আল হাসানাইন (আ.)

মুসলিম-দর্শনে অনাদিত্ব বিষয়ক বিতর্ক : একটি পর্যালোচনা

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

মুসলিম-দর্শনে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে অনাদিত্ব বিষয়ক সমস্যাটির ওপর আলোচনা করা হয়েছে। অনাদি (eternal) বলতে বুঝায় নিত্য বা চিরন্তন সত্তাকে যার কোন শুরুও নেই শেষও নেই। সাধারণ ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী আল্লাহ্ই একমাত্র অনাদি বা চিরন্তন,অবিনশ্বর,অব্যয় ও অক্ষয়। তিনি ছাড়া সবকিছুই সৃষ্ট। অতএব,অনাদি বা অনাদিত্ব শুধু আল্লাহর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। হাদিসে কুদ্সিতে রয়েছে (আল্লাহ  বলেন) : ‘আমি ছিলাম গুপ্ত ধনভাণ্ডার,আমি চাইলাম আমার পরিচয় ঘটুক,তাই আমি সবকিছু সৃষ্টি করলাম।’ প্রাথমিক যুগের সাধারণ বিশ্বাসীরা এর বাইরে নতুন কোন ধারণা পোষণ করত না। আল্লাহ্ই একমাত্র অনাদি সত্তা আর যা কিছু রয়েছে সবই পরবর্তীকালে সৃষ্টি হয়েছে,এটাই তাদের কাছে শেষ কথা।

মুসলিম চিন্তার ইতিহাসে এক পর্যায়ে এসে দেখা গেল অনাদিত্ব বিষয়ে নতুনভাবে কিছু চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে। সে থেকে মুসলিম-দর্শনে বিশেষ করে অ্যারিস্টটলের দর্শনে,এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ প্রবন্ধে আমরা অনাদিত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন চিন্তাগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার চেষ্টা করব এবং তাদের বক্তব্যসমূহ পর্যালোচনা করব।

মুতাযিলা মতবাদ

মুতাযিলারা মুসলিম-দর্শনে যুক্তিবাদী হিসাবে পরিচিত। তারা প্রতিটি বিষয়কে যুক্তির আলোকে পর্যালোচনা করার চেষ্টা করেছেন। প্রত্যাদেশ হিসাবে কুরআনকে স্বীকার করে নেওয়া সত্ত্বেও তারা এর আক্ষরিক অর্থসমূহ হুবহু গ্রহণ করতে সম্মত নন। যে কারণে মুসলিম-দর্শনের ইতিহাসে তারা ইসলামের বুদ্ধিবাদী (rationalist of Islam) নামে পরিচিত। অনাদিত্ব বিষয়ক তাদের আলোচনার সূত্রপাত ঘটে যুক্তিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকেই। তবে তা এসেছে পরোক্ষভাবে। তাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল আল্লাহর একত্ব বা তাওহীদকে-যা ইসলামের মূলনীতি-যুক্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করা। একইভাবে তারা আল্লাহর ন্যায়বিচারের (আদ্ল) এর ধারণাকেও যৌক্তিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পান। সে কারণেই তারা নিজেদের আল্লাহর একত্ব ও ন্যায়বিচারের পক্ষাবলম্বনকারী বা রক্ষক (আহল আত্-তাওহীদ ওয়াল আদ্ল) হিসাবে অভিহিত করে থাকেন।

মুতাযিলারা সহজ ও সরল অর্থে আল্লাহর একত্বের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। আল্লাহর সত্তা (জাত) থেকে পৃথকভাবে অস্তিত্বশীল গুণাবলিকে তারা স্বীকার করেননি। এ ধরনের স্বীকৃতি,তাদের মতে,আল্লাহর একত্বের ধারণার সাথে সংঘাতপূর্ণ। কেননা,এতে আল্লাহ  ছাড়া আরও বহু অনাদি সত্তার ধারণার উদ্ভব ঘটবে। মুতাযিলা মতবাদের প্রধান বিরোধিতাকারী আশ্আরিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা আবুল হাসান আল্-আশ্’আরী (মৃ. ৩২৪ হি./৯৩৫ খ্রি.) এর মতে মুতাযিলারা আল্লাহর ভিন্নতা ও অতিবর্তিতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে আল্লাহর একত্বের ধারণাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন।

মুতাযিলারা এ বিষয়ে অভিন্ন মত পোষণ করেন যে,আল্লাহ্ সবকিছু থেকে আলাদা এবং তাঁর শ্রবণ ও দর্শন ক্ষমতা একইভাবে ভিন্নতর। তিনি দেহবিশিষ্ট নন,তিনি প্রেতাত্মা,শব,আকার,মাংসপিণ্ড,রক্ত,দ্রব্য এসব কিছুই নন। তিনি অবান্তর লক্ষণও নন এবং বর্ণ,স্বাদ,গন্ধ,স্পর্শ,উষ্ণ,শীতল,আর্দ্রতা,শুষ্কতা,উচ্চতা,প্রশস্ততা অথবা গভীরতাসম্পন্ন নন। তিনি অবিভাজ্য এবং স্থান ও সময়ের নিয়ন্ত্রণমুক্ত। সৃষ্ট বস্তুসমূহের গুণাবলি,যাতে সাপেক্ষতা রয়েছে সেগুলো তাঁর ওপর আরোপযোগ্য নয়। তাকে ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষণ সম্ভব নয় অথবা মানুষের পক্ষে তাঁকে আত্মীকরণও সম্ভব নয়। তিনি সর্বদাই প্রথম,সমগ্র সাপেক্ষ বস্তুসমূহের পূর্ববর্তী। তিনি সবসময়ই জ্ঞানী,ক্ষমতাবান,জীবন্ত এবং তা সবসময় বজায় থাকে। কোন দৃষ্টি তাঁকে দেখতে পারে না,কল্পনা তাঁকে বেষ্টন করতে পারে না,তিনিই একমাত্র অনাদি সত্তা,তিনি ছাড়া আর কোন অনাদি সত্তা নেই এবং কোন দৈবশক্তি বা সঙ্গী তাঁর রাজ্যে তার শরীক নয়।

মুতাযিলারা উক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে আল্লাহর একত্বকে সুদৃঢ় যৌক্তিক ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পান। তাদের অভিমত হল আল্লাহর সত্তা ব্যতীত অন্য কিছুকে অনাদি হিসাবে গ্রহণ করলে তা হবে তাওহীদের মূলনীতির পরিপন্থী। সেই কারণেই তারা আল্লাহর অনাদি গুণসমূহের ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেন। তাদের মতে আল্লাহর সত্তার মধ্যেই জ্ঞান,ক্ষমতা ও জীবন রয়েছে,এগুলো অনাদি গুণ বা ধারণা হিসাবে তাঁর মধ্যে নিহিত নেই। যদি এসব গুণ আল্লাহর অনাদিত্বের অংশ হয়,তাহলে তা তাঁর সত্তারও অংশীদার হবে। সে কারণেই মুতাযিলারা সর্বসম্মতভাবে অনাদিত্ব ব্যতীত আল্লাহর অনাদি গুণাবলির ধারণা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন।

মুতাযিলারা যে যুক্তিতে আল্লাহর গুণাবলির স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছিলেন,ঠিক একই যুক্তিতে তারা কুরআনকে নিত্য বা চিরন্তন বলে মেনে নেননি। এ প্রসঙ্গে তাদের অভিমত হল কুরআনে আল্লাহ কে একমাত্র অনাদি সত্তা হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে।

অতএব,কুরআনকে যদি আল্লাহর কালাম হিসাবে নিত্য ধরে নেওয়া হয় তবে তা হবে কুরআনে উল্লিখিত আল্লাহর একত্বের ধারণার পরিপন্থী। অতএব,আল্লাহর বাণী হিসাবে কুরআনকে তারা অনাদি হিসাবে মেনে নেননি। তাদের অভিমত হল কুরআন সৃষ্ট।

প্রখ্যাত মুতাযিলা চিন্তাবিদ আবুল হুযায়েল এ প্রসঙ্গে বলেন,‘আল্লাহর বাণীর দু’টি দিক রয়েছে : [কুরআন অনুযায়ী] প্রাথমিক আদেশ (কুন) এর মাধ্যমে আল্লাহ  জগৎ সৃষ্টি করেছেন যাতে রয়েছে হওয়ার নির্দেশ এবং পরবর্তী বা দ্বিতীয় আদেশ দ্বারা বিশেষ বিশেষ বস্তুসমূহের সৃষ্টি বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রথমোক্তটি আল্লাহর অন্তর্বর্তী হতে পারে না। কেননা,তিনি অবান্তর লক্ষণসমূহের ধারক হতে পারেন না,তিনি পৃথিবীর ধারণকারী হতে পারেন না। কারণ,তখন পর্যন্ত পৃথিবী অস্তিত্বেই আসেনি।’

আন-নাযযামসহ অন্য চিন্তাবিদরা মানুষের কথা ও আল্লাহর বাণীর মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করতে গিয়ে বলেন,প্রথমটি হল অবান্তর গুণ,আর অপরটি হল শ্রবণযোগ্য শব্দ যার কারণ আল্লাহ্ স্বয়ং।

আল্লাহর বাণী বিষয়ক মুতাযিলাদের বিভিন্নমুখী আলোচনা,পর্যালোচনা সত্ত্বেও তাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় অর্থাৎ আল্লাহর বাণীর সৃষ্টিশীলতা অপরিবর্তিত থাকে। এ বিষয়ে মুতাযিলা চিন্তাবিদরা সবাই একমত যে,কুরআন সৃষ্ট,একে কোন অবস্থাতেই অনাদি বলা চলে না। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ওপর হযরত জিবরাঈলের মাধ্যমে কুরআন নাযিল হওয়ার পূর্বে তা সংরক্ষিত ফলকে (লাওহে মাহফুজে) ছিল১০- মুসলমানদের এ সাধারণ ধর্মীয় বিশ্বাসকে মুতাযিলারা গ্রহণ করেছিলেন। কুরআন অতীন্দ্রিয় পর্যায় থেকে মানবীয় দু’টি পর্যায় অতিক্রম করেছে : লিপিবদ্ধকরণ এবং পঠন;মুতাযিলা মত অনুযায়ী সকল পর্যায়েই কুরআন সৃষ্ট।১১ উল্লেখ্য যে,সামগ্রিকভাবে মুতাযিলারা ছাড়াও খারেজি এবং মুরজিয়া,শিয়া ও জাহেমিয়া সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোকই কুরআন সৃষ্ট- এ তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন।১২

কুরআন যে অনাদি নয়,সৃষ্ট- এ নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা,পর্যালোচনা দীর্ঘদিন পর্যন্ত চলে। তবে খলিফা আল মামুন এ বিষয়ে মুতাযিলা মতবাদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। ৮২৭ এবং ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে সরকারি ফরমানে কুরআনকে সৃষ্ট বলে ঘোষণা করা হয়। এতে বিভিন্ন ধর্মীয় মহলে,বিশেষ করে ধর্মীয় বিশ্বাসকে যৌক্তিক বিচার-বিশ্লেষণে আনার বিপক্ষে অবস্থানকারী মহলে,বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। খলিফা আল-মামুনের কুরআনের সৃষ্টি বিষয়ক মতবাদ তাঁর দুই উত্তরসূরি আল-মুতাসিম এবং আল-ওয়াসিক গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে,ধর্মীয় বিশ্বাসসমূহকে যৌক্তিক বিচার-বিশ্লেষণের আওতায় আনার নীতির প্রধান বিরোধিতাকারীদের অন্যতম ছিলেন মালিক ইবনে আনাস (মৃ. ৭৯৫ খ্রি.)। তাঁর অভিমত হল ধর্মীয় বিশ্বাসকে ‘কীভাবে’ সে প্রশ্ন উত্থাপন না করেই (বিলাকায়ফা) গ্রহণ করতে হবে। সেই ধারাবাহিকতায় প্রখ্যাত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব আহমদ ইবনে হাম্বাল (মৃ. ৮৫৫ খ্রি.) মুতাযিলাদের কুরআনের সৃজন বিষয়ক মতাবাদের তীব্র বিরোধিতা করেন।১৩

আল মুতাওয়াক্কিল ৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে খলিফার আসনে সমাসীন হওয়ার পর কুরআনের সৃজন বিষয়ক রাষ্ট্রীয় ফরমান প্রত্যাহার করা হয়।১৪ মুতাযিলারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা হারালেও তাদের চিন্তাধারার প্রভাব ইসলামী চিন্তাজগতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। পরবর্তী চিন্তাবিদরা,এমনকি এর বিরোধিতাকারীরাও এর প্রভাবমুক্ত হতে পারেননি। মুতাযিলারা যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেছেন পরবর্তী চিন্তাবিদরা,এমনকি ধর্মতত্ত্ববিদরা পর্যন্ত এসব বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনায় ব্যাপৃত ছিলেন। অনাদিত্ব বিষয়ক আলোচনাও মুসলিম-দর্শনে একইভাবে অব্যাহত থাকে।

আশ্আরিয়া

মুতাযিলা সম্প্রদায়ের অতি যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আশ্‘আরিয়া সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয়। কিন্তু আশ্‘আরিয়া অবস্থানকে সম্পূর্ণ রক্ষণশীল একটি মতবাদ হিসাবে গণ্য করা যায় না। মুতাযিলারা ধর্মীয় বিশ্বাস ও নীতিমালাকে সম্পূর্ণভাবে যুক্তিনির্ভর করার প্রচেষ্টা চালান,সেই পরিপ্রেক্ষিতেই অনাদিত্ব ও অন্যান্য বিষয়ে তাদের অবস্থান ধর্মীয় ঐতিহ্যপন্থী ও সংরক্ষণবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠে। আশ্আরিয়ারা ধর্মীয় বিশ্বাসসমূহকে সম্পূর্ণ যুক্তির আওতায় এনে সে অনুযায়ী এগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বিরোধী হলেও ধর্মীয় বিষয়ে প্রত্যাদেশের (ওহী) নিয়ন্ত্রণে সীমিত আকারে যুক্তি প্রয়োগের বিরোধী নন। এক্ষেত্রে তাদের অভিমত অতি সংরক্ষণবাদী ও সর্বক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আক্ষরিক অর্থে প্রত্যাদেশকে গ্রহণের পক্ষ অবলম্বনকারীদের থেকে ভিন্নতর। আল্-আশআরীর মতে,পবিত্র কুরআনে উপমা ও অবরোহ পদ্ধতিতে যুক্তি প্রয়োগের বহু নজির রয়েছে।১৫ আল্লাহর গুণাবলি ও কুরআনের সৃজন প্রশ্নে আল্-আশারীর মত মুতাযিলাদের মত থেকে যেমন ভিন্নধর্মী,তেমনিভাবে স্থূল নরাত্মারোপবাদী (মুজাসসিমুন) বা কট্টর আক্ষরিকপন্থীদের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।১৬

আশ্‘আরিয়াদের মতে আল্লাহর যেসব সাধারণ গুণ রয়েছে সেগুলোকে দু’ শ্রেণীতে ভাগ করা যায় : ক. নঞর্থক গুণাবলি (সিফাত-ই-সাল্বীয়াহ) এবং খ. অস্তিত্বমূলক বা সদর্থক গুণাবলি (সিফাত-ই-উজূদিয়াহ),যাকে তারা বুদ্ধিবৃত্তিক গুণাবলি (সিফাত-ই-আকলিয়া) বলেও অভিহিত করেন। এগুলোর সংখ্যা হল সাত : জ্ঞান,ক্ষমতা,ইচ্ছা,শ্রবণ,দর্শন ও বাচন।১৭

কট্টরপন্থী সিফাতিয়ারা আল্লাহর যে সব গুণ দৈহিক অস্তিত্ব নির্দেশ করে,সেগুলোকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করতে প্রস্তুত। এর বিরুদ্ধে আশ্‘আরিয়াদের অভিমত হল,আপাতদৃষ্টিতে আল্লাহর দেহ নির্দেশক কিছু গুণের উল্লেখ থাকলেও এগুলোকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা যাবে না। এগুলোকে ‘কীভাবে’ সে প্রশ্ন উত্থাপন না করে (বিলা কায়ফা) এবং অন্য কোন কিছুর সাথে তুলনা না করে (বিলা তাশবীহ) বিশ্বাস করতে হবে।১৮

আশ্‘আরিয়ারা এখানে আল্লাহর গুণাবলি সংক্রান্ত যে তত্ত্ব উপস্থাপন করেন সেটি হল আল্লাহর গুণাবলি অনুপম এবং সেগুলো সৃষ্ট সবকিছু থেকে মৌলিকভাবেই ভিন্নতর এবং সে কারণেই গুণাবলির সাথে কোন কিছুরই তুলনা চলে না। তাদের এ মতবাদ মুখালাফা বা চুড়ান্ত ভিন্নতা নামে পরিচিত। এ মতবাদ অনুযায়ী কোন গুণ বা শব্দ যদি আল্লাহর ওপর আরোপিত হয় তবে তার অর্থ হবে আল্লাহর ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও অনুপম অর্থাৎ সৃষ্ট কোন কিছুর ওপর এর প্রয়োগ হলে সাধারণত যে অর্থে তা ব্যবহৃত হয়,তা থেকে এ প্রয়োগ সম্পূর্ণ আলাদা। মুখালাফা মতবাদের কারণে আশ্‘আরিয়ারা নিজে থেকে আল্লাহর ওপর কোন গুণ আরোপের বিরোধী। শুধু সে সব গুণই আল্লাহর ওপর আরোপযোগ্য যেগুলোর সুস্পষ্ট উল্লেখ কুরআন মজিদে রয়েছে। আল্লাহর গুণাবলির সাথে সৃষ্ট সকল কিছুর গুণাবলির পার্থক্য শুধু পরিমাণগত নয়,গুণগতও। অর্থাৎ প্রকৃতিগতভাবে তা সম্পূর্ণ ভিন্নতর।১৯

মুতাযিলা মতবাদের বিরোধিতা করে আল্-‘আশআরি বলেন যে,আল্লাহর গুণাবলি অনাদিভাবে তাঁর মধ্যে নিহিত এবং সেগুলো তাঁর সত্তার অতিরিক্ত।২০ এসব গুণ হল অনাদি। তবে এগুলো এবং আল্লাহর সত্তা অভিন্ন- মুতাযিলাদের মত এ কথা যেমন বলা যায় না,একইভাবে এগুলো ভিন্ন এ কথাও বলা যায় না। কারণ,এতে কেউ স্বয়ং আল্লাহ  ছাড়া আল্লাহর গুণাবলির নিকট প্রার্থনা করে বসতে পারে,যা হবে উদ্ভট।২১

আশ্‘আরিয়াদের মতে মুতাযিলাদের মত আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলিকে এক ও অভিন্ন বলে বিবেচনা করা হলে তা হবে আল্লাহর গুণাবলিকে অস্বীকার করার শামিল। তবে তারা এ বলেননি যে,এসব অনাদি গুণ সম্পূর্ণভাবেই আল্লাহ  থেকে পৃথক। এ ধরনের ধারণা অনাদির ক্ষেত্রে বহুত্বের সূত্রপাত ঘটাবে এবং তা হবে আল্লাহর একত্বের পরিপন্থী। সেজন্যই তারা বলেন যে,আল্লাহর গুণাবলি এক অর্থে আল্লাহর সত্তার অন্তর্ভুক্ত,অপর অর্থে তাঁর সত্তা বহির্ভূত।২২ আল্লাহর সত্তার সাথে গুণাবলির সম্পর্ক বিষয়ক যে বিতর্ক চলছিল তার সমাপ্তি টানতে গিয়ে আল-আশ্‘আরি বলেন যে,আল্লাহর সত্তা এক,তবে তার মধ্যে অসংখ্য গুণ নিহিত। এগুলো তাঁর সত্তা থেকে যেমন অভিন্ন নয়,আবার সম্পূর্ণভাবে ভিন্নও নয়।২৩ আল্লাহর গুণাবলি বিষয়ক বিতর্কে আল-আশ্‘আরিয়াদের অবস্থান যদিও মুতাযিলাদের থেকে ভিন্নতর,তথাপি তারা মুতাযিলাদের প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত নন। আশ্‘আরিয়ারা আল্লাহর গুণাবলিকে অনাদি বলেছেন ঠিকই,কিন্তু এগুলোর স্বতন্ত্র অবস্থান যে তাওহীদের ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না,সে সম্পর্কেও তারা সচেতন ছিলেন। সেই প্রেক্ষিতেই তারা একটি মাঝামাঝি অবস্থান গ্রহণ করেন।

কুরআনের নিত্যতা বিষয়ক বিতর্কে মুসলিম চিন্তাবিদদের জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। ধর্মীয় সংরক্ষণবাদীদের মতে কুরআন আল্লাহর কালাম হিসাবে অনাদি। এর জন্য কোন প্রকার যৌক্তিক আলোচনার প্রয়োজন নেই। অপরদিকে মুতাযিলারা যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আল্লাহর সত্তা ছাড়া অন্য কোন কিছুকেই অনাদি হিসাবে গ্রহণ করতে রাজী নন। তাদের মতে কুরআন সৃষ্ট। আশ্‘আরিয়াদের মতে বাচন (কালাম) হল আল্লাহর সাতটি বুদ্ধিবৃত্তিক গুণাবলির অন্যতম এবং যেহেতু আল্লাহর গুণাবলি অনাদি,আল্লাহর বাচন অর্থাৎ আল-কুরআন একইভাবে অনাদি। তবে কুরআনের অনাদি হওয়া বিষয়ক আশ্‘আরিয়াদের অবস্থানকে মধ্যপন্থী হিসাবে অভিহিত করা যায়। কেননা,চরম গোঁড়াপন্থী সম্প্রদায়,বিশেষ করে হাম্বলি ও জাহেরিদের মতে আল্লাহর কালাম অর্থাৎ কুরআন যেসব অক্ষর,শব্দ ও ধ্বনির সমন্বয়ে গঠিত সেগুলোও অনাদি। এমনকি হাম্বলি সম্প্রদায়ের কেউ কেউ এমন মতও পোষণ করতেন যে,কুরআনের কভারও অনাদি।২৫

অপরদিকে মুতাযিলারা ছাড়া শিয়াদের একটি অংশ কুরআনকে সৃষ্ট ও অনিত্য বলে মনে করতেন। তাদের যুক্তি হল কুরআন বিভিন্ন অংশ নিয়ে সংকলিত হয়েছে এবং এর অংশসমূহকে ক্রমানুসারে বিন্যাস করা হয়েছে। অতএব,যা কিছু বিভিন্ন অংশের সমন্বয়ে এভাবে সংকলিত হয় তা অনিত্য হতে বাধ্য।২৬ এ প্রসঙ্গে আশ্‘আরিয়াদের বক্তব্য হল কুরআন সংকলনের জন্য যে শব্দাবলি ও ধ্বনি ব্যবহৃত হয়েছে তা আল্লাহর সত্তায় নিহিত নেই। এক্ষেত্রে তারা কুরআনের বাহ্যিক ও ভাষায় প্রকাশিত মূর্ত দিক এবং যথার্থ ও স্বতঃঅস্তিত্বশীল অর্থের (self-subsisting meaning) মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেন। তাদের মতে শব্দাবলি ও ধ্বনি দ্বারা প্রকাশিত কুরআন নিঃসন্দেহে অনিত্য,কিন্তু কুরআন এর অর্থের ক্ষেত্রে অসৃষ্ট ও নিত্য। স্বতঃঅস্তিত্বশীল অর্থ এটি অনাদিকাল থেকে আল্লাহর সত্তায় নিহিত। এই অর্থসমূহ প্রকাশিত হয়েছে;এর ভাষায় প্রকাশিত রূপ হল অনিত্য ও সৃষ্ট। এর কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে তারা বলেন,অর্থ এক থেকেও বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ব্যক্তি বা জাতির দ্বারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হতে পারে। তারা আরো উল্লেখ করেন যে,এই অর্থ হল জ্ঞান ও ইচ্ছা ছাড়া অপর আরেকটি গুণ,যা অনাদিকাল থেকে আল্লাহর সত্তায় নিহিত,সে কারণেই তা অনাদি।২৭

এ মতের সমর্থনে আশআরির যুক্তিসমূহ হল :

১.   কুরআন আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্ঞান। অতএব,এটি আল্লাহর জ্ঞান সংক্রান্ত গুণের-যা অনাদি ও অসৃষ্ট-সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। অতএব,কুরআনও একইভাবে অনাদি ও অসৃষ্ট।

২.   আল্লাহ কুন (হও) শব্দ দ্বারা সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং এ শব্দটি কুরআন মজিদে আছে,যা সৃষ্ট কোন কিছু হতে পারে না;অন্যথায় একটি সৃষ্ট শব্দ স্রষ্টায় পরিণত হবে,যা উদ্ভট। অতএব,আল্লাহর কথা সৃষ্ট হতে পারে না,অন্য কথায় এটি অনাদি।

৩.   কুরআন সৃষ্টি (খাল্ক) ও আদেশ (আমর) এর মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে। যেমন কুরআনে উল্লেখ রয়েছে,‘সৃষ্টি এবং আদেশ কি একমাত্র তাঁর নয়?’ অতএব,আল্লাহর আদেশ,তাঁর কথা বা কালাম সুস্পষ্টভাবে সৃষ্টবস্তুসমূহ (মাখলূক) থেকে আলাদা,সে কারণে তা অসৃষ্ট ও অনাদি।

৪.   আল্লাহ্ মূসা (আ.)-কে বলেন,‘আমি তোমাকে সমগ্র মানবজাতির মধ্য থেকে বেছে নিয়েছি আমার রাসূল এবং আমার কথা হিসাবে।’ এ আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে আল্লাহর বচন রয়েছে। আবারও আল্লাহ মূসা (আ.)-কে লক্ষ্য করে বলেন,‘নিশ্চয় আমি তোমার প্রভু।’ এখন যেসব শব্দ দ্বারা হযরত মূসাকে সম্বোধন করা হয়েছে সেগুলো যদি সৃষ্ট হয়,তবে এ থেকে বুঝা যাবে যে,কোন সৃষ্ট বস্তু ঘোষণা করেছে যে,তিনি মূসার প্রভু (আল্লাহ্),যা উদ্ভট। অতএব,আল্লাহর কথা অবশ্যই অনাদি হবে। মুতাযিলাদের কুরআনের সৃজন সংক্রান্ত যুক্তিসমূহ শুধু প্রকাশিত কুরআনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য,আসল কুরআনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।২৮

এখানে দেখা যাচ্ছে যে,আশ্‘আরিয়ারা কুরআনের নিত্যতার পক্ষে আলোচনা করেছেন এবং এতে তারা নানাবিধ যুক্তির আশ্রয় নিয়েছেন। যদিও তাদের অভিমত ইসলামের যুক্তিবাদী’ হিসাবে পরিচিত মুতাযিলাদের মতবাদ থেকে ভিন্নতর,তা সত্ত্বেও বক্তব্য উপস্থাপনার ক্ষেত্রে তারা যৌক্তিক পদ্ধতিই অবলম্বন করেছেন।

দার্শনিক সম্প্রদায়

মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে অনেকের রাচনাবলিতে অনাদিত্ব বিষয়ক আলোচনা বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। মুসলিম দার্শনিকরা (ফালাসিফা) গ্রিক-দর্শন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। গ্রিক-দর্শন,বিশেষ করে অ্যারিস্টটলের দর্শনের সাথে ইসলামি চিন্তাধারার একটি যোগসূত্র স্থাপন এবং সমন্বয় সাধন ছিল তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। জগতের অনাদি হওয়ার যোগসূত্র বিষয়ক মুসলিম দার্শনিকদের মতবাদ অ্যারিস্টটলের জগৎ বিষয়ক মতবাদের প্রভাবেই গড়ে উঠেছিল। অ্যারিস্টটলের মতে জগৎ অনাদি। তিনি শূন্য থেকে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে- এ মতবাদে বিশ্বাসী নন,এমনকি তিনি গতিকেও অনাদি বলে বিবেচনা করতেন।২৯ অপরদিকে ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী জগৎ সৃষ্ট। আল্লাহ্ জগতের স্রষ্টা। অ্যারিস্টটলের দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত গাযালি-পূর্ববর্তী মুসলিম দার্শনিকরা,বিশেষ করে আল-ফারাবি ও ইবনে সিনা,জগৎ বিষয়ক অ্যারিস্টটলীয় মতবাদের সাথে ইসলামি মতবাদের সমন্বয়ের প্রচেষ্টা চালান। তারা জগৎকে সৃষ্ট বলে উল্লেখ করেও একে অনাদি হিসাবে দাবি করেন। এ বিষয়ে তাদের যুক্তিসমূহ একত্র করে আল-গাযালি তাঁর তাহাফুত আল-ফালাসিফা গ্রন্থে উপস্থাপন করেন। জগতের অনাদি হওয়া বিষয়ক আলোচনা উক্ত গ্রন্থের প্রায় এক-চতুর্থাংশ স্থান দখল করে রেখেছে। আল-গাযালী জগতের অনাদিত্বের পক্ষে দার্শনিকদের যুক্তিসমূহ প্রথমে উপস্থাপন করে পরে তা খণ্ডনের চেষ্টা করেন।

দার্শনিদের প্রথম যুক্তি হল অনাদি বা নিত্য থেকে অনিত্য কিছু উদ্ভূত হওয়া সম্পূর্ণভাবে অসম্ভব। অর্থাৎ আল্লাহ যে অনাদি সত্তা তা ধর্মীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য। এ বিষয়ে কারও ভিন্নমত নেই। সে সূত্র ধরেই দার্শনিকরা তাদের প্রতিপাদ্য বিষয় অর্থাৎ জগতের অনাদিত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তারা বলেন,যদি এমন একটি পর্যায় ধরে নেওয়া হয় যখন পর্যন্ত আল্লাহ থেকে জগৎ উদ্ভূত হয়নি। এর পেছনে যুক্তি হিসাবে ভাবা হবে যে,এর অস্তিত্ব শুধু সম্ভাবনার পর্যায়ে ছিল। যখন পরবর্তীকালে জগৎ অস্তিত্বে এল,তখন একে ব্যাখ্যা করতে হলে দার্শনিদের মতে যে কোন একটি বিকল্পকে স্বীকার করে নিতে হবে,হয় নির্ধারক উদ্ভূত হয়েছে অথবা হয়নি। যদি নির্ধারক উদ্ভূত না হয়,তবে জগৎ শুধু সম্ভাবনার স্তরে থেকে যেত,যে অবস্থায় পূর্বে ছিল। কিন্তু যদি নির্ধারক উদ্ভূত হয় তবে প্রশ্ন উঠবে এটি কার দ্বারা উদ্ভূত হয়েছে এবং কেন এখন উদ্ভূত হল,পূর্বে কেন হয়নি? অতএব,নির্ধারকের উদ্ভূত হওয়া নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। দার্শনিকদের অভিমত হল যেহেতু অনাদি সর্বাবস্থায় একই রকম,সেজন্য হয় এ থেকে কোন কিছুই উদ্ভূত হবে না অথবা যা কিছু উদ্ভূত হবে তা অবিরামভাবে উদ্ভূত হতেই থাকবে।৩০ এভাবে দার্শনিকরা বলতে চাচ্ছেন,জগতের উদ্ভূত হওয়া স্বীকার করলে নানাবিধ যৌক্তিক সমস্যা দেখা দেয়। যেমন আল্লাহ্ কেন জগৎ আগে সৃষ্টি করেননি,এর আগে কি তিনি জগৎ সৃষ্টি করতে অপারগ ছিলেন? অথবা জগৎ পূর্বে সৃষ্টি হওয়া কি অসম্ভব ছিল? এর অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহ্ পূর্বে জগৎ সৃষ্টিতে অক্ষম ছিলেন পরে সক্ষমতা অর্জন করেছেন অথবা জগৎ অসম্ভাব্যতা থেকে সম্ভাব্যতায় এসেছে। এ দু’টি ব্যাখ্যাই দার্শনিকদের মতে অযৌক্তিক। দার্শনিকরা আরও বলেন যে,এমন দাবিও করা যাবে না যে,জগৎ উদ্ভূত হওয়ার পূর্বে এর উদ্দেশ্য ছিল না অথবা আল্লাহর জগৎ সৃষ্টির ইচ্ছা ছিল না,পরবর্তীকালে উদ্দেশ্য ও ইচ্ছার উন্মেষ ঘটেছে। এক্ষেত্রেও উদ্দেশ্য ও ইচ্ছার উদ্ভূত হওয়া সম্পর্কে নতুনভাবে প্রশ্নের উদ্ভব হবে। যদি জগৎ উদ্ভূত হওয়াকে আল্লাহর কর্ম হিসাবে বিবেচনা করা হয় সে ক্ষেত্রেও প্রশ্ন জাগবে : কেন এখন,এবং পূর্বে নয় কেন? এর কারণ কি উপায় অথবা ক্ষমতা অথবা উদ্দেশ্য অথবা প্রকৃতির অনুপস্থিতি? নতুনভাবে ইচ্ছা যে উদ্ভূত হতে পারে না সে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এসব যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে দার্শনিকরা সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে,অনাদি বা নিত্য থেকে অনিত্য কোন কিছু উদ্ভূত হওয়া সম্পূর্ণভাবে অসম্ভব। যেহেতু আল্লাহ্ অনাদি এবং অনাদি হওয়ার কারণে তার মধ্যে কোন ধরনের পরিবর্তনই সম্ভব নয়। জগতের যেহেতু কোন বিশেষ সময়ে শুরু হওয়া অসম্ভব এ থেকে জগৎ যে অনাদি তা নিঃসৃত হয়।৩১

এটি হল জগতের অনাদিত্ব প্রমাণে দার্শনিকদের প্রথম যুক্তি। আল্-গাযালি দার্শনিকদের এ যুক্তিকে সবচেয়ে চাতুর্যপূর্ণ যুক্তি বলে অভিহিত করেন।৩২ তাঁর মতে দার্শনিকরা আধিবিদ্যক যত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন এর সবগুলোই উপরিউক্ত যুক্তিটির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ। কেননা,এখানে তারা বিষয়টিকে নানাবিধ যুক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন যা অন্য কোন সমস্যার ক্ষেত্রে হয়নি।৩৩

আল্-গাযালি জগৎকে অনাদি হিসাবে মেনে নিতে রাজী নন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে দার্শনিকদের প্রথম যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে তিনি বলেন,কীভাবে দার্শনিকরা এ যুক্তিকে খণ্ডন করবেন- যদি কেউ বলে,অনাদি ইচ্ছা যখন চেয়েছেন তখনই জগৎ অস্তিত্বে এসেছে,যতক্ষণ চাননি ততক্ষণ পর্যন্ত তা অস্তিত্বে আসেনি। যখনই তিনি চেয়েছেন ঠিক তখনই জগৎ শুরু হয়েছে। আল্-গাযালির বক্তব্য হল অনাদি ইচ্ছার পক্ষে বিশেষ সময়ে জগৎ সৃষ্টিতে কোন বাধা নেই।৩৪ আল্-গাযালি অনাদিত্বের পক্ষে উপস্থাপিত দার্শনিকদের প্রথম যুক্তিটিকে নানাভাবে আলোচনা ও পর্যালোচনা করে বলতে চাচ্ছেন যে,অনাদি বা নিত্য থেকে অনিত্য কোন কিছু উদ্ভূত হওয়া সম্ভব। এমনকি দার্শনিকদেরও এটা মেনে নিতে হবে। কেননা,জগৎ অনিত্য বা অস্থায়ী ঘটনাবলিতে ভরপুর। এর একটিকে অন্যটির কারণ হিসাবে ধরা হয়ে থাকে। সেভাবে কার্য-কারণ শৃঙ্খল এক জায়গায় গিয়ে সমাপ্ত হয়। দার্শনিকরাও তাদের জগৎ সম্পর্কিত তত্ত্বে কার্যকারণ শৃঙ্খল যেখানে সমাপ্ত হয়েছে তাঁকে স্রষ্টা বলে অভিহিত করেছেন;তিনি হলেন অনিবার্য সত্তা,সমগ্র সম্ভাব্য বস্তু তাঁর ওপর নির্ভরশীল। অতএব,ক্ষণস্থায়ী ঘটনাবলির শৃঙ্খল যেখানে গিয়ে সমাপ্ত হয় তাঁকেই অনাদি বলে অভিহিত করতে হয়। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে,অনাদি থেকে ক্ষণস্থায়ী বা অনিত্য কোন কিছু উদ্ভূত হওয়া সম্ভব।৩৫

দার্শনিকরা জগতের অনাদিত্বের পক্ষে দ্বিতীয় যুক্তিটি উপস্থাপন করতে গিয়ে বলেন,যাঁরা আল্লাহ কে জগতের পূর্ববর্তী এবং জগৎকে পরবর্তী বলে বিশ্বাস করেন তারা এর ব্যাখ্যা দু’টি বিকল্পের যে কোন একভাবে করতে বাধ্য। প্রথম বিকল্পটি হল আল্লাহ সত্তাগত দিক থেকে জগতের পূর্ববর্তী,কিন্তু সময়গত দিক থেকে নন। যেমন ‘এক’ ‘দুই’ এর পূর্ববর্তী। এ পূর্ববর্তিতা প্রকৃতিগত,যদিও উভয়ই একই সময়ে অস্তিত্বশীল। দার্শনিকরা অন্যভাবেও এর ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করতে পারেন। তাদের মতে কারণ কার্যের পূর্ববর্তী,কিন্তু তারা একই সময়ে অবস্থান করে। যেমন মানুষের হাঁটার সাথে ছায়ারও হাঁটা। প্রথমটি দ্বিতীয়টির কারণ হওয়া সত্ত্বেও কালগত দিক থেকে তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। দার্শনিকরা আল্লাহ্ ও জগতের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ক এ বিকল্পটি গ্রহণ করে বলতে চান,আল্লাহ অনাদি হলে জগৎও অনাদি হবে। এটি সম্ভব নয় যে,একটি অনাদি হবে আর অপরটি হবে অনিত্য।৩৬

এর পরে দার্শনিকরা আল্লাহর পূর্ববর্তিতা সম্পর্কে দ্বিতীয় বিকল্পটি আলোচনা করেন। দ্বিতীয় বিকল্পটি হল আল্লাহ এবং জগতের মধ্যে সময়গত পার্থক্য। অর্থাৎ আল্লাহ সময়ের দিক থেকে পূর্ববর্তী এবং জগৎ পরে আবির্ভূত হয়েছে। অর্থাৎ পার্থক্যটি শুধু সত্তাগত নয়,সময়গতও বটে। এ বিকল্পটি গ্রহণ করলে যে যৌক্তিক জটিলতা সৃষ্টি হয় দার্শনিকরা তা দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তারা বলেন,আল্লাহ যদি সময়গত দিক থেকে জগতের পূর্ববর্তী হন তবে এ থেকে আরেকটি বিষয়ের উদ্ভব হবে,তা হল জগৎ এবং সময় অস্তিত্বে আসার পূর্বে এমন একটি সময় ছিল যখন জগৎ অস্তিত্বশীল ছিল না। ঐ সময়ে অর্থাৎ যখন জগৎ অস্তিত্বশীল ছিল না সেই সময়,জগৎ অস্তিত্বশীল হওয়ার পরবর্তী সময়ের পূর্ববর্তী। এ থেকে এটা নিঃসৃত হয় যে,আল্লাহ্ এমন একটি সময়ে অস্তিত্বশীল ছিলেন যখন জগৎ অস্তিত্বে আসেনি এবং জগৎ অস্তিত্বে আসার সাথে সাথেই সেই সময়টির পরিসমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু এ সময়টির কোন শুরু ছিল না। এ থেকে এটি প্রমাণিত হয় যে,সময়ের পূর্বে একটি অসীম সময় ছিল। দার্শনিকদের মতে তা হবে পরস্পর বিরোধী। দার্শনিকরা এ কারণে বলেন,সময়ের সূত্রপাত হয়েছে এটা মেনে নেওয়া অসম্ভব। সময়কে অনাদি হিসাবে মেনে নেওয়ার অর্থ হল গতির পরিমাপককে অনাদি হিসাবে মেনে নেওয়া এবং একই যুক্তিতে গতিও হবে অনাদি। গতি অনাদি হলে গতি যার গতি অর্থাৎ জগৎ,সেটিও হবে অনাদি।৩৭

উক্ত আলোচনা থেকে যে বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে তা হল দার্শনিকরা জগতের পূর্ববর্তী হিসাবে যে দু’টি বিকল্পের উল্লেখ করেছেন সেই বিকল্প দু’টি পর্যালোচনার মাধ্যমে তারা দেখাতে চাচ্ছেন যে,প্রথম বিকল্পটি অর্থাৎ আল্লাহর পূর্ববর্তিতা সত্তাগত,সময়গত নয়- যৌক্তিকভাবে গ্রহণযোগ্য। দ্বিতীয় বিকল্পটি অর্থাৎ আল্লাহ সময়গত দিক থেকে জগতের পূর্ববর্তী- গ্রহণ করলে যৌক্তিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। সেজন্য দ্বিতীয় বিকল্পটি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শেষ পর্যন্ত এর অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহ যদি সময়ের দিক থেকে জগতের পূর্ববর্তী না হন,তাহলে আল্লাহ ও জগৎ উভয়েই অনাদি হয়।

আল্-গাযালি দার্শনিকদের এ ব্যাখ্যা মানতে রাজী নন। তাঁর মতে সময় শুরু হয়েছে এবং তা সৃষ্ট। যখন বলা হয়,আল্লাহ্ জগৎ ও সময়ের পূর্ববর্তী,তখন এর দ্বারা এটি বুঝানো হয় যে,তিনি ছিলেন,জগৎ ছিল না,পরবর্তীকালে আল্লাহ্ ও জগৎ উভয়েই বিদ্যমান। ‘তিনি ছিলেন এবং জগৎ ছিল না’ এর অর্থ হল জগতের অস্তিত্বের পূর্বে তার সত্তাই একমাত্র সত্তা ছিল। এ উক্তিকে বুঝানোর জন্য অন্য কোন বস্তুর ধারণার প্রয়োজন নেই। যদি কল্পনায় তৃতীয় কোন বস্তুর ধারণা চলে আসে তবে কল্পনার এ ভুলপথ অনুসরণ করাকে কোন গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই।৩৮ আল্-গাযালি এভাবে দেখান যে,সময়গত দিক থেকে আল্লাহ কে পূর্ববর্তী মেনে নিলে যৌক্তিক কোন সমস্যা সৃষ্টি হয় না। অর্থাৎ আল্লাহ কে অনাদি মেনে নিলে জগৎকেও অনাদি মেনে নিতে হবে এমন কোন যৌক্তিক বাধ্যবাধকতা নেই।

দার্শনিকরা জগতের অনন্ত সম্ভাবনা থেকে জগৎকে অনাদি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। তারা বলতে চাচ্ছেন,জগৎ সৃষ্টির পূর্বে এর সম্ভাবনা ছিল। যা অসম্ভব তা কখনও সম্ভব হতে পারে না। অতএব,জগৎ কোন সময়েই অসম্ভব ছিল না। অর্থাৎ জগৎ সব সময়ই সম্ভব ছিল। যা সব সময় সম্ভব তার কোন শুরু হতে পারে না। এভাবে তারা বলতে চাচ্ছেন,জগতেরও কোন শুরু নেই,তা অনাদিকাল থেকেই আছে।৩৯ এখানে দার্শনিকরা একটি যৌক্তিক কৌশল অবলম্বন করেছেন,অর্থাৎ জগতের সম্ভাবনাকে অনাদি প্রমাণ করে জগৎকে অনাদি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। এ বিষয়ে আল-গাযালির বক্তব্য হল বাস্তবে জগতের অস্তিত্বে আসা এবং সম্ভাবনা এক জিনিস নয়। অতএব,সম্ভাবনা ছিল এর অর্থ এ নয় যে,জগৎ বাস্তবেও অস্তিত্বে ছিল। অতএব,আল্-গাযালির কাছে জগতের অনন্ত সম্ভাবনা থেকে তা অনাদি এ ধারণায় উত্তরণের যৌক্তিক প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্য নয়।

দার্শনিকরা জগতের অনাদিত্ব বিষয়ক তাদের চতুর্থ যুক্তিতে বলেন যে,প্রতিটি উদ্ভূত বস্তুর পূর্বেই এর উপাদান থাকতে হবে। কোন উদ্ভূত বস্তুই উপাদান ছাড়া হতে পারে না এবং উপাদান স্বয়ং উদ্ভূত নয়। শুধু আকার,অবান্তর লক্ষণ বা গুণাবলিই উদ্ভূত। দার্শনিকরা এখানে যুক্তি উপস্থাপন করে বলেন যে,জগতের উদ্ভূত হওয়ার পূর্বে সম্ভাবনা ছিল। সম্ভাবনা সাপেক্ষ গুণ। এর জন্য একটি দ্রব্য প্রয়োজন। খালি খালি সম্ভাবনা থাকতে পারে না। আর এ দ্রব্যই হল উপাদান বা জড়। অতএব,উপাদান অনাদি এবং এর অর্থ হল জগৎ অনাদি।৪০

আল্-গাযালি এর উত্তরে বলেন,দার্শনিকরা জগতের সম্ভাবনা সম্পর্কে যে কথা বলেছেন তা উদ্ভূত হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক অবধারণ থেকে। কিন্তু এ বুদ্ধিবৃত্তিক অবধারণের জন্য কোন বাস্তব অস্তিত্বশীল সত্তার প্রয়োজন নেই। আল্-গাযালি দার্শনিকদের যুক্তিকে নানাভাবে পর্যালোচনা করে দেখান যে,জগতের সম্ভাবনা সংক্রান্ত বুদ্ধিবৃত্তিক অবধারণ থেকে উপাদানের অনিবার্য উপস্থিতি নিঃসৃত হয় না। অতএব,উপাদানের অনাদি হওয়া সংক্রান্ত দার্শনিকদের অবস্থান যৌক্তিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়।৪১ এভাবে আল্-গাযালি দার্শনিকদের সর্বশেষ যুক্তিকেও নাকচ করে দেন। আল্-গাযালির বক্তব্য হল আল্লাহ্ই একমাত্র অনাদি সত্তা,জগতের অনাদিত্ব সম্পর্কিত দার্শনিকদের দাবি যৌক্তিকভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ।

প্রখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে রুশদ জগতের অনাদিত্ব সম্পর্কিত পূর্ববর্তী দার্শনিকদের বক্তব্য খণ্ডন করে আল্-গাযালি যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেছেন সেগুলোর মধ্যে অসঙ্গতি রয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি প্রকারান্তরে এ সমস্যা সম্পর্কিত দার্শনিকদের অবস্থানের পক্ষেই যুক্তি প্রদর্শন করেন। অর্থাৎ তিনিও জগৎকে অনাদি বলেই গণ্য করেন। আল্-গাযালি তাঁর তাহাফুত-আল-ফালাসিফা গ্রন্থে দার্শনিকদের যুক্তিসমূহ খণ্ডন করে যে বক্তব্য রাখেন ইবনে রুশদ সেগুলোকে খণ্ডনের উদ্দেশ্যে তাহাফুত-আল-তাহাফুত নামক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনিও আল্-গাযালির ন্যায় উক্ত গ্রন্থে অনাদিত্ব বিষয়ক আলোচনাকে সর্বাগ্রে স্থান দেন। ইবনে রুশদের বক্তব্য হল জগতের অনাদিত্ব বিষয়ক দার্শনিকদের যুক্তিসমূহ নয়;বরং দার্শনিকদের বিরুদ্ধে উপস্থাপিত আল্-গাযালির যুক্তিসমূহই অসঙ্গতিপূর্ণ।৪২ ইবনে রুশদ বলেন,জগৎ যে আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট এতে কোন সন্দেহ নেই,কিন্তু এটি যে শূন্য থেকে সৃষ্ট এবং সময়ে সৃষ্ট এ সম্পর্কিত কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য কুরআনে নেই। তিনি বলেন,কুরআনে একটি জায়গায়ও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই যে,‘আল্লাহ অ-সত্তার সাথে এক সঙ্গে অস্তিত্বশীল ছিলেন’ এবং জগৎ পূর্বে অস্তিত্বশীল না থেকে পরে অস্তিত্বে এসেছে। বরং কুরআনের অনেকগুলো আয়াতের তাৎপর্য এটাই নির্দেশ করে যে,জগতের আকার বিশেষ সময়ে সৃষ্টি হয়েছে,পক্ষান্তরে এর স্থিতিকাল ও উপাদান অসৃষ্ট। যেমন ‘তিনিই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেন,তখন তাঁর ‘আরশ ছিল পানির ওপর’ (কুরআন,১১ : ৭)- এ আয়াতের দ্বারা পানি,আরশ এবং সময়-যা হল স্থিতিকালের পরিমাপক-এর অনাদিত্ব প্রমাণিত হয়। একইভাবে অন্যত্র উল্লেখ রয়েছে,‘অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন যা ছিল ধুম্রপুঞ্জ বিশেষ’ (কুরআন ৪১ : ১১)। এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে,আকাশ পূর্বে অস্তিত্বশীল উপাদান ‘ধুম্র’ দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে।৪৩ এখানে সুস্পষ্টভাবেই বুঝা যাচ্ছে যে,ইবনে রুশদ পূর্ববর্তী দার্শনিকদের ন্যায় জগতের অনাদিত্বে বিশ্বাসী।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে মুসলিম দর্শনে অনাদিত্ব বিষয়ক বিতর্কের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। এটা সবাই স্বীকার করেন যে,আল্লাহ হলেন অনাদি সত্তা। কিন্তু তিনিই একমাত্র অনাদি সত্তা কিনা এ নিয়েই বিতর্কের সূত্রপাত। আলোচনায় দেখা গিয়েছে আল্লাহর গুণাবলিকে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল অনাদি সত্তা হিসাবে গ্রহণ করলে নানাবিধ বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় এবং ইসলামের মর্মবাণী তাওহীদের সাথে এ মতটি সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে বিবেচনা করা সম্ভব হয় না। একইভাবে কুরআনের নিত্যতা নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। আল্লাহর বাণী হিসাবে এর একটি চিরন্তন আবেদন রয়েছে,কিন্তু যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে কুরআনকে আল্লাহর সমান্তরাল একটি অনাদি সত্তা হিসাবে প্রমাণের প্রচেষ্টা যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে নানাবিধ জটিলতার জন্ম দেয়। মুসলিম-দর্শনে জগতের অনাদিত্ব বিষয়ক বিতর্কটির সূত্রপাত ঘটে মূলত অ্যারিস্টটলীয় দর্শনের প্রভাবের ফলে। অ্যারিস্টটলের দর্শনের সাথে সৃষ্টি বিষয়ক ইসলামি চিন্তাধারার সমন্বয় করার জন্য এ বিষয়ে এত আলোচনা ও পর্যালোচনা হয়েছে। ইসলামে আল্লাহকে যে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী,অনুপম সত্তা হিসাবে বিশ্বাস করা হয় তা অ্যারিস্টটলীয় দর্শনে অনুপস্থিত। অতএব,অ্যারিস্টটলীয় ভাবধারাকে সমুন্নত রেখে জগৎ সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান বিশুদ্ধ ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

 

তথ্যসূত্র :

১. Majid Fakhry, A History of Muslim Philosophy, Second edition, London: Longman, 1983; New York: Columbia University Press, 1983. p. 47

২. M.M Sharif, ed., A History of Muslim Philosophy, Wiesbaden: Otto Harrassowitz, 1963, Vol. one, p. 200

৩. M. al-Shahrastani, Al-Milal Wa’l-Nihal, London, 1892, p. 30, Majid, Fakhry, op.cit., p. 57

৪. Abul Hasan al-Ash‘ari, Maqalat al-Islamiyin, Istanbul; 1939-40, pp.156-57, †`Lyb : Majid Fakhry, op.cit., p. 57; also see A.J. Wensinck, The Muslim Creed. 2nd impression, London: Frank Cass & Co. Ltd. 1965, pp. 73-74, cf. Abu Mansur Abd-al-Qahir ibn-Tahir al-Baghdadi (d.1037) Al-Farq Bain al-Firaq English translation, Moslem Schisms and Sects, New York: Columbia University Press, 1920, p. 116 (Hereinafter the English translation of this book will be cited as reference)

৫. দেখুন,Al-Shahrastai, op.cit. p. 30, Wensinck, op.cit. p.75

৬. Wensink, op. cit. p.75
৭.  দেখুন : বাগদাদের প্রধান বিচারপতির কাছে লেখা খলিফা আল-মামুনের পত্র,উদ্ধৃত : আল্- তাবারী,তারীখ,কায়রো,১৯৩৯,৭ম খণ্ড,পৃ ১৯৮;ইবনে আল্-নাদীম,কিতাব আল-ফিহরিস্ত,কায়রো (সন উল্লেখ নেই). পৃ. ২৬৯-৭০; Fakhry, op. cit. p. 61

৮.  Al-Baghdadi, Usul al-Din, Istanbul, 1928, p.106; al-Ashari, op. cit. p. 598; al-Shahrastani, op. cit., p. 34; Fakhry, op. cit., p. 61-62; T.J. De Boer, The History of Philosophy in Islam, Eng. tr. Edward R. Jones, Delhi, Cosmo Publications reprint. 1983 (first published in 1903) pp. 50-51

৯.    Al-Ashari, op. cit., pp. 191, 588; Fakhry, op. cit., p. 62

১০.   কুরআন,৮৫ : ২১

১১.   Al-Ashari, op. cit., p. 598; Fakhry, op. cit., p. 62

১২.  A.H. Al-Khayyat, Kitab al-Intisar, Beirut; 1957, al-Ashari, op. cit., pp. 582, 589, Fakhry, op. cit., p. 62

১৩.  W.M. Patton, Ahmad b. Hambal and the Minha, Leyden, 1897, pp. 33ff. 50ff; Fakhry, op. cit., p. 63; দেখুন: Saiyed Abdul Hai, Muslim Philosophy, 2nd ed. Dhaka: Islamic Foundation Bangladesh, 1982, pp. 114-115

১৪.   দেখুন: Fakhry, op. cit., p. 63; Patton, op. cit., p. 139ff

১৫.   দেখুন: R.J. McCarthy, The Theology of al-Ash‘ari. Beirut, 1953, p.9: Fakhry, op. cit., p. 206

১৬.   Sharif. op. cit., p. 226; Fakhry, op. cit, p. 205

১৭.   Sharif, op. cit., p. 227

১৮.  Al-Ashari, Kitab al-Ibanah ‘an Usul al-Diyanah, Hyderabad, 1903, p. 47; Sharif, op. cit., p. 227

১৯.   Sharif, op. cit., p. 227

২০.    Al-Ashari, al-Maqalat, p. 291; Sharif, p. 227

২১.    Fakhry, op. cit., p. 206-7; al-Ashari, al-Ibanah, p. 54

২২.  Abu al-Ala, Sharh-i Mawaqif, Lucknow; Newal Kishore (N.D.), p. 571; Sharif, op. cit., pp. 227-8

২৩.    Sharif, op. cit., pp. 228-9, al-Ashari, al-Maqalat, p. 484

২৪.    Sharif, op. cit., p. 232

২৫.    Kitab al-Asma’ wa-al-Sifat, p. 198; Sharif, op. cit., p. 233

২৬.    Qadi ‘Add and Sayyid Sharif, Sharh al-Mawaqif, (N.P., N.D) p. 601

২৭.    Ibid., p.602; Al-Ashari, al-Ibanah, pp. 23-42, Sharif, op. cit., p. 233

২৮.    Al-Ashari, al-Maqalat, pp. 292, 582-602; Sharif, op. cit., pp. 233-34

২৯.    দেখুন : Simon Van Den Bergh, English translation of Ibn Rushd’s Tahafut al-Tahafut, London: Luzac & Co. 1954, translator’s Introduction, pp. XV-XVII,আবদুল জলিল মিয়া অনূদিত,অ্যারিস্টটলের অধিবিদ্যা,ঢাকা,বাংলা একাডেমী,১৯৮৮,পৃ. ৩২৫,৩৩১,৩৩৪

৩০.   Al-Ghazali, Tahafut al-Falasifa, Eng. tr. Sabih Ahmad Kamali, (Incoherence of the Philosophers), Lahore: Pakistan Philosophical Congress, 1963,  p. 14

৩১.   Ibid., p. 15

৩২.   Loc. cit.

৩৩.   Ibid., pp. 15-16

৩৪.   Ibid., p. 16

৩৫.   Ibid., p. 32

৩৬.   Ibid., pp. 35-36

৩৭.   Ibid., p. 36

৩৮.   Ibid., pp. 36-37

৩৯.   Ibid., pp. 45-46

৪০.   Ibid., p. 47

৪১.   Ibid., pp. 48-49

৪২.   বিস্তারিত তথ্যের জন্য দেখুন : Ibn Rushd. Tahafut al-Falasifah, Eng. tr. pp. 1-69

৪৩.  Ibn Rushd. Fasl al-Maqal, Cairo, N.D. p. 13, দেখুন : Fakhry, op. cit., p. 282

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)