আল হাসানাইন (আ.)

সূরা বাকারাহ;(৫০তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা বাকারাহ; আয়াত ১৯০-১৯৫

সূরা বাকারাহ'র ১৯০ আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-


وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ

"যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে তোমরাও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর,কিন্তু সীমালঙ্ঘন কর না,আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীকে ভালবাসেন না।" (২: ১৯০)

শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনে যুদ্ধ করার অধিকার প্রত্যেক মানুষেরই রয়েছে। কিন্তু কোরআন এক্ষেত্রে সব ধরনের বাড়াবাড়ির বিরোধীতা করে বলেছে,শত্রুকে ন্যায়ের পথে আহ্বান জানানোর আগে অস্ত্র ব্যবহার করো না এবং যুদ্ধের সূচনাকারী হইও না। নারী,শিশু ও বৃদ্ধ যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত নয় তাদের ওপর হামলা কর না,এমনকি যুদ্ধের ময়দানেও দয়া ও মানবিক দিকগুলো মেনে চলতে হবে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
এক. জিহাদ অবশ্যই আল্লাহর জন্য ও আল্লাহর পথে হতে হবে। জিহাদ ও ধর্মযুদ্ধ দেশের সীমানা বাড়ানো বা জাতিগত দ্বন্দ্বের জন্য নয়।
দুই. যুদ্ধের সময়ও ন্যায় ও ইনসাফ বজায় রাখতে হবে এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না।

এরপর ১৯১ ও ১৯২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوهُمْ وَأَخْرِجُوهُمْ مِنْ حَيْثُ أَخْرَجُوكُمْ وَالْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ وَلَا تُقَاتِلُوهُمْ عِنْدَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ حَتَّى يُقَاتِلُوكُمْ فِيهِ فَإِنْ قَاتَلُوكُمْ فَاقْتُلُوهُمْ كَذَلِكَ جَزَاءُ الْكَافِرِينَ () فَإِنِ انْتَهَوْا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

"আর তাদেরকে হত্যা কর যেখানে পাও সেখানেই এবং তাদেরকে বের করে দাও সেখান থেকে যেখান থেকে তারা বের করেছে তোমাদেরকে। ফেতনা ফ্যাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ। আর মসজিদুল হারামের নিকটে (কাবা শরীফের) তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর না,যতক্ষণ না তারা তোমাদের সঙ্গে সেখানে যুদ্ধ করে। যদি তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে তাহলে তাদেরকে হত্যা কর। এই হলো কাফেরদের শাস্তি। কিন্তু তারা যদি বিরত হয় তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু।" (২: ১৯১-১৯২)

এই আয়াতে মক্কার মুশরিকদের বিরুদ্ধে তাদেরই কাজের জবাব অনুযায়ী আচরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কারণ তারা মুসলমানদেরকে তাদের নিজ শহর ও ঘরবাড়ী ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করেছে এবং তাদেরকে এত অত্যাচার ও নির্যাতন করেছে যে,কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী তা ছিল হত্যার চেয়েও জঘন্য। আল্লাহ মসজিদুল হারাম বা কাবা শরীফের পবিত্রতা রক্ষার জন্য সেখানে যুদ্ধ নিষিদ্ধ করেছেন। অবশ্য মুশরিক বা অংশীবাদীরা যুদ্ধ শুরু করলে যেকোন জায়গায় আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
এক. ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে আঘাত হানার কোন সুযোগ কাউকে দেয়া যাবে না এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অশান্তি সৃষ্টিরও সুযোগ দেয়া যাবে না।
দুই. যদিও আল্লাহর ঘর পবিত্র কিন্তু মুসলমানদের রক্ত আরো বেশী পবিত্র এবং এই রক্তের প্রতি সম্মান দেখানো আরো বেশী জরুরী।
তিন. ইসলামের শত্রুদেরকে তাদের আচরণ ও কাজের ঠিক অনুরূপ শাস্তি দেয়া ইসলামের অন্যতম মূলনীতি।

এরপরের আয়াতে অর্থাৎ ১৯৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন-

وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِ فَإِنِ انْتَهَوْا فَلَا عُدْوَانَ إِلَّا عَلَى الظَّالِمِينَ

"আর তোমরা তাদের সাথে লড়াই কর,যে পর্যন্ত না ফেতনার অবসান হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর যদি তারা নিবৃত হয়ে যায় তাহলে কারো প্রতি কোন জবরদস্তি নেই,কিন্তু যারা জালেম (তাদের ব্যাপারে আলাদা)। (২:১৯৩)

ইসলামের দৃষ্টিতে জিহাদের উদ্দেশ্য ধন-সম্পদ লাভ করা,জাতিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা কিংবা রাষ্ট্রের সীমানা বৃদ্ধি করা নয় বরং জিহাদের উদ্দেশ্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত। জুলুম,অত্যাচার,অবিচার,অসত্য,শির্ক,কুফরী ও কুসংস্কার নির্মূল করে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা এবং জনগণকে আল্লাহর ধর্মের দিকে পরিচালিত করাই হলো জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধের উদ্দেশ্য। তাই যারা ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত এবং মুসলমানদের ওপর নির্যাতন নিপীড়ন চালায়,আমরা শুধু তাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করতে পারি। যদি তারা এসব কাজ থেকে বিরত হয় তাহলে যুদ্ধ শুরু করার অধিকার আমাদের নেই। ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মে বিশ্বাসী হবার কারণে কাউকে অসম্মান বা উৎপীড়ন করা যাবে না।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
এক. পৃথিবীতে আল্লাহর ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য জালেম শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। কারণ জালেম শাসকরা মানুষের মধ্যে ভুল ও মিথ্যা চিন্তাধারার প্রসার ঘটায়।
দুই. সুপথে ফিরে আসা এবং ক্ষমা বা তওবার পথ কোন অবস্থাতেই বন্ধ নয়। এমনকি অবিশ্বাসী বা কাফেররাও যদি যুদ্ধের সময় তাদের ভুল আকিদা-বিশ্বাস ও কাজ পরিত্যাগ করে তবে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন।

এবারে সূরা বাকারার ১৯৪ নম্বর আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে-

الشَّهْرُ الْحَرَامُ بِالشَّهْرِ الْحَرَامِ وَالْحُرُمَاتُ قِصَاصٌ فَمَنِ اعْتَدَى عَلَيْكُمْ فَاعْتَدُوا عَلَيْهِ بِمِثْلِ مَا اعْتَدَى عَلَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ

"পবিত্র মাসের বদলে পবিত্র মাস। এভাবে সব পবিত্র জিনিসেরই বিনিময় আছে। যারা পবিত্র মাসে তোমাদের ওপর আগ্রাসন চালাবে তোমরাও তাদের অনুরূপ জবাব দেবে। তবে আল্লাহকে ভয় কর ও বাড়াবাড়ি কর না। জেনে রাখ আল্লাহ পরহেজগারদের সঙ্গে রয়েছেন।" (২: ১৯৪)

চারটি নির্দিষ্ট মাসে যুদ্ধ করতে ইসলাম নিষেধ করেছে। এই মাসগুলো হল রজব,জ্বিলকাদ,জ্বিলহাজ্ব ও মহররম। মুশরিকরা আল্লাহর এই নির্দেশ থেকে যুদ্ধের সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করত। তারা এইসব মাসে মুসলমানদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে তাদেরকে অপ্রস্তুত করার পদক্ষেপ নিত। তারা জানতো যে,মুসলমানদের জন্য এইসব মাসে যুদ্ধ করার নিয়ম নেই। কিন্তু তারা এটা জানত না যে,মুসলমানদের রক্তের মর্যাদা এইসব মাসের মর্যাদার চেয়েও বেশী। যারাই এই পবিত্রতা লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধেও মুসলমানদের পক্ষ থেকে অনুরূপ জবাব দেয়া হবে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে,
এক. শত্ররা সব সময়ই ক্ষতি করার জন্য ওঁৎ পেতে আছে। তাই তাদেরকে সুযোগের অপব্যবহার করতে দেয়া যাবে না।
দুই. যে কোন সামাজিক চুক্তি বা সমঝোতা ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য যতক্ষণ অন্য পক্ষ তা পালন করে। কোন সমঝোতা বা চুক্তিকে যখন অন্য পক্ষ অপব্যবহার করে তখন তা গ্রহণযোগ্য থাকে না।
তিন. শত্রুদের সাথে মোকাবেলার ক্ষেত্রেও ন্যায় ও ইনসাফ বজায় রাখতে হবে এবং ন্যায়ের সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না।
এবারে সূরা বাকারার ১৯৫ নম্বর আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে-

وَأَنْفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ

"তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় কর,তোমরা নিজেরা নিজেদের সর্বনাশ কর না,তোমরা সৎকাজ কর,নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন।" (২:১৯৫)

আগের আয়াতে জিহাদ ও শত্রুদেরকে তাদের আঘাতের অনুরূপ শাস্তি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এটা স্পষ্ট,কোন যুদ্ধই জিহাদের ময়দানে লড়াইরত মুজাহিদদের ও তাদের পরিবারের আর্থিক বা বৈষয়িক চাহিদা পূরণ ছাড়া সম্ভব নয়। যদি মুসলমানরা আল্লাহর পথে জীবন ও অর্থ দিতে রাজী না হয় তবে তারা পরাজিত হবে এবং নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করবে। অবশ্য শান্তির সময়ও যদি ধনীরা সমাজের গরীবদের সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা না করে এবং খোমস্ ও যাকাত দেয়াসহ আল্লাহর পথে দান করা থেকে বিরত থাকে,তবে স্বাভাবিকভাবেই ধনী ও গরীবদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেবে। এর পরিণামে সমাজে নিরাপত্তাহীনতা ও অবিচারের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। কারণ আল্লাহর পথে ব্যয় ও অন্যদের সাহায্য করা সম্পদের বন্টনের ক্ষেত্রে ভারসাম্য সৃষ্টি করে এবং এভাবেই সম্পদ ও পুঁজি টিকে থাকে। হযরত আলী (আঃ) যেমনটি বলেছেন,যাকাত দিয়ে নিজের সম্পদ রক্ষা কর।

এই আয়াতের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
এক. যখনই কৃপণতা ও সম্পদ জমা করা সমাজে প্রচলিত হয়ে পড়ে,তখন সমাজের মর্যাদা ও অস্তিত্ব বিলীন হবার সম্মুখীন হয়।
দুই. যেসব কাজ মানুষের জীবনের জন্য ক্ষতিকর এবং যা ধ্বংসের কারণ হিসেবে ভূমিকা রাখে সেসব কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহর কাছে দোয়া করছি আমরা যেন আল্লাহর পথে নিজেদের জীবন ও সম্পদকে উৎসর্গ করতে পারি এবং নিজেকে রক্ষার চেয়ে ধর্ম রক্ষাকে বেশী প্রাধান্য দেই। কারণ আমাদের সৌভাগ্য আল্লাহর সন্তুষ্টির ওপরই নির্ভর করছে অন্যদের সন্তুষ্টির ওপর নয়।

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)