আল হাসানাইন (আ.)

নৈতিকতা ও কতিপয় মূল্যবান উপদেশ -প্রথম পর্ব

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

ভূমিকা

মানুষের শরীরের যেমন খাদ্য,বস্ত্র ও আশ্রয়ের চাহিদা আছে ঠিক তেমনি তার আত্মারও চাহিদা রয়েছে। আর তা হল নৈতিক ও অন্যান্য শিক্ষার চাহিদা। যে ব্যক্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে অজ্ঞ,যে নৈতিক শিক্ষায় বেড়ে ওঠেনি এবং নোংরা ও অশ্লীল কাজ হতে বিরত থাকে না সে বাহ্যিকভাবে মানুষ হলেও বাস্তবে সে মনুষ্যত্ব থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। আর তাই ইরানের বিখ্যাত কবি হাফিজ বলেন : 

‘মানুষকে সম্মানিত করে তার আত্মা;

সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদ মানুষকে সম্মানিত করে না।

যদি চোখ,জিহ্বা,কান এবং নাক গঠন করে মানুষকে

তাহলে কি পার্থক্য মানুষ ও দেয়ালে আঁকা ছবির মধ্যে;

সত্যিকার মানুষ হও,নতুবা হবে তুমি মানুষের বুলি আওড়ানো একটি পাখি

যদি তুমি তোমার হিংস্র স্বভাবের করতে পার মূলোৎপাটন

তবে তুমি যাপন করবে এক মানুষের জীবন।’

এ জন্যই প্রত্যেক নবী-রাসূলের কাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল নৈতিকতাপূর্ণ ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণের শিক্ষা দান। তাঁরা বিরাজমান পরিবেশ-পরিস্থিতিতে কখনও নিজেরা আচরণের মাধ্যমে,কখনও বক্তৃতা,উপদেশবাণী ইত্যাদির মাধ্যমে নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছেন।

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) হলেন মানবজাতির জন্য আদর্শ। পবিত্র কুরআনে তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে :

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ

‘নিশ্চয়ই রাসূলের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।’

এক ব্যক্তি হযরত আয়েশার কাছে জিজ্ঞাসা করে : ‘রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর চরিত্র কেমন ছিল?’ তিনি বলেন : ‘তুমি পবিত্র কুরআন পাঠ করনি? পবিত্র কুরআনই রাসূলের চরিত্র।’

রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর শিক্ষা হল এমনকি শত্রুর সাথেও সৌহার্দপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে তার মনোভাবের পরিবর্তন করা। এক বৃদ্ধা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত। একদিন রাসূল কাটা দেখতে না পেয়ে ঐ বৃদ্ধার খোঁজ করলেন। তাঁকে বলা হল যে,বৃদ্ধা অসুস্থ। রাসূল তাকে দেখতে গেলেন এবং তাকে সান্ত্বনা দিলেন। এরপর ঐ বৃদ্ধা মুসলমান হয়ে গেল। এমনই ছিল রাসূলের শিক্ষা। মহান ইমামগণও রাসূলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অনেক দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। যারা তাঁদের সম্পর্কে কটু কথা বলত তাদের সাথেও তাঁরা কোমল আচরণ করতেন,তাদের অভাব পূরণ করতেন।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এবং ইমামগণের অসংখ্য হাদীসে মানুষের চরিত্রগঠনমূলক বিষয়ের বর্ণনা এসেছে। আমরা যদি তাঁদের জীবন এবং বাণীগুলো থেকে শিক্ষা নেই তাহলেই আমরা উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে পারব। এ উন্নত চরিত্র গঠন সংক্রান্ত যে শিক্ষা তাকে আখলাক (اخلاق) বা নীতিশাস্ত্র বলা হয়।

আখলাক (اخلاق)

اَخْلَاقٌ শব্দটি خَلْقٌ বা خُلْقٌ শব্দ থেকে এসেছে। خَلْقٌ (প্রকৃতি বা স্বভাব) ও خُلْقٌ (প্রকৃতি বা চরিত্র) শব্দ দু’টি মূলত একই,কিন্তু خَلْقٌ মানুষের বাহ্যিক কাঠামোকে নির্দেশ করে যা চোখে দেখা যায় যেখানে خُلْقٌ মানুষের অভ্যন্তরীণ শক্তি ও সহজাত বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে যা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। ইমাম আলী (আ.) বলেছেন : ‘خُلْقٌ আত্মার সাথে সম্পর্কিত,যেখানে خَلْقٌ শরীরের সাথে সম্পর্কিত।’

মানুষের চেহারার মধ্যে যেমন পার্থক্য আছে- কারও চেহারা সুন্দর,আবার কারও কুৎসিৎ,তেমনি মানুষের আত্মার মধ্যেও পার্থক্য আছে- কোনটা সুন্দর- মানবিক,কোনটা অমানবিক। মানুষের শারীরিক কাঠামো সৃষ্টিগত নিয়মের ওপর নির্ভরশীল। এখানে মানুষের করার কিছু নেই। বিপরীত দিকে আমাদের আচরণ এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকাংশই শিক্ষা ও চেষ্টা-প্রচেষ্টার মাধ্যমে গঠিত হয়।

ইবনে মাসকুয়ী তাঁর ‘তাহারাতুল আরাক’ গ্রন্থে বলেছেন : ‘خُلْقٌ হল মানুষের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যা কোনরূপ চিন্তাভাবনা ছাড়াই মানুষকে তার দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করে।’আর এটি দু’ প্রকারের : এর একটি অংশ স্বাভাবিক- যা মানুষের সহজাত। যেমন যখন এক ব্যক্তি কোন তুচ্ছ বিষয়েই ভয়ংকর রূপ ধারণ করে অথবা সামান্য ঘটনায় ভয় পায় অথবা খুশী বা হতাশাগ্রস্ত হয়।

এর অন্য অংশ নির্ভর করে আমাদের অভ্যাস ও অনুশীলনের ওপর। এ অংশ প্রথমে চিন্তার ওপর নির্ভরশীল থাকে;কিন্তু পরবর্তীকালে অনুশীলন এবং পুনপুন করার মাধ্যমে অভ্যাসে পরিণত হয়;তারপর কোনরূপ চিন্তা ছাড়াই কাজ করে। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমাদের মধ্যে স্থিরতা লাভ না করে ততক্ষণ তা নৈতিক বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ একটি মানুষ যদি হঠাৎ কোন ভাল বা মহৎ কাজ করে তাহলে তাকে মহৎ বলা যায় না। আবার হঠাৎ বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্যও কাউকে বীর বলা যায় না। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে কেবল তখনই خُلْقٌ বলা যায় যখন তা প্রতিনিয়ত কোন চিন্তাভাবনা ছাড়াই মানুষের মধ্যে প্রকাশিত হয়।

নীতিশাস্ত্র শিক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা

মানুষের নীতিশাস্ত্র শিক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে। একজন মানুষের প্রবৃত্তি ও আকাঙ্ক্ষার একটি পরিমিত পর্যায় পর্যন্ত উপভোগ করা,অন্যদের সাথে শান্তিতে বসবাস এবং পার্থিব ও পরকালীন উন্নতির জন্য নীতিশাস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

মানব সমাজের উন্নতি এবং অধঃপতন কেবল বিজ্ঞান ও বস্তুগত উন্নতির ওপর নির্ভর করে না;বরং নৈতিকতার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিই মানব সমাজের উন্নতি বা পতনের কারণ। নীতিশাস্ত্র মানব জাতিকে জীবন্ত রাখে,যে গোষ্ঠীর নীতি নেই,তার ধ্বংস অনিবার্য।

নৈতিকতার অভাব মানবসমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলা যায়। নৈতিকতার অভাব ভাল লোকের ভাল আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রভাবিত করতে পারে। বিপরীত দিকে নীতি-নৈতিকতা কোন বিপথগামী লোককেও রক্ষা করতে পারে। নীতিশাস্ত্রের প্রয়োজন সকলের-শাসিত কিংবা শাসক,এমনকি নবী-রাসূলগণেরও।

পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে :

قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا وَ قَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا

‘যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে সে-ই সফলকাম,আর যে নিজেকে কলুষিত করে সে ব্যর্থ হয়।’

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ছিলেন উত্তম চরিত্রের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলছেন :

إِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيْمٍ

‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’

ইসলামের নৈতিকতা শিক্ষার প্রশংসনীয় দু’টি প্রকৃতি রয়েছে : একটি হল অপ্রকৃত বা গৌণ দিক,অপরটি হল প্রকৃত বা মুখ্য দিক।

নীতিশাস্ত্রের অপ্রকৃত দিকের মধ্যে রয়েছে শারীরিক ও পোশাক-আশাকের পরিচ্ছন্নতা,হাসিখুশী থাকা,অন্যদের সম্মান করা,নম্রভাবে কথা বলা,অসুস্থ ব্যক্তিদের দেখতে যাওয়া,অহংকার পরিত্যাগ করা,সন্দেহ না করা ইত্যাদি।

কিন্তু নীতিশাস্ত্রের প্রকৃত দিক হল মানবচরিত্রের ঐ সকল বিষয় যেগুলো মানব চরিত্রের সত্যিকার বৈশিষ্ট্য। যেমন মহানুভবতা,ন্যায়পরায়ণতা,প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা,বিশ্বস্ততা,মানবতাবোধ ইত্যাদি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নীতিশাস্ত্রের গৌণ বিষয়গুলো যা প্রায় প্রত্যেক মানুষের পক্ষে কম-বেশি অর্জন করা সম্ভব। যদি কেউ চায় যে,এগুলো মেনে চলবে তাহলে অনুশীলনের মাধ্যমে তা করা সহজ। কিন্তু নীতিশাস্ত্রের মুখ্য বিষয়গুলো এবং সর্বোৎকৃষ্ট মানবীয় চরিত্র অর্জন করা খুবই কঠিন। সবাই তা অর্জন করতে পারে না। কেবল ঐ সব ব্যক্তিই তা অর্জন করতে পারে যারা উন্নত আত্মার অধিকারী,নিজের ওপর যাদের নিয়ন্ত্রণ আছে,যারা মানবীয় রীতি মেনে চলায় অভ্যস্ত এবং মহান আল্লাহ্কে মান্য করে।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) মহান ইসলামী শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে নৈতিক চরিত্র গঠনের জন্য উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন :

أَفْضَلُ النَّاسِ إِيْمَاناً أَحْسَنُهُمْ خُلْقاً

‘ঈমানের দৃষ্টিতে সর্বোত্তম মানুষ হল তারা যারা সদাচরণের দিক থেকে সর্বোত্তম।’

রাসূল (সা.) বলেছেন :

بُعِثْتُ لِمَكَارِمِ الْأَخْلَاقِ

‘মহৎ গুণাবলির পূর্ণতার জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি।’

আরেকটি হাদীসে এসেছে :

بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ حُسْنَ الْأَخْلَاقِ

‘আমি নৈতিকতাকে পূর্ণতা দানের জন্য প্রেরিত হয়েছি।’

এক ব্যক্তি ইমাম সাদিক (আ.)-কে উত্তম মানবীয় গুণাবলি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। তিনি বলেন : ‘তুমি মানুষকে দয়া করবে,নম্রভাবে কথা বলবে এবং তোমার ভাইয়ের সাথে উত্তম আচরণ করবে।’

আরেক ব্যক্তি ইমাম সাদিক (আ.)-এর কাছে এসে বলল : ‘হে আল্লাহর রাসূলের সন্তান! আমাকে নৈতিক গুণাবলি সম্পর্কে বলুন।’ ইমাম বললেন : ‘যে তোমার ওপর জুলুম করেছে তাকে ক্ষমা করবে,যে তোমার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করেছে তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবে,তোমার প্রাপ্য থেকে যে তোমাকে বঞ্চিত করেছে তাকে প্রদান করবে এবং সত্য কথা বলবে যদি তা তোমার বিপক্ষেও হয়।’

সহীফায়ে সাজ্জাদিয়ায় ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) তাঁর দোয়ায়ে ‘মাকারিমুল আখলাক’-এ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন : ‘হে আল্লাহ্! হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর বংশধরদের ওপর দরুদ ও সালাত প্রেরণ করুন। আমাকে সাহায্য করুন যাতে যে আমাকে প্রতারিত করেছে তাকে সদুপদেশ দানের মাধ্যমে তার প্রতারণাকে প্রতিরোধ করতে পারি,যে আমাকে ত্যাগ করেছে তার প্রতি সদাচরণের মাধ্যমে এ কর্মের শাস্তি দিতে পারি। যে আমাকে বঞ্চিত করেছে তাকে দানের মাধ্যমে পুরস্কৃত করতে পারি;যে আমার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে তার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বিষয়টিকে মোকাবিলা করতে পারি;যে আমার গীবত করেছে তার ভাল দিকগুলো স্মরণের মাধ্যমে তার গীবতকে প্রতিরোধ করতে পারি;আমি যেন কল্যাণের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি এবং মন্দ থেকে চোখ বন্ধ করতে পারি।’

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) মক্কা বিজয়ের পর তাঁর চরম শত্রুকেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। সিফ্ফীনের যুদ্ধে মুয়াবিয়ার সৈন্যরা ফোরাতের দখল নিয়ে এর পানি ব্যবহার করতে ইমাম আলীর সৈন্যদের বাধা দেয়। ইমাম আলীর সৈন্যরা যখন মুয়াবিয়ার সৈন্যদের সরিয়ে নদীর দখল লাভ করে তখন তাঁর সৈন্যদের কেউ কেউ বলেছিল,আমরাও মুয়াবিয়ার সৈন্যদের পানি নিতে দেব না। কিন্তু ইমাম আলী (আ.) জবাবে বলেন : ‘আমরা তাদের ভুলের বিপরীতে দুর্ব্যবহার করব না,আমরা তাদেরকে পানি ব্যবহার করতে বাধা দেব না।’

যখন এক দোকানদার আলী (আ.)-এর সেনাপতি মালিক আশতারের মাথায় আবর্জনা নিক্ষেপ করে,তখন মালিক আশতার মসজিদে চলে যান। তিনি এ ব্যক্তির জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন।

ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-কে যখন তাঁর এক প্রতিবেশী অপমান করে তখন তিনি তার বাড়িতে যান এবং বলেন : ‘যদি তুমি যা বলেছ তা সত্য হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহ্ যেন আমাকে ক্ষমা করেন। আর তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য না হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহ্ যেন তোমাকে ক্ষমা করেন।’

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এবং ইমামগণের এ ঘটনাগুলো উত্তম নৈতিক চরিত্রের কিছু দৃষ্টান্ত।

নীতিশাস্ত্রের অপ্রকৃত বিষয়গুলোর সাথে প্রকৃত বিষয়ের পার্থক্য হল অপ্রকৃত বিষয়গুলো বস্তুগত কল্যাণের মাধ্যম,কিন্তু প্রকৃত বিষয়গুলো আধ্যাত্মিক উন্নতি অর্জনের সোপান। প্রথমটি আমাদের জীবনকে সুশৃঙ্খল করে,যেখানে পরেরটি আমাদের আত্মাকে উন্নত এবং সন্তুষ্ট করে।

মানুষের জীবনে নৈতিক শিক্ষার ভূমিকা

পশুপাখি জন্মের পরই সহজাত প্রবৃত্তির মাধ্যমে তার কাজ সম্পর্কে জানে। তাদের কোন প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই। যখন মাছের পোনা ডিম ফুটে বের হয় তখন থেকেই জানে কীভাবে সাঁতার কাটতে হবে,কীভাবে খাদ্য খেতে হবে,কীভাবে নিজেকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। তাকে কিছুই শিক্ষা দিতে হয় না।

এনোফিলিস মশা লতা-পাতাভোজী,কিন্তু সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চার খাবারের জন্য দরকার শুয়োপোকা বা এ রকম কীট। তখন মা মশা এ রকম বিশেষ কীট শিকার করে,একে হুল ফুটিয়ে নিস্তেজ করে। এভাবে সে তার বাচ্চার জন্য টাটকা মাংসের ব্যবস্থা করে। এটা সে করে তার সহজাত প্রবৃত্তির মাধ্যমে-কোন শিক্ষার মাধ্যমে নয়। এটা সে অর্জন করেনি।

সহজাত প্রবৃত্তির কারণেই মৌমাছি ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে,আশ্রয়স্থল তৈরি করে এবং চাকের প্রতিটি মাছির মধ্যে কাজ বণ্টন করে দেয়।

কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে তার প্রতিদিনের কর্তব্য সম্পাদন করা এবং পূর্ণতায় পৌঁছানোর জন্য সহজাত প্রবৃত্তি এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বুদ্ধকরণের চেয়েও বেশি কিছু প্রয়োজন। তাছাড়া বিবেকের পাশাপাশি তার দিক-নির্দেশনারও প্রয়োজন রয়েছে।

যদি মানবশিশুকে সাহায্য করা না হত তাহলে হয়তো সে পশুর মত হাঁটত। সে হয়তো বোবা হত যদি তাকে ভাষা শিক্ষা দেওয়া না হত।

মাওলানা রুমী বলেন : ‘একজন বধির একজন বোবায় পরিণত হয়;সে-ই বক্তা যে তার মায়ের কাছ থেকে কথা শোনে।’

অতএব,এ পৃথিবীর বাস্তবতা সম্পর্কে বোঝা এবং সৃষ্টির রহস্যাবলি অনুধাবনের জন্য মানুষের একজন শিক্ষকের প্রয়োজন। একজন শিক্ষক ছাড়া মানুষ এ ধরনের রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে অক্ষম।

মানুষের শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক ক্ষমতার সঠিক ব্যবহারের জন্য,আদর্শে পৌঁছান ও তার চরিত্রের ক্ষতিকর অংশগুলো ছেটে ফেলার জন্য একজন শিক্ষকের প্রয়োজন রয়েছে। যদি আল্লাহ্ নবী-রাসূলদের প্রেরণ না করতেন তাহলে মানুষ কখনই এত উন্নত জীবন যাপন করতে পারত না।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :

لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَى الْمُؤْمِنِيْنَ إِذْ بَعَثَ فِيْهِمْ رَسُوْلًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُوْا عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَ يُزَكِّيْهِمْ وَ يُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَ الْحِكْمَةَ وَ إِنْ كَانُوْا مِنْ قَبْلُ لَفِيْ ضَلَالٍ مُّبِيْنٍ

‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ ঈমানদারদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন যে,তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন। তিনি তাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন,তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেন। বস্তুত তারা ছিল পূর্ব থেকেই পথভ্রষ্ট।’

মহান আল্লাহ্ রাসূলের শিক্ষাকে সত্যিকারের জীবন বলেছেন,আর যারা তা গ্রহণ করবে না তাদেরকে মৃত বলেছেন।

يَاَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اسْتَجِيْبُوْا للهِ وَ لِلرَّسُوْلِ إِذَا دَعَاكُمْ لِمَا يُحْيِيْكُمْ

‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আহ্বানে সাড়া দাও যখন তিনি (রাসূল) তোমাদের আহ্বান করেন এমন বিষয়ের প্রতি যা তোমাদের জীবিত করে।’

শিক্ষা মানুষের ক্ষমতাকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহারে সাহায্য করে। মানুষের সহজাত কিছু যোগ্যতা আছে,যেমন সত্যান্বেষণ,নৈতিক চেতনা,সৌন্দর্র্যের প্রতি ভালবাসা,স্বাধীন হওয়া,নিজের ভাল বোঝা ইত্যাদির জন্য একজন প্রশিক্ষকের প্রয়োজন যিনি তার এ যোগ্যতাগুলোকে বের করে আনবেন এবং এগুলোকে সঠিক দিকে পরিচালিত করবেন।

জীব-জন্তুর ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় শিক্ষাগ্রহণের সম্ভাবনা আছে। জীবজন্তু সহজাত প্রবৃত্তির মাধ্যমে তাদের জীবন যাপন করে। এগুলো তাদেরকে একটি সীমিত পর্যায়ের পূর্ণতা দান করে। কিছু সংখ্যক প্রাণী,যেমন কুকুর,ঘোড়া,হাতী,বানর,ডলফিন,শিয়াল ও ভল্লুক অপেক্ষাকৃত উচ্চতর বুদ্ধি ধারণ করে। এদেরকে কোন কিছু খুঁজে বের করা,পশুর পাল রক্ষা করা ও সার্কাসের কাজে ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষিত করা যায় যেগুলো আমরা সিনেমা বা অন্যান্য জায়গায় দেখতে পাই।

কিন্তু প্রাণীদের কাজকর্মের ক্ষেত্র খুবই সীমিত। কারণ,এদের ক্ষমতা মানুষের তুলনায় অনেক কম। এজন্যই আমরা যত চেষ্টাই করি না কেন তারা কোন গাণিতিক বিষয়ের সমাধান করতে পারবে না,পরমাণুর গঠন বিশ্লেষণ করতে পারবে না,মহাকাশ যান তৈরি করতে পারবে না,রোগ নিরাময়ের জন্য ঔষধ তৈরি করতে পারবে না এবং সার্জিক্যাল অপারেশন করতে পারবে না। একমাত্র মানুষের পক্ষেই সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে এগুলো করা সম্ভব।

জ্ঞান ও প্রবৃত্তি

মানুষের জ্ঞান পশুর প্রবৃত্তির মতই কাজ করে। তবে এ দু’টির মধ্যে অনেক দিক থেকেই পার্থক্য রয়েছে। যেমন-

১.   প্রবৃত্তি এর অধিকারীর সম্মতি ছাড়াই কাজ করে। এর ব্যতিক্রম হয় না। মৌমাছি সবসময় ষড়ভূজাকৃতির চাক তৈরি করে। পিঁপড়া মাটির নিচে তার আবাসস্থলে গমের দানা সবসময় দু’ভাগে ভাগ করে রাখে যাতে অঙ্কুরোদ্গম হতে না পারে। কিন্তু স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হওয়ার কারণে মানুষ সবসময় জ্ঞানের অনুবর্তী হয়ে কাজ করে না। পশু সৃষ্টির নিয়ম দ্বারা চালিত হয় এবং এ ক্ষেত্রে তার নিজের সম্মতি অসম্মতির কোন ব্যাপার নেই।

.مَا مِنْ دَابَّةٍ إِلَّا هُوَ آخِذٌ بِنَاصِيَتِهَا إِنَّ رَبِّيْ عَلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍ

‘এমন কোন জীব-জন্তু নেই যে তাঁর পূর্ণ অধীন নয়,নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক আছেন সরল পথে।’

২.   প্রবৃত্তি কোন ভ্রান্তি ছাড়াই একটি কাজ করে,কিন্তু জ্ঞান যখন প্রতিজ্ঞা (premise)  থেকে কোন উপসংহারে উপনীত হয় তখন ভুলও করে। পরিবেশ-পরিস্থিতি,পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব,ভুল শিক্ষা,কুসংস্কার,কামনা ও ক্রোধ এবং এরকম আরো অনেক বিষয়ের আমাদের জ্ঞানের ওপর বিপজ্জনক প্রভাব রয়েছে। এগুলোর কারণে মানুষ ভুল-ভ্রান্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে।

মানুষের জন্য নিষ্পাপ পথনির্দেশকের প্রয়োজনীয়তা

যেহেতু মানুষের ভুলভ্রান্তির সম্ভাবনা রয়েছে সেহেতু তার একজন নিষ্পাপ পথনির্দেশকের প্রয়োজন। আর এজন্যই মানুষকে পথনির্দেশনা দেওয়ার জন্য আল্লাহ্ নবী-রাসূল ও ইমামগণ পাঠিয়েছেন। ইমাম মূসা ইবনে জাফর (আ.) তাঁর শিষ্য হিশামকে বলেন : ‘মহান আল্লাহ্ মানুষকে দু’টি পথনির্দেশক দিয়েছেন : প্রকাশ্য পথনির্দেশক ও গুপ্ত পথনির্দেশক। প্রকাশ্য পথনির্দেশক হলেন নবী-রাসূল ও ইমামগণ,আর গুপ্ত পথনির্দেশকের অন্তর্ভুক্ত হল মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি বা বিবেক।’১০

নবী-রাসূল ও ইমামগণ আসাধারণ ব্যক্তি ছিলেন যাঁরা সরাসরি মহান আল্লাহ্-যিনি সকল বিষয় সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে জ্ঞাত তাঁর নিকট থেকে ধর্মীয় বিষয়াদি গ্রহণ করতেন। সুতরাং যে শিক্ষা এমন উৎসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে তার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করা যায়।

শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ

আমরা দেখি পশুপাখি প্রকৃতিগতভাবেই ভাল ও মন্দ বুঝতে পারে,তাদের খাবারের উৎস সম্পর্কে জানে এবং জানে কীভাবে তার জীবন যাপন করতে হবে। কিন্তু এর বিপরীতে মানুষ কিসে তার ভোগান্তি হবে,আর কার মাধ্যমে এর প্রতিকার সম্ভব তা জানে না,কে তার শত্রু,কে তার মিত্র,তা জানে না। সে তার আত্মরক্ষার জন্যও কোন উপকরণ ধারণ করে না। সে এর সবকিছুই শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জন করে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :

وَ اللهُ أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُطُوْنِ أُمَّهَاتِكُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ شَيْئاً وَ جَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَ الْأَبْصَارَ وَ الْأَفْئِدَةَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ

‘আল্লাহ্ তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে বের করেছেন এমন অবস্থায় যে,তোমরা কিছুই জানতে না এবং তিনি তোমাদের কর্ণ,চক্ষু ও অন্তর দিয়েছেন যেন তোমরা অনুগ্রহ স্বীকার কর।’১১

মানুষের দক্ষতা ও ক্ষমতার বিভিন্নমুখি বিকাশের জন্য,যেমন কথা বলা,উন্নত মানসিকতা অর্জন,হাঁটা-চলা করা,সৎভাবে জীবন-যাপন,ন্যায়পরায়ণতাকে ভালবাসা ইত্যাদির জন্য একজন শিক্ষকের প্রয়োজন। শিক্ষা তার জ্ঞান বৃদ্ধি করে এবং সৃষ্টিকে উন্নত করে,যেখানে প্রশিক্ষণ ব্যবহৃত হয় তার সহজাত ক্ষমতা ও আধ্যাত্মিক প্রবণতাকে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে। একজন শিক্ষক তাকে যে জিনিসটি সে জানে না তা শিক্ষা দেন,যেখানে একজন প্রশিক্ষক তার সহজাত ক্ষমতাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন।

শিক্ষাগ্রহণের উপযুক্ত সময়

আমরা অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি যে,শিশুরা বয়স্কদের তুলনায় শিক্ষাগ্রহণ করার ক্ষেত্রে বেশি উপযুক্ত। শিশু বয়সে তাদেরকে যা শিক্ষা দেয়া হয় তা তারা আত্মস্থ করে নেয়। এটা বলা হয় যে,বাল্য অবস্থায় শিক্ষা অর্জন হল পাথরে খোদাই করার মত,কিন্তু বয়স্কাবস্থায় শিক্ষা অর্জন পানির ওপরে রেখা টানার মতো।

আবার এটাও বলা হয় : একজন শিশু নরম কাদার মতো,তাকে যেভাবে গঠন করা হবে সে সেই আকৃতি গ্রহণ করবে। কিন্তু যার বয়স বেশি হয়ে গেছে তার ব্যক্তিত্ব ও পরিচয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও নীতি দ্বারা গঠিত হয়ে গেছে এবং সে অনেক বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছে;তাকে পরিবর্তন করা কঠিন।

ইমাম আলী (আ.) শিক্ষাগ্রহণের জন্য শিশু বয়সকেই উপযুক্ত বলেছেন। এ সময়েই শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেয়ার জন্য তিনি উপদেশ দিয়েছেন।

পিতার কর্তব্য

মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনকারী অন্যতম কারণ হল তার পারিবারিক পরিবেশ এবং পিতামাতার নির্দেশনা বা তত্ত্বাবধান। পিতামাতার তত্ত্বাবধান শিশুর জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ,বিশেষ করে তার আচার-আচরণ ও ব্যবহার গঠনের ক্ষেত্রে। শিশু অবস্থায় মানসিকতা থাকে কোমল-নমনীয়,তাই যে বিশ্বাসের সাথে তারা পরিচিত হয় তা স্থায়িত্ব লাভ করে।

যেহেতু ভাল ব্যবহার একজন ব্যক্তির শিক্ষা ও ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক সেজন্য ইসলাম এর ওপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করেছে। ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) এ ব্যাপারে বলেন : ‘শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে তোমার ওপর তোমার সন্তানের অধিকার আছে। কারণ,সে তোমার অংশ এবং তার জীবনের ভাল-মন্দ তোমার ওপর নির্ভর করে। তোমার জানা উচিত তার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য তুমি দায়ী। তুমি তাকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর দিকে পরিচালিত করতে এবং তাকে তার দায়িত্ব পালনে সাহায্য কর। তোমার সতর্ক হওয়া উচিত যে,তোমার সন্তানের শিক্ষার জন্য তোমাকে দায়ী করা হবে। যদি সে কোন খারাপ কাজ করে তাহলে তার জন্য তোমাকেও শাস্তি ভোগ করতে হবে।’

এজন্যই ইমামগণ শিশুদের অধিকার সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস বর্ণনা করেছেন। শিশুদের অন্যান্য অধিকারগুলো হল : তাদের জন্য ভাল নাম নির্বাচন,কুরআন শিক্ষা দেওয়া,সাঁতার ও তীর চালনা (লক্ষ্যভেদ বা শুটিং) শিক্ষা দেয়া,তাদের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করা,বিয়ে দেওয়া,ঠিকমত ভরণ-পোষণ দেওয়া,বাসস্থানের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।

সর্বোৎকৃষ্ট উপদেশদাতা

একজন জ্ঞানী ব্যক্তি পরিবেশের প্রতিটি উপাদান থেকে উপদেশ গ্রহণ করে। ইমাম আলী (আ.) বলেন : ‘প্রত্যেক শিক্ষিত ও জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য প্রতিটি জিনিসের মধ্যে উপদেশ নিহিত রয়েছে।’১২

বিশিষ্ট সুফি আবুল খায়ের বলেন : ‘আমি একটি সরু গলি দিয়ে যাচ্ছিলাম যেখানে মেথররা মলের কূয়া পরিষ্কার করছিল। আমার সাথীরা দুর্গন্ধ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য নাক বন্ধ করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করছিল। মেথর তাদেরকে সম্বোধন করে বলল : এই মল তোমাদেরকে কিছু বলছে। এটা বলছে : আমরা ঐ সব সুস্বাদু খাবার যা লাভের জন্য তোমরা খুব চেষ্টা করতে। আমরা তোমাদের সাথে ছিলাম এবং এ আবর্জনায় পরিণত হয়েছি। তোমরা কেন আমাদের থেকে পালিয়ে যাচ্ছ? আমরা তোমাদেরই অভ্যন্তরের রং এবং গন্ধ। এ কথা শুনে জনতা চিৎকার করে উঠল এবং কাঁদতে লাগল।’১৩

তাই বলা যায়,একেবারে নোংরা একটা জিনিস মলের মধ্যেও মানুষের জন্য শিক্ষার বিষয় রয়েছে।

আবার কিছু সংখ্যক উপদেশদাতা এবং তাদের উপদেশ মানুষের ওপর অসম্ভব রকমের প্রভাব বিস্তার করে। যেগুলো সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হল :

১.পবিত্র কুরআন

আল্লাহ্ ব্যতীত আমাদের জন্য আর কেউ উত্তম উপদেশ দিতে পারে না,যিনি আমাদের অস্তিত্বের প্রতিটি দিক সম্পর্কে জ্ঞাত। আল্লাহ্ বলেন :

إِنَّ اللهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِهِ

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমাদের যে উপদেশ দেন তা কত উৎকৃষ্ট!’১৪

পবিত্র কুরআন বা আল্লাহর বাণী মানুষকে নানাভাবে সতর্ক করেছে। এজন্যই মহানবী (সা.) পবিত্র কুরআনকে সবচেয়ে সহজবোধ্য বাণী,সর্বোৎকৃষ্ট উপদেশ এবং সবচেয়ে উত্তম ঘটনা বর্ণনাকারী গ্রন্থ বলে অভিহিত করেছেন।১৫

২. মৃত্যু এবং অতীত মানুষের জীবন বিশ্লেষণ

মৃত্যু এবং অতীত কালের মানুষের জীবনে যা ঘটেছে তা উত্তম উপদেশদাতা। মহানবী (সা.) বলেন :

كَفَى بِالْمَوْتِ وَاعِظاً

‘মৃত্যুই আমাদেরকে উপদেশ দেয়ার জন্য যথেষ্ট।’

ইমাম আলী (আ.) এ বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন : ‘আমি তোমাকে সর্বদা মৃত্যুকে স্মরণ করতে এবং এর প্রতি অমনোযোগিতা কমিয়ে ফেলতে উপদেশ দিচ্ছি। তুমি কিভাবে মৃত্যুকে উপেক্ষা করবে যখন এটি তোমার পেছনে রয়েছে? তুমি কিভাবে মৃত্যুর ফেরেশতা থেকে পালাবে যখন সে তোমাকে আরেকটি সুযোগ দেবে না? যে মৃত ব্যক্তিগুলোকে তুমি প্রত্যক্ষ করেছ তারাই তোমার উপদেশ গ্রহণের জন্য যথেষ্ট। তোমরা তাদের কবরে নিয়ে গিয়েছ। তারা নিজেরা যেতে পারেনি;তোমরা তাদেরকে কবরে শুইয়ে দিয়েছ,তারা নিজেদের থেকে তা করতে পারেনি। মনে হয় তারা যেন কখনও এ পৃথিবীতে বসবাস করেনি এবং পরকালই তাদের আবাসস্থল ছিল। তারা যে স্থানকে সরগরম করে বসবাস করত তা নির্জন করে চলে গেছে,আর যে স্থানকে নির্জন মনে করত সেখানে গিয়ে বসবাস করছে। যা পরিত্যাগ করতে হবে তারা তা নিয়ে ব্যস্ত ছিল এবং যে স্থানে যেতে হবে সে স্থানকে বেমালুম ভুলেই ছিল। এখন তারা তাদের পাপ স্খলন করতে পারছে না এবং তাদের পুণ্য এতটুকুও বাড়াতে পারছে না। তারা দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এর প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল এবং দুনিয়া তাদেরকে নিদারুণভাবে বঞ্চনা করেছে। তারা দুনিয়াকে বিশ্বাস করেছিল,এখন দুনিয়া তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি সদয় হোন। যে ঘরে চিরস্থায়ীভাবে থাকার আদেশ করা হয়েছে সেদিকে দ্রুত এগিয়ে থাকার প্রস্তুতি গ্রহণ কর। কারণ,সেদিকে প্রতিনিয়ত তোমাদেরকে আহ্বান ও আমন্ত্রণ জানান হচ্ছে। ধৈর্য সহকারে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার কর এবং তাঁর অবাধ্যতা থেকে বিরত থেকে তোমাদের প্রতি তাঁর পূর্ণ আনকূল্য যাচাই কর। কারণ,আগামীকাল তোমাদের জন্য আজই রুদ্ধ হতে পারে। লক্ষ্য কর দিনের ঘণ্টাগুলো,মাসের দিনগুলো,বছরের মাসগুলো এবং জীবনের বছরগুলো কত দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে!’১৬

অন্য এক খুতবায় আলী (আ.) বলেছেন : ‘ইতিহাসে অসংখ্য উপদেশ রয়েছে;আমালিকরা কোথায়,কোথায় তাদের বংশধররা? ফিরআউনরা ও তাদের সন্তানরা কোথায়? কোথায় ‘রাস’ নগরীর অধিবাসীরা যারা নবীদের হত্যা করত,তাদের হাদীসের আলো নিভিয়ে দিত এবং অত্যাচারী ও আগ্রাসীদের পথ প্রশস্ত করত? কোথায় সেসব নেতা যারা হাজারো সেনাকে পরিচালিত করত এবং নগর পত্তন করেছিল?

হে বিশ্বাসীরা! আমি তোমাদের আল্লাহর প্রতি অনুগত হওয়ার উপদেশ দিচ্ছি,যে আল্লাহ্ তোমাদের সুন্দর পোশাক পরিয়েছেন এবং যিনি তোমাদের অফুরন্ত নেয়ামত দান করেছেন। যদি চিরস্থায়ী জীবনের অথবা মৃত্যু থেকে পালানোর কোন পথ থাকে তবে দাউদের পুত্র সোলায়মান নিশ্চয়ই তা পছন্দ করতেন। কারণ,আল্লাহ্ তাঁকে নবুওয়াতের সাথে সাথে জীন ও মানব জাতিকে তাঁর  নিয়ন্ত্রণে দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন তাঁর দিন শেষ হয়ে গেল এবং মৃত্যুর তীর তাঁর দিকে নিক্ষেপ করা হল,তিনি তাঁর ঘরবাড়ি এবং আশ্রয় ফেলে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। পরবর্তীকালে অন্যান্য মানুষ যেগুলো লাভ করেছিল।’

৩. সময়

সময়ের পরিক্রমায় কোন জাতি উন্নতি করে আবার কোন জাতি শোচনীয় অবস্থায় পতিত হয়। সময়ও মানুষের সতর্ক হওয়ার অন্যতম উৎস হতে পারে। ইমাম মূসা ইবনে জাফর (আ.) তাঁর ছাত্র হুসামকে উপদেশ দেন : ‘পৃথিবী ও এর অধিবাসীদের কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ কর। এ বিষয়টি পবিত্র কুরআনে সময় বা যুগের কসম খাওয়ার একটি কারণ হতে পারে।’

ইমাম আলী (আ.) সময়কে শ্রেষ্ঠ উপদেশদাতা এবং শিক্ষক হিসাবে গণ্য করে বলেছেন : ‘পৃথিবী তোমাকে শ্রেষ্ঠ উপদেশ দান করে এ শর্তে যে,তুমি তার বিচ্ছেদ ঘটানোর মাধ্যমে শিক্ষা নেবে।’১৭

তবে সমস্যা এখানে যে,‘শিক্ষাগ্রহণের বিষয় অসংখ্য,কিন্তু খুব অল্প সংখ্যক মানুষই শিক্ষাগ্রহণ করে।’১৮

বিহারুল আনওয়ার গ্রন্থের ৭৮তম খণ্ডের ৪৮ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে যে,যখন ইমাম আলী (আ.) মাদায়েন অতিক্রম করছিলেন তখন তিনি সম্রাট নওশেরওয়ানের প্রাসাদ লক্ষ্য করেন যেটা ধবংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন : ‘কেন তোমরা সূরা দুখানের ২৫ থেকে ২৯ নং আয়াত তেলাওয়াত কর না যেখানে বলা হয়েছে :

كَمْ تَرَكُوْا مِنْ جَنَّاتٍ وَّ عُيُوْنٍ وَّ زُرُوْعٍ وَّ مَقَامٍ كَرِيْمٍ وَّ نَعْمَةٍ كَانُوْا فِيْهَا فَاكِهِيْنَ كَذَالِكَ وَ أَوْرَثْنَاهَا قَوْمًا آخَرِيْنَ فَمَا بَكَتْ عَلَيْهِمُ السَّمَاءُ وَ الْأَرْضُ وَ مَا كَانُوْا مُنْظَرِيْنَ

তারা ছেড়ে গিয়েছিল কত উদ্যান ও প্রস্রবন! কত শস্যক্ষেত্র ও সুরম্য স্থান! কত সুন্দর উপকরণ যাতে তারা খোশগল্প করত! এমনই হয়েছিল এবং আমি এগুলোর মালিক করেছিলাম ভিন্ন সম্প্রদায়কে। তাদের জন্য ক্রন্দন করেনি আকাশ ও পৃথিবী এবং তারা অবকাশও পায়নি।’

৪. অভিজ্ঞতাসমূহ

আমরা জানি,অন্যদের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করা জ্ঞান অর্জনের অন্যতম নিরাপদ পথ। ইমাম আলী (আ.) এ ব্যাপারে বলেন : ‘যে বিষয়গুলো পণ্ডিতরা কষ্ট করে সংগ্রহ করেছেন এবং তোমার জন্য মুক্ত করেছেন পরবর্তী কিছু করার জন্য সেগুলো মনোযোগ সহকারে ও ভালভাবে অধ্যয়ন কর।’

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন : ‘একজন বিশ্বাসী এক গর্তে দু’বার পতিত হয় না।’

সঠিক পথ গ্রহণ এবং অযথার্থ পদ্ধতি এড়ানোর জন্য অভিজ্ঞতা মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। এ প্রসঙ্গে আলী (আ.)-এর কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হল : ‘নৈতিক নিয়ম-কানুন শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা হল শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি।’ ‘জ্ঞানীদের জন্য অভিজ্ঞতাসমূহ হল উপদেশের শ্রেষ্ঠ উৎস।’ ‘প্রতিটি অভিজ্ঞতার মধ্যে উপদেশ লুকিয়ে আছে।’ ‘জ্ঞানী ব্যক্তি হল সে যে তার অভিজ্ঞতাসমূহ থেকে উপদেশ গ্রহণ করে।’

 

তথ্যসূত্র

 ১.   সূরা আহযাব : ২১

 ২. সূরা শামস : ৯-১০

 ৩. সূরা কালাম : ৪

 ৪. বিহারুল আনওয়ার,৭১তম খণ্ড,পৃ. ৩৮৩

 ৫. ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত মুয়াত্তায়ে ইমাম মালিক,

২য় খণ্ড,পৃ. ৬২৩

 ৬. মাআনীল আখবার,পৃ. ২৫৩

 ৭. সূরা আলে ইমরান : ১৬৪

 ৮. সূরা আনফাল : ২৪

 ৯. সূরা হূদ : ৫৬

১০.   তুহাফুল উকুল,পৃ. ৩৮৩

১১.   সূরা নাহল : ৭৮

১২.   গুরারুল হিকাম,২য় খণ্ড,পৃ. ৫০৭

১৩. আসরারুত তাওহীদ,১ম খণ্ড,পৃ. ২৬৬

১৪.   সূরা নিসা : ৫৮

১৫.   বিহারুল আনওয়ার,৭৭তম খণ্ড,পৃ. ১৩৭

১৬.   নাহজুল বালাগাহ,খুতবা নং ১৮৮

১৭. মীযানুল হিকমাহ,১০ম খণ্ড,পৃ. ৫৪২

১৮. নাহজুল বালাগাহ,বাণী ২৯৭

সূত্র: ঢাকা থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক প্রত্যাশা বর্ষ ১, সংখ্যা ২।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)