আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আ'রাফ; (২৪তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আ'রাফ; আয়াত ১০৯-১১৬

সূরা আল আ'রাফের ১০৯ ও ১১০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قَالَ الْمَلَأُ مِنْ قَوْمِ فِرْعَوْنَ إِنَّ هَذَا لَسَاحِرٌ عَلِيمٌ (109) يُرِيدُ أَنْ يُخْرِجَكُمْ مِنْ أَرْضِكُمْ فَمَاذَا تَأْمُرُونَ ((110

"ফেরাউনের সম্প্রদায়ের প্রধানগণ বলেছিলো, এ তো সত্যিই এক সুদক্ষ জাদুকর।" (৭:১০৯)

"সে তোমাদের দেশ থেকে তোমাদেরকে বিতাড়িত করতে চায়। তাই তার  ব্যাপারে তোমাদের কী পরামর্শ?" (৭:১১০)

আগের পর্বে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহর নির্দেশে হযরত মুসা (আ.) ফেরাউনের দরবারে গিয়ে তাকে এক আল্লাহর ইবাদত করার আহ্বান জানান। বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের শোষণ ও নির্যাতন থেকে রক্ষা করাও ছিল তার এই মিশনের উদ্দেশ্য। মুসা (আ.) তাঁর নবুওত ও খোদায়ী মিশনের দলিল হিসেবে যে মোজেজা দেখিয়েছিলেন তা ফেরাউনের দলবলকে বিস্মিত করে। এ আয়াতে বলা হয়েছে, ফেরাউনের সাঙ্গপাঙ্গ ও তার জাতির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা এসব মোজেজাকে জাদু বলে অভিহিত করল যাতে কেউ মুসা (আ.)'র কথা ও তাঁর মোজেজাগুলো দেখে প্রভাবিত না হয়। সে যুগে জাদু ছিল ব্যাপক প্রচলিত বিষয়। মানুষ জানতো যে জাদু হচ্ছে এক ধরনের প্রতারণা বা সম্মোহন মাত্র, তা বাস্তব নয়। ফেরাউনের সাঙ্গপাঙ্গ ও তার জাতির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা এ অভিযোগও তুলল যে, ধর্ম প্রচার নয় বরং ক্ষমতা দখল ও সম্পদ আহরণই হযরত মুসা (আ.)'র এইসব 'জাদু প্রদর্শনীর' আসল উদ্দেশ্য। সে ফেরাউন ও তার দলবলকে উতখাত বা বিতাড়িত করে বনি ইসরাইলের ওপর শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর এ লক্ষ্য যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে এই দেশে আর আমাদের কোনো কর্তৃত্ব বা নাম-নিশানাই থাকবে না। এইসব কথা বলে তারা একে-অপরকে চিন্তা করতে বলে এবং  পরস্পরের মতামত জানতে চায়।

এ দুই আয়াতের দু'টি শিক্ষা হলো:

এক. নবী-রাসূলদের স্পস্ট যুক্তি প্রমাণের মোকাবেলায় তাঁদের বিরোধীরা কেবলই অপবাদ আরোপ করত এবং  চরম গোড়ামির আশ্রয় নিত।

দুই. ক্ষমতালিপ্সু খোদাদ্রোহীরা সত্যপন্থীদের সব সময়ই ক্ষমতাপিপাসু ও অশান্তিকামী বলে অপবাদ দিয়েছে যাতে সত্যপন্থীরা সফল না হয়।

সূরা আল আরাফের ১১১ ও ১১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَالُوا أَرْجِهْ وَأَخَاهُ وَأَرْسِلْ فِي الْمَدَائِنِ حَاشِرِينَ (111) يَأْتُوكَ بِكُلِّ سَاحِرٍ عَلِيمٍ ((1120

"তারা (অর্থাত ফেরাউনের সাঙ্গপাঙ্গরা) বলেছিলো, "তাকে ( তথা মুসা) এবং তাঁর ভাইকে (কারাগারে পাঠিয়ে) [সাময়িক] অবকাশ দাও। এবং নগরে নগরে লোক পাঠাও  জাদুকরদের সংগ্রহ করার জন্য।" (৭:১১১)

"তারা যেন প্রত্যেক সুদক্ষ জাদুকরদের তোমার কাছে উপস্থিত করে।" (৭:১১২)

ফেরাউনের দরবারের  আমির-ওমরাহ বা অভিজাত লোকেরা শলা-পরামর্শ করে বলল যে, আপাতত মুসা (আ.)-কে হত্যা করার দরকার নেই বা তাকে হত্যার জন্য তাড়াহুড়া করার দরকার নেই।  কারণ, তাঁকে প্রতিহত করার জন্য জাদুকরদের সাহায্য নেয়া হবে। আর এ জন্য তারা দেশের  সব সুদক্ষ জাদুকরদের ফেরাউনের কাছে উপস্থিত করার পরামর্শ দেয়।

এ দুই আয়াতের দু'টি শিক্ষা হলো:

এক. খোদাদ্রোহী শক্তিগুলো সত্যের শক্তিকে হারানোর জন্য বড় বড়  আন্তর্জাতিক সম্মেলন, সভা ও সেমিনারের আয়োজন করে থাকে।

দুই. অনেক সময় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলাকে সত্যের শক্তির বিরুদ্ধে এবং পথভ্রষ্ট লোকদের সেবায় ব্যবহার করা হয়।

সূরা আল আ'রাফের ১১৩ ও ১১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَجَاءَ السَّحَرَةُ فِرْعَوْنَ قَالُوا إِنَّ لَنَا لَأَجْرًا إِنْ كُنَّا نَحْنُ الْغَالِبِينَ (113) قَالَ نَعَمْ وَإِنَّكُمْ لَمِنَ الْمُقَرَّبِينَ ((114

"এবং জাদুকররা ফেরাউনের কাছে এসে বলল, আমাদের জন্যে কি কোন পারিশ্রমিক নির্ধারিত আছে, যদি আমরা জয়লাভ করি?" (৭:১১৩)

"সে (ফেরাউন) বলল, হ্যাঁ (পুরস্কার তো আছেই,) এবং এ ছাড়াও অবশ্যই তোমরা আমার ঘনিষ্ঠ লোক হয়ে যাবে।" (৭:১১৪)

ফেরাউনের সাধারণ ঘোষণায় সাড়া দিয়ে মিশরের নানা অঞ্চলের জাদুকররা তার রাজদরবারে হাজির হল। যেসব কাজ করতে হবে তা তাদের বুঝিয়ে দেয়া হয়। এ অবস্থায় তারা বলল, এতো খুব বড় কাজ। আমরা যদি মুসাকে জাদুর মাধ্যমে হারিয়ে দিতে পারি তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই খুব বড় পুরস্কার দিতে হবে। ফেরাউন বিজয়ী জাদুকরদের জন্য খুব দামী বস্তুগত পুরস্কার ছাড়াও তাদেরকে দরবারে উচ্চ পদে নিয়োগ করার ওয়াদা দিল। এমনকি তাদেরকে খুব ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে বরণ করা হবে বলেও ফেরাউন ঘোষণা দেয়। তবে শর্ত হল মুসা (আ.)'র বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে হবে।

এ দুই আয়াতের দু'টি শিক্ষা হল:

এক.  জাদুকররাও অন্যদের মত তাদের কাজের জন্য পুরস্কার ও পারিশ্রমিক চায় । কিন্তু নবী-রাসূলরা মানুষকে সুপথ দেখানোর বিনিময়ে কিছুই চান না। এটা ছিল যুগে যুগে নবী-রাসূলদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

দুই. খোদাদ্রোহী শক্তিগুলো সত্যকে দমিয়ে রাখার আশায় পুঁজি বিনিয়োগ করে থাকে। তারা এই লক্ষ্য হাসিলের কাজে শিল্পী ও বিশেষজ্ঞদের ব্যবহার করে এবং তাদেরকে বড় বড় পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়।

সূরা আল আ'রাফের ১১৫ ও ১১৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَالُوا يَا مُوسَى إِمَّا أَنْ تُلْقِيَ وَإِمَّا أَنْ نَكُونَ نَحْنُ الْمُلْقِينَ (115) قَالَ أَلْقُوا فَلَمَّا أَلْقَوْا سَحَرُوا أَعْيُنَ النَّاسِ وَاسْتَرْهَبُوهُمْ وَجَاءُوا بِسِحْرٍ عَظِيمٍ ((116

"জাদুকররা বলল,  হে মূসা! হয় তুমি নিক্ষেপ কর অথবা আমরা নিক্ষেপ করছি।" (৭:১১৫)

"তিনি বললেন, তোমরাই নিক্ষেপ কর। যখন তারা (জাদুর উপকরণগুলো) নিক্ষেপ করল তখন সেগুলো লোকদের চোখগুলোকে বিভ্রান্ত করে দিল, তাদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলল এবং তারা এক (কৃতিত্বপূর্ণ) মহাজাদু প্রদর্শন করল।" (৭:১১৬)

হযরত মুসা (আ.)'র মোকাবেলায় জাদুকররা যখন তাদের কসরত দেখানোর জন্য তৈরি হল, তখন ফেরাউন জনগণকেও ওই লড়াই দেখার জন্য খোলা ময়দানে সমবেত হতে বলে। ফলে মুসা (আ.) ও জাদুকরদের চারদিকে সমবেত হয় বিপুল সংখ্যক মানুষ। ফেরাউন ধরে নিয়েছিল যে জাদু প্রদর্শনীর এ লড়াইয়ে মুসা হেরে যাবেন এবং এভাবে তাকে চিরদিনের জন্য দমিয়ে রাখা যাবে।

জাদুকররা মুসা(আ.)-কে বলল, তুমি শুরু করবে, না আমরা শুরু করব?–এ কথা বলে তারা এটা বোঝাতে চেয়েছিল যে, হে মুসা আমরা তো বিজয়ী হবই, তাই কে আগে বা পরে লড়াই শুরু করবে-সেটা তাদের জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, আগে ও পরে শুরু করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু হযরত মুসা (আ.) মহান আল্লাহর শক্তির ওপর ভরসা করে বললেন, তোমরাই প্রদর্শনী শুরু কর। আর জাদুকররাও তাদের সব দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করে উপস্থিত জনতার চোখে এমনভাবে ধাঁধা লাগিয়ে দেয় যে, তারা কিছু রশি বা দড়ি জাতীয় জিনিষকে সাপ মনে করে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।

এ  দুই আয়াতের দু'টি শিক্ষা হল:

এক. মানুষের ইন্দ্রিয়-অনুভূতি অনেক সময় ভুল করতে পারে। তাই তারা অনেক সময় বাস্তবতাকে ভিন্নভাবে দেখে। ঠিক যেভাবে মানুষ মরুভূমিতে মরিচীকা দেখে।  জাদুকররা মানুষের এই দুর্বলতাকে ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিল করে।

দুই. জাদু কুসংস্কার বা খেয়ালীপনার বিষয় নয়। জাদু মানুষকে প্রভাবিত করে। তাই ইসলামে জাদু পুরোপুরি নিষিদ্ধ।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)