আল হাসানাইন (আ.)

অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ভারসাম্য

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং কল্যাণকামী ধর্ম হিসেবে মানুষকে সকল ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ হবার আহ্বান জানায়। ইসলামে চরমপন্থা ও বাড়াবাড়ির কোন স্থান নেই। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডেও ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যপন্থা অবলম্বনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডও মানুষের বৈষয়িক ও আত্মিক উভয় চাহিদাকেই পূরণ করতে পারে। কিন্তু এ জন্যও মানুষকে ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে। পবিত্র কোরান ও হাদিসে মানুষকে আয়-উপার্জন করে স্বাবলম্বী হতে বলা হয়েছে এবং অলসতা ও কর্ম-বিমুখতার বিরোধিতা করা হয়েছে। অর্থাৎ মানুষকে কর্মতৎপর ও সচেষ্ট হতে হবে। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বৈরাগ্যবাদ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ঘরকুনো ও অলস মানুষকে ইসলাম পছন্দ করে না। রাসূলের জীবদ্দশায় যারা ঘর-সংসার ও দৈনন্দিন কাজ-কর্ম ত্যাগ করে শুধু মাত্র এবাদতে মশগুল হয়েছিলেন, তিনি তাদেরকে ঐ পন্থা অবলম্বন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। রাসূল (সাঃ) তাদেরকে দৈনন্দিন কাজকর্ম চালিয়ে যেতে এবং জীবনকে আনন্দঘন করে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন। বিশ্বনবী হালাল পথে উপার্জনকে আল্লাহর পথে জিহাদের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, যারা সম্মানের সাথে হালাল উপার্জনের চেষ্টা করে,তাদের মর্যাদা শহীদদের সমতুল্য।
ইসলাম ধর্মে কর্মতৎপরতা ও হালাল পথে আয়-উপার্জনের উপর ব্যাপক গুরুত্ব আরোপের পাশাপাশি এক্ষেত্রেও বাড়াবাড়ি না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। অনেকে অর্থ উপার্জন ও তা পুঞ্জিভূত করাকেই জীবনের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত করে। এ কারণে তারা জীবনের অন্যান্য মৌলিক উপাদানকে উপেক্ষা করে। তারা তাদের সময় ও শক্তিকে শুধুমাত্র অর্থের পেছনে ব্যয় করে। আমিরুল মোমেনিন হযরত আলী (আঃ) এ ক্ষেত্রেও ভারসাম্যপূর্ণ হবার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "মুমিনরা রাত ও দিনের পুরো সময়টাকে তিন ভাগে বিভক্ত করে। এর এক ভাগ ব্যয় করে আল্লাহর কাছে মোনাজাতের মধ্য দিয়ে, দ্বিতীয় অংশকে কাজে লাগায় আয়-উপার্জন ও সাংসারিক কাজ সম্পাদনের জন্য এবং তৃতীয় অংশ ব্যয় করে হালাল উপায়ে আনন্দ উপভোগের জন্য।"
এটা ঠিক যে স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য যে পরিমাণ অর্থ-সম্পদ মানুষের প্রয়োজন তা জমা বা পুঞ্জিভূত করা দোষের কিছু নয়। কিন্তু এরও একটি সীমা-পরিসীমা রয়েছে,যা কোন ভাবেই লংঘন করা উচিত নয়। সম্পদ যদি মানুষকে মোহগ্রস্ত করে ফেলে এবং মানবিকতা ও আধ্যত্বিকতা থেকে দূরে ঠেলে দেয়, তাহলে তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে এর অর্থ এই নয় যে, সম্পদ থাকলেই তা বল্গাহীন ভাবে ব্যয় করতে হবে। ইসলামে অপচয় ও অপব্যয় উভয়ই নিষিদ্ধ এবং তা বাড়াবাড়ি হিসেবে পরিগণিত। ইসলামের দৃষ্টিতে অপচয় ও অপব্যয় না করে তা মানব কল্যাণে ব্যয় করাই হচ্ছে প্রকৃত মুমিনের কাজ। কৃপনতাও বাড়াবাড়ির মধ্যেই পড়ে। কাজেই সম্পদ উপার্জন ও ব্যয় উভয় ক্ষেত্রেই ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে। আমিরুল মোমেনিন হযরত আলী (আঃ) এ সম্পর্কে বলেছেন, উদার হও কিন্তু বল্গাহীনভাবে সম্পদ খরচ করো না। ভারসাম্যপূর্ণ হও, সংকীর্ণমনা ও কৃপণ হইও না। কুরআন মজীদের সূরা ফুরকানের ৬৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্‌ তা'আলা এ সম্পর্কে বলেছেন, "যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপচয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে।"
ইসলাম ধর্ম মানুষকে আল্লাহর নেয়ামত ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও ভারসাম্য রক্ষার নির্দেশ দিয়েছে। যেমন নিজের আনন্দ-ফুর্তি ও স্বার্থের জন্য পরিবেশ-প্রকৃতিকে ধ্বংস করা ইসলাম সম্মত নয়। বর্তমানে বিশ্বের এক শ্রেনীর মানুষ ও দেশের বাড়াবাড়ির কারণে বিশ্বের নানা প্রান্তে পরিবেশ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। মানুষ পরিবেশ-প্রকৃতিকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ হলে আজ এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। আল্লাহতায়ালা মানুষকে অফুরন্ত নেয়ামত দিয়েছেন। তিনি মানুষকে সেই নেয়ামত ব্যবহার করতে বলেছেন। কাজেই যারা আল্লাহর নেয়ামতগুলোকে একেবারেই কাজে লাগাচ্ছেনা তারাও কিন্তু সঠিক কাজ করছে না। সূরা আরাফের ৩২ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, "বান্দাদের জন্যে সৃষ্ট ঐশী সাজসজ্জা এবং পবিত্র খাদ্যবস্তুসমূহকে কে হারাম করেছে? আপনি বলুন: এসব নেয়ামত আসলে পার্থিব জীবনে মুমিনদের জন্যে এবং কিয়ামতের দিন খাঁটিভাবে তাদেরই জন্যে।"
তবে আবার যারা এক্ষেত্রে আগ্রাসী হয়ে উঠছে,তারাও অন্যায় করছে।
ইসলামী অর্থনীতির একটি মৌলিক বিষয় হলো, ন্যায়পরায়নতা। এই নীতির আলোকেই সমাজে ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। সম্পদের সুষম বন্টনের অভাবে সমাজের এক অংশ অতি দরিদ্র এবং অপর এক অংশ অতি সম্পদ শালীতে পরিণত করে। এ কারণে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্যেও ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইসলাম ধর্ম অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য দূর করার জন্য বিভিন্ন দিক নিদের্শনা দিয়েছে। এর কোন কোনটি মুসলমানদের জন্য ফরজ করা হয়েছে। ইসলাম সমাজের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায় ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য যাকাত ও খোমসকে বাধ্যতামূলক করেছে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরানের বিভিন্ন আয়াতে নামায আদায়ের সাথে সাথে যাকাত প্রদানেরও নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "নামায কায়েম করো এবং যাকাত প্রদান করো"। যাকাত কাদেরকে দিতে হবে কোরানে সে সম্পর্কেও দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরানের সূরা তওবার ৬০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, 'যাকাত হল কেবল মাত্র ফকির, মিসকীন, যাকাত সংগ্রহকারী ও যাদের হৃদয়-মনকে আকৃষ্ট করা প্রয়োজন, তাদের অধিকার এবং তা দাস-মুক্তির জন্যে-ঋণ গ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে, এই হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।'
ইসলাম সব সময় একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতা প্রদান এবং দান খয়রাতের জন্য মানুষকে উৎসাহিত করেছে। পবিত্র কোরানেও বারবারই গরীব-দু:খীদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে দান করার ক্ষেত্রেও ভারসাম্যপূর্ণ হতে বলা হয়েছে। সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে নি:স্ব হয়ে বসে থাকতে নিষেধ করা হয়েছে। পবিত্র কোরানের সূরা বনী ইসরাইলের ২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, 'তুমি একেবারে ব্যয়-কুষ্ঠ হয়ো না এবং একেবারে মুক্ত হস্তও হয়ো না। তাহলে তুমি নিঃস্ব হয়ে বসে থাকবে।' সমাজ যাতে দারিদ্রমুক্ত হয়, সে লক্ষ্যেই ইসলাম এ ধরনের নির্দেশ জারি করেছে। ইসলাম ন্যায়ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সুদ,মুনাফালোভ, মজুতদারি, নিম্নমানের জিনিস সরবরাহ ও বিক্রি এবং ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতারণাকে হারাম ঘোষণা করেছে। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ন্যায় প্রতিষ্ঠার উপরই ইসলামী অর্থনীতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কারণে ইসলামী অর্থনীতি অনুসরণ করা হলে একটি সমাজে দারিদ্য্ম ও বৈষম্যের মাত্রা সব নিম্ন পর্যায়ে নেমে আসতে বাধ্য।
ইসলামে অর্থনৈতিক ব্যবস্হায় আয় ও ব্যয় সংক্রান্ত নীতিগুলো এতটাই ভারসাম্যপূর্ণ যে, এগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে দারিদ্র্য ও দুর্নীতিমুক্ত জীবন ব্যবস্থা অতি সহজেই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আয়-উপার্জনের ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষ যদি ভারসাম্য রক্ষা করে চলে তাহলে ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে তার বিপদের সম্মুখীন হবার আশংকাও অনেক কমে যায়। হালাল-হারামের ক্ষেত্রে ইসলামের ভারসামপূর্ণ নীতি মেনে চললে মানুষ শারীরিক ও আত্মিক নানা সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে পারবে।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)