আল হাসানাইন (আ.)

পরোপকার

1 বিভিন্ন মতামত 01.0 / 5
আল হাসানাইন (আ.)এমন অনেক সমস্যা আছে যা একা কোন ব্যক্তির পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। তবে তার সাথে যদি এক বা একাধিক ব্যক্তির শ্রম ও প্রচেষ্টা জড়িত হয় তাহলে ঐ সব সমস্যার সমাধান সহজসাধ্য হয়ে যায়। মূলত মানব জীবন পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতা ব্যতীত একদম অর্থহীন এবং তা পাশবিক জীবনে পরিণত হতে বাধ্য।     
 এ কারণেই ইসলাম অত্যন্ত জোরালোভাবে মুসলমানদেরকে তাদের দ্বীনী ভাইদের জরুরী প্রয়োজনাদি মেটানোর জন্য সাহায্য এবং তাদেরকে সমস্যা মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে একা না রাখার নির্দেশ দিয়েছে। ইসলাম মানুষকে সর্বোচ্চ মানবিকতা, সহমর্মিতা ও মহানুভবতার শিক্ষা দিয়েছে। এ উদ্দেশ্যে আল্লাহ দয়া ও সহমর্মিতার প্রতীক হিসেবে তাঁর নবীকে প্রেরণ করেন । আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, ‘‘আর আমি আপনাকে বিশ্বজগতের জন্য অনুগ্রহস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’’(সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭)

অনাহারীর কষ্টে সমব্যথী হতে আল্লাহ তা‘আলা রমযান মাসে সিয়াম ফরয করেছেন। দুঃখীর অভাব মোচনে যাকাত ফরয ও সাদাকুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন। দান-সদকা ও অন্যের জন্য খরচে উদ্বুদ্ধ করে বেশকিছু আয়াত নাযিল হয়েছে। যেমন-
‘কে আছে যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ (কর্জে হাসনা) দেবে,তা হলে তিনি তার জন্য একে বর্ধিত করে দিবেন এবং তার জন্য সম্মানজনক প্রতিদানও রয়েছে’ (সূরা আল-হাদীদ, আয়াত : ১১)

‘যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ খরচ করে,কিন্তু রটনা করে না (দানের খোঁটা দেয় না),আর না (যাকে দান করেছে তাকে) কষ্ট দেয়, তাদের প্রতিদান (ও সওয়ার) প্রতিপালকের কাছে আছে; আর না (পরকালে) তাদের কোন ভয় থাকবে, আর না তারা দুঃখিত হবে।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ২৬২)

‘যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের দৃষ্টান্ত সেই বীজের মত যা থেকে সাতটি শীষ উৎপন্ন হল (এবং) প্রত্যেক শীষে একশ করে দানা হল, এবং আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা করেন আরও বৃদ্ধি করে দেন। এবং আল্লাহ অতিশয় প্রাচুর্যদাতা, সর্বজ্ঞানী।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ২৬১)

‘নিশ্চয় দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, যেক্ষেত্রে তারা (বিশুদ্ধ অভিপ্রায়ে) আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান করে তাদের প্রতিদান বর্ধিত করা হবে এবং তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান।’ (সূরা আল-হাদীদ, আয়াত : ১৮)

‘ সুতরাং তোমরা আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় কর এবং (তাঁর কথা) শ্রবণ কর ও (তাঁর) আনুগত্য কর এবং (তাঁর পথে) ব্যয় কর; এতেই তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে। যারা তাদের আত্মার কৃপণতা (স্বার্থপরতা ও লোভ) হতে মুক্ত, তারাই সফলকাম।  যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণদান কর তবে তিনি তোমাদের জন্য তা বৃদ্ধি করবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন; আর আল্লাহ অতিশয় গুণগ্রাহী, পরম সহনশীল’ (সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত : ১৬-১৭)

‘আর নামায প্রতিষ্ঠা কর এবং যাকাত প্রদান কর, আর আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। তোমরা তোমাদের আত্মার জন্য যা কিছু কল্যাণ পূর্বে প্রেরণ করবে কেবল তা-ই তোমরা আল্লাহর নিকট উৎকৃষ্টতর রূপে এবং (তার) প্রতিদান মহত্তররূপে পাবে।’ (সূরা আল-মুযযাম্মিল, আয়াত : ২০)

 প্রখ্যাত সাহাবী জাবির ইবন আবদুল্লাহ রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে কখনো কাউকে ‘না’ বলেননি। তাঁর বদান্যতা,পরোপকার, মানবসেবা ও সমাজকল্যাণে অবদানের অসংখ্য দৃষ্টান্ত ইতিহাস ও হাদীস গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ হয়েছে। মানব সেবায় গুরুত্বারোপ এবং এতে উদ্বুদ্ধ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসংখ্য বাণী উচ্চারণ করেছেন,নিম্নে স্বল্প পরিসরে তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হল।


মহানবী (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মুসলমানদের স্বার্থ ও বিষয়াদি নিয়ে মোটেও চিন্তা-ভাবনা করে না সে মুসলমানই নয়। আর ঐ ব্যক্তিও মুসলিম নয় যে এক মুসলমান ভাইয়ের সাহায্যের আবেদনে সাড়া দেয় না এবং তাকে সাহায্য করতে অগ্রসর হয় না।”      
ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন,  যদি কোন ব্যক্তির কাছে তার মুমিন ভাই প্রয়োজন ও অভাব মেটানোর জন্য সাহায্য প্রার্থনা করে আর তার সামর্থ্য ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সে তাকে সাহায্য না করে তাহলে মহান আল্লাহ্ তাকে এমন এক বিপদে জড়িত করবেন যেন সে আমাদের (আহলে বাইতের) কোন শত্রু “কে সাহায্য করেছে বা করছে এবং এ কারণে মহান আল্লাহ্ তার ওপর শাস্তি (আজাব) অবতীর্ণ করবেন।”      
কোন ব্যক্তি যদি বসত বাড়ীর মালিক হয় এবং তার কোন মুমিন ভাইয়ের এ রকম থাকার জায়গার প্রয়োজন হয় আর সে যদি তাকে তা না দেয় তাহলে মহান আল্লাহ্ তাঁর ফেরেশতাদেরকে সম্বোধন করে বলবেন, “হে আমার ফেরেশতাগণ, আমার এ বান্দাটি তার (অতিরিক্ত) বাড়ী বা স্থান আমারই আরেক জন বান্দার বসবাস করার জন্য তার হাতে সোপর্দ করে নি। আমি আমার সম্মান ও মহিমার কসম করে বলছি, আমিও বেহেশতে বসবাস করার জন্য কোন স্থান তাকে দেব না।”      
কোন ব্যক্তির কাছে তারই কোন মুমিন ভাই যদি অভাব ও প্রয়োজন পূরণ করার আবেদন জানায় আর তার সামর্থ্য ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সে তা পূরণ না করে তাহলে মহান আল্লাহ্ কিয়ামত দিবসে তাকে ঘাড়ের সাথে তার দু’হাত বাঁধাবস্থায় পুনরুজ্জীবিত করবেন এবং সকল মানুষের হিসাব ও বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থায় রাখবেন।
অন্যদিকে মহান আল্লাহ্ এ কাজের (পরোপকার করা) জন্য এমন সওয়াব নির্ধারণ করেছেন যা এতটা গুরুত্বপূর্ণ যে, অন্য কোন সৎ কাজ দ্বারা অর্জিত পুণ্যেও এর নজীর খুব কমই পাওয়া যায়।     
 মহানবী (সাঃ) বলেছেন,“বেহেশতে মহান আল্লাহর এমন সব বান্দা আছে যারা সেখানে কর্তৃত্ব করবে (এবং উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবে)। আর তারা হচ্ছে ঐ সব ব্যক্তি যারা তাদের মুমিন ভাইদের অভাব ও প্রয়োজনাদি দূর করে দেয়।”      
যে ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইয়ের অভাব ও প্রয়োজনাদি পূরণ করে সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে তার সমগ্র জীবনে মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করেছে।      
যে ব্যক্তি মুসলমানদের থেকে বিপদাপদ দূর করবে তা বন্যাই হোক আর অগ্নিকাণ্ডই হোক, মহান আল্লাহ্ তার জন্য বেহেশত অবধারিত করে দেবেন।      
ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন,“যখন কোন ব্যক্তি আমার কাছে অভাব ও প্রয়োজন পূরণ করার আবেদন করে তখন তা পূরণ করার জন্য আমি তাড়াহুড়া করতে থাকি যাতে করে এমন না হয় যে, তার অভাব ও প্রয়োজন শেষ হয়ে যায় (আর আমিও এ ধরনের সৌভাগ্য অর্জন করা থেকে বঞ্চিত হয়ে যাই)।”     
 একইভাবে ইমাম সাদেক (আ.) বলেছেন, “যখন কোন মুসলমানের কাছে তার কোন মুসলমান ভাই (সাহায্য লাভের জন্য) আগমন করে এবং সেও তার অভাব মিটিয়ে দেয় তখন সে মহান আল্লাহর পথে মুজাহিদের ন্যায় গণ্য হয়।”      
এক মুসলমান অপর কোন মুসলমানের অভাব ও প্রয়োজন পূরণ করার সাথে সাথেই মহান আল্লাহ্ তাকে ডেকে বলবেন,  “তোমার এ কাজের পুণ্য আমার কাছে আছে এবং আমি তোমার জন্য জান্নাত ব্যতীত আর অন্য কোন পুরস্কার প্রদানে সন্তুষ্ট হব না।”১০      
ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন,  “যে ব্যক্তি তার মুমিন ভাইয়ের অভাব মোচন করবে মহান আল্লাহ্ কিয়ামত দিবসে তার এক লক্ষ প্রয়োজন পূরণ করবেন, যার প্রথমটি হচ্ছে জান্নাত এবং এরপর তিনি তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও দীনী ভাইদেরকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন, তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত এই যে, তারা মূর্তিপূজক (মুশরিক) হবে না।”১১       
“যে মুমিন তার কোন দুর্দশাগ্রস্ত মুমিন ভাইয়ের দুঃখ-দুর্দশা দূর ও তার অভাব পূরণ করবে মহান আল্লাহ্ ইহলোক ও পরলোকে তার সমস্ত অভাব পূরণ করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি তার মুমিন ভাইয়ের কোন দোষ, ত্রুটি ও ভেদ যা সে ভয় করে তা গোপন রাখবে মহান আল্লাহ্ তার ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের ৭০টি দোষ ও ভেদ গোপন রাখবেন।” অতঃপর তিনি বললেন, “মুমিন যে পর্যন্ত তার মুমিন ভাইকে সাহায্য করে যাবে সে পর্যন্ত মহান আল্লাহ্ও তাকে সাহায্য করে যাবেন। অতএব, তোমরা মহান আল্লাহর বিরাটত্ব ও মহত্ত্ব থেকে উপকৃত হও এবং কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা কর।”১২
সাফওয়ান আল্-জামাল যিনি ইমাম জাফর সাদেক ও ইমাম মূসা কাযেমের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সাহাবী ছিলেন তিনি বলেছেন,  “আমি ইমাম আবু আব্দিল্লাহ্ জাফর সাদেকের নিকট বসা ছিলাম। এমন সময় পবিত্র মক্কার অধিবাসী মায়মুন নামীয় এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পথ খরচের যে তার সামর্থ্য নেই তা ইমামকে জানাল। ইমাম সাদেক (আ.) আমাকে বললেন,  “তোমার এ ভাইকে সাহায্য কর।” আমি সেখান থেকে ঐ লোকটিকে সাথে নিয়ে বের হলাম। অতঃপর মহান আল্লাহ্ তার (মক্কায় প্রত্যাবর্তনের) প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা করে দিলেন। এরপর আমি পুনরায় আমার বসার স্থানে ফিরে এলাম। ইমাম সাদেক (আ.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে তুমি কি করেছো?” আমি তখন তাঁকে বললাম, “আপনার চরণে আমার পিতামাতা উৎসর্গীকৃত হোক, মহান আল্লাহ্ তার প্রয়োজন মিটিয়ে দিয়েছেন।” অতঃপর ইমাম সাদেক (আ.) বললেন, “জেনে রাখ, তোমার কোন মুসলমান ভাইকে সাহায্য করা পবিত্র কাবার চতুর্দিকে এক সপ্তাহ তাওয়াফ করার চাইতে উত্তম।”১৩     
ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন, “মহান আল্লাহ্ বলেছেন, মানব জাতি আমার কাছ থেকে রিযিকপ্রাপ্ত। তাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় যে তাদের প্রতি সবচেয়ে বেশী সদয় ও দয়াবান এবং অভাব ও প্রয়োজনাদি পূরণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী চেষ্টা করে।”১৪ যে মুসলমানদেরকে খুশী করবে নিঃসন্দেহে সে কিয়ামত দিবসে আনন্দিত ও প্রফুল্ল থাকবে।     
ইমাম মূসা কাযেম (আ.) বলেছেন, “এ পৃথিবীতে মহান আল্লাহর এমন সব বান্দা আছে যারা মানুষের অভাব ও প্রয়োজনাদি পূরণ করার জন্য চেষ্টা করে তারাই কিয়ামত দিবসে নিরাপদ থাকবে। আর যে ব্যক্তি কোন মুমিনকে আনন্দিত করবে মহান আল্লাহ্ কিয়ামত দিবসে তার চিত্তকে আনন্দিত ও প্রফুল্ল করবেন।”১৫ সংক্ষেপে এ কাজ অর্থাৎ মুমিন মুসলমানদেরকে তথা মানব জাতিকে সাহায্য করা এতই গুরুত্ববহ যে, মহান আল্লাহ্ এ কাজের ইচ্ছা ও নিয়ত করারও সওয়াব দেবেন।     
ইমাম মুহাম্মদ বাকের (আ.) বলেছেন, “কখনো কখনো এমন হয় যে, কোন অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি কোন মুমিন ব্যক্তির কাছে অভাব পূরণ করার জন্য আবেদন করে, উক্ত মুমিন ব্যক্তি সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সামর্থ্য না থাকার কারণে তাকে সাহায্য করতে সক্ষম হয় না। এমতাবস্থায় মহান আল্লাহ্ এই সদিচ্ছা পোষণ করার জন্য তাকে বেহেশত প্রদান করবেন।”১৬     
আমাদের এ আলোচনার ফলাফল হচ্ছে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ঐ বক্তব্য যাতে তিনি বলেছেন,  “তোমাদের কাছে জনগণ তাদের অভাব ও প্রয়োজনাদি পূরণ করার যে আবেদন করে থাকে আসলে তা তোমাদের প্রতি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অন্যতম নেয়ামত। তাই তোমরা নেয়ামতসমূহকে ওলট-পালট করে দিও না।”১৭     
ইমাম আলী (আ.) বলেছেন, “আমি সত্যিই ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে অবাক হয়ে যাই, যার কাছে তার কোন মুসলমান ভাই কোন প্রয়োজনবশত আসে, অথচ সে তার প্রয়োজন মেটানো ও অভাব দূর করা থেকে বিরত থাকে। সে কি নিজেকে কল্যাণ ও মঙ্গল লাভের যোগ্য মনে করে না?!! ধরে নিই যে, কোন সওয়াবও নেই, কোন শাস্তিও নেই, তারপরও কি তোমরা উত্তম চরিত্র, মহৎ গুণ ও সদাচারণ করা থেকে বিরত থাকবে?”১৮     
মহান আহলুল বাইতের এসব সুস্পষ্ট ও সহজবোধ্য বর্ণনাসমূহ যা এখানে উল্লেখ করা হলো এবং আরো যে অগণিত হাদীস যা এখানে স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না সেগুলো থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, পবিত্র ইসলাম ধর্ম মুসলমান তথা মানব জাতিকে সাহায্য করা, তাদের প্রয়োজনসমূহ মেটানোর জন্য চেষ্টা করা এবং সমাজ সেবামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও পছন্দনীয় ইবাদতসমূহের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করে। ইসলামের দৃষ্টিতে এ মহান কাজ সম্পাদন করার জন্য সব মুমিন-মুসলমানেরই দায়িত্ব আছে এবং এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র অবহেলা প্রদর্শন ও অমনোযোগিতা সম্পূর্ণরূপে অবৈধ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব কষ্টসমূহ থেকে কোনো কষ্ট দূর করবে আল্লাহ তার একটি কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে দুনিয়াতে ছাড় দেবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে তাকে ছাড় দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ তা‘আলা বান্দার সাহায্যে থাকেন যতক্ষণ সে তার ভাইয়ের সাহায্য করে যায়।’১৯


অপর হাদীসে তিনি বলেছেন- ‘না, আল্লাহর কসম সে ঈমান আনে নি’; ‘না, আল্লাহর কসম সে ঈমান আনে নি’; ‘না, আল্লাহর কসম সে ঈমান আনে নি’। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, তারা কারা হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, ‘সেই ব্যক্তি যার হঠকারিতা থেকে প্রতিবেশি নিরাপদ নয়।’ জিজ্ঞেস করা হলো, হঠকারিতা কী? তিনি বললেন, ‘তার অনিষ্ট বা জুলুম’।২০


বলাবাহুল্য আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদের অপচয় করা অথচ নিকটস্থ অসহায়ের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করাও এক ধরনের জুলুম। একে অপরকে সাহায্য করা, একে অন্যকে সামান্য হলেও কিছু দেয়াও গুরুত্বপূর্ণ। প্রখ্যাত সাহাবী আবূ হুরায়রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘হে মুসলিম নারীগণ, এক প্রতিবেশি যেন তার অপর প্রতিবেশির পাঠানো দানকে তুচ্ছজ্ঞান না করে, যদিও তা ছাগলের পায়ের একটি ক্ষুর হয়।’২১
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দারিদ্রক্লিষ্ট বনী আদম এবং অসহায় নারীদের সাহায্যে উদ্বুদ্ধ করেছেন ব্যাপকভাবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ প্রসঙ্গে বলেছেন-‘বিধবা ও অসহায়কে সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর সমতুল্য।’ (বর্ণনাকারী বলেন,) আমার ধারণা তিনি আরও বলেন, ‘এবং সে ওই সালাত আদায়কারীর ন্যায় যার ক্লান্তি নেই এবং ওই সিয়াম পালনকারীর ন্যায় যার সিয়ামে বিরাম নেই।’২২

আরেক হাদীসে বলা হয়েছে, আবূ মূসা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
‘অসুস্থ লোকের সেবা করো, ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও এবং বন্দিকে মুক্ত করো।’২৩

বিজ্ঞানের ভাষায় পরোপকারের উপকারিতা
দীর্ঘজীবন প্রাপ্তি:
২০১৩ সালে ৪০টি আন্তর্জাতিক গবেষণার পর্যালোচনায় বলা হয়- পরোপকারীতা/স্বেচ্ছাসেবীতা আপনার আয়ু কমপক্ষে আরও এক বছর বাড়িয়ে দিতে পারে। পরোপকারি মানুষদের মৃত্যুঝুঁকি ২২ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পাওয়ার প্রমাণও আছে। প্রশ্ন উঠতে পারে আপনি পরোপকারীতার পেছনে কত সময় দেবেন?
বেশ কয়েকটি পৃথক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব জ্যেষ্ঠরা বছরে ১০০ ঘন্টা বা তারও বেশি সময় জনহিতকর কাজে দিয়েছেন তাদের মৃত্যুর হার জনসেবাবিমুখ ব্যক্তিদের তুলনায় ২৮ শতাংশ কম। ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটার স্কুল অব সোশ্যাল ওয়ার্কের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষণার সহলেখক এলিজাবেথ লাইটফুট বলেন, “স্বেচ্ছাসেবীতায় বছরে ১০০ ঘন্টা সময়ই দিতে হবে এমন কোন কথা নাই, এই সময় হতে পারে ৭৫ কিংবা ২৫ ঘন্টা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে আপনি নিয়মিত অন্য মানুষের উপকার করার চেষ্টা করছেন কি না? পরোপকারী হয়ে ওঠার সুবিধা সব বয়সের মানুষই পায়।
অনির্বচনীয় সুখ অনুভূত হয়:
পরোপকারিতা মস্তিষ্কে সুখানুভূতি নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন ডোপামিনের ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা প্রতিসপ্তাহে বা কয়েক সপ্তাহে অন্তত একদিন ছোট ছোট কিছু সহযোগিতা বা সহমর্মিতামূলক কাজ করেন(বন্ধুকে সাহায্য করা, আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাওয়া, “থ্যাংক ইউ” নোট লিখা ইত্যাদি), তাদের সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে স্বস্তির সুবাতাস বয়ে যায়, অন্যরকম ভাললাগা অনুভূত হয়। অবসাদ কমে যায়। মেজাজ হয় ফুরফুরে।
ব্যথা উপশমে কার্যকরী ভূমিকা রাখে: গবেষকরা বলেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে টানা ব্যথায় ভুগছেন তারা যদি একে অন্যকে ব্যথা উপশমে সহায়তা করেন তাহলে উভয়েরই উপকার হয়। প্রত্যেকেই দ্রুত সমস্যা থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে পারেন।
যদি ব্যথার মাত্রা পরিমাপের জন্যে শূন্য থেকে দশ পর্যন্ত দাগ টানা একটি স্কেল কল্পনা করি, তাহলে সেচ্ছাসেবকদের ব্যথার মাত্রা ৬ থেকে ৪ এ নেমে আসে। অন্য গবেষকরা বলছেন, “যারা টানা ব্যথায় ভুগতেন, তারা নিজেদের অসহায় মনে করতেন। কিন্তু একজন অন্যজনকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে প্রত্যেকের জীবন পাল্টে যাওয়া শুরু হয়। তারা এখন অন্যান্য রোগীদেরকেও একই পরামর্শ দেন। অন্যদের সাহায্য করার মাধ্যমে নিজের অস্বস্তি নিয়ন্ত্রণে আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাওয়া যায়”। জনসেবামূলক কাজ উদ্বেগ ও অবসাদ কমিয়ে মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
রক্তচাপ কমিয়ে দেয়:
২০১৩ সালে সাইকোলজি ও এজিং জার্নালের একটি গবেষণায় বলা হয়, পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স্কদের মধ্যে যারা বিগত বছরে ২০০ ঘন্টা(সপ্তাহে ৪ ঘন্টা) জনহিতকর কাজ করেছেন, ৪ বছর পর তাদের উচ্চরক্তচাপ অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে এবং অন্যদের তুলনায় এই রক্তচাপ কমার হার ৪০ শতাংশ।
ইসলাম ধর্মে মানবসেবা ও সমাজকল্যাণের গুরুত্ব সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীসে কুদসী দ্বারা ইতি টানছি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে,
‘কেয়ামত দিবসে নিশ্চয় আল্লাহ তাআ’লা বলবেন, ‘হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমার শুশ্রুষা করো নি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক। আপনিতো বিশ্বপালনকর্তা কিভাবে আমি আপনার শুশ্রুষা করব?’ তিনি বলবেন, ‘তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, অথচ তাকে তুমি দেখতে যাও নি। তুমি কি জান না, যদি তুমি তার শুশ্রূষা করতে তবে তুমি তার কাছেই আমাকে পেতে?’ ‘হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে আহার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে আহার করাও নি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার রব, তুমি হলে বিশ্ব পালনকর্তা, তোমাকে আমি কীভাবে আহার করাব?’ তিনি বলবেন, ‘তুমি কি জান না যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিল, কিন্তু তাকে তুমি খাদ্য দাও নি। ‘হে আদম সন্তান, তোমার কাছে আমি পানীয় চেয়েছিলাম, অথচ তুমি আমাকে পানীয় দাও নি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার প্রভু, তুমি তো রাব্বুল আলামীন তোমাকে আমি কীভাবে পান করাব?’ তিনি বলবেন, ‘তোমার কাছে আমার অমুক বান্দা পানি চেয়েছিল কিন্তু তাকে তুমি পান করাও নি। তাকে যদি পান করাতে তবে নিশ্চয় আজ তা প্রাপ্ত হতে।’


এসব আয়াত ও হাদীসকে সামনে রাখলে কোনো মুসলিমের পক্ষেই সমাজসেবা বিমুখ হওয়া সম্ভব নয়। কুরআন-সুন্নাহর ধারক-বাহক উলামায়ে কিরাম তাই এ ব্যাপারে সবসময় সচেতন ছিলেন। আর্ত-মানবতার সেবায় ইসলামের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে নিজেদের কর্মকাণ্ড শুধু মসজিদ-মাদরাসা স্থাপন, কুরআন শিক্ষা ইত্যাদির মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে এতিমদের পুনর্বাসন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বিধবাদের সহায়তা প্রদান, যৌতুক প্রতিরোধ, মাদকদ্রব্য নির্মূল, বৃক্ষরোপন, স্যানিটেশন প্রকল্প, ইসলামভিত্তিক ক্ষদ্র ঋণ প্রকল্প, বেকারদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কাজ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই পার্থিব লালসা ও ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাসের রোগ থেকে নিজেদের দূরে থাকতে হবে।


তথ্যসূত্র  
1.    উসূলুল কাফী, পৃঃ ৩৯০।
2.    উসূলুল কাফী, পৃঃ ৪৭৬।
3.    উসূলুল কাফী, পৃঃ ৪৭৬।
4.    বিহারুল আনওয়ার, ১৬শ খণ্ড, পৃঃ ৮০।
5.    ওয়াসায়েলুশ্ শিয়া, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৫২৩।
6.    ওয়াসায়েলুশ্ শিয়া, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৫২৩।
7.    উসূলুল কাফী, পৃঃ ৩৯০।
8.    বিহারুল আন্ওয়ার, ১৫শ খণ্ড, কিতাবুল আশারাহ্, পৃঃ ৮৯।
9.    মুস্তাদরাকুল্ ওয়াসাইল, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৪০৭।
10.    ওয়াসায়েলুশ্ শিয়া, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৫২০।
11.    ওয়াসায়েলুশ্ শিয়া, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২২৩।
12.    উসূলুল কাফী, পৃঃ ৪১০।
13.    উসূলুল কাফী, পৃঃ ৪০৯। উ
14.    সূলুল কাফী, পৃঃ ৪০৯।
15.    ওয়াসায়েলুশ্ শিয়া, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৫২৪।
16.    ওয়াসায়েলুশ্ শিয়া, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৫২৩।
17.    বিহারুল আনওয়ার, ১৫শ খণ্ড, কিতাবুল আশারাহ্, পৃঃ ৯০।
18.    দুরারুল হিকাম, পৃঃ ৪৯৬।
19.    মুসলিম : ৭০২৮; আবূ দাঊদ : ৪৯৪৮; তিরমিযী : ১৪২৫।
20.    মুসনাদ আহমদ : ৮৪১৩।
21.    বুখারী : ২৫৬৬; মুসলিম : ২২৬ ।
22.    বুখারী : ৬০০৭; মুসলিম : ৭৬৫৯ ।
23.    বুখারী : ৫৬৪৯; মুসনাদ আবী ই‘আলা : ৭৩২৫ ।
24.    মুসলিম : ৬৭২১; সহীহ ইবন হিব্বান : ৭৩৬ ।
 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)