আল হাসানাইন (আ.)

অত্যাচারিতদের সাহায্য করা

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5
অত্যাচারিতদের সাহায্য করা
মূল আরবী থেকে মো. মুনীর হোসেন খান কর্তক অনূদিত
ইসলাম এমন এক জাতির মধ্যে আবির্ভূত হয়েছিল যেখানে অন্য সকল নৈতিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি জুলুম পূর্ণ মাত্রায় বিরাজ করত। শক্তিধর, অভিজাত ও শাসক সম্প্রদায় সমাজের সাধারণ, নিরীহ ও দুর্বল জনগণের ওপর যত জুলুম করতে পারত তারা ততই জুলুম করত এবং তাদেরকে নিজেদের সামনে অবনত থাকতে বাধ্য করত। আবার কিছু সংখ্যক লোক ভয়-ভীতি ও অন্যান্য কারণে নীরব থাকত এবং তাদের এ নীরবতা প্রকৃতপক্ষে ঐ সব জালেমের কার্যকলাপের সমর্থন বলেই গণ্য হতো।
ইসলাম ধর্ম জালেমদের তিরষ্কার ও নিন্দা করা, তাদের ওপর অভিশাপ দেয়া এবং তাদের মহান আল্লাহর রহমত থেকে দূরে বলে গণ্য করা ছাড়াও যারা অন্যায়-অত্যাচারের সামনে প্রতিবাদ না করে নীরব থেকেছে, এবং মজলুমদের সাহায্যও করেনি তাদের কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করেছে এবং মহান আল্লাহর কঠিন  শাস্তির  ভয় দেখিয়েছে।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন,
 “যে ব্যক্তি কোন মুমিনকে জালেমের হাত থেকে রক্ষা করবে মহান আল্লাহ তার জন্য কিয়ামত দিবসে একজন ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যে তাকে দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করবে।”১
ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন,
 “যখন কোন মুসলিম শক্তি ও সামর্থ্য রাখা সত্ত্বেও নিজের মুসলিম ভাইকে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকে তখন মহান আল্লাহও দুনিয়া ও আখেরাতে তাকে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকবেন।”২
ইসলাম ধর্মের বক্তব্য হচ্ছে, অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করো এবং অত্যাচারিতদের সাহায্য কর।
আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (আ.)-কে উপদেশ দিয়ে বলেছেন,
كونا للظالم خصماً و للمظلوم عَوْناً
“তোমরা অত্যাচারীদের শত্রু এবং অত্যাচারিতের বন্ধু ও সাহায্যকারী হও।”৩
ইমাম সাদেক বলেছেন,
ما مِن مؤمنٍ يُعينُ مؤمناً مظلوماً إلّا كان أفْضَلَ مِن صيامِ شهرٍ و اعْتكافِه في المَسْجِدِ الحرام
“যখন কোন মুমিন কোন অত্যাচারিত মুমিনকে সাহায্য করে তখন তার এ কাজটি এক মাস রোযা রাখা এবং মসজিদুল হারামে ই‘তিকাফ করার চেয়েও উত্তম।”৪
ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন, “একজন ঈমানদার লোক এক জালেম বাদশার রাজ্যে বাস করত। ঐ বাদশাহ্ মুমিন অধিবাসীদের অশেষ কষ্ট দিত। মুমিন ব্যক্তি ঐ অত্যাচারী বাদশার রাজ্য থেকে পালিয়ে একটি কাফের দেশে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় এবং ঐ দেশে এক কাফেরের ঘরে বসবাস করতে থাকে। আশ্রয়দাতা মুশরিক ব্যক্তি তাকে অনেক সম্মান দিতে থাকে এবং তাকে লুকিয়ে রাখে। ঐ আশ্রয়দাতা কাফেরের মৃত্যুর সময় নিকটবর্তী হলে মহান আল্লাহ তার কাছে ইলহাম করে বললেন : আমি আমার সম্মান ও মহত্ত্বের শপথ করে বলছি! বেহেশ্তে যদি কাফেরদের স্থান থাকত তাহলে আমি তোমাকে সেখানে স্থান দিতাম, কিন্তু কাফেরদের জন্য বেহেশ্ত হারাম। তাই হে দোযখের আগুন! একে ধর কিন্তু কষ্ট দিও না।”৫
ইমাম সাদেক (আ.) অপর এক বাণীতে অত্যাচারিতদের সাহায্য করার ব্যাপারে স্পষ্ট বলেছেন,
لأن نصرة المؤمن على المؤمن فريضة واجبة
“(জালেমের মোকাবিলায়) অত্যাচারিত মুসলমানকে সাহায্য করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরয।”৬
ক্ষমা ও উদারতা
কিছু সংখ্যক ব্যক্তি নিজেদের শত্রু ও বিরোধীদের দমন এবং তাদের নিশ্চি‎হ্ন করার জন্য যে কোন ধরনের উপায়-উপকরণ ও মাধ্যম ব্যবহার করতে কুণ্ঠাবোধ করে না এবং মন্দ আচরণের প্রত্যুত্তর মন্দ আচরণ দিয়েই দিয়ে থাকে। তবে ইমাম আলী (আ.) বলেছেন,
 “নিজ ভাইকে উপকার ও মহানুভবতা দিয়ে সাজা দাও এবং তার অনিষ্ট ও অমঙ্গলকে তার ওপর অনুগ্রহ প্রদর্শনের মাধ্যমে বিদূরিত করে দাও।”৭
অর্থাৎ কারো স্খলন ও দোষত্রুটি ক্ষমা করা আসলে ঐ দোষ ও স্খলনটির বারবার সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দানের সর্বোত্তম পন্থা। তাই পবিত্র কোরআনে মুত্তাকী বান্দাদের বৈশিষ্ট্যসমূহের ব্যাপারে বলা হয়েছে :
الذين ينفقون في السّراء و الضّرّاء و الكاظمين الغيظ و العافين عن الناس و الله يحب المحسنين
“যারা সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় দান করে, নিজেদের ক্রোধ সম্বরণ করে এবং মানুষের দোষ-ত্রুটি ও স্খলন ক্ষমা করে দেয়। আর নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ সৎ কর্মশীল ও পরোপকারীদের ভালবাসেন।”৮
পবিত্র কোরআনে মুসলমানদের নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে :
 “এবং যেন তারা ক্ষমা করে দেয় এবং উপেক্ষা করে (ছোটখাটো দোষ-ত্রুটি যেন না ধরে), তোমরা কি এটি পছন্দ করো না যে, মহান আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দিন। মহান আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু।”৯
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :
فمن عفا و اصلح فأجره على الله ...
“অতঃপর যে ব্যক্তি ক্ষমা করবে এবং সন্ধি করবে তার এ কাজের প্রতিদান তো মহান আল্লাহর কাছে আছে (অর্থাৎ এ কাজের প্রতিদান ও পুরস্কার মহান আল্লাহ প্রদান করবেন)”...।১০
ক্ষমা ও মানুষের ছোট-খাটো দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করা এমন সব গুণের অন্তর্ভুক্ত যা এ পার্থিব জগৎ এবং আখেরাতে সফলতা ও সৌভাগ্যের জামানতদার।
মহানবী (সা.) বলেছেন,
 “আমি কি তোমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের সর্বোত্তম মঙ্গল ও কল্যাণের সন্ধান দেব? যে তোমার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করবে তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবে, যে তোমাকে বঞ্চিত করবে তাকে তুমি প্রদান করবে এবং যে তোমার ওপর অত্যাচার করবে তাকে তুমি ক্ষমা করবে।”
ইমাম জাফর সাদেক বলেছেন, “মহানবী (সা.) বলেছেন :
তোমাদের উচিত ক্ষমা করা। কারণ ক্ষমা কেবল বান্দার সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করে; তাই তোমরা পরস্পরকে ক্ষমা করে দাও, তাহলে মহান আল্লাহও তোমাদের সম্মানিত করবেন।”
আর একটি বিষয় এখানে স্মরণ রাখা উচিত যে, ক্ষমা ঐ সময় গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যমণ্ডিত হবে যখন প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা ও শক্তি অর্জিত হবে। আর ঐ ব্যক্তি ক্ষমা করতে সক্ষম যে (প্রতিশোধ গ্রহণের) শক্তি ও সামর্থ্য রাখে।
ইমাম আলী (আ.) বলেছেন,
 “যখন তুমি তোমার শত্রুর ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করতে সক্ষম হবে তখন তার ওপর (প্রতিশোধ গ্রহণের) শক্তি ও ক্ষমতা অর্জনের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাকে ক্ষমা করে দাও।”১১
ইমাম আলী (আ.) বলেছেন,
 “ঐ ব্যক্তি ক্ষমা করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযুক্ত যে শাস্তি প্রদান করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সামর্থ্যবান।”১২
ইমাম সাদেক (আ.)-এর নিম্নোক্ত বক্তব্য থেকে আমরা ক্ষমা করার অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি। তিনি বলেছেন,
 “নিশ্চয়ই আমরা মহানবীর আহ্লে বাইত এমন এক পরিবার, যারা আমাদের ওপর অত্যাচার করেছে তাদের ক্ষমা করে দেয়াই হচ্ছে আমাদের বৈশিষ্ট্য।”১৩
ইমাম সাদেক বলেছেন,
العَفْوُ عند القُدرةِ مِنْ سنَنِ المرسلين و المتقين
“(প্রতিশোধ গ্রহণের) ক্ষমতা ও শক্তি থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা করে দেয়া হচ্ছে মহান নবী ও মুত্তাকী বান্দাদের সুন্নাহ্।”১৪


তথ্যসূত্র

  ১.     জামেউস্ সাআদাত, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২১।
  ২.     বিহারুল আনওয়ার, ১৫শ খণ্ড, কিতাবুল ইশরাহ্, পৃ. ১৩১।
  ৩.     নাহজুল বালাগাহ্, পৃ. ৯৬৮।
  ৪.     বিহারুল আনওয়ার, ১৫শ খণ্ড, কিতাবুল ইশরাহ্, পৃ. ১২৩।
  ৫.     উসূলে কাফী, পৃ. ৪০৩।
  ৬.     বিহারুল আনওয়ার, ১৫শ খণ্ড, কিতাবুল ইশরাহ্, পৃ. ১২৩
  ৭.     নাহজুল বালাগাহ্, পৃ. ১১৫৫।
  ৮.     সূরা আলে ইমরান : ১৩৪।
  ৯.     সূরা নূর : ২২।
১০.    সূরা শুরা : ৪০।
১১.     নাহজুল বালাগাহ্, পৃ. ১০৮২।
১২.     নাহজুল বালাগাহ্, পৃ. ১১০২।
১৩.     ওয়াসাইলুশ শিয়া, ২য় খণ্ড, পৃ, ২২৪।
১৪.     সাফীনাতুন বিহার সাফীনাতুল বিহার, ২য় খণ্ড, পৃ. ২০৭।
সূত্র: জ্যোতি ১ম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)