আল হাসানাইন (আ.)

জ্ঞানের সাথে মুসলমানদের সম্পর্কের উৎস

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

রাসূল (সা.) বলেছেন,كلمة الحكمة ضالّة المؤمن فحيث وجدها فهو أحقّ بها

সারাংশ: জর্জি যাইদানের মতে মুসলমানদের জ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়ার অন্যতম কারণ হলো জ্ঞানার্জনের জন্য ইসলামের পুনঃপুন অনুপ্রেরণা দান ও তাকিদ। মুসলমানরা "সত্য জ্ঞানকে ভ্রান্ত বিশ্বাসীদের নিকট হতে হলেও গ্রহণ কর, কিন্তু ভ্রান্ত ধারণাকে সত্যপন্থীর নিকট হতে হলেও গ্রহণ কর না এবং যে কোন কথা পর্যালোচনা ও যাচাই কর।” --এ হাদিসটিকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিল।

মূল প্রবন্ধ: জ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলমানদের দ্রুত উন্নয়নের অন্যতম কারণ হলো তারা জ্ঞান, শিল্প ও স্থাপত্যবিদ্যা অর্জনের ক্ষেত্রে কোন গোঁড়ামি পোষণ করত না। তারা যেখানেই বা যার কাছেই জ্ঞানের সন্ধান পেত তা আহরণ করত। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে তারা উদার মনোভাব পোষণ করত।

আমরা জানি যে, নবী (সা.)-এর হাদীসেও জ্ঞান যেখানেই ও যার কাছেই পাওয়া যাক না কেন তা লাভ করতে বলা হয়েছে। যেমন রাসূল (সা.) বলেছেন,

كلمة الحكمة ضالّة المؤمن فحيث وجدها فهو أحقّ بها

"সঠিক প্রজ্ঞা মুমিনের হারানো সম্পদ। তাই যেখানেই তা পায় তা অর্জনে তার অধিকার সর্বাধিক।”

নাহজুল বালাগায় এসেছে :

الحكمة ضالّة المؤمن فخذ الحكمة و لو من أهل النّفاق

"সঠিক জ্ঞান মুমিনের হারানো সম্পদ। তাই তা গ্রহণ কর যদিও মুনাফিকের নিকট হতে হয়।”

হযরত আলী (আ.) অন্যত্র বলেছেন,

خذوا الحكمة و لو من المشركين

"জ্ঞান শিক্ষা কর যদিও মুশরিকদের নিকট হতে হয়।”

পবিত্র ইমামগণের নিকট হতে বর্ণিত হয়েছে, হযরত ঈসা (আ.) বলেছেন,

خذوا الحقّ من أهل الباطل و لا تأخذوا الباطل من أهل الحقّ و كونوا نقّاد الكلام

"সত্য জ্ঞানকে ভ্রান্ত বিশ্বাসীদের নিকট হতে হলেও গ্রহণ কর, কিন্তু ভ্রান্ত ধারণাকে সত্যপন্থীর নিকট হতে হলেও গ্রহণ কর না এবং যে কোন কথা পর্যালোচনা কর।”

সমুন্নত চিন্তা, গোঁড়ামিমুক্ত ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির এ সকল হাদীস অমুসলমানদের হতেও জ্ঞান অর্জনে মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করেছে। এ হাদীসসমূহ জ্ঞানার্জনে মুসলমানদের মধ্যে সংস্কারহীন ও মুক্ত মনের সৃষ্টি করেছে।

এ কারণেই মুসলমানরা এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিত না যে, কার নিকট হতে জ্ঞান লাভ করছে বা কার মাধ্যমে গ্রন্থসমূহ অনূদিত হয়ে তাদের নিকট পৌঁছেছে; বরং তাদের ইমামদের শিক্ষানুযায়ী মুমিন ও জ্ঞানের প্রকৃত উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেদের মনে করত এবং অন্যদের নিকট তা গচ্ছিত রয়েছে বলে বিশ্বাস করত।

মুসলমানরা বিশ্বাস করত ইলম ও ঈমান পরস্পর বিচ্ছিন্ন হতে পারে না এবং ঈমানহীন পরিবেশে জ্ঞান অপরিচিত হিসেবে মূল্যহীন হয়ে রয়েছে। তাই তার প্রকৃত ও পরিচিত ভূমি মুমিনের অন্তরে ফিরে আসা প্রয়োজন।

তাই রাসূলের كلمة الحكمة ضالّة المؤمن فحيث وجدها فهو أحقّ بها -এ কথা উপরোক্ত সকল কিছুকেই ধারণ করে। আর এজন্যই মুসলমানদের সকল প্রচেষ্টা এ চিন্তাকেই কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো যে, কিরূপে বিশ্বের সকল জ্ঞানভা-ার হস্তগত করা যায়।

জর্জি যাইদান ইসলামী সভ্যতার দ্রুত প্রসার ও বিস্তারের কারণ সম্পর্কে বলেন,

"ইসলামী সভ্যতার দ্রুত প্রসার এবং জ্ঞান ও সাহিত্যের দ্রুত বিকাশ ও উন্নয়নের অন্যতম প্রধান কারণ আব্বাসীয় খলীফাগণ যারা অন্য ভাষার জ্ঞান অনুবাদের বিষয়ে ব্যয় করতে কোন দ্বিধা করতেন না এবং জাতি, ধর্ম ও বংশের বিষয়টি লক্ষ্য করা ব্যতীতই সকল অনুবাদক ও জ্ঞানী ব্যক্তির প্রতি অভূতপূর্ব সম্মান প্রদর্শন করতেন। তাঁদের সকল ধরনের সহযোগিতা দিতেন। এ কারণেই ইহুদী, খ্রিষ্টান, যারথুষ্ট্র, সাবেয়ী ও সামেরী সকল ধর্মের পণ্ডিত ব্যক্তিই খলীফাদের নিকট আসত। এ ক্ষেত্রে আব্বাসীয় খলীফাদের আচরণ সকল জাতি ও ধর্মের সেই সকল নেতা যাঁরা স্বাধীন ও ন্যায়পরায়ণ চিন্তা করেন তাঁদের আদর্শ হওয়ার উপযুক্ত।”

জর্জি যাইদান সাইয়্যেদ শরীফ রাযী কর্তৃক সাবেয়ী ধর্মানুসারী আবু ইসহাক নামের এক ব্যক্তির প্রতি মর্সিয়া পাঠের প্রসিদ্ধ ঘটনা বর্ণনা করে বলেছেন, চিন্তা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা ও মনীষীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টি এতটা প্রচলিত যে, একজন আলেম সম্পূর্ণ মুক্ত মনে একজন সাবেয়ী মনীষীর মৃত্যুতে তার প্রশংসায় মর্সিয়া পাঠ করেছেন।

জর্জি যাইদানের মতে খলীফা ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের উদারতা ও তাঁদের সংস্কারমুক্ত হওয়ার কারণেই সাধারণ মানুষও তাঁদের অনুসরণে এরূপ করত। যদি নির্দেশদাতা ও সম্ভ্রান্তগণ স্বাধীন নীতি গ্রহণ করেন তাহলে অন্যরাও তাঁদের অনুসরণে তা-ই করে। কিন্তু এ মতটি সঠিক নয়। কারণ সাইয়্যেদ শরীফ রাযীর ন্যায় ব্যক্তিবর্গ খলীফাদের অনুসরণ করতেন না এবং এ উদারতা ও সমুন্নত চিন্তা তাঁরা খলীফাদের নিকট হতে শিক্ষাগ্রহণ করেননি। তাঁরা এটি পবিত্র ইসলাম ধর্মের নীতি হতে শিক্ষা লাভ করেছিলেন যা মনে করে যে, জ্ঞান সকল অবস্থায়ই সম্মানিত। তাই যখন মর্সিয়া পাঠের কারণে সাইয়্যেদের সমালোচনা করা হয় তখন তিনি উত্তরে বলেন, "আমি জ্ঞানের প্রশংসায় মর্সিয়া পাঠ করেছি; ব্যক্তির প্রশংসায় নয়।”

ডক্টর যাররিন কুবও তাঁর ‘করনামেহ ইসলাম’ গ্রন্থে মুসলমানদের দ্রুত অগ্রগতির পেছনে গোঁড়ামিমুক্ত উদার নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বলে উল্লেখ করেছেন।

মুসলমানদের জ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়ার অন্যতম কারণ হলো জ্ঞানার্জনের জন্য ইসলামের পুনঃপুন অনুপ্রেরণা দান ও তাকিদ। জর্জি যাইদান খ্রিষ্টধর্মের প্রতি গোঁড়ামি পোষণ সত্ত্বেও (যা তাঁর কোন কোন লেখায় স্পষ্ট, যেমন তিনি বলেছেন, ‘প্রথম যুগের মুসলমানগণ কোরআন ব্যতীত অন্য সকল গ্রন্থের বিরোধী ছিল’) এটি স্বীকার করেছেন, জ্ঞানের প্রতি ইসলামের অনুপ্রেরণা দানের বিষয়টি মুসলমানদের অগ্রগতিতে বিশেষ প্রভাব রেখেছিল। তিনি বলেন,

"যখন ইসলামী সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটল এবং মুসলমানগণ ইসলামী শিক্ষার প্রসার সম্পন্ন করল তখন ধীরে ধীরে শিল্প ও অন্যান্য জ্ঞান অন্বেষণে লিপ্ত হলো। তারা নিজ সভ্যতার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ শুরু করল। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই শিল্প ও অন্যান্য জ্ঞান অর্জনের পথে পা বাড়াল। যেহেতু তারা খ্রিষ্টান পাদ্রীদের হতে দর্শন সম্পর্কে শুনেছিল সেহেতু অন্যান্য জ্ঞান অপেক্ষা দর্শনের প্রতি অধিকতর ঝুঁকে পড়ল। বিশেষত রাসূলের নিকট হতে জ্ঞান অন্বেষণে উদ্বুদ্ধ করে যে সকল হাদীস বর্ণিত হয়েছিল, যেমন ‘জ্ঞান অর্জন কর যদিও তা চীনে গিয়ে অর্জন করতে হয়’, ‘প্রজ্ঞা মুমিনের হারান সম্পদ, যার কাছেই পাও তা গ্রহণ কর যদিও সে ব্যক্তি মুশরিকও হয়’, ‘প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর ওপর জ্ঞান অর্জন ফরয’ এবং ‘দোলনা হতে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ কর’ তা তাদের এ পথে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।”

ডক্টর যাররিন কুব বলেছেন,

"ইসলাম ইলম (জ্ঞান) ও আলেমের (জ্ঞানীর) প্রতি গুরুত্ব ও মনোযোগ দানের বিষয়ে এতটা উদ্বুদ্ধ করেছিল যে, তা মানবিক জ্ঞান ও সংস্কৃতি শিক্ষায় মুসলমানদের অগ্রগতির কারণ হয়েছিল। কোরআন মানব জাতিকে পুনঃপুন বিশ্বজগৎ ও কোরআনের আয়াতের রহস্য অনুসন্ধানে চিন্তা করতে বলেছে, অনেক স্থানেই অন্যান্যদের ওপর জ্ঞানীদের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি উল্লেখ করেছে, একস্থানে আল্লাহ্ ও ফেরেশতাম-লীর সাক্ষ্যের সমপর্যায়ে জ্ঞানীর সাক্ষ্যের মূল্য দিয়েছে, এ বিষয়গুলো জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে যথেষ্ট বলে ইমাম গাজ্জালী মনে করেন। তদুপরি বিভিন্ন সূত্রে রাসূল (সা.)-এর নিকট হতে বর্ণিত হাদীসসমূহও ইলম ও আলেমের মর্যাদার সাক্ষ্য। হাদীসসমূহ ও তাতে নির্দেশিত জ্ঞানের বিষয়ে মতানৈক্যও জ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রতি মুসলমানদের আসক্তির কারণ হয়েছিল। এ বিষয়টি বিশ্বের রহস্য উদ্ঘাটনে ও এ সম্পর্কে চিন্তা ও পর্যালোচনায় তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। রাসূল স্বয়ং জ্ঞানার্জনে অনুপ্রেরণা দিতেন। বদরের যুদ্ধে যে সকল বন্দী মুক্তিপণ হিসেবে অর্থ প্রদানে সক্ষম ছিল না তারা যদি মদীনার দশটি শিশুকে অক্ষরজ্ঞান দান করত তবে মুক্তি পেত। রাসূলের অনুপ্রেরণাতেই যাইদ ইবনে সাবেত সুরিয়ানী (সেমেটিক) ও হিব্রু ভাষা শিক্ষা লাভ করেন এবং অন্য সাহাবীরাও জ্ঞানের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। যেমন প্রসিদ্ধ সূত্রমতে আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) তাওরাত ও ইঞ্জিলে পণ্ডিত ছিলেন, আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর ইবনে আসও তাওরাতের জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তিনি সুরিয়ানী ভাষা জানতেন বলেও কথিত আছে। নবীর তাকিদ ও অনুপ্রেরণা যেমন মুসলমানদের জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছিল তেমনি জ্ঞানী ও আলেমের সম্মানকে বর্ধিত করেছিল।”#আল বাসাইর

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)