আল হাসানাইন (আ.)

নারী বৈষম্য রোধে কনভেনশন

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5
পৃথিবীর সৃষ্টি থেকেই জীবনযাত্রায় নারী-পুরুষ পরস্পরের সঙ্গী,সহযাত্রী। আজকাল অবশ্য পারিবারিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার বিষয়টি আর কারো কাছেই অস্পষ্ট নেই। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কনফারেন্স বা ঘোষণায় নারী একটি বিশ্বজনীন বিষয় হিসেবে গুরুত্ব পেয়ে আসছে। উদাহরণস্বরূপ ‘নারীদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার বৈষম্য রোধ সংক্রান্ত কনভেনশনের' কথা উল্লেখ করা যায়। ১৯৭৯ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে নারী-পুরুষের সমানাধিকার বাস্তবায়ন এবং বিভিন্ন দেশে নারী সংক্রান্ত আইন-কানুন একই রকম করার লক্ষ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের পক্ষ থেকে ঐ কনভেনশনটির আয়োজন করা হয়।  
নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য রোধ সংক্রান্ত কনভেনশনে একটি ভূমিকা এবং ত্রিশটি ধারা রয়েছে। ধারা নম্বর এ্যাকে রয়েছে ‘নারীদের ব্যাপারে বৈষম্য মুছে ফেলা'র কথা। এই বৈষম্য বলতে বোঝানো হয়েছে নারীকে লৈঙ্গিক মানদণ্ডে বিচার করা যাবে না অর্থাৎ নারী বলে তার ব্যাপারে কোনোরকম সীমাবদ্ধতা আরোপ করা কিংবা তাকে আলাদা করে বিবেচনা করা ইত্যাদি সর্বপ্রকার প্রভেদরেখা মুছে ফেলতে হবে। দুই থেকে ষোলো নম্বর ধারা পর্যন্তও সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত জাতিসংঘের অনেক সদস্য ঐ কনভেনশনটি গ্রহণ করেছে। অবশ্য এই কনভেনশনের কোনো কোনো ধারা ইসলামী নীতিমালা ও নৈতিক মূল্যবোধের সাথে খানিকটা সাংঘর্ষিক। এ কারণে এখনো মুসলিম অমুসলিম বহু দেশ এই নীতিমালা গ্রহণ করেনি কিংবা শর্তসাপেক্ষে গ্রহণ করেছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান এই কনভেনশনের বেশ কিছু ধারা বিশেষ করে এক থেকে ষোলো নম্বর ধারা পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। এই ধারাগুলো কোরানের শিক্ষা, ইসলামী আইন এবং ইরানের সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাছাড়া ইরানের সংবিধান ইসলামী চিন্তাদর্শ বা ইসলামী সরকার ব্যবস্থায় নারীর অধিকার ও মর্যাদা অনেক উর্ধ্বে। এই নীতিমালায় ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে নারীকে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। ইরানের সংবিধান অনুযায়ী নারী কোনো পণ্য বস্তু নয় বরং মাতৃত্বের মতো গুরুদায়িত্ব পালন এবং পরিবারে তার প্রধান ভূমিকা বা দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নেওয়ার কারণে নারীর স্থান এবং মর্যাদা অনেক উর্ধ্বে। তবে বিভিন্ন দেশ যে ঐ কনভেনশনের বিরোধিতা করছে তা বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং জাতীয় স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক হবার কারণেই করছে। কোনো একটি দেশ যখন কোনো আইন বা চুক্তি সম্পাদন করে তখন অবশ্যই কয়েকটি বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে। সবার আগে দেখে ঐ চুক্তিটা দেশের স্বার্থের অনুকূলে কি না; কিংবা দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না। সাধারণত যে-কোনো দেশেরই নিয়ম-কানুন বা বিধি-বিধান সেদেশের চিন্তাদর্শ ও মূল্যবোধের ভিত্তিতেই বিন্যস্ত হয়। পশ্চিমা দেশগুলোর চিন্তাধারা ও মূল্যবোধগুলোসহ আন্তর্জাতিক বহু নিয়ম-নীতিই লিবারেলিজম বা উদারনৈতিকতাবাদ অনুসৃত। তাই এই কনভেনশনের মৌলিক ধারাগুলো স্বাভাবিকভাবেই লিবারেলিজম বা উদারনৈতিকতাবাদের প্রভাবে প্রভাবিত। আর এজন্যেই নিঃসন্দেহে এই কনভেনশনের বহু ধারা মুসলিম দেশগুলোর চিন্তা-চেতনা বা আদর্শিক ব্যবস্থার পরিপন্থী।
নারীর ব্যাপারে বৈষম্য রোধ সংক্রান্ত কনভেনশন পারিবারিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। নিঃসন্দেহে পরিবার ব্যবস্থা হলো সমাজ ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। মূল্যবোধ এবং অবস্থানের দিক থেকে পরিবার ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব অনস্বীকার্য। অথচ এই কনভেনশন নারী-পুরুষকে স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে এবং পরস্পর-বিমুখ সত্ত্বা হিসেবে দেখিয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নারী-পুরুষের পারস্পরিক অঙ্গীকারগুলোকে ম্লান করে দেয় এবং পারিবারিক ব্যবস্থার ভিত্তিগুলোকে দুর্বল করে দেয়। নারীর ব্যাপারে বৈষম্য রোধ সংক্রান্ত কনভেনশন গুরুত্বের সাথে নারী-পুরুষের মধ্যকার অসাম্য দূর করার ব্যাপারে কথা বলেছে। কনভেনশন অনুযায়ী নারীদের ব্যাপারে সর্বপ্রকার বৈষম্য দূর করতে হবে এবং অধিকারের প্রশ্নে নারীদেরকে পুরষের সমান মর্যাদা দিতে হবে। এই কনভেনশন লৈঙ্গিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে নারী-পুরুষের মধ্যকার যে-কোনো রকমের ভেদাভেদকে বৈষম্য বলে মনে করে এবং সেগুলোকে দূর করার পক্ষে।
নারী-পুরুষকে সমান মনে করার বিষয়টি পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে উঠে এসেছে। যারা নারী-পুরুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রবক্তা তাদের বিবেচনায় সৃষ্টি ব্যবস্থায় এই দুটি সত্তার অস্তিত্ব ও ভূমিকার ব্যাপারে ভুল করা হয়েছে। ঐ প্রবক্তারা নারী-পুরুষের মাঝে সাম্য বা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। পশ্চিমা বিশ্বে সমতার শ্লোগানে নারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নারী-পুরুষের সাম্যের অজুহাতে পারিবারিক দায়-দায়িত্ব সমানভাবে তাদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে উভয়ের শারীরিক বা মানসিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে বিবেচনা করা হয় নি। এর ফলে নারীরা বাধ্য হয়েছে সমাজে তাদের অবস্থান সৃষ্টি করার জন্যে কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়তে। আর এই কর্মযজ্ঞে নেমে পড়ায় পুরুষের তুলনায় নারীরাই শারীরিক এবং মানসিকভাবে বেশি ভেঙ্গে পড়েছে। এই বিষয়টি বহু চিন্তাবিদ এমনকি পোস্ট মডার্ন ফেমিনিস্টরাও স্বীকার করেছে। তারা বলতে বাধ্য হয়েছে, নারী-পুরুষের মধ্যকার সমতা বিধানের চিন্তা তাদেরকে তাদের যথার্থ অবস্থানে স্থাপিত করতে পারে নি বরং এই ব্যবস্থাটা তাদের উভয়ের বিরুদ্ধেই জুলুম এবং অন্যায় হিসেবে পরিগণিত।
আর এখানেই লিবারেলেজমের সাথে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যটি স্পষ্ট হয়ে যায়। পশ্চিমারা নারী-পুরুষের মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তার কারণটা হলো নারী-পুরুষকে তারা সার্বিক দিক থেকেই সমান বলে মনে করে। অথচ ইসলামে নারী এবং পুরুষ মানবিক পরিচয়ের দিক থেকে সমান,যার ফলে মানবীয় পূর্ণতায় পৌঁছা কিংবা জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক মর্যাদা অর্জনের ক্ষেত্রে উভয়ই সমান। তবে সৃষ্টিব্যবস্থার স্বাভাবিক নিয়মে তাদের নিজ নিজ ভূমিকায় যেহেতু পার্থক্য রয়েছে, সেহেতু নারী এবং পুরুষ উভয়ই ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। সেজন্যেই নারী এবং পুরুষ কেবল যে শারীরিক দিক থেকেই আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তাই নয় বরং অনুভূতি, মন-মানসিকতা, আত্মা, আচার আচরণ ইত্যাদি বিচিত্র দিক থেকেও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। বলা বাহুল্য বৈশিষ্ট্যগত এই পার্থক্যের কারণে কিন্তু কারো ওপর কারো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে এই পার্থক্যগুলো নারী-পুরুষের মাঝে সম্পর্কের উৎস। তারা পরস্পরের পরিপূরক। আর একের প্রতি অপরের প্রয়োজনীয়তা বা চাহিদাই হলো মানুষের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্কের মূল উপাদান। নারী পুরুষও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়।
মার্কিন বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী জন গ্রে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ men are from mars, women are from venus অর্থাৎ ‘ভেনাসের নারী,মঙ্গলের পুরুষ'-এ বলেছেন নারী এবং পুরুষের মাঝে টানাপোড়েন কিংবা দ্বন্দ্ব তখন থেকেই দেখা দিয়েছে যখন থেকে তারা তাদের মধ্যকার পার্থক্যকে ভুলে গেছে।
১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত বেইজিং সম্মেলনে নারী-পুরুষের সমতা বিষয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও প্রতিবাদ হয়েছিল। কনভেনশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বহু দেশের প্রতিনিধি সম্মেলন ত্যাগ করেছিল। কানাডীয় পার্লামেন্ট সদস্য মিসেস শ্যারন হিয অধিবেশন ত্যাগ করে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেনঃ আমাদের উচিত নারী-পুরুষের মধ্যকার পার্থক্যকে রক্ষা করা, যেমনটি সৃষ্টি জগতে বিরাজমান। কেননা এই পার্থক্যই আমাদেরকে রক্ষা করবে। মিসেস শ্যারন আরো বলেন, ‘কানাডার নারীদের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে নারী-পুরুষের এই সমতা নিয়ে বিতর্ক। নারীরা এখন নিরর্থক কাজের জগতে প্রবেশ করেছে। তার পরিণতি দাড়িয়েঁছে এইঃ আমার স্বামী আট ঘণ্টার কাজ সেরে বাসায় ফিরে বিশ্রাম নেয়, আর আমি তার দ্বিগুণ কাজ করি। অথচ আমার পারিশ্রমিক তার অর্ধেক।'
পাঠক! আলোচনার পরিসমাপ্তি টানবো ইরানের সবোর্চ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর বক্তব্যের একটি উদ্ধৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে। তিনি বলেছেনঃ ‘নারী হওয়াটা নারীর জন্যে খুবই উচ্চ মর্যাদার একটা বিষয়। পুরুষের সাথে সাযুজ্য খোঁজার মধ্যে নারীর জন্যে কোনোরূপ মর্যাদা বা সম্মান বয়ে আনবে না, যেমনটি পুরুষের জন্যেও মর্যাদাকর নয় নারীর সাথে সাদৃশ্য খোঁজার মাঝে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভূমিকা, অবস্থান এবং বৈশিষ্ট্য রয়েছে।...আমরা মনে করি নারী পুরুষ উভয়ই মানুষ এবং তাদের জন্যে পূর্ণতায় পৌঁছার ক্ষেত্র উন্মুক্ত। আল্লাহর দিকে যে যতোটুকু অগ্রসর হবে, যে যতোটা চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাবে সে ততোটুকুই উন্নতি করবে এবং পূর্ণতা লাভ করবে।' (সূত্র:ইন্টারনেট)

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)