষ্টা চালায় এবং মদীনায় নিয়োজিত তার গভর্নররাও একই কাজে মশগুল ছিল। ফলে ইমাম মদীনায় দশ বছর অবস্থান করা সত্ত্বেও তার অনুসারীরা এই মহান ইমামের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ খুবই কম পেত। ফলে ইমাম হাসান (আ.)’র মত মহাজ্ঞানের উতস থেকে খুব কম সংখ্যক অনুসারীই উপকৃত হতে পেরেছে। এই মহান ইমাম থেকে বর্ণনার সংখ্যাও তাই খুব কম দেখা যায়।

মুয়াবিয়া নিজের মৃত্যু আসন্ন এটা উপলব্ধি করতে পেরে নিজের ছেলের জন্য ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার আয়োজন করতে থাকে। সে এটাও বুঝতে পেরেছিল যে, ইমাম হাসান (আ.) বেঁচে থাকলে জনগণ সহজেই তার লম্পট ছেলেকে খলিফা হতে দেবে না। তাই মুয়াবিয়া বেশ কয়েকবার ইমামকে শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করে। অবশেষ চক্রান্তের মাধ্যমে বিষ প্রয়োগে ইমামকে শহীদ করে। মুয়াবিয়া অত্যন্ত কূট-কৌশলে ইমামের (আ.) এক স্ত্রীকে বিভ্রান্ত করে তাঁকে দিয়ে বিষ-প্রয়োগের মাধ্যমে ইমামকে শহীদ করতে সক্ষম হয়। পঞ্চদশ হিজরির সফর মাসের ২৮ তারিখে ৪৭ বা ৪৮ বছর বয়সে শাহাদতের অমৃত পান করেন ইমাম হাসান (আ.)। বলা হয় ইমাম হাসান (আ.)-কে তাঁর প্রিয় নানার কবরের পাশে দাফন করার উদ্যোগ নিয়েছিল নবী-পরিবার। কিন্তু বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইতের এই উদ্যোগকে বাধা দেয় বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের বিদ্বেষী প্রভাবশালী মহলগুলো। ফলে রাসূল (সা.)'র রওজা থেকে বেশ কিছু দূরে জান্নাতুল বাকি গোরস্তানে দাফন করা হয় এই মহান ইমামকে।

ইমাম হাসান (আ.) দেখতে প্রায় নানার মত তথা বিশ্বনবী (সা.)’র মত ছিলেন। তাঁর আচার-আচরণও ছিল সে রকম। তাঁকে দেখলেই রাসূল (সা.)’র স্মৃতি চাঙ্গা হত দর্শকদের মনে।

এই মহান ইমামের মূল্যবান একটি বাণী শুনিয়ে এবং সবাইকে আবারও মুবারকবাদ জানিয়ে শেষ করবো আজকের এই আলোচনা।

ইমাম হাসান (আ.) বলেছেন- “আমি বিস্মিত হই তার ব্যাপারে যে তার খাদ্যের মান নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে বা চিন্তিত অথচ নিজের চিন্তার খোরাক নিয়ে ভাবে না। অর্থাত সে তার পাকস্থলীর জন্য ক্ষতিকর খাবার বর্জন করলেও তার চিন্তার জগতে এমন কিছুকে প্রবেশ করতে দেয় যা তাকে ধ্বংস করে।”

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)