আল হাসানাইন (আ.)

সূরা ইউসুফ; (২৮তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা ইউসুফ; আয়াত ১০০-১০১

সূরা ইউসুফের ১০০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَرَفَعَ أَبَوَيْهِ عَلَى الْعَرْشِ وَخَرُّوا لَهُ سُجَّدًا وَقَالَ يَا أَبَتِ هَذَا تَأْوِيلُ رُؤْيَايَ مِنْ قَبْلُ قَدْ جَعَلَهَا رَبِّي حَقًّا وَقَدْ أَحْسَنَ بِي إِذْ أَخْرَجَنِي مِنَ السِّجْنِ وَجَاءَ بِكُمْ مِنَ الْبَدْوِ مِنْ بَعْدِ أَنْ نَزَغَ الشَّيْطَانُ بَيْنِي وَبَيْنَ إِخْوَتِي إِنَّ رَبِّي لَطِيفٌ لِمَا يَشَاءُ إِنَّهُ هُوَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ

“ইউসুফ তার মাতা-পিতাকে উচ্চাসনে বসাল এবং তারা সকলে তার প্রতি সেজদায় লুটিয়ে পড়ল। সে বলল, হে আমার পিতা! এটিই আমার পূর্বেকার স্বপ্নের ব্যাখ্যা, আমার প্রতিপালক তা সত্যে পরিণত করেছেন। তিনি আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে এবং শয়তান আমার ও আমার ভাইদের সম্পর্ক নষ্ট করার পরও আপনাদেরকে মরু অঞ্চল থেকে এখানে এনে দিয়ে আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আমার প্রতিপালক যা ইচ্ছা তা নিপুণতার সঙ্গে করেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।" (১২:১০০)

হযরত ইউসুফ (আ.) যখন জানতে পারলেন তার পরিবার মিশরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন তখন তিনি তাদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য শহরের বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কাফেলা পৌঁছামাত্রই তিনি পিতাকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করলেন। এই আয়াতে মা-বাবার সঙ্গে হযরত ইউসুফের আচরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, হযরত ইউসুফ তার মা-বাবাকে প্রাসাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন এবং তাদেরকে সিংহাসনে বসালেন এবং সম্মান প্রদর্শন করলেন। কিন্তু তার মা-বাবা এবং ভাইয়েরা সকলেই ইউসুফকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য সিজদায় অবনত হলেন,তারা বারবার বিস্মিত হচ্ছিল ইউসুফ শুধু জীবিতই নয় সে এখন একজন অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তাই তারা সকলেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। তবে তারা যখন সিজদায় অবনত মস্তকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তখন হযরত ইউসুফ তাদের সামনেই দন্ডায়মান ছিলেন, এজন্য সিজদা থেকে উঠার পর তিনি তার পিতাকে বললেন, বাল্যকালে আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম চন্দ্র সূর্য ও এগার নক্ষত্র আমাকে সিজদা করছে, আজ আমার সেই স্বপ্নই যেন বাস্তবায়িত হল। চন্দ্র সূর্য হল আমার মা-বাবা আর এগার নক্ষত্র হল আমার এগার ভাই। হযরত ইউসুফ মিশরে তার ঘটনাবহুল জীবনের সব কিছু পরিবারের সবাইকে খুলে বললেন, কিভাবে কোনো পরিস্থিতিতে তিনি কারাগারে যেতে বাধ্য হলেন, কিভাবে আবার মুক্তি পেলেন, সব ঘটনাই তিনি বর্ণনা করলেন, এসব কিছুকে তিনি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ বলে মন্তব্য করলেন। কিন্তু তিনি বৈমাত্রেয় ভাইদের দ্বারা কিভাবে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন এবং কৃতদাসে পরিণত হয়ে কিভাবে তিনি মিশরে এসেছিলেন সে প্রসঙ্গে তিনি কিছুই বললেন না। কারণ এসব বলে তিনি ভাইদেরকে লজ্জিত করতে চান নি। বরং তিনি ভাইদের অন্যায় আচরণকে শয়তানের কুপ্ররোচনার ফল বলে উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন, শয়তানই ভাইদের মনে বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে ঐ অপকর্ম করতে বাধ্য করেছিল।

এই ঘটনায় লক্ষ্য করার মত বিষয় হচ্ছে, অন্যায় আচরণকারীর প্রতি বিদ্বেষ লালন না করে তাকে ক্ষমা করতে পারাটা হচ্ছে মহত্বের রক্ষণ। হযরত ইউসুফ (আ.) তার ভাইদের অমার্জনীয় অপরাধ ক্ষমা করে দিয়ে মহানুভবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এখানে হযরত ইউসুফ (আ.) এর আচরণে মাতা-পিতার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা উচিত তারও বাস্তব দৃষ্টান্ত ফুটে ওঠেছে। মানুষ যত বড় বা ক্ষমতাবানই হোক না কেন পিতা মাতার কাছে সে সব সময়ই একজন সন্তানতুল্য। তাই পিতা মাতাকে সর্বোচ্চ সম্মান দেয়ার বিষয়টি সর্বাবস্থায় মনে রাখতে হবে।

সূরা ইউসুফের ১০১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

رَبِّ قَدْ آَتَيْتَنِي مِنَ الْمُلْكِ وَعَلَّمْتَنِي مِنْ تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَنْتَ وَلِيِّي فِي الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةِ تَوَفَّنِي مُسْلِمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ

“হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে রাজ্য দান করেছ এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছ। হে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা! তুমিই ইহলোক ও পরলোকে আমার অভিভাবক। তুমি আমাকে মুসলমান বা আত্মসমর্পণকারীর মৃত্যু দাও এবং আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত কর।" (১২:১০১)

পবিত্র কুরআনে প্রাচীন মিশরের দু’জন শাসকের বর্ণনা পাওয়া যায়। এদের একজন হলো ফেরাউন এবং অপরজন হলেন হযরত ইউসুফ (আ.)। ফেরাউন ছিল ঔদ্ধত্য ও অত্যাচারী। জনগণকে সে দাস হিসেবে বিবেচনা করত। সে মনে করত ক্ষমতার উৎস সে নিজেই। অপর দিকে হযরত ইউসুফ (আ.) ছিলেন সম্পূর্ণ তাঁর বিপরীত। ক্ষমতাকে তিনি আল্লাহর দেয়া আমানত হিসেবে বিবেচনা করতেন। তিনি বলতেন, হে আল্লাহ! আমার যা কিছু সম্বল তার সবটুকুই তোমার। জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং ক্ষমতার যতটুকু অধিকারী হতে পেরেছি তা তোমারই অনুগ্রহে সম্ভব হয়েছে। শুধু ইহকালেই নয় পরকালেও আমরা তোমার ওপরই নির্ভরশীল। হে আল্লাহ! আমি যেন তোমার অনুগত থেকেই মৃত্যুবরণ করি। আমাকে তুমি তোমার একান্ত অনুগত ও সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করে নাও।

হযরত ইউসুফ (আ.) এভাবে স্ববিনয়ে আল্লাহর কছে দোয়া করতেন। তিনি প্রকৃতই একজন আত্মসমর্পণকারী ছিলেন। ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌছার পরও তিনি এক মুহুর্তের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহের কথা ভুলেননি।

ক্ষমতা এবং সম্পদ মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে নেয়। এই দুই ক্ষেত্রে মানুষের জীবনে অনেক উত্থান পতন আসে। তাই সব সময় আল্লাহর স্মরণাপন্ন হওয়া উচিৎ, তিনিই যে কোনো বিপদ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারে।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)