আল হাসানাইন (আ.)

সূরা বাকারাহ;(৫৮তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা বাকারাহ;আয়াত ২২৮-২৩২

সূরা বাকারাহ'র ২২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ ثَلَاثَةَ قُرُوءٍ وَلَا يَحِلُّ لَهُنَّ أَنْ يَكْتُمْنَ مَا خَلَقَ اللَّهُ فِي أَرْحَامِهِنَّ إِنْ كُنَّ يُؤْمِنَّ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَبُعُولَتُهُنَّ أَحَقُّ بِرَدِّهِنَّ فِي ذَلِكَ إِنْ أَرَادُوا إِصْلَاحًا وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

"তালাক প্রাপ্তা নারী তিন রজঃস্রাব কাল প্রতীক্ষায় থাকবে (অর্থাৎ বিবাহ করা থেকে বিরত থাকবে) তারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হলে তাদের গর্ভাশয়ে আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন,তা গোপন রাখা তাদের পক্ষে বৈধ নয়। এই সময়ের মধ্যে তাদের স্বামীদের অধিকার রয়েছে তাদেরকে পুনরায় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার,যদি তারা আপোষে মিলে-মিশে থাকতে চায়। আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের ওপর অধিকার রয়েছে,তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের ওপর। আর (পরিবার পরিচালনার ক্ষেত্রে) নারীদের ওপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। আর আল্লাহ হচ্ছে পরাক্রমশালী,প্রজ্ঞাময়।" (২:২২৮)

এ আয়াতে পরিবারের ও সন্তানদের পবিত্রতা রক্ষার জন্য তালাকের পর পুনরায় বিয়ের জন্য স্ত্রীদেরকে তিন মাস অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে,যাতে তাদের গর্ভে যদি সন্তান থেকে থাকে তবে তা যেন স্পষ্ট হয় এবং নবজাতকের অধিকার যেন রক্ষা করা যায়। সম্ভবত এই নবজাতক তালাক প্রতিরোধের পটভূমিও সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ এরই মধ্যে স্বামী বা স্ত্রী যদি তালাকের সিদ্ধান্তের জন্য অনুতপ্ত হয় এবং পুনরায় আগের মতো যৌথ জীবন শুরু করতে চায় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এক্ষেত্রে পূর্বের স্বামী অন্যদের চেয়ে বেশি অধিকার পাবে। আয়াতের শেষাংশে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বিবাদ মিটানো ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাদের উভয়কেই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রথমে স্বামীদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে,‘‘তোমাদের স্ত্রীর উপর যেমন ঘর ও সংসারের দায়িত্ব রয়েছে,তেমনি তোমাদের ওপরও স্ত্রীর অধিকার আছে। কাজেই সঠিকভাবে এই দায়িত্ব পালন করতে হবে।''এরপর স্ত্রীদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে,‘‘পরিবার পরিচালনার দায়িত্ব স্বামীর এবং এক্ষেত্রে স্ত্রীর চেয়ে স্বামীর যোগ্যতা বেশি।''

এরপর ২২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

الطَّلَاقُ مَرَّتَانِ فَإِمْسَاكٌ بِمَعْرُوفٍ أَوْ تَسْرِيحٌ بِإِحْسَانٍ وَلَا يَحِلُّ لَكُمْ أَنْ تَأْخُذُوا مِمَّا آَتَيْتُمُوهُنَّ شَيْئًا إِلَّا أَنْ يَخَافَا أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا فِيمَا افْتَدَتْ بِهِ تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَعْتَدُوهَا وَمَنْ يَتَعَدَّ حُدُودَ اللَّهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ

"এ তালাক দুবার,অতঃপর স্ত্রীকে হয় বিধিসম্মতভাবে রাখবে অথবা সদয়ভাবে বিদায় দেবে।আর স্ত্রীকে দেয়া কোন কিছু ফেরৎ নেয়া তোমাদের পক্ষে উচিত নয়। তবে যদি তাদের উভয়ের আশংকা হয় যে তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করে চলতে পারবে না এবং তোমরা যদি আশংকা কর যে তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করে চলতে পারবে না,তবে (সে অবস্থায়) স্ত্রী কোন কিছুর বিনিময়ে (স্বামী থেকে) নিষ্কৃতি পেতে চাইলে তাতে (স্বামী-স্ত্রীর) কারো কোন পাপ নেই। এসব আল্লাহর সীমারেখা। কাজেই তা লংঘন কর না। যারা আল্লাহর (নির্দিষ্ট) সীমারেখা লংঘন করে তারাই অত্যাচারী।" (২:২২৯)

আগের আয়াতে বলা হয়েছিল- তালাকের পর স্ত্রীকে তিন মাস অপেক্ষা করতে হবে। যাতে তার গর্ভে যদি সন্তান থেকে থাকে তা স্পষ্ট হয় এবং তালাকের বিষয়ে স্বামী অনুতপ্ত হলে আবার ফিরে আসার যেন পথ থাকে। এই আয়াতে বলা হয়েছে,স্বামী তার স্ত্রীকে দুই তালাক দিয়ে তা ফিরিয়ে নিতে পারে। আর যদি তিন তালাক দিয়ে দেয় তাহলে স্ত্রীর কাছে আর ফিরে যেতে পারবে না। এরপর পরিবার পরিচালনার বিষয়ে একটি জরুরী মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে। পুরুষদের উদ্দেশ্যে এ মূলনীতিতে বলা হয়েছে- স্বামীদেরকে হয় পৃথক থাকার সিদ্ধান্ত নিতে হবে অথবা স্ত্রীর সাথে স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে হবে। আর যদি একত্রে বসবাস একেবারেই সম্ভব না হয় তাহলে অত্যন্ত ভদ্রভাবে স্ত্রীর সাথে সম্পর্কের ইতি টানতে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্যই স্ত্রীর প্রাপ্য দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। আর যদি স্ত্রী নিজেই তালাকের জন্য পীড়াপীড়ি করেন,তাহলে স্ত্রী তার মোহরানা মাফ করে দিয়ে তালাক নিতে পারেন কিন্তু কোন অবস্থাতেই মোহরানা মাফ করার জন্য স্ত্রীর ওপর কোন ধরনের চাপ দেয়া বা তালাক নিতে তাকে বাধ্য করানো যাবে না ।

এই আয়াত থেকে আমরা যা শিখলাম তাহলো -

প্রথমত : স্ত্রীর মানবিক অধিকার ছাড়াও তার অর্থনৈতিক অধিকারও রক্ষা করতে হবে এবং স্ত্রীর সম্পদ ও মোহরানা থেকে স্বামী কিছুই গ্রহণ করতে পারবে না।

দ্বিতীয়ত: তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ যদি একান্তই অপরিহার্য হয়ে পড়ে তাহলে সম্মান ও সদয়ভাবে তা করতে হবে এবং প্রতিশোধ ও বিদ্বেষের মনোভাব নিয়ে তা করা যাবে না।

এরপর ২৩০,২৩১ ও ২৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِنْ بَعْدُ حَتَّى تَنْكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَنْ يَتَرَاجَعَا إِنْ ظَنَّا أَنْ يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ يُبَيِّنُهَا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ (২৩০) وَإِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَبَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَأَمْسِكُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ أَوْ سَرِّحُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ وَلَا تُمْسِكُوهُنَّ ضِرَارًا لِتَعْتَدُوا وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ وَلَا تَتَّخِذُوا آَيَاتِ اللَّهِ هُزُوًا وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَمَا أَنْزَلَ عَلَيْكُمْ مِنَ الْكِتَابِ وَالْحِكْمَةِ يَعِظُكُمْ بِهِ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ (২৩১) وَإِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَبَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَلَا تَعْضُلُوهُنَّ أَنْ يَنْكِحْنَ أَزْوَاجَهُنَّ إِذَا تَرَاضَوْا بَيْنَهُمْ بِالْمَعْرُوفِ ذَلِكَ يُوعَظُ بِهِ مَنْ كَانَ مِنْكُمْ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكُمْ أَزْكَى لَكُمْ وَأَطْهَرُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

"তারপর যদি উক্ত স্ত্রীকে (তৃতীয়বার) তালাক দেয়া হয়,তবে ঐ স্ত্রী যে পর্যন্ত তাকে ছাড়া অপর কোন স্বামীর সাথে বিয়ে না করবে,তার জন্য হালাল হবে না। এরপর যদি দ্বিতীয় স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেয়,তাহলে তাদের উভয়ের জন্যই পরস্পরকে পুনরায় বিয়ে করাতে কোন পাপ নেই,যদি আল্লাহর হুকুম বজায় রাখার ইচ্ছা তাদের থাকে। আর এই হলো আল্লাহ নির্ধারিত সীমা;জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহ এগুলি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন।" (২:২৩০)

"আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়ে দাও,অতঃপর তারা নির্ধারিত ইদ্দত সমাপ্ত করে নেয়,তখন তোমরা নিয়ম অনুযায়ী তাদেরকে রেখে দাও অথবা সহানুভূতির সাথে তাদেরকে বিদায় দাও। আর তোমরা তাদেরকে জ্বালাতন ও বাড়াবাড়ি করার উদ্দেশ্যে আটকে রেখো না। আর যারা এমন করবে,নিশ্চয়ই তারা নিজেদেরই ক্ষতি করবে। আর আল্লাহর নির্দেশকে হাস্যকর বিষয়ে পরিণত করো না এবং তোমাদের প্রতি তাঁর অবদান - কিতাব ও বিজ্ঞান যা তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছেন ও যা দিয়ে তিনি তোমাদের উপদেশ দেন তা স্মরণ কর। আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ যে,আল্লাহ সর্ববিষয়েই জ্ঞানময়।" (২:২৩১)

"আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়ে দাও এবং তারপর তারাও নির্ধারিত ইদ্দত পূর্ণ করতে থাকে,তখন তাদেরকে পূর্ব স্বামীদের সাথে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নিয়মানুযায়ী বিয়ে করতে বাধাদান করো না। এ উপদেশ তাকেই দেয়া হচ্ছে,যে আল্লাহ ও কেয়ামত দিনের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে। এর মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে একান্ত পরিশুদ্ধতা ও অনেক পবিত্রতা। আর আল্লাহ জানেন,তোমরা জান না।" (২:২৩২)

ইসলাম স্বামী-স্ত্রীর পুণর্মিলন ও তাদের কোলে সন্তানের প্রতিপালনকে স্বাগত জানায়। আর এ জন্যই ইসলাম,কোন স্ত্রী যদি অন্য পুরুষকে বিয়ে করার পর পুনরায় তার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়,তাহলে পূর্বের স্বামীর সাথে সম্মতির ভিত্তিতে বিয়ে করাবে বৈধ করেছে। এক্ষেত্রে তাদের পুণর্বিবাহে অভিভাবক বা অন্যকারো বাধা দেয়ার কোন অধিকার নেই এবং এক্ষেত্রে উভয়ের সম্মতিই বিয়ের আকদ্ হিসেবে যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে।

এই আয়াত থেকে আমরা যা শিখলাম তা হলো-

বর নির্বাচনের ক্ষেত্রে কনের মতামতকে সম্মান দেখাতে হবে এবং বিয়ের ভিত্তি হলো বর ও কনের যথাযথ সম্মতি। অতএব আমরা পারিবারিক অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য দম্পতিদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। আপনারা পরস্পরের অধিকার যথাযথভাবে পালন করুন যাতে সন্তানদের এ উষ্ণ আশ্রয়স্থল শীতল না হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত যেন বিবাহ-বিচ্ছেদ না ঘটে।

 

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)