আল হাসানাইন (আ.)

কারবালা ও ইমাম হোসাইন (আ.)-৭ম পর্ব

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

ইবনে যিয়াদ কর্তৃক বন্দী ইমাম পরিবারকে সিরিয়ায় প্রেরণ

ইবনে যিয়াদের চিঠি পেয়ে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর ইয়াজিদ ইবনে যিয়াদকে লিখল, হোসাইন (আ.) এর মস্তক ও যারা তার সাথে নিহত হয়েছে তাদের কর্তিত মাথা ইমাম হোসাইন (আ.) এর বন্দী পরবিার-পরিজনসহ সিরিয়ায় পাঠিয়ে দাও। ইবনে যিয়াদ মাহফার বনি সা’লাবা আল আনেদীর নেতৃত্বে ইমাম হোসাইন (আ.) ও তার নিগত সঙ্গী-সাথীদের মাথা এবং বন্দী আহলে বাইত (আ.) কে সিরিয়ায় প্রেরণ করে। কাফির মুশরিক যুদ্ধবন্দীদেরকে যেমনিভাবে মুখমণ্ডল অনাবৃত করে রাখা হয় ঠিক তেমনিভাবে মিহফার বন্দী নবী-পরিবারকে সিরিয়ায় নিয়ে যায়।

সিরিয়ায় আহলে বাইত (আ.)-এর করুণ অবস্থা

বন্দী আহলে বাইত (আ.) এর কাফেলা দামেশক শহরের সদর দরজার নিকটবর্তী হলে হযরত উম্মে কুলসুম (আ.) শিমারের কাছে গিয়ে বললেন, “তোমার সাথে একটু কথা আছে।” শিমার তাকে জিজ্ঞেস করল, “কি কথা?” কথন উম্মে কুলসুম তাকে বললেন,

“এ শহরে প্রবেশ করানোর সময় আমাদেরকে এমন ফটক দিয়ে শহরের ভিতরে নিয়ে যাও যেখান। অল্পসংখ্যক দর্শক জড়ো হয়েছে এবং তোমার সিপাইদেরকে বল তারা এই মাথাগুলোকে পতাকাসমূহের মধ্য থেকে বাইরে বের করে আনে এবং এবং আমাদের (বন্দী নবী পরিবার) ওগুলো থেকে দূরে রাখে। কারণ আমরা ইতোমধ্যে অনেক অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছি। আর আমরা তো বন্দী অবস্থার মধ্যেই রয়েছি। শিমারের মাঝে বিশেষ ধরনের কুফরী ও পাপ-পঙ্কিলতা (কলুষতা) থাকার কারণে হযরত উম্মে কুলসুমের এ কথায় সে মোটেও কান দিল না বরং উল্টো আদেশ দিল, “কর্তিত মস্তকগুলোকে বর্শাগ্রে বেধে পতাকাসমূহের মাঝেই রাখা হয়।” আর এভাবেই বন্দী নবী পরিবারকে দর্শকদের উপস্থিতিতে দামেশকের প্রধান ফটকের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করানো হল। শহরের প্রধান জামে মসজিদের দরজার সামনে যেখানে যুদ্ধবন্দীদেরকে রাখা হত সেখানেই বন্দী নবী পরিবারকে রাখা হয়। বর্ণিত আছে যে, একজন জ্ঞানী তাবেয়ী সিরয়িায় যখন ইমাম হোসাইনের কর্তিত মাথা মোবারক দেখতে পান তখন থেকে এক মাসের জন্য তিনি নিজ বান্ধবদের সাথেও দেখা দেননি, আত্মগোপন করেছিলেন। একমাস পর যখন তাকে দেখা গেল তখন তাকে আত্মগোপন করার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল। তিনি জবাবে বলেছিলেন, তোমরা দেখতে পাচ্ছ না যে আমরা কত বড় দুর্ভাগ্য ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছি?” তারপর তিনি নিম্নোক্ত কবিতাটি পাঠ করলেন,

“তোমরা কারা? তখন ঐ মেয়েটি বলল, আমি হোসাইনের (আ.) কন্যা সাকীনা।” আমি তাকে বললাম, “আমি আপনার প্রপিতামহের একজন সাহাবা । আমার নাম সাহল বিন সা’দ। আমার দ্বরা যদি আপনাদের কোন উপকার হয় তাহলে আমাকে বলুন।” তখন তিনি (সাকীনা) বললেলঃ

“হে নবী দৌহিত্র সিরিয়ায় আপনার রক্তাক্ত মাথা আনা হয়েছে। আপনাকে হত্যা করার অর্থই হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে প্রকাশ্যে ও ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা। হে নবী দৌহিত্র, আপনাকে তৃষ্ণার্তাবস্থায় ওরা হত্যা করেছে এবং পবিত্র কোরআনের বিধান লংঘন করেছে। আপনাকে হত্যা করার সময় তারা তাকবীর-ধ্বনি দিয়েছেন। আসলে তারা আপনাকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে তাকবীর ও তাহলীলেরই ধ্বংস সাধন করেছে।”

একজন সিরিয়াবাসী বৃদ্ধের কাহিনী

বর্ণিত আছেঃ বন্দী নবী পরিবারকে যখন দামেশ্কের জামে মসজিদের দরজার সামনে জড় করা হল তখন তাদের (আ.) সামনে একজন বৃদ্ধ এসে বলল, “মহান আল্লাহর সব প্রশংসা যিনি তোমাদেরকে হত্যা ও ধ্বংস করেছেন এবং তোমাদের পুরুষদেরকে হত্যা করে দেশের শহর ও জনপদসমূহকে নিরাপদ করেছেন। তিনি আমীরুল মুমেনীন ইয়াজিদকে তোমাদের উপর বিচয়ী করেছেন।” ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) তখন ঐ বৃদ্ধ লোকটিকে বললেন, “তুমি কি এ আয়াতটা…

قُلْ لا أسْألُكُمْ عليْهِ أجْرًا إِلّا الْمودّة فِي الْقُرْبى

“হে নবী বলে দিন একমাত্র আমার নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া তোমাদের কাছে এ রিসালাতের(দাওয়াতের) দায়িত্ব পলন করার জন্য কোন প্রতিদানই প্রত্যাশা করি না।”(সূরা আস-সূরা, আয়াত নং-২৩) পবিত্র কোরআনে পড়নি? তখন বৃদ্ধ লোকটি বলল, হ্যাঁ পড়েছি।”তখন ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) বললেন, জেনে রাখ আমরাই মহানবীর নিকটাত্মীয়। আচ্ছা তুমি কি বনী ইসরাইলের এ আয়াটি

وآتِ ذا الْقُرْبى حقّه

(বনী ইসরাইল, আয়াত নং-২৬)

(“নিকটাত্মীয়ের অধিকার।”) পড়নি? ইমাম (আ.) বললেন, “আমরাই মহানবীর নিকটাত্মীয় অর্থাৎ ذا الْقُرْبى (যাল-কুরবা)।” তোমরা কি এ আয়াতটি

واعْلمُوا أنّما غنِمْتُمْ مِنْ شيْءٍ فأنّ لِلّهِ خُمُسهُ ولِلرّسُولِ ولِذِي الْقُرْبى

আর জেনে রাখো যখন তোমরা কোন জিনিস গণীমত লাভ করবে তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ, তার রাসূল ও নিকটাত্মীয়দের জন্য…।(সূরা আনফাল, আয়াত নং-৪১) বৃদ্ধ লোকটি বলল, “হ্যাঁ, আমি পড়েছি।” তখন ইমাম বললেন, আমরাই যাল কুরবা অর্থাৎ নিকটাত্মীয়।” আচ্ছা তুমি কি কোরআনের এ আয়াতটি

إِنّما يُرِيدُ اللّهُ لِيُذْهِب عنْكُمُ الرِّجْس أهْل الْبيْتِ ويُطهِّركُمْ تطْهِيرًا

“হে নবীর আহলে বাইত নিশ্চয় মহান আল্লাহ তোমাদেরকে সব ধরনের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পূর্ণরূপে পবিত্র করতে চান।’ (সূরা আহযাব, আয়াত নং-৩৩) পড়নি? বৃদ্ধলোকটি বলল হ্যাঁ, পড়েছি।” ইমাম (আ.) বললেন, “আমরাই মহানবীর আহলে বাইত। মহান আল্লাহ আমাদের শানেই এ আয়াতটি নাযিল করেছেন।” বৃদ্ধলোকটি ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) এর এ কথাগুলো শুনে নির্বাক হযে গেল এবং যে সব কথা সে কিছুক্ষন আগে বলেছিল সে জন্য সে অনুতপ্ত হয়ে বলল, “খোদার শপথ, কোরআনের এ আয়াতগুলো কি তোমাদের শানেই নাযিল হয়েছে?” তখন ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) বললেন, “মহান আল্লাহ ও আমার দাদা মহানবীর (সা.) কসম, এ আয়াতগুলো আমাদের শানেই অবতীর্ণ হয়েছে।” ঐ বৃদ্ধলোকটি এ কথা শুনে কেদে ফেলল এবং মাথা থেকে পাগড়ী খুলে মাটিতে ফেলে দিল এবং আকাশের দিকে মাথা তুলে প্রার্থনা করল, “হে খোদা, আমি মহানবীর (সা.) বংশধরদের মনুষ্য ও জ্বীন শত্রুদের থেকে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” এরপর সে ইমাম (আ.) কে বলল, “আমার তওবা কি কবুল হবে?” ইমাম (আ.) তাকে বললেন, “হ্যাঁ, যদি তুমি তওবা কর তাহলে মহান আল্লাহ তোমার তওবা কবুল করবেন। তুমি তো আমাদের সাথেই আছ।” তখন বৃদ্ধ লোকটি বলল, “আমি তওবা করলাম।” ইয়াজিদ যখন বৃদ্ধলোকটির এ কাহিনীটি শুনল তখন তাকে কতল করার আদেশ দিল এবং তাকে হত্যা করা হল।

ইয়াজিদের সভায় বন্দী আহলে বাইতের প্রবেশ

এরপর মহানবীর (সা.) বন্দী পরিবার-পরিজনকে দড়িতে বেধে ইয়াজিদের দরবারে আনা হয় । ঠিক এ সময় ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) বললেন,

“হে ইয়াজিদ, তোমাকে, খোদর নামে শপথ করে বলছি, মহানবী (সা.) সম্পর্কে তুমি কেমন ধারণা পোষণ কর, যদি তিনি আমাদেরকে এ অবস্থায় দেখতে পেতেন?” ইয়াজিদের নির্দেশে বন্দী নবী-পরিবারকে যে সব রশি দিয়ে বধা হয়েছিল সেগুলো কেটে ফেলা হল। তারপর ইমাম হোসাইনের (আ.) পবিত্র মাথা ইয়াজিদের সামনে রাখা হয় এবং নবী-পরিবারের মহিলাদেরকে ইয়াজিদের পিছনে দাড় করানো হয় যাতে করে তারা ইমাম হোসাইনের (আ.) পবিত্র মাথা দেখতে না পান। কিন্তু ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) এ দৃশ্য দেখে ফেললেন। হযরত যয়নাবের (আ.) দৃষ্টি ইমাম হোসাইনের (আ.) এ দৃশ্য দেখে ফেললেন। হযরত যয়নবের (আ.) দৃষ্টি ইমাম হোসাইনের (আ.) কর্তিত মাথার দিকে পড়ামাত্রই দুই গ্রীবাদেশে হাত রেখে অতি করুণ স্বরে বলে উঠলেন, “ওয়া হেসাইনাহ (হায় হোসাইন), হায় রাসুলুল্লাহর (সা.) দৌহিত্র, হায় পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদীনার সন্তান, হায় ফাতেমা যাহরার সন্তান, হায় মুস্তাফার (সা.) দৌহিত্র।” বর্ণনাকারী বলেনঃ হযরত যয়নব (আ.) উক্ত সভায় যারাই উপস্থিত ছিল তাদের সবাইকে কাদালেন। এর এ সময় পাপিষ্ঠ ইয়াজিদ (তার উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক) চুপ করে ছিল। এ সময় বনী হাশিমের যে মহিলাটি ইয়াজিদের গৃহে বাস করত সে ইমাম হোসাইনের (আ.) জন্য শোক প্রকাশ করতে লাগল এবং উচ্চস্বরে বলতে লাগল, “ইয়া হাবীবাহ (হায় প্রিয় হোসাইন), হায় আহলে বাইতের নেতা, হায় হযরত মুহাম্মদের (সা.) দৌহিত্র, হায় অনাথদের আশ্রয় ও ভরসাস্থল, হায় খোদার শত্রুদের হাতে নিহত শহীদ।” যারাই তার ফরিয়াদ শুনতে পেল তারাই কাদতে লাগল। এরপর ইয়াজিদ খায়যুরান কাঠের নির্মিত একটি লাঠি আনার আদেশ দিল এবং সেই লাঠি দিয়ে সে ইমাম হোসাইনের (আ.) পবিত্র দাঁত ও ঠোটে আঘাত করতে লাগল। আবু বারযা আসলামী ইয়াজিদকে লক্ষ্য করে বললেন, “ইয়াজিদ তোমার জন্য আক্ষেপ, তুমি লাঠি দিয়ে হযরত ফাতেমার (আ.) পুত্র হোসাইনের (আ.) মুখে আঘাত করছ। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি মহানবীকে (সা.) হাসান ও হোসাইনের গালে চুম্বন করতে দেখেছি এবং তিনি (সা.) বলতেনঃ

أنْتُما سيِّدا شبابِ أهْلِ الْجنّة

“তোমরা দু’ভাই বেহেশতের যুবকদের নেতা।” তোমাদের হত্যাকারীদেরকে আল্লাহ হত্যা করবেন ও অভিশাপ দিন এবং তোদেরকে নিকৃষ্ট বাসস্থান জাহান্নামে প্রবেশ করান। “ইয়াজিদ এ কথা শুনে অত্যন্ত ক্ষেপে গেল। পাপিষ্ঠ ইয়াজিদের নির্দেশে আবু বারযাহকে টেনে হিচড়ে দরবার থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ ঘটনার পর ইয়াজিদ ইবনে যে’বারীর কবিতা আবৃত্তি করতে লাগল,

হায় আমার পূর্ব পুরুষেরা যারা বদরের যুদ্ধে নিহত হয়েছে তারা যদি আজ দেখতে পেত যে খাযরাজ গোত্র আমাদের তরবারীর আঘাতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে কাদছে তখন তারা অত্যন্ত আনন্দিত ও উল্লাসি হত এবং বলত সাবাস হে ইয়াজিদ, তোমার শক্তি অটুট থাকুক। আমরা হাশেমী গোত্র প্রধানদেরকে হত্যা করেছি এবং তাদের থেকে বদরের যুদ্ধের প্রতিশোধ গ্রহণ করেছি। আমি যদি আহমদের কৃতকার্যের জন্য তারই বংশধরদের উপর প্রতিশোধই গ্রহণ না করি তাহলে আমি কি করে খিন্দিকের বংশধর হব?

(ইবনে যে’বারী কোরাইশ বংশীয় কাফির ছিল। তার আসল নাম আবদুল লাত। ইসরাম ধর্ম গ্রহণ করার পর মহানবী (সা.) তার নাম আব্দুল্লাহ রেখেছিলেন। ইবনে যে’বারী এ কবিতাটি উহুদের যুদ্ধে আবৃত্তি করেছিল। ‘নাসেখ’ গ্রন্থের রচয়িতা বলেন, “প্রথম ও দ্বিতীয় কবিতা ইবনে যে’বারীর রচিত। আর বাদ বাকী কবিতাসমূহ ইয়াজিদ কর্তৃক রচিত।)

হযরত যয়নাব (সা.আ.) এর ভাষণ

হযরত যয়নাব (আ.) দাড়িয়ে বললেন, “সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর যিনি এ নিখিল বিশ্বের প্রভু। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তার বংশরদের সকলের উপর মহান আল্লাহর দরুদ ও সালাম। মহান আল্লাহ সত্য বলেছেন, “যারা মন্দ কাজ এবং অপরাধ করেছে তাদের পরিণাম হচ্ছে এটাই যে তারা মহান আল্লাহর নিদর্শনসমূহ অস্বীকার ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে এবং সেগুলো উপহাস ও ঠাট্টার বিষয়বস্তুতে পরিণত করেছে। হে ইয়াজিদ, যেহেতু এ প্রশস্ত পৃথিবী ও আকাশকে আমাদের জন্য সংকীর্ণ করে দিয়েছিস। আমাদেরকে যুদ্ধ বন্দীদের মত এক শহর থেকে অন্য শহরে নিয়ে যাচ্ছিস এতে করে তুই ভেবেছিস যে আল্লাহর কাছে আমরা অপদস্থ ও লাঞ্ছিত হয়েছি এবং খোদার কাছে তোর মর্যাদা বেড়ে গেছে? এ কারণেই কি তুই এত গর্ব করছিস? তোর পার্থিব জীবন নিরাপদ ও তোর সাম্রাজ্য এবং রাজত্ব সুদৃঢ় হয়েছে মনে করে তুই আজ উল্লসিত ও আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিস? এত তাড়াহুড়া করিস নে। তুই কি মহান আল্লাহর বাণী “যারা কুফরী করেছে তারা যেন অবশ্যই মনে না করে যে কয়দিনের সুযোগ তাদেরকে দেয়া হয়েছে তা তাদের সৌভাগ্যের সূচনা করেছে । না, আসলে ব্যাপারটা ঠিক এরকম নয়। বরং এ সুযোগ তাদের পাপ ও অপরাধকে আরো বাড়িয়ে দেবে। এ কারণে তাদের জন্য পরকালে ভয়ঙ্কর শাস্তি রয়েছে।”-ভুলে গিয়েছিস? হে তুলাকাদের সন্তান নিজের স্ত্রী, দাসী ও মহিলাদেরকে পর্দাবৃত করে রেখেছিস আর মহানবীর (সা.) কন্যাদেরকে মুখমণ্ডল খোলাবস্থায় এবং অনাবৃত করে শত্রুদের সাথে এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরাচ্ছিস অথচ তাদেরকে এ ঘোর দুর্দিনে সহায়তা করতে পারে এমন লোকেরা কেউ বেচে নেই- এটা কি ন্যায় বিচার ও ন্যায়পরায়ণতার নমুনা? যে ব্যক্তি মুক্তমনা মহামানবদের কলিজা দাত দিয়ে কামড়ায়৭ এবং শহীদদের রক্তে যার অস্থি ও মাংসপিণ্ড হয়েছে তার কাছে কি দয়া ও মায়ার আশা করা সম্ভব?!! যে আমাদের সাথে সবসময় শত্রুতা পোষণ করে সে কেন আমাদের সাথে শত্রুতা করা থেকে বিরত থাকবে? আদৌ এটা কি সম্ভব? এখন যে ব্যক্তি শক্তি ও মদমত্ততায় নিমগ্ন সে কিভাবে নিজের পাপ ও অপরাধের কথা ভাববে? ক্ষমতার দর্পে ও অহংকারে নেশাগ্রস্থ হয়ে তুই এখন লাঠি দিয়ে বেহেশতের যুবকদের নেতা হোসাইন (আ.) এর দাতে আঘাত করছিস আর প্রকাশ্যে আবৃত্তি করছিসঃ

আর তোর পক্ষে এ ধরনের উক্তি আর এ ধরনের কবিতা আবৃত্তি করা শোভা পায়। কারণ তোর হাত মহানবীর (সা.) বংশধরদের রক্তে রঞ্জিত। মর্তের উজ্জ্বল নক্ষত্রদেরকে যারা আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর ছিলেন তুই তাদেরকে ধ্বংস করেছিস। আর এ কাজ করে আসলে তুই নিজের মৃত্যু ও দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছিস। এখন তুই তোর মৃত পূর্ব পুরুষদেরকে ডাকছিস আর ভাবছিস যে তারা তোর কথা শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু তুই জেনে রাখিস অচিরেই তুইও তাদের সাথে মিলিত হবি। আর তখনই তুই বুঝতে পারবি এবং আশা করবি হায় আমার দু’হাত যদি অক্ষম হত এবং আমি যদি বোবা হতাম। আর যে জঘন্য কথা বলেছি তা যদি না বলতাম। যে অন্যায় করেছি তা যদি না করতাম। এখানে হযরত যয়নাব অভিশাপ দিয়ে বললেনঃ “হে সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের সাথে যারা অত্যাচার করেছে তাদের উপর তুমি প্রতিশোধ গ্রহণ কর। তাদের কাছ থেকে আমাদের হক যা তারা আামদের থেকে কেড়ে নিয়েছে তা উদ্ধার কর এবং তাদেরকে দোযখের আগুনে দগ্ধ কর।”

এরপর তিনি ইয়াজিদকে লক্ষ্য করে বললেন, “হে ইয়াজিদ এ গর্হিত কাজ করে তুই নিজের চামড়া নিজেই তুলে ফেলেছিস এর নিজের দেহকে খণ্ডিত খণ্ডিত করেছিস (নবী বংশকে হত্যা করে তুই আসলে নিজেকেই বধ করেছিস)। আর অচিরেই তুই মহানবীর (সা.) বংশধরদেরকে হত্যা ও অপদস্থ করে পাপের যে মহাভারী বোঝা ঘাড়ে বহন করেছিস তা নিয়ে মহানবীর সামনে উপস্থিত হবি। সেদিন আল্লাহ মহানবীর (সা.) বংশধরদেরকে (যাদের তুই হত্যা করেছিস) একত্রিত করে তাদের হৃত অধিকার আদায় করবেন এবং প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। তুই ভাবিস না যে, যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তারা মৃত,

ولا تحْسبنّ الّذِين قُتِلُوا فِي سبِيلِ اللّهِ أمْواتًا بلْ أحْي أ عِنْد ربِّهِمْ يُرْزقُون

যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত মনে করনা বরং তারা জীবিত ও মহান আল্লাহর কর্তৃক রিযিকপ্রাপ্ত। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং-১৬৯) আর ঐ দিন মহান আল্লাহ বিচার করবেন, হযরত মুহাম্মদ (সা.) তোর সাথে বিবাদ করবেন এবং আল্লাহর ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) তাকে (সা.) সাহায্য করবেন। যে সব লোক তোকে সিংহাসনে বসিয়েছিল তারা অচিরেই বুঝতে পারবে যে কত মন্দ, নিকৃষ্ট ও অত্যাচারীকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল। আর তোদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি যে সবচে হতভাগা তাও তারা জানতে পারবে। সময়ের চাপে পড়ে আমাকে যদিও তোর সাথে কথা বলতে হচ্ছে তারপরও আমি তোকে তুচ্ছ বলেই মনে করি এবং আমি জানি যে তোকে তিরস্কার করা আসলে পছন্দনীয় কাজ। হায় ! নয়নগুলো থেকে অশ্রু ঝরছে আর বক্ষগুলো দুঃখের আগুনে দগ্ধ হচ্ছে। আহ এটা ভাবতে কত অবাক লাগছে যে, আল্লাহর সৈন্যরা শয়তানের সৈন্যদের হাতে নিহত হচ্ছে। আমাদের রক্ত এদের হাত দিয়ে ঝরছে এবং বধ্যভূমিতে আজ শৃগাল-নেকড়ের খাদ্যে পরিণত হয়েছে!! বুনো পশুগুলো ঐসব পবিত্র মৃতদেহগুলোকে মাটির সাথে পদদলিত করেছে। হে ইয়াজিদ আজ আমাদেরকে বাহ্যত পরাজিত করে আমাদেরকে গনীমতের সম্পদ বলে মনে করছিস। তাহলে জেনে রাখ অচিরেই তোকে একাজের পরিণাম ভোগ করতে হবে। আর যা তুই পরকালের জন্য অগ্রিম পঠিয়েছিস কেবল সেটুকু ছাড়া আর কিছুই তোর থাকবে না। মহান আল্লাহ বান্দাদের প্রতি জুলুম করেন না। আমরা কেবল তারই সমীপে আমাদের অভিযোগ উত্থাপন করব এবং তিনিই আমাদের আশ্রয়স্থল। হে ইয়াজিদ, তুই তোর ঘৃণ্য অপতৎপরতায় ব্যস্ত থাক এবং সব ধরনের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা করে যা। তারপর খোদার কসম করে বলছি, তুই আমাদের নাম কখনো মুছে ফেলতে পরবি না। আমাদের রসূলের ওহীকে স্তব্ধ ও ধ্বংস করতে পারবি না এবং তোর নিজের পাপ থেকেও রেহাই পাবি না। কারণ তোর বিবেক বুদ্ধি বিকারগ্রস্থ। তোর আয়ুষ্কালও সীমিত। তোর সংগী-সাথীরা অবশ্যই ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। যেদিন আহ্বানকারী যখন বলতে থাকবে, “খোদার অভিশাপ অত্যাচারীদের উপর বর্ষিত হোক।” ঐ আল্লাহর সমস্ত প্রশংসা যিনি আমাদের ভাগ্যকে সৌভাগ্য ও ক্ষমার দ্বারা আরম্ভ করেছেন এবং তা শাহাদাত ও রহমত প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সমাপ্ত করেছেন।

আমারা মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি যেন তিনি আমাদের শহীদদের উপর তার নেয়ামতসমূহ পূর্ণ করে দেন এবং তাদেরকে উত্তম পুরস্কার দান করেন এবং আমাদেরকে তাদের যোগ্য উত্তরসূরি করে দেন। কারণ তিনিই পরম দাতা ও দয়ালু। মহান আল্লাহই আমাদের সর্বোত্তম আশ্রয়স্থল।” ইয়াজিদ হযরত যয়নাবের এ ভাষণ শোনার পর বলল,

বিলাপকারিণীদের বিলাপ ও কান্নার ধ্বনি কত পছন্দনীয়!! শোকগ্রস্থ বিলাপকারিণী মহিলাদের জন্য মৃত্যুবরণ করা কত সহজ!! এরপরই ইয়াজিদ সিরীয় নেতাদের সাথে বন্দী আহলে বাইতের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে সে ব্যাপারে শলা-পরামর্শ করল। তারা আহলে বাইতকে হত্যা করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করল। তবে নু’মান বিন বাশীর এ সময় বলল, “আমাদেরকে দেখতে হবে যে মহানবী (সা.) বন্দীদের সাথে কেমন আচরণ করেছেন। তিনি (সা.) যে রকম আচরণ করে থাকবেন ঠিক সেরকমই তোমাকে করতে হবে।”

ইয়াজিদের রাজদরবারে একজন সিরীয় লোকের কাহিনী

এ সময় একজন সিরিয়াবাসী হযরত ফাতেমা বিনতে হোসাইনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমীরুল মুমেনীন, আমাকে এ দাসীটি দিন।” ফাতেমা ফুফী হযরত যয়নাবকে বললেন, “ফুফী, এতিম হওয়ার পর আমাকে দাসী হিসেবে নিতে চাইছে।” হযরত যয়নাব (আ.) তখন বললেন, না এ ফাসেক কখনোই এ ধরনের কাজ করতে পারবে না।” তখন ঐ সিরীয় লোকটি ইয়াজিদকে জিজ্ঞেস করল, “এ মেয়েটি কে?” ইয়াজিদ বলল, এ মেয়েটি হোসাইনের কন্যা ফাতেমা এবং ঐ মহিলাটি হযরত আলীর কন্যা যয়নাব। তখন সিরীয় লোকটি বলল, “হে ইয়াজিদ তোর উপর খোদার লানত। তুই মহানবীর বংশধরদেরকে হত্যা করেছিস এবং তার (সা.) আহলে বাইতকে বন্দী করেছিস। খোদার কসম, আমি মনে করেছিলাম যে, এরা রোমের যুদ্ধবন্দী। ইয়াজিদ একথা শুনে ঐ সিরীয় লোকটিকে বলল, “খোদার শপথ, তোকেও ওদের অন্তর্ভুক্ত করব।” এরপর ইয়াজিদের নির্দেশে ঐ সিরীয় লোকটিকে হত্যা করা হয়।

বর্ণনাকারী থেকে বর্ণিতঃ ইয়াজিদ এক বক্তাকে ডেকে পাঠিয়ে তাকে মিম্বার দাড়িয়ে ইমাম হোসাইন (আ.) ও হযরত আলী (আ.) কে গালি দিয়ে বক্তৃতা করতে বলে । ঐ বক্তাটি মিম্বরে উঠে হযরত আলী (আ.) ও ইমাম হোসাইন (আ.) এর বিরুদ্ধে কটুক্তি এবং মুয়াবিয়া ও ইয়াজিদের উচ্ছসিত প্রশংসা করে । ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) প্রতিবাদ করে বললেন,

 “হে বক্তা, তোমার জন্য আক্ষেপ, তুমি স্রষ্টার অসন্তুষ্টির বদলে এক নগণ্য সৃষ্ট জীবের সন্তুষ্টি খরিদ করছ। অতঃপর তুমি এ কাজের মাধ্যমে নিজের বাসস্থান জাহান্নামের আগুনেই নির্ধারণ করে নিয়েছ।

ইবনে সিনান খাফফাজী কত সুন্দর ভাষায় শেরে খোদা হযরত আলী (আ.) এর প্রশংসা করেছেনঃ

তোমারা মিম্বারে আরোহণ করে আমীরুল মুমেনীন হযরত আলীকে (আ.) গালি দিচ্ছো? অথচ মিম্বরসমূহ তারই তরবারীর বদৌলতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। (হযরত আলী অমিত বীরত্ব সহকারে মহানবীর পাশে দাড়িয়ে কাফির-মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়েছেন এবং তাদেরকে পরাস্ত করেছেন। তার ত্যাগ-তিতিক্ষার কারণে ইসলামের বিজয় অর্জিত হয়েছে। মসজিদসমূহ আবাদ হয়েছে। আর এখন তোমরা তারই বিরুদ্ধে কথা বলছো, তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছো)।

ওই দিনই ইয়াজিদ ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর কাছে তার তিনটি আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করল। এরপর ইয়াজিদের নির্দেশে আহলে বাইতকে এমন এক গৃহে অন্তরীণ করে রাখা হয় যেখানে তারা শীত ও তাপে কষ্ট পেতে থাকেন। সেখানে তাদের অবস্থান করার ফলে তাদের বদনমণ্ডল ফেটে গিয়েছির। তারা যত দিনই দামেশকে ছিলেন ততদিন ইমাম হোসাইন (আ.) এর জন্য শোক ও আহাযারী করেছিলেন।

হযরত সাকীনার (আ.) স্বপ্ন

হযরত সাকীনা (আ.) থেকে বর্ণিতঃ দামেশকে চারদিন অতিবাহিত হওয়ার পর আমি আকটি স্বপ্ন দেখি। অতঃপর তিনি দীর্ঘ স্বপ্নটি বর্ণনা করলেন এবং শেষে বললেন, “স্বপ্নে দেখলাম একজন মহিলা হাওদায় মাথায় হাত রেখে বসে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “মহিলাটি কে/” তখন আমাকে বলা হল, “ইনি হযরত মুহাম্মদের (সা.) কন্যা ফাতেমা এবং তোমার পিতামহী।” আমি একথা শুনে বললাম, “খোদার শপথ, আমি তার কাছে যাব এবং আমাদের প্রতি যে অন্যায় ও অত্যাচার করা হয়েছে তা তাকে আমি জানাব।” অতঃপর আমি দ্রুত তার কাছে গেলাম এবং তার সামনে দাড়ালাম এবং তাকে কেদে বললাম,

পরিবারকে ধ্বংস করা হয়েছে আমাদের মান-সম্ভমের উপর আঘাত হানা হয়েছে, আমাদের পিতা হোসাইনকে (আ.) হত্যা করা হয়েছে।” আমার একথা শুনে তিনি (সা.) বললেন, “সাকীনা আর বলিসনে দাদু। তোর কথা শুনে আমার হৃদপিণ্ডের ধমনী ছিড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এ জামাটি তোমার পিতা হোসাইনের। আমি এ জামাটি নিয়ে কাল কিয়ামত দিবসে খোদার দরবারে ফরিয়াদ করব।” ইবনে লাহীয়াহ, আবুল আসওয়াদ মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান থেকে বর্ণনা করেছেন, “রাসূল জালুত(এক ইয়াহুদীর নাম) আমাকে দেখে বলল, “খোদার শপথ আমি হযরত দাউদের (আ.) ৭০তম অধঃস্তন পুরুষ। ইহুদীরা আমাকে দেখলেই অত্যন্ত সম্মান করে। আর তোমরা মুসলমারা তোমাদের নবী (সা.) ও তার দৌহিত্রের মধ্যে কেলমাত্র এক পুরুষের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও তার (সা.) বংশধরদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করেছ।”

রোম সম্রাটের দূতের কাহিনী

ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) থেকে বর্ণিতঃ ইমাম হোসাইনের (আ.) পবত্রি মস্তক পাপিষ্ঠ ইয়াজিদের সামনে আনা হলে সব সময় সে মদপানের আসর বসাত এবং ইমাম হোসাইনের (আ.) পবিত্র মস্তক ইয়াজিদের সামনে রাখা হত। কোন একদিন রোম সম্রাটের দূত ইয়াজিদের উক্ত আসরে আসল এবং বলল, “আরব জাহানের সম্রাট, এ মাথাটি কার? ইয়াজিদ বলল, এ ব্যাপারে তুমি কেন মাথা ঘামাচ্ছ? দূত বলল, আমি যখন রোম সম্রাটের কাছে উপস্থিত হব তখন আপনার সাম্রাজ্যে আমি যা দেখেছি সে সম্পর্কে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করবেন। আর আমি এ মস্তক এবং যার এ মস্তক তার সম্পর্কেও সম্রাটকে জানানোর ইচ্ছা করছি যাতে করে তিনিও (সম্রাট) আপনার সাথে আপনার এ বিজয় ও আনন্দে শরীক হতে পারেন।” ইয়াজিদ তখন দূতকে বলল, এ মাথা হোসাইন ইবনে আলী ইবনে আবু তালিবের। দূত জিজ্ঞেস করল, “ইনার মা কে?” তখন ইয়াজিদ বলল, হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কন্যা হযরত ফাতেমা (আ.)। তখন রোমান সম্রাটের দূত বলল, “আপনার ও আপনার ধর্মের জন্য আক্ষেপ, আমার ধর্ম আপনার ধর্মাপেক্ষা উত্তম। কারণ আমার পিতা হযরত দাউদের (আ.) বংশধর। আমার বাবা ও তার (আ.) মাঝে অনেক পুরুষের ব্যবধান হওয়া সত্ত্বেও খ্রীষ্টানরা আমাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে এবং তারা আমার পায়ের মাটি তাবাররুক হিসেবে নিয়ে যায়। কিন্তু আপনারা আপনাদের নবীর দৌহিত্রকে হত্যা করেছেন। অতচ তার ও নবীর (সা.) মাঝে কেবলমাত্র এক পুরুষের ব্যবধান । কেমন আপনাদের ধর্ম?” এরপর সে ইয়াজিদকে বলল, “আপনি হাফেরবা খুরের গির্জার কথা শুনেছেন?” ইয়াজিদ বলল, “আচ্ছা বল তো দেখি।” ঐ খ্রীষ্টান দূতটি বলল, “ওমান ও চীনের মাঝে এমন এক সাগর রয়েছে যা অতিক্রম করতে এক বছর লাগে। আর ঐ সমুদ্রের কেন্দ্রস্থলে একটি মাত্র শহর ছাড়া আর কোন জনবসতি সেখানে নেই। ঐ শহরের আয়তন ৮০ বর্গ ফারসাং। ঐ শহরটির মত অতবড় শহর পৃথিবীতে আর নেই। ওখান থেকে ইয়াকুত পাথর এবং কর্পূর অন্যান্য দেশে রপ্তানী করা হয় এবং উদ ও আম্বর হচ্ছে সেখানকার প্রধান উদ্ভিদ । এ শহর খ্রীষ্টানদের নিয়ন্ত্রণে এবং খ্রীষ্টান সম্রাট ছাড়া সেখানে আর কারো শাসন কর্তৃত্ব চলে না। সেখানে অনেক গীর্জা আছে। ঐ গীর্জার মেহরাবে একটি স্বর্ণ নির্মিত হুক্কা রয়েছে এবং তাতে একটি খুর রয়েছে। এ ব্যাপারে জনশ্রুতি রয়েছে যে, উক্ত খুরটি যে গাধার পিঠে হযরত ঈসা (আ.) চড়তেন সে গাধাটির। ঐ হুক্কার চারপাশে রেশমী কাপড় দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। প্রতি বছর দূর দূরান্ত থেকে অগণিত ভক্ত খ্রীষ্টান ঐ গীর্জা যিয়ারত করতে আসে। তারা ঐ হুক্কার চারপাশে প্রদক্ষিণ করে এবং ওটিতে চুমো দেয়। সেখানে তারা মহান আল্লাহর কাছে মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ার জন্য প্রার্থনা করে। খ্রীষ্টান-নাসারারা এ ধরনের আচরণ করে আর ঐ খুর সম্পর্কে তারা দৃঢ় বিশ্বাস করে যে, এটা ঐ গাধার খুর যার উপর হযরত ঈসা (আ.) সওয়ার হতেন। আর তোমরা মুসলমানেরা নিজেদের নবীর দৌহিত্রকে হত্যা কর।

মহান আল্লাহ তোমাদেরকে কখনো যেন মঙ্গল না দেন। ইয়াজিদ তখন ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, “এ খ্রীষ্টানটিকে হত্যা কর; এ কিনা আমাকেই আমার সাম্রাজ্যের মধ্যে অপদস্ত করেছে। এর স্পর্ধা তো কম নয়।” ঐ খ্রীষ্টানটি যখন বুঝতে পারল যে, তাকে হত্যা করা হবে তখন সে ইয়াজিদকে বলল, “আমাকে আপনি কি হত্যা করবেন?” ইয়াজিদ বলল, “অবশ্যই”। তখন ঐ খ্রীষ্টানটি ইয়াজিদকে বলল, তাহলে আপনি জেনে রাখুন যে, গতরাতে আমি আপনাদের নবীকে (সা.) স্বপ্নে দেখেছি। তিনি আমাকে বলছিলেন, “হে খ্রীষ্ট যুবক, তুমি বেহেশতী হবে।” এ ধরনের সুসংবাদে আমর বিস্ময়ের সীমা ছিল না এবং আমি অত্যন্ত অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি এখন সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, “আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) তার রাসূল।” এরপর ঐ খ্রীষ্টান লোকটি হোসইন (আ.) এর পবিত্র মাথা তুলে বুকে লাগাল, চুম্বন করল এবং নিহত হওয়া পর্যন্ত কাদতে লাগল।

মিনহালের ঘটনা

ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) একদিন বাইরে বের হলেন এবং দামেশকের বাজারের ভিতরে হাটছিলেন। মিনহাল বিন আমর তার সামনে এগিয়ে এসে বলল,

“হে মহানবীর (সা.) সন্তান, সিরিয়ায় আপনাদের দিনকাল কেমন কাটছে? তিনি (আ.) বললেন,

“ফেরআউন বংশীয়দের মাঝে বনী ইসরাইল যেমনিভাবে দিন কাটাত আমরাও তেমনিভাবে (উমাইয়া বংশীয়দের মাঝে) দিন কাটাচ্ছি (অর্থাৎ ফেরআউন বংশীয়রা বনী ইসরাইলেন পুরুষদেরকে হত্যা করত এবং নারীদেকে জীবিত রাখত)। হে মিনহাল, আরবরা অনারবদের উপর গর্ব করে বলে, “হযরত মুহাম্মদ (সা.) আমাদের স্ব-গোত্রীয়। আর আমরা তারই আহলে বাইত। কিন্তু আমাদের থেকে আমাদের ন্যায্য অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। আমাদেরকে হত্যা ও ছত্রভঙ্গ করা হয়েছে।

ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন (নিশ্চয় আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি আর তারই কাছে ফিরে যাব) কবি কত সুন্দর বলেছেন।

মহানবীর (সা.) সম্মানার্থে যারা তার মিম্বরের কাঠগুলোকে সম্মান করে অথচ তারাই তার (সা.) বংশধরদেরকে পিষ্ট করে মারছে। কোন আইনে মহানবী (সা.) এর বংশধরেরা তোমাদেরকে অনুসরণ করবে? অথচ মহানবীর সঙ্গী-সাথী ও অনুসরণকারী হওয়ার কারণেই তো তোমাদের গৌরব।

একদিন, ইয়াজিদ আলী ইবনুল হোসাইন (আ.) ও আমর ইবনুল হোসাইনকে ডেকে পাঠাল। আমরের বয়স তখন এগারো বছর ছিল। ইয়াজিদ আমরকে বলল, “তুমি কি আমার ছেলে খালেদের সাথে মল্লযুদ্ধ করবে?” তখন আমর ইয়াজিদকে বললেন, “না, তবে আমাকে ও তোমার ছেলে খালেদকে তলোয়ার দাও। আমরা যুদ্ধ করব।” একথা শুনে ইয়াজিদ বলল, “পিতার রক্তধারা সন্তানদের মাঝে বহমান। তাই পিতার মত সন্তানরাও হয়(সাপের বাচ্চা সাপই হয়)।”

অতঃপর ইয়াজিদ ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) কে বলল, “তোমার তিনটি মনস্কামনা পূরণ করার যে প্রতিজ্ঞা আমি করেছিলাম তা আমি পূরণ করব। এখন তুমি সেগুলো একে একে বল। তখন ইমাম (আ.) বললেন,

প্রথমতঃ আমার পিতা হোসাইনের কর্তিত মাথা আমাকে ফিরিয়ে দাও। আমি তার সুন্দর বদনমণ্ডল দেখতে চাই।

দ্বিতীয়তঃ আমাদের যে সম্পদ লুন্ঠন করা হয়েছে তা আমাদের কাছে ফেরত দেয়া হোক।

তৃতীয়তঃ যদি আমাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাক তাহলে একজন বিশ্বস্ত লোকের সাথে নবীবংশের বন্দী মহিলাদেরকে মদীনায় পাঠিয়ে দিও।

ইয়াজিদ এ কথা শুনে বলল. “পিতার মুখ কখনো দেখতে পাবে না। আমি তোমাকে হত্যা করব না। একমাত্র তুমি ব্যতীত আর কেউ মহিলাদেরকে মদীনায় নিয়ে যাবে না। তবে যে সম্পদ লুন্ঠন করা হয়েছে তার বদলে অনেক গুণ বেশী দামের ধন-সম্পদ আমি তোমাদেরকে দেব।” ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) তখন বললেন, “তোমার ধনসম্পদের এক কানা কড়িও আমাদের দরকার নেই। তোমার ধনসম্পদ থেকে আমাদেরকে কিছু দিতে হবে না। আমরা কেবল আমাদের লুন্ঠিত সম্পদগুলোই চাচ্ছিলাম। কারণ হযরত ফাতেমা (আ.) এর জামা, স্কার্ফ, গলার হার ও কামিজ ঐ সব লুন্ঠিত সম্পদের মধ্যে আছে।” তখন ইয়াজিদ ঐ সব লুন্ঠিত নিয়ে আসার আদেশ দিল । সে ঐ সম্পদগুলো ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-কে ফেরৎ দিল এবং তাকে আরো দুশো দিরহাম দিল। ইমাম যয়নুল আবেদীন ঐ দু’শো দিরহাম ফকির মিসকিনদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। অতঃপর ইয়াজিদ বন্দী ইমাম পরিবারকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করার আদেশ দিল। তবে ইমাম হোসাইনের পবিত্র মাথা মোবারক সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, ইমাম হোসাইনের (আ.) পবিত্র মাথা কারবালায় ফেরত পাঠানো হয়েছিল এবং পবিত্র দেহের সাথে মাথাও দাফন করা হয়েছিল। এতদসংক্রান্ত অনেক বর্ণনা রয়েছে। তবে এ পুস্তিকার স্বল্প পরিসরে এগুলো সব বর্ণনা করা সম্ভব নয়।#আল হাসানাইন

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)