আল হাসানাইন (আ.)

রাজনৈতিক অর্থনীতির ইসলামী দৃশ্যপট : শহীদ বাকের আস্-সাদরের অভিমত

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

(অত্র প্রবন্ধটি অধ্যাপক টি. এম. আযীয লিখিত গ্রন্থ “The Islamic Political Theory of Muhammad Baqir al-Sadr of Iraq" এর অংশ বিশেষ।)

পূর্ব ইউরোপ ও তার হৃৎপিণ্ডস্বরূপ বিবেচিত সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিজমের বিপর্যয় এবং সেই সাথে রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির সাথে সাথে গোটা বিশ্ব পুনরায় পুঁজিবাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে এবং সর্বত্র পুঁজিবাদী নীতি অনুসৃত হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্ব-অর্থনীতি অ্যাডাম স্মিথের তত্ত্ব অনুযায়ী রূপ পরিগ্রহ করেছে। বাজারে ‘বাজার-নীতি’-কে স্বীয় ভূমিকা পালন করতে দেয়া ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য অন্য কোন বিকল্পের কথা মোটেই বিবেচনা করা হচ্ছে না। জাতিসমূহ ও ব্যক্তি মানুষদের জীবনে ভাগ্য নির্ধারণী ও সিদ্ধান্তকর উপাদান হিসেবে বাজার-এর ‘অদৃশ্য হাত’-এর ভূমিকা বর্তমানে অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় অধিকতর দৃশ্যমান। ফলত সমাজের সদস্যদের ব্যক্তিগত স্বার্থই হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থনীতির চালিকা শক্তি এবং চাহিদা ও সরবরাহের বিধি সমাজে মুনাফালোভীদের কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে;এমন কি ইতোপূর্বে যেসব দেশ মার্ক্সবাদী বলয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল সেসব দেশের অর্থনীতিবিদগণ নিজ নিজ দেশের অর্থনীতির দুরবস্থা দূরীকরণের জন্যে এ ধরনের অর্থনৈতিক আচরণকে একমাত্র বিকল্প হিসেবে মেনে নিয়েছেন।

অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মনে করেন,উপরোক্ত ধারণা মোটেই সঠিক নয়। তাঁদের মতে অপূর্ণ মানুষের গড়া রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও নৈতিক মূল্যবোধসমূহ দ্বারা সৃষ্ট সমস্যাবলী মোকাবিলার জন্যে ইসলাম মানব জাতির সামনে সঠিক পথনির্দেশ ও সুষ্ঠু সমাধান পেশ করেছে। ইসলাম হচ্ছে আল্লাহ্ তা’য়ালার পক্ষ থেকে প্রদত্ত এমন একটি সমাজব্যবস্থা যা শারীরিক ও আত্মিক নির্বিশেষে জীবনের সকল ক্ষেত্রে মানুষকে শান্তির দিকে পথনির্দেশ করে। ইরাকের শহীদ আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ বাকের সাদর (রহঃ) ছিলেন এ ধরনেরই একজন ইসলামী চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।

শহীদ বাকের সাদর ইরাকের স্বৈরাচারী সমাজতান্ত্রিক বাথ পার্টি সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৮০ সালে এক বৈপ্লবিক আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং তাতে নেতৃত্ব দেন। এ কারণে বাথ দলীয় সরকার তাঁকে হত্যা করে।

শহীদ বাকের সাদর (রহঃ) সমকালীন মুসলিম বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চরম দুর্নীতিদুষ্ট ও বিকৃত রাষ্ট্রব্যবস্থা বলে মনে করতেন। তিনি এ রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে একটি ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা পেশ করেন। তিনি মুসলিম বিশ্বে তৎকালে বিরাজমান পুঁজিবাদী ও সমাজবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি নতুন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার রূপরেখা উপস্থাপন করেন। অত্র প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলনীতিসমূহ সম্বন্ধে শহীদ বাকের সাদরের মতামতের ওপর আলোকপাত করা।

শহীদ বাকের সাদর মনে করেন,পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় যেসব স্ববিরোধিতা রয়েছে তার সমাধানে ইসলামী অর্থব্যবস্থাই সক্ষম এবং একই কারণে মানবিক প্রয়োজন পূরণে অধিকতর সক্ষম। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে,ইসলামী অর্থব্যবস্থা মানবীয় সম্ভাবনার সাথে তাল মিলিয়ে উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারে।

শহীদ আয়াতুল্লাহ্ বাকের সাদর ছিলেন একজন মুজতাহিদ। এ কারণে তিনি ইসলামী আকায়েদ ও দীনি তথ্যসমূহ (কোরআন ও হাদীস) থেকে তাঁর যুক্তিতর্কের ভিত্তি নিষ্পন্ন করেন। এখানে আমরা তাঁর তাত্ত্বিক যুক্তিতর্কসমূহ ও সমাজের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি সংক্রান্ত মতামত উপস্থাপন করব এবং দেখব,তাঁর এ মতামত ও কর্মসূচী বাস্তবে কতখানি গ্রহণ ও বাস্তবায়নযোগ্য। আমরা এখানে তাঁর যুক্তিসমূহ তুলে ধরব এবং ইসলামী অর্থব্যবস্থার কাঠামোকে বোঝার চেষ্টা করব।

শহীদ বাকের সাদরের অর্থনৈতিক মতামত মূলত তাঁর সাধারণ রাজনৈতিক তত্ত্বেরই একটি অংশমাত্র। তাঁর এ রাজনৈতিক তত্ত্বের লক্ষ্য হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করা। তাই মূলতঃ ইসলামী অর্থব্যবস্থার আচরণকে কেবল একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরেই বিচার করা সম্ভব যেখানে মানুষের পুরো আর্থ-সামাজিক আচরণই ইসলাম অনুযায়ী নির্ধারিত হয়ে থাকে।

শহীদ আয়াতুল্লাহ্ বাকের সাদর (রহঃ) অর্থনীতি সম্পর্কে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি রচনা করেন ১৯৬০-৬১ সালে। এ গ্রন্থটির নাম اقتصادنا (আমাদের অর্থনীতি),যদিও তিনি পরবর্তীকালে এ বিষয়ে কিছু ছোট ছোট পুস্তিকাও রচনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অর্থনৈতিক চিন্তার মূল যুক্তিতর্কগুলো এই ‘ইকতিসাদুনা’ গ্রন্থেই সন্নিবেশিত হয়েছে।

শহীদ সাদরের মতে ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনীতি ব্যক্তি হিসেবে জনগণ ও শাসকের মধ্যে বিভক্ত। এক্ষেত্রে ব্যক্তি হচ্ছেন আল্লাহর খলীফা (প্রতিনিধি) এবং শাসক হচ্ছেন পর্যবেক্ষক (শাহেদ) যিনি আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পরিচালনা ও তার দেখাশোনা করেন। সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্রে দু’ধরনের সম্পদ থাকে : ব্যক্তিগত সম্পদ ও সরকারী সম্পদ।

অবশ্য এ থেকে মনে করা উচিত হবে না যে,ইসলামী অর্থনীতিতে হয়ত পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের সমন্বয় ঘটেছে। শহীদ বাকের সাদর এরূপ ভ্রান্ত ধারণাকে জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেন,ইসলামী অর্থনীতিতে ব্যক্তিমালিকানা ও রাষ্ট্রীয় মালিকানার পাশাপাশি অবস্থানের ধারণাটি ইসলামের মৌলিক আকায়েদ থেকে উৎসারিত হয়েছে। স্বীয় আদর্শিক ও দার্শনিক চিন্তা-বিশ্বাসের ভিত্তিতে পুঁজিবাদীরা যেভাবে ব্যক্তিমালিকানার পক্ষে ও সমাজবাদীরা রাষ্ট্রীয় মালিকানার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন,ঠিক একইভাবে শহীদ সাদর ইসলামী অর্থনীতিতে দুই ধরনের মালিকানার সহাবস্থানের সপক্ষে ইসলামের আদর্শিক ও তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।

বস্তুত ইসলামে যে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় উভয় ধরনের মালিকানা আছে তা প্রমাণ করতে হলে ইসলাম ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের জন্যে যে অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছে অবশ্যই সে সম্পর্কে অবগত হতে হবে। শহীদ বাকের সাদর ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও এর অর্থনৈতিক কাঠামোর বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন-যা ইসলামী অর্থনীতির ধারণার সপক্ষে সর্বোত্তম যুক্তি তুলে ধরে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক

শহীদ বাকের সাদরের (রহঃ) মতে মানুষের সমস্ত আচরণকে তিন ধরনের সম্পর্কে বিন্যস্ত করা যায়: সামাজিক,অর্থনৈতিক ও ধর্মীয়। তার সকল আচরণের উৎস হচ্ছে অন্য মানুষ,পারিপার্শ্বিকতা ও আল্লাহ্ তা’য়ালার সাথে তার মৌলিক সম্পর্ক। অবশ্য তার অর্থনৈতিক সম্পর্ক তার নিজের মধ্যকার আত্মপ্রীতির সহজাত প্রবণতারই ফলশ্রুতি। তার এ আত্মপ্রীতিই তাকে “সব সময় নিজের জন্য উত্তম জিনিসগুলো পেতে,স্বীয় স্বার্থ নিশ্চিত করতে ও স্বীয় প্রয়োজন পূরণ করতে উৎসাহিত করে।” এ কারণেই ধরে নেয়া হয়েছিল,মানুষ তার পারিপার্শ্বিকতার সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বীয় প্রয়োজন পূরণ ও আনন্দ বর্ধনের লক্ষ্যে সম্ভাব্য সকল সমাজসূত্রকে ব্যবহার করত। যথাসময়ে সে পারিপার্শ্বিকতার বিরুদ্ধে তার সংগ্রামে প্রাণীকুল ও উদ্ভিদের সাহায্য গ্রহণ করতে মনস্থ করে। যদিও ইতিহাসের প্রথম যুগে তার অপরিহার্য প্রয়োজন ছিল অত্যন্ত সাদামাটা,কিন্তু তা সত্ত্বেও তার মানসিক ক্ষমতা তাকে নতুন নতুন কলাকৌশল ও উপায়-উপকরণ উদ্ভাবনে উদ্বুদ্ধ করে;এগুলো প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে তাকে সাহায্য করে। এভাবে পারিপার্শ্বিকতায় নিহিত সম্পদসূত্রসমূহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে উদ্ভূত জটিলতার কারণে তার প্রয়োজন সর্বদা বেড়েই চলেছে।

অন্যদের সাথে মানুষের এ ধরনের সম্পর্ক ছিল তার কামনা-বাসনা পূরণে প্রয়োজনের স্বাভাবিক ফলশ্রুতি। পারিপার্শ্বিকতার সাথে সম্পর্ক থেকে উৎসারিত মানব জীবনের জটিলতা তার জন্যে স্বীয় প্রয়োজনের সাথে পুরোপুরি তাল মিলিয়ে চলার কাজকে কঠিন করে তোলে। অন্যদের সাথে সহযোগিতাই কেবল তার প্রয়োজনসমূহ পূরণের প্রচেষ্টাকে ফলপ্রসূ করে তোলে। অন্যদের সাথে সহযোগিতার ফলে সমাজের অন্য সদস্যদের সাথে সুবিধাদি ভাগ করে নিয়ে ভোগ করার পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়। বস্তুত মানুষের ভেতরে নিহিত আত্মপ্রীতির সহজাত প্রবণতা যে তাকে প্রথম সমাজ গঠনে উদ্বুদ্ধ করেছিল তা অত্যন্ত স্পষ্ট ব্যাপার। আর এই প্রবণতা থেকেই মানুষ তার ভাইকেও শোষণ করতে অগ্রসর হয়।

যেহেতু বিভিন্ন মানুষের শারীরিক ক্ষমতা ও মানসিক যোগ্যতা অভিন্ন ছিল না,সেহেতু পারিপার্শ্বিকতা থেকে প্রাপ্ত সম্পদসূত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে তারা একই ধরনের সাফল্যের পরিচয় দিতে পারেনি। বস্তুত শক্তি ও ক্ষমতার এ পার্থক্য হচ্ছে একটি ঐশী পরিকল্পনা যার উদ্দেশ্য হচ্ছে কর্মবিভাজনের মাধ্যমে মানুষকে সমষ্টি বা সমাজের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকতে বাধ্য করা। এভাবেই সমাজব্যবস্থার আওতায় বিভিন্ন ধরনের ক্ষমতা ও যোগ্যতার অধিকারী লোকেরা বিভিন্ন ধরনের কাজকর্মে মশগুল থাকে।

অবশ্য মানুষের মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রায় স্বীয় স্বার্থ হাসিল করার যে কামনা নিহিত রয়েছে তার ফলে মানুষ পরিস্থিতিকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগাবার চেষ্টা করে। সেই সাথে মানুষের মানসিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের কারণে তার প্রয়োজনসমূহও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তার ক্রমবর্ধমান অভিজ্ঞতা তার মাঝে পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত সম্পদসূত্র ব্যবহারে তার সক্ষমতাও সম্প্রসারিত করে। একই সাথে অধিক পরিমাণে পারিপার্শ্বিক সম্পদসূত্রকে নিজের স্বার্থে করায়ত্ত করার কামনা প্রবলতর হয়ে ওঠে। ফলত কতক মানুষ স্বীয় লোভ চরিতার্থ করা ও অহংবোধকে পরিতৃপ্ত করার লক্ষ্যে (উভয়টিই আত্মপ্রীতির ফসল) অন্যদের ওপর জুলুম করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এভাবেই মানব সমাজ অর্থনৈতিক শোষণরূপ জুলুমের মুখোমুখি হয়।

মানব জাতির ইতিহাস জুড়েই সামাজিক শান্তি ও সর্বোচ্চ মাত্রায় স্বার্থ হাসিলের ব্যক্তিগত প্রবণতার মধ্যে সংঘাত চলে এসেছে। শহীদ আয়াতুল্লাহ্ বাকের সাদরের মতে এই ঐতিহাসিক সংঘাত দু’টি শ্রেণীর মধ্যে সংঘটিত হয়ে এসেছে। একটি শ্রেণী সেই সব ব্যক্তির সমন্বয়ে গড়া যারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক নির্বিশেষে পারিপার্শ্বিক সম্পদসমূহ নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বীয় স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করে এবং অপর শ্রেণীতে রয়েছে সমাজের অন্য মানুষ যারা শান্তিতে ও পারস্পরিক সহযোগিতা সহকারে বেঁচে থাকার জন্য চেষ্টা করে।

এ পর্যায়ে এসে মার্ক্সবাদীরা মনে করে,গুটিকয় লোক কর্তৃক অর্থনৈতিক সম্পদসূত্র নিয়ন্ত্রণ থেকেই এ সমস্যার উদ্ভব হয়েছে এবং সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হচ্ছে মজলুম শ্রেণীর বিপ্লবের মাধ্যমে সুবিধাভোগী শ্রেণীর বিশেষ স্বার্থের ধ্বংস সাধন। অন্যদিকে পুঁজিবাদে বিশ্বাসীরা মনে করে,এ ধরনের সামাজিক সংঘাতের কারণ হচ্ছে মানুষের প্রয়োজন পূরণের জন্য অপ্রতুল সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ। অতএব,সামাজিক সংঘাত সব সময়ই চলতে থাকবে। কেবল ক্রমবর্ধমান ও পর্যায়ক্রমিক সংস্কারের মাধ্যমেই সামাজিক সংঘাতকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। তাহলেই সামাজিক সংঘাত মানব জাতির অগ্রগতিকে ব্যাহত করতে পারবে না। এ ধারণার ভিত্তিতে পুঁজিবাদে বিশ্বাসীরা যে কোন ধরনের সামাজিক বিপ্লবের বিরোধিতা করে। কিন্তু ইসলাম মার্ক্সবাদী ও পুঁজিবাদী উভয় ধারণার সাথে ভিন্নমত পোষণ করে। ইসলাম পারিপার্শ্বিকতায় বিদ্যমান সম্পদসমূহকে সকল মানুষের প্রয়োজন পূরণের জন্য যথেষ্ট গণ্য করে।

আয়াতুল্লাহ্ বাকের সাদরের মতে এখানে মূল সমস্যা হচ্ছে মানব প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ। মানুষের আত্মপ্রীতির সহজাত প্রবণতাকে যথাযথ পন্থায় নিয়ন্ত্রিত করে পরিচালিত করতে হবে। মানুষের কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণ ও অন্যদের শোষণের আশঙ্কা রোধের লক্ষ্যে একটি কার্যকর সমাধান ব্যতিরেকে সমাজব্যবস্থা ও সামাজিক শৃঙ্খলা অত্যন্ত নড়বড়ে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য।

শহীদ বাকের সাদর সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন,সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যাবলীর উৎস হচ্ছে মানুষের ভ্রান্ত ও অন্যায় আচরণ। তিনি সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যাবলীর পেছনে সুনির্দিষ্টভাবে দু’টি কারণ উল্লেখ করেন : (১) আত্মপ্রীতি থেকে উদ্ভূত মানুষের জুলুম শোষণমূলক চরিত্র এবং (২) অর্থনৈতিক সম্পদসমূহের ব্যবহারে মানুষের অদক্ষতা।

শহীদ সাদরের ব্যাখ্যা অনুযায়ী অর্থনৈতিক অঙ্গনে মানুষের জুলুম-শোষণমূলক চরিত্র থেকে উদ্ভূত কুফলসমূহ অর্থনৈতিক সম্পদসমূহের অসম বণ্টন ও এসব সম্পদের অদক্ষ ব্যবহারের আকারে অব্যাহত থাকে। আর এই শেষোক্ত উপাদানটির পরিণতি হচ্ছে অর্থনৈতিক সম্পদসমূহের অনুন্নয়ন ও অপচয়। তাই মানুষের অর্থনৈতিক আচরণের এ দু’টি প্রধান ও মৌলিক নেতিবাচক অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে একটি সমাধান অপরিহার্য। শহীদ সাদর এ সমস্যার ইসলামী সমাধান নির্দেশ করেন,যার তিনটি অংশ রয়েছে : (১) অর্থনৈতিক সম্পদসূত্রের অন্যায় ও বৈষম্যমূলক বণ্টন আকারে প্রকাশিত বিভিন্ন ধরনের জুলুম-শোষণের অবসান ঘটানো (২) মানব প্রকৃতিকে এমনভাবে সুশৃঙ্খলিতকরণ যাতে মানুষ স্বীয় প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং (৩) সমগ্র মানব জাতির প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক সম্পদসমূহের সদ্ব্যবহার করা।

ইসলামী বণ্টননীতি

সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোতে নিহিত স্ব-বিরোধিতা অবসানের প্রথম পদক্ষেপ শুরু হবে জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পদসমূহ বণ্টনের মধ্য দিয়ে। বস্তুত সেই সমাজব্যবস্থাই ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা যা সকল মানুষকে অর্থনৈতিক সম্পদ থেকে লাভবান হবার সুযোগ দেয়। অতএব,বলা বাহুল্য,ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এ নীতির ওপরই ভিত্তিশীল।

বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সম্পদের মধ্যে প্রথম প্রকার অর্থনৈতিক সম্পদ হচ্ছে পারিপার্শ্বিকতায় বিদ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদ। এই প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানার সমস্যা থেকেই অর্থনৈতিক সম্পদের অন্যায় ও বৈষম্যমূলক বণ্টন শুরু হয়। তাই এটি জানা অপরিহার্য যে,ইসলামের দৃষ্টিতে এই সব সম্পদের মালিকানার অধিকার কার? এ প্রেক্ষিতে শহীদ সাদর প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের তত্ত্বকে দু’টি পর্যায়ের ওপর ভিত্তিশীল করেছেন। তা হচ্ছে উৎপাদনপূর্ব স্তর ও উৎপাদনোত্তর স্তর,অন্য কথায় যাকে আমরা প্রাথমিক পর্যায়ের সম্পদ ও দ্বিতীয় পর্যায়ের সম্পদ নামে অভিহিত করতে পারি।

শহীদ বাকের সাদর সম্পদের মালিকানা সংক্রান্ত ইসলামী শিক্ষার তাত্ত্বিক ভিত্তি উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেন। তাঁর দৃষ্টিতে এ পর্যায়ে সামাজিক সুবিচার প্রশ্নে পরীক্ষামূলক বা ফলিত অর্থে অর্থনৈতিক তত্ত্বের গবেষণা একটি অপ্রাসঙ্গিক বিষয়। অন্য কথায় তিনি এ সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে একটি আদর্শিক তত্ত্ব পেশ করেছেন। অর্থনীতির পরীক্ষামূলক বা ফলিত গবেষণা আসবে আরো পরে। এ গবেষণার লক্ষ্য হবে এ ব্যাপারে উপসংহারে উপনীত হওয়া যে,এই আদর্শিক তত্ত্বটির বাস্তব প্রয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট সমাজ জীবনে যথাযথ ভিত্তি রয়েছে কিনা।

প্রাকৃতিক সম্পদের বণ্টন

শহীদ বাকের সাদর (রহঃ) কাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে অর্থনৈতিক সম্পদের আওতার প্রশ্নে রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদদের সাথে ভিন্নমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি পুঁজি ও শ্রমকে অথনৈতিক সম্পদসূত্রের অংশরূপে গণ্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তাঁর মতে প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের তত্ত্বে কেবল প্রকৃতিকেই বিবেচনা করা যেতে পারে। “কারণ প্রকৃতপক্ষে পুঁজি হচ্ছে একটি উৎপাদিত সম্পদ,উৎপাদনের প্রাথমিক উৎস নয়। কারণ অর্থনৈতিকভাবে (ধরে নিলে) পুঁজি শ্রমের দ্বারা উৎপাদিত হয়েছে এমন কোন সম্পদের প্রতিনিধিত্ব করে যা নতুন সম্পদ উৎপাদনের জন্য পুনর্বিনিয়োগ করা সম্ভব।”

অন্যদিকে প্রকৃতি স্বয়ং চার ভাগে বিভক্ত : (১) ভূমি (২) কাঁচামাল (৩) পানি ও (৪) বাতাস,পানি ও ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল প্রজাতিসমূহসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ। যদিও দৃশ্যত এর প্রতিটির জন্য ইসলামের ভিন্ন ভিন্ন বিধান রয়েছে,কিন্তু শহীদ সাদর তাঁর বিরল উদ্ভাবনী ক্ষমতার সাহায্যে এগুলোর মধ্যকার একটি সাধারণ বা অভিন্ন ভিত্তি উদ্ঘাটনে সক্ষম হয়েছেন। তিনি একে “ইসলামের সাধারণ অর্থনৈতিক তত্ত্ব” নামকরণ করে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পেশ করেছেন।

শহীদ সাদরের মতে ভূমি ও কাঁচামালসমূহের একচ্ছত্র মালিকানা ইসলামী হুকুমতের। মানুষ তাদের শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমে,যেমন : চাষাবাদ,খনিজ দব্য আহরণ ও উত্তোলনের মাধ্যমে মালিকানার বিশেষ অধিকার অর্জন করতে পারে। একখণ্ড জমিতে বা একটি খনিতে যারা কাজ করে তারা সেখানে অন্যদের তুলনায় অগ্রাধিকার লাভ করতে পারে। কেবল জমি বা কাঁচামালের উন্নয়নে শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমেই বিশেষ মালিকানা অধিকার লাভ করা যেতে পারে এবং উক্ত উন্নয়নের অবসান ঘটার সাথে সাথেই এ ধরনের মালিকানার অবসান ঘটবে। যেসব লোক এসব সম্পদসূত্র ব্যবহার করবে তারা তা ব্যবহার করার বিনিময়ে অবশ্যই ইসলামী হুকুমতকে কর দিতে বাধ্য থাকবে।

অন্যদিকে কোন লোক তখনই পানির মালিকানা লাভ করবে যখন সে তা অথনৈতিক উন্নয়নের জন্য অধিকার করবে। যদিও প্রাকৃতিক পানিসম্পদের একচ্ছত্র মালিকানা রাষ্ট্রের,তথাপি লোকেরা নিজেদের কাজে তা ব্যবহার করতে পারবে। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি। যে ব্যক্তি স্বীয় শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানিকে ব্যবহারোপযোগী তথা উত্তোলনের ব্যবস্থা করবে তা ব্যবহার করা ও তা থেকে উপকৃত হবার অধিকার তারই।১০

অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ,যেমন : পাখি,পশু,উদ্ভিদ,জলজ প্রাণী ইত্যাদি হচ্ছে সর্বসাধারণের সম্পদ। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমে এ ধরনের সম্পদ ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হতে পারে।১১ অতএব,রাষ্ট্র নয়,জনগণই তাদের শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমে সম্পদের বিশেষ মালিকানার অধিকার অর্জন করতে পারে। তারা হয় তাদের এ অধিকার অনির্দিষ্ট কালেও হারাবে না,নয়ত তাদের মালিকানার জন্য কর দিতে বাধ্য থাকবে।

এ দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে শহীদ বাকের সাদর এ উপসংহারে উপনীত হন,স্বয়ং জনসাধারণ বা আরো স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে,তাদের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারই হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদের একচ্ছত্র ও বৈধ মালিক। ব্যক্তি কেবল এসব সম্পদের উন্নয়নের কাজে স্বীয় শ্রম বিনিয়োগের বিনিময়ে এ থেকে বিশেষ সুবিধা লাভ করতে পারে। অন্য ধরনের ব্যক্তিগত শ্রম,যেমন কোন প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করার জন্য শক্তি প্রয়োগকে মালিকানা অর্জনের বৈধ পন্থা বলে বিবেচনা করা হয় না। প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা অর্জনের ক্ষেত্রে কেবল বিনিয়োগকৃত মানবিক শ্রমই গুরুত্ব বহন করে।

সামগ্রিকভাবে বলা যেতে পারে,ইসলামের দৃষ্টিতে কেবল সমগ্র সমাজকে লাভবান করার জন্য এসব সম্পদের উন্নয়নের কাজে অব্যাহত শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমেই কেউ ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার লাভ করতে পারে। তাই এসব প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়নে ব্যক্তিগত শ্রম বিনিয়োগ স্থগিত হয়ে গেলে ঐ সম্পদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটবে।১২ এ থেকে শহীদ সাদর তাঁর তত্ত্বের প্রথম মূলনীতিটি এভাবে নিষ্পন্ন করেন :

“সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদই রাষ্ট্রীয় খাতের অংশ এবং ব্যক্তি কেবল একটি কারণে তা ব্যবহারের বিশেষ অধিকার লাভ করে,তা হচ্ছে : প্রত্যক্ষভাবে (ব্যক্তি স্বয়ং) কাজ করার মাধ্যমে (এসব সম্পদের) উন্নয়নে বিনিয়োগকৃত শ্রম।”১৩

এ মূলনীতি অনুযায়ী কোন ব্যক্তি কোন প্রাকৃতিক সম্পদের,উদাহরণস্বরূপ,একটি বড় জমির মালিকানা হাসিলের লক্ষ্যে ঐ সম্পদের উন্নয়নের জন্য অন্য ব্যক্তিদেরকে কাজে লাগাতে পারবে না। এভাবে অন্যদেরকে কাজে লাগালে তারাও ঐ সম্পদের মালিকানায় অংশীদার হবে এবং তাদের শ্রমের কারণে তারা ঐ সম্পদ থেকে সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে। অন্যদের শ্রম দ্বারা প্রাকৃতিক সম্পদের উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে যে কোন ব্যক্তি বিরাটাকারে বা বিপুল পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা হাসিল করতে পারবে বলে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে যে মূলনীতি গ্রহণ করা হয়েছে ইসলাম তাকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। একই কারণে তেল ও খনিজ সম্পদের ন্যায় প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় শিল্পকারখানা রাষ্ট্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হতে পারে। শহীদ বাকের সাদর প্রাকৃতিক সম্পদসমূহের রাষ্ট্রীয় মালিকানার ওপর গুরুত্ব আরোপ করার পাশাপাশি ব্যক্তিদের জন্য প্রাকৃতিক অর্থনৈতিক সম্পদসমূহের ওপর “ব্যবহারের অগ্রাধিকার”-এর তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। শহীদ বাকের সাদর বলেন,যেসব লোক শ্রম দানের ক্ষমতা রাখে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করতে আগ্রহী,তাদের দ্বারা উক্ত সম্পদ ব্যবহারের ফলে যদি জনস্বার্থ রক্ষিত হয় তাহলে তাদের এসব সম্পদ করায়ত্ত করার অধিকার থাকবে।

উৎপাদিত সম্পদের বণ্টন

শহীদ বাকের সাদর (রহঃ) উৎপাদিত সম্পদের বণ্টন সম্পর্কেও নীতি উদ্ভাবন করেছেন। উৎপাদিত সম্পদকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে : (১) প্রাথমিক পর্যায়ের দ্রব্যাদি,যেমন : কৃষিজাত দ্রব্য ও কাঁচামাল এবং (২) দ্বিতীয় পর্যায়ের দ্রব্যাদি যা আসলে প্রাথমিক পর্যায়ের দ্রব্যাদিরই পরিবর্তিত রূপ অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায়ের দ্রব্যাদি ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের কারখানাজাত যে পণ্য উৎপাদন করা হয়েছে। এ হচ্ছে উন্নততর অর্থনৈতিক তৎপরতার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়। উভয় পর্যায়ের উৎপাদনে পূর্ববর্তী অর্থনৈতিক শ্রম-সাধনা থেকে উৎপাদিত পুঁজি এবং সেই সাথে বিভিন্ন উৎপাদন-উপকরণ (সরঞ্জামাদি) উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করে। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে পুঁজি ও উৎপাদন-উপকরণকে যেমন উৎপাদিত দ্রব্যের অংশীদার মনে করা হয়,তার বিপরীতে শহীদ সাদরের বণ্টন নীতিতে পুঁজি ও যন্ত্রপাতি পণ্যে অংশীদার হয় না,অবশ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পুঁজির ব্যবহার ও যন্ত্রাপাতির যে ক্ষয় হয় সে কারণে এতদুভয়ের জন্যে বিশেষ অধিকার বিবেচনা করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী মূলনীতি সংক্রান্ত আলোচনায় যেমন উল্লেখ করা হয়েছে,ইসলাম শ্রমিককে তার উৎপাদিত পণ্যে নিরঙ্কুশ অধিকার দিয়েছে। অবশ্য শহীদ সাদর এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি রেখেছেন,প্রাথমিক পণ্য উৎপাদনে মানুষের শ্রম হচ্ছে অন্যতম উৎপাদন-উপাদানমাত্র। অন্য উপাদানগুলো হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং উৎপাদন কার্যে মানুষকে সাহায্যকারী যন্ত্রপাতি। শহীদ সাদরের মতে যন্ত্রপাতি বা উৎপাদন-উপকরণ হচ্ছে “পূর্ববর্তী উৎপাদন-পর্যায়সমূহের সঞ্চিত কাজ যা উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় ব্যবহারের ফলে ক্ষয় বা নিঃশেষ হয়ে যাবে।”১৪ এক্ষেত্রে উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এসব যন্ত্রপাতি থেকে সুবিধা গ্রহণকারী শ্রমিক নিজেই যদি এসবের মালিক না হয়ে থাকে তাহলে এসব যন্ত্রপাতি অর্থাৎ এতে সঞ্চিত কাজকে ব্যবহারের জন্য অবশ্যই এসবের মালিককে বিনিময় দিতে হবে।১৫

শহীদ বাকের সাদরের মতে এখানেই পুঁজিবাদ ও ইসলামের অন্যতম নীতিগত পার্থক্য নিহিত রয়েছে। পুঁজিবাদ যেখানে উৎপাদন-উপকরণকে উৎপাদিত পণ্যের একচ্ছত্র মালিক মনে করে,সেখানে ইসলাম কেবল শ্রমিককেই উৎপাদিত পণ্যের বৈধ দাবীদার গণ্য করে। পুঁজিবাদে উৎপাদন কাজে ব্যবহারের বিনিময়ে শ্রমের ন্যায় যন্ত্রপাতি উৎপাদিত পণ্যে একটি অংশ লাভ করে। কারণ এক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় একটি সুনির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে যন্ত্রপাতি মানুষকে উৎপাদন কাজে সাহায্য করে মাত্র। সুতরাং যন্ত্রপাতিকে অবশ্যই ভাড়া দিয়ে তার ক্ষতিপূরণ করতে হবে,তাকে মুনাফায় অংশীদার করা যাবে না।১৬

অতএব,শ্রমিকের শ্রম ও চেষ্টা-সাধনার ফসল যে উৎপাদিত পণ্য তার একমাত্র বৈধ দাবীদার স্বয়ং শ্রমিক। শহীদ সাদরের মতে ইসলামী অর্থনীতিতে এটি ভাবাই যায় না যে,এক ব্যক্তি অন্যদেরকে কাজে নিয়োজিত করবে,তাদেরকে ভাড়া (বেতন) দেবে এবং যন্ত্রপাতি সরবরাহ করবে,অতঃপর সে একাই তাদের শ্রমলব্ধ উৎপাদিত পণ্যের মালিক হয়ে বসবে।১৭ অনুরূপভাবে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে বহু শ্রমিক নিয়োগকারী শিল্পকারখানা ও উৎপাদন-ইউনিট কেবল তখনই কাজ করতে পারে যদি তা সরকারী মালিকানাধীন হয়। শহীদ সাদরের তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে তার নিয়ন্ত্রণ ব্যতিরেকে ইসলামী অর্থব্যবস্থায় কিছুতেই পুঁজিকেন্দ্রিক শিল্প উৎপাদনের উদ্ভব সম্ভব নয়। যেহেতু রাষ্ট্রই অর্থনৈতিক সম্পদসমূহের একচ্ছত্র মালিক সেহেতু সমাজের পক্ষ থেকে রাষ্ট্র লোকদের মজুরির বিনিময়ে কাজে নিয়োগ করতে পারে এবং তাদেরকে তাদের উৎপাদিত দ্রব্যাদিতে অংশ প্রদান না করতে পারে।

এছাড়া যেহেতু সামগ্রিকভাবে সমাজই হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদের একচ্ছত্র মালিক ও সুবিধা ভোগের বৈধ অধিকারী,সেহেতু প্রাকৃতিক পরিবেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সম্পদকে কাজে লাগানো সমাজেরই দায়িত্ব। তাই সমাজ উৎপাদিত প্রাথমিক দ্রব্যসামগ্রীতে একটি অংশ লাভ করে। উৎপাদনের এ স্তরে উৎপাদিত পণ্য থেকে রাষ্ট্রের আয়কর সংগ্রহের অধিকার আছে যা সমাজ কল্যাণ ও জনগণের অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণে ব্যয় করা হবে।১৮

প্রাথমিক দ্রব্যাদি বা কাঁচামাল ব্যবহার করে যে উৎপাদনকার্য সম্পাদিত হয়-যার উৎপাদিত দ্রব্যকে দ্বিতীয় পর্যায়ের উৎপাদন (Secondary commodities) বলা যায়-ইসলাম তার উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রাথমিক দ্রব্যাদির মালিককে তাতে অংশ দাবী করার অধিকার দিয়েছে। এক্ষেত্রে তার মালিকানার বৈধতার উৎস এই নয় যে,কেউ তাকে,তার দ্রব্যকে বিভিন্ন ধরনের নতুন পণ্যে পরিণত করতে সহায়তা করেছে,বরং এ অধিকারের উৎস হচ্ছে,কোন ব্যক্তি যখন কোন কাঁচামালের মালিক হয় তখন তা ব্যবহার করে,উৎপাদিত দ্রব্যাদিতে অবশ্যই তার অধিকার থাকে। সহজ করে বলা যায়,এক্ষেত্রে শ্রমিক কেবল প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে উৎপাদিত দ্রব্যেরই মালিক হচ্ছে না,বরং উৎপাদনের দ্বিতীয় স্তরে উৎপাদিত দ্রব্যেরও মালিক হচ্ছে। অতএব,উদাহরণস্বরূপ রাষ্ট্র যদি সরকারী মালিকানাধীন কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানীর মাধ্যমে কোন বিশেষ প্রাকৃতিক সম্পদ,যেমন খনিজ দ্রব্য,উত্তোলন বা আহরণ করে তাহলে রাষ্ট্র উক্ত প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে প্রাপ্ত দ্রব্যসামগ্রী বা পণ্যের মালিক হবে। এক্ষেত্রে যেসব লোক উক্ত উৎপাদন কাজে অংশ গ্রহণ করেছে তারা তাদের শ্রমের বিনিময় লাভ করবে।

বস্তুত তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়,ইসলামী রাষ্ট্রে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণকারী শিল্পসমূহ,যেমন তেল ও খনিজ সম্পদ আহরণকারী শিল্পসমূহ,ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হতে পারে না। কারণ প্রাকৃতিক সম্পদসমূহের প্রাথমিক মালিক হচ্ছে রাষ্ট্র। এ কারণে এসব সম্পদ থেকে উৎপাদিত দ্রব্যের মালিকানার অধিকারও রাষ্ট্রের। অবশ্য এখানে একটি তত্ত্বগত ফাঁক আছে যার মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রেও পুঁজিপতি তৈরি হতে পারে এবং তারা প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে উৎপাদিত দ্রব্যাদির মালিক হতে পারে। তা হচ্ছে,বেসরকারী মালিকানাধীন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের নিকট থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ ভাড়ায় (লীজ) নিতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা উৎপাদিত দ্রব্যাদির বৈধ মালিকানা দাবী করতে পারে।

তবে এর কোন অবস্থাতেই অন্যের মালিকানাধীন উৎপাদন-উপকরণ (যন্ত্রপাতি) ব্যবহার করার কারণে মালিকানা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। উভয় ক্ষেত্রেই যন্ত্রপাতি যদি উৎপাদকের নিজের না হয় তাহলে উৎপাদন প্রক্রিয়ার যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য বিনিময় (ভাড়া) প্রদান করা হবে। একই নিয়মের আওতায় প্রাথমিক দ্রব্যাদি বা কাঁচামালের মালিক দ্বিতীয় পর্যায়ের দ্রব্যাদি উৎপাদনের জন্য অন্য লোকদেরকে ভাড়া করতে পারে। এক্ষেত্রে শ্রমিক তার শ্রমের জন্য পারিশ্রমিক পাবে। এ পারিশ্রমিকের পরিমাণ কর্মে নিয়োগের পূর্বে চুক্তির মাধ্যমে স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হতে হবে। এর ফলে উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীর ওপর শ্রমিকের কোন দাবী থাকবে না।১৯

ইসলাম ভাড়ায় খাটা শ্রমিকের জন্যে দু’টি পন্থায় পারিশ্রমিক প্রদানের বিধান দিয়েছে। প্রথম পন্থা হচ্ছে আর্থিক মজুরি। এক্ষেত্রে সে একটি কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে কি পরিমাণ কাজ করবে তার ভিত্তিতে মজুরি নির্ধারণ করা হবে। দ্বিতীয় পন্থা হচ্ছে তাকে সংশ্লিষ্ট উৎপাদনের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুনাফায় অংশীদার করা হবে। এক্ষেত্রে শ্রমিক ও প্রাথমিক দ্রব্যসামগ্রীর মালিকের মধ্যে পূর্বাহ্নে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী শ্রমিক মুনাফার একটি সুনির্দিষ্ট অংশ পাবে।

বস্তুত ইসলামে উপার্জন (নির্ধারিত প্রাপ্য) সংক্রান্ত সাধারণ নীতি হচ্ছে :

“...উপার্জনের (নির্ধারিত প্রাপ্যের) ভিত্তি হচ্ছে (উৎপাদন) প্রক্রিয়া চলাকালে প্রদত্ত শ্রম। অতএব,যে শ্রমিক শ্রম প্রদান করেছে সেই (উৎপাদন) প্রক্রিয়ার মালিকের নিকট থেকে বিনিময় পাবার অধিকারী। ...এ ধরনের অবদান ছাড়া উপার্জনের (নির্দিষ্ট প্রাপ্যের) কোনই বৈধতা নেই।”২০

এই অর্থনৈতিক নীতি অনুযায়ী পুঁজির মালিক প্রাথমিক দ্রব্যাদির মালিকের নিকট থেকে কোন সুনির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করতে পারবে না। কারণ তা হবে রিবা (সূদ);আর ইসলামে রিবাকে হারাম করা হয়েছে। আর্থিক পুঁজিকে কোনভাবেই শ্রম দান হিসেবে গণ্য করা যাবে না।২১

ইসলামে কেবল একটি ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অর্থ প্রদানের অনুমতি দেয়া হয়েছে,তা হচ্ছে শ্রম প্রদানের বিনিময়ে। এই শ্রম প্রদানের কাজ দু’ভাবে হতে পারে : উৎপাদন প্রক্রিয়ায় একজন শ্রমিক কর্তৃক সরাসরি শ্রম প্রদান অথবা উৎপাদন-উপকরণের (যন্ত্রপাতির) মাধ্যমে পরোক্ষভাবে (স্মর্তব্য,যন্ত্রপাতি হচ্ছে সঞ্চিত শ্রম)। এ উভয় ক্ষেত্রেই (শ্রমের) ক্ষয় বা বিলুপ্তি ঘটে। কিন্তু আর্থিক পুঁজির ক্ষেত্রে তা ঘটে না। তাই এক্ষেত্রে পুঁজির মালিককে প্রাথমিক দ্রব্যসামগ্রীর মালিকের সাথে লাভ-লোকসানের অংশীদার হবার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে তার উপার্জনের বৈধতার ভিত্তি হচ্ছে,সে উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু ও অব্যাহত রাখার কাজে প্রাথমিক দ্রব্যাদির মালিককে সাহায্য করেছে। সুতরাং সে মুনাফায় অংশীদার হবার মাধ্যমে পুরস্কৃত হবার অধিকার রাখে।

মানব প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ

ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রথম কাজ হচ্ছে অর্থনৈতিক সম্পর্কের আওতায় সকল প্রকার জুলুম-শোষণকে উৎখাত করা এবং অর্থনৈতিক সম্পদসমূহের বণ্টনে একটি ন্যায়ানুগ বণ্টন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।

শহীদ বাকের সাদরের মতে অন্যায়-অবিচারের উৎস সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস বা উৎপাদন উপকরণ নয়,বরং স্বয়ং মানবিক প্রকৃতিই এর উৎস। মানুষের ভেতরকার আত্মপ্রীতির প্রবণতা তাকে কেবল তার নিজের টিকে থাকার নিশ্চয়তা বিধানে প্ররোচিত করে। অবশ্য দুনিয়াতে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য এ প্রবণতা অপরিহার্য। মুনাফা হচ্ছে এই আত্মপ্রীতিরই অর্থনৈতিক বহিঃপ্রকাশ। এই মুনাফা ব্যক্তিগত বিনিয়োগ থেকেই অর্জিত হয়। মানুষের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার চালিকা শক্তি এই মুনাফা। মুনাফা ব্যক্তি-মানুষকে কঠোর পরিশ্রম করতে এবং সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উৎসাহ যোগায়।

কিন্তু এই আত্মপ্রীতি প্রবণতাকে নৈতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত ছেড়ে দেয়া হলে তা বিভিন্ন ধরনের জুলুম-শোষণ আকারে নিজেকে প্রকাশ করে। তখন মানুষ শুধু নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এমনভাবে উঠে পড়ে লাগে যে,এজন্য সে অন্যের স্বার্থকে বিনষ্ট করতেও দ্বিধাবোধ করে না। তাই মানব প্রকৃতির এই বৈশিষ্ট্যের একটি সমাধান প্রয়োজন। এর সমাধান না হলে,এমন কি ন্যায়ানুগ বণ্টন ব্যবস্থাকেও ফাঁকি দেয়ার ও অপব্যবহারের জন্য মানুষ কোন না কোন পথ খুঁজে বের করবে।

প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তি-মানুষের আত্মপ্রীতির প্রবণতা থেকেই সামাজিক বৈষম্য ও সংঘাতের উদ্ভব ঘটে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় অন্যদের ওপর অর্থনৈতিক শোষণ চালানোর মধ্য দিয়ে এর প্রকাশ ঘটে। অন্যদিকে কমিউনিস্ট ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পদের বিলোপ সাধন করা হয় বিধায় সেখানে মানুষের আত্মপ্রীতি প্রবণতা রাজনৈতিক নির্যাতন আকারে,যেমন : ক্ষমতা দখল ও টিকিয়ে রাখা এবং বিশেষ সামাজিক সুবিধা ও মর্যাদা হস্তগতকরণের সংগ্রাম আকারে আত্মপ্রকাশ করে।২২

শহীদ বাকের সাদরের মতে কেবল ধর্মই মানব প্রকৃতির এ মৌলিক ও গভীর সমস্যার একমাত্র সমাধান দিতে পারে। ধর্ম মানুষের সামনে অনেক আত্মনিয়ন্ত্রণ পন্থা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে। এসব পন্থা মানুষের প্রবণতাকে যথাযথ সামাজিক আচরণে পরিণত হবার দিকে চালিত করে। অন্য কথায় ধর্ম ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যকার সংঘাতের অবসান ঘটায়।

আত্মনিয়ন্ত্রণের এই প্রক্রিয়াসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম প্রক্রিয়া হচ্ছে একটি আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া। এ হচ্ছে এমন একটি মনস্তাত্ত্বিক শক্তি যা মানুষকে স্বীয় আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রদান করে।

মানুষ হচ্ছে আল্লাহর খলীফা। একথার মানে হচ্ছে,মানুষ এ পৃথিবীর বুকে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তা’য়ালার প্রতিনিধি। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সে মানব জাতির জন্য সৃষ্ট ধনসম্পদের ওপর আল্লাহ্ তা’য়ালার পক্ষ থেকে মনোনীত ওয়াসি বা জিম্মাদার। এ ধরনের খিলাফত বা প্রতিনিধিত্বের অনিবার্য দাবী হচ্ছে,মানুষকে তার অর্থনৈতিক কার্যকলাপের জন্য আল্লাহ্ তা’য়ালার নিকট জবাবদিহি করতে হবে। খিলাফতের তাৎপর্যের মধ্যে এও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে,মানুষ তার ব্যক্তিগত আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারকে আল্লাহ্ তা’য়ালার ইচ্ছার অনুকূলে পরিচালিত করবে।২৩

মানুষ যদি অনুচিত আচরণ করে এবং আল্লাহ্ তা’য়ালার দেয়া ধন-সম্পদের অপচয় বা অপব্যবহার করে সেজন্য তাকে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে এবং কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। একইভাবে আল্লাহ্ তা’য়ালার পছন্দের অনুসরণ তার জন্য উত্তম পুরস্কার ও আল্লাহ্ তা’য়ালার সন্তুষ্টির নিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। আল্লাহ্ এরশাদ করেন :

هُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ الْأَرْضِ وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِّيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ ۗ إِنَّ رَبَّكَ سَرِيعُ الْعِقَابِ وَإِنَّهُ لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ

“আর তিনিই (আল্লাহ্) যিনি তোমাদেরকে ধরণীর বুকে খলীফা বানিয়ে দিয়েছেন এবং তোমাদের কতককে অপর কতকের ওপর উচ্চতর অবস্থান দিয়েছেন যাতে তিনি তোমাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন সে ব্যাপারে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন। নিঃসন্দেহে তোমার রব প্রতিফল দানে অত্যন্ত দ্রূত পদক্ষেপ গ্রহণকারী এবং নিঃসন্দেহে তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান।” (সূরা আল-আনআম : ১৬৫)

অতএব,এটিই আশা করা যায় যে,আল্লাহর দেয়া সম্পদকে কিভাবে বণ্টন করতে হবে ও কিভাবে তা ব্যয়-ব্যবহার করতে হবে-সে ব্যাপারে মানুষ পথনির্দেশ লাভ করবে। এটিই হচ্ছে বর্তমান পার্থিব জগত ও পরকালীন জগতের মধ্যকার যোগসূত্র। আর এই যোগসূত্রই সামাজিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। কারণ যে কেউ অন্যদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করবে তাকে পুরস্কৃত করা হবে।

অতএব,দেখা যাচ্ছে আলোচ্য সমস্যার ধর্মীয় সমাধান কোন বস্তুগত সমাধান নয়,বরং একটি আধ্যাত্মিক সমাধান। এ সমাধান মানুষকে অন্যের খেদমত করতে এবং সামাজিক সুবিধার স্বার্থে ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়। এর মাধ্যমে অবশ্য সে একই সাথে নিজেরও খেদমত করে এবং নিজেকেও উপকৃত করে। ইসলামে আল্লাহর ভয় ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের আকাঙ্ক্ষা প্রতিযোগী,লোভী মানব প্রকৃতির স্থান দখল করে নেয়। ধর্ম যখনই এমন মানুষ গড়ে তুলতে সফল হয় যারা তাদের প্রবণতা ও কামনা-বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম,তখনই সমাজকে সংঘাত ও ব্যক্তিগত অপব্যবহার থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।

যেহেতু ইসলাম নির্ধারিত এ লক্ষ্য একটি পুরোপুরি আদর্শবাদী লক্ষ্য,যার পূর্ণ বাস্তবায়ন সকল মানুষের দ্বারা তা গ্রহণ ও অনুসরণের ওপর নির্ভরশীল-যা আশা করা অবাস্তব মনে হওয়া স্বাভাবিক। এ কারণে ইসলাম মানব সমাজে শান্তি ও সমন্বয়ের নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে একটি সামাজিক প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছে। তা হচ্ছে,আল্লাহ্ তা’য়ালা তাঁর প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব স্বয়ং ব্যক্তির ওপর অর্পণ না করে গোটা মানব জাতির ওপর অর্পণ করেছেন। গোটা সমাজ বা সম্প্রদায়ই হচ্ছে অর্থনৈতিক সম্পদের ওপর ওয়াসী বা অভিভাবক। তারা সকলে একটি সমষ্টি হিসেবে সকল প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানবিক সম্পদকে সমষ্টির স্বার্থ ও কল্যাণে কাজে লাগানোর জন্য দায়িত্বশীল। কুরআন মজিদের নিম্নোক্ত আয়াতে এ সামাজিক দায়িত্বের কথাই বলা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

وَلَا تُؤْتُوا السُّفَهَاءَ أَمْوَالَكُمُ الَّتِي جَعَلَ اللَّـهُ لَكُمْ قِيَامًا

“আল্লাহ্ তোমাদের যে ধন-সম্পদকে তোমাদের জন্য সুস্থিতির মাধ্যম বানিয়ে দিয়েছেন তোমরা তা নির্বোধদের হাতে তুলে দিও না।” (সূরা আন-নিসা : ৫)

শহীদ বাকের সাদরের ব্যাখ্যা অনুযায়ী উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ তা’য়ালা মানসিক প্রতিবন্ধী লোকদের সম্পদকে জনগণের বা সমাজের সম্পদরূপে গণ্য করেছেন। তাই নির্বোধদের ধন-সম্পদের যাতে অপব্যবহার না হয় সেজন্য গোটা সমাজকেই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পদের ওপর আরোপিত এ সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ফলে ব্যক্তি কেবল আল্লাহ্ তা’য়ালার নিকটই নয়,বরং তার সমাজের জনগণের সামনেও জবাবদিহি করতে বাধ্য।

এছাড়া ইসলাম সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখার মানসিকতাকে সমর্থন করে না। ইসলাম ব্যক্তির প্রাচুর্য ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে তার সামাজিক মর্যাদার নিদর্শনরূপে গণ্য করে না। ইসলাম চায়,ব্যক্তি-মানুষ ধন-সম্পদকে একটি দায়িত্বের বোঝা বলে গণ্য করুক। কারণ সচ্ছল ব্যক্তিদের ওপর তার নিজের ও সমাজের অন্য সদস্যদের খেদমত করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। বস্তুত এ দায়িত্ব পালন মানবতার লক্ষ্যে উপনীত হবার মাধ্যম।২৪

পুঁজিবাদী সমাজে প্রাচুর্যের অধিকারী হওয়াই জীবনের লক্ষ্যরূপে পরিগণিত হয়। ফলে মানুষ সম্ভাব্য যে কোন পন্থায় স্বীয় ধন-সম্পদ বৃদ্ধির চেষ্টা করে,এমন কি তাতে অন্যদের ক্ষতি ও স্বার্থহানি হলেও তারা স্বীয় সম্পদ বৃদ্ধি থেকে বিরত হয় না। ইসলাম এ ধরনের মানসিকতাকে সমর্থন করে না। অবশ্য মানুষ যদি ধন-সম্পদকে আল্লাহ্ তা’য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমরূপে গণ্য করে তাহলে অন্যদেরকে সাহায্য করাই সচ্ছল ও ধনী ব্যক্তিদের রীতি হয়ে দাঁড়াবে,অন্যদের ওপর জুলুম-শোষণ চালানো নয়। অন্য কথায় ইসলাম ধন-সম্পদের অধিকারী হওয়া ও ব্যক্তিগত সম্পদ সংক্রান্ত ধ্যান-ধারণা ও সামাজিক মূল্যবোধকে পরিবর্তন করতে চায়। তাই মার্ক্সবাদে যেভাবে ব্যক্তিগত সম্পদ বিলুপ্ত করার কথা বলা হয় তার কোনই প্রয়োজন নেই। শহীদ বাকের সাদরের মতে ব্যক্তিগত সম্পদ বিলুপ্ত করার সামাজিক নীতি সফল হতে পারে না। কারণ এ নীতি মানব প্রকৃতির বিরোধী,বরং সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে,সমাজ মননকে এমনভাবে পরিবর্তন ও সংস্কার করা যাতে সম্পদ আর ব্যক্তিদের জীবনের লক্ষ্য থাকবে না,বরং তা উচ্চতর নৈতিক লক্ষ্য হাসিলের সামাজিক হাতিয়ারে পরিণত হবে।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন

শহীদ আয়াতুল্লাহ্ বাকের সাদরের মতে অর্থনৈতিক সমস্যার ইসলামী সমাধানের তৃতীয় দিকটি হচ্ছে ‘উৎপাদন বৃদ্ধি ও পারিপার্শ্বিকতায় বিদ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদসমূহের পূর্ণতম ব্যবহার।’২৫

আল্লাহ্ তা’য়ালা মানুষের প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রকৃতিতে অফুরন্ত সম্পদ সৃষ্টি করেছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই মানুষকে নিজেদের প্রয়োজন পূরণ ও কল্যাণার্থে এসব নেয়ামত ব্যবহারের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। শহীদ সাদরের মতে ‘আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায়,ইসলাম অর্থনৈতিক সম্পদের উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক সম্পদের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মাত্রায় সদ্ব্যবহারকে সমাজের জন্য একটি লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে।’২৬

এ অর্থনৈতিক লক্ষ্যটি ইসলাম ও পুঁজিবাদ উভয় মতাদর্শের দ্বারাই স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। তবে এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য উভয়ের আবেদনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

“পুঁজিবাদ যেখানে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার নীতিকে বাধাগ্রস্ত করে এমন যে কোন উৎপাদন বৃদ্ধিকারী বা সম্পদ বৃদ্ধিকারী পন্থাকে প্রত্যাখ্যান করে,ইসলাম সেখানে সেই সব পন্থাকে প্রত্যাখ্যান করে যা তার (অর্থনৈতিক সম্পদসমূহের) বণ্টনত্ব ও সুবিচার নীতির সাথে সাংঘর্ষিক।”২৭

ইতোপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে,ইসলাম ব্যক্তিদেরকে সম্পূর্ণরূপে বস্তুগত লক্ষ্যের পেছনে লেগে থাকতে নিরুৎসাহিত করেছে এবং এভাবে এই অন্তর্বর্তীকালীন (পার্থিব) অস্তিত্বের সাময়িক সুবিধার গুরুত্বকে কমিয়ে দিয়েছে। শহীদ বাকের সাদর (রহঃ) অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে একটি পুণ্যবান সমাজের লক্ষ্যরূপে গণ্য করেন যদিও ব্যক্তির জন্য লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করেন না। কারণ আল্লাহ্ তা’য়ালা তো ধরণীর বুকে যা কিছু আছে তার সব কিছুকে এবং বেহেশতকেও মানুষের খেদমতের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।২৮ ইসলাম শুধু পার্থিব সুবিধা অর্জনকে মানুষের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্যরূপে গণ্য করার মানসিকতাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ তা মানুষকে অন্যদের ওপর জুলুম-শোষণ চালাতে বাধ্য করে। এর পরিবর্তে ইসলাম মানুষকে যুহদ্ (কৃচ্ছ্র সাধনা) অবলম্বনে উৎসাহিত করে। কারণ যুহদ্ হচ্ছে এমন একটি মূল্যবোধ যা মানুষকে বস্তুগত সম্পদকে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্যরূপে গণ্য না করার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করে।২৯ বস্তুত যুহদ্ হচ্ছে মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া যার সহায়তায় সে তার প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এবং তার লক্ষ্যসমূহকে আল্লাহর দিকে পরিচালিত করে। অবশ্য যুহদ্ ঈমানদার জনগণের সমাজব্যবস্থার লক্ষ্য নয়,বরং তা ব্যক্তির জন্যে কাম্য গুণ হিসেবে পরিগণিত।

এখানে এ কথাটি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে,প্রাচুর্য এবং জীবন যাত্রার উন্নত মান মানব জাতিকে আল্লাহর পথে চলতে সাহায্য করে। অভাব-অভিযোগ ও দুঃখ-কষ্ট মানব জাতির এ অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক ও প্রকৃতির সাথে তার সম্পর্কের মধ্যে একটি যোগ আছে। মানব জাতি যতই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য চেষ্টা-সাধনা করবে ততই প্রকৃতি মানুষের প্রয়োজনসমূহ পূরণ করতে থাকবে। সামাজিক সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্য মানব জাতির প্রতি আল্লাহ্ তা’য়ালার সন্তুষ্টির নিদর্শন। অন্যদিকে আল্লাহ্ তা’য়ালার প্রতি মানুষের অকৃতজ্ঞতার বাহ্যিক প্রকাশ বা উপসর্গ হচ্ছে সামাজিক অবিচার। আর এর পরিণতিতে অর্থনৈতিক সম্পদসমূহ ও উৎপাদনশীলতা ধ্বংস হয়ে যায়,সেই সাথে মানুষের সামাজিক অস্তিত্বেও বন্ধ্যত্ব সৃষ্টি হয়।৩০

ইসলাম স্বীয় দীনী বিধি-বিধানের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির সামাজিক তৎপরতার গতি বৃদ্ধি করে। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় উপার্জন কেবল কাজ করার সাথে সংশ্লিষ্ট। অন্য সকল প্রকার উপার্জন ও মালিকানাকে বিলুপ্ত করা হয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদসমূহের উন্নয়নে অব্যাহত মানবিক প্রচেষ্টা ব্যতিরেকে প্রাকৃতিক সম্পদসমূহের ওপর কারো মালিকানাকে ইসলাম বৈধতা দেয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদন উভয় ক্ষেত্রেই মানবিক শ্রম প্রদান ব্যতীত যে কোন ধরনের উপার্জনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ কারণেই উপার্জনের কাজে অর্থনৈতিক পুঁজির ব্যবহারকে বিলুপ্ত করা হয়েছে। বৈধভাবে পুঁজি ব্যবহারের একমাত্র পথ হচ্ছে লাভ-লোকসানের ঝুঁকি গ্রহণপূর্বক উৎপাদনে বিনিয়োগ করা। অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যে পুঁজির ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইসলাম অর্থ সঞ্চিত করে রাখাকে নিষিদ্ধ করেছে এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা হয়নি এমন যে কোন সম্পদের ওপর একটি বার্ষিক কর আরোপ করে এ সম্পদকে ক্রমান্বয়ে হ্রাস করার ব্যবস্থা করেছে। অধিকন্তু ইসলাম যে কোন ধরনের মূল্যহীন অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে,যেমন : জুয়া,যাদু,ভোজবাজি ইত্যাদিকে নিষিদ্ধ করেছে।৩১

এছাড়া ইসলাম মুসলমানদের জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল অঙ্গনের বিকাশ সাধন এবং পারিপার্শ্বিকতায় বিদ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ থেকে সর্বাধিক কল্যাণ লাভের জন্য তার ব্যবহারের লক্ষ্যে যে কোন কার্যকর উৎপাদন-উপকরণ উদ্ভাবন ও তা কাজে লাগানোকে জরুরী গণ্য করেছে।৩২ অন্যদিকে মুসলমানদের অর্থনৈতিক শক্তি তাদের সামরিক শক্তিরই অনুরূপ। ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতি ও সামাজিক অগ্রগতির ভিত্তিতেই তার শক্তি ও ক্ষমতাকে পরিমাপ করা হয়। এ কারণেই ইসলাম অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্রূততরকরণ ও অপচয় রোধের লক্ষ্যে সামাজিক-অর্থনৈতিক তৎপরতাকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকার ওপর বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছে।

রাষ্ট্রের ভূমিকা

ইসলামী বণ্টনতত্ত্ব সংক্রান্ত আলোচনায় যেমন উল্লেখ করা হয়েছে,প্রাকৃতিক সম্পদসমূহের মালিকানার একক অধিকার ইসলামী রাষ্ট্রের। ফলে অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতার সকল দিকের ওপরই ইসলামী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। শহীদ বাকের সাদরের মতে প্রাকৃতিক সম্পদ বা প্রাথমিক দ্রব্য-সামগ্রীর মালিকই দ্বিতীয় পর্যায়ের দ্রব্যসামগ্রীর একক মালিক। মূলত ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার সমাজে সম্পদের প্রবাহ নির্ধারণ ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট করতে পারে। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে গোটা সমাজকে উপকৃত করার উদ্দেশ্যে প্রাকৃতিক সম্পদসমূহের পূর্ণ মাত্রায় উন্নয়নের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা।

এ অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে ইসলামী রাষ্ট্র সর্বাধিক পরিমাণ উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য সামাজিক-অর্থনৈতিক সম্পদসমূহ বণ্টনের অধিকার রাখে। আর সর্বাধিক উৎপাদনের ফলে জনগণের সমৃদ্ধি অর্জিত হবে।

সমাজের ন্যূনতম অপরিহার্য প্রয়োজনসমূহ পূরণ করা এবং জনগণের অর্থনৈতিক কল্যাণ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে পুঁজিবাদী বা মার্ক্সবাদী রাষ্ট্রের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের কোন মিল নেই। কারণ পুঁজিবাদী রাষ্ট্র জনগণের প্রয়োজন পূরণ ও কল্যাণ সাধনের বিষয়টি বাজারের ওঠা-নামার ওপর ছেড়ে দেয় এবং মার্ক্সবাদী তত্ত্ব রাষ্ট্র কর্তৃক সকল প্রকার অথনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের পক্ষপাতী। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র অর্থনৈতিক তৎপরতার লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয় এবং একই সাথে সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য মানুষের ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার প্রদান করে। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা হচ্ছে অর্থনৈতিক তৎপরতার ওপর দৃষ্টি রাখা ও প্রয়োজন মাফিক নিয়ন্ত্রিত করা।

অতএব,দেখা যাচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যাপারে ইসলাম রাষ্ট্রকে অত্যন্ত উঁচু পর্যায়ের স্থিতিস্থাপক এখতিয়ার দিয়েছে। ফলে উদ্ভূত যে কোন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ইসলামী রাষ্ট্র নতুন নতুন আইন-কানুন রচনা করতে পারে। শহীদ আয়াতুল্লাহ্ বাকের সাদর (রহঃ) শরীয়তের নিষেধাজ্ঞা বা কড়াকড়িবিহীন ক্ষেত্রগুলোকে ‘মানাতেকে ফারাক’ (আইনের অবকাশ ক্ষেত্রসমূহ) নামকরণ করেছেন। এ হচ্ছে এমন সব ক্ষেত্র যেখানে মুজতাহিদ ইজতিহাদী মূলনীতির ভিত্তিতে রায় দিতে পারেন।৩৩

শহীদ বাকের সাদর আইন প্রণয়নের এ ক্ষেত্রটিকে আইনদাতা (আল্লাহ্ তা’য়ালা)-এর পক্ষ থেকে প্রদত্ত একটি বাস্তবভিত্তিক অবকাশ বলে গণ্য করেছেন। এ অবকাশের উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক তৎপরতা ও উৎপাদন উপকরণাদির বিকাশ নিশ্চিতকরণ। এ অবকাশের ফলেই ইসলামী রাষ্ট্রের নেতা জনগণের অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণ এবং অর্থনৈতিক সম্পদসমূহের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতির উপযোগী যে কোন নতুন আইন-কানুন প্রণয়ন ও কার্যকর করতে পারেন।

অন্য কথায় ইসলামী সরকার স্বীয় সামাজিক লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য অত্যন্ত ব্যাপকভিত্তিক অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে। ইসলামী সরকার চাইলে যেমন অর্থনীতির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করতে পারে,তেমনি চাইলে উন্মুক্ত উদ্যোগের সুযোগ দিতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারকে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির গতিধারা নির্ধারণের লক্ষ্যে সম্ভাব্য সর্বোত্তম বিকল্প নীতিমালা প্রণয়নের জন্য অবশ্যই অর্থনীতিবিদগণ ও বিশেষজ্ঞগণের মতামতের ওপর নির্ভর করতে হবে। অবশ্য এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে,ইসলামের মৌলিক বণ্টনতত্ত্বকে উপেক্ষা করা যাবে না।

ইসলামী রাষ্ট্রে সরকারের যে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভূমিকা রয়েছে তা থেকেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলামী সরকারের সীমাহীন ভূমিকার যথার্থতা প্রমাণিত হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র জনগণের কল্যাণের জন্য দায়িত্বশীল। ইসলামী রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক সম্পদসমূহ কেবল কাজ ও উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ীই বণ্টন করা হয় না,বরং প্রয়োজন অনুযায়ীও বণ্টন করা হয়। সমাজের সকল মানুষই কাজ করতে সক্ষম নয় এবং যারা কাজ করে তারাও আবার স্বীয় প্রয়োজন পূরণে সক্ষম নয়। শহীদ বাকের সাদর সমাজের মানুষকে তিনটি অর্থনৈতিক শ্রেণীতে বিভক্ত করেন : (১) যাদের নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদনের মানসিক বা শারীরিক ক্ষমতা রয়েছে;(২) যারা কাজ করতে সক্ষম,কিন্তু তাদের কর্মক্ষমতা কেবল স্বীয় অপরিহার্য প্রয়োজনসমূহ পূরণের জন্য যথেষ্ট এবং (৩) যাদের উৎপাদনে ব্যবহারযোগ্য মানসিক বা শারীরিক ক্ষমতা নেই। শেষোক্ত দু’শ্রেণীর প্রয়োজন পূরণ করা সরকারের দায়িত্ব। বলা বাহুল্য,‘প্রয়োজন’ বলতে কেবল জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য প্রয়োজন বোঝায় না। তাই দ্বিতীয় শ্রেণীটির প্রতিও সরকারের দায়িত্ব রয়েছে।

ইসলামী রাষ্ট্রে মানুষকে মর্যাদা সহকারে বাঁচতে হবে অর্থাৎ তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে অবশ্যই একটি গ্রহণযোগ্য সাধারণ স্তরে উন্নীত করতে হবে। তাই রাষ্ট্রের হাতে অবশ্যই সমাজকল্যাণ কর্মসূচীতে অর্থায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ থাকতে হবে। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন :

مَّا أَفَاءَ اللَّـهُ عَلَىٰ رَسُولِهِ مِنْ أَهْلِ الْقُرَىٰ فَلِلَّـهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنكُمْ ۚ

‘‘জনপদের অধিবাসীদের কাছ থেকে আল্লাহ্ তাঁর রাসূলের নিকট যা দিয়েছেন তা আল্লাহর,রাসূলের,রাসূলের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন,ইয়াতিম,মিসকিন ও পথিকদের জন্য যাতে ধন-সম্পদ কেবল তোমাদের মধ্যকার বিত্তশালীদের মাঝেই পুঞ্জীভূত না হয়।” (সূরা হাশর :৭)

আয়াতুল্লাহ্ বাকের সাদরের মতে এ আয়াতে দু’টি বিষয়ের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে সরকার ও অভাবী লোকদের মধ্যে সম্পদসমূহ বরাদ্দকরণ এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে এমনভাবে সম্পদের বণ্টন যাতে ধনীদের দ্বারা অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ প্রতিহত করা যায়।

উক্ত ব্যাখ্যার ভিত্তিতে শহীদ বাকের সাদর যুক্তি প্রদর্শন করেন,ইসলামী অর্থনীতির প্রধান মূলনীতি দু’টি : (১) উৎপাদন-উপকরণ ও বণ্টনের ওপর (জনগণের) রাষ্ট্রীয় মালিকানা এবং (২) কেন্দ্রীকৃত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। বস্তুত কেবল সমাজ কর্তৃক জাতির সকল সম্পদ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই সামাজিক নিরাপত্তার সাধারণ প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা দেয়া যায় এবং ব্যক্তির অপরিহার্য অর্থনৈতিক অধিকারও নিশ্চিত করা যায়। ফলত সর্বজনীন কল্যাণ সাধন ও বাজারের অস্থিতিশীলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ণের দায়িত্ব সরকারের। ইসলাম বিভিন্ন মানুষের আয়ের মধ্যে ব্যবধানকে স্বীকার করে,তবে সেই সাথে একটি ন্যায়ানুগ ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান সৃষ্টির চেষ্টা করে। এ ধরনের আর্থ-সামাজিক অবস্থা তৈরি করার লক্ষ্যে ইসলাম একদিকে যেমন সচ্ছল লোকদের নিকট থেকে কর আদায়ের ব্যবস্থা করে,অন্যদিকে একটি সামাজিক ও নৈতিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করে। ইসলাম অপব্যয় ও অপচয়মূলক জীবনধারাকে পুরোপুরি নিরুৎসাহিত করেছে। এছাড়া ইসলাম অর্থনৈতিক সম্পদসমূহকে সেসব দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনের দিকে চালিত করে যা সকল মানুষের প্রয়োজন পূরণ ও সামাজিক সাম্য তৈরি করে। একই লক্ষ্যে ইসলাম উৎপাদন ও ভোগ-ব্যবহারে অপচয়কে নিষিদ্ধ করেছে। এছাড়া যেসব লোক অর্থনৈতিক সম্পদের অধিকারী তাদের স্বার্থপরতা ও লোভকে অতিক্রম করার জন্য রাষ্ট্র শ্রমিকদের মজুরি ও দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারে। এইভাবে রাষ্ট্র সকল মানুষের জন্য একটি ন্যায়ানুগ জীবনমান নিশ্চিত করতে পারে।

মোদ্দাকথা,ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে সকল নাগরিকের সুখ-সমৃদ্ধি বিধান করা।

পাদটীকা ও তথ্যসূত্র

১. আয়াতুল্লাহ্ বাকের সাদর (রহঃ) : اخترنالک প্রকাশক : দারুয্ যাহরা,বৈরুত,১৯৮২, الجانب الاقتصادی من النظام الاسلامی (ইসলামী জীবন ব্যবস্থার অর্থনৈতিক দিক) শীর্ষক অধ্যায়,পৃঃ ১১২-১১৩।

২. শহীদ সাদর اخترنالک গ্রন্থের النظام الاسلامی مقارنا بالنظام الراءسمالی و المارکسی (পুঁজিবাদী ও মার্ক্সবাদী ব্যবস্থা এবং ইসলামী ব্যবস্থার মধ্যে তুলনা) শীর্ষক অধ্যায়,পৃঃ ১৬০।

৩. প্রাগুক্ত,পৃঃ ১৬১।

৪. শহীদ সাদর اقتصادنا (আমাদের অর্থনীতি,প্রকাশক : দারুত্ তা’আরুফ,বৈরুত,১৯৮২, পৃঃ ৩১১-৩১৩), Iqtisaduna (Our Economics), Translated from the Arabic, Published by World Organization for Islamic Services (1983), Tehran, Iran.

৫. দৃশ্যত এখানে সাদর টমাস রবার্ট ম্যালথাসের মতের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। যেসব পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক চিন্তাবিদ মনে করেন যে,অর্থনৈতিক সমস্যার উৎস হচ্ছে অর্থনৈতিক সম্পদের বণ্টন,তিনি তাঁদের মতকে প্রত্যাখ্যান করেন।

৬. শহীদ সাদর اخترنالک গ্রন্থের النظریة الإسلامیة لتوزیع المصادر الطبیعیة (প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টন সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি) শীর্ষক অধ্যায়,পৃঃ ১৩৬-১৩৭)।

৭. প্রাগুক্ত,পৃঃ ১৩৮।

৮. اقتصادنا,পৃঃ ৪৩৩।

৯. প্রাগুক্ত,পৃঃ ৪৮৩।

১০. প্রাগুক্ত,পৃঃ ৫১৯-৫২০।

১১. প্রাগুক্ত,পৃঃ ৫২।

১২. اخترنالک গ্রন্থের النظریة الإسلامیة لتوزیع المصادر الطبیعیة অধ্যায়,পৃষ্ঠা ১৪৮।

১৩.  الإسلام یقود الحیاةগ্রন্থের  خطط تفصیلیة عن اقتصاد المجتمع الإسلامی(ইসলামী সমাজের অর্থনীতির বিস্তারিত রূপরেখা) প্রবন্ধ,পৃঃ ৮৮।

১৪. اقتصادنا,পৃঃ ৬১৯।

১৫. প্রাগুক্ত,পৃঃ ৫৮৪।

১৬. الإسلام یقود الحیاة গ্রন্থের خطط تفصیلیة عن اقتصاد المجتمع الإسلامی প্রবন্ধ,পৃঃ ৯৭।

১৭. প্রাগুক্ত,পৃঃ ৯৯।

১৮. প্রাগুক্ত,পৃঃ ৫৬১।

১৯. اقتصادنا,পৃঃ ৬০৫।

২০. প্রাগুক্ত,পৃঃ ৬১৮।

২১. প্রাগুক্ত,পৃঃ ৬২৫-৬২৭।

২২. اخترنالک গ্রন্থের النظام الاسلامی مقارنا بالنظام الراءسمالی و المارکسی প্রবন্ধ,পৃঃ ১৭০।

২৩. اقتصادنا,পৃঃ ৫৩৬-৫৩৭।

২৪. প্রাগুক্ত ,পৃঃ ৫৬৮।

২৫. প্রাগুক্ত,পৃঃ ৬৪৯।

২৬. প্রাগুক্ত,পৃঃ ৬৫০।

২৭. প্রাগুক্ত,পৃঃ ৬৪৯।

২৮. শহীদ বাকের সাদর তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে হযরত ইমাম আলী (আ.) কর্তৃক মিশরের প্রাদেশিক আমীরকে লেখা একটি পত্রের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এতে মুসলিম জনগণের সমাজব্যবস্থার উদাহরণ দিতে গিয়ে বলা হয়েছে,তাতে পার্থিব জীবন ও পরকালীন জীবনের সমৃদ্ধি শামিল রয়েছে। (দ্রষ্টব্য : اقتصادنا পৃঃ ৬৫১)

২৯. এখানে আয়াতুল্লাহ্ বাকের সাদর কতগুলো আপাত পরস্পরবিরোধী হাদীসে রাসূলের (সা.) ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। এসব হাদীসের কতগুলোতে কৃচ্ছ্র সাধনা অবলম্বন ও বস্তুগত স্বার্থ বর্জনের কথা বলা হয়েছে। অপর হাদীসগুলোতে মানুষকে স্বীয় কল্যাণের জন্য ধনসম্পদের সদ্ব্যবহার করার আহ্বান জানানো হয়েছে। শহীদ সাদরের মতে এই দু’ধরনের হাদীসের মধ্যে কোন বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতা নেই। কারণ প্রথমোক্ত ধরনের হাদীসে অর্থনৈতিক ধন-সম্পদকে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্যরূপে গ্রহণ করা থেকে মানুষকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। (দ্রষ্টব্য : اقتصادنا পৃঃ ৬৬৯-৬৭২)

৩০. শহীদ বাকের সাদর : مقدمة فی التفسیر,প্রকাশক : আদ্-দারুল ইসলামিয়াহ্,কুয়েত,১৯৮২,পৃঃ ১০৪-    ১০৭।

৩১. اقتصادنا,পৃঃ ৬৭০।

৩২. প্রাগুক্ত,পৃঃ ৬৭১।

৩৩. শহীদ বাকের সাদরের মতে মুজতাহিদ ইসলামের প্রাথমিক কোন মূলনীতি পরিবর্তন করবেন না। অর্থাৎ তিনি হারাম ও হালালের ক্ষেত্রে,অন্য কথায় যা কিছু বাধ্যতামূলক (ওয়াজিব বা ফরয) ও যা কিছু নিষিদ্ধ (হারাম) তাতে তিনি পরিবর্তন সাধন করবেন না। কিন্তু তিনি দ্বিতীয় স্তরের বিষয়সমূহে-যা ফরয নয়,হারামও নয় অর্থাৎ মানদূব (কাম্য ও পছন্দনীয়) ও মাকরুহ (অপছন্দনীয় ও নিন্দনীয়) বিষয়সমূহ সম্পর্কে মতামত দিতে পারেন। বৃহত্তর কল্যাণকে সামনে রেখে মুজতাহিদ বিশেষ পরিস্থিতিতে মানদূব থেকে নিষেধ করতে ও মাকরুহে উৎসাহ দিতে পারেন।

৩৪. اقتصادنا,পৃঃ ৬৯৭।

কতিপয় পরিভাষা

[অত্র প্রবন্ধে কতিপয় পরিভাষা প্রচলিত অর্থ থেকে কিছুটা ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং কিছু নতুন পরিভাষাও ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে এ ধরনের পরিভাষাগুলো মূল ইংরেজী,অনুবাদ ও ক্ষেত্রবিশেষে ব্যাখ্যাসহ উল্লেখ করা হল।]

Commodities

দ্রব্যাদি/দ্রব্যসামগ্রী।

Components in production

উৎপাদন-উপাদান।

Development

বিকাশ/উন্নয়ন। [এখানে প্রাকৃতিক সম্পদ বা দ্রব্যের উন্নততর ব্যবহারযোগ্যতা সৃষ্টি অর্থে ‘উন্নয়ন’ ব্যবহার করা হয়েছে,  অবকাঠামোগত অর্থে নয়।]

Earnings

উপার্জন (নির্ধারিত প্রাপ্য-বেতন/ভাড়া)। [উৎপাদন বা ব্যবসায় থেকে   উপার্জিত মুনাফা এর অন্তর্ভুক্ত নয়।]

Economic activities

অর্থনৈতিক তৎপরতা/অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।

Economic behaviour

অর্থনৈতিক আচরণ।

Environment

পারিপার্শ্বিকতা [অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে,পরিবেশ অর্থে নয়।]     

Environmental resource

পারিপার্শ্বিক সম্পদ। [প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে ব্যাপকতর অর্থে;পানি,বায়ু এবং পাখী ও জলজ প্রাণীও এর অন্তর্ভুক্ত।]

Exclusive right

একান্ত অধিকার।

Exploitation

শোষণ।

Human work

মানবিক শ্রম (শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নির্বিশেষে।)

Human wealth

মানবিক সম্পদ (মানুষের মধ্যকার শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা-প্রতিভা [স্বয়ং কর্মক্ষম মানুষকে সম্পদ গণ্য করে যে ‘মানব-সম্পদ’ বলা হয় এখানে সে অর্থে ব্যবহৃত হয়নি।]

Industrial capitalist production

পুঁজিকেন্দ্রিক শিল্প-উৎপাদন। [মোটা অংকের পুঁজি ব্যবহারকারী অর্থে।]

Jurisprudent

মুজতাহিদ/ফিকাহশাস্ত্রবিদ।

land

ভূমি (প্রাকৃতিক অর্থনৈতিক উপাদান অর্থে।জমি,কৃষিকাজ,বাড়ীঘর নির্মাণ ইত্যাদি কাজে সরাসরি ব্যবহারযোগ্য ভূমি।)

Market

বাজার। [পুঁজিকেন্দ্রিক শিল্প-উৎপাদন ও পণ্য কেনা-বেচা অর্থে;বেচা-কেনার স্থান অর্থে নয়।]

Market economy

বাজার অর্থনীতি। [পুঁজিবাদী অর্থনীতির পরিবর্তিত পরিভাষা।]

Means of production

উৎপাদন-উপকরণ। [সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি অর্থে;‘উপাদান’ অর্থে নয়।]

Market environment

প্রাকৃতিক পরিবেশ। [অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে।]

Oppression

জুলুম/জুলুম-শোষণ/শোষণ। [প্রধানত অর্থনৈতিক জুলুম অর্থাৎ শোষণ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।]

Primary commodities

প্রাথমিক পর্যায়ের দ্রব্যাদি (যা প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে সরাসরি আহরিত হয় বা উৎপাদিত হয়;ভোগ্য পণ্য ও কাঁচামাল উভয়ই অন্তর্ভুক্ত। )

Primary owner

প্রাথমিক মালিক।

Primary source

প্রাথমিক উৎস।

Priority right of use

ব্যবহারের অগ্রাধিকার।

Realm

আওতা।

Secondary commodities

দ্বিতীয় পর্যায়ের দ্রব্যাদি। [প্রাথমিক পর্যায়ের দ্রব্যাদিকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে উৎপাদিত দ্রব্যাদি।]

Social-economic

সামাজিক-অর্থনৈতিক।

Social justice

সামাজিক সুবিচার।

Social settings

সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস।

Socio-economic

আর্থ-সামাজিক।

Sole proprietor

একচ্ছত্র মালিক।

Special privileges

বিশেষ সুবিধা।

Special right of ownership

বিশেষ মালিকানা অধিকার।

Underdevelopment

অনুন্নয়ন। [‘অনুন্নত’ অর্থে ব্যবহৃত হয়নি।]

Wealth

সম্পদ/ধন-সম্পদ।

তেহরান থেকে প্রকাশিত "Al-Tawhid" সাময়িকীর মুহররম-রবিউল আউয়াল ১৪১৩ সংখ্যা থেকে জনাব নূর হোসেন মজিদী কর্তৃক অনূদিত।  

 

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)