আল হাসানাইন (আ.)

নৈতিকতা ও কতিপয় মূল্যবান উপদেশ -শেষ পর্ব

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

কতিপয় শ্রেষ্ঠ উপদেশ

পবিত্র কুরআনে এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ও ইমামগণের হাদীসে অসংখ্য শ্রেষ্ঠ উপদেশ বাণী বর্ণিত হয়েছে। এখানে ঐ সব শ্রেষ্ঠ উপদেশ বাণী থেকে মাত্র কয়েকটি উপস্থাপন করা হল :

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :

قُلْ إِنَّمَا أَعِظُكُمْ بِوَاحِدَةٍ أَنْ تَقُوْمُوْا لِلّهِ مَثْنَى وَ فُرَادَى...

‘বলুন,আমি তোমাদেরকে একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি : তোমরা আল্লাহর নামে এক একজন করে,দু’দুজন করে দাঁড়াও...।’

এ আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষকে উপদেশ দিচ্ছেন একটি মাত্র বিষয়ে। আর তা হল কেবল আল্লাহর জন্যই দাঁড়ানোর অর্থাৎ কিয়াম করার এবং অন্য কোন কিছুর জন্য নয়। আর এ ধরনের আন্দোলনই ফলদায়ক।

 

রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর উপদেশ

কাইস ইবনে আসিম বলেন : ‘বনু তামীম গোত্রের কিছু সংখ্যক লোক ও আমি মহানবী (সা.)-এর কাছে গেলাম এবং বললাম : হে রাসূলুল্লাহ্! যেহেতু আমরা সবসময় আপনার সাথে থাকি না এবং আমরা মরুভূমিতে বসবাস করি,অনুগ্রহ করে আমাদের কিছু উপদেশ দিন যাতে আমরা সঠিক পথে চলতে পারি। মহানবী (সা.) বললেন : হে কাইস! প্রতিটি সৌভাগ্যের সাথে দুর্ভাগ্যও রয়েছে;জীবনের সাথে মৃত্যু এবং এ পৃথিবীর সাথে পরকাল। আমাদের প্রত্যেককে আমরা যা করি তার হিসাব দিতে হবে ভাল বা মন্দের। তুমি অবশ্যই একজনের সঙ্গ লাভ করবে যাকে তোমার সাথে কবরে রাখা হবে। তুমি মৃত,কিন্তু সে জীবিত। সে যদি সহৃদয় হয় তাহলে তোমাকে আদর করবে,যদি সে হতভাগ্য হয় সে তোমার বিদ্রোহী হবে। তারপর তোমরা কিয়ামতের দিন একত্রে উপস্থিত হবে। তোমাকে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। তাই সঠিক ব্যক্তিকে বেছে নাও। যদি সে সৎকর্মপরায়ণ হয় তুমি তাকে সঙ্গ দেবে এবং যদি সে অসৎকর্মপরায়ণ হয় তুমি তাকে ভয় করবে। আর সে হল তোমারই কর্ম।’

হযরত ফাতিমা (আ.)-এর উপদেশ

হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) আনসার ও মুহাজিরদের সামনে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেখানে তিনি ধর্মের আইন-কানুন,আল্লাহর উপাসনা এবং রাসূলের আনুগত্য সম্পর্কে গুরুত্ব প্রদান করে বলেন : ‘আল্লাহ্ ঈমানকে শিরক হতে তোমাদের পরিশুদ্ধ থাকার জন্য নির্ধারণ করেছেন। ঔদ্ধত্য ও অহংকার হতে বিরত থাকার জন্য নামাযকে ওয়াজিব করেছেন। আত্মার পরিশুদ্ধি ও সম্পদের বরকতের জন্য যাকাত নির্ধারণ করেছেন। একনিষ্ঠতা সুদৃঢ়করণের লক্ষ্যে রোযাকে ওয়াজিব করেছেন। ইসলামী বিধানকে শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে হজ্বকে ওয়াজিব করেছেন। হৃদয়সমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য ন্যায়পরায়ণতাকে নির্ধারণ করেছেন। মুসলিম উম্মাহর মাঝে সংহতি সৃষ্টির লক্ষ্যে আমাদের (আহলে বাইতের) অনুসরণকে আবশ্যক করেছেন। অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতা হতে মুক্তির লক্ষ্যে ইমামত ও আমাদের নেতৃত্বকে নির্ধারণ করেছেন। জিহাদকে ইসলামে মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ওয়াজিব করেছেন। ধৈর্য ও সংযমকে আল্লাহর পুরস্কারের মাধ্যম হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। সাধারণ মানুষের সংশোধনের জন্য সৎ কাজের প্রতি আদেশকে আবশ্যক করেছেন। পিতামাতার প্রতি সদাচরণকে আল্লাহর ক্রোধ থেকে মুক্তির মাধ্যম হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। সংখ্যা ও সামর্থ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে আত্মীয়দের মাঝে সুসম্পর্ক বজায় রাখার বিধানকে আবশ্যক করেছেন। প্রাণরক্ষার জন্য কেসাসকে ওয়াজিব করেছেন। গুনাহ থেকে মুক্তির মাধ্যম হিসাবে মানত বা নযর পালনকে নির্ধারণ করেছেন। ঘাটতি মোকাবিলার লক্ষ্যে ওজনে কম দেয়াকে হারাম ঘোষণা করেছেন। কলুষতা ও পঙ্কিলতা থেকে বিরত থাকার জন্য মদপানকে হারাম করেছেন। আযাব থেকে রক্ষার মাধ্যম হিসাবে অপবাদ ও গালি-গালাজকে হারাম করেছেন। আত্মসম্মান রক্ষার লক্ষ্যে চুরি করাকে হারাম ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ্ শিরককে হারাম ঘোষণা করেছেন,যাতে বান্দারা ইখলাসের সাথে তাঁর বন্দেগী করতে পারে। অতএব,তিনি যে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী সে অনুযায়ী তাকওয়া অবলম্বন কর। কখনও তাঁর আদেশের অমান্য করবে না এবং চেষ্টা করবে যাতে মুসলমান অবস্থাতে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পার। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পূর্ণাঙ্গরূপে মেনে চল এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পথ অনুসরণ কর। কেননা,আল্লাহ্ বলেছেন : إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ

নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই তাঁকে ভয় করে।’

ইমাম আলী (আ.)-এর উপদেশ

ইমাম আলী (আ.) বলেন : ‘আমি তোমাকে পাঁচটি উপদেশ দেব। এগুলো অর্জনের জন্য তুমি যত চেষ্টা করবে তত তোমার জন্য উত্তম হবে :

১. আল্লাহ্ ছাড়া আর কারও ওপর নির্ভর করবে না;

২. কেবল তোমার পাপকেই ভয় কর;

৩. তোমাকে যে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয় যদি তুমি তা না জান তাহলে কখনও ‘আমি জানি না’ বলতে লজ্জাবোধ কর না;

৪. তুমি যা জান না,তা জানতে কখনও লজ্জিত হয়ো না এবং

৫. ধৈর্যধারণ করার অভ্যাস কর। কারণ,দেহের জন্য মাথা যেরূপ ঈমানের জন্য ধৈর্যও সেরূপ।’

ইমাম হাসান (আ.)-এর উপদেশ

ইমাম হাসান (আ.)-এর উপদেশাবলির মধ্যে একটি হল : ‘হে আদম সন্তানরা! আল্লাহ্ যে কাজ করতে নিষেধ করেছেন সে কাজ পরিত্যাগ কর তাহলে তাঁর অনুগত বান্দা হিসাবে বিবেচিত হবে। বিত্তবান হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ্ তোমাকে যা দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট থাক। একজন সত্যিকার মুসলমান হওয়ার জন্য তোমার প্রতিবেশীর সাথে দয়ার্দ্র ব্যবহার কর,তুমি অন্যদের থেকে যে আচরণ পছন্দ কর মানুষের সাথে সে-ই আচরণ কর। তোমাদের পূর্ববর্তী ধনী ব্যক্তিরা বিপুল সম্পদ পুঞ্জিভূত করত,দুর্ভেদ্য বাড়ি তৈরি করত এবং অস্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা পোষণ করত- তারা সকলেই ধ্বংস হয়ে গেছে এবং তাদের ঘর-বাড়ি কবরে পরিণত হয়েছে। হে আদমসন্তানরা! জন্মের সময় থেকে তোমরা নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার চেষ্টা করে যাচ্ছ। তাই ভবিষ্যতের জন্য সবর কর। কারণ,একজন সত্যিকার বিশ্বাসী সঞ্চয়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আর একজন অবিশ্বাসী স্বল্পকালীন কামনা-বাসনা চরিতার্থ করে।

সূরা বাকারার ১৯৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে :

وَ تَزَوَّدُوْا فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَى

‘আর তোমরা পাথেয় সাথে নিয়ে নাও। নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম পাথেয় হচ্ছে আল্লাহর ভয়।’

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর উপদেশ

এক ব্যক্তি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাছে এসে বলল : ‘আমি একজন অপরাধী। আমি পাপ থেকে বিরত থাকতে পারি না। আমাকে আপনি উপদেশ দিন।’ ইমাম হুসাইন বললেন : ‘পাঁচটি কাজ কর,এরপর তোমার যত খুশী পাপ করতে থাক :

১. আল্লাহর দেওয়া খাদ্য খেও না। এরপর যত ইচ্ছা খারাপ কাজ কর।

২. আল্লাহর অধীন এলাকা থেকে বাইরে চলে যাও;এরপর তুমি যে কোন খারাপ কাজে লিপ্ত হও।

৩. তোমার পাপ কাজ করার জন্য এমন কোন জায়গা নির্ধারণ কর যেখানে আল্লাহ্ উপস্থিত নন;তারপর তোমার যা ইচ্ছা কর।

৪. যখন মৃত্যুর ফেরেশতা তোমার কাছে আসবে তখন তাকে বল যেন সে তোমাকে ত্যাগ করে;তারপর যা খুশী কর।

৫. যখন মালিক (জাহান্নামের ফেরেশতা) তোমাকে আগুনে নিক্ষেপ করতে চাইবে তখন আগুনে প্রবেশ কর না;তারপর তুমি যা খুশী কর।’

ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর উপদেশ

এক ব্যক্তি ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর কাছে এসে তার সমস্যাদির বিষয়ে অভিযোগ করল। ইমাম বললেন : ‘আদমসন্তানরা হতভাগা। কারণ,প্রতিদিন তারা তিনটি বিপজ্জনক শত্রুর মুখোমুখি হয়,কিন্তু তারা এ থেকে শিক্ষা লাভ করে না। যদি তারা এগুলো থেকে শিক্ষা নেয় তাহলে তাদের অসংযত বিষয়কে দমন করা সহজ হবে।

প্রথমত প্রতিদিন তার আয়ু কমে আসছে। যদি তার সম্পদ কমে যায় সে হতাশাগ্রস্ত হয়। কিন্তু তার জানা উচিত পার্থিব সম্পদের বিকল্প আছে,কিন্তু জীবনের কোন বিকল্প নেই।

দ্বিতীয়ত প্রতিদিন সে তার রুজি উপভোগ সম্পন্ন করে। যদি তা বৈধভভাবে হয়ে থাকে তাহলে সে পুরস্কৃত হবে,আর যদি তা অবৈধভাবে হয়ে থাকে তাহলে সে শাস্তি পাবে।

তৃতীয়ত আর এটি অন্য দু’টির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যখন সে একটি দিন অতিবাহিত করে তখন সে আসলে পরকালের দিকে অগ্রসর হয়,কিন্তু জানে না যে,সে কি জান্নাতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে নাকি জাহান্নামের দিকে।

ইমাম বাকের (আ.)-এর উপদেশ

জাবির ইবনে ইয়াযীদ জু’ফী বলেন : ‘আমি ইমাম বাকের (আ.)-এর সান্নিধ্যে আঠারো বছর অতিবাহিত করেছি। তাঁর নিকট থেকে বিদায় গ্রহণের সময় আমি তাঁর কাছ থেকে কিছু উপদেশ চাইলাম। ইমাম বললেন : ‘হে জাবির! এ আঠারো বছর পর! তুমি (আজ) জ্ঞানের এক অতল সাগরে পরিণত হয়েছ যা অন্য কারও পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়।’

তারপর ইমাম বললেন : ‘আমার অনুসারীদের আমার শুভেচ্ছা জানিও এবং তাদের বল : আমাদের সাথে মহান আল্লাহর কোন দূরত্ব নেই। কেউ তাঁর ইবাদত ছাড়া তাঁর সান্নিধ্য অর্জন করতে পারে না।

হে জাবির! যে আল্লাহর আনুগত্য করে এবং আমাদের ভালবাসে,সে আমাদের বন্ধু বলে বিবেচিত হবে,কিন্তু যে পাপ কাজ করে আমাদের বন্ধুত্ব তার কোন কাজে আসবে না।

হে জাবির! এমন কেউ কি আছে যে আল্লাহর কাছে কিছুর প্রার্থনা করে,কিন্তু তা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যাত হয়? কেউ কি আছে যে আল্লাহর ওপর ভরসা করে,কিন্তু কোন নিরাপত্তা পায় না? এমন কেউ কি আছে,যে আল্লাহকে বিশ্বাস করে,কিন্তু তাঁর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়?

হে জাবির! এ পৃথিবীকে একটি আশ্রয়স্থল মনে কর যেখানে তুমি মাত্র কয়েকদিন অবস্থান করবে এবং এরপর তুমি তা ত্যাগ করবে। এ পৃথিবী কি একটি ঘোড়া সদৃশ নয় যাতে তুমি স্বপ্নের মধ্যে সওয়ার হও,কিন্তু যখন তুমি জেগে ওঠ তখন ঘোড়ার কোন চিহ্নই থাকে না। এ পৃথিবী তো একটি ব্যবহৃত বস্ত্রের সাথেই তুলনীয়।

হে জাবির! জ্ঞানী মানুষের জন্য এ পৃথিবী একটি ছায়ার মত। যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে,তার জন্য এটি উদারতার উৎস। প্রার্থনা উদ্ধত ভাব পরিত্যাগ করার একটি মাধ্যম,দান-সদাকাহ রুজি বৃদ্ধি করে,রোযা এবং হজ্ব মানুষের হৃদয়কে শান্ত করে,ধর্মীয় শাস্তি মানুষকে রক্তপাতের হাত থেকে রক্ষা করে এবং আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা ধর্মকে শক্তিশালী করে। আল্লাহ্ আমাদের তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা নিভৃতে আল্লাহকে ভয় করে এবং কিয়ামত দিবসের ভয়ে ভীত।’

ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর উপদেশ

সুফিয়ান সাওরী বলেন : ‘আমি ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর নিকট উপস্থিত হলাম এবং বললাম : আমাকে কিছু উপদেশ দিন যেন আমি তা পালন করতে পারি। ইমাম জিজ্ঞাসা করলেন : হে সুফিয়ান! তুমি কি তা স্মরণ রাখবে? আমি জবাব দিলাম : জী,হে রাসূলের কন্যার সন্তান! আমি তা স্মরণ রাখব। তারপর তিনি বললেন : হে সুফিয়ান! একজন মিথ্যাবাদীর পৌরুষত্বের (মর্যাদার) অভাব রয়েছে,একজন মিথ্যাবাদী শান্তিতে থাকতে পারে না। রাজার কোন ভাই নেই,উদ্ধত ব্যক্তির কোন বন্ধু নেই এবং বদমেজাজী লোকের জন্য কোন মহানুভব ব্যক্তি নেই।’ তারপর ইমাম চুপ করলেন। আমি তাঁকে বললাম : হে রাসূলের কন্যার সন্তান! অনুগ্রহ করে আরও বলুন। তিনি বললেন : ‘হে সুফিয়ান! জ্ঞানী হওয়ার জন্য আল্লাহর ওপর নির্ভর কর,ঐশ্বর্যশালী বোধ করার জন্য আল্লাহ্ তোমাকে যা দিয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট হও। তোমার বিশ্বাসকে বাড়াবার জন্য মানুষ তোমার সাথে যেমন আচরণ করে তেমন আচরণ কর,পাপাচারীর সঙ্গী হয়ো না;কারণ,তারা তোমাকে পাপ কাজ শিক্ষা দেবে;এবং তোমার বিষয়াদির ব্যাপারে খোদাভীরু লোকের সাথে পরামর্শ কর।’

সুফিয়ান আরও জানতে চাইলে ইমাম বলেন : ‘হে সুফিয়ান! যে ব্যক্তি ক্ষমতা ও প্রাচুর্য ছাড়া সম্মানের আকাঙ্ক্ষা করে তার উচিত পাপ কাজে লিপ্ত না হয়ে আল্লাহর আনুগত্যকে পছন্দ করা।’

তিনি আরও বলেন : ‘হে সুফিয়ান! আমার পিতা আমাকে তিনটি বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন ও তিনটি বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন : ‘হে আমার সন্তান! যে পাপীকে সঙ্গ দেয় সে অপরিবর্তিত থাকতে পারে না;যে তার কথায় সতর্ক হয় না সে অনুতপ্ত হবে এবং যে পুনপুন নিকৃষ্ট জায়গায় যায় সে অভিযুক্ত হবে।’

আমি জিজ্ঞাসা করলাম : ‘হে রাসূলুল্লাহর সন্তান! সেই তিনটি জিনিস কী,যেগুলো সম্পর্কে আপনাকে সতর্ক করা হয়েছে?’

তিনি বললেন : ‘আমার পিতা আমাকে ঐ ব্যক্তির সঙ্গ দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলেছেন যে অন্যের প্রাচুর্য দেখে ঈর্ষান্বিত হয়,যে অন্যের দুর্ভাগ্যে আনন্দ প্রকাশ করে এবং যে রটনাকারী।’

ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-এর উপদেশ

ইমাম মূসা কাযেম (আ.) বলেছেন : ‘তোমার দিন ও রাতকে চারটি ভাগে ভাগ করতে চেষ্টা কর : এক-চতুর্থাংশ আল্লাহর ইবাদতের জন্য;এক-চতুর্থাংশ জীবিকা অর্জনের জন্য;এক-চতুর্থাংশ তোমার ভাইদের সঙ্গ দেওয়ার জন্য এবং এক-চতুর্থাংশ ব্যক্তিগত বৈধ উপভোগের জন্য।

তোমার হৃদয়ে দারিদ্র্যের চিন্তা ও দীর্ঘায়ু লাভ করার চিন্তা প্রোথিত কর না;কারণ,যে দারিদ্র্যের চিন্তা করে সে ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে পড়ে এবং যে দীর্ঘায়ু লাভ করার চিন্তা করে সে লোভী হয়ে পড়ে। এ পৃথিবীতে তোমার সময়ের সদ্ব্যবহার কর। যে সব বৈধ আকাঙ্ক্ষা তোমার মর্যাদাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না অথবা অমিতচার নয় সেসব উপভোগ কর। এর মাধ্যমে তুমি ধর্মীয় কাজে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত হবে। এটা এজন্য যে,একটি হাদীসে বলা হয়েছে : যে তার ধর্মের জন্য দুনিয়া ছেড়ে দেয় অথবা দুনিয়ার জন্য ধর্ম ছেড়ে দেয় সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’১০

ইমাম রেযা (আ.)-এর উপদেশ

ইমাম রেযা (আ.) বলেন : সাতটি বিষয়ের সাথে অপর সাতটি বিষয় না থাকলে মানুষ পরিহাসের পাত্র হয় :

১. যে শুধু মৌখিকভাবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে,অথচ অন্তরের গভীর থেকে অনুতপ্ত হয় না,সে নিজেকেই পরিহাস করে।

২. যে আল্লাহর কাছে সাহায্য চায়,কিন্তু নিজে কোন প্রচেষ্টা চালায় না,সে নিজের সাথে উপহাস করে।

৩. যে আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করে,কিন্তু যথেষ্ট ধৈর্যশীল নয়,সেও নিজেকে পরিহাস করে।

৪. যে আল্লাহর কাছে জাহান্নামের আগুন থেকে নিরাপত্তা চায়,কিন্তু পাপ কাজ ও অন্যায় কামনা-বাসনা ত্যাগ করে না,সেও নিজেকে পরিহাস করে।

৫. যে মৃত্যু সম্পর্কে কথা বলে,কিন্তু এর জন্য তৈরি হয়নি,সে নিজেকে পরিহাস করে।

৬. যে মৃত্যুকে স্মরণ করে,কিন্তু এর মুখোমুখি হতে ইচ্ছুক নয় সেও নিজেকে পরিহাস করে।

৭. যে সতর্ক হওয়ার জন্য ইচ্ছা করে,কিন্তু প্রয়োজনীয় মুহূর্তে সতর্কতা অবলম্বন করে না,সেও নিজেকে পরিহাস করে।১১

ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর উপদেশ

এক ব্যক্তি ইমাম জাওয়াদ (আ.)-কে কিছু উপদেশ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করল। ইমাম বললেন : ‘ধৈর্যের নিকটবর্তী থেক,দারিদ্রকে গ্রহণ কর। তুমি সর্বক্ষণ আল্লাহর নজরে রয়েছ,সুতরাং তুমি কী কর সে বিষয়ে সতর্ক হও।’১২

 

ইমাম নাকী (আ.)-এর উপদেশ

ইমাম নাকী (আ.) বলেন : ‘যে আল্লাহকে ভয় করে,অন্যরা তাকে ভয় করে এবং যে আল্লাহর আনুগত্য করে তাকে অন্যরা আনুগত্য করে। যে আল্লাহর আনুগত্য করে সে অন্যের ক্রোধের ভয় করে না। যে আল্লাহকে ক্রোধান্বিত করে সে নিশ্চিতভাবেই অন্যদের ক্রোধের সম্মুখীন হয়।’১৩

ইমাম হাসান আল আসকারী (আ.)-এর উপদেশ

ইমাম হাসান আল আসকারী (আ.) তাঁর অনুসারীদের বলেন : ‘আমি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি যে,তোমরা আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হও,মিতচারী হও,আল্লাহর কারণে কষ্ট কর,মানুষের আমানতের ক্ষেত্রে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত হও,তোমাদের সিজদাকে দীর্ঘায়িত কর,তোমাদের প্রতিবেশীদের প্রতি ভাল আচরণ কর যা মুহাম্মাদ (সা.) সবসময় করতেন। তোমাদের প্রতিবেশীদের সাথে নামায পড়,তাদের জানাযায় শরীক হও,তাদের কেউ অসুস্থ হলে দেখতে যাও। তাদের ঋণ পরিশোধ কর। তোমাদের মধ্য থেকে যে কেউ ধর্মপরায়ণ হয় ও সত্য কথা বলে,মানুষের আমানত ফিরিয়ে দেয় এবং মানুষের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে সে আমাকে খুশী করে। এমন ব্যক্তিই আমাদের সত্যিকার অনুসারী এবং আমাদের জন্য মর্যাদার কারণ,অমর্যাদার কারণ নয়।

আমাদের প্রতি যে কোন ধরনের বন্ধুত্বকে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা কর। আর যে কোন ধরনের শত্রুতাকে হটিয়ে দিতে চেষ্টা কর। কারণ,আমাদের সম্পর্কে যা কিছু ভাল বলা হয় তা আমাদের জন্য প্রযোজ্য,আর আমাদের সম্পর্কে খারাপ যা কিছু বর্ণনা করা তা আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। আল্লাহর কিতাবে (পবিত্র কুরআনে) আমাদের জন্য একটি দৃঢ় অধিকার সংরক্ষিত হয়েছে। আমরা আল্লাহর নবীর আত্মীয়। আল্লাহ্ আমাদের পবিত্র করেছেন। একমাত্র মিথ্যাবাদী ছাড়া আর কেউ আমাদের এ মর্যাদা দাবি করতে পারে না। আল্লাহকে বেশি স্মরণ কর এবং মৃত্যুকে ভুলে যেও না। প্রায়শই আল্লাহর কিতাব পাঠ কর। নবীর প্রতি আল্লাহর রহমত কামনা কর। এমন কাজের দশটি উপকারিতা রয়েছে। আমি তোমাদের যা উপদেশ দিয়েছি তা স্মরণ রাখ। আল্লাহ্ তোমাদের রক্ষা করুন। আমার আশীর্বাদ তোমাদের সকলের জন্য।’১৪

ইমাম মাহদী (আ.)-এর উপদেশ

ইমাম মাহদী (আ.) তাঁর আবির্ভাবের জন্য প্রতীক্ষারতদের উদ্দেশ্যে বলেন : ‘আমার আবির্ভাবের জন্য তোমরা অধিক থেকে অধিকতর প্রার্থনা কর। এ প্রার্থনায় তোমাদের জন্য অত্যধিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে।’১৫

 

তথ্যসূত্র

১. সূরা সাবা : ৪৬

২. বিহারুল আনওয়ার,৭৭তম খণ্ড,পৃ. ১১১

৩. সূরা ফাতির : ২৮

৪. তাবারসীর ইহতিজাজ,১ম খণ্ড,পৃ. ১৩৪;কাশফুল গুম্মাহ,১ম খণ্ড,পৃ. ৪৮৪

৫. নাহজুল বালাগা,বাণী ৭৯

৬. বিহারুল আনওয়ার,৭৮তম খণ্ড,পৃ. ১২৬

৭. প্রাগুক্ত,পৃ. ১৬০

৮.প্রাগুক্ত,পৃ. ১৮৩

৯. প্রাগুক্ত,পৃ. ২৬১

১০. প্রাগুক্ত,পৃ. ৩২১

১১. কানজুল ফাওয়ায়েদ কারাযাকী,পৃ. ১৫২

১২. বিহারুল আনওয়ার,৭৮তম খণ্ড,পৃ. ৩৫৮

১৩. তুহাফুল উকুল,পৃ. ৫১০

১৪. তুহাফুল উকুল,পৃ. ৪৮৮;বিহারুল আনওয়ার,৭৮তম খণ্ড,পৃ. ২৭৩।

১৫.এ অংশটুকু নেওয়া হয়েছে কারওয়ানে ইনতিসারুল মাহ্দী (আ.ফা.) কর্তৃক প্রকাশিত ‘হে ইমাম মাহ্দী (আ.)! আপনারই অপেক্ষায়’ গ্রন্থ থেকে।

সূত্র: ঢাকা থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক প্রত্যাশা,বর্ষ ১,সংখ্যা ২।

 

 

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)