আল হাসানাইন (আ.)

বর্তমান মুসলিম বিশ্বের সমস্যা ও আমাদের করণীয়

2 বিভিন্ন মতামত 01.5 / 5

মুসলিম বিশ্ব আজ নানাবিধ সমস্যায় আক্রান্ত। এ সমস্যাগুলোর পেছনে একদিকে যেমন ইসলামের শত্রুদের হাত রয়েছে তেমনি এর জন্য মুসলমানরা নিজেরাও দায়ী। মুসলমানরা একসময় ইসলামী সভ্যতার জন্ম দিলেও ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে তারা ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে। ভোগবাদী শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরাচারিতা, ক্ষমতার দ্বন্দ, শাসকদের অপকর্মের সমর্থক চাটুকার একদল আলেমের উদ্ভব, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার ধারক আলেমদের সমাজ বিচ্ছিন্নতা, বিধর্মী ও বিজাতীয় চিন্তার অনুপ্রবেশ,চিন্তাগত ও নৈতিক বিচ্যুতি, মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও দলাদলি, মাজহাবগত সংকীর্ণতা ও গোড়ামি, ইহুদী ও খ্রিস্টানদের ষড়যন্ত্র, জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত পশ্চাদপদতা ইত্যাদি উপাদানগুলো মুসলমানদের ক্রমাগত দুর্বল করে ফেলছিল। ইসলামের শত্রুরা এ দুর্বলতারই সুযোগ নিয়ে মুসলিম বিশ্বের ওপর জেঁকে বসে। 

মুসলিম উম্মাহ আজ তিন ধরনের শত্রুর মুখোমুখি। প্রথম দল হল ইহুদি-খ্রিস্টান চক্র, দ্বিতীয় দল মুনাফিক ও গোপন শত্রু, তৃতীয় দল ধর্মজ্ঞানহীন উগ্র মুসলমানের দল। পবিত্র কোরআন এ তিন দলেরই চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। প্রথম দলের মধ্যে মূলত মুশরিক, (হজরত ঈসা ও হজরত মুসার শিক্ষা থেকে বিচ্যুত) খ্রিস্টান ও ইহুদীরা অন্তর্ভুক্ত। খ্রিস্টান ও ইহুদীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘ইহুদী ও খ্রিস্টানরা তোমার প্রতি কখনও সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্মের অনুসারী (চিন্তা ও কর্মের সমর্থক) হবে।’ (বাকারা: ১২০) পাশ্চাত্য বিশ্ব যা এ দুই ধর্মের (বিকৃত রূপের) প্রতিনিধিত্ব করে, বিগত চারশ বছর ধরে কখনও প্রকাশ্যে, আবার কখনও গোপনে সমগ্র বিশ্বকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিকভাবে তাদের পদানত করে রেখেছে। মুসলমানরা তাদের সামরিক শক্তির বিপরীতে অসহায়ত্ব বোধ করছে।

অপরদিকে তিনি মুশরিকদের চরিত্র এভাবে তুলে ধরেছেন: কিভাবে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নিকট (চুক্তি ভঙ্গকারী) মুশরিকদের চুক্তি বলবৎ থাকবে? যেক্ষেত্রে তারা যদি তোমাদের ওপর প্রভাবশালী হয়, তবে তোমাদের সঙ্গে না আত্মীয়তার সম্পর্করক্ষা করবে, আর না চুক্তি ও অঙ্গীকারের মর্যাদা রাখবে; তারা তাদের মুখের কথায় তোমাদের সন্তুষ্ট করে; কিন্তু তাদের অন্তর তা অস্বীকার করে; এবং তাদের মধ্যে অধিকাংশই অবাধ্য।’ (তওবা: ৮) আরো বলেছেন: ‘তারা (মুশরিক) যদি তোমাদের আয়ত্তে আনতে পারে তবে তারা তোমাদের শত্রুতে পরিণত হবে এবং তাদের হাত ও জিহ্বা দ্বারা তোমাদের অনিষ্ট সাধন করবে এবং তারা আশা করে যে, তোমরাও অবিশ্বাসী হয়ে যাও।’ (মুমতাহিনা: ২)

মুসলমানদের সাথে তাদের শত্রুতার তীব্রতা ও ধরন সম্পর্কে বলেছেন: (হে রাসূল!) অবশ্যই তুমি লোকদের মধ্যে বিশ্বাসীদের প্রতি সবচেয়ে শত্রুতা পোষণকারী হিসেবে ইহুদী ও মুশরিকদের দেখবে (মায়েদা: ৮২) অন্যত্র বলেছেন: হে বিশ্বাসিগণ! তোমাদের নিজেদের (বিশ্বাসীদের) ব্যতীত অন্যদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ কর না, (কেননা,) তারা তোমাদের ক্ষতিসাধনে কোনরূপ অবহেলা করে না, তারা কেবল তোমাদের দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ কামনা করে। নিঃসন্দেহে শত্রুতা তাদের মুখে প্রকাশ পেয়েছে এবং তাদের বক্ষসমূহ যা গোপন করে রাখে তা আরও গুরুতর। (আলে ইমরান: ১১৮) এ বৈশিষ্ট্যগুলো ইসলামের বর্তমান শত্রুদের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে বিদ্যমান। এরাই ঐদল যারা দু’শ বছর মুসলিম বিশ্বের ওপর উপনিবেশবাদের জোয়াল চাপিয়ে দিয়েছিল এবং বিগত সত্তর বছর ধরে আমাদের ওপর তাদের তাবেদার শাসকদের বসিয়ে ইসলামী জগতের সম্পদ লুণ্ঠন করছে ও অর্থনৈতিক শোষণ ও নিপীড়ন চালাচ্ছে। মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করছে, বিচ্যুত চিন্তার মুসলমানদের জিহাদের নামে সংঘবদ্ধ করে মুসলমানদের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা ইসলামকে ভীতিকর এক রূপে পরিচিত করানো ছাড়াও মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে নিজেদের উপস্থিতিকে বৈধতা দান করছে। আর তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করছে। তারা তাদের আধিপত্য ও দখলদারিত্ব বজায় রাখার স্বার্থে মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রের ধারক সমগ্রতাবাদী ও অধিকার হরণকারী রাজতান্ত্রিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। অপরদিকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে অবৈধ ইসরাইলী দখলদারীর বিরোধী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টায় রত হয়েছে।

দ্বিতীয় দল মুনাফিকদের সম্পর্কে বলেছেন: ‘(হে রাসূল!) মানুষের মধ্যে একদল (কপট) আছে যাদের (তোষামোদী) কথাবার্তা পার্থিব জীবনে তোমাকে খুবই বিস্মিত করে এবং সে তার আন্তরিক বিষয়ে আল্লাহকে সাক্ষী রাখে; অথচ সে (তোমার শত্রুদের মধ্যে) সর্বাধিক শত্রুভাবাপন্ন আর যখন সে ক্ষমতা লাভ করে তখন দেশে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করে এবং ফসলাদি ও সৃষ্টিকে (মানুষ ও প্রাণীকে) ধ্বংস করে। অথচ আল্লাহ অরাজকতা পছন্দ করেন না। (বাকারা: ২০৪ ও ২০৫) এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারীরাই ইসলামের ইতিহাসে জাহেলিয়াতের প্রত্যাবর্তন ঘটায়। যে ইসলাম মানুষের ওপর মানুষের দাসত্বের অবসান ঘটিয়ে মানুষকে এক আল্লাহর দাস হিসাবে গড়ে তোলার শিক্ষা নিয়ে এসেছিল সে ইসলামকে তারা এক গোত্র ও বংশের দাসে পরিণত করে। জোর করে স্বীয় গোত্রের শাসকদের জন্য মানুষের কাছে বাইয়াত ও আনুগত্যের শপথ গ্রহণের ধারা চালু করে। বিরোধীদের হত্যা, নিপীড়ন, বন্দী ও নির্বাসন দানই ছিল তাদের রাজনৈতিক কৌশল। তারাই প্রথমবারের মত নৈতিকতাহীন ও ভোগবিলাসী শাসকও যে খলিফা হতে পারে এ ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করে। সামরিক শক্তি, ষড়যন্ত্র, গুপ্তহত্যাসহ যে কোন কৌশলে ক্ষমতা দখল করা ও তা ধরে রাখাকে বৈধতা দান করে। তারাই অত্যাচারী, অন্যায়কারী ও বিবেকহীন শাসকদেরকেও মুসলমানদের নেতা হিসাবে মেনে নেয়ার আবশ্যকতার মত প্রচার করে। বর্তমান মুসলিম দেশগুলোর একদল শাসক এ ধারাটিকেই অব্যাহত রেখেছে। এ গোষ্ঠীই মুসলমানদের দুর্ভাগ্যের পেছনে দায়ী মুসলিম দেশগুলোর প্রকাশ্য শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়ে স্বীয় ক্ষমতাকে টিকিয়ে রেখেছে। তুর্কী জাতীয়তাবাদ, আরব জাতীয়তাবাদ, সুন্নী-শিয়া ইত্যাদি বিভক্তির ধোয়া তুলে উম্মতকে তার প্রকৃত শত্রুদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে দূরে রেখেছে।

কখনই এরা যায়নবাদী শক্তির দ্বারা জবরদখলকৃত মুসলমানদের ভূমি উদ্ধারের চিন্তা করে না, নির্যাতিত গাজার জনগণের পাশে এদের কখনও দেখা যায় না কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির জন্য সহস্র কোটি পেট্রোডলার খরচ করতে তারা কুন্ঠিত হয় না। স্বীয় ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য মিলিয়ন নিরীহ মুসলমানের রক্ত ঝরানোর প্রয়োজন হলেও তারা তা করে। এ গণভিত্তিহীন শাসকগোষ্ঠী মুসলমান ও যায়নবাদী কাফের শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে মুসলমানদের ফিরিয়ে এনে তাদের আত্মঘাতি সংঘর্ষে লিপ্ত করেছে। যে যুদ্ধ পূর্বে ইসরাইলের সীমান্তে ইহুদী যায়নবাদী ও মুসলিম সেনাদের মধ্যে ছিল সেটিকে সিরিয়া ও ইরাকের রাস্তায় টেনে এনেছে যাতে যায়নবাদীরা নিরাপদ থাকতে পারে। তাদের এ বিশ্বাসঘাতকতার ফলে লক্ষ লক্ষ মুসলমান উদ্বাস্তু হয়েছে ও হাজার হাজার মুসলমান প্রাণ হারাচ্ছে। যে ইসরাইল হামাস ও হিজবুল্লাহর দ্বারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল এ মুনাফিকদের কারণে যায়নবাদীরা পুনরায় গাজায় ৫০ দিনব্যাপী বর্বর হামলা করার সাহস পেয়েছিল।

মুনাফিকদের এ দলটির মুখপাত্র বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম মুসলিম বিশ্বের দৃষ্টি ইসরাইল থেকে ফিরিয়ে ইসলামের মিত্র ও পৃষ্ঠপোষক গোষ্ঠীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে যা ইসলামের শত্রুদের মূল লক্ষ্য। সউদী আরবের ‘আর রিয়াদ’ পত্রিকার এক সংখ্যায় বলা হয়েছে: ‘ইরাক ও সিরিয়া ব্যতীত ‘জিসিসি’ভুক্ত দেশগুলোকে ইরানের বিরুদ্ধে শক্তিশালী এক প্রতিরক্ষা জোট তৈরী করতে হবে। আমাদের বায়তুল আকসা মুক্তকরণ, ফিলিস্তিন জাতির মুক্তি ও এর ভূখণ্ড উদ্ধার এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিবর্তে ইরানকে টার্গেট করতে হবে। কারণ আমাদের আসল শত্রু ইসরাইল নয়, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান।’ এ প্রতিক্রিয়াশীল মুনাফিকগোষ্ঠী যারা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের সহযোগিতায় তুর্কী খেলাফতের পতন ঘটিয়ে ও ইসলামী বিশ্বকে শতধা বিভক্ত করে বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতায় বসেছে এবং পাশ্চাত্যের করুণায় টিকে আছে, তাদের কাছে পাশ্চাত্যের প্রভুদের সন্তুষ্টিই মূখ্য হবে এটাই স্বাভাবিক।যারা মুসলমানদের রক্তের ওপর নিজেদের প্রাসাদ গড়েছে, তাদের কাছে ফিলিস্তিনীদের রক্তের মূল্যই বাকতটুকু? ফিলিস্তিন নামে যদি পৃথিবীতে কোন রাষ্ট্র নাও থাকে ও একজন ফিলিস্তিনিও যদি জীবিত না থাকে এই মুনাফিকদের কিছু যায় আসে না। ইসরাইলের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখেই ১৯৮৬ সালের জুনে সাদ্দাম ইরানীদের উদ্দেশ্যে বলেছিল যে, যদি এ বছর ‘আল কুদস’ দিবসের মিছিল বের করা হয় তবে সমগ্র ইরানে ঐ মিছিলের ওপর সে বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করার নির্দেশ দিবে। যদি মুসলমানরা আজ ঐক্যবদ্ধ থাকতো এবং বনি উমাইয়ার বশংবদ এ রাজতান্ত্রিক শাসকরা বিশ্বাসঘাতকতা না করতো তবে নিঃসন্দেহে অসংখ্য মানবতা বিরোধী অপরাধের হোতা ইসরাইলের পতন ঘটতো।

তৃতীয় যে দলটি নিজেদের জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞতাবশত মুসলমানদের সাথে শত্রুতা করছে তারা হল খারেজী চিন্তার ধারকরা যারা নিজেদের ছাড়া সকলকে কাফের বলে অভিহিত করে। এ গোষ্ঠী কাফের ও মুশরিকদের বিষয়ে নাজিলকৃত আয়াতকে মুমিনদের ওপর আরোপ করতো তারা আহলে কিবলা ও মুসলমানদের রক্ত ঝরাতো ও সম্পদকে লুন্ঠন করতো। মহানবী (সা.) তাদের সম্পর্কে বলেছেন: আমার উম্মতের মধ্যে মতভেদ হবে; তখন একদল থাকবে যাদের কথা আকর্ষণীয় ও কর্ম খুবই মন্দ হবে, তারা কুরআন পড়বে কিন্তু তা তাদের গলদেশের নীচে নামবে না (এর মর্মকে অনুধাবন করবে না), তীর যেমন ধনুক থেকে বেরিয়ে যায় তারা দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে... তারা কোরআনের দিকে আহ্বান করবে অথচ তার থেকে কিছুই তারা অর্জন করেনি। তাদের বৈশিষ্ট্য হলো মাথা মুণ্ডন করা।’ তারা কেবল মুসলমানদের সাথেই যুদ্ধ করতো এবং কখনই মুশরিক ও কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করতো না।

এ বৈশিষ্ট্যগুলো বর্তমানে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধরত ও মুসলমানদের কাফের প্রতিপন্নকারী গোষ্ঠীর ওপর একশভাগ প্রযোজ্য। তারা নিরীহ মুসলমানদের এমনকি নারী ও শিশুদের হত্যা করে থাকে। অথচ আল্লাহ কোন মুসলমানকে কাফের বলতে নিষেধ ও অন্যায়ভাবে যে কোন মুমিনকে হত্যার শাস্তি চিরস্থায়ী জাহান্নাম নির্ধারণ করেছেন। (নিসা: ৯৩ ও ৯৪) আজ ধর্মজ্ঞানহীন এ দলটি পাশ্চাত্যের হাতের ক্রীড়নক হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ও পাশ্চাত্যের সহযোগিতায় যায়নবাদী ইসরাইলের প্রতিপক্ষ ইসলামী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে ও ইসলামের শত্রুদের স্বার্থকে নিশ্চিত করছে। এরা নাইজেরিয়া, ইরাক, সিরিয়া, মিশর, পাকিস্তান প্রভৃতি মুসলিম দেশের পথে-ঘাটে, বাজারে, মসজিদে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এবং নিরীহ মুসমানদের শুধু এ অজুহাতে যে তাদের মতাবলম্বী নয় হত্যা ও শিরোচ্ছেদ করছে। অথচ যখন ফিলিস্তিনের নারী ও শিশুরা আর্তনাদ করে সাহায্যের আহ্বান জানাচ্ছে তখন নিরবতা পালন করছে।

শুধু তাই নয় এরা বিশ্বজগতের জন্য রহমত হিসেবে আগত ইসলামের এক বীভৎস চিত্র পৃথিবীর সামনে উপস্থাপনের মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ করছে। যে ইসলাম এর মহানুভব আদর্শের কারণে মানুষের মন জয় করেছিল। মহানবী (সা.) তাঁর চাচা হামজার কলিজা ভক্ষণকারী হিন্দা ও ইসলামের চরম শত্রু আবু সুফিয়ানসহ অন্যান্য মুশরিকদের ক্ষমার ঘোষণা দিয়ে ইসলামের উদারতার যে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলেন সে ইসলাম আজ এমন এক নৃশংসরূপে পরিচিত হচ্ছে যা স্বীয় মুসলমান ভাইদের এমনকি নারী, শিশু ও বন্দীদের পর্যন্ত নির্বিচারে হত্যা করে এবং তাদের দাস হিসেবে বিক্রয় করে। অথচ আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন: ‘তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না।’ (নিসা: ২৯) কারবালায় শিশু ও নারী হন্তা বনি উমাইয়ার ইসলাম এ গোষ্ঠীর বর্বরতার মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। আর ইসলামের শিক্ষার সাথে অপরিচিত একদল মুসলমান যুবক মানবতাবর্জিত এ বিকৃত ইসলামকে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তাদের রক্ত ও শ্রম দিচ্ছে। যে রক্ত ও শ্রম ইসলামের স্বার্থে ও এর শত্রুদের ধ্বংসে নিয়োজিত হওয়া আবশ্যক ছিল, এখন তা নিজেদের শক্তি ক্ষয় ও প্রজন্মের বিনাশে ব্যয় হচ্ছে। যে যুবকটি ইসলামের জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতি ও সামরিক শক্তিকে মজবুত করতে পারতো সে ইসলামের শত্রুদের ফাঁদে পা দিয়ে ইসলামের পক্ষ শক্তিকে দুর্বল ও এর বিরোধী শক্তিকে মুসলমানদের ওপর আধিপত্য দানে ভূমিকা পালন করছে।

আল্লাহ এ দিকটির প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন: ‘(হে বিশ্বাসিগণ!) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, আর পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ কর না, অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাবশক্তি বিলুপ্ত হয়ে যাবে, আর ধৈর্য্যধারণ কর; নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।’ (আনফাল: ৪৬) তিনি তাঁর রাসূলকে কেবল মুমিনদের প্রতি বিনয়ী হওয়ারই নির্দেশ দেননি বরং যারা তাঁর অবাধ্য হয় তাদের প্রতিও কঠোরতা দেখানো থেকে বিরত থাকাকেই উত্তম জ্ঞান করেছে। (শোয়ারা: ২১৫-২১৬ ও আলে ইমরান: ১৫৯) এটা এ কারণে যে, যেন মুসলমানরা পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকে। মহানবী (সা.) এমনকি আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মত মুনাফিকদেরও শাস্তি দান থেকে বিরত থাকতেন যাতে তার অনুসারীদের মধ্যে এ ঐক্য বজায় থাকে। পবিত্র কোরআন আমাদের শত্রুর প্রতিও সদাচরণ করার নির্দেশ দিয়ে বলছে: মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দিয়ে, ফলে তোমার সঙ্গে যার শত্রুতা রয়েছে সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত হয়ে যাবে। (হা-মীম আস সাজদাহ: ৩৩) সেক্ষেত্রে মুমিনদের প্রতি আমাদের কতটা সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত তা বলাই বাহুল্য।

মহান আল্লাহ মুসলমানদের পরস্পরের ভাই বলে অভিহিত করেছেন (হুজুরাত: ১০) এবং মুমিনদের প্রতি দয়ালু হওয়াকে মহানবী (সা.) এর প্রকৃত সঙ্গীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসাবে উল্লেখ করেছেন (ফাতহ: ২৯) এ বৈশিষ্ট্যগুলো মুসলমানদের মধ্যে পুনরুজ্জীবিত করা আবশ্যক। নতুন প্রজন্মকে তাদের গৌরবময় অতীত ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত করতে হবে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা দানে মুসলিম বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদদের অবদান ও ইউরোপীয় সভ্যতাকে মধ্যযুগের অন্ধকার থেকে বের করে আনতে ইসলামী সভ্যতার ভূমিকার কথা স্মরণ করাতে হবে যাতে তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হয়। তাদের মধ্যে শত্রুদের অহেতুক ভয় দূর করতে হবে। কারণ আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন: তোমরা শৈথিল্য প্রদর্শন কর না এবং দুঃখিত হও না, (কেননা,) যদি তোমরা খাঁটি বিশ্বাসী হয়ে থাক তবে তোমরাই শ্রেষ্ঠ (ও জয়ী) হবে। (আলে ইমরান: ১৩৯) আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মুসলমানরা একতাবদ্ধ ছিল বলেই তাদের মধ্যে বিভিন্ন দল (ফিরকা), জাতি ও মাজহাব থাকা সত্ত্বেও তারা মহান এক সভ্যতার জন্ম দিতে পেরেছিল এবং এ ধর্মের অনুসারী প্রত্যেক জাতি ও বর্ণ সাধ্যমত তার মেধা ও যোগ্যতাকে এ পথে ব্যয় করতে পেরেছিল। বৈচিত্র সত্ত্বেও তারা নিজেদের এক জাতি ও সত্তা বলে জানতো।

আমাদের অবশ্যই পাশ্চাত্যের দোসর স্বৈরাচারী শাসকদের চিনতে হবে এবং তাদের শোষণ ও জুলুম সম্পর্কে মুসলমানদের অবগত করতে হবে। মুসলিম দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তারকারী সাম্রাজ্যবাদী লুটেরাদের প্রকৃত চেহারা যুবকদের সামনে উন্মোচিত করতে হবে। মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও আত্মঘাতি দ্বন্দের তাদের গভীর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সকলকে সচেতন করতে হবে। ইসলামের আনীত প্রকৃত স্বাধীনতা, সাম্য ও সার্বভৌমত্বের ধারণার সাথে নতুন প্রজন্মকে পরিচিত করাতে হবে। জনগণের স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিতকারী ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রূপ ও কাঠামোকে তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে যাতে তারা তথাকথিত পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের, যা মূলত সংখ্যালঘু পুজিবাদী গোষ্ঠীর শাসন,প্রতারণার শিকার না হয়। পাশ্চাত্যের একচ্ছত্র আধিপত্যের বিরোধী বিভিন্ন দল ও চিন্তার অনুসারীদের সঙ্গে সংলাপ ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও আল আকসা মুক্তির আন্দোলনে যায়নবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে সকলকে সোচ্চার করতে হবে। এক্ষেত্রে বিগত বছরগুলোতে প্রতিরোধ আন্দোলনের সফলতার খবর প্রচারের মাধ্যমে মুসলমানদের আশাকে জাগ্রত করতে হবে। অপরিণামদর্শী ও অদূরদর্শী তড়িৎ পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।

মুসলমানদের জন্য আবশ্যক হল যে কোন দল সম্পর্কে জানতে পাশ্চাত্য প্রচার মাধ্যমের ওপর আদৗ নির্ভর না করা। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহর এ নির্দেশকে স্মরণ রাখা: হে বিশ্বাসিগণ! যদি (আল্লাহর) অবাধ্য (ও পাপাচারী) কোন ব্যক্তি তোমাদের নিকট কোন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা তা উত্তমরূপে অনুসন্ধান করবে, যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতি না করে বস এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করতে হয়। (হুজুরাত: ৬) আর ইসলামের নামে সংঘটিত যে কোন বর্বর ও মানবতা বিরোধী কর্মের সাথে ইসলামের সম্পর্কহীনতার ঘোষণা দেয়া যেন মহান ইসলামের ওপর কলঙ্কের ছাপ না পড়ে। উগ্র ও গোড়া চিন্তার সকল দলকে যে কোন ফিরকা ও মাজহাবের অনুসারীই হোক বর্জন করতে হবে। বিভিন্ন মাজহাবের মধ্যে চিন্তাগত মতবিনিময় ও সংলাপের ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে। একে অপরের ওপর অপবাদ ও মিথ্যা আরোপ থেকে বিরত থাকতে হবে। পরিশেষে মহানবী (সা.) এর মহান চরিত্র ও জীবনপদ্ধতির সাথে পরিচিত ও ইসলামের জ্ঞানে গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী বিভিন্ন মাজহাবের আলেমদের গ্রন্থ থেকে ইসলামকে তুলে ধরতে হবে। (সূত্র:আল বাসাইর)

তথ্যসূত্র:

১. সহীহ বুখারী, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৫১, কিতাবু ইসতিতাবাতুল মুরতাদ্দিন।

২. তাফসীরে বাগাভী, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৫৭; তাফসীরে সালাবী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৭১।

৩. মুসনাদে আহমাদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩২৪; সুনানে আবু দাউদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪২৮, হা. ৪৮৬৫, মুসনাদে আবু ইয়ালা, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪২৬।

৪. সীরাতে হালাবী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৮৯; শারহে সহীহ মুসলিম, নাভাবী, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৫৯, উমদাতুল কারী, ১৫তম খণ্ড, পৃ. ২৩১।

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)