আল হাসানাইন (আ.)

মানবাত্মার ব্যাধি (হিংসা)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

মানবাত্মার ব্যাধি (হিংসা)

মানুষের আত্মিক রোগ শারীরিক রোগ হতে জটিলতর। এ রোগ বুদ্ধি ও যুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন এবং শুধু রোগীর আত্মিক অবস্থার সঙ্গেই সংগতিপূর্ণ। বর্তমান সময়ে এরূপ অসুস্থতাকে মানসিক জটিলতা বলা হয়। যে সকল বস্তু মানবাত্মাকে ব্যাধিগ্রস্ত করে তা সংক্ষেপে আলোচনা করব। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বঞ্চনা আত্মিক রোগের অন্যতম উৎস। অধিকাংশ মানসিক রোগের কারণ হলো বঞ্চনা। আপনারা জানেন ফ্রয়েড বাড়াবাড়িমূলকভাবে এ তত্ত্বের উপর নির্ভর করেছেন,বিশেষত যৌনতার বিষয়ে। যা হোক বঞ্চনা মানসিক ব্যাধির প্রধান কারণ। বঞ্চনা মানুষের মনে বিদ্বেষের সৃষ্টি করে। যখন মানুষ অন্তরে কারো প্রতি বিদ্বেষ অনুভব করে তখন তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চায় এবং যতক্ষণ না তাকে হত্যা বা লাঞ্ছিত করতে পারে ততক্ষণ শান্তি লাভ করতে পারে না। এ প্রতিশোধ স্পৃহাটি কি?

হিংসা মানুষের মধ্যে যুক্তির বিরোধিতার প্রবণতা সৃষ্টি করে অর্থাৎ মানুষের মধ্যে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয় যে,মানুষ নিজের সাফল্যের চিন্তাকেও ভুলে যায় এবং কেবল অন্যের অকল্যাণের চিন্তায় মগ্ন থাকে। তার আকাঙ্ক্ষা নিজের সৌভাগ্য নয়। যদিও নিজের সৌভাগ্যের চিন্তা করে,তবে তার দ্বিগুণ অন্যের অকল্যাণের চিন্তা করে। এটা কোন যুক্তিতেই বোধগম্য নয়। কোন প্রাণীর মধ্যেই এ বৈশিষ্ট্য নেই যে,অন্য প্রাণীর দুর্ভাগ্যের আকাঙ্ক্ষা করে। অন্য প্রাণী নিজের পেটের চিন্তায়ই ক্ষান্ত হয়,কিন্তু মানুষের মধ্যে এ অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়।

হিংসুক ব্যক্তি যখন কারো ভালো বা কল্যাণ দেখে তখন তার সমগ্র কামনা হয়ে ওঠে এটা যে,ঐ ব্যক্তি থেকে এ কল্যাণ যেন দ্রুত অপসারিত হয়। নিজের বিষয়ে তখন সে আর চিন্তা করে না,বরং ঐ ব্যক্তির অমঙ্গলের চিন্তায় মগ্ন হয়। সুস্থ চিন্তার মানুষ প্রতিযোগিতা করে,হিংসা করে না। সুস্থ মানুষ সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সব সময় নিজেকে নিয়ে চিন্তা করে। সব সময় এগিয়ে থাকার চিন্তা করা সুস্থতার পরিচয়,এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু অন্যেরা সব সময় পিছে পড়ে থাক- এ চিন্তা অসুস্থতার পরিচায়ক। হিংসুক ব্যক্তির অসুস্থতা কখনো কখনো এতটা অধিক হয় যে,নিজের একশ’ ভাগ ক্ষতি করেও যদি অপরের পাঁচ ভাগ ক্ষতি করা যায় তাতে সে খুশী।

 

‘হিংসা’ রোগের নমুনা

একটি প্রসিদ্ধ কাহিনী ইতিহাসের বইয়ে এসেছে। কোন এক খলিফার সময় একজন ব্যক্তি একদাস কিনে এনেছিল। প্রথম দিন থেকেই সে তার সঙ্গে দাসের মতো আচরণ না করে বরং সম্মানিত ব্যক্তির মতো আচরণ করত। সব সময় ভাল খাবার দিত,তার জন্য ভাল পোষাক কিনত,বিশ্রামের জন্য উত্তম উপকরণ এনে দিত। মোট কথা,তার সঙ্গে নিজের সন্তানের মত আচরণ করত। মনে হতো লালন-পালনের জন্যই তাকে আনা হযেছে। দাসটি লক্ষ্য করত তার মনিব সব সময়ই বিষন্ন ও চিন্তিত। কিন্তু তার কারণ সে জানত না। একদিন মনিব তাকে ডেকে বলল,“আমি তোমাকে মুক্ত করে দিতে চাই,সে সাথে প্রচুর অর্থও দিতে চাই। কিন্তু তুমি কি জান কেন তোমাকে এত আদর ও স্নেহ করেছি? এজন্য যে,তুমি যেন আমার একটি অনুরোধ রক্ষা কর। তুমি যদি তা রক্ষা কর তবে আমার আদর-স্নেহের প্রতিদান দিলে এবং এর জন্য আরো অধিক কিছু তোমাকে আমি দেব। কিন্তু যদি তা না কর তবে আমি তোমার উপর অসন্তুষ্ট।” দাস বলল,“যেহেতু আপনি আমার মনিব এবং আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন,আপনি যা বলবেন আমি তা-ই করব।” মনিব বলল,“না,তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে,আমার ভয় হয় যদি রাজি না হও।” দাস বলল,“যে কোন প্রস্তাব দিন আমি রাজী হব।” যখন দাস প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো তখন মনিব বলল,“আমার অনুরোধ হলো একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমি তোমাকে নির্দেশ দেব। তুমি আমার মাথা গোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন করবে।” দাস বলল,“আমি তা করতে পারব না।” মনিব বলল,“না,অবশ্যই তোমাকে তা করতে হবে। কারণ তুমি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছ।” মাঝ রাতে মনিব দাসকে ঘুম থেকে জাগিয়ে একটি ধারালো ছুরি হাতে দিয়ে তাকে নিয়ে এক প্রতিবেশীর বাড়ীর ছাদে গেল আর বলল,“এখানেই আমার মস্তক বিচ্ছিন্ন কর,তারপর যেখানে ইচ্ছা চলে যাও।” দাস বলল,“কেন এটা করব?” সে বলল,“যেহেতু এই প্রতিবেশীকে আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। মৃত্যু আমার কাছে বেঁচে থাকার চেয়ে উত্তম। সে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সে আমার থেকে অগ্রগামী। সব কিছুতেই সে আমার থেকে উত্তম অবস্থায় রয়েছে। আমি হিংসার আগুনেজ্বলে মরছি। আমি চাই সে খুনী বলে পরিচিত হোক ও শাস্তি ভোগ করুক। যদি এমন হয় তবেই আমি শান্তি পাব। আমার শান্তি এখানেই যে,যদি আমাকে এখানে হত্যা কর,কালকে সবাই বলবে (যেহেতু প্রতিদ্বন্দ্বীর লাশ তার বাড়ির ছাদে পাওয়া গেছে) সে-ই আমাকে হত্যা করেছে। অতঃপর তাকে বন্দীকরা হবে ও পরে প্রাণদণ্ড দেয়া হবে। আমার ইচ্ছাও পূর্ণ হবে।” দাস বলল,“যেহেতু তুমি এমন বোকা লোক সেহেতু কেন আমি এটা করব না। তুমি এটার জন্যই উপযুক্ত।” অতঃপর সে মনিবের মাথা বিচ্ছিন্ন করল এবং টাকাগুলো নিয়ে চলে গেল। পরের দিন সবখানে খবর ছড়িয়ে পড়ল। ঐ বাড়ির মালিককে গ্রেফতার করা হলো। কিন্তু সবাই বলাবলি করতে লাগল যদি সে খুনীই হতো তবে নিজের বাড়ির ছাদে খুন করতে যাবে কেন? সম্ভবত কিছু একটা আছে। ব্যাপারটা রহস্যময়। দাসের বিবেক তাকে চিন্তায় ফেলল। অবশেষে বিচারকের কাছে গিয়ে সত্য ঘটনা বর্ণনা করে সে বলল,“আমি তার ইচ্ছাতেই তাকে হত্যা করেছি। সে প্রতিহিংসায় এতটা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে,মৃত্যুকে জীবনের উপর প্রাধান্য দিয়েছে। যখন প্রমাণিত হলো ঘটনা এ রকম তখন দাস এবং ঐ বাড়ির মালিক দু’জনকেই মুক্তি দেয়া হলো।

সুতরাং এটা বাস্তব যে,মানুষ প্রকৃতই হিংসা রোগে অসুস্থ হয়। কোরআন বলছে,

(قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا)

 “সে-ই সফলকাম হলো যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করল এবং সে-ই অকৃতকার্য হলো যে তা প্রোথিত করল। কোরআনের প্রথম কর্মসচী আত্মার পরিশুদ্ধি ও উন্নয়ন এবং হৃদয়কে মানসিক রোগ,সমস্যা,অশান্তি,অন্ধকার ও বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করা।

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)