আল হাসানাইন (আ.)

মুসলিম সমাজে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত (৩য় পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5
“রহিম সাহেব বেসরকারী একটি অফিসের কর্মকর্তা। নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করে অভ্যস্ত। পাঁচটার পর যথারীতি অফিসের কাজ গুটিয়ে হটপটটি কাঁধে ঝুলিয়ে বাসা অভিমুখে রওনা হলেন। দোতলা ভলভো সার্ভিসের অপেক্ষায় আছেন কাউন্টারের সামনের সারিতে। আচমকা পেছন থেকে একটা ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলেন। জামা-প্যান্ট ধূলি-ধূসর হয়ে গেল। পেছন ফিরে যেসব শব্দ বা বাক্য তিনি সজোরে উচ্চারণ করলেন, তা সাধারণত কেউই শুনতে চায় না। আর শোনার পর নিস্ক্রিয় থাকে না। ভলভোয় একটু ভদ্রগোছের মধ্যবিত্তরাই চড়ে। তাই কেউই তার অভদ্র শব্দগুলোর জবাব দিল না। ঝগড়াটে মানুষ ঝগড়া করতে না পারলে স্বস্তি পায় না। মনের পোটে প্রাণীটি ভেতরেই রয়ে গেল। অবশেষে বাসায় ফেরার পর বৌয়ের হাতে হটপটটি দেয়ার সময় প্রাণীটি বেরিয়ে এলোঃ কী ছাইপাঁশ রান্না করো আজকাল, এসব কি খাওয়া যায় ? সারাদিনে সামান্য একটু রান্না করবে-তারও এই হাল! যত্তোসব। বারেক, বাসু ওরা কোথায়?
বৌঃ নিরুত্তরই থাকলো। কোন কথাই বললো না।
রহিম সাহেব বললো : কথা কানে যায় না? কোথায় ওরা!
এদিকে বৌ কাঁদতে কাঁদতে অন্দরে চলে গেল। তার ছেলে দুটি মায়ের রুমে আজ্রাইলের ভয়ে চুপটি মেরে পড়ে আছে।
এদিকে বাসায় রহিম সাহেবের বন্ধু এলেন হঠাৎ করেই। তিনি রহিম সাহেবকে তার কূশলাদি জিজ্ঞেস করার সাথে সাথেই জবাব দিলেন, “ভালো আর থাকলাম কই, ঘরে-বাইরে সব খানেই অশান্তি আর অশান্তি। তোর ভাবীকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করলাম ছেলেপুলেগুলো কোথায়, সে তার মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।”
দুই বন্ধুর এরকম কথাবার্তার মাঝে রহিম সাহেবের স্ত্রী মেহমানকে সালাম দিয়ে ড্রইংরুমে এলেন। পারস্পরিক কূশল বিনিময়ের পর ভদ্র মহিলা চা আনার কথা বলে ভেতরে যাচ্ছিলেন, এমন সময় রহিম সাহেব টিপপনি কেটে বললেন, “তোমার যেই চা, ও আর খাওয়া লাগবে না। বরং ফল-টল কিছু দাও”। রহিম সাহেবের স্ত্রী লজ্জিত হয়ে অন্দর মহলে চলে গেলেন।
এবারে আসুন ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। প্রতিটি মানুষেরই আলাদা আলাদা ব্যক্তিত্ব রয়েছে, আত্মমর্যাদা রয়েছে। মর্যাদা এমন একটি ব্যাপার, যা অনেকের কাছেই সম্পদের চেয়েও মূল্যবান। নিকৃষ্ট চরিত্রের অধিকারীরাই কেবল ধন-সম্পদের লোভে মর্যাদা বা ব্যক্তিত্বকেও বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। কিন্তু যারা সৎ তারা মর্যাদাকে সব কিছুর উপরে স্থান দেয়। নারীরা স্বভাবতই লজ্জাবতী। সৎ নারীদের কাছে অর্থাৎ লজ্জাশীলা নারীদের কাছে মর্যাদার গুরুত্ব বেশী। স্ত্রীরাও স্বামীদের কাছে একইভাবে মর্যাদা পেতে আশা করে। স্বামীরা যদি তাদেরকে অমর্যাদা কিংবা অপমানিত করে, তাহলে তারা ভীষণ আহত হয়। আর স্ত্রীদের অর্থাৎ নারীদের অনেকেরই স্বভাব হলো, আহত হলেও তা প্রকাশ না করা। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তুষের আগুনের মতো ধিকি ধিকি সে আহত হবার বেদনা লালন করতে থাকে। ধীরে ধীরে স্বামীর ব্যাপারে নিস্পৃহ মনোভাব দেখা দেয় এবং ঘৃণা করতে শুরু করে। অথচ স্ত্রী হলো আপনার জীবনসঙ্গিনী, আপনার সেরা বন্ধু, আপনার সবচেয়ে কাছের মানুষ। ফলে সে-ই আপনার কাছ থেকে বন্ধুত্বের শ্রেষ্ঠ মর্যাদা পাবার অধিকার রাখে। স্ত্রীকে সম্মান করলে তা প্রেম-ভালোবাসায় পরিণত হয়। ফলে স্ত্রীও আপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অনুরক্ত হয়ে পড়বে। এই সম্মান বা মর্যাদা প্রদর্শনের ব্যাপারটি কিন্তু আলাদা কোন আনুষ্ঠানিকতার মতো ঘটনা নয়। বরং উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে সকল কাজে কর্মেই সম্মান প্রদর্শন করা যেতে পারে। যখন বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবেন, স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিন। অফিসে এসে কাজের ফাঁকে খোঁজ নিন। বাসায় ফেরার পর দরজা খুলতেই তার আগে আপনিই সালাম দিন। সারাদিন কেমন কাটলো, খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো হলো কিনা, সন্তানেরা জ্বালাতন করলো কিনা, এসব খোঁজ-খবর নিন। তারপর যতোক্ষণ একত্রে বাসায় থাকেন, সন্তানদের দেখাশোনার দায়-দায়িত্ব পালনে নিজেও অংশ নিন। স্ত্রী আপনাকে নিষেধ করলে আপনি বলুন সারাদিন তো তুমিই জ্বালাতন সহ্য কর। তার খানিকটা আমাকেও নিতে দাও। আপনার স্ত্রী এতে কৃতজ্ঞতায় বিনয়ী হয়ে উঠবে। খাওয়া-দাওয়া করতে বসলেন-তার রান্নাবান্নার প্রশংসা করুন। ঠাট্টা-মশকরা করেও স্ত্রীকে বিদ্রুপ করা বা অসম্মানিত করা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করুন। কারণ আপনি ভালোবেসেই যে ঠাট্টা করেছেন এটা সে বুঝবে। সেজন্যে হয়তো কিছু মনে করবে না। তবে মনে মনে হয়তো ঠাট্টাটিকে সে অপছন্দই করতে পারে। কী প্রয়োজন! ঠাট্টার পরিবর্তে বরং প্রশংসার কাব্যিক পথ বেছে নিন। মজা যদি করতেই হয়, তাহলে এমন ধরনের রসিকতা করুন, যাতে মজাও পাওয়া যায় আবার সম্মান-মর্যাদায়ও আঘাত না লাগে। কোন মজলিসে কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের সমাবেশে কখনই স্ত্রীকে খাটো করে বা অমর্যাদা করে কথা বলবেন না। বরং তাকে সম্মান দিয়ে তাকে প্রশংসা করুন। এতে আপনার বন্ধু মহলেও আপনার স্ত্রীর সম্মান-মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। যার ফলে আপনারা দুজনেই সম্মানিত হবেন। আর পারস্পরিক সম্মান ও মর্যাদার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সম্পর্ক দৃঢ় হয়। সেইসাথে দাম্পত্য জীবন ও পরিবারে সুখ-শান্তি ও সৌরভময় এক পরিবেশ বিরাজ করে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, যারা মহৎ হৃদয় সম্পন্ন্, একমাত্র তারাই নারীদের সম্মান প্রদর্শন করে। তিনি আরো বলেছেন, ” যে পরিবার অর্থাৎ স্ত্রীকে অসম্মান করে, সে নিজের জীবনের সুখ নষ্ট করে ফেলে।”
রাসূল (সাঃ)এর এই মহান বাণীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তাঁর সকল উম্মতের উচিত নিজ নিজ স্ত্রীকে সম্মান করা। ইমাম সাদিক (আঃ)ও তাঁর পিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, “যে বিয়ে করেছে তার অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হলো স্ত্রীকে সম্মান করা।” পারিবারিক সুখ-শান্তি ও শৃঙ্খলার স্বার্থেই তারা স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কিন্তু এই সম্মান দেখানোর বিষয়টি অন্তর থেকে উত্থিত হওয়াই বাঞ্চনীয়। সম্মান ভালোবাসারই প্রকাশ। ফলে ভালোবাসা যেমন অকৃত্রিম হওয়া দরকার, সম্মান প্রদর্শনও ঠিক তাই হওয়া উচিত। দৈনন্দিন জীবনে মানুষ বিচিত্র ঘটনাবলীর সম্মুখীন হয়। এসব ঘটনা সবসময় সুখকর নাও হতে পারে। অফিসে বিচিত্র মানসিকতার সহকর্মী থাকে। সবাই যে বন্ধু সুলভ হবে তা নাও হতে পারে। ফলে আপনি যদি কারো কাছ থেকে কখনো অবন্ধুসুলভ আচরণ পান, তাহলে আপনার মনটা খারাপ হয়ে থাকতে পারে। তার উপর হয়তো বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেলেন, কিংবা দুর্ভাগ্যবশত: কোন ছিনতাইকারী আপনার সর্বস্ব লুট করে নিল-এরকম অবস্থায় আপনি বিক্ষুদ্ধ মনে বাসায় ফিরলেন। বাসায় ফেরার পর আপনি আর কাউকে না পেয়ে বেচারী স্ত্রীর ওপর মনের ঝাল ঝাড়লেন। আপনার ছেলে মেয়েরা আপনার আচরণ দেখে ভাবলো, বাবা তো নয় যেন এক আজরাইল বাসায় ফিরেছে। তারা আপনার কাছে না ঘেঁষে ভয়ে পালিয়ে বাঁচলো। এদিকে আপনার স্ত্রী আপনার জন্যে সারাদিন খেটে যে রান্নাবান্না করলো, সেই রান্নাবান্নার ছোট-খাটো স্বাভাবিক ত্রুটিতে আপনি অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করলেন, কিংবা ঘরদোর হয়তো বাচ্চারা অগোছালো করে রেখেছে, কিংবা তারা চেঁচামেচি করছে-যাই হোক না কেন আপনি যদি এসব অজুহাতে আপনার স্ত্রীর সাথে দুর্ব্যবহার করেন, তাহলে এরচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী থাকতে পারে! আপনি নিজেই আপনার সংসারকে দোজখে পরিণত করলেন। আপনার এই আচরণ মোটেই অভিভাবক সুলভ নয়, বরং একজন অত্যাচারী স্বৈরাচারের মতো। আপনার মতো স্বৈরাচারের শোষণে আপনার পুরো পরিবার অসহ্য যন্ত্রণার শিকার হচ্ছে। আর আপনার স্ত্রী যে তার স্বামীকে দেখামাত্রই খুশী হয়ে ওঠার কথা ছিল, সে আপনার চেহারা দেখা মাত্রই বিরক্ত হয়ে উঠবে। আপনার সঙ্গই তার কাছে বিষময় মনে হবে। ধীরে ধীরে আপনার স্ত্রী আপনার সঙ্গ ত্যাগ করতে চাইবে। বাচ্চাদের কারণে তা অসম্ভব হলে ঘৃণা করতে শুরু করবে। এর ফলে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটি আপনার হবে, তাহলো আপনার এই আচরণের প্রভাব ছেলেমেয়েদের মনে ব্যাপকভাবে পড়বে। ছেলেমেয়েরা ধীরে ধীরে মানসিকভাবে এতটাই জটিল বা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়তে পারে যে, তারা আপনার চেয়েও ভয়ঙ্কর কাজ শুরু করতে পারে। অপরাধ জগতে যারা প্রবেশ করে, তাদের পারিবারিক ইতিহাস অনুসন্ধান করে দেখলে এই জটিল মানসিকতার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে। যার মূল কারণ আপনারই রূঢ় ও ভারসাম্যহীন আচরণ। আপনার সাময়িক অসহিষ্ণুতা কতো মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে, তা একবার ভেবে দেখুন।
সর্বোপরি একটা বিষয় আপনার সুষ্ঠুভাবে চিন্তা করা উচিত, তাহলো যেই দুর্ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার কারণে আপনি রূঢ় আচরণ শুরু করলেন, সেই ঘটনার জন্য আপনি, আপনার স্ত্রী কিংবা ছেলেমেয়েরা কী দায়ী? মোটেই না। ফলে নিরপরাধে আপনার পরিবারের সদস্যদের সাথে নির্দয় আচরণ করা কি অন্যায় নয়? বুদ্ধিমানের কাজ হলো সবকিছুকে ঠান্ডা মাথায় মোকাবেলা করা। ধৈর্য্যহারা না হয়ে নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। কাজকর্ম সেরে ধীরে সুস্থে দুর্ঘটনার কথাটি আপনার স্ত্রীসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সামনে তুলে ধরলে তারা বরং কষ্টটিকে আপনার সাথে ভাগ করে নেবে। এতে সবাই কষ্টের অংশীদার হলো। অন্যদিকে আপনাকে কতোভাবে যে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করবে, তাতে আপনার কষ্টকে আর কষ্টই মনে হবে না। আর আপনার সন্তানরা আপনার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠবে। প্রতিদিন তারা অপেক্ষায় থাকবে কখন আপনি বাসায় ফিরবেন। ঠিকমতো আপনি পৌঁছলেন কিনা এ ব্যাপারে তারা সদা উদ্বিগ্ন থাকবে। যার ফলে পারস্পরিক বন্ধন দৃঢ় হবে। তাই কোন সমস্যার মোকাবেলায় উগ্রতা পরিহার করে ঠান্ডা মাথায় সামাধান করার চেষ্টা করুন। পরিবারের সবার সাথে বিশেষ করে স্ত্রীর সাথে হাসিখুশী থাকার চেষ্টা করুন। সুন্দর আচরণ করার চেষ্টা করুন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এটাকে ঈমানের নিদর্শন বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি সুন্দর আচরণ করে, তার ঈমান অধিকতর পূর্ণ। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ যে তার নিজ পরিবারের সাথে সুন্দর আচরণ করে। রাসূল (সাঃ) আরো বলেছেন, সুন্দর আচরণের চেয়ে শ্রেয়তর কোন কর্ম নেই।
ইসলামের জীবনযাপন পদ্ধতি সব সময়ই সুশৃঙ্খল এবং বৈজ্ঞানিক। ফলে তা মানুষের জন্য কল্যাণকর। কিন্তু এই কল্যাণকে আমরা অনেকেই ব্যক্তিগত জীবনের বাস্তবতায় যথার্থভাবে কাজে লাগাতে পারছি না বলেই কল্যাণবিমুখ হয়ে হতাশায় ভুগি। আমাদের একটা অভ্যাস অজান্তেই গড়ে ওঠেছে, তাহলো না জেনে না বুঝে পাশ্চাত্যের ভেঙ্গে পড়া পরিবার কাঠামোর অনুসারী হয়ে পড়া। তাদের উশৃঙ্খল ও অযৌক্তিক জীবনযাপন পদ্ধতিকে ‘আধুনিক’ আখ্যা দিয়ে আমরা যখন তার চর্চা শুরু করে দেই, তখনই ইসলামের জীবন পদ্ধতি আমাদের সামনে সেকেলে হয়ে দাঁড়ায়। অথচ পাশ্চাত্যের এই আধুনিকতার দাবীদাররা বহু আগেই তাদের জীবন চর্চার ভ্রান্তির ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠেছে। তাদের উশৃঙ্খল জীবন পদ্ধতি কেবল পরিবার নয় সমাজ থেকে রাষ্ট্রপতি সর্বত্রই এক দুর্বিসহ বিশৃঙ্খলার জন্ম দিয়েছে। পরিবার কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা তারা এখন হাড়ে হাড়ে উপলদ্ধি করছে। অথচ ইসলাম দেড় হাজার বছর আগে যে পারিবারিক শৃঙ্খলা বিধান করে গেছে, তার আজো পরম সত্যের আলোকবর্তিকা হিসাবে পৃথিবীকে আলো বিকিরণ করে যাচ্ছে। কিয়ামত পর্যন্ত ইসলামের এই জীবন বাস্তবতা অক্ষুন্ন থাকবে। তাই আমাদের উচিত ভেঙ্গে পড়া সমাজের ভঙ্গুর আদর্শের চাকচিক্যকে আধুনিকতার মোড়কে বন্দী করে নিজেদেরকে বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত না করা। ইসলামের শ্বাশ্বত আদর্শে অবগাহিত হয়ে তারি আলোকে পারিবারিক জীবনকে সাজিয়ে তুলে ইহকাল এবং পরকালীন সুখ-শান্তির পথ সুগম করা। ইসলামের দিক নির্দেশনা আনুযায়ী আমরা ইতোপূর্বে পরিবারের অভিভাবক পুরুষের দায়িত্ব এবং কর্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
এবারে আমরা সংসারের সুখ-শান্তির নিশ্চয়তা বিধানকারিনী স্ত্রীর দায়িত্ব এবং কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করবো।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মহিলাদেরকে এক অসাধারণ ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধি কিংবা অশান্তি বা দুর্ভোগ এসবের অধিকাংশই নির্ভর করে নারীর ওপর। নারী ইচ্ছে করলে ঘরকে বানাতে পারে বেহেশত, আবার সে-ই ঘরকে পরিণত করতে পারে জ্বলন্ত দোযখে। একইভাবে নারী তার স্বামীকে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দিতে যেমন সাহায্য করতে পারে, তেমনি খুব সহজেই স্ত্রী পারে স্বামীকে দুর্ভাগ্যের অতল গহ্বরে পৌঁছে দিতে। নারীর এই বিশেষ ক্ষমতা বা গুন আল্লাহর দান। অতএব গুনের প্রয়োগ যথার্থ হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। অর্থাৎ নারীকে অবশ্যই তার এই গুন বা যোগ্যতাকে স্বামী ও সংসারের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। রাসূলে কারীম (সাঃ) বলেছেন, “যদি কোন মহিলা তার স্বামীর প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে সে আল্লাহর প্রতি তার কর্তব্যকেও পালন করেনি।” কতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এটি। পাশ্চাত্য চিন্তার অনুসরণে তথাকথিত আধুনিক নারীদের দায়িত্ববোধে এ ব্যাপারটি আপাত দৃষ্টিতে হাস্যকর বলে মনে হলেও পরিণতিতে তার চরম সত্যের রূপ পরিগ্রহ করে। যেসব নারী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে স্বামীর প্রতি নিজস্ব দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়ে, তাদের সংসার, পরিবার তথা জীবনের সুখ-শান্তি যে সুদূর পরাহত, তার প্রমাণ পাশ্চাত্যের ভেঙ্গে পড়া পরিবার কাঠামো। হযরত আলী (আঃ) বলেছেন, “একজন স্ত্রীলোকের জিহাদ হলো তার স্বামীকে ভালো রাখা।” এই ভালো রাখতে গেলেই স্ত্রীর ওপর বিচিত্র দায়িত্ব বর্তায়। এই দায়িত্ব পালনে স্ত্রীকে হতে হয় চটপটে ও চালাক-চতুর। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক অনুভূতি, সুরুচীবোধ এবং অকৃত্রিম ও অকপট আচরণের মাধ্যমে স্ত্রী তার স্বামীকে ভালো অর্থাৎ কাঙ্খিত লক্ষ্য নিয়ে যেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে স্ত্রীর প্রাথমিক কাজ হবে স্বামীর হৃদয়কে জয় করা এবং স্ত্রীর ওপর স্বামীর ভালোবাসা, আস্থা ও বিশ্বাস জাগিয়ে তুলে তাকে খারাপ কাজ থেকে কৌশলে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করা। ভালোবেসে পৃথিবী জয় করা যায়। ভালোবাসা বন্ধুত্বের সম্পর্ককে দৃঢ় করে। প্রতিটি মানুষই ভালোবাসা প্রত্যাশা করে। কারণ ভালোবাসাহীন মানুষ বড়ো একা-নিঃসঙ্গ এমনকি পরিত্যক্ত। তাই একজন স্ত্রী হিসাবে স্বামীকে যতোবেশী ভালোবাসা যাবে, ততোই পারস্পরিক সম্পর্ক হয়ে উঠবে মধুর ও সুখের। কারণ ভালোবাসা এমন একটি পরস্পরমুখী সম্পর্ক যা দুটি হৃদয়কে একত্রিত করে দেয়। এই ভালোবাসার প্রকাশ বিচিত্র। ভালোবাসা কেবল প্রকাশ্যে নয়, আন্তরিক হতে হবে। ঘরে-বাইরে সবখানেই তার অভিব্যক্তি হতে হবে অকৃত্রিম। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবার সামনেই স্বামীর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ স্বামীর প্রশংসা ও সৎগুনাবলীর ইতিবাচকতা তুলে ধরতে হবে। সব মিলিয়ে স্বামীর সাথে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে না উঠলে পরস্পরের প্রতি হৃদয়ের টান অনুভূত হবে না। আর দুটি হৃদয় যদি অভিন্ন না হয়, তাহলে সেখানে ভালোবাসা থাকে না। ভালোবাসা না থাকলে সংসারে বিরাজ করে অশান্তি। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন ও আকর্ষণকে শান্তি ও কল্যাণের উৎস হিসাবে প্রকাশ করেছেন এভাবে-”এবং তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে এই যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্যে সঙ্গীনি তৈরী করেছেন, যাতে করে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক দয়া ও ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল লোকদের জন্যে এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।” ইমাম রেজা (আঃ) বলেছেন, ‘কোন কোন স্ত্রীলোক তাদের স্বামীদের জন্যে আশীর্বাদস্বরূপ- যারা তাদের ভালোবাসা ও অনুগত্যকে প্রকাশ করে।’
মানুষের পারিবারিক জীবন একটা বহতা নদীর মত। নদীতে কখনও চর জাগে, কখনও ঝড় ওঠে। আর নিত্য জোয়ার ভাটাতো রয়েছেই। এই বিচিত্র উত্তাল তরঙ্গের মাঝে যথার্থভাবে টিকে থেকে নিজস্ব গন্তব্যে পৌঁছুতে হলে প্রয়োজন সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা। ইসলাম এ ক্ষেত্রে যে যুগান্তকরী নির্দেশনা দিয়েছে তা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষেরই জীবন-কল্যাণের জন্যে সুপ্রযুক্ত। ইসলামের এই জীবন বিধানের আলোকেই আমরা পরিবারের প্রধান দুটি স্তম্ভ স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক কর্তব্য নিয়ে কথা বলছিলাম। গত পর্বে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য সম্পর্কে খানিকটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছি। এবারের পর্বে আমরা তারি ধারাবাহিকতায় আলোচনা অব্যাহত রাখবো।
মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ। ফলে মানুষের বাহ্যিক যেই রূপ, তা তার নিজস্ব নয়, তা আল্লাহরই দান। তাই এই রূপ নিয়ে কারো গর্ব-অহঙ্কার করার কিছু নেই। অথচ দুঃখজনক ব্যাপার হলো অনেক সুন্দরী মহিলাই তাদের রূপের অহঙ্কারে বুঁদ হয়ে এমন সব অযৌক্তিক ও অপ্রত্যাশিত আচরণ করে বসেন, যা পারিবারিক কাঠামোকে নড়বড়ে করে দেয়। স্বামী যদি এরকম কোন সুন্দরী স্ত্রীর রূপশ্রীর তুলনায় পিছিয়ে থাকেন, তাহলে ঐ স্ত্রী কথায় কথায়, উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে স্বামীকে এমন অবমাননাকর ভাষায় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে থাকেন, যাতে স্বামীর জীবন হয়ে পড়ে দুর্বিসহ। স্ত্রীর কাছে উপেক্ষিত হয়ে সংসারের প্রতিই একরকম উদাসীন হয়ে পড়েন হতভাগ্য ঐ স্বামী। যার ফলে সংসার আর সংসার থাকে না, সংসার হয় মোটামুটি একটা অশান্ত দোযখে। এখন কথা হলো, স্বামী যদি স্ত্রীর কাছ থেকে নিরন্তর উপেক্ষার যন্ত্রণায় ভুগতে থাকে, তাহলে সংসারতো আর টিকবে না। তাই জীবনের প্রয়োজনে পারিবারিক শৃঙ্খলার প্রয়োজনে, স্ত্রীর উচিত গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে সুষ্ঠু একটা সিদ্ধান্ত নেয়া। ইসলাম যেকোন রকম সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা তাকে দিয়েছে। তবে স্ত্রী যদি অন্যায়ভাবে কোন সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সেজন্যে পরকালে তাকে আল্লাহর দরবারে জবাবদীহি করতে হবে। যাই হোক স্ত্রীর যেহেতু সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রয়েছে, সেহেতু স্বামীর সংসারে অবস্থান করে স্বামীকে অযথা উৎপীড়ন করার কোন মানে হয় না। কারণ কোন স্বামীই স্ত্রীর কাছ থেকে দুর্বিনীত আচরণ প্রত্যাশা করে না। স্বামীর সংসারে বসবাস করার অন্যতম দাবী হলো-দুটি জীবনকে একই স্রোতে প্রবাহিত করার প্রচেষ্টা চালানো। স্বামীর প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা প্রদান স্ত্রীর একটা প্রাথমিক দায়িত্ব। এটি হলো বিশাল সংসার বৃক্ষের বীজ। শ্রদ্ধা মেশানো ভালোবাসার মধ্য দিয়ে অনাবিল শান্তির ধারা বয়ে যায় জীবনে, সংসারে। স্বামীর প্রতি এই শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন স্ত্রীকে কখনো খাটো করবে না বরং উন্নততর জীবনে প্রবেশের যুদ্ধে স্ত্রীর এই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা স্বামীকে আরো শক্তি ও উৎসাহ জোগাবে।
কথার ভেতরে কথা বলা মানুষের একটা বদ-অভ্যাস। এই বদ-অভ্যাস ভদ্রতা বিরোধী। ব্যক্তিগত আচার-আচরণে এই গুনটিকে পরিহার করতে না পারলে ব্যক্তিত্বের প্রতি আঘাত আসতে পারে। ছোট-বড় সবার ক্ষেত্রেই এ বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রেও মৌলিক এই আচরণবিধিটি অনুসরণ করা উচিত। স্বামী যখন কোন কথা বলবে, তখন হুট করে তার কথার ভেতরে অন্যকোন প্রসঙ্গ টানা ঠিক হবে না। স্বামীর সাথে কথা বলার সময় বিনীতভাবে উচ্চকণ্ঠ পরিহার করা মঙ্গলজনক। এই বিনীত শ্রদ্ধাবোধের কারণে স্বামীও স্ত্রীর প্রতি সম্মানজনক আচরণ করতে বাধ্য হবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ফলে ঐ পরিবারে শান্তির সোনালী পরিবেশ বিরাজ করবে-যা সবারই আন্তরিক প্রত্যাশা। শ্রদ্ধা-সম্মান হতে হবে আন্তরিক। কৃত্রিম শ্রদ্ধা বা লোকদেখানো শ্রদ্ধায় কোন কল্যাণ নেই। নিজে যেমন স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধেয় মনোভাব পোষণ করবেন, তেমনি ছেলে-মেয়েদেরকেও বলতে হবে যেন বাবাকে শ্রদ্ধা করে। এটাই আন্তরিকতার বহি:প্রকাশ। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা পাড়া-প্রতিবেশীর সামনে স্বামীকে হেয় প্রতিপন্ন করে কথা বলা ঠিক নয়। সাময়িকভাবে তারা হয়তো আপনার বক্তব্যের প্রতি সমর্থন যোগাবে। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে তারাই আপনার সমালোচক হয়ে উঠবে। আর দুষ্টেরা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আপনাদের সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি করার চেষ্টা চালাবে। তাই স্বামীর ভালোগুনগুলোই তুলে ধরুন, এতে কল্যাণ রয়েছে।
মোটকথা স্বামীর প্রতি মনযোগী হোন, তার ভালো লাগা মন্দ লাগার ব্যাপারগুলোকে আবিস্কার করার চেষ্টা করুন, অমায়িক ব্যবহার করুন। সবসময় হাসিখুশী থাকার চেষ্টা করুন। হাসিমুখে কথা বলার চেষ্টা করুন। আপনার ক্লান্ত পরিশ্রান্ত স্বামী মানুষটিকে কাজের শেষে এক বুক অবসাদ নিয়ে যখন ঘরে ফেরে, তখন আপনার সুন্দর একটু হাঁসি তার সকল ক্লান্তি দূর করে দিতে পারে। দরজায় কলিংটা বাজতেই আপনি যদি গোমড়া মুখে দরজা খুলে দিয়ে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেন, তাহলে স্বামী মানুষটির ক্লান্তির ওপরে বাড়তি একটা টেনশন বা উদ্বেগ যুক্ত হবে। ফলে এরকম আচরণ না করে তার প্রতি সদয় ও বিনম্র আচরণ করুন। জগত সংসারে এমন অনেক নারী রয়েছেন, যারা তাদের অভিলাষ মেটাতেই ব্যস্ত থাকেন। এদের অধিকাংশই পরশ্রীকাতর হয়ে থাকেন। প্রতিবেশীদের ঘরে এটা আছে, সেটা আছে আমাদের কেন নেই-আমাদের অবশ্যই সেটা থাকতে হবে। স্বামীর আয় রোজগারের কথা না ভেবেই এরকম চিন্তা করেন। স্বামী যদি তাঁর আর্থিক সমস্যার কথা জানান, তাহলে উল্টো বলে বসেন-অন্যদের থাকলে তোমার কেন নেই, তুমি একটা বুদ্ধু, হাবা ইত্যাদি। এতে করে স্বামী পুরুষটি ভীষণভাবে মর্মাহত হন, হতাশায় ভোগেন। সব সময় তার মনে স্ত্রীর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের বিষয়টি কাজ করে। স্ত্রীর কাছে নিজেকে নতজানু মনে হতে হতে সকল আগ্রহ-উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলেন-যার পরিণতি খুবই অপ্রত্যাশিত। ফলে স্ত্রীদের উচিত পরশ্রীকাতরতা পরিহার করে স্বামীর আয় রোজগারে সন্তুষ্ট থেকে এমনভাবে আচরণ করা, যাতে স্বামী মানুষটি নিজে থেকেই অনুভব করে যে, “আমার স্ত্রীকে যদি অমুক জিনিসটা কিনে দিতে পারতাম।” একদিন ঠিকই দেখা যাবে তার অনুভূতি বাস্তব রূপ পেয়েছে। স্ত্রীও যে এতে মহা খুশী হবে-তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই আত্মতৃপ্তি আর সন্তুষ্টির ফলে দু’জনের পারস্পরিক ভালোবাসা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে। আর সংসার ভরে উঠবে সুখের সুরভিত আমেজে। সবশেষে ইমাম জাফর সাদেক (আঃ)এর একটি বাণী উদ্ধৃতি করছি। তিনি বলেছেন, “সেই রমনী সৌভাগ্যবতী ও সফল যে তার স্বামীকে শ্রদ্ধা করে এবং তাকে কখনো খাটো করে না।”
আপনার সংসারটা কি সত্যিই সোনালী নীড় ? এ প্রশ্নের যথার্থ উত্তর যদি মনে মনে ‘না’ বা নেতিবাচক হয়, তাহলে এ আলোচনা আপনার জন্যে। আর প্রশ্নের জবাবটি যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলেও আলোচনা আপনার জন্য, কারণ এ আসর আপনাকে ব্যক্তিগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এছাড়া যারা এখনো সংসার জীবনে প্রবেশ করেননি, তবে করতে যাচ্ছেন, এ আলোচনা তাদের জন্য-কারণ এ আসর আপনাকে পারিবারিক কাঠামোয় প্রবেশের প্রস্তুতি নিতে যথার্থ দিক-নির্দেশনা দেবে।
একটি হাদিস উদ্ধৃত করার মাধ্যমে আজকের আলোচনা শুরু করবো।
রাসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন, “যে স্ত্রী তার স্বামীকে জিহবা দিয়ে তাড়না করে, তার প্রার্থনা আল্লাহ শোনেন না, যদিও সে প্রতিদিনই রোজা রাখে, প্রতি রাতেই নামাজের জন্যে জাগে, কোন দাস-দাসীকে মুক্ত করে দেয় এবং আল্লাহর পথে তার সম্পদ ব্যয় করে। মুখরা স্ত্রী যে তার স্বামীকে এভাবে কষ্ট দেয়, সে-ই দোযখে প্রথম প্রবেশ করবে।”
আসলে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কটি এতো আন্তরিক ও ভালোবাসার যে, সেখানে সামান্যতম বিচ্যুতি দেখা দিলে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, ঘৃণা ও বিরাগ এসে ভর করে। আর এই বিচ্যুতির সূচনা ঘটে আচার-আচরণ ও কথা-বার্তার মাধুর্যহীনতা থেকে। সবারই উচিত সব সময় হাসিখুশী থাকা, আনন্দমুখর থাকা। নম্র, ভদ্রভাবে হাসিমুখে কথা বললে অনেক কঠিন পরিস্থিতিও খুব সহজেই মোকাবেলা করা সম্ভব। উচ্চাভিলাষী নারীদের মধ্যে অনেক সময় অতৃপ্তির অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যায়। এই অভিব্যক্তি তাদের স্বামীদের মনোপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্বামীরা সাধারণত স্ত্রীদের সন্তুষ্টি, সংসারের কল্যাণ এসবের জন্যে নিজেদের সকল শ্রম ও মেধা ব্যয় করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও পেশাভেদে উপার্জনগত তারতম্য থাকতেই পারে। এই তারতম্যের বিষয়টিকে যদি ইতিবাচক বা সমার্থক হিসাবে ধরে নিয়ে মেনে নেয়া যায়, তাহলে কিন্তু আর সমস্যা থাকে না। কিন্তু যখনি তা অন্যদের সাথে তুলনা করা হয়, তখনি দেখা দেয়া বিরুপতা। তাই স্বামী-সন্তান, পরিবার-সংসারের বৃহত্তর স্বার্থে সামর্থ অনুযায়ী বিবেচনা করাই উত্তম। স্বামীর ব্যাপারেও স্ত্রীদের সহানুভূতিশীল হওয়া প্রয়োজন। কর্মক্লান্তি নিয়ে তিনি যখন বাসায় ফেরেন, তখন তার সাথে আন্তরিক আচরণ করা উচিত। কোন অভাব-অভিযোগ বা নেতিবাচক বিষয় হুট করেই তার সামনে উপস্থাপন করা ঠিক নয়। স্বামী বাসায় ফেরার পর স্ত্রীদের উচিত এমন আচরণ করা, যাতে বোঝা যায় যে, তার আগমনে আপনি ভীষণ খুশী ও আনন্দিত হয়েছেন। কিংবা এমন বোঝা যায় যে, আপনি তার জন্যেই এতোক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। ধীরে ধীরে অবস্থা বুঝে সংসার, সন্তান ও ব্যক্তিগত সকল বিষয়ে আলাপ করুন। সমস্যা সমাধানে পরস্পরকে সহযোগিতা করাই স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য।
ইমাম সাদিক (আঃ) বলেছেন, ” আনন্দময় জীবনের চাইতে আর কোন জীবনই কাম্য নয়”। এই উক্তির সত্যতা ও যথার্থতা অনস্বীকার্য। দেখা গেছে, অনেক ধনী লোক তার সকল সম্পদ নিয়েও অশান্তিতে রয়েছেন। তার কারণ ধন-সম্পদের প্রতিযোগিতায় তারা যতো আন্তরিক, সুখ-শান্তির অন্বেষায় ততোটা নন। আবার তার বিপরীতে দেখা যায়, অভাব-অনুযোগ সত্ত্বেও বহু দম্পতি সুখে-শান্তিতে দিনাতিপাত করে যাচ্ছে। ফলে এ কথাটি বুঝতে হবে যে, সম্পদের প্রাচুর্যে শান্তি নেই, শান্তি হলো মনে। মনের প্রশান্তিই সাংসারিক ও দাম্পত্য জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি। তাই সম্পদের প্রতিযোগিতায় অন্ধ হয়ে অন্যদের সাথে তুলনা করে পরশ্রীকাতরতায় না ভুগে যা আছে তাই নিয়ে আনন্দ উপভোগ করাই হবে যুক্তিযুক্ত। মনে রাখতে হবে যারা প্রাচুর্যের সন্ধানেরত, তাদের প্রত্যাশা সীমাহীন। কোনভাবেই এই প্রত্যাশা মিটবে না। আর সামান্যতম কম প্রাপ্তি বা অচরিতার্থতায় প্রাচুর্যকামীরা ভেঙ্গে পড়েন। এ থেকেই জন্ম নেয় হিংসা, রাগ, বদমেজাজসহ সমূহ চারিত্রিক অসৎ গুনাবলী। কোন কিছুতেই তখন আর মনের তৃপ্তি মেটেনা। মেজাজ সব সময় তিরিক্ষি হয়ে থাকে। রাসূলে কারীম (সাঃ) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, মানুষের বদমেজাজ ও মনোভাব স্থায়ী যন্ত্রণা ও ভোগান্তির সৃষ্টি করে।” অথচ সদ্ব্যবহার, সদাচরণ, সামর্থে-তুষ্টির মনোভাব মানুষকে সর্বাবস্থায়ই সন্তুষ্টিই রাখে। আর এই সন্তুষ্টিই হলো মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি। ইমাম সাদিক (আঃ) যথার্থই বলেছেন, ” সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা সদ্ব্যবহারকারীদের জন্যে জিহাদের সমান পুরস্কার রেখেছেন। তার প্রতি দিনে ও রাতে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে।”
স্বামীদের উপর সংসারের একটা বিশাল চাপ ও দায়িত্ব থাকে। এ দায়িত্ব পালনে সবসময় হয়তো তিনি সফল না-ও হতে পারেন। তাই বলে তার ব্যর্থতার জন্য তাকে বকা-ঝকা করা কিন্তু ঠিক নয়। বরং তাকে সান্ত্বনা ও প্রবোধ দেয়া উচিত। কারণ জীবন নির্বাহের বোঝা বহন করার জন্য কিংবা বোঝা বহন করার পর, এমন একজন সহানুভূতিশীল বন্ধু প্রয়োজন যে তার প্রতি মনোযোগ হবে। তার কাজ-কর্মের ব্যাপারে ধন্যবাদ দেবে, উৎসাহ যোগাবে। এই কাজগুলো যার পক্ষে সবচেয়ে বেশী সম্ভব তিনি হলেন তার স্ত্রী। স্ত্রীর বন্ধুত্বসুলভ সান্নিধ্য ও ভালোবাসাই স্বামীর সকল ক্লান্তি, অবসাদ ও দুর্ভাবনা দূর করে দিতে পারে সহজেই।(সংগৃহীত)

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)