আল হাসানাইন (আ.)

সিবতে আকবার : ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.)

1 বিভিন্ন মতামত 03.0 / 5

ভূমিকা:

মদীনার আকাশ-বাতাস মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইত (আ.)-এর উপস্থিতিতে সবসময় অদ্ভুত প্রাণবন্ত ও দ্যুতিময় ছিল। সত্যি কথা বলতে কী,এ শুষ্ক মরু শহরটি এর আগে কিম্বা পরে কখনই এরূপ মহীমার অধিকারী ছিল না। এর অলিগলি দিয়ে চলতে  অনেক মজা ছিল। কারণ,প্রত্যুষ না হতেই এর আকাশ-বাতাস সুরভিত হয়ে উঠত মহানবী (সা.)-এর গায়ের বেহেশতী সুঘ্রাণে। এরকম এক নির্মল আনন্দঘন দিনে একটি সুসংবাদ মদীনার মুসলমানদের অন্তরে খুশির জোয়ার তোলে। মহানবী (সা.)-এর সিব্তে আকবার (জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র) ইমাম হাসান দুনিয়ায় এসেছেন।

 

সত্যি,মদীনা সেদিনের মত কখনই সুন্দর ছিল না। এতটা শান্তিময় ছিল না। কিন্তু সে সুন্দর দিনগুলো বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মহানবী (সা.)-এর ওফাতের অব্যবহিত পর থেকেই এ সৌন্দর্য হারিয়ে যেতে থাকে। অচিরেই সে স্থান দখল করে নেয় এমন তিক্ততা,যা মদীনা কখনও দেখেনি। এ সময়ে ইমাম হাসান (আ.)-এর বয়স মাত্র আট বছর ছিল। তিনি হারালেন নানা রাসূল (সা.)-কে। আর খুবই সামান্য ব্যবধানে (৭৫ কিম্বা ৯৫ দিন) হারালেন প্রিয় মাতা ফাতেমা যাহরাকে। এরপর থেকে পিতা হযরত আলী (আ.) শহীদ হওয়ার সময় পর্যন্ত দীর্ঘদিন তিনি তাঁর পাশেই অতিবাহিত করেন। পৃথিবীর নিকৃষ্টতম অপরাধীর হাতে হযরত আলী (আ.)-এর নির্মমভাবে শাহাদাত লাভের পর এক ঝঞ্ঝাময় পরিবেশে ইমাম হাসান ইসলামী হুকুমাতের তরীর হাল ধরেন। ইমামের ছয় মাসের হুকুমাত এবং দশ বছরের ইমামতকাল এমন এক সময়ে ছিল যখন ইসলামী শাসনব্যবস্থায় প্রথমবারের মত প্রকাশ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বেলে আমীরে মু‘আবিয়া মুসলিম জাহানকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছিলেন।

এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে,ইসলামের সত্যবাণী প্রচার করা তো দূরের কথা,সত্যপন্থী মানুষের বেঁচে থাকাও কঠিন হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ইমাম হাসান খেলাফতের মাত্র ছয় মাসের মাথায় অভাবনীয় এক প্রজ্ঞাময় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলমানদের উমাইয়্যা চক্রের সর্বনাশী প্রকোপ থেকে রক্ষা করেন। এ প্রবন্ধে আমরা এ মজলুম ইমামের জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক আলোচনা করব।

ইমাম হাসান মুজতাবা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রিয়পাত্র

মূল আলোচনায় প্রবেশ করার আগে ইমাম হাসান (আ.)-এর পবিত্র ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে কিছু জেনে নিই। মহানবী (সা.)-এর কাছে ইমাম হাসানের মর্যাদা কত বেশি ছিল এ কথা শুধু সে যুগের মুসলমানরাই নয়,আজ অবধি সকল মুসলমান খুব ভালভাবেই জানে। প্রিয়নবী (সা.) তাঁর এ আদরের দৌহিত্রকে পিঠে তুলে নিতেন এবং দো‘আ করতেন : ‘হে  আল্লাহ! আমি একে ভালবাসি,তুমিও একে ভালবাস।’

ইমাম বুখারী ও মুসলিম স্ব স্ব সহীহ’র মধ্যে বর্ণনা করেছেন : ...বারা (রা.) বলেন :

‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছি যে,হাসান ইবনে আলীকে তাঁর কাঁধে বসিয়ে বলছেন : হে আল্লাহ! আমি একে ভালবাসি। কাজেই তুমিও তাকে ভালবাস।’

একই রকম আরও রেওয়ায়াত হযরত উসামা বিন যায়েদ এবং আবু হুরায়রা থেকেও সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের এ অধ্যায়গুলোতে বর্ণিত হয়েছে।

ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে শত্রুতা করার পরিণাম

ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে শত্রুতা করার কঠিন পরিণামের ব্যাপারেও সহীহ গ্রন্থসমূহে একাধিক রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে।

ইবনে হিব্বান স্বীয় সহীহতে বর্ণনা করেছেন : যায়েদ ইবনে আরকাম থেকে বর্ণিত হয়েছে :

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফাতেমা,হাসান ও হুসাইনকে উদ্দেশ্য করে বলেন : ‘আমি তার সাথে শত্রুতা করি,যে তোমাদের সাথে শত্রুতা করে। আর তার সাথে শান্তি বজায় রাখি যে তোমাদের সাথে শান্তি বজায় রাখে।”

হাকেম নিশাবুরিও তাঁর মুস্তাদরাক গ্রন্থে বর্ণনা লিখেছেন : .হযরত আবু হুরায়রা বর্ণনা করেছেন :

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী,ফাতেমা,হাসান ও হুসাইন (তাঁদের সকলের ওপর দরূদ ও সালাম) এর দিকে তাকিয়ে বলেন : ‘আমি তার সাথেই দুশমনি করি,যে তোমাদের সাথে দুশমনি করে। আর তার সাথেই শান্তি বজায় রাখি যে তোমাদের সাথে শান্তি বজায় রাখে।”

শামসুদ্দীন যাহাবী ‘সিয়ারু আ’লামুন নুবালা’ গ্রন্থে লিখেছেন : আবু হুরায়রা বর্ণনা করেছেন :

“নবী (সা.) আলী,ফাতেমা,হাসান ও হুসাইনের দিকে তাকিয়ে বলেন : ‘আমি তার সাথেই দুশমনি করি,যে তোমাদের সাথে দুশমনি করে। আর তার সাথেই শান্তি বজায় রাখি যে তোমাদের সাথে শান্তি বজায় রাখে।”

হাকেম নিশাবুরী তাঁর মুস্তাদরাক গ্রন্থে আবান ইবনে তাগলিব এর সনদে আরও একটি রেওয়ায়াত বর্ণনা করেছেন : আবি সাঈদ বলেন :

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “যে ব্যক্তিই আমার আহলে বাইতকে ঘৃণা করবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।”

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বালও স্বীয় মুসনাদ গ্রন্থে আবু হুরায়রা থেকে একই রকম রেওয়ায়াত বর্ণনা করেছেন। সুতরাং মুসলমানদের নির্ভরযোগ্য সকল সূত্রে বণিত সহীহ হাদীস ও রেওয়ায়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে,আহলে বাইত (আ.),যাঁদের অন্যতম হলেন ইমাম হাসান (আ.),তাঁদের সাথে শত্রুতা করা ও যুদ্ধ করার অর্থ হল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিরুদ্ধে দুশমনি ও যুদ্ধ করা।

ইমাম হাসানের আরও কিছু পরিচয়

ইমাম হাসান বেহেশতের যুবকদের সম্রাট এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে চাদরের নিচে অবস্থানকারী আহলে বাইতের পাঁচজনের অন্যতম। এছাড়াও সকল মুফাসসির ও মুহাদ্দিসের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে যে,তিনি এবং আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্য মুবাহালার ঘটনায় নাযিলকৃত আয়াত এবং তাতহীরের আয়াতের ঘোষণা অনুযায়ী পুতপবিত্র। আর ইমাম হাসান এজন্য গর্বও করতেন।

ইমাম হাসান ছিলেন নানা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চেহারার প্রতীম। আনাস ইবনে মালেক প্রমুখ বলেন যে,আহলে বাইতের সদস্যদের মধ্যে অন্য কেউ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এতখানি সদৃশ চেহারার ছিলেন না। তিনি ২৫ বার পায়ে হেঁটে হজ্জ পালন করেন,অথচ আকর্ষণীয় ঘোড়া তাঁর কাছেই ছিল। তাঁর বদান্যতা ও দানশীলতা এতই প্রসারিত ছিল যে,তিনি ‘কারিম-এ আহলে বাইত’ বা আহলে বাইতের দয়াশীল উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি তিনবার নিজের সমুদয় সম্পদ অর্ধেক করেন এবং দু’বার তা পুরোপুরি আল্লাহর রাহে দান করেন। তিনি যখন নামাযে দাঁড়াতেন তখন আল্লাহর ভয়ে তাঁর শরীর কেঁপে কেঁপে উঠত এবং তাঁর চেহারা হলুদ বর্ণ ধারণ করত। আর ইমামের ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা এমন ছিল যে,তাঁর পরম শত্রুদ্বয় মু‘আবিয়া ও মারওয়ান বলতেন : ‘যেন পর্বতের বিরুদ্ধে লড়াই করছি।’১১

ইমামত লাভের পূর্বে ইমাম হাসানের কিছু কর্মতৎপরতা

১. রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড :

ক. জঙ্গে জামালে (উটের যুদ্ধ) অংশগ্রহণের জন্য লোকজনকে সংগঠিত করা

অঙ্গীকার ভঙ্গ করে অবাধ্যতার পথে পা বাড়ানো বিচ্যুত মুসলমানদের দমন করার জন্য আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) জঙ্গে জামালে অংশগ্রহণে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইমাম হাসানকে কুফায় প্রেরণ করেন। ইমাম হাসান মুজতাবাও তাঁর আকর্ষণীয় বাচনক্ষমতা প্রয়োগ করে বিশাল সৈন্য বাহিনী সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।

খ. জঙ্গে জামালে অংশগ্রহণ

ইমাম হাসান জঙ্গে জামালে অংশগ্রহণ করে উল্লেখযোগ্য ও সাহসিকতাপূর্ণ অবদান রাখেন। এ যুদ্ধে হযরত আয়েশাকে বহনকারী উটকে হত্যা করার মাধ্যমে বিদ্রোহী দলের পরাজয় নিশ্চিত হয়। এ কারণেই একে ‘জঙ্গে জামাল’ বা উটের যুদ্ধ বলা হয়।

গ. সিফফীন যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং সেনাপতির দায়িত্ব পালন

এ যুদ্ধে ইমাম হাসান (আ.) হযরত আলী (আ.)-এর নির্দেশে দক্ষিণ বাহিনীর সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি পিতার অধীনে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। শত্রুপক্ষের নেতা মু‘আবিয়া উবায়দুল্লাহ ইবনে ওমরকে প্রেরণ করেন যেন কোন প্রতিশ্রুতির আশ্বাস দিয়ে ইমাম হাসানকে রণাঙ্গণ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। কিন্তু মু‘আবিয়ার দূত নিরাশ হয়ে মাথা নিচু করে ফিরে আসে।

২. সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ড

ক. কুফার জুমআ নামাযের অস্থায়ী ইমাম

হযরত আলীর খেলাফতকালে ইমাম হাসানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কর্মতৎপরতা ছিল জুমআর নামাযের ইমামতির দায়িত্ব পালন। যখনই হযরত আলী কুফা থেকে বাইরে যেতেন কিম্বা কোন কারণে জুমআর নামাযে ইমামতি করতে পারতেন না,তখন এ গুরুদায়িত্ব ইমাম হাসানের ওপরই ন্যস্ত করতেন।

খ. ইমাম আলী (আ.)-এর স্থলে বিচারকাজ পরিচালনা

বর্ণিত হয়েছে যে,আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের সময়ে এক ব্যক্তিকে তাঁর কাছে নিয়ে আসা হল। তাকে একটি ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটি রক্তাক্ত লাশের পাশে পাওয়া গিয়েছিল,আর তার হাতে একটি চাকুও ছিল। বিচারের জন্য লোকটিকে হযরত আলীর কাছে আনা হল। তিনি তাকে বললেন : ‘তোমার কি কিছু বলার আছে?’ লোকটি বলল : ‘হে আমীরুল মুমিনীন! এ অভিযোগ আমি মেনে নিলাম।’ আলী (আ.) নির্দেশ দিলেন তাকে নিয়ে কিসাসের দণ্ড তার ওপর কার্যকর করতে। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি ছুটতে ছুটতে এসে উপস্থিত হল এবং চিৎকার করে বলতে লাগল : ‘তাকে ছেড়ে দাও,তাকে ছেড়ে দাও। সে কাউকে হত্যা করেনি। আমিই হত্যাকারী।’ তখন আলী (আ.) অভিযুক্তকে জিজ্ঞেস করলেন :‘তুমি এ হত্যার অভিযোগ কেন মেনে নিলে,অথচ হত্যাকারী তো অন্যজন?’ লোকটি উত্তর দিল : ‘আমি এমন অবস্থায় ছিলাম না যে,নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারতাম। কারণ,কয়েকজন লোক আমাকে চাকু হাতে ঐ লাশের পাশে দেখেছিল। আমি একটি দুম্বা জবাই করেছিলাম। অতঃপর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য ঐ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ঢুকেছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি ঐ লাশটির রক্তে মাটি একাকার। আমি চমকে উঠলাম,আর এ লোকগুলোও সেখানে ঢুকে হাতে চাকু অবস্থায় আমাকে দেখে ফেলে। তারা মনে করল যে,আমিই হত্যা করেছি।’ আলী (আ.) অভিযুক্ত লোকটি ও হত্যাকারীকে ইমাম হাসানের কাছে পাঠিয়ে দিলেন যাতে তিনিই এর বিচার করে রায় প্রদান করেন। ইমাম হাসান উভয়ের বক্তব্য শোনার পর রায় দিলেন : ‘আসল হত্যাকারী তার সত্য স্বীকারের মাধ্যমে অভিযুক্ত লোকটির প্রাণ রক্ষা করেছে এবং যেহেতু সে পবিত্র কুরআনের ‘আর যে (ব্যক্তি) কোন মানুষকে বাঁচায় সে যেন সকল মানুষকে বাঁচালো’- এ আয়াতের আওতায় একজনকে হত্যা করার পর অপর একজনকে বাঁচিয়েছে,কাজেই দু’জনকেই ছেড়ে দাও। আর নিহতের রক্তমূল্য বাইতুল মাল থেকে পরিশোধ কর।’

৩. অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড

ইমাম হাসান (আ.)-এর ইমামত লাভের পূর্বের উল্লেখযোগ্য একটি অর্থনৈতিক কর্ম হল সেসব জমির তত্ত্বাবধান করা যেগুলো রাসূলুল্লাহ (সা.),হযরত আলী ও হযরত ফাতেমার পক্ষ থেকে ওয়াক্ফ হিসাবে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। সেগুলোর বেশিরভাগই আল্লাহর ঘর যিয়ারতকারী হাজী,ইয়াতিম,অনাথ ও আহলে বাইতের পরিবারবর্গের জন্য দেওয়া হয়েছিল। এসব সম্পত্তি মূলত খেজুর বাগান,ফসলি জমি,কুয়া,ভূগর্ভস্থ পানির নালা ইত্যাদি রূপে ছিল।

পিতার শাহাদাতের পর ইমাম হাসান

ইমামুল মুত্তাকীন আলী ইবনে আলী (আ.)-এর মজলুমভাবে শাহাদাত বরণের পর জনগণের মধ্য থেকে একদল ইমাম হাসানের কাছে উপস্থিত হয়ে বলে : ‘হে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সন্তান! আপনি হলেন খলীফা এবং আপনার পিতার স্থলাভিষিক্ত। আমরা সবাই আপনার নির্দেশ মান্য করার জন্য প্রস্তুত। সুতরাং আপনি যেভাবে কল্যাণ মনে করেন,সেভাবেই আমাদের পরিচালিত করুন।’ জবাবে ইমাম তাদের বললেন : ‘তোমরা মিথ্যাবাদী জনগণ। কারণ,যে মানুষ আমার চেয়ে শ্রেয়তর ছিল তাঁর সাথেই তোমরা বেঈমানী করেছ। সুতরাং কিভাবে তোমরা আমার নির্দেশ মান্য করবে? আর আমিও কোন ভরসায় তোমাদের ওপর আস্থা রাখব? তা সত্ত্বেও যদি তোমরা তোমাদের কথায় সত্যবাদী হয়ে থাক,তাহলে তোমাদের সাথে আমার কথা থাকল মাদায়েন শহরের নিকট পরস্পর দেখা হবে। সেখানেই সবাই দুশমনের মোকাবিলা করার জন্য সমবেত হব।’ তখন তাদের অধিকাংশই ইমাম হাসানের প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল এবং নিজ নিজ ঘরে ফিরে গেল। ইমাম সব অবস্থা অবগত হয়ে নিজের সওয়ারীর ওপর সওয়ার হলেন এবং কিছু সংখ্যক সঙ্গী নিয়ে রওনা হলেন। নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে তিনি সমবেত লোকদের উদ্দেশে এক ভাষণে বলেন : ‘হে লোকসকল! তোমরাই আমাকে ধোঁকা দিতে চেয়েছ,ফলে ছলনা ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছ,যেমনটি করেছ আমার পিতার সাথে। তোমরা আমার পরে এক কাফের ও যালেম ব্যক্তির নেতৃত্বে যুদ্ধ করবে,যার আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান বলতে কিছুই নেই।’

এরপর ইমাম হাসান কিন্দী নামের এক ব্যক্তিকে সেনাদলের অধিনায়ক নির্বাচিত করে চার সহস্রাধিক সৈন্যসহ রণাঙ্গণে প্রেরণ করেন এবং বলেন : ‘আম্বার নামক স্থানে যাত্রাবিরতি করবে। আমার পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ না আসা পর্যন্ত সেখান থেকে নড়বে না।’

মু‘আবিয়া যখন এ ঘটনার কথা অবগত হলেন,তখন পাঁচ লক্ষ দিরহামসহ কয়েকজন অনুচরকে ইমামের সেনাধিনায়কের কাছে প্রেরণ করলেন। তাদের মাধ্যমে এ বার্তা পৌঁছালেন : ‘যদি তুমি আমাদের সাথে যোগ দাও তাহলে যে প্রদেশেরই গভর্নর হতে চাও,তোমাকে সে প্রদেশের গভর্নর করা হবে।’ ইমামের সেনাধিনায়ক যেহেতু দুর্বল ঈমানের অধিকারী ও দুনিয়ালোভী ছিল,সেহেতু সে ইমাম হাসানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল। সে উক্ত দিরহামগুলো গ্রহণ করে অনেক সৈন্যসহ মু‘আবিয়ার দলে যোগ দিল।

যখন এ খবর ইমাম হাসানের কাছে পৌঁছল,তখন তিনি বলেন : ‘হে লোকসকল! কিন্দী আমার প্রতি ও তোমাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং আমি দ্বিতীয়বারের মত পুনরাবৃত্তি করছি যে,তোমরা হলে অবিশ্বস্ত ও দুনিয়ালিপ্সু। কিন্তু আমি অন্য একজনকে তার জায়গায় প্রেরণ করছি। যদিও আমি জানি যে,সেও আগের লোকটির মতই বিশ্বাসঘাতক।’ অতঃপর ইমাম মুরাদ গোত্রের মুরাদি নামের এক লোককে চার হাজার সৈন্যসহ প্রেরণ করলেন এবং তার নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন যেন সে মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করে। সেও কসম

করল যে,সে পর্বতের মতই অবিচল ও অটল থাকবে। অতঃপর যখন সে রওনা হওয়ার জন্য তৈরি হল তখন ইমাম নিচুস্বরে বললেন,‘এর ওপরও কোন ভরসা নেই।’

যখন মুরাদির সৈন্যদল আম্বার-এ পৌঁছল,তখন মু‘আবিয়া পুনরায় কিন্দীর মত একই পরিকল্পনা কার্যকর করল এবং সেও ধোঁকার শিকার হল। আর নিজের অঙ্গীকার ও কসম ভঙ্গ করে মু‘আবিয়ার দলে যোগ দিল। ইমাম হাসান (আ.) মুরাদির বিশ্বাসঘাতকতার খবর শুনে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং বললেন : ‘আবারও বলছি যে,তোমাদের মধ্যে সততা ও বিশ্বস্ততা নেই। তোমরা অঙ্গীকার ভঙ্গকারী। নিজের চোখেই দেখলে যে,কিন্দী ও মুরাদি কীভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করল!’ কিন্তু উপস্থিত লোকেরা বলল : ‘হে রাসূললাহ (সা.)-এর সন্তান! তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বটে,কিন্তু আমরা সততার সাথেই আপনার সাথে আছি। আপনি যা নির্দেশ দান করবেন,সেটাই মেনে চলব।’ ইমাম হাসান বললেন : ‘তাহলে তোমাদের আরও একবার পরীক্ষা করে দেখি যাতে সত্য তোমাদের নিজেদের জন্য প্রমাণিত হয়ে যায়। তোমাদের সাথে আমার ওয়াদা রইল নুখাইলা ভূখণ্ডে। যে কেউ চায়,সেখানে হাজির হবে। যদিও আমি জানি,তোমরা ওয়াদা ভঙ্গকারী ও বিশ্বাসঘাতক।’

অতঃপর ইমাম নুখাইলা ভূখণ্ডে প্রবেশ করলেন এবং সেখানে দশ দিন অবস্থান করলেন। কিন্তু তিনি লক্ষ্য করলেন যে,গুটিকতক লোক ছাড়া সেখানে অন্য কেউ উপস্থিত হয়নি। তখন ইমাম কুফায় প্রত্যাবর্তন করলেন এবং মিম্বারে আরোহণ করে এক ভাষণে বললেন : ‘আমি আশ্চর্য হই তোমাদের মত নিকৃষ্ট,বে-দীন ও অবিশ্বাসী লোকদের থেকে। ধিক তোমাদের! এমন সস্তা প্রতারণার শিকার হওয়া ও আত্মবিক্রিত লোকেরা! জেনে রেখ,ইসলামী হুকুমত বনি উমাইয়্যার ওপর হারাম। কিন্তু যদি হুকুমত মু‘আবিয়ার হাতে পড়ে,তাহলে যেহেতু তোমাদের তার হুকুমতের বিরোধিতাকারী হিসেবে জানবে,ফলে সামান্যতম দয়াও তোমাদের প্রতি দেখাবে না; বরং নিষ্ঠুরতম পন্থায় তোমাদের নির্যাতন চালাবে এবং তোমাদের ধ্বংস করবে।’

কুফার অনেক বিশ্বাসঘাতক ও দুনিয়াপূজারি লোক ইমামের এসব কথা চিঠি লিখে মু‘আবিয়াকে জানায়। চিঠিতে তারা লেখে : ‘যদি আপনি আগ্রহী থাকেন তাহলে আমরা হাসান ইবনে আলীকে গ্রেফতার করে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিতে রাজি আছি।’

যখন তারা এ ব্যাপারে মু‘আবিয়ার সন্তুষ্টির কথা অবগত হল,তখন তারা ইমাম হাসানের আবাসস্থলে হামলা করল এবং তরবারির আঘাতে তাঁর পবিত্র দেহকে ক্ষত-বিক্ষত করল।

এ ঘটনার পরে ইমাম নিরূপায় হয়ে মু‘আবিয়ার কাছে এ মর্মে একটি পত্র লেখেন : ‘যদিও আমার নানা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট থেকে শুনেছি যে,তিনি বলতেন, খেলাফত ও বেলায়াত বনি উমাইয়্যার ওপর হারাম,কিন্তু যে অবস্থা ও পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে,নিরূপায় হয়ে আমি কিছু শর্তসাপেক্ষে সন্ধির জন্য প্রস্তুত আছি।’১৩

ইমাম হাসানের সাথে উমাইয়্যা ও আব্বাসীদের বিরোধিতার ঐকমত্য

ইমাম হাসান (আ.)-এর রাজনৈতিক জীবন এমন সব জটিলতায় ভরা যা এমনকি কোন কোন গবেষককে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়। এ কারণে তাঁদের মধ্যে কমসংখ্যক ব্যক্তিই সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদানে সক্ষম হয়েছেন।

ইমাম হাসান সম্পর্কে মুসলমানদের ইতিহাসের সকল সূত্রে বর্ণিত হাদীস ও রেওয়ায়াতগুলো বিকৃতি ও তাঁর দুশমনদের অযাচিত হস্তক্ষেপের কবলে পড়েছে। যেহেতু ইমাম সবসময় উমাইয়্যাদের সাথে মোকাবিলায় লিপ্ত ছিলেন সেহেতু তাদের,বিশেষ করে মারওয়ানের হিংসা ও বিদ্বেষের মুখে ছিলেন। তাছাড়া সিফফিনের যুদ্ধকালীন সালিশের মতই চাপিয়ে দেওয়া এক সন্ধি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি ক্ষমতা থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে উমাইয়্যারা ক্ষমতার ময়দানে নিজেদের একচেটিয়া দৌরাত্ম্য প্রতিষ্ঠা করে। এ সুযোগে তারা ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে আরও দু’টি লক্ষ্য বাস্তবায়নের অশুভ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর মধ্যে একটি হল ইমামকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার পর ইমামের ব্যক্তিত্ব ভূলুণ্ঠিত করার চেষ্টা। আর অন্যটি হল চূড়ান্ত পর্যায়ে ইমামকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া।

ইমাম হাসানের ব্যক্তিত্বকে ভূলুণ্ঠিত করার জন্য তারা প্রথমে প্রচারণা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করতে শুরু করে। আর এ চেষ্টা সফল হলে তাদের পরবর্তী লক্ষ্য অর্থাৎ তাঁকে হত্যা করার কাজটি সহজ হয়ে যাবে। অপরদিকে,আব্বাসীদের উত্থানের পরে যখন তাদের শাসনক্ষমতা পূর্ব থেকে পশ্চিমের সর্বত্র বিস্তৃতি লাভ করেছিল,এ সময়ে ইমাম হাসানের বংশধরদের বিভিন্ন আন্দোলন মাথা চাড়া দেওয়ায় আব্বাসীরাও উমাইয়্যাদের মতই তাঁদেরকে দুর্বল করার লক্ষ্যে তাঁদের পূর্বপুরুষ ইমাম হাসানের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করতে থাকে। ফলে রেওয়ায়াতের নামে ইমাম হাসানের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ মিথ্যা ও বানোয়াট কথা সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ইতিহাস ও হাদীসের গ্রন্থসমূহে এগুলো এমনভাবে সন্নিবেশিত করে দেওয়া হয়েছে যে,একজন সরলমনা মুসলমান সেগুলো পাঠ করলে তার মনে এ মহান ইমামের প্রতি শুধুই কুধারণা ও ঘৃণাই জন্ম নেবে। শুধু তা-ই নয়,আজ দেখা যায় যে,পাশ্চাত্যের অনেক প্রাচ্যবিদ যখন ইমাম হাসানের রাজনৈতিক জীবনের ওপর বিশ্লেষণ লেখেন তখন ঐসব বানোয়াট রেওয়ায়াতকেই তাঁদের লেখনীর মধ্যে উল্লেখ করে থাকেন। তাঁরা যেহেতু আহলে বাইতের অনুসারীবৃন্দের মূলধারার সাথে পরিচিত নন,অপরদিকে উমাইয়্যাদের এসব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বানোয়াট রেওয়ায়াতে পরিপূর্ণ ইতিহাস ও হাদীসের গ্রন্থগুলোকেই তাঁরা সূত্র হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন,ফলে এসব বানোয়াট ও অমূলক বর্ণনা দ্বারা অনায়াসে প্রভাবিত হয়ে পড়েন এবং ইমাম হাসান (আ.) সম্পর্কে নিকৃষ্টতম মন্তব্য করতেও তাঁরা দ্বিধা করেন না। ফরাসি প্রাচ্যবিদ Le Mans (১৮৭২-১৯৫৬) এর মত লেখকবৃন্দের নাম এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য,যাঁদের লেখা খ্রিস্টান ও ইয়াহুদীবাদের অনেক সেবায় এসেছে।১৪

এসব লেখনী,সেটা ইতিহাস গ্রন্থেই হোক অথবা প্রাচ্যবদিদের লেখনীতে,নিম্নোক্ত দু’টি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অগ্রসর হয়েছে :

১. ব্যক্তিত্ব হনন ও

২. রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা।

স্মর্তব্য যে,দীনি হুকুমতসমূহে হুকুমত লক্ষ্য নয়; বরং তা মানুষের পার্থিব ও আখেরাতের কল্যাণ সাধনের জন্য একটি উসিলা মাত্র। এ কারণে শাসকরা নিজেরা যেমন সৎকর্মপরায়ণ হন,তদ্রুপ সৎকর্মপরায়ণদেরই জনগণের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। বিপরীতক্রমে ধর্ম বহির্ভূত হুকুমতসমূহে যেহেতু লক্ষ্য হল ক্ষমতায় পৌঁছানো- সেটা যে কোন উপায়েই হোক না কেন,তাই যে কোন কাজ করতে তারা দ্বিধা করে না। এরূপ একটি কার্যকর পদক্ষেপ হল সমাজের জন্য ব্যক্তিত্ব বানানো এবং ব্যক্তিত্ব ধ্বংসের নীতি। তারা নিজেদের সাথে সমাজকে একই পথের পথিক করে তোলার জন্য চেষ্টা করে। তারা প্রচারণার মাধ্যমে তাদের পছন্দের ব্যক্তিবর্গকে তুচ্ছ থেকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে মহান করে তোলে এবং তাদের মধ্য থেকেই ফকীহ,মুফাসসির, মুহাদ্দিস,কারী,আলেম,রাজনীতিক ইত্যাদি বানায়। বিপরীতক্রমে অপপ্রচার চালিয়ে শ্রদ্ধাবান ও সঠিক আদর্শ স্থানীয় ব্যক্তিত্বদের মূল্যহীন ও তাচ্ছিল্যের পাত্রে পরিণত করে যাতে তাদেরকে জনগণ ও সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। আর এ কারণেই বলা যায়,সমাজের সংস্কারক ও যোগ্য নেতাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার হল তাদের ব্যক্তিত্বকে ধ্বংস করে দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কঠিন দুশমন ও মুনাফিকরা যখন যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে তখন নবী পত্নীর বিরুদ্ধে নানা অপবাদ আরোপ করার মাধ্যমে মহানবীর সাথে তাদের কঠিন শত্রুতার পরিচয় দেয়। তদ্রুপ উমাইয়্যারা আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপবাদ আরোপ করতে দ্বিধা করেনি। স্বয়ং মু‘আবিয়ার ভাষায়,এ অপপ্রচারের ভিত্তিতে বড় থেকে বড়রা এবং ছোট থেকে ছোটরা মৃত্যু অবধি ঘুরপাক খেতে থাকবে।১৫

এ একই ধারাবাহিকতায় ইমাম হাসানের দুশমনরাও তাঁকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় অঙ্গনে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে এবং ঘৃণ্য অপপ্রচার ও কুৎসা রটনা করতে থাকে। এক্ষেত্রে এ শ্রেণীর লেখক ও ঐতিহাসিকদের জন্য যে বিষয়টি আরও সুবিধা করে দেয় সেটা হল মু‘আবিয়ার সাথে ইমাম হাসান (আ.)-এর সন্ধির ঘটনা।

অথচ সেই সময়ের ইতিহাস ও ঘটনা পরম্পরা সম্পর্কে কিছুটা হলেও অধ্যয়ন করলে সন্ধি মেনে নেওয়ার ব্যাপারে তাঁর প্রজ্ঞাময় সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়। এটি তাঁর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের দুর্বলতা তো নয়ই; বরং এটি তাঁর উচ্চ রাজনৈতিক মেধারই সাক্ষ্য বহন করে। কেননা,সন্ধিচুক্তি সম্পন্ন হওয়ার এক দশক পরে যখন রাজন্যদের খেয়ানত (বিশ্বাসঘাতকতা) প্রকাশ্য রূপ লাভ করে তখন সকলেই ইমাম হাসান (আ.)-এর সন্ধির সঠিকত্ব ও গভীরতার ব্যাপারে অনুধাবন করতে সক্ষম হয় এবং তা অকপটে স্বীকার করতে থাকে।

এ সন্ধিচুক্তি সম্পন্ন হওয়ার অনেক বছর আগেই রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন : ‘নিশ্চয় হাসান হল আমার সুগন্ধী ফুল এবং আমার এ সন্তান হল সাইয়্যেদ ও মহান। অচিরেই মহান আল্লাহ তার মাধ্যমে দু’দল মুসলমানের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করাবেন এবং তারা তার আশীর্বাদপূর্ণ উপস্থিতির মাধ্যমে নিরাপত্তা,স্বস্তি ও শান্তি লাভ করবে।’ এ রেওয়ায়াতটি এবং ইতিহাসের ন্যায়নিষ্ঠ বিশ্লেষণ বিদ্বেষী লেখকদের ‘ব্যক্তিত্ব ধ্বংসের’ ঘৃণ্য প্রয়াসের মুখোশ খুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। যদিও এর বাইরেও মহান ইমামের জ্ঞানগত,ব্যক্তিগত ও সামাজিক অনেক বৈশিষ্ট্যের কথা

লিপিবদ্ধ রয়েছে,যেগুলো প্রত্যেকটিই তাঁর পুত-পবিত্র ব্যক্তিত্বের প্রকৃত স্বরূপ বিশ্লেষণের এক একটি সনদ হতে পারে। ইসলামী শিক্ষার পাঠদান,উপযুক্ত শিষ্যবৃন্দ প্রতিপালন- যাঁরা কঠিনতম পরিস্থিতিতেও মুসলিম বিশ্বের জন্য কল্যাণ ও মঙ্গলের উৎস হতে পারেন,নবীর হাদীস বর্ণনা,গঠনমূলক ও ভাগ্যনির্ধারণী বিচার কাজ পরিচালনা- এরূপ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করার মাধ্যমে ইমাম হাসান মুজতাবা যে মূল্যবান অবদান রেখেছেন,তা কেবল তাঁর ব্যক্তিত্বকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার জন্য গবেষক ও মুসলমানদের সাহায্যই করবে না; বরং একটি চিন্তাশীল সমাজ গঠনেও যথাযথ ভূমিকা রাখবে।

আরেকটি বিষয় হল,সব গোত্র বা জাতির জীবনে তাদের অতীত ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সত্যকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিফলিত করে সুলিখিত ইতিহাস যেমন একটি জাতির উজ্জীবিত জীবন গড়তে অনুপ্রেরণা যোগায়,বিপরীতক্রমে কোন পক্ষপাতদুষ্ট এবং অসত্য ও বিকৃত ইতিহাস একটি জাতিকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করে। পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও মহান মুসলিম জাতির ইতিহাস একদিকে যেমন গৌরবের আলোয় উদ্ভাসিত,একইভাবে আবার অযাচিত হস্তক্ষেপে অনেক সত্যই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের মুসলমানদের কাছে চাপা পড়ে রয়েছে। এরূপ একটি চাপা পড়া ইতিহাস হল ইমাম হাসান (আ.)-এর খেলাফতকাল। আমীরে মু‘আবিয়ার নেতৃত্বে তৎকালীন উসমানীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উত্তরাধিকার পাওয়া আজকের যেসব ইতিহাস,তার একটি পরিচয় হল ইমাম হাসানের ছয় মাসের খেলাফতকালের প্রতি কোনরূপ ভ্রুক্ষেপ না করা বা তা অস্বীকার করা। ইমাম হাসানের এ খেলাফতকালকে না খোলাফায়ে রাশেদার মধ্যে গণ্য করা হয়,আর না কোন মানবীয় যুগের মধ্যে গণ্য করা হয়। আসলে ঐ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এ খেলাফতকে তেমন স্বীকৃতি প্রদান করা হয় না। অথচ সেদিন অবশিষ্ট মুহাজির ও আনসার যাঁরা কুফায় ছিলেন,তাঁরা ছাড়াও ইরাকের জনগণ এবং ইসলামী সাম্রাজ্যের পূর্বাংশের বাসিন্দারা সকলে ইমাম হাসান (আ.)-কে মুসলমানদের খলীফা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্পষ্টতই দৃশ্যমান হচ্ছিল যে,মুসলমানদের মাঝে বিশাল এক ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। আবার এ সময়েই মু‘আবিয়া শামে খেলাফাতের দাবিদার ছিলেন। যদিও তাঁর নিজের কথা অনুযায়ী আনসারদের মধ্য থেকে শুধু একজন ব্যক্তিই তাঁর সাথে ছিল।

খেলাফতের ইতিহাসে একই সময়ে দু’জন খলীফা থাকার বিষয়টির কোন স্থান নেই। যে সময়ে ইমাম হাসান (আ.) খেলাফতে আসীন হন,তখন শামের তুলনায় ইরাকের অবস্থা অতি শোচনীয় ছিল। একদিকে সিফফীন যুদ্ধোত্তর সালিশী ফয়সালায় ইরাকের জনগণের ক্ষতি হয়,এর পাশাপাশি খারেজীদের বিদ্রোহও ইরাকের শক্তিকে প্রচণ্ডভাবে দুর্বল করে দেয়। তারা পরপর তিনটি যুদ্ধের (জঙ্গে জামাল,জঙ্গে সিফফিন ও জঙ্গে নাহরাওয়ান) কারণে পরিশ্রান্ত ও বিপন্ন হয়ে পড়েছিল।

ইমাম আলী (আ.)-এর জীবনের শেষ দিনগুলোতে যতই জনগণকে বলা হল সংঘবদ্ধ হতে,খুব স্বল্প সংখ্যক লোকই তাতে সাড়া দিল। এবার ইমাম আলীর শাহাদাতের পরে এবং শামের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ফলে ইরাকবাসীর সীমাহীন উৎকণ্ঠার কারণে আশা করা হচ্ছিল যে,তারা একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে একতাবদ্ধ হবে। আর তাদের এ কাজের পথে একজন ইমাম (বা নেতাকে) বেছে নিবে এবং যেমনটা ইশারা করা হল,তাদের ইমামকে মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। কায়েস ইবনে সা’দ এবং আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের বাইআতও ইমামের সাথে ইরাকের জনগণের বাইআত হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। যে পথ অনুসরণ করে‘ হিজাজের জনগণও কিছু সময় নিয়ে বাইয়াতে প্রবৃত্ত হয়।

আসলে কুফাবাসীর অধিকাংশের প্রবণতা ছিল ইমাম আলী (আ.)-এর সরকারকে সমর্থন করা। আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পরে তারা ইমাম হাসান (আ.) ব্যতীত আর কাকে নির্বাচিত করতে পারত? অবশ্য মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে,এমনকি কুরাইশদের মধ্যে কোন কোন সাহাবী কুফায় ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের ন্যায় ব্যক্তিও কুফায় উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ইমাম হাসানকে নির্বাচনের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়নি এবং অন্য কোন ব্যক্তির নাম সামনে আসেনি। তবে এটা এ কারণে নয় যে,ইরাকের জনগণ হাসান ইবনে আলীকে তাঁর পিতার চেয়েও বেশি ভালবাসত; বরং এর কারণ ছিল যে,এটা ছাড়া তাদের কোন গত্যন্তর ছিল না।

এ আলোচনা অবতারণা করার কারণ হল যাঁরা বলতে চান,ইমাম হাসান (আ.)-এর সময় সকল পরিস্থিতি তাঁর অনুকূল থাকা সত্ত্বেও তিনি স্বেচ্ছায় চাননি যুদ্ধ ও হানাহানির পথ অব্যাহত রাখতে,এ কারণে খেলাফতও ছেড়ে দেন। কিন্তু এ বক্তব্য কখনই সঠিক নয়। এ প্রবন্ধে ইমাম হাসানের সন্ধিচুক্তি বিশ্লেষণ করার কোন অভিপ্রায় আমাদের নেই। তবে যাঁরা উক্ত সন্ধিচুক্তির প্রেক্ষাপট ও চুক্তির শর্তাবলি সম্পর্কে জানেন,তাঁদের কাছে সুস্পষ্ট যে,ইমাম হাসান খলীফা এবং ইমাম হিসাবে সেদিন কী বলিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন! এমনকি এ প্রসঙ্গে আহলে বাইতের অনুসারীবৃন্দের সূত্রে স্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান যে,ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) স্বীয় পুত্রকে খেলাফতের জন্য নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসাবে ঘোষণা করে যান। যদিও আহলে সুন্নাতের সূত্রগুলো সেগুলোকে স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণ সংক্রান্ত বলে উল্লেখ করেনি। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট থেকে একটি রেওয়ায়াত অনেকগুলো সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। রেওয়ায়াতটি হল :

“হাসান ও হুসাইন দু’জন ইমাম,তারা উঠে দাঁড়ালেও অথবা বসে থাকলেও।”১৭

এ হাদীসের বক্তব্য স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে,এ দু’ ভাইয়ের ইমামতের বিষয়টি সুঘোষিত একটি ব্যাপার। নাসর বিন মুযাহিমের বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আলী (আ.)- এর আমলেই আওয়ার শান্নি ইমামকে উদ্দেশ করে বলেন : ‘ আল্লাহ আপনার সাফল্য বৃদ্ধি করুন,আপনি খোদায়ী নূরের আলোক ছায়ায় দৃষ্টিপাত করেন... আপনি হলেন নেতা (ইমাম) এবং যদি আপনি নিহত হন তাহলে আপনার পরে নেতৃত্ব এ দু’জনের (হাসান ও হুসাইন) ওপর ন্যস্ত হবে। আমিও এ সম্বন্ধে কিছু রচনা করেছি। আপনি যদি অনুগ্রহ করে শুনতেন :

হে আবুল হাসান! আপনি হলেন মধ্যাহ্নের আলোকবর্ষী সূর্যসম,

আর এ দু’জন (আপনার পুত্রদ্বয়) সৃষ্টিকুলের মাঝে কিরণময় চন্দ্রসম

আপনি এবং এ দুই তরুণ শেষ মুহূর্ত অবধি কর্ণ ও চক্ষুর ন্যায়

সঙ্গের সাথী এবং একাদিক্রমে পরস্পর,

আপনারা পুণ্যকর্মী,সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী,যেখানে

মানব প্রজন্মের নাগাল ছুঁতে পারে না সে সম্মান।

মুনযির বিন জারুদও সিফফিনে ইমাম আলী (আ.)-কে বলেন :

“যদি আপনি নিহত হন,তাহলে এ দু’জন অর্থাৎ হাসান ও হুসাইন হবেন আপনার পরে আমাদের ইমাম।”

তিনি একটি কবিতায় বলেন :

‘আবুল হাসান,আপনি হলেন দ্বি-প্রহরের উজ্জ্বল সূর্য

আর আপনি ও এ দু’জন (একসাথে),মৃত্য পর্যন্ত

এরা দু’জন কিরণময় চন্দ্রসম

চক্ষুর পরে কর্ণ যেমন।’

সুতরাং স্পষ্ট হয়ে যায় যে,হযরত আলী (আ.)-এর শাসনকাল থেকেই ইমামের সঙ্গীরা তাঁর পরের নেতৃত্ব হাসান ও হুসাইন (আ.)-এর অধিকারে বলে জানত। এ কারণেই আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) শাহাদাত বরণ করার পর আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস জনগণকে ইমাম হাসানের দিকে আহ্বান করেন এবং বলেন : ‘তিনি তোমাদের নবীর সন্তান এবং তোমাদের ইমামের ওয়াসী। কাজেই তাঁর হাতেই বাইআত কর।’ ইমাম হাসানও একটি পত্রে আমীরে মু‘আবিয়াকে উদ্দেশ করে লেখেন : ‘যখন আমার পিতা মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে উপনীত হন,তখন এ দায়িত্ব তাঁর পরবর্তীকালে আমার ওপর সোপর্দ করেন।’ হায়ছাম বিন আদি তাঁর একাধিক মাশায়েখ থেকে বর্ণনা করেছেন যে,তাঁরা বললেন,হাসান ইবনে আলী তাঁর পিতার ‘ওয়াসী’ ছিলেন। আবুল আসওয়াদ দুয়ালিও,যিনি বসরায় ছিলেন তিনি ইমামের বাইআত গ্রহণের সময়ে বলেন : ‘তিনি দরজা- সদর দরজা দিয়েই ওয়াসী ও ইমামত লাভ করেছেন।’ তদ্রুপ সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকেও বলা হয় : ‘আপনি হলেন আপনার পিতার ওয়াসী ও খলীফা। আমরা আপনার আনুগত্যকারী।’

মোটকথা,এ বিষয় মেনে নেওয়া যায় যে,হযরত আলী (আ.) তাঁর পুত্রকে সেই ব্যক্তিরূপে উপস্থাপন করেছেন যাঁকে তিনি নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসাবে গ্রহণ করেন। তাই দেখা যায়,ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.)-এর সর্বপ্রথম ভাষণে তিনি বলেন :‘যে আমাকে চেনে সে তো চেনেই। আর যে চেনে না (সে জেনে রাখুক),আমি হলাম হাসান,মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সন্তান। আমি হলাম সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারীর সন্তান। আমি হলাম আল্লাহর দিকে তাঁরই অনুমতিক্রমে আহ্বানকারী ও উজ্জ্বল আলোর সন্তান। আমি হলাম এমন আহলে বাইত থেকে,যাঁদের থেকে মহান আল্লাহ অপবিত্রতা ও পঙ্কিলতা দূর করেছেন এবং তাঁদের পুত-পবিত্র করেছেন। যাঁদের ভালবাসা আল্লাহ স্বীয় কিতাবে ওয়াজিব করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে : “বলুন,আমি রিসালাতের পারিশ্রমিক তোমাদের কাছে কিছুই চাই না,শুধু আমার নিকটাত্মীয়ের ভালবাসা।” ‘আর যে পুণ্যের কাজ করবে,আমি তার পুণ্য বৃদ্ধি করে দিই।’১৯ অতএব,পুণ্যের কাজ হল,আমার আহলে বাইতকে ভালবাসা।’ ঐতিহাসিক মাসউদি ইমাম হাসান (আ.)-এর এ সংক্রান্ত একটি ভাষণের অংশবিশেষ বর্ণনা করেছেন এভাবে : ‘আমরা আল্লাহর দল সফলকাম। আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকটতম ইতরাত (আত্মীয়),আমরা হলাম পুতপবিত্র আহলে বাইত এবং সাকালাইন (দু’টি ভারী বস্তু)-এর একটি,যা রাসূলুল্লাহ (সা.) তোমাদের মধ্যে রেখে গেছেন এবং এর অন্যটি হল আল্লাহর কিতাব,যার মধ্যে কোন দিক থেকেই বাতিলের কোন পথ নেই।... কাজেই আমাদের আনুগত্য কর,আমাদের আনুগত্য করা ওয়াজিব। কারণ,আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করার সাথে যুক্ত রয়েছে উলিল আমরের আনুগত্য। অর্থাৎ যদি কোন বিষয়ে বিবাদ কর,তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের কাছে নিয়ে যাবে... আর যদি রাসূল ও উলিল আমরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়,তাঁরা যেহেতু জ্ঞানের অবধারণকারী,কাজেই তা জানবে...’

হেলাল বিন ইয়াসাফ বলেন : ‘আমি হাসান বিন আলীর ভাষণ শুনছিলাম। তিনি বলছিলেন : হে কুফার জনগণ! আমাদের ব্যাপারে  আল্লাহ থেকে ভয় করবে,আমরা হলাম তোমাদের আমীর ও তোমাদের অতিথি। আমরা এমন আহলে বাইত যে, আল্লাহ আমাদের সম্পর্কে বলেছেন :

 

إِنَّمَا يُرِ‌يدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّ‌جْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَ‌كُمْ تَطْهِيرً‌ا

 

“আল্লাহ তো চান তোমাদের থেকে সকল অপবিত্রতা দূর করতে,হে আহলে বাইত! এবং তোমাদের পুতপবিত্র রাখতে।”২১

সম্ভবত এ ভাষণটি ইমাম হাসান (আ.) সাবাত-এ আহত হওয়ার পর প্রদান করেছিলেন।

উপসংহার

অনেক ঐতিহাসিক ও হাদীসবিদ বর্ণনা করেছেন যে,একদিন ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.) একদল সঙ্গী-সাথীর মাঝে কয়েকটি সাপকে নিজের কাছে ডাকলেন এবং সেগুলোকে একটার পর একটা হাতে তুলে নিলেন। সেগুলো ইমামের হাতের কব্জি থেকে পেঁচিয়ে গলার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। অতঃপর ইমাম সেগুলোকে ছেড়ে দিচ্ছিলেন যাতে চলে যায়। এমন সময় হযরত ওমর ইবনে খাত্তাবের বংশের একজন লোক,যে ঐ বৈঠকে উপস্থিত ছিল,সে বলল : ‘এটা তো কোন পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাপার নয়। এরূপ কাজ আমিও করতে পারি।’ একথা বলে সেও একটি সাপ তুলে নিল এবং তার হাতে পেঁচাতে চাইলো। হঠাৎ করে সাপটি তাকে দংশন করল। ফলে সেই লোকটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।’২২

ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.)-এর হাত থেকে এক প্রতারণামূলক সন্ধিচুক্তির মাধ্যমে মুসলিম জাহানের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নিয়ে কি আমীরে মু‘আবিয়ারও একই পরিণতি হয়েছিল?

 

তথ্যসূত্র:

১. সহীহ বুখারী,৩য় খণ্ড,পৃ. ১৩৭০,হাদীস নং ৩৫৩৯; দারু ইবনে কাসীর প্রকাশনী,

তৃতীয় মুদ্রণ,বৈরুত,১৯৮৭; সহীহ মুসলিম,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ১৮৮৩,হাদীস ২৪২২,দারু এহইয়াউত তুরাসিল আরাবি প্রকাশনী,বৈরুত;

২. মুহাম্মাদ ইবনে হিব্বান বিন আহমাদ আবু হাতেম (মৃ. ৩৫৪ হি.),সহীহ ইবনে হিব্বান বি তারতিবি ইবনে বুলবান,১৫তম খণ্ড,পৃ. ৪৩৪,মুয়াসসাতুর রিসালাহ প্রকাশনী,দ্বিতীয় মূদ্রণ,বৈরুত,১৯৯৩,

৩. হাকেম নিশাবুরী,আল মুস্তাদরাক আলা সাহীহাইন,৩য় খণ্ড,পৃ. ১৬১,হাদীস ৪৭১৩,দারুল কুতুবুল ইলমিয়্যা প্রকাশনী,বৈরুত,প্রথম মূদ্রণ,১৯৯০,

৪. যাহাবী শাফেয়ী,শামসুদ্দীন আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ওসমান (মৃ. ৭৮৪ হি.),সিয়ারু আ’লামুন নুবালা,২য় খণ্ড,পৃ. ১২৩,মুয়াসসাতুর রিসালাহ প্রকাশনী,নবম মূদ্রণ,বৈরুত,১৯৯৩,

৫. ইবনে সা’দ,তরজমাতুল ইমাম হাসান (আ.) পৃ. ৭৮;

৬. মানাকিব-এ আলে আবি তালিব,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৯;

৭. মুখতাসারু তারিখে দামেশক,৭ম খণ্ড,পৃ. ২৪;

৮. বাকের শারীফ কুরাইশী,আল হায়াতুল ইমাম আল হাসান বিন আলী,১ম খণ্ড,পৃ. ২০৩;

৯. তারীখে ইয়াকুবী,২য় খণ্ড,পৃ. ১৩৫;

১০. মানাকিব-এ আলে আবি তালিব,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ১৪;

১১. ইবনে আবিল হাদীদ,শারহে নাহজুল বালাগা,১৬তম খণ্ড,পৃ. ১৩;

১২. সূরা মায়েদাহ : ৩২;

১৩. আল খারায়িজ ওয়াল জারায়িহ্,২য় খণ্ড,পৃ. ৫৭৬,হাদীস ৪;

১৪. হাসান মা’রুফ আল হাসানী,আল আয়িম্মাতুল ইসনা আশার,১ম খণ্ড,পৃ. ৫৪২

১৫. ইবনে আবিল হাদীদ,শারহে নাহজুল বালাগা,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৫৭; আল-গাদীর,২য় খণ্ড, পৃ. ১০১

১৬. আল ইসাবাহ ফি তামাযিস সাহাবা,২য় খণ্ড,পৃ. ১২

১৭. অর্থাৎ তাঁরা ক্ষমতাসীন থাকুন,আর ক্ষমতার বাইরে থাকুন।

১৮. সূরা শুরা,আয়াত নং : ২৩

১৯. সূরা আহযাব,আয়াত নং ৩৩

২০. মুরুজুয যাহাব

২১. সূরা আহযাব,আয়াত নং ৩৩

২২. মাদীনাতুল আল মাআজিয,৩য় খণ্ড,পৃ. ২৪০,হাদীস ৮৬২; ইসবাতুল হুদাত,২য় খণ্ড,পৃ. ৫৬৩,হাদীস ৩৩২

সূত্র: প্রত্যাশা,১ম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)