আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আল আনফাল; (৪র্থ পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আল আনফাল; আয়াত ১৫-২১

সূরা আনফালের ১৫ ও ১৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

 

 يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا زَحْفًا فَلَا تُوَلُّوهُمُ الْأَدْبَارَ (15) وَمَنْ يُوَلِّهِمْ يَوْمَئِذٍ دُبُرَهُ إِلَّا مُتَحَرِّفًا لِقِتَالٍ أَوْ مُتَحَيِّزًا إِلَى فِئَةٍ فَقَدْ بَاءَ بِغَضَبٍ مِنَ اللَّهِ وَمَأْوَاهُ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ

 

“হে মুমিনগণ! তোমরা যখন কাফের বাহিনীর সম্মুখীন হবে তখন তোমরা তাদেরকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না।" (৮:১৫)

"সেদিন যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন কিংবা স্বীয় দলে স্থান নেওয়া ছাড়া কেউ তাদেরকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে তো আল্লাহর বিরাগভাজন হবে এবং তার আশ্রয় জাহান্নাম, আর সেটা কত নিকৃষ্ট।” (৮:১৬)

আগের পর্বে আমরা বদরের যুদ্ধ সম্পর্কে খানিকটা আলোচনা করেছি। এ দুই আয়াতে যুদ্ধের ময়দানের শৃঙ্খলা ও নিয়ম-নীতি মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলা হয়েছে, যুদ্ধের ময়দানে শত্রু সেনাদের আধিক্য দেখে ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া কোনো মুমিন ব্যক্তির জন্য মোটেই শোভনীয় নয়। তবে যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্র, লোকবল শক্তি বৃদ্ধির জন্য কিংবা শত্রুপক্ষকে অতর্কিত হামলা চালিয়ে পর্যুদস্ত করবার জন্য স্থান বা কৌশল পরিবর্তন করতে কোনো অসুবিধা নেই।

এই দুই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, যুদ্ধের ময়দান বা জিহাদ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া মস্তবড় গুণাহ্‌র কাজ। যুদ্ধ থেকে পলায়নকারী ব্যক্তি আল্লাহর ক্রোধ এবং অভিশাপের শিকার হতে পারে। কিন্তু যুদ্ধে শত্রুপক্ষকে নাস্তানাবুদ করার জন্য কৌশল পরিবর্তন বা পিছু হটতে কোনো অসুবিধা নেই।

সূরা আনফালের ১৭ ও ১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 

فَلَمْ تَقْتُلُوهُمْ وَلَكِنَّ اللَّهَ قَتَلَهُمْ وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ رَمَى وَلِيُبْلِيَ الْمُؤْمِنِينَ مِنْهُ بَلَاءً حَسَنًا إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ (17) ذَلِكُمْ وَأَنَّ اللَّهَ مُوهِنُ كَيْدِ الْكَافِرِينَ

 

“তোমরা তাদেরকে হত্যা করনি, আল্লাই তাদেরকে হত্যা করেছেন। আর তুমি যখন নিক্ষেপ করেছিলে তখন তুমি  নিক্ষেপ করনি বরং আল্লাহই তা নিক্ষেপ করেছিলেন এবং তা মুমিনদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তম পুরস্কার দান করবার জন্য, আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।" (৮:১৭)

"এটা তোমাদের জন্য; আল্লাহ কাফেরদের ষড়যন্ত্র দুর্বল করেন।” (৮:১৮)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে মুমিনদের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যুদ্ধে জয়লাভ করার ফলে তাদের মধ্যে যেন অহঙ্কারবোধের জন্ম না হয়, তারা যেন এটা না ভাবে যে, নিজেদের বাহুবল ও কৌশলের কারণেই তারা জয়ী হয়েছে। আর এ জন্যই এ আয়াতে ঐশী সাহায্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, আল্লাহর ইচ্ছা এবং সাহায্যের জন্যই শত্রুপক্ষ দুর্বল ও পরাজিত হয়েছে। তোমাদের অস্ত্র-শস্ত্র এবং লোকবল মোটেও যথেষ্ট ছিল না। মহান আল্লাহ তার বিশেষ অনুগ্রহে তোমাদের তীরগুলোকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যপানে পৌঁছে দিয়েছেন। আর এ ছাড়া ওই যুদ্ধক্ষেত্র ছিল মুমিনদের পরীক্ষার জন্য এক উত্তম স্থান। মহান স্রষ্টা এ যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলমান বাহিনীর ঈমানের দৃঢ়তা পরীক্ষা করেছেন, দেখেছেন কারা স্রষ্টার আনুগত্যের জন্য নিজেদের প্রাণ অবলীলায় বিলিয়ে দিতে পারেন।

এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, যুদ্ধ বা জিহাদ হচ্ছে পরীক্ষার একটি মাধ্যম। এর মাধ্যমে মুসলমানদের ঈমানের দৃঢ়তা বোঝা যায়। মানুষ নিজ ইচ্ছা বা শক্তিবলে কাজ করলেও স্রষ্টার অনুগ্রহ বা ইচ্ছা ছাড়া তা বাস্তবায়িত হতে পারে না। এ আয়াত থেকে এটাও বোঝা যায় যে, মহান আল্লাহ প্রকৃত ঈমানদারদের সহায় হন। তিনি ইচ্ছা করলে শত্রুদের সব ষড়যন্ত্র নস্যাত করে দিতে পারেন।

সূরা আনফালের ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

 

  إِنْ تَسْتَفْتِحُوا فَقَدْ جَاءَكُمُ الْفَتْحُ وَإِنْ تَنْتَهُوا فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَإِنْ تَعُودُوا نَعُدْ وَلَنْ تُغْنِيَ عَنْكُمْ فِئَتُكُمْ شَيْئًا وَلَوْ كَثُرَتْ وَأَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ

 

“তোমরা সত্যের জয় চেয়েছিলে তাতো তোমাদের কাছে এসেছে, যদি তোমরা আল্লাহর বিরুদ্ধাচারণ থেকে বিরত হও তবে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা পুণরায় তা কর তবে আমিও পুণরায় শাস্তি দেব এবং তোমাদের দল সংখ্যায় অধিক হলেও তোমাদের কোনো কাজে আসবে না এবং আল্লাহ মুমিনদের সাথে রয়েছেন।”

অনেক মুফাসসিরের মতে, বদরের যুদ্ধে শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে জয়ী হবার পর মুসলমানদের মধ্যে কেউ কেউ গণিমতের মাল বণ্টন নিয়ে বিরোধে লিপ্ত হয়। এমনকি তারা এ নিয়ে রাসূলে খোদার সঙ্গেও বাক-বিতণ্ডা করে। এ আয়াত তাদেরকে উদ্দেশ্য করেই অবতীর্ণ হয়েছে। তবে অধিকাংশ মুফাসসিরগণ মনে করেন, এই আয়াত কাফের এবং মুশরিকদের উদ্দেশ্যে নাযিল হয়েছে। এ আয়াতে বলা হয়েছে, যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ী করার মাধ্যমে মহান আল্লাহ সত্যকে উদ্ভাসিত করেছেন। এ ছাড়া, আল্লাহর রাসূলের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হওয়া কিংবা তার নির্দেশ অমান্য করা কোনভাবেই সমীচিন নয়। এতে মহান আল্লাহর অভিশাপ বা গজব নেমে আসতে পারে। কোনো ব্যক্তি বা কোনো শক্তিই আল্লাহর শাস্তি থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারবে না। এ আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মেনে চলার মাধ্যমেই মানুষের প্রকৃত কল্যাণ ও সৌভাগ্য নিশ্চিত হতে পারে। এ ছাড়া, খোদার অনুগ্রহ লাভের জন্য দৃঢ় ঈমান ও আনুগত্যের প্রয়োজন।

সূরা আনফালের ২০ ও ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَوَلَّوْا عَنْهُ وَأَنْتُمْ تَسْمَعُونَ (20) وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ قَالُوا سَمِعْنَا وَهُمْ لَا يَسْمَعُونَ

 

“হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমরা যখন তার কথা শ্রবণ করছ  তখন তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না।" (৮:২০)

"এবং তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা বলে শ্রবন করলাম কিন্তু তারা শ্রবন করে না।” (৮:২১)

এ আয়াতে মুমিনদেরকে আল্লাহ ও তার রাসূলের পূর্ণ আনুগত্যের আহ্বান জানিয়ে বলা হচ্ছে, তোমরা আল্লাহর নবীর কথা শুনেছো এবং তার প্রতি ঈমান এনেছো, কাজেই কখনও তাঁর নির্দেশের অবাধ্য হয়ো না। কারণ আল্লাহর নবীর আনুগত্য করা ঈমানের অন্যতম শর্ত। এমন অনেকেই ছিল যারা মুখে মুখে বলতো যে আমরা রাসূলের বাণী শুনেছি এবং তা মেনে নিয়েছি কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তারা রাসূলের নির্দেশ মেনে চলতো না।

এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, মুমিনদের জন্য আল্লাহর নির্দেশের অবাধ্য হওয়ার  আশঙ্কা থেকে যায়। কাজেই তাদের জন্যও সতর্কবাণীর প্রয়োজন রয়েছে। এ ছাড়া, সত্যকে জানার পর তা মেনে চলা উচিত। ঈমান কেবল মুখের দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং কাজের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত করতে হবে।

 

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)