আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আ'রাফ; (৪০তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আ'রাফ; আয়াত ১৭৫-১৭৮

সূরা আ'রাফের ১৭৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آَتَيْنَاهُ آَيَاتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ

"হে নবী! আপনি মানুষের কাছে ওই ব্যক্তির ঘটনা বর্ণনা করুন যাকে আমি আমার ক্ষমতা সম্পর্কে নিদর্শনাবলী দিয়েছিলাম। কিন্তু সে অকৃতজ্ঞ হয়ে তা বর্জন করে এবং শয়তান তাকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে। আর সে বিপথগামীদের দলভুক্ত হয়।" (৭:১৭৫)

এ আয়াতে বনি ইসরাইলের বালাম ব আউরা নামের একজন পণ্ডিত ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে। এ পণ্ডিত প্রথমে হযরত মূসা (আ.)'র অনুসারী তথা মুমিন ছিল, কিন্তু পরে শয়তানের প্ররোচনায় পথভ্রষ্ট হয়ে ফেরাউনের দরবারে যোগ দেয় । ফেরাউনের রাজদরবারের বাহ্যিক চাকচিক্য ও জৌলুস তাকে এতটা ধোঁকায় ফেলে দেয় যে সে হযরত মূসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে মন্দ পরিণতির শিকার  হয়। তাওরাতেও তার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকারঃ

এক. দুনিয়ার  লোভ-লালসা  ধর্মীয় পণ্ডিত বা আলেমদেরকেও ধোঁকায় ফেলতে   পারে । বালাম ব আউরার পরিণতি থেকে সব আলেমেরই শিক্ষা নেয়া উচিত।

দুই. নিজের অতীত নিয়ে অহংকার করা ঠিক নয়। পতনের বিপদ সব সময়ই রয়েছে এবং যে যত বেশী উপরে উঠবে তার তত বেশী নীচে পড়ার আশংকা বেশী।

তিন. যে আল্লাহর পথ ছেড়ে দেয় সে শয়তানের ধোঁকায় পড়ে। দুনিয়ার লোভ ধর্মীয় পণ্ডিত বা আলেমকেও শয়তানের শিকার বা শয়তানের দোসরে পরিণত করে।

সূরা আ'রাফের  ১৭৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلَوْ شِئْنَا لَرَفَعْنَاهُ بِهَا وَلَكِنَّهُ أَخْلَدَ إِلَى الْأَرْضِ وَاتَّبَعَ هَوَاهُ فَمَثَلُهُ كَمَثَلِ الْكَلْبِ إِنْ تَحْمِلْ عَلَيْهِ يَلْهَثْ أَوْ تَتْرُكْهُ يَلْهَثْ ذَلِكَ مَثَلُ الْقَوْمِ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا فَاقْصُصِ الْقَصَصَ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ

"আমি ইচ্ছে করলে এ নিদর্শন ও যে জ্ঞান তাকে দিয়েছি তার মাধ্যমে তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করতে পারতাম। কিন্তু সে দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং তার কামনা বাসনার অনুসরণ করে। তার অবস্থা এমন কুকুরের মতো তাকে আপনি কষ্ট বা আঘাত দিলে  সে জিভ বের করে হাঁপাতে থাকে এবং কষ্ট না দিলেও জিভ বের করে হাঁপায়। যারা  আমার নিদর্শনকে অবিশ্বাস করে, তাদের অবস্থা এ রকম ; আপনি এ ঘটনা তাদের কাছে বলুন, যেন তারা চিন্তা করে।" (৭:১৭৬)

এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন আমি তাকে মর্যাদা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে নিজেই দুনিয়ার লোভ ছাড়তে পারেনি। আমি তাকে উন্নতি ও মর্যাদার মাধ্যম দিয়েছিলাম, কিন্তু সে নিজেই উঁচুতে উঠতে তথা মর্যাদা নিতে চায়নি। সে দুনিয়ার লোভের কারণে শয়তানের ফাঁদে পড়ে এবং যা কিছু সে অর্জন করেছিল তা হারিয়ে ফেলে ।

পবিত্র কুরআন উদাসীন মানুষকে চতুস্পদ জন্তুর সাথে তুলনা করেছে এবং দুনিয়া পূজারী পণ্ডিতকে কুকুরের সাথে তুলনা করেছেন। কুকুর সব সময় মুখ থেকে জিভ বের করে রাখে এবং এমনভাবে লালা ঝরাতে থাকে যে মনে হয় তার লোভের কোনো শেষ নেই।  অর্থ-বিভব, খ্যাতি, যশ এবং সম্মানের লোভ মানুষের অহংকার থেকে উদ্ভুত হয়। বিশ্বনবী হযরত মোঃ সঃ বলেছেন: জ্ঞান বাড়লেও সঠিক পথের দিশা বা হেদায়াতের চেতনা যার মধ্যে বৃদ্ধি পায় না, সে জ্ঞান তাকে আল্লাহ থেকে আরো বেশী দূরে সরিয়ে দেয় ।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. আল্লাহর নিদর্শন সম্পর্কিত জ্ঞান মানুষের মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি করে। তবে শর্ত হলো এ জ্ঞান হতে হবে দুনিয়ার আকর্ষণ থেকে মুক্ত।

দুই. ধর্মীয় আলেমগণ যদি দুনিয়া পূজারী হন, তাহলে তারা আল্লাহর নিদর্শনকেও অস্বীকার করে বসেন এবং কাফেরে পরিণত হতে পারেন।

তিন. অতীত ব্যক্তিদের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের জন্যে শিক্ষার বিষয়। অতীতের ইতিহাসকে গুরুত্ব দেয়া উচিত।

সূরা আ'রাফের ১৭৭ ও ১৭৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

سَاءَ مَثَلًا الْقَوْمُ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا وَأَنْفُسَهُمْ كَانُوا يَظْلِمُونَ (177) مَنْ يَهْدِ اللَّهُ فَهُوَ الْمُهْتَدِي وَمَنْ يُضْلِلْ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ (178)

"যারা আমার নিদর্শনকে অস্বীকার করে, তারা বাস্তবে নিজের ওপরই জুলুম করে, তাদের দৃষ্টান্ত কতই না মন্দ।" (৭:১৭৭)

"আল্লাহ যাকে সুপথ দেখান সেই সুপথ পায় এবং আল্লাহ যাকে বিপথগামী করেন তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।" (৭:১৭৮)

বালাম ব আউরার ঘটনা বর্ণনার পর পবিত্র কুরআন এখানে মহান আল্লাহর একটি সামগ্রীক নীতি বর্ণনা করছে। এ নীতিটি হলো যারা আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করে, তাদের অত্যন্ত খারাপ পরিণতি ভোগ করতে হবে এবং তাদের এমন ভাবনা বোকামী যে, তারা আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শনকে অস্বীকার করে আল্লাহ ও তার ধর্মের  ক্ষতি করতে পেরেছে। আসলে তাঁরা নিজেরাই নিজের ওপর জুলুম করেছে এবং এভাবে তারা নিজেরাই নিজেকে আল্লার দয়া ও করুণা থেকে বঞ্চিত করছে। কারণ, যাঁরা সত্যকে অস্বীকার করে তারা খোদায়ী দিক-নির্দেশনা বা হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হয়। আর এটাই মানুষের জন্যে সবচেয়ে বড় ক্ষতি।

এটা ঠিক যে মানুষের সুপথগামীতা ও বিপথগামীতা আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ, তবে এটাও মনে রাখা দরকার, আল্লাহ কোনো কারণ ছাড়াই মানুষকে সুপথ বা বিপথে পরিচালিত করেন না। মানুষ যখন নিজেই সুপথ বা বিপথের দিকে অগ্রসর হয়, তখন সে আল্লাহর দয়া বা ক্রোধের পাত্র হয়।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখতে হবে :

এক. নিজের ওপর জুলুম করা হলো সবচেয়ে বড় জুলুম । আল্লাহকে উপেক্ষা করা ও নিজ প্রবৃত্তির পূজার কারণে মানুষ নিজের আত্মার ওপর জুলুম করে।

দুই.আল্লাহর প্রতি আমাদের বিশ্বাস বা অবিশ্বাসে আল্লাহর কোনো লাভ বা ক্ষতি নেই। মহান আল্লাহ কোনো কিছুরই মুখাপেক্ষী নন, কিন্তু অন্য সব সৃষ্টিই আল্লাহর মুখাপেক্ষী।

তিন.  শুধু জ্ঞান বা বিশ্বাস মানুষকে মুক্তি দিতে সক্ষম নয়, মুক্তির জন্যে বিশ্বাস ও জ্ঞান অনুযায়ী কাজও করা দরকার । আল্লাহর রহমত ও সুপথ লাভের জন্যে জ্ঞান ও বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করা জরুরি।

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)